Warning: Attempt to read property "post_content" on null in /home/dakshinermashalc/public_html/wp-content/plugins/pj-news-ticker/pj-news-ticker.php on line 202
উপ-সম্পাদকীয় Archives - Page 3 of 7 - Daily Dakshinermashal

Category: উপ-সম্পাদকীয়

  • ফের মসলিন যুগ ॥ ১৭০ বছর পর তৈরি হলো হুবহু সেই ঢাকাই শাড়ি

    ফের মসলিন যুগ ॥ ১৭০ বছর পর তৈরি হলো হুবহু সেই ঢাকাই শাড়ি

    • গবেষক দলের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ৬ বছরে মিলল সাফল্য
    • ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি
    • শীঘ্রই বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর আভাস

    কাওসার রহমান/মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ হারিয়ে যাওয়া মসলিন আবার ১৭০ বছর পর ফিরে এসেছে। একদল গবেষক দীর্ঘ ছয় বছরের আপ্রাণ চেষ্টায় আবারও মসলিন বুনতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে বাংলাদেশ আবার প্রবেশ করতে যাচ্ছে মসলিনের নতুন যুগে। ১৭১০ সালে বোনা একটি শাড়ির নক্সা দেখে হুবহু মসলিন শাড়ি বুনেন তাঁতিরা। প্রথম অবস্থায় মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। যার একটি উপহার দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে।

    ফলে ঢাকাই মসলিন এখন বাংলাদেশেরই। গবেষকদের দীর্ঘ ছয় বছরের প্রচেষ্টায় মিলেছে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতিও। একমাস আগে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়েছে। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং মসলিনকে তুলনা করেছিলেন ভোরের হালকা কুয়াশার সঙ্গে। এ কাপড় নাকি এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যে আংটির ভেতর দিয়ে চলে যেতে পারত। অনায়াসে এঁটে যেতে পারত দেশলাই বাক্সের ভেতর। নারায়ণগঞ্জের দু’জন তাঁতিও যে মসলিন শাড়ি তৈরি করেছেন তাও অনায়াসে আংটির ভেতর দিয়ে পার করা সম্ভব হয়েছে।

    প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও একদল নিষ্ঠাবান গবেষকের হাত ধরে ১৭০ বছর পর ফিরে এসেছে ঢাকাই মসলিন। ২০১৪ সালের অক্টোবরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় মসলিন সুতা তৈরি হতো, তা জেনে সে প্রযুক্তি উদ্ধারের নির্দেশনা দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ওই বছরই ঢাকায় মসলিন তৈরির প্রযুক্তি ও পুনরুদ্ধার নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। পরে গবেষণা কাজের স্বার্থে আরও সাত সদস্যকে কমিটিতে যুক্ত করা হয়। প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেনকে।

    ফুটি কার্পাসের খোঁজে ॥ ৬ বছরের প্রচেষ্টায় ধরা দেয়া সাফল্যের গল্প জানিয়েছেন প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, বই থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মসলিন কাপড় বোনার জন্য ‘ফুটি কার্পাস’-এর কথা জানতে পারি। পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে এই গাছের চাষ হতো। মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই হয়ত কোন তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের হাতে কোন মসলিন কাপড়, ফুটি কার্পাস কোনটাই ছিল না। ফুটি কার্পাস তুলা সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন জায়গাতে খোঁজখবর নিয়েছি। এরমধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাস দেখে গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে এক ছাত্র আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। জানায়, কাপাসিয়ায় এই তুলার চাষ হতো। গাছের খোঁজে সে এলাকার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাতে চিঠি পাঠানো হয়, মাইকিং করা হয়। পরে সেখানে নয়টি তুলা গাছ পাই। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩৮ প্রজাতির তুলা গাছের সন্ধান পাই। কিন্তু কাপাসিয়া স্থায়ী এক ব্যক্তি গাছটির সঠিক সন্ধান দেন। সংগ্রহ করা গাছ রাবির গবেষণা মাঠে চাষ শুরু করি। স্থানীয় উৎস থেকে মসলিন খুঁজতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আট টুকরো কাপড়ও সংগ্রহ করা হয়। সেগুলোর কোনটি মসলিন ছিল না। পরে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি। একপর্যায়ে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কলকাতায় যাই। কিন্তু সেখানেও পাওয়া যায়নি। পরে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যাওয়া হয়। সেখানে মসলিনের কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়।

    প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনজুর হোসেন বলেন, কাপাসিয়া থেকে সংগ্রহ করা তুলার আঁশ বেশি শক্ত, সাদা ধবধবে। এটা মসলিনের সেই সুতার কাছাকাছি যেতে পারে এমন ধারণা ছিল। তারপর লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ আর সেই তুলার ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হলো কাপাসিয়া থেকে সংগ্রহ করা তুলার জাতটা ফুটি কার্পাস। মসলিন তৈরি করার জন্য সাধারণত ৩০০-৫০০ কাউন্টের সুতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফুটি কার্পাস থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা সহজ নয়। এই সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে। চরকায় সুতা কাটা তাঁতিদের খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কুমিল্লায় পাওয়া যায়। কিন্তু তারা মোটা সুতা কাটেন যাতে কাউন্টের মাপ আসে না। পরে তাদের ৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেখান থেকে ৬ জনকে বাছাই করা হয়। বাছাই করতেই প্রায় দুই বছর সময় লেগে যায়। অবশেষে সুতা নিয়ে তাঁতির দুয়ারে হাজির হলাম। নারায়ণগঞ্জে দুজন তাঁতির খোঁজ পেলাম। কিন্তু এত মিহি সুতা দিয়ে কেউ বানাতে রাজি হচ্ছিল না। পরে তাদের কয়েক ধাপে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বহু কষ্টে তারা বুনন পদ্ধতি রপ্ত করে। অবশেষে ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নক্সা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন তাঁতিরা। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করা হয়। যার একটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেয়া হয়েছে।

    একসময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সর্বোচ্চ কদর পেত আমাদের দেশের তাঁতিদের হাতে বোনা এই কাপড়। যা ‘ঢাকাই মসলিন’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত পেয়েছিল। ১৮৫০ সালে শেষবারের মতো মসলিনের প্রদর্শনী হয় লন্ডনে। সেই প্রদর্শনের ১৭০ বছর পর ২০২০ সালে আবার ঢাকাই তাঁতিরাই বুনেছেন এই মিহি সুতিবস্ত্র। ফুটি কার্পাস তুলা থেকে উৎপন্ন অতি চিকন সুতা দিয়েই তৈরি হয়েছে এই মসলিন। আর ছয় বছর চেষ্টায় আবারও মসলিন বুনতে সফল হয়েছেন গবেষকরা। প্রচলিত আছে, কারিগরদের আঙুল কেটে দেয়ার পরে ঢাকাই মসলিন তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। এখন ভারতেও এক রকম মসলিন তৈরি হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকাই মসলিনের বিশেষত্বই আলাদা।

    প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেনকে। আর প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত হন বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোঃ আয়ুব আলী।

    মসলিনের উপাদান সংগ্রহের গল্প ॥ কত কাঠখড় পুড়িয়ে সংগ্রহ করা হয়েছে মিহি মসলিনের উপাদানগুলো, সেগুলো একেকটি আসলেই গল্প। কাজের শুরুতে মসলিন কাপড় বা তুলার কোন নমুনাই গবেষকদের কাছে ছিল না। তাদের প্রথম কাজ ছিল, যে তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, সেই তুলার গাছ খুঁজে বের করা। সেই গাছটি আসল ফুটি কার্পাস কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার মসলিন কাপড়ের প্রয়োজন ছিল। এই দুটি জিনিস জোগাড় করাই এই প্রকল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।

    প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক মনজুর হোসেন জানান, মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করে ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখাই ছিল তার দলটির প্রধান কাজ। কিন্তু হাতে কোন মসলিন কাপড়ের নমুনা নেই, নেই ফুটি কার্পাসের কোন চিহ্নও। ছিল শুধু সুইডিশ গবেষক ক্যারোলাস লিনিয়াসের লেখা ‘স্পেসিস প্লান্টেরাম’, আবদুল করিমের ‘ঢাকাই মসলিন’ এর মতো কিছু বই। এর মধ্যে ক্যারোলাস লিনিয়াসের বইতে মসলিন কাপড় বোনার জন্য ‘ফুটি কার্পাস’ উপযুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়। এই গাছ পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে চাষ হতো বলে সেখানে লেখা রয়েছে।

    ফুটি কার্পাস বন্য অবস্থায় বাংলাদেশে কোথাও টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে। এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্য অবস্থায় পাওয়া তুলার জাত সংগ্রহ, নিজেদের গবেষণা মাঠে চাষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা করা হয়। গাছটি খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে এর ছবি আঁকানো হয়। সেই ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। বিটিভিতে প্রচার করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙ্গামাটি থেকে এই গাছের খবর আসে। গবেষকেরা গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক ও লংদু; বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে মোট ৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনা হিসেবে নেয়া হয় গাছের তুলা, বীজ, পাতা, কাণ্ড ও ফুল। গবেষকেরা কাপাসিয়ার একটি গাছের জাতের সঙ্গে স্কেচের (আঁকা ছবির) মিল পান। সম্ভাব্য ফুটি কার্পাসের এই জাতটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের নিজস্ব মাঠে ও আইবিএসসির মাঠে চাষ করা হয়।

    একইভাবে স্থানীয় উৎস থেকে মসলিন কাপড় সংগ্রহ করার জন্য ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর তারা প্রায় দুই হাজার ফোন পান। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৮ কাপড়ের নমুনা পাওয়া যায়। গবেষক দল নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে ৩০০ বছর আগের শাড়িও পেয়েছেন। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তা আসলে পুরনো সিল্কের কাপড়।

    দেশের অন্য কোন উৎস থেকে মসলিনের নমুনা না পেয়ে তারা জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে ধরণা দেন। গবেষকদের দরকার ছিল চার বাই চার ইঞ্চির এক টুকরো ঢাকাই মসলিন কাপড়। কিন্তু কিছুতেই তাদের নমুনা দিচ্ছিল না জাদুঘর। এমনকি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে আসার পরেও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের মসলিনের নমুনা দেয়নি। গবেষক দলটি জাতীয় জাদুঘরের নমুনার আশায় প্রায় আট মাস পার করে ফেলেন। একপর্যায়ে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য তারা ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কলকাতায় যান। মিউজিয়ামের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মুর্শিদাবাদে এখন যে মসলিন শাড়ি তৈরি হচ্ছে, তা দক্ষিণ ভারতে উৎপাদিত তুলা থেকে করা হয়, যা ঢাকাই মসলিনের মতো মোলায়েম নয়। তাদের মতে, ঢাকাই মসলিন তৈরি করতে হলে ঢাকার আশপাশ থেকে জাত খুঁজে বের করে সেই তুলা দিয়ে সেই এলাকাতেই করতে হবে। মসলিন তৈরিতে তুলার জাত এবং আবহাওয়ার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। চাইলেই যেখানে-সেখানে ঢাকাই মসলিনের মতো শাড়ি তৈরি করা যাবে না।

    গবেষক দল নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে ৩০০ বছর আগের শাড়িও পেয়েছেন। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তা আসলে পুরনো সিল্কের কাপড়। ভারতে গিয়ে বিফল হয়ে গবেষক দল হতাশ হয়ে পড়েন। অধ্যাপক মনজুর হোসেন বলেন, এই খবর শুনে প্রধানমন্ত্রী তাদের লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যেতে বলেন। তিনি সেখানে ঢাকাই মসলিন দেখে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত মসলিনের একটু নমুনার জন্য ২০১৭ সালের জুলাইয়ে কমিটির তিন সদস্যসহ চার সদস্যের একটি দল লন্ডনের ওই মিউজিয়ামে যান। সেখানে মসলিনের কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত তারা পেয়ে যান।

    লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করা হয়। গবেষকেরা এই মসলিনের ডিএনএর সঙ্গে আগে সংগৃহীত কাপাসিয়ার একটি জাতের ফুটি কার্পাস গাছের মিল পেলেন অবশেষে। তারা নিশ্চিত হন, সেটিই তাদের কাক্সিক্ষত জাতের ‘ফুটি কার্পাস’। কাপাসিয়ার আবদুল আজিজ এই কার্পাসের সন্ধান দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে এই কমিটির পক্ষ থেকে তাকে একটি মোবাইল ফোন উপহার দেয়া হয়।

    এত কিছু করার পরে অবশ্য জাতীয় জাদুঘরে তাদের ঢুকতে দেয়া হয়। প্রকল্প পরিচালক জানান, তারা দেখেছেন, জাদুঘরের শুধু একটি পাগড়ি ঢাকাই মসলিনের তৈরি।

    মসলিন শাড়ি তৈরি করতে হলে ৫০০ কাউন্টের সুতার প্রয়োজন। এক কিলোমিটার সুতাকে ওজন করলে যত গ্রাম হয়, তা দিয়ে সুতার দৈর্ঘ্যকে ভাগ করলে কাউন্ট পাওয়া যায়। যেমন ১ হাজার মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি সুতার ওজন যদি ২ গ্রাম হয়, তাহলে ২ দিয়ে ১০০০ মিটারকে ভাগ করলে ভাগফল হয় ৫০০। এই ভাগফলকেই কাউন্ট হিসেবে গণ্য করা হয়। সাধারণত ৫০০ কাউন্ট সুতা দিয়ে মসলিন কাপড় বোনা হতো। একটি শাড়িতে ১৪০ থেকে ১৫০ গ্রাম সুতার প্রয়োজন পড়ে। এই প্রকল্পের প্রশিক্ষিত সুতা কাটুনিরা এখন পাঁচদিনে এক গ্রাম সুতা কাটতে পারেন। অর্থাৎ এই গতিতে একজন যদি মসলিনের সুতা কাটতে থাকেন, তাহলে একটি শাড়ি জন্য সুতা তৈরি করতে তার প্রায় দুই বছর লাগার কথা।

    কার্পাস তুলা থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা চাট্টিখানি কথা নয়। এই সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে। সুতা তৈরির কাজের নেতৃত্ব দেন কমিটির সদস্য সচিব ও তাঁত বোর্ডের জ্যেষ্ঠ ইনস্ট্রাক্টর মঞ্জুরুল ইসলাম। এবার খোঁজ শুরু হয় দেশের কোথায় এখনও তাঁতিরা চরকায় সুতা কাটেন। খবর আসে, কুমিল্লার চান্দিনায় এখনও এই তাঁতিরা রয়েছেন। তারা খদ্দরের জন্য চরকায় মোটা সুতা কাটেন। তবে সেই সুতা কাউন্টের মাপেই আসে না। তা সর্বোচ্চ আট-দশ কাউন্টের হতে পারে। তবু গবেষকেরা সেখানেই ছুটে যান। তারা ভাবেন, এমন তো হতে পারে যে তাদের পূর্বপুরুষদের কেউ মসলিন সুতা কেটেছিলেন। বহুদিন ঘোরাঘুরির পর তারা হাসু ও নূরজাহান নামের অশীতিপর দুই বৃদ্ধার সন্ধান পান। তারা বলতে পেরেছেন তাদের পূর্বপুরুষেরা মসলিন সুতা কাটতেন। তাদেরও ছোটবেলায় মিহি সুতার স্মৃতি রয়েছে। তাদের পেয়ে গবেষক দল যেন সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আশার আলো দেখেন। কিন্তু তারা তো এখন সুতা কাটতে পারেন না।

    শেষ পর্যন্ত তারা খদ্দরের মোটা সুতাকাটুনিদের নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের পাঁচজন করে আটটি দলে ভাগ করেন। প্রতিটি দলের মধ্যে সুতা চিকন করার প্রতিযোগিতা করা হয়। প্রতিটি দলের সেরাদের নিয়ে আবার দল গঠন করা হয়। এভাবে ছয়জন সেরা সুতাকাটুনি বের করতেই তাদের দুই বছর সময় লেগে যায়। এই ছয়জনই প্রশিক্ষক হয়ে গেছেন। তাদের একজনকে দিয়ে আরও ১১ জনকে শেখাতে সময় লেগেছে মাত্র ছয় মাস। এ রকম ১০০ জন তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ করছেন।

    আর নতুন করে এই সুতা কাটার জন্য চরকা তৈরি করেন তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলাম ও টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক আলীমুজ্জামান।

    লেগে থাকাতেই সফলতা ॥ সুতা মিহি করার ব্যাপারটা আসলে তিন আঙুলের জাদু। তিন আঙুলে কীভাবে তুলা ছাড়তে হবে, সেটাই আবিষ্কার করতে হয়েছে। আর নারীদের আঙুলেই এই সুতা সবচেয়ে মিহি হয়। তিনটি আঙুলকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় নরম করে রাখতে হয়। প্রথমে তাদের আঙুলগুলো শক্ত ছিল। অনুভূতি ছিল না। পরে তাদের আঙুলের ‘ট্রিটমেন্ট’ করতে হয়েছে। সন্ধ্যায় তিনটি আঙুলে লোশন মাখিয়ে রেখে সকালে সুতা কাটা হতো। আর সব সময় আঙুল তিনটির যত্ন নিতে হয়েছে। যাতে এই তিন আঙুলে কোন আঁচড় না লাগে বা এই তিনটি আঙুল দিয়ে অন্য কোন জিনিস কাটাকুটির কাজ ওরা না করে।

    আবার কখনও কাজ করতে গেলে আঙুল ঘেমে যেত, তখন আবার পাউডার দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর চারকার এক ফাঁকে তারা কতটুকু সুতা ছাড়বেন, এ ব্যাপারে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে একাগ্রতা তৈরি করা হয়েছে। তাদের মনোযোগ বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। এটা বড় একটা ব্যাপার। কারণ, এর যান্ত্রিক কোন মাপ নেই। সম্পূর্ণ মনোযোগের মাধ্যমেই চরকার ঘূর্ণনের সঙ্গে সুতা ছাড়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।

    অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেন বলেন, ‘একটা ভরসা ছিল যে আমাদের দেশে জামদানি তৈরি হয়। জামদানিতে ১৫০ কাউন্টের সুতা লাগে। জামদানি আসলে নিম্নমানের মসলিন। এ জন্য আশাবাদী হয়েছিলাম কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ৩০০ কাউন্টের সুতা নিয়ে তাঁতিদের দুয়ারে দুয়ারে আমরা ঘুরেছি। তারা বলেছেন, এটা সম্ভব নয়। খামাখা এগুলো নিয়ে ঘুরছেন। কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। একপর্যায়ে আমরা নারায়ণগঞ্জে সেই কাক্সিক্ষত তাঁতিকে পেয়ে যাই। তারা হচ্ছেন রুবেল মিয়া ও মোঃ ইব্রাহিম।’

    চিকন সুতা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। ঘর্ষণ থেকে ক্ষয় রোধের জন্য মাড় দেয়া প্রয়োজন, কিন্তু গতানুগতিক মাড়ে কাজ হচ্ছিল না। একপর্যায়ে তারা চিকন ধানের খইয়ে মাড় ব্যবহার করে কাজ করতে সক্ষম হয়েছেন। আবার মাড় দিয়ে নাটাইয়ে জড়াতে গিয়ে বারবার ছিঁড়ে যায়। কীভাবে করলে ছিঁড়বে না। সেটাও বের করা হলো। শুকানো হলো। ববিনে ভরতে গেলেও বারবার ছিঁড়ে যায়। প্রতিটি পদক্ষেপই নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়েছে। টানা তৈরি করতে গিয়েও একই অবস্থা।

    বিমের মধ্যে সহজভাবে যাতে ববিন ঘুরতে পারে, এ জন্য কাঠামোগত দিকটা ঠিক করে নিতে হয়। এই চিকন সুতা দিয়ে বিমে জড়ানো ও সানা করতে হয়েছে। চিকন সুতার কারণে আঙুলে লেগেই সুতা ছিঁড়ে যায়। আধা ঘণ্টার কাজ চার ঘণ্টা ধরে করতে হয়েছে। বেশি শীতেও হয় না বেশি গরমেও হয় না। মাটির গর্তে তাঁত বসিয়ে করা হয়। মাটির আর্দ্রতার সঙ্গে মসলিনের একটা সম্পর্ক আছে। সুতা বারবার ছিঁড়ে যাওয়া রোধ করার জন্য বালতিতে পানি রেখেও কাজ করতে হয়েছে।

    আবার এই দুই তাঁতিকে কাপড় বোনাতেও ধাপে ধাপে অনেক কারিগরি প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে। প্রথমে একটি তাঁত করা হয়েছিল। পরে তিনটি করা হয়েছে। এই তাঁতেই রুবেল ও ইব্রাহিম ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নক্সা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন।

    লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে প্রায় সাড়ে তিন শ’ ঢাকাই মসলিন শাড়ি সংরক্ষিত আছে। সেখানেই রয়েছে ১৭১০ সালে বোনা সেই শাড়িটি। সেই শাড়ির নক্সা দেখেই হুবহু ঢাকাই মসলিন তৈরি করেছেন দুই কারিগর।

    প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। গবেষকদের প্রত্যাশা, এই খরচ আস্তে আস্তে কমতে থাকবে। ইতোমধ্যে তারা মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করেছেন। একটি শাড়ি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শাড়ি দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।

    প্রকল্পের আরেকজন গবেষক অধ্যাপক ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রায় ১০ মাস আগে মসলিনের ৫টি নমুনা দিয়ে জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। গত ২৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়। এতে করে মসলিনের উৎপত্তি, বুনন পদ্ধতি ও সুতা বাংলাদেশের বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। তারা আশা করছেন, সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে খুব শীঘ্রই দেশে মসলিনের ব্যাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হবে। এতে করে বাংলাদেশ পা দেবে মসলিনের নতুন অধ্যায়ে।

    প্রকল্প পরিচালক আইয়ুব আলীও আশা করছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে এই শাড়ি সর্বসাধারণের জন্য বাজারে আনা সম্ভব হতে পারে।

    (দৈনিক জনকন্ঠ হতে সংগৃহীত)

  • স্মৃতিতে অম্লান কমরেড মণি সিংহ

    স্মৃতিতে অম্লান কমরেড মণি সিংহ

    ডা. অসিত বরণ রায়

    কমরেড মণি সিংহ ছিলেন কিংবদন্তি মহানায়ক-টংক আন্দোলনের নেতা। এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা। ছোটবেলা থেকেই এই মহামানবের বহু রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনেছি। তার চিন্তায়-চেতনায় ধ্যান-জ্ঞান ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের, যিনি প্রতিনিয়তই ভাবতেন বৈষম্যমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমার জীবনে সৌভাগ্য যে কমরেড মণি সিংহের মতো মহামানবের সান্নিধ্য পেয়েছি। প্রায় এক যুগ পাশাপাশি কাটিয়েছি। কাছ থেকে দেখেছি আটপৌরেভাবে। সকাল থেকে রাত, রাত থেকে সকাল যার চুল থেকে নখ পর্যন্ত ছিল বিপ্লবী চেতনায় ভাস্বর।
    তিনি ছিলেন একজন কমিউনিস্ট এবং পরম পূজনীয় মানবতার পূজারি মহামানব। প্রথম দেখা থেকেই আমি কমরেড মণি সিংহকে দাদু বলে সম্বোধন করি, যদিও পার্টির নেতাকর্মীরা সবাই ‘বড় ভাই’ বলে ডাকতেন। সে সময় কিছুদিন আগেই অণিমাদি (কমরেড মণি সিংহের স্ত্রী) রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। সেই শূন্যতা দাদুকে খুব ব্যথিত করেছিল। এই সময়েই পার্টি আমাকে তাকে দেখাশোনা-সেবাযতে্নর দায়িত্ব দেয়। আমার মা এবং বাবা যখন শুনলেন এই গুরু দায়িত্বের কথা, তারা আমাকে সাহস দিয়েছিলেন। বারবার বলে দিয়েছিলেন, কোনোভাবেই যেন দাদুর অযত্ন না হয়। দাদু প্রতিটা মুহূর্তই সময় ও নিয়মের মধ্যে থাকতেন। সকালে দাড়ি কাটা থেকে শুরু করে দিনের সব কাজই করতেন একদম ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মিলিয়ে। এর ব্যত্যয় কখনো দেখিনি। সকাল সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠা এবং তারপর সকালের হাঁটা। সেটা শীত হোক, বৃষ্টি হোক, দাদুর ব্যত্যয় ঘটেনি কখনো। বৃষ্টি হলে ছাতা নিয়ে বের হতেন। পার্টি অফিসেও যেতেন সময়মতো। রাত ১১টায় ঘুম, বাসায় থাকা মানেই তার বই পড়া। সোভিয়েত ইতিহাস গ্রন্থটি দাদু বারবার পড়তেন।
    দাদুর কাছে শুনেছি টংক আন্দোলনের ইতিহাস। পাহাড়ে, জঙ্গলে হাতি ধরার গল্প। তাছাড়া পাহাড়ি আদিবাসী মানুষের জুম চাষের কথা। শীতের রাতে পাহাড়ের আগুন দেখা যেত। এর মানে জুম চাষের প্রস্তুতি চলছে। তারপর গর্ত খুঁড়ে নানা ধরনের বীজ পুঁতে দেয়া হতো- এটাই জুম চাষ। শুনেছি মহাশোলের গল্প। পাহাড়ি মাছ সোমেশ্বরী নদীতে পাওয়া যেত। খুবই সুস্বাদু মাছ।
    দাদুর কাছে শুনেছি কীভাবে ’৭১ সালে জেল ভেঙে বেরিয়েছিলেন। জেলের সব কয়েদি সেদিন দাদুর হুকুমে রাজশাহী জেলের দেয়াল ভেঙে বের হলেন এবং দাদু স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। সময় পেলেই দাদুর কাছে গল্প শুনতাম। শুনেছি ষাট দশকের প্রথম ভাগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই ঐতিহাসিক বৈঠকের কথা। এ বৈঠকের পরেই এ দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করল। শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা আন্দোলন। দাদু সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন, এখনো স্বাধীনতা চাওয়ার সময় আসেনি। দাদুর কাছে শুনেছিলাম বঙ্গবন্ধু সেই কথা, ‘দাদা, লিডার (শহীদ সোহরাওয়ার্দী) বলেছেন আপনার কথা শুনতে। আপনার কথা মেনে নিলাম কিন্তু মনে নিলাম না। আমি বাংলার স্বাধীনতাই চাই।’
    মনে পড়ে মালিবাগের বাসায় এসেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সেদিন স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে কীভাবে আন্দোলন শুরু করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করতে। সেদিনও কমরেড মণি সিং শেখ হাসিনাকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। আমি সেদিন পাশে বসে দেখেছি এবং শুনেছি সব কথা। সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমরেড মঞ্জুরুল আহসান খান।
    অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন কমরেড মণি সিংহ। প্রতিটি আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। আজ যখন সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখনই কমরেড মণি সিংহকে মনে পড়ে। কারণ এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে তিনি সারাজীবন লড়াই করেছেন। আজকে এই অশুভ শক্তি জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙছে। এই ভাস্কর্য ভাঙা মানে জাতীয় পতাকাকে অস্বীকার করা, সংবিধানকে অস্বীকার করা, স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা।
    আজকে যদি কমরেড মণি সিংহ বেঁচে থাকতেন, তবে হয়তো প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কমরেড মণি সিংহকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘কী করবেন?’ হয়তো কমরেড মণি সিংহ বলতেন, ‘স্বাধীনতার সপক্ষের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেন।’ আর এ কারণেই কমরেড মণি সিংহ আজো বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক। কমরেড মণি সিংহকে জানাই লাল সালাম।

    লেখক : যুগ্ম আহ্বায়ক, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট কেন্দ্র।

  • বাংলা ও বাঙালীর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ

    • এফএম শরিফুল ইসলাম
    • জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সংগঠনটির দীর্ঘ পথ চলায় রয়েছে দেশ ও জাতির জন্য গৌরবময় অসংখ্য অর্জন। সমৃদ্ধ সেসব অর্জন জাতিকে দিয়েছে নতুন পথের ঠিকানা। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময়ে কোন কাজ করতে চাইলে অধিকাংশ সময় সে যাত্রা ছাত্রলীগ দিয়ে শুরু করতেন। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকাকালীন ছাত্র নেতাদের চিঠি লিখে আন্দোলনের গতিকে বেগবান করতে দিকনির্দেশন দিতেন। বলা যায় ছাত্রদের রাজনৈতিক সক্রিয়তা এবং তাদের সংগঠিত করার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে তিনি ছাত্রলীগকে প্রাধান্য দিতেন।
    • দেশের বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৭১ সালের ১৭ হাজার নেতাকর্মীর আত্মত্যাগে মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, তথাকথিত ১/১১ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ইতিহাসের সবখানেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। গর্বের সঙ্গে বলা যায় যে কোন সঙ্কটে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের রয়েছে অনন্য অবদান। স্বৈরশাসক মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্রের প্রবর্তন করেন। তিনি ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে এ দেশের মেধাবী শ্রেণীকে বিপথগামী করে তোলেন। সেখান থেকে ছাত্রবান্ধব নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৪ সালে ২৮ ডিসেম্বর মতিঝিল শাপলা চত্বরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পুনর্মিলনীতে তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি এ কে এম এনামুল হক শামীম এবং সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্নার হাতে বই, খাতা ও কলম তুলে দিয়ে আবারও ইতিবাচক ধারায় বাংলার ছাত্র সমাজকে ছাত্রলীগের পতাকাতলে নিয়ে আসেন। ছাত্ররাজনীতিতে বলা যায় এক নবযুগের সূচনা এবং মেধাবী ধারা প্রবর্তন করেন দেশরতœ শেখ হাসিনা। জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময় দিকনির্দেশনা ও উপদেশ দিয়ে থাকেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘শুধু ভাল কর্মী হলে চলবে না, ভাল ছাত্র হতে হবে’ যা প্রমাণ করে ছাত্রলীগকে ইতিবাচক এবং মেধাবী রাজনীতির পথ দেখিয়েছেন তিনি। অস্ত্র নয় কলমের শক্তির প্রতি তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন সবসময়।
    • জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বক্তৃতায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অবদানের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস ছাত্রলীগের ইতিহাস’, ‘দেশ গড়ার জন্য সোনার ছেলে চাই। সেই সোনার ছেলে গড়ার কারিগর ছাত্রলীগ।’ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নাম। জেল-জুলুম আর অত্যাচার-নির্যাতনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল জর্জরিত। যার যৌবনের ১৩টি বছর কেটেছে পাকিস্তান কারাগারে। ১৯৬৯ সালে ২১ দফা আন্দোলনের ভিত্তিতে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জেল থেকে মুক্তি পান শেখ মুজিবুর রহমান। ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ জাতির পক্ষ থেকে বক্তৃতা করে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। বঙ্গবন্ধুর জীবন কর্মের সঙ্গে তাই ছাত্রলীগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত এটি চিরন্তন সত্য।
    • জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন নিজের প্রচেষ্টায় ছাত্রলীগকে ছাত্রদের মাঝে একটি জনপ্রিয় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ঠিক তেমনিভাবে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাও বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের ছাত্রসমজের কাছে একটি জনপ্রিয় সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে প্রতিষ্ঠিত করে তুলেছেন। বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিবাচক ধারণা বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এসেছে। ছাত্ররাই ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব দেবে এই উপলব্ধি থেকেই জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসার বয়স সীমা ২৭ বছর নির্ধারণ করে দেন, যা সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য ও প্রশংসিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছাত্র সমাজের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন। শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পরিচালিত হয়ে থাকে। ২০০১ সালের ১৭ মে পল্টন ময়দানে ছাত্র সংবর্ধনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি বাহাদুর বেপারী ও সাধারণ সম্পাদক অজয় কর খোকন ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ‘দেশরতœ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এটি প্রমাণ করে ছাত্রলীগ সময়ের প্রয়োজনে তার অভিভাবককে মূল্যায়ন করতে ভুলে যায়নি।
    • ইতিহাস বলে প্রয়োজনে দেশের যে কোন সঙ্কটকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তার সর্বোচ্চ দিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এসেছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্রদল ও শিবিরের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছিল। তখন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, অছাত্রদের সংগঠন ছাত্রদল ও রগ কাটা বাহিনী ছাত্রশিবিরকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয় আনে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধভাবে সরকার গঠন করে সেই অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। এ সময় বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেফতার হয। জেল-জুলুম, হুলিয়া দিয়ে ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মীকে হয়রানি করা হয়। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ১৪ জানুয়ারি ২০০৭ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটনকে বিনা কারণে গ্রেফতার করে কারাগারে অন্তরীণ করে রাখে। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনার জন্য ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের মুখে তৎকালীন সময়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
    • ২৭ জুলাই ২০০৭ দিনটি ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের জন্য এক কালো দিন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য বাংলা ও বাঙালীর প্রিয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সুধাসদন থেকে যৌথবাহিনী দ্বারা গ্রেফতার করে। নেত্রীর মুক্তির দাবি করে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল ও সমাবেশ করে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে মিছিল বের করে কোর্টের সামনের রাস্তা অবরোধ করে। সেদিনের মিছিল আলোড়ন সৃষ্টি ও শাসকগোষ্ঠীর মাঝে ভীতির সঞ্চার করতে সক্ষম হয়। বাংলার গণতান্ত্রিকামী মানুষের প্রবল চাপে ও আন্দোলনের মুখে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ফখরুদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যার অবদান নিশ্চয় ছাত্রলীগকে দিতে হয়। এছাড়া সে সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
    • ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরামর্শে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম সারা বাংলাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সেভ ক্যাম্পাস ক্লিন ক্যাম্পাস’ কর্মসূচী ঘোষণা করে। ‘সেভ ক্যম্পাস ক্লিন ক্যম্পাস’ কর্মসূচীর মাধ্যমে ছাত্রলীগকে ইতিবাচক কর্মসূচীতে যুক্ত করেন সজিব ওয়াজেদ জয়। যা নতুন করে ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষের মাঝে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। সে ধারাবাহিকতায় বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য ছাত্রলীগকে নিয়েছেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়।
    • সূর্যের আলোর মতো তেজদীপ্ত হয়ে গণমানুষের অধিকার আদায়ে নিয়মিত রাজপথে সোচ্চার এবং ছাত্রসমাজের অভিভাবক হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। বর্তমান সময়েও বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছাত্র সমাজের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্র সংগঠন। জাতির পিতার নিজ হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাতিকে এগিয়ে নিতে কাজ করে যাবে নিরন্তর, সে প্রত্যাশা রইল। ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গৌরবময় ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ছাত্রলীগের শুভাকাক্সক্ষী এবং অসংখ্য নেতাকর্মীদের প্রতি রইল সশ্রদ্ধ সালাম ও শুভেচ্ছা।
    • লেখক : বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, সাবেক সভাপতি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ
  • ফুলের শ্রদ্ধায় সিক্ত একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন

    ফুলের শ্রদ্ধায় সিক্ত একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন

    সোমবার বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চের পাদদেশে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয় একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুনের মরদেহ । সেখানে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মন্ত্রী, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও লেখকসহ তার ভক্ত, পাঠক-অনুরাগীরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
    এ সময় তথ্যমন্ত্রী, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ছোটকাকু ক্লাব, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, টেলিভিশন, নাট্যশিল্পী ও নাট্যকার সংসদ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতিসহ বিভিন্ন পেশাজীবী ও সেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
    রাবেয়া খাতুন রোববার বিকেলে ৮৫ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। গতকাল কয়েক দফায় জানাজা শেষে বনানী কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হবে।
    বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন রাবেয়া খাতুন। অর্ধশতাধিক উপন্যাস ও চার শতাধিক গল্প লিখেছেন তিনি। এমন একজন লেখিকার চলে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি। তার চেয়ে বড় কথা, তিনি যেই সময়ে সাহিত্য রচনা শুরু করেছিলেন, সেই সময়ে নারীদের ক্ষেত্রে সেটা খুব সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি তার কাজে সফল হয়েছেন।
    বাংলা সাহিত্যে রাবেয়া খাতুনের মতো লেখিকা আর পাওয়া যাবে না। একুশে পদকপ্রাপ্ত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন শুধু বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেননি; তার লেখনির মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতিকে সমাজে দারুণভাবে তুলে ধরছেন । তিনি তার লেখনীর মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনবোধকে তুলে ধরতেন। আমরা বিশ্বাস করি তিনি তার লেখার মাধ্যমে আমাদের মাঝে সারাজীবন বেঁচে থাকবেন। মুক্তিযুদ্ধ ও নারীদের নিয়ে তিনি প্রতিনিয়ত কাজ করেছেন।
    যাদের লেখায় আজকের সাংস্কৃতাঙ্গণ অনুপ্রাণিত হয় রাবেয়া খাতুন তাদেরই একজন। অর্ধ শতাধিক উপন্যাসের রচয়িতা রাবেয়া খাতুন শিক্ষকতা করেছেন, সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৩ সালে একুশে পদক এবং ২০১৭ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন।
    কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন লেখার মধ্য দিয়ে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। আমরা মহীয়সী এ নারীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

  • আশুরার বিলের বাঁধ বিরোধী আন্দোলন


    পাভেল পার্থ

    ফগা হাঁসদার কাছে বেশকিছুদিন সাঁওতালি বনবিদ্যা শিখতে গিয়েছিলাম। দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ ও বিরামপুরের শারশাবীরে আলোকধূতি গ্রামের বিখ্যাত কবিরাজ তিনি। ক্ষয়িষ্ণু শালবন ঘুরতে ঘুরতে ফগা হাঁসদাই আমাকে প্রথম চেনান দেশের এই আদি জলাভূমি ‘আশুরার বিল’। দেশের অন্যসব আদিবিলের মতোই কত কাহিনি আর আখ্যান জড়িয়ে আছে এই বিলের সাথে। ফগা হাঁসদা জানান, শৈশবে এই বিল ও আশেপাশের জংগল থেকে দাদুর সাথে কত ভেষজ লতাগুল্ম কুড়িয়েছেন। আজ যার কোনো চিহ্ন নেই। এত বড় বিল, একটি কাঁকড়াও দেখা যায় না। বাংলাদেশ জাতীয় তথ্যবাতায়ন জানায়,‘‘… দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ সদরের উত্তর-পশ্চিমে শালবন আর বনের উত্তর পাশ ঘেঁষেই আশুরার বিল। আয়তন ২৫১.৭৮ হেক্টর। বোরো মওসুমে স্থানীয় কৃষকেরা বিলে ধান আবাদ করে এবং প্রচুর ফলন পায়। আশুরার বিল মৎস্যজীবি সমবায় সমিতি লি. ২০১৩ সন পর্যন্ত বিল ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল। সমিতি বিলে ২০ একরের মৎস্য অভয়াশ্রম তৈরি করেছে। বিলে প্রতিবছর মৎস্য অধিদপ্তর পোণা ছাড়ে এবং প্রতি দুই বছর পরপর রাক্ষুসে প্রজাতির মাছ ধরে। বিলটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন আর ৪/৫ মাসের বেশি মাছ ধরার সুযোগ থাকে না।’’ তো এই ঐতিহাসিক আশুরার বিল নিয়ে শুরু হয়েছে আরেক বিবাদ। করোনাকালে যেখানে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানা জরুরি, দু:খজনকভাবে সেখানে আশুরার বিলের চারধারের কৃষক নারী-পুরুষেরা এক বাঁধবিরোধী আন্দোলনে সামিল হতে বাধ্য হয়েছেন। আশুরার বিলে সরকার এক বাঁধ দিয়েছেন, কিন্তু পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে আশেপাশের কৃষিকাজ ব্যহত হয়। আবার বাঁধটি সংস্কার হবে, হয়তো আবারো তলিয়ে যাবে কৃষিজমিগুলো। এই আশংকায় কৃষকেরা একত্র হয়েছেন। অবস্থান কর্মসূচি ও অনশনের মাধ্যমে জনদাবি তুলে ধরছেন। একটানা কর্মসূচির কারণে অসুস্থ হয়েছেন অনেকে, করুণ মৃত্যু হয়েছে কৃষক গোলাপ সরকারের। কৃষিজমির সুরক্ষায় ‘জীবন নিলে নিয়ে নেন/আমাদের দাবী মেনে নেন/আশুরার বিলে ধান চাষ করতে দেন’ শ্লোগান দিতে বাধ্য হচ্ছেন আশুরার বিলের কৃষকেরা। বিল-জলাভূমি বনাম উন্নয়নের এই বিবাদ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে সারা দুনিয়ায় বৃহৎবাঁধের বিরুদ্ধে জনআন্দোলনের ইতিহাস সুপ্রাচীন। ফারাক্কা, নর্মদা থেকে শুরু করে টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কৃষিজমি ও জলাভূমি সুরক্ষা করে উন্নয়নের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু সকল উন্নয়ন পরিকল্পনায় এই পরিবেশপ্রশ্নটি আড়াল হয়ে যায়। অপরিকল্পিত অবকাঠামো আর জনভোগান্তিই প্রকট হয়ে ওঠে। কৃষিজমি ও জলাভূমি সুরক্ষায় আমাদের উন্নয়নচিন্তায় আমূল পরিবর্তন জরুরি। প্রবল জনআন্দোরনের চাপে মুন্সীগঞ্জের আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে রাষ্ট্র সরে আসতে বাধ্য হয়েছিল। প্রতিদিন কমছে কৃষিজমি, প্রতিদিন উধাও হচ্ছে জলাভূমি। চলনবিলকে আমরা কেটে কেটে টুকরো টুকরো করেছি। গোপালগঞ্জের চান্দারবিল, টাঙ্গাইলের আসিল বিল, কুড়িগ্রামের তাগরাই বিল, বগুড়ার কেশপাথার বিল, গাজীপুরের বেলাই বিল, দক্ষিণের বিলডাকাতিয়া সবই আজ উন্নয়ন যন্ত্রণায় রক্তাক্ত। কিন্তু বিল আর জমিনের মজবুত সুরক্ষা ও জনসম্পর্ক ছাড়া কী বাংলাদেশের কৃষির বিকাশ সম্ভব? করোনাকালে এইসব মৌলিক প্রশ্নের সুরাহা জরুরি। অপরিকল্পিত কোনো অবকাঠামো ও উন্নয়নের চাবুকে ঐতিহাসিক আশুরার বিলকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলা অন্যায়। আশুরার বিলের বোরো মওসুমের ধানের উৎপাদন দিয়ে নাকি বাংলাদেশের আড়াই দিনের ভাতের জোগান হয়। আশুরার মাছ দেশের মৎস্যখাতকে মজবুত রাখছে। আশুরার বিলের বাঁধবিরোধী আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানো জরুরি। ক্ষতিগ্রস্থ ও শংকিত কৃষকের কথা শোনা জরুরি। কৃষকের সম্মতি ও বিশ্লেষণে আশুরার বিলের সামগ্রিক উন্নয়নচিন্তা জোরালো করা দরকার। আর এভাবেই তো মহামারি সামাল দিয়ে দাঁড়াতে পারে এক নতুন বাংলাদেশ।
    শালবনের এক আদি জলাভূমি
    দিনাজপুর বনবিভাগের চরকাই রেঞ্জের চরকাই সদর বীটের অধীন ধানজুরী শালবন। নবাবগঞ্জ ও বিরামপুরে বিস্তৃত এমন আদি শালবনের সাঁওতালি নাম ‘শারশা বীর’। সাঁওতালি ভাষায় বীর মানে জংগল। শারশা বীরের এক অনন্য জলবাস্তসংস্থান হলো আশুরার বিল। অনেকে বলেন আসিলের বিল। স্থানীয় জনইতিহাস অনুযায়ী আশিটি ডাঢ়া/দাঁড় (জলের নালা) থেকে সৃষ্ট বলেই এর নাম ‘আশুরা’। সিঙ্গের ডাড়া, নাও ডাড়া, পানি ডাড়া, মাড়া ডাড়া, নেংটিহারা, কোদালকাটি, কুচনিরটেক, চেংমাড়ি ডাঢ়া গুলো বিখ্যাত। বিলের উত্তরে হরিপুর মৌজার গ্রাম, দক্ষিণে শালবন, পূর্বে ধূপঘাট ও ডাংগেরঘাট, পশ্চিমে পীরেরদগ, নাওডাঢ়া, পানির ডাঢ়া ও ধানজুরী বনবীট। আশুরার বিলের ধার ঘেঁষে অনেক ঐতিহাসিক, প্রতœতাত্ত্বিক ও স্মৃতিময় পবিত্রস্থল আছে। বুড়িরদও, কাচলাদও, মানিকদও, ধূপঘাট, মনিরথান, কালিরদও, টিপিরদও, পাইলাদও। শারশাবীরে সাঁওতালদের অনেক জাহেরথান (পবিত্র জংগল) আছে। আশুরারবিলের বুড়িমন্টপ এলাকা থেকে চৈত্রমাসেও পানি বের হতো, এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সেইসব আদি ঝারণা (জলধারা) এখন নেই। আশুরা বিলে শোল, গজার, চিংড়ি, বোয়াল, পুঁটি, টেংরা, পিয়া, কাকলা, কৈ, গচি, শিং এখনো পাওয়া যায়। তবে বিলুপ্ত হয়েছে খড়িকাঠি ও তর মাছ। প্রবীণ সাঁওতালেরা জানান, অনেক আগে এই বিলের কালো কুচকুচে পানিতে তায়ান (কুমীর) দেখা যেত। ছিল ঢুকনো হড়ো ও কাঠ হড়ো নামের কচ্ছপ। আগের দিনে আশুরার বিলে কোনো আবাদ হতো না। আমন ও আউশ মওসুমে বিলের পাথারে আবাদ করতেন সাঁওতালেরা। পরবর্তীতে সেটেলার বাঙালিদের আগম ও বিল ভরাট হয়ে যাওয়ায় আশুরার বিলে ধানের আবাদ শুরু হয় এবং চলতি সময়ে বোরো মওসুমে এখানে ব্যাপক চাষ হয়।
    বাঁধবিরোধী আন্দোলন
    আন্দোলনকারী কৃষকদের দাবি সরকার অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ করায় প্রায় ১৯০০ হেক্টর কৃষিজমি জলাবদ্ধ হয়ে যায়। এই জমির ৯ ভাগের এক ভাগ মাত্র সরকারি জমি, বাকি জমি ব্যক্তিমালিকাধীন। ৪,৬৯৫ একর জমির ভেতর ৫৮৮ একর সরকারি খাস। বাঁধ নির্মাণের কারণে জলাবদ্ধ জমিনে কৃষিকাজ ব্যহত হচ্ছে। বাঁধটি নির্মাণের পর জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় স্থানীয় কৃষকেরা বাঁধটি খুলে দেয়ার দাবি জানান। চলতি বর্ষায় বাঁধটি একবছরেই ভেঙে পড়েছে। জানা যায়, প্রশাসন আবারো বাঁধ সংস্কারে উদ্যোগ নিয়েছে। স্লুইসগেট বা পানি নিষ্কাশনের জন্য কোনো সুব্যবস্থা না রেখে আবারো বাঁধটি আগের মতো চালু হলে আবারো জলাবদ্ধ হয়ে যেতে পারে ৪ হাজার ১১০ একর ব্যক্তিগত কৃষিজমি। কৃষিজমি সুরক্ষায় তাই এই বাঁধবিরোধী আন্দোলন। আশুরার বিলের আবাদি জমি রক্ষা ও বিলে বাঁধ নির্মাণের প্রতিবাদে আশেপাশের কৃষকরা ৩০ অক্টোবর থেকে আন্দোলনে নামে। টানা আট দিন ‘অনশন’ ও অবস্থান কর্মসূচির একপর্যায়ে ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়েন নবাবগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামের প্রবীণ কৃষক গোলাপ সরকার (৭৫)। বাড়ি নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। অনশনের কারণে অসুস্থ হয়েছেন গফুর আলী, সাদেক আলী, সিরাজুল ইসলাম, আইজুল ইসলাম ও দিলবর আলী।
    বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির দূষণ
    কেবল অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ভরাট বা বেদখল নয়; আশুরার বিল বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির কারণেও প্রতিদিন কাতরাচ্ছে। আশুরার বিল থেকে বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির দূরত্ব প্রায় ৩০ কি.মি.। বড়পুকুরিয়া কয়লাখনির বর্জ্যপানি এখন এই বিলে মেশে। ধীরে ধীরে এখানকার পানি দূষিত হতে শুরু করে এবং অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ পর্যন্ত পানির দূষণ বেশি হয়। কয়লাখনির দূষণের ফলে গোলাপগঞ্জ ইউনিয়নের রঘুনাথপুর, পাদমপুর, বস্তাপাড়া, হরিপুর এবং বিনায়েতনগর ইউনিয়নের নন্দনপুর, চেরাগপুর ও আমবাহাদুরপুর গ্রামের মানুষ দুর্বিষহ যন্ত্রণা পাড়ি দিচ্ছে। আশুরারবিলের পীররেদও এলাকায় বৈশাখ মাসে মানুষের মেলা বসে। প্রতি রবি ও বৃহস্পতিবার সব ধর্ম ও গোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের মানত নিয়ে এখানে আসে। আগেরদিনে বিলের পানি দিয়ে মানুষ জিয়াফতের বাসনপত্র ধুতে পারত, পানি খাওয়াও যেত। কিন্তু এখন দূষিত পানি শরীর চুলকায়।
    একজন গোলাপ সরকার
    উন্নয়ন বাহাদুরির চাপে যখনই কোনো নদী বা জলপ্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়েছে তখনি মানুষ গর্জে ওঠেছে। বাংলাদেশের মানুষের নদ-নদী, বিল, হাওর, পুকুর, খাঁড়ি, বাওর, দীঘি, ঝর্ণা, ঝিরি, ছড়া, সমুদ্র সুরক্ষার লড়াইয়ের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। প্রতিনিয়ত দেশের নানাস্থানে প্রতিদিন মানুষ নিজস্ব জলধারা বাঁচাতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। উজানে যখনই অভিন্ন নদীতে বাঁধ দেয়া হয়েছে ভাটির বাংলাদেশ তখনই ঐক্যব্ধভাবে এর প্রতিবাদ করেছে। এমনকি দেশের অভ্যন্তরেও জলপ্রবাহ বাঁচাতে আন্দোলন অব্যাহত থেকেছে। ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে পদ্মার প্রবাহ বাঁচাতে বাংলাদেশ যে দীর্ঘ গণপদযাত্রা করেছে তা দুনিয়ায় নদী বাঁচানোর প্রথম দীর্ঘ গণমানুষের মিছিল। সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে গড়ে ওঠা ভাসান পানির আন্দোলন পৃথিবীর প্রথম মুক্ত পানিতে জনগণের সর্বজনীন অধিকারের সংগ্রাম। মৌলভীবাজারের মাধবকুন্ড জলপ্রপাত ইকোপার্কের নামে ইজারা দেয়ার বিরুদ্ধে আদিবাসী খাসি ও মান্দি জনগণের আন্দোলন বেশ গুরুত্বপূর্ণ পানিফলক। তিস্তার পানির ন্যায্যহিস্যা নিয়ে বাংলাদেশ এখনও লড়ছে। টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে গণদ্রোহ অব্যাহত রেখেছে। কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়েছে দীর্ঘ পাহাড়ি সংগ্রাম। প্রতিনিয়ত বিল ও মুক্তজলাশয়ে জেলে ও গরিব মানুষের প্রথাগত অধিকারের দাবিতে দেশের নানাপ্রান্তে আন্দোলন অব্যাহত আছে। নদী বাঁচানোর এ লড়াইয়ে মানুষ জান দিয়েছে, জেলজুলুম খেটেছে, মামলা মোকদ্দমার অন্ত নাই। কিন্তু মানুষ থামেনি। মানুষ লড়ছে, নদীর মুক্ত প্রবাহের দাবিতে। সর্বত্র। তিস্তা বাঁচাও আন্দোলন, বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন, বড়াল নদী রক্ষা আন্দোলন, কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন, গোমতী রক্ষা আন্দোলন, যমুনা বাঁচাও আন্দোলন, ভবদহ আন্দোলন, বিল ডাকাতিয়া আন্দোলন গুলো সমসাময়িককালে কেবলমাত্র পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকেনি। হয়ে ওঠেছে জীবন ও জীবিকা বিকাশের মৌলিকচিন্তার দলিল। সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত ঘেঁষে কুশিয়ারা নদীতে তৈরী করা হয়েছিল সরকারী প্রকল্পের বাঁধ এর ফলে জকিগঞ্জ থানার বিরশ্রী ইউনিয়নের কিছু কৃষকেরা সেচের জন্য পানি পেলেও বরহল ইউনিয়নের মানুষের জমি প্রতিবছর বন্যায় তলিয়ে যেত। বরাক নদী থেকে নেমে আসা বালি ও পলিতে কৃষি জমি গুলো ভরে যায়। বাধ্য হয়ে বরহল ইউনিয়নের নারী পুরুষ সর্বনাশা এই বাঁধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেন। ২৬ জুলাই ১৯৯৩ সালে বরহল ইউনিযনের হাজার হাজার নারী পুরুষ প্রতিবাদ সমাবেশ করেন সীমান্তবর্তী বাঁধ এলাকায়। সীমান্তরক্ষীর গুলিতে শহীদ হন চারজন গ্রামবাসী, আহত হন প্রায় ৫০এরও বেশী মানুষ। আবারো আশুরার বিলে বাঁধের বিরুদ্ধে কৃষিজমি সুরক্ষায় প্রাণ দিলেন দিনাজপুরের গোলাপ সরকার। গোলাপ সরকারের এই পরিবেশচিন্তার মৃত্যু নেই। বাঁধবিরোধী মনস্তত্ত্বের ক্ষয় নেই। গোলাপ সরকারের আওয়াজ আমাদের বোঝা জরুরি। উন্নয়নের বাহাদুরিকে প্রশ্ন করা জরুরি। আশুরার বিলের কৃষকের ন্যায্য দাবি এবং প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষায় দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার।

    লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: ধহরসরংঃনধহমষধ@মসধরষ.পড়স

  • কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে বর্তমান সরকার

    কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে বর্তমান সরকার

    ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া*

    কৃষি এ দেশের অর্থনীতির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ খাত। বর্তমানে দেশে জিডিপির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অর্জিত হয় কৃষি খাত থেকে। তার চেয়েও বড় কথা কৃষি এ দেশের জনমানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রদানের প্রধানতম এবং অন্যতম উৎস। এখনও এ দেশের বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থানও হয়ে থাকে কৃষিকে অবলম্বন করেই। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, জীবনযাত্রায় মানোন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে কৃষিক্ষেত্রে যে অধিকতর মনোযোগ দিতে হবে শুরুতেই ২০০৯ সনে নির্বাচিত হয়ে মহাজোট সরকার সেটি অনুধাবন করতে সক্ষম হয়। গত অর্ধযুগ ধরে কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন খাতে যে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা বর্তমান সরকারের কৃষি ভাবনার এক বাস্তব প্রতিফলন।


    শুরুতেই খাদ্যশস্য উৎপাদনে গত অর্ধযুগের ধারাবাহিক সাফল্যের কথা তুলে আনা যুক্তিসঙ্গত হবে। ২০০৮-২০০৯ সনে আমাদের চাল, গম ও ভুট্টার মোট উৎপাদন ছিল ৩৩৩.০৩ লাখ টন। এরপর থেকে প্রতি বছর খাদ্যশস্যের উৎপাদন বর্তমান সরকারের কৃষিবান্ধবনীতি ও কর্মকাণ্ডের ফলশ্রুতিতে ক্রমে বেড়েছে। গত ২০০৯-১০, ২০১০-১১, ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ সনে যথাক্রমে ৩৪৫.৯৬, ৩৬০.৬৫, ৩৬৮.৩৩৯ ও ৩৭২.৬৬ লাখ টনে উন্নীত হয়। আলু উৎপাদনের কথা যদি ধরা হয় তাহলে দেখা যায় যে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০১২-১৩ সনে এর উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭.৪৬ লাখ টন থেকে ৮৬.০৩ লাখ টনে। এ সময়কালে পেঁয়াজ, গম ও সবজির উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেড়েছে।


    মূলত চারটি প্রধান কারণে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে গত অর্ধযুগ ধরে। এক, অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় ফসল আবাদের জন্য কৃষক এখন বেশি পরিমাণ গুণগতমান সম্পন্ন ফসলের বীজ পাচ্ছেন। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে বিএডিসি থেকে বিভিন্ন ফসলের বীজ সরবরাহ করা হয় ২ লাখ ৬১ হাজার ৫৯ টন যা বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমান সরকারের আমলে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৩ টনে। এ বৃদ্ধি চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত হলেও তা আড়াই গুণের বেশি। দুই, অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় এ সময়কালে অনেক বেশি সংখ্যক জাত উদ্ভিদ প্রজননবিদরা উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছেন আর অনেক বীজ এরই মধ্যে কৃষক পর্যায়ে বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন ফসলের মোট ১৪৫টি জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। তিন, সারের মূল্য হ্রাস ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় কৃষক স্বল্প মূল্যে সুষম সার প্রয়োগ করার সুযোগ পেয়েছেন। ২০০৯ সনে মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর থেকে সরকার নন-ইউরিয়া সারের মূল্য তিনবার হ্রাস করেছে। ২০০৯ সনে যেখানে টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি এর কেজি প্রতি মূল্য ছিল যথাক্রমে ৮৭, ৭০ ও ৯০ টাকা, ২০১০ সনের অক্টোবরে এসে তা যথাক্রমে হ্রাস করা হয়েছে ২২, ১৫ ও ২৭ টাকায়। অন্যদিকে, ২০১৩ সনের আগস্ট মাসে এসে ইউরিয়া সারের মূল্য কৃষক পর্যায়ে কেজিপ্রতি ১৬ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বর্তমান সরকারের আমলে দেশে একটি টেকসই সার বিতরণ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে যার মাধ্যমে কৃষকের কাছে সব ধরনের সার সময়মতো পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। চার, বেসরকারি বীজ আমদানিকে উৎসাহিত করায় দেশে ভুট্টা, সবজি, গোলআলু এবং পাট বীজ সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে বীজ ব্যবস্থাকে বিশেষ সুযোগ প্রদান করায় প্রাইভেট সেক্টর দেশে প্রচুর সবজি বীজ আমদানির মধ্য দিয়ে কৃষকের কাছে সবজি বীজের জোগান বৃদ্ধি করতে পেরেছে। ফলে দেশে মুক্ত পরাগী বীজের পাশাপাশি হাইব্রিড সবজি বীজের সরবরাহও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সবজি উৎপাদন বেড়েছে।
    মহাজোট সরকারের আরেকটি বড় সাফল্য হলো কৃষি গবেষণাকে অগ্রাধিকার প্রদান। বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে ঘঅচঞ-এর আওতায় পরিচালিত ঝঢ়ড়হংড়ৎবফ চঁনষরপ এড়ড়ফং জবংবধৎপয (ঝচএজ) এর মাধ্যমে প্রতিটি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে ল্যাব উন্নয়নসহ নানামুখী গবেষণা পরিচালনা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে দেশে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটে আণবিক জীববিদ্যা সম্পর্কিত আধুনিক গবেষণাগার গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে পাটের নানা রকম প্রতিকূলতাসহিষ্ণু পাট জাত উদ্ভাবনের গবেষণা চলছে।


    দেশে ফসল কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বর্তমান সরকার আরও যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-


    বর্তমান সরকারের আমলে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ আরও গতিশীল হয়েছে। ‘খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি’ প্রকল্পের মাধ্যমে ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে ২৫% কম মূল্যে ৩৫টি জেলায় ৩৮ হাজার ৩২৪টি বিভিন্ন প্রকার কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছে। তাছাড়া বিএআরআই এবং বিআরআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত কৃষি যন্ত্রপাতি মোট মূল্যের ৬০% পর্যন্ত ভর্তুকি মূল্যে কৃষকের নিকট সরবরাহ করে যাচ্ছে।
    কৃষকের উৎপাদন খরচ হ্রাস করার জন্য সরকার বিদ্যুতের রিবেট প্রদান করেছে এবং বীজ, সারসহ ইক্ষু চাষিদের সহায়তা ভর্তুকি বছর বছর বৃদ্ধি করেছে। ২০০৮-০৯ সনে এ রকম ভর্তুকি যেখানে ছিল ৫১৭৮.২৬৯১ কোটি টাকা ২০১২-১৩ সনে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১৯৯৯.৯৯৩৮ কোটি টাকায়।
    সরকার বন্যা, আইলা, সিডর, মহাসেনসহ নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে ফসল উৎপাদনে প্রণোদনা প্রদান করেছে ও কৃষি পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।


    ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার করে ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানি উত্তোলন হ্রাস করার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার ক্ষুদ্র সেচ কার্যক্রম জোরদার করেছে। দেশের জলাবদ্ধ এলাকা, হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন ক্ষুদ্র সেচ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারকে সরকার গুরুত্ব দিয়েছে। সেচ সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সেচের আওতা বাড়ানো হয়েছে। ড্যাম, পাহাড়ে ঝিরি বাঁধ, রাবার ড্যাম ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছে।


    কৃষি পণ্যের বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন বর্তমান সরকারের আরেকটি সাফল্য। পাইকারি বাজার সৃষ্টি, গ্রোয়ার্স মার্কেট, কুল চেম্বার স্থাপন, রিফার ভ্যান পণ্য বিপণন, নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপণন ব্যবস্থায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়েছে।


    সরকার অঞ্চলভিত্তিক ১৭টি সমন্বিত কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে এলাকা উপযোগী ফসলের জাত উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, সেচ অবকাঠামো নির্মাণ করে সেচের আওতা বৃদ্ধি করা, কৃষিজাত পণ্যের বাজার সুবিধা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়েছে।


    কৃষি জমি ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে বলে বৃহত্তর বরিশাল, খুলনা ও সিলেট জেলার পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আনার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।
    দেশের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার কৃষির সার্বিক উন্নয়ন সাধনের জন্য ২০১৩ সনে একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ মহাপরিকল্পনার আওতায় দক্ষিণাঞ্চলের ১৪টি জেলায় সামগ্রিকভাবে ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতসহ ১০টি প্রধান ক্ষেত্রে কর্মকা- শুরু হয়েছে।


    দেশে বর্তমান সরকারের আমলে ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। কৃষি তথ্য সার্ভিসের মাধ্যমে দেশের ১০টি কৃষি অঞ্চলে ২৪৫টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র (এআইসিসি) স্থাপন করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কৃষক ফসল উৎপাদন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন।
    দেশে মাটির উর্বরতা অনুযায়ী অনলাইন সুষম সার সুপারিশ করার জন্য ২০০টি উপজেলায় ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। তাছাড়া দেশে এওঝ ভিত্তিক মডেলিংয়ের মাধ্যমে ১৭টি শস্য উপযোগিতা বিষয়ক ম্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। এটি অঞ্চলভিত্তিক শস্য উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করবে।


    মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে পৃথিবীর পাঁচটি সর্বাধিক মৎস চাষকারী দেশের একটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৩-১৪ সনে আমাদের দেশে প্রায় ৩.৪৬ মিলিয়ন টন মাছ উৎপাদন করা হয়েছে যার প্রায় ২ মিলিয়ন টনই মৎস্য আবাদ থেকে পাওয়া গেছে। মৎস্য গবেষণার মাধ্যমে দেশে মাছের নতুন জাত উদ্ভাবন এবং এসব জাতের মাছের পোনা ব্যবহার করার কারণে মৎস্য উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত অর্ধযুগ ধরে মৎস্য উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং এদের প্রয়োগ নিশ্চিতকরণের কারণেও মৎস্য উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেছে। মৎস্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের আমলে যেসব কৌশল উদ্ভাবন ও এদের প্রসার ঘটানো হয়েছে সেগুলো হলো-
    সুপার জাতের মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা উৎপাদন এবং এর আবাদ করা,
    থাই পাঙ্গাশের কৃত্রিম প্রজনন এবং পোনা উৎপাদন,
    পুকুরে পাঙ্গাশ উৎপাদন কৌশল উদ্ভাবন,
    পুকুরে রুই মাছের প্রজাতির মিশ্র আবাদ করা,
    মৌসুমি পুকুরে রাজপুঁটি উৎপাদন,
    উন্নত রুই জাতীয় মাছের রেণু উৎপাদন এবং নার্সারি ব্যবস্থাপনা।


    প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে বর্তমান মহাজোট সরকারের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে ২০০৭-০৮ সনের তুলনায় ২০১২-১৩ সনে দেশের দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদন যথাক্রমে শতকরা ৪৬, ৫৫ এবং ৪.২ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২-১৩ সনে কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রে শতকরা ৭.৪ ভাগ বৃদ্ধি ঘটেছে। এ সময়ে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার কারণে মুরগির মৃত্যু হার কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। দেশে এ সময়ে ২৪টি লাইভস্টক কোয়ারেনটাইন স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। প্রাণীর ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে এবং হাইব্রিড গবাদিপশু পালন কর্মকা-কে ত্বরান্বিত করা হয়েছে। গবাদিপশু এবং হাঁস-মুরগি পালনে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বেকার যুবক, দুঃস্থ মহিলা, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ২০১১-১২ সনে দেশের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের আটটি জেলায় ইনটিগ্রেটেড এগ্রিকালচারাল প্রোডাক্টিভিটি প্রজেক্ট ত্বরান্বিত করা হয়েছে। দেশি মুরগির ব্রিড সংরক্ষণ করা এবং এদের বাড়তি খাদ্য সরবরাহ করে উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।


    বর্তমান সরকারের কৃষিক্ষেত্রে গৃহীত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে আজ কৃষির প্রত্যেকটি খাতে ধনাত্মক পরিবর্তন হয়েছে। ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রত্যেকটি খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হওয়ায় এখন এ দেশের কৃষক কেবল খাদ্য নিরাপত্তা নয় বরং পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে দেশ ক্রমে এগোচ্ছে। খাদ্যশস্য, গোলআলু, ভুট্টা এবং সবজি উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদনে দেশ আজ এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জমি হ্রাসের প্রেক্ষাপটে জনমানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানের জন্য সরকার নানামুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করে চলেছে। কৃষিবান্ধব বর্তমান সরকার সত্যিকার অর্থেই খাদ্য ঘাটতির দেশকে এক খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে পরিণত করার দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

    লেখক:

    ড. মো. শহীদুর রশীদ ভূঁইয়া*
    * প্রফেসর, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগ এবং প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলানগর, ঢাকা-১২০৭, মোবাইল : ০১৫৫২৪৬৭৯৪৫

  • নদ ও নদীর পার্থক্য—-ডক্টর মোহাম্মদ আমীন

    নদ ও নদীর পার্থক্য—-ডক্টর মোহাম্মদ আমীন

    কোনও জলপ্রবাহের নাম যদি মহিলাবাচক হয় তাহলে নদী এবং পুরুষবাচক হলে নদ। গঙ্গা, সরস্বতী, যমুনা, পদ্মা, গৌরী, ভাগীরথী, চিত্রা, নর্মদা, কাবেরী, কৃষ্ণা কর্ণফুলী প্রভৃতি মহিলাবাচক নাম, তাই নদী লেখা হয়। কপোতাক্ষ, ব্রহ্মপুত্র, নারদ, ভৈরব, কুমার, মুসা খান, মির্জা মাহমুদ প্রভৃতি পুরুষবাচক নাম, তাই নদ লেখা হয়। অনেকে মনে করেন, যে জলস্রোতের নামের শেষে আ-কার কিংবা ই-কার থাকে তাকে নদী বলা হয়। অন্যদিকে যে জলস্রোতের নামের শেষে আ-কার কিংবা ই-কার থাকে না তাদের নদ বলে। যেমন-তুরাগ, কপোতাক্ষ, ব্রহ্মপুত্র, নীল, বালু, সাঙ্গু প্রভৃতি নদ নামে পরিচিত।তবে এ সূত্রের কিছুটা ব্যতিক্রম ও বিতর্ক লক্ষণীয়। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য সূত্র হল : নামের শেষে যদি আকার, একার, ওকার, ঔকার প্রভৃতি থাকে তবে নিশ্চিতভাবে সে প্রবাহগুলো নদী নামে অভিহিত হবে। নামের শেষে এগুলো না-থাকলে এবং শুধু হ্রস্ব উ-কার থাকলে সেটি নদ হবে। যেমন : ‘আড়িয়ালখাঁ’ পুরুষজ্ঞাপক নাম হলেও শেষে আকার রয়েছে। সে জন্য এটি নদ না হয়ে নদী। কিন্তু ‘মুসা খান’ নামের অন্ত-বর্ণ ‘দন্ত্য-ন’-এর পরে আকার একার কিছু নেই, এ জন্য এটি নদ। ‘সিন্ধু’ বানানের শেষে যেহেতু হ্রস্ব উ-কার রয়েছে, সেহেতু এটি নদ। একইভাবে ‘বালু’ একটি নদ। ‘নীল’ স্ত্রী নাম জ্ঞাপক একটি প্রবাহ। যেহেতু এর শেষে আকার, একার কিছু নেই, সে জন্য এটি নদ। এভাবে ‘ঘাঘট’ স্ত্রী নাম জ্ঞাপক জলপ্রবাহ হলেও অন্তবর্ণ ‘ট’-এর পরে আ-কার, এ-কার নেই, তাই এটি নদ।অনেকে নদ ও নদীর আরও একটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেন। সেটি হল – একটি সর্বদা পূর্ব-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয় এবং অন্যটি সর্বদা উত্তর-দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে। নদীর প্রবাহদিক খেয়াল করে থাকলে নদের প্রবাহদিক অনুধাবন করা যায়। আবার কারও কারও মতে, নদের কোন শাখা বা উপশাখা হয় না। পুরুষবাচক নাম বলে হয়তো এমন ধারণা। তবে এর কোন ভিত্তি নেই। ব্রহ্মপুত্র নদ হলেও শাখা আছে। যেমন : শীতলক্ষ্যা ও যমুনা যদি ব্রহ্মপুত্রের শাখা। আসলে, নদ ও নদীর সঙ্গে শাখা থাকা না-থাকা নিয়ে কোন সম্পর্ক নেই। এটি সম্পূর্ণ ব্যাকরণগত এবং ভারতীয় পুরাণ বা প্রচলিত প্রবাদের উপর নির্ভরশীল। আমাদের উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে নদ ও নদীকে যথাক্রমে নারী ও পুরুষ হিসেবে ভাগ করার পেছনে পুরাণ, ধর্মীয় ও লোকজ বিশ্বাসের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শাখা থাকুক আর নাই থাকুক, ব্রহ্মার পুত্র ব্রহ্মপুত্রকে মেয়ে ভাবার কোন সুযোগ নেই। তেমনি হিমালয়দুহিতা গঙ্গা, সে তো নারী ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। পারে কি?————————————–সর্বজনীন/সার্বজনীন—————–‘সর্বজনীন’ ও ‘সার্বজনীন’ উভয় শব্দ শুদ্ধ কিন্তু অর্থ ভিন্ন। তাই দুটো শব্দকে অভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা সমীচীন নয়। অনেকে ‘সর্বজনীন’ অর্থে ‘সার্বজনীন’ লিখে থাকেন। শব্দ দুটোর আভিধানিক অর্থ না-জানার জন্য এমন ভুল হয়। ‘সর্বজনীন’ শব্দের অর্থ ‘সকলের মঙ্গল বা সবার হিত বা কল্যাণ বা সকলের মঙ্গলের জন্য কৃত বা সকলের জন্য উদ্দিষ্ট’। যেমন :‘মানবাধিকার সর্বজনীন অধিকার হিসেব স্বীকৃত।’ অন্যদিকে, ‘সার্বজনীন’ শব্দের অর্থ ‘সবার মধ্যে প্রবীণ বা সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠ’। যেমন: (১) নেলসন মেন্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার একজন সার্বজনীন নেতা। (২) সার্বজনীন দুর্গাপূজায় আপনাকে স্বাগত’। দ্বিতীয় বাক্যের অর্থ হচ্ছে : সর্বশ্রেষ্ঠ দুর্গাপূজায় আপনাকে স্বাগত। সুতরাং ‘সবার হিতের জন্য’ অর্থে ‘সকলের মধ্যে প্রবীণ বা সবার মধ্যে শ্রেষ্ঠ’ বলা বিধেয় নয়। অনেকে মনে করেন ‘সার্বজনীন’ শব্দটি ভুল কিন্তু এটি ভুল নয়। তবে ‘সর্বজনীন’ অর্থে সার্বজনীন’ শব্দের ব্যবহার কখন সমীচীন তা ভেবে দেখা প্রয়োজন

  • কর্নেল তাহের এবং ৭ই নভেম্বর

    কর্নেল তাহের এবং ৭ই নভেম্বর


    তাহেরা বেগম জলি
    জাসদ রাজনীতির অনেক কিছুই আজ আমার কাছে শুধুই স্মৃতি বা ইতিহাস। তবে সব স্মৃতি তো মুছে যায় না। এবং আমি চাইলেও তা যায় না। আবার এমন অনেক অতিত আছে, যে অতিতকে শুধু স্মৃতি বলেও পাশ কাটানো যায় না। শহীদ কর্নেল আবু তাহের আমার কাছে তেমনই এক ইতিহাস,যা শুধুই স্মৃতি বা অতিত নয়-আমার জীবনেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।


    কর্নেল তাহের হত্যা মামলা পরিচালনা করবার সময় আমি ঢাকা কারাগারের বাসিন্দা ছিলাম। এটা আমার জীবনের একটা মস্তবড় দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার মাত্র ছয় বছরের মাথায় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সেই যুদ্ধেরই একজন সেক্টর কমান্ডারের হত্যাকান্ডের সাক্ষী হতে হয়েছে। শ্রদ্ধেয় সালেহা বেগম এই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন। এবং তিনি পাঁচ বছর কারাবাসে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ১৯৭৬য়ের মধ্য জুনে ( আমার যদি ভুল না হয়,মামলা শুরু হয়েছিলো ১৭ই জুন ) শুরু হওয়া মামলার রায় এক মাস পর ১৯৭৬-১৭ই জুলাই ঘোষণা করা করা হয়। রায় ঘোষণার পর সালেহা আপা যখন আমাদের নির্ধারিত সেলে ফিরে এলেন,আমরা সকলেই তখন জানতে চেয়েছি তাহের ভাইয়ে কী হোলো। আমরা মানে শিরীন আপা এবং আমি সহ আরও দুই চার জন। সালেহা আপা সেদিন মুখ ফুটে বলতে পারেননি তাহের ভাইয়ের ফাঁসির দ-ের কথা। অনেক কষ্টে বলেছিলেন কী আর হবে,যা হবার তাই হলো। আমরা ঐ সময়ে নিজেদের কথা বলার ধরণ বা আকার ইঙ্গিত বুঝতে পারতাম। তাই ঐটুকুতে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি তাহের ভাইয়ের ফাঁসির দ-াদেশের কথা। রায় ঘোষণার পরদিনই ১৮ ই জুলাই সালেহা আপাকে বরিশাল কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে ১৭ই জুলাই থেকে-তাহের ভাইকে নিয়ে কারা কতৃপক্ষের ব্যস্ততার গল্প আমাদের কানে আসা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। বা আমরাও চেষ্টা করতাম সে সব খবর জানতে। মামলা চলাকালীন প্রতিদিনের ঘটনা আমরা সালেহা আপার কাছেই জানতে পারতাম। এবং তা জানবার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকতাম। তাছাড়া কারাগারে কোন কিছুই গোপন থাকে না। বিশেষ ক’রে রাজনৈতিক বন্দীদের ব্যাপারে। মুখে মুখে সকলেই তা জেনে যায়। তাহের ভাইকে ২০ তারিখে জরুরী ভিত্তিতে তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করানোর সংবাদ যথারীতি আমাদের কানে এলো। তখন আমাদের অনুমান করতে দেরি হয়নি,সহসাই আমাদের জন্য একটা বড় ধরণের দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। অবশেষে এলো সেই নির্মম রাত, যে রাত সকাল হতেই আমরা জানতে পেরেছিলাম,তাহের ভাইয়ের মরদেহ জেলগেটে।


    ২১শে জুলাই সকাল। অন্যান্য দিনের মতোই খুব ভোরে আমাদের সেলের তালা খুলে দিয়ে সুবেদার সাহেব চাবি নিয়ে চলে গেছেন। আমাদের মনটা একেবারেই ভালো ছিলো না,কারণ চারিদিকে ঘটছিলো এমন কিছু ঘটনা,যেখানে আমাদের করবার কিছুই ছিলো না। কিন্তু আমাদের জন্য তা ছিলো অত্যন্ত বেদনার। আমরা বিষণ্ণ মনে নিজেদের মধ্যে এই সব কথাই বলাবলি করছিলাম। আমরা নিজেদের মধ্যে আরও বলাবলি করছিলাম,তাহের ভাইকে পরিবারের সঙ্গে যেহেতু বিশেষভাবে দেখা করানো হয়েছে,তাহলে পরিস্থিতি নিশ্চয় ভালো নয়। আমাদের মুখের কথা মুখেই আছে,সকালের দায়িত্বপ্রাপ্ত জমাদ্দার্নী এর মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললেন,আপনারা সব সেলে ঢোকেন। তাহের সাহেবের মরদেহ জেল গেটে দেখে এলাম। আপনাদের সেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুবেদার সাহেব সে রকমই ব্যস্ত হয়ে এসে,আমাদের সেলের দরজায় তালা লাগিয়ে কোনো কথা না বলে চলে গেলেন। আমরা তখন জেলের মধ্যে সেল বন্দী হয়ে রইলাম। এবং সেই সেলবন্দী ছিলাম পাঁচ দিন। সেদিন সেলবন্দী করা হয়েছিলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রায় সকল রাজবন্দীকেই। সেলবন্দী হলেও আমরা সহ গোটা জেলখানা হয়ে উঠেছিল বেশ সরগরম। কারণ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অধিকাংশ বন্দীবাসিন্দা এবং কর্মকর্তা কর্মচারীরা তাহের ভাইকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। শহীদ কর্নেল আবু তাহের মানুষকে ভালবাসতেন এবং মানুষের ভালোবাসা তিনি আদায় করে নিতেও জানতেন। সম্ভবত তাহের ভাইয়ের রাজনৈতিক প্রভাব পড়েছিলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রায় সকলের উপরই। তাঁর রাজশক্তি মোকাবেলা করবার সাহস দেখে সকল রাজবন্দিই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ২১ জুলাই সকালে আমাদের সকলের কষ্ট দুঃখ তাই একাকার হয়ে গিয়েছিলো। তিনদিন আগে ঘোষণা করা কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ-, ২১ জুলাই ভোরে চোরের মতো কার্যকর করেছিলো তৎকালীন স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান। এবং এটা ছিলো নজিরবিহীন একটা নিকৃষ্ট-বর্বর ঘটনা। সভ্য জগতের সমস্ত নিয়ম ভেঙ্গে তাহের ভাইয়ের মামলা পরিচালনা করা হয়েছিলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে,এবং সে মামলার আদালত ছিলো মিলিটারি শাসিত। সেখানে কোনো অভিযুক্তদের স্বাধীন মতো আইনজীবী নিয়োগের অধিকার দেওয়া হয়নি। যদিও পরবর্তী সময়ে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি,কোনো কোনো সামরিক আদালতে বন্দীদের নিজেদের আইনজীবী নিয়োগের অধিকার দেওয়া হয়েছে। অথচ কর্নেল তাহেরকে নিয়ে গঠিত আদালতে,স্বাধীন মতো নিজেদের কথাও উপস্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। তার মানে দাঁড়ায় অন্যান্য সামরিক আদালতের থেকেও নিকৃষ্ট ছিলো কর্নেল তাহের মামলার সামরিক আদালত। ন্যাক্কারজনক এসব ঘটনা আমাদের দেশের সকল সচেতন মানুষই জানেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকার সুবাদে,ঐরকম একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়ার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিলো। যা আমার কাছে আজও একটা দুঃসহ স্মৃতি। সে সময় প্রতিটা মুহূর্তই আমরা পার করেছিলাম কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা নিয়ে। এতো কষ্টকর পরিস্থিতি অন্তত আমার জীবনে আর কোনোদিন আসেনি। ফাঁসির দ- ঘোষণার পর,শহীদ কর্নেল আবু তাহেরকে তিনদিন অতিক্রমের সময়ও দেওয়া হয়নি। কর্নেল তাহের ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার। স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র ছয় বছর আগে। এত কিছু বাদ দিলেও একটা স্বাধীন দেশের,একজন সাধারণ নাগরিকের যে অধিকার থাকে,তাহের ভাইকে সে অধিকারও দেওয়া হয়নি। তাহের ভাইয়ের সকল মানবিক অধিকার সেদিন হরন করা হয়েছিলো অত্যন্ত নিকৃষ্ট এবং নির্মমভাবে। জেনারেল জিয়াউর রহমান অবশ্য এই হত্যাকা-ে ফেলেছিলো স্বস্তির নিঃশ্বাস। যদিও আমাদের মতো অসংখ্য মানুষের চিরদিনের জন্য তা হয়ে রইলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস। একটা গৌরবের কথা এখানে বলি,চারিদিকের নিদারুণ সংকটে জড়িয়ে থাকা জাসদের নেতা কর্মীরা সেদিন কিন্তু সব বাঁধা অতিক্রম ক’রে বিক্ষোভ করেছিল। জাসদের নেতা কর্মীরা রীতিমত বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলো তাদের প্রিয় নেতার মর্মান্তিক হত্যাকা-ে। আজ সময় পাল্টেছে অনেক,পানি গড়িয়েছে অনেকদুর। কিন্তু তার পরেও তাহের হত্যাকারী এবং হত্যাকারীদের পদলেহনকারীদের ভুলে যাওয়া আমাদের মতো অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই,এই কথা আওড়ে যারা কালে কালে একাকার হয়েছেন তাহের হত্যাকারী বা হত্যাকারীর দলের সঙ্গে,যারা যে কোন ধরনের নিকৃষ্ট উপায় সহজ করবার ফন্দি হিসেবে বলে থাকেন রাজনীতি ব’লে কথা,হোক না তাহেরের খুনি,তবুও আমার বা আমাদের তরী ঐ ঘাটেই বাঁধবো। তারা নিক্ষিপ্ত হোক ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। জনতা প্রস্তুত করুক সেই বিচারাসন,যেখানে তাহের হত্যাকারী এবং তার পদলেহীদের বিচার যেন হয় একই মানদ-ে।
    ৭ই নভেম্বর এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবেই এসে দাঁড়ায়। আমি ৭ই নভেম্বরকে যতটা রাজনৈতিক ভাবে দেখি তার থেকেও বেশি দেখি মূল্যবোধের ঢাল হিসেবে। ৭ই নভেম্বর নিয়ে এতদিনে অনেকে অনেক কিছুই লিখেছেন। পাঠক হিসেবে আমি লক্ষ্য করেছি দুই একটা লেখার মধ্যে শহীদ কর্নেল আবু তাহেরকে বেশ কিছুটা ম্লান ক’রে দেওয়া হয়েছে। তবে তা ইচ্ছাকৃত করা হয়েছে এমন নাও হতে পারে। আবার তা হতেও পারে। আমি মনে করি কোনো লড়াই মানেই সব সময় তা সফলতার হিসাব নয়। পৃথিবীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লড়াই সংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার প্রমাণ আছে। সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। বা চট্টগ্রাম ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ এখানে স্মরণযোগ্য। প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরপিয়ান ক্লাবে আক্রমণ করবার আগে সেখানে আরও দুইবার হামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। এবং দুইবারই তা ব্যর্থ হয়। কিন্তু তৃতীয়বার যখন প্রীতিলতার নেতৃত্বে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়,তখন আগের দুই হামলার বীরদের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। তাছাড়া ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অনেক আক্রমন শুরুর দিকে তো ব্যর্থতার চাদরেই মোড়া ছিলো। ধীরে ধীরে সেই সব আন্দোলনের পথ পরিশীলিত হয়েছে। এবং মানুষ তখন বুঝতে আরম্ভ করেছে ব্যর্থতা আসলে সাময়িক একটা ব্যাপার। প্রতিটা আন্দোলনের মধ্যেই পথের নিশানা থাকে। এখানে কথা উঠতে পারে সেই আন্দোলন এবং ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থান একেবারেই এক নয়। আমিও তা অস্বীকার করিনা। তবে আমি মনে করি ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক ভ্রান্তির পুরো দায় সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের। শহীদ কর্নেল আবু তাহের সেখানে ছিলেন পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী। বা বিশেষ সময়ের নেতৃত্ব দানকারী। সঙ্গতকারণেই সমালোচনার কেন্দ্র বিন্দু হবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল। শহীদ কর্নেল আবু তাহের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একটা জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন এটা হতে পারে। কিন্তু তারপরেও তিনি অন্যদের সঙ্গে মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে সিদ্ধান্ত ছিলো দলীয়। তাই রাজনৈতিক ভ্রান্তির শতভাগ দায় সংশ্লিষ্ট দলেরই নিতে হবে। ৭ই নভেম্বরের গোলকধাঁধা থেকে শহীদ কর্নেল আবু তাহেরের বেরিয়ে আসা হয়তো আর সম্ভব ছিলো না। তবে তিনি যা পারতেন সে দায়িত্ব তিনি শতভাগ পালন করেছেন। তাঁর এই নিষ্ঠা এবং বীরত্বের চরিত্র যদি কেউ ছোট করবার চেষ্টা করে,তারা কিছুতেই মানব বান্ধব নয়। লড়াই সফলতার মুখ দেখবে না,হয়তো তিনি তা বুঝতে পেরেছিলেন। এবং যে কোনো লড়াইয়ের নেতারা এটা বুঝতে পারেন। তারপরেও শহীদ কর্নেল আবু তাহের সেখানে ছিলেন অবিচল আত্মনিবেদিত মানুষ। তিনি যা পারতেন-আত্মবলিদানে অবিচল থাকা। সেই আত্মবলিদানের মঞ্চে সেদিন তিনি পৃথিবী সেরা মানুষদের সারিতে উঠে এসেছিলেন এবং তা আজও তিনি আছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ কর্নেল আবু তাহের আপসহীন জীবনের অসাধারণ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। যা আমাদের দেশের আগামী যে কোনো আন্দোলন সংগ্রামের আলোবর্তিকা হয়ে কাজ করবে।


    আজ ৭ই নভেম্বর, আমার কাছে ৭ই নভেম্বর এবং ২১ জুলাই সময়ের ফারাক ছাড়া আর কিছু নয়। আজ তাহের ভাইকে জানাই সস্রদ্ধ সালাম। শেষে আমি স্পার্টাকাসের একটা উক্তি দিয়ে আমার লেখা শেষ করবো।
    “আমার ব্যর্থ বিদ্রোহ শত শত সার্থক বিদ্রোহের জন্ম দিয়ে গেলো।”

  • আজ জেল হত্যা দিবসআজও আমরা বিচার প্রার্থী

    আজ জেল হত্যা দিবস
    আজও আমরা বিচার প্রার্থী

    জহুরুল কবীর:

    আজ সেই ভয়াল-বীভৎস্য ৩ নবেম্বর। ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে।
    বাঙালী জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতে ৪৫ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ জাতির চার সূর্যসন্তান, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পরিচালক, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ-ঘনিষ্ঠ সহচর বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় এমন জঘন্য, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকা- পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
    জেল হত্যাকা-ের পর ওই সময়ই লালবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর এ হত্যাকা-ের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার জেলহত্যা মামলার প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করে। এরপর দীর্ঘ ৮ বছরেরও বেশি সময় বিচারকাজ চলার পর বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করে। রায়ে ২০ আসামির মধ্যে ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তার শাস্তি এবং অপর ৫ জনকে খালাস দেয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক তিন আসামির মৃত্যুদ- এবং অপর ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়।
    মৃত্যুদ-প্রাপ্তরা হলো দফাদার মারফত আলী শাহ, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ওরফে হিরন খান ও এলডি দফাদার মোঃ আবুল হাসেম মৃধা। যাদের যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয় তারা হলো- কর্নেল (অব) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব) সৈয়দ শাহরিয়ার রশীদ, মেজর (অব) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ (বরখাস্ত), লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব) এমএইচএম বি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, লে. কর্নেল (অব) এএম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মোঃ কিসমত হোসেন এবং ক্যাপ্টেন (অব) নাজমুল হোসেন আনসার। খালাসপ্রাপ্তরা হলো বিএনপি নেতা মরহুম কে এম ওবায়দুর রহমান, জাতীয় পার্টি নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সাবেক মন্ত্রী মরহুম তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, নুরুর ইসলাম মঞ্জুর এবং মেজর (অব) খায়রুজ্জামান।
    ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকের্টের রায়ে কেবল রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদ- বহাল রেখে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি দফাদার মোঃ আবুল হাসেম মৃধা এবং যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত অপর চার আসামি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব) শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব) বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে মামলা থেকে খালাস দেয়া হয়। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত ওই চার আসামির চারটি আপীল ও রাষ্ট্রপক্ষের ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করে হাইকের্টের একটি বেঞ্চ এ রায় দেয়।
    তবে জেল হত্যাকা-ের সুদীর্ঘ সময় পর এর বিচারের রায় হলেও জাতীয় নেতার পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন মহল থেকে ওই সময়ই রায়টিকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ও ‘প্রহসনের রায়’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। একই সঙ্গে রায়টি প্রত্যাখ্যানও করা হয়। তাদের অভিযোগ, জেল হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে কাউকে শাস্তি দেয়া হয়নি। জাতির ইতিহাসের নৃশংসতম এই হত্যাকা-ের পুনঃতদন্ত ও পুনঃবিচার দাবি করেন তারা।
    অবশ্য জেলহত্যা মামলায় খালাস পেলেও লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব) শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব) বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ- এই চারজন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত হওয়ায় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি এদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ে পলাতক অপর আট যাবজ্জীবন কারাদ- পাওয়া আসামি সম্পর্কে কোন মতামত না দেয়ায় তাদের দ- বহাল আছে বলে আইনজীবীরা ব্যাখ্যা দেন।
    ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ায় জেল হত্যাকা-ের পুনঃবিচারের সুযোগ আসে। ২০১২ সালের ১ নবেম্বর সরকারপক্ষ জেলহত্যা মামলার আপীল বিষয়ে সারসংক্ষেপ সুপ্রীমকোটের আপীল বিভাগে জমা দিলে পুনঃবিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল আপীল বিভাগের চূড়ান্ত সংক্ষিপ্ত রায়ে ২০০৮ সালের হাইকোটের রায় বাতিল করে ২০০৪ সালের নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখা হয়। অর্থাৎ পলাতক তিন আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ওরফে হিরন খান, দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি দফাদার মোঃ আবুল হাসেম মৃধাকে মৃত্যুদ- এবং অন্য ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। সুদীর্ঘ বছর পর বাঙালী জাতি পায় কাঙ্খিত বিচার। আমরা চাই রায় কার্যকর হোক।

  • জাসদ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে তরুণদের প্রতি –

    জাসদ প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে তরুণদের প্রতি –

    শিরীন আখতার

    ৩১ অক্টোবর ২০২০ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ-এর ৪৮তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ১৯৬২ সালের ডিসেম্বরে যারা ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ বা ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেছেন, ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত যাঁরা পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে কাজ করেছেন, ১৯৬৬ সাল থেকে যাঁরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত ছয় দফাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের টুল বা উপায় হিসেবে গ্রহণ করে নিবেদন করেছেন জীবনের সর্বস্ব, শিক্ষা-গণতন্ত্র-প্রগতি ও প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো যাঁরা বুদ্ধিমত্তার সাথে টেনে এনেছেন ‘স্বাধীনতা’র দিকে, যাঁরা ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’ বা ‘জয়বাংলা বাহিনী’র উত্তরাধিকার হিসেবে নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক-সামরিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-বিএলএফ’ বা ‘মুজিব বাহিনী’ গঠন করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন ও বিজয়ী হয়েছেন— তাঁরাই গঠন করেছেন জাসদ। এঁদের প্রায় সকলেই ছিলেন ছাত্র, তরুণ ও যুবক। জাসদ গঠনকারী নিউক্লিয়াসের ছাত্র-তরুণ-যুবকগণ ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান প্রবর্তন করেছেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধা দিয়েছেন, জাতীয় পতাকা তৈরি-প্রদর্শন-উত্তোলন করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনাক্রমে জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করেছেন। অন্য কোন দল নয়। ১৯৭২-১৯৭৫ সময়কালে সমগ্র বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের লাল ঝাঁন্ডার এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল; লড়াই চলেছিল দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী এ পতাকাতলে সমবেত হয়েছিলেন। এ সময় প্রায় ৯৮ ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেন এই তরুণগণ। তারুণ্যের জয়গানে দীপ্ত ছিল রাজপথ। শহরে- গ্রামে-গঞ্জে জ্বলে উঠেছিল অগ্নিমশাল। শ্রমিক-কৃষক-তরুণ-যুবগণ হাতে হাত মিলিয়ে লড়াই-সংগ্রাম শুরু করেছিলেন চোরাকারবারী-মুনাফাখোর-মজুদদারদের বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লক্ষ শহীদদের লাশ, সে লাশের গন্ধ আকাশ-বাতাস তখনও ভরেছিল। অস্ত্র হাতে তরুণগণ লড়াই ছেড়ে ঘরে ঢুকে যেতে পারেননি। ক্ষমতা নির্মাণ করে জ্ঞান, সে জ্ঞান আবার ক্ষমতাকে যুক্তি ও ভিত্তি দেয়। বাংলাদেশের গত ৪৯ বছরের বড় একটা সময়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৬ সালের জুন পর্যন্ত পাকিস্তানপন্থার সামরিক-বেসামরিক স্বৈরতন্ত্র একটা ইতিহাস তৈরি করেছিল— যেখানে প্রজাতন্ত্রের জনক বঙ্গবন্ধুর সমান্তরাল নেতৃত্ব হিসেবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারি জিয়াউর রহমানকে উপস্থাপন করা হয়েছিল শিক্ষাঙ্গণগুলোতে ‘স্বাধীনতার ঘোষক জিয়া— লও লও লও সালাম’ শ্লোগান দিয়ে।প্রশ্ন হতে পারে, নিউক্লিয়াসপন্থিরা স্বাধীনতার জন্য যদি এত কাজ করে থাকেন তাহলে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে তারা জাসদ গঠন করলেন কেন? এখানে নির্দ্বিধায় বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের পর আগের দশ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের রূপকার ও নিয়ামক ভূমিকায় যাঁরা ছিলেন, তাঁদেরকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল আওয়ামী রাজনীতির অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সুরা। ফলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ‘বিপ্লবী জাতীয় সরকার’ গঠিত হতে পারেনি আর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে নিউক্লিয়াস ও ছাত্র-তরুণ-যুবকদের কোনো প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করতে পারেননি; বিপ্লবোত্তর দেশে যেরকম হয়— সমাজের সেরকম আমূল পরিবর্তন হয়নি। বরং স্বাধীনতার পর থেকে জনপ্রশাসন, সামরিক-বেসামরিক গোয়েন্দা বিভাগ ও সশস্ত্র বাহিনী থেকে শুরু করে সংস্কৃতি-রাজনীতি পর্যন্ত সবকিছু পাকিস্তানপন্থার করায়ত্ব হয়েছিল। অনেক দুঃখভরে ফিদেল ক্যাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন— মহামান্য, আপনি শেষ, আপনি পুরোনো জনপ্রশাসন বহাল রেখেছেন। পরিতাপের বিষয়, পুনর্বাসিত পাকিস্তানপন্থা প্রথমে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে; পরে কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে হত্যা করেছে ও জাসদ-ধ্বংসে নিয়োজিত হয়েছে।নিউক্লিয়াসপন্থিদেরকে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয়ার পাশাপাশি জাসদ গঠনে ভূমিকা রেখেছে আওয়ামী রাজনীতির সাথে নিউক্লিয়াসপন্থিদের মতাদর্শগত বিতর্ক ও ভিন্নমত— জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণ ও অবস্থান।বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৫ বছর ধরে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও জাসদকে অপরাপর দলকে সাথে নিয়ে লড়তে হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য। নব্বইয়ের ছাত্র_গণঅভ্যুত্থানে_যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি তারা কিছুটা হলেও মুক্তিযুদ্ধের স্বাদ পেয়েছিল। সামরিক শাসন ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াই ছিল মুক্তিযুদ্ধে গড়া বাংলাদেশ ফিরে পাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এবারও সে তরুণ-যুবকগণ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন; এঁদের সাথে ছিলেন বুদ্ধিজীবী-নারী-শ্রমিক-কৃষক-সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ। অভূতপূর্ব এ গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য তরুণগণ আবারও ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আপোষহীন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সেনাশাসনকে পরাজিত করে গণতন্ত্রের ঝান্ডা উড়িয়েছিলেন।কিন্তু গণতন্ত্রের নামে ১৯৯০ সাল থেকে ক্ষমতায় একবার মুক্তিযুদ্ধের দল একবার রাজাকারের দল— এই মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা চলতে থাকে, যে খেলায় গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী রাজাকারের দল জামাত ও সামরিক স্বৈরাচারের গর্ভজাত দল বিএনপি জঙ্গিবাদ বিকশিত করতে থাকে। এরা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দকে জানে মেরে ফেলার মিশন নিয়ে মাঠে নামে।২০০২ সাল থেকে জাসদের প্রয়াসে, ২০০৩ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ও জাসদের সমান্তরাল প্রয়াসে, ২০০৪ সালে ১৪টি দলের যুগপৎ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়, ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই ১৪ দলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে, ২০০৭-২০০৮ সালের ওয়ান-ইলেভেনের ষড়যন্ত্রকাল উৎরিয়ে, ১৪ দলের সাথে অপরাপর দল নিয়ে ‘মহাজোট’ নামের নির্বাচনী সমঝোতা করে, ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয় ১৪ দল ও মহাজোটের সরকার। বিএনপি-জামাত জোট ১৪ দল ও মহাজোট সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে পরিচালনা করে ৯৩ দিনের আগুনসন্ত্রাস; হত্যা করতে থাকে শিশু ও শ্রমিকসহ জনপরিবহনে ভ্রমণকারী সাধারণ নাগরিকদের।১৪ দল ও মহাজোট সরকার এখন তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায়। জামাত-বিএনপি কিছুটা কোনঠাসা হয়েছে; কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র থেমে নেই। এদের সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে; কিন্তু লড়াইয়ের মাঠে সামনে আনতে হবে দুনীতি-লুটপাট-দলবাজি-অনাচার-অত্যাচার-নিপীড়ন-ধর্ষণ প্রতিরোধে সুশাসন ও আইনের শাসনের সংগ্রাম ও সকল ধরনের ভেদ-বিভেদ-অসমতা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সমাজ পরিবর্তনের সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম।আবারও এ সংগ্রামে প্রয়োজন তরুণ ও যুব সমাজের অংশগ্রহণ_ বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো লড়াইয়ের সামনের কাতারে থেকেই পরাজিত করতে হবে সকল অত্যাচার-ধর্ষণ-নিপীড়নের হাত। তারুণ্যের জোরালো শক্তিশালী লৌহকঠিন ঐক্যের বন্ধন যদি তৈরি করা না যায় তাহলে মার খাবে গণতন্ত্র। পদদলিত হবে সমাজ পরিবর্তনের কলাকৌশল। তাই আজ ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তারুণ্যের অভিযাত্রা। তারুণ্যের এই অভিযাত্রা শুরু করতে চায় জাসদ।অতীতে জাসদ ইতিহাস চর্চার সময় পায়নি; আর জাসদ ইতিহাসের গৌরব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চায় না; জাসদ চায় বর্তমানের সমস্যা মোকাবেলা করে ভবিষ্যৎ-যাত্রা। এ যাত্রায় জাসদ তরুণদের সাথে পেতে চায়; এখানে তরুণদের উপলব্ধি করতে হবে সামাজিক আন্দোলন দিয়ে অনেক কিছু অর্জন করা যায়, ক্ষমতা অর্জন করা যায় না; আর ক্ষমতা না থাকলে আমূল পরিবর্তন করা যায়না। ক্ষমতা অর্জন করতে, ক্ষমতাহীনদের ক্ষমতা দিতে, অবশ্য-দরকার হলো রাজনৈতিক আন্দোলন। এ r জাসদ তরুণদের স্বাগত জানায়; জাসদ তরুণদের যে কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে সবসময় প্রস্তুত; জাসদ রাজনীতির অ্যাজেন্ডায় তারুণ্যের দিকনির্দেশনা চায়।(লেখক: সংসদ সদস্য, সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ও প্রধান উপদেষ্টা, জাতীয় শ্রমিক জোট-বাংলাদেশ।)

  • আন্তর্জাতিক খাদ্য দিবস : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

    আন্তর্জাতিক খাদ্য দিবস : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ


    ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার পাশাপাশি স্থুলতা ও অপুষ্টিজনিত জটিলতার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৪৫ সাল থেকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা (এফএও) প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর বিশ^ খাদ্য দিবস পালন করে আসছে। এই বছর বিশ^ খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে- ‘এৎড়,ি ঘড়ঁৎরংয, ঝঁংঃধরহ. ঞড়মবঃযবৎ’। আমাদের সরকার এই বছর প্রতিপাদ্য ঠিক করেছে, “সবাইকে নিয়ে একসাথে বিকশিত হোন, শরীরের যতড়ব নিন, সুস্থ থাকুন, আমাদের কর্মই আমাদের ভবিষ্যৎ”।
    একই সাথে প্রতিবছর ১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়। এই বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হয়েছে “কৃষি ও গ্রামীণ উনড়বয়ন, খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং গ্রামীণ দারিদ্র্য নিরসনে নৃ-গোষ্ঠীর নারীসহ গ্রামীণ নারীর ভূমিকা ও অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ”। এছাড়া প্রতি বছর ১৭ অক্টোবর বিশ^জুড়ে আন্তজার্তিক দারিদ্র্য নিরসন দিবস পালিত হয়। সেই সাথে প্রতি বছরের এই মাসে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থা (এফএও)-র ’খাদ্য নিরাপত্তা কমিটি’ এবং ‘খাদ্য বিষয়ক সিভিল সোসাইটি ম্যাকানিজম’-এর ক্সবশি^ক সভা অনুষ্ঠিত হয়।
    তাই বাংলাদেশের সকল মানুষের জন্য সাং¯‥ৃতিভেদে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বাংলাদেশে খাদ্য অধিকার বিষয়ক আইন প্রণয়নের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার পক্ষে জনমত, আগ্রহ ক্সতরি এবং আইনপ্রণেতা, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনিক পর্যায়ে সংবেদনশীলতা ক্সতরির জন্য অক্টোবর মাসজুড়ে দেশব্যাপী খাদ্য অধিকার প্রচারাভিযান করছে।
    খাদ্য অধিকার প্রতিটি মানুষের ক্ষুধা, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং পুষ্টি বিষয়ক অধিকার রক্ষা করে। খাদ্য অধিকার একজন মানুষের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত। আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে, নাগরিকের খাদ্য অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ২৫ অনুচ্ছেদে এবং অর্থনৈতিক-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তির ১১তম অনুচ্ছেদে খাদ্য অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। একই সাথে বিশ্বব্যাপী অসংখ্য দেশের সংবিধানে খাদ্য অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে।
    সাংবিধানিকভাবে খাদ্যের অধিকার অর্জন এবং জনগণের পুষ্টিমান উনড়বয়নে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাছাড়া বাংলাদেশ বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সদস্য এবং ভিয়েনা ঘোষণা ১৯৯৩, ইকোসোক-সহ বিভিনড়ব আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে সমর্থন প্রদান করেছে। কিন্তু, এখনো বাংলাদেশের সংবিধান ১৫(ক) অনুচ্ছেদে খাদ্যকে জীবনধারণের মৌলিক প্রয়োজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মাত্র। যার কারণে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের কোন জায়গায় আবেদন-নিবেদন করার বা দাবি করার মতো কোনো সুযোগ নেই। যদিও দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি চাহিদা পূরণের জন্য বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ সরকার কৃষিঋণ, কর্মসৃজন কর্মসূচি, দু:স্থভাতাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি ও নীতিমালা গ্রহণ করেছে, কিন্তু খাদ্যের অভাবে অমানবিক ও অসহায় অবস্থায় উপনীত হবার পরও কাউকে দায়বদ্ধ করার আনুষ্ঠানিক সুযোগ নেই, যতদিন না খাদ্যকে অধিকার হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ইতোমধ্যে আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, ব্রাজিল, ইক্যুয়েডর, এল সালভেদর, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, মেক্সিকো, মোজাম্বিক, নিকারাগুয়া, প্যারাগুয়ে, পেরু, দক্ষিণ আফ্রিকা, তানজানিয়া, উগান্ডা, নেপাল ও ভেনেজুয়েলা ইত্যাদি দেশে খাদ্য অধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
    জাতিসংঘে গৃহীত টেকসই উনড়বয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-এর দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো, ক্ষুধার সমাপ্তি, খাদ্য নিরাপত্তা ও অধিকতর পুষ্টি অর্জন এবং টেকসই কৃষি প্রবর্তন। এছাড়া লক্ষ্য ৩-এর আওতায় সবার জন্য স্বাস্থ্যকর জীবন, লক্ষ্য ৬-এর আওতায় পানীয় জলের সরবরাহ, লক্ষ্য ১০-এ আভ্যন্তরীণ অসমতা দূরীকরণ,
    লক্ষ্য ১২-তে টেকসই উৎপাদন ও ভোগ, লক্ষ্য ১৫-তে স্থলজ প্রতিবেশ ও বন সংরক্ষণ এবং লক্ষ্য ১৬-তে জবাবদিহিতা ও অন্তর্ভূক্তিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। এ দলিলে ২০৩০ সালের মধ্যে সব ধরনের ক্ষুধা নির্মূল করা, অপুষ্টি দূর করা, প্রাকৃতিক সম্পদসহ সব সম্পদে ক্ষুদ্র কৃষকদের ন্যায্য প্রবেশাধিকার দেয়া, কর্মসংস্থান ও আয়ের ক্ষেত্রে ক্সবষম্য দূর করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
    কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বব্যাপী প্রশংসনীয়। তারপরও বৈশিক বিবেচনায় বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তা সূচক-২০১৯ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১১৩ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৩ তম। যা, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তলানিতে। এই সূচক দেশের খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতির পাশাপাশি প্রান্তিক কৃষক ও ভবিষ্যৎ খাদ্য সঙ্কটের চিত্রও তুলে ধরে। ২০১৯ এর সূচক অনুযায়ী, পুষ্টিকর খাদ্যের μয়ক্ষমতা, প্রাপ্যতা ও গুণমানের সমন্বয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্জন ৫৩.২। সামগ্রিকভাবে তা সন্তোষজনক হলেও খাদ্য নিরাপত্তা ও খাদ্য মানে অনেকখানি পিছিয়ে (৩০.৬ পয়েন্ট)১।
    বাংলাদেশ যখন এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পিছনে ছুটছে, তখন এই দেশেরই খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি অধিকার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী (ডাব্লিউএফপি) এবং বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত ‘খাদ্যের সহজলভ্যতা ও μয়ক্ষমতা’ বিষয়ক সমীক্ষায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রতি ৮ জনের মধ্যে ১ জনের পুষ্টিকর খাবারের μয়ক্ষমতা নেই। শুধুমাত্র সঠিক পুষ্টির অভাবে দেশের ৩১ শতাংশ শিশুর শারীরিক বিকাশ হয় না২। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে মোট খাদ্যেও প্রায় ৩০ ভাগ বিভিনড়বভাবে নষ্ট হয়, যার আর্থিক মূল্য বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। দেশে প্রায় ৪ কোটি মানুষ পুষ্টিহীনতার শিকার এবং প্রায় ৪৪ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল দুর্গম এলাকার দলিত, আদিবাসী, বিভিনড়ব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও শহরের নিমড়বআয়ের মানুষের মধ্যে পুষ্টিহীনতা বেশি৩। একটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তার প্রথম শর্ত হলো, খাদ্যের জোগানের সাথে সে দেশের জনসাধারণের μয়ক্ষমতার সমন্বয় থাকা। বাংলাদেশ দানাদার খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও সার্বিকভাবে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে।
    গবেষণা বলছে, করোনার বিপর্যয় ঠেকাতে দেশের প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে লকডাউন থ আয়ের পথ বন্ধ হয়ে দরিদ্র-অতি দরিদ্র মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। এই সময়ে দেশে নতুন করে ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার (২২.৯%) মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশে সবমিলিয়ে ৭ কোটি দরিদ্র মানুষ দারিদ্র্য অবস্থায় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে৪। এশীয় উনড়বয়ন ব্যাংক বলেছিলো, করোনা লকডাউনের লম্বা প্রভাবে চলতি অর্থবছরে ১ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হারাবে বাংলাদেশ এবং চাকরি হারাবে অন্তত: ৯ লাখ মানুষ৫।
    দক্ষিণ এশিয়ার উনড়বয়নশীল এই দেশটির অর্থ‣নতিক ভিত্তি মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ওপর নির্ভরশীল। দেশের ৮৮ শতাংশ শ্রমশক্তি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত এবং এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ নিয়োজিত কৃষিখাতে। বাংলাদেশের জিডিপির এক তৃতীয়াংশ আসে এই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত থেকে৬। তাই করোনাভাইরাসের সংμমণ রোধে দেশজুড়ে সাধারণ ছুটি ঘোষণার নামে কার্যত লকডাউন করে দেওয়ার ফলে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত মানুষগুলোবিআইডিএস-এর ধারণা করেছে, করোনার প্রভাবে মার্চের শেষদিক থেকে আগস্ট পর্যন্ত, টানা লকডাউনে বছরের দ্বিতীয় ক্সত্রমাসিকে দেশে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। শহুরে শ্রমিকের আয় কমেছে ৮০ শতাংশ, গ্রামীণ শ্রমিকের কমেছে ১০ শতাংশ৭ সেই সাথে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বলছে, দেশের পরিবারগুলোর আয় ২০.২৪ শতাংশ কমেছে। তবে খাদ্য নিরাপত্তার দিক থেকে বলতে গেলে, কৃষির ক্ষতি এক্ষেত্রে বড় প্রভাব ফেলতে চলেছে। করোনাকালীন কৃষিখাত ও সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তার প্রভাব নিয়ে ব্র্যাকের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে পরের দেড় মাসে কৃষি পণ্যের ক্ষতি, কম মূল্য; ইত্যাদির কারণে কৃষকের গড় আর্থিক লোকসানের পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার ৯৭৬ টাকা। সারা দেশের বিবেচনায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৬ হাজার ৫৩৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা৮।
    পিআিরসি ও ব্আিই্জিডির হিসাব মতে, করোনাকালীন সময়ে দেশে শহরাঞ্চলে মানুষের ৪৭ শতাংশ ও গ্রামের মানুষের ৩২ শতাংশ খাবারের পরিমাণ কমেছে। সরকারি তথ্য মোতাবেকই দেশের প্রায় পে․নে ৪ কোটি মানুষ (দরিদ্র ২১.৮ শতাংশ) পর্যাপ্ত খাবার গ্রহণ করতে পারতেন না। আর প্রায় ২ কোটির (অতি দরিদ্র ১১.৩ শতাংশ) কাছাকাছি মানুষ পর্যাপ্ত খাবার কেনার জন্য প্রয়োজনীয় আয় করতে পারতেন না। তারমানে, খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্কট আগ থেকেই ছিলো৯। করোনাভাইরাস দুর্যোগ আমাদের এই খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকিকে আরও ঘনীভূত এবং দীর্ঘমেয়াদী করবে। দুই হাজার ৬৭৫ জনের ওপর পরিচালিত ব্র্যাকের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা যায়, জরিপকালীন ১৪ ভাগ মানুষের ঘরে কোনো খাবার ছিল না। ২৯ ভাগের ঘরে ছিল এক থেকে তিন দিনের খাবার-এর তথ্য সেই ইঙ্গিতই বহন করছে।
    করোনাকালীন লকডাউনে এই খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলায় সরকারের গৃহীত নানান পদক্ষেপের মধ্যে ছিল ক্ষতিগ্রস্থদের ২,৫০০ টাকার নগদ অর্থ প্রদান, ১০ কেজি চাল প্রদান, অন্যান্য খাদ্য সামগ্রীর ত্রাণ প্রদান, খাতভিত্তিক প্রণোদনা ইত্যাদি। এইসকল উদ্যোগ লকডাউন চলাকালীন সময়ে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে এবং কার্যকর ভূমিকা পালনা করেছে। তবে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা অভাব, কার্যকারীতা ও সমন্বয়হীনতার ঘাটতি, অনিয়ম ও দুর্নীতি; ইত্যাদি কারণে এই সকল উদ্যোগে বিশৃঙ্খলা এবং সমালোচনাও ক্সতরি করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের একটি গবেষণায় দেখা যায়, শতকরা ৮২ শতাংশ এলাকায় সুবিধাভোগীর তালিকা প্রণয়নে রাজ‣নতিক বিবেচনাকে প্রাধাণ্য দেওয়া হয়েছে এবং ৪২ শতাংশ এলাকায় ত্রাণ বিতরণে কোন তালিকা অনুসরণ করা হয়নি। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৬০ শতাংশ এলাকায় বিচ্ছিনড়বভাবে ত্রাণ বিতরণের কারণে, ত্রাণ পাওয়ার প্রকৃত উপযুক্ত ব্যক্তিরা ত্রাণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এছাড়া, গবেষণা অন্তর্ভুক্ত এলাকার শতভাগ ক্ষেত্রেই অতি দরিদ্রদের নগদ সহায়তা (২,৫০০ টাকা) প্রদানের ক্ষেত্রে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে। ত্রাণ বিতরণে ২১৮টি দুর্নীতির ঘটনায় মোট ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৮৭০ কেজি ত্রাণের চাল উদ্ধার করা হয়েছে১০। পার্বত্য এলাকায় করোনাকালীন ত্রাণ বিতরণে বড় ধরণের অস্বচ্ছতার অভিযোগ রয়েছে। কম প্রত্যন্ত এলাকায় অনেক পরিবার ৩-৪ বার সরকারি খাদ্য সহায়তা পেলেও, বেশি প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে অনেক পরিবার একবারও পাননি।
    করোনার মাঝেই ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও দীর্ঘমেয়াদী চার দফা বন্যায় আবারও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কৃষিখাত, যা পুরো দেশের খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ৪৬ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আম্ফানের কারণে সারা দেশের ১ লাখ ৭৬ হাজার ৭ হেক্টর জমির বিভিনড়ব ফসল নষ্ট হয়। আম্ফানের পরপরই দেশের ৩৭টি জেলায় তিন দফার বন্যায় দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রত্যন্ত অঞ্চল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, কৃষিতেই ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ১২ লাখ ৭৩ হাজার কৃষক। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া ফসলি জমির পরিমাণ ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৪৮ হেক্টর, যার মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ এক লাখ ৫৮ হাজার ৮১৪ হেক্টর। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩২ হাজার ২১৩ হেক্টর জমির আউশ ধান, ৭০ হাজার ৮২০ হেক্টর জমির আমন ধান এবং ৭ হাজার ৯১৮ হেক্টর জমির আমন বীজতলা১১।
    বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। আর সেই পরিপ্রেক্ষিতে, সরকারি ত্রাণের এই হিসেব অনুযায়ী এই ৫০ লাখ বন্যা দুর্গত মানুষের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ৩ কেজি চাল। যেখানে বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে আড়াই কেজি। অন্যদিকে, মাথাপিছু নগদ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৮ টাকা মাত্র, বিতরণকৃত অর্থের হিসেব ধরলে দাঁড়ায় ৫.৮৯ টাকা১২। শুধু তাই নয়, বন্যা কবলিত এলাকাগুলোর মধ্যে প্রবল খাদ্য সঙ্কট এলাকার চেয়ে তুলনামূলক কম সঙ্কটাপনড়ব এলাকায় বেশি ত্রাণ দেওয়ার অভিযোগ ছিল শুরু থেকেই। যে কারণে এই সময়ে প্রত্যক্ষভাবেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের মধ্যে খাদ্য সঙ্কট বৃদ্ধি পেয়েছে।
    দেশের হত-দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠির জন্য সরকার প্রায় ১৩০টির মতো সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি পরিচালনা করলেও করোনা মহামারীর চলকালীন সময়ে দেখা যাচ্ছে সকল মানুষ খাদ্য ও জীবিকা সুরক্ষার জন্য এই জাতীয় কর্মসূচি যথাযথ বাস্তবায়ন হয় না। এছাড়াও করোনাকালীন সৃষ্ট নব দরিদ্র, নিঃস্ব মধ্যবিত্ত, বিদেশফেরত শ্রমিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বেকারদের জন্য এসএসএসপি’তে কোন নির্দেশনা বা কর্মসূচিও নেই। সেই সাথে, রাষ্ট্র জনগণের খাদ্যপ্রাপ্তির বিষয়টিকে মে․লিক চাহিদা হিসেবে স্বীকার করলেও ‘অধিকার’ হিসেবে গণ্য না করার কারণে খাদ্য নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো সাধারণত দান বা সেবামূলক কর্মসূচি হিসেবে বিবেচিত হয়। সেজন্য সমগ্র বিষয়টিকে ‘অধিকারভিত্তিক’ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে দেখা প্রয়োজন। অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের স্বীকৃতি থাকলে বাধ্যবাধকতা ক্সতরি হয় বিধায় ‘খাদ্য অধিকার’র প্রয়োজন রয়েছে।
    এই প্রেক্ষাপটে আমরা জনগণের খাদ্যপ্রাপ্তির বিষয়টিকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি এবং সকল মানুষের জন্য ১. খাদ্য প্রাপ্যতা (Availability), ২. স্থিতিশীলতা (Stability), ৩. অভিগম্যতা (Accessibility), ৪. স্থায়িত্বশীলতা (Sustainability) ও ৫. পর্যাপ্ততা (Adequacy) নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা আইন’ প্রবর্তনের নিমিত্তে সকলের সμিয় অংশগ্রহণ ও ভূমিকা প্রত্যাশা করি। আমরা দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য খাদ্য, পুষ্টি এবং জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত ২০১৫ সালের ৩০ মে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খাদ্য অধিকার বিষয়ক আইন প্রণয়নের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের দাবি জানাই।
    আমরা মনে করি, খাদ্য প্রত্যেক মানুষের প্রাথমিক ও প্রধানতম অধিকার। খাদ্য অধিকার পূরণ না হলে মানুষের অস্তিত্বই বিপন্নব হয়ে পড়ে। তাই জনগণের খাদ্য প্রাপ্তিকে রাষ্ট্র দান বা সেবামূলক কর্মসূচি পরিবর্তে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিবে এবং এই সকল নাগরিকের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য অধিকার প্রণয়ন করা দাবি জানাই।
    খাদ্য অধিকার নেটওয়ার্ক-খানির সৌজন্যে

  • অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ: পর্ব ৫

    অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ: পর্ব ৫


    জিয়াউল হক মুক্তা


    [জিয়াউল হক মুক্তা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এ রচনায় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্যের সাথে যোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিচার-আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও কিছু সাক্ষ্যভাষ্য এবং বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রী প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিজনদের কিছু বক্তব্য; এবং বর্তমান লেখকের গবেষণালব্ধ কিছু পর্যবেক্ষণ। সবশেষে প্রধানমন্ত্রীর সদয় বিবেচনা ও সকলের আলোচনার জন্য যোগ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা সত্যানুসন্ধান কমিশন’ বিষয়ক কিছু বিষয়গত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা। পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় লেখাটি ১৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আজ প্রকাশিত হচ্ছে পঞ্চম পর্ব।]

    আমেরিকার পক্ষে এসব কোনোভাবেই মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ের দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি লরেন্স লিফস্যুলৎসের মতে এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে আমেরিকানরা শেখ মুজিব হত্যায় যুক্ত ছিল ও এতে সবুজ সংকেত দিয়েছিল; জিয়াউর রহমানের সমর্থন ছাড়া এ হত্যাকা- ঘটানো সম্ভব ছিল না এবং আমেরিকার সমর্থন ছাড়া জিয়ার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব ছিল না; জিয়া ও রশীদ-ফারুক ও অপরাপর খুনীদের সাথে আমেরিকানদের ‘পূর্ব-যোগাযোগ’ ছিল, এবং এ পূর্বযোগাযোগ হচ্ছে, লরেন্স লিফস্যুলৎসের ভাষায়, শেখ মুজিব হত্যা বিষয়ে এসেনসিয়াল বা অপরিহার্য ও ক্রুশিয়াল বা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। তৎকালীন [আগস্ট ১৯৭৫] সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ২০০২ সালের ১৫ আগস্টে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে ১৫ আগস্ট সাতসকালে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজেন বোস্টারকে বাংলাদেশ বেতারের পাশে শেরাটন হোটেলে দেখা গেছে; এবং ক্ষমতা দখলের পরে মোশতাক প্রথম সভাটি করেন বোস্টারের সাথে। লিফস্যুলৎসের সাথে এখানে বলে রাখা দরকার যে শুধু জিয়াই নয়, খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলসহ প্রায় সকল বড় সেনা কর্মকর্তারাই যে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত, তার তথ্য-প্রমাণ-ব্যাখ্যা এখন প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছে। এ রচনায় পরে তার কিছু কিছু তথ্য উল্লেখ করা হবে।

    এভাবেই— সোভিয়েত ব্লকের ন্যাপ-সিপিবির জাতীয়তাবাদ বিরোধী ও জোট নিরপেক্ষতা বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান আর বাকশালে তাদের অন্তর্ভুক্তি— বঙ্গবন্ধু হত্যার বিবিধ জাতীয় পরিস্থিতির সাথে যোগ করলো আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিগত প্রেক্ষাপট; এ বিষয় অবহেলা করে বৈশ্বিক সুপার পাওয়ারদের হিসেব-নিকেশকে বাইরে রেখে বঙ্গবন্ধু হত্যাকে পুরোটা কোনভাবেই অনুধাবন করা যাবেনা। সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট নির্মাণে ন্যাপ-সিপিবির ও তাদের পরিচালক সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব এড়িয়ে যাবার উপায় নেই এক বিন্দুও।

    অধ্যায় নয়. বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট ও নেপথ্য-কুশীলব
    বঙ্গবন্ধু হত্যার পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট-পরিসরের সার-সংক্ষেপ বিবেচনা করা যাক। উল্লেখ্য পারিবারিক প্রেক্ষাপট বলতে এ রচনায় বোঝানো হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের আসাযাওয়া ও সামাজিক সম্পর্ক ছিল তাঁর পরিবারের সাথে; এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্যদের বক্তব্য এ রচনার অধ্যায় এগারোতে উপস্থাপন করা হয়েছে।

    [১] স্বাধীন দেশের বৈপ্লবিক রূপান্তর ব্যাহত করতে বঙ্গবন্ধুর নিজের মনোনীত বিএলএফ/মুজিববাহিনীর ৪ নেতার ৪ সুপারিশ [ইতোমধ্যে মুজিব বাহিনীর চার যুব নেতা আর ঐকমত্যে নেই; তারা বিভক্ত হয়েছেন ও পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন] আর মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র-যুব-তরুণদের ১৫ দফা ও ১২ দফা সুপারিশ গ্রহণ করা থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করা হলো ।

    [২] সরকারি প্রতিবেদনের প্রগতিশীল পরামর্শ উপেক্ষা করে জনপ্রশাসনে পাকহানাদার-দোসরদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হলো।

    [৩] গোয়েন্দা সংস্থায় পাকহানাদার-দোসরদের পুনর্বাসিত করা হলো।

    [৪] সামরিক বাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে পাকহানাদার-দোসরদের পুনর্বাসিত করা হলো।

    [৫] রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে হাজার হাজার বীর-মুক্তিযোদ্ধার জায়গা হলো জেলে আর হাজার হাজার পাকহানাদার-দালাল কারামুক্ত হয়ে বিচরণ করতে লাগলো অবাধে।

    [৬] দুর্নীতি-লুটপাট-সন্ত্রাস-কালোবাজারি-মজুদদারি-পাচারকারিদের মহোৎসব অব্যাহত রইলো; দুর্নীতির ব্যাপকতা বোঝাতে বঙ্গবন্ধু নিজেই চাটার দল আর চোরের দল আর নরপশুর দলের কথা বলেছিলেন; বলেছিলেন, বলেছিলেন আমার কম্বল কই?

    [৭] ১৯৭৪ সালে— বৈশ্বিক পরিসরে মূল্যস্ফীতি, দেশজ পরিসরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নি¤œবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস, আর চাটার দল ও চোরের দল ও নরপশুর দলের দুর্নীতির ফলে পর্যাপ্ত খাদ্য থাকার পরও দেশে দুর্ভিক্ষ হলো; মানুষ মারা গেল সরকারি হিসেবে ২৬,০০০ থেকে ৩৭,০০০ জন।

    [৮] এ রচনায় আলোচিত হয়নি, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ নিবর্তনমূলক বিভিন্ন কালাকানুন প্রবর্তিত হলো।

    [৯] ডাকসু ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া হলো; প্রার্থী অপহরণ ও ভোট ডাকাতি হলো, যদিও এর প্রয়োজন ছিল না। জাসদ কার্যালয় জ্বালিয়ে দেয়া হলো আর দৈনিক গণকণ্ঠ কার্যালয় তছনছ করা হলো।

    [১০] শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ন্যাপ-সিপিবি আওয়ামী লীগ ও বাকশাল সরকারকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিলো; প্রকাশ্য অপর সকল দল সরকার বিরোধী জোট গঠন করলেও কোন ভূমিকা রাখতে পারলো না; চীনপন্থি দলগুলো গোপনে বিরোধিতা করলো শ্রেণিশত্রু খতমের রাজনীতির মাধ্যমে। আর রাজনৈতিক পরিমলে জাসদ ছিল একা।

    [১১] একদলীয় ব্যবস্থা ‘বাকশাল’ কায়েম করা হলো; অন্য সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হলো; চারটি বাদে অন্যসব পত্রিকা নিষিদ্ধ হলো। গণকণ্ঠ নিষিদ্ধ হলো; নিষিদ্ধ জাসদ অপ্রকাশ্যে ও গোপনে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করলো।

    [১২] বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হলো; মার্কিনীদের পুরোনো দিনের বঙ্গবন্ধু বিরোধী অবস্থান অব্যাহত রইলো ও শক্তিশালী হলো—মোশতাকের পেয়াদা রশিদ-ফারুকচক্রের কাছে বঙ্গবন্ধু-হত্যায় ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের গ্রিন সিগনাল গেল এভাবে যে— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না ও তৎকালীন সরকারকে তারা স্বীকৃতি দেন। এর মধ্যে জিয়াও সিআইএ-র সাথে অনুষ্ঠিত দুটো সভায় বঙ্গবন্ধু হত্যায় তাদের সম্মতি পেয়ে যান; বঙ্গবন্ধু হত্যার ছয় মাস আগেই এ হত্যা পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয় [বিস্তারিত দশম অধ্যায়ে]।

    হয়তো এই সব নয়; বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপটে হয়তো যোগ করার আছে আরও অনেক কিছু। এবারে দেখা যাক বর্ণিত প্রেক্ষাপটে কোন কুশীলব-চক্র সাড়ে তিন বছর ধরে বঙ্গবন্ধুকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন ও তাঁকে হত্যার উল্লিখিত প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন—

    [১] আওয়ামী রাজনীতিতে শেখ মনির অনুসারীগণ; যদিও ১৫ আগস্ট শেখ মনিরও মৃত্যু হয়েছে— তার মত-পথ-জন ও ক্ষমতালিপ্সায় গৃহীত কার্যক্রম তাকেই দুর্বল করেছে ও সামগ্রিক পরিস্থিতি ঘোলা করেছে।

    [২] খন্দকার মোশতাকের অনুসারীগণ।

    [৩] জনপ্রশাসনে পাকিস্তানপন্থার অনুসারীগণ।

    [৪] গোয়েন্দা বিভাগে পাকিস্তানপন্থার অনুসারীগণ।

    [৫] আধা-সামরিক ও সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরে পাকিস্তানপন্থার অনুসারীগণ।

    [৬] মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু ঔপনিবেশিক সেনাকাঠামোর ক্ষমতালিপ্সু সামরিক কর্মকর্তাগণ।

    [৭] বাকশালে বিলীন সোভিয়েত ব্লকের ন্যাপ-সিপিবির অনুসারীগণ।

    [৮] ঢাকায় সোভিয়েত ইউনিয়ন দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ— বিশেষত কেজিবির কর্মকর্তাগণ।

    [৯] ঢাকায় বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ ও সিআইএ’র কর্মকর্তাগণ, যারা যথাক্রমে মোশতাকের অনুসারীদের ও জিয়াকে বঙ্গবন্ধু-হত্যায় সবুজ সংকেত দিয়েছেন [বিস্তারিত দশম অধ্যায়ে]।

    অধ্যায় দশ. আদালতের পর্যবেক্ষণ ও সাক্ষ্য-ভাষ্য
    ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরের ১২ নভেম্বর সংসদে কুখ্যাত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হয় ও বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার শুরু হয়। বিএনপি ও ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে মাঝে সাত বছরের বেশি ওই বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকে। পরে আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতৃত্বে নেতৃত্বে ১৪ দল ও মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে আবারও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। রায় হয়। রায়ে ঘোষিত দণ্ড কার্যকর করা শুরু হয়।

    বিশিষ্ট সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খান বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পর্যবেক্ষণ করেছেন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় তার বই ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল’। তিনি মুজিব-হত্যার বিচারের রায়ের একদম শেষ দিকে বিচারক কাজী গোলাম রসুলের ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন, “প্রাসঙ্গিকভাবে ইহা উল্লেখ করিয়া পারা যায় না যে, এই মামলায় প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ বিশেষ করিয়া যাহারা ঢাকায় অবস্থান করিতেছিলেন, তাহারা তাহাদের দায়িত্ব পালন করেন নাই, এমনকি পালনের কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করেন নাই, যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও। ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন আদেশ পাওয়ার পরও তাহার নিরাপত্তার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নাই। সাক্ষ্য প্রমাণে ইহা পরিষ্কার যে, মাত্র দুইটি রেজিমেন্টের খুবই অল্প সংখ্যক জুনিয়র সেনা অফিসার/সৈন্য এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেন এই কতিপয় সেনা সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ/নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে নাই তাহা বোধগম্য নয়। ইহা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য একটি চিরস্থায়ী কলঙ্ক হিসাবে চিহ্নিত হইয়া থাকিবে।”

    বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার আদালত অনুসরণকারী আরেক সাংবাদিক সাহাদত হোসেন খান তার ‘স্বাধীনতা উত্তর ট্র্যাজেডি: মুজিব থেকে জিয়া’ বইয়ে আদালতে দেয়া বিভিন্ন সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট উর্ধতন সেনা কর্মকর্তাদের কার্যক্রমের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন; নিচে এর নির্বাচিত অংশ নগণ্য পরিমার্জনসহ প্রায় হুবহু তুলে ধরা হলো।

    [১] মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার ও নৌবাহিনী প্রধান কমোডর মোশাররফ হোসেন খান ছাড়া উর্ধতন প্রায় সকল সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন; তাদের সমর্থন এবং পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষ সহায়তাও পেয়েছিলেন। খুনিরা ক্যু’র দিন বঙ্গবন্ধু, শেখ মনি ও আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসার টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করেননি; কারণ তারা জানতেন যে টেলিফোন করলেও কেউ এগিয়ে আসবেন না। শেখ মনিকে হত্যার প্রায় ঘণ্টা খানেক পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়; এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ ও আরও অনেক জায়গায় ফোন করেন; কিন্তু যথেষ্ট সময় থাকার পরও কেউ তাঁকে রক্ষায় ছুটে আসেননি।

    [২] ক্যু’র পরপরই এক রহস্যময় নীরবতার চাদরে ঢাকা সেনানিবাস আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ঢাকার শক্তিশালী ৪৬-ব্রিগেড ও ডিজিএফআইয়ের নিষ্ক্রিয়তা তার প্রমাণ। মেজর ফারুকের পরিকল্পনায় ৪৬-ব্রিগেডের হুমকি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা হয় এবং তুলনামূলকভাবে দুর্বল রক্ষীবাহিনীকে একমাত্র প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করা হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ হামিদ (অব.) তার ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইয়ে বলেছেন যে খুনি দুই মেজর তার কাছে নির্দ্বিধায় বলেছেন, ‘বড় ভাইয়েরা সমর্থন না দিলে এমন একটি অসম্ভব কাজ আমরা কিভাবে করতে যেতাম?’ কর্নেল হামিদ ৪৬-ব্রিগেডের নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে ফারুকের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘রশীদকে জিজ্ঞেস করুন। কেননা রশীদই যে কোনোভাবে ৪৬-ব্রিগেডকে নিশ্চল করে রেখেছিল।’ যথারীতি কর্নেল এমএ হামিদ রশীদের কাছে সরাসরি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্যার, ব্যাপারটি আপনিই বুঝে নিন। ৪৬-ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল ছিলেন আমাদের লোক। তার তরফ থেকে আমরা কোনো আক্রমণের আশঙ্কা করিনি। শাফায়াত ও তার অধীনস্থ অফিসারদের সবাই ব্যাপারটি জানতেন।’

    [৩] মুজিব-হত্যার পর মেজর রশীদ প্রথম কর্নেল শাফায়াত জামিলের সাথে দেখা করে হত্যার খবর জানান। কিন্তু শাফায়াত তাকে সাথে সাথে গ্রেফতার না করে স্টাফ অফিসার মেজর হাফিজকে নিয়ে সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি জিয়াউর রহমানের কাছে যান। জেনারেল জিয়া যথারীতি সকাল সাড়ে ৭টায় অফিসে উপস্থিত হন; যেন কিছুই হয়নি।

    [৪] কর্নেল শাফায়াত বলছেন, সবার সঙ্গে যোগাযোগ করার পর জেনারেল সফিউল্লাহ সকাল প্রায় ৬টায় তাকে টেলিফোন করেন। হ্যাঁ, সফিউল্লাহ তাকে প্রায় সকাল ৬টায় টেলিফোন করেন; তবে এটা ছিল তার কাছে সেনাপ্রধানের দ্বিতীয় টেলিফোন। সে সময় মেজর রশিদ কর্নেল শাফায়াত জামিলকে বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন। ভোর সাড়ে ৫টায় মেজর রশীদ কর্নেল শাফায়াত জামিলের কাছে অবস্থান করার সময়ও মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ তাকে টেলিফোন করেছিলেন। কিন্তু শাফায়াত আদালতের কাছে তাকে সাড়ে ৫টায় জেনারেল সফিউল্লাহর নির্দেশ প্রদানের কথা এড়িয়ে যান।

    ৫] এছাড়া মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ কর্নেল শাফায়াত জামিলের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক কর্নেল সালাহউদ্দিনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি নিজেও তার কাছে টেলিফোন করার জন্য ডায়াল ঘুরাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখনো ছিলেন জীবিত; সাড়ে ৫টার দিকে তিনি ফোর্স পাঠানোর জন্য সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে নির্দেশ দেন। সফিউল্লাহ টেলিফোন করেন ৪৬-ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াতকে। এক্সচেঞ্জ থেকে সেনাপ্রধানকে জানানো হয়, মনে হয় তিনি [শাফায়াত জামিল] রিসিভার উঠিয়ে রেখেছেন।

    [৬] সঠিকভাবে তদন্ত করা হলে দেখা যেতো যে, কর্নেল শাফায়াত জামিল ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে জড়িত। মেজর রশিদের বদলি হয়েছিল যশোরে গানারি স্কুলে। রশিদের এ বদলিতে তাদের হত্যা-পরিকল্পনা লাটে উঠতে যাচ্ছিল। শাফায়াত তাকে ঢাকায় থেকে যাবার জন্য আবেদন করতে বলেন। শাফায়াতের সহযোগিতায় রশীদের যশোরে বদলি বাতিল হয় এবং তাকে ঢাকায় টু-ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডার হিসেবে বহাল করা হয়।

    [৭] মেজর ফারুক শেরেবাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীর সদরদপ্তর ট্যাঙ্ক দিয়ে ঘেরাও করে রেখেছিলেন। ৪৬-ব্রিগেড ছিল পুরোপুরি ঘেরাও মুক্ত। জেনারেল সফিউল্লাহ প্রেসিডেন্টকে রক্ষায় ৪৬-ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াতকে নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও তিনি সৈন্য মুভ করেননি। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ কর্নেল শাফায়াত জামিলের অফিসেও যান। কিন্তু তিনি তাকে অফিসে পাননি। শাফায়াত জামিল থাকছিলেন দূরে দূরে।

    [৮] শুধু শাফায়াত জামিলই নয়, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফও অত্যন্ত রহস্যময় ভূমিকা পালন করেন। ব্রিগেডিয়ার রউফ রাত তিনটায় ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারি চলাচলের গোয়েন্দা তথ্য পান, কিন্তু প্রেসিডেন্ট অথবা সেনাপ্রধানকে তিনি কিছু জানাননি। তার একটি বিশ্লেষণ ভেবে দেখার মতো। ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাসদরে সব গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনি জেনারেল সফিউল্লাহর বাসার বারান্দার নিচে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের গাড়ি দেখতে পান। তিনি বিশ্বাস করছিলেন যে, তার দেখা অফিসারদের মধ্যে অভ্যুত্থানের নেপথ্য নায়ক উপস্থিত। তিনি প্রত্যেকের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকান। সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ছাড়া আর কাউকে তার সন্দেহ হয়নি। অবশ্য ব্রিগেডিয়ার রউফ যাকেই সন্দেহ করে থাকুন না কেন, সন্দেহের তালিকায় প্রথমে ছিলেন তিনি নিজে।

    [৯] ১৫ আগস্ট পর্যন্ত খুনি মেজরদের প্রতি শাফায়াত জামিলের ছিল বলিষ্ঠ সমর্থন। কিন্তু এতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিলের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় তারা উল্টে যান। ক্যু সফল হওয়ার পর কর্নেল শাফায়াত জামিল দেখতে পেলেন যে, এতে তার কোনো লাভ হয়নি। জিয়া চিফ অব স্টাফ হওয়ায় খালেদও শঙ্কিত হয়ে উঠেন; তার স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যায়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিলের এ ক্ষোভ থেকে পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে।

    [১০] মেজর ফারুক ও রশিদের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে পর্দার অন্তরালে থেকে কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা তাদের পরিচালনা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৮ আগস্ট ৪৬-ব্রিগেডের স্টাফ অফিসার মেজর সাখাওয়াত হোসেনের সাথে মেজর শরীফুল হক ডালিমের আলাপ থেকেও ক্যু’র সাথে সিনিয়র আর্মি অফিসারদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। ডালিম জিপ চালিয়ে ক্যুদেতার সময় আহত সৈন্যদের দেখতে সিএমএইচে যাবার পথে মেজর সাখাওয়াত হোসেনকে জানান যে সে ক্যু ছিল বহুদিনের ফসল। কিভাবে তারা সমস্ত সিনিয়র অফিসারের সমর্থন আদায় করেছিলেন সে ব্যাপারে জানতে চাইলে উল্টো ডালিম সাখাওয়াত হোসেনের কাছে জানতে চান, অল্প কজন অফিসার এ অভ্যুত্থানে জড়িত, এ ধারণা তিনি কোথা থেকে পেলেন। ডালিম অত্যন্ত সহজভাবে সাখাওয়াত হোসেনকে বললেন যে আপনি কিভাবে জানলেন যে এ ক্যু’র পরিকল্পনা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি?

    [১১] পুরো সশস্ত্র বাহিনী আগস্ট ক্যু’তে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সার্বিকভাবে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা মৌনভাবে তা মেনে নিয়েছিলেন। সেনাবাহিনী প্রধান সফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকেও নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে; খালেদ সরল জবাব দিয়েছিলেন, ‘এখন কিছুই করণীয় নেই যা এ প্রক্রিয়াকে উল্টে দিতে পারে।’

    [১২] ক্যুদেতায় মেজর ফারুক খালি ট্যাঙ্ক নিয়ে শেরেবাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীকে ধোঁকা দেন। সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ বা সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের কাছে তিনি তার অভিযানের বর্ণনা দেন এবং তাকে গোলা ইস্যু করতে বলেন। খালেদ সঙ্গে সঙ্গে সেনাসদরের জেনারেল স্টাফ বা জিএস ব্রাঞ্চের আওতাধীন গোলা সরবরাহে জয়দেবপুরের অর্ডিন্যান্স ডিপোকে নির্দেশ দেন। একইদিন তিনি মেজর শাহরিয়ার রশীদ খানকে চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। [আগামী কাল ষষ্ঠ পর্ব]

  • অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ: পর্ব ৪


    জিয়াউল হক মুক্তা:

    [জিয়াউল হক মুক্তা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এ রচনায় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্যের সাথে যোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিচার-আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও কিছু সাক্ষ্যভাষ্য এবং বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রি প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিজনদের কিছু বক্তব্য; এবং বর্তমান লেখকের গবেষণালব্ধ কিছু পর্যবেক্ষণ। সবশেষে প্রধানমন্ত্রির সদয় বিবেচনা ও সকলের আলোচনার জন্য যোগ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা সত্যানুসন্ধান কমিশন’ বিষয়ক কিছু বিষয়গত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা। পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় লেখাটি ১৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আজ প্রকাশিত হচ্ছে চতুর্থ পর্ব।]
    ১৯৭৪ সালে বিজয় দিবসের একদিন আগে ১৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া এ ভাষণে মূল্যস্ফীতিকে এক নম্বর শত্রু, প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে দুই নম্বর শত্রু ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু বললেন, “আমাদের নতুন প্রতিরোধ সংগ্রামে সর্ব শেষ ও সর্বপ্রধান শত্রু চোরাকারবারি, কালোবাজারি, মুনাফাবাজ ও ঘুষখোরের দল। মানুষ যখন অনাহারে মারা যায়, তখনও এই সব নরপশুর দল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখের গ্রাস অন্যত্র পাচার করে দিয়ে থাকে। বিদেশ থেকে ধার-কর্জ, এমনকি ভিক্ষা করে আনা পণ্য ও বাংলার সম্পদ মজুদের মাধ্যমে এরা মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে। এদের কোন জাত নেই, নেই কোন দেশ।”

    আগে-পরে অন্য অনেক বক্তব্যের মতো, পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গভবনে বাকশাল কমিটির উদ্বোধনী ভাষণেও তিনি বলেন, “আমি সার দিতে পারি নাই। যা সার দিয়েছি, তার থার্টি পারসেন্ট চুরি হয়ে গেছে। স্বীকার করেন? আমি স্বীকার করি। আমি মিথ্যা কথা বলতে পারবো না। মিথ্যা বলে একদিনও হারাম এ-দেশের প্রেসিডেন্ট থাকবো না। আমার যে সার আমি দিয়েছি, তার কমপক্ষে থার্টি পারসেন্ট ব্ল্যাক মার্কেটিং-এ চুরি হয়ে গেছে। আমি যে ফুড দিই, তার কুড়ি পারসেন্ট চুরি হয়ে যায়। আমি যে মাল পাঠাই গ্রামে গ্রামে তার বিশ পারসেন্ট, পঁচিশ পারসেন্ট চুরি হয়ে যায়। সব চুরি হয়ে যায়। হুইট [গম] আমি তো হুইট পয়দা করি না, খুব কমই করি, তবু কোন বাজারে হুইট পাওয়া যায় না? গভর্নমেন্ট গোডাউনের হুইট? সার তো আমি ওপেন মার্কেটে বিক্রি করি না, তবু কোন বাজারে সার পাওয়া যায় না?” এ সময়, জাসদ ব্যস্ত আত্মরক্ষায়; পলাতক। বঙ্গবন্ধু কথিত চাটার দল আর চোরের দল আর নরপশুর দল ঠেকানোর কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক শক্তি তখন আর প্রকাশ্যে/মাঠে নেই। পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের বিরুদ্ধে দশ বছর লড়াই করা আর মুক্তিযুদ্ধে মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে তাকে তুড়ে মেরে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া ছাত্র-যুব-তরুণরা এ অশনিসংকেত দেখেছিলেন অনেক আগেই। ১৯৭৪ সালের শুরুতেই জাসদ বঙ্গবন্ধু কথিত চাটার দল আর চোরের দল আর নরপশুর দলের দুর্নীতি-লুটপাট-মজুদদারি-কালোবাজারি-পাচারকারিদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর ‘ঘেরাও’ কর্মসূচি। কর্মসূচির প্রথম দিনে ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওয়া রক্ষীবাহিনী গুলি করে হত্যা করে ৫০ জন জাসদ নেতাকর্মীকে; তাদের চার জনের লাশ বাদে বাকিদের লাশ গুম করে ফেলা হয়; গ্রেফতার করা হয় শতাধিক। পরের দিন জ্বালিয়ে দেয়া হয় জাসদ কার্যালয়। তছনছ করা হয় জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠের কার্যালয়। ১৭ মার্চ রাত থেকে সারাদেশে শুরু হয় নতুন উদ্যমে জাসদ-দমন; চিরুনী অভিযানের ফলে কারোর এমনকি আত্মগোপনে থাকাও অসম্ভব হয়ে ওঠে। দেশের দুর্ভাগা জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল জাসদ একা; আর কেউ দাঁড়ায়নি তাদের পাশে; ন্যাপ-সিপিবি সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল, গোপন চীনপন্থী দলগুলো ব্যস্ত কথিত শ্রেণিশত্রু খতমে আর অপরাপর প্রকাশ্য সব সংগঠন নিজেরা একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম তৈরি করলেও তেমন উল্লেখযোগ্য কোন কর্মসূচি হাজির করতে পারেনি। এককভাবে আন্দোলনে থাকা জাসদকে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনার দাম দিতে হলো কড়ায়গন্ডায়— অত্যাচার-নির্যাতন-জেল-জুলুম-সন্ত্রাস-নিপীড়ন-খুন-গুমের শিকার হয়ে। রাজনীতির মাঠে নিঃসঙ্গ জাসদ যেন হয়ে ওঠলো সংশপ্তক।

    অধ্যায় আট. এ ব্যাটলফিল্ড অব দ্য প্রক্সি ওয়ার?
    সে সময়টা ছিল শীতল যুদ্ধের কাল। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। পারমাণবিক যুদ্ধের শংকায় কম্পমান মানব সভ্যতা। পাকিস্তান সমাজতন্ত্র মোকাবেলার সামরিক জোট সাউথইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা সিয়াটো ও দি সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা সেনটো’র সদস্য; উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় পাশে পেয়েছে চীন ও আমেরিকাকে। ইউরোপের অনেক দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক হস্তক্ষেপে; এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায় সমাজতন্ত্র এসেছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের হাত ধরে। ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোও চেষ্টা করেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা পেতে; কিন্তু সহায়তা গ্রহণের পাশাপাশি তাদেরকে ঝুঁকিও নিতে হয়েছে অনেক। ১৯৫৪ সালে ভিয়েতনাম দ্বিখন্ডিত হয়েছিল ও ১৯৬২ সালের অক্টোবরে কিউবা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল ১৩ দিনের স্নায়ু-ছেঁড়া পারমানবিক যুদ্ধের মিসাইল সংকট।

    এদিকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টরা চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয়ে বিভক্ত ছিলেন। ফলে চীনপন্থীদের কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ও কেউ জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মূলধারার বাইরে স্বতন্ত্র অবস্থান গ্রহণ করেছেন; আর সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুসারীরাও ন্যাপ-সিপিবিতে বিভক্ত ছিলেন। এসব বামপন্থীদের কেউ বাঙালির জাতীয় মুক্তির দিকে পরিকল্পিত আন্দোলন সংগ্রামের অংশ ছিলেন না। এরা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের ঔপনিবেশিক সরকার ও তাদের শাসনকে নিজেদের অবস্থান দ্বারা প্রকারান্তরে সহায়তাই করে গিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরশাসন ও সামরিক শাসনের বেলায়ও এরা আপোষই করেছেন প্রায় সকল সময়। বঙ্গবন্ধু তাই বলতেন যে বাংলাদেশ কোনো আমদানি করা সমাজতন্ত্র চলবে না। স্বাধীনতা-সমাজতন্ত্রের অগ্রবাহিনী নিউক্লিয়াসপন্থীরাও বলতেন যে আমদানি করা সমাজতন্ত্র নয়, বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিকশিত জাতীয় সমাজতন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক প্রভাববলয়ের বাইরে থেকে কায়েম করবেন শোষণমুক্ত সমাজ ও দেশ। দেশজ বাস্তবতার বৈজ্ঞানিক অনুধাবন থেকে পরিচালনা করবেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের আন্দোলন ও নির্মাণ করবেন সমাজতান্ত্রিক সমাজ। কোন দেশ বা সামরিক জোটের অনুসরণ নয়, জোট নিরপেক্ষতা হবে ভূরাজনীতিগত অবস্থান। জাসদ তৎকালীন জাতীয়-আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সা¤্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল জাতীয় সার্বভৌমত্বকে বিপদমুক্ত রাখতে; আজ ২০২০ সালে এসে এ কথাগুলো হাস্যকর শোনাতে পারে, কিন্তু প্রক্সি ওয়ারের যুগে স্বাধীন ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকেই এসব রাজনৈতিক টার্ম তৈরি হয়েছিল। জাতীয় সমাজতন্ত্র ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারণা থেকে গঠিত জাসদ স্বাধীন দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়, আর তাই চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী সমাজতান্ত্রিক দলগুলো মনে করতো জাসদ তাদের সমাজতান্ত্রিক জমিদারি ধ্বংস করে দিয়েছে; আর তাই তারা জাসদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত সর্বদা সর্বত্র।

    বঙ্গবন্ধু যখন দল ও দলের বাইরের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি দ্বারা অবরুদ্ধ ও জাসদ যখন রাজনৈতিকভাবে ‘একলা চলো’ নীতি অনুসরণ করে মিত্রহীন নিঃসঙ্গ, ওই ন্যাপ-সিপিবি সুযোগটি নিলো পুরোপুরি, অনপ্রবেশ করলো আওয়ামী লীগের ঘরে; সরকারের সমর্থক থেকে পরিণত হলো সরকারের অংশে। দেশে একদল বাকশাল গঠন করা হলে সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী সিপিবি ও ন্যাপ নিজেদের দল বিলোপ করে এতে ঢুকে পড়লো। ন্যাপ-সিপিবি বাকশালে বিলুপ্তির ফলে— বিশেষত ন্যাপ-সিপিবির জাতীয়তাবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিকতাবাদের রাজনীতি, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে এদের পার্টি-টু-পার্টি সম্পর্ক ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর নির্দেশ পালনকারী বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির সাথে এদের সম্পর্ক বিবেচনায়— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনে হতেই পারে যে বাংলাদেশ বুঝি জোট নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে গিয়ে সোভিয়েত ব্লকে ঢুকে গেল। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অগত্যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হলেও, বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিতে পারেনি কখনোই; বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি কখনোই।

    কোমিতেত গোসুদার্স্তভেন্নয় বেজোপাসনস্তিবা কেজিবি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। কেজিবি’র পক্ষত্যাগী সাবেক আর্কাইভ কর্মকর্তা ভাসিলি মিত্রোখিন ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার এন্ড্রু কেজিবির নথিপত্রের ভিত্তিতে রচনা করেন ‘দি মিত্রোখিন আর্কাইভ: দি কেজিবি অ্যান্ড দি ওয়ার্ল্ড’ নামের গ্রবেষণাগ্রন্থ। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-সিক্সের তদারকিতে ২০০৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর এটা পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত হয়। দি মিত্রোখিন আর্কাইভ, বাংলাদেশে পরিচালিত আরও কিছু গবেষণাকর্ম এবং ন্যাপ-সিপিবি’র নেতাদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান ২০০৬ সালের মার্চ মাসে নিজ পত্রিকায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ও কেজিবির নীতিগত ও আর্থিক সহায়তা বিষয়ে একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।

    এ প্রতিবেদনে বলা হয় যে ১৯৭৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরো কেজিবিকে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে নির্দেশ দেয়। কেজিবি আওয়ামী লীগ ও এর মিত্র সিপিবি-ন্যাপ-এর নির্বাচনী প্রচারণায় তহবিলের যোগান দেয়। দি মিত্রোখিন আর্কাইভ জানায় ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে কেজিবি মিশনের আনুষ্ঠানিক বাজেট ছিল ৫২ হাজার ৯০০ রুবল। কেজিবি একটি দৈনিক পত্রিকা ও একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দৈনিক পত্রিকাটিকে ছাপাখানা কেনার জন্য ৩ লাখ রুবলের সমপরিমাণ অর্থ দেয়। বইটির এক ফুটনোটে লেখা হয়েছে যে বাকশালে একীভূত আওয়ামী লীগকেও কেজিবি গোপনে তহবিলের যোগান দিয়েছে। অবশ্য আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতা তোফায়েল আহমেদ বিদেশী অর্থ নেয়ার বিষয়টিকে নাকচ করে দিয়েছেন; কিন্তু ন্যাপ-সিপিবি তা করেনি।

    ন্যাপ-এর সাবেক নেতা মোনায়েম সরকার জানিয়েছেন যে সোভিয়েত সহায়তায় ১৯৭২-১৯৭৫ সময়কালে ন্যাপ পরিচালিত সমাজতন্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ৭ হাজার ৭০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সিপিবি সূত্র থেকে মিজানুর রহমান খান জানান যে আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক তাদেরকে দেয়া অর্থের পরিমাণ হয় সর্বোচ্চ বার্ষিক প্রায় ৫০ হাজার ডলার। ন্যাপও সিপিবির মতো অনেকটা সমপরিমাণ অর্থ পেত; সিপিবি-ন্যাপ-এর সাথে যুক্ত অন্যান্য গণসংগঠনও আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা পেত। অন্যান্য সহায়তার মধ্যে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে ছাত্র পাঠানো, প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণ ইত্যাদি। সিপিবির এ বছরভিত্তিক তহবিল দলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ বিশেষভাবে নিজস্ব এখতিয়ারে দেখভাল করতেন। সিপিবির সাবেক নেতা অজয় রায়ও একই তথ্য প্রকাশ করে বলেন, ‘দলীয় তহবিলের হাঁড়ির খবর একমাত্র জানতেন দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মোহাম্মদ ফরহাদ। দলীয় সিদ্ধান্ত যৌথভাবে গৃহীত হলেও তহবিল ব্যবস্থাপনা কিন্তু যৌথ নেতৃত্বাধীন ছিল না।’ ১৯৮৭ সালে মোহাম্মদ ফরহাদের মৃত্যুর পর থেকে ১৯৯১ সালে সিপিবি বিভক্ত হওয়ার সময় পর্যন্ত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কেজিবিপ্রদত্ত সে অর্থ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন।

    প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৭২ সালে কেজিবির আবাসিক মিশন ঢাকা রেসিডেন্সি ‘মুজিবের সচিবালয়ের একজন উর্ধতন সদস্য, দুজন মন্ত্রি ও দুজন ঊর্ধতন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে [তাদের এজেন্ট হিসেবে] নিয়োগ’ করে। এটা আরও জানায়, ১৯৭৫ সালে ‘সন্দেহাতীতভাবে মস্কোর উৎসাহে’ শেখ মুজিব বাংলাদেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। দি মিত্রোখিন আর্কাইভ-এর মতো অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামানের স্বতন্ত্র একটি গবেষণাও তা বলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের নাম উল্লেখ না করে নিজের একটি বইয়ে তিনি বলেন যে ‘দেশটির ঢাকাস্থ দূতাবাস’ ১৯৭৪ সালের নভেম্বর থেকে মস্কোপন্থী দলগুলোর নেতৃত্বে সংসদীয় গণতন্ত্র বাতিল করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার কথা বলছিল; আওয়ামী লীগের দুজন বড় নেতাকে তারা একদল বাকশাল গঠন করতে প্রভাবিত করেছিল। [আগামী কাল পঞ্চম পর্ব]

  • অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ: পর্ব ২

    অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ: পর্ব ২


    জিয়াউল হক মুক্তা


    [জিয়াউল হক মুক্তা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এ রচনায় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্যের সাথে যোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিচার-আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও কিছু সাক্ষ্যভাষ্য এবং বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রি প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিজনদের কিছু বক্তব্য; এবং বর্তমান লেখকের গবেষণালব্ধ কিছু পর্যবেক্ষণ। সবশেষে প্রধানমন্ত্রির সদয় বিবেচনা ও সকলের আলোচনার জন্য যোগ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা সত্যানুসন্ধান কমিশন’ বিষয়ক কিছু বিষয়গত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা। পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় লেখাটি ১৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আজ প্রকাশিত হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব।]

    [গতকালের পর] আগাচৌ বলেন, “মনি চান, তার প্রতি এখন যারা ব্যক্তিগত আনুগত্য দেখাচ্ছেন, তারা এককালে মোনায়েম খাঁর এনএসএফ বা জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের গুণ্ডা হোক বা প্রাক্তন রাজাকার আলবদর হোক, তাদের নিয়ে তিনি গ্রুপ গঠন করবেন। অন্যদিকে যারা নীতিগতভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেকুলারিজম, সোস্যালিজমে বিশ্বাসী কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগ বা যুবলীগের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে না, তাদের জাতীয় জীবনের ক্ষেত্রে পাত্তা দেয়া হবে না। এই নীতির সর্বনাশা দিক হলো, ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগে তখন আইয়ুব খাঁ-মোনায়েম খাঁর আমলের সুবিধাবাদী দল ভোল পাল্টিয়ে এসে আসর জাঁকিয়ে বসছিল। আর আওয়ামী লীগের যারা প্রকৃত কর্মী ৃ তারা ক্রমশই পিছনে হটে যাচ্ছিলেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা ছাত্রলীগের কিছু নেতা ও নেতৃস্থানীয় কর্মীও এই সুবিধাভোগী ও রাতারাতি বড়লোক হওয়ার দুর্নীতিময় পথে পা বাড়াননি, তা নয়। ৃ আর সংখ্যাগরিষ্ঠ যে অংশের দুর্নীতি ও সমাজবিরোধী কাজের জন্য বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে এত দুর্নাম কুড়াতে হয়েছে, তারা কেউ দুর্দিনে বা সংগ্রামের দিনে আওয়ামী লীগের বন্ধু বা সমর্থক ছিলেন না। ৃ শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব হ্রাস পাচ্ছিল এবং নেপথ্যে থেকে শক্তি সঞ্চয় করছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমাদের সমর্থক তরুণ প্রতিমন্ত্রিদের গ্রুপটি। এদের মধ্যে আছেন ফরিদপুরের কেএম ওবায়দুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাহের উদ্দিন ঠাকুর, বরিশালের নূরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রমুখ।” বলা নিষ্প্রয়োজন, শেখ মনিও রেহাই পাননি, তার ক্ষমতালিপ্সা তার প্রাণও কেড়ে নিয়েছে; কেএম ওবায়দুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও বরিশালের নূরুল ইসলাম মঞ্জুরদের উত্থান ঘটেছিল খুনি মোশতাক-মেজরদের হাত ধরে।
    বলে রাখা ভালো যে ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কুখ্যাত ‘সেভেন মার্ডার’-এর কথা বলা হয়েছে, তার জন্য আইনের চোখে প্রধানত দায়ী ছিলেন আওয়ামী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান ও তার অনুসারীগণ; এজন্য তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল; পরে জিয়ার আমলে তিনি ক্ষমা পান। সে সময় শফিউল আলম প্রধান রাজ্জাক-তোফায়েল উপ-উপদলের অংশ ছিলেন। আওয়ামী রাজনীতিতে সে সময় বঙ্গবন্ধুর পর যাদের দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল, তারা হলেন শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদ দেখতেন পুরো প্রশাসন ও রক্ষীবাহিনী; আব্দুর রাজ্জাকের নিয়ন্ত্রণে ছিল আওয়ামী লীগের তরুণ নেতৃত্ব পুরোটা ও আওয়ামী ছাত্রলীগের অধিকাংশ; আর শেখ মনির নিয়ন্ত্রণে ছিল যুবলীগের পুরোটা, শ্রমিক লীগের আধাটা ও ছাত্রলীগের সামান্য অংশ। তোফায়েল আহমেদ যেহেতু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন, তাই তার ও আব্দুর রাজ্জাকের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লালিত শফিউল আলম প্রধানের অনুসারীদের কৃত সেভেন মার্ডারের সাথে প্রধানমন্ত্রির কার্যালয় জড়িত— এমন একটা ভ্রান্ত ধারণা বঙ্গবন্ধুর ইমেজের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর হয়ে ওঠেছিল; যদিও ক্ষমতার জন্য তাদের সকলের উপ-উপদলীয় কোন্দলের একটা রাজনৈতিক আবরণ ছিল যে তারা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য আবস্থান নিয়েছিলেন।
    অধ্যায় তিন. জনপ্রশাসন আওয়ামী রাজনীতির ওই দুই উপদল— বঙ্গবন্ধু সরকারকে বাধ্য করলো ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের একদিন আগে ও বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় গৃহীত একটি সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে— যে সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়া বেসামরিক প্রশাসনের আমলাদের স্ক্রিনিং করার কথা বলা হয়েছিল। পরে এদের দালাল আইনে বিচার করার কথাও ওঠেছিল; কিন্তু তাও কখনও হয়নি। সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিস্টোরেশন কমিটির ৪ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখের প্রতিবেদন অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রাদেশিক প্রশাসন কাঠামোকে বাংলাদেশের জাতীয় প্রশাসন কাঠামোয় রূপান্তর করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যে আমলারা পাকিস্তানের হয়ে কাজ করছিলেন, তাদের নেতৃত্বে চলতে শুরু করলো স্বাধীন বাংলাদেশের জনপ্রশাসন; পরে এদের সাথে যোগ দেন পাকিস্তান ফেরত আমলারা, যাদের অনেকেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর স্বেচ্ছায় পাকিস্তানে বদলি নিয়েছিলেন। সরকার গঠিত অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যান্ড সার্ভিসেস রিঅর্গানাইজেশন কমিটি বা এএসআরসি ও ন্যাশনাল পে কমিশন বা এনপিসি কর্তৃক পেশকৃত প্রগতিশীল জনপ্রশাসন প্রতিষ্ঠার সুপারিশমালা লুকিয়ে ফেলা হলো। পাকিস্তানপন্থার দৌরাত্ম্য কায়েম হলো জনপ্রশাসনে। এসবের বিস্তারিত রয়েছে বাংলাপিডিয়ায় এটিএম ওবায়দুল্লাহ-র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফর্মস নিবন্ধে ও ইন্টারনেটে সহজলভ্য কিছু পিএইচডি অভিসন্দর্ভে।
    মুজিব বাহিনী নেতৃত্বের ৪ দফা, ছাত্র-যুব-তরুণদের ১৫ দফা ও ১২ দফা, এএসআরসি ও এনপিসি না মেনে পুরোনো ব্যবস্থা বহাল রাখার ফলে, “বাংলার দুর্ভাগ্য আইনানুগ উত্তরাধিকারীর [অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের] বদলে [স্বাধীন দেশে] সর্বস্তরের নেতৃত্ব এসেছে তাদেরই হাতে যারা প্রাক বিপ্লব যুগে ছিলেন ক্ষমতার উৎস। প্রশাসন যন্ত্র সেই পুরোনো ব্যক্তিরাই চালান। বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তারাই। যে সামরিক অফিসার পাকিস্তানীদের সৈন্যদের সাথে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য ছিলেন সচেষ্ট, তিনি আজ আরও উচ্চপদে সমাসীন। যে পুলিশ অফিসার দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে সোপর্দ করেছে পাকিস্তানীদের হাতে, তিনি আবার মুক্তিযোদ্ধাদের নামে হুলিয়া বের করতে ব্যস্ত। যে আমলারা রাতদিন খেটে তৈরি করেছে রাজাকার বাহিনী, তারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চাকরি দিয়ে দয়া প্রদর্শনের অধিকারী। যে শিক্ষক দেশের ডাকে সাড়া দিতে পারেনি, তিনিই আজ তরুণদের শিক্ষা দেয়ার বাহানা করছেন।” কথাগুলো বলেছেন শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম তাঁর ‘মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে’ প্রবন্ধে।
    পরের অনুচ্ছেদে তিনি আরও বলেছেন, “পরিকল্পনা বিভাগের যে কর্মীকে শোষণের পরিকল্পনা করা শেখানো হয়েছে বছরের পর বছর ধরে, তিনিই এখন সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পরিকল্পনা তৈরি করেন। যুদ্ধ চলাকালে যারা পাকিস্তানীদের হয়ে প্রচারণায় মত্ত ছিলেন, ১৬ ডিসেম্বরের পর তারাই ভোল পাল্টিয়ে সংস্কৃতির মধ্যমণি হয়েছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর প্রত্যেক দেশে করা হয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধকে যারা সাহায্য করেনি তারা স্থান পেয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে।সেখানে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদেরকে আত্মশুদ্ধির সুযোগ দেয়া হয়েছে, যাতে করে তারা বিপ্লবী জনতার অংশ হতে পারে। নিতান্তই পরিতাপের বিষয়, যাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে থেকে আত্মশুদ্ধি করার কথা, সকলের অগোচরে তারা সর্বস্তরের নেতৃত্বের আসন দখল করে বসেছে।”
    অধ্যায় চার. গোয়েন্দা সংস্থা বঙ্গবন্ধু হত্যা ও কর্নেল তাহের হত্যা বিষয়ে ১৯৭৫ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফস্যুলৎসের ১৯৭৯ সালে জেড বুকস প্রকাশিত বই ‘বাংলাদেশ: দি আনফিনিশড রেভ্যুলুশন’-এর প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণিত কিছু তথ্য দেখা যাক। তৃতীয় বিশ্বে আমেরিকার সাহায্য কর্মসূচির একটি ছিল অফিস অফ পাবলিক সেফটি: এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বা ওপিএসএইড। এ কর্মসূচির একটা অংশ ছিল মাঝারি ও উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের আমেরিকায় প্রশিক্ষণ প্রদান। প্রশিক্ষণ দেয়া হতো ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অ্যাকাডেমি বা আইপিএ ও ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ সার্ভিসেস স্কুল বা ইনপোলসে থেকে। ওপিএস শুরু থেকেই সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ-র সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল; আর ইনপোলসে ছিল সরাসরি সিআইএ’র মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে এ কর্মসূচির আওতায় প্রায় ৪০ জন বাঙালি কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ পান। এরা সবাই পাকিস্তান জাতীয়তাবাদের কট্টর সমর্থক ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর দালালদের পাইকারিভাবে ক্ষমা করে দেয়ার ফলে এদের মধ্যকার রাঘব বোয়ালরা লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান।
    পরে ১৯৭৪ সালে বন্যাপরবর্তী দুর্ভিক্ষ, গণবিক্ষোভ ও জাসদ দমনের জন্য সরকারের প্রয়োজন হয়ে ওঠে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা ব্যক্তিত্বের। আওয়ামী লীগ সরকার তখন এদের পুনর্বাসন শুরু করে। এদের মধ্যে বিশেষ কয়েকজনের দিকে একটু নজর দেয়া যাক। ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খানের সময়কার ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো বা আইবি-র সহকারী-পরিচালক ও পরে উপ-পরিচালক এবিএস সফদারকে নিয়োগ দেয়া হয় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা দলে। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে এবিএস সফদার বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহঅভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফাইল ও ডোঁশিয়ে তৈরির কাজ করতেন এবং প্রতিদিন নিজ হাতে বিচারকদের জন্য ব্রিফকেস নিয়ে আদালতে যেতেন। সফদারের সহপাঠি ও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর পরিচালক আবদুর রহিমকে নিয়োগ দেয়া হয় রাষ্ট্রপতির সচিব হিসেবে; এর আগে কোন পুলিশ কর্মকর্তা এভাবে পূর্ণসচিবের মর্যাদা ভোগ করেননি, এমনকি পাকিস্তান আমলেও নয়। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এরা দুজন ওয়াশিংটনে আইপিএ-তে ছিলেন। মার্চে যুদ্ধ শুরু হলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিগণ ও পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশের পক্ষ নেন; কিন্তু সফদার ও রহিম তা করেননি। তাদেরকে পাকিস্তান সরকার ডেকে পাঠালে ইউএস পাবলিক সেফটি প্রোগ্রাম ইন পাকিস্তান-এর প্রধান যোশেফ কার পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর পরিচালক এনএ রিজভির সাথে কথা বলে এদের প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখেন। প্রশিক্ষণ শেষে এরা নিজ ইচ্ছায় সরাসরি ঢাকা আসেন এবং ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড কাউন্টার ইনসার্জেন্সি কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এদের সাথে সাথে আওয়ামী লীগ সরকার পাকিস্তান পুলিশ কর্মকর্তা সৈয়দ আমীর খসরুকে নিয়োগ দেয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব পদে। পাকিস্তানের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্য এবং আমেরিকার ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই ও ইনপোলসে-তে প্রশিক্ষিত এমএন হুদাকেও নিয়োগ দেয়া হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা যাক যে এরা কেউ বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করেননি; খুনিদের সহায়তাই করেছেন; বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের সরকার কর্তৃক এদের আরও উচ্চতর পদায়ন ও ক্ষমতায়ন তার ইঙ্গিত দেয়।
    উল্লেখ করা যেতে পারে যে মিজানুর রহমান চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর এককালের রাজনৈতিক সহকর্মী; বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর একসময় তিনি আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনেও ভূমিকা রাখেন। ২০০২ সালের ১৩ আগস্ট আজকের কাগজের প্রতিবেদক জাহিদ রহমানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান যে বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন/চার দিন আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী মাওলানা মান্নান— যিনি পরে দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক হয়েছিলেন— তার বাসায় এসে সাবেক সিএসপি আব্দুর রব চৌধুরীর বরাত দিয়ে তাকে ‘একটা গোপন কথা’ জানান। গোপন কথাটি হলো— ‘দু’চার দিনের মধ্যেই খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে দেশে রক্তের গঙ্গা বয়ে যাবে’। এখানে বিষয় হলো খন্দকার মোশতাক ও সেনাবাহিনীর খুনিদের বাইরে এমনকি স্বাধীনতা বিরোধীরাও যখন বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন/চার দিন আগে থেকে হত্যা-পরিকল্পনাটি জানতেন— যা আসলে প্রণীত হয়েছিল আরও ছয় মাস আগে— সেখানে গোয়েন্দা বিভাগ এ তথ্য জানতো না এমনটি বিশ্বাসযাগ্য নয়। গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তাগণ অবশ্যই এ পরিকল্পনার অংশ ছিলেন। প্রসঙ্গত লরেন্স লিফস্যুলৎসের ‘বাংলাদেশ: দি আনফিনিশড রেভ্যুলুশন’ থেকে একটি চমৎকার অংশ দেখা যাক— লিফস্যুলৎস কথা বলছিলেন এনএসআই-এর কর্মকর্তা এমএন হুদার সাথে— ÒWhen asked whether the N.S.I. had been incompetent in discovering the conspiracy to kill Mujib or whether it was true the N.S.I. itself had been involved, Huda laughed and said the question was a very, very clever one. But he would not answer.প্রয়োজন নেই।
    অধ্যায় পাঁচ. সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর এখানে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের ক্যুদেতার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও সংগঠক মেজর নাসির উদ্দিনের ‘গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী’ এবং ‘বাংলাদেশ: বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর’ বই দুটো থেকে সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরে ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের দালালদের পুনর্বাসনের দিকটি দেখা যাক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় পাকিস্তানের এক নম্বর সামরিক আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কেএম রহমানকে স্বাধীনতার পর দায়িত্ব দেয়া হয় সেনাবাহিনীর সরবরাহ ব্যবস্থার প্রধানের পদে। রাজাকার বাহিনীর উপপ্রধান লে. কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিনকে দেয়া হয় রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের পদ। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্টে চাকুরিরত থেকে বাঙালিদের হত্যাকারী— বিশেষত তেলিয়াপাড়া, মনতলা ও আখাউড়া এলাকায় যার গোলায় শহীদ হয়েছেন শত শত শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা— সেই ক্যাপ্টেন হাকিমকে দেয়া হয় সেনা-পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব। সেনা পুলিশে আরও নিয়োগ দেয়া হয় পাকিস্তানের অর্ডিন্যান্স কোরের কর্মকর্তা লে. আল ফরিদ ও লে. মোদাব্বেরকে; এরা ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সেনা বাহিনীকে সহযোগিতা করেছেন। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সেনা কর্মকর্তাদের বসানোর পাশাপাশি ভয়াবহতম যে কাজটি করা হয় তা হচ্ছে— প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিজিএফআই প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয় এয়ার কমোডর আমিনুল ইসলামকে। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি বাঙালি হয়েও বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স বা আইএসআইয়ের পরিচালক ছিলেন। এভাবে ক্রমে সেনা বাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সর্বত্রই কায়েম হয় পাকিস্তানপন্থী অফিসারদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ। [আগামী কাল তৃতীয় পর্ব]

  • অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ: পর্ব ১

    অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ: পর্ব ১

    জিয়াউল হক মুক্তা

    [জিয়াউল হক মুক্তা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এ রচনায় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্যের সাথে যোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিচার-আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও কিছু সাক্ষ্যভাষ্য এবং বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রি প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিজনদের কিছু বক্তব্য; এবং বর্তমান লেখকের গবেষণালব্ধ কিছু পর্যবেক্ষণ। সবশেষে প্রধানমন্ত্রির সদয় বিবেচনা ও সকলের আলোচনার জন্য যোগ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা সত্যানুসন্ধান কমিশন’ বিষয়ক কিছু বিষয়গত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা। পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় লেখাটি ১৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আজ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম পর্ব।]

    অধ্যায় এক. ত্রিচক্রযান
    [১] ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পাটি অফ বাংলাদেশ বা সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের সাবেকদের মধ্যে আত্মশ্লাঘা-জর্জরিত পরাজিতদের প্রতিভূ, আর [২] ছাত্রলীগে ও বহু-মত-পথের দল আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা প্রথমে স্বাধীনতার বদলে কেবল স্বায়ত্তশাসনে সন্তুষ্ট ছিলেন, পরে ১৯৬৯-১৯৭০ সালে স্বাধীনতার পক্ষে আসেন কিন্তু সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন, আরও পরে ১৯৭০-১৯৭১-এ স্বাধীনতা-সমাজতন্ত্র মেনে নিলেও স্বাধীনতার পর ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে পশ্চাদপদ অবস্থান নিয়েছেন এবং স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনে কোন বৈপ্লবিক পন্থা না নিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছেন, আর [৩] যারা পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের ফেডারেশন-কনফেডারেশনের স্বপ্নবিভোর খুনি খন্দকার মোশতাক আহমাদের দক্ষিণপন্থার প্রেতাত্মা— তারা সবাই সমস্বরে— গভীর-নিশিথে ধূর্ত শেয়ালের দল যেমন সমস্বরে হুক্কাহুয়া করে ওঠে— তেমনভাবে জাসদের বিরুদ্ধে উৎসবে-আনন্দে-কোরাসে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন বছরের দুটো সময়— ১৫ আগস্ট ও ৭ নভেম্বরের আগে-পরে। এদের উৎসবে-আনন্দে-কোরাসে কখনও কখনও অতিথি হিসেবে যোগ দেন জামাত-জঙ্গি-বিএনপি-তেঁতুল ও জাতীয় পার্টির লোকজন। এ দুটো মওসুমে তারা জাসদ-সমালোচনার মধ্য দিয়ে এক বিকৃত আনন্দলাভ করেন। বলে রাখা ভালো যে উল্লিখিত দ্বিতীয় ধারার নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি ও তৃতীয় ধারার নেতা ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমাদ; এঁদের বিষয়ে পরে আরও কথা হবে।

    বাংলাদেশের লেখক ও সাংবাদিকদের একটা নগণ্য অংশ ন্যাপ-সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আগত; এবং এরাই, এদের লেখালেখি ও বক্তব্যের মধ্য দিয়ে— যতোটা না আওয়ামী লীগ ও অপরাপর দলের ব্যক্তিবর্গ জাসদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন— তার চেয়ে বেশি উগ্র ও উন্মত্ত হয়ে ওঠেন জাসদের বিরুদ্ধে। ন্যাপ-সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের এসব সাবেক নেতা-কর্মীগণ অতীতে বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মেনে নিতে পারেননি, ছয় দফা মেনে নিতে পারেননি, বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিতে পারেননি; এবং এর ফলে এদেরকে বিশ্বাস করা হতো না বলে ১৯৭১ সালের সুমহান মুক্তিযুদ্ধে এরা অনানুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণের অধিকারও পাননি। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে ভূরাজনীতিগত কারণে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ৯ আগস্ট মৈত্রিচুক্তি স্বাক্ষরের পর যুদ্ধের শেষদিকে এসে এদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ছাড় দেয়া হয়। সংখ্যায় অতি নগণ্য এরা হলেন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে গণপ্রত্যাখ্যান থেকে বাঁচানোর জন্য ‘দায়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা’— পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কল্পিত বিপ্লব না হাতছাড়া হয়ে যায়— সে ভয়ে।

    এদের আগের আমলনামাও একই সাক্ষ্য দেয়। ব্রিটিশ শাসনামলেও এরা সমাজতান্ত্রিক-আন্তর্জাতিকতার নাম করে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রগতিশীল বণকৌশলের সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান ঔপনিবেশিক আমলে এদের যে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি— সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির যে স্বকল্পিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তজাত জমিদারি— ১৯৬২ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও আওয়ামী লীগের স্বাধীনতাপন্থী-সমাজতন্ত্রী ছাত্র-যুব-নেতৃত্ব এবং ১৯৭২ সাল থেকে ওই স্বাধীনতাপন্থী-সমাজতন্ত্রী ছাত্র যুবসমাজ কর্তৃক গঠিত জাসদ— তা তছনছ করে দেয়। আর তাই যে কোন সুযোগে জাসদের প্রতি এরা প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে ওঠেন; প্রয়োজনে নদীর রচনা লিখতে গিয়ে— যেহেতু শুধু গরুর রচনাই মুখস্ত আছে— নদীর তীরে গরুকে ঠেলে দিয়ে নদীর রচনার নামে সে গরুর রচনা উগলে দেন। এসবের ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে।

    ব্রিটিশ আমলে তাদের যে রাজনৈতিক দীনতা ও পরাজয়— সময়ানুসারে দূরে বলে তারা তা মোটামুটি কাটিয়ে ওঠেছেন। তবে পাকিস্তান আমলের পরাজয়ের ধারায় স্বাধীন বাংলাদেশেও তাদের একাধিক রাজনৈতিক পরাজয় আছে জাসদের কাছে— এদের মধ্যে কেবল একটি হলো এ যে— ১৯৮৩ সালে সূচিত সামরিক স্বৈরশাসন-বিরোধী গণআন্দোলনের সময় ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ থেকে ন্যাপ-সিপিবি ও আওয়ামী লীগ হেঁটেছিল সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পরিবর্তে আপোষের পথে, ১৫ দলের আন্দোলন পরিত্যাগ করে করে তারা জান্তার নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন ১৯৮৬ সালের ৭ মে; কিন্তু দুবছরের কম সময়ের মধ্যে ফিরে আসতে হয়েছিল রাজপথে— জাসদের গণঅভ্যুত্থানমূলক রাজনীতির লাইনে। ১৯৯০ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসন অবসানের মধ্য দিয়ে আদর্শিকভাবে জিতেছিল জাসদ। সিপিবি’র রণকৌশল কখনও জেতেনি। এ রকম বারবার রণকৌশলগত পরাজয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মনোবিকলনজাত আত্মশ্লাঘা জর্জরিত ন্যাপ-সিপিবির সাবেকদের প্রতিভূরা যে প্রতিনিয়ত জাসদের বিরুদ্ধে বলতেই থাকবেন— এ আর নতুন কী!

    অধ্যায় দুই. দ্বিচক্রযান: উপদল ও উপ-উপদল
    বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে যারা তাঁকে প্রেরিত-পুরুষের আসনে বসিয়ে স্তুতিগান বা বন্দনা করেন— তারা প্রকারান্তরে তাঁর সারাজীবনের ধারাবাহিক সংগ্রামকে অস্বীকার করেন। একটি মিশনে প্রেরিত পুরুষের নিজের অবদান থাকে কম, ঈশ্বরের ইচ্ছায় ও ঈশ্বরের সহায়তায় তাঁরা হাঁটেন ঈশ্বর-নির্দিষ্ট পথে। কিন্তু মানুষকে তার পথ তৈরি করে নিতে হয়, এবং সেজন্যই মানুষ হয়ে ওঠেন কথিত প্রেরিত পুরুষের চেয়েও মহান— জিতে যাওয়া বা হেরে যাওয়া নির্বশেষে। বাংলার মানুষের প্রতি সুগভীর ভালোবাসা থেকে রাজনীতি-আন্দোলন-সংগঠন গড়ে তুলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু নীতি-নিষ্ঠা-মেধা-কৌশল-শৃঙ্খলা-দক্ষতা-অভিজ্ঞতা-জ্ঞান-প্রজ্ঞার সুষম প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। বাঙালি জাতির সংগ্রামের পথে পথে হেঁটে গোপালগঞ্জের খোকা-তিনি গড়ে ওঠেছেন ধীরে ধীরে; তিনি নিজেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বক্তব্যে বলেছেন যে বাঙালির সাথে তাঁর সম্পর্ক ‘ইমোশনাল’ বা আবেগপ্রবণ [তিনি কোনোদিন কল্পনা করতে পারেননি যে বাঙালির কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারে]; বাঙালি জাতির জাতীয়তাবোধের প্রতি যে আনুগত্য তিনি প্রদর্শন করেছেন, বাঙালি জাতি তাঁকে তা ফিরিয়ে দিয়েছে বহুগুণে— তিনি অভিহিত ও অভিষিক্ত হয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জাতির জনক’ অভিধায়।

    ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরপরই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের পূর্ববর্ণিত ওই দুই রাজনৈতিক উপদল— যথাক্রমে শেখ মনির নেতৃত্বাধীন অংশ ও মোতাশতাকের নেতৃত্বাধীন অংশ— দ্রুত তাঁর চারপাশে এক কঠিন দেয়াল তুলে দেয় যাতে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-জাতীয়তাবাদের অনুসারী প্রগতিশীল ছাত্র-যুব সমাজ তাঁর কাছে ঘেঁষতে না পারেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ— একাত্তরের অক্টোবরে যা মুজিব বাহিনী নাম গ্রহণ করে— পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধুর নিজের নির্বাচিত চার যুবনেতা— সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ— তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তাঁকে ৪ দফা সুপারিশ প্রদান করেছিলেন, আর তার ক’দিন পর জানুয়ারির শেষ দিকে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-জাতীয়তাবাদের অনুসারী প্রগতিশীল ছাত্র-তরুণ-যুব সমাজের পক্ষ থেকে সিরাজুল আলম খান তাঁকে ১৫ দফা সুপারিশ প্রদান করেছিলেন। পরে আবারও ছাত্র-তরুণ-যুবকদের পক্ষে আসম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ ও শরীফ নূরুল আম্বিয়া ১৯৭২ সালের ২৫ মে এক বিবৃতিতে— বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে যা সকল দেশে হয়ে থাকে, সেভাবে— তাঁর প্রতি “জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সকল ক্ষমতার উৎস বলে ঘোষণা করতে হবে”সহ ১২ দফা সুপারিশ গ্রহণের আহ্বান জানান। এ আহ্বানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য-প্রবল অবস্থান নিলেন এ রচনার শুরুতে বর্ণিত তিন পক্ষ [পরে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে]। এদের প্রকাশ্য-প্রবল বিরোধীতার মুখে— ১৯৭২ সালের ৭ জুন ছাত্রলীগের প্রকাশনার মাধ্যমে সকল পক্ষকে এসব না মানার বিপদ সম্পর্কে অবহিত করা হলেও— বঙ্গবন্ধু সেসব সুপারিশের কিছুই গ্রহণ করতে পারলেন না। শামসুদ্দিন পেয়ারার ‘আমি সিরাজুল আলম খান: একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য’, ও মনিরুল ইসলামের [মার্শাল মনি’র] ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র’ ও ১৯৭২ সালের ৭ জুন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ প্রকাশিত পুস্তিকা ‘৭ই জুন’ এবং অপরাপর ঐতিহাসিক দলিল, প্রকাশনা ও তৎকালীন পত্রপত্রিকা এর সাক্ষ্য দেয়।

    আওয়ামী রাজনীতির বর্ণিত দুই অভ্যন্তরীণ উপদল আর বহিঃশক্তি ন্যাপ-সিপিবির প্রকাশ্য-প্রবল বিরোধীতার ফলে বঙ্গবন্ধুর সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হলো তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী ও বিশ্বাসভাজন এবং এক দশক ধরে পরিচালিত স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা নেতা-কর্মীদের আশি ভাগের; পরিণতিতে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ [এ রচনায় এ বিষয়ে পরে আরও আলোচনা করা হবে]। তবে আপাতত কেবল এ বলে রাখা যাক যে জাসদকে প্রতিবিপ্লবী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে জাসদের উপর রাজনৈতিক দমন-পীড়ন পরিচালনায় শেখ মনি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত যুবলীগের নৃশংস ভুমিকা ছিল— নৃশংসতা ছিল তার সাধারণ কর্মপদ্ধতি। জাসদের প্রথম আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রহমত আলীকে প্রথম দিনই তুলে নিয়ে নির্যাতন করে পদত্যাগ পত্র লিখিয়ে নিয়েছিলেন শেখ মনি নিজে। ১৯৭৩ সালের ৪ জানুয়ারি তার অনুসারীরা শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে হামলা করেন, যাকে সামনে পান তাকে পেটান, ছাত্রলীগ সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়ার হাত ভেঙে দেন ও সাধারণ সম্পাদক আফম মাহবুবুল হকের মাথা ফাটিয়ে দেন। এক মাস তারা হাসপাতালে ছিলেন। শেখ মনি নিজেকে বিপ্লবী ভাবতেন; সেজন্য সে সময়ের অপরাপর সংগঠনের সাধারন অনুশীলনের বাইরে গিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আদলে সর্বময় ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে যুবলীগে চেয়ারম্যান পদ তৈরি করে তার চেয়ারম্যান হন। যদিও স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বিপ্লবী ধারার তেমন কেউ যুবলীগে যোগ দেননি; বরং কাজী ফিরোজ রশীদ চৌধুরী টাইপের এলিমেন্টের আধিক্য ছিল যুবলীগে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল গঠনের পর সিপিবি-ন্যাপ তাকে সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী বানাতে সমর্থ হয়েছিল।

    জাসদ গঠন হয়ে যাবার পরও, আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতির অভ্যন্তরে শেখ মনির ক্ষমতালিপ্সা আবারও উপ-উপদলীয় কোন্দল তৈরি করলো, তারা সরিয়ে দিল তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতৃত্ব; আর তা শেষবিচারে শক্তিশালী করলো মোশতাকের উপদলকে। রচনার এ অংশে শেখ ফজলুল হক মনি বনাম আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বাধীন উপ-উপদল সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ রাজনীতির একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক, সমর্থক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরীর [আগাচৗ] লেখার তথ্যসূত্রে।

    বঙ্গবন্ধু যখনই দেশের বাইরে থাকেন, এই উপ-উপদলীয় কোন্দল সশস্ত্র রূপ পায়; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩-এ খুন হলেন তিনজন আর ১৯৭৪-এর এপ্রিলে সূর্যসেন হল ও মহসিন হলে সংঘটিত হলো কুখ্যাত ‘সেভেন মার্ডার’; এ বিষয়ে আগাচৌ বলছেন, “তাহলে কি তাঁর [বঙ্গবন্ধুর] আমলাতন্ত্র, থানা, পুলিশ, সেনাবাহিনী কোন কিছুই কাজ করছে না? নাকি ভিতরের অথবা বাইরের উস্কানীতে তারা নিষ্ক্রিয়?” ১৯৭৪ সালের ৩০ মার্চ আওয়ামী ছাত্রলীগের এক সভা থেকে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে— গাজী গোলাম মোস্তফা ও অন্যান্যদের নামে— দুর্নীতির অভিযোগ এনে তাদের বিচার দাবি করা হয়; দুনী‍র্তিবাজদের প্রতি শেখ মনির আশ্রয়-প্রশ্রয়-পক্ষপাতিত্বের আভিযোগ ওঠে; এদিনই শেখ মনি বলেন যে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ঝগড়ায় তার কোন হাত নেই। অভিযোগ ছিল শ্রমিক লীগে উপদলীয় কোন্দলের পর ছাত্রলীগেও শেখ মনি এই দ্বন্দ্ব সম্প্রসারিত করেছিলেন এবং ছাত্রলীগ ভেঙে আরেকটি ছাত্রলীগ করতে চেয়েছিলেন। এদিন রাতে হোটেল পূর্বাণীতে আগাচৌ ও শেখ মনির আলোচনায় আগাচৌ ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বদলে ‘দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক পন্থা ও পদ্ধতির উন্মুক্ত থাকা প্রয়োজন’— এ কথা বললে শেখ মনি বিরক্ত হয়ে বলেন যে ‘সকল সময় তত্ত্ব দিয়ে রাজনীতি চলে না’। আগাচৌ তাকে বলেন যে শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ হয়ে আওয়ামী লীগে এ দ্বন্দ্ব সম্প্রসারিত হলে তা শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকেই আঘাত করবে, এবং বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করলে সে সময় তারাও কেউ রেহাই পাবেন না। আগাচৌ তাকে বলেন, নীতিগত আনুগত্যের বদলে ব্যক্তি-আনুগত্য দিয়ে কোন কাজ হবে না। [আগামী কাল দ্বিতীয় পর্ব]

  • সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ খিচ্চু  : তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা

    সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ খিচ্চু : তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা


    ———————————————————
    আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম
    ———————————————————

    জাসদ পরিবারে আমাদের সবার প্রিয় খিচ্চু ভাইয়ের ছবি হয়ে যাওয়ার ১০ বছর হলো আজ ১৬ জুলাই। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর ছাত্র নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শ্রমিক নেতা, জননেতা ও জাসদের দুই মেয়াদের সাধারণ সম্পাদক। ২০১০ সালের এইদিন রাতে মিরপুর রূপনগরে বাসায় আকস্মিকভাবে মারাত্মক হার্ট অ্যাটাকে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। তাঁর হার্টে সামান্য সমস্যা ছিল; এজন্য একটা স্টেন্টও বসানো হয়েছিল; তারপর ভালই ছিলেন; কার্ডিওলজিস্টের সাথে নিয়মিত ফলো-আপ করতেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য— দীঘল দেহের মানুষটিকে আমরা হারিয়ে ফেললাম। পৃথিবীতে সব শূন্যস্থানই পূর্ণ হয় সময়ের সাথে। কিন্তু কিছু শূন্যস্থান পূর্ণ হবার পরও শূন্য হবার দাগচিহ্ন থেকে যায়।

    জাসদের রাজনীতি ও সংগঠনে খিচ্চু ভাই চলে যাওয়ার শূন্যস্থানে অমোচনীয় দাগচিহ্ন থেকে গেছে। কারণটা কী? খিচ্চু ভাই ছিলেন দলকেন্দ্রীক মানুষ, সাধারণ কর্মীকেন্দ্রীক মানুষ, দলের অফিসকেন্দ্রীক মানুষ। সহজেই দলের যে কেউ খিচ্চু ভাইয়ের কাছে যেতে পারতেন। নির্ভয়ে কথা বলতে পারতেন। এর জন্য কোনো আনুষ্ঠানিকতা লাগতো না, আয়োজন করা লাগতো না, ঘটা করাও লাগতো না। যে কারণে কথা— তার সহজ উত্তর ও সরল সমাধান পেতেও সময় লাগতো না। কারণ, খিচ্চু ভাই রাজনীতি ও দল করাকে জটিল-কঠিনভাবে দেখতেন না।

    তাঁর কাছে রাজনীতি করা ও দল করার মানেই ছিল দলের বক্তব্য ও কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে যাওয়া, মানুষকে বুঝিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করা। মানুষের বিপদে-সংকটে পাশে-সাথে থাকা। মানুষের মনের মধ্যে যে কথাগুলো ঘুরপাক খায়— সেগুলো যেন তারা গুছিয়ে বলতে পারেন সেটা শিখিয়ে দেয়া। এটুকু করতে পারলেই রাজনীতি ও দলের কাজ করা শুরু হয়ে গেলো। এটা করার সিদ্ধান্ত নেয়া আর লেগে থাকাটাই হচ্ছে কঠিন। যিনি পারেন— তিনি নিজের ক্ষুদ্র পরিসরে কর্মী আর কর্মী থেকে নেতা হন— ধীরে ধীরে তাঁর পরিসর বাড়ে— বড় নেতা হন। তিনি বলতেন নেতা মানে পদ না, দায়িত্ব।

    খিচ্চু ভাইয়ের মনের চিন্তা, মুখের কথা, বক্তৃতার ভাষা, কাজ, আচরণ, চালচলন ও জীবনযাপনের এক ও অভিন্ন দর্শন ছিল। আর তা হলো— দেশপ্রেম ও সমাজতন্ত্র। তিনি অত্যন্ত সহজ সরল সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তিনি অকৃতদার ছিলেন। তাঁর জীবনযাপনের চাহিদা ছিল খুব সামান্য ও সাধারণ। খিচ্চু ভাই ব্যক্তিগত সম্পদ ও সম্পত্তির মালিক হবার সকল লোভের উর্ধে ছিলেন। তাঁর এই জীবনদর্শনের ভিত্তি ছিল সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে খিচ্চু ভাইয়ের কোনো ছাড় ছিল না।

    জাসদের প্রতিষ্ঠাতা, পিতৃপুরুষ ও বড় বড় নেতারা তাদের নিজেদের দলকে পরিত্যাগ-পরিত্যক্ত করে নিজেদের সুবিধামতো দল করেছেন, বিভিন্ন দলে চলে গিয়েছেন। কিন্তু খিচ্চুভাই জাসদকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন।

    কীভাবে তাঁর এই জীবনের শুরু?

    ১৯৪৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার রতুয়ায় নানাবাড়িতে তাঁর জন্ম। জন্মের ১৮ মাস পর মা শেখ সাইরুন্নেসা তাঁকে নিয়ে চলে আসেন পাকশিতে স্বামী সৈয়দ শামসাদ আলীর কাছে। খিচ্চু ভাইরা ছিলেন ৫ ভাই ও ৩ বোন। তাঁর বাবা রেলওয়ের প্রথম শ্রেণির কন্ট্রাক্টর ছিলেন। খিচ্চু ভাইয়ের বাবা-দাদার আদিবাড়ি পশ্চিমবঙ্গ— অধুনা ঝাড়খন্ডের রাজমহলে। তাঁর বাবা রেলওয়ের কন্ট্রাক্টরি ব্যবসার কারণে পাকশিতে চলে আসেন ১৯৩৫ সালে। পাকশি কেন বিখ্যাত সবারই জানা। পদ্মা নদীর উপর ব্রিটিশরাজ নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পাকশিতেই। আর এই ব্রিজকে কেন্দ্র করে বৃটিশ আমল থেকেই পাকশি একটি রেল সিটি। আধুনিক শিল্প নগরী।

    খিচ্চু ভাইয়ের বাবা ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের জেলখাটা কর্মী। তাঁর দাদা সৈয়দ গওহর আলী ও দাদার বাবা সৈয়দ আনোয়ার আলী ছিলেন রাজমহলে বড় ভূস্বামী। তারা মালদা শহরে একটি বড় বাসভবন নির্মান করে সেখানেই বসবাস করতেন। বর্তমানে মালদা জেলা সার্কিট হাউস ভবনটিই ছিল খিচ্চু ভাইয়ের দাদার বাসভবন।

    পাকশির নাগরিক পরিবেশেই খিচ্চু ভাইয়ে শৈশব-বাল্য-কৈশোর-যৌবন কেটেছে। পাকশির চন্দ্ররভা স্কুলে তিনি লেখা পড়া করেন। ৯ম শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৬৫ সালে ছাত্রলীগে যোগদান করেন। সে বছরই পুলিশী নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে একুশের প্রভাতফেরি করতে গিয়ে গ্রেফতার হন এবং কারাবরণ করেন। ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক পাস করে ঈশ্বরদী সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি উচ্চমাধ্যমিক ও বি.কম. পাস করেন। ১৯৬৮-৬৯ শিক্ষাবর্ষে ঈশ্বরদী কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মনোনীত প্যানেল থেকে ভিপি পদে নির্বাচন করে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হন।

    ষাটের দশকে ঈশ্বরদী ছিল চীনপন্থী বাম অধ্যুষিত এলাকা। এ এলাকায় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ করা অত্যন্ত দরূহ ছিল। খিচ্চু ভাইয়ের হাত ধরেই ঈশ্বরদীতে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের উত্থান ঘটে।

    ১৯৭০ সালের ৭ জুন স্বাধীকার দিবসে ছাত্রলীগ কর্তৃক জয়বাংলা বাহিনীর মার্চপাস্টে প্রথম প্রদর্শনের পর ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব স্বাধীনতার পতাকা প্রদর্শন করেন। তার দুদিন পর ৪ মার্চ পাকশি রেলওয়ে ময়দানে খিচ্চু ভাই স্থানীয়ভাবে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।

    ১৯৭১ এর ২৯ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঈশ্বরদীর বাঁশের বাধা নামক স্থানে সম্মুখ যুদ্ধের মাধ্যমে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয় এবং খিচ্চু ভাইয়ের সহযোদ্ধা রঞ্জু ও গফুর শহীদ হন। এরপর তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে রিট্রিট করে ভারতে চলে যান।

    ভারতে এফএফ-এর ট্রেনিং নিয়ে ৩০ জনের ট্রুপস নিয়ে আবার দেশের অভ্যন্তের প্রবেশ করেন। তিনি এফএফ ঈশ্বরদী থানার কমান্ডারের দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে বিএলএফ-ও তাকে ঈশ্বরদী থানার কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়। মুক্তিযুদ্ধে খিচ্চু ভাইসহ মাত্র কয়েকজন ব্যতিক্রম আছেন— যাঁরা একই ব্যক্তি হিসেবে এফএফ ও বিএলএফ দুই বাহিনীর থানা কমান্ডারের দায়িত্ব পান; এবং এসব ক্ষেত্রে দুই বাহিনী একই কমান্ডে মুক্তিযুদ্ধ করে।

    খিচ্চু ভাইয়ের দুর্ভাগ্য সদ্য স্বাধীন দেশে তিনি বেশিদিন এলাকায় থাকতে পারেননি। আওয়ামী লীগ ও চীনপন্থী আলাউদ্দিন বাহিনী তাঁকে হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এরকম পরিস্থিতিতে দলের নির্দেশে ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। মোহাম্মদ শাহজাহান ও রুহুল আমিন ভুইয়ার সাথে শ্রমিক লীগের কাজের সাথে যুক্ত হন। জাসদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলে তিনি তাতে শ্রম বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮৩ সালে জাসদের ভাঙ্গন হলে তিনি জাসদ (রব) গ্রপের সাথে যুক্ত ছিলেন।

    ১৯৯৭ সালে জাসদ ঐক্যবদ্ধ হবার পর তিনি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন। ২০০২ সাল এবং ২০০৫ সালের কাউন্সিলে পরপর দুইবার জাসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৪ দল গঠনের উদ্যোগের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং ১৪ দলে জাসদের প্রতিনিধি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান পিপলস ফোরাম-বিবিপিপিএফ-এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

    সাধারণ থেকে রাজনীতিতে অসাধারণ হবার অনন্য নজির খিচ্চু ভাই। জাসদের সংগ্রামী রাজনীতি ও গণমানুষের রাজনীতির প্রতীক হয়েছিলেন তিনি।

    ভুলি নাই, ভুলবো না— খিচ্চু ভাই।
    অভিবাদন আপনাকে।
    আপনি আমাদের কাছে এখন শুধু ছবি নন। একজন আদর্শ।

  • এসজিডির সফল বাস্তবায়নে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের বিশেষ মনোযোগ

    এসজিডির সফল বাস্তবায়নে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের বিশেষ মনোযোগ

    আশেক-ই-এলাহী: বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার থেকে সম্পূর্ন পৃথক এক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গড়ে উঠেছে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল। যে এলকাটি বিশ্বব্যাপি সাম্প্রতিক মহাসংকট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল। সাগরের নোনাপানি আর উজানের মিষ্টি পানির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা উপকূলীয় এ অঞ্চলের ভুমি গঠনের সাথে রয়েছে জোয়ার ভাটার প্রভাব। জোয়ারে পলি অবক্ষেপনের মাধ্যমে ভূমির গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ার আগেই ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ করায় ভূমি বসে যেয়ে নদী পাড় অপেক্ষা বাঁধের মধ্যের জমি নিচু হয়ে যায়। পাশাপাশি পলি জমিতে (প্লাবনভুমিতে) না পড়তে পেরে নদীর মধ্যে পড়ায় নদীর তলদেশ উচু হতে শুরু করে। উপকূলীয় বাঁধ এর নির্মাণকালীনগলদরে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ৭০ দশকের শেষ দিকে বিশেষ করে আশি সালে মারাত্মক আকার ধারণ করে। কৃষি উৎপাদন নেমে আসে নিন্মস্তরে আর তৈরী হতে থাকে অঞ্চল ভিত্তিক জলাবদ্ধতা।

    বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রবণতা অত্যাধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় উপকূলীয় দেশ সমুহের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুকিতে আছে। দেশের মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে দক্ষিণ-পচিম উপকূলীয় অঞ্চল। সমুদ্রপৃষ্ঠে ঘূর্ণিঝড় ও জলচ্ছ্বাস প্রায়শ তৈরী হচ্ছে। আগে যেটি দশ বছরের অধিক সময়ে একবার ঘটতো, বর্তমানে সেটি প্রায় প্রতি বছর হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে উপক’লের মানুষ ফণি, বুলবুল ও সর্বশেষ আম্ফানে আক্রন্ত হয়েছে। ২০০৯ আইলায় প্রচন্ড বিপর্যস্তার সম্মুখিন হয় দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মানুষ। দশ বছরের পরও আইলার ক্ষতির রেশ কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আম্ফান আইলায় বিধ্বস্ত এলাকাকে আবারও বিধ্বস্ত করে। আম্ফানে সরকারের সময় উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে প্রানহানি প্রায় শুন্যের কোটায় থাকলেও সম্পদের ক্ষতি হয় মারাত্মক। এমনকি সরকারের গত দশ বছরের উন্নয়ন কর্মকান্ডও প্রায় বিলীন হয়ে যায়।

    অন্য যে কোন এলাকার দুর্যোগের থেকে পৃথক দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের দূর্যোগের বাস্তবতা। এখানে দুর্যোগ এলাকার মানুষদের প্রতিদিন দু বার করে দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হয়। জোয়ারভাটার কারনে দুর্যোগ কবলিত এলকার মানুষদের কোনধরনের সহযোগীতা টেকসই হয় না, যদি না দুর্যোগ কবলিত এলাকায় জোয়ারের নোনা পানি উঠা বন্ধ করা না যায়। যার প্রধান অনুসঙ্গ হচ্ছে উপক’লীয় টেকসই বাঁধ। আইলার পর দু বছর জোয়ার ভাটার মধ্যে কাটানোর দুর্ভোগ সরকার প্রধানের সরাসরি হস্তক্ষেপ ও সেনাবাহিনী নিয়োগ দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে।
    ষাটের দশকে অর্থাৎ ১৯৬৬ সালে সম্পন্ন উপকূলীয় বাধঁ নিয়ে পরে আর কোন স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করে সংস্কারের ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে বর্তমানে যে ভেড়িবাঁধটি আছে সেটি বতমান জলবায়ু পরিবর্তনের সহযোগী জলোচ্ছ্বাস ঘূণিঝড় থেকে রক্ষায় অকার্যকর। শুধুমাত্র সুন্দরবনের কারনে সকল দুর্যোগে উপকূলের মানুষের জীবন ও সম্পদ ও সরকারী উন্নয়ন কর্মকান্ড আজও ধ্বংশের শেষ প্রান্তে এসেও টিকে আছে। এহেন বাস্তবতায় দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের সরকারী উন্নয়ন কর্মকান্ড, স্থানীয় মানুষের সম্পদ ও জীবিকার উৎস্য স্থায়ীত্বশীল করতে উপকূলের নদী প্রবাহ, পলি অবক্ষেন, জোয়ারভাটার প্রভাব, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার জীববৈচিত্রসহ প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করে টেকসই উপকূলীয় বাধ নির্মানের বিকল্প নেই। মাননীয় প্রধান মন্ত্রী যেটি ২০১০ শ্যামনগরের হরিচরন হাইস্কুলের মাঠে ঘোষনা করেন।

    দূর্যোগ প্রবণ দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকাতে প্রকৃতিগত ভাবে প্রধান সংকট সাধু পানি। নোনা কবলিত ও সুমুদ্র এর কাছাকাছি হওয়ায় এখানে সাধু পানি বা নিরাপদ পানির সংকট মারাত্মক। শুধুমাত্র খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে যেয়ে নারী ও শিশুদের ৫ থেকে ৬ ঘন্টা বাড়ীর বাইরে থাকতে হয়। এবং শরীরের ওজনের অধিক ওজনের পানি পাত্র নিয়ে কিশোরীদের কয়েক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। ফলে শুধু খাওয়ার ও ব্যবহারের পানি সংকট এলাকার দারিদ্রতার হার অন্য এলাকার প্রায় দ্বিগুন করেছে। সরকারের ভীষন বাস্তবায়নে মাধ্যমে ক্ষুধামুক্ত, দরিদ্রমুক্ত সমতার বাংলাদেশ গড়তে উপকূলের পানির স্থায়ী সমাধন হওয়া জরুরী।

    দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল একটি শৃজনশীল ব্যতিক্রমধর্মি এলাকা। বাংলাদেশের এমনকি উপকুলের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পৃথক একটি অঞ্চল। বর্তমানে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা অঞ্চল এটি। দরিদ্রের হার বেশী, শিক্ষায় পিছিয়ে, মানুষের এলাকা ত্যাগের প্রবনতাও অধিক। সরকারকারের নানামুখি কর্মকান্ডও উপকূলের মানুষের জীবন মান উন্নয়নের লক্ষ্যে করা হচ্ছে। কিন্তু এখানে কর্মরত সকল সরকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতাও এলাকাতে মাঝে মধ্যে বিপর্যয় তৈরী করে, যেজন্য এখানে, হাওড়, বরেন্দ্র, পার্বত্য অঞ্চলের মত একটি কতৃপক্ষ হওয়া খুবই জরুরী। এখানের বন ও পরিবেশ মন্ত্রনালয়, কৃষি বিভাগ, মৎস্য, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র, পানি সম্পদসহ সকল মন্ত্রনালয়কে সমন্বিত করে কাজ করা জলবায়ু ঝুকিতে থাকা এলাকা হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

    এলাকার বিপর্যয়ের আরো একটি কারণ অপরিকল্পিত চিংড়ী চাষ। কৃষি জমিতে গড়ে তোলা চিংড়ী প্রকল্পের মালিকরা যথেচ্ছার ভাবে উপকূলীয় বাঁধকে নিজের ঘেরের রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করে থাকে, প্রয়োজনে অপ্রয়োজেনে ভেড়িবাধ কাটা, ফুটো করে এবং প্রকল্পের নোনা পানি অরিকল্পিত ভাবে নিস্কাশন করা ইত্যাদির ফলে বাঁধ ও পরিবেশের ঝুঁকি উত্তোর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

    দক্ষিণ-পশ্চিম বিশেষ করে সাতক্ষীরার উপকূলের কর্মক্ষম মানুষদের এলাকা ত্যাগের হার অনেক বেশী। কৃষি জমিতে নোনা পানি থাকায় কাজের সন্ধানে কেহ মৌসুম ভিত্তিক আবার কেহ কেহ স্থায়ী ভাবে এলাকা ত্যাগ করছে। ফলে পরিবারের শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধিদের ভার পরে পরিবারের নারীদের উপর। যা খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক নিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলে দেয়। শিশু শ্রম ও বাল্য বিবাহের প্রবনতা তৈরী করে।

    দুর্যোগ আর সমন্বয়হীন উন্নয়ন কর্মকান্ড দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মানুষের জীবন জীবিকা ও প্রশাসনিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনাকে অনিশ্চিত করে ফেলেছে। যা স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পক্ষে একটি বড় অন্তরায়। ‘কাউকে পিছনে ফেলে নয়’- এ ধারার সফল বাস্তবায়নে দক্ষিণ- পশ্চিম উপকূলের নাগরিকদের সংকট নিরসনের ও দ্রুত বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের জরুরী কর্মসুচি ও কার্যক্রম দরকার। এসজিডির সফল বাস্তবায়নে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের জন্য দরকার সরকারে বিশেষ মনোযোগ।