আমি যে ভাবে দেখেছি বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সালাম মোড়লকে


জুলাই ২৭ ২০২২


অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী

আমার রাজনৈতিক জীবনে মোড়ল আব্দুস সালামের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব অনেক ও দীর্ঘ । আমি রাজনৈতিক ধারায় যুক্ত হই ৬৮ সালের গণ আন্দোলনের শুরুর দিকে। তখন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে ও আগরতলা মামলা শুরুর শুরুর সময়কাল। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালী জাতির সকল ধারাকে পরিবর্তন করে। স্বাধীনতার পর দুটো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আনে। একটি পাকিস্তানের কাছে যা পাওয়া যায় নি সেই সংবিধান রচনা। অন্যটি একটি সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির জন্ম। যার নেতৃত্বে থাকে সদ্য যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা একদল মুক্তিযোদ্ধা, যাদের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ৬২ সালের তিন তরুণের স্বাধীনতার স্বপ্নবীজ বোনার (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াস বা বিএলএফ) মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু, মুজিব বাহিনীর সফল এবং দীর্ঘ সংগ্রামের প্রস্তুতির প্রশিক্ষনের ধারায় সমাজতান্ত্রিক চেতনার সাথে পরিচিত ও সম্পৃক্ত বাংলার তারুন্য দৃপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এনে দেয় দেয় নূতন উৎমাদনা। স্বাধীনতার পর সেই তারুণ্য দীপ্ত উৎমাদনা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে জন্ম দেয় বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে একটি নূতন রাজনৈতিক দলের। “আমাদের লক্ষ্য বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র” স্লোগানকে ধারণ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ নামে দলটির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগের ৭০ সালের কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য হিসেবে প্রচার সম্পাদক শহীদ স্বপন কুমার উত্থাপিত স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়া প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন দেন। আব্দুস সালাম মোড়ল এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হন ধারাবাহিকতার অংশ হিসাবে। স্বাধীনতার পূর্ব সমরয় রাজনৈতিক চারণ ক্ষেত্র ছিল বাগেরহাট। যুক্ত ছিলেন ছাত্রলীগের অভ্যান্তরে নিউক্লিয়াসের সাথে। আব্দুস সালাম মোড়ল মুক্তিযুদ্ধে তার জন্মএলাকা তালা অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন তিনি। এ আলোচনায় মুজিববাহিনীর বিষয়টি প্রাসঙ্গিক থাকলেও সময়ের কারণে সেটিকে বাদ রাখলাম। আগামীতে সময় সুযোগে আলোচনা করা যাবে।
১৯৭৮ সালের পর থেকে খুলনা অবস্থানের সময় কালের বেশিরভাগ সময় কেটেছে এ নেতার সান্যিধ্যে। এসময় খুলনাতে আমি ও আবু কাজী মিলে আমরা একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলি। উদ্ভাস সম্মিলিত সাহিত্য আসর যার নাম ছিল। মুলত: আমরা জাসদের ধারার সাথে মিলে এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলি। আব্দুস সালাম মোড়ল, বিপ্লব কান্তি মন্ডল প্রমুখ সংগঠনটির উপদেষ্ঠা ছিলেন। আমি ও আবু কাজী দুজনই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম।
জাসদ প্রতিষ্ঠার সময় ঘোষনা করা হয় জাসদ একটি সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন। এ সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি বিপ্লবী পার্টি গঠন করা হবে। মুলত সেই সময়ে জাসদের উপলব্ধি ছিল দেশে যতগুলো বামধারার রাজনৈতিক দল ছিল তাদের সমাজ বিশ্লেষন সঠিক ছিল না। তত দিনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটে গেছে। কিন্তু সকল বাম রাজনৈতিক দলের বিশেষন ছিল ‘ বাংলাদেশ একটি আধা উপনিবেশ ও আধা সামন্ততান্ত্রিক দেশ’। এ সময়ে জাসদের অন্যতম সহ-সভাপতি ও তৎকালিন একজন প্রথম শ্রেনীর অর্থনীতিবীদ ড. আখলাকুর রহমান একটি লেখার মাধ্যমে প্রমান করেন যে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি পুঁজিবাদের দিকে মোড় নিয়েছে। তিনি ‘কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ’ নামে একটি গবেষনাপত্র লেখেন। জাসদ এ বিশ^াসকে ধারণ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসুচি ঘোষনা করেন। এবং এ বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য একটি বিপ্লবী পাটি গঠনের কথা বলেন। জাসদ যার প্লাট ফর্ম হিসেবে কাজ করবে বলে দলের অভ্যন্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

জাসদ জন্ম লগ্ন থেকেই ‘সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেনী সংগ্রামকে তরানিত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা’ এর সংগ্রাম করার কথা ঘোষনা করে। ’৭৩ সালের মধ্য সময় কাল থেকে সে প্রক্রিয়া শুরু হয় কি না আমি জানি না। তবে এ সময় জাসদের অভ্যন্তরে নূতন একটি রাজতৈকি ধারা শুরু হয়, দলের অভ্যন্তরে পাটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে সেল গঠন করা হয়। শ্যামনগর থানাতে সে সময় ৬ জনের একটি সেল গঠন করা হয়। যার সাথে আমাকে যুক্ত করা হয়। এর কার্যক্রমটা ছিল অনেকাংশেই গোপনীয়। দলের সকলে এর সাথে যুক্ত ছিলেন না, এমনি কি জানতেনও না।

জাসদের বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলের এ প্রক্রিয়ার মূল নেতা ছিলেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু। এবং তাঁর দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন মোড়ল আব্দুস সালাম। মোড়ল আব্দুল সালাম কখনই প্রকাশ্য নেতা ছিলেন না। তিনি এ প্রক্রিয়ার অন্যতম ত্বাত্তিক নেতা ও খুলনা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরার, নড়াইল, মাগুরা, যশোর এলাকার মুল সংগঠক ছিলেন। সাতক্ষীরা অঞ্চলের এ প্রক্রিয়্ার প্রধান ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। শ্যামনগরে ছিলেন জি,এম আবু বকর সিদ্দিক (্এ্যাড)। ৬৯ সালে সাতক্ষীরা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়। ছাত্রনেতা মোস্তাফিজুর রহমানের উদ্যোগে এ কমিটিতে সভাপতি রবীন্দ্র নাথ, নজরুল ইসলাম সেক্রেটারী ও জি এম আবুবকর সিদ্দিক কে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। তিন জনই শ্যামনগরের।
সিদ্দিক ভাইয়ের মাধ্যমে আমার সাথে পরিচয় হয় মুক্তিযুদ্ধের নেতা ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমান ভাইয়ের সাথে। তিনি ও শেখ কামরুজ¥ামান টুকু ভাই একদিন আমাকে ডেকে নেন সিদ্দিক ভাইয়ের বাড়িতে। সে সময় সেটি ছিলো আমাদের একটি অঘোষিত যোগাযোগ কেন্দ্র। মনে রাখতে হবে এসময় জাসদ প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল ছিলো। টুকু ভাই বললেন, একটি গাড়িতে অনেকে উঠেন কিন্তু একজন ড্রাইভার থাকেন তিনি পথ দেখিয়ে গন্তবে নিয়ে যান। আমরা সে যাত্রা শুরু করেছি তোমাকে তার সাথে যুক্ত হওয়ার তালিকায় রাখতে চাই।’
রাজনীতিতে আমার স্বপ্নের মানুষগুলোর সামনে বসে আমি কথা বলছি, তারা যা বলবেন তা করতে আমার কোন আপত্তি নেই- এরকম একটি মানষিক প্রস্তুতি আমার। শ্যামনগরে সেল গঠন করা হয় ৬ জনকে নিয়ে। বাবু বিশ^নাথ দাশ (থানা জাসদের সাধারন সম্পাদক), শেখ হারুন-অর-রশীদ( সাংগঠনিক সম্পাদক), জি এম আবু বকর সিদ্দিক (রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র), শেখ আবুল কালম আযাদ(সদ্য থানা ছাত্রলীগের দায়িত্ব ছেড়ে কৃষকলীগের দায়িত্বে) আর ছাত্রদের মধ্যে আমি ও শেখ শফিকুর রহমান খোকন। বয়সে সবচেয়ে কম। তখনও কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলাম না, ৭৩ সালের শেষ দিকে আমাকে থানা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক হিসেবে তৎকালিন কমিটিতে কো-অপট করা হয়। সম্মেলনের মাধ্যমে ১৯৭৪ সালে থানা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আমি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাই।

১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে শ্যামনগর থেকে বাবু বিশ^নাথ দাশ (তৎকালিন থানা জাসদের সাধারন সম্পাদক)নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনের পর থেকে দ্রুত রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হতে থাকে। ৭৪ সালের প্রথম দিকে আমরা সক্রিয়ভাবে সেল যুক্ত ছিলাম এবং নিয়মিত সভা হতো।

সেল গঠনের পর আমাদের কাজের ধারায়, অধ্যায়নে পরিবর্তন আসে। আমার অ-প্রকাশ্য দায়িত্ব আসতে শুরু করে। সেল এর মিটিং সমুহ রাতেই সাধারনত হতো। এ সময়ে একজন ব্যক্তি শ্যামনগরে আসেন। সেল এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমার দায়িত্ব পড়ে তার সাথে যাওয়া। চুল দাড়িতে ঢাকা এক লোককে আমার সাথে দেওয়া হয়। আসল নাম পরে জানতে পারি। তিনি ছিলেন মোড়ল আব্দুস সালাম। অত্যান্ত ধীর স্থির ব্যক্তিত্বসম্পন্ন । কথা বলেন আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রনে। দিনের বেলায় বাইরে কম বের হতেন, অধিকাংশ সময়ে বিাভন্ন ব্যক্তি ও নেতৃবৃন্দের সাথে বলতেন যাদের অধিকাংশকেই আমি চিনতাম না। এর পর আসেন আরো একজন। তিনি আসেন টুকু ভাইয়ের সাথে। সিদ্দিক ভাইয়ের বাড়ীতে বৈঠক শেষে আমার উপর দায়িত্ব পড়ে। তাকে বেদকাশী(কয়রা) নিয়ে যাওয়ার। তিনি ছিলেন বিপ্লব কান্তি মন্ডল। এভাবেই একের পর এক বিপ্লবী ব্যক্তিদেও সাথে পরিচয় হতে থাকে আর আলোচনার মাধ্যমে আমার জ্ঞানের মাত্রাও বাড়তে থাকে। এই প্রথম কয়রা যাওয়া। কয়রার দিঘির জল খুব প্রশিদ্ধ ছিল। দীঘি থেকে উঠিয়ে আনা পানি গ্লাসে করে খেতে দিত। আমিও আট আনা দিয়ে এক গ্লাস পানি কিনে খাই। বেকাশীতে সোলাইমানের বাড়ী আসি। অমল, মাহবুব ও কবিরের সাথে পরিচয় হয়।
আমিও আস্তে আস্তে বিপ্লবী গণবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে পড়ি। তবে আমার কাজটা ছিল প্রকাশ্য। ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চে পর জাসদ এর উপর চরম নির্যাতন নেমে আসে। এ সময় অনেকেই গ্রেফতার হন। প্রকাশ্য রাজনীতি করা কঠিন হলেও জাসদ বাকশাল গঠনের আগ পর্যন্ত প্রকাশ্য রাজনীতি অব্যাহত রাখে। ইতোমধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের গণবাহিনীর অন্যতম কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল ঢালীসহ তার বাহিনীকে শ্যামনগরে গ্রহণ ও থাকার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব পরে। জালাল ঢালী তখন অপ্রকাশ্য ভাবে থাকেন। এক রাতে জালাল ঢালী, অমল, সোলাইমান, মাহবুব, সহ চুনানদী পার হয়ে আসেন। সকলে স্বশস্ত্র ছিল। আমি রাতেই তাদের নিয়ে হোমিও ডাক্তার ছালাম ভাইয়ের বাড়ী নিয়ে যাই। অস্ত্র গুলো ধানের গোলায় রাখি। আর সকলকে আক(ইক্ষু) বাগানে থাকার ব্যবস্থা করি। পরে সিদ্দিক ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেই। সিদ্দিক ভাই পুরো গ্রুপকে জয়ন্ত কাকা (বিশিষ্ট আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্র্যোপধ্যায়) বাড়ীতে সেল্টার করিয়ে দেন।
গণবাহিনী স্বশস্ত্র হলেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রনাধীন ছিল। গণবাহিনীর খুলনা বিভাগীয় প্রধান ও কেন্দ্রিয় প্রতিনিধি ছিলেন শেখ কামরুজ্জামান টুকু। খুলনা জেলার দায়িত্বে ছিলেন বিপ্লব কান্তি মন্ডল, সাতক্ষীরা জেলার দায়িত্বে ছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। মোড়ল আব্দুস সালাম ছিলেন আঞ্চলিক সমন্বয়কারী। এ অঞ্চলের গণবাহিনীর সামরিক প্রধান ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান মাষ্টার। সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন জালাল ঢালী, আবুবকর সিদ্দিক (এড.), আশাশুনিতে মোসলেম উদ্দীন (এড.), কয়রায় কেরামত হোসেন (এড.) প্রমুখ।
আগস্টে আমাদের একটি দল নিয়ে আমরা হরিনগর এলাকাতে সেল্টার নেই। আমার এ দলে অমলসহ কয়রার বেশ জনের স্বশস্ত্র বাহিনীর একটি দল ছিল। এ সময় সুন্দরবন এলাকায় ডাকাত দলের উপদ্রুপ খুব বেড়ে যায় এবং ডাকাতরা অধিকাংশ সময় জাসদের নাম ব্যবহার করে মানুষের বাড়ীতে ডাকাতি করতো। ফলে তাদের দমন করা জরুরী হয়ে পড়ায় আমাদের এ এলাকায় আসা। আমাদের সাথে স্থানীয় ভাবে মুজিবুল হক, জাবের মোড়লসহ কয়েকজন যুক্ত হয়। আর শ্যামনগর থেকে গমআব্দুস সালাম, সম আতাউর রহমান, আবুল কালাম গাইন প্রমুখ ছিল। স ম আতাউর রহমান, আবুল কালাম গাইন স্বশস্ত্র বাহিনীর সদস্য। প্রথম রাতে জেহেরডাকাতসহ দুজন দুরান্ত ডাকাতকে ধরা ও হত্যা করা হয়। এলাকায় এ ঘটনা দারুন আলোড়ন সৃষ্টি করে ফলে আমাদের সেল্টারের সংকট কমে আসে। তবু আমরা বাহিনীর নিরাপত্তার জন্য ভিতরে মড়গাঙ্গে দিকে যেয়ে সহকর্মি — বাড়ী যেয়ে আশ্রয় গ্রহণ করি। বাড়ীতে অতিরিক্ত ঘর না থাকায় গোয়ালঘর পরিস্কার করে প্রথমে চুলাই ছাই ছিটিয়ে তার উপর বিচলি পেতে আমাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা ১৫র মত ছিল। এতজন লোকের পরপর তিন বেলা খাওয়ানো সকলের সামর্থ ছিল না। দিনে বাইরে গণবাহিনীর স্বশস্ত্র দের বের হতে দেওয়া হতো না। এক দিন পর আমরা একই এলাকার রমেশ বাবু বলে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তার বাড়ীতে সেল্টার নেই অনেকটা জোর করে। আমরা ব্যাগ বোচকা রেখে সন্ধ্যায় মুন্সিগজ্ঞ বাজারে আসি নেতৃবৃন্দ এসেছেন কথা বলতে। সেখানে আবু বকর সিদ্দিক ভাই ও কয়রার মাহবুব অপেক্ষা করছিলে। যাওয়ার পর কয়েকটি প্রয়োজনীয় কথা শেষে বলেন তোমাদের গ্রুপকে এখনই এ এলাকা ত্যাগ করতে হবে। নির্দেশ মত আমাদের সকলকে সেল্টার পরিবর্তনের বিষয় জানানো হলো, তবে তাদের পুরাতন সেল্টারের মালামাল আনার বিকল্প ব্যবস্থতা করে মালসামাল আনতে গেলাম।
৭৪ সালে উপক’লের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই দূর্গম ছিল। এলাকার একমাত্র বাহন হেলিকপ্টার (সাইকেলের পিছনে তক্তা দিয়ে বসার ব্যবস্থা)। আমি মালামাল আনতে যাওয়ার সময়ে ঘটে যায় একটি বড় দুর্ঘটনা। মুন্সিগজ্ঞ এলাকা সুন্দরবন সংলগ্ন হওয়ায়, স্থানীয় গরীব মানুষেরা সুন্দরবন হতে সহজে ‘ছিটে’ (গোড়ান গাছের ডাল) কাঠ সংগ্রহ করে আনতো। যা জ¦ালানী হিসেবে ব্যবহার করতো। আর এসময় থানার একদল পুলিশ ছিল, যারা সুযোগ পেলে আসতো এদের ধরে দ’ু পাঁচ টাকা নিতে। এদিনও দুজন পুলিশ আসে বাজারে। এ বিষয়ে আমাদের কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। কারণ পুলিশ তত দিনে গণবাহিনীর নাম জেনে গেছে। ফলে তারাও পারত পক্ষে জাসদদের লোকদের এড়িয়ে চলতো। কিন্তু এদিন ঘটলো বিপরীত ঘটনা। সম্ভবত নূতন আগত ছিল তারা। আমাদের বাহিনী সদস্য কালামকে বাজারে দোকানে বসায় অবস্থায় কেহ একজন গোপনে উষ্কে দিলে পুলিশ আটক করায়। ঘটনাটি দ্রুত বাহিনীর সদস্যদের পৌছে গেলে পুলিশদের নিকট থেকে কালামকে মুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যেহেতু আবু বকর সিদ্দিক ভাই অবস্থান করছিলেন এলকাতে, ফলে তার মতামতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশদ্বয় কালামকে সাথে নিয়ে গ্রামে ভিতরে চলে যাওয়ায় তাৎক্ষনিক একটু সমস্যা তৈরী হয়। আজকেরমত বৈদ্যুতিক আলো না থাকায় গ্রাম এলাকায় সন্ধ্যার পর পরই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসতো। ফলে কালামকে নিয়ে পুলিশরা কোন দিকে গেছে সেটি জানতে বেশ সময় চলে যায়। কালামকে পুলিশ নিয়ে গেলে নির্যাতনের মুখে সকল তথ্য বলে দিতে পারে। ফলে নেতৃবৃন্দ নির্দেশ দেন যেকোন প্রকারে কালামকে মুক্ত করতে হবে। পরে জানাগেল যে পুলিশ কালাম সহ গ্রামের মধ্যে গেছে। ফেরার পথে এ্যামবুশ করা হলো, পুলিশ কাছাকাছি আসলে কৌশলে ছাড়ানোর চেষ্টা করা হয়।
একাতে থাকা নিরাপদ না হওয়ায় সিদ্দিক ভাই ও মাহবুব মুল বাহিনী নিয়ে কয়রার দিকে চলে যায়। আমাকে তাদের সাথে না যেয়ে এলাকাতে ফিরবার সিদ্ধান্ত দেন। এ সময় আমার দায়িত্ব ছিল প্রকাশ্য দলের কাজ করা। তখন শ্যামনগরে তত দিন পর্যন্ত গণবাহিনীর প্রকাশ্য কাজের দায়িত্বে ছিলেন শেখ আবুল কালাম আযাদ, নওশেরম আরশাদ, শেখ শফিকুর রহমান, শেখ ফিরোজ প্রমুখ। কিন্তু বাড়ীতে পৌছে বুঝতে পারলাম এখানে থাকা নিরাপদ নয়। আমার আব্বা আমাকে পরের দিন ভোরে একজনকে সাথে দিয়ে সাতক্ষীরাতে রওনা করে দেন। আমরা গুমানতলী গ্রামের পিছন দিয়ে কৃষ্ণনগরের মানপুরে আমাদের জোরদার আহম্মদ চাচার বাড়ী আসি, তিনি সহ ঘোলা খেয়া পার হয়ে ব্যাংগদহ হয়ে দুদিন ধরে হেটে সাতক্ষীরার সুলতানপুরে এসে আমার এক ভগ্নিপতি কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা আবুল কাশেমের বাসাতে উঠি। আমার আব্বা মুলত এখানে থাকার ব্যবস্থা করেন। আমি এ সময় সাতক্ষীরা কলেজের ছাত্র। কয়েক দিনের মধ্যে সাতক্ষীরার গোলাম রসুলের সাথে যোগাযোগ হয়। পরে হাসনে জাহিদ জজ ভাইয়ের মাধ্যমে কামরুল ইসলাম খানের সাথে যোগাযোগ হয়। কামরুল ইসলাম খান কোটের সামনে একটি দোকান ছিল। এটাই মোটামুটি যোগাযোগের কেন্দ্র ছিল। আর একটি কেন্দ্র ছিল চৌধুরী পাড়ার মধ্যে ক্লাব ঘর। এখানে সান্টু চৌধুরী, যঙ্গু ও নান্নাসহ অনেকেই থাকতো।
১৯৭৫ সালের আগষ্ট মাসের প্রথম দিকে গোলাম রসুল (পরে কাউন্সিলার হন) একদিন জানান নেতৃবৃন্দ তালার মুড়োগাছিতে আছেন, সেখানে কয়েকটা অস্ত্র নিয়ে যেতে হবে। কারন জাসদ নেতা লতিফ ও হাতেমকে হত্যার মুলব্যক্তি নূর খাঁ চেয়ানম্যানকে অপারেশন করতে হবে। সে সময় তালা, আশাশুনি, শ্যামনগর, কয়রা, পাইকগাছা, দেবহাটা এলাকা ক্যাপ্টেন শাহজাহান, আবু বকর সিদ্দিক ও জালাল ঢালীদের নিয়ন্ত্রনে ছিল। এরা বেশীর ভাগ সময় এ সকল প্রত্যান্ত অঞ্চলে বাহিনী নিয়ে অবস্থান করতেন।
আমি সুলতানপুর হতে বের হয়ে ভোরে পুরাতন সাতক্ষীরাস্থ গোলাম রসুলের বাড়ীতে পৌছাই। রসুলের বাড়ীতে পান্তা ভাত খেয়ে আমরা পিছনের বিল দিয়ে পানিতে নেমে হাটতে শুরু করি। অস্ত্র গুলো বস্তার মধ্যে ভরে পর্যায় ক্রমে মাথায় ঘাড়ে করে হাটতে শুরু করি। এক কোমর পানি দিয়ে হাটা সহজ সাধ্য ছিল না। মাঝে মধ্যে কিছুটা উচু পথ পাওয়া যেত বটে তবে সে পথ অপেক্ষা পানির মধ্য দিয়ে হাটা সহজ ছিল। তালা অঞ্চলে তখন ইপিসিপি/নকশালদের অবস্থান শক্তিশালী ছিল। এনারা জাসদকে সা¤্রাজ্যবাদের দালাল মনে করতো। তাদের কাছে জাসদ, গনবাহিনীর সদস্যদের হত্যা করা শ্রেনী সংগ্রামের অংশ ছিল। ফলে সাবধানতা অবলম্বন ছিল শ্রেয়। তালার বিলে জোক ছিল মারাত্মক ধরনের। ইতোমধ্যে কতগুলো জোঁক যে সঙ্গি হয়েছে, তা হিসাব করে বের করা মুসকিল। যত কষ্ট হোক নিরাপত্তার জন্য এ পথেই চলতে হবে। কিন্তু পথ আর কমে না। ক্লান্ত হয়ে একটু বিশ্রাম নেব, সে সুযোগ বা স্থান নেই। ফলে প্রায় মন খানেক মালামাল মাথায় ঘাড়ে পিঠে করে রাত আনুমানিক ১০ টার দিকে মুড়াগাছি মুক্তিযোদ্ধা সুজাত মাষ্টারের বাড়ীতে পৌছাই। সে রকম নির্দেশই ছিল। এ সময় আমাদের আপ্যায়ন করবে বাড়ীতে সে অবস্থা নেই। বাড়ীতে এক জন নারী সন্তান জন্ম দিতে যেয়ে বিপদজনক অবস্থার মধ্যে আছে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে সে নারী। নারী মর্মান্তিক আত্মচিৎকার আমারা শুনতে পাচ্ছিলাম। ফলে বাড়ীর অবস্থা প্রতিকুল। এর মধ্যে সুজাত ভাই অত্যান্ত আন্তরিকতার সাথে আমাদের গ্রহণ করেন ও খেতে দেন। আমাদের যে সময়ে পৌছানোর কথা ছিল তা থেকে অনেক পরে পৌছাই। ফলে আমাদের গ্রহণকারী দল ফিরে গেছেন সেল্টার এলাকায়। আমাদের জন্য নির্দেশ হলো এ রাতেই কাদাকাটি মুরতোজা ভাইয়ের বাড়ীতে পৌছাতে হবে। আমরা খেয়ে দেরী না করে বের হয়ে পড়ি এবং ভোর রাতে মুর্তুজা ভায়ের বাড়ী পৌছে হাতমুখ ধোয়ার সুযোগ পাই। মুর্তুজা ভাইয়ের বাড়ীতে আসার পর তার এক বোনের নার্সিং এ কিছুটা জোকে কাটা রক্ত পড়া বন্ধ হলো। এক সপ্তাহ পরে সাতক্ষীরা ফিরি। ফেরার দুদিন পরেই ঘটে যায় জাতীয় বিপর্যয়।
১৫ আগস্ট মধ্যরাতে আওয়ামীগের একটি গ্রুপের নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুকে স্ব-পরিবারে হত্যা করে।ঁ ৭৩ সালের র্ন্বিাচনে জাসদ প্রার্থী ডা. আজহার উদ্দীনের জয়কে ছিনতাই করে অতিউৎসাহী আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ পরাজিত খন্দকার মোস্তাককে বিজয়ী ঘোষনা করতে নির্বাচনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদেও বাধ্য করেন। সেই খন্দকারই জাতীর জনককে স্ব-পরিবারে হত্যার প্রধান সুফল ভোগী। রেডিওতে খবর শোনার পরপরই আমাদের মধ্যে একধরনের সংশয় সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় সুলতানপুরের আমার বাসার কাছাকাছি স্থানে আস্তে আস্তে জড়ো হয় কোকিল, মোহাম্মদ আলী, গোলাম রসুল, মাইকেল প্রমুখ। আমরা কেন্দ্রের নির্দেশ জানার জন্য অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত জানার দ্রুত সকলে একত্রিত হব বলে গোলাম রসুল জানান। গোলাম রসুল তখন মুলত সকল সংযোগ রক্ষা করে সমন্বয় করতো শহরের কাজগুলো।
৩০সেপ্টেম্বরের ও ১অক্টোবর, এ দুদিন তালার মুড়াগাছিতে জাসদ গণবাহিনীর বিশেষ সভা হয়। সভায় কেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে শরীফ নূরুল আম্বীয়া ও খুকু (পরবর্তিতে সাবেক বাসদ নেতা আ ফ ম মাহাবুবুল হকের স্ত্রী) শেখ কামরুজ্জামন টুকু, জালাল ঢালী, ক্যাপ্টেন শাহাজান মাষ্টার, আবু বকর সিদ্দিক, আব্দুস সালাম, কেরামত আলী ও মোসলেম উদ্দীর প্রমুখর সমন্বয়ে দু দিস ব্যপি বিশেষ সভা হয়। সভা শেষে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এলাকা ত্যাগ করে । ২ অক্টোবর ছালাম ভাই, শাহজান স্যার সিদ্দিক ভাই ও জালাল ঢালী, মনোরজ্ঞন বড়দলে কার্তিক মন্ডল (সাবেক চেয়ারম্যান) এর বাড়ীতে যাওয়া উদ্দেশ্যে রওনা হন। কোন প্রস্তুতি ছাড়াই তাদের যাত্রা। পথে সকাল ৭ টার দিকে তারা খড়িহাটি, আশাশুনিতে বিশাল পুলিশ বাহিনীর মুখোমুখি হন। পুলিশ হঠাৎ শাহজাহান স্যারকে লক্ষ কওে গুলি ছোড়ে, স্যার গুলিবৃদ্ধ হয়ে গড়ে যান, একই ভাবে জালাল ঢালী ও আবু বকর সিদ্দিক ভাইকে গুলি করা হয়। ৩ গুলিবিদ্ধসহ ৫ জন গ্রেফতার হন। সালাম ভাই গুলিবিদ্ধ ছিলেন না। তবে পুলিশের লাঠির আঘাতে অজ্ঞান হয়ে গ্রেফতার হন। সেখান থেকে নৌকা করে তাদের আশাশুনি। আশাশুনি থেকে পরের দিন ৩ অক্টোবর লঞ্চে সাতক্ষীরা থানায় নিয়ে আসা হয়। আমরা রাতে খবর পাই। কিন্তু কোন নির্ভর যোগ্য খবর পাই না। পরদিন ভোরে হাটতে হাটতে পলাশপোল চৌধুরী পাড়ায় আসি। সান্টু ভাইসহ কয়েক জনের সাথে কথা হয়। সকলেই একই ধরনের খবর শুনেছে। ইতোমধ্যে খবর পাই তাদেরকে সাতক্ষীরাতে নিয়ে আসছে।
আমি খবরটা নেওয়ার জন্য পাকা পোল এলাকাতে আস্তে আস্তে আসি। বেলা তখন দুপুরের কাছাকাছি। লোকেলোকারণ্য সমগ্র এলাকা। পুলিশ থানার কাছাকাছি কাউকে ভিড়তে না দেওয়ায় থানার চারধারে লোক ভর্তি। তার মধ্য দিয়ে ঠেলে কোন মতে থানার কাছাকাছি আসি। থানার পশ্চিম দিকে দরজা তখন দরজা ছিল। সামনের দিকটা তারের ঘেরা। আমি কাছাকাছি যেয়ে দেখি চারজন পরপর শুয়ে আছে। হাতে সেলাইন লাগানো তিনজনের। তিনজনই বিশাল দেহের অধিকারী হওয়ায় পা সকলের বাইরে চলে এসেছে। জ্ঞান আছে বলে মনে হলো না। মানষিক ভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। কোন মতে নিজেকে সামলে ফিরে আসি। এদিন বিকালে তাদের খুলনা নিয়ে খুলনা জেলে নেওয়া হয়।
খুলনা থেকে ৩১ অক্টোবর ঢাকা সেন্টাল কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময়ে গুলিবিদ্ধ তিন জনের চিকিৎসা জেলের মধ্যে করা হয়, যা কোন কাজে আসে না। ইতোমধ্যে ক্ষত স্থানে পচন ধরে। কিন্তু উন্নত চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা জেল কতৃপক্ষ করতে পারে না। এ সময়ে সাতক্ষীরা আতিয়ার রহমান (যিনি শাহজান মাষ্টারের এলাকার বন্ধু ও সহযোদ্ধা ছিলেন) তিনি পোস্ট মাষ্টার জেনারেল ছিলেন। তিনি ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় উর্দ্ধতন কতৃপক্ষের সম্মতি নিয়ে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করান। কিন্তু তত দিনে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সকলের পায়ের ক্ষতস্থানের হাড় বাদ দিতে হয়।
কারাগারে ছালাম ভাইয়ের জীবনে একটি নূতন যাত্রা শুরু হয়। কারাগারে পরিচয় ঘটে আর এক বিপ্লবী নারী নেত্রীর সাথে। আমিনা সুলতানা বকুল নামের এ মেয়েটিও কারাগারে আসেন। জাসদ ও গণবাহিনীর সক্রিয় নেত্রী হওয়ায় দলের সকলে তারপ্রতি আন্তরিক ছিলেন। দু জনের ভালোলাগা ও নেতৃবৃন্দের সিদ্ধান্তে ৭৭ সালে তাদের কারা অভ্যন্তরে বিয়ে হয়। আসম রব সহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন সেখানে। পরে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর খুলনাতে শেখ আব্দুল কাইয়ুম ভাইয়ের বাসাতে আবার আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়।
৭৮ সালের প্রথম থেকে জাসদ নেতৃবৃন্দ কারাগার থেকে ছাড়া পেতে শুরু করে। ছালাম ভাইও এ সময় মুক্ত হন। ছালাম ভাই এ সময় পর্যন্ত জাসদের কোন কমিটিতে ছিলেন না। তিনি ছিলেন স্বাধীনতার পর গঠিত আওয়ামীলীগের সহযোগি প্রথম কৃষক সংগঠন জাতীয় কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাকালিন কেন্দ্রিয় কমিটির সহ-সভাপতি। আওয়ামীলীগের অনেক নেতাদের বিরোধীতা উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু প্রথম কমিটির সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক করেন খন্দকার আব্দুল মালেক শহিদুল্লাহ ও হাসানুল হক ইনুকে। ৮০ সাল পর্যন্ত আব্দুস সালাম মোড়ল কৃষক লীগের কেন্দ্রিয় কমিটিতে ছিলেন।
৭৯ সাল থেকে জাসদ অভ্যন্তরে দুটি ধারা প্রবল আকার ধারন করে । গনতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের পক্ষে ও বিপক্ষ। সংক্ষেপে বলাহতো ডিএনজি ও এন্টি ডিএনজি। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মান্না-আকতার এন্টিডিএনজির পক্ষে থাকায় ছাত্রলীগের অধিকাংশই এর পক্ষে ছিলেন। জাসদ কেন্দ্রিয় কমিটিতে বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা এ ধারার পক্ষে অবস্থান নেন। দলের মধ্যে বিপ্লবী দল গঠনের দাবী প্রবল হয়। এ অবস্থায় জাসদ কেন্দ্রিয় কমিটি ১২ নেতাকে নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে। এ কমিটির পক্ষ হতে বৃহত্তর জেলা গুলোতে কর্মি সমাবেশ করা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। খুলনাতে প্রথম সভা হওয়ার কথা নির্দ্ধরিত হয়। নির্দ্ধারিত দিনে খুলনা রেলওয়ে অডিটরিয়াম মিলনায়তনে সভা শুরু হয় কিন্তু কর্মিদের নানান প্রশ্ন, প্রশ্নের জবাব চাওয়া ইত্যাদি কারনে সভা ভালো ভাবে শেষ হয় না। পরে দায়িত্বশীল ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ ও জেলা নেতাদের নিয়ে মিটিং করা কথা থাকলেও মিটিং শেষে ফিরে যাওয়ার পথে একেজন বাস থেকে পড়ে মৃত্যুবরণ করারায় নেতৃবৃন্দ নিহত ছেলের বাড়ীতে তাৎক্ষনিক যাওয়ায় মিটিং আর হয় না। এ ঘটনার কয়েক দিন পরে জাসদের কেন্দ্রিয় সমন্বয় কমিটির পক্ষ হতে ডাকসুর ভিপি মাহামুদুর রহমান মান্না ও জিএস আক্তারুজ্জামানকে ছাত্রলীগের সকল দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের মধ্যে এ ঘটনা মারাত্মক বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরী হয়। প্রায় সকল কমিটির পক্ষ হতে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবী জানাতে শুরু। কোন কোন এলাকা এ ধরনের সিদ্ধান্তকে নিন্দা জানায়। এ সময় জাসদ কেন্দ্রিয় কমিটির প্রভাবশালী সদস্য খালেকুজ্জামান ভূইয়া, আব্দুল্লাহ সরকার, ময়নুদ্দিন খান বাদল, মতিয়া চৌধুরীসহ ১১ জন পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবী জানান। খুলনা থেকে আব্দুস সালাম মোড়ল, বিপ্লব কান্তি মন্ডল, আবম নূরুল আলম সহ ১১ জন জেলা নেতৃবৃন্দ একই ধরনের বিবৃতি দেওয়ার প্রেক্ষাপটে জাসদের পক্ষ হতে ঘোষনা করা হয় এর পর এ ধরনের বিবৃতি যারা দেবেন তারা আপনা আপনি দলথেকে বহিস্কার হয়ে যাবেন। ফলে জাসদের ্িবভক্তি চুড়ান্ত হলো।

১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর নূতন একটি সমাজতান্ত্রিক পাটির আত্মপ্রকাশ হলো খালেকুজ্জামান ভুইয়াকে আহ্বায়ক করে। কেন্দ্রিয় আহ্বায়ক কমিটির সদস্য হিসেবে মোড়ল আব্দুস সালাম ও মো¯তাফিজুর রহমান খুলনা সাতক্ষীরাতে অর্ন্তভুক্ত হন। আব্দুস সালম মোড়ল সক্রিয় ভাবে সকল কার্যক্রমে অংশ নিতেন। বাসদের দলগঠন, দলের প্রক্রিয়া ও কিছু ব্যক্তিগত ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন উপস্থাপিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দলের দায়িত্ব থেকে মাহমুদুর রহমান মান্না ও খুকু আপাকে সাময়িক অব্যহতি দেওয়া হয় ৮৪ সালের দিকে। পরে ৮৪ সালের নভেম্বরের দিকে আফম মাহবুবুল হকের পক্ষ হতে মাহমুদুর রহমান মান্না ও খুকু আপাকে সাময়িক অব্যহতি প্রত্যারের বিষয়ে বাসদ কেন্দ্রিয় কমিটির তলবী সভা আহ্বান করা হয়। এ সময় ছালাম ভাই, বাদল ভাই সিদ্দিক ভাইসহ শ্যামনগরে চিংড়ী চাষের সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারনে শ্যামনগরে বেশী সময় অবস্থান করতেন। শ্যামনগর হতে ছালাম ভাই ও বাদল ভাই ঢাকাতে যেয়ে এ সভায় যোগ দেন ও পৃথক বাসদ গঠন করেন। ছালাম ভাই তখন খালেকুজ্জামান ভাইদের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে মাহবুবুল হক ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন বাসদে যোগ দেন এবং একই ভাবে কেন্দ্রিয় কমিটিতে থাকেন।
৮০ সালে জিয়া হত্যার পরে বিচারপকি আব্দুস সাত্তারের কাছ থেকে এরশাদ ক্ষমতা দক্ষল করে নেয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাসদ ভেঙে যায়। রব ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন জাসদ এরশাদের পক্ষে থাকে। কিন্ত কাজী আরিফ, হাসানুল ইনু জাসদ (ইনু) নামে মুল জাসদ ধারার প্রতিনিধিত্ব করে। কাজী আরিফ, হাসানুল ইনু নেতৃত্বাধীন জাসদ (ইনু) এরশাদ বিরোধী বাম জোটের সাথে থাকে।
১৯৮৬ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জাসদে আবার বিভক্তি হয়। কাজী আরেফ, শাহাজান সিরাজ, ইনু ভাইয়ের নেতৃত্বে প্রধান ধারার জাসদ। মূলত সিরাজুল আলম খান এরশাদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় নেওয়ায় এ বিভক্তি সৃষ্টি হয়। রব ভাই, জিকু ভাই সিরাজুল আলম খানের সিদ্ধান্তের দিকে থাকেন। এর পরপরই সালাম ভাই বাসদ (মাহবুব) ত্যাগ করে রব ভাইয়ের সাথে যুক্ত হন। ৮৬ সালে এরশাদেও নেতৃত্বে জাতীয় নির্বাচনের সুচনাকালে তিনি জাসদ রব গ্রুপে যোগদেন এবং জাসদ রবের পক্ষে সংসদ নির্বাচনে তালা-কলারোয়া আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
আসম আব্দুর রব ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন জেএসডিতে যোগ দেওয়ার পরপরই সালাম ভাইয়ের জীবনে পারিবারিক বিপর্যয় নেমে আসে। এ সময় বকুল ভাবি সালাম বাইকে ছেড়ে চলে যায়। একমাত্র কন্যা মায়ের সাথে থেকে যান। পরবর্তীতে সালাম ভাই বিয়ে করেন জিকু ভাইয়ের নিকট আত্মীয়কে। এ বিয়ের পওে সালাম ভাই কানাইদিতে ফিওে আসেন। এখানে তার পৈত্রিক বাড়ী। পাইকগাছা আদালতে প্রাকটিস করার জন্য আগেই ফিরে বিপ্লব কান্তি মন্ডল কপিলমুনি(নাসিরকুড়), পাইকগাছাতে বসবাস শুরু করেন। মোড়ল আব্দুস সালাম এর স্ত্রী বিপ্লব মন্ডলের সাথে যোগাযোগ করে কয়েক কাটা জমি ক্রয় করে সেখানে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন।
জেএসডির সাংগঠনিক কাঠামোয় থাকলেও তিনি বাসদ কেন্দ্রিক বাম ধারার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন আবারও। সিরাজুল আলম খানের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল প্রগাঢ়। যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। র্প্বূ পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাথে তাঁর সম্পর্ক ও মুক্তিযুদ্ধে তার ভ’মিকা এ আলোচনায় বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবন আলোচনায় সেটি সম্পৃক্ত করা হবে।
এক বনাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী সংগ্রামী মানুষ ছিলেন সালাম ভাই। শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে জীবনের বিলাসিতার সকল সুযোগকে অবলিলাক্রমে ঠেলে দিতে পেরেছিলেন। জীবনের একমাত্র চাওয়া সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাংখায় আপোষহীন থাকতে নূতন করে পথ খুজে ফিরেছেন। নানান পথ পরিক্রমায় আকা বাকা রাস্তা দিয়ে চললেও কখনো ব্যক্তি লোভ, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার সুবিধাবাদী চিন্তায় নিজেকে যুক্ত করেন নি। সৎ, নির্লোভ এবং বৈষম্যহীন সমাজের মূল্যবোধের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছেন সেই পথেই তিনি হেটেছেন মাথা উচু করে। পরবর্তীতে স্থানীয় মানুষের সংকট সমস্যায় তিনি একজন সক্রিয় সমাজ সংস্কারের ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এখানেও তিনি ছিলেন সামাজিক মূল্যবোধের ধারক। এ সময় তিনি ব্যপক পড়াশুনা শুরু করেন।
তাকে গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে আমার কথা শেষ করছি।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক, জাতীয় কৃষক জোট কেন্দ্রিয় কমিটি।

শ্যামনগর

যশোর

আশাশুনি


জলবায়ু পরিবর্তন