Warning: Attempt to read property "post_content" on null in /home/dakshinermashalc/public_html/wp-content/plugins/pj-news-ticker/pj-news-ticker.php on line 202
উপ-সম্পাদকীয় Archives - Daily Dakshinermashal

Category: উপ-সম্পাদকীয়

  • দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে চরম সংকটে জনজীবন

    দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে চরম সংকটে জনজীবন

    বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে অস্থিরতা বিরাজ
    করছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে জনজীবনে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা অত্যন্ত
    গভীর ও বহুমাত্রিক। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ
    মানুষের জীবনযাত্রার মান নেমে আসছে এবং ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় বেঁচে থাকা
    কঠিন হয়ে পড়ছে। বিশেষ করে, নি¤œ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের ওপর এর চরম
    প্রভাব পড়ছে।
    সম্প্রতি শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে, যা
    দেশের দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অসন্তোষের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। সাধারণ
    মানুষের আশা ছিল, ক্ষমতার পালাবদলের পর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমবে এবং
    জীবনযাত্রার মান কিছুটা হলেও উন্নতি ঘটবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দুই মাস
    পেরিয়ে গেলেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনের বাজার
    পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে অসহনীয় করে তুলেছে এবং সরকারের
    ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
    বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত, যেখানে নূন্যতম
    খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ এবং সাশ্রয়ী মূল্যে ক্রয়ক্ষমতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমন
    উচ্চমূল্যে নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জন্য ডিম-মুরগির মতো
    প্রোটিনজাতীয় খাদ্য কেনা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য বাজারে
    টিসিবির ট্রাকে লাইন দিয়ে কম দামে পণ্য কেনার চেষ্টা করতে হচ্ছে, যা তাদের
    জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্লান্তিকর।
    বর্তমান বাজার সংকটের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, সরকারের অদক্ষতা,
    সিন্ডিকেটের কারসাজি, এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা। অতীতে
    সরকারের নীতিমালায় বিদ্যুৎ, গ্যাস, এবং পানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব বাজার
    অস্থিতিশীলতায় ভূমিকা রেখেছে। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য এবং রাজনৈতিক
    পৃষ্ঠপোষকতায় বাজারের অস্থিরতা আরো জটিল হয়ে উঠেছে, যা দ্রব্যমূল্যের
    ঊর্ধ্বগতির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম।
    বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক হওয়ায়, গ্রামীণ কৃষির অবনতি সরাসরি
    বাজার সংকটে প্রভাব ফেলে। বর্তমানে কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি এবং
    প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল উৎপাদন কমে গেছে, যার ফলে বাজারে পণ্যের
    ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। গ্রামীণ কৃষকরা পর্যাপ্ত ফসল উৎপাদন করতে না পারায়
    সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। কৃষিতে পুনরায়
    বিনিয়োগ ও কৃষকদের উৎসাহিত করা এখন সময়ের দাবি।
    যদিও সরকার সম্প্রতি কিছু পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নিয়েছে, তবে
    তা মোটেও যথেষ্ট নয়। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সিন্ডিকেটের
    কারসাজি বন্ধ করতে হবে এবং সরবরাহ চেইনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
    কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্য
    সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যথায়, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরও দুর্বিষহ হয়ে

    উঠবে এবং জনমনে অসন্তোষ ক্রমশ বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের স্থিতিশীলতার জন্য
    ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।
    বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে হলে কেবল বাজার নিয়ন্ত্রণেই নয়, বরং
    অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে তৎপর হয়ে
    জনগণের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে এবং দুর্নীতির
    বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দেশের মানুষের কল্যাণে শক্তিশালী ও
    দায়িত্বশীল পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই।

  • তিব্বতের জনগণের স্বাধীনতা ও চীনের হুমকি

    তিব্বতের জনগণের স্বাধীনতা ও চীনের হুমকি

    সম্প্রতি তিব্বতের জনগণের ধর্ম পালন ও নিজেদের নিয়মিত স্বাধীন জীবনযাপনের বিষয়ে মার্কিন হাউসে ‘তিব্বত’ রেজল্যুশন পাস করা হয়। এ বিষয়ে শুরু থেকেই হুমকি দিয়ে আসছিল চীন। কিন্তু দেশটির সেই রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চস্তরের কংগ্রেশনাল প্রতিনিধিদল ভারতে তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামার সঙ্গে দেখা করেন জুন মাসের ১৯ তারিখে। বিষয়টি তিব্বতের মানবাধিকার ইস্যুর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। এই প্রতিনিধিদল তিব্বতের জনগণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি তিব্বত ও চীনের মধ্যে বিরোধের শান্তিপূর্ণভাবে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানায়।

    রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, তিব্বত ইস্যুতে চীনের ওপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ওই অঞ্চলের জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ফেরত দেওয়ার আলোচনা শুরু করতেই যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ। যেখানে মার্কিন প্রতিনিধিদলের মধ্যে ছিলেন মার্কিন হাউসের প্রাক্তন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। চীনের হুমকি উপেক্ষা করেই ভারতে দালাই লামার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। ২০২২ সালেও চীনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাইওয়ান সফর করেছিলেন তিনি। ন্যান্সি দালাই লামার শিষ্য হিসেবে সুপরিচিত। সুতরাং এটি বেশ স্পষ্ট যে, চীনের শত বিরোধিতার পরও ন্যান্সি প্রতিনিধিদলকে নিয়ে দালাই লামার সঙ্গে দেখা করেছেন এবং হয়তো ভবিষ্যতেও করবেন।

    বিগত কয়েক বছর করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক টালমাটাল অবস্থার সুযোগ নিয়ে তিব্বতের নিজেদের আগ্রাসন আরও বাড়িয়েছে চীন। ২০২১ সালে তিব্বতে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু করে চীন। এ সময় তিব্বতের অধিবাসী ও প্রবাসে থাকা তিব্বতিয়ানরা জানান, স্থানীয়দের নিজেদের সংস্কৃতি অনুসারে চলতে বাধা দিচ্ছে চীন সরকার। সেইসঙ্গে তিব্বতের অধিবাসীদের স্থানীয় ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমেও বাধা প্রদান করে চীন। ২০২২ সালে তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের মুখপাত্র তেনজিন লক্ষ্মী জানান, বেশ কিছু তিব্বতিয়ান লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পীদের বন্দি ও আটক করেছে চীন। তিনি আরও অভিযোগ করেন, তিব্বত এখনো চীনের প্রধান সমস্যাগুলোর একটি। আর তিব্বতকে নিয়ন্ত্রণে চীন আরও যুদ্ধংদেহী অবস্থান গ্রহণ করেছে। তারা তিব্বতের সব ঐতিহ্যের নিন্দা করার পাশাপাশি সেখানকার সব ঐতিহ্য মুছে ফেলছে ধীরে ধীরে।

    তিব্বতের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম এবং ইতিহাস ছিল। বেশ শক্তিশালী নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনা বোধ ছিল এ অঞ্চলের মানুষের। কিন্তু চীনা কমিউনিস্টরা সর্বদা এ অঞ্চলকে যুক্ত করতে চেয়েছিল। ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর চীনের সেনা তিব্বতে প্রবেশ করে। সেই সময় বেশিরভাগ তিব্বতি এ আক্রমণের কথা ভাবতেই পারেননি। দাওয়া নরবু, সেই সময়ে শিশু। ১৯৭৮ সালে ওয়ার্ল্ড ভিউ ম্যাগাজিনে তিনি লেখেন, ‘১৯৫০ সালের চীনা আগ্রাসনের খবর আমাদের কাছে ১৯৫২ সালের কোনো একসময়ে এসে পৌঁছেছিল।’ ১৯৫০ সালে তিব্বত এমনই ছিল। সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে নরবু লিখেছেন, ‘পৃথিবীর ছাদে আধুনিকতার আশীর্বাদ এবং বাধা উভয় থেকেই দূরে (তিব্বত) ছিল একটি প্রত্যন্ত ভূমি। ধীরে ধীরে চীনা আগ্রাসনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। উদ্বেগ ছড়ায় আরও ধীরে। আতঙ্কজনক খবর সত্ত্বেও শাক্যতে কেউ তার তরবারি ধারালো করেননি। তার ধনুক এবং তীর ব্যবহারও করেননি।’ শাক্যের বাসিন্দারা কল্পনাও করেননি যে, চীনের আক্রমণ একটি স্থায়ী দখলদারি হয়ে উঠবে, যা তিব্বতকে চিরতরে বদলে দেবে। চীনের সেই আক্রমণের ৭৪তম বছর চলছে এখন। কিন্তু চীনের অস্ত্রের বিরুদ্ধে কখনোই তিব্বতের মানুষ সহিংস অবস্থান গ্রহণ করেননি। কেননা সহিংসতা তিব্বতের অধিবাসীদের শিক্ষা নয়। কিন্তু এমন অহিংস একটি জাতির ওপর চীনের অত্যাচার নিপীড়ন নিয়ে বিশ্বের নিশ্চুপ অবস্থান এ অঞ্চলের মানুষের সেই অহিংস আচরণ বজায় রাখার পথে ভবিষ্যতে বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে। এটি শুধু চীনের জন্য নয়, বরং পরবর্তীকালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান এমনকি বাংলাদেশের জন্যও হুমকির কারণ হতে পারে। আর এ কারণেই চীনের ক্ষোভ উপেক্ষা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দালাই লামার সঙ্গে বৈঠকের পর আমেরিকান আইনপ্রণেতাদের দ্বিদলীয় সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রায় একই সময়ে, কানাডিয়ান হাউস অব কমন্স সর্বসম্মতিক্রমে তিব্বতের স্বনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থন করে একটি প্রস্তাব পাস করে। তিব্বতিরা একটি জাতি হিসেবে এ মৌলিক অধিকারের দাবিদার।

    মার্কিন প্রতিনিধিদলের এ সফর শেষে বেইজিং বেশ হতাশার সঙ্গে উপলব্ধি করেছে যে, বিশ্ব তার চাপ এবং গুণ্ডামি কৌশলের কাছে নতিস্বীকার করবে না। বিশ্ব তিব্বতের ওপর চীনা দখলের বৈধতা সম্পর্কে দেশটির প্রোপাগান্ডাকে গ্রহণ করবে না। বেইজিং এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে তিব্বত সমর্থনে উত্থাপিত বিলে স্বাক্ষর না করার জন্য আবেদন করছে, যা শুধু স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে। এতদিন চীন হুমকি দিয়ে এসেছে, দালাই লামার সঙ্গে দেখা করলে তার ফল যুক্তরাষ্ট্রকে ভোগ করতে হবে। কিন্তু এখন দালাই লামার সঙ্গে বৈঠক শেষে চীন তার আগের একগুঁয়ে অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। বরং এখন চীন ‘তার রাজনৈতিক প্রস্তাবগুলোর সম্পূর্ণ প্রতিফলন এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সংশোধন করার’ কথা জানিয়েছে, যদিও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বার্তা বা ব্যাখ্যা প্রদান করেনি চীন। চীনের হঠকারিতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, তারা মার্কিন আইনপ্রণেতাদের দালাই লামার সঙ্গে দেখা না করার জন্য হুমকি দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে। শুধু গণমাধ্যমে নয়, হুমকি প্রদান করে চীন প্রতিনিধিদলটিকেও চিঠি প্রদান করেছে। প্রতিনিধিদলের নেতা ইউএস হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান মাইকেল ম্যাককাল এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের প্রতিনিধিদল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছে, যেখানে আমাদের এখানে না আসার জন্য সতর্ক করেছে। তারা তাদের মিথ্যা দাবির পুনরাবৃত্তি করেছে যে, ১৩ শতক থেকে তিব্বত চীনের অংশ। কিন্তু আমরা সিসিপির সেই ভয় দেখানোতে মনোযোগ দিইনি এবং আমরা আজ এখানে এসেছি।’ ভারতের ধর্মশালায় নির্বাসিত তিব্বত সরকারের তত্ত্বাবধানে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যাকে চীন ‘নিছক রাজনৈতিক চক্র’ বলে উড়িয়ে দেয়। মার্কিন প্রতিনিধিদলের এই নেতা বলেন, ‘তিব্বতের জনগণ একটি স্বতন্ত্র ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক পরিচয়ের অধিকারী এবং তাদের নিজেদের ভবিষ্যতের কথা বলা উচিত। তাদের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করার অধিকার লাভ করার কথা। সে কারণেই আমরা এখানে সিসিপির সতর্কতা অমান্য করেছি।’

    মার্কিন আইনপ্রণেতারা যারা আমেরিকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, তারা ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে সমর্থন করেছেন। তারা মনে করেন, তিব্বতে কখনোই চীনের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এ নিয়ন্ত্রণের মাত্রাটি ছিল একটি শিথিল আধিপত্য, যা এ অঞ্চলের ওপর সার্বভৌম অধিকার থেকে অনেক দূরের বিষয়। অতীতেও বেশ কয়েকবার এ বিষয়ক আলোচনায় জানানো হয়, তিব্বত কীভাবে চীনা নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীন ছিল এবং ১৯১২ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে তিব্বত একটি স্বাধীন দেশ ছিল। আর এ কারণেই ১৯৫০ সালে তিব্বতে চীনের অধিগ্রহণ ছিল অবৈধ।

    তিব্বত সমস্যার সমাধান বিষয়ক বিলটি মার্কিন হাউসে ৩৯১ বনাম ২৬ ভোট ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হয়। তিব্বতের পক্ষে সব ডেমোক্র্যাটের পাশাপাশি অধিকাংশ রিপাবলিকান ভোট দেন। মাত্র ২৬ জন রিপাবলিকান এর বিপক্ষে ভোট দেন। এ বিলটির অন্যতম প্রবর্তক ও মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতা ম্যাককল বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কখনোই স্বীকার করেনি যে, তিব্বত প্রাচীনকাল থেকে চীনের অংশ ছিল। কারণ সিসিপি মিথ্যা দাবি করেছে। এ আইনটি মার্কিন নীতিকে স্পষ্ট করেছে এবং তিব্বতি জনগণের অনন্য ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে। এটি মার্কিন কূটনীতিকে চীনা প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশনা দেয়, তিব্বতিদের নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত করে এবং সিসিপি ও তিব্বতের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অন্য নেতাদের মধ্যে আলোচনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়। যে কোনো রেজল্যুশন বা আলোচনায় তিব্বতি জনগণের ইচ্ছা ও কণ্ঠকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

    এর আগে, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০ সালে তিব্বতের জনগণের পরবর্তী দালাই লামার পছন্দে চীনের হস্তক্ষেপ রোধ করতে ২০২০ সালে তিব্বত নীতি ও সমর্থন আইনে স্বাক্ষর করেছিলেন। কানাডিয়ান হাউস অব কমন্সে গৃহীত প্রস্তাবটি তিব্বতিদের চীনের পদ্ধতিগত সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের বিরোধিতা করেছে এবং বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় নীতিগুলো বেছে নেওয়ার অধিকারকে তিব্বতি জনগণের অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করেছে। সেইসঙ্গে ১৪তম দালাই লামার পুনর্জন্ম নির্বাচনের বিষয়টিও তিব্বতের জনগণের নিজস্ব সিদ্ধান্ত বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছে।

    কানাডিয়ান হাউসের প্রস্তাবে জোর দিয়ে বলা হয় যে, ‘চীন তিব্বতিদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। তিব্বতিরা, একটি জাতি হিসেবে তাদের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করতে পারে। কোনো বাহ্যিক শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় নীতি নির্বাচন করতে পারে এবং এ ক্ষমতায়ন চীনকে ১৪তম দালাই লামার পরবর্তী তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে বাধা দেয়।’

    কানাডিয়ান হাউসের রেজল্যুশন বেশ স্পষ্টভাবে তিব্বতের জনগণের জন্য প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে। সেইসঙ্গে বর্তমান দালাই লামার অবস্থানের সঙ্গেও বিষয়টি সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদিও এখানে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি রাজনৈতিক স্বাধীনতাকেও বোঝায়।

    এটি বেশ স্পষ্ট করেই বলা যায়, এ প্রেক্ষাপটে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মার্কিন আইনপ্রণেতাদের প্রতিনিধিদলের মধ্যে বৈঠক তিব্বতের জনগণের জন্য ভারতীয় সমর্থনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। তিব্বতের জনগণের স্বার্থকে এগিয়ে নিতে বিশ্বের জন্য ভারতীয় সমর্থন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত তিব্বতের নিকটতম প্রতিবেশী এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক তিব্বতি উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিচ্ছে। প্রায় এক লাখের বেশি তিব্বতিয়ান ভারতে আশ্রয় নিয়ে আছে। সেইসঙ্গে দালাই লামা ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ মর্যাদাসহ ১৯৫৯ সাল থেকে ভারতের সম্মানিত অতিথি হিসেবে রয়েছেন। তিব্বত মালভূমিতে চীনের এ নীল-নকশাকে পরাস্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে একটি কৌশলগত অংশীদারত্ব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে মার্কিন প্রতিনিধিদল। তারা বলেছিল, একসঙ্গে আমরা চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রতিরোধের একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠাতে পারি। কারণ যখন বিশ্বের দুটি বৃহত্তম গণতন্ত্র একসঙ্গে দাঁড়ায়, তখন স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা জয়লাভ করে।

    লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • নর্থ ব্লকে স্বয়ংবর সভা

    নর্থ ব্লকে স্বয়ংবর সভা

    আমি যে এক সম্পূর্ণ অন্য দুনিয়ায় পা রেখেছি, খুব তাড়াতাড়িই টের পেলাম। আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছিল একটি অ্যাম্বাসাডর গাড়ি।

     

    কৌশিক বসু

    নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠিত হল, এ বার সেই সরকার বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নীতি রূপায়ণ করবে। অর্থ মন্ত্রকের নর্থ ব্লকে কী ভাবে নীতি রূপায়ণের কাজটি হয়, এবং আগামী কয়েক মাসে এই সরকারের থেকে কী কী আশা করা যেতে পারে, সে বিষয়ে অনেক কিছুই পড়ছি গত কয়েক দিন যাবৎ। পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাচ্ছে নর্থ ব্লকে আমার শুরুর দিনগুলোর কথা— ভারত সরকারের হয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতার সূচনাপর্ব।

    আমার সৌভাগ্য যে, আমি চমৎকার সব মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁদের মধ্যে যেমন ছিলেন আমার দুই বস— প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়— তেমনই ছিলেন আমার অফিসের কর্মীরা, দফতর চালানোর কাজে প্রতিনিয়ত যাঁদের সহযোগিতা পেয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই, খুবই ইতিবাচক পরিবেশ ছিল অর্থ মন্ত্রকে— বন্ধুত্বপূর্ণ কাজের পরিবেশ, সবাই সাহায্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার কাছে সে এক সম্পূর্ণ নতুন দুনিয়া। তার আগে অবধি আমি আজীবন শুধু অর্থনীতির গবেষণা করেছি, এবং ক্লাসে ছাত্রদের অর্থশাস্ত্র পড়িয়েছি, তা সে ভারতে হোক বা আমেরিকায়। সরকারি দুনিয়ায় এই প্রথম পা রাখলাম আমি।
    সে সময়ের কিছু মজার অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছা করছে।

    আমি যে এক সম্পূর্ণ অন্য দুনিয়ায় পা রেখেছি, খুব তাড়াতাড়িই টের পেলাম। আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছিল একটি অ্যাম্বাসাডর গাড়ি। অফিসে যাব বলে গাড়িতে উঠেছি— অভ্যাসবশে সিটবেল্ট লাগাতে গেলাম। আমার গাড়ির চালককে দেখে মনে হল, খুবই অস্বস্তিতে পড়েছেন তিনি। প্রসঙ্গত, পরে টের পেয়েছি যে, মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নামক গেরামভারী পদের অধিকারীর গাড়ির সারথি বলে তাঁর বেশ গর্ববোধ ছিল। আমায় সিটবেল্ট পরতে দেখে শেষ অবধি নিজের আপত্তি আর চেপে রাখতে পারলেন না তিনি। আমার দিকে ঘুরে বললেন, “স্যর, আমি জানি আপনি আগে শিক্ষক ছিলেন; তবে এখন আপনি দেশের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। আর সিটবেল্ট পরার কোনও প্রয়োজন নেই!” বলা বাহুল্য, লোকটিকে আমার ভারী মনে ধরল! তবে, এটাও বুঝলাম যে, এক নতুন, অচেনা দুনিয়ায় পা দিয়েছি আমি।

    এখন আমি কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে গেম থিয়োরি বা দ্বন্দ্ব তত্ত্বের যে কোর্সটি পড়াই, তার একটি অংশের নাম ‘বারগেনিং থিয়োরি’। এই তত্ত্বটির উদ্ভাবক ছিলেন আশ্চর্য প্রতিভাধর গণিতজ্ঞ জন ন্যাশ। আ বিউটিফুল মাইন্ড নামের ছবিটিতে রাসেল ক্রো অভিনয় করেছিলেন তাঁর ভূমিকায়, এটা বললে হয়তো ন্যাশকে মনে করতে সুবিধা হবে। মাত্র ২২ বছর বয়সে বারগেনিং বিষয়ে দু’টি ছোট পেপার লিখেছিলেন ন্যাশ। তার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আক্রান্ত হন স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া রোগে, গবেষণার জগৎ থেকে হারিয়ে যান। কিন্তু, তাঁর ওই দু’টি ছোট গবেষণাপত্র ‘বারগেনিং থিয়োরি’-র ভিত গড়ে দিয়েছিল। গোটা দুনিয়ায় গেম থিয়োরির ক্লাসরুমে, এবং আমেরিকার আদালতকক্ষে, তার ব্যবহার চলছে।

    কিন্তু, বারগেনিং থিয়োরির সেরা বাস্তব উদাহরণটি আমি কোনও ক্লাসঘরে পাইনি, পেয়েছিলাম দিল্লির অর্থ মন্ত্রকে আমার অফিসের কর্মীদের থেকে। সে কথা বলি। মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার অফিসে আমার চিফ অব স্টাফ ছিলেন সোমনাথন নামে এক জন— খুবই নির্ভরযোগ্য মানুষ। এক দিন তিনি আমার অফিসে এলেন। তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, এবং তাঁর ঘাড়ের উপর দিয়ে আর কয়েক জন উঁকি মারছে, এমন অবস্থায় সোমনাথন আমায় জানালেন, আমার মতো উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সরকার ৬০০০ টাকা অবধি দামের ব্রিফকেস কিনে দিয়ে থাকে। সেই মুহূর্তে আমার আদৌ একটা নতুন ব্রিফকেসের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু সোমনাথন ও তাঁর ঘাড়ের উপর থেকে উঁকি মারা সহকর্মীদের হতাশ করতে মন চাইল না। বললাম, আমায় কয়েকটা স্যাম্প্‌ল দেখানোর ব্যবস্থা করা হোক।

    পর দিনই এক সর্দারজি হাজির আমার অফিসে। তাঁর হাতে ছ’টি ব্রিফকেস, তবে বলে না-দিলে সেগুলোর মধ্যে ফারাক খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমার টেবিলের উপরে সেগুলো সাজিয়ে রাখা হল। মনে হচ্ছিল, স্বয়ংবর সভা চলছে— সামনে রাজপুত্রের দল, এক জনের গলায় আমি বরমাল্যটি পরিয়ে দিলেই হয়! সোমনাথন এলেন; তাঁর পিছন পিছন এলেন আমার পার্সোনাল সেক্রেটারি ও সহায়করা; তাঁদেরও পিছনে এলেন আমার পিয়নরা। এই শেষের দলটি এমনিতে লাজুক— কিন্তু এই মহাভারত-তুল্য ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করার লোভ তাঁরাও সামলাতে পারেননি বলে দেখা গেল।

    আমার উদ্দেশে মৃদুস্বরে উপদেশাবলি ভেসে আসতে আরম্ভ করল; বিভিন্ন ব্রিফকেসের দিকে ইতিউতি আঙুলও উঠল। আমার কোন ব্রিফকেসটা বাছা উচিত, সে বিষয়ে দফতরের বিভিন্ন স্তরের কর্মীরা আমায় সৎ পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু, ব্রিফকেস বাছার চেয়ে ঢের জরুরি কাজ পড়ে রয়েছে তখন। কাজেই, খুব একটা ভাবনাচিন্তা ছাড়াই একটা ব্রিফকেস বেছে নিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল— আমায় জানানো হল, আমার জন্য বরাদ্দ যেখানে ৬০০০ টাকা, আমি সেখানে মাত্র ২৫০০ টাকা দামের ব্রিফকেস বেছেছি! আর কথা বাড়াব না ভেবে বললাম, যে দামেরই হোক, এটাই আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে। আমার সহায়কদের মধ্যে এক জন বললেন, “তা হলে স্যর, আপনি দুটো ব্রিফকেস নিন।” আমি নিশ্চিত নই, তবে এই ভদ্রলোক সম্ভবত অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেছিলেন— অর্থনীতিবিদদের কাছেই সব সমস্যার এমন চটজলদি সমাধান থাকে! প্রস্তাবটি শুনে অন্যরা বেশ সপ্রশংস ভঙ্গিতে তাঁর দিকে তাকালেন।
    ভেবে দেখলাম, আমার সামনে দুটো রাস্তা রয়েছে— এক, আমার দফতরের কর্মীদের এই সব ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া উপেক্ষা করে তাঁদের ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া; অথবা একটা নয়, দু’দুটো বেশ ‘বলতে নেই’-টাইপ খারাপ দেখতে ব্রিফকেসের মালিক হওয়া। দু’দিকের লাভ-ক্ষতি হিসাব কষে শেষ পর্যন্ত বললাম, “ঠিক আছে, দুটো ব্রিফকেসই নেব। কিন্তু, সরকার যে-হেতু ৬০০০ টাকা দেবে, আর দুটো ব্রিফকেসের দাম যে-হেতু ৬৭০০ টাকা পড়ছে, তাই বাকি ৭০০ টাকাটা আমার থেকে নিয়ে নিন।” আমার কথা শুনে দফতরের কর্মীরা স্তম্ভিত। তাঁরা সর্দারজিকে বললেন, “আপনি তো একটা ব্রিফকেস বেচবেন বলে এসেছিলেন। উনি দুটো নিচ্ছেন। ওই ৭০০ টাকাটা ডিসকাউন্ট দিন, মশাই।” সর্দারজি দাড়ি চুলকে একটু ভাবলেন, তার পর রাজি হয়ে গেলেন। এ ভাবেই আমি দুটো ব্রিফকেসের গর্বিত মালিক হলাম, যার মধ্যে একটাও আমি চাইনি।
    ( ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে নেওয়া)
  • কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞা

    কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞা

    কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞা

    জিয়াউল হক মু্ক্তা*
    স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার গোপন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রক্রিয়া ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ বা ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ বা ‘নিউক্লিয়াস’ প্রথম দিকে ছিল তিন জনের একটি ফোরাম; এটি গঠন করেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। এর গঠন প্রক্রিয়ায় সিরাজুল আলম খান প্রথমে দলে ভেড়ান আব্দুর রাজ্জাককে; পরে সিরাজুল আলম খান আব্দুর রাজ্জাকের সাথে পরামর্শক্রমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সাথে নেন কাজী আরেফ আহমেদকে। উল্লেখ্য, এখানে এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন স্বতঃপ্রণোদিত স্বাধীনতা-সংগ্রামী; এঁদেরকে কাউকে কারোর বোঝাতে হয়নি কেন স্বাধীনতা দরকার।

    ইতিহাসের ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায় আবহমান সময় এঁদের জন্ম দিয়েছেন বাংলার মানুষের মুক্তির আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে। এঁরা ছিলেন আমাদের ভূমির রেভ্যুলুশনারি ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস— যাঁরা রেভ্যুলুশনারি মাসকে নির্দেশনা দিয়েছেন ইতিহাসে মানুষের জয়যাত্রা এগিয়ে নিতে। আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন তো সারা দুনিয়ার সকল মানুষের মুক্তি আন্দোলনেরই একটি আঞ্চলিক সংস্করণমাত্র— বাঙালি জাতীয়তাবাদের যা অন্যতম প্রধান উপাদানও বটে। যদিও এ দেশের আঠারো ও উনিশ শতকের লেজওয়ালা কম্যুনিস্টদের মস্তিষ্ক এটা উপলব্ধি করার মতো ততোটা বিকশিত হয়ে ওঠেনি তখনও পর্যন্ত।
    ১৯৬২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে গঠিত নিউক্লিয়াস পরে আরও দু’জনকে অন্তর্ভুক্ত করে: একজন আবুল কালাম আযাদ [১৯৬৪] ও অপরজন চট্টগ্রামের আব্দুল মান্নান [১৯৬৫]। পরে আবুল কালাম আযাদ নিউক্লিয়াসের কজ ও কাজের প্রতি আনুগত্য বহাল রেখে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি নেন নিজের পারিবার-সদস্যদের সহযোগিতা করার লক্ষ্যে আয়রোজগারে যুক্ত হতে। উল্লেখ্য, নিউক্লিয়াসের সদস্যদের কোন সার্বক্ষণিক পেশায় যুক্ত হওয়া আর প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ে ও পারিবারিক দায়বদ্ধতায় জড়ানো ছিল নিষিদ্ধ। নিউক্লিয়াস আব্দুল মান্নানকে অব্যাহতি দেয় তাঁর কাজের ধীরগতি ও অনিয়মিত যোগাযোগের জন্য।
    উল্লেখ্য, আবুল কালাম আযাদ ছিলেন এমন এক তরুণ, যিনি দারিদ্র্যের তীব্র কষাঘাতে মাত্র সাত বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে জন্মস্থান নোয়াখালি থেকে অভিবাসী হন অনেক দূরের যশোরে অন্যের বাড়িতে রাখালবৃত্তি করে নিজের খাওয়াদাওয়া নিশ্চিত করতে ও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে। নবম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি কোনোদিন পাঠ্য বই কিনতে পারেননি; এ সময় তিনি রাখালবৃত্তি ছেড়ে টিউশনি শুরু করেন এবং তা অব্যাহত রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে শিক্ষকতায় যুক্ত হবার আগ পর্যন্ত। ১৯৬২ সালে তিনি প্রবেশিকা পাশ করেন, এবং এ সময়ই তিনি বৃহত্তর যশোর-খুলনা জেলায় শিক্ষা আন্দোলন সংগঠিত করে ছাত্রলীগের ব্যাপকভিত্তি দেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ও নিউক্লিয়াসভুক্ত হন। তিনি বারবার কারাবরণ করেছেন, এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বহু লোমহর্ষক প্রত্যক্ষযুদ্ধের সামরিক নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আন্দোলন, প্রাথমিক শিক্ষার জাতীয়করণ ও শিক্ষকদের দাবিদাওয়া অর্জনের একচ্ছত্র নেতৃত্ব অর্জন করেন ও সেসব দাবি আদায়ে সফল হন। স্মর্তব্য, ১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ সালকালপর্বে জাসদ তাঁর নেতৃত্বাধীন শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনকে নিরঙ্কুশ সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করে। 
    পরবর্তী জীবনে আবুল কালাম আযাদ যেহেতু কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন না, তাই তাঁকে স্মরণ করার কেউ নেই। সেজন্যই, কাজী আরেফ আহমেদ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তাঁর প্রসঙ্গ এল বলে— সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তাঁর সম্পর্কে কিছুটা জানিয়ে রাখছি। এ মহান জাতীয় বীরকে ভুলে গেলে আমাদের জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের কন্টেন্ট ও এসেন্স আমরা বুঝতে পারবো না।
    আবুল কালাম আযাদের অনন্য কীর্তির একটি হলো, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণার আগেই, ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে তিনি পূর্ব-বাংলার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্যের ওপর একটি গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেন; এ প্রবন্ধটি ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় আলোচিত হয়; মূল প্রবন্ধ ও ছাত্রলীগের বর্ধিত সভার আলোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে একটি পুস্তিকাও রচিত হয়; ছাত্রলীগের তখনকার সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের ভূমিকাসহ এ পুস্তিকা সারা পূর্ববাংলায় প্রচারিত হয়। এর ফলে পরে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করলে তা সাথে সাথে পূর্ব বাংলা ও পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য বিষয়ে জ্ঞাত ছাত্রলীগের কাছে বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বা অধিকারের সনদ হিসেবে গৃহীত হয়। 
    ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগসহ কোন রাজনৈতিক দল একে সমর্থন করেনি। কাজী আরেফ আহমেদ ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগরের সে সময়ের সভাপতি হিসেবে নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্তে ৬ দফার পক্ষে সর্বপ্রথম বিবৃতি দেন; তিনি হলেন ৬ দফার প্রথম সমর্থক। নিউক্লিয়াসের নিয়ন্ত্রণাধীন ছাত্রলীগ ছিল সর্বপ্রথম সংগঠন যা ৬ দফাকে সমর্থন করে রাজনৈতিক অবস্থান নেয়। নিউক্লিয়াসপন্থি এমএ আজিজের নেতৃত্বাধীন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ১৩ ফেব্রুয়ারি ৬ দফার পক্ষে বিবৃতি প্রদান করে। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে— এ ৬ দফা নিয়ে বিরোধের ফলে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল; ৬ দফাপন্থি আওয়ামী লীগ আর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট বা পিডিএম-এর ৮ দফাপন্থি আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল। 
    এখানে মাঝখানে একটু বিনোদনের জন্য একটি বিশেষ বিষয়ের দিকে তাকানো যাক। কাজী আরেফ আহমেদ ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থিদের সাথে অন্যান্য দল-মতের কোন ধরনের গুন্ডামি সহ্য করতেন না; তিনি নিজে গুন্ডা ধরনের ব্যক্তি ছিলেন না, কেননা গুন্ডারা সবসময় এক্সপোজড হয়ে যায় এবং যা তাঁর [কাজী আরেফ আহমেদ-এর] চরিত্র ও কাজের ধরনের বিরোধী; তিনি ছিলেন নিজেকে এক্সপোজ করার ঘোর বিরোধী এবং তিনি চলাফেরা করতেন ভীষণ সন্তর্পনে। কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি নিজে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থি অংশের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করতেন; আর পরবর্তীকালে তিনি লালন-পালন করেছেন সেসব নিবেদিতপ্রাণ সাহসী তরুণদের যারা ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থিদেরকে এনএসএফ ও ছাত্র ইউনিয়নের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতেন, প্রয়োজনে কাউন্টার-অ্যাটাক করতেন। 
    ৬ দফা ঘোষণার পর আবুল কালাম আযাদ আবারও সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াসের নির্দেশে রচনা করেন মুক্তিপাগল তরুণদের জন্য আবেগময় এক বই: সংগ্রামী বাঙলা। ‘সংগ্রামী বাঙলা’য় বাংলার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য তুলে ধরার পাশাপাশি— শেষ অধ্যায়ের আগের অধ্যায়ে ৬ দফা ব্যাখ্যা করা হয় ও ১৯৬৬-র ৭ জুনের হরতালের ওপর আলোকপাত করা হয়; আর শেষ অধ্যায়ে দেড় পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকে ‘বাংলার নেতা’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এতে আবেগময় ভাষায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলা হয়, “শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর শৈশব গ্রাম-বাংলার বুকেই কাটান। তিনি এদেশের মাটির মানুষ। সকালে পান্তা খেয়ে স্কুলে যাওয়া, ছুটির দিনে মাঠে ও নদীর ধারে ঘুরে বেড়ানো আর মাছ ধরা ছিল তাঁর অন্যতম প্রিয় শখ। বাংলার ধূলিকণা আর ঝড়-ঝঞ্ঝায় প্রস্তুত হয়েছে মুজিবের অনু-পরমানু। তিনি বাংলার মাটির মানুষ। গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষ। বাংলার নেতা।” তবে এ বইয়ের এমনকি বাংলাদেশ সংস্করণেও কেন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চের পরিবর্তে ১৯২২ সালের ২২ নভেম্বর লেখা রয়েছে তা রহস্যজনক বৈকি! হতে পারে এটা সার্টিফিকেটে দেয়া জন্ম তারিখ।
    সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে ১৯৬৭ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এ বইয়ের প্রকাশক ছিলেন তোফায়েল আহমদ। এপ্রিলে পাকিস্তান সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে; কিন্তু ছাত্রলীগ এর প্রচার-প্রচারণা ও ব্যবহার অব্যাহত রাখে। সারা জীবন সিরাজুল আলম খানকে গুরু মেনে অসংখ্য বক্তৃতা দেয়া তোফায়েল আহমদ সম্প্রতি বিশেষ মহলকে খুশি করে কিছু প্রাপ্তিযোগের আশায় সিরাজুল আলম খানের বিরুদ্ধে অশালীন ও স্ববিরোধী বক্তব্য রেখেছেন— যা খুবই দুঃখজনক। সে যাক। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যেক গবেষক-পাঠককে মনে রাখতে হবে— তৎকালে বিরাজমান কোন লেখক-বুদ্ধিজীবীর রচনা নয়— ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে আবুল কালাম আযাদ ও নিউক্লিয়াস/ছাত্রলীগের প্রযোজনায় আঞ্চলিক বৈষম্য বিষয়ক প্রবন্ধ ও পুস্তিকা, ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু-ঘোষিত ছয় দফা ও ১৯৬৭ সালে আবুল কালাম আযাদের বই ‘সংগ্রামী বাঙলা’ ছিল বাঙালির নিজস্ব নির্ধারক রাজনৈতিক-সাহিত্য যা স্বাধীনতা সংগ্রামকে শাণিত করেছিল। সে যাক। ফেরা যাক মূল প্রসঙ্গে। 
    ৬ দফার পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেয়া সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও আবুল কালাম আযাদ ১৯৬৪—১৯৬৫ সময়কালে জেলে অন্তরীণ থাকায় কাজী আরেফ আহমেদকে শুধু ঢাকা মহানগর নয়, বরং সারা দেশে নিউক্লিয়াসের সাংগঠনিক কাজের দেখভাল করতে হয়; অবশ্য এ সময় তিনি কারাগরে অন্তরীণ সিরাজুল আলম খানের সাথেও কিছুটা যোগাযোগ রাখতেন। নিউক্লিয়াসের উল্লিখিত তিন জন জেলে থাকার পরও কাজী আরেফ আহমেদের একক নেতৃত্বে কেবলমাত্র ঢাকাতেই নিউক্লিয়াসের অনুসারীর সংখ্যা চার/পাঁচ শ’তে উন্নীত হয়; বর্ণিত তিন জন জেলে যাবার আগে সারা পূর্ব বাংলায় নিউক্লিয়াসের অনুসারীর সংখ্যা ছিল তিন শত আর ঢাকায় তা ছিল দুই শত।
    পরে আব্দুল মান্নানের অব্যাহতি ও আবুল কালাম আযাদের কাঠামোগত বিযুক্তির ফলে ১৯৬৯ সালের সূচনায় নিউক্লিয়াস আবার সেই প্রতিষ্ঠাকালীন তিন সদস্যের কেন্দ্রীয় কাঠামোয় পরিণত হয়। শুরু থেকেই এ কেন্দ্রীয় কাঠামোর সদস্যদের কাজের কঠোর শ্রেণিবিভাজন না থাকলেও, কাজী আরেফ আহমেদের প্রধান দায়িত্ব ছিল ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের দেখভাল করা। স্বাধীনতা-পূর্বকালের কাজী আরেফ আহমেদের— স্বভাবগতভাবে যিনি ছিলেন অর্ন্তমুখি— ব্যক্তি-চরিত্রের প্রধানতম শক্তি ছিল তাঁর তীব্র তীক্ষ্ন ইনট্যুইশন বা সজ্ঞা। সিরাজুল আলম খান সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর জীবনালেখ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ঘুরে ফিরে বারবার কাজী আরেফের এই সজ্ঞা বা ইনট্যুইশন ও এর ঐতিহাসিক উপযোগিতার আবশ্যিকতার স্বীকৃতি দিয়েছেন। 
    সিরাজুল আলম খান বলেছেন যে ১৯৬২-র শেষ দিকে “… খুবই তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন অথচ স্বল্পভাষী এক তরুণ কাজী আরেফ আহমেদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সে তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। মাত্র আইএ পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। আরেফের মধ্যে ঘটনার ভেতরে না থেকেও আড়াল-অন্তরাল থেকে ঘটনা পর্যবেক্ষণ, পরিকল্পনা ও কাজ করার যোগ্যতাসম্পন্ন একজন তরুণকে খুঁজে পেলাম। সাধারণ আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠি।”
    কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা বা ইনট্যুইশন সম্পর্কে তিনি আরও বলছেন, “প্রাথমিকভাবে দেখলাম ছাত্র হিসেবে অতি মেধাবী না হলেও কাজ করার যে দক্ষতা এবং শৃঙ্খলা ও নিপুণতা আরেফের আছে তা এর আগে আমি আর কারো মধ্যে দেখিনি। আমরা দুইজন যখন আলাপ করতাম অনেক সময় প্রাথমিকভাবে দ্বিমত করলেও সিদ্ধান্তের পর মুহূর্তে সিদ্ধান্তের আগের দ্বিমতকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে সিদ্ধান্তভিত্তিক কাজ করার মানুষও আমি এর আগে পাইনি। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অনেককে সে সন্দেহের চোখে দেখতো। এটা ছিল তার স্বভাবজাত।” 
    তাঁর এ সজ্ঞা বা ইনট্যুইশনের বিষয়টি আমরা একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্মের যারা তাঁর সাহচর্য পেয়েছি, তারাও কিছুটা জেনেছি ও উপলব্ধি করেছি। তাঁর এ সজ্ঞা বা ইনট্যুইশন তাঁর চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠেছিল তাঁর অন্য একটি স্বভাবের কারণে— সেটা হলো তাঁর বস্তুনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা। এ বিষয়ে আবারও সিরাজুল আলম খানের দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে; তিনি বলেছেন, “দেখেছি, আমরা অনেক সময় কোনো বিষয়ে উপস্থিত ও আবেগনির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেও, আরেফের একটি গুণ ছিল এই যে, কোনো ধরনের আবেগকেই সাধারণত সে গুরুত্ব দিতো না। বরং যে-কোনো বিষয়ের ভালো ও মন্দ দিকগুলো অত্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারপর তার নিজের সিদ্ধান্তে আসতো। আরেফের এই বিশেষ গুণটি বহু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ‘নিউক্লিয়াস’-এর কাজে লেগেছে।”  
    তো আবারও যাওয়া যাক নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রীয় কাঠামো বিষয়ে। নিউক্লিয়াসের একটি সৌন্দর্য ছিল, তা হলো এর প্রত্যেক সদস্যের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা। এটা উপলব্ধ যে কাজী আরেফ আহমেদই সম্ভবত বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ভেটো ক্ষমতার প্রয়োগ করতেন সবচেয়ে বেশি, ফলে কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হলেও চূড়ান্ত বিচারে তা নিউক্লিয়াসকে ব্যাপক যথার্থতা প্রদান করেছে, তা সিরাজুল আলম খান নিজেও স্বীকার করেন। এক পর্যায়ে নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রীয় কমান্ডের সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব এলেও কাজী আরেফ আহমেদের ভেটোর ফলে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে এ ভেটোটি ছিল কেন্দ্রীয় কমান্ড প্রসঙ্গে; সারা দেশে নিউক্লিয়াসের অধঃস্তন সদস্য, সেল ও উপকমিটিগুলোতে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নিতেন সশ্লিষ্ট উর্ধতন সংগঠক। 
    তবে নিউক্লিয়াসের তিন সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমান্ড একজনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কাজী আরেফ আহমেদ তাঁর ব্যাপারে ভেটো দেননি: তিনি হলেন মনিরুল ইসলাম বা সকলের প্রিয় মার্শাল মনি। মার্শাল মনি ১৯৬০ সালে প্রবেশিকা পাশের পর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাত্রলীগে যুক্ত হন ও ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। পরে তাঁকে নিউক্লিয়াস কেন্দ্রীয় কমান্ডে যুক্ত করা হয়। সিরাজুল আলম খান জানাচ্ছেন, “মার্শাল মনি ছাড়া আর কাউকে ‘নিউক্লিয়াস’-এর মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণের অংশীদার করা হয়নি।” তাঁকে নির্বাচন করাটা ছিল নিউক্লিয়াসের এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। 
    সে সময় ৬ দফা ভিত্তিক স্বাধীনতা আন্দোলন দ্রুত ব্যাপ্তি পাচ্ছিল; সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাককে অভ্যন্তরীণভাবে আপওয়ার্ড কম্যুনিকেশনসে ও ক্ষেত্রবিশেষে এক্সটার্নাল কম্যুনিকেশনসেও জোর দিতে হচ্ছিল। তখন কাজী আরেফ আহমেদ নিয়োজিত ছিলেন তাঁদের তিনজনের পক্ষে ছাত্রলীগের দেখভাল করার জন্য আর ছাত্রলীগের কমিটিভুক্ত ছিলেন বিধায় মার্শাল মনি ছিলেন ছাত্রলীগে নিউক্লিয়াসের প্রধান ব্যক্তিত্ব। মার্শাল মনি তাঁর ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র’ বইটির উৎসর্গপত্রে লিখেছেন, “এই লেখার বহু তথ্য অকথিত ইতিহাসের অংশ। যে-অংশের অনেক স্থানেই আমার প্রবেশাধিকার না থাকলেও রাজনৈতিক অঙ্গনের সুদীর্ঘ দিনের বন্ধু কাজী আরেফ আহমেদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে জানার সুযোগ ঘটেছে। যা এ লেখার মূল বিষয়ের বিস্তৃতিতে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। এ লেখাটি তাই তার প্রতি উৎসর্গ করাটাই শ্রেয়।” আমরা নিজেরাও কাজী আরেফ আহমেদের মুখে বহুবার শুনেছি: ‘আমার দোস্ত মার্শাল মনি’। তাঁদের এ বন্ধুত্ব, আমাদের জাতীয় ইতিহাসে— কীর্তিময় এক বন্ধুত্ব। 
    কীভাবে? ইচ্ছে করলে অনেক উদাহরণ দেয়া যায়, তবে এখানে শুরুতে মাত্র তিনটি বিশেষ বিষয় উল্লেখ করবো। 
    প্রথমত, মার্ক্সিয় দর্শনের তৃতীয় সূত্রের বরাতে বলা যায়— পরিমাণের গুণে উত্তরণ। ছাত্রলীগ ততোদিনে অপরাপর ছাত্র সংগঠনগুলোকে ছাড়িয়ে দেশের বৃহত্তম ছাত্র সংগঠনে উন্নীত হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী ছাত্র ইউনিয়নের ব্যাঙ্গোক্তির ভাষায় ছাত্রলীগ ছিল তথাকথিত আঞ্চলিকতাবাদ ও প্রাদেশিকতাবাদের দোষে দুষ্ট একটি সংগঠন। হ্যাঁ, ছাত্রলীগের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের স্পৃহাকে ছাত্র ইউনিয়ন তাই মনে করতো। 
    তখনও ছাত্রলীগ স্বাধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে যে পরিমাণ উচ্চকণ্ঠ ছিল, সে পরিমাণ উচ্চকন্ঠ ছিল না স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে। নিউক্লিয়াসের একদম শুরুর দিকে, এমনকি সিরাজুল আলম খান নিজেও সমাজতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন না; সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, কাজী জাফর আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো ও মাহবুব উল্লাহ প্রমুখ ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের সাথে বিতর্ক করতে করতে ও তাঁদের দেয়া বইপত্র পড়তে পড়তে তিনি সমাজতন্ত্রের দীক্ষা নেন। শুরুর দিকে, তাঁর নিজের ভাষায়, ‘মূলত কমিউনিজমের বিরোধিতা করার জন্যই আমি এসব বই [সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য] পড়ার প্রয়োজন মনে করেছিলাম’। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সক্রিয় স্বাধীকার ও স্বায়ত্তশাসনপন্থি স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েরা ছাত্র ইউনিয়নের দিকে টিপ্পনি কাটতো: ‘হো হো মাও মাও, চিন যাও ব্যাঙ খাও।’ 
    স্বাধীকার-স্বাধীনতাপন্থি ছাত্রলীগ সদস্যদের বা নিউক্লিয়াস অনুসারীদের— স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকল্প নেই— এমন দীক্ষায় দীক্ষিত করেন মার্শাল মনি। বলা চলে স্বাধীনতার লক্ষ্যে যে হাজার হাজার ছাত্র-তরুণ-যুবদের সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগের পতাকাতলে আকৃষ্ট ও সমবেত করেছিলেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যাঁরা স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে ছাত্রলীগে যোগদান করেছিলেন— মার্শাল মনি তাঁদের চেতনাজগতের গুণগত রূপান্তর ঘটান, তিনি তাঁদেরকে সমাজতন্ত্রের দীক্ষায় শিক্ষিত নিষ্ঠাবান এক যোদ্ধাবাহিনীতে রূপান্তরিত করেন। এ কাজে তাঁর সাথে টিম-আপ হয়েছিলেন ছাত্রলীগের স্বতঃপ্রণোদিত ও স্বশিক্ষিত এক গুচ্ছ সাহসী তরুণ। নিউক্লিয়াসের পক্ষে ছাত্রলীগের এ আদর্শগত রূপান্তরের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে মার্শাল মনি কাজী আরেফ আহমেদ ও নিউক্লিয়াসের অনুমোদন পান, প্রেরণা পান। নিউক্লিয়াস কেন্দ্রীয় কমান্ডের পক্ষে কাজী আরেফ আহমেদ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন মার্শাল মনির সাথে।
    যদিও ১৯৬৩ সাল থেকেই নিউক্লিয়াসের সুকৌশলী নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতো ছাত্রলীগ, স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের দীক্ষায় দীক্ষিত সদস্যগণ সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ নেন ১৯৭০ সালের ২০ মার্চের কাউন্সিল থেকে। এ কাউন্সিলে নির্বাচিত ৪৫ জনের কেন্দ্রীয় কমিটির ৩৮ জনই ছিলেন স্বাধীনতাপন্থি ও সমাজতন্ত্রী; বাকি ৭ জন ছিলেন স্বায়ত্তশাসনপন্থি। স্বায়ত্তশাসনপন্থিদের নেতৃত্ব দিতেন নূরে আলম সিদ্দিকী আর স্বাধীনতাপন্থি ও সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্ব দিতেন মার্শাল মনি। স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের পক্ষে নীতিগত ও সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭০ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে— ছাত্রলীগের বর্ধিত সভা, কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ও ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে মধুর ক্যান্টিনে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভার মাধ্যমে। বর্ধিত সভা ও কেন্দ্রীয কমিটির সভার ট্যাকটিক্যাল দিকটি ছিল— সারা দেশে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের বার্তা শক্তিশালীভাবে প্রচার করা। বর্ধিত সভার এক পর্যায়ে প্রথম দিন সন্ধ্যায় কাজী আরেফ আহমেদ টিএসসিতে মার্শাল মনিকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-এর পক্ষে আলোচনা পরিচালনা করতে বলেন; মার্শাল মনি গণপ্রজাতন্ত্রকে কোয়ালিফাই করে ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা পরিচালনা করতে চাইলে কাজী আরেফ তা অনুমোদন দেন। সভায় স্বপন কুমার চৌধুরী এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ছাত্রলীগের বর্ধিত সভা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় সংঘটিত এ আলোচনা আওয়ামী রাজনৈতিক-সাংগঠনিক পরিমণ্ডলে সারা দেশের স্বাধীনতাপন্থি নেতা-কর্মী-সংগঠক-সদস্যদের বিশেষ বার্তা প্রদান করে। ২০২১ সালে এ গল্প খুব সাধারণ মনে হলেও ১৯৭০ সালে উত্থাপিত এ প্রস্তাব ও বিতর্ক ছাত্রলীগের ক্লাইমেক্স ছাপিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও ক্রাইসিস তৈরি করে। বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খানের আলোচনার মধ্য দিয়েও এ ক্লাইমেক্স ও ক্রাইসিসের অবসান হয়নি। অবশেষে ১৭ সেপ্টেম্বর মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ আয়োজিত শিক্ষা দিবসের আলোচনায় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এমএ আজিজ স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের পক্ষে নিজের কঠোরতম সমর্থন ব্যক্ত করায় সেসবের আপাত-অবসান ঘটে। বঙ্গবন্ধু নিজেও হাফ ছাড়েন। 
    উল্লেখ্য, মার্শাল মনি ও তাঁর টিমের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক দীক্ষায় শিক্ষিত এ ছাত্র-তরুণ-যুবগণ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং তাঁরাই ১৯৭২ সালে সারা দেশে জাসদ গঠনে নেতৃত্ব দেন। আরও উল্লেখ্য, নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে এ বিএলএফ গঠন করা হয়েছিল অনেক আগেই, ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে, আর প্রায় একই সময়ে বিএলএফ-এর সামরিক শাখা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল জয় বাংলা বাহিনী। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে বিএলএফ বিস্তারিত কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল, সেসব পরে আলোচনা করা যাবে; তবে এখানে এটুকু বলে রাখা যাক যে বঙ্গবন্ধু বিএলএফ-এর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পরিসরে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বিএলএফ-এর অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ অভ্যন্তরীণভাবে সমন্বয়ের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ।  
    দ্বিতীয়ত, ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যারিষ্ঠতা অর্জন বিষয়। ছাত্রলীগের আঞ্চলিক-বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন ও উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে ১৯৭০-এর নির্বাচনকে বঙ্গবন্ধু ও নিউক্লিয়াস এক দফা স্বাধীনতার দিকে জনগণের ম্যান্ডেট নেবার কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এ নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ও নিউক্লিয়াস এতটাই শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছিলেন যে এমনকি সত্তরের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েক লাখ মানুষ মারা যাওয়া সত্ত্বেও উপদ্রুত এলাকা ছাড়া সর্বত্র নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁরা অনড় থাকেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ এ নির্বাচন বর্জন করে। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলম খানের নির্বাচিত প্রায় দুই শত নবীন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেন; অবশ্য এর অনেক আগেই বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলম খানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের সংগ্রামী অংশের মাধ্যমে সারা দেশে আওয়ামী লীগের পুরোনো নেতৃত্ব প্রতিস্থাপন করে আওয়ামী লীগের দখল নেয়ার জন্য। 
    সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের লক্ষ্যে নিউক্লিয়াস একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রায় দেড় হাজার বিএলএফ কর্মীকে তিন থেকে পাঁচ জনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে সারা দেশের সকল প্রার্থীর পক্ষে গণসংযোগ ও প্রচারের কাজে নিয়োগ দেয়া হয়। এ কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় মার্শাল মনিকে, তাঁকে সহযোগিতা করেন আফম মাহবুবুল হক। মার্শাল মনিকে এ কাজের দায়িত্ব দেয়ায় নিঃসন্দেহে কাজী আরেফ আহমেদের ভূমিকা ছিল বলে ধরে নেয়া যায়, কেননা ইতোপূর্বে নিউক্লিয়াসের পক্ষে তিনিই ছিলেন মার্শাল মনির তথা ছাত্রলীগের রাজনৈতিক অভিভাবক।
    তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও শাসন-প্রশাসন বিষয়ে [ক] বিএলএফ-এর চার প্রধানের ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর সুপারিশ, [খ] জানুয়ারির শেষে সিরাজুল আলম খানের দেয়া ১৫ দফা সুপারিশ, [গ] ছাত্রলীগের মার্চ মাসের বর্ধিত সভা ও সাধারণ সভার সুপারিশ, [ঘ] আসম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজের দেয়া মে মাসের সুপারিশ ও [ঙ] ৭ জুন আবারও ছাত্রলীগ কর্তৃক দেয় সুপারিশ বঙ্গবন্ধু গ্রহণ না করায় এবং জুলাই মাসে ছাত্রলীগের সম্মেলনে নিরপেক্ষ না থেকে সংখ্যালঘুদের উপদলীয় সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তাদের সমর্থন দেয়ায়, কাঠামোগতভাবে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন বিষয়ে নিউক্লিয়াসের দু’জন— সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ আহমেদ— প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এটা মনে রাখতে হবে যে তাঁরা দু’জন জাসদ গঠনে একমত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও [তৃতীয়জন, আব্দুর রাজ্জাক দল গঠন বিষয়ে একমত হননি], সিদ্ধান্তের জন্য দাবি/চাপ এসেছিল সারা দেশের হাজার হাজার স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকেই— যাঁরা সকলে ছিলেন মার্শাল মনির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় দীক্ষিত। 
    উল্লিখিত তিনটি বিশেষ বিষয়ের পাশাপাশি ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞার আরো দুটো বিশেষ বিষয়ের উল্লেখ করতে হয়। 
    প্রথমত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মহান সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের পরাজয়ের পর কাজী আরেফ আহমেদ বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির ও জাসদীয় রাজনীতির পক্ষে এক উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেটা হলো মোশতাক-জিয়া চক্রের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পাকিস্তানপন্থার বিরুদ্ধে জাসদ ও আওয়ামী লীগসমেত মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা— যদিও জাসদ ও আওয়ামী লীগ ১৯৭২ থেকে পরস্পরবিরোধী রাজনীতির চর্চা করেছে। অতীত ক্ষত ও বিরোধ ভুলে জাতীয় প্রয়োজনে ঐক্যের রাজনীতি পরিচালনা বিষয়ে তাঁর এ প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্ত— যদিও বারবার তা বিবিধ ষড়যন্ত্রে মুখ থুবড়ে পড়েছে— বাংলাদেশের রাজনীতিতে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নির্ধারক ভূমিকা রেখেছে। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার আলোকে ও সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালে জাসদ ও আওয়ামী লীগসমেত গঠিত হয়েছিল ১০ দলীয় ঐক্যজোট ও পরে এরশাদ ক্ষমতায় আসলে গঠিত হয়েছিল ১৫ দল। তাঁর দেখানো পথেই— তাঁর প্রয়াণের পর— সর্বশেষ বিএনপি-জামাত-জঙ্গির বিরুদ্ধে জাসদ আওয়ামী লীগের সাথে গঠন করেছে ১৪ দল। ১৪ দল এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সফলতম একটি আদর্শগত জোট। 
    আর দ্বিতীয়ত, ১৯৯০ সালে অবৈধ সামরিক জান্তা এরশাদের পতনের পর, সূচিত আংশিক গণতন্ত্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি নিউক্লিয়াসের পুরোনো সহকর্মী আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে নেতৃত্বে রেখে যুদ্ধাপরাধ বিচারের আন্দোলন এগিয়ে নিতে গঠন করেন ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন জাতীয় সমন্বয় কমিটি’; জাসদের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য হিসেবে তিনি ও আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলির সদস্য হিসেবে আব্দুর রাজ্জাক এ ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র ‘স্টিয়ারিং কমিটি’র সদস্য হিসেবে মূল নীতি-নির্ধারণী ভূমিকা পালন করেন এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে লিয়াঁজো রাখেন; এবং সংগঠিত করেন ঐতিহাসিক গণআদালত। ক্রমে এ আন্দোলন বাংলাদেশের তরুণ সমাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে এবং জাতীয় রাজনীতির নির্ধারক উপাদানে পরিণত হয়। সর্বশেষ ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশে সূচিত হয় যুদ্ধাপরাধ বিচারপ্রক্রিয়া। একদম শুরু থেকেই জাসদ একনিষ্ঠভাবে সারা দেশে এ আন্দোলনে যুক্ত থাকে। 
    স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াস গঠনের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের বাইরে এখানে কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞার পাঁচটি উদাহরণ আলোচনা করা হলো। সংক্ষেপে এগুলো হলো— [১] নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মার্শল মনিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে ভেটো প্রদান না করে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা, [২] মার্শাল মনি ও তাঁর টিম কর্তৃক ছাত্রলীগের রাজনৈতিক-দার্শনিক রূপান্তরে সম্মতি ও সহযোগিতা দেয়া ও স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা, [৩] জাসদ গঠন বিষয়ে সিরাজুল আলম খানের সাথে যৌথ-সিদ্ধান্ত নেয়া, [৪] ১৯৭৫ সালের পর আবারও মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্যের রাজনীতির সূচনা করা, এবং [৫] যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্দোলন সংগঠিত করা। 
    এগুলো ছাড়াও বাঙালির জাতীয় মুক্তি আন্দোলন পরিচালনায় ও বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালনার লক্ষ্যে তাঁর ছোট-বড় আরও অনেক ভূমিকা রয়েছে। যেমন বলা যায় পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষা প্রচলনের লক্ষ্যে তাঁর উদ্যোগে ও নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলা ভাষা প্রচলন আন্দোলন। তাঁর এ আন্দোলনী-প্রয়াসেই পূর্ব বাংলায় উর্দু ও ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় সাইনবোর্ড ও গাড়ির নাম্বার প্লেট লেখা হতে থাকে। তিনি ছিলেন সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধু কর্তৃক অস্ত্র আমদানি ও প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য নিউক্লিয়াস মনোনীত কেন্দ্রীয় ব্যক্তি; যদিও একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের কারণে তা বিলম্বিত/স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। 
    ঘাতকের বুলেট কাজী আরেফ আহমেদকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। ওই সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান উপদেষ্টা/কার্যালয়ের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকে বাংলাদেশের এক বড় অংশকে সন্ত্রাসীদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করছিলেন— কেননা এ সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানপন্থা-দক্ষিণপন্থার ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় দক্ষিণপন্থার বিদ্যমানতা বহাল রাখতে চাইছিল।  
    কাজী আরেফ আহমেদ চলে গেছেন মহাকালের পথে; কিন্তু আমরা জানি মহাকাল তাঁকে হারিয়ে ফেলতে পারবে না, লুকিয়ে রাখতে পারবে না। যতো দিন বাংলা ও বাঙালি থাকবে— ততো দিন উদ্ভাসিত থাকবেন বাঙালির জাতীয় বীর কাজী আরেফ আহমেদ। বীরের মৃত্যু নেই। শহীদ কাজী আরেফ আহমেদ অমর হোন। জয় বাংলা। 
    * লেখকঃ জিয়াউল হক মুক্তা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং জাসদের মুখপত্র ‘লড়াই’-এর সম্পাদক ও প্রকাশক।

  • মুক্তমত ।। স্মরণ: একেএম আনিছুর রহমান চাইতেন সুপ্রভাত সাতক্ষীরার দায়িত্ব নিক সুভাষ চৌধুরী

    Inbox

    Attachments

    স্মরণ: একেএম আনিছুর রহমান চাইতেন সুপ্রভাত সাতক্ষীরার দায়িত্ব নিক সুভাষ চৌধুরী
    ।। তানজির কচি।। 

    অনেকটা নীরবেই কেটে গেল দৈনিক সুপ্রভাত সাতক্ষীরার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক একেএম আনিছুর রহমানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।

    ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ৫৬ বছর বয়সে একেএম আনিছুর রহমান সবাইকে কাঁদিয়ে পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।  

    গত এক বছর তার সাথে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি নানাভাবেই সামনে এসেছে, মনে পড়েছে। তাকে নিয়ে মানুষকে কত গল্পই না শুনিয়েছি, যারা আমাদের সম্পর্ক সম্পর্কে জানতেন, তারা বিশ্বাস করেছে, যারা জানতেন না, তারা আজগুবি গল্প ভেবেছে।

    যাকে চিনতামই না, তার সাথে বছর দুয়েক কত যে ঘনিষ্ঠতা তা বলে শেষ করার মতো স্বল্প বিষয় নয়। আবার দু’বছর ঘুরতেই নানা সমীকরণের মুখে দাড়িয়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন, কত যে তিক্ততা- সেটিও ছোটখাট কোন বিষয় ছিল না।

    টানাপোড়েনের মধ্যেই একেএম আনিছুর রহমানের অকাল প্রয়াণ। তিনি নেই এটা ভাবতেও অবাক লাগে।

    এক সময় যার সাথে পরিচয়ই ছিল না, তার সাথে পরিচয়ের প্রেক্ষাপটটাও ছিল ভিন্ন।

    তখন ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর। আমি, এখন টিভির আহসান রাজীব ও বৈশাখী টিভির শামীম পারভেজ- আমরা বেশির ভাগ অবসর সময়টা কাটাতাম এক সাথে। দিনের বেলা সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বসেই প্রতিদিন নিউজ পাঠাতাম। সন্ধ্যার পর তিনজন এক সাথে প্রেসক্লাব কান্টিনে বসে গরম রুটি আর ভাজি, অথবা ইটাগাছা হাটের মোড়ে কোয়েল পাখি ফ্রাই বা ছাগলের মগজ কিংবা কাটিয়ায় চপ খেতে যেতাম। এটা অনেকটা দৈনন্দিন কাজ ছিল আমাদের।
    একদিন বেলা ১১টার দিকে প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বসে কাজ করছি, হঠাৎ শামীম পারভেজ এসে পাশে বসলেন। বললেন, তানজির আনিছ ভাই সাজেক্রীসের (সাতক্ষীরা জেলা ক্রীড়া সংস্থা) নির্বাচন করবে, একটু কাজ করতে হবে নে। আমি প্রশ্ন করলাম কোন আনিছ ভাই, আনিসুর রহিম (সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি, দৈনিক পত্রদূত) স্যার? বললেন না, চায়না বাংলার মালিক আনিছ। আমি বললাম আপনার কেমন ভাই, বললেন হ্যাঁ আমার ভাই। আমি বললাম, আপনার ভাই- অবশ্যই কাজ করবো।

    এরপর দু’এক দিন কেটে গেল। হঠাৎ একদিন সন্ধ্যায় শামীম পারভেজ বললেন, আজ আর বাইরে কোথাও যাব না, আনিছ ভাইয়ের ওখানে যাব। তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। শামীম পারভেজের সাথে গেলাম চায়না বাংলা শপিং কমপ্লেক্সে। তখন তিনি তিনতলায় বসতেন। গেলাম, গিয়ে দেখি এরিয়ান্স ক্লাবের শানু মামাসহ ক্রীড়াঙ্গনের বেশ কয়েকজন।
    শামীম পারভেজ একেএম আনিছুর রহমানকে বললেন, ভাই এই তানজির, ওকে আনতে বলেছিলেন। এর আগে তিনি আমাকে কখনও দেখেননি, আমিও না। ছোট্ট করে বললেন বসো। অন্যান্যরা আড্ডায় মত্ত। আমাকে পাশে ডেকে নিয়ে বসিয়ে বললেন, আমি সাজেক্রীসের ভোট করবো। বিসিবি থেকে একটা বায়োগ্রাফি চেয়েছে। তোমরা যে স্টাইলে বিভিন্নজনকে নিয়ে ফিচার লেখ, ও রকম হতে হবে। আমি বললাম লিখে দেব। কিন্তু এতো হট্টগোলের মধ্যে না, আমাকে আধা ঘণ্টা সময় দিতে হবে সিঙ্গেলি। বললেন আচ্চা, তাহলে আজ না কাল রাত ১০টায়। কেউ থাকবে না তুমি আমি আর শামীম। আমি বললাম জি।

    পরের দিন গেলাম। তার সাথে বসে কফি’তে চুমুক দিতে দিতে তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য নোট বইতে লিপিবদ্ধ করলাম। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার শুরুতেই বললেন, শোন দুই একটা কিন্তু বানিয়ে বানিয়ে বলবো। আমি বললাম চলবে- সমস্যা নেই। যাই হোক, তথ্য উপাত্ত নিয়ে পরের দিন বেশ সময় ধরে তার উপর একটা ফিচার লিখে শামীম পারভেজকে মেইল করলাম। শামীম পারভেজ সেটি প্রিন্ট আউট করে পরের দিন রাতে একেএম আনিছুর রহমানকে দেখালেন। পরে শামীম পারভেজের মাধ্যমে জানতে পারলাম লেখাটি তার খুব পছন্দ হয়েছে।

    এরপর প্রায় দিনই শামীম পারভেজ রাতে তার ওখানে নিয়ে যেতেন। আমরা (আমি ও রাজীব আহসান) ওখানে ততটা স্বস্তি বোধ করতাম না, ওখানে সব সিনিয়র লোকজন, তাও বিভিন্ন ক্ষেত্রের। গেলে চুপচাপ বসে কফি ও নাস্তা খাওয়া ছাড়া কোন কাজ হতো না, বাইরে ঘোরাঘুরিও হতো না। নাস্তা শেষে বেশ রাত ১০টার দিকে শামীম পারভেজ বলতেন, তোমরা এবার যাও। আমি ভাইর সাথে কথাবার্তা বলে তাড়াতাড়ি বের হবো। নইলে আমার বাড়ি যাওয়া হবে না।
    এভাবে এক দিন, দুদিন পার হলো। সাজেক্রীসের নির্বাচন ঘনিয়ে এলো। একেএম আনিছুর রহমান সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হলেন। আমরা বেশ কয়েকদিন মাইক্রো ভরে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় গিয়েছি নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে। এর মধ্যে তাকে নিয়ে মিডিয়া ক্যাম্পেইনের দায়িত্ব আমার উপর। তাকে নিয়ে লেখা ফিচার বাংলানিউজ, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক পত্রদূত, সাতনদী ও দক্ষিণের মশাল-এ প্রকাশিত হলো। তবে, সবচেয়ে ইতিবাচক শিরোনাম হলো দৈনিক ইনকিলাব-এ। তারা সাপ্তাহিক স্পোর্টস ফিচার পাতায় আট কলাম জুড়ে প্রকাশ করলো ‘সাতক্ষীরার স্বপ্নবাজ একেএম আনিছুর রহমান’ শিরোনামে।

    সবমিলিয়ে তাকে সাজেক্রীসের নির্বাচনে জেতাতে আমাদের প্রচেষ্টাটা ছিল বেশ জোরেশোরে। আমরা ক্রীড়াঙ্গনের পরিচিতজনদের সাথে কথা বলতাম, খবরাখবর দিতাম, নিতাম। একই সাথে গণমাধ্যমের সাপোর্টটি একেএম আনিছুর রহমানের পক্ষে আনতে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন চ্যানেল আইয়ের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি, পত্রদূতের উপদেষ্টা সম্পাদক ও প্রেসক্লাবের তৎকালীন সভাপতি আবুল কালাম আজাদ।

    ভোট হলো, একেএম আনিছুর রহমান তার প্যানেলের বেশির ভাগ প্রার্থীকে নিয়ে জয়লাভ করলেন। আমাদের প্রার্থী জেতায় আমরা বেজায় খুশি হলাম। ভোটের ক্যাম্পেইনের মধ্যেই চায়না বাংলা শপিং কমপ্লেক্সের চতুর্থ তলায় চায়না বাংলা গ্রুপের কর্পোরেট অফিস তৈরি হয়েছে। ওদিকে সিবি হসপিটালের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের পর ভবন নির্বাচনের কাজ চলমান।
    ভোটের পরে একদিন রাতে শামীম পারভেজ নিয়ে গেলেন চায়না বাংলা শপিং কমপ্লেক্সের চতুর্থ তলায়। সেখানে একেএম আনিছুর রহমানের অফিস ও বিশ্রাম ঘর পাশাপাশি। কেউ নেই। রাত ১০টা বাজে। অফিস থেকে উনার বিশ্রামের ঘরে গেলাম আমরা তিনজন। টিভি ছেড়ে কফি-তে চুমুক দিতে দিতে বললেন, চাচ্চা ভোট তো হয়ে গেল। অনেক কাজ করেছ। এবার আমার একটা শখ পূরণ কর। আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, এতো বিত্তশালী মানুষের শখ আমি কিভাবে পূরণ করবো। উনি বললেন, আমার একটা পত্রিকা বের করার শখ। ওটা তুমি দায়িত্ব নিয়ে বের কর। আমি উত্তর দিয়ে বললাম, সরি আংকেল আমি পারবো না। আমি আর লোকাল মিডিয়ায় রাত জেগে কাজ করতে চাই না। কাজ করলে আমি পত্রদূত ছাড়তাম না। কারণ টাকা পয়সা কম থাকলেও পত্রদূতকে আমি আইডিয়াল হাউজ মনে করি। (যদিও পত্রদূত ছাড়ার পর সাতনদী সম্পাদক হাবিবুর রহমানের অনুরোধে সাতনদী নতুন কলরবে বের করার জন্য ও দৈনিক দক্ষিণের মশাল সম্পাদক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহীর অনুরোধে মশাল’র আত্মপ্রকাশের সময় অল্পদিন কাজ করতে হয়েছে।) আমার কথা শুনে উনি, কোন রিঅ্যাক্ট না করে বললেন, একটু দেখ, ভেবে দেখ।

    তারপর থেকে বেশ কিছু দিন পত্রিকা নিয়ে আমাদের আলাপ হয়নি। মাঝে মাঝেই তার ওখানে শামীম পারভেজের সাথে যাওয়া হতো। খাওয়া দাওয়া গল্প হতো। হঠাৎ একদিন, বাংলানিউজ অফিস থেকে তৎকালীন চিফ অব করেসপন্ডেন্ট সেরাজুল ইসলাম ফোন দিয়ে বললেন, ‘তানজির ভাই। আমরা সাতক্ষীরা আসছি। বাংলানিউজের ‘বছরঘুরে দেশজুড়ে’ শিরোনামে যে বিশেষ প্রোগ্রাম চলছে, ওটার দক্ষিণাঞ্চলের ভেন্যু হবে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের সুশীলন টাইগার পয়েন্ট। আমরা বেশ কিছু স্পন্সর পেয়েছি। ইউএস বাংলা, সুশীলন, বাগেরহাটের নিউ বসুন্ধরা রিয়েল স্টেট কোম্পানি, খুলনা ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি- এরা স্পন্সর করছে। এখন সাতক্ষীরা থেকে আপনি একটু দেখেন স্পন্সর পাওয়া যায় কি না। তবে, আসিফ আজিজ (সাহিত্যিক অধ্যাপক গাজী আজিজুর রহমানের ছেলে, বাংলানিউজের তৎকালীন অ্যাসিসটেন্ট আউটপুর এডিটর) বলছিলেন, বরসা রিসোর্টের কথা। যেহেতু আমাদের প্রোগ্রাম পর্যটন নিয়ে, সেহেতু ওরা বেটার হতে পারে।’

    আমি তো শুনে কিছুটা ভ্যাবাচকা হয়ে পড়লাম। আনিছ আংকেলের সাথে এতো ভাল সম্পর্ক। কিভাবে তার কাছে আমি স্পন্সরশিপের কথা বলবো- এটা ভেবে বিব্রত হলাম।। বিষয়টি নিয়ে প্রথমে শামীম পারভেজের সাথে আলাপ করলাম। বললাম, অফিস বরসা রিসোর্টের কথা বলেছে, কি করবো, উনি বললেন আনিছ ভাইর সাথে আলাপ কর, সমস্যা হবে না।
    আনিছ আংকেলকে বললাম, আংকেল অফিস থেকে আপনার কাছে আসতে চায়, আমি পরিস্থিতির শিকার, বিব্রত। ওরা আসলে, আপনি কিছু একটা বলে একটু ম্যানেজ কইরেন। উনি বললেন আসুক। 
    কয়েকদিনের মধ্যে অফিস থেকে সেরাজ ভাই ও মবিন ভাই আসলেন। তাদের সন্ধ্যায় চায়না বাংলার চার তলায় নিয়ে গেলাম। তারা আনিছ আংকেলের কাছে প্রস্তাবনা তুলে ধরলেন, আনিছ আংকেল শুনে বললেন, ভাই এতো কিছু বুঝি না। ভাইপোকে নিয়ে আইছেন, যান আমি এক লাখ টাকা দেব। উত্তরে উনারা বললেন, আমাদের আপনার কাছে আর একটু বেশি প্রত্যাশা ছিল, উত্তরে তিনি বললেন, শুরু করেন বেধে গেলে দেখবোনে।

    পরে আমরা প্রেসক্লাবে আসলাম। আসলেই প্রেসক্লাবে অবস্থানরত শামীম পারভেজ বললেন, কি এক লাখ দেছে, আমাকে ফোনে বলেছে, তানজিররে কিন্তু এক লাখ দিয়ে দিলাম। আমি বললাম হ্যাঁ। কিন্তু এতোটা করবে বুঝতে পারিনি। এতো দরকার ছিল। আমি নিজেও তো এখনো ওখান থেকে এতো টাকা সম্মানী পায়নি। এতো দিয়ে লাভ কি। বললেন ভাই তোমাকে খুব স্নেহ করে, তোমার যদি অফিসে এজন্য একটু গুরুত্ব বাড়ে, তাই আর কি।

    পরে বাংলানিউজের প্রোগ্রাম হয়ে গেল। সময়ও বেশ কিছুটা চলে গেছে। বাংলানিউজকে স্পন্সর করার পর আমার ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা যেন একটু বেড়ে গেল। মাঝে মাঝেই শামীম পারভেজ বলেন, ভাই চায় পত্রিকা তুমি দায়িত্ব নিয়ে বের কর। আমি শুনি, কিছু বলি না। একদিন উনি বেশ গুরুত্ব সহকারেই বললেন, আমরা তো সন্ধ্যায় ঘুরে বেড়ায়, পত্রিকাটা হলে সন্ধ্যার সময়টা কাজে লাগতো। আমিও না করতে করতে পারি না আর। তারউপর বাংলানিউজকে এক লাখ টাকা স্পন্সর করার কর আমারও একটা লজ্জা কাজ করতো। উনার জন্য কিছু করতে পারলে কিছুটা হলেও দায় শোধ হতো, বিষয়টি এমন।

    এভাবে চলতে চলতে একদিন চারতলায় আনিছ আংকেলের রুমে আমি ও শামীম পারভেজ বসা। হঠাৎ আনিছ আংকেল বলে উঠলেন, দেখ আমার শখ একটা পত্রিকা বের করা। আমি মনে প্রাণে চাইতাম সুভাষ দা পত্রিকাটার দায়িত্ব নিক। মানে সুভাষ চৌধুরী। কিন্তু দাদা রাজি হইনি। এর পর অনেকেই নিজে থেকে চেয়েছে পত্রিকার দায়িত্ব নিতে। কিন্তু তাদের আমার পছন্দ হয় না। তারাও সাংবাদিক, মাট্রিক পাস, কিন্তু ও হবে না। এখন তুমি একটু দেখ। শুনতে শুনতে আমি বলে বসলাম, আমি যেভাবে চাইবো, তা শুনলে তো আপনার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। উনি বললেন, কি চাও, আমার সব ধনসম্পদ দিয়ে দিতে হবে না কি। আমি বললাম না। গতানুগতিক পত্রিকা বের করে তো লাভ নেই। একশ, দুইশ, পাঁচশ বের করলাম, সরকারি অফিসে দিলেন, হয়ে গেল, এমন হলে বের করার দরকার কি। উনি বললেন, তা হবে কেন, ভাল করে বের করবা। আমি বললাম, সমস্যাটা ওখানেই। যারা ট্রাডিশনালি সাংবাদিকতা করে, কম, বেশি যাই হোক, তাদের দিয়ে এখন ভাল নিউজ ডেভলপ করা অসম্ভব।

    সব সি সি’তে চলে। উনি বললেন, ‍তা তুমি কি করতি চাও। আমি বললাম, আমি দায়িত্ব নিলে আমার হাউজে পুরাতন কোন লোক থাকবে না। আমি ফ্রেশ অনার্স মাস্টার্স পড়া কয়েকটা ছেলে নেব, তাদের ছয় মাস সাংবাদিকতা শেখাব, তারপর তারা তৈরি হলে তখন ডামি পত্রিকা বের করবো, তারপর পত্রিকা মার্কেটে আসবে। কিন্তু এজন্য তো অনেক খরচ। উনি বললেন, খরচ সমস্যা না, তাই হবে তুমি তোমার ওয়ার্ক প্লান রেডি কর, কত খরচ হবে বল। আর সেই সাথে পত্রিকার ডিক্লারেশন এর জন্য কাগজপত্র রেডি করে জমা দাও। আমি বললাম এখনো ডিক্লারেশন হয়নি? তাহলে কিভাবে সম্ভব, কবে হবে তারও তো ঠিক নেই। আদৌ হবে কি না? উনি বললেন, তুমি তো ছয় মাস সময় চেয়েছ, তোমার লোকজন তৈরি করতে, আমার কাছ থেকে ছয়মাস পরে বুঝে নিও। এখন যতদ্রুত সম্ভব আবেদন জমা দাও ডিসি অফিসে। যারা পত্রিকার দায়িত্ব নিতে চাই, তারা কাগজ একবার রেডি করে দিছিল, কিন্তু তা অফিস চেঞ্জ করতে যেয়ে হারিয়ে গেছে। বললাম, ওকে।

    পরের দিন প্রেসক্লাবে, আমি কালাম আংকেলকে ডেকে বললাম, আনিছ আংকেল পত্রিকার দায়িত্ব নিতে বলে, আসলে আমি পারবো কি না, আর আমি নতুনদের নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দিয়ে এসেছি। উনি সাহস দিলেন, পারবা। দায়িত্ব নাও। হেল্প আমি করবো, সমস্যা হবে না।

    পরের দিন ডিসি অফিস থেকে ডিক্লারেশন এর জন্য ফরম ও কি কি লাগবে জেনে আসলেন কাজী কামরুজ্জামান। ওটা দেখে আমি আর শামীম পারভেজ চলে গেলাম পত্রদূত অফিসে। কালাম আংকেলকে বললাম আনিছ আংকেলের অভিজ্ঞতা পত্র আর প্রেসের সাথে চুক্তিপত্র দিতে, উনি সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিলেন। যাই হোক কাগজপত্র সব রেডি করে ডিসি অফিসে আবেদন করা হলো।

    এদিকে, আমি একটা প্রোপজাল রেডি করে আনিছ আংকেলকে দিলাম। সেখানে টিমে নয়জনকে রাখা হলো। শর্ত সবাইকে সাংবাদিকতা ও গ্রাফিক্স এর কাজ হাতে কলমে শিখতে হবে। প্রথম ছয়মাস হবে প্রশিক্ষণ। আমি নিজেই প্রশিক্ষক। সবাই প্রশিক্ষণকালীন সময় থেকেই তাদের জন্য নির্ধারিত সম্মানী পাবেন। আমি শামীম পারভেজকে বললাম আমি সম্মানী নেব না। এমনিতেই আমার জন্য আনিছ আংকেল বাংলানিউজকে এক লাখ টাকা স্পন্সর করেছে। তিনি বলতেন, এটা শুনলে আনিছ ভাই রাগ করবে, এটা তার উপর ছেড়ে দাও।
    চায়না বাংলার চতুর্থ তলার বোর্ড মিটিংয়ের রুমে ২০১৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শুরু হলো প্রশিক্ষণ।
    এরই মধ্যে সিনিয়র সাংবাদিকদের মধ্যে পত্রিকার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া নিয়ে জ্বালা পোড়া শুরু হলো। আমাকে অনেকেই শত্রুর চোখে দেখা শুরু করলেন। বিশেষ করে যারা পত্রিকার দায়িত্ব নিতে চাইতেন, বা আগে ডিক্লারেশন এর কাগজ রেডি করেছিলেন তারা।

    যাই হোক, আমাদের প্রশিক্ষণ চলতে থাকলো। টিমের সবাই লিখতে শুরু করলেন। অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে শুরু করলেন। হাতে কলামে গ্রাফিক্স এর কাজ করতে থাকলেন।
    এর মধ্যে মার্চে আমার চাকরি হলো কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য উইং কৃষি তথ্য সার্ভিসে সহকারী সম্পাদক পদে। এটা নিয়ে সৃষ্টি হলো নতুন জটিলতা। কি করবো? নতুনদের নিয়ে পত্রিকা বের করার এমন চ্যালেঞ্জ নিয়ে ছেড়ে দিলে তো হেরে গেলাম। কারণ আমরা যে প্রক্রিয়ায় যে প্লানে এগুচ্ছিলাম, আমি চলে গেছে তার হাল কেউ ধরতে পারবে না। কারণ আমাদের প্লানটা ছিল ব্যতিক্রম ও নতুন। এক পর্যায়ে ৩০ এপ্রিল পার হলো, অর্থাৎ চাকরিতে যোগদানের সময়সীমা শেষ হলো। যাওয়া হলো না পত্রিকার কথা চিন্তা করে।

    প্রায় সাড়ে তিন মাস পর আমরা পত্রিকা ডামি পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। কিন্তু প্রিন্ট করতাম না। এর কিছুদিনের মধ্যেই খবর এলো পত্রিকার ডিক্লারেশন হয়ে গেছে। আরও আগে হতো, নাম নিয়ে জটিলতার কারণে একটু দেরি হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলার প্রত্যেক উপজেলাসহ সম্ভাব্য সবজায়গায় প্রতিনিধি চূড়ান্ত করা হয়েছে। এরপর আমরা ডামি প্রিন্ট করা শুরু করলাম। ঠিক হলো জুলাই মাসে পত্রিকা বাজারে আসবে। উদ্বোধনী সংখ্যা হবে ১৬ পাতার। ব্যাপক তোড়জোড় করে ১৬ পাতার উদ্বোধনী সংখ্যার প্রস্তুতি নেওয়া হলো। জুলাই মাসের শেষে পত্রিকা বাজারে আসলো। এরপর সংসদ নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতার সাথে রিপোর্টিং করে আমাদের পত্রিকা পাঠকের কাছে আস্থা অর্জন করতে শুরু করলো। তখন সুপ্রভাত সাতক্ষীরা মানে প্রতিদিন কোন না কোন নতুন আইটেম। এভাবে চলতে থাকলো পত্রিকাটি। এক পর্যায়ে ২০১৯ সালের ৩০ মে পত্রিকাটির দায়িত্ব ছেড়ে একেএম আনিছুর রহমান ও শামীম পারভেজের সাথে কথা বলে স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসি সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তারপর একেএম আনিছুর রহমান, শামীম পারভেজ ও আহসান রাজীবের সাথে আমার দূরত্ব বেড়ে গেল যোজন যোজন। আমরা হয়ে উঠলাম একে অপরের শত্রু।

    এরপর আমার সাথে একেএম আনিছুর রহমানের তিনবার দেখা হয়েছে, দুই দিন ডিসি অফিসে, একদিন থানা মোড়ে ফলের দোকানে। সালাম দিয়েছি, বলেছি আমি তানজির। উত্তর দিয়েছেন। বলেছেন, হু চিনতে পারছি। তানজির সাহেব।
    ভাবতাম কোন একদিন আবার সামনা সামনি বসে কথা হবে। সেদিন কথার পাঞ্জা লড়বো দুই বাপ-ব্যাটা।

    কিন্তু হলো না। ১৬ ডিসেম্বর ২০২১। দুপুর আড়াইটা। অফিসে যাব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার জন্য, রেডি হচ্ছিলাম বউ বাচ্চাসহ। হঠাৎ বাংলাট্রিবিউনের আসাদুজ্জামান মধু ফোন করে বলল, শুনেছ আনিছ সাহেব মারা গেছেন। আমি বললাম, মানে। ও বলল, সুপ্রভাত সাতক্ষীরার সম্পাদক আনিছ সাহেব, তোমার আংকেল। শুনে আমি স্থবির হয়ে পড়লাম। দ্রুত আব্বাকে (বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আব্দুল ওয়াজেদ কচি, সম্পাদক, দ্য এডিটরস ও স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক ইনকিলাব) জানালাম।

    এরপরই আমার বড় ভাইয়া ফোন করে শুনতে চাইলো, বিষয়টি সঠিক কি না, ইতোমধ্যে আমি কালাম আংকেলের কাছে ফোন দিয়েছি খবর জানতে। এভাবে কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। মনের মধ্যে হু হু করতে ক্রদন হতে লাগলো। তারপরও অফিসে গেলাম। ফিরে এসে আর কোন কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না। মনকে কোন ভাবেই শান্ত করতে পারছিলাম না। সাতক্ষীরার হাজারো মানুষের কর্মস্থান গড়ার কারিগরের এমন অকাল মৃত্যু, আমাকে শুধু সেই দিন নয়, এখনো ঘুমাতে দেয় না।

    সুপ্রভাত সাতক্ষীরা ছাড়ার পর শামীম পারভেজ ও আহসান রাজীবের সাথে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেটা কমেছে। কিন্তু আনিছ আংকেল এখন নেই। তিনি আছেন কেবল মনে। যেখানেই যায়, মনের মধ্যে ভেসে ওঠে একেএম আনিছুর রহমানের মুখটি।

    লেখক: প্রতিষ্ঠাকালীন নির্বাহী সম্পাদক, সুপ্রভাত সাতক্ষীরা

  • আমি যে ভাবে দেখেছি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম মোড়লকে -অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী


    অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী

    আমার রাজনৈতিক জীবনে মোড়ল আব্দুস সালামের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অনেক ও দীর্ঘ । আমি রাজনৈতিক ধারায় যুক্ত হই ৬৮ সালের গণ আন্দোলনের শুরুর দিকে। তখন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে ও আগরতলা মামলা শুরুর শুরুর সময়কাল। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী জাতির সকল ধারাকে পরিবর্তন করে। স্বাধীনতার পর দুটো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আনে। একটি পাকিস্তানের কাছে যা পাওয়া যায় নি সেই সংবিধান রচনা। অন্যটি একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির জন্ম। যার নেতৃত্বে থাকে সদ্য যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা একদল মুক্তিযোদ্ধা, যাদের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ৬২ সালের তিন তরুণের স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ বোনার (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াস বা বিএলএফ) মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু, মুজিব বাহিনীর সফল এবং দীর্ঘ সংগ্রামের প্রস্তুতির প্রশিক্ষনের ধারায় সমাজতান্ত্রিক চেতনার সাথে পরিচিত ও সম্পৃক্ত বাংলার তারুন্য দৃপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এনে দেয় দেয় নূতন উৎমাদনা। স্বাধীনতার পর সেই তারুণ্য দীপ্ত উৎমাদনা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে জন্ম দেয় বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে একটি নূতন রাজনৈতিক দলের। “আমাদের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র” স্লোগানকে ধারণ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ নামে দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
    পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগের ৭০ সালের কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য হিসেবে প্রচার সম্পাদক শহীদ স্বপন কুমার উত্থাপিত স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়া প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন দেন। আব্দুস সালাম মোড়ল এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন ধারাবাহিকতার অংশ হিসাবে। স্বাধীনতার পূর্ব সমরয় রাজনৈতিক চারণ ক্ষেত্র ছিল বাগেরহাট। যুক্ত ছিলেন ছাত্রলীগের অভ্যান্তরে নিউক্লিয়াসের সাথে। আব্দুস সালাম মোড়ল মুক্তিযুদ্ধে তার জন্মএলাকা তালা অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন তিনি। এ আলোচনায় মুজিববাহিনীর বিষয়টি প্রাসঙ্গিক থাকলেও সময়ের কারণে সেটিকে বাদ রাখলাম। আগামীতে সময় সুযোগে আলোচনা করা যাবে।
    ১৯৭৮ সালের পর থেকে খুলনা অবস্থানের সময় কালের বেশিরভাগ সময় কেটেছে এ নেতার সান্যিধ্যে। এসময় খুলনাতে আমি ও আবু কাজী মিলে আমরা একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলি। উদ্ভাস সম্মিলিত সাহিত্য আসর যার নাম ছিল। মুলত: আমরা জাসদের ধারার সাথে মিলে এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলি। আব্দুস সালাম মোড়ল, বিপ্লব কান্তি মন্ডল প্রমুখ সংগঠনটির উপদেষ্ঠা ছিলেন। আমি ও আবু কাজী দুজনই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম।
    জাসদ প্রতিষ্ঠার সময় ঘোষনা করা হয় জাসদ একটি সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন। এ সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি বিপ্লবী পার্টি গঠন করা হবে। মুলত সেই সময়ে জাসদের উপলব্ধি ছিল দেশে যতগুলো বামধারার রাজনৈতিক দল ছিল তাদের সমাজ বিশ্লেষন সঠিক ছিল না। তত দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে গেছে। কিন্তু সকল বাম রাজনৈতিক দলের বিশেষন ছিল ‘ বাংলাদেশ একটি আধা উপনিবেশ ও আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশ’। এ সময়ে জাসদের অন্যতম সহ-সভাপতি ও তৎকালিন একজন প্রথম শ্রেনীর অর্থনীতিবীদ ড. আখলাকুর রহমান একটি লেখার মাধ্যমে প্রমান করেন যে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি পুঁজিবাদের দিকে মোড় নিয়েছে। তিনি ‘কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ’ নামে একটি গবেষনাপত্র লেখেন। জাসদ এ বিশ^াসকে ধারণ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসুচি ঘোষনা করেন। এবং এ বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য একটি বিপ্লবী পাটি গঠনের কথা বলেন। জাসদ যার প্লাট ফর্ম হিসেবে কাজ করবে বলে দলের অভ্যন্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

    জাসদ জন্ম লগ্ন থেকেই ‘সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেনী সংগ্রামকে তরানিত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’ এর সংগ্রাম করার কথা ঘোষনা করে। ’৭৩ সালের মধ্য সময় কাল থেকে সে প্রক্রিয়া শুরু হয় কি না আমি জানি না। তবে এ সময় জাসদের অভ্যন্তরে নূতন একটি রাজতৈকি ধারা শুরু হয়, দলের অভ্যন্তরে পাটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে সেল গঠন করা হয়। শ্যামনগর থানাতে সে সময় ৬ জনের একটি সেল গঠন করা হয়। যার সাথে আমাকে যুক্ত করা হয়। এর কার্যক্রমটা ছিল অনেকাংশেই গোপনীয়। দলের সকলে এর সাথে যুক্ত ছিলেন না, এমনি কি জানতেনও না।

    জাসদের বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের এ প্রক্রিয়ার মূল নেতা ছিলেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু। এবং তাঁর দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন মোড়ল আব্দুস সালাম। মোড়ল আব্দুল সালাম কখনই প্রকাশ্য নেতা ছিলেন না। তিনি এ প্রক্রিয়ার অন্যতম ত্বাত্তিক নেতা ও খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার, নড়াইল, মাগুরা, যশোর এলাকার মুল সংগঠক ছিলেন। সাতক্ষীরা অঞ্চলের এ প্রক্রিয়্ার প্রধান ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। শ্যামনগরে ছিলেন জি,এম আবু বকর সিদ্দিক (্এ্যাড)। ৬৯ সালে সাতক্ষীরা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। ছাত্রনেতা মোস্তাফিজুর রহমানের উদ্যোগে এ কমিটিতে সভাপতি রবীন্দ্র নাথ, নজরুল ইসলাম সেক্রেটারী ও জি এম আবুবকর সিদ্দিক কে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। তিন জনই শ্যামনগরের।
    সিদ্দিক ভাইয়ের মাধ্যমে আমার সাথে পরিচয় হয় মুক্তিযুদ্ধের নেতা ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান ভাইয়ের সাথে। তিনি ও শেখ কামরুজ¥ামান টুকু ভাই একদিন আমাকে ডেকে নেন সিদ্দিক ভাইয়ের বাড়িতে। সে সময় সেটি ছিলো আমাদের একটি অঘোষিত যোগাযোগ কেন্দ্র। মনে রাখতে হবে এসময় জাসদ প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল ছিলো। টুকু ভাই বললেন, একটি গাড়িতে অনেকে উঠেন কিন্তু একজন ড্রাইভার থাকেন তিনি পথ দেখিয়ে গন্তবে নিয়ে যান। আমরা সে যাত্রা শুরু করেছি তোমাকে তার সাথে যুক্ত হওয়ার তালিকায় রাখতে চাই।’
    রাজনীতিতে আমার স্বপ্নের মানুষগুলোর সামনে বসে আমি কথা বলছি, তারা যা বলবেন তা করতে আমার কোন আপত্তি নেই- এরকম একটি মানষিক প্রস্তুতি আমার। শ্যামনগরে সেল গঠন করা হয় ৬ জনকে নিয়ে। বাবু বিশ^নাথ দাশ (থানা জাসদের সাধারন সম্পাদক), শেখ হারুন-অর-রশীদ( সাংগঠনিক সম্পাদক), জি এম আবু বকর সিদ্দিক (রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র), শেখ আবুল কালম আযাদ(সদ্য থানা ছাত্রলীগের দায়িত্ব ছেড়ে কৃষকলীগের দায়িত্বে) আর ছাত্রদের মধ্যে আমি ও শেখ শফিকুর রহমান খোকন। বয়সে সবচেয়ে কম। তখনও কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলাম না, ৭৩ সালের শেষ দিকে আমাকে থানা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক হিসেবে তৎকালিন কমিটিতে কো-অপট করা হয়। সম্মেলনের মাধ্যমে ১৯৭৪ সালে থানা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আমি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাই।

    ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে শ্যামনগর থেকে বাবু বিশ^নাথ দাশ (তৎকালিন থানা জাসদের সাধারন সম্পাদক)নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনের পর থেকে দ্রুত রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে থাকে। ৭৪ সালের প্রথম দিকে আমরা সক্রিয়ভাবে সেল যুক্ত ছিলাম এবং নিয়মিত সভা হতো।

    সেল গঠনের পর আমাদের কাজের ধারায়, অধ্যায়নে পরিবর্তন আসে। আমার অ-প্রকাশ্য দায়িত্ব আসতে শুরু করে। সেল এর মিটিং সমুহ রাতেই সাধারনত হতো। এ সময়ে একজন ব্যক্তি শ্যামনগরে আসেন। সেল এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমার দায়িত্ব পড়ে তার সাথে যাওয়া। চুল দাড়িতে ঢাকা এক লোককে আমার সাথে দেওয়া হয়। আসল নাম পরে জানতে পারি। তিনি ছিলেন মোড়ল আব্দুস সালাম। অত্যান্ত ধীর স্থির ব্যক্তিত্বসম্পন্ন । কথা বলেন আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রনে। দিনের বেলায় বাইরে কম বের হতেন, অধিকাংশ সময়ে বিাভন্ন ব্যক্তি ও নেতৃবৃন্দের সাথে বলতেন যাদের অধিকাংশকেই আমি চিনতাম না। এর পর আসেন আরো একজন। তিনি আসেন টুকু ভাইয়ের সাথে। সিদ্দিক ভাইয়ের বাড়ীতে বৈঠক শেষে আমার উপর দায়িত্ব পড়ে। তাকে বেদকাশী(কয়রা) নিয়ে যাওয়ার। তিনি ছিলেন বিপ্লব কান্তি মন্ডল। এভাবেই একের পর এক বিপ্লবী ব্যক্তিদেও সাথে পরিচয় হতে থাকে আর আলোচনার মাধ্যমে আমার জ্ঞানের মাত্রাও বাড়তে থাকে। এই প্রথম কয়রা যাওয়া। কয়রার দিঘির জল খুব প্রশিদ্ধ ছিল। দীঘি থেকে উঠিয়ে আনা পানি গ্লাসে করে খেতে দিত। আমিও আট আনা দিয়ে এক গ্লাস পানি কিনে খাই। বেকাশীতে সোলাইমানের বাড়ী আসি। অমল, মাহবুব ও কবিরের সাথে পরিচয় হয়।
    আমিও আস্তে আস্তে বিপ্লবী গণবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে পড়ি। তবে আমার কাজটা ছিল প্রকাশ্য। ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চে পর জাসদ এর উপর চরম নির্যাতন নেমে আসে। এ সময় অনেকেই গ্রেফতার হন। প্রকাশ্য রাজনীতি করা কঠিন হলেও জাসদ বাকশাল গঠনের আগ পর্যন্ত প্রকাশ্য রাজনীতি অব্যাহত রাখে। ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের গণবাহিনীর অন্যতম কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল ঢালীসহ তার বাহিনীকে শ্যামনগরে গ্রহণ ও থাকার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব পরে। জালাল ঢালী তখন অপ্রকাশ্য ভাবে থাকেন। এক রাতে জালাল ঢালী, অমল, সোলাইমান, মাহবুব, সহ চুনানদী পার হয়ে আসেন। সকলে স্বশস্ত্র ছিল। আমি রাতেই তাদের নিয়ে হোমিও ডাক্তার ছালাম ভাইয়ের বাড়ী নিয়ে যাই। অস্ত্র গুলো ধানের গোলায় রাখি। আর সকলকে আক(ইক্ষু) বাগানে থাকার ব্যবস্থা করি। পরে সিদ্দিক ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেই। সিদ্দিক ভাই পুরো গ্রুপকে জয়ন্ত কাকা (বিশিষ্ট আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্র্যোপধ্যায়) বাড়ীতে সেল্টার করিয়ে দেন।
    গণবাহিনী স্বশস্ত্র হলেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিল। গণবাহিনীর খুলনা বিভাগীয় প্রধান ও কেন্দ্রিয় প্রতিনিধি ছিলেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু। খুলনা জেলার দায়িত্বে ছিলেন বিপ্লব কান্তি মন্ডল, সাতক্ষীরা জেলার দায়িত্বে ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। মোড়ল আব্দুস সালাম ছিলেন আঞ্চলিক সমন্বয়কারী। এ অঞ্চলের গণবাহিনীর সামরিক প্রধান ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার। সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন জালাল ঢালী, আবুবকর সিদ্দিক (এড.), আশাশুনিতে মোসলেম উদ্দীন (এড.), কয়রায় কেরামত হোসেন (এড.) প্রমুখ।
    আগস্টে আমাদের একটি দল নিয়ে আমরা হরিনগর এলাকাতে সেল্টার নেই। আমার এ দলে অমলসহ কয়রার বেশ জনের স্বশস্ত্র বাহিনীর একটি দল ছিল। এ সময় সুন্দরবন এলাকায় ডাকাত দলের উপদ্রুপ খুব বেড়ে যায় এবং ডাকাতরা অধিকাংশ সময় জাসদের নাম ব্যবহার করে মানুষের বাড়ীতে ডাকাতি করতো। ফলে তাদের দমন করা জরুরী হয়ে পড়ায় আমাদের এ এলাকায় আসা। আমাদের সাথে স্থানীয় ভাবে মুজিবুল হক, জাবের মোড়লসহ কয়েকজন যুক্ত হয়। আর শ্যামনগর থেকে গমআব্দুস সালাম, সম আতাউর রহমান, আবুল কালাম গাইন প্রমুখ ছিল। স ম আতাউর রহমান, আবুল কালাম গাইন স্বশস্ত্র বাহিনীর সদস্য। প্রথম রাতে জেহেরডাকাতসহ দুজন দুরান্ত ডাকাতকে ধরা ও হত্যা করা হয়। এলাকায় এ ঘটনা দারুন আলোড়ন সৃষ্টি করে ফলে আমাদের সেল্টারের সংকট কমে আসে। তবু আমরা বাহিনীর নিরাপত্তার জন্য ভিতরে মড়গাঙ্গে দিকে যেয়ে সহকর্মি — বাড়ী যেয়ে আশ্রয় গ্রহণ করি। বাড়ীতে অতিরিক্ত ঘর না থাকায় গোয়ালঘর পরিস্কার করে প্রথমে চুলাই ছাই ছিটিয়ে তার উপর বিচলি পেতে আমাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা ১৫র মত ছিল। এতজন লোকের পরপর তিন বেলা খাওয়ানো সকলের সামর্থ ছিল না। দিনে বাইরে গণবাহিনীর স্বশস্ত্র দের বের হতে দেওয়া হতো না। এক দিন পর আমরা একই এলাকার রমেশ বাবু বলে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তার বাড়ীতে সেল্টার নেই অনেকটা জোর করে। আমরা ব্যাগ বোচকা রেখে সন্ধ্যায় মুন্সিগজ্ঞ বাজারে আসি নেতৃবৃন্দ এসেছেন কথা বলতে। সেখানে আবু বকর সিদ্দিক ভাই ও কয়রার মাহবুব অপেক্ষা করছিলে। যাওয়ার পর কয়েকটি প্রয়োজনীয় কথা শেষে বলেন তোমাদের গ্রুপকে এখনই এ এলাকা ত্যাগ করতে হবে। নির্দেশ মত আমাদের সকলকে সেল্টার পরিবর্তনের বিষয় জানানো হলো, তবে তাদের পুরাতন সেল্টারের মালামাল আনার বিকল্প ব্যবস্থতা করে মালসামাল আনতে গেলাম।
    ৭৪ সালে উপক’লের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই দূর্গম ছিল। এলাকার একমাত্র বাহন হেলিকপ্টার (সাইকেলের পিছনে তক্তা দিয়ে বসার ব্যবস্থা)। আমি মালামাল আনতে যাওয়ার সময়ে ঘটে যায় একটি বড় দুর্ঘটনা। মুন্সিগজ্ঞ এলাকা সুন্দরবন সংলগ্ন হওয়ায়, স্থানীয় গরীব মানুষেরা সুন্দরবন হতে সহজে ‘ছিটে’ (গোড়ান গাছের ডাল) কাঠ সংগ্রহ করে আনতো। যা জ¦ালানী হিসেবে ব্যবহার করতো। আর এসময় থানার একদল পুলিশ ছিল, যারা সুযোগ পেলে আসতো এদের ধরে দ’ু পাঁচ টাকা নিতে। এদিনও দুজন পুলিশ আসে বাজারে। এ বিষয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। কারণ পুলিশ তত দিনে গণবাহিনীর নাম জেনে গেছে। ফলে তারাও পারত পক্ষে জাসদদের লোকদের এড়িয়ে চলতো। কিন্তু এদিন ঘটলো বিপরীত ঘটনা। সম্ভবত নূতন আগত ছিল তারা। আমাদের বাহিনী সদস্য কালামকে বাজারে দোকানে বসায় অবস্থায় কেহ একজন গোপনে উষ্কে দিলে পুলিশ আটক করায়। ঘটনাটি দ্রুত বাহিনীর সদস্যদের পৌছে গেলে পুলিশদের নিকট থেকে কালামকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেহেতু আবু বকর সিদ্দিক ভাই অবস্থান করছিলেন এলকাতে, ফলে তার মতামতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশদ্বয় কালামকে সাথে নিয়ে গ্রামে ভিতরে চলে যাওয়ায় তাৎক্ষনিক একটু সমস্যা তৈরী হয়। আজকেরমত বৈদ্যুতিক আলো না থাকায় গ্রাম এলাকায় সন্ধ্যার পর পরই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসতো। ফলে কালামকে নিয়ে পুলিশরা কোন দিকে গেছে সেটি জানতে বেশ সময় চলে যায়। কালামকে পুলিশ নিয়ে গেলে নির্যাতনের মুখে সকল তথ্য বলে দিতে পারে। ফলে নেতৃবৃন্দ নির্দেশ দেন যেকোন প্রকারে কালামকে মুক্ত করতে হবে। পরে জানাগেল যে পুলিশ কালাম সহ গ্রামের মধ্যে গেছে। ফেরার পথে এ্যামবুশ করা হলো, পুলিশ কাছাকাছি আসলে কৌশলে ছাড়ানোর চেষ্টা করা হয়।
    একাতে থাকা নিরাপদ না হওয়ায় সিদ্দিক ভাই ও মাহবুব মুল বাহিনী নিয়ে কয়রার দিকে চলে যায়। আমাকে তাদের সাথে না যেয়ে এলাকাতে ফিরবার সিদ্ধান্ত দেন। এ সময় আমার দায়িত্ব ছিল প্রকাশ্য দলের কাজ করা। তখন শ্যামনগরে তত দিন পর্যন্ত গণবাহিনীর প্রকাশ্য কাজের দায়িত্বে ছিলেন শেখ আবুল কালাম আযাদ, নওশেরম আরশাদ, শেখ শফিকুর রহমান, শেখ ফিরোজ প্রমুখ। কিন্তু বাড়ীতে পৌছে বুঝতে পারলাম এখানে থাকা নিরাপদ নয়। আমার আব্বা আমাকে পরের দিন ভোরে একজনকে সাথে দিয়ে সাতক্ষীরাতে রওনা করে দেন। আমরা গুমানতলী গ্রামের পিছন দিয়ে কৃষ্ণনগরের মানপুরে আমাদের জোরদার আহম্মদ চাচার বাড়ী আসি, তিনি সহ ঘোলা খেয়া পার হয়ে ব্যাংগদহ হয়ে দুদিন ধরে হেটে সাতক্ষীরার সুলতানপুরে এসে আমার এক ভগ্নিপতি কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা আবুল কাশেমের বাসাতে উঠি। আমার আব্বা মুলত এখানে থাকার ব্যবস্থা করেন। আমি এ সময় সাতক্ষীরা কলেজের ছাত্র। কয়েক দিনের মধ্যে সাতক্ষীরার গোলাম রসুলের সাথে যোগাযোগ হয়। পরে হাসনে জাহিদ জজ ভাইয়ের মাধ্যমে কামরুল ইসলাম খানের সাথে যোগাযোগ হয়। কামরুল ইসলাম খান কোটের সামনে একটি দোকান ছিল। এটাই মোটামুটি যোগাযোগের কেন্দ্র ছিল। আর একটি কেন্দ্র ছিল চৌধুরী পাড়ার মধ্যে ক্লাব ঘর। এখানে সান্টু চৌধুরী, যঙ্গু ও নান্নাসহ অনেকেই থাকতো।
    ১৯৭৫ সালের আগষ্ট মাসের প্রথম দিকে গোলাম রসুল (পরে কাউন্সিলার হন) একদিন জানান নেতৃবৃন্দ তালার মুড়োগাছিতে আছেন, সেখানে কয়েকটা অস্ত্র নিয়ে যেতে হবে। কারন জাসদ নেতা লতিফ ও হাতেমকে হত্যার মুলব্যক্তি নূর খাঁ চেয়ানম্যানকে অপারেশন করতে হবে। সে সময় তালা, আশাশুনি, শ্যামনগর, কয়রা, পাইকগাছা, দেবহাটা এলাকা ক্যাপ্টেন শাহজাহান, আবু বকর সিদ্দিক ও জালাল ঢালীদের নিয়ন্ত্রনে ছিল। এরা বেশীর ভাগ সময় এ সকল প্রত্যান্ত অঞ্চলে বাহিনী নিয়ে অবস্থান করতেন।
    আমি সুলতানপুর হতে বের হয়ে ভোরে পুরাতন সাতক্ষীরাস্থ গোলাম রসুলের বাড়ীতে পৌছাই। রসুলের বাড়ীতে পান্তা ভাত খেয়ে আমরা পিছনের বিল দিয়ে পানিতে নেমে হাটতে শুরু করি। অস্ত্র গুলো বস্তার মধ্যে ভরে পর্যায় ক্রমে মাথায় ঘাড়ে করে হাটতে শুরু করি। এক কোমর পানি দিয়ে হাটা সহজ সাধ্য ছিল না। মাঝে মধ্যে কিছুটা উচু পথ পাওয়া যেত বটে তবে সে পথ অপেক্ষা পানির মধ্য দিয়ে হাটা সহজ ছিল। তালা অঞ্চলে তখন ইপিসিপি/নকশালদের অবস্থান শক্তিশালী ছিল। এনারা জাসদকে সা¤্রাজ্যবাদের দালাল মনে করতো। তাদের কাছে জাসদ, গনবাহিনীর সদস্যদের হত্যা করা শ্রেনী সংগ্রামের অংশ ছিল। ফলে সাবধানতা অবলম্বন ছিল শ্রেয়। তালার বিলে জোক ছিল মারাত্মক ধরনের। ইতোমধ্যে কতগুলো জোঁক যে সঙ্গি হয়েছে, তা হিসাব করে বের করা মুসকিল। যত কষ্ট হোক নিরাপত্তার জন্য এ পথেই চলতে হবে। কিন্তু পথ আর কমে না। ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নেব, সে সুযোগ বা স্থান নেই। ফলে প্রায় মন খানেক মালামাল মাথায় ঘাড়ে পিঠে করে রাত আনুমানিক ১০ টার দিকে মুড়াগাছি মুক্তিযোদ্ধা সুজাত মাষ্টারের বাড়ীতে পৌছাই। সে রকম নির্দেশই ছিল। এ সময় আমাদের আপ্যায়ন করবে বাড়ীতে সে অবস্থা নেই। বাড়ীতে এক জন নারী সন্তান জন্ম দিতে যেয়ে বিপদজনক অবস্থার মধ্যে আছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে সে নারী। নারী মর্মান্তিক আত্মচিৎকার আমারা শুনতে পাচ্ছিলাম। ফলে বাড়ীর অবস্থা প্রতিকুল। এর মধ্যে সুজাত ভাই অত্যান্ত আন্তরিকতার সাথে আমাদের গ্রহণ করেন ও খেতে দেন। আমাদের যে সময়ে পৌছানোর কথা ছিল তা থেকে অনেক পরে পৌছাই। ফলে আমাদের গ্রহণকারী দল ফিরে গেছেন সেল্টার এলাকায়। আমাদের জন্য নির্দেশ হলো এ রাতেই কাদাকাটি মুরতোজা ভাইয়ের বাড়ীতে পৌছাতে হবে। আমরা খেয়ে দেরী না করে বের হয়ে পড়ি এবং ভোর রাতে মুর্তুজা ভায়ের বাড়ী পৌছে হাতমুখ ধোয়ার সুযোগ পাই। মুর্তুজা ভাইয়ের বাড়ীতে আসার পর তার এক বোনের নার্সিং এ কিছুটা জোকে কাটা রক্ত পড়া বন্ধ হলো। এক সপ্তাহ পরে সাতক্ষীরা ফিরি। ফেরার দুদিন পরেই ঘটে যায় জাতীয় বিপর্যয়।
    ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে আওয়ামীগের একটি গ্রুপের নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুকে স্ব-পরিবারে হত্যা করে।ঁ ৭৩ সালের র্ন্বিাচনে জাসদ প্রার্থী ডা. আজহার উদ্দীনের জয়কে ছিনতাই করে অতিউৎসাহী আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ পরাজিত খন্দকার মোস্তাককে বিজয়ী ঘোষনা করতে নির্বাচনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদেও বাধ্য করেন। সেই খন্দকারই জাতীর জনককে স্ব-পরিবারে হত্যার প্রধান সুফল ভোগী। রেডিওতে খবর শোনার পরপরই আমাদের মধ্যে একধরনের সংশয় সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় সুলতানপুরের আমার বাসার কাছাকাছি স্থানে আস্তে আস্তে জড়ো হয় কোকিল, মোহাম্মদ আলী, গোলাম রসুল, মাইকেল প্রমুখ। আমরা কেন্দ্রের নির্দেশ জানার জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত জানার দ্রুত সকলে একত্রিত হব বলে গোলাম রসুল জানান। গোলাম রসুল তখন মুলত সকল সংযোগ রক্ষা করে সমন্বয় করতো শহরের কাজগুলো।
    ৩০সেপ্টেম্বরের ও ১অক্টোবর, এ দুদিন তালার মুড়াগাছিতে জাসদ গণবাহিনীর বিশেষ সভা হয়। সভায় কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে শরীফ নূরুল আম্বীয়া ও খুকু (পরবর্তিতে সাবেক বাসদ নেতা আ ফ ম মাহাবুবুল হকের স্ত্রী) শেখ কামরুজ্জামন টুকু, জালাল ঢালী, ক্যাপ্টেন শাহাজান মাষ্টার, আবু বকর সিদ্দিক, আব্দুস সালাম, কেরামত আলী ও মোসলেম উদ্দীর প্রমুখর সমন্বয়ে দু দিস ব্যপি বিশেষ সভা হয়। সভা শেষে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এলাকা ত্যাগ করে । ২ অক্টোবর ছালাম ভাই, শাহজান স্যার সিদ্দিক ভাই ও জালাল ঢালী, মনোরজ্ঞন বড়দলে কার্তিক মন্ডল (সাবেক চেয়ারম্যান) এর বাড়ীতে যাওয়া উদ্দেশ্যে রওনা হন। কোন প্রস্তুতি ছাড়াই তাদের যাত্রা। পথে সকাল ৭ টার দিকে তারা খড়িহাটি, আশাশুনিতে বিশাল পুলিশ বাহিনীর মুখোমুখি হন। পুলিশ হঠাৎ শাহজাহান স্যারকে লক্ষ কওে গুলি ছোড়ে, স্যার গুলিবৃদ্ধ হয়ে গড়ে যান, একই ভাবে জালাল ঢালী ও আবু বকর সিদ্দিক ভাইকে গুলি করা হয়। ৩ গুলিবিদ্ধসহ ৫ জন গ্রেফতার হন। সালাম ভাই গুলিবিদ্ধ ছিলেন না। তবে পুলিশের লাঠির আঘাতে অজ্ঞান হয়ে গ্রেফতার হন। সেখান থেকে নৌকা করে তাদের আশাশুনি। আশাশুনি থেকে পরের দিন ৩ অক্টোবর লঞ্চে সাতক্ষীরা থানায় নিয়ে আসা হয়। আমরা রাতে খবর পাই। কিন্তু কোন নির্ভর যোগ্য খবর পাই না। পরদিন ভোরে হাটতে হাটতে পলাশপোল চৌধুরী পাড়ায় আসি। সান্টু ভাইসহ কয়েক জনের সাথে কথা হয়। সকলেই একই ধরনের খবর শুনেছে। ইতোমধ্যে খবর পাই তাদেরকে সাতক্ষীরাতে নিয়ে আসছে।
    আমি খবরটা নেওয়ার জন্য পাকা পোল এলাকাতে আস্তে আস্তে আসি। বেলা তখন দুপুরের কাছাকাছি। লোকেলোকারণ্য সমগ্র এলাকা। পুলিশ থানার কাছাকাছি কাউকে ভিড়তে না দেওয়ায় থানার চারধারে লোক ভর্তি। তার মধ্য দিয়ে ঠেলে কোন মতে থানার কাছাকাছি আসি। থানার পশ্চিম দিকে দরজা তখন দরজা ছিল। সামনের দিকটা তারের ঘেরা। আমি কাছাকাছি যেয়ে দেখি চারজন পরপর শুয়ে আছে। হাতে সেলাইন লাগানো তিনজনের। তিনজনই বিশাল দেহের অধিকারী হওয়ায় পা সকলের বাইরে চলে এসেছে। জ্ঞান আছে বলে মনে হলো না। মানষিক ভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। কোন মতে নিজেকে সামলে ফিরে আসি। এদিন বিকালে তাদের খুলনা নিয়ে খুলনা জেলে নেওয়া হয়।
    খুলনা থেকে ৩১ অক্টোবর ঢাকা সেন্টাল কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময়ে গুলিবিদ্ধ তিন জনের চিকিৎসা জেলের মধ্যে করা হয়, যা কোন কাজে আসে না। ইতোমধ্যে ক্ষত স্থানে পচন ধরে। কিন্তু উন্নত চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা জেল কতৃপক্ষ করতে পারে না। এ সময়ে সাতক্ষীরা আতিয়ার রহমান (যিনি শাহজান মাষ্টারের এলাকার বন্ধু ও সহযোদ্ধা ছিলেন) তিনি পোস্ট মাষ্টার জেনারেল ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের সম্মতি নিয়ে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করান। কিন্তু তত দিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সকলের পায়ের ক্ষতস্থানের হাড় বাদ দিতে হয়।
    কারাগারে ছালাম ভাইয়ের জীবনে একটি নূতন যাত্রা শুরু হয়। কারাগারে পরিচয় ঘটে আর এক বিপ্লবী নারী নেত্রীর সাথে। আমিনা সুলতানা বকুল নামের এ মেয়েটিও কারাগারে আসেন। জাসদ ও গণবাহিনীর সক্রিয় নেত্রী হওয়ায় দলের সকলে তারপ্রতি আন্তরিক ছিলেন। দু জনের ভালোলাগা ও নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তে ৭৭ সালে তাদের কারা অভ্যন্তরে বিয়ে হয়। আসম রব সহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন সেখানে। পরে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর খুলনাতে শেখ আব্দুল কাইয়ুম ভাইয়ের বাসাতে আবার আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়।
    ৭৮ সালের প্রথম থেকে জাসদ নেতৃবৃন্দ কারাগার থেকে ছাড়া পেতে শুরু করে। ছালাম ভাইও এ সময় মুক্ত হন। ছালাম ভাই এ সময় পর্যন্ত জাসদের কোন কমিটিতে ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্বাধীনতার পর গঠিত আওয়ামীলীগের সহযোগি প্রথম কৃষক সংগঠন জাতীয় কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাকালিন কেন্দ্রিয় কমিটির সহ-সভাপতি। আওয়ামীলীগের অনেক নেতাদের বিরোধীতা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু প্রথম কমিটির সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক করেন খন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহ ও হাসানুল হক ইনুকে। ৮০ সাল পর্যন্ত আব্দুস সালাম মোড়ল কৃষক লীগের কেন্দ্রিয় কমিটিতে ছিলেন।
    ৭৯ সাল থেকে জাসদ অভ্যন্তরে দুটি ধারা প্রবল আকার ধারন করে । গনতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের পক্ষে ও বিপক্ষ। সংক্ষেপে বলাহতো ডিএনজি ও এন্টি ডিএনজি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মান্না-আকতার এন্টিডিএনজির পক্ষে থাকায় ছাত্রলীগের অধিকাংশই এর পক্ষে ছিলেন। জাসদ কেন্দ্রিয় কমিটিতে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা এ ধারার পক্ষে অবস্থান নেন। দলের মধ্যে বিপ্লবী দল গঠনের দাবী প্রবল হয়। এ অবস্থায় জাসদ কেন্দ্রিয় কমিটি ১২ নেতাকে নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে। এ কমিটির পক্ষ হতে বৃহত্তর জেলা গুলোতে কর্মি সমাবেশ করা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খুলনাতে প্রথম সভা হওয়ার কথা নির্দ্ধরিত হয়। নির্দ্ধারিত দিনে খুলনা রেলওয়ে অডিটরিয়াম মিলনায়তনে সভা শুরু হয় কিন্তু কর্মিদের নানান প্রশ্ন, প্রশ্নের জবাব চাওয়া ইত্যাদি কারনে সভা ভালো ভাবে শেষ হয় না। পরে দায়িত্বশীল ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ ও জেলা নেতাদের নিয়ে মিটিং করা কথা থাকলেও মিটিং শেষে ফিরে যাওয়ার পথে একেজন বাস থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করারায় নেতৃবৃন্দ নিহত ছেলের বাড়ীতে তাৎক্ষনিক যাওয়ায় মিটিং আর হয় না। এ ঘটনার কয়েক দিন পরে জাসদের কেন্দ্রিয় সমন্বয় কমিটির পক্ষ হতে ডাকসুর ভিপি মাহামুদুর রহমান মান্না ও জিএস আক্তারুজ্জামানকে ছাত্রলীগের সকল দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের মধ্যে এ ঘটনা মারাত্মক বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়। প্রায় সকল কমিটির পক্ষ হতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবী জানাতে শুরু। কোন কোন এলাকা এ ধরনের সিদ্ধান্তকে নিন্দা জানায়। এ সময় জাসদ কেন্দ্রিয় কমিটির প্রভাবশালী সদস্য খালেকুজ্জামান ভূইয়া, আব্দুল্লাহ সরকার, ময়নুদ্দিন খান বাদল, মতিয়া চৌধুরীসহ ১১ জন পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবী জানান। খুলনা থেকে আব্দুস সালাম মোড়ল, বিপ্লব কান্তি মন্ডল, আবম নূরুল আলম সহ ১১ জন জেলা নেতৃবৃন্দ একই ধরনের বিবৃতি দেওয়ার প্রেক্ষাপটে জাসদের পক্ষ হতে ঘোষনা করা হয় এর পর এ ধরনের বিবৃতি যারা দেবেন তারা আপনা আপনি দলথেকে বহিস্কার হয়ে যাবেন। ফলে জাসদের ্িবভক্তি চুড়ান্ত হলো।

    ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর নূতন একটি সমাজতান্ত্রিক পাটির আত্মপ্রকাশ হলো খালেকুজ্জামান ভুইয়াকে আহ্বায়ক করে। কেন্দ্রিয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে মোড়ল আব্দুস সালাম ও মো¯তাফিজুর রহমান খুলনা সাতক্ষীরাতে অর্ন্তভুক্ত হন। আব্দুস সালম মোড়ল সক্রিয় ভাবে সকল কার্যক্রমে অংশ নিতেন। বাসদের দলগঠন, দলের প্রক্রিয়া ও কিছু ব্যক্তিগত ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন উপস্থাপিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দলের দায়িত্ব থেকে মাহমুদুর রহমান মান্না ও খুকু আপাকে সাময়িক অব্যহতি দেওয়া হয় ৮৪ সালের দিকে। পরে ৮৪ সালের নভেম্বরের দিকে আফম মাহবুবুল হকের পক্ষ হতে মাহমুদুর রহমান মান্না ও খুকু আপাকে সাময়িক অব্যহতি প্রত্যারের বিষয়ে বাসদ কেন্দ্রিয় কমিটির তলবী সভা আহ্বান করা হয়। এ সময় ছালাম ভাই, বাদল ভাই সিদ্দিক ভাইসহ শ্যামনগরে চিংড়ী চাষের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারনে শ্যামনগরে বেশী সময় অবস্থান করতেন। শ্যামনগর হতে ছালাম ভাই ও বাদল ভাই ঢাকাতে যেয়ে এ সভায় যোগ দেন ও পৃথক বাসদ গঠন করেন। ছালাম ভাই তখন খালেকুজ্জামান ভাইদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে মাহবুবুল হক ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন বাসদে যোগ দেন এবং একই ভাবে কেন্দ্রিয় কমিটিতে থাকেন।
    ৮০ সালে জিয়া হত্যার পরে বিচারপকি আব্দুস সাত্তারের কাছ থেকে এরশাদ ক্ষমতা দক্ষল করে নেয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাসদ ভেঙে যায়। রব ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন জাসদ এরশাদের পক্ষে থাকে। কিন্ত কাজী আরিফ, হাসানুল ইনু জাসদ (ইনু) নামে মুল জাসদ ধারার প্রতিনিধিত্ব করে। কাজী আরিফ, হাসানুল ইনু নেতৃত্বাধীন জাসদ (ইনু) এরশাদ বিরোধী বাম জোটের সাথে থাকে।
    ১৯৮৬ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাসদে আবার বিভক্তি হয়। কাজী আরেফ, শাহাজান সিরাজ, ইনু ভাইয়ের নেতৃত্বে প্রধান ধারার জাসদ। মূলত সিরাজুল আলম খান এরশাদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় নেওয়ায় এ বিভক্তি সৃষ্টি হয়। রব ভাই, জিকু ভাই সিরাজুল আলম খানের সিদ্ধান্তের দিকে থাকেন। এর পরপরই সালাম ভাই বাসদ (মাহবুব) ত্যাগ করে রব ভাইয়ের সাথে যুক্ত হন। ৮৬ সালে এরশাদেও নেতৃত্বে জাতীয় নির্বাচনের সুচনাকালে তিনি জাসদ রব গ্রুপে যোগদেন এবং জাসদ রবের পক্ষে সংসদ নির্বাচনে তালা-কলারোয়া আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
    আসম আব্দুর রব ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন জেএসডিতে যোগ দেওয়ার পরপরই সালাম ভাইয়ের জীবনে পারিবারিক বিপর্যয় নেমে আসে। এ সময় বকুল ভাবি সালাম বাইকে ছেড়ে চলে যায়। একমাত্র কন্যা মায়ের সাথে থেকে যান। পরবর্তীতে সালাম ভাই বিয়ে করেন জিকু ভাইয়ের নিকট আত্মীয়কে। এ বিয়ের পওে সালাম ভাই কানাইদিতে ফিওে আসেন। এখানে তার পৈত্রিক বাড়ী। পাইকগাছা আদালতে প্রাকটিস করার জন্য আগেই ফিরে বিপ্লব কান্তি মন্ডল কপিলমুনি(নাসিরকুড়), পাইকগাছাতে বসবাস শুরু করেন। মোড়ল আব্দুস সালাম এর স্ত্রী বিপ্লব মন্ডলের সাথে যোগাযোগ করে কয়েক কাটা জমি ক্রয় করে সেখানে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন।
    জেএসডির সাংগঠনিক কাঠামোয় থাকলেও তিনি বাসদ কেন্দ্রিক বাম ধারার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন আবারও। সিরাজুল আলম খানের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল প্রগাঢ়। যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। র্প্বূ পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাথে তাঁর সম্পর্ক ও মুক্তিযুদ্ধে তার ভ’মিকা এ আলোচনায় বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবন আলোচনায় সেটি সম্পৃক্ত করা হবে।
    এক বনাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী সংগ্রামী মানুষ ছিলেন সালাম ভাই। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে জীবনের বিলাসিতার সকল সুযোগকে অবলিলাক্রমে ঠেলে দিতে পেরেছিলেন। জীবনের একমাত্র চাওয়া সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাংখায় আপোষহীন থাকতে নূতন করে পথ খুজে ফিরেছেন। নানান পথ পরিক্রমায় আকা বাকা রাস্তা দিয়ে চললেও কখনো ব্যক্তি লোভ, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার সুবিধাবাদী চিন্তায় নিজেকে যুক্ত করেন নি। সৎ, নির্লোভ এবং বৈষম্যহীন সমাজের মূল্যবোধের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছেন সেই পথেই তিনি হেটেছেন মাথা উচু করে। পরবর্তীতে স্থানীয় মানুষের সংকট সমস্যায় তিনি একজন সক্রিয় সমাজ সংস্কারের ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এখানেও তিনি ছিলেন সামাজিক মূল্যবোধের ধারক। এ সময় তিনি ব্যপক পড়াশুনা শুরু করেন।
    তাকে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার কথা শেষ করছি।

    লেখক: ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক, জাতীয় কৃষক জোট কেন্দ্রিয় কমিটি।

  • আজ পালিত হলো আজীবন বিপ্লবীকমরেড আ ফ ম মাহবুবুল হকের ৫ম মৃত্যু বাষিকী

    আজ পালিত হলো আজীবন বিপ্লবী
    কমরেড আ ফ ম মাহবুবুল হকের ৫ম মৃত্যু বাষিকী

    আজ ১০ নভেম্বর ২০২২, বৃহস্পতিবার সকালে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের অস্থায়ী বেদীতে কমরেড আ ফ ম মাহবুবুল হকের প্রতিকৃতিতে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিনের কর্মসূচী। পুষ্পস্তবক দিয়ে শ্রদ্ধা জানান, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের আহবায়ক সন্তোষ গুপ্ত, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মহিনউদ্দিন চৌধুরী লিটন ও জাকির হোসেন; বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সহকারী সাধারণ সম্পাদক মিহির ঘোষ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সহসভাপতি শফিউদ্দিন মোল্লা, বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সদস্য বেলাল চৌধুরী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা, ঐক্য ন্যাপের সহ সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ ভূঁইয়া; বাম ঐক্য ফ্রন্টের সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন আহমেদ নাসু, ইমাম গাজ্জালি ও সন্তোষ গুপ্ত; সৎসঙ্গ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সামছুল আলম জুলফিকার, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের রঞ্জিত কুমার সাহা ও যুবকেন্দ্রের সংগঠক জামাল শিকদার।

    এসময় বাসদ আহবায়ক ও বীর মুক্তিযোদ্ধার আ ফ ম মাহবুবুল হকের স্মরণে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় নেতারা বলেন, আওয়ামী ফ্যাসীবাদী দুঃশাসন থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বাম প্রগতিশীল শক্তি ঐক্যের ভিত্তিতে গলআন্দোলন গণসংগ্রাম গড়ে তুলে রাষ্ট্র সরকার সংবিধান প্রণয়নের আহ্বান জানান। এবং আজীবন বিপ্লবী এই নেতার আদর্শ অনুসরণের মধ্যেই দেশের মানুষের মুক্তি নিহিত আছে বলে উল্লেখ্য করেন।

  • আগামীকাল কমরেড আ ফ ম মাহবুবুল হক এর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী

    আগামীকাল কমরেড আ ফ ম মাহবুবুল হক এর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী

    আগামীকাল কমরেড আ ফ ম মাহবুবুল হক এর ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী
    (জন্ম : ২৫.১২.১৯৪৭-মৃত্যু : ১০.১১.২০১৭)

    আগামীকাল ১০ নভেম্বর’২২ বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর আহ্বায়ক আজীবন বিপ্লবী কমরেড আ.ফ.ম. মাহবুবুল হকের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৭ সালের এই দিনে তিনি কানাডার আটোয়া দেহ ত্যাগ করেন। কমরেড আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক কে সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতিতে অসম সাহসী পদচারণা এদেশের মানুষ চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখবে। প্রথমে স্বাধীনতা, পরে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে গেছেন। লোভ-লালসা কিংবা ভয়ভীতি তার পথচলা থামাতে পারেনি। সমাজবিপ্লবের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন অবিচল। এ কারণে বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠীর কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আতঙ্ক।
    বিপ্লবী রাজনীতিতে বহু আত্মত্যাগের ইতিহাস রয়েছে। যে ইতিহাস সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে প্রেরণা জোগায়। আ.ফ.ম. মাহবুবুল হকের জীবন সংগ্রামে ছিল তেমনি আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত। স্লোগান মিছিল আর লড়াই ছিল তার জীবনের অংশ।
    আ.ফ.ম. মাহবুবুল হকের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর, নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের নি¤œ মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা মৌলভী ফজলুল হক, মাতা মরিয়ম নেছা। ছয় বোনের একমাত্র ভাই ছিলেন তিনি। একমাত্র ছেলে হিসেবে সমাজের আর দশজনের মতো শুধু পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু তিনি মা-বাবা ও পরিবারের প্রতি যতœবান হতে পারেননি। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলাই ছিল তার জীবনের প্রধান কাজ। সহকর্মীদের সেই আদর্শে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
    আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। নিজ গ্রামে প্রাইমারি স্কুলে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তিনি ১৯৬৪ সালে কুমিল্লা বোর্ড থেকে এসএসসিতে চতুর্থ স্থান এবং ১৯৬৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় একই বোর্ড থেকে ১১তম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬৬-৬৯ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের কৃতী ছাত্র ছিলেন।

    আ.ফ.ম. মাহবুবুল হকের পুরো নাম আবুল ফজল মোহাম্মদ মাহবুবুল হক মুকুল। ১৯৬২ সালে স্কুলজীবনে শরীফ কমিশনের প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। ওই সময় তার ছাত্র রাজনীতিতে পদার্পণ ঘটে। তিনি ১৯৬৭-৬৮ সালে পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগ সূর্যসেন হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৮-৬৯ সালে পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৬৯-৭০ সালে কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
    সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতাপন্থী ১১ সদস্যের যে নিউক্লিয়াস গঠন করা হয়েছিল, আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক অন্যতম সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে বিএলএফের রাজনৈতিক এবং গেরিলা যুদ্ধের অন্যতম প্রশিক্ষক ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৩-৭৮ পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
    ১৯৭৮-৮০ সালে জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৩ সাল থেকে মৃত্যুর পর্যন্ত তিনি বাসদের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বামপন্থীদের প্রথম জোট পাঁচ দলের তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক। সমাজবিপ্লবের কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য গড়ে তুলেছিলেন বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। যে ফ্রন্ট দেশের মানুষের আশার আলো হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে ফ্রন্টেই প্রস্তাব উঠল ১১ দল গঠনের। ১১ দল গঠনের প্রশ্নে নোট অফ ডিসেন্ট দিয়ে এতে যুক্ত হলো বাসদ (মাহবুব)। এই ১১ দলীয় জোটকে যখন ১৪ দলীয় মহাজোটে যুক্ত করার প্রস্তাব উঠল, তখন অন্য বাম দলের আগেই বিবৃতি দিয়ে পাতিবুর্জোয়াদের জোট ১১ দল থেকে বের হয়ে যান তিনি। ৪বাম দলের সাথে যুক্ত হয়ে গড়ে তোলেন ৫বামদল, যা এখন গণতান্ত্রিক বামমোর্চা নামে কাজ করছে। এছাড়া জাতীয় সম্পদ রক্ষায় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠান তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক। এছাড়া বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলন, পুঁজিবাদ-সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে আ ফ ম মাহবুবুল হক ছিলেন আপোষহীন যোদ্ধা।
    ১৯৬৮ সালে তিনি প্রথম কারাবরণ করেন। ১৯৭৫ সালে ৮ নভেম্বর বায়তুল মোকাররমের সামনে জাসদের জনসভায় বক্তৃতারত অবস্থায় জিয়া-মুশতাকপন্থী সন্ত্রাসীদের গুলির শিকার হন। এ সময় পেটে ও বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত বেঁচে যান তিনি। ১৯৭৬ থেকে ’৭৮ সাল পর্যন্ত রাজবন্দি হিসেবে জেলে কাটান। ১৯৮৬ সালে আবার কারাবরণ করেন। এছাড়াও ১৯৯৫ সালে ঋণখেলাপি কালোটাকার মালিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে মিথ্যা মামলার আসামি হন।
    ১৯৭৪ সালে ছাত্রনেতা মাহবুবের পরিচয় হয় রাজনৈতিক সতীর্থ কামরুন্নাহার বেবীর সঙ্গে। ১৯৭৯ সালে তাদের বিয়ে হয়। ১৯৮০ সালে একমাত্র সন্তান উৎপলা ক্রান্তির জন্ম হয়।
    ২০০৪ সালের ২৫ অক্টোবর অজ্ঞত ঘাতকদ্বাধা আঘাত প্রপ্ত হওয়ার পর দেশে চিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসা জন্য ২০০৫ সালের মে মাসে মাহবুবুল হককে নিয়ে যাওয়া হয় কানাডায়। অটোয়া রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে প্রায় বছরখানেক চিকিৎসার পর কিছুটা ফিরে পান চলনশক্তি ও স্মৃতিশক্তি। আগের অসুস্থতার জের ধরে ২০০৯ সালে কানাডায় আবার শিকার হন ঝবরুঁৎব অঃঃধপশ (সিজ্র অ্যাটাক) এবং ব্রেইন হেমারেজের। আবারও ফিরে আসে আগের সব শারীরিক ও মস্তিষ্কজনিত বিকলাঙ্গতা। সাত মাস ধরে সিভিক এবং মন্টফোর্ট হাসপাতালে চিকিৎসার পর আবারও ফিরে আসেন পারিবার এবং সতীর্থদের কাছে। তবে আগের মতো সুস্থ আর হতে পারেননি। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আবারও ঝবরুঁৎব অঃঃধপশ (সিজ্র অ্যাটাক) এবং ব্রেইন হেমারেজে আক্রান্ত হন। এবারের রক্তক্ষরণের মাত্রা অনেক বেশি। আর ফিরলেন না। গত ১০ নভেম্বর ২০১৭ সালে ১০.১৫মিনিটে অটোয়া সিভিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আজীবন বিপ্লবী আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক। পেছনে ফেলে যান অসংখ্য গুণগ্রাহী, পরিবার-পরিজন এবং সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তার সংগ্রামী শিক্ষা ও আপসহীন অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার হোক নতুন প্রজন্মের বিপ্লবীদের পাথেয়।

    জয়তু কমরেড মাহবুবুল হক
    দুনিয়ার মজদুর এক হও

  • জাসদ কেন লালন দিবস পালন করছে?- জিয়াউল হক মুক্তা

    জাসদ কেন লালন দিবস পালন করছে?- জিয়াউল হক মুক্তা

    জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল – জাসদ তার প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর উদযাপনের অংশ হিসেবে এবছর ১৭ অক্টোবর দেশব্যাপি লালন দিবস পালনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ কর্মসূচি দলের অভ্যন্তরে ব্যাপক আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা উপজেলায় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে। লালনের বাণির ব্যাপক প্রচারের জন্য কেন্দ্রীয় উদ্যোগে পক্ষকালব্যাপি অনলাইন ক্যাম্পেইন পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু যারা জাসদকে মোটে সহ্য করতে পারে না, তারা এতে হায় হায় করে ওঠলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও চায়ের আড্ডায় তাদের জাসদ প্রেম উথলে ওঠলো। তারা আফসোস করতে লাগলো, জাসদ শেষ; জাসদ মার্কসবাদ থেকে এক দৌড়ে চলে গেছে লালনবাদে; জ্ঞানের ভাব দেখিয়ে একে কেউ কেউ বলেছে বস্তুবাদ ছেড়ে জাসদের ভাববাদি যাত্রা শুরু। বলা বাহুল্য, এসব লোক না বোঝে মার্কস, না বোঝে লালন, না বোঝে জাসদ; এদের না আছে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি নিয়ে কোন বোঝাপড়া; সর্বোপরি না আছে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান। সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের বিষয়টিতে তাকানো যাক। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণভাবে সাহিত্য ও সঙ্গীতসমেত নন্দন-সংস্কৃতি চর্চা করেনা। তবে সরকারিভাবে রবীন্দ্র-নজরুলজয়ন্তি উদযাপন করা হয়ে থাকে এখনও। লালনের আখড়াতেও সরকারি আয়োজনে অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। দেশে একসময় ব্যাপকভাবে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত স্মরণে বিবিধ সংগঠন-প্রতিষ্ঠান অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করতো। বাঙালি সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কৃতি ব্যক্তিত্বদের স্মরণ করার মধ্যে কোন সমস্যা বা আপত্তি থাকা উচিত নয়। এক্ষেত্রে রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত মার্কসবাদি না লালনবাদি অথবা বস্তুবাদি না ভাববাদি সেটা বিবেচ্য নয়। প্রসঙ্গত মনে রাখা দরকার, দেশ-বিদেশের রাজনীতি-শিল্প-সাহিত্যের অনেক কৃতি ব্যক্তিত্বকে জাসদ বা জাসদের মতো দলগুলো স্মরণ করে, এবং এসব ব্যক্তিত্বের খুব অল্প সংখ্যকই মার্কসবাদ বা মার্কসিয় দর্শন দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ চর্চা করেন। সুতরাং জাসদের লালন-চর্চা একটি সাধারণ ব্যাপার— এটা নিয়ে যারা ব্যঙ্গোক্তি করছে তারা নিজেদের কাণ্ডজ্ঞানহীনতা প্রদর্শন করে হাসি ও করুণার পাত্র হচ্ছে। এবারে আসা যাক বাংলাদেশের চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে লালন দিবস পালনের বিষয়ে। বাংলাদেশে এখন একটি যুদ্ধ-পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এক পক্ষে আছে জাসদ ও আওয়ামী লীগসমেত মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো। অন্য পক্ষে আছে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা-ধর্ষণ-অগ্নিকাণ্ড-লুটপাটে নিয়োজিত অপশক্তি জামাত ও জামাতের প্রধান রাজনৈতিক-আদর্শিক মিত্র বিএনপি; আদর্শিকভাবে এদের সাথে আরো আছে হেফাজত-হিজবুতের মতো জঙ্গিরা। মধ্যপন্থার নামে যারা দূরে আছে, তারা ধিরে ধিরে তাদের স্বরূপ প্রকাশ করছে ও বিএনপি জোটের পক্ষের রাজনীতি চর্চা করছে। বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থি জঙ্গিরা সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনে বাধা দিয়েছে। এর আগে তারা বাধা দিয়েছে বাউল-ভাস্কর্য স্থাপনে। ভাস্কর্য স্থাপনে বাধা দিয়ে তারা কেবল সৃজনশীল শিল্পকর্মের বিরোধিতা করেনি, তারা জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-জীবনবোধ-জাতীয়তাবাদকে পরাভূত করতে চেয়েছে। জাসদ একদম শুরু থেকে এ বিষয়ে আওয়ামী দোদুল্যমানতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এদেরকে শক্তভাবে মোকাবেলার প্রশাসনিক পদক্ষেপ দাবি করেছে এবং সভা-সমাবেশ-বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে এদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান বজায় রেখেছে। মনে রাখতে হবে, জাসদের অপরিমেয় পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে ২০০১ সাল পরবর্তীতে ১৪ দল গঠিত হয়েছে দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক বিপদ মোকাবেলা করতে। দক্ষিণপন্থার বিপদ মোকাবেলার বিষয়টিকে জাসদ কেবল রাজনৈতিকভাবে দেখছে না; দেখছে আরো ব্যাপক বিস্তৃতিতে। জঙ্গি দক্ষিণপন্থার একটি সাংস্কৃতিক পশ্চাদভূমি রয়েছে, আর তা হচ্ছে সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা। সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার ভূমিতে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের ভাষা-পোশাক-চালচলন-জীবনযাপন, তার আশ্রয়ে রোপিত হচ্ছে ধর্মান্ধতা ও ধমী‍র্য় অসহিষ্ণুতার বীজ, আর তাই জন্ম দিচ্ছে রাজনৈতিক ইসলাম ও জঙ্গিবাদ। জাসদ সেজন্য সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক সংগ্রামের উপর জোরারোপ করছে বেশ কয়েক বছর ধরে। জাসদের জাতীয় ও কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকগুলো সভার সিদ্ধান্তে তা প্রতিপলিত। দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক সংগ্রামের অংশ হিসেবে জাসদ বাঙালির স্মরণীয় বরণীয় ব্যক্তিত্ব ও তাঁদের শিক্ষা প্রচারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। তার অংশ হিসেবে লালন দিবস পালন অযৌক্তিক কিছু নয়। ব্যাপক বিস্তৃত সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার আগ্রাসন জাসদের মিত্র আওয়ামী লীগকেও গিলে ফেলছে প্রায়। জামাতের সাথে মিলেমিশে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও যখন গ্রামে গ্রামে বাউলদের আখড়া ভেঙে দেয়, তাঁদের উপর হামলা করে, তাঁদের চুল-দাঁড়ি-গোঁফ কেটে দেয়, মসজিদে জোর করে ধরে নিয়ে গান না গাইতে তওবা করায়— জাসদ তখন প্রতিবাদ জানায়। জাসদ প্রতিবাদ জানায় বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে, রাজপথে মিছিল করে, সংসদে আলোচনা করে ও প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করে। শরিয়ত বাউল ও রীতা বাউল পুলিশী হয়রানির শিকার হলে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপির কাছে প্রশ্নোত্তর পর্বে জবাবদিহিতা চান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বাউলদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন; যদিও ধর্মানুভূতিতে আঘাত বিষয়ে তার বক্তব্য ছিল অস্বচ্ছ ও অগ্রহণযোগ্য— তার বক্তব্য থেকে মনে হয়নি একজন প্রধানমন্ত্রী কথা বলছেন; মনে হচ্ছিল কথা বলছিলেন সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতায় আক্রান্ত একজন সাধারণ মুসলিম নাগরিক; তার বক্তব্যে বাউলদের সম্পর্কে চরম অজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছে। আজও জামাত ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি যখন গ্রামে-গঞ্জে বাউলদের গান গাইতে বাধা দেয়, জাসদ নেতাকর্মীগণ তখন সশরীরে উপস্থিত থেকে বাউলদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। সুতরাং জাসদ এক দৌড়ে লালন বা বাউলদের কাছে চলে গেছে তা বলা যাবে না। জাসদ ঐতিহাসিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের বাউল ও লালন অনুসারিদের সাথে আছে। এখন আসা যাক মার্কস ও লালন প্রসঙ্গে। মার্কসের জন্ম ১৮১৮ সালে, মৃত্যু ১৮৮৩ সালে। লালনের জন্ম ১৭৭৪ সালে, মৃত্যু ১৮৯০ সালে। ১৮১৮ সালে মার্কসের জন্মের আগে এবং ১৭৯৮ সালে লালনের গুরু সিরাজ সাঁইয়ের মৃত্যুর আগে লালন খেরকা পান। খেরকা পাওয়ার ঘটনাটি হলো একটি রাইটস অব প্যাসেজ বা উত্তরণের আচার— যখন থেকে বাউলগণ জাগতিক সকল চাওয়া-পাওয়ার উর্ধে উঠে মৃতপ্রায় জীবনযাপন করেন এবং কেবল ভিক্ষা করে জীবন পরিচালনা করেন। বাউল হিসেবে পরিপূর্ণ তাত্ত্বিক জ্ঞান অর্জন ও গোপন জীবনাচারের মাধ্যমে নিজেকে ব্যবহারিক জীবনে যোগ্য প্রমাণ করতে পারলেই কেবল একজন বাউল খেরকা পান। এসব তথ্যের মাধ্যমে এখানে বলার চেষ্টা হচ্ছে যে মার্কসেরও আগে লালন সাম্যের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, অনুশীলন বা প্রাক্সিসকে গুরুদ্ব দেন। উপরন্তু এখানে মনে রাখতেই হবে যে, সারা দুনিয়ার অ্যাকাডেমিক বা বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলে মার্কসবাদের প্রধান সমালোচনা যেখানে অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণবাদ বা কেবলমাত্র অর্থনীতিকে শ্রেণি ধারণা ও রাজনীতির প্রধানতম নিয়ামক ভাবা নিয়ে, সেখানে লালন ভেদ-বিভেদ-অসমতা-বৈষম্য-সহিংসতার অর্থনৈতিক ও অ-অর্থনৈতিক উভয় মাত্রার উপর জোর দিয়েছেন। এখানে পশ্চাত্য ও প্রাচ্যের পার্থক্য স্পষ্ট। পাশ্চাত্য সমাজে অর্থনৈতিক শ্রেণি যতোটা গুরুত্ব পেয়েছে, প্রাচ্যের সমাজে অর্থনৈতিক ভেদ-বিভেদ-অসমতা-বৈষম্য-সহিংসতার পাশাপাশি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-গোষ্ঠিগত ভেদ-বিভেদ-অসমতা-বৈষম্য-সহিংসতাও গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। প্রাচ্যে শ্রেণি বিভক্ত সমাজের মার্কসিয় বিশ্লেষণের সাথে সাথে অবশ্যই লালনের বিশ্লেষণও মানতে ও ব্যবহার করতে হবে। অতীতে যা করা হয়নি, তা এখন করতে হবে। সবশেষে তথাকথিত জ্ঞানগর্ভ বিষয়টিতে আসা যাক— বস্তুবাদ ও ভাববাদ বিষয়ে। এটা দর্শনের সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন। বস্তু আগে, নাকি ভাব/চেতনা আগে— এ প্রশ্নের জবাব দিয়ে জগতের সকল দর্শনকে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়। যারা মনে করেন চেতনা/ভাব আগে, তারা ভাববাদি। আর যারা মনে করেন, বস্তুজগত থেকে চেতনা/ভাবজগতের উদ্ভব, তারা বস্তুবাদি। মার্কস হেগেলের দ্বন্দ্ববাদকে গ্রহণ করেছেন নিজের বস্তুবাদ দিয়ে পরিমার্জন করে— তিনি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তাত্ত্বিক জনক। লালন নিজেও বস্তুবাদি; তিনি কোনো ধরনের অতিপ্রাকৃতিকতায় বিশ্বাস করতেন না। একজন যুক্তিশীল মানুষ হিসেবে লালন তাঁর সমস্ত চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে রেখেছেন মানুষকে। মানুষের আরাধনা তাঁর কাছে প্রধান। ঈশ্বর বলতে তিনি কোন অতিপ্রাকৃতিক সত্তায় বিশ্বাস করেননি; মানুষ দেহের আকারের মধ্যে তিনি ঈশ্বর পেয়েছেন— ঈশ্বর অতিপ্রাকৃতিক বা স্বতন্ত্র কোনো সত্তা নয়। ঈশ্বরের মাধ্যমে নয়, বরং মানুষের মধ্যে ঈশ্বর জন্মেছেন। আর মানুষের জন্মকেও তিনি মাত্র একবারের জন্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ দেখতে পেয়েছেন— পুনর্জন্ম বা পুনরুত্থান তিনি নাকচ করেন। আত্মার প্রসঙ্গ টেনে এনেও কেউ কেউ লালনকে ভাববাদি বলতে পারেন। কিন্তু আত্মা লালনের কাছে কোন অতিপ্রাকৃত সত্তা নয়, বাইরের সত্তা নয়, দেহে আত্মার বাস। হ্যাঁ, লালন ঈশ্বর ধারণার ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তা পরম অর্থে, যে পরমের বসবাস মানুষের দেহে। তার মানে, মানুষই পরম। এসব বানানো কথা নয়, লালনের অনেক অনেক গানে এগুলো সহজ-সরল ও রূপক-সাংকেতিক উভয় ভাষায় বর্ণিত রয়েছে। লালন ভাববাদি না বস্তুবাদি সে বিষয়ে সংশয় বা বিভ্রান্তি বা অজ্ঞতা দূর করতে তাঁর অনেক প্রাসঙ্গিক গানের মধ্য থেকে একটির কয়েক লাইন ব্যবহার করা যায়: তুমি, আপনি আল্লাহ ডাকো আল্লাহ বলে, আল্লাহ কে বোঝে তোমার অপর লীলে। লালনের দর্শন চিন্তা নিয়ে আরো অনেক আলোচনার রয়েছে, কিন্তু তা বর্তমান রচনার শিরোনামের বিষয়গত পরিধির মধ্যে না আনাই ভালো। লালন হচ্ছেন বাঙালি জাতির মহত্তম সৃজনশীল প্রতিভা ও প্রধানতম দার্শনিক। বাঙালির সংস্কৃতি, জীবনবোধ ও জাতীয়তাবোধ গঠন ও পরিশীলনে তাঁর অবদান সর্বাধিক। কিন্তু এভাবে তাঁর অবদান কখনো আলোচিত হয়নি। সেসব পরে আলোচনা করা যাবে। তবে আপাতত এখানে দুটো বিষয় বলে রাখা জরুরি। প্রথমত, সংখ্যালঘু শহুরে ও তথাকথিত শিক্ষিত নাগরিক সমাজের বাইরে তিনি অবস্থান করতেন। এ নাগরিক মানস মনে করে যে তারা বেশি জানে ও বোঝে। লালন গ্রামের লোক, আর গ্রামে থেকেও এবং তিরোধানের পরেও, তিনি বৃহত্তর জনগোষ্ঠির মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়— এভাবে তারা লালনকে মূল্যায়ন করে ও সার্টিফিকেট দিতে চায়। লালনকে বোঝার বৌদ্ধিক সক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু লালন নিজের পরিচয়েরই যখন কোন তোয়াক্কা করেন না, সেখানে এদের সার্টিফিকেটে তাঁর কী আসে যায়! দ্বিতীয়ত, বাংলার বাউলদের ও লালনকে নিয়ে যারা কাজ করেছে, তারা প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাঁকে মূল্যায়নের ও তাঁর পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করেছে। বাউলদের ও লালনকে নিয়ে প্রকাশিত প্রায় সকল প্রচলিত বইই ভুল। এটাও বানানো কথা নয়। বাংলার বাউলদের মধ্যে প্রাজ্ঞজনগণ একমাত্র শক্তিনাথ ঝা রচিত বইগুলোকে গুরুত্ব দেন; অন্য সমস্ত রচনাকে তারা নাকচ করেন ভুল হিসেবে। বাউলগণ নিজেরা যেভাবে নিজেদের বোঝেন, সেটাই তো তাঁদের পরিচয়; অন্যরা কিভাবে তাঁদের পরিচয় নির্মাণ করলো তা তো বিবেচ্যই হতে পারে না। উপরের দুটো বক্তব্যের সাথে প্রাসঙ্গিক একটি বক্তব্য দিয়ে এ রচনা শেষ করা যায়। রাজনৈতিক ইসলামের ও জঙ্গিবাদের অনুসারীরা বাউলদের ও লালনকে ভালো বুঝতে পারে। এজন্যই তারা বাম-সমাজতন্ত্রি-কমিউনিস্ট ও এমনকি নাস্তিকদের চেয়েও বেশি ঘৃণা করে বাউলদের, লালনকে। এখান থেকেও যারা বোঝেনা বাউলগণ বা লালন আসলে কে, বাঙালি ও বাঙালি প্রগতিশীলদের কেন উচিত তাদের স্মরণ ও বরণ করার, তারা মূলত উপরে বর্ণিত ওই দুই শ্রেণির একটির প্রতিনিত্বি করেন। এদের জন্যই লালন বলেন: এসব দেখি কানার হাটবাজার। * জিয়াউল হক মুক্তা: জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। জাসদের মুখপত্র লড়াই-এর সম্পাদক।

  • দুর্গাপূজা : মাতৃরূপা ব্রহ্মেরই উপাসনা

    দুর্গাপূজা : মাতৃরূপা ব্রহ্মেরই উপাসনা

    কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

    ব্রহ্ম এবং তাঁর শক্তি অভেদ্য। চিন্তার অতীত ব্রহ্মই যখন ক্রিয়াশীল হয়ে সৃষ্টি, পালন এবং লয়ে অংশগ্রহণ করেন তখন তাকেই আমরা শক্তি বা আদ্যাশক্তি বলি। জগতের সবকিছুর মূলেই এই ব্রহ্মরূপা আদ্যাশক্তি। তিনিই সৃষ্টি করেন, তিনিই পালন করেন আবার তিনিই লয় বা ধ্বংস করেন। অনন্ত তাঁর রূপ, অনন্ত তাঁর প্রকাশ এবং অনন্ত তাঁর বৈভব।

    শ্রীচণ্ডীর শুরুতেই শ্রীশ্রীচণ্ডীকার ধ্যানমন্ত্রে (ধ্যান : ৩) সেই আদ্যাশক্তি মহামায়াকে “নবকোটীমূর্তিসহিতা” বলা হয়েছে। এই বাক্যের দুই ধরনের অর্থ। নবকোটীমূর্তি বলতে প্রথমত নিত্যনতুন মূর্তিতে দেবী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রকাশিতা এবং দ্বিতীয় আক্ষরিক অর্থে নবকোটীমূর্তি পরিবৃতা অর্থেও প্রযুক্ত হয়।

    “যা চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী যা মাহিষোন্মূলিনী

    যা ধূম্রেক্ষণচণ্ডমুণ্ডমথনী যা রক্তবীজাশনী।

    শক্তিঃ শুম্ভনিশুম্ভদৈত্যদলনী যা সিদ্ধিদাত্রী পরা

    সা দেবী নবকোটীমূর্তিসহিতা মাং পাতু বিশ্বেশ্বরী।।”

    আদ্যাশক্তি মহামায়া যখন সৃষ্টি করেন, তখন তিনি সত্ত্বগুণ সম্ভূতা ব্রহ্মাণী বা মহাসরস্বতী বলে অভিহিত হন; যখন পালন করেন তখন রজোগুণ সম্ভূতা বৈষ্ণবী বা মহালক্ষ্মী বলা হয় তাঁকে এবং লয় বা ধংসের স্বরূপে মাহেশ্বরী বা মহাকালী বলে অভিহিত হন দেবী।

    “যে চণ্ডিকা মধুকৈটভাদি-দৈত্যনাশিনী, যিনি মহিষাসুরমর্দিনী, যিনি ধূম্রলোচন-চণ্ড-মুণ্ড-সংহারিণী, যিনি রক্তবীজ-ভক্ষয়ত্রী, যে মহাশক্তি শুম্ভ-নিশুম্ভ-অসুর-বিনাশিনী ও শ্রেষ্ঠা সিদ্ধিদাত্রী এবং নিত্যনতুন মূর্তিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রকাশিতা, সেই জগদীশ্বরী দেবী আমাকে পালন করুন।”

    আরও পড়ুন : শারদীয় দুর্গোৎসব : সম্প্রীতির উৎসব

    ব্রহ্ম এবং তাঁর ক্রিয়াশীল শক্তির মাঝে অভেদ-তত্ত্ব বোঝাতে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস অসাধারণ কয়েকটি কথা বলেছেন। কথাগুলো শ্রী মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত বা শ্রীম লিখিত ‘শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ গ্রন্থে বিধৃত হয়েছে—

    ”ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ, এককে মানলেই আর-একটিকে মানতে হয়। যেমন অগ্নি আর তার দাহিকাশক্তি; … অগ্নি মানলেই দাহিকাশক্তি মানতে হয়, দাহিকাশক্তি ছাড়া অগ্নি ভাবা যায় না; আবার অগ্নিকে বাদ দিয়ে দাহিকাশক্তি ভাবা যায় না। সূর্যকে বাদ দিয়ে সূর্যের রশ্মি ভাবা যায় না।”

    “আদ্যাশক্তি লীলাময়ী; সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম কালী। কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী! একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয়—সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কোনো কাজ করছেন না—এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এই সব কার্য করেন, তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি নাম-রূপভেদ।”

    শারদীয়া দুর্গাপূজা আশ্বিনের শুক্লপক্ষে হয়। আবার কার্তিক মাসেও দেবীর পূজা হয়, যা কাত্যায়নী পূজা নামে খ্যাত। বর্তমানে আমরা বাঙালিরা যে পদ্ধতিতে দুর্গাপূজা করি এই পূজা প্রচলন করেন রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংশনারায়ণ...

    সামবেদীয় কেনোপনিষদের উমা হৈমবতী আখ্যানে ব্রহ্ম এবং তৎশক্তি অভেদ, এই শাক্ত সিদ্ধান্ত অত্যন্ত সুন্দরভাবে গল্পের মাধ্যমে বর্ণনা করা আছে। আদ্যাশক্তি মহামায়া যখন সৃষ্টি করেন, তখন তিনি সত্ত্বগুণ সম্ভূতা ব্রহ্মাণী বা মহাসরস্বতী বলে অভিহিত হন; যখন পালন করেন তখন রজোগুণ সম্ভূতা বৈষ্ণবী বা মহালক্ষ্মী বলা হয় তাঁকে এবং লয় বা ধংসের স্বরূপে মাহেশ্বরী বা মহাকালী বলে অভিহিত হন দেবী।

    “মহালক্ষ্মীর্ম্মহাকালী তথা মহাসরস্বতী।

    ঈশ্বরী সর্বভূতানাং সর্বকারণকারণম্‌।।

    সর্বকামার্থদা শান্তা সুখসেব্যা দয়ান্বিতা।

    নামোচ্চারণমাত্রেণ বাঞ্ছিতার্থফলপ্রদা।।”

    (দেবীভাগবত পুরাণ : ৩.৯. ৩৯-৪০)

    “অখিল ভূতগণের ঈশ্বরী, সমুদয় কারণের কারণ সেই মহামায়াই মহালক্ষ্মী, মহাকালী ও মহাসরস্বতী। সেই পরম দয়াবতী শান্তময়ী দেবীকে সেবা করাও ক্লেশকর নহে এবং তাঁর আরাধনায় সর্বফল লাভ হয়। অধিক কি তাঁর নাম উচ্চারণ মাত্রেই বাঞ্ছিত ফল লাভ হয়।”

    আরও পড়ুন : এই দুঃখ কোথায় রাখি?

    শ্রীচণ্ডীতে তিনটি চরিত্রে আদ্যাশক্তি মহামায়ার তিনটি প্রধান রূপেরই বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম চরিত্রে (প্রথম অধ্যায়) দেবী মহাকালিকা রূপে মধুকৈটভকে বধ করেছেন। দ্বিতীয় চরিত্রে (দ্বিতীয়-চতুর্থ অধ্যায়) দেবী মহালক্ষ্মী রূপে মহিষাসুর বধ করেছেন এবং তৃতীয় বা উত্তর চরিত্রে (পঞ্চম-ত্রয়োদশ) দেবী মহাসরস্বতী রূপে শুম্ভনিশুম্ভকে বধ করেছেন।

    শ্রীচণ্ডীতে আমরা দেখি যিনি কালী, তিনিই লক্ষ্মী এবং তিনিই সরস্বতী। কিন্তু আমরা প্রচলিত বাঙালি বিশ্বাসে দেখি দেবী দুর্গার দুই মেয়ে লক্ষ্মী এবং সরস্বতী; কিন্তু শ্রীচণ্ডী অনুসারে তাঁরা সকলেই এক আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গা। শুধুমাত্র প্রকাশ বিভিন্ন। শ্রীচণ্ডীর দেবীকবচে নবদুর্গা নামে দেবীর নয় প্রকার রূপের কথা ব্যক্ত হয়েছে।

    “প্রথমং শৈলপুত্রীতি দ্বিতীয়ং ব্রহ্মচারিণী।

    তৃতীয়ং চন্দ্রঘণ্টেতি কুষ্মাণ্ডেতি চতুর্থকম্।।

    পঞ্চমং স্কন্দমাতেতি ষষ্ঠং কাত্যায়নী তথা।

    সপ্তমং কালরাত্রীতি মহাগৌরীতি চাষ্টমম্।।

    নবমং সিদ্ধিদাত্রী চ নবদূর্গাঃ প্রকীর্তিতাঃ।

    উক্তান্যেতানি নামানি ব্রহ্মণৈব মহাত্মনা।।”

    (দেবীকবচ : ৩-৫)

    “প্রথম শৈলপুত্রী, দ্বিতীয় ব্রহ্মচারিণী, তৃতীয় চন্দ্ৰঘণ্টা, চতুর্থ কুষ্মাণ্ডা, পঞ্চম স্কন্দমাতা, ষষ্ঠ কাত্যায়নী, সপ্তম কালরাত্রি, অষ্টম মহাগৌরী এবং নবম মোক্ষপ্রদাত্রী সিদ্ধিদাত্রী; দেবীর এই নবরূপই নবদুর্গা নামে প্রকীর্তিতা। এই সকল নাম ব্রহ্মের দ্বারাই উক্ত হয়েছে।”

    আরও পড়ুন : ধর্ম যার যার থাকুক, উৎসব হোক সবার

    সেই আদ্যাশক্তি মহামায়া দুর্গাই কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী ইত্যাদি বিবিধ নামে প্রকাশিতা। বৈদিককাল থেকেই তাঁর পূজা প্রচলিত। আশ্বলায়ন শাখার ঋগ্বেদ সংহিতার দশম মণ্ডলের রাত্রিসূক্তে রাত্রিরূপা আদ্যাশক্তি ভগবতী দুর্গাকে ক্ষীরসহ পঞ্চগব্যাদি দিয়ে দেবীর শ্রীবিগ্রহকে অভিষিক্ত করে চন্দনাদি দ্বারা অনুলিপ্ত করে “নমো দুর্গে নমো নমঃ” মন্ত্রে দেবীর গলায় বিল্বপত্রের মালা প্রদান করে পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের নির্দেশনাও রয়েছে।

    “ক্ষীরেণ স্নাপিতা দুর্গা চন্দনেনানুলেপিতা।

    বৈল্বপত্রকৃতামালা নমো দুর্গে নমো নমঃ।।”

    (আশ্বলায়ন শাখার ঋগ্বেদ সংহিতা : ১০.১২৮.৮)

    দুর্গাপূজা এই বঙ্গে প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। বঙ্গের বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রকারদের বিধানেও আমরা দুর্গোৎসবের সরব উপস্থিতি পাই...

    পুষ্পপত্র, চন্দনাদি অনুলেপন এবং দেবীর শ্রীবিগ্রহের অভিষেকসহ বিবিধ উপাচারে দেবীর পূজাও পদ্ধতিও বৈদিক। অর্থাৎ অনেকেই বলেন, বৈদিকযুগে প্রতিমাপূজা ছিল না, প্রতিমা পূজা পদ্ধতি অবৈদিক, তাদের কথাগুলো সত্য নয়। তারা অনেকটা বেদ সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে না জেনেই ব্যক্তিগত বা জনপ্রিয় প্রচলিত ধারণার বশবর্তী হয়ে বলেন।

    একই সত্ত্বার শুধুমাত্র প্রকাশ বিভিন্ন হওয়ার কারণে এই দৃশ্যমান বিভিন্ন স্বরূপ দেখে মায়ার প্রভাবে বিভ্রান্ত হয়ে যাই আমরা প্রতিনিয়ত। উপাস্য রুচির বৈচিত্র্যের জন্যে একই ব্রহ্মের আলাদা আলাদা রূপের প্রকাশ। আমরা এক পরমেশ্বর ছাড়া দ্বিতীয় কারো উপাসনা করি না। বেদে বিভিন্ন মন্ত্রে অত্যন্ত সুন্দর এবং স্পষ্ট করে বিষয়টা বলা আছে।

    “ইন্দ্রং মিত্রং বরুণমগ্নি-মাহু রথো

    দিব্যঃ স সুপর্ণো গরুত্মান্।

    একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি

    অগ্নি যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ।।”

    (ঋগ্বেদ সংহিতা : ১.১৬৪.৪৬)

    আরও পড়ুন : মিলেছি প্রাণের উৎসবে

    “সেই সদ্বস্তু অর্থাৎ পরব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু জ্ঞানীগণ তাঁকেই ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, দিব্য (সূর্য), সুপর্ণ, গরুড়, যম, বায়ু ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন।”

    “ন দ্বিতীয়ো ন তৃতীয়শ্চতুর্থো নাপুচ্যতে।

    ন পঞ্চমো ন ষষ্ঠঃ সপ্তমো নাপুচ্যতে।

    নাষ্টমো ন নবমো দশমো নাপুচ্যতে।

    য এতং দেবমেক বৃতং বেদ।।”

    (অথর্ববেদ সংহিতা : ১৩.৪.২)

    “পরমাত্মা এক, তিনি ছাড়া কেহই দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম বা দশম ঈশ্বর বলে অভিহিত হয় না। যিনি তাঁহাকে শুধু এক বলে জানেন একমাত্র তিনিই তাঁকে প্রাপ্ত হন।”

    আরও পড়ুন : রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!

    বৈদিক একত্ববাদের মতো শ্রীচণ্ডীতেও অসংখ্য স্থানে দেবীর অদ্বৈতবাদী একত্ব বর্ণিত আছে। উত্তর চরিত্রে দেবী ব্রহ্মাণী, বৈষ্ণবী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, ঐন্দ্রী, নারসিংহী, বারাহী এবং চামুণ্ডা এই অষ্টমাতৃকা শক্তিকে সাথে নিয়ে শুম্ভনিশুম্ভের সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

    যুদ্ধে দেবীর হাতে শুম্ভের প্রাণতুল্য ভাই নিশুম্ভ বধ হয়। শুম্ভ ভাইকে নিহত হতে দেখে এবং সকল সৈন্যবল বিনষ্ট হতে দেখে, উত্তেজিত হয়ে দেবীকে বলেন, “হে উদ্ধতা দুর্গা, তুমি গর্ব করিও না তুমি অন্যান্য বিভিন্ন দেবীকে সাথে নিয়ে আমাদের সাথে যুক্ত করছো, তাই গর্বিত হওয়ার কিছুই নেই।” শুম্ভের ক্রোধভরা উক্তি শুনে দেবী তখন বলেন—

    “একৈবাহং জগতত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।

    পশ্যৈতা দুষ্ট ময্যেব বিশন্ত্যো মদ্বিভূতয়ঃ।।”

    (শ্রীচণ্ডী : ১০.০৫)

    “আমিই একমাত্র জগতে বিরাজিতা। আমার অতিরিক্ত অন্য দ্বিতীয়া আর কে আছে জগতে? ওরে দুষ্ট, ব্রহ্মাণী এই সকল দেবী আমারই অভিন্না বিভূতি। এই দেখ ওরা আমাতেই মিলে বিলীনা হয়ে যাচ্ছে।”

    অর্থাৎ দেবী এক থেকে বহু হয়েছিলেন, আবার বহু থেকে আবার এক অদ্বৈত হয়ে গেলেন।

    “একই শক্তির শুধু বিভিন্নরূপের প্রকাশ চারিদিকে

    নিরাকারকে সাকারে বাধার ভক্তচেষ্টা।

    সরস্বতী-লক্ষ্মী-কালী এ ত্রিধা মূর্তি পরিব্যাপ্ত,

    সত্ত্ব-রজঃ-তমঃ গুণপ্রতিভূ হয়ে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে।

    অণুতে পরমাণুতে সর্বত্রই চলছে সেই

    চিন্ময় শক্তির নিয়ত প্রকাশের খেলা।

    সৃষ্টির আনন্দ, স্থিতির অভিভাবকত্ব;

    ধ্বংসের মুক্তির প্রশান্তি সর্বত্রই সেই কারণমময়ী।

    তিনি অনন্তরূপী,তাঁর কোনো প্রাকৃত মূর্তি নেই,

    সন্তানের শুদ্ধমানসলোকই তাঁর মূর্ত্তির উৎস।”

    বাঙালিরা ষষ্ঠী থেকে বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মাধ্যমে পূজা শুরু করে বিজয়া দশমীতে দশমীবিহিত বিসর্জনাঙ্গ পূজা, সিঁদুর খেলা এবং পরিশেষে নৃত্যগীতাদির সাথে বিসর্জনের মাধ্যমে পাঁচদিনের বর্ণাঢ্য দুর্গোৎসব সমাপ্ত করেন...

    সমস্যা বাধে তখনই, যখন আমরা যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকেই যে যে মতাবলম্বী সবাইকে সেই সেই মতাবলম্বী বানাতে চাই। আমরা ভুলে যাই বেদান্তসূত্রের চতুর্থসূত্রকে। “তত্তু সমন্বয়াৎ (১.১.৪)।” এই সূত্রেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে বিভিন্ন মত-পথ নির্বিশেষে সকল মত-পথই ব্রহ্ম লাভ এবং উপলব্ধির এক একটি পন্থা। তিনিই জীবকে অজ্ঞানতার মায়ার ডোরে বদ্ধ করেন, আবার তিনিই সেই বন্ধন থেকে মুক্তি দেন।

    আরও পড়ুন : ফিরে আসুক সম্প্রীতি

    ঋগ্বেদ সংহিতায় দেবী বলেছেন, তিনি রাষ্ট্রী অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চালিকা শক্তি ঈশ্বরী। যে সব সাধক তার উপাসনা করে, সেই সব উপাসকদের তিনি মুক্তিরূপ নিঃশ্রেয়স ধন এবং জাগতিক আভ্যুদয়িক ধন প্রদান করেন। প্রত্যেকটি জীবের হৃদয়ের মাঝেই তিনি বিরাজিতা। তিনি যজ্ঞের অধিষ্ঠাত্রী, সব দেবতাগণের তিনি শক্তিস্বরূপা এবং অগ্রগণ্যা।

    বিবিধ রূপে প্রকাশিত হলেও তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। তিনিই জগৎ প্রপঞ্চরূপে অনন্তভাবে, অনন্তরূপে নিমিত্ত এবং উপাদান কারণ হয়ে বিরাজ করেন। তিনিই নিমিত্ত কারণ হয়ে জগতকে পরিচালনা করেন, আবার তিনিই উপাদান কারণ হয়ে এই জগতের জড় চেতন সকল কিছুতেই বিরাজ করেন।

    তিনিই জীবাত্মা হয়ে জীবের মধ্যে প্রবিষ্টা জীবের প্রাণকে সচল রাখেন। রূপ থেকে রূপান্তরে সর্বদেশে, সর্বকালেই তিনি পূজিতা। প্রাণীকুল থেকে দেবতা সকলেই বিবিধভাবে তাকে আরাধনা করে। তিনি যেহেতু অনন্য এবং অনন্ত; তাই তাঁর উপাসনা পদ্ধতিও অনন্ত।

    “অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসুনাং

    চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্।

    তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা

    ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যাবেশয়ন্তীম্।।”

    (ঋগ্বেদ সংহিতা : ১০.১২৫.৩)

    “আমি রাষ্ট্রী অর্থাৎ সমগ্র জগতের ঈশ্বরী। আমি উপাসকগণের ধন প্রদাত্রী। আমি পরব্রহ্মকে আত্মস্বরূপে অভিন্নরূপে প্রত্যক্ষ জেনেছি। আমি যজ্ঞিয় দেবতাগণের প্রধানা। জগৎ প্রপঞ্চরূপে আমি অনন্তভাবে অবস্থান করি এবং জীবাত্মা হয়ে জীবের মধ্যে প্রবিষ্টা। আমাকেই সর্বদেশে সুরনরাদি যজমানগণ বিবিধভাবে আরাধনা করে।”

    আরও পড়ুন : অর্থনীতি যখন উৎসবের অংশ

    ঈশ্বরকে মাতৃরূপে আরাধনা সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। শুধুমাত্র ভারতবর্ষেই নয় সারা পৃথিবীব্যাপী ছিল সৃষ্টিকর্তাকে মাতৃরূপে আরাধনার প্রভাব। প্রত্যেকটি জাতির জীবনেই দেখি ঈশ্বরীরূপা মহাদেবীর অবস্থান। যেমন, সেমিটিকদের মধ্যে ছিল দেবী ননা, অনৎ; আরবদের ছিল ঈশ্বরীস্বরূপা সর্বশক্তিমান অল্লৎ; ব্যাবিলন ও আসিরিয়াতে ইশতার; পারস্যে ছিলেন মহাদেবী অর্দ্বি; ফিনিশিয়দের হলেন মিলিত্তা; মিশরের অন্যতম প্রধান দেবী হলেন আইসিস; এথেন্সের হলেন এথিনি; গ্রিকদের হলেন আর্তিমিস; রোমানদের হলেন ডায়না। অর্থাৎ পৃথিবীতে প্রাচীন খুব কম জাতিই আছে যাদের জীবনে একজন শক্তি স্বরূপা মহাদেবী নেই।

    আমাদের প্রচলিত ধারণা মতে, বসন্তকালের দুর্গাপূজাই প্রকৃত পূজা। কিন্তু এই তথ্য গ্রহণযোগ্য নয়। শ্রীচণ্ডীতে জগন্মাতা দুর্গা নিজেই তাঁর বাৎসরিক পূজা শরৎকালে করতে বলেছেন। বাল্মীকিরচিত রামায়ণে কোথাও শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক দুর্গাপূজার কথা পাওয়া যায় না। অবশ্য বাল্মীকিরচিত রামায়ণের যুদ্ধকাণ্ডে বা লঙ্কাকাণ্ডে একটা শ্লোকে (৮৫.৩৪) ব্রহ্মার বিধান দ্বারা রঘুনন্দনের মহামায়া পূজার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে দুর্গাপূজা বিস্তৃতভাবে পাওয়া যায় কৃত্তিবাস ওঝার (আনু. ১৩৮১-১৪৬১) লেখা কৃত্তিবাসী বাংলা রামায়ণে।

    “শরৎকালে মহাপূজা ক্রিয়তে যা চ বার্ষিকী।

    তস্যাং মমৈতম্মাহাত্ম্যং শ্রুত্বা ভক্তিসমন্বিতঃ।।”

    (শ্রীশ্রীচণ্ডী : ১২.১২)

    “শরতকালে আমার যে বাৎসরিক মহাপূজা অনুষ্ঠিত হয় তাতে সবাই ভক্তি সহকারে আমার মাহাত্ম্য কথারূপ শ্রীচণ্ডী পাঠ করে শুনবে।”

    দুর্গাপূজার প্রচলন বা মাহাত্ম্য সম্পর্কে মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১-৯৩ অধ্যায় যা আমাদের কাছে শ্রীচণ্ডী নামে খ্যাত। এই শ্রীচণ্ডীর তেরটি অধ্যায়ের ৫৭৮টি শ্লোক এবং ৭০০টি মন্ত্রে দেবী মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পুরাকালে রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্ত্রী-সন্তানদের দ্বারা প্রতারিত সমাধি নামক এক বৈশ্য একদিন মেধা ঋষির আশ্রমে যান। সেখানে তাঁর নির্দেশে তাঁরা দেবীদুর্গার মৃন্ময়ী প্রতিমায় পূজা করেন এবং দেবীসূক্ত জপ করেন। পূজায় সন্তুষ্টা হয়ে দেবী তাঁদের মনস্কামনা পূর্ণ করেন। কৃত্তিবাসী রামায়ণ এবং কালিকা পুরাণ থেকে জানা যায়, শ্রীরামচন্দ্র রাবণবধের জন্য অকালে শরৎকালে যুদ্ধজয় করতে দেবীকে পূজা করেছিলেন। তখন থেকে এই পূজার নাম হয় অকালবোধন বা শারদীয়া দুর্গাপূজা। চৈত্রের শুক্লপক্ষেও দেবীর পূজা হয় যা বাসন্তী দুর্গাপূজা নামে খ্যাত।

    শারদীয়া দুর্গাপূজা আশ্বিনের শুক্লপক্ষে হয়। আবার কার্তিক মাসেও দেবীর পূজা হয়, যা কাত্যায়নী পূজা নামে খ্যাত। বর্তমানে আমরা বাঙালিরা যে পদ্ধতিতে দুর্গাপূজা করি এই পূজা প্রচলন করেন রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা কংশনারায়ণ, তিনি ছিলেন মনুসংহিতার টীকাকার কুল্লুক ভট্টের বংশধর।

    কংশনারায়ণকে পূজা পদ্ধতি প্রদান করেন রাজপুরোহিত রমেশ শাস্ত্রী। দুর্গাপূজা এই বঙ্গে প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। বঙ্গের বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রকারদের বিধানেও আমরা দুর্গোৎসবের সরব উপস্থিতি পাই। জীমূতবাহনের (আনু. ১০৫০-১১৫০) দুর্গোৎসব নির্ণয়, বিদ্যাপতির (১৩৭৪-১৪৬০) দুর্গাভক্তি তরঙ্গিণী, শূলপাণির (১৩৭৫-১৪৬০) দুর্গোৎসব বিবেক, বাচস্পতি মিশ্রের (১৪২৫-১৪৮০) ক্রিয়া চিন্তামণি, শ্রীচৈতন্যদেবের সমসাময়িক রঘুনন্দনের (১৫শ-১৬শ শতক) তিথিতত্ত্ব গ্রন্থেও দুর্গাপূজার বিধান পাওয়া যায়।

    রাজশাহীর তাহেরপুরের রাজা কংশনারায়ণের পরবর্তীতে, নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮৩) বিভিন্ন আড়ম্বর এবং চাকচিক্যের মাধ্যমে দুর্গাপূজাকে জনপ্রিয় করে তোলেন। একবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে এসে দুর্গাপূজা রাজা, মহারাজা এবং জমিদারদের হাত থেকে বেড়িয়ে সর্বজনীন এক মহোৎসবে পরিণত হয়ে যায়। এই মহোৎসবের পরিধি বাড়তে বাড়তে আজ সারাবিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে।

    আজ দুর্গোৎসব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সারা পৃথিবীর প্রত্যেকটি ছোট, বড় শহরে অনুষ্ঠিত হয়ে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বর্ণাঢ্য মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। শুক্ল পক্ষের অষ্টমী, নবমী এবং বিজয়া দশমী সারা পৃথিবীতেই দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। কেউ হয়তো ভাদ্র কৃষ্ণা নবমী থেকে পূজা শুরু করে, কেউ প্রতিপদ থেকে, কেউ বা পঞ্চমী থেকে।

    বাঙালিরা ষষ্ঠী থেকে বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মাধ্যমে পূজা শুরু করে বিজয়া দশমীতে দশমীবিহিত বিসর্জনাঙ্গ পূজা, সিঁদুর খেলা এবং পরিশেষে নৃত্যগীতাদির সাথে বিসর্জনের মাধ্যমে পাঁচদিনের বর্ণাঢ্য দুর্গোৎসব সমাপ্ত করেন।

    দেবী দুর্গা যে রাজা-প্রজা, ভালো-মন্দ, সৎ-অসৎ নির্বিশেষে সকলেরই মা এবং তিনি যে সর্বস্থানেই বিরাজ করেন এই সরল তত্ত্বীয় বিষয় বোঝাতেই দেবীর মহাস্নানে সমাজের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত রাজার দ্বারের মাটি যেমন লাগে; পক্ষান্তরে সমাজের সর্বোচ্চ অপাংক্তেয় বেশ্যার দ্বারের মাটিসহ আরও বহু স্থানের মাটি, জলের প্রয়োজন হয়। অবশ্য বেশ্যা শব্দটি গণিকা শব্দের বাইরে ভিন্ন অর্থও হয়। তন্ত্র মতে বেশ্যা শব্দের অর্থ, কৌল অভিসিক্তা নারী অর্থাৎ শাক্ত মতে, সাধন পথে অভিষিক্তা নারীকেও বোঝায়।

    দেবী দুর্গার সর্বজনীনতার এই বিষয়টি বুঝতে হলে এই ভূখণ্ডের মনন প্রয়োজন। চোখের দৃষ্টিপথে বৈদেশিক সংস্কৃতির চশমা পরিধান করে থাকলে, কখনো বিষয়টি উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।

    কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

  • হিজাব এবং অন্যান্য জরুরি বিষয়

    হিজাব এবং অন্যান্য জরুরি বিষয়

    তসলমিা নাসরনি

    ১. ঠকি করে হজিাব না পরার অপরাধে ২২ বছর বয়সী মাহসা আমনিীকে পুলশিরো পটিয়িে মরেে ফলোর অপরাধে দশেে বাধ্যতামূলক হজিাবরে বরিুদ্ধ,ে সরকাররে নারীবরিোধী আচরণরে বরিুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়ছে।ে সইে আন্দোলনরে ১১ দনি পার হয়ছে।ে ইরানরে পুলশি এ র্পযন্ত ইরানজুড়ে ঘটচেলা হজিাববরিোধী সইে আন্দোলনরে ৭৬ জনকে হত্যা করছে।ে ইন্টারনটে বন্ধ করে দয়িছে।ে তাতওে আন্দোলন বন্ধ করতে পারনে।ি তারপরও ময়েরো রাস্তায় বরেয়িে মাথা থকেে হজিাব খুলে শূন্যে উড়য়িছে,হিজাব ছুড়ে ফলেে দচ্ছি।ে হজিাব ছাড়া নারী, জীবন, মুক্তি লখো পোস্টার নয়িে রাস্তায় র্দুবনিীত হঁেটে গছে।ে যে কোনও সময় গুলি এসে ঝাঁজরা করে দবেে বুক জনেওে হঁেটছে।ে

    হানানে কয়িান ২৩ বছর বয়সী তরুণী, তারও বুক ঝাঁজরা হয়ে গছেে পুলশিরে গুলতি,ে তার অপরাধ সে হজিাব পরনে।ি ২১ বছর বয়সী তরুণী হাদসি নাজাফরি বুকে মুখে মাথায় ছটি গুলি করা হয়ছে।ে সে যখন তার র্দীঘ রশেমি চুলে হাতখােঁপা করে আন্দোলনে যোগ দতিে যাচ্ছলি, তখন। নারীর মুক্তরি জন্য কছিু বলার আগইে মৃত্যু হলো হাদসি নাজাফরি, উচ্ছল উজ্জ্বল প্রাণবন্ত তরুণীর। এরকম আরও অনকে কুড়-িএকুশ-বাইশ বছররে ইরানি তরুণীকে হত্যা করছে সরকার। প্রগতশিীলতার আর প্রতভিার কী যে অপচয়!
    ইরানরে র্ধমান্ধ সরকার দশেরে সৎ সাহসী সচতেন তরুণ প্রজন্মকে নঃিশষে করে দতিে চাইছ।ে না, র্ধমান্ধ মৌলবাদী সরকারকে না হটয়িে নারীর মুক্তি সম্ভব নয়।

    ইরানি ময়েরো লাঠরি মাথায় গত কয়কে বছর যাবৎ তাদরে সাদা র্স্কাফ উড়য়িে দয়িে হজিাবরে বরিুদ্ধে প্রতবিাদ করছে।ে এবার তারা তাদরে র্দীঘ চুল লাঠরি মাথায় বঁেধে উড়য়িছে।ে এটইি আজ ইরানরে জাতীয় পতাকা।

    বারো শ আন্দোলনকারীকে গ্রফেতার করছেে পুলশি। এর মধ্যে প্রচুর সাংবাদকিও আছনে। ১৭ সপ্টেম্বের মাহসা আমনিীর জানাজার পর ইরানরে আশটিি শহরে ছড়য়িে পড়ছেে সরকারবরিোধী বক্ষিোভ। এমনকি বশ্বিবদ্যিালয়রে ছাত্র-শক্ষিক এক হয়ে বক্ষিোভে নমেছেনে। বশ্বিরে গণতান্ত্রকি রাষ্ট্রগুলো ইরানরে সরকারকে ভায়োলন্সে বন্ধ করতে বলছ।ে কন্তিু বললে কি আর কাজ দয়ে? সুন্নি মৌলবাদ যমেন ক্ষমতায় থাকার জন্য সাধারণ জনগণরে বরিুদ্ধে ভায়োলন্সে করে শয়িা মৌলবাদও ঠকি একই কাজ কর।ে র্ধমকে প্রতষ্ঠিতি করত,ে মানুষরে বাক স্বাধীনতা ছনিয়িে নতি,ে মানবাধকিারকে বদিয়ে করত,ে নারীর অধকিাররে র্সবনাশ করতে র্ধমান্ধ অপশক্তি চরিকালই ভায়োলন্সেরে আশ্রয় নয়িছে।ে কন্তিু এই একবংিশ শতাব্দতিে ভায়োলন্সেরে ব্যবহার কোনও সভ্য দশেই মনেে নবেে না। সমালোচনা করবইে। এবং এই একবংিশ শতাব্দতিে পৃথবিীর উন্নত এবং সভ্য গণতান্ত্রকি দশেগুলোর সঙ্গে শত্রুতা করে একা একা বাঁচাও সম্ভব নয়। এ মুর্হূতে ইরানরে মৌলবাদী সরকারকে হটয়িে গণতন্ত্রে এবং নারীর অধকিারে বশ্বিাসী সরকাররে ক্ষমতায় আসা অত্যন্ত জরুর।ি মৌলবাদরে কবল থকেে ইরান এবং ইরানরে জনগণকে মুক্তি দতিে হলে এ ছাড়া আর কোনও পথ নইে।

    ২. কত কছিুর দবিস যে পালতি হচ্ছ।ে শুনলাম কাল নাকি ‘কন্যা দবিস’ ছলি। জানি না পুত্র দবিস বলে কোনও দবিস আছে কি না। আসলে পুত্র দবিস তো প্রায় প্রতদিনিই পালতি হয়। কন্যা যহেতেু অনকে সংসারইে অবহলেতি, তাই কন্যাকে মূল্য দওেয়ার জন্য, আমার ধারণা, একটি দবিস তরৈি করা হয়ছে।ে আমার কন্যাও নইে, পুত্রও নইে। যৌবনে অনকে ভুল সদ্ধিান্ত নলিওে সন্তান না জন্ম দওেয়ার সদ্ধিান্তটি আমার সঠকি ছলি। ৭৮০ কোটি লোকে পৃথবিী উপচে পড়ছ,ে এই দুঃসময়ে আমি মনে করি জনসংখ্যা বাড়ানোর কোনও প্রয়োজন নইে। যারা জন্মছেে তারা কি সবাই খতেে পরতে পাচ্ছ,ে শক্ষিা স্বাস্থ্য পাচ্ছ?ে

    ইতর প্রাণীর মধ্যে বংশ বস্তিাররে ইচ্ছটো কলিবলি কর,ে এই কলিবলি ব্যাপারটি নয়িন্ত্রণ করতে তারা পারে না। মানুষরে মধ্যওে এই ইচ্ছটেি আছ,ে তবে এটি আরোপতি। আরোপতি বলইে এটি নয়িন্ত্রণ সম্ভব। অনকেে সন্তান জন্ম দওেয়ার ইচ্ছে নইে বলে সন্তান জন্ম দয়ে না। কছিু মানুষ, আমার অবাক লাগ,ে মনে করে সন্তান জন্ম না দলিে তাদরে জীবনই র্ব্যথ, র্অথহীন। তারা সন্তানরে জন্য ইতর প্রাণীদরে মতো কলিবলি করা ইচ্ছরে আমদানি কর।ে আমার এক বোন উচ্চশক্ষিতিা, নামি কলজেরে অধ্যাপকিা, কন্তিু সন্তান নইে বলে এমনই দুঃখ-েকষ্টে ডুবে থাকে যে তার জীবনটইি সে উপভোগ করে না। তার এমন র্অথর্পূণ জীবনটকিে সে যে র্অথহীন মনে করছ,ে এ দোষ কার বা কাদরে? তার কানরে কাছে যারা শশৈব থকেে গুনগুন করছেে সন্তান না জন্মালে জীবনরে কোনও মানে নইে, দোষ নশ্চিয়ই তাদরে অনকেটা, বাকি দোষ তাদরেও যারা যুক্তি বুদ্ধি দয়িে নারীবদ্বিষেী রীতগিুলোকে ভাঙার কোনও চষ্টো করে না।

    প্রজাতকিে বাঁচয়িে রাখার জন্য যদি প্রজননরে প্রয়োজন পড়তো, কথা ছলি। এখন তো দখো যাচ্ছে মানুষরে আধক্যি একটা ভয়াবহ পরস্থিতিি তরৈি করছে।ে লক্ষ কোটি অরণ্য-নর্ভির প্রাণীর আবাসস্থল উড়য়িে দয়িে মানুষরে জন্য শহর নগর বানাতে হয়ছে।ে পৃথবিীর কত প্রজাতি যে আমাদরে মানুষ-প্রজাতরি হংিস্রতা আর বোধবুদ্ধহিীনতার কারণে বলিুপ্ত হয়ে গছে।ে এই গ্রহে আমাদরে যতটা অধকিার, ততটা অধকিার তো তাদরেও। অস্ত্ররে জোরে কী অরাজকতাই না আমরা চালয়িছে!ি আমরা পৃথবিীর বন জঙ্গল ধ্বংস করছে,ি নদী সমুদ্র আকাশ বাতাস দূষতি করছেি আমাদরে র্স্বাথান্ধ জীবন যাপন এবং আমাদরে র্অথহীন জনসংখ্যা দয়ি।ে অনকেে মনে করনে, জ্ঞানীগুণীদরে সন্তান জন্ম দওেয়া উচতি। কন্তিু বারবার প্রমাণতি হয়ছে,ে জ্ঞানীগুণীদরে সন্তান জ্ঞানীগুণী হয় না। আর কত প্রমাণ দরকার! মৃত্যুতইে জীবনরে চরিকালীন সমাপ্ত।ি বংশ রয়ে গয়ি,ে রক্তরে ছটিফোেঁটা রয়ে গয়িে কারও কোনও লাভ হয় না।

    আজ এতকাল পরও নজিকেে আরকেবার ধন্যবাদ দইি, না পুত্র না কন্যা কছিুই জন্ম না দয়িে আমি একটি স্বাধীন এবং র্অথর্পূণ জীবনযাপন করছেি বল।ে তুমি সন্তান জন্ম দয়িে জীবনকে র্অথর্পূণ করার চষ্টো কোরো না। তুমি তোমার কাজ দয়িে জীবনকে র্অথর্পূণ করো। তুমি ক,ে তুমি কী সটোই বড়। সন্তান যে কউে জন্ম দতিে পার,ে যে কোনও গ র্মূখই; এ কোনও উল্লখেযোগ্য ব্যাপার নয়।

    ৩. বদ্যিাসাগররে জন্মর্বাষকিীতে ভাবছ-ি

    বদ্যিাসাগররে মতো হন্দিু র্ধমরে আরও কোনও সংস্কারক গত দুশো বছরে জন্মছেনে ক?ি কারও কথা তো জানি না। বধিবারা তো এখনও হবষ্যিি খান। একবোরে হবষ্যিি না হলওে মাছ মাংস বাদ দয়িে খান। শাড়ওি পরনে সাদা। একবোরে সাদা না পরলওে লাল রং এড়য়িে চলনে। কপালে লাল টপিও পরনে না। এরকম আমি শক্ষিতি বাড়তিইে দখেছে।ি বধিবার বয়ি?ে হাজারে ক’টা হয় কে জান!ে

    ময়েদেরে শক্ষিাটা বশেরি ভাগ ক্ষত্রেইে মডি ডে মলি জুটবে বল,ে বা বয়িরে পাত্র জুটবে বল।ে ময়েরো পড়াশুনো করে বড় হব,ে নজিরে পায়ে দাঁড়াব,ে স্বনর্ভির হব,ে নজিরে জীবন নজিইে পরচিালনা করব-ে এমন মহৎ উদ্দশেে নয়।

    র্ধমীয় কুসংস্কারে বদ্যিাসাগররে সময়ে সমাজ যতটা আচ্ছন্ন ছলি, তার চয়েে তো এখন কছিু কম আচ্ছন্ন নয়।

    জাত পাতরে বরিুদ্ধওে তো লড়ছেলিনে বদ্যিাসাগর। জাত পাত ওপরে ওপরে আজ নইে হয়তো, ভতিরে ভতিরে ঠকিই কন্তিু আছ।ে

    বদ্যিাসাগররে বাংলা র্বণ পরচিয়? কজন পড়ে আজকাল! বাচ্চারা তো অ আ ক খ নয়, এ বি সি ডি পড়।ে বাংলা শখিে নাকি কোনও লাভ নইে, তাই পড়ে না।

    ৪. বড় কছিু বাঙালি লখেক সর্ম্পকে খুব র্গব করে বলা হয় তাঁদরে কোনও শত্রু নইে । শুনে আঁতকে উঠি আম।ি শত্রু নইে, তাহলে কমেন লখেক তাঁরা, কী লখেনে যে শত্রু তরৈি হয়ন?ি তাঁরা এমন লখো লখেনে, যে লখো পড়ে সবাই খুশি থাক।ে বামপন্থি ডানপন্থি কট্টরপন্থি নরমপন্থি সকলইে খুশ,ি ধনী গরবি নারীবদ্বিষেী নারীবাদী সকলইে খুশ,ি কউে লখোর কোনও বষিয়ে আপত্তি করে না, মন খারাপ করে না, রুখে ওঠে না। কারণ আপত্তি করার, মন খারাপ করার বা রুখে ওঠার কছিু থাকে না তাঁদরে লখোয়।

    আমার ভয় হয় এমন লখেকরে নাম শুনলইে। এই লখেকরো এক নষ্ট সমাজে বাস করছনে, কন্তিু নষ্ট সমাজরে নন্দিে করনে না, করলে নষ্ট সমাজরে র্হতার্কতারা তাঁদরে পছন্দ করবনে না তাই। এই লখেকরো বষৈম্যরে মধ্যে বাস করনে, কন্তিু বষৈম্যরে প্রতবিাদ করনে না, প্রতবিাদ করলে শত্রু তরৈি হব,ে বষৈম্যে বশ্বিাস করা মানুষ তাঁদরে ঘৃণা করবে এই ভয়।ে এই লখেকরো বস্তির জাতীয় পুরস্কার পান, বড় বড় সাহত্যি সভায় সভাপতত্বি করনে, পুরু পুরু ফুলরে মালা পরনে গলায়, উদ্বোধনরে ফতিে কাটনে, প্রকাশকরো এই লখেকদরে রচনাবলী প্রকাশ করনে। এই লখেকরো নষিদ্ধি হন না, বরং বক্রিি হন ভালো।

    ৫. অনকেে বলে ‘ব্যক্তরি সমালোচনা নয়, তার কাজরে সমালোচনা করা উচতি’। কাজ বলতে লখেকরে লখোর, শল্পিীর শল্পির্কমরে, ডাক্তাররে ডাক্তাররি, সম্পাদকরে সম্পাদনার…। আমি কন্তিু ব্যক্তরি সমালোচনারও পক্ষ।ে আমি একজন সরিয়িাল কলিাররে চমৎকার প্রমেরে গল্প পড়,ে বা একজন পডিোফাইলরে চমৎকার নাটক দখেে তাদরে গুণগান গাইতে চাই না। আমার অনুরাগী পাঠকরা অনকে সময় আমাকে ডফিন্ডে করতে গয়িে র্দুমুখদরে বলনে, ‘ব্যক্তি তসলমিার কনে, তসলমিার লখোর সমালোচনা করুন’। আমার প্রশ্ন, ব্যক্তি তসলমিার সমালোচনা নয় কনে? আমার পক্ষরে মানুষরো ভয় পায় যহেতেু বরিোধীরা আমার চরত্রি মন্দ- এর উদাহরণ দতিে গয়িে বল,ে আমি একাধকি পুরুষরে সঙ্গে শুয়ছে।ি যদওি একটি সর্ম্পক থাকা অবস্থায় দ্বতিীয় কোনও সর্ম্পকে আমি যাইন,ি কারও সঙ্গে প্রতারণা করনি,ি কন্তিু ময়েে হয়ে আমি জীবনে একরে বশেি সর্ম্পক করছে-ি এ নয়িে আপত্ত,ি ঘৃণাটা মূলত এ কারণইে। আমার বপিক্ষরে এবং পক্ষরে মানুষরো যারা মানুষরে চরত্রিরে ভালো মন্দরে এই সংজ্ঞা মাননে, তাদরে উচতি আমাকে নয়িে আপাতত দুশ্চন্তিা না করে নজিদেরে নয়িে দুশ্চন্তিা করা, নজিদেরে ভুলগুলো চহ্নিতি করা, নজিদেরে শুধরে নওেয়া।

    ব্যক্তি তসলমিা সর্ম্পকে বরিোধীরা যা বলে তার কতটা সত্য, কতটা জনেে বল,ে কতটা শুনে বল,ে কতটা নজিরে ভতিররে কূপমন্ডুকতা, নারীবদ্বিষে, পৌরুষকি হংিস-েদ্বষে, আর অজ্ঞতা থকেে বল,ে সটো কউে পরমিাপ করে দখেে না। আমি কন্তিু যতটা নম্বর দইি ব্যক্তি তসলমিাক,ে ততটা দইি না লখেক তসলমিাক।ে লখেক তসলমিাকে আমি যদি ১০০য় ৪৫ দইি, ব্যক্তি তসলমিাকে ১০০য় ১০০ দইি। লখেক তসলমিার ৪৩টি বইয়রে মধ্য থকেে ২২টা কলাম, ১৫টা কবতিা, ৪টা ছোটগল্প, ৩টা আত্মজীবনী, ২টা উপন্যাস ছাড়া বশিষে কছিু আমার ভালো লাগে না। বাকি লখোগুলোয় অযত্ন, অবহলো আর অদক্ষতা পাই। কন্তিু ব্যক্তি তসলমিার সমালোচনা করার জন্য হন্যে হয়ে খুঁত খুঁজলওে খুঁত পাই না। মানুষটা সৎ, নষ্ঠি, উদার। মানুষটাকে সোজা সরল পয়েে অনকেে ঠকায়, মানুষটা কাউকে ঠকায় না। মানুষটা সবাইকে বশ্বিাস কর,ে ঠকতে ঠকতে নঃিস্ব হয়ওে বশ্বিাস কর।ে মানুষটা অতি সাধারণ জীবনযাপন কর,ে শত প্রলোভনওে নজিরে আর্দশ বর্সিজন দয়ে না। মথ্যিে বলে না, অন্যায়রে সঙ্গে আপস করে না। মানুষটা নজিরে দুঃখে কাঁদে না, অন্যরে দুঃখে কাঁদ।ে

    আমইি সবচয়েে কাছ থকেে লখেক তসলমিা আর ব্যক্তি তসলমিাকে দখেছে।ি এ আমি দায়ত্বি নয়িইে বলছ,ি লখেক তসলমিা থকেে ব্যক্তি তসলমিা অনকে ওপর।ে

    লেখক: কথা সাহিত্যিক

  • অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কারা?অগ্নিধ্র শর্মা

    অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কারা?
    অগ্নিধ্র শর্মা

    একটা গল্প দিয়ে শুরু করি। যদিও গল্পটা অনেকেরই জানা তবুও বিষয়বস্তুর সাথে প্রাসঙ্গিকতা থাকায় গল্পটা আবার পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে চাই। একবার এক দরিদ্র কৃষক সরকার থেকে ৫০ লাখ টাকা অনুদান পেল। তখন সে চিন্তা করল আর কষ্ট না করে ঐ টাকা দিয়ে বসে বসে খাবে। মনের আনন্দে সে বাজারে গেল মিষ্টি কিনতে তার প্রতিবেশীদের খাওয়াবে বলে। বাজারে গিয়ে দেখল যে, মিষ্টির দোকান বন্ধ। কারণ মিষ্টির দোকানদারও ৫০ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছে। সেও আর কষ্ট করে দোকান চালাবে না, ঐ টাকা দিয়ে বসে বসে বাকি জীবন পার করবে। তারপর সেই কৃষক বাজারে গেল তার নিজের জন্য চাল, ডাল এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতে। কিন্তু গিয়ে দেখল সব দোকানই বন্ধ। কারণ তারাও প্রত্যেকে সরকার থেকে ৫০ লাখ টাকা করে অনুদান পেয়েছে। তারও চিন্তা করেছে আর কষ্ট না করে এবার আরাম-আয়েশে জীবনটা পার করতে। উপায় না পেয়ে কৃষক এবার হোটেলে গেল ভাত খেতে। সেখানেও একই অবস্থা। তারপর সে এক মুদির দোকানে গেল অন্তত কিছু শুকনো খাবার ও পানি খেয়ে নিজের জীবনটা বাঁচাতে। সেখানেও একই অবস্থা। এরপর ঐ কৃষক তার আশেপাশের মানুষের হাতে-পায়ে ধরছে তাকে কিছু খাবার দেওয়ার জন্য। বিনিময়ে সে বস্তা বস্তা টাকা দিতেও রাজি। কারণ টাকা খেয়ে তো আর বেঁচে থাকা যায় না।

    উপরের গল্প থেকে আমরা এটা বুঝতে পারি যে, শুধু টাকা দিয়ে জীবন চলে না। উৎপাদন ছাড়া টাকা কোনো কাজে আসে না। এখানে দেখা যাচ্ছে, সরকার থেকে টাকা পেয়ে তারা তাদের নিজ নিজ কর্ম বা উৎপাদন বন্ধ করেছে। ফলে বাজারে অতিরিক্ত অর্থের যোগান হয়েছে কিন্তু প্রয়োজনীয় দ্রব্যের যোগান বাড়েনি। অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে Inflation বা মুদ্রাস্ফীতি। এজন্য তাদের কাছে প্রচুর টাকা আছে কিন্তু খাবার নেই। তাহলে এই টাকা দিয়ে কী হবে? কোনো কাজে আসবে না। সুতরাং উৎপাদন না বাড়িয়ে দেশকে উন্নতি করার আমাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে।

    এবার আসি উৎপাদন নিয়ে। উৎপাদন কারা করে? বাংলাদেশের শিক্ষার হার এখনো শতভাগে পৌছায়নি। তাই বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ এখনো অশিক্ষিত। তবে তারা ছোট-বড় বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত রয়েছে। আর যারা শিক্ষিত তাদের মধ্যে কেউ কেউ সরকারি বা বেসরকারি চাকরি করছেন; আবার কেউ কেউ উদ্যোক্তা হয়ে আরো অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন; আবার কেউ কেউ বেকার। এবং এই বেকারত্বের পরিমাণটা নেহাত কম না। তারা চায় একটা চাকরি করতে, বিশেষ করে সরকারি চাকরি করতে। কারণ সবার ধারণা, সরকারি কাজ কোনো কাজই না। এখানে তেমন কোনো চাপ নেই, কষ্টও নেই। কিন্তু ক্রমবর্ধমান এই জনসংখ্যার দেশে এত লোকের চাকরি দেওয়া কীভাবে সম্ভব? বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে বছরে কতগুলো পদ খালি হয়, আর নতুন করেই বা কতগুলো পদ সৃষ্টি হয়? সব মিলিয়ে যদি ৫০ হাজারও হবে না (এটা আনিমানিক হিসেব)। কিন্তু প্রতি বছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় – সব মিলিয়ে কয়েক লক্ষ শিক্ষিত যুবক চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। বিগত বিসিএসগুলোতে আবেদনকারীর সংখ্যা বিশ্বের কয়েকটি দেশের মোট জনসংখ্যা থেকেও বেশি। এমতাবস্থায় যত ভাল শিক্ষার্থী হোক না কেন একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি চাকরি পাবে না। তাহলে যারা বাদ পড়ে যাবে তারা সবাই কি খারাপ? হতে পারে অনেকেই চাকরি পাওয়ার যোগ্য না। তাইবলে তো সবাই অযোগ্য হতে পারে না। বিসিএসে যারা পাস করে সবাই চাকরি পায় না। কারণ পদ স্বল্পতা। তাহলে যারা বিসিএসে পাস করেও চাকরি পেল না তাদেরকে আমরা কি বলব? ‘বিসিএস পাস বেকার’ ছাড়া কিছুই বলার নেই। এত কষ্ট করে পড়ালেখা করে পাস করেও পদ স্বল্পতার কারণে চাকরি না পাও বহু যুবকের চাকরির বয়স শেষ হয়ে গেছে। যাইহোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় সেটা না। এখন এই যে চাকরি না পাওয়া শিক্ষিত যুবকগুলো তো কিছু না কিছু করে জীবিকা নির্বাহ করবে। কারণ বেঁচে থাকতে গেলে কিছু একটা উপার্জনের পথ বের করতে হবে। আর জীবনের তাগিদে তখন সুবিধামতো বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হতে হয়। হতে পারে যারা চাকরি পায় নি তাদের মেধা, যারা চাকরি পেয়েছে তাদের থেকে তুলনামূলক কম (ব্যতিক্রমও রয়েছে)। তবে এটা তো পরিষ্কার আপনাকে বা আমাকে বা কাউকে না কাউকে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হবেই হবে। কারণ পদ সীমিত। এখন এই মানুষগুলো যখন বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হয় তখন তাদেরকে অবজ্ঞা ভরে দেখা হয়। কারণ তারা চাকরি করে না। আমাদের সমাজে চাকরি না করাটা ‘পরিচয়হীন ব্যক্তি’ বলে মনে করা হয়। কী অদ্ভুদ ব্যাপার! এতো গেল নীতি নৈতিকতার কথা। এবার আসি বাস্তবতায়।

    আচ্ছা, জীবনের প্রয়োজনে আমাদের অনেক কিছুই দরকার হয়। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা -এই পাঁচটা মৌলিক অধিকারের বাইরে আমাদের আরো বহুবিধ চাহিদা রয়েছে। সেটা হতে পারে প্রয়োজনীয় বা বিলাসবহুল। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই সকল চাহিদা পূরণ করবে কারা? নিশ্চয়ই কোনো চাকরিজীবী নয়। বিনোদোন আমাদের জীবনের অপরিহার্য একটা অংশ। বিনোদন ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। কিন্তু বিনোদন জগতে তো সরকারি চাকরির পদ নেই। তাহলে তো বিনোদন দেওয়ার মতো লোক পাওয়া যাবেনা অথচ যেটা আমাদের দরকার। আমাদের বস্ত্র দরকার। কিন্তু পোশাক কারখানাগুলো তো ব্যক্তি মালিকানাধীন। তাহলে সেখানে কাজ করবে কারা? পোশাক ছাড়া তো চলা অসম্ভব। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য দরকার। খাদ্য তো এসি রুমে হয় না। হয় মাঠে। তাহলে রোদ, ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে ফসল উৎপাদন করবে কারা? আমাদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য মাছ উৎপাদন করবে কারা? আমাদের পা-কে রক্ষার জন্য জুতো তৈরি করবে কারা? রোগ-ব্যাধি থেকে আমাদের মুক্তির জন্য ওষধ তৈরি করবে কারা? ক্যানসার, ইবোলা ভাইরাস, এইডস, হাম, যক্ষা, বি-ভাইরাস ইত্যাদি থেকে নিরাপদ থাকার জন্য টিকা তৈরি করবে কারা? উপরের সকল পণ্য সঠিক স্থানে পৌঁছে দেবে কারা? চাকরিজীবিদের গাড়ি-বাড়ি তৈরি করে দেবে কারা? যাতায়াতের জন্য রাস্তা-ঘাট তৈরি করবে কারা? তাদের বাড়িতে পানি, মাছ, মাংস যোগান দেবে কারা? তাদের টিভি, ফ্রিজ, এসি মেরামত করবে কারা? তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ করবে কারা? এরকম হাজারও ‘কারা’ এর কোনো উত্তর আমাদের কাছে নেই।

    একটা দেশের সার্বিক উন্নতি করতে হলে সকল পেশায় দক্ষ জনশক্তি দরকার। আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বিষয়টা আরও একটু পরিষ্কার হবে। গত কয়েকমাস যাবৎ দেশের অর্থনীতিতে বেশ মন্দা ভাব দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে জুলাইয়ের শুরুতে। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গেছে, টাকার মান কমে গেছে এবং জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে ডলার সংকট একটা। এই ডলার আসে কীভাবে? ১. প্রবাসীদের পাঠানো ডলার এবং ২. আমাদের দেশীয় পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অর্জিত ডলার। এখন আসি প্রবাসী আয়ে। বিষয়টা একটু অন্যভাবে আলোচনা করা যাক, আমরা যারা একটু লেখাপড়া শিখেই চাকরি চাকরি করি, তারা কি ভেবে দেখেছি আমরা দেশের অর্থনীতিতে কতটুকু অবদান রাখছি? আমাদের বিভিন্ন খাদ্যশস্য, ফল, জ্বালানি তেল, গ্যাস, ঔষধ, গাড়ি, শিশুখাদ্য, প্রসাধনী, বিলাসবহুল পণ্য, ইলেক্ট্রনিক দ্রব্যাদিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আমদানি করতে হয় বাইরের দেশ থেকে। আর এই আমাদনি কার্যক্রম চালাতে হয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলার দিয়ে। ডলার তো আমরা ছাপাতে পারি না। এই ডলার আসে প্রবাসী আয় থেকে এবং আমাদের নিজেদের পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে। এখন যারা বাইরের বিভিন্ন দেশে কাজ করে ডলার পাঠান তারা যদি এই ডলার না পাঠান, অর্থাৎ অবৈধভাবে পাঠান অথবা, ধরে নিই বাইরের দেশে কেউ কাজ করতে গেল না সেক্ষেত্রে আমাদের অর্থনীতি কোথায় যাবে সেটা বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানের দরকার হয় না। তাহলে বুঝতেই পারছি প্রবাসীরা আমাদের অর্থনীতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

    এবার আসি আমাদের নিজেদের পণ্য রপ্তানির বিষয়ে। আমরা আমাদের খাদ্যশস্য যেমন, চাল, গম, পাট ও পাটজাত দ্রব্য, চিংড়ি, ফল, তৈরি পোশাক, ঔষধ, রড, সিমেন্ট, বিলাসজাত পণ্য, জনশক্তিসহ বিভিন্ন প্রকার দ্রব্য রপ্তানি করে থাকি এবং এর মাধ্যমে ডলার পেয়ে থাকি। এখন প্রশ্ন হলো এই সব দ্রব্যাদি উৎপাদন করে কারা। নিশ্চয়ই কোনো অফিসিয়াল চাকরিজীবী নয়। এসব উৎপাদন করে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ। তৈরি পোশাক আমাদের অর্থনীতির একটা বড় শক্তি। সেই পোশাক কারখানাগুলোতেও কাজ করে একেবারে প্রান্তিক লোকজন।

    তাহলে আমরা যারা চাকরি চাকরি করে দিন পার করছি, আর চাকরি না হলে হতাশ হচ্ছি এবং যারা চাকরি না করে বিভিন্ন উৎপাদনশীল খাতে যুক্ত আছে বলে তাদেরকে ছোট করে দেখছি, আমরা কি ভেবে দেখেছি আমরা কতটা ঠিক কাজ করছি? সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে কারা আমরা একবারও চিন্তা করছি? দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে এই মুহুর্তে দুটো জিনিস আগে দরকার। এক. প্রবাসী আয় বৃদ্ধি করা; এবং দুই. আমাদের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করা। যার কোনোটাই আমরা সবাই করতে পারব না। কই? আপনিতো চাকরিজীবী! তো বাঁচান না দেশের অর্থনীতিকে। আপনার ক্ষমতা অনেক। তো প্রয়োগ করে দেখান যাতে করে আমাদের দেশের লোকজন একটু স্বাচ্ছন্দ্যে খেয়ে পরে বেঁচে থাকে।

    এখন প্রশ্ন আসতে পারে তাহলে সরকারি বা বেসরকারি চাকরির কি কোনো দরকার নেই? হ্যাঁ, অবশ্য আছে। আমি কিন্তু কখনো বলিনি যে চাকরির দরকার নেই। ‘চাকরি’ মানে ‘কাজ’। তবে সেই কাজ করা হয় কখনো নিজের মতো স্বাধীনভাবে, কখনো সরকারের অধীনে আবার কখনো বেসরকারি সংস্থা বা ব্যক্তির অধীনে। সবইতো চাকরি বা কাজ। সরকারের অধীনে যে কাজ করা হয় সেটাকে বলা হয় সরকারি চাকরি। বলা হয় সরকারি চাকরিতে অন্যান্য চাকরি থেকে তুলনামূলক সুযোগ-সুবিধা বেশি। আর বেসরকারি চাকরিতে সেই সুযোগ-সুবিধাগুলো তুলনামূলক কম (কিছু ব্যতিক্রম বাদে)। এবার আসি সেই সুযোগ-সুবিধা কী। আসলে মোটাদাগে সরকারি চাকরি বা কাজ বলতে আমরা সাধারণ জনগণ সেটাই বুঝি যেখানে তেমন কোনো কাজ নেই। তবে রাষ্ট্রের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের কথা আলাদা। সেখানে প্রচুর চাপ থাকে, এমনকি তাদের মাঠ পর্যায়েও কাজের প্রেসার অনেক। কিন্তু গড় হিসেবে অন্যান্য সেক্টরগুলোতে আসলে বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কী সেবা দিয়ে থাকেন সেটা প্রতিদিনকার খবরের কাগজে দেখা যায়। আমরা সবাই সরকারি চাকরি করতে চাই, কিন্তু সেবা নিতে যাই বেসরকারি খাত থেকে। কেন? কারণ সেখানে আমাদের আস্থা বেশি। কারণ কি? সেখানকার ব্যবস্থাপনা ভাল। আর ব্যবস্থাপনা ভাল কারণ সেখানকার কাজগুলো নিয়মিত মনিটরিং করা হয় সুশৃঙ্খলভাবে। আর তাই সেখানে চাকরি করা একটু চাপ বেশি বলে মনে হয়। কারণ আমাদের চোখের সামনে দেখছি একই পেশায় সরকারি প্রতিষ্ঠানে থেকে অন্যরা আরামে দিন কাটাচ্ছে।

    আমাদের মাঠ পর্যায়ে উৎপাদনশীল বা অনুৎপাদনশীল কাজে যারা যুক্ত আছেন তাদেরকে সঠিক দিক নির্দেশনার প্রয়োজন হয়। এখন এই দিক নির্দেশনা কারা দিবে? আমরা প্রতেকেই তো একাই একশ, কিন্তু একশ লোক কখনো এক হতে পারি না, আর বর্তমান বাস্তবতায় সেটা সম্ভবও না। আর তাই কেন্দ্রীয়ভাবে দেশের প্রত্যেক সেক্টরকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য আলাদা আলাদা দক্ষ জনশক্তি দরকার হয়। যেমন: কৃষি খাত দেখাশোনা করার জন্য কৃষি কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য খাত দেখার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়ে দক্ষ কর্মকর্তা, প্রকৌশল খাত দেখাশোনা করার জন্য প্রকৌশলী- এরকমভাবে প্রত্যেক সেক্টরে দক্ষ জনবল দরকার। আর তাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য আরও কিছু অধীনস্থ কর্মকর্তা এবং কর্মচারীও দরকার হয়। আর এই সকল সেক্টরকে মনিটরিং করার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে সিভিল প্রশাসন দরকার। এখন এসব সেক্টরের কর্মরত কর্মকর্তা বা কর্মচারী, অথবা সাধারণ মানুষ যারা অপরাধ করবে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার জন্য এবং দেশে শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বিচার বিভাগ, পুলিস প্রশাসন, দুদকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য এজেন্সি দরকার। দেশকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনী দরকার। দেশের অভ্যন্তরীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু রাখা এবং বৈদেশিক লেনদেন চালু রাখার জন্য ব্যাংক এবং ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী দরকার। আবার সকলকে ছোট থেকে বড় করে সত্যিকার অর্থে মানুষ করার জন্য দক্ষ শিক্ষক দরকার। আর সবাইকে ভালভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সৎ ও যোগ্য রাজনৈতিক নেতা দরকার। তাহলে সবকিছু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের সবাইকে সবার প্রয়োজন। আমরা প্রতেকেই একটা সামগ্রিক ব্যবস্থার এক একটা ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। কেউ কাউকে ছাড়া চলতে পারি না।

    এক সময় আমাদের দেশ ১০০% শিক্ষিত হবে। তখনওতো বিভিন্ন পেশায় দক্ষ জনবল প্রয়োজন হবে। দেশ যখন ১০০% শিক্ষিত হবে তার অর্থ দাঁড়াবে, রাস্তার রিক্সাওয়ালাটা শিক্ষিত, বাড়ির কাজের কাজের বুয়াও শিক্ষিত, একজন সেলুন দোকানদার সেও শিক্ষিত, যে জুতো সেলাই করে সে শিক্ষিত, যে মাঠে ফসল ফলায় সেও শিক্ষিত, যে নদীতে মাছ ধরে সেও শিক্ষিত। ১০০% শিক্ষিত মানে চায়ের দোকানি থেকে শুরু করে যারা ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে সবাই শিক্ষিত। সবাই ১০০% এর ভিতরে। তাহলে তখন শিক্ষিত হয়ে সবাই অফিসিয়াল চাকরি করলে কে ফসল ফলাবে? কে প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করবে? উৎপাদনের সাথে কারা যুক্ত থাকবে? কারা বিদেশে গিয়ে রেমিট্যান্স পাঠাবে? দেশ চলবে কীভাবে? সবচেয়ে বড় কথা হল, কে কাকে চাকরি দেবে? উত্তর আমাদের জানা নেই। তাহলে মানুষের পেশা নিয়ে কেন এত হীনমন্যতা? কেন এত সংকীর্ণতা? সত্যিকার অর্থে দেশকে বাঁচিয়ে রাখছে কারা? দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কারা?

  • আমি যে ভাবে দেখেছি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম মোড়লকে

    আমি যে ভাবে দেখেছি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম মোড়লকে


    অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী

    আমার রাজনৈতিক জীবনে মোড়ল আব্দুস সালামের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অনেক ও দীর্ঘ । আমি রাজনৈতিক ধারায় যুক্ত হই ৬৮ সালের গণ আন্দোলনের শুরুর দিকে। তখন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে ও আগরতলা মামলা শুরুর শুরুর সময়কাল। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী জাতির সকল ধারাকে পরিবর্তন করে। স্বাধীনতার পর দুটো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আনে। একটি পাকিস্তানের কাছে যা পাওয়া যায় নি সেই সংবিধান রচনা। অন্যটি একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির জন্ম। যার নেতৃত্বে থাকে সদ্য যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা একদল মুক্তিযোদ্ধা, যাদের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ৬২ সালের তিন তরুণের স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ বোনার (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াস বা বিএলএফ) মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু, মুজিব বাহিনীর সফল এবং দীর্ঘ সংগ্রামের প্রস্তুতির প্রশিক্ষনের ধারায় সমাজতান্ত্রিক চেতনার সাথে পরিচিত ও সম্পৃক্ত বাংলার তারুন্য দৃপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এনে দেয় দেয় নূতন উৎমাদনা। স্বাধীনতার পর সেই তারুণ্য দীপ্ত উৎমাদনা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে জন্ম দেয় বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে একটি নূতন রাজনৈতিক দলের। “আমাদের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র” স্লোগানকে ধারণ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ নামে দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
    পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগের ৭০ সালের কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য হিসেবে প্রচার সম্পাদক শহীদ স্বপন কুমার উত্থাপিত স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়া প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন দেন। আব্দুস সালাম মোড়ল এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন ধারাবাহিকতার অংশ হিসাবে। স্বাধীনতার পূর্ব সমরয় রাজনৈতিক চারণ ক্ষেত্র ছিল বাগেরহাট। যুক্ত ছিলেন ছাত্রলীগের অভ্যান্তরে নিউক্লিয়াসের সাথে। আব্দুস সালাম মোড়ল মুক্তিযুদ্ধে তার জন্মএলাকা তালা অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন তিনি। এ আলোচনায় মুজিববাহিনীর বিষয়টি প্রাসঙ্গিক থাকলেও সময়ের কারণে সেটিকে বাদ রাখলাম। আগামীতে সময় সুযোগে আলোচনা করা যাবে।
    ১৯৭৮ সালের পর থেকে খুলনা অবস্থানের সময় কালের বেশিরভাগ সময় কেটেছে এ নেতার সান্যিধ্যে। এসময় খুলনাতে আমি ও আবু কাজী মিলে আমরা একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলি। উদ্ভাস সম্মিলিত সাহিত্য আসর যার নাম ছিল। মুলত: আমরা জাসদের ধারার সাথে মিলে এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলি। আব্দুস সালাম মোড়ল, বিপ্লব কান্তি মন্ডল প্রমুখ সংগঠনটির উপদেষ্ঠা ছিলেন। আমি ও আবু কাজী দুজনই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম।
    জাসদ প্রতিষ্ঠার সময় ঘোষনা করা হয় জাসদ একটি সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন। এ সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি বিপ্লবী পার্টি গঠন করা হবে। মুলত সেই সময়ে জাসদের উপলব্ধি ছিল দেশে যতগুলো বামধারার রাজনৈতিক দল ছিল তাদের সমাজ বিশ্লেষন সঠিক ছিল না। তত দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে গেছে। কিন্তু সকল বাম রাজনৈতিক দলের বিশেষন ছিল ‘ বাংলাদেশ একটি আধা উপনিবেশ ও আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশ’। এ সময়ে জাসদের অন্যতম সহ-সভাপতি ও তৎকালিন একজন প্রথম শ্রেনীর অর্থনীতিবীদ ড. আখলাকুর রহমান একটি লেখার মাধ্যমে প্রমান করেন যে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি পুঁজিবাদের দিকে মোড় নিয়েছে। তিনি ‘কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ’ নামে একটি গবেষনাপত্র লেখেন। জাসদ এ বিশ^াসকে ধারণ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসুচি ঘোষনা করেন। এবং এ বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য একটি বিপ্লবী পাটি গঠনের কথা বলেন। জাসদ যার প্লাট ফর্ম হিসেবে কাজ করবে বলে দলের অভ্যন্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

    জাসদ জন্ম লগ্ন থেকেই ‘সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেনী সংগ্রামকে তরানিত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’ এর সংগ্রাম করার কথা ঘোষনা করে। ’৭৩ সালের মধ্য সময় কাল থেকে সে প্রক্রিয়া শুরু হয় কি না আমি জানি না। তবে এ সময় জাসদের অভ্যন্তরে নূতন একটি রাজতৈকি ধারা শুরু হয়, দলের অভ্যন্তরে পাটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে সেল গঠন করা হয়। শ্যামনগর থানাতে সে সময় ৬ জনের একটি সেল গঠন করা হয়। যার সাথে আমাকে যুক্ত করা হয়। এর কার্যক্রমটা ছিল অনেকাংশেই গোপনীয়। দলের সকলে এর সাথে যুক্ত ছিলেন না, এমনি কি জানতেনও না।

    জাসদের বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের এ প্রক্রিয়ার মূল নেতা ছিলেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু। এবং তাঁর দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন মোড়ল আব্দুস সালাম। মোড়ল আব্দুল সালাম কখনই প্রকাশ্য নেতা ছিলেন না। তিনি এ প্রক্রিয়ার অন্যতম ত্বাত্তিক নেতা ও খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার, নড়াইল, মাগুরা, যশোর এলাকার মুল সংগঠক ছিলেন। সাতক্ষীরা অঞ্চলের এ প্রক্রিয়্ার প্রধান ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। শ্যামনগরে ছিলেন জি,এম আবু বকর সিদ্দিক (্এ্যাড)। ৬৯ সালে সাতক্ষীরা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। ছাত্রনেতা মোস্তাফিজুর রহমানের উদ্যোগে এ কমিটিতে সভাপতি রবীন্দ্র নাথ, নজরুল ইসলাম সেক্রেটারী ও জি এম আবুবকর সিদ্দিক কে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। তিন জনই শ্যামনগরের।
    সিদ্দিক ভাইয়ের মাধ্যমে আমার সাথে পরিচয় হয় মুক্তিযুদ্ধের নেতা ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান ভাইয়ের সাথে। তিনি ও শেখ কামরুজ¥ামান টুকু ভাই একদিন আমাকে ডেকে নেন সিদ্দিক ভাইয়ের বাড়িতে। সে সময় সেটি ছিলো আমাদের একটি অঘোষিত যোগাযোগ কেন্দ্র। মনে রাখতে হবে এসময় জাসদ প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল ছিলো। টুকু ভাই বললেন, একটি গাড়িতে অনেকে উঠেন কিন্তু একজন ড্রাইভার থাকেন তিনি পথ দেখিয়ে গন্তবে নিয়ে যান। আমরা সে যাত্রা শুরু করেছি তোমাকে তার সাথে যুক্ত হওয়ার তালিকায় রাখতে চাই।’
    রাজনীতিতে আমার স্বপ্নের মানুষগুলোর সামনে বসে আমি কথা বলছি, তারা যা বলবেন তা করতে আমার কোন আপত্তি নেই- এরকম একটি মানষিক প্রস্তুতি আমার। শ্যামনগরে সেল গঠন করা হয় ৬ জনকে নিয়ে। বাবু বিশ^নাথ দাশ (থানা জাসদের সাধারন সম্পাদক), শেখ হারুন-অর-রশীদ( সাংগঠনিক সম্পাদক), জি এম আবু বকর সিদ্দিক (রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র), শেখ আবুল কালম আযাদ(সদ্য থানা ছাত্রলীগের দায়িত্ব ছেড়ে কৃষকলীগের দায়িত্বে) আর ছাত্রদের মধ্যে আমি ও শেখ শফিকুর রহমান খোকন। বয়সে সবচেয়ে কম। তখনও কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলাম না, ৭৩ সালের শেষ দিকে আমাকে থানা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক হিসেবে তৎকালিন কমিটিতে কো-অপট করা হয়। সম্মেলনের মাধ্যমে ১৯৭৪ সালে থানা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আমি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাই।

    ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে শ্যামনগর থেকে বাবু বিশ^নাথ দাশ (তৎকালিন থানা জাসদের সাধারন সম্পাদক)নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনের পর থেকে দ্রুত রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে থাকে। ৭৪ সালের প্রথম দিকে আমরা সক্রিয়ভাবে সেল যুক্ত ছিলাম এবং নিয়মিত সভা হতো।

    সেল গঠনের পর আমাদের কাজের ধারায়, অধ্যায়নে পরিবর্তন আসে। আমার অ-প্রকাশ্য দায়িত্ব আসতে শুরু করে। সেল এর মিটিং সমুহ রাতেই সাধারনত হতো। এ সময়ে একজন ব্যক্তি শ্যামনগরে আসেন। সেল এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমার দায়িত্ব পড়ে তার সাথে যাওয়া। চুল দাড়িতে ঢাকা এক লোককে আমার সাথে দেওয়া হয়। আসল নাম পরে জানতে পারি। তিনি ছিলেন মোড়ল আব্দুস সালাম। অত্যান্ত ধীর স্থির ব্যক্তিত্বসম্পন্ন । কথা বলেন আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রনে। দিনের বেলায় বাইরে কম বের হতেন, অধিকাংশ সময়ে বিাভন্ন ব্যক্তি ও নেতৃবৃন্দের সাথে বলতেন যাদের অধিকাংশকেই আমি চিনতাম না। এর পর আসেন আরো একজন। তিনি আসেন টুকু ভাইয়ের সাথে। সিদ্দিক ভাইয়ের বাড়ীতে বৈঠক শেষে আমার উপর দায়িত্ব পড়ে। তাকে বেদকাশী(কয়রা) নিয়ে যাওয়ার। তিনি ছিলেন বিপ্লব কান্তি মন্ডল। এভাবেই একের পর এক বিপ্লবী ব্যক্তিদেও সাথে পরিচয় হতে থাকে আর আলোচনার মাধ্যমে আমার জ্ঞানের মাত্রাও বাড়তে থাকে। এই প্রথম কয়রা যাওয়া। কয়রার দিঘির জল খুব প্রশিদ্ধ ছিল। দীঘি থেকে উঠিয়ে আনা পানি গ্লাসে করে খেতে দিত। আমিও আট আনা দিয়ে এক গ্লাস পানি কিনে খাই। বেকাশীতে সোলাইমানের বাড়ী আসি। অমল, মাহবুব ও কবিরের সাথে পরিচয় হয়।
    আমিও আস্তে আস্তে বিপ্লবী গণবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে পড়ি। তবে আমার কাজটা ছিল প্রকাশ্য। ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চে পর জাসদ এর উপর চরম নির্যাতন নেমে আসে। এ সময় অনেকেই গ্রেফতার হন। প্রকাশ্য রাজনীতি করা কঠিন হলেও জাসদ বাকশাল গঠনের আগ পর্যন্ত প্রকাশ্য রাজনীতি অব্যাহত রাখে। ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের গণবাহিনীর অন্যতম কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল ঢালীসহ তার বাহিনীকে শ্যামনগরে গ্রহণ ও থাকার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব পরে। জালাল ঢালী তখন অপ্রকাশ্য ভাবে থাকেন। এক রাতে জালাল ঢালী, অমল, সোলাইমান, মাহবুব, সহ চুনানদী পার হয়ে আসেন। সকলে স্বশস্ত্র ছিল। আমি রাতেই তাদের নিয়ে হোমিও ডাক্তার ছালাম ভাইয়ের বাড়ী নিয়ে যাই। অস্ত্র গুলো ধানের গোলায় রাখি। আর সকলকে আক(ইক্ষু) বাগানে থাকার ব্যবস্থা করি। পরে সিদ্দিক ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেই। সিদ্দিক ভাই পুরো গ্রুপকে জয়ন্ত কাকা (বিশিষ্ট আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্র্যোপধ্যায়) বাড়ীতে সেল্টার করিয়ে দেন।
    গণবাহিনী স্বশস্ত্র হলেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিল। গণবাহিনীর খুলনা বিভাগীয় প্রধান ও কেন্দ্রিয় প্রতিনিধি ছিলেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু। খুলনা জেলার দায়িত্বে ছিলেন বিপ্লব কান্তি মন্ডল, সাতক্ষীরা জেলার দায়িত্বে ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। মোড়ল আব্দুস সালাম ছিলেন আঞ্চলিক সমন্বয়কারী। এ অঞ্চলের গণবাহিনীর সামরিক প্রধান ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার। সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন জালাল ঢালী, আবুবকর সিদ্দিক (এড.), আশাশুনিতে মোসলেম উদ্দীন (এড.), কয়রায় কেরামত হোসেন (এড.) প্রমুখ।
    আগস্টে আমাদের একটি দল নিয়ে আমরা হরিনগর এলাকাতে সেল্টার নেই। আমার এ দলে অমলসহ কয়রার বেশ জনের স্বশস্ত্র বাহিনীর একটি দল ছিল। এ সময় সুন্দরবন এলাকায় ডাকাত দলের উপদ্রুপ খুব বেড়ে যায় এবং ডাকাতরা অধিকাংশ সময় জাসদের নাম ব্যবহার করে মানুষের বাড়ীতে ডাকাতি করতো। ফলে তাদের দমন করা জরুরী হয়ে পড়ায় আমাদের এ এলাকায় আসা। আমাদের সাথে স্থানীয় ভাবে মুজিবুল হক, জাবের মোড়লসহ কয়েকজন যুক্ত হয়। আর শ্যামনগর থেকে গমআব্দুস সালাম, সম আতাউর রহমান, আবুল কালাম গাইন প্রমুখ ছিল। স ম আতাউর রহমান, আবুল কালাম গাইন স্বশস্ত্র বাহিনীর সদস্য। প্রথম রাতে জেহেরডাকাতসহ দুজন দুরান্ত ডাকাতকে ধরা ও হত্যা করা হয়। এলাকায় এ ঘটনা দারুন আলোড়ন সৃষ্টি করে ফলে আমাদের সেল্টারের সংকট কমে আসে। তবু আমরা বাহিনীর নিরাপত্তার জন্য ভিতরে মড়গাঙ্গে দিকে যেয়ে সহকর্মি — বাড়ী যেয়ে আশ্রয় গ্রহণ করি। বাড়ীতে অতিরিক্ত ঘর না থাকায় গোয়ালঘর পরিস্কার করে প্রথমে চুলাই ছাই ছিটিয়ে তার উপর বিচলি পেতে আমাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা ১৫র মত ছিল। এতজন লোকের পরপর তিন বেলা খাওয়ানো সকলের সামর্থ ছিল না। দিনে বাইরে গণবাহিনীর স্বশস্ত্র দের বের হতে দেওয়া হতো না। এক দিন পর আমরা একই এলাকার রমেশ বাবু বলে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তার বাড়ীতে সেল্টার নেই অনেকটা জোর করে। আমরা ব্যাগ বোচকা রেখে সন্ধ্যায় মুন্সিগজ্ঞ বাজারে আসি নেতৃবৃন্দ এসেছেন কথা বলতে। সেখানে আবু বকর সিদ্দিক ভাই ও কয়রার মাহবুব অপেক্ষা করছিলে। যাওয়ার পর কয়েকটি প্রয়োজনীয় কথা শেষে বলেন তোমাদের গ্রুপকে এখনই এ এলাকা ত্যাগ করতে হবে। নির্দেশ মত আমাদের সকলকে সেল্টার পরিবর্তনের বিষয় জানানো হলো, তবে তাদের পুরাতন সেল্টারের মালামাল আনার বিকল্প ব্যবস্থতা করে মালসামাল আনতে গেলাম।
    ৭৪ সালে উপক’লের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই দূর্গম ছিল। এলাকার একমাত্র বাহন হেলিকপ্টার (সাইকেলের পিছনে তক্তা দিয়ে বসার ব্যবস্থা)। আমি মালামাল আনতে যাওয়ার সময়ে ঘটে যায় একটি বড় দুর্ঘটনা। মুন্সিগজ্ঞ এলাকা সুন্দরবন সংলগ্ন হওয়ায়, স্থানীয় গরীব মানুষেরা সুন্দরবন হতে সহজে ‘ছিটে’ (গোড়ান গাছের ডাল) কাঠ সংগ্রহ করে আনতো। যা জ¦ালানী হিসেবে ব্যবহার করতো। আর এসময় থানার একদল পুলিশ ছিল, যারা সুযোগ পেলে আসতো এদের ধরে দ’ু পাঁচ টাকা নিতে। এদিনও দুজন পুলিশ আসে বাজারে। এ বিষয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। কারণ পুলিশ তত দিনে গণবাহিনীর নাম জেনে গেছে। ফলে তারাও পারত পক্ষে জাসদদের লোকদের এড়িয়ে চলতো। কিন্তু এদিন ঘটলো বিপরীত ঘটনা। সম্ভবত নূতন আগত ছিল তারা। আমাদের বাহিনী সদস্য কালামকে বাজারে দোকানে বসায় অবস্থায় কেহ একজন গোপনে উষ্কে দিলে পুলিশ আটক করায়। ঘটনাটি দ্রুত বাহিনীর সদস্যদের পৌছে গেলে পুলিশদের নিকট থেকে কালামকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেহেতু আবু বকর সিদ্দিক ভাই অবস্থান করছিলেন এলকাতে, ফলে তার মতামতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশদ্বয় কালামকে সাথে নিয়ে গ্রামে ভিতরে চলে যাওয়ায় তাৎক্ষনিক একটু সমস্যা তৈরী হয়। আজকেরমত বৈদ্যুতিক আলো না থাকায় গ্রাম এলাকায় সন্ধ্যার পর পরই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসতো। ফলে কালামকে নিয়ে পুলিশরা কোন দিকে গেছে সেটি জানতে বেশ সময় চলে যায়। কালামকে পুলিশ নিয়ে গেলে নির্যাতনের মুখে সকল তথ্য বলে দিতে পারে। ফলে নেতৃবৃন্দ নির্দেশ দেন যেকোন প্রকারে কালামকে মুক্ত করতে হবে। পরে জানাগেল যে পুলিশ কালাম সহ গ্রামের মধ্যে গেছে। ফেরার পথে এ্যামবুশ করা হলো, পুলিশ কাছাকাছি আসলে কৌশলে ছাড়ানোর চেষ্টা করা হয়।
    একাতে থাকা নিরাপদ না হওয়ায় সিদ্দিক ভাই ও মাহবুব মুল বাহিনী নিয়ে কয়রার দিকে চলে যায়। আমাকে তাদের সাথে না যেয়ে এলাকাতে ফিরবার সিদ্ধান্ত দেন। এ সময় আমার দায়িত্ব ছিল প্রকাশ্য দলের কাজ করা। তখন শ্যামনগরে তত দিন পর্যন্ত গণবাহিনীর প্রকাশ্য কাজের দায়িত্বে ছিলেন শেখ আবুল কালাম আযাদ, নওশেরম আরশাদ, শেখ শফিকুর রহমান, শেখ ফিরোজ প্রমুখ। কিন্তু বাড়ীতে পৌছে বুঝতে পারলাম এখানে থাকা নিরাপদ নয়। আমার আব্বা আমাকে পরের দিন ভোরে একজনকে সাথে দিয়ে সাতক্ষীরাতে রওনা করে দেন। আমরা গুমানতলী গ্রামের পিছন দিয়ে কৃষ্ণনগরের মানপুরে আমাদের জোরদার আহম্মদ চাচার বাড়ী আসি, তিনি সহ ঘোলা খেয়া পার হয়ে ব্যাংগদহ হয়ে দুদিন ধরে হেটে সাতক্ষীরার সুলতানপুরে এসে আমার এক ভগ্নিপতি কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা আবুল কাশেমের বাসাতে উঠি। আমার আব্বা মুলত এখানে থাকার ব্যবস্থা করেন। আমি এ সময় সাতক্ষীরা কলেজের ছাত্র। কয়েক দিনের মধ্যে সাতক্ষীরার গোলাম রসুলের সাথে যোগাযোগ হয়। পরে হাসনে জাহিদ জজ ভাইয়ের মাধ্যমে কামরুল ইসলাম খানের সাথে যোগাযোগ হয়। কামরুল ইসলাম খান কোটের সামনে একটি দোকান ছিল। এটাই মোটামুটি যোগাযোগের কেন্দ্র ছিল। আর একটি কেন্দ্র ছিল চৌধুরী পাড়ার মধ্যে ক্লাব ঘর। এখানে সান্টু চৌধুরী, যঙ্গু ও নান্নাসহ অনেকেই থাকতো।
    ১৯৭৫ সালের আগষ্ট মাসের প্রথম দিকে গোলাম রসুল (পরে কাউন্সিলার হন) একদিন জানান নেতৃবৃন্দ তালার মুড়োগাছিতে আছেন, সেখানে কয়েকটা অস্ত্র নিয়ে যেতে হবে। কারন জাসদ নেতা লতিফ ও হাতেমকে হত্যার মুলব্যক্তি নূর খাঁ চেয়ানম্যানকে অপারেশন করতে হবে। সে সময় তালা, আশাশুনি, শ্যামনগর, কয়রা, পাইকগাছা, দেবহাটা এলাকা ক্যাপ্টেন শাহজাহান, আবু বকর সিদ্দিক ও জালাল ঢালীদের নিয়ন্ত্রনে ছিল। এরা বেশীর ভাগ সময় এ সকল প্রত্যান্ত অঞ্চলে বাহিনী নিয়ে অবস্থান করতেন।
    আমি সুলতানপুর হতে বের হয়ে ভোরে পুরাতন সাতক্ষীরাস্থ গোলাম রসুলের বাড়ীতে পৌছাই। রসুলের বাড়ীতে পান্তা ভাত খেয়ে আমরা পিছনের বিল দিয়ে পানিতে নেমে হাটতে শুরু করি। অস্ত্র গুলো বস্তার মধ্যে ভরে পর্যায় ক্রমে মাথায় ঘাড়ে করে হাটতে শুরু করি। এক কোমর পানি দিয়ে হাটা সহজ সাধ্য ছিল না। মাঝে মধ্যে কিছুটা উচু পথ পাওয়া যেত বটে তবে সে পথ অপেক্ষা পানির মধ্য দিয়ে হাটা সহজ ছিল। তালা অঞ্চলে তখন ইপিসিপি/নকশালদের অবস্থান শক্তিশালী ছিল। এনারা জাসদকে সা¤্রাজ্যবাদের দালাল মনে করতো। তাদের কাছে জাসদ, গনবাহিনীর সদস্যদের হত্যা করা শ্রেনী সংগ্রামের অংশ ছিল। ফলে সাবধানতা অবলম্বন ছিল শ্রেয়। তালার বিলে জোক ছিল মারাত্মক ধরনের। ইতোমধ্যে কতগুলো জোঁক যে সঙ্গি হয়েছে, তা হিসাব করে বের করা মুসকিল। যত কষ্ট হোক নিরাপত্তার জন্য এ পথেই চলতে হবে। কিন্তু পথ আর কমে না। ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নেব, সে সুযোগ বা স্থান নেই। ফলে প্রায় মন খানেক মালামাল মাথায় ঘাড়ে পিঠে করে রাত আনুমানিক ১০ টার দিকে মুড়াগাছি মুক্তিযোদ্ধা সুজাত মাষ্টারের বাড়ীতে পৌছাই। সে রকম নির্দেশই ছিল। এ সময় আমাদের আপ্যায়ন করবে বাড়ীতে সে অবস্থা নেই। বাড়ীতে এক জন নারী সন্তান জন্ম দিতে যেয়ে বিপদজনক অবস্থার মধ্যে আছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে সে নারী। নারী মর্মান্তিক আত্মচিৎকার আমারা শুনতে পাচ্ছিলাম। ফলে বাড়ীর অবস্থা প্রতিকুল। এর মধ্যে সুজাত ভাই অত্যান্ত আন্তরিকতার সাথে আমাদের গ্রহণ করেন ও খেতে দেন। আমাদের যে সময়ে পৌছানোর কথা ছিল তা থেকে অনেক পরে পৌছাই। ফলে আমাদের গ্রহণকারী দল ফিরে গেছেন সেল্টার এলাকায়। আমাদের জন্য নির্দেশ হলো এ রাতেই কাদাকাটি মুরতোজা ভাইয়ের বাড়ীতে পৌছাতে হবে। আমরা খেয়ে দেরী না করে বের হয়ে পড়ি এবং ভোর রাতে মুর্তুজা ভায়ের বাড়ী পৌছে হাতমুখ ধোয়ার সুযোগ পাই। মুর্তুজা ভাইয়ের বাড়ীতে আসার পর তার এক বোনের নার্সিং এ কিছুটা জোকে কাটা রক্ত পড়া বন্ধ হলো। এক সপ্তাহ পরে সাতক্ষীরা ফিরি। ফেরার দুদিন পরেই ঘটে যায় জাতীয় বিপর্যয়।
    ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে আওয়ামীগের একটি গ্রুপের নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুকে স্ব-পরিবারে হত্যা করে।ঁ ৭৩ সালের র্ন্বিাচনে জাসদ প্রার্থী ডা. আজহার উদ্দীনের জয়কে ছিনতাই করে অতিউৎসাহী আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ পরাজিত খন্দকার মোস্তাককে বিজয়ী ঘোষনা করতে নির্বাচনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদেও বাধ্য করেন। সেই খন্দকারই জাতীর জনককে স্ব-পরিবারে হত্যার প্রধান সুফল ভোগী। রেডিওতে খবর শোনার পরপরই আমাদের মধ্যে একধরনের সংশয় সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় সুলতানপুরের আমার বাসার কাছাকাছি স্থানে আস্তে আস্তে জড়ো হয় কোকিল, মোহাম্মদ আলী, গোলাম রসুল, মাইকেল প্রমুখ। আমরা কেন্দ্রের নির্দেশ জানার জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত জানার দ্রুত সকলে একত্রিত হব বলে গোলাম রসুল জানান। গোলাম রসুল তখন মুলত সকল সংযোগ রক্ষা করে সমন্বয় করতো শহরের কাজগুলো।
    ৩০সেপ্টেম্বরের ও ১অক্টোবর, এ দুদিন তালার মুড়াগাছিতে জাসদ গণবাহিনীর বিশেষ সভা হয়। সভায় কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে শরীফ নূরুল আম্বীয়া ও খুকু (পরবর্তিতে সাবেক বাসদ নেতা আ ফ ম মাহাবুবুল হকের স্ত্রী) শেখ কামরুজ্জামন টুকু, জালাল ঢালী, ক্যাপ্টেন শাহাজান মাষ্টার, আবু বকর সিদ্দিক, আব্দুস সালাম, কেরামত আলী ও মোসলেম উদ্দীর প্রমুখর সমন্বয়ে দু দিস ব্যপি বিশেষ সভা হয়। সভা শেষে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এলাকা ত্যাগ করে । ২ অক্টোবর ছালাম ভাই, শাহজান স্যার সিদ্দিক ভাই ও জালাল ঢালী, মনোরজ্ঞন বড়দলে কার্তিক মন্ডল (সাবেক চেয়ারম্যান) এর বাড়ীতে যাওয়া উদ্দেশ্যে রওনা হন। কোন প্রস্তুতি ছাড়াই তাদের যাত্রা। পথে সকাল ৭ টার দিকে তারা খড়িহাটি, আশাশুনিতে বিশাল পুলিশ বাহিনীর মুখোমুখি হন। পুলিশ হঠাৎ শাহজাহান স্যারকে লক্ষ কওে গুলি ছোড়ে, স্যার গুলিবৃদ্ধ হয়ে গড়ে যান, একই ভাবে জালাল ঢালী ও আবু বকর সিদ্দিক ভাইকে গুলি করা হয়। ৩ গুলিবিদ্ধসহ ৫ জন গ্রেফতার হন। সালাম ভাই গুলিবিদ্ধ ছিলেন না। তবে পুলিশের লাঠির আঘাতে অজ্ঞান হয়ে গ্রেফতার হন। সেখান থেকে নৌকা করে তাদের আশাশুনি। আশাশুনি থেকে পরের দিন ৩ অক্টোবর লঞ্চে সাতক্ষীরা থানায় নিয়ে আসা হয়। আমরা রাতে খবর পাই। কিন্তু কোন নির্ভর যোগ্য খবর পাই না। পরদিন ভোরে হাটতে হাটতে পলাশপোল চৌধুরী পাড়ায় আসি। সান্টু ভাইসহ কয়েক জনের সাথে কথা হয়। সকলেই একই ধরনের খবর শুনেছে। ইতোমধ্যে খবর পাই তাদেরকে সাতক্ষীরাতে নিয়ে আসছে।
    আমি খবরটা নেওয়ার জন্য পাকা পোল এলাকাতে আস্তে আস্তে আসি। বেলা তখন দুপুরের কাছাকাছি। লোকেলোকারণ্য সমগ্র এলাকা। পুলিশ থানার কাছাকাছি কাউকে ভিড়তে না দেওয়ায় থানার চারধারে লোক ভর্তি। তার মধ্য দিয়ে ঠেলে কোন মতে থানার কাছাকাছি আসি। থানার পশ্চিম দিকে দরজা তখন দরজা ছিল। সামনের দিকটা তারের ঘেরা। আমি কাছাকাছি যেয়ে দেখি চারজন পরপর শুয়ে আছে। হাতে সেলাইন লাগানো তিনজনের। তিনজনই বিশাল দেহের অধিকারী হওয়ায় পা সকলের বাইরে চলে এসেছে। জ্ঞান আছে বলে মনে হলো না। মানষিক ভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। কোন মতে নিজেকে সামলে ফিরে আসি। এদিন বিকালে তাদের খুলনা নিয়ে খুলনা জেলে নেওয়া হয়।
    খুলনা থেকে ৩১ অক্টোবর ঢাকা সেন্টাল কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময়ে গুলিবিদ্ধ তিন জনের চিকিৎসা জেলের মধ্যে করা হয়, যা কোন কাজে আসে না। ইতোমধ্যে ক্ষত স্থানে পচন ধরে। কিন্তু উন্নত চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা জেল কতৃপক্ষ করতে পারে না। এ সময়ে সাতক্ষীরা আতিয়ার রহমান (যিনি শাহজান মাষ্টারের এলাকার বন্ধু ও সহযোদ্ধা ছিলেন) তিনি পোস্ট মাষ্টার জেনারেল ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের সম্মতি নিয়ে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করান। কিন্তু তত দিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সকলের পায়ের ক্ষতস্থানের হাড় বাদ দিতে হয়।
    কারাগারে ছালাম ভাইয়ের জীবনে একটি নূতন যাত্রা শুরু হয়। কারাগারে পরিচয় ঘটে আর এক বিপ্লবী নারী নেত্রীর সাথে। আমিনা সুলতানা বকুল নামের এ মেয়েটিও কারাগারে আসেন। জাসদ ও গণবাহিনীর সক্রিয় নেত্রী হওয়ায় দলের সকলে তারপ্রতি আন্তরিক ছিলেন। দু জনের ভালোলাগা ও নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তে ৭৭ সালে তাদের কারা অভ্যন্তরে বিয়ে হয়। আসম রব সহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন সেখানে। পরে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর খুলনাতে শেখ আব্দুল কাইয়ুম ভাইয়ের বাসাতে আবার আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়।
    ৭৮ সালের প্রথম থেকে জাসদ নেতৃবৃন্দ কারাগার থেকে ছাড়া পেতে শুরু করে। ছালাম ভাইও এ সময় মুক্ত হন। ছালাম ভাই এ সময় পর্যন্ত জাসদের কোন কমিটিতে ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্বাধীনতার পর গঠিত আওয়ামীলীগের সহযোগি প্রথম কৃষক সংগঠন জাতীয় কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাকালিন কেন্দ্রিয় কমিটির সহ-সভাপতি। আওয়ামীলীগের অনেক নেতাদের বিরোধীতা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু প্রথম কমিটির সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক করেন খন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহ ও হাসানুল হক ইনুকে। ৮০ সাল পর্যন্ত আব্দুস সালাম মোড়ল কৃষক লীগের কেন্দ্রিয় কমিটিতে ছিলেন।
    ৭৯ সাল থেকে জাসদ অভ্যন্তরে দুটি ধারা প্রবল আকার ধারন করে । গনতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের পক্ষে ও বিপক্ষ। সংক্ষেপে বলাহতো ডিএনজি ও এন্টি ডিএনজি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মান্না-আকতার এন্টিডিএনজির পক্ষে থাকায় ছাত্রলীগের অধিকাংশই এর পক্ষে ছিলেন। জাসদ কেন্দ্রিয় কমিটিতে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা এ ধারার পক্ষে অবস্থান নেন। দলের মধ্যে বিপ্লবী দল গঠনের দাবী প্রবল হয়। এ অবস্থায় জাসদ কেন্দ্রিয় কমিটি ১২ নেতাকে নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে। এ কমিটির পক্ষ হতে বৃহত্তর জেলা গুলোতে কর্মি সমাবেশ করা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খুলনাতে প্রথম সভা হওয়ার কথা নির্দ্ধরিত হয়। নির্দ্ধারিত দিনে খুলনা রেলওয়ে অডিটরিয়াম মিলনায়তনে সভা শুরু হয় কিন্তু কর্মিদের নানান প্রশ্ন, প্রশ্নের জবাব চাওয়া ইত্যাদি কারনে সভা ভালো ভাবে শেষ হয় না। পরে দায়িত্বশীল ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ ও জেলা নেতাদের নিয়ে মিটিং করা কথা থাকলেও মিটিং শেষে ফিরে যাওয়ার পথে একেজন বাস থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করারায় নেতৃবৃন্দ নিহত ছেলের বাড়ীতে তাৎক্ষনিক যাওয়ায় মিটিং আর হয় না। এ ঘটনার কয়েক দিন পরে জাসদের কেন্দ্রিয় সমন্বয় কমিটির পক্ষ হতে ডাকসুর ভিপি মাহামুদুর রহমান মান্না ও জিএস আক্তারুজ্জামানকে ছাত্রলীগের সকল দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের মধ্যে এ ঘটনা মারাত্মক বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়। প্রায় সকল কমিটির পক্ষ হতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবী জানাতে শুরু। কোন কোন এলাকা এ ধরনের সিদ্ধান্তকে নিন্দা জানায়। এ সময় জাসদ কেন্দ্রিয় কমিটির প্রভাবশালী সদস্য খালেকুজ্জামান ভূইয়া, আব্দুল্লাহ সরকার, ময়নুদ্দিন খান বাদল, মতিয়া চৌধুরীসহ ১১ জন পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবী জানান। খুলনা থেকে আব্দুস সালাম মোড়ল, বিপ্লব কান্তি মন্ডল, আবম নূরুল আলম সহ ১১ জন জেলা নেতৃবৃন্দ একই ধরনের বিবৃতি দেওয়ার প্রেক্ষাপটে জাসদের পক্ষ হতে ঘোষনা করা হয় এর পর এ ধরনের বিবৃতি যারা দেবেন তারা আপনা আপনি দলথেকে বহিস্কার হয়ে যাবেন। ফলে জাসদের ্িবভক্তি চুড়ান্ত হলো।

    ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর নূতন একটি সমাজতান্ত্রিক পাটির আত্মপ্রকাশ হলো খালেকুজ্জামান ভুইয়াকে আহ্বায়ক করে। কেন্দ্রিয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে মোড়ল আব্দুস সালাম ও মো¯তাফিজুর রহমান খুলনা সাতক্ষীরাতে অর্ন্তভুক্ত হন। আব্দুস সালম মোড়ল সক্রিয় ভাবে সকল কার্যক্রমে অংশ নিতেন। বাসদের দলগঠন, দলের প্রক্রিয়া ও কিছু ব্যক্তিগত ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন উপস্থাপিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দলের দায়িত্ব থেকে মাহমুদুর রহমান মান্না ও খুকু আপাকে সাময়িক অব্যহতি দেওয়া হয় ৮৪ সালের দিকে। পরে ৮৪ সালের নভেম্বরের দিকে আফম মাহবুবুল হকের পক্ষ হতে মাহমুদুর রহমান মান্না ও খুকু আপাকে সাময়িক অব্যহতি প্রত্যারের বিষয়ে বাসদ কেন্দ্রিয় কমিটির তলবী সভা আহ্বান করা হয়। এ সময় ছালাম ভাই, বাদল ভাই সিদ্দিক ভাইসহ শ্যামনগরে চিংড়ী চাষের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারনে শ্যামনগরে বেশী সময় অবস্থান করতেন। শ্যামনগর হতে ছালাম ভাই ও বাদল ভাই ঢাকাতে যেয়ে এ সভায় যোগ দেন ও পৃথক বাসদ গঠন করেন। ছালাম ভাই তখন খালেকুজ্জামান ভাইদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে মাহবুবুল হক ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন বাসদে যোগ দেন এবং একই ভাবে কেন্দ্রিয় কমিটিতে থাকেন।
    ৮০ সালে জিয়া হত্যার পরে বিচারপকি আব্দুস সাত্তারের কাছ থেকে এরশাদ ক্ষমতা দক্ষল করে নেয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাসদ ভেঙে যায়। রব ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন জাসদ এরশাদের পক্ষে থাকে। কিন্ত কাজী আরিফ, হাসানুল ইনু জাসদ (ইনু) নামে মুল জাসদ ধারার প্রতিনিধিত্ব করে। কাজী আরিফ, হাসানুল ইনু নেতৃত্বাধীন জাসদ (ইনু) এরশাদ বিরোধী বাম জোটের সাথে থাকে।
    ১৯৮৬ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাসদে আবার বিভক্তি হয়। কাজী আরেফ, শাহাজান সিরাজ, ইনু ভাইয়ের নেতৃত্বে প্রধান ধারার জাসদ। মূলত সিরাজুল আলম খান এরশাদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় নেওয়ায় এ বিভক্তি সৃষ্টি হয়। রব ভাই, জিকু ভাই সিরাজুল আলম খানের সিদ্ধান্তের দিকে থাকেন। এর পরপরই সালাম ভাই বাসদ (মাহবুব) ত্যাগ করে রব ভাইয়ের সাথে যুক্ত হন। ৮৬ সালে এরশাদেও নেতৃত্বে জাতীয় নির্বাচনের সুচনাকালে তিনি জাসদ রব গ্রুপে যোগদেন এবং জাসদ রবের পক্ষে সংসদ নির্বাচনে তালা-কলারোয়া আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
    আসম আব্দুর রব ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন জেএসডিতে যোগ দেওয়ার পরপরই সালাম ভাইয়ের জীবনে পারিবারিক বিপর্যয় নেমে আসে। এ সময় বকুল ভাবি সালাম বাইকে ছেড়ে চলে যায়। একমাত্র কন্যা মায়ের সাথে থেকে যান। পরবর্তীতে সালাম ভাই বিয়ে করেন জিকু ভাইয়ের নিকট আত্মীয়কে। এ বিয়ের পওে সালাম ভাই কানাইদিতে ফিওে আসেন। এখানে তার পৈত্রিক বাড়ী। পাইকগাছা আদালতে প্রাকটিস করার জন্য আগেই ফিরে বিপ্লব কান্তি মন্ডল কপিলমুনি(নাসিরকুড়), পাইকগাছাতে বসবাস শুরু করেন। মোড়ল আব্দুস সালাম এর স্ত্রী বিপ্লব মন্ডলের সাথে যোগাযোগ করে কয়েক কাটা জমি ক্রয় করে সেখানে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন।
    জেএসডির সাংগঠনিক কাঠামোয় থাকলেও তিনি বাসদ কেন্দ্রিক বাম ধারার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন আবারও। সিরাজুল আলম খানের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল প্রগাঢ়। যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। র্প্বূ পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাথে তাঁর সম্পর্ক ও মুক্তিযুদ্ধে তার ভ’মিকা এ আলোচনায় বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবন আলোচনায় সেটি সম্পৃক্ত করা হবে।
    এক বনাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী সংগ্রামী মানুষ ছিলেন সালাম ভাই। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে জীবনের বিলাসিতার সকল সুযোগকে অবলিলাক্রমে ঠেলে দিতে পেরেছিলেন। জীবনের একমাত্র চাওয়া সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাংখায় আপোষহীন থাকতে নূতন করে পথ খুজে ফিরেছেন। নানান পথ পরিক্রমায় আকা বাকা রাস্তা দিয়ে চললেও কখনো ব্যক্তি লোভ, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার সুবিধাবাদী চিন্তায় নিজেকে যুক্ত করেন নি। সৎ, নির্লোভ এবং বৈষম্যহীন সমাজের মূল্যবোধের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছেন সেই পথেই তিনি হেটেছেন মাথা উচু করে। পরবর্তীতে স্থানীয় মানুষের সংকট সমস্যায় তিনি একজন সক্রিয় সমাজ সংস্কারের ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এখানেও তিনি ছিলেন সামাজিক মূল্যবোধের ধারক। এ সময় তিনি ব্যপক পড়াশুনা শুরু করেন।
    তাকে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার কথা শেষ করছি।

    লেখক: ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক, জাতীয় কৃষক জোট কেন্দ্রিয় কমিটি।

  • আহত সেনাপতি আবু তাহের এবং একটি চিরকুট

    আহত সেনাপতি আবু তাহের এবং একটি চিরকুট


    সৈয়দ মনিরুজ্জামান
    মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর ১১-এর অধিনায়ক মেজর (পরে কর্নেল)আবু তাহের। সেক্টরের সদর দফতর মেঘালয় রাজ্যের তুরা পাহাড়ের সীমান্তঘেষা মহেন্দ্রগঞ্জে। মহেন্দ্রগঞ্জ, মানকারচর, পুরাকাশিয়া, সাঙ্গু ও বাগমারা-এই পাঁচটি ‘সাব-সেক্টর’ নিয়ে গঠিত হয় সেক্টর-১১। মেজর আবু তাহের উল্কার মত ছুটে প্রতিদিন প্রতিটি ‘সাব-সেক্টর”-এ পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। সে এক বিস্ময়কর যোগ্যতা।
    ১৪ নভেম্বর ১৯৭১। ঘটনাবহুল ১১ নম্বর সেক্টরে ঐতিহাসিক কামালপুর যুদ্ধের অবিস্মরণীয় এক দিন।
    ১৩ নভেম্বর গোপন সংবাদে জানা গেল কামালপুর বিওপির উত্তর দিকে ভারতীয় বেড়িবাঁধ সংলগ্ন কিছু বাঙ্কার থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা সরে গেছে। এই সংবাদের ভিত্তিতে সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের ঐ বাঙ্কারগুলোতে অবস্থান নিয়ে কামালপুর দখল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হেলাল কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা একটি গ্রুপ নিয়ে রাত সাড়ে দশটায় মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে গেল। বেড়িবাঁধ অতিক্রম করে কামালপুর পোস্টের উত্তর-পূর্ব কোণে পাকিস্তানীদের পরিত্যাক্ত বাঙ্কারগুলোতে অবস্থান নিল।
    উত্তর পূর্ব দিকে প্রথম বাঙ্কারে মেজর তাহের, তাঁর দেহরক্ষী বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সিপাহী এবং তাঁর দুই ভাই বেলাল-বাহার। হেলাল কোম্পানির কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও একই সাথে অবস্থান নেয়। কয়েকশত গজ দূরে পশ্চিম দিকের বাঙ্কারগুলোতে হেলাল, লতা, মিঠু, সুজাসহ আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান গ্রহণ করে। কামালপুর বিওপির মুখোমুখি ধানুয়াতে আবেদীন কোম্পানির জয়নাল আবেদীন, লেফটেন্যান্ট মিজান, সাঈদ কোম্পানির সাঈদ (তাহেরের ছোট ভাই), ক্যাপ্টেন মান্নান ও হারুন-হাবীব সহ আরো অনেকে তাদের গ্রুপ নিয়ে বিভিন্ন “হাইড আউটে” আগে থেকেই অবস্থান করছিল।
    প্রত্যেক গ্রুপের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় রক্ষার জন্যে ছিলো কয়েকটি ‘ওয়াকিটকি’। মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে আমার হাতে ছিলো আরেকটি সেট। প্রত্যেকটি গ্রুপের সাথে আমি যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলাম। বেড়িবাঁধের উত্তর পাশে মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে মিত্রবাহিনীর ১৩ গার্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ফায়ারিং দিয়ে ঐতিহাসিক অপারেশনটিকে ‘কভারেজ’ দিচ্ছিল। পরিকল্পনাটি আগেই করা হয়েছিল।
    ভোররাত ৩টা ৪৫ মিনিটে অপারেশন শুরু হল। সকাল সোয়া সাতটা পর্যন্ত দু’পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গুলিবিনিময় হলো। কিন্তু এতো প্রচন্ড গোলাগুলির পরও হানাদার বাহিনী তাদের বাঙ্কার থেকে উঠে আসেনি। ১৪ নভেম্বর সকাল সাড়ে আটটার দিকে মেজর তাহের তাঁর বাঙ্কার থেকে উঠে লে. মিজান ও হেলালের পজিশনে আসেন। তাদের কোন অবস্থাতেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে উঠে না যাওয়ার নির্দেশ দেন। এ সময় ধানুয়া ‘হাইড আউটের’ কোম্পানি কমান্ডার আবেদীন এগিয়ে এসে মেজর তাহেরের সাথে কথা বলতে থাকেন। সকলের সাথে কথা বলতে বলতে তাদের বাঁধের কাছে ঘাসের ওপর বসে পড়েন। মুহূর্তেই প্রচন্ড একটি শব্দ হয় এবং সকলের সামনেই মেজর তাহের মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। উপস্থিত সকলেই মনে করেন, কোন একটি মর্টার সেলের আঘাত- আবার কেউ কেউ মনে করেন যেখানে তাহের লুটিয়ে পড়েন সেখানে একটি ‘এন্টি পারসোনাল মাইন’ ছিল। সে যাই হোক, তাঁর বাম পায়ের হাঁটুর উপরের অংশ প্রায় দ্বিখন্ডিত হয়ে সামান্য কিছু শুধু চামড়ার সাথে ঝুলে থাকে।
    এ ঘটনায় উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা হতভম্ব ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে এই মর্মান্তিক খবর। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ থেমে যায়। সে বারে কামালপুর বিওপি থেকে পাকিস্তানীদের হটিয়ে দেয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু কি আশ্চর্য, এত রক্তপাতের পরও মেজর তাহের সংজ্ঞা হারান নি। তিনি আঘাতপ্রাপ্ত অংশটিকে গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিতে বললেন যেন রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। দু’তিন জনকে তাঁর কাছে থাকবার এবং বাকী সবাইকে যার যার অবস্থানে চলে যেতে বললেন।
    এরপর গামছা দিয়ে বেঁধে রাইফেলের বাঁট দিয়ে ঝুলিয়ে বহু কষ্টে বাঁধের ওপারে ভারতীয় সীমানায় আনা হয় আহত তাহেরকে। আসার সময় জয়নাল আবেদীনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা এসো না-কামালপুর আজ দখল করতেই হবে।’ ভাবতে অবাক লাগে এ অবস্থায় এমন সঠিক নির্দেশ দেয়া কী ভীষণ মনোবলের পরিচয় বহন করে একজন সেনাপতির!
    এ সময় ক্যাম্পে বসে আমি প্রতিটি গ্রুপের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলাম। প্রায় ন’টার দিকে ক্যাপ্টেন মান্নান জানতে চাইলেন আমি মেজর তাহেরের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পেরেছি কিনা। তিনি জানালেন কয়েকবার চেষ্টা করেও তিনি লাইন ধরতে পারেন নি।
    কিছুক্ষণ পর আমি লে. মিজানের লাইন পেলাম। ধরেছিল কোম্পানি কমান্ডার হেলাল। হেলাল কান্নাজড়িত কন্ঠে মেজর তাহেরের অবস্থা জানাল এবং সেক্টর কমান্ডারকে সরিয়ে নেয়ার জন্যে এম্বুলেন্স পাঠাতে বলল। আমি বিএসএফের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নিয়োগীর সাথে যোগাযোগ করে এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করি। তিনি জানালেন, তিনি আগেই খবরটি পেয়েছেন এবং এম্বুলেন্স ইতিমধ্যেই পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
    এক ঘন্টা পর হেলালের সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হলাম যে, মেজর তাহেরকে বাঁধের এপারে নিয়ে এসে এম্বুলেন্সে তুলে দেয়া হয়েছে। মিত্র বাহিনীর মেজর মুখার্জী (ডাক্তার) নিজেই এম্বুলেন্স নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের মেডিক্যাল কোরের মুক্তিযোদ্ধা নাসিরকে এম্বুলেন্সের সাথে দেয়া হয়েছে। সেক্টরের ডাক্তার প্রেমাংকুর রায়ও এসেছেন। ডা. মেজর মুখার্জী মেজর তাহেরকে শিলিগুড়ি হাসপাতালে নিয়ে যান। ক্যাম্পে আমি দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠায় পায়চারি করে কালক্ষেপণ করছি মাত্র। কিছুই যেন করার নেই। এমন সময় সেন্ট্রি মহেন্দ্রগঞ্জ থানার একজন পুলিশকে আমার কাছে নিয়ে এলো। সে আমাকে ভাঁজ করা একটি কাগজ হাতে দিয়ে বলল, থানার ও.সি. সাহেব পাঠিয়েছেন। চিরকুটটি হাতে নিয়ে পড়লাম।
    হাতের লেখা স্পষ্ট, সুন্দর-কিন্তু আমার পরিচিত নয়। পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, আহত তাহেরকে নিয়ে যে এম্বুলেন্সটি যাচ্ছিল, মহেন্দ্রগঞ্জ থানার সামনে থামিয়ে থানার ও.সি.কে ডেকে একজন ডাক্তার চিরকুটটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছে দিতে বলেন।
    ঘটনার সাত-আটদিন পর ডাক্তার মেজর মুখার্জীর সঙ্গে মহেন্দ্রগঞ্জে আমার দেখা। তিনি কিছুক্ষণ সময় দিলেন। জানতে চাইলাম ১৪ নভেম্বর মেজর তাহেরকে কেমন দেখেছেন। জবাবে মেজর মুখার্জী বললেন, “কি বলব মেজর তাহেরের কথা। আমি সামরিক বাহিনীর ডাক্তার-যুদ্ধাহত সৈনিক নিয়েই আমার কারবার। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে যুদ্ধাহত কত সৈনিকই তো দেখলাম কিন্তু মেজর তাহেরের মত একজনও দেখিনি। অমন আহত অবস্থায় রোগীরা যন্ত্রণায় চিৎকার করে- বাবাগো, মাগো, আল্লাহ-ভগবান বলে বিলাপ করে। কিন্তু তাহেরকে যখন এম্বুলেন্সে উঠালাম-তিনি নিশ্চুপ তাকিয়ে ছিলেন, আমায় দেখলেন। ভাবলাম, অধিক রক্তক্ষরণে নির্জীব হয়ে গেছেন। আমি তাড়াতাড়ি স্যালাইনের ব্যবস্থা করলাম। এম্বুলেন্স নিয়ে যখন বাঁধরোড অতিক্রম করে মহেন্দ্রগঞ্জ থানার কাছে এসেছি-তিনি জানালা দিয়ে চারদিকে তাকালেন। এরপর আমাকে বললেন- উড়পঃড়ৎ, ও ংঁঢ়ঢ়ড়ংব ও ধস হবধৎ ঃড় গবযবহফৎধমধহল ঞযধহধ?
    আমি বললাম, ‘ণবং’
    বললেন ঝঃড়ঢ় ঃযব াবযরপষব. গাড়ি থামানো হল। তিনি বললেন, ‘চষবধংব ঃধশব ধ ঢ়রবপব ড়ভ ঢ়ধঢ়বৎ ধহফ ৎিরঃব যিধঃ ও ংধু.’
    তাঁর নির্দেশমতো কাগজ কলম নিয়ে লিখলাম তিন লাইনের একটি চিঠি। তাঁর পরামর্শমতোই চিরকুটটি থানার ওসিকে দেয়া হলো, যা আপনি পেয়েছেন। তারপর থেকে সেদিনকার ঘটনাটি আমি অনেক ভেবেছি। অমন মারাত্মক আহত অবস্থায় একজন মানুষ অমন সুচিন্তিত কথা বলতে পারে-নির্দেশ দিতে পারে-তা আমি আজও ভাবতে পারি না। আমার মনে হয়-ওঃ ধিং হড়ঃ গধল. ঞধযবৎ ঃধষশবফ ঃড় সব ৎধঃযবৎ রঃ ধিং যরং রহারহপরনষব রিষষ ঢ়ড়বিৎ ধহফ ফবঃবৎসরহধঃরড়হ যিড় ঃধষশবফ. অমন সাহসী ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী মানুষ আমি দেখিনি!”
    দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মার্চ ১৯৭২ মেজর তাহের পুনা হাসপাতাল থেকে দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তাঁর বাসায় দেখা করতে গেলাম। পুনা হাসপাতালে চিকিৎসার কথা, ‘ফলস’ পা লাগানোর কথা তাঁর মুখে বিস্তারিত শুনলাম। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে দেখতে পুনা হাসপাতালে গিয়েছিলেন এবং কেমন আন্তরিকতার সাথে তাঁর চিকিৎসার খোঁজ খবর নেন, সে ঘটনা বর্ণনা করলেন তিনি।
    মেজর তাহেরের সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তিনি হাসতে হাসতে বললেন,- ‘জামান, আমার জন্ম হয়েছে ১৪ নভেম্বর, পঙ্গু হলাম ১৪ নভেম্বর, মনে হয় আমার মৃত্যুও হবে কোন এক ১৪ নভেম্বর।’
    তাই কি হয়েছিল?
    প্রত্যেক ২১ জুলাই কর্নেল তাহেরের স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে আমার মনের আকাশে। আর ভাবি, তাই কি হয়েছিল?
    -সান ফিচার সার্ভিস

  • সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ খিচ্চু : তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা

    সৈয়দ জাফর সাজ্জাদ খিচ্চু : তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা

    আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম:
    জাসদ পরিবারে আমাদের সবার প্রিয় খিচ্চু ভাইয়ের ছবি হয়ে যাওয়ার ১২ বছর হবে আগামীকাল ১৬ জুলাই। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর ছাত্র নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শ্রমিক নেতা, জননেতা ও জাসদের দুই মেয়াদের সাধারণ সম্পাদক। ২০১০ সালের এইদিন রাতে মিরপুর রূপনগরে বাসায় আকস্মিকভাবে মারাত্মক হার্টঅ্যাটাকে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। তাঁর হার্টে সামান্য সমস্যা ছিল; এজন্য একটা স্টেন্টও বসানো হয়েছিল; তারপর ভালই ছিলেন; কার্ডিওলজিস্টের সাথে নিয়মিত ফলো-আপ করতেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য— দীঘল দেহের মানুষটিকে আমরা হারিয়ে ফেললাম। পৃথিবীতে সব শূন্যস্থানই পূর্ণ হয় সময়ের সাথে। কিন্তু কিছু শূন্যস্থান পূর্ণ হবার পরও শূন্য হবার দাগচিহ্ন থেকে যায়।

    জাসদের রাজনীতি ও সংগঠনে খিচ্চু ভাই চলে যাওয়ার শূন্যস্থানে অমোচনীয় দাগচিহ্ন থেকে গেছে। কারণটা কী? খিচ্চু ভাই ছিলেন দলকেন্দ্রীক মানুষ, সাধারণ কর্মীকেন্দ্রীক মানুষ, দলের অফিসকেন্দ্রীক মানুষ। সহজেই দলের যে কেউ খিচ্চু ভাইয়ের কাছে যেতে পারতেন। নির্ভয়ে কথা বলতে পারতেন। এর জন্য কোনো আনুষ্ঠানিকতা লাগতো না, আয়োজন করা লাগতো না, ঘটা করাও লাগতো না। যে কারণে কথা— তার সহজ উত্তর ও সরল সমাধান পেতেও সময় লাগতো না। কারণ, খিচ্চু ভাই রাজনীতি ও দল করাকে জটিল-কঠিনভাবে দেখতেন না।

    তাঁর কাছে রাজনীতি করা ও দল করার মানেই ছিল দলের বক্তব্য ও কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে যাওয়া, মানুষকে বুঝিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করা। মানুষের বিপদে-সংকটে পাশে-সাথে থাকা। মানুষের মনের মধ্যে যে কথাগুলো ঘুরপাক খায়— সেগুলো যেন তারা গুছিয়ে বলতে পারেন সেটা শিখিয়ে দেয়া। এটুকু করতে পারলেই রাজনীতি ও দলের কাজ করা শুরু হয়ে গেলো। এটা করার সিদ্ধান্ত নেয়া আর লেগে থাকাটাই হচ্ছে কঠিন। যিনি পারেন— তিনি নিজের ক্ষুদ্র পরিসরে কর্মী আর কর্মী থেকে নেতা হন— ধীরে ধীরে তাঁর পরিসর বাড়ে— বড় নেতা হন। তিনি বলতেন নেতা মানে পদ না, দায়িত্ব।
    খিচ্চু ভাইয়ের মনের চিন্তা, মুখের কথা, বক্তৃতার ভাষা, কাজ, আচরণ, চালচলন ও জীবনযাপনের এক ও অভিন্ন দর্শন ছিল। আর তা হলো— দেশপ্রেম ও সমাজতন্ত্র। তিনি অত্যন্ত সহজ সরল সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। তিনি অকৃতদার ছিলেন। তাঁর জীবনযাপনের চাহিদা ছিল খুব সামান্য ও সাধারণ। খিচ্চু ভাই ব্যক্তিগত সম্পদ ও সম্পত্তির মালিক হবার সকল লোভের ঊর্ধ্বে ছিলেন। তাঁর এই জীবনদর্শনের ভিত্তি ছিল সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে খিচ্চু ভাইয়ের কোনো ছাড় ছিল না।

    জাসদের প্রতিষ্ঠাতা, পিতৃপুরুষ ও বড় বড় নেতারা তাদের নিজেদের দলকে পরিত্যাগ-পরিত্যক্ত করে নিজেদের সুবিধামতো দল করেছেন, বিভিন্ন দলে চলে গিয়েছেন। কিন্তু খিচ্চুভাই জাসদকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বুক দিয়ে আগলে রেখেছিলেন।

    কীভাবে তাঁর এই জীবনের শুরু?

    ১৯৪৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার রতুয়ায় নানাবাড়িতে তাঁর জন্ম। জন্মের ১৮ মাস পর মা শেখ সাইরুন্নেসা তাঁকে নিয়ে চলে আসেন পাকশিতে স্বামী সৈয়দ শামসাদ আলীর কাছে। খিচ্চু ভাইরা ছিলেন ৫ ভাই ও ৩ বোন। তাঁর বাবা রেলওয়ের প্রথম শ্রেণির কন্ট্রাক্টর ছিলেন। খিচ্চু ভাইয়ের বাবা-দাদার আদিবাড়ি পশ্চিমবঙ্গ— অধুনা ঝাড়খন্ডের রাজমহলে। তাঁর বাবা রেলওয়ের কন্ট্রাক্টরি ব্যবসার কারণে পাকশিতে চলে আসেন ১৯৩৫ সালে। পাকশি কেন বিখ্যাত সবারই জানা। পদ্মা নদীর উপর ব্রিটিশরাজ নির্মিত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পাকশিতেই। আর এই ব্রিজকে কেন্দ্র করে বৃটিশ আমল থেকেই পাকশি একটি রেল সিটি। আধুনিক শিল্প নগরী।

    খিচ্চু ভাইয়ের বাবা ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের জেলখাটা কর্মী। তাঁর দাদা সৈয়দ গওহর আলী ও দাদার বাবা সৈয়দ আনোয়ার আলী ছিলেন রাজমহলে বড় ভূস্বামী। তারা মালদা শহরে একটি বড় বাসভবন নির্মাণ করে সেখানেই বসবাস করতেন। বর্তমানে মালদা জেলা সার্কিট হাউস ভবনটিই ছিল খিচ্চু ভাইয়ের দাদার বাসভবন।

    পাকশির নাগরিক পরিবেশেই খিচ্চু ভাইয়ে শৈশব-বাল্য-কৈশোর-যৌবন কেটেছে। পাকশির চন্দ্ররভা স্কুলে তিনি লেখা পড়া করেন। ৯ম শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৬৫ সালে ছাত্রলীগে যোগদান করেন। সে বছরই পুলিশি নিষেধাজ্ঞা ভেঙে একুশের প্রভাতফেরি করতে গিয়ে গ্রেফতার হন এবং কারাবরণ করেন। ১৯৬৬ সালে মাধ্যমিক পাস করে ঈশ্বরদী সরকারি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি উচ্চমাধ্যমিক ও বি.কম. পাস করেন। ১৯৬৮-৬৯ শিক্ষাবর্ষে ঈশ্বরদী কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ মনোনীত প্যানেল থেকে ভিপি পদে নির্বাচন করে তিনি বিপুল ভোটে বিজয়ী হন।

    ষাটের দশকে ঈশ্বরদী ছিল চীনপন্থী বাম অধ্যুষিত এলাকা। এ এলাকায় ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ করা অত্যন্ত দরূহ ছিল। খিচ্চু ভাইয়ের হাত ধরেই ঈশ্বরদীতে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের উত্থান ঘটে।

    ১৯৭০ সালের ৭ জুন স্বাধীকার দিবসে ছাত্রলীগ কর্তৃক জয়বাংলা বাহিনীর মার্চপাস্টে প্রথম প্রদর্শনের পর ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব স্বাধীনতার পতাকা প্রদর্শন করেন। তার দু’দিন পর ৪ মার্চ পাকশি রেলওয়ে ময়দানে খিচ্চু ভাই স্থানীয়ভাবে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।

    ১৯৭১ এর ২৯ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঈশ্বরদীর বাঁশের বাধা নামক স্থানে সম্মুখ যুদ্ধের মাধ্যমে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয় এবং খিচ্চু ভাইয়ের সহযোদ্ধা রঞ্জু ও গফুর শহীদ হন। এরপর তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে রিট্রিট করে ভারতে চলে যান।

    ভারতে এফএফ-এর ট্রেনিং নিয়ে ৩০ জনের ট্রুপস নিয়ে আবার দেশের অভ্যন্তের প্রবেশ করেন। তিনি এফএফ ঈশ্বরদী থানার কমান্ডারের দায়িত্ব পান। পরবর্তীতে বিএলএফ-ও তাকে ঈশ্বরদী থানার কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়। মুক্তিযুদ্ধে খিচ্চু ভাইসহ মাত্র কয়েকজন ব্যতিক্রম আছেন— যাঁরা একই ব্যক্তি হিসেবে এফএফ ও বিএলএফ দুই বাহিনীর থানা কমান্ডারের দায়িত্ব পান; এবং এসব ক্ষেত্রে দুই বাহিনী একই কমান্ডে মুক্তিযুদ্ধ করে।

    খিচ্চু ভাইয়ের দুর্ভাগ্য সদ্য স্বাধীন দেশে তিনি বেশিদিন এলাকায় থাকতে পারেননি। আওয়ামী লীগ ও চীনপন্থী আলাউদ্দিন বাহিনী তাঁকে হত্যা করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এরকম পরিস্থিতিতে দলের নির্দেশে ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। মোহাম্মদ শাহজাহান ও রুহুল আমিন ভুইয়ার সাথে শ্রমিক লীগের কাজের সাথে যুক্ত হন। জাসদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলে তিনি তাতে শ্রম বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮৩ সালে জাসদের ভাঙণ হলে তিনি জাসদ (রব) গ্রপের সাথে যুক্ত ছিলেন।

    ১৯৯৭ সালে জাসদ ঐক্যবদ্ধ হবার পর তিনি দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন। ২০০২ সাল এবং ২০০৫ সালের কাউন্সিলে পরপর দুইবার জাসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি ১৪ দল গঠনের উদ্যোগের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং ১৪ দলে জাসদের প্রতিনিধি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান পিপলস ফোরাম-বিবিপিপিএফ-এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। সাধারণ থেকে রাজনীতিতে অসাধারণ হবার অনন্য নজির খিচ্চু ভাই। জাসদের সংগ্রামী রাজনীতি ও গণমানুষের রাজনীতির প্রতীক হয়েছিলেন তিনি।

    ভুলি নাই, ভুলবো না— খিচ্চু ভাই।
    অভিবাদন আপনাকে।
    আপনি আমাদের কাছে এখন শুধু ছবি নন। একজন আদর্শ।

    -লেখকঃ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, জাসদ।

  • তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে নির্মূল কমিটির ভূমিকা

    আজ থেকে ২৮ বছর পূর্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার মধ্যে দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং দ্বিতীয়টি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। ২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুসারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করে। কয়েকজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে, এবং বাকীদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান। কিন্তু অন্য গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।

    অনেকে মনে করেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর মধ্যে দিয়ে নির্মূল কমিটির কাজ সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু আদতে তা হয়নি। এখনও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। যতদিন না বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে ততদিন নির্মূল কমিটির আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

    কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সফল করতে হলে তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বে এগিয়ে আসতে হবে। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের গণআদালতে বিচারের মধ্যে দিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলন একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ১৯৭২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন দেশের রাজপথে শহীদ পরিবারের সদস্যরা প্রথম মিছিল করে তাদের দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন। সে দাবি তখন ছিল মুষ্টিমেয় স্বজন হারানো শহীদ পরিবারের। ক্রমশ এই দাবি সাধারণ মানুষের মধ্যে আবেদন সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বিস্তার লাভ করে।

    বঙ্গবন্ধু দালাল আইন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি দেশে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আনুকূল্যে যুদ্ধাপরাধীরা সমাজ ও রাষ্ট্রে পুনর্বাসিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারার রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলে। কিন্তু এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও শহীদ পরিবার ও সুশীল সমাজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।

    ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত করার পর সুশীল সমাজ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। প্রতিবাদের ফলস্বরুপ ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এই কমিটি ২৬ মার্চ প্রকাশ্য গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার করে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করে তৎকালীন বিএনপি-জামায়েত জোট সরকারকে তা বাস্তবায়নের অনুরোধ জানায়। কারণ গণআদালত কোনো প্রচলিত আদালত ছিল না, যে তারা রায় বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার রায় বাস্তবায়ন না করে উল্টো শহীদজননীসহ নির্মূল কমিটির ২৪ জন নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করে। হামলা-মামলা দিয়ে নির্মূল কমিটিকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। গণতদন্ত কমিশন গঠন করে পর্যায়ক্রমে ১৬জন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর অপকর্ম জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়।

    রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা মাথায় নিয়ে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন শহীদ জননী মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য চলমান আন্দোলন স্তিমিত হলেও বন্ধ হয়ে যায়নি। তখন তরুণ প্রজন্মকে সাথে নিয়ে এই আন্দোলন অব্যাহত রাখেন শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, শহীদজায়া শ্যামলী নাসীর চৌধুরী, কাজী মুকুলসহ অন্যরা। এই সময়ে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করার জন্য নির্মূল কমিটি ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র’ ও ‘শহীদ স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে নতুন করে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্মূল কমিটি ও অন্যান্য সমমনা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহায়তায় জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগী সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। ফলস্বরূপ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে।

    ক্রমশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি শহীদ পরিবার ও সুশীল সমাজের গণ্ডীর বাইরে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্মূল কমিটির শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। তরুণ প্রজন্ম এই আন্দোলনে যোগদান করে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবিকে নতুন মাত্রা দেয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্মূল কমিটির শাখা গঠন করে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করার কাজ এগিয়ে চলে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও ছাত্রদের নিয়ে কমিটি গঠন করে তাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত করার চেষ্টা অব্যাহত থাকে।

    এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মহাজোটকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা সরকার গঠনের পর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদের মোল্লার রায়ের প্রতিবাদে শাহবাগে গণজাগরণমঞ্চ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি তাদের ঘৃণা এবং বিচারের প্রতি তাদের দৃঢ়তা প্রকাশ করে। জয় বাংলা স্লোগান আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে। শহীদ জননীর ছবি সামনে রেখে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে জেগে ওঠা শাহবাগ কাদের মোল্লাসহ শীর্ষ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রত্যক্ষ করেছে। তরুণরা প্রমাণ করেছে তারা শহীদ জননীর আন্দোলনের সন্তান।

    গত ২৮ বছরের আন্দোলনের ভেতর দিয়ে নির্মূল কমিটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত একটি প্রজন্ম সৃষ্টি করতে পেরেছে। আন্দোলনে যৌথ নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে কেন্দ্র থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে নির্মূল কমিটির যাত্রা শুরু হয়েছে এবং শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে আন্দোলনের সফলতা এসেছে। এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তরুণ প্রজন্মকে সাথে নিয়ে নির্মূল কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। ২০২০ সাল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘মুজিব বর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছে। শহীদ জননীন আন্দোলনের সন্তান তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন সত্যি হবে। মুজিব বর্ষে এই প্রত্যাশা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

    লেখক তপন পালিত সূত্র বিডিনিউজ২৪ডটকম

  • শেখ হাসিনা ফিরেছিলেন বলেই বাংলাদেশ এগিয়েছে

    শেখ হাসিনা ফিরেছিলেন বলেই বাংলাদেশ এগিয়েছে

    ড. কাজী এরতেজা হাসান

    ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নরঘাতকরা ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। এ সময় বিদেশে থাকায় আল্লাহর অশেষ রহমতে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে বাঙালি জাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু করে ঘাতকগোষ্ঠী। বাঙালি জাতির জীবনে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসে ঘোর অমানিশার অন্ধকার। ঠিক এমনই ক্রান্তিলগ্নে ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
    দেশমাতৃকার মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার পবিত্র দায়িত্ব অর্পণ করা হয় জাতির জনকের কন্যার হাতে। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বকে ভয় পায় ঘাতকগোষ্ঠী। খুনি সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করতে না দেওয়ার জন্য সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে প্রিয় স্বদেশভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসন শেষে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে ফিরে আসেন শেখ হাসিনা। দেশে ফিরে তিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
    ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঝড়-বাদল আর জনতার আনন্দাশ্রুতে অবগাহন করে শেরে বাংলা নগরে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনার জবাবে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির জনকের হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই। আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেলসহ সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তা বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়, মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’
    ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন দীর্ঘ সংগ্রাম শুরু হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে চলে তার একটানা অকুতোভয় সংগ্রাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ন্যায় বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা যখনই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন তখন এদেশের মাটি ও মানুষের কল্যাণে বাস্তবায়ন করেছেন বহুমাত্রিক উদ্যোগ। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি অগাধ প্রেম এবং অক্ষয় ভালোবাসাই হলো তার রাজনৈতিক শক্তি।
    বৈশ্বিক মহামারি করোনা সংকটের এই ক্রান্তিলগ্নেও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা জনগণের জীবন-জীবিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিঃস্বার্থভাবে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে জাতির অভিভাবক হিসেবে ৩১-দফা নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। জনগণের জীবন-জীবিকা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা ধরে রাখার জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। যা জিডিপির ৩.৬ শতাংশ। করোনা সংকটের সময় কেউ যেন না খেয়ে থাকে সেজন্য ব্যাপক খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করেছেন। ৫০ লাখ পরিবারকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নগদ অর্থ সহায়তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
    উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে ৫ বছর দায়িত্ব পালন করেন শেখ হাসিনা। এরপর ২০০৮ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তিনি। বাংলাদেশে পরপর ৩ বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এবং ৪ বার প্রধানমন্ত্রী থাকার নজির আর কারও নেই। গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশে নিকষ অন্ধকার ছিল জাতির পিতা হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সময়গুলো। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে ইতিহাসের নারকীয় পাশবিকতায় সপরিবারে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় খোদ স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টাকেই। চরম রকমের বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশেও, ভাগ্যলিখনে সেদিন বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা। পিতৃহত্যার প্রতিশোধের আগুন বুকে চেপে নির্বাসিত ফেরারি জীবনে স্বজন হারানো দুই বোনের ঠিকানা ছিল বিদেশের মাটি; দেশান্তরে উদভ্রান্ত যাত্রায় ছয়টি বছর কেটে গেছে তাদের। জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা দলের সিদ্ধান্তে এক বজ্রকঠিন ব্রত নিয়ে ১৯৮১ সালে দেশের মাটিতে পা রেখেছিলেন।
    আজ থেকে ৪০ বছর আগে উদারনৈতিক প্রগতিশীলতার রাজনীতির পরিবেশ ফিরিয়ে, দেশ ও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নেওয়ার জন্য, জননী শেখ হাসিনা ত্যাগ করেছিলেন সন্তানদের মায়া পর্যন্ত! মাতৃসঙ্গ বঞ্চিত তাঁর দুই সন্তান তখন বিদেশে ছোট বোন রেহানার কাছে। গণতন্ত্র আর সুবিচার নিশ্চিত করার যুদ্ধে তখন বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রতিকূল রাজনৈতিক বাস্তবতায় দলের সাংগঠনিক পুনর্গঠন। বাংলার মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের সংকল্পে শেখ হাসিনার স্বদেশে ফেরার দিনটি ইতিহাসের এক বড় সূচনাক্ষণ নতুন অধ্যায়ের। পরতে পরতে সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু কন্যার রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতা ফেরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগের হাতে। দলীয় প্রধান হিসেবে ইতিহাস তার কাঁধে সমর্পণ করেছিলো জাতির কাণ্ডারি হবার দায়ভার। সেই থেকে দারিদ্র্যক্লিষ্ট এই জাতিকে মুক্তি দিতে বিরতিহীন যাত্রা একজন শেখ হাসিনার। দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করে সবার বাসোপযোগী করা প্রগতির স্বপ্ন বাস্তবায়নের সেই যাত্রা রাজনৈতিক-পারিপার্শ্বিক আর প্রাকৃতিক শত প্রতিকূলতাতেও হার মানাতে পারেনি দৃঢ়চেতা এই নেত্রীকে। প্রত্যাবর্তনের চার দশকে ব্যক্তি শেখ হাসিনাকে বরাবরই দেখা গেছে কল্যাণমুখী মানসিকতায় যেকোনো দুর্যোগ পরিস্থিতিতে সব সামলে নেওয়ার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ভূমিকায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশের জন্য সুকৌশলে তিনি যুদ্ধ করে চলেছেন প্রাকৃতিক আর মনুষ্যসৃষ্ট সব বাধা-বিপত্তির বিপরীতে। পিতৃহারা শেখ হাসিনা যখন ঢাকায় ফিরেছিলেন সে সময়টাতেও প্রকৃতি ছিলো এক রুদ্র মূর্তির বার্তাবরণে। কালবৈশাখীর ঝড় সামলে চলার শুরু হয়তো সেই থেকেই। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা চতুর্থ বারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজও মুখোমুখি এক অদৃশ্য ঝড়ের। নানান সূচকে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল সত্যিকারের সোনার বাংলা হয়ে উঠতে, ঠিক তখনই বৈশ্বিক মহামারির বাধা এসে হাজির। সংক্রমণ প্রবণ এক জীবাণুর (করোনাভাইরাস) বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এখন পুরো জাতি। এর মধ্যেও থেমে নেই এর করাল গ্রাস থেকে উত্তরণের চেষ্টা; যার নেতৃত্বও দিচ্ছেন সেই বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
    করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে যখন দেশে ক্রমে বেড়েই চলেছে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। ঠিক এর শুরু থেকেই এ যুদ্ধের জন্য দেশবাসীকে প্রস্তুত করেছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। সংক্রমণ রোধে অর্থনৈতিক স্থবিরতা নেমে আসবে জেনেও, দীর্ঘ সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে মানুষকে নিরাপদ করার প্রয়াসে নির্দেশ দেন ‘ঘরে থাকার’। অর্থনীতি থেকে শুরু করে পরিবর্তিত সামাজিক বাস্তবতায় সবকিছু থমকে দেওয়ার বৈশ্বিক এই দুর্যোগেও বিরতিহীন যিনি শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন তিনি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। অচেনা এই দুর্যোগের ধাক্কা সামাল দিতে সমাজের সব শ্রেণির জন্য রাষ্ট্রের তরফ থেকে প্রতিনিয়তই ‘কিছু না কিছু’ বন্দোবস্তু করে চলেছেন তিনি। আর এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে যাঁর নেতৃত্বে, তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের এই দিনে তিনি ফিরে এসেছিলেন প্রিয় পিতৃভূমিতে বলেই তিনি আজ অসহায় মানুষের ত্রাতা। তিনিই দিক-নির্দেশক, অর্থনৈতিক মুক্তির অগ্রযাত্রায় বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। ভয়কে জয় করে সেদিন তিনি ফিরে এসেছিলেন বলেই বাংলাদেশ আজ এই করোনা সংকটেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের ইতিবাচক পরিবর্তনের অগ্রনায়ক তিনি। তাঁকে ঘিরেই সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখে বাংলাদেশ। আমাদের অভিবাদন গ্রহণ করুন প্রিয় নেত্রী। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
    লেখক :সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক ভোরের পাতা, দ্য পিপলস টাইম
    সহ-সভাপতি, সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগ
    সদস্য, কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
    পরিচালক, এফবিসিসিআই
    প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ইরান-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ

  • মন্তব্য প্রতিবেদন : প্রসঙ্গ : ভোমরা সিএন্ডএফ নির্বাচন। চেনা পুলিশ কেন হলো অচেনা?

    মন্তব্য প্রতিবেদন : প্রসঙ্গ : ভোমরা সিএন্ডএফ নির্বাচন। চেনা পুলিশ কেন হলো অচেনা?

    রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী
    —————-

    দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছি। ৯ বছর আগে ভোমরা সি এন্ড এফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যপদ লাভ করেছি। এর পাশাপাশি আমদানি ব্যবসায়ী জড়িয়ে পড়ি। ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যে কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতার সন্ধান পেয়েছি। ইতোপূর্বে সিএন্ডএফ এর কমিটি নিয়ে  তেমন আগ্রহ ছিল না। তারপরও  সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কার্যনির্বাহী কমিটিতে যুক্ত ছিলাম। নিজের পদের জন্য কখনও কোন নেতার কাছে ধর্ণা ও ধরিনি। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন রকম।

    ২০২১ সালের জুন জুলাই মাস থেকে ভোমরা বন্দর এর বিপরীতে ভারতের ঘোজাডাঙ্গা বেসরকারি পার্কিং ওয়ার্ডগুলোতে সিরিয়ালের নামে চাঁদাবাজি শুরু হয়। যেহেতু আমদানি ব্যবসার সাথে জড়িত, সে কারণে সিরিয়ালের নামে চাঁদাবাজির কারণে আমার মত অসংখ্য ব্যবসায়ী আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে থাকে। তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান নাসিমকে বলেছিলাম, এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করতে। তিনি জেলা প্রশাসকের কাছে আমদানিকারক ব্যবসায়ী সংগঠনের আবেদন ফরওয়ার্ডিং করে দায়িত্ব শেষ করেছিলেন।

    এরপর আইন-আদালত শেষে এজাজ আহমেদ স্বপন এর নেতৃত্বাধীন এডহক কমিটির সদস্যপদে এখনো দায়িত্ব পালন করে চলেছি। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে এজাজ আহমেদ স্বপন এর নেতৃত্বে সিরিয়ালের নামে চাঁদাবাজি বন্ধের দাবিতে আন্দোলন শুরু করি। কিছুটা সফলতা আসে। কিন্তু মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর থেকে আবারো সিরিয়ালের নামে চাঁদাবাজি শুরু হয়। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট আহবায়ক কমিটির ৪ জন সদস্য যুক্ত স্বাক্ষরের ঘোজাডাঙ্গা সিএন্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি ও সম্পাদকের কাছে গত ৩১ মার্চ সিরিয়ালের নামে চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানিয়ে চিঠি পাঠায়। অন্যথায় সিরিয়াল বহির্ভূত আমদানিজাত পণ্যবাহী ট্রাক আটক করে জরিমানা আদায়ের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করি। আমদানিকারকদের অনুরোধে গত ৩ এপ্রিল থেকে সিরিয়াল বহির্ভূত পণ্যবাহী ট্রাকের বিল অব এন্ট্রি আটকাতে শুরু করি। গত ৪ এপ্রিল আরো একটি বিল অফ এন্ট্রি আটকায়। উদ্দেশ্য একটাই সিরিয়ালের নামে চাঁদাবাজি বন্ধের উদ্যোগ।। জরিমানার ভয়ে আমদানিকারকরা যেন চাঁদা দিয়ে সিরিয়াল বহির্ভূত গাড়ি বন্দরে না ঢুকায়। কিন্তু ঘটে যায় বিপত্তি। ঐদিন রাতে একজন আমদানিকারক জানাই, সিরিয়াল বহির্ভূত আমদানিজাত পণ্যবাহী ট্রাক আটকানো যাবে না। কারণ জানতে চাইলে সে আমাকে জানালো, এক প্রশাসনিক কর্মকর্তার কথা। ওই আমদানিকারকের পীড়াপীড়িতে সিরিয়াল বহির্ভূত গাড়ির বিল অব এন্ট্রি আটকাতে ব্যর্থ হই। পরদিন ওই প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছে ফোন করেছিলাম। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, ওপারে চাঁদাবাজি হচ্ছে আমাদের তাতে কি। বললাম ভোমরা বন্দরের ৮টি সংগঠনের যৌথ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিরিয়ালের নামে চাঁদাবাজি বন্ধের জন্য জরিমানার সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে চাই। ওই কর্মকর্তাকে বুঝাতে ব্যর্থ হলাম। বুঝতে পারলাম “ডাল মে কুচ কালা হে”! নিজেদের মধ্যে ভূল বুঝাবুঝি ও মতপার্থক্যের কারণে আহ্বায়ক এজাজ আহমেদ স্বপন এর স্থলাভিষিক্ত হন আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মোঃ মিজানুর রহমান।

    সম্ববত ১৩ এপ্রিল, আহ্বায়ক মিজানুর রহমানের সাথে ওই প্রশাসনিক কর্মকর্তার সাথে দেখা করতে গেলাম। বললাম, আপনার কারণে সিরিয়ালের নামে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারলাম না। তিনি আশ্বস্ত করলেন, ওপারের সম মর্যাদার প্রশাসনিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলবেন।

    এরই মধ্যে ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ত্রি বার্ষিক নির্বাচনে তফসিল ঘোষণা হল। অতীতে না থাকলেও এবারের কমিটিতে আমার আগ্রহ ছিল, এমন একটি কমিটি তৈরি করা যাদের নেতৃত্বে সিরিয়ালের নামে চাঁদাবাজি বন্ধ করে ভোমরা বন্দরকে রক্ষা করা যায়। ক্ষমতাসীন দলের একাধিক শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বললাম। আশ্বস্ত করা হলো, আওয়ামী লীগপন্থী সিএন্ডএফ এজেন্টদের নিয়ে কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে। ক্ষমতাসীন দলের দুই শীর্ষ নেতা ও এক প্রশাসনিক কর্মকর্তার সমন্বয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ৯ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি চূড়ান্ত করা হবে। তফসিল অনুযায়ী গত ৯ মে ছিল নির্বাচনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহের নির্ধারিত দিন। আগের দিন রাতেই খবর পেলাম ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের গুরুত্বপূর্ণ পদ হাইব্রিড নেতাদের দখলে চলে যাচ্ছে। মোটা অংকের লেনদেনের কথা মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। বুঝতে অসুবিধা হলো না, আমাদেরকে পুঁজি করে তারা বাণিজ্য করতে দ্বিধা করছে না।

    ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্ট অ‌্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক যুবলীগ নেতা মিজানুর রহমান ও আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম এটা কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। কথা হল আরো কয়েকজনের সাথে। মনোনয়নপত্র সংগ্রহের নির্ধারিত দিনে আমি যাওয়ার আগেই মিজান ভোমরায় পৌঁছে গেছে। আমি ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্ট অ‌্যাসোসিয়েশন ভবনে পৌঁছে দেখি বিশাল পুলিশ বাহিনী । গাড়ি থেকে নেমে অ্যাসোসিয়েশনের অফিস কক্ষে যেতে পুলিশের বাধার সম্মুখীন হলাম। সাতক্ষীরা সদর থানা পুলিশ ও জেলা গোয়েন্দা বিভাগের কয়েকজন ইন্সপেক্টর ও সাব্ ইন্সপেক্টর পদমর্যাদা সম্পন্ন অফিসার বিশাল বাহিনী নিয়ে ভবনের গেটে অবস্থান করছেন। অধিকাংশ পুলিশ অফিসার পরিচিত। তাদের সাথে রয়েছে সুন্দর সুসম্পর্ক। ছোট্ট শহরে প্রতিনিয়ত দেখা হয়। প্রতিনিয়ত তাদের সাথে কুশলাদি বিনিময় হয় । এদের মধ্যে একজন সাতক্ষীরা সদর থানার ইন্সপেক্টর তারেক বিনয়ের সাথে বললেন, দাদা এখানে ঢোকা যাবে না। নির্দেশনা নেই। অফিস কক্ষে বসে ছিলেন আহ্বায়ক মিজানুর রহমান। খবর পেয়ে সে বাইরে বেরিয়ে এলো। আমাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে সে নিজেও পুলিশের বাধার সম্মুখীন হল। নির্বাচন কমিশনের কেউ ভোমরা সিএন্ডএফ এজেন্ট অ‌্যাসোসিয়েশন ভবনে আসেনি। মিজান ও আমি বাইরে অপেক্ষা করার সময় দেখতে পেলাম, অনেকেই মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে এসে পুলিশের বাঁধার মুখে পড়ে ফিরে গেল। যেসব পুলিশ অফিসাররা দায়িত্বরত ছিল তাদের অধিকাংশই পরিচিত। তাদেরকে দিয়ে ঐদিন যে দায়িত্ব পালন করানো হলো, তা কতটুকু বৈধ ছিল? আর এই চেনা পুলিশগুলো কেনই বা হঠাৎ অচেনা হয়ে গেল? একজন সহকর্মী বলল, দাদা টাকার কাছে চেনা মানুষ অচেনা হয়ে যায়।

    লেখক পরিচিত :
    সংবাদকর্মী, সিএন্ডএফ এজেন্ট ও আমদানীকারক