কর্নেল তাহের এবং ৭ই নভেম্বর


নভেম্বর ৯ ২০২০


তাহেরা বেগম জলি
জাসদ রাজনীতির অনেক কিছুই আজ আমার কাছে শুধুই স্মৃতি বা ইতিহাস। তবে সব স্মৃতি তো মুছে যায় না। এবং আমি চাইলেও তা যায় না। আবার এমন অনেক অতিত আছে, যে অতিতকে শুধু স্মৃতি বলেও পাশ কাটানো যায় না। শহীদ কর্নেল আবু তাহের আমার কাছে তেমনই এক ইতিহাস,যা শুধুই স্মৃতি বা অতিত নয়-আমার জীবনেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।


কর্নেল তাহের হত্যা মামলা পরিচালনা করবার সময় আমি ঢাকা কারাগারের বাসিন্দা ছিলাম। এটা আমার জীবনের একটা মস্তবড় দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার মাত্র ছয় বছরের মাথায় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সেই যুদ্ধেরই একজন সেক্টর কমান্ডারের হত্যাকান্ডের সাক্ষী হতে হয়েছে। শ্রদ্ধেয় সালেহা বেগম এই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন। এবং তিনি পাঁচ বছর কারাবাসে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ১৯৭৬য়ের মধ্য জুনে ( আমার যদি ভুল না হয়,মামলা শুরু হয়েছিলো ১৭ই জুন ) শুরু হওয়া মামলার রায় এক মাস পর ১৯৭৬-১৭ই জুলাই ঘোষণা করা করা হয়। রায় ঘোষণার পর সালেহা আপা যখন আমাদের নির্ধারিত সেলে ফিরে এলেন,আমরা সকলেই তখন জানতে চেয়েছি তাহের ভাইয়ে কী হোলো। আমরা মানে শিরীন আপা এবং আমি সহ আরও দুই চার জন। সালেহা আপা সেদিন মুখ ফুটে বলতে পারেননি তাহের ভাইয়ের ফাঁসির দ-ের কথা। অনেক কষ্টে বলেছিলেন কী আর হবে,যা হবার তাই হলো। আমরা ঐ সময়ে নিজেদের কথা বলার ধরণ বা আকার ইঙ্গিত বুঝতে পারতাম। তাই ঐটুকুতে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি তাহের ভাইয়ের ফাঁসির দ-াদেশের কথা। রায় ঘোষণার পরদিনই ১৮ ই জুলাই সালেহা আপাকে বরিশাল কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে ১৭ই জুলাই থেকে-তাহের ভাইকে নিয়ে কারা কতৃপক্ষের ব্যস্ততার গল্প আমাদের কানে আসা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। বা আমরাও চেষ্টা করতাম সে সব খবর জানতে। মামলা চলাকালীন প্রতিদিনের ঘটনা আমরা সালেহা আপার কাছেই জানতে পারতাম। এবং তা জানবার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকতাম। তাছাড়া কারাগারে কোন কিছুই গোপন থাকে না। বিশেষ ক’রে রাজনৈতিক বন্দীদের ব্যাপারে। মুখে মুখে সকলেই তা জেনে যায়। তাহের ভাইকে ২০ তারিখে জরুরী ভিত্তিতে তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করানোর সংবাদ যথারীতি আমাদের কানে এলো। তখন আমাদের অনুমান করতে দেরি হয়নি,সহসাই আমাদের জন্য একটা বড় ধরণের দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। অবশেষে এলো সেই নির্মম রাত, যে রাত সকাল হতেই আমরা জানতে পেরেছিলাম,তাহের ভাইয়ের মরদেহ জেলগেটে।


২১শে জুলাই সকাল। অন্যান্য দিনের মতোই খুব ভোরে আমাদের সেলের তালা খুলে দিয়ে সুবেদার সাহেব চাবি নিয়ে চলে গেছেন। আমাদের মনটা একেবারেই ভালো ছিলো না,কারণ চারিদিকে ঘটছিলো এমন কিছু ঘটনা,যেখানে আমাদের করবার কিছুই ছিলো না। কিন্তু আমাদের জন্য তা ছিলো অত্যন্ত বেদনার। আমরা বিষণ্ণ মনে নিজেদের মধ্যে এই সব কথাই বলাবলি করছিলাম। আমরা নিজেদের মধ্যে আরও বলাবলি করছিলাম,তাহের ভাইকে পরিবারের সঙ্গে যেহেতু বিশেষভাবে দেখা করানো হয়েছে,তাহলে পরিস্থিতি নিশ্চয় ভালো নয়। আমাদের মুখের কথা মুখেই আছে,সকালের দায়িত্বপ্রাপ্ত জমাদ্দার্নী এর মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললেন,আপনারা সব সেলে ঢোকেন। তাহের সাহেবের মরদেহ জেল গেটে দেখে এলাম। আপনাদের সেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুবেদার সাহেব সে রকমই ব্যস্ত হয়ে এসে,আমাদের সেলের দরজায় তালা লাগিয়ে কোনো কথা না বলে চলে গেলেন। আমরা তখন জেলের মধ্যে সেল বন্দী হয়ে রইলাম। এবং সেই সেলবন্দী ছিলাম পাঁচ দিন। সেদিন সেলবন্দী করা হয়েছিলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রায় সকল রাজবন্দীকেই। সেলবন্দী হলেও আমরা সহ গোটা জেলখানা হয়ে উঠেছিল বেশ সরগরম। কারণ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অধিকাংশ বন্দীবাসিন্দা এবং কর্মকর্তা কর্মচারীরা তাহের ভাইকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। শহীদ কর্নেল আবু তাহের মানুষকে ভালবাসতেন এবং মানুষের ভালোবাসা তিনি আদায় করে নিতেও জানতেন। সম্ভবত তাহের ভাইয়ের রাজনৈতিক প্রভাব পড়েছিলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রায় সকলের উপরই। তাঁর রাজশক্তি মোকাবেলা করবার সাহস দেখে সকল রাজবন্দিই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ২১ জুলাই সকালে আমাদের সকলের কষ্ট দুঃখ তাই একাকার হয়ে গিয়েছিলো। তিনদিন আগে ঘোষণা করা কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ-, ২১ জুলাই ভোরে চোরের মতো কার্যকর করেছিলো তৎকালীন স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান। এবং এটা ছিলো নজিরবিহীন একটা নিকৃষ্ট-বর্বর ঘটনা। সভ্য জগতের সমস্ত নিয়ম ভেঙ্গে তাহের ভাইয়ের মামলা পরিচালনা করা হয়েছিলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে,এবং সে মামলার আদালত ছিলো মিলিটারি শাসিত। সেখানে কোনো অভিযুক্তদের স্বাধীন মতো আইনজীবী নিয়োগের অধিকার দেওয়া হয়নি। যদিও পরবর্তী সময়ে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি,কোনো কোনো সামরিক আদালতে বন্দীদের নিজেদের আইনজীবী নিয়োগের অধিকার দেওয়া হয়েছে। অথচ কর্নেল তাহেরকে নিয়ে গঠিত আদালতে,স্বাধীন মতো নিজেদের কথাও উপস্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। তার মানে দাঁড়ায় অন্যান্য সামরিক আদালতের থেকেও নিকৃষ্ট ছিলো কর্নেল তাহের মামলার সামরিক আদালত। ন্যাক্কারজনক এসব ঘটনা আমাদের দেশের সকল সচেতন মানুষই জানেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকার সুবাদে,ঐরকম একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়ার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিলো। যা আমার কাছে আজও একটা দুঃসহ স্মৃতি। সে সময় প্রতিটা মুহূর্তই আমরা পার করেছিলাম কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা নিয়ে। এতো কষ্টকর পরিস্থিতি অন্তত আমার জীবনে আর কোনোদিন আসেনি। ফাঁসির দ- ঘোষণার পর,শহীদ কর্নেল আবু তাহেরকে তিনদিন অতিক্রমের সময়ও দেওয়া হয়নি। কর্নেল তাহের ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার। স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র ছয় বছর আগে। এত কিছু বাদ দিলেও একটা স্বাধীন দেশের,একজন সাধারণ নাগরিকের যে অধিকার থাকে,তাহের ভাইকে সে অধিকারও দেওয়া হয়নি। তাহের ভাইয়ের সকল মানবিক অধিকার সেদিন হরন করা হয়েছিলো অত্যন্ত নিকৃষ্ট এবং নির্মমভাবে। জেনারেল জিয়াউর রহমান অবশ্য এই হত্যাকা-ে ফেলেছিলো স্বস্তির নিঃশ্বাস। যদিও আমাদের মতো অসংখ্য মানুষের চিরদিনের জন্য তা হয়ে রইলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস। একটা গৌরবের কথা এখানে বলি,চারিদিকের নিদারুণ সংকটে জড়িয়ে থাকা জাসদের নেতা কর্মীরা সেদিন কিন্তু সব বাঁধা অতিক্রম ক’রে বিক্ষোভ করেছিল। জাসদের নেতা কর্মীরা রীতিমত বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলো তাদের প্রিয় নেতার মর্মান্তিক হত্যাকা-ে। আজ সময় পাল্টেছে অনেক,পানি গড়িয়েছে অনেকদুর। কিন্তু তার পরেও তাহের হত্যাকারী এবং হত্যাকারীদের পদলেহনকারীদের ভুলে যাওয়া আমাদের মতো অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই,এই কথা আওড়ে যারা কালে কালে একাকার হয়েছেন তাহের হত্যাকারী বা হত্যাকারীর দলের সঙ্গে,যারা যে কোন ধরনের নিকৃষ্ট উপায় সহজ করবার ফন্দি হিসেবে বলে থাকেন রাজনীতি ব’লে কথা,হোক না তাহেরের খুনি,তবুও আমার বা আমাদের তরী ঐ ঘাটেই বাঁধবো। তারা নিক্ষিপ্ত হোক ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। জনতা প্রস্তুত করুক সেই বিচারাসন,যেখানে তাহের হত্যাকারী এবং তার পদলেহীদের বিচার যেন হয় একই মানদ-ে।
৭ই নভেম্বর এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবেই এসে দাঁড়ায়। আমি ৭ই নভেম্বরকে যতটা রাজনৈতিক ভাবে দেখি তার থেকেও বেশি দেখি মূল্যবোধের ঢাল হিসেবে। ৭ই নভেম্বর নিয়ে এতদিনে অনেকে অনেক কিছুই লিখেছেন। পাঠক হিসেবে আমি লক্ষ্য করেছি দুই একটা লেখার মধ্যে শহীদ কর্নেল আবু তাহেরকে বেশ কিছুটা ম্লান ক’রে দেওয়া হয়েছে। তবে তা ইচ্ছাকৃত করা হয়েছে এমন নাও হতে পারে। আবার তা হতেও পারে। আমি মনে করি কোনো লড়াই মানেই সব সময় তা সফলতার হিসাব নয়। পৃথিবীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লড়াই সংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার প্রমাণ আছে। সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। বা চট্টগ্রাম ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ এখানে স্মরণযোগ্য। প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরপিয়ান ক্লাবে আক্রমণ করবার আগে সেখানে আরও দুইবার হামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। এবং দুইবারই তা ব্যর্থ হয়। কিন্তু তৃতীয়বার যখন প্রীতিলতার নেতৃত্বে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়,তখন আগের দুই হামলার বীরদের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। তাছাড়া ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অনেক আক্রমন শুরুর দিকে তো ব্যর্থতার চাদরেই মোড়া ছিলো। ধীরে ধীরে সেই সব আন্দোলনের পথ পরিশীলিত হয়েছে। এবং মানুষ তখন বুঝতে আরম্ভ করেছে ব্যর্থতা আসলে সাময়িক একটা ব্যাপার। প্রতিটা আন্দোলনের মধ্যেই পথের নিশানা থাকে। এখানে কথা উঠতে পারে সেই আন্দোলন এবং ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থান একেবারেই এক নয়। আমিও তা অস্বীকার করিনা। তবে আমি মনে করি ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক ভ্রান্তির পুরো দায় সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের। শহীদ কর্নেল আবু তাহের সেখানে ছিলেন পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী। বা বিশেষ সময়ের নেতৃত্ব দানকারী। সঙ্গতকারণেই সমালোচনার কেন্দ্র বিন্দু হবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল। শহীদ কর্নেল আবু তাহের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একটা জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন এটা হতে পারে। কিন্তু তারপরেও তিনি অন্যদের সঙ্গে মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে সিদ্ধান্ত ছিলো দলীয়। তাই রাজনৈতিক ভ্রান্তির শতভাগ দায় সংশ্লিষ্ট দলেরই নিতে হবে। ৭ই নভেম্বরের গোলকধাঁধা থেকে শহীদ কর্নেল আবু তাহেরের বেরিয়ে আসা হয়তো আর সম্ভব ছিলো না। তবে তিনি যা পারতেন সে দায়িত্ব তিনি শতভাগ পালন করেছেন। তাঁর এই নিষ্ঠা এবং বীরত্বের চরিত্র যদি কেউ ছোট করবার চেষ্টা করে,তারা কিছুতেই মানব বান্ধব নয়। লড়াই সফলতার মুখ দেখবে না,হয়তো তিনি তা বুঝতে পেরেছিলেন। এবং যে কোনো লড়াইয়ের নেতারা এটা বুঝতে পারেন। তারপরেও শহীদ কর্নেল আবু তাহের সেখানে ছিলেন অবিচল আত্মনিবেদিত মানুষ। তিনি যা পারতেন-আত্মবলিদানে অবিচল থাকা। সেই আত্মবলিদানের মঞ্চে সেদিন তিনি পৃথিবী সেরা মানুষদের সারিতে উঠে এসেছিলেন এবং তা আজও তিনি আছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ কর্নেল আবু তাহের আপসহীন জীবনের অসাধারণ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। যা আমাদের দেশের আগামী যে কোনো আন্দোলন সংগ্রামের আলোবর্তিকা হয়ে কাজ করবে।


আজ ৭ই নভেম্বর, আমার কাছে ৭ই নভেম্বর এবং ২১ জুলাই সময়ের ফারাক ছাড়া আর কিছু নয়। আজ তাহের ভাইকে জানাই সস্রদ্ধ সালাম। শেষে আমি স্পার্টাকাসের একটা উক্তি দিয়ে আমার লেখা শেষ করবো।
“আমার ব্যর্থ বিদ্রোহ শত শত সার্থক বিদ্রোহের জন্ম দিয়ে গেলো।”

শ্যামনগর

যশোর

আশাশুনি


জলবায়ু পরিবর্তন