Category: ইতিহাস

  • ইতিহাসে আজকের এই দিনে

    ইতিহাসে আজকের এই দিনে

    এই দিনে

    মঙ্গলবার , ২৮ মার্চ

    ১৪৭২ ইতালীয় চিত্রশিল্পী ফ্রা পাগোলো–র জন্ম।

    ১৪৮৩ ইতালীয় চিত্রশিল্পী রাফায়েল সানৎসিও–র জন্ম।

    ১৫৯২ মোরাভীয় সংস্কারক ইয়াহান আমোস কোমেনিয়াস–এর জন্ম।

    ১৬৪৫ সপ্তম শিখগুরু হরগোবিন্দর মৃত্যু।

    ১৮০০ আইরিশ পার্লামেন্টে ইংলন্ডের সঙ্গে সংযুক্তির আইন অনুমোদিত হয়।

    ১৮২২ ঊর্দু ভাষায় প্রথম ভারতীয় সংবাদপত্র সাপ্তাহিক ‘জাম–ই–জাহান জুমা’ প্রকাশিত হয়।

    ১৮৩৭ বিজ্ঞানী উইলি কুন্‌–এর জন্ম।

    ১৮৫৪ ব্রিটেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ক্রিমিয়ায় যুদ্ধ শুরু হয়।

    ১৮৬২ নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত (১৯২৬) ফরাসি রাষ্ট্রনীতিবিদ আরিস্তিদ ব্রিয়া–এর জন্ম।

    ১৮৬৮ রুশ সাহিত্যিক মাক্সিম্‌ গোর্কি–র জন্ম।

    ১৮৫২ অন্ধদের পাঠপদ্ধতির উদ্ভাবক ফরাসি গবেষক লুই ব্রায়ি–র মৃত্যু।

    ১৮৮১ রুশ সংগঠনস্রষ্টা মোদেস্ত মুসোর্‌গাাস্কি–র মৃত্যু।

    ১৮৯২ নোবেলজয়ী শারীরবিদ কর্নেল্লি হিমান্‌জ–এর জন্ম।

    ১৮৯৮ শিক্ষাবিদ ও সমাজসংস্কারক স্যার সৈয়দ আহমদের মৃত্যু।

    ১৯৮২ রসয়ানে নোবেলজয়ী (১৯৪৯) কানাডাজাত মার্কিন বিজ্ঞানী ইউলিয়াম ফ্রাঙ্কোয় গিয়ারুক–এর মৃত্যু।

    ১৯৩০ কনস্টানটিনোপলের নাম ইস্তাম্বুল ও অ্যাঙ্গোরার নাম আংকারা করা হয়।

    ১৯৩৯ মাদ্রিদের আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে স্পেনের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে।

    ১৯৪১ নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু কলকাতা থেকে গোপনে বার্লিন পৌঁছান।

    ১৯৪১ ইংরেজ মহিলা ঔপন্যাসিক ও সমালোচক ভার্জিনিয়া উল্‌ফ্‌–এর মৃত্যু।

    ১৯৪২ কলকাতায় ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়।

    ১৯৪২ রাসবিহারী বসু জাপানের টোকিওতে ভারত স্বাধীন করার আহ্বান জানিয়ে ভাষণ দেন।

    ১৯৪২ স্পেনীয় কবি মিতোল এনান্ডেথ–এর মৃত্যু।

    ১৯৪৩ রুশ সংগীতস্রষ্টা সের্গেই রাহমানিভ–এর মৃত্যু।

    ১৯৪৪ কানাডীয় হাস্যরসস্রষ্টা লেখক ও অর্থনীতিবিদ স্টিফেন লিকক–এর মৃত্যু।

    ১৯৫৭ মার্কিন ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লি–র মৃত্যু।

    ১৯৭৫ বাংলাদেশ ইসলামি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠিত হয়।

    ১৯৮২ নোবেলজয়ী (১৯৪৯) মার্কিন রসায়নবিদ ফ্রান্সিস জিয়ক–এর মৃত্যু।

    ১৯৮৫ রুশ চিত্রশিল্পী মার্ক শাগাল–এর মৃত্যু।

  • কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞা

    কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞা

    কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞা

    জিয়াউল হক মু্ক্তা*
    স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার গোপন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রক্রিয়া ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ বা ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ বা ‘নিউক্লিয়াস’ প্রথম দিকে ছিল তিন জনের একটি ফোরাম; এটি গঠন করেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ। এর গঠন প্রক্রিয়ায় সিরাজুল আলম খান প্রথমে দলে ভেড়ান আব্দুর রাজ্জাককে; পরে সিরাজুল আলম খান আব্দুর রাজ্জাকের সাথে পরামর্শক্রমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সাথে নেন কাজী আরেফ আহমেদকে। উল্লেখ্য, এখানে এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন স্বতঃপ্রণোদিত স্বাধীনতা-সংগ্রামী; এঁদেরকে কাউকে কারোর বোঝাতে হয়নি কেন স্বাধীনতা দরকার।

    ইতিহাসের ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায় আবহমান সময় এঁদের জন্ম দিয়েছেন বাংলার মানুষের মুক্তির আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে। এঁরা ছিলেন আমাদের ভূমির রেভ্যুলুশনারি ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস— যাঁরা রেভ্যুলুশনারি মাসকে নির্দেশনা দিয়েছেন ইতিহাসে মানুষের জয়যাত্রা এগিয়ে নিতে। আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলন তো সারা দুনিয়ার সকল মানুষের মুক্তি আন্দোলনেরই একটি আঞ্চলিক সংস্করণমাত্র— বাঙালি জাতীয়তাবাদের যা অন্যতম প্রধান উপাদানও বটে। যদিও এ দেশের আঠারো ও উনিশ শতকের লেজওয়ালা কম্যুনিস্টদের মস্তিষ্ক এটা উপলব্ধি করার মতো ততোটা বিকশিত হয়ে ওঠেনি তখনও পর্যন্ত।
    ১৯৬২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে গঠিত নিউক্লিয়াস পরে আরও দু’জনকে অন্তর্ভুক্ত করে: একজন আবুল কালাম আযাদ [১৯৬৪] ও অপরজন চট্টগ্রামের আব্দুল মান্নান [১৯৬৫]। পরে আবুল কালাম আযাদ নিউক্লিয়াসের কজ ও কাজের প্রতি আনুগত্য বহাল রেখে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি নেন নিজের পারিবার-সদস্যদের সহযোগিতা করার লক্ষ্যে আয়রোজগারে যুক্ত হতে। উল্লেখ্য, নিউক্লিয়াসের সদস্যদের কোন সার্বক্ষণিক পেশায় যুক্ত হওয়া আর প্রেম-ভালোবাসা-বিয়ে ও পারিবারিক দায়বদ্ধতায় জড়ানো ছিল নিষিদ্ধ। নিউক্লিয়াস আব্দুল মান্নানকে অব্যাহতি দেয় তাঁর কাজের ধীরগতি ও অনিয়মিত যোগাযোগের জন্য।
    উল্লেখ্য, আবুল কালাম আযাদ ছিলেন এমন এক তরুণ, যিনি দারিদ্র্যের তীব্র কষাঘাতে মাত্র সাত বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে জন্মস্থান নোয়াখালি থেকে অভিবাসী হন অনেক দূরের যশোরে অন্যের বাড়িতে রাখালবৃত্তি করে নিজের খাওয়াদাওয়া নিশ্চিত করতে ও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে। নবম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি কোনোদিন পাঠ্য বই কিনতে পারেননি; এ সময় তিনি রাখালবৃত্তি ছেড়ে টিউশনি শুরু করেন এবং তা অব্যাহত রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে শিক্ষকতায় যুক্ত হবার আগ পর্যন্ত। ১৯৬২ সালে তিনি প্রবেশিকা পাশ করেন, এবং এ সময়ই তিনি বৃহত্তর যশোর-খুলনা জেলায় শিক্ষা আন্দোলন সংগঠিত করে ছাত্রলীগের ব্যাপকভিত্তি দেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ও নিউক্লিয়াসভুক্ত হন। তিনি বারবার কারাবরণ করেছেন, এবং আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে বহু লোমহর্ষক প্রত্যক্ষযুদ্ধের সামরিক নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আন্দোলন, প্রাথমিক শিক্ষার জাতীয়করণ ও শিক্ষকদের দাবিদাওয়া অর্জনের একচ্ছত্র নেতৃত্ব অর্জন করেন ও সেসব দাবি আদায়ে সফল হন। স্মর্তব্য, ১৯৮১ থেকে ১৯৮৪ সালকালপর্বে জাসদ তাঁর নেতৃত্বাধীন শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনকে নিরঙ্কুশ সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করে। 
    পরবর্তী জীবনে আবুল কালাম আযাদ যেহেতু কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলেন না, তাই তাঁকে স্মরণ করার কেউ নেই। সেজন্যই, কাজী আরেফ আহমেদ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তাঁর প্রসঙ্গ এল বলে— সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তাঁর সম্পর্কে কিছুটা জানিয়ে রাখছি। এ মহান জাতীয় বীরকে ভুলে গেলে আমাদের জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের কন্টেন্ট ও এসেন্স আমরা বুঝতে পারবো না।
    আবুল কালাম আযাদের অনন্য কীর্তির একটি হলো, ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণার আগেই, ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে তিনি পূর্ব-বাংলার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্যের ওপর একটি গবেষণা প্রবন্ধ রচনা করেন; এ প্রবন্ধটি ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় আলোচিত হয়; মূল প্রবন্ধ ও ছাত্রলীগের বর্ধিত সভার আলোচনার ভিত্তিতে এ বিষয়ে একটি পুস্তিকাও রচিত হয়; ছাত্রলীগের তখনকার সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের ভূমিকাসহ এ পুস্তিকা সারা পূর্ববাংলায় প্রচারিত হয়। এর ফলে পরে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণা করলে তা সাথে সাথে পূর্ব বাংলা ও পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য বিষয়ে জ্ঞাত ছাত্রলীগের কাছে বাঙালির ম্যাগনাকার্টা বা অধিকারের সনদ হিসেবে গৃহীত হয়। 
    ১৯৬৬ সালের বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগসহ কোন রাজনৈতিক দল একে সমর্থন করেনি। কাজী আরেফ আহমেদ ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগরের সে সময়ের সভাপতি হিসেবে নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্তে ৬ দফার পক্ষে সর্বপ্রথম বিবৃতি দেন; তিনি হলেন ৬ দফার প্রথম সমর্থক। নিউক্লিয়াসের নিয়ন্ত্রণাধীন ছাত্রলীগ ছিল সর্বপ্রথম সংগঠন যা ৬ দফাকে সমর্থন করে রাজনৈতিক অবস্থান নেয়। নিউক্লিয়াসপন্থি এমএ আজিজের নেতৃত্বাধীন চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ১৩ ফেব্রুয়ারি ৬ দফার পক্ষে বিবৃতি প্রদান করে। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে— এ ৬ দফা নিয়ে বিরোধের ফলে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল; ৬ দফাপন্থি আওয়ামী লীগ আর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট বা পিডিএম-এর ৮ দফাপন্থি আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল। 
    এখানে মাঝখানে একটু বিনোদনের জন্য একটি বিশেষ বিষয়ের দিকে তাকানো যাক। কাজী আরেফ আহমেদ ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থিদের সাথে অন্যান্য দল-মতের কোন ধরনের গুন্ডামি সহ্য করতেন না; তিনি নিজে গুন্ডা ধরনের ব্যক্তি ছিলেন না, কেননা গুন্ডারা সবসময় এক্সপোজড হয়ে যায় এবং যা তাঁর [কাজী আরেফ আহমেদ-এর] চরিত্র ও কাজের ধরনের বিরোধী; তিনি ছিলেন নিজেকে এক্সপোজ করার ঘোর বিরোধী এবং তিনি চলাফেরা করতেন ভীষণ সন্তর্পনে। কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি নিজে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থি অংশের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করতেন; আর পরবর্তীকালে তিনি লালন-পালন করেছেন সেসব নিবেদিতপ্রাণ সাহসী তরুণদের যারা ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থিদেরকে এনএসএফ ও ছাত্র ইউনিয়নের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতেন, প্রয়োজনে কাউন্টার-অ্যাটাক করতেন। 
    ৬ দফা ঘোষণার পর আবুল কালাম আযাদ আবারও সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াসের নির্দেশে রচনা করেন মুক্তিপাগল তরুণদের জন্য আবেগময় এক বই: সংগ্রামী বাঙলা। ‘সংগ্রামী বাঙলা’য় বাংলার ঐতিহাসিক ঐতিহ্য তুলে ধরার পাশাপাশি— শেষ অধ্যায়ের আগের অধ্যায়ে ৬ দফা ব্যাখ্যা করা হয় ও ১৯৬৬-র ৭ জুনের হরতালের ওপর আলোকপাত করা হয়; আর শেষ অধ্যায়ে দেড় পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকে ‘বাংলার নেতা’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। এতে আবেগময় ভাষায় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলা হয়, “শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর শৈশব গ্রাম-বাংলার বুকেই কাটান। তিনি এদেশের মাটির মানুষ। সকালে পান্তা খেয়ে স্কুলে যাওয়া, ছুটির দিনে মাঠে ও নদীর ধারে ঘুরে বেড়ানো আর মাছ ধরা ছিল তাঁর অন্যতম প্রিয় শখ। বাংলার ধূলিকণা আর ঝড়-ঝঞ্ঝায় প্রস্তুত হয়েছে মুজিবের অনু-পরমানু। তিনি বাংলার মাটির মানুষ। গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষ। বাংলার নেতা।” তবে এ বইয়ের এমনকি বাংলাদেশ সংস্করণেও কেন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৯২০ সালের ১৭ মার্চের পরিবর্তে ১৯২২ সালের ২২ নভেম্বর লেখা রয়েছে তা রহস্যজনক বৈকি! হতে পারে এটা সার্টিফিকেটে দেয়া জন্ম তারিখ।
    সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে ১৯৬৭ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এ বইয়ের প্রকাশক ছিলেন তোফায়েল আহমদ। এপ্রিলে পাকিস্তান সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে; কিন্তু ছাত্রলীগ এর প্রচার-প্রচারণা ও ব্যবহার অব্যাহত রাখে। সারা জীবন সিরাজুল আলম খানকে গুরু মেনে অসংখ্য বক্তৃতা দেয়া তোফায়েল আহমদ সম্প্রতি বিশেষ মহলকে খুশি করে কিছু প্রাপ্তিযোগের আশায় সিরাজুল আলম খানের বিরুদ্ধে অশালীন ও স্ববিরোধী বক্তব্য রেখেছেন— যা খুবই দুঃখজনক। সে যাক। বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রত্যেক গবেষক-পাঠককে মনে রাখতে হবে— তৎকালে বিরাজমান কোন লেখক-বুদ্ধিজীবীর রচনা নয়— ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে আবুল কালাম আযাদ ও নিউক্লিয়াস/ছাত্রলীগের প্রযোজনায় আঞ্চলিক বৈষম্য বিষয়ক প্রবন্ধ ও পুস্তিকা, ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু-ঘোষিত ছয় দফা ও ১৯৬৭ সালে আবুল কালাম আযাদের বই ‘সংগ্রামী বাঙলা’ ছিল বাঙালির নিজস্ব নির্ধারক রাজনৈতিক-সাহিত্য যা স্বাধীনতা সংগ্রামকে শাণিত করেছিল। সে যাক। ফেরা যাক মূল প্রসঙ্গে। 
    ৬ দফার পক্ষে সক্রিয় অবস্থান নেয়া সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও আবুল কালাম আযাদ ১৯৬৪—১৯৬৫ সময়কালে জেলে অন্তরীণ থাকায় কাজী আরেফ আহমেদকে শুধু ঢাকা মহানগর নয়, বরং সারা দেশে নিউক্লিয়াসের সাংগঠনিক কাজের দেখভাল করতে হয়; অবশ্য এ সময় তিনি কারাগরে অন্তরীণ সিরাজুল আলম খানের সাথেও কিছুটা যোগাযোগ রাখতেন। নিউক্লিয়াসের উল্লিখিত তিন জন জেলে থাকার পরও কাজী আরেফ আহমেদের একক নেতৃত্বে কেবলমাত্র ঢাকাতেই নিউক্লিয়াসের অনুসারীর সংখ্যা চার/পাঁচ শ’তে উন্নীত হয়; বর্ণিত তিন জন জেলে যাবার আগে সারা পূর্ব বাংলায় নিউক্লিয়াসের অনুসারীর সংখ্যা ছিল তিন শত আর ঢাকায় তা ছিল দুই শত।
    পরে আব্দুল মান্নানের অব্যাহতি ও আবুল কালাম আযাদের কাঠামোগত বিযুক্তির ফলে ১৯৬৯ সালের সূচনায় নিউক্লিয়াস আবার সেই প্রতিষ্ঠাকালীন তিন সদস্যের কেন্দ্রীয় কাঠামোয় পরিণত হয়। শুরু থেকেই এ কেন্দ্রীয় কাঠামোর সদস্যদের কাজের কঠোর শ্রেণিবিভাজন না থাকলেও, কাজী আরেফ আহমেদের প্রধান দায়িত্ব ছিল ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের দেখভাল করা। স্বাধীনতা-পূর্বকালের কাজী আরেফ আহমেদের— স্বভাবগতভাবে যিনি ছিলেন অর্ন্তমুখি— ব্যক্তি-চরিত্রের প্রধানতম শক্তি ছিল তাঁর তীব্র তীক্ষ্ন ইনট্যুইশন বা সজ্ঞা। সিরাজুল আলম খান সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর জীবনালেখ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ঘুরে ফিরে বারবার কাজী আরেফের এই সজ্ঞা বা ইনট্যুইশন ও এর ঐতিহাসিক উপযোগিতার আবশ্যিকতার স্বীকৃতি দিয়েছেন। 
    সিরাজুল আলম খান বলেছেন যে ১৯৬২-র শেষ দিকে “… খুবই তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন অথচ স্বল্পভাষী এক তরুণ কাজী আরেফ আহমেদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সে তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। মাত্র আইএ পাশ করে বিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। আরেফের মধ্যে ঘটনার ভেতরে না থেকেও আড়াল-অন্তরাল থেকে ঘটনা পর্যবেক্ষণ, পরিকল্পনা ও কাজ করার যোগ্যতাসম্পন্ন একজন তরুণকে খুঁজে পেলাম। সাধারণ আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠি।”
    কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা বা ইনট্যুইশন সম্পর্কে তিনি আরও বলছেন, “প্রাথমিকভাবে দেখলাম ছাত্র হিসেবে অতি মেধাবী না হলেও কাজ করার যে দক্ষতা এবং শৃঙ্খলা ও নিপুণতা আরেফের আছে তা এর আগে আমি আর কারো মধ্যে দেখিনি। আমরা দুইজন যখন আলাপ করতাম অনেক সময় প্রাথমিকভাবে দ্বিমত করলেও সিদ্ধান্তের পর মুহূর্তে সিদ্ধান্তের আগের দ্বিমতকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে সিদ্ধান্তভিত্তিক কাজ করার মানুষও আমি এর আগে পাইনি। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অনেককে সে সন্দেহের চোখে দেখতো। এটা ছিল তার স্বভাবজাত।” 
    তাঁর এ সজ্ঞা বা ইনট্যুইশনের বিষয়টি আমরা একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্মের যারা তাঁর সাহচর্য পেয়েছি, তারাও কিছুটা জেনেছি ও উপলব্ধি করেছি। তাঁর এ সজ্ঞা বা ইনট্যুইশন তাঁর চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠেছিল তাঁর অন্য একটি স্বভাবের কারণে— সেটা হলো তাঁর বস্তুনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা। এ বিষয়ে আবারও সিরাজুল আলম খানের দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে; তিনি বলেছেন, “দেখেছি, আমরা অনেক সময় কোনো বিষয়ে উপস্থিত ও আবেগনির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে চাইলেও, আরেফের একটি গুণ ছিল এই যে, কোনো ধরনের আবেগকেই সাধারণত সে গুরুত্ব দিতো না। বরং যে-কোনো বিষয়ের ভালো ও মন্দ দিকগুলো অত্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তারপর তার নিজের সিদ্ধান্তে আসতো। আরেফের এই বিশেষ গুণটি বহু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ‘নিউক্লিয়াস’-এর কাজে লেগেছে।”  
    তো আবারও যাওয়া যাক নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রীয় কাঠামো বিষয়ে। নিউক্লিয়াসের একটি সৌন্দর্য ছিল, তা হলো এর প্রত্যেক সদস্যের ভেটো প্রদানের ক্ষমতা। এটা উপলব্ধ যে কাজী আরেফ আহমেদই সম্ভবত বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর ভেটো ক্ষমতার প্রয়োগ করতেন সবচেয়ে বেশি, ফলে কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হলেও চূড়ান্ত বিচারে তা নিউক্লিয়াসকে ব্যাপক যথার্থতা প্রদান করেছে, তা সিরাজুল আলম খান নিজেও স্বীকার করেন। এক পর্যায়ে নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রীয় কমান্ডের সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব এলেও কাজী আরেফ আহমেদের ভেটোর ফলে তার বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এখানে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে এ ভেটোটি ছিল কেন্দ্রীয় কমান্ড প্রসঙ্গে; সারা দেশে নিউক্লিয়াসের অধঃস্তন সদস্য, সেল ও উপকমিটিগুলোতে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত নিতেন সশ্লিষ্ট উর্ধতন সংগঠক। 
    তবে নিউক্লিয়াসের তিন সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমান্ড একজনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কাজী আরেফ আহমেদ তাঁর ব্যাপারে ভেটো দেননি: তিনি হলেন মনিরুল ইসলাম বা সকলের প্রিয় মার্শাল মনি। মার্শাল মনি ১৯৬০ সালে প্রবেশিকা পাশের পর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাত্রলীগে যুক্ত হন ও ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হন। পরে তাঁকে নিউক্লিয়াস কেন্দ্রীয় কমান্ডে যুক্ত করা হয়। সিরাজুল আলম খান জানাচ্ছেন, “মার্শাল মনি ছাড়া আর কাউকে ‘নিউক্লিয়াস’-এর মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণের অংশীদার করা হয়নি।” তাঁকে নির্বাচন করাটা ছিল নিউক্লিয়াসের এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত। 
    সে সময় ৬ দফা ভিত্তিক স্বাধীনতা আন্দোলন দ্রুত ব্যাপ্তি পাচ্ছিল; সিরাজুল আলম খান ও আব্দুর রাজ্জাককে অভ্যন্তরীণভাবে আপওয়ার্ড কম্যুনিকেশনসে ও ক্ষেত্রবিশেষে এক্সটার্নাল কম্যুনিকেশনসেও জোর দিতে হচ্ছিল। তখন কাজী আরেফ আহমেদ নিয়োজিত ছিলেন তাঁদের তিনজনের পক্ষে ছাত্রলীগের দেখভাল করার জন্য আর ছাত্রলীগের কমিটিভুক্ত ছিলেন বিধায় মার্শাল মনি ছিলেন ছাত্রলীগে নিউক্লিয়াসের প্রধান ব্যক্তিত্ব। মার্শাল মনি তাঁর ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র’ বইটির উৎসর্গপত্রে লিখেছেন, “এই লেখার বহু তথ্য অকথিত ইতিহাসের অংশ। যে-অংশের অনেক স্থানেই আমার প্রবেশাধিকার না থাকলেও রাজনৈতিক অঙ্গনের সুদীর্ঘ দিনের বন্ধু কাজী আরেফ আহমেদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে জানার সুযোগ ঘটেছে। যা এ লেখার মূল বিষয়ের বিস্তৃতিতে বিশেষভাবে সহায়তা করেছে। এ লেখাটি তাই তার প্রতি উৎসর্গ করাটাই শ্রেয়।” আমরা নিজেরাও কাজী আরেফ আহমেদের মুখে বহুবার শুনেছি: ‘আমার দোস্ত মার্শাল মনি’। তাঁদের এ বন্ধুত্ব, আমাদের জাতীয় ইতিহাসে— কীর্তিময় এক বন্ধুত্ব। 
    কীভাবে? ইচ্ছে করলে অনেক উদাহরণ দেয়া যায়, তবে এখানে শুরুতে মাত্র তিনটি বিশেষ বিষয় উল্লেখ করবো। 
    প্রথমত, মার্ক্সিয় দর্শনের তৃতীয় সূত্রের বরাতে বলা যায়— পরিমাণের গুণে উত্তরণ। ছাত্রলীগ ততোদিনে অপরাপর ছাত্র সংগঠনগুলোকে ছাড়িয়ে দেশের বৃহত্তম ছাত্র সংগঠনে উন্নীত হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী ছাত্র ইউনিয়নের ব্যাঙ্গোক্তির ভাষায় ছাত্রলীগ ছিল তথাকথিত আঞ্চলিকতাবাদ ও প্রাদেশিকতাবাদের দোষে দুষ্ট একটি সংগঠন। হ্যাঁ, ছাত্রলীগের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা অর্জনের স্পৃহাকে ছাত্র ইউনিয়ন তাই মনে করতো। 
    তখনও ছাত্রলীগ স্বাধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে যে পরিমাণ উচ্চকণ্ঠ ছিল, সে পরিমাণ উচ্চকন্ঠ ছিল না স্বাধীন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে। নিউক্লিয়াসের একদম শুরুর দিকে, এমনকি সিরাজুল আলম খান নিজেও সমাজতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন না; সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, কাজী জাফর আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো ও মাহবুব উল্লাহ প্রমুখ ছাত্র ইউনিয়ন নেতাদের সাথে বিতর্ক করতে করতে ও তাঁদের দেয়া বইপত্র পড়তে পড়তে তিনি সমাজতন্ত্রের দীক্ষা নেন। শুরুর দিকে, তাঁর নিজের ভাষায়, ‘মূলত কমিউনিজমের বিরোধিতা করার জন্যই আমি এসব বই [সমাজতান্ত্রিক সাহিত্য] পড়ার প্রয়োজন মনে করেছিলাম’। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সক্রিয় স্বাধীকার ও স্বায়ত্তশাসনপন্থি স্কুল কলেজের ছেলে-মেয়েরা ছাত্র ইউনিয়নের দিকে টিপ্পনি কাটতো: ‘হো হো মাও মাও, চিন যাও ব্যাঙ খাও।’ 
    স্বাধীকার-স্বাধীনতাপন্থি ছাত্রলীগ সদস্যদের বা নিউক্লিয়াস অনুসারীদের— স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকল্প নেই— এমন দীক্ষায় দীক্ষিত করেন মার্শাল মনি। বলা চলে স্বাধীনতার লক্ষ্যে যে হাজার হাজার ছাত্র-তরুণ-যুবদের সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগের পতাকাতলে আকৃষ্ট ও সমবেত করেছিলেন সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ এবং স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে যাঁরা স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে ছাত্রলীগে যোগদান করেছিলেন— মার্শাল মনি তাঁদের চেতনাজগতের গুণগত রূপান্তর ঘটান, তিনি তাঁদেরকে সমাজতন্ত্রের দীক্ষায় শিক্ষিত নিষ্ঠাবান এক যোদ্ধাবাহিনীতে রূপান্তরিত করেন। এ কাজে তাঁর সাথে টিম-আপ হয়েছিলেন ছাত্রলীগের স্বতঃপ্রণোদিত ও স্বশিক্ষিত এক গুচ্ছ সাহসী তরুণ। নিউক্লিয়াসের পক্ষে ছাত্রলীগের এ আদর্শগত রূপান্তরের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে মার্শাল মনি কাজী আরেফ আহমেদ ও নিউক্লিয়াসের অনুমোদন পান, প্রেরণা পান। নিউক্লিয়াস কেন্দ্রীয় কমান্ডের পক্ষে কাজী আরেফ আহমেদ প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন মার্শাল মনির সাথে।
    যদিও ১৯৬৩ সাল থেকেই নিউক্লিয়াসের সুকৌশলী নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতো ছাত্রলীগ, স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের দীক্ষায় দীক্ষিত সদস্যগণ সাংগঠনিকভাবে ছাত্রলীগের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ নেন ১৯৭০ সালের ২০ মার্চের কাউন্সিল থেকে। এ কাউন্সিলে নির্বাচিত ৪৫ জনের কেন্দ্রীয় কমিটির ৩৮ জনই ছিলেন স্বাধীনতাপন্থি ও সমাজতন্ত্রী; বাকি ৭ জন ছিলেন স্বায়ত্তশাসনপন্থি। স্বায়ত্তশাসনপন্থিদের নেতৃত্ব দিতেন নূরে আলম সিদ্দিকী আর স্বাধীনতাপন্থি ও সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্ব দিতেন মার্শাল মনি। স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের পক্ষে নীতিগত ও সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৭০ সালের আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে— ছাত্রলীগের বর্ধিত সভা, কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ও ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে মধুর ক্যান্টিনে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভার মাধ্যমে। বর্ধিত সভা ও কেন্দ্রীয কমিটির সভার ট্যাকটিক্যাল দিকটি ছিল— সারা দেশে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের বার্তা শক্তিশালীভাবে প্রচার করা। বর্ধিত সভার এক পর্যায়ে প্রথম দিন সন্ধ্যায় কাজী আরেফ আহমেদ টিএসসিতে মার্শাল মনিকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-এর পক্ষে আলোচনা পরিচালনা করতে বলেন; মার্শাল মনি গণপ্রজাতন্ত্রকে কোয়ালিফাই করে ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা পরিচালনা করতে চাইলে কাজী আরেফ তা অনুমোদন দেন। সভায় স্বপন কুমার চৌধুরী এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ছাত্রলীগের বর্ধিত সভা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় সংঘটিত এ আলোচনা আওয়ামী রাজনৈতিক-সাংগঠনিক পরিমণ্ডলে সারা দেশের স্বাধীনতাপন্থি নেতা-কর্মী-সংগঠক-সদস্যদের বিশেষ বার্তা প্রদান করে। ২০২১ সালে এ গল্প খুব সাধারণ মনে হলেও ১৯৭০ সালে উত্থাপিত এ প্রস্তাব ও বিতর্ক ছাত্রলীগের ক্লাইমেক্স ছাপিয়ে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও ক্রাইসিস তৈরি করে। বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খানের আলোচনার মধ্য দিয়েও এ ক্লাইমেক্স ও ক্রাইসিসের অবসান হয়নি। অবশেষে ১৭ সেপ্টেম্বর মধুর ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ আয়োজিত শিক্ষা দিবসের আলোচনায় চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এমএ আজিজ স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের পক্ষে নিজের কঠোরতম সমর্থন ব্যক্ত করায় সেসবের আপাত-অবসান ঘটে। বঙ্গবন্ধু নিজেও হাফ ছাড়েন। 
    উল্লেখ্য, মার্শাল মনি ও তাঁর টিমের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক দীক্ষায় শিক্ষিত এ ছাত্র-তরুণ-যুবগণ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স-বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং তাঁরাই ১৯৭২ সালে সারা দেশে জাসদ গঠনে নেতৃত্ব দেন। আরও উল্লেখ্য, নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে এ বিএলএফ গঠন করা হয়েছিল অনেক আগেই, ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে, আর প্রায় একই সময়ে বিএলএফ-এর সামরিক শাখা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল জয় বাংলা বাহিনী। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে বিএলএফ বিস্তারিত কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল, সেসব পরে আলোচনা করা যাবে; তবে এখানে এটুকু বলে রাখা যাক যে বঙ্গবন্ধু বিএলএফ-এর জন্য অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক পরিসরে উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বিএলএফ-এর অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ অভ্যন্তরীণভাবে সমন্বয়ের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ।  
    দ্বিতীয়ত, ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যারিষ্ঠতা অর্জন বিষয়। ছাত্রলীগের আঞ্চলিক-বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন ও উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে ১৯৭০-এর নির্বাচনকে বঙ্গবন্ধু ও নিউক্লিয়াস এক দফা স্বাধীনতার দিকে জনগণের ম্যান্ডেট নেবার কৌশল হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। এ নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু ও নিউক্লিয়াস এতটাই শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছিলেন যে এমনকি সত্তরের ১২ নভেম্বরের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েক লাখ মানুষ মারা যাওয়া সত্ত্বেও উপদ্রুত এলাকা ছাড়া সর্বত্র নির্বাচনের ব্যাপারে তাঁরা অনড় থাকেন। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ এ নির্বাচন বর্জন করে। এ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলম খানের নির্বাচিত প্রায় দুই শত নবীন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেন; অবশ্য এর অনেক আগেই বঙ্গবন্ধু সিরাজুল আলম খানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের সংগ্রামী অংশের মাধ্যমে সারা দেশে আওয়ামী লীগের পুরোনো নেতৃত্ব প্রতিস্থাপন করে আওয়ামী লীগের দখল নেয়ার জন্য। 
    সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের লক্ষ্যে নিউক্লিয়াস একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রায় দেড় হাজার বিএলএফ কর্মীকে তিন থেকে পাঁচ জনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে সারা দেশের সকল প্রার্থীর পক্ষে গণসংযোগ ও প্রচারের কাজে নিয়োগ দেয়া হয়। এ কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় মার্শাল মনিকে, তাঁকে সহযোগিতা করেন আফম মাহবুবুল হক। মার্শাল মনিকে এ কাজের দায়িত্ব দেয়ায় নিঃসন্দেহে কাজী আরেফ আহমেদের ভূমিকা ছিল বলে ধরে নেয়া যায়, কেননা ইতোপূর্বে নিউক্লিয়াসের পক্ষে তিনিই ছিলেন মার্শাল মনির তথা ছাত্রলীগের রাজনৈতিক অভিভাবক।
    তৃতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও শাসন-প্রশাসন বিষয়ে [ক] বিএলএফ-এর চার প্রধানের ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এর সুপারিশ, [খ] জানুয়ারির শেষে সিরাজুল আলম খানের দেয়া ১৫ দফা সুপারিশ, [গ] ছাত্রলীগের মার্চ মাসের বর্ধিত সভা ও সাধারণ সভার সুপারিশ, [ঘ] আসম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজের দেয়া মে মাসের সুপারিশ ও [ঙ] ৭ জুন আবারও ছাত্রলীগ কর্তৃক দেয় সুপারিশ বঙ্গবন্ধু গ্রহণ না করায় এবং জুলাই মাসে ছাত্রলীগের সম্মেলনে নিরপেক্ষ না থেকে সংখ্যালঘুদের উপদলীয় সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে তাদের সমর্থন দেয়ায়, কাঠামোগতভাবে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন বিষয়ে নিউক্লিয়াসের দু’জন— সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ আহমেদ— প্রাথমিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এটা মনে রাখতে হবে যে তাঁরা দু’জন জাসদ গঠনে একমত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও [তৃতীয়জন, আব্দুর রাজ্জাক দল গঠন বিষয়ে একমত হননি], সিদ্ধান্তের জন্য দাবি/চাপ এসেছিল সারা দেশের হাজার হাজার স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকেই— যাঁরা সকলে ছিলেন মার্শাল মনির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারায় দীক্ষিত। 
    উল্লিখিত তিনটি বিশেষ বিষয়ের পাশাপাশি ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞার আরো দুটো বিশেষ বিষয়ের উল্লেখ করতে হয়। 
    প্রথমত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মহান সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের পরাজয়ের পর কাজী আরেফ আহমেদ বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির ও জাসদীয় রাজনীতির পক্ষে এক উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেটা হলো মোশতাক-জিয়া চক্রের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা পাকিস্তানপন্থার বিরুদ্ধে জাসদ ও আওয়ামী লীগসমেত মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলা— যদিও জাসদ ও আওয়ামী লীগ ১৯৭২ থেকে পরস্পরবিরোধী রাজনীতির চর্চা করেছে। অতীত ক্ষত ও বিরোধ ভুলে জাতীয় প্রয়োজনে ঐক্যের রাজনীতি পরিচালনা বিষয়ে তাঁর এ প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্ত— যদিও বারবার তা বিবিধ ষড়যন্ত্রে মুখ থুবড়ে পড়েছে— বাংলাদেশের রাজনীতিতে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে নির্ধারক ভূমিকা রেখেছে। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার আলোকে ও সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালে জাসদ ও আওয়ামী লীগসমেত গঠিত হয়েছিল ১০ দলীয় ঐক্যজোট ও পরে এরশাদ ক্ষমতায় আসলে গঠিত হয়েছিল ১৫ দল। তাঁর দেখানো পথেই— তাঁর প্রয়াণের পর— সর্বশেষ বিএনপি-জামাত-জঙ্গির বিরুদ্ধে জাসদ আওয়ামী লীগের সাথে গঠন করেছে ১৪ দল। ১৪ দল এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে সফলতম একটি আদর্শগত জোট। 
    আর দ্বিতীয়ত, ১৯৯০ সালে অবৈধ সামরিক জান্তা এরশাদের পতনের পর, সূচিত আংশিক গণতন্ত্র থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি নিউক্লিয়াসের পুরোনো সহকর্মী আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে নেতৃত্বে রেখে যুদ্ধাপরাধ বিচারের আন্দোলন এগিয়ে নিতে গঠন করেন ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন জাতীয় সমন্বয় কমিটি’; জাসদের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য হিসেবে তিনি ও আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলির সদস্য হিসেবে আব্দুর রাজ্জাক এ ‘জাতীয় সমন্বয় কমিটি’র ‘স্টিয়ারিং কমিটি’র সদস্য হিসেবে মূল নীতি-নির্ধারণী ভূমিকা পালন করেন এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে লিয়াঁজো রাখেন; এবং সংগঠিত করেন ঐতিহাসিক গণআদালত। ক্রমে এ আন্দোলন বাংলাদেশের তরুণ সমাজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে ওঠে এবং জাতীয় রাজনীতির নির্ধারক উপাদানে পরিণত হয়। সর্বশেষ ২০০৯ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশে সূচিত হয় যুদ্ধাপরাধ বিচারপ্রক্রিয়া। একদম শুরু থেকেই জাসদ একনিষ্ঠভাবে সারা দেশে এ আন্দোলনে যুক্ত থাকে। 
    স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ বা নিউক্লিয়াস গঠনের যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের বাইরে এখানে কাজী আরেফ আহমেদের সজ্ঞা ও প্রজ্ঞার পাঁচটি উদাহরণ আলোচনা করা হলো। সংক্ষেপে এগুলো হলো— [১] নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় মার্শল মনিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবে ভেটো প্রদান না করে তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করা, [২] মার্শাল মনি ও তাঁর টিম কর্তৃক ছাত্রলীগের রাজনৈতিক-দার্শনিক রূপান্তরে সম্মতি ও সহযোগিতা দেয়া ও স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা, [৩] জাসদ গঠন বিষয়ে সিরাজুল আলম খানের সাথে যৌথ-সিদ্ধান্ত নেয়া, [৪] ১৯৭৫ সালের পর আবারও মুক্তিযুদ্ধের ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ঐক্যের রাজনীতির সূচনা করা, এবং [৫] যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্দোলন সংগঠিত করা। 
    এগুলো ছাড়াও বাঙালির জাতীয় মুক্তি আন্দোলন পরিচালনায় ও বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালনার লক্ষ্যে তাঁর ছোট-বড় আরও অনেক ভূমিকা রয়েছে। যেমন বলা যায় পূর্ব বাংলায় বাংলা ভাষা প্রচলনের লক্ষ্যে তাঁর উদ্যোগে ও নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলা ভাষা প্রচলন আন্দোলন। তাঁর এ আন্দোলনী-প্রয়াসেই পূর্ব বাংলায় উর্দু ও ইংরেজির পরিবর্তে বাংলায় সাইনবোর্ড ও গাড়ির নাম্বার প্লেট লেখা হতে থাকে। তিনি ছিলেন সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধু কর্তৃক অস্ত্র আমদানি ও প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য নিউক্লিয়াস মনোনীত কেন্দ্রীয় ব্যক্তি; যদিও একাত্তরের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের কারণে তা বিলম্বিত/স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। 
    ঘাতকের বুলেট কাজী আরেফ আহমেদকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। ওই সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান উপদেষ্টা/কার্যালয়ের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থেকে বাংলাদেশের এক বড় অংশকে সন্ত্রাসীদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করছিলেন— কেননা এ সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানপন্থা-দক্ষিণপন্থার ভাড়াটে বাহিনী হিসেবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় দক্ষিণপন্থার বিদ্যমানতা বহাল রাখতে চাইছিল।  
    কাজী আরেফ আহমেদ চলে গেছেন মহাকালের পথে; কিন্তু আমরা জানি মহাকাল তাঁকে হারিয়ে ফেলতে পারবে না, লুকিয়ে রাখতে পারবে না। যতো দিন বাংলা ও বাঙালি থাকবে— ততো দিন উদ্ভাসিত থাকবেন বাঙালির জাতীয় বীর কাজী আরেফ আহমেদ। বীরের মৃত্যু নেই। শহীদ কাজী আরেফ আহমেদ অমর হোন। জয় বাংলা। 
    * লেখকঃ জিয়াউল হক মুক্তা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং জাসদের মুখপত্র ‘লড়াই’-এর সম্পাদক ও প্রকাশক।

  • সলঙ্গা বিদ্রোহ : চাপা পড়া ইতিহাস

    সলঙ্গা বিদ্রোহ : চাপা পড়া ইতিহাস

    ইমাম গাজ্জালী

    আজ থেকে শতবর্ষ আগে, এই দিনে সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায় বড় ধরণের গণহত্যা সংঘটিত করেছিল ব্রিটিশ পুলিশ ও সৈন্য। একটা হাটে বিলেতি পণ্য বর্জনের শান্তিপূর্ণ আয়োজনে গুলি করে গণহত্যা চালানো হয়। সেখানে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আড়াল করতে সাড়ে চার হাজার মানুষ ‘হতাহত’ হয়েছিল বলে সরকারিভাবে স্বীকার করা হয়েছিল।

    ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি। এ ঘটনার তিন বছর আগে ১৯১৯ সালের ২৪ এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিনওয়ালাবাগে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে ৩৭৯ থেকে এক হাজার লোক নিহত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। সে ঘটনাটি নিয়ে উপমহাদেশে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশের দেওয়া নাইট উপাধি প্রত্যাখান করেছিলেন। অথচ শতবছরেও সলঙ্গা বিদ্রোহের ঘটনাটি সামনে আসেনি, আসেনি আলোচনায়। বিষয়টি বিষ্ময়কর।

    সলঙ্গা বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে জার্মানের অক্ষ শক্তির পরাজয় হলেও, পর্যুদস্থ হয়েছিল ব্রিটিশ শক্তি। এছাড়া যুদ্ধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের একতরফা ভারতীয় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্তে লোকজনের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাধতে থাকে। ঠিক সেই সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রাওলাট আইন নামে একটি আইন পাশ করা হয়। ভারতের ভাইসরয় ও ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ১৯১৯ সালের ৬ এপ্রিল এ আইন বলবৎ করে। এ আইনবলে ভারতবাসীর ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন শুরু হয়। ন্যূনতম প্রমাণ দাখিল ব্যতিরেকেই সেনা ও পুলিশকে সাধারণ ভারতীয়দের গ্রেপ্তার, জেল-জরিমানা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি দেওয়া হয়। পুলিশের দমন পীড়নে মানুষ ক্ষোভে ফুসতে থাকে।

    অন্যদিকে, তুরস্কের সুলতানকে বিশ্বের সকল সুন্নী মুসলমানদের খলিফা বলে মনে করতেন খেলাফতিরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) তুরস্ক ছিল জার্মানীর নেতৃত্বে অক্ষ শক্তির পক্ষে। তাদের পরাজয় ঘটে। তুরস্কের অখণ্ডতা হুমকিতে পড়ে। মুস্তাফা কামাল তুরস্কের সুলতানকে সিংহাসনচ্যুত করলে ব্রিটিশ সরকার কামালকে সমর্থন করেন। তখন লাখ লাখ ভারতীয় মুসলমান সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হন। তারা তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার দাবি তোলেন। তুর্কি সুলতান বা খলিফার মর্যাদা ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রাখার দাবিতে মুসলমান নেতারা খিলাফত কমিটি গঠন করেন। তাঁদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের ঔদাসিন্যের অবসান ঘটাতে সচেষ্ট হন।

    উল্লেখ্য, খেলাফতিরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি। মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্না খেলাফত আন্দোলনকে সমর্থন দেননি। কংগ্রেস খেলাফত আন্দোলনকে সমর্থন জানায়।

    অপরদিকে, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মুখতার আহমেদ আনসারী, হাকিম আজমল খান, আব্বাস তয়েবজি, মওলানা মহম্মদ আলি ও মওলানা শওকত আলী প্রমুখ মুসলিম নেতারা গান্ধীকে সমর্থন করেন। ১৯১৯ ও ১৯২০ সালে গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। হিন্দু মুসলিমের মধ্যেকার বিরোধটি আপাত স্থগিত হয়ে যায়।

    এদিকে, গান্ধী রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে গণক্ষোভকে কাজে লাগাতে একটি জাতীয় প্রতিবাদ আন্দোলনের সূচনা করেন। সকল অফিস ও কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ভারতীয়দের সরকারি স্কুল, পুলিশ বিভাগ, সেনাবাহিনী ও সরকারি চাকরি ত্যাগে উৎসাহিত করা হয়। আইনজ্ঞরা সরকারি আদালত বর্জন করেন। গণ-পরিবহন, ব্রিটিশ দ্রব্যসামগ্রী বিশেষত কাপড় বর্জিত হয়।

    অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্য ও লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পর্যুদস্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। এমন একটি বাস্তবতায় সংঘটিত হয় সলঙ্গা বিদ্রোহ। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা এই আন্দোলনের সময়কে ‘গান্ধী যুগ’’ বলে অভিহিত করা হয়।

    অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ার থেকে বাদ যায় না প্রত্যন্ত সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা। সলঙ্গার গণহত্যার তিন দিন আগে, সেখান থেকে কয়েক মাইল উত্তরে চান্দাইকোনা হাটে অসহযোগ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনকারীরা পুলিশের বন্দুক কেড়ে নিয়ে পাশের ফুলঝোর নদীতে ফেলে দেয়। সলঙ্গা বিদ্রোহের সপ্তাহ খানেক পর ১৯২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি উত্তর ভারতের গোরক্ষপুর জেলায় চৌরিচৌরার ‘অসহযোগ’ আন্দোলনকারী জনতা একটি থানায় আগুন ধরিয়ে দিলে পুলিশ গুলি চালায়। সেখানে ২৩ জন পুলিশ ও তিনজন আন্দোলনকারী নিহত হয়। ‘অহিংস ও অসহযোগ’ চরিত্র থেকে আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী আন্দোলনের তেজ দেখে ভীত হয়ে পড়েন। তিনি ভারতীয় জনগণকে সংগ্রাম বন্ধ করার অনুরোধ জানান। আন্দোলন বন্ধ করার জন্য গান্ধী তিন দিন অনশন পালন করেন। চৌরিচৌরায় সহিংস ঘটনার ৮ দিন পর ১২ ফেব্রুয়ারি গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। হিন্দু-মুসলমানের মিলন বিরোধে রূপ নেয়। আন্দোলন এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছিল, সেটা অব্যাহত রাখলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের মেরুদণ্ড তখনই ভেঙে দেওয়া সম্ভব ছিল, সাতচল্লিশে সমঝোতায় ইংরেজ বিদায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত না। তার আগেই ব্রিটিশকে ভারত ছাড়তে বাধ্য করার চমৎকার হাতে আসা সুযোগ পায়ে ঠেলা হয়।

    কিন্তু মোহনদাস করমচাদ গান্ধী এত বড় রক্তক্ষয়ী ঘটনার পরও আসেননি সলঙ্গায়। তিনি ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি পর্যন্ত দেননি। যে রবীন্দ্রনাথ জালিনওয়ালাবাাগের হত্যাকাণ্ডের প্রশ্নে নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান করলেন, পূর্ববাঙলার জমিদারির (নওগাঁর পতিসর, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর) অর্থ বিত্তে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি দ্যুতি ছড়ালেও, সেই রবীন্দ্রনাথ সলঙ্গা গণহত্যা নিয়ে সরব হননি।

    আমাদের জানা মতে, ইতিহাসের এই অধ্যায় নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। কেউ নাটক লেখেনি, কোনো সিনেমা হয়নি। কারো কবিতা চোখে পড়েনি। শুধু উপমহাদেশ নয়, বাংলাদেশেও ইতিহাসের এই অধ্যায়টি অনালোচিত।

    জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের গাড়াদহ নদীর তীরেই বসত সলঙ্গার হাট। সিরাজগঞ্জ তো বটেই, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, টাঙ্গাইল ও বগুড়া থেকে নানা পণ্যবাহী মহাজনী নৌকা এসে ভিড়ত সলঙ্গার হাটে। এত নৌকা আসত যে, নদীর ঘাট প্রায় দেড় মাইল লম্বা হয়ে যেত।

    ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি, দিনটি ছিল শুক্রবার, বড় হাটবার। বিলেতি পণ্য বর্জনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছিল কংগ্রেস ও খেলাফতের কর্মীরা। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেসময়ের তরুণ কংগ্রেসকর্মী আবদুর রশিদ, যিনি পরবর্তীতে আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ নামেই খ্যাতি পেয়েছিলেন। একপর্যায়ে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নিযুক্ত হন। গণ-আজাদী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেছিলেন। ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি, দিনটি ছিল শুক্রবার, বড় হাটবার। বিলেতি পণ্য বর্জনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছিল কংগ্রেস ও খেলাফতের কর্মীরা।

    আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের সংক্ষেপিত বয়ান, “আমি প্রায় তিনশ’ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে সলঙ্গা হাটে কাজ করছি। এমন সময় পাবনার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. আর এন দাস, সিরাজগঞ্জ মহকুমার এসডিও মি. এসকে সিনহা বা সুনীল কুমার সিংহ (তিনি ছিলেন আইসিএস লর্ড বিজয় কুমার সিংহ রায়ের ছেলে) এবং পাবনা জেলার ব্রিটিশ পুলিশ সুপার ৪০ জন আর্মড পুলিশ নিয়ে হাটে উপস্থিত হন। আমি ছিলাম কংগ্রেস অফিসে। বিশাল বপু টাক মাথাওয়ালা এসপি সাহেব আমাকে দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। আগে থেকেই তার খাতায় আমার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ জমা হয়েছিল। তাই আমাকে হাতের কাছে পাওয়ার পর তার আর তর সইল না। তৎক্ষণাৎ আমার ওপর নির্মম দৈহিক নির্যাতন শুরু করেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমার নাক-কান ফেটে দেহের নানা অংশ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সলঙ্গা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা আমার পিতামহ ও পিতার অনেক ভক্ত মুরিদান ছিলেন। তারা তো বটেই, হাটের সাধারণ হাটুরেরাও এ নির্যাতন দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার জ্ঞান ফিরে আসে। আমাকে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় ভিড়ের মধ্য থেকে জনৈক ব্যক্তি ‘নড়ি’ (গরু খেদানোর লাঠি) দিয়ে পুলিশ সুপারের মাথায় সজোরে আঘাত হানে। ইংরেজ সাহেবের টাকমাথা ফেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। পুলিশ সুপার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সবাই যখন পুলিশ সুপারকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন হাটের তিন দিক থেকে লাখো জনতা আমাকে মুক্ত করার জন্য এগিয়ে এলো। ক্ষিপ্ত জনতা নিকটবর্তী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্মড পুলিশ সারিবদ্ধ হয়ে জনতার দিকে রাইফেল তাক করে হাঁটু গেড়ে বসে।”

    “ইতোমধ্যে পুলিশ সুপারের সংজ্ঞা ফিরে আসে। পুলিশ সুপার পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে পরামর্শ করে গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশ সুপার হুকুম দিলেন ‘ফায়ার’। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল ৩৯টি রাইফেল। অবিরাম গুলিবর্ষণ চলে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর। গুলিবিদ্ধ হয়ে আমার সামনেই সাতজন নিহত হয়। অবিরাম গুলিবর্ষণে কতজন যে নিহত হয়ে হাটের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল, তার কোনো হিসাব ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকেও পাওয়া যায়নি। সরকারি তদন্ত রিপোর্টে হতাহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার বলে হিসাব পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কত শত আহত হয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে পথঘাটে ঝোপে-জঙ্গলে মৃত্যুবরণ করেছে এবং কত শত আজও অজ্ঞাত, তার হিসাব নেই। সরকারি কোপদৃষ্টিতে পড়ে নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে কখনো মৃত্যুর কথা প্রকাশ করেনি স্বজনরা।

    “সরকারি তদন্ত রিপোর্টে হতাহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার বলে হিসাব পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কত শত আহত হয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে পথঘাটে ঝোপে-জঙ্গলে মৃত্যুবরণ করেছে এবং কত শত আজও অজ্ঞাত, তার হিসাব নেই। সরকারি কোপদৃষ্টিতে পড়ে নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে কখনো মৃত্যুর কথা প্রকাশ করেনি স্বজনরা।

    অবিরাম গুলিবর্ষণে আর্মড পুলিশের সব গুলি শেষ হয়ে যায়। এ খবর মুহূর্তে সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষিপ্ত, উত্তেজিত, মার খাওয়া জনতা ফালা, লাঠি, সরকি, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে চারদিক ঘিরে সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে মুক্ত করে দিয়ে অনুরোধ করেন, ‘আপনি যেমন করেই হোক জনতাকে বুঝিয়ে শান্ত করুন এবং ফিরিয়ে নিন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অনুরোধ আমি গ্রহণ করলাম। কারণ অহিংস আন্দোলনের সৈনিক হিসেবে এটা আমার নৈতিক দায়িত্বও ছিল।”

    “যতদূর মনে পড়ে বলেছিলাম, এখন আপনার যদি নিরস্ত্র না হন, শান্ত না হন, তবে এ সংবাদ পেয়ে আরো পুলিশ আসবে, গোটা সৈন্যও আসবে। তারা এলে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে, নির্বিচারে হত্যা করবে, ধরে নিয়ে যাবে। এ কথা শোনার পর জনগণের ভেতর থেকে একটি বিক্ষুব্ধ কণ্ঠ ভেসে এলো, তাহলে গান্ধী রাজারে খবর দেন, সেও তার সৈন্য পাঠাক। উত্তরে বললাম, গান্ধী রাজার সৈন্য তো আমরাই। অন্য সৈন্য গান্ধী পাবেন কোথায়? তখন ভিড়ের মধ্যে শতকণ্ঠে প্রশ্ন এলো, তাহলে ওই পচা ভেড়ার লেজ ধরেছেন কেন?”

    “এই ভয়াবহ হত্যাকান্ডের খবর রাতারাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিনই কলকাতা, ঢাকা ও বাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির নেতা, কর্মী

    বাহিনী, ডাক্তার, ছাত্র, স্বেচ্ছাসেবক সলঙ্গা বাজারের দিকে দলে দলে আসতে থাকে। নায়ক, আনন্দবাজার, অমৃতবাজার প্রভৃতি দৈনিক এই হত্যাকান্ডের উল্লেখ করে সরকারি ও বেসরকারি তদন্তের দাবি উত্থাপন করে।”

    অসহযোগ ও খেলাফতের যুগ্ম আন্দোলন প্রত্যাহার হওয়ার পর হিন্দু মুসলিম-দুই সম্প্রদায় পুনরায় ফিরে যায় বিভেদের পথে। তরুণ আবদুর রশিদ তৎকালীন ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র দেওবন্দের পথে পা বাড়ান।

  • গোলাম আযম, মুজাহিদ ও  মীর কাশেমসহ ৩ মানবতাবিরোধী অপরাধীর মামলার নথি জাতীয় আর্কাইভসে

    গোলাম আযম, মুজাহিদ ও মীর কাশেমসহ ৩ মানবতাবিরোধী অপরাধীর মামলার নথি জাতীয় আর্কাইভসে

    ৩ মানবতাবিরোধী অপরাধীর মামলার নথি জাতীয় আর্কাইভসে

    অনলাইন ডেস্ক ॥ একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত তিনজনের মামলার যাবতীয় নথিপত্র জাতীয় আর্কাইভসে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

    আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস উপলক্ষে বুধবার (৯ জুন) একটি ওয়েবিনারে এসব নথি সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। নথি হস্তান্তর করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক এম. সানাউল হক।

    তিন মামলার আসামিরা হলেন- জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম। সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী।

    তদন্ত সংস্থা জানায়, ২০১৮ সালে ন্যাশনাল আর্কাইভস দিবসে মানবতাবিরোধী অপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আব্দুল কাদের মোল্লা, চৌধুরী মঈনুদ্দিন ও আশরাফুজ্জামান খানের নিষ্পত্তি হওয়া চারটি মামলার নথিপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছিল।

    তদন্ত সংস্থায় পরবর্তী মামলার বিচারিক কার্যক্রম চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তির পর নথিপত্র ন্যাশনাল আর্কাইভস কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা অব্যাহত রয়েছে।

    সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব বদরুল আরেফিনের সভাপতিত্বে ওয়েবিনার প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। আলোচনায় অংশ নেন তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক এম. সানাউল হক।

  • আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

    আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

    জহুরুল কবীর : আজ ১৭ এপ্রিল। ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য এক দিন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদিনে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে।এ দিনটি এবার এসেছে নজিরবিহীন এক সঙ্কেটের মধ্যে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস বাঙালিকেও ঘরে থাকতে বাধ্য করছে।দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবার বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও এবার করোনাভাইরাসের কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্তভাবে মুজিবনগর দিবস পালন করবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে বাইরে থেকে লোক না যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা চালানোর পর ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়েছিল। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন।ওই সরকারের শপথগ্রহণের স্থান বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর নামকরণ করা হয়। মুজিবনগরে ১২ জন আনসার সদস্য বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। মুজিবনগর সরকারের সফল নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকচক্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বেআইনিভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ন্যায়নীতিবহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়ারলেসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।তারই ধারাবাহিকতায় ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকার মুক্তাঞ্চলে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এক বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হন এবং স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন।এদিকে ঘরে বসেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস পালনের জন্য আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতাকর্মীসহ দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে সৃষ্ট সংকটের কারণে মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ নির্যাতিত মা-বোন, মুক্তিযুদ্ধের সকল সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ঘরে বসেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস পালনের জন্য আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতাকর্মী এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনসমূহসহ সর্বস্তরের জনগণ ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।এর আগে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। সারা দেশে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি চলছে। এ ছুটি ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।

  • ফের মসলিন যুগ ॥ ১৭০ বছর পর তৈরি হলো হুবহু সেই ঢাকাই শাড়ি

    ফের মসলিন যুগ ॥ ১৭০ বছর পর তৈরি হলো হুবহু সেই ঢাকাই শাড়ি

    • গবেষক দলের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ৬ বছরে মিলল সাফল্য
    • ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি
    • শীঘ্রই বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর আভাস

    কাওসার রহমান/মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ হারিয়ে যাওয়া মসলিন আবার ১৭০ বছর পর ফিরে এসেছে। একদল গবেষক দীর্ঘ ছয় বছরের আপ্রাণ চেষ্টায় আবারও মসলিন বুনতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে বাংলাদেশ আবার প্রবেশ করতে যাচ্ছে মসলিনের নতুন যুগে। ১৭১০ সালে বোনা একটি শাড়ির নক্সা দেখে হুবহু মসলিন শাড়ি বুনেন তাঁতিরা। প্রথম অবস্থায় মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করা হয়েছে। যার একটি উপহার দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে।

    ফলে ঢাকাই মসলিন এখন বাংলাদেশেরই। গবেষকদের দীর্ঘ ছয় বছরের প্রচেষ্টায় মিলেছে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যের স্বীকৃতিও। একমাস আগে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর ঢাকাই মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়েছে। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং মসলিনকে তুলনা করেছিলেন ভোরের হালকা কুয়াশার সঙ্গে। এ কাপড় নাকি এতটাই সূক্ষ্ম ছিল যে আংটির ভেতর দিয়ে চলে যেতে পারত। অনায়াসে এঁটে যেতে পারত দেশলাই বাক্সের ভেতর। নারায়ণগঞ্জের দু’জন তাঁতিও যে মসলিন শাড়ি তৈরি করেছেন তাও অনায়াসে আংটির ভেতর দিয়ে পার করা সম্ভব হয়েছে।

    প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও একদল নিষ্ঠাবান গবেষকের হাত ধরে ১৭০ বছর পর ফিরে এসেছে ঢাকাই মসলিন। ২০১৪ সালের অক্টোবরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মসলিনের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার কথা বলেন। বাংলাদেশের কোন কোন এলাকায় মসলিন সুতা তৈরি হতো, তা জেনে সে প্রযুক্তি উদ্ধারের নির্দেশনা দেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ওই বছরই ঢাকায় মসলিন তৈরির প্রযুক্তি ও পুনরুদ্ধার নামে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়। পরে গবেষণা কাজের স্বার্থে আরও সাত সদস্যকে কমিটিতে যুক্ত করা হয়। প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেনকে।

    ফুটি কার্পাসের খোঁজে ॥ ৬ বছরের প্রচেষ্টায় ধরা দেয়া সাফল্যের গল্প জানিয়েছেন প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেন। তিনি বলেন, বই থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মসলিন কাপড় বোনার জন্য ‘ফুটি কার্পাস’-এর কথা জানতে পারি। পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে এই গাছের চাষ হতো। মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই হয়ত কোন তথ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের হাতে কোন মসলিন কাপড়, ফুটি কার্পাস কোনটাই ছিল না। ফুটি কার্পাস তুলা সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন জায়গাতে খোঁজখবর নিয়েছি। এরমধ্যে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। স্ট্যাটাস দেখে গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে এক ছাত্র আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে। জানায়, কাপাসিয়ায় এই তুলার চাষ হতো। গাছের খোঁজে সে এলাকার বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাতে চিঠি পাঠানো হয়, মাইকিং করা হয়। পরে সেখানে নয়টি তুলা গাছ পাই। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ৩৮ প্রজাতির তুলা গাছের সন্ধান পাই। কিন্তু কাপাসিয়া স্থায়ী এক ব্যক্তি গাছটির সঠিক সন্ধান দেন। সংগ্রহ করা গাছ রাবির গবেষণা মাঠে চাষ শুরু করি। স্থানীয় উৎস থেকে মসলিন খুঁজতে গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আট টুকরো কাপড়ও সংগ্রহ করা হয়। সেগুলোর কোনটি মসলিন ছিল না। পরে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা চেয়েছিলাম, কিন্তু পাইনি। একপর্যায়ে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কলকাতায় যাই। কিন্তু সেখানেও পাওয়া যায়নি। পরে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যাওয়া হয়। সেখানে মসলিনের কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপাত্ত পাওয়া যায়।

    প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনজুর হোসেন বলেন, কাপাসিয়া থেকে সংগ্রহ করা তুলার আঁশ বেশি শক্ত, সাদা ধবধবে। এটা মসলিনের সেই সুতার কাছাকাছি যেতে পারে এমন ধারণা ছিল। তারপর লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ আর সেই তুলার ডিএনএ মিলিয়ে দেখা হলো কাপাসিয়া থেকে সংগ্রহ করা তুলার জাতটা ফুটি কার্পাস। মসলিন তৈরি করার জন্য সাধারণত ৩০০-৫০০ কাউন্টের সুতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ফুটি কার্পাস থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা সহজ নয়। এই সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে। চরকায় সুতা কাটা তাঁতিদের খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কুমিল্লায় পাওয়া যায়। কিন্তু তারা মোটা সুতা কাটেন যাতে কাউন্টের মাপ আসে না। পরে তাদের ৪০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সেখান থেকে ৬ জনকে বাছাই করা হয়। বাছাই করতেই প্রায় দুই বছর সময় লেগে যায়। অবশেষে সুতা নিয়ে তাঁতির দুয়ারে হাজির হলাম। নারায়ণগঞ্জে দুজন তাঁতির খোঁজ পেলাম। কিন্তু এত মিহি সুতা দিয়ে কেউ বানাতে রাজি হচ্ছিল না। পরে তাদের কয়েক ধাপে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বহু কষ্টে তারা বুনন পদ্ধতি রপ্ত করে। অবশেষে ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নক্সা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন তাঁতিরা। প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়ে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করা হয়। যার একটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেয়া হয়েছে।

    একসময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সর্বোচ্চ কদর পেত আমাদের দেশের তাঁতিদের হাতে বোনা এই কাপড়। যা ‘ঢাকাই মসলিন’ নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত পেয়েছিল। ১৮৫০ সালে শেষবারের মতো মসলিনের প্রদর্শনী হয় লন্ডনে। সেই প্রদর্শনের ১৭০ বছর পর ২০২০ সালে আবার ঢাকাই তাঁতিরাই বুনেছেন এই মিহি সুতিবস্ত্র। ফুটি কার্পাস তুলা থেকে উৎপন্ন অতি চিকন সুতা দিয়েই তৈরি হয়েছে এই মসলিন। আর ছয় বছর চেষ্টায় আবারও মসলিন বুনতে সফল হয়েছেন গবেষকরা। প্রচলিত আছে, কারিগরদের আঙুল কেটে দেয়ার পরে ঢাকাই মসলিন তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। এখন ভারতেও এক রকম মসলিন তৈরি হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকাই মসলিনের বিশেষত্বই আলাদা।

    প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় এই কাজ সম্পন্ন করার জন্য ‘বাংলাদেশের সোনালি ঐতিহ্য মসলিন সুতা তৈরির প্রযুক্তি ও মসলিন কাপড় পুনরুদ্ধার (প্রথম পর্যায়)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নেয়। প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেনকে। আর প্রকল্প পরিচালক নিযুক্ত হন বাংলাদেশে তাঁত বোর্ডের প্রধান পরিকল্পনা কর্মকর্তা মোঃ আয়ুব আলী।

    মসলিনের উপাদান সংগ্রহের গল্প ॥ কত কাঠখড় পুড়িয়ে সংগ্রহ করা হয়েছে মিহি মসলিনের উপাদানগুলো, সেগুলো একেকটি আসলেই গল্প। কাজের শুরুতে মসলিন কাপড় বা তুলার কোন নমুনাই গবেষকদের কাছে ছিল না। তাদের প্রথম কাজ ছিল, যে তুলা থেকে সুতা কেটে মসলিন শাড়ি বোনা হতো, সেই তুলার গাছ খুঁজে বের করা। সেই গাছটি আসল ফুটি কার্পাস কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার মসলিন কাপড়ের প্রয়োজন ছিল। এই দুটি জিনিস জোগাড় করাই এই প্রকল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।

    প্রকল্পের প্রধান বৈজ্ঞানিক মনজুর হোসেন জানান, মসলিন কাপড়ের নমুনা পেলে তার সুতার ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করে ফুটি কার্পাস গাছের ডিএনএর সঙ্গে মিলিয়ে দেখাই ছিল তার দলটির প্রধান কাজ। কিন্তু হাতে কোন মসলিন কাপড়ের নমুনা নেই, নেই ফুটি কার্পাসের কোন চিহ্নও। ছিল শুধু সুইডিশ গবেষক ক্যারোলাস লিনিয়াসের লেখা ‘স্পেসিস প্লান্টেরাম’, আবদুল করিমের ‘ঢাকাই মসলিন’ এর মতো কিছু বই। এর মধ্যে ক্যারোলাস লিনিয়াসের বইতে মসলিন কাপড় বোনার জন্য ‘ফুটি কার্পাস’ উপযুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়। এই গাছ পূর্ব ভারত তথা বাংলাদেশে চাষ হতো বলে সেখানে লেখা রয়েছে।

    ফুটি কার্পাস বন্য অবস্থায় বাংলাদেশে কোথাও টিকে থাকার সম্ভাবনা আছে। এ ধারণার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বন্য অবস্থায় পাওয়া তুলার জাত সংগ্রহ, নিজেদের গবেষণা মাঠে চাষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরিকল্পনা করা হয়। গাছটি খুঁজে পাওয়ার জন্য প্রথমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এক শিক্ষার্থীকে দিয়ে এর ছবি আঁকানো হয়। সেই ছবি দিয়ে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। বিটিভিতে প্রচার করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের মার্চ মাসে গাজীপুরের কাপাসিয়া ও রাঙ্গামাটি থেকে এই গাছের খবর আসে। গবেষকেরা গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। এরপর রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি, সাজেক ও লংদু; বাগেরহাট, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম থেকে মোট ৩৮টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। নমুনা হিসেবে নেয়া হয় গাছের তুলা, বীজ, পাতা, কাণ্ড ও ফুল। গবেষকেরা কাপাসিয়ার একটি গাছের জাতের সঙ্গে স্কেচের (আঁকা ছবির) মিল পান। সম্ভাব্য ফুটি কার্পাসের এই জাতটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের নিজস্ব মাঠে ও আইবিএসসির মাঠে চাষ করা হয়।

    একইভাবে স্থানীয় উৎস থেকে মসলিন কাপড় সংগ্রহ করার জন্য ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর তারা প্রায় দুই হাজার ফোন পান। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ৮ কাপড়ের নমুনা পাওয়া যায়। গবেষক দল নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে ৩০০ বছর আগের শাড়িও পেয়েছেন। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তা আসলে পুরনো সিল্কের কাপড়।

    দেশের অন্য কোন উৎস থেকে মসলিনের নমুনা না পেয়ে তারা জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে ধরণা দেন। গবেষকদের দরকার ছিল চার বাই চার ইঞ্চির এক টুকরো ঢাকাই মসলিন কাপড়। কিন্তু কিছুতেই তাদের নমুনা দিচ্ছিল না জাদুঘর। এমনকি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে আসার পরেও জাদুঘর কর্তৃপক্ষ তাদের মসলিনের নমুনা দেয়নি। গবেষক দলটি জাতীয় জাদুঘরের নমুনার আশায় প্রায় আট মাস পার করে ফেলেন। একপর্যায়ে মসলিনের নমুনা সংগ্রহের জন্য তারা ভারতের ন্যাশনাল মিউজিয়াম কলকাতায় যান। মিউজিয়ামের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মুর্শিদাবাদে এখন যে মসলিন শাড়ি তৈরি হচ্ছে, তা দক্ষিণ ভারতে উৎপাদিত তুলা থেকে করা হয়, যা ঢাকাই মসলিনের মতো মোলায়েম নয়। তাদের মতে, ঢাকাই মসলিন তৈরি করতে হলে ঢাকার আশপাশ থেকে জাত খুঁজে বের করে সেই তুলা দিয়ে সেই এলাকাতেই করতে হবে। মসলিন তৈরিতে তুলার জাত এবং আবহাওয়ার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। চাইলেই যেখানে-সেখানে ঢাকাই মসলিনের মতো শাড়ি তৈরি করা যাবে না।

    গবেষক দল নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে ৩০০ বছর আগের শাড়িও পেয়েছেন। পরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, তা আসলে পুরনো সিল্কের কাপড়। ভারতে গিয়ে বিফল হয়ে গবেষক দল হতাশ হয়ে পড়েন। অধ্যাপক মনজুর হোসেন বলেন, এই খবর শুনে প্রধানমন্ত্রী তাদের লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে যেতে বলেন। তিনি সেখানে ঢাকাই মসলিন দেখে এসেছেন। শেষ পর্যন্ত মসলিনের একটু নমুনার জন্য ২০১৭ সালের জুলাইয়ে কমিটির তিন সদস্যসহ চার সদস্যের একটি দল লন্ডনের ওই মিউজিয়ামে যান। সেখানে মসলিনের কাপড়ের নমুনা ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত তারা পেয়ে যান।

    লন্ডন থেকে সংগৃহীত মসলিন কাপড়ের ডিএনএ সিকুয়েন্স বের করা হয়। গবেষকেরা এই মসলিনের ডিএনএর সঙ্গে আগে সংগৃহীত কাপাসিয়ার একটি জাতের ফুটি কার্পাস গাছের মিল পেলেন অবশেষে। তারা নিশ্চিত হন, সেটিই তাদের কাক্সিক্ষত জাতের ‘ফুটি কার্পাস’। কাপাসিয়ার আবদুল আজিজ এই কার্পাসের সন্ধান দিয়েছিলেন। খুশি হয়ে এই কমিটির পক্ষ থেকে তাকে একটি মোবাইল ফোন উপহার দেয়া হয়।

    এত কিছু করার পরে অবশ্য জাতীয় জাদুঘরে তাদের ঢুকতে দেয়া হয়। প্রকল্প পরিচালক জানান, তারা দেখেছেন, জাদুঘরের শুধু একটি পাগড়ি ঢাকাই মসলিনের তৈরি।

    মসলিন শাড়ি তৈরি করতে হলে ৫০০ কাউন্টের সুতার প্রয়োজন। এক কিলোমিটার সুতাকে ওজন করলে যত গ্রাম হয়, তা দিয়ে সুতার দৈর্ঘ্যকে ভাগ করলে কাউন্ট পাওয়া যায়। যেমন ১ হাজার মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি সুতার ওজন যদি ২ গ্রাম হয়, তাহলে ২ দিয়ে ১০০০ মিটারকে ভাগ করলে ভাগফল হয় ৫০০। এই ভাগফলকেই কাউন্ট হিসেবে গণ্য করা হয়। সাধারণত ৫০০ কাউন্ট সুতা দিয়ে মসলিন কাপড় বোনা হতো। একটি শাড়িতে ১৪০ থেকে ১৫০ গ্রাম সুতার প্রয়োজন পড়ে। এই প্রকল্পের প্রশিক্ষিত সুতা কাটুনিরা এখন পাঁচদিনে এক গ্রাম সুতা কাটতে পারেন। অর্থাৎ এই গতিতে একজন যদি মসলিনের সুতা কাটতে থাকেন, তাহলে একটি শাড়ি জন্য সুতা তৈরি করতে তার প্রায় দুই বছর লাগার কথা।

    কার্পাস তুলা থেকে ৫০০ কাউন্টের সুতা তৈরি করা চাট্টিখানি কথা নয়। এই সুতা আধুনিক যন্ত্রে হবে না, চরকায় কাটতে হবে। সুতা তৈরির কাজের নেতৃত্ব দেন কমিটির সদস্য সচিব ও তাঁত বোর্ডের জ্যেষ্ঠ ইনস্ট্রাক্টর মঞ্জুরুল ইসলাম। এবার খোঁজ শুরু হয় দেশের কোথায় এখনও তাঁতিরা চরকায় সুতা কাটেন। খবর আসে, কুমিল্লার চান্দিনায় এখনও এই তাঁতিরা রয়েছেন। তারা খদ্দরের জন্য চরকায় মোটা সুতা কাটেন। তবে সেই সুতা কাউন্টের মাপেই আসে না। তা সর্বোচ্চ আট-দশ কাউন্টের হতে পারে। তবু গবেষকেরা সেখানেই ছুটে যান। তারা ভাবেন, এমন তো হতে পারে যে তাদের পূর্বপুরুষদের কেউ মসলিন সুতা কেটেছিলেন। বহুদিন ঘোরাঘুরির পর তারা হাসু ও নূরজাহান নামের অশীতিপর দুই বৃদ্ধার সন্ধান পান। তারা বলতে পেরেছেন তাদের পূর্বপুরুষেরা মসলিন সুতা কাটতেন। তাদেরও ছোটবেলায় মিহি সুতার স্মৃতি রয়েছে। তাদের পেয়ে গবেষক দল যেন সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে আশার আলো দেখেন। কিন্তু তারা তো এখন সুতা কাটতে পারেন না।

    শেষ পর্যন্ত তারা খদ্দরের মোটা সুতাকাটুনিদের নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের পাঁচজন করে আটটি দলে ভাগ করেন। প্রতিটি দলের মধ্যে সুতা চিকন করার প্রতিযোগিতা করা হয়। প্রতিটি দলের সেরাদের নিয়ে আবার দল গঠন করা হয়। এভাবে ছয়জন সেরা সুতাকাটুনি বের করতেই তাদের দুই বছর সময় লেগে যায়। এই ছয়জনই প্রশিক্ষক হয়ে গেছেন। তাদের একজনকে দিয়ে আরও ১১ জনকে শেখাতে সময় লেগেছে মাত্র ছয় মাস। এ রকম ১০০ জন তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে তারা কাজ করছেন।

    আর নতুন করে এই সুতা কাটার জন্য চরকা তৈরি করেন তাঁত বোর্ডের কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলাম ও টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অধ্যাপক আলীমুজ্জামান।

    লেগে থাকাতেই সফলতা ॥ সুতা মিহি করার ব্যাপারটা আসলে তিন আঙুলের জাদু। তিন আঙুলে কীভাবে তুলা ছাড়তে হবে, সেটাই আবিষ্কার করতে হয়েছে। আর নারীদের আঙুলেই এই সুতা সবচেয়ে মিহি হয়। তিনটি আঙুলকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় নরম করে রাখতে হয়। প্রথমে তাদের আঙুলগুলো শক্ত ছিল। অনুভূতি ছিল না। পরে তাদের আঙুলের ‘ট্রিটমেন্ট’ করতে হয়েছে। সন্ধ্যায় তিনটি আঙুলে লোশন মাখিয়ে রেখে সকালে সুতা কাটা হতো। আর সব সময় আঙুল তিনটির যত্ন নিতে হয়েছে। যাতে এই তিন আঙুলে কোন আঁচড় না লাগে বা এই তিনটি আঙুল দিয়ে অন্য কোন জিনিস কাটাকুটির কাজ ওরা না করে।

    আবার কখনও কাজ করতে গেলে আঙুল ঘেমে যেত, তখন আবার পাউডার দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হতো। আর চারকার এক ফাঁকে তারা কতটুকু সুতা ছাড়বেন, এ ব্যাপারে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে একাগ্রতা তৈরি করা হয়েছে। তাদের মনোযোগ বাড়ানোর চেষ্টা হয়েছে। এটা বড় একটা ব্যাপার। কারণ, এর যান্ত্রিক কোন মাপ নেই। সম্পূর্ণ মনোযোগের মাধ্যমেই চরকার ঘূর্ণনের সঙ্গে সুতা ছাড়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।

    অধ্যাপক মোঃ মনজুর হোসেন বলেন, ‘একটা ভরসা ছিল যে আমাদের দেশে জামদানি তৈরি হয়। জামদানিতে ১৫০ কাউন্টের সুতা লাগে। জামদানি আসলে নিম্নমানের মসলিন। এ জন্য আশাবাদী হয়েছিলাম কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল ৩০০ কাউন্টের সুতা নিয়ে তাঁতিদের দুয়ারে দুয়ারে আমরা ঘুরেছি। তারা বলেছেন, এটা সম্ভব নয়। খামাখা এগুলো নিয়ে ঘুরছেন। কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। একপর্যায়ে আমরা নারায়ণগঞ্জে সেই কাক্সিক্ষত তাঁতিকে পেয়ে যাই। তারা হচ্ছেন রুবেল মিয়া ও মোঃ ইব্রাহিম।’

    চিকন সুতা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। ঘর্ষণ থেকে ক্ষয় রোধের জন্য মাড় দেয়া প্রয়োজন, কিন্তু গতানুগতিক মাড়ে কাজ হচ্ছিল না। একপর্যায়ে তারা চিকন ধানের খইয়ে মাড় ব্যবহার করে কাজ করতে সক্ষম হয়েছেন। আবার মাড় দিয়ে নাটাইয়ে জড়াতে গিয়ে বারবার ছিঁড়ে যায়। কীভাবে করলে ছিঁড়বে না। সেটাও বের করা হলো। শুকানো হলো। ববিনে ভরতে গেলেও বারবার ছিঁড়ে যায়। প্রতিটি পদক্ষেপই নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়েছে। টানা তৈরি করতে গিয়েও একই অবস্থা।

    বিমের মধ্যে সহজভাবে যাতে ববিন ঘুরতে পারে, এ জন্য কাঠামোগত দিকটা ঠিক করে নিতে হয়। এই চিকন সুতা দিয়ে বিমে জড়ানো ও সানা করতে হয়েছে। চিকন সুতার কারণে আঙুলে লেগেই সুতা ছিঁড়ে যায়। আধা ঘণ্টার কাজ চার ঘণ্টা ধরে করতে হয়েছে। বেশি শীতেও হয় না বেশি গরমেও হয় না। মাটির গর্তে তাঁত বসিয়ে করা হয়। মাটির আর্দ্রতার সঙ্গে মসলিনের একটা সম্পর্ক আছে। সুতা বারবার ছিঁড়ে যাওয়া রোধ করার জন্য বালতিতে পানি রেখেও কাজ করতে হয়েছে।

    আবার এই দুই তাঁতিকে কাপড় বোনাতেও ধাপে ধাপে অনেক কারিগরি প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে। প্রথমে একটি তাঁত করা হয়েছিল। পরে তিনটি করা হয়েছে। এই তাঁতেই রুবেল ও ইব্রাহিম ১৭১০ সালে বোনা শাড়ির নক্সা দেখে হুবহু একটি শাড়ি বুনে ফেলেন।

    লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এ্যান্ড আলবার্ট মিউজিয়ামে প্রায় সাড়ে তিন শ’ ঢাকাই মসলিন শাড়ি সংরক্ষিত আছে। সেখানেই রয়েছে ১৭১০ সালে বোনা সেই শাড়িটি। সেই শাড়ির নক্সা দেখেই হুবহু ঢাকাই মসলিন তৈরি করেছেন দুই কারিগর।

    প্রথম অবস্থায় শাড়িটি তৈরি করতে খরচ পড়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। গবেষকদের প্রত্যাশা, এই খরচ আস্তে আস্তে কমতে থাকবে। ইতোমধ্যে তারা মোট ছয়টি শাড়ি তৈরি করেছেন। একটি শাড়ি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার হিসেবে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শাড়ি দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।

    প্রকল্পের আরেকজন গবেষক অধ্যাপক ড. মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রায় ১০ মাস আগে মসলিনের ৫টি নমুনা দিয়ে জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে বাংলাদেশ। গত ২৮ ডিসেম্বর ঢাকায় মসলিনকে বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ হয়। এতে করে মসলিনের উৎপত্তি, বুনন পদ্ধতি ও সুতা বাংলাদেশের বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়া হয়। তারা আশা করছেন, সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে খুব শীঘ্রই দেশে মসলিনের ব্যাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হবে। এতে করে বাংলাদেশ পা দেবে মসলিনের নতুন অধ্যায়ে।

    প্রকল্প পরিচালক আইয়ুব আলীও আশা করছেন, আগামী দুই বছরের মধ্যে এই শাড়ি সর্বসাধারণের জন্য বাজারে আনা সম্ভব হতে পারে।

    (দৈনিক জনকন্ঠ হতে সংগৃহীত)

  • স্মৃতিতে অম্লান কমরেড মণি সিংহ

    স্মৃতিতে অম্লান কমরেড মণি সিংহ

    ডা. অসিত বরণ রায়

    কমরেড মণি সিংহ ছিলেন কিংবদন্তি মহানায়ক-টংক আন্দোলনের নেতা। এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা। ছোটবেলা থেকেই এই মহামানবের বহু রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনেছি। তার চিন্তায়-চেতনায় ধ্যান-জ্ঞান ছিল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের, যিনি প্রতিনিয়তই ভাবতেন বৈষম্যমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমার জীবনে সৌভাগ্য যে কমরেড মণি সিংহের মতো মহামানবের সান্নিধ্য পেয়েছি। প্রায় এক যুগ পাশাপাশি কাটিয়েছি। কাছ থেকে দেখেছি আটপৌরেভাবে। সকাল থেকে রাত, রাত থেকে সকাল যার চুল থেকে নখ পর্যন্ত ছিল বিপ্লবী চেতনায় ভাস্বর।
    তিনি ছিলেন একজন কমিউনিস্ট এবং পরম পূজনীয় মানবতার পূজারি মহামানব। প্রথম দেখা থেকেই আমি কমরেড মণি সিংহকে দাদু বলে সম্বোধন করি, যদিও পার্টির নেতাকর্মীরা সবাই ‘বড় ভাই’ বলে ডাকতেন। সে সময় কিছুদিন আগেই অণিমাদি (কমরেড মণি সিংহের স্ত্রী) রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। সেই শূন্যতা দাদুকে খুব ব্যথিত করেছিল। এই সময়েই পার্টি আমাকে তাকে দেখাশোনা-সেবাযতে্নর দায়িত্ব দেয়। আমার মা এবং বাবা যখন শুনলেন এই গুরু দায়িত্বের কথা, তারা আমাকে সাহস দিয়েছিলেন। বারবার বলে দিয়েছিলেন, কোনোভাবেই যেন দাদুর অযত্ন না হয়। দাদু প্রতিটা মুহূর্তই সময় ও নিয়মের মধ্যে থাকতেন। সকালে দাড়ি কাটা থেকে শুরু করে দিনের সব কাজই করতেন একদম ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে মিলিয়ে। এর ব্যত্যয় কখনো দেখিনি। সকাল সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠা এবং তারপর সকালের হাঁটা। সেটা শীত হোক, বৃষ্টি হোক, দাদুর ব্যত্যয় ঘটেনি কখনো। বৃষ্টি হলে ছাতা নিয়ে বের হতেন। পার্টি অফিসেও যেতেন সময়মতো। রাত ১১টায় ঘুম, বাসায় থাকা মানেই তার বই পড়া। সোভিয়েত ইতিহাস গ্রন্থটি দাদু বারবার পড়তেন।
    দাদুর কাছে শুনেছি টংক আন্দোলনের ইতিহাস। পাহাড়ে, জঙ্গলে হাতি ধরার গল্প। তাছাড়া পাহাড়ি আদিবাসী মানুষের জুম চাষের কথা। শীতের রাতে পাহাড়ের আগুন দেখা যেত। এর মানে জুম চাষের প্রস্তুতি চলছে। তারপর গর্ত খুঁড়ে নানা ধরনের বীজ পুঁতে দেয়া হতো- এটাই জুম চাষ। শুনেছি মহাশোলের গল্প। পাহাড়ি মাছ সোমেশ্বরী নদীতে পাওয়া যেত। খুবই সুস্বাদু মাছ।
    দাদুর কাছে শুনেছি কীভাবে ’৭১ সালে জেল ভেঙে বেরিয়েছিলেন। জেলের সব কয়েদি সেদিন দাদুর হুকুমে রাজশাহী জেলের দেয়াল ভেঙে বের হলেন এবং দাদু স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন। সময় পেলেই দাদুর কাছে গল্প শুনতাম। শুনেছি ষাট দশকের প্রথম ভাগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সেই ঐতিহাসিক বৈঠকের কথা। এ বৈঠকের পরেই এ দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করল। শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফার আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই স্বাধীনতা আন্দোলন। দাদু সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন, এখনো স্বাধীনতা চাওয়ার সময় আসেনি। দাদুর কাছে শুনেছিলাম বঙ্গবন্ধু সেই কথা, ‘দাদা, লিডার (শহীদ সোহরাওয়ার্দী) বলেছেন আপনার কথা শুনতে। আপনার কথা মেনে নিলাম কিন্তু মনে নিলাম না। আমি বাংলার স্বাধীনতাই চাই।’
    মনে পড়ে মালিবাগের বাসায় এসেছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সেদিন স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে কীভাবে আন্দোলন শুরু করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করতে। সেদিনও কমরেড মণি সিং শেখ হাসিনাকে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। আমি সেদিন পাশে বসে দেখেছি এবং শুনেছি সব কথা। সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমরেড মঞ্জুরুল আহসান খান।
    অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন কমরেড মণি সিংহ। প্রতিটি আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। আজ যখন সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখনই কমরেড মণি সিংহকে মনে পড়ে। কারণ এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে তিনি সারাজীবন লড়াই করেছেন। আজকে এই অশুভ শক্তি জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙছে। এই ভাস্কর্য ভাঙা মানে জাতীয় পতাকাকে অস্বীকার করা, সংবিধানকে অস্বীকার করা, স্বাধীনতাকে অস্বীকার করা।
    আজকে যদি কমরেড মণি সিংহ বেঁচে থাকতেন, তবে হয়তো প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা কমরেড মণি সিংহকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘কী করবেন?’ হয়তো কমরেড মণি সিংহ বলতেন, ‘স্বাধীনতার সপক্ষের সব শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ডাক দেন।’ আর এ কারণেই কমরেড মণি সিংহ আজো বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক। কমরেড মণি সিংহকে জানাই লাল সালাম।

    লেখক : যুগ্ম আহ্বায়ক, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট কেন্দ্র।

  • ১৩ নভেম্বর ইতিহাসের এই দিনে

    পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন অনেক জ্ঞানী-গুণিজন। একের পর এক রচনা করেছেন এবং করছেন ইতিহাসের পাতা। উন্মোচিত হয়েছে জগতের নতুন নতুন দিগন্ত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সেই ইতিহাস চিন্তা, চেতনা ও প্রেরণার উৎস। যারা জন্মেছিলেন কিংবা চলে গেছেন আজকের এই দিনে। আবার বহু ঘটনাই রয়েছে ফেলে আসা সময়ের পথে। যেসব ঘটনা এনেছিল প্রশান্তি কিংবা রচনা করেছে অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃস্বপ্নে নীলকাব্য। যা ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনেই। আসুন জেনে নেওয়া যাক ইতিহাসের এই দিনে বিশিষ্টজনদের জন্ম-মৃত্যু দিনসহ ঘটে যাওয়া ঘটনা-

    ইতিহাস

    ১৭৭৫ – আমেরিকার বিদ্রোহীরা কানাডার মন্ট্রিল দখল করে।

    ১৮০৫ – ফরাসিরা ভিয়েনা দখল করে।

    ১৮৩৫ – টেক্সাস মেক্সিকোর কাছ থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়।

    ১৮৬৪ – গ্রিসের নতুন সংবিধান গৃহীত হয়।

    ১৯১৮ – প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে সম্মিলিত বাহিনী অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল দখল করে।

    ১৯৭৪ – ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা বা পি এল ও’র নেতা ইয়াসির আরাফাত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভাষণ দেন।

    ১৯৭৭ – ঢাকায় বিজ্ঞান যাদুঘর উদ্বোধন করা হয়।

    ১৯৮৫ – কলম্বিয়ায় এক ভূমিকম্পে ২৩ হাজারেরও বেশী মানুষ প্রাণ হারায়।

    ১৯৯৪ – সুইডেন এক গণভোটের মাধ্যমে ইউরোপীয় জোটে যোগ দেয়।

    ২০০২ – ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের সরকার জাতিসংঘের অস্ত্র পরিদর্শক দলকে ইরাকে ফিরে আসার অনুমতি দেয়।

    জন্ম

    ১৮৪৭ – ঔপন্যাসিক মীর মশাররফ হোসেন।

    ১৯২১ – অশোক বড়ুয়া, বাঙালি লেখক।

    ১৯৪৮ – জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।

    ১৯৬৭ – জুহি চাওলা, জনপ্রিয় ভারতীয় অভিনেত্রী।

    মৃত্যু

    ১৯০৭- ইংরেজ কবি ফ্রান্সিস থমসন।

  • আমাদের নায়ক: হাসানুল হক ইনু

    আমাদের নায়ক: হাসানুল হক ইনু

    আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম ও জিয়াউল হক মুক্তা*

    এক.
    তিনি তখন ক্যাথলিক চার্চ পরিচালিত ঢাকার বিখ্যাত নটরডেম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্র। একবার একজন ফাদার বললেন যে ইউ বেঙ্গলিজ আর চিকেন হার্টেড। একজন শিক্ষার্থী তাঁর এ বক্তব্যের প্রতিবাদ করলেন; সহপাঠিদের সংগঠিত করলেন; ধর্মঘট ডাকলেন। ফলে সে ফাদারকে তাঁর বক্তব্য প্রত্যাহার করতে হলো। সদ্যতারুণ্যের এ শিক্ষার্থী আর কেউ নন, হাসানুল হক ইনু। হ্যাঁ, আমরা এখানে বলছি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের বর্তমান সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি’র কথা। আজ ১২ নভেম্বর ২০২০ তাঁর ৭৪তম জন্মদিন।

    দুই.
    হাসানুল হক ইনু পূর্ববাংলার একটি নীতিনিষ্ঠ ও শিক্ষিত পরিবারের একজন সন্তান। তখন তিনি পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান পরিসরে অ্যাথলেট হিসেবে নাম করছেন, প্রথম বিভাগে ফুটবল খেলছেন আর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নামি প্রতিষ্ঠানে রসায়ন-প্রকৌশল পড়ছেন— ১৯৬৮ সালে যোগ দিলেন ছাত্র-রাজনীতিতে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনের মাঠে তিনি সাহসী ভূমিকা রাখলেন এবং ফলশ্রুতিতে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর ভূমিকার ফলে তিনি অতি দ্রুত মনযোগ আকর্ষণ করেছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রবাহিনী ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ বা ‘নিউক্লিয়াস’ নেতৃত্বের; তাঁরা নিশ্চিত হলেন যে হাসানুল হক ইনু নিবেদিতপ্রাণ-নির্লোভ-নিঃস্বার্থ একজন অ্যাকটিভিস্ট ও তাঁর ওপর ভরসা করা যায়, সেজন্য তাঁরা তাঁকে ‘নিউক্লিয়াস’ ও এর রাজনৈতিক-সামরিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা ‘বিএলএফ’ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করলেন। তিনি ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে সর্বপাকিস্তান আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পশ্চিম পাকিস্তান গিয়ে একজন দুঃসাহসী রোমান্টিক বিপ্লবী হিসেবে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে অস্ত্র সংগ্রহের একটি উৎস হিসেবে লান্ডিকোটালো খোলা বাজারকে এক্সপ্লোর করলেন; নমুনা হিসেবে সেখান থেকে একটি পয়েন্ট থ্রি টু ক্যালিবারের পিস্তলও নিয়ে এলেন বিমানবন্দর ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস-পিআইএ-র নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে।

    তিন.
    ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘জহুরের রক্ত— স্বাধীনতার মন্ত্র’ শ্লোগানে আয়োজিত ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’র সামরিক কুঁচকাওয়াজে তিনি নেতৃত্ব দেন; বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও এ কুঁচকাওয়াজের একজন অংশগ্রহণকারী ছিলেন। এ বছর ৭ জুন পল্টন ময়দানের শ্রমিক সমাবেশে ‘জয়বাংলা বাহিনী’র সামরিক কুঁচকাওয়াজে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি মঞ্চে দণ্ডায়মান বঙ্গবন্ধুকে সামরিক অভিবাদন জানান। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ৬ দফার চরমতম কট্টর সমর্থক ছিলেন চট্টগ্রামের এমএ আজিজ, যাঁর সাথে অনিবার্যভাবে গভীর সম্পর্ক ও যোগাযোগ গড়ে ওঠে নিউক্লিয়াস-এর; সে এমএ আজিজকে কারামুক্তির পর বুয়েটে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন হাসানুল হক ইনু ও বুয়েট ছাত্রলীগের সে সময়ের নেতৃত্ব; এ সম্বর্ধনাও ছিল ৬ দফা থেকে ১ দফার আন্দোলন-কৌশলের একটি অংশ । ১৯৭০ সালে বুয়েট ছাত্রলীগের সম্মেলনে তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে প্রধান অতিথি করে নিয়ে যান, সেটা ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম বুয়েট আগমন; আর এ সম্মেলন থেকে হাসানুল হক ইনু মাত্র তিন বছরের স্বল্পকালীন ছাত্র-রাজনীতির জীবন থেকে বিদায় নেন।

    চার.
    ১৯৭১ সালের প্রথম তিন মাস তিনি ও সুনির্বাচিত অন্যান্য কয়েকজন কর্মী নিউক্লিয়াস নেতৃত্বের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের সামরিক প্রস্তুতির জন্য বোমা তৈরির রাসায়নিক উপাদান ও অস্ত্র সংগ্রহ এবং প্রশিক্ষণ প্রদান প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত হন; সাইন্স ল্যাবরেটরি লুটে নেতৃত্ব দেন হাসানুল হক ইনু। একাত্তর সালে বঙ্গবন্ধু বিএলএফ-এর জন্য ভারত থেকে যে অস্ত্রের চালান আনার ব্যবস্থা করেন, নিউক্লিয়াস নেতৃত্ব হাসানুল হক ইনুকে সে চালান ঢাকায় আনার দায়িত্ব প্রদান করেন; তবে একাত্তরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তনের কারণে সে চালান আর আনা হয়নি। এভাবে রাজনীতিতে তাঁর সামরিক অভিজ্ঞতা বিকশিত ও সমৃদ্ধ হতে থাকে।

    ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে নিউক্লিয়াস নেতৃত্বের নির্দেশে পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের গৌরবের অধিকারীও তিনি। এবিসি টেলিভিশনের একটি সংবাদের ভিডিও ও ন্যারেশন দেখাচ্ছে যে পল্টন ময়দানে দশ হাজারেরও বেশি মানুষের সামনে হাসানুল হক ইনু তাঁর সেমি-অটোমেটিক পিস্তল-প্যারাবেলাম বা ল্যুগার থেকে ফায়ার করে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করছেন আর পতাকা তোলার সময় কামরুল আলম খান খসরু তাঁর রাইফেল থেকে গান ফায়ার করছেন; তখন মঞ্চে ছিলেন ডাকসু ও ছাত্রলীগের সমন্বয়ে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ। এ দিন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের পতাকা লাগানো গাড়িতে করে ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করতে যান।

    পাঁচ.
    শুরু থেকেই একজন সাহসী কর্মী ও ছোট নেতা হিসেবে বড় বড় দায়িত্ব পালন করেছেন হাসানুল হক ইনু। সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ ও মনিরুল ইসলাম [মার্শাল মনি] তাঁর সরাসরি নেতা হলেও শেষের জন তাঁর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন; শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ-এর কাছ থেকে আদেশ-নির্দেশ না পেলেও তাঁদের সাথে তাঁর বরাবরই শ্রদ্ধা-স্নেহের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। বন্ধু ও তাঁর চেয়ে বড় নেতা হিসেবে তাঁর ওপর প্রভাব ফেলেছিলেন শরীফ নূরুল আম্বিয়া, আফম মাহবুবুল হক ও মাসুদ আহমেদ রূমী। বন্ধু শফিউল ইসলাম কামালের শর্তহীন সমর্থন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অসাধারণ প্রাপ্তি। যুদ্ধপূর্ব সে সময় সম্পর্কে আফম মাহবুবুল হককে হাসানুল হক ইনু বলেছিলেন, “মাহবুব, তুই যখন বটতলায় বক্তৃতা দিতি, আমি তখন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তোর বক্তৃতা শুনতাম। তুই ছিলি হিমালয়ের চূড়ায়, আর আমি ছিলাম ঘাসের কাছে।”

    ছয়.
    ১৯৬৮-৬৯-৭০ সালে তখন অপরাপর বাম ছাত্র সংগঠনের প্রভাব উতরিয়ে সারা দেশে ছাত্রলীগের প্রবল জোয়ার; লাখ লাখ নিবেদিতপ্রাণ ছাত্র-তরুণের সংগঠন ছাত্রলীগে শত শত ক্যারিশমাটিক ছাত্র নেতৃত্বের সমাবেশে স্বাধীনতা আন্দোলন তখন রত্নগর্ভা; সে সময় মাত্র অল্প কিছুদিন আগে ছাত্রলীগে যোগ দেয়া হাসানুল হক ইনুর এতসব গৌরবময় কাজ করতে পারার সৌভাগ্যটি কারো প্রীতির ফলাফল ছিল না, তা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রতি তাঁর আদর্শনিষ্ঠার অর্জন। ১৯৭০ সালে আন্দোলন-সংগামের সময় তিনি রসায়ন-প্রকৌশলের স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন; কিন্তু অ্যাথলেট-ফুটবলার বা প্রকৌশলী হবার স্বপ্ন ছেড়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি আত্মনিবেদন করেন; ঔপনিবেশিকতার কালে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও প্রকৌশলবিদ্যার সোনালী পেশার হাতছানি উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন রাজনীতি। সে ‘অগ্নিঝরা সময়ের অবলম্বন’ হিসেবে তিনি প্রকাশিত-উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন। যে সময়ের সন্তান তিনি, সে সময় তাঁকে বেছে নিয়েছিল, তাঁর মাধ্যমে নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে নিতে।

    সাত.
    সুমহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হাসানুল হক ইনু ভারতের দেরাদুনের তান্দুয়ায় বিএলএফ-এর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মনি— উভয়ে অত্যন্ত স্পর্শকাতর এ দায়িত্বটি পালনের জন্য তাঁকেই যোগ্য মনে করেছিলেন; তাঁর উপরে আরও অনেক নেতা থাকতেও তিনি এ দায়িত্ব পেয়েছিলেন এজন্য যে সিরাজ-মনি উভয়ে বুঝেছিলেন— ইনু একজন নিউক্লিয়াসপন্থি হলেও মুক্তিযুদ্ধের সাধারণ স্বার্থকে তিনি উপদলীয় স্বার্থের উর্ধে রাখবেন। এছাড়াও তাঁর ভাষাগত দক্ষতা আর বিএলএফ নেতৃত্বের প্রতি রেজিমেন্টেড আনুগত্যও এক্ষেত্রে বিবেচিত হয়েছিল; তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন তিনি ক্যাম্পে ভারতীয় কর্তৃত্বের বদলে বাঙালির কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব বজায় রাখবেন। এ সময় রাজনীতি ও বয়সে তিনি তাঁর সিনিয়রদের চেয়ে স্পর্শকাতর কাজ ও পদে থাকায় কেউ মন খারাপ করেননি, প্রত্যেকে তাঁর যোগ্যতাকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এ ক্যাম্পের বিশেষত্ব ছিল সামরিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ প্রদান। এখান থেকে তাঁর হাত দিয়ে বের হয়েছেন দশ হাজারের বেশি বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত যোদ্ধা। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের অক্টোবরে চার প্রধানের [সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ] ঐকমত্যের ভিত্তিতে জেলা পর্যায়ের শতাধিক প্রতিনিধিদের এক সভা থেকে বিএলএফ ‘মুজিব বাহিনী’ নাম গ্রহণ করে।

    আট.
    হাসানুল হক ইনু স্বাধীনতা অর্জনের রাজনীতির সমর্থনে নিজ পরিবার সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তিনি বাবা-মার অকুণ্ঠ সমর্থন-সহযোগিতা পেয়েছেন। আপন দুই ভাই ও অপরাপর কাজিনদেরও তিনি পাশে পেয়েছেন মুজিব বাহিনীর যোদ্ধা হিসেবে। পারিবারিক নীতিনিষ্ঠা তাঁকে পথ দেখিয়েছে আজীবন। স্বাধীনতার পর জহুরুল হক হলে তোফায়েল আহমেদ একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তুমি কিসে চলাফেরা করো? তিনি বলেছিলেন রিকসায়। তোফায়েল আহমেদ তখন তাঁকে একটি জিপের চাবি দিয়ে বলেছিলেন, এটা তুমি ব্যবহার করবে। এ জিপ চালিয়ে বাসায় ফিরলে তাঁর বাবা তাঁকে বকাঝকা করেন; বলেন, দেশ স্বাধীন করেছো লুটের গাড়ি ব্যবহারের জন্য? দরকার হলে আমার গাড়ি চালাবে। বাবার নির্দেশে পরদিন সকালে তিনি জহুরুল হক হলে গাড়ীটি ফেরত দিয়ে আসেন।

    শুধু পরিবার নয়, সামাজিক সম্পর্কগুলোকেও তিনি তাঁর রাজনীতির পক্ষে সমবেত করতে পেরেছেন। একজন প্রকৌশলী হিসেবে তিনি সমগ্র প্রকৌশলী সমাজের সমর্থন-সহযোগিতা পেয়েছেন, এবং এখনও পাচ্ছেন। ব্যবহারিক রাজনীতিতে সোভিয়েতপন্থি-চীনপন্থি সমাজতন্ত্রীদের সাথে জাতীয় সমাজতন্ত্রীদের আজীবনের বিতর্ক থাকার পরও সোভিয়েতপন্থি-চীনপন্থি প্রকৌশলীগণ তাঁকে সবচেয়ে বেশি সমর্থন-সহযোগিতা প্রদান করেছেন ও করছেন। শিল্পী ও ব্যবসায়ী নিতুন কুণ্ডুর মতো মানুষও তাকে সকল সময় সহযোগিতা প্রদান করেছেন। তিনি ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ বা আইইবি’র একজন স্থায়ী ফেলো; এর কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে তিনি নিয়মিত সদস্য পদে নির্বাচন করেন।

    পাকিস্তানের ২২ পরিবারের একটির প্রধান ইস্পাহানি যেমন কমরেড মনি সিংহকে শ্রদ্ধা করতেন, সিপিবিকে সমর্থন-সহযোগিতা করতেন, এমনকি পার্টি অফিসের জন্য জায়গাও দিয়েছেন; তেমনি হাসানুল হক ইনুও বন্ধু শফিউল ইসলাম কামালের মাধ্যমে জহুরুল ইসলামের সাথে পরিচিত হয়েছিলেন ও তাঁর স্নেহ পেয়েছিলেন, রাজনীতির জন্য তাঁর সমর্থন-সহযোগিতা পেয়েছিলেন।

    নয়.
    ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র সংগঠনের ছোট নেতা হাসানুল হক ইনু উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আরও বড় দায়িত্ব নেয়ার মতো আরও ম্যাচিওরিটি অর্জন করলেন। তাঁর ফেলো-ফিলিংস ছিল উচ্চতর; মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি পুরো দেশ চষে দেখা করেছেন পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাথে। একইভাবে ১৯৮০ সালেও কারাগার থেকে বের হবার পর তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সহযোদ্ধাদের সাথে দেখা করেছেন। এটা এমন একটি মানবিক গুণ যা প্রত্যেক নেতৃত্বের থাকা উচিত।

    দশ.
    ১৯৭২ সালের ২৮ মে ‘জাতীয় কৃষক লীগ’ গঠিত হলে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক তিনি এর কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন; ৮৭ সদস্য বিশিষ্ট এ কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন গণপরিষদ সদস্য খন্দকার আব্দুল মালেক শহীদুল্লাহ; পাশাপাশি গণপরিষদের আরও অনেক সদস্য এর সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন। জাতীয় কৃষক লীগ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিল এবং পরবর্তীতে এর ‘সমাজতান্ত্রিক কৃষি বিপ্লব’-এর কর্মসূচি জাসদ রাজনীতির গ্রামীণ ভিত্তি অর্জনের প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠেছিল। সমাজতান্ত্রিক কৃষি বিপ্লবের কর্মসূচি প্রণয়নে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন; জাসদ ঘরানার বিষয়ভিত্তিক তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণে এ ছিল তাঁর প্রথম প্রয়াস। পরবর্তীতে জাসদের বিভিন্ন দলীয় ও রাজনৈতিক সাহিত্য প্রণয়নের কমিটি/উপকমিটিগুলোতে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন; বিশেষত গণআন্দোলনের ধরন নির্ধারণের বিষয়ে তিনি নির্ধারক ভূমিকা পালন করেন।

    এগারো.
    ১৯৭৩ সালে সম্মেলন ও কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে জাসদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হলে তিনি এতে সদস্যপদ অর্জন করেন। পরবর্তীকালে গঠিত ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’র ‘উপ-প্রধান’ হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। উল্লেখ্য শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম ছিলেন বিপ্লবী গণবাহিনীর প্রধান। খাস জমি বণ্টন ও কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের কার্যক্রম পরিচালনা করায় গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী গণবাহিনী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৮৬ সালে তিনি জাসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯০ সালকালপর্বে একাধিকবার কেন্দ্রীয় ৫ দলের সমন্বয়কারী এবং ১৯৯৪ সালে গঠিত বামগণতান্ত্রিক ফ্রন্টের প্রথম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৭ সালে ঐক্যবদ্ধ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

    ২০০২ সাল থেকে তিনি দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি কুষ্টিয়ার মিরপুর-ভেড়ামারা আসনের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য; মাঝে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবং দেড় টার্ম তথ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। পাশাপাশি তিনি ‘খাদ্য, কৃষি ও গ্রাম উন্নয়ন বিষয়ক সর্বদলীয় সংসদীয় দল’-এর চেয়ারপারসন এবং ‘আদিবাসী বিষয়ক সর্বদলীয় সংসদীয় ক্যকাস’-এর কো-চেয়ারপরসন-এর দায়িত্ব পালন করছেন।

    বারো.
    জাসদের মূল নেতৃত্ব কারাগরে অন্তরীণ থাকার সময় সংঘটিত হয় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড; এ বর্বর হত্যাকাণ্ডে অনেক দল ও জাতীয় নেতৃত্ব উল্লসিত হয়েছে, কিন্তু তাদের মতো করে বিভ্রান্তির চোরাবালিতে হারায়নি জাসদ, আগের রাজনৈতিক বিরোধ বা কোনো প্রতিহিংসা থেকে কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়নি জাসদ [যদিও বাকশাল কায়েমের পর থেকে জাসদ ছিল নিষিদ্ধ আর দলের নেতৃত্ব ছিলেন কারাগারে]; বরং সঠিক রাজনৈতিক অবস্থান নিতে পেরেছে, মোশতাকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধু-হত্যা পরবর্তী পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক নতুন রাজনৈতিক নির্দেশনা প্রণয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন কাজী আরেফ আহমেদ ও মনিরুল ইসলাম [মার্শাল মনি], তাঁদের সাথে হাসানুল হক ইনুর সংযুক্তি ও ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য [সিরাজুল আলম খান তখন ভারতে আবস্থান করছিলেন; দেশে ফেরার পর তিনি গৃহীত রাজনৈতিক অবস্থান এনডোর্স করেন]। এভাবে দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে মেজর এমএ জলিল ও আসম আবদুর রব দায়িত্বে বহাল থাকা অবস্থায় তিনি দলের নীতি-নির্ধারণী প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে শুরু করেন।

    তের.
    কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম-এর সহকারী হিসেবে হাসানুল হক ইনু ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান সংগঠনে অনন্য-সহচরের ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানপন্থার ঐক্যবদ্ধ প্রতিআক্রমণে অভ্যুত্থান হাতছাড়া হবার পর কর্নেল তাহের ও অপরাপর জাসদ নেতৃবৃন্দের সাথে তিনিও গ্রেফতার হন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে গোপন বিচার প্রহসনের মাধ্যমে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয় ও কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে হাসানুল হক ইনুকে সর্বোচ্চ সাজা [১২ বছরের কারাদণ্ড] প্রদান করা হয়। কারাগার থেকে তিনি মুক্তিও পান সবার শেষে। এ আদালতে কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমের জবানবন্দিটি যেমন বৈপ্লবিক, হাসানুল হক ইনুর জবানবন্দিটিও সেরকম দৃঢ়চেতা এক বিপ্লবীর ভাষ্য।

    চৌদ্দ.
    ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল-কালপর্বেও, যখন তিনি কারাগারে, তখনও তিনি জাসদের উল্লেখযোগ্য বড় নেতা হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন না; সারা দেশে নেতৃবৃন্দের মুক্তি চাওয়ার দেয়াল লিখনে তার নাম দেখা যেত বড় বড় ৫০ জন নেতার পর। কারাগারের দিনগুলোতে তিনি প্রচুর পড়াশোনা করেন ও লেখেন। লিগ্যাল সাইজের ঢাউস এক রেজিস্ট্রার খাতায় কারাগারে থাকাকালীন সময়ে তাঁর তৈরি রচনাগুলোর ছোট্ট দুটো—’আশা করা কি অনুচিত’ ও ‘জীবনবোধের প্রশ্নে’— জাসদ থেকে প্রায় আশি শতাংশ তরুণের বাসদে যোগদানের পর জাসদের অবশিষ্ট তরুণদের শক্তি সঞ্চয় ও পুনরুত্থানের দার্শনিক অবলম্বন হয়ে ওঠেছিল। এগুলো প্রকাশিত হয়েছিল ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের প্রকাশনা ‘ইশতেহার’-এ। আরও পরে সামরিক স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনের সময় এ দুটো রচনার সাথে বিশেষভাবে যোগ হয়েছিল ‘আন্দোলন শুরু হবে কোথা থেকে’ রচনাটি।

    ‘আশা করা কি অনুচিত’ রচনাটিতে, যতোদূর মনে পড়ে, একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি ‘আশা’কে ব্যাখ্যা করেছেন। এতে তিনি আশা করার ও আশাহত হবার পেছনে কারণ হিসেবে ব্যক্তি কর্তৃক বাস্তবতার পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ-অনুধাবনকে সামনে এনেছেন। তিনি বলার চেষ্ট করেছেন যে বাস্তবতার পর্যবেক্ষণ-বিশ্লেষণ-অনুধাবনকে সামনে না রেখে যদি কেউ আশা করেন, তিনি আশাহত হবেন। বাস্তবতার আলোকে কেউ যদি তার আশা রচনা করেন বা তার মাত্রা নির্ধারণ করেন, তার আশাহত হবার কোনো কারণ নেই। আশার সাবজেকটিভিটিকে তিনি অবজেকটিভিটি দিয়ে প্রতিস্থাপন করেছেন। ‘জীবনবোধের প্রশ্নে’ রচনায় তিনি কঠোর-কঠিন-রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হলে ভেঙে না পড়ে সে বাস্তবতা মেনে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বলেছেন। ‘আন্দোলন শুরু হবে কোথা থেকে’ রচনায় তিনি বলেছেন যে ব্যক্তিক-পারিবারিক-সামাজিক-জাতীয়-রাষ্ট্রীয় জীবনের যে কোনো অন্যায়-অবিচার-অনাচার-অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ছোট ছোট প্রতিবাদ থেকেই বড় বড় জাতীয় আন্দোলন গড়ে ওঠতে পারে।

    হাসানুল হক ইনু সে সময় আমাদের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠেছিলেন ও আমাদের নায়কে পরিণত হয়েছিলেন মূলত তিনটি কারণে— প্রথমত, জান্তা বিরোধী আন্দোলনে তাঁর আপোষহীন অবস্থানের কারণে; দ্বিতীয়ত, শহরভিত্তিক গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশলের সীমিত প্রয়োগের সৃজনশীল উদ্ভাবন এবং আন্দোলনকালে তার আলোকে পুলিশ-বিডিআর-সেনাবাহিনী-সরকারের বিরুদ্ধে কিছুটা বল প্রয়োগের রোমান্টিসিজমের আভাষ-ইঙ্গিত দেয়ার কারণে; আব তৃতীয়ত, তাঁর উল্লিখিত প্রবন্ধ তিনটির মাধ্যমে আমাদের কনভিন্স/সন্তুষ্ট করতে পারার কারণে।

    উল্লেখ্য, উল্লিখিত রচনা তিনটি ছাড়াও তাঁর ‘গতিময়তাই জীবন’, ‘বাম রাজনীতি’, ‘বিপ্লবের সমস্যা’, ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বামপন্থিদের ভুমিকা প্রসঙ্গে’, ‘স্বাধীনতা বিরোধী চেতনা রাষ্ট্র ক্ষমতায় কেন’ ইত্যাদি প্রবন্ধগুলো ছাত্রলীগ, শ্রমিক জোট ও জাসদের নতুন ও তরুণ কর্মীদের আদর্শিক দার্শনিক রাজনৈতিক মানস গঠনে নির্ধারক ভূমিকা রাখে। এসব রচনা সে সময় কুয়াত ইল ইসলাম সম্পাদিত জাসদের সাহিত্য পত্রিকা ‘গণসংস্কৃতি’তে প্রকাশিত হয়েছিল।

    পনের.
    ১৯৮০ সালে কারামুক্তির পর তিনি আওয়ামী লীগ ও বাকশাল শাসনামলে বিপর্যস্ত, মোশতাকের শাসনামলে সেসবের ধারাবাহিকতা, এবং জিয়ার শাসনামলে অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়নে ছিন্নভিন্ন দল পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু ও প্রায় পাঁচ দশকের সহযোদ্ধা শরীফ নূরুল আম্বিয়াকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম দলে এত বড় বড় নেতা থাকতে তাঁরা হাসানুল হক ইনুকে কেন নেতৃত্বে ঠেলে দিলেন? তিনি জবাবে বলেছিলেন যে গভীর অন্ধকারেও ইনু আলোর সন্ধান পান, চরম আশাহীনতার মধ্যেও তিনি আশা খুঁজে পান, বিপর্যয় থেকে অর্জন করেন পুনরুত্থানের শক্তি, ধ্বংসস্তুপ থেকে সংগ্রহ করেন নির্মাণের উপাদান, ফিরে এসে ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন স্বপ্ন ও পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামতে পারেন, চ্যালেঞ্জ গ্রহণের স্পর্ধা তিনি ভালোবাসেন। বিদ্যমানতার এমন দ্বান্দ্বিক অনুধাবনপ্রক্রিয়া এমনকি অধিকাংশ বাম-কমিউনিস্টের মধ্যেও দৃশ্যমান নয়; হাসানুল হক ইনুর ক্ষেত্রে তা সহজাত, স্বভাবজাত।

    ষোল.
    ব্যক্তিগত সম্পর্ককে তিনি খুব গুরুত্ব দেন, কিন্তু তার ভিত্তিতে কোনো রাজনৈতিক-সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেন না। সিরাজুল আলম খানের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও পারস্পরিক আস্থা-ভরসা-বোঝাপড়া ছিল গভীর। এজন্য দলে তাঁর সমসাময়িক বন্ধুদের অনেকেই বাঁকা কথা বলতেও ছাড়েননি। অনেকেই বলতেন যে দাদা যা বলবেন তুই তো তাতেই হ্যাঁ বলবি, তাঁকেই সমর্থন দিবি। সিরাজুল আলম খান যখন গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকারের ধারণা উপস্থাপন করেন, তিনি ছাড়া আর কেউ তা নিয়ে মাঠে নামেননি; ১৮ দফার ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে।

    কিন্তু সামরিক জান্তার সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে জান্তাকে সহযোগিতা করে উপর থেকে ১৮ দফা বাস্তবায়ন করার সিরাজুল আলম খানের কৌশলের তিনি বিরোধিতা করেন। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা, সাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তিভিত হিসেবে শ্রেণিপেশার সংগঠন [শ্রমিক-কর্মচারি ঐক্য পরিষদ বা স্কপ, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, ১৭টি কৃষক ও ক্ষেতমজুর সংগঠন, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ ইত্যাদি] গড়ে তোলা, রাষ্ট্রযন্ত্রের মুখোমুখি সার্বক্ষণিক গণঅভ্যুত্থানধর্মী আন্দোলন ও মারমুখি জনতার জঙ্গি অবস্থান তৈরি করা, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক শাসককে উচ্ছেদ করা ইত্যাদি প্রশ্নে হিমালয়ের মতো সিরাজুল আলম খানের অবস্থানের বিরোধিতা করতে ঘাসের মতো সামান্য হাসানুল হক ইনু সামান্যতম দ্বিধায় ভোগেননি।

    জাসদের ভাঙাগড়া নিয়ে কতোজনে কতোকিছু বলেছেন-লিখেছেন, কিন্তু এটাই ছিল জাসদের মধ্যকার মতাদর্শগত সংগ্রামের চতুর্থ অধ্যায়। আপোষ না সংগ্রাম? সংগ্রাম, সংগ্রাম। জাসদের লাখো কর্মীর ঐতিহ্যবাহী সংগ্রামের ধারাটি রক্ষা পেয়েছিল হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে, আর তাঁর নেতা হিসেবে তিনি সাথে পেয়েছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ, মনিরুল ইসলাম [মার্শাল মনি], শরীফ নূরুল আম্বিয়া ও অন্যদের; হিমালয়সম নেতৃত্ব সিরাজুল আলম খান প্রমুখদের বিপরীতে।

    [আর হ্যাঁ, এর আগে জাসদের মধ্যকার মতাদর্শগত সংগ্রামের প্রথমটি ছিল গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার বিষয়ে, দ্বিতীয়টি জিয়ার আমলে আওয়ামী লীগ নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য বিষয়ে ও তৃতীয়টি ছিল দলের মধ্যে বিপ্লবী পার্টি গঠন প্রক্রিয়া শুরু করা বিষয়ে। এ বিতর্কত্রয়ের পরিণতিতে জাসদ থেকে আফম মাহবুবুল হক ও প্রমুখ এবং ছাত্রলীগ থেকে মাহমুদুর রহমান মান্না ও প্রমুখ আলাদা হয়ে বাসদ গঠন করেন। জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের শক্তিভিত তা তারা বুঝে উঠতে পারেন নি; বাসদ গঠনের সে উদ্যোগ চূড়ান্ত বিচারে টিকে থাকতে সহযোগিতা করেছিল খুনি জিয়াকে; আর বাসদও অল্প সময়ের মধ্যে স্ববিরোধী হয়ে ১৫ দলে আওয়ামী লীগ ও জাসদের সাথে আর ৫ দলে জাসদের সাথে ঐক্যবদ্ধ রাজনীতি করেছিল।]

    হাসানুল হক ইনুর ব্যক্তিগত-সামাজিক-রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে এখানে আরও একটা কথা বলা যায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও তাঁর বন্ধু ও সহযোদ্ধা। ১৯৭০-এর ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’র কুঁচকাওয়াজে তাঁদের ভূমিকার কথা আগেই বলা হয়েছে। ১৯৯৭ সালের শেষ দিকে জাসদের একটি প্রতিনিধি দল শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে গেলে তিনি গল্পে গল্পে বলেছিলেন যে তিনি যখন ইডেন কলেজের ভিপি নির্বাচন করেন, হাসানুল হক ইনু তখন তাঁর বাবার গাড়ি চালিয়ে তাঁকে নিয়ে ক্যাম্পেইনে বের হতেন, শেখ হাসিনার তখন পারিবারিক বা দলগতভাবে গাড়ির ব্যবস্থা করার অবস্থা ছিল না। তবে, বহু বছর আগের এ ঘটনা মনে করতে গিয়ে শেখ হাসিনা কিছুটা ভুল বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে শেখ হাসিনা ভিপি হয়েছিলেন ১৯৬৬-৬৭ সালে, হাসানুল হক ইনু তখন ঢাকায় ছিলেন না। ১৯৬৯ সালে ইডেন কলেজ সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের প্যানেলের পক্ষে হাসানুল হক ইনু তাঁর বাবার গাড়ি চালিয়ে শেখ হাসিনাকে নিয়ে ক্যাম্পেইন করেছেন। শেখ হাসিনা মনে না করিয়ে দিলে বিষয়টি হয়তো কারো মনেই আসতো না।

    সতের.
    দেশে সক্রিয় বিবিধ শক্তি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকায় হাসানুল হক ইনু কখনোই সামরিক শাসকদের পাতা ফাঁদে পা দেননি। এরশাদ শাসনামলে ১৫ দল ভেঙে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবিসহ ৮ দল সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচন করলেও তিনি জাসদ ও ৫ দল নিয়ে তা বর্জন করেন। অবশেষে জয় হয়েছিল গণঅভ্যুত্থানমূলক রাজনীতির; ১৯৮৬-র নির্বাচনের সংসদ টেকেনি। ১৯৮৮ সালে আপোষকামীদের ফিরে আসতে হয়েছিল রাজপথে। তেমনি, ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত সরকারের কোনো ফাঁদে জাসদ ধরা পড়েনি বা তিনি পা দেননি।

    আঠারো.
    এরশাদ জান্তা স্বৈরশাসনবিরোধী ছাত্র-গণআন্দোলন দমন করতে আন্দোলনকারী শক্তির ওপর লেলিয়ে দিয়েছিলেন রগকাটা-হত্যাকারী জামাত-শিবিরকে। ১৯৮৮ সালের ২৪ আগস্ট সিলেটে জামাত-শিবিরের হামলায় শহীদ হন জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের তিন নেতাকর্মী মুনীর-তপন-জুয়েল। পরদিন এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য রাখার সময় আবেগাপ্লুত-উত্তেজিত হাসানুল হক ইনুর ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়, তিনি মঞ্চের ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। চিকিৎসকগণ আন্তরিকভাবে তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেন; অফিশিয়ালি তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন; তারপরও একজন ইন্টার্ন ডাক্তার সিনিয়রদের অনুমতি নিয়ে কার্ডিয়াক-শক প্র্যাকটিস করার জন্য তাঁকে কার্ডিয়াক-শক দিলে মনিটরের সরল রেখাটি অতি ধীরে আবারও সর্পিলাকার হয়ে ওঠে, তাঁর প্রাণের সাড়া পাওয়া যায়।

    তাঁর হৃদপিণ্ড এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে বাইপাস বা স্টেন্টিংয়ের কোনো সুযোগ ছিল না। চিকিৎসকগণ বলেছিলেন যে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না। কিন্তু ছয় মাসের মধ্যেই তিনি গাড়ি ড্রাইভ করা ও দিনে ১৬/১৮ ঘণ্টা কাজ করা শুরু করলেন। সে সময় তাঁর হার্টবিট ছিল ২২ পার মিনিট; ২০২০ সালে এখন তা সর্বোচ্চ ৩৮/৪০ পার মিনিট; একজন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে যা হওয়া উচিত ৬০ থেকে ১০০ পার মিনিট। পরে আমরা উপলব্ধি করেছিলাম ওষুধ-পথ্যের বাইরে তাঁর মধ্যকার অফুরান প্রাণশক্তির অধিকারী পরম রোমান্টিক মানসটিই তাঁর চরম শরীরীঝুঁকি উপেক্ষা করে তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছে।

    তাঁর অসুস্থতার পর, এমনকি তার প্রায় এক দশক পরও ১৯৯৬-১৯৯৭ সালে যখন ছাত্রলীগ থেকে বিদায় নেয়া জাসদের নতুন কর্মী-সদস্যদেরকে সাংগঠনিক প্রয়োজনে সকালে তাঁর বাসায় যেতে হতো ও তাঁর সাথে অফিসের উদ্দেশ্যে বা কাজে বের হতে হতো, তখনও দেখা গিয়েছে যে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হঠাৎ হঠৎ কেউ না কেউ এসে তাঁর ঘুম ভাঙার জন্য অপেক্ষা করছেন— তুলসি-নিম-অর্জুন-পেয়ারা-সজনে-তেঁতুল-জলপাই-বেল-জাম প্রভৃতি গাছের পাতা-বল্কল-বীজ এসব দিয়ে বানানো তাঁর জন্য টোটকা ওষুধ নিয়ে। সে দৃশ্যটি ভালো লাগতো এজন্য যে বিশ্বাস-অবিশ্বাস উৎরে হাসানুল হক ইনু সেসব গ্রহণ করতেন; খেতেন। কেউ কেউ আসতেন তাঁকে নিয়ে তাঁদের দোয়া বা স্বপ্নে দেখা তথ্যের কথা জানাতে। এসব দেখে-শুনে, তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা দেখে, কর্মীদের আপ্লুত হওয়া ছিল স্বাভাবিক। ওইসব ওষুধ বা দোয়া-দাওয়ার চেয়েও তাঁদের ভালোবাসার সর্বশক্তিমানতা তিনি উপলব্ধি করতেন নিশ্চয়; এরকম ভালোবাসা বিচারের কোনো মাপকাঠি মানবসমাজ এখনও আবিষ্কার করতে পারেনি। তাঁর সৌভাগ্য, তিনি আপাদমস্তক নিরাপদে ঢাকা রয়েছেন নিরঙ্কুশ ভালোবাসার চাদরে।

    উনিশ.
    ১৯৮০ সালে জেল থেকে বের হয়ে তিনি মনি সিংহ, মোহাম্মদ ফরহাদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আব্দুল হক, আব্দুল মতিন, টিপু বিশ্বাস, দেবেন শিকদার ও আবুল বাশারসহ চিরায়ত ধারার বাম নেতাদের সাথে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দিনের পর দিন আলোচনা করে তাঁদের কাছে জাসদের রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরেছেন, তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থান বোঝার চেষ্টা করেছেন এবং বাম ঐক্যের সূত্র খোঁজার চেষ্টা করেছেন। সে কারণে চিরায়ত বাম ধারার বাইরের দলের নেতা হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীকালে ১৯৯৪ সালে ৮টি বামপন্থি দলের জোট ‘বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ গঠন করা হলে এর প্রথম আহ্বায়ক হিসেবে হাসানুল হক ইনুকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন বাম নেতৃবৃন্দ।

    বিশ.
    সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যের রাজনীতির কৌশল প্রণয়ন ও প্রয়োগে হাসানুল হক ইনু চ্যাম্পিয়ন। ১৯৮২—১৯৯০ কালপর্বের পর সর্বশেষ ২০০২ সাল থেকে জাসদের একক-নিরলস প্রয়াস, ২০০৩ সালে জাসদ ও আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রাথমিক ঐকমত্য ঘোষণা, আর ২০০৪ সালে জাসদ ও আওয়ামী লীগের সমান্তরাল ঐক্য-প্রয়াস এবং ১৪টি রাজনৈতিক দলের যুগপৎ কর্মসূচি পালন, আর অবশেষে এসবের ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে ১৪ দল গঠন ও এর যাত্রা শুরু হয়। এ প্রক্রিয়ায় তিনি পালন করেন নির্ধারকের ভূমিকা। জামাত-জঙ্গি-বিএনপি’র বিরুদ্ধে এ ঐক্যের সরকার ক্ষমতায় রয়েছে টানা তৃতীয় বারের মতো।

    এ ঐক্য প্রসঙ্গে জাসদ ও হাসানুল হক ইনুর মত হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও জাসদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের ‘কেন্দ্র’ বা ‘প্রধান শক্তি’; জাসদ যদি আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে অপরাপর দলের সাথে রাজনৈতিক ঐক্য করে তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের পক্ষের পূর্ণাঙ্গ ঐক্য হিসেবে বিবেচিত হবে না; তেমনি আওয়ামী লীগও যদি জাসদকে বাদ দিয়ে অপরাপর দলের সাথে রাজনৈতিক ঐক্য করে তাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধের পক্ষের পূর্ণাঙ্গ ঐক্য হিসেবে বিবেচিত হবে না। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, রাজনৈতিক ঐক্যে ৯৯ পয়সা মানে ১ টাকা নয়; ৯৯ পয়সার মালিককে ১ টাকার মালিক হতে হলে ১ পয়সার মালিকের সাথে হাত মেলাতে হয়।

    একুশ.
    নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন সময় তিনি সোশালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল এবং ভারত, শ্রীলংকা, নেপাল, রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, কিউবা, জার্মানি, ইংল্যান্ড, প্যালেস্টাইন, ইরাক এসব দেশের বাম-সমাজতন্ত্রী-কমিউনিস্টদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। অনেক আঞ্চলিক নেতৃত্বের সাথেও সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। প্রতিবেশ-পরিবেশ, নদী ও পানি, উপআঞ্চলিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতা, আঞ্চলিক বাণিজ্য, টেকসই উন্নয়ন, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিষয়ে আঞ্চলিক পরিসরের বিবিধ আলোচনায় তিনি মৌলিক বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান রেখেছেন দশকের পর দশক ধরে। জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ, কৃষি ও নারী-শ্রমিক-যুব এসব বিষয়েও জাতীয় পরিসরে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক অবদান রেখেছেন। জাতীয়-আন্তর্জাতিক বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনগুলোও তাঁর ইনপুট পেতে পছন্দ করে।

    তিনি জাতিসংঘের ‘ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম’-এর একজন রিসোর্স পারসন এবং ‘বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম’-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

    বাইশ.
    একজন জননেতার ব্যস্ততা সত্ত্বেও হাসানুল হক ইনু সময় বের করে পড়াশোনার চেষ্টা করেন; তার জন্য অর্থ ও সময় ব্যয় করেন। জ্ঞানার্জনের পথে তিনি অন্ধকূপের বাসিন্দা নন; সমকালীন বিশ্লেষণ ও নতুন চিন্তা তিনি অনুধাবনের চেষ্টা করেন; ক্ষেত্রবিশেষে সেগুলো আত্মীকরণের চেষ্টাও করেন নিজের মূল মার্কসবাদি চিন্তাকাঠামো অক্ষুন্ন রেখে। রাজনৈতিক দর্শন ও তত্ত্ব, রাজনৈতিক ইতিহাস ও বিশ্বের সেরা নেতৃত্বের জীবনী পড়তে তিনি ভালোবাসেন; তিনি বিশেষ গুরুত্ব দেন সমরবিদ্যা, সমরকৌশল ও রাজনৈতিক কৌশলের মতো বিষয়গুলোয়। একুশ শতকে সূচিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব তাঁর এ সময়ের অন্যতম প্রধান আগ্রহের বিষয়। শেখার জন্য তিনি যে কারো পরামর্শ গ্রহণ করেন; নতুন বিষয় জানাশোনার বেলায় তিনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন কিশোর-তরুণদের সাহচর্য।

    একটা সময় ছিল, অন্ততপক্ষে ১৯৮৮-১৯৮৯ সাল পর্যন্ত, তিনি ছিলেন নিয়মিতভাবে কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা সিরিজেরও একনিষ্ঠ পাঠক। বেস্ট সেলার বই কেনা তাঁর অভ্যেস। এখনও পর্যন্ত তাঁর একমাত্র বিলাসিতা হলো যখন যে শহরে যান, সেখানকার অভিজাত বইয়ের দোকানে একবার ঢুঁ মারেন। নিজের জন্য বই কেনেন; নাম বলে দিলে আমাদেরও কিনে দেন।

    তেইশ.
    এখানে সংযোজন করে রাখা যাক যে ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তাঁর অ্যাজিটেশনাল ও সামরিক অভিজ্ঞতার সাথে অব্যাহত পড়াশোনার সংযোজন তাঁর মধ্যে যে সমরকৌশল বিকশিত করেছে তা অনন্য। গণআন্দোলনের সাথে শক্তি প্রয়োগের তাঁর সৃজনশীল ‘সিলেকটিভ অ্যান্ড এফেক্টিভ ফোর্স অ্যাপ্লিকেশন’ বিষয়ক চিন্তা তরুণদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী অ্যাজিটেশনাল গণআন্দোলনের দিনগুলোতে। পত্রিকায় তাঁর দেয়া সুতীক্ষ্ণ-ধারালো সাক্ষাৎকার আর জনসভার ভাষণগুলো আমাদের অ্যাজিটেশনাল করেছিল।

    তাঁর চিন্তায় প্রতিপক্ষ বা শত্রু শিবিরকে আতঙ্কিত করা বা ছত্রভঙ্গ করার উদ্ভাবনী শক্তিও রয়েছে। আজ থেকে সাড়ে সাত বছর আগে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের মতিঝিলের সমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে গুলির বদলে আলো-অন্ধকার-শব্দ ব্যবহারের কৌশল প্রয়োগ তাঁর সমরচিন্তার উজ্বল দৃষ্টান্ত। বিদ্যুৎ সরবারহ বন্ধ করে পুরো এলাকা অন্ধকার করে দেয়া, অন্ধকারের ভেতর ফ্লেয়ার গান ব্যবহার করে অনেক বেশি আলো তৈরি করা, শব্দ বোমার ব্যবহার, নিরাপদ পশ্চাদপসরণের জন্য এক্সিট-পথ খুলে রাখা ইত্যাদি কৌশল তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ঠিক সেভাবেই কার্যক্রম পরিচালনা করেছিল; একটিও বুলেট না ছুঁড়ে, একফোঁটা রক্তও না ঝড়িয়ে, তারা ছত্রভঙ্গ-তছনছ করে দিয়েছিল হেফাজতের দম্ভ আর খালেদার গোপন খায়েশ।

    চব্বিশ.
    লিসেনিং টু আদার্স যে নেতৃত্বের একটি বিশেষ গুণ তা তিনি উপলব্ধি করেন; তাই তিনি ধৈর্যশীল ও মনযোগী একজন শ্রোতা— যে কারও কাছ থেকে নতুন ও প্রয়োজনীয় কিছু জানতে/শুনতে পেলে তিনি তা নোট করে রাখেন। নোট রাখা তাঁর অভ্যাসগুলোর অন্যতম।

    বলার ক্ষেত্রে তিনি তাৎক্ষণিকতার অনুসারী নন; শ্রোতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তিনি তার যে কোনো বক্তব্যের জন্য সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন ও প্রস্তুতি নেন; পয়েন্ট হিসেবে নিজের বক্তব্য সাজিয়ে-গুছিয়ে নেন; পড়াশোনা না করে বা না বুঝে তিনি কোন বিষয়ে কোন বক্তব্য প্রদান করেন না। যারা তার দৈনন্দিন জীবন অনুসরণ করেছেন, তারা জানেন তিনি একসাথে অনেক ফাইল ও বইপত্র সাথে নিয়ে দিনের শুরু করেন, গাড়িতে বা অফিসে ওসব ফাইল ও বইপত্র তাঁর সাথে থাকে, যখন দরকার তখন তিনি সেসব ফাইল বা বইপত্র কনসাল্ট করেন।

    পড়া-শোনা-বলার সাথে সাথে তিনি প্রচুর লেখেনও। এ রচনায় আগেই তাঁর লেখা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। তাঁর লেখা একদিকে যেমন দলের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা প্রদান করে তেমনি জাতীয় রাজনীতির পলিমিক্সে ভূমিকা রাখে। এর মধ্যে তাঁর ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা’, ‘গণতান্ত্রিক সংগ্রামের নয়াকৌশল’, ‘তিন দাগে ঘেরা বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিষবৃক্ষ’ ও আরও বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ-সংকলন প্রকাশিত হয়েছে।

    ১৯৯৩-র সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৯০-এর জানুয়ারি পর্যন্ত গণমাধ্যমগুলোতে তাঁর দেয়া সাক্ষাৎগুলোর নির্বাচিত কয়েকটির সংকলন ‘ক্যান্টমেন্ট কিংবা বিদেশের দিকে তাকিয়ে আন্দোলনে জেতা যাবেনা’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ছোট ছোট বাক্যের কাটাকাটা জবাব দেয়া এসব সাক্ষৎকার যখন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতো, আমরা সেগুলো থেকে দিক নির্দেনা পেতাম; রোমাঞ্চিতও হতাম খুব; আনন্দও পেতাম। রাগী সাপ্তাহিক বিচিন্তায় দেয়া এক সাক্ষাৎকারে—

    বিচিন্তা: আপনার নামে হুলিয়া। আপনাকে আমরা খুঁজে বের করেছি। পুলিশ কি আপনাকে খুঁজে বের করতে পারবে না?

    ইনু: পুলিশ পারেনা এটা বলবো না, পারে। তবে আমার মনে হয় সরকারের সর্বস্তরের যন্ত্রগুলো সঠিকভাবে কাজ করছে না।

    বিচিন্তা: এর কারণ কী হতে পারে?

    ইনু: সরকারের প্রতি কর্মচারিদের সমর্থন নেই।

    নিজের আত্মগোপনে থাকার দক্ষতাকে তিনি পুলিশের অক্ষমতা না বলে তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করা ও এর মাধ্যমে স্বৈরাচারের মনে আতঙ্ক তৈরি করায় এসব সাক্ষাৎকার ছিল দারুণ কৌশলী যোগাযোগ পদ্ধতি।

    পঁচিশ.
    নিজেকে তিনি সবসময় প্রকাশিত রাখেন; রাজনীতিতে ঘনিষ্ঠদেরও তা থাকতে বলেন। তিনি লো প্রাফাইল মেইনটেইন করেন; ঘনিষ্ঠদেরও বলেন যে ট্রাই টু মেইনটেইন লো প্রোফাইল। কর্মী হিসেবে আমরা তাঁর উভয় পরামর্শ মেনে চলার চেষ্টা করি। তিনি এমন একজন রাজনীতিবিদ যাঁর কাছে যে কেউ প্রবেশাধিকার পান; তাঁর কাছে যেতে বা তাঁর সাথে কথা বলতে কারো কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন হয়না, অ্যাপয়েন্টমেন্ট দরকার হয়না; মন্ত্রী থাকাকালেও যে কেউ তাঁর কক্ষের দরোজা ঠেলে ভেতরে যেতে পারতেন; যে কোনো ব্যক্তি তাঁকে সরাসরি ফোন করতে পারেন, কথা বলতে পারেন।

    ছাব্বিশ.
    বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ষড়যন্ত্র’ একটি জনপ্রিয় শব্দ। এ বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট অবস্থান রয়েছে। তিনি বলেন, “শোন, রাজনীতিতে সবসময় সিন্ধান্ত নেবে প্রকাশ্য ও জ্ঞাত/জানাশোনা তথ্যের ভিত্তিতে; ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব অনুসরণ করে কখনোই কোনো পদক্ষেপ নিওনা।”

    সাতাশ.
    কোন বিশেষ বা কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তিনি তাঁর চারপাশের নেতাকর্মীদের পরামর্শ চান। তাঁরাও হয়তো সে বিষয়কে কঠিন মনে করেন; সেজন্য তাঁরা দলের বাইরের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সহায়তা নেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তাঁর কাছে সমাধানের ফর্মুলাটি সহজ; তিনি বলেন, “কমন সেন্স প্রয়োগ করো।” এভাবে, আগে তাঁর যে সহজাত দ্বান্দ্বিক অনুধাবন প্রক্রিয়ার কথা বলেছি, সে সাধারণ দ্বান্দ্বিকতার সাথে ‘কমন সেন্স’কে তিনি রাজনীতির প্রয়োজনীয় উপাদানে পরিণত করেন। রাজনীতিকে একটি কঠিন বা দুর্বোধ্য বিষয় হিসেবে পরিচিত করার ঘোর বিরোধী তিনি।

    আটাশ.
    তাঁর চরিত্রের একটি প্রধানতম বৈশিষ্ট হলো রাজনৈতিক বক্তব্যকে সহজবোধ্য-প্রতীকময়তায় আবদ্ধ করতে প্রতিনিয়ত তিনি শব্দ-বাক্য-ভাষা ব্যবহারের পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেন। রাজনৈতিক বক্তব্যকে জনপ্রিয় করতে তিনি একের পর এক শব্দ-বাক্য-ভাষা দিতে থাকেন জনমানসে, অপেক্ষা করেন কোনটি সকলের মনযোগ আকর্ষণ করে ও অর্থবোধক হয়ে ওঠে। এভাবে তিনি ক্যাম্পেইনের ভাষা তৈরি করেন, আর তারপর সেটার ব্যবহারে মরীয়া হয়ে ওঠেন। অতীতে সামরিক আইনের অধঃস্তন ‘নির্বাচন, সংসদ ও গণতন্ত্র’কে তিনি ‘স্বৈরাচারের সাজানো বাগান’ বলে অভিহিত করতেন; সামরিক আইনের অধঃস্তন সংসদের সদস্য ও নিষ্ক্রিয়-বিপ্লবী লেখকদের তিনি স্বৈরাচারের সাজানো বাগানের ‘ফুল’ বলে অভিহিত করতেন। সাম্প্রতিককালে তাঁর ব্যবহৃত শব্দসমূহের মধ্যে আগুন-সন্ত্রাস, তেঁতুল-হুজুর, সন্ত্রাসের-রানী, জঙ্গি-সঙ্গী, জঙ্গিমাতা ইত্যাদি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ শব্দগুলো শ্রোতার মানসে সুনির্দিষ্ট চিত্র-চরিত্র তুলে ধরে।

    উনত্রিশ.
    কর্পোরেট ম্যানেজমেন্টে ডেলিগেশন একটি উল্লেখযোগ্য উপাদান, কিন্তু রাজনীতিতে তা অত্যন্ত দুর্লভ কিংবা প্রায় অদৃশ্য একটি গুণ; আর তা যদি হয় দলীয় সাহিত্য নিয়ে তাহলে তো কোনো কথাই নেই। দলের পোস্টার-লিফলেটের বাইরে বিবিধ অপরাপর প্রকাশনার ক্ষেত্রে তিনি সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় সম্পাদককে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা প্রদান করেন। নিকট অতীতেও তিনি কখনও জানতেও চাননি যে দলের প্রকাশনায় কী কী যাচ্ছে ইত্যাদি। এর ফলে তিনি তাঁর আস্থার অপব্যবহারের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হননি একটি বারের জন্যও। দলের ছোট-বড় সকলকে তিনি ন্যায্য সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করেন।

    ত্রিশ.
    মানবিক গুণাবলীর চর্চায় হাসানুল হক ইনু কোমল ও নিভৃতচারী। এমনকি আমরাও প্রায় সকল ক্ষেত্রে জানতে পারিনা যে স্বাস্থ্য-চিকিৎসা-পড়াশোনা-বিয়েশাদি-অভাব ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি কখন কাকে কীভাবে সহযোগিতা করেন। সহযোদ্ধা-সহকর্মীদের প্রতি তাঁর কমরেডশিপ অনন্য। অন্যদের প্রতি তার সৌজন্যবোধ এবং কথা-আচার-আচরণের পরিমিতিবোধ তাঁর সুশিক্ষা ও পরিশীলিত সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। নিজের ভুল-ত্রুটির প্রতি তিনি নির্মোহ; দলের সভা, কর্মীসভা ও ওয়ান-টু-ওয়ান আলোচনায় দ্বিধাহীনভাবে তাঁর সমালোচনা করা যায়, তাঁকে প্রশ্ন করা যায়, চ্যালেঞ্জ করা করা যায়, জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা যায়; তিনি মনযোগ দিয়ে সেসব শোনেন ও প্রয়োজনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। পাবলিক ফিগার হিসেবে নিজ রাজনৈতিক বক্তব্য ও অবস্থানের জন্য তিনি প্রচুর সমালোচনারও মুখোমুখি হন, সে স্বাভাবিক কিন্তু ভিন্ন প্রসঙ্গ।

    তাঁর মানবিক গুণাবলীর মহত্তম দিকটি সম্ভবত তাঁর ধৈর্য, সহনশীলতা, ঔদার্য ও ক্ষমাশীলতা। আমরা আমাদের চোখের সামনে দেখেছি— কীভাবে তাঁকে এক্সপ্লয়েটকারীরা, তাঁর আনুকূল্য ও অনুগ্রহপ্রাপ্তরা, তাঁর সামনে চোখ উল্টে দিয়েছেন, তাঁকে ছেড়ে গিয়েছেন ও তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আমরা দেখেছি, তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে ও রাজনৈতিকভাবে বিপদে ফেলতে দলের সভার বাইরে যারা পত্রিকার অপ-সংবাদ ফটোকপি করে বিলি করেছেন, তাঁদেরকেও তিনি পরে আবার দলের স্থায়ী কমিটিতে জায়গা করে দিয়েছেন। আমরা এও দেখেছি, যে মামলায় কর্নেল তাহেরের ফাঁসি ও অন্যদের কারাদণ্ড হলো, সে মামলার রাজসাক্ষীদের প্রতিও তিনি সহানুভূতিশীল, এ যুক্তিতে যে কী ভয়াবহতম নিপীড়নের ফলেই না তাঁরা রাজসাক্ষী হতে বাধ্য হয়েছিলেন!

    একত্রিশ.
    হাসানুল হক ইনু উপর থেকে নাজেল হওয়া বা চাপিয়ে দেয়া একজন নেতা নন। তিল তিল করে গায়ে-গতরে কষ্টকর খাঁটনি খেঁটে আর ছোট কর্মী হিসেবে বড় বড় দায়িত্ব পালন করে তৃণমূল থেকে ওঠে আসা একজন জাতীয় নেতা তিনি। তিনি যা কিছু অর্জন করেছেন, তা পরিশ্রম করে অর্জন করেছেন। অনেকে বলেন সিরাজুল আলম খান, মেজর জলিল ও আসম আবদুর রবের দলত্যাগের পর কাজী আরেফ আহমেদ, মনিরুল ইসলাম [মার্শাল মনি], হাসানুল হক ইনু ও শরীফ নূরুল আম্বিয়ার টিমওয়ার্কের পরিণতি হচ্ছেন হাসানুল হক ইনু; কিন্তু এও তো সত্য যে সে টিমের কেউই আর দলে নেই; এমনকি গত প্রায় ৫০ বছরে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের যারা দলে ও রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারতেন তাদের মধ্যে হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া আর কেউ দলে নেই।

    সেজন্যই আমাদের অনুধাবনে হাসানুল হক ইনু একজন ‘স্বরচিত’ রাজনৈতিক নেতা। এ দল যাঁরা তৈরি করেছেন, তাঁরা পথ ছেড়েছেন; কর্মীদের প্রতিনিধি হয়ে হাসানুল হক ইনু দায়িত্ব নিয়ে সে দল ও রাজনীতি পরিচালনা করছেন। তিনি নিজে বারবার বলেন, “জাসদ কর্মীদের দল, আমি কর্মীদের নিযুক্ত পাহারাদার মাত্র।” তারপরও জাসদের সকল বড় আয়োজনে বক্তব্যের শুরুতে তিনি এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন পথহারা সেসব বড় বড় নেতাদের প্রতি; সকলের প্রতি তাঁর বক্তব্য এই যে, জাসদের দরোজা সকলের জন্য খোলা— যে কারোর ফিরে আসার জন্য।

    বত্রিশ.
    বিশিষ্ট মার্কসবাদী লেখক বদরুদ্দিন উমর তাঁকে ‘মিসগাইডেড জিনিয়াস’ বলতেন। ভিন্ন পথের পথিক বদরুদ্দিন উমরের ব্যবহৃত ‘মিসগাইডেড’ শব্দটি আমরা অবলীলায় উপেক্ষা করতে পারি এবং ‘মিসগাইডেড জিনিয়াস’ অভিধাটিকে আমরা একটি ‘কমপ্লিমেন্ট’ হিসেবে গ্রহণ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।

    তেত্রিশ.
    বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি’র এককালের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ সম্পর্কে হাসানুল হক ইনু বলেছিলেন যে ফরহাদ ছিলেন ‘নীতির প্রশ্নে অনমনীয়, কৌশলে নমনীয়’। আমরা মনে করি এ কথাটি তাঁর বেলায় আরও বেশি করে প্রযোজ্য। এ নমনীয়তার ফলে তিনি ধীরে চলতে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরে চলার নামে মার্কটাইম করতে, আর ক্ষেত্রবিশেষে সহযোদ্ধাদের মতামতকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কালক্ষেপন করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

    চৌত্রিশ.
    হাসানুল হক ইনু’র চিন্তা-লেখা-কাজে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ‘টু ট্যাকটিকস অব সোশাল ডেমোক্রেসি ইন ডেমোক্রেটিক রেভ্যুলুশন’-এর প্রভাব রয়েছে। তাঁর মধ্যে তাৎক্ষণিকতা ও প্রয়োগবাদিতার বা প্রাগমাটিজমের ঝোঁকও রয়েছে, তাতে খুব একটি সমস্যা নেই; কিন্তু ‘নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য’ সাধনের ‘কাজ’— ঐতিহাসিক বস্তুবাদসিদ্ধ অনিবার্য ও চূড়ান্ত লক্ষ্যাভিমুখে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অনুপস্থিতিতে— তাঁর প্রয়োগবাদিতাকে সীমাবদ্ধ করে, লক্ষ্যাভিমুখি পরিণতিতে যায়না। তাঁর প্রাগমাটিজম অনেক বেশি রোমান্টিসিজমতাড়িত।

    পঁয়ত্রিশ.
    ঐতিহাসিক বস্তুবাদ অনুধাবনে তিনি পারঙ্গম; শ্রেণি বিভাজন বা সামাজিক স্তরবিন্যাসসমেত সমাজের দ্বন্দ্বগুলো তিনি স্পষ্ট ধরতে পারেন, শ্রেণিগুলোর ক্ষমতা বিশ্লেষণ করতে পারেন নিখুঁতভাবে, এবং সেভাবে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারেন; কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা অনুধাবনের বেলায় তাঁর মধ্যে অস্বচ্ছতা-দোলাচাল-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়; রসায়ন-প্রকৌশলের শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও বস্তু ও শক্তি এবং প্রকৃতির নিয়মাবলীর অনুধাবনে তাঁর মধ্যে ভাববাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পায়। আতিপ্রাকৃতিকতায় বা ঐশ্বরিকতায় কেন সমর্পন করবেন নিজেকে? তিনি কেন হজ্ব করবেন? সময় ও অর্থের অপব্যয় করবেন? হ্যাঁ, জাসদ কোনো কমিউনিস্ট পার্টি নয়, এর নেতাকর্মীদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে, এবং তাঁরা তা পালন করতেই পারেন, এবং হাসানুল হক ইনুও তা করতে পারেন। তারপরও তাঁর কাছে নিখুঁত-প্রত্যাশা বেশি বলেই এ দার্শনিক প্রসঙ্গের অবতারণা। এখানে অন্যদের জন্য বলে রাখা ভালো যে হাসানুল হক ইনু ধর্মনিরপেক্ষতার অনুধাবনে সক্ষম; নিজ ধর্ম বিশ্বাসকে তিনি দল বা রাজনীতিতে ব্যবহার করেননা; অপরাপর ধর্মমতের প্রতি তিনি সহিষ্ণু; লিবারেশন থিওলজি বা মুক্তির ধর্মতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি নিজ ও অপরাপর ধর্মমতের অনুষ্ঠানাদিতে নিমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে কথা বলেন। আমাদের তাতে আপত্তি নেই।

    ছত্রিশ.
    তিনি সাধারণভাবে জীবন যাপন করতে পছন্দ করেন। বই কেনা ছাড়া তাঁর আর কোনো বিলাসিতা নেই। স্বাধীনতার পর থেকে তিনি সাধারণ দোকানের সাধারণ পাজামা-পাঞ্জাবি-স্যান্ডেল পরিধান করেন। সবাই যখন বোতলজাত পানি পান করতেন, জাসদ অফিসে তিনি পান করতেন ওয়াসার ট্যাপের পানি। তিনি স্বল্পাহারী; যখন মন্ত্রী ছিলেন বা এখনও যখন দলের সভাপতি, দুপুরে জাসদ অফিসের নিচের মান্নান-খোরশেদের ফুটপাতের দোকানের খাবারই তিনি খান। রাস্তার ধারের খাবার, বিশেষত মুড়িমাখা-চটপটি-ফুসকা কিংবা চানাচুর-চিড়াবাদাম-পুরি-সিঙ্গারা-সমুচা তাঁর পছন্দের খাবার। অসুস্থতার আগে তিনি ধূমপান করতেন, অন্যরা ট্রিপল ফাইভ সিগারেট পান করলেও তিনি পান করতেন ফিল্টারহীন সস্তা প্লেইন স্টার।

    সাঁইত্রিশ.
    অনেকের অভিযোগ তিনি এমপি-মন্ত্রী হবার লোভে নীতি বিসর্জন দিয়ে আওয়ামী লীগের দালালি করছেন। তাদের মনে রাখা উচিত ১৯৭২ সালে ক্ষমতাকে পায়ে দলে তিনি বিরোধী দলীয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন; সামান্য আপোষ করলে ১৯৭৯ সালে এমপি হতে পারতেন; ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ ও সিপিবি’র মতো আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে নির্বাচন করলে এমপি হতে পারতেন। মনে রাখা দরকার যে হাসানুল হক ইনুর কর্মীর কর্মীরও দল ত্যাগ করে মন্ত্রী হয়েছেন। তিনি সে পথে জাননি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসন সমঝোতার আলোচনায় আওয়ামী লীগ তাঁকে ভেড়ামারা-মিরপুর ছেড়ে ঢাকার মিরপুরে নির্বাচন করতে চাপ দিয়েছিল, যেমন চাপ দিয়েছিল রাশেদ খান মেননকে বরিশাল ছেড়ে ঢাকার মতিঝিলে নির্বাচন করতে। সে আলোচনায় হাসানুল হক ইনু সাফ সাফ বলে দিয়েছিলেন যে তাহলে তিনি নির্বাচন করবেন না।

    আর নীতির প্রসঙ্গে যদি বলতে হয়, অতিসংক্ষেপে বলা যায় সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের পথে সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সংগ্রামও একটি বিপ্লবী কর্তব্য; এটা আমাদের বানানো কথা নয়, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের ‘টু ট্যাকটিকস অব সোশাল ডেমোক্রেসি ইন ডেমোক্রেটিক রেভ্যুলুশন’-এর মূল কথা। বাংলাদেশের সমাজের গণতন্ত্রকে রক্ষা ও বিকশিত করতে ২০০২ সালের শুরু থেকে ২০০৪ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত জাসদের পক্ষে নিরলস পরিশ্রম করে তিনি ১৪ দল গঠন ও এর রাজনীতির আদর্শিক ভিত্তি রচনায় নিয়ামক ভূমিকা রাখেন; সাম্প্রদায়িকতা-যুদ্ধাপরাধ-জঙ্গিবাদ নির্মূলের লক্ষ্যে ১৪ দলের ২৩ দফা জাতীয় ন্যূনতম কর্মসূচি প্রণয়নে তিনি নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন; এবং পরে সে নীতির আলোকে জামাত-বিএনপি-জঙ্গির ঐক্যের বিরুদ্ধে আপোষহীন অবস্থান গ্রহণ করেন। এ আপোষহীনতাকে যারা দালালি বলেন তারা সমকালের বিশ্বরাজনীতির প্রবণতা ও ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ, প্রতিক্রিয়াশীল।

    তাঁর সম্পর্কে আরেকটা কমন অপপ্রচার এ যে দলগতভাবে নির্বাচন করলে তাঁর জামানত থাকবে না। এখানে তাদের উদ্দেশ্যে বলি ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তিনি দলগতভাবে নির্বাচন করেছেন, একবারও জামানত হারাননি। যে দেশে প্রতীক দেখে কলাগাছকেও ভোট দেয়া হয়, সে দেশে ১৯৯১-এর পরের দুটো নির্বাচনে তিনি নিজ দলের প্রতীক মশালের ভোট বাড়িয়েছেন। এসব বানানো কথা নয়, নির্বচন কমিশনে তার রেকর্ড আছে।

    আটত্রিশ.
    হাসানুল হক ইনু অনেক কিছু দিয়েছেন; কিন্তু তিনি চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন; আর কোনো মানুষই জীবনদায়ী-জননী-প্রকৃতির ঋণ কোনোভাবেই শোধ করতে সক্ষম নন। তাই তাঁর মতো দুঃসাহসী রোমান্টিক বিপ্লবীর চুহাত্তরতম জন্মদিনেও আমরা জাসদ কর্মীরা দেখতে চাই বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন পুনর্গঠন করতে, সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করতে আর জাসদকে একটি আধুনিক সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার অধীনে দাঁড় করাতে তিনি আমাদের কতোটুকু কাজে লাগান আর কোথায় নিয়ে যান।

    উনচল্লিশ.
    বাবা এএইচএম কামরুল হক ও মা বেগম হাসনা হেনা হকের পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে প্রথম সন্তান হাসানুল হক ইনু জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ১২ নভেম্বর। তাঁর বাবা ছিলেন কর্ণফুলি পেপার মিলের জেনারেল ম্যানেজার। তাঁর স্ত্রী আফরোজা হক রীনাও একজন রাজনীতিক, তিনিও স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান কম্পিউটার প্রকৌশলী শমিত আশফাকুল হক; পুত্র শমিত ও পুত্রবধু চিকিৎসক নাহিদ ফারহানার রয়েছে এক পুত্র। এই পাঁচ জন নিয়ে হাসানুল হক ইনুর সংসার।

    তাঁর মমতাময়ী মা ১৯৭৬ সালের ৫ জানুয়ারি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর খবর জেল কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও জিয়াউর রহমানের নির্দেশে জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে এ খবর জানানো থেকে বিরত থাকে; প্যারোলে মুক্তি দিয়ে মাকে শেষবারের মতো দেখার সুযোগ দেয়া তো দূরের কথা, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বরিশাল জেলা কারাগারে পাঠানোর পরই কেবল মা’র মারা যাবার খবর তাঁকে জানানো হয় ছয় মাস পর। নোংরা জিয়া কতোটা বর্বর ও অসভ্য চরিত্রের ঘৃণ্য ও বিকৃতমানসের ব্যক্তি— এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তা পুরোপুরি প্রকাশ পায়।

    এরশাদ সামরিক জান্তার সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ তাঁকে গ্রেফতারের জন্য খুঁজে না পেয়ে ১৯৮৬ সালে তুলে নিয়ে যায় ছোট ভাই মঞ্জুরুল হক টিংকুকে। ইলেকট্রিক শক দেয়া থেকে শুরু করে বরফখণ্ডের সাথে বেঁধে রাখাসহ বিভিন্ন পন্থায় টিংকুর ওপর অমানবিক শারীরিক নির্যাতন চালায় ও চিরদিনের মতো এমন শারীরিক ক্ষতি করে যে তার ফলে পরে তার অকালমৃত্যু হয়।

    চল্লিশ.
    ২১ বছর বয়সে শুরু করে ৫৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি মুখোমুখি হয়েছেন ঔপনিবেশিক-সামরিক-সেনাসমর্থিত-বেসামরিক স্বৈরশাসন আর গড়ে তুলেছেন গণপ্রতিরোধ-গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান-সশস্ত্রসংগ্রাম; দেখেছেন আশাহীনতার অন্ধকার আর আশার সূর্যোদয়; জয় আর পরাজয়; দেখেছেন অনেক নেতা-সহযোদ্ধা-কর্মী-সদস্য শাসকদের আক্রমণে দল ছেড়েছেন, অনেকে পায়ে পায়ে তাল মেলাতে না পেরে পথ ছেড়েছেন, অনেকে আপোষ করেছেন, বিশ্বাসঘাতকতাও করেছেন কেউ কেউ, জীবিকা হারিয়েছেন বহুজন, সম্পদ ও সম্পর্ক হারিয়েছেন অসংখ্যজন এবং দেখেছেন অগণনজন প্রত্যেকে হারিয়েছেন একমাত্র জীবন। তাঁদের ও তাঁদের পরিবার-পরিজনদের জন্য তাঁর রয়েছে গভীর বেদনা ও সমবেদনা; কিন্তু তিনি নিজের রাশ টেনে ধরতে জানেন, তাই বিহ্বল হননা। তিনি তার সহকর্মীদের নির্দেশ দেন, “আর কিছু অর্জন হোক বা না হোক, অন্তত এঁদের জন্য যখন যেভাবে যতোটুকু পারো, কিছু কোরো।”

    একচল্লিশ.
    বেদনা ও সমবেদনায় ভারাক্রান্ত না হয়ে বা বিহ্বল না হয়ে তিনি এগিয়ে চলেন পরিবর্তনের সমুখপথে, সেসব বেদনা-সমবেদনার কারণেরে যুঝতে; ভবিষ্যতে আর যাতে বেদনা অর্জন ও সমবেদনা প্রকাশ করতে না হয়, সেজন্য। এরকম অনিশ্চিতি, বিধিনিষেধ, অসহযোগিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা আর নিরন্তর পথ চলা নিয়ে স্যাম কুক লিখেছেন-গেয়েছেন সৌল/রিদম অ্যান্ড ব্লুজ [আরঅ্যান্ডবি]— এ চেঞ্জ ইজ গনা কাম।

    ১৯৬৩ সালে স্যাম কুক গানটি লেখেন ও প্রথমবারের মতো গান; তিনি এটা নিবেদন করেছিলেন আমেরিকার বৈষম্য-বিরোধী নাগরিক অধিকার আন্দোলনের প্রতি। পরে জ্যাজ-ব্লুজ-সৌল-আরঅ্যান্ডবি ঘরানার আরও অনেক শিল্পী এটি গেয়েছেন; কেউ স্যাম কুকের ভাষা অপরিবর্তিত রেখে, কেউ একটি-দুটি শব্দ পাল্টে আর কেউবা দু’এক লাইন যোগ করে; কিন্তু প্রত্যেকে প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁদের নিজস্ব গায়কীর; ফলে প্রতিটি সংস্করণ ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ দেয় বেদনামথিত কাঙ্ক্ষিত-পরিবর্তনের মূলে বিশ্বস্ত থেকে; তবে হ্যাঁ, স্যাম কুকের পাশাপাশি সিল-এর গাওয়াও দারুণ। ‘সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক ও নান্দনিক গুরুত্ব’ বিবেচনা করে আমেরিকার ‘লাইব্রেরি অব কংগ্রেস’-এর ‘ন্যাশনাল রেকর্ডিং রেজিস্ট্রি’ গানটি সংরক্ষণ করছে। হাসানুল হক ইনুর জন্মদিনে আমাদের নিবেদন এ সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক-নান্দনিক সৌল/রিদম অ্যান্ড ব্লুজ—

    I was born by the river in a little tent. Oh and just like the river I’ve been running ev’r since. It’s been a long time, a long time coming. But I know a change gonna come, oh yes it will.

    It’s been too hard living, but I’m afraid to die. ‘Cause I don’t know what’s up there, beyond the sky. It’s been a long, a long time coming. But I know a change gonna come, oh yes it will.

    I go to the movie and I go downtown. Somebody keep tellin’ me don’t hang around. It’s been a long, a long time coming. But I know a change gonna come, oh yes it will.

    Then I go to my brother. And I say brother help me please. But he winds up knockin’ me. Back down on my knees, oh.

    There have been times that I thought I couldn’t last for long. But now I think I’m able to carry on. It’s been a long, a long time coming. But I know a change is gonna come, oh yes it will. [Sam Cooke (1963): A Change Is Gonna Come]

    চুহাত্তরতম জন্মদিনে অনেক শুভেচ্ছা, প্রিয় জননেতা হাসানুল হক ইনু। আপনি দীর্ঘজীবী হোন, যাতে স্বার্থপরের মতো আমরা আপনার সাহচর্য পাই আরও দীর্ঘদিন। আপনার জন্য আমাদের হৃদয়গভীরের ভালোবাসা অফুরান, প্রিয়তম কমরেড, আমাদের নায়ক।

    (লেখক: আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম, সদস্য, স্থায়ী কমিটি; জিয়াউল হক মুক্তা, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি; জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ।)

    যুগবার্তার অন লাইন থেকে সংগৃহীত

  • আজ ১২ নভেম্বর : ইতিহাসের এইদিনে

    আজ ১২ নভেম্বর : ইতিহাসের এইদিনে

    পৃথিবীকে আলোকিত করেছেন অনেক জ্ঞানী-গুণিজন। একের পর এক রচনা করেছেন এবং করছেন ইতিহাসের পাতা। উন্মোচিত হয়েছে জগতের নতুন নতুন দিগন্ত। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সেই ইতিহাস চিন্তা, চেতনা ও প্রেরণার উৎস। যারা জন্মেছিলেন কিংবা চলে গেছেন আজকের এই দিনে। আবার বহু ঘটনাই রয়েছে ফেলে আসা সময়ের পথে। যেসব ঘটনা এনেছিল প্রশান্তি কিংবা রচনা করেছে অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃস্বপ্নে নীলকাব্য। যা ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনেই। আসুন জেনে নেওয়া যাক ইতিহাসের এই দিনে বিশিষ্টজনদের জন্ম-মৃত্যু দিনসহ ঘটে যাওয়া ঘটনা-

    ইতিহাস

    • ১৭৮১ – ব্রিটিশ বহিনী দক্ষিণ ভারতের নাগাপাট্টম দখল করে।
    • ১৮৩৭ – দেশষীয় ও ইউরোপীয় ভূ-স্বামীদেরদ স্বর্থরক্ষা ভারতে জমিদার সভা প্রতিষ্ঠিত হয়।
    • ১৯১৩ – রবীন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়।
    • ১৯১৮ – অস্ট্রিয়াকে প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
    • ১৯৩০ – ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আইন অমান্য আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লন্ডনে প্রথম গোলটেবিল বৈঠক হয়।
    • ১৯৫৬ – মরোক্কো, তিউনিসিয়া ও সুদান জাতিসংঘে যোগদান করে।
    • ১৯৫৬ – ইসরাইলী সেনারা ফিলিস্তিনের গাজার রাফা শহরে ফিলিস্তিনী শরণার্থী শিবিরে গণহত্যা চালায়।
    • ১৯৭০ – বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ও জলোচ্ছ্বাসে দশ থেকে পনের লাখ লোক প্রাণ হারান।
    • ১৯৭১ – চীনের সঙ্গে রোয়ান্ডার কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।
    • ১৯৮২ – ইউরি আন্দ্রোপভ সোভিযে়ত রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।
    • ১৯৮৩ – বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্ত বরাবর ভারতের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ শুরু হয়।
    • ১৯৯০ – পৃথিবীর প্রাচীনতম ও ২৬০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী বংশপরম্পরাগত রাজতন্ত্রের সিংহাসনে জাপানের সম্রাট আকাহিতো অভিষিক্ত হন।
    • ১৯৯৬ – বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে মানবতাবিরোধী কালাকানুন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়।
    • ১৯৯৬ – ভারতের হরিয়ানার আকাশে উড্ডয়নরত দুটি বিমানের সংঘর্ষে ৩৫০ ব্যক্তি নিহত হয়।
    • ২০১১ – ইতালির প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকনি পদত্যাগ করেন।

    জন্ম

    • ১৬৪৮ – মেক্সিকান কবি হুয়ানা ইনেস দে লা ক্রস।
    • ১৬৫১ – জুয়ানা ইনেস ডে লা ক্রুজ, তিনি ছিলেন মেক্সিকান নূনের, কবি ও পণ্ডিত।
    • ১৭২৯ – লুই আন্টইনে ডে বউগাইনভিলে, তিনি ছিলেন ফরাসি অ্যাডমিরাল ও এক্সপ্লোরার।
    • ১৭৪৬ – জ্যাকুইস চার্লস, ফরাসি উদ্ভাবক, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ এবং বেলুন বিশেষজ্ঞ।
    • ১৭৯০ – লেটিশিয়া টাইলার, তিনি ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জন টেইলারের সহধর্মীনি ও ফার্স্ট লেডি।
    • ১৮১৭ – বাহাউল্লা নামে পরিচিত আধ্যাত্মিক নেতা মির্জা হুসায়েইন আলী নুরি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাহাই বিশ্বাসের জনক।
    • ১৮৪০ – ওগুস্ত রদ্যাঁ, আধুনিক যুগের একজন বিখ্যাত ফরাসি ভাস্কর।
    • ১৮৪২ – জন উইলিয়াম স্ট্রাট, ৩য় ব্যারন রেলি, তিনি ছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইংরেজ পদার্থবিদ ও শিক্ষাবিদ।
    • ১৮৬৬ – চীনের বিপ্লবী নেতা সান ইয়াৎ সেন।
    • ১৮৯৬ – সালিম আলী, বিখ্যাত ভারতীয় পক্ষীবিদ ও প্রকৃতিপ্রেমী।
    • ১৮৯৬ – নিমা ইয়ুশিজ, তিনি ছিলেন ইরানী কবি ও অধ্যাপক।
    • ১৯০৩ – জ্যাক অয়াকি, তিনি ছিলেন আমেরিকান অভিনেতা ও গায়ক।
    • ১৯১৫ – রোল্যান্ড বার্থেজ, তিনি ছিলেন ফরাসি দার্শনিক, তাত্ত্বিক ও সমালোচক।
    • ১৯২৭ – রবীন্দ্র সংগীতে অকাদেমি পুরস্কার বিজয়ী (২০১০) দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী।
    • ১৯২৭- ইয়ুতাকা তানিয়ামা, তিনি ছিলেন জাপানী গণিতবিদ ও তাত্তিক।
    • ১৯৩১ – গ্রেগরি হেমিংওয়ে, মার্কিন চিকিৎসক ও স্মৃতিকথাকার।
    • ১৯৩৩ – জালাল তালাবানি, তিনি ইরাকি রাজনীতিবিদ ও ৬ষ্ঠ রাষ্ট্রপতি।
    • ১৯৩৪ – ভাভা, ব্রাজিলীয় ফুটবলার।
    • ১৯৩৮ – বেলাল চৌধুরী,বাংলাদেশী কবি।
    • ১৯৪৫ – নিল ইয়ং, তিনি কানাডিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান গায়ক, গীতিকার, গিটার ও প্রযোজক।
    • ১৯৪৮ – হাসান রুহানি, তিনি ইরানের আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও ৭ম রাষ্ট্রপতি।
    • ১৯৬১ – ইনযো ফ্রাঞ্চেস্কলি, তিনি সাবেক উরুগুয়ের ফুটবলার।
    • ১৯৭৩ – রাধা মিচেল, তিনি অস্ট্রেলীয়অভিনেত্রী ও প্রযোজক।
    • ১৯৭৮ – আলেকজান্দ্রা লারা, তিনি রোমানীয় বংশোদ্ভূত জার্মান অভিনেত্রী।
    • ১৯৮০ – রায়ান গসলিং, তিনি কানাডিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান অভিনেতা, গায়ক ও প্রযোজক।
    • ১৯৮৬ – ইগ্নাযিও আবাটে, তিনি ইতালিয়ান ফুটবলার।

    মৃত্যু

    • ১০৩৫ – কনুট গ্রেট, তিনি ছিলেন ডেনিশ ইংরেজ রাজা।
    • ১৭৯৩ – জাঁ সযল্ভাইন বাইলয়, তিনি ছিলেন ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও রাজনীতিবিদ ১ম মেয়র।
    • ১৮৬৫ – এলিজাবেথ গাস্কেল, তিনি ছিলেন ইংরেজ লেখক।
    • ১৯১৬ – পারসিভালমাস্টার লোয়েল, তিনি ছিলেন আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও লেখক।
    • ১৯২৯ – স্যার মনীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, কাশিমবাজারের মহারাজা ও মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব।
    • ১৯৪৬ – ভারতীয় শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ মদনমোহন মালব্য।
    • ১৯৬৯ – অজিতকুমার গুহ, বাঙালি শিক্ষাবিদ এবং লেখক।
    • ১৯৭৬ – মিখাইল গুরেভিচ, তিনি ছিলেন রাশিয়ান বিমান ডিজাইনার, বোখারা সমবায়ের প্রতিষ্ঠিত।
    • ১৯৮১ – উইলিয়াম হোল্ডেন, মার্কিন অভিনেতা।
    • ১৯৮৯ – বিশ্বনন্দিত কমিউনিস্ট নেত্রী, স্পেনের কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও স্পেনের গৃহযুদ্ধের নায়িকা ডলোরেস ইরারুর বির।
    • ২০০৭ – ইরা লেভিন, তিনি ছিলেন আমেরিকান লেখক ও নাট্যকার।
    • ২০১৩ – আলেকজান্ডার সেরেবরভ, তিনি ছিলেন রাশিয়ান প্রকৌশলী ও মহাকাশচারী।
    • ২০১৮ – স্ট্যান লি, মার্কিন কমিক বই লেখক, সম্পাদক, প্রযোজক ও প্রকাশক।
    • ২০১৯ -রাম রে নামে সুপরিচিত ভারতের বিজ্ঞাপন জগতের এক কিংবদন্তি।

    দিবস

    • বিশ্ব স্থাপত্য দিবস।
    • আন্তর্জাতিক নিউমোনিয়া দিবস।
    • জনসেবা প্রসারণ দিবস। (ভারত)।

    (সংকলিত)

  • আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর

    আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর

    আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এই দিনে মহা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ভোলাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। লাখ লাখ মানুষ সেদিন প্রাণ হারায়।

    দিনটি স্মরণে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আলোচনা সভা, সেমিনার, কোরআনখানি ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।

    উপমহাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর মধ্যে ৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। প্রলয়ঙ্করী ওই ঝড়ে প্রায় ১০ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। এর মধ্যে ভোলা জেলায় লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আর অসংখ্য জনপদ বিরান ভূমিতে রূপ নেয়। উত্তাল মেঘনা নদী আর তার শাখা-প্রশাখাগুলো রূপান্তরিত হয়েছিল লাশের ভাগারে। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। ঝড়ের আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়েছিলো পুরো ভোলাসহ উপকুল অঞ্চল।

    ১৯৭০ সালের ১১ নভেম্বর বুধবার সকাল থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হতে থাকে। পরদিন ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার আবহাওয়া আরো খারাপ হতে লাগল এবং মধ্যরাত থেকেই ফুঁসে উঠতে শুরু করে সমুদ্র। তীব্র বেগে লোকালয়ের দিকে ধেয়ে আসল পাহাড় সমান উঁচু ঢেউ। ৩০/৪০ ফুট উঁচু সেই ঢেউ আছড়ে পড়ল লোকালয়ের উপর। আর মুহূর্তেই ভাসিয়ে নিয়ে গেলো মানুষ, গবাদি পশু, বাড়ি-ঘর এবং ক্ষেতের সোনালী ফসল। পথে প্রান্তরে উন্মুক্ত আকাশের নীচে পড়েছিলো কেবল লাশ আর লাশ। কত কুকুর, শিয়াল আর শকুন খেয়েছে সে লাশ তার কোন ইয়ত্তা নেই। মরনপুরীতে রূপ নেয় ভোলাসহ গোটা অঞ্চল।

    তৎকালীন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার স্থানীয় প্রতিনিধি ও ভোলা প্রেসক্লাবের সভাপতি এম হাবিবুর রহমান বলেন, বন্যার পরে দেখেছি সাপ আর মানুষ দৌলতখানের চৌকিঘাটে জড়িয়ে পড়ে আছে। স্নেহময়ী মা তার শিশুকে কোলে নিয়ে মেঘনার পাড়ে মৃত অবস্থায়। সোনাপুরের একটি বাগানে গাছের ডালে এক মহিলার লাশ ঝুলছে। এমনিভাবে মনপুরা, চরফ্যাশন, লালমোহন, তজুমুদ্দিন ও দৌলতখানসহ সমগ্র জেলায় মানুষ আর গবাদি পশু সেদিন বঙ্গোপসাগরের উত্তাল জলে ভেসে গেছে। জন-মানুষ শূন্য হয়ে পড়েছিলো দ্বীপজেলা ভোলা।

    তিনি বলেন, ঝড়ের আঘাতে টিঅ্যান্ডটি ভবনসহ সকল স্থাপনা ভেঙ্গে যায়। নিউজ পাঠানোর কোন মাধ্যম ছিলোনা। ঘটনার তিনদিন পরে তিনি তৎকালীন বরিশাল জেলা প্রশাসক হাসেম আলীর অনুমতি নিয়ে ভোলা থানার ওয়ারলেসযোগে পূর্বদেশ পত্রিকায় ‘বাংলার মানুষ কাঁদো, গাছে গাছে ঝুলছে লাশ’ শিরোনামে সংবাদ পাঠান। এছাড়া একটি ট্রলারে করে ছবি পাঠান পত্রিকা অফিসে। ঘটনার ৪দিন পরে পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হলে পুরো দেশে এ নিয়ে আলোড়িত হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে ত্রাণ আসতে শুরু করে।

    হাবিবুর রহমান আরো বলেন, ১৮ অথবা ১৯ তারিখে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ করে এক জাহাজ ত্রাণ নিয়ে আসেন ভোলায়। সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মনপুরায়। মনপুরার ২৬ হাজার মানুষের মধ্যে ১৭ হাজারই সেদিন সাগরের জলে ভেসে গিয়েছিলো।

  • শহীদ নূর হোসেন দিবস আজ

    শহীদ নূর হোসেন দিবস আজ

    আজ শহীদ নূর হোসেন দিবস। ১৯৮৭ সালের এদিনে তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকার বিরোধী আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর জিরো পয়েন্ট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন নূর হোসেন।

    মৃত্যুর পর নূর হোসেনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাজধানীর জিরো পয়েন্ট এলাকার নামকরণ করা হয় শহীদ নূর হোসেন স্কয়ার এবং ১০ নভেম্বরকে শহীদ নূর হোসেন দিবস ঘোষণা করা হয়।

    নূর হোসেন ১৯৬১ সালে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। জীবিকার সন্ধানে তার পরিবার ঢাকায় এসেছিল। নূর হোসেনের পরিবার থাকত রাজধানীর পুরনো ঢাকার বনগ্রামে। নূর হোসেনের বাবা মজিবুর রহমান পেশায় ছিলেন একজন বেবিট্যাক্সি চালক। মা মরিয়ম বেগম গৃহিণী। নূর হোসেন নিজেও ছিলেন একজন পরিবহন শ্রমিক।

    গায়ের শার্ট কোমড়ে বাঁধা, পরনে জিন্সপ্যান্ট, পায়ে কেডস, খালি গায়ে বুকে পিঠে লেখা ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’। নূর হোসেনের পুরো শরীরটাই যেন প্রতিবাদি পোস্টার। নূর হোসেনের এ প্রতিবাদ সহ্য করতে পারেনি স্বৈরাচার সরকার। নির্মম বুলেট ছুটে আসে প্রতিবাদি যুবক নূর হোসেনের দিকে।  

    গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে যখন একটি রিকশায় করে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন এক যুবক। গুলিবিদ্ধ নূর হোসেনকে রিকশা থেকে নামিয়ে পুলিশের গাড়িতে তুলে নেয়া হয়। নূর হোসেন যখন মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন তখনও একজন পুলিশ সদস্য পায়ের বুট তার বুকের উপর চেপে ধরে। স্বৈরাচারী পুলিশ এমন নিষ্ঠুরভাবে সেদিন নূর হোসেনকে হত্যা করে।  

    নূর হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন আরও বেগবান হয় এবং স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের পতন ঘটে।  

    নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, সিপিবি, জেএসডি, বাম গণতান্ত্রিক জোট, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, শহীদ নূর হোসেন সংসদ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, মোটরচালক লীগসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন গুলিস্তানে নূর হোসেন চত্তরে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, মিলাদ-দোয়া মাহফিল, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবে।

    নূর হোসেনের বুকে ও পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লেখা স্লোগান আজও সবাইকে স্বৈরশাসনসহ সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শক্তি ও অনুপ্রেরণা যোগায়।

  • কর্নেল তাহের এবং ৭ই নভেম্বর

    কর্নেল তাহের এবং ৭ই নভেম্বর


    তাহেরা বেগম জলি
    জাসদ রাজনীতির অনেক কিছুই আজ আমার কাছে শুধুই স্মৃতি বা ইতিহাস। তবে সব স্মৃতি তো মুছে যায় না। এবং আমি চাইলেও তা যায় না। আবার এমন অনেক অতিত আছে, যে অতিতকে শুধু স্মৃতি বলেও পাশ কাটানো যায় না। শহীদ কর্নেল আবু তাহের আমার কাছে তেমনই এক ইতিহাস,যা শুধুই স্মৃতি বা অতিত নয়-আমার জীবনেরই একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ।


    কর্নেল তাহের হত্যা মামলা পরিচালনা করবার সময় আমি ঢাকা কারাগারের বাসিন্দা ছিলাম। এটা আমার জীবনের একটা মস্তবড় দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার মাত্র ছয় বছরের মাথায় একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সেই যুদ্ধেরই একজন সেক্টর কমান্ডারের হত্যাকান্ডের সাক্ষী হতে হয়েছে। শ্রদ্ধেয় সালেহা বেগম এই মামলার অন্যতম অভিযুক্ত ছিলেন। এবং তিনি পাঁচ বছর কারাবাসে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ১৯৭৬য়ের মধ্য জুনে ( আমার যদি ভুল না হয়,মামলা শুরু হয়েছিলো ১৭ই জুন ) শুরু হওয়া মামলার রায় এক মাস পর ১৯৭৬-১৭ই জুলাই ঘোষণা করা করা হয়। রায় ঘোষণার পর সালেহা আপা যখন আমাদের নির্ধারিত সেলে ফিরে এলেন,আমরা সকলেই তখন জানতে চেয়েছি তাহের ভাইয়ে কী হোলো। আমরা মানে শিরীন আপা এবং আমি সহ আরও দুই চার জন। সালেহা আপা সেদিন মুখ ফুটে বলতে পারেননি তাহের ভাইয়ের ফাঁসির দ-ের কথা। অনেক কষ্টে বলেছিলেন কী আর হবে,যা হবার তাই হলো। আমরা ঐ সময়ে নিজেদের কথা বলার ধরণ বা আকার ইঙ্গিত বুঝতে পারতাম। তাই ঐটুকুতে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি তাহের ভাইয়ের ফাঁসির দ-াদেশের কথা। রায় ঘোষণার পরদিনই ১৮ ই জুলাই সালেহা আপাকে বরিশাল কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে ১৭ই জুলাই থেকে-তাহের ভাইকে নিয়ে কারা কতৃপক্ষের ব্যস্ততার গল্প আমাদের কানে আসা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। বা আমরাও চেষ্টা করতাম সে সব খবর জানতে। মামলা চলাকালীন প্রতিদিনের ঘটনা আমরা সালেহা আপার কাছেই জানতে পারতাম। এবং তা জানবার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকতাম। তাছাড়া কারাগারে কোন কিছুই গোপন থাকে না। বিশেষ ক’রে রাজনৈতিক বন্দীদের ব্যাপারে। মুখে মুখে সকলেই তা জেনে যায়। তাহের ভাইকে ২০ তারিখে জরুরী ভিত্তিতে তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করানোর সংবাদ যথারীতি আমাদের কানে এলো। তখন আমাদের অনুমান করতে দেরি হয়নি,সহসাই আমাদের জন্য একটা বড় ধরণের দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। অবশেষে এলো সেই নির্মম রাত, যে রাত সকাল হতেই আমরা জানতে পেরেছিলাম,তাহের ভাইয়ের মরদেহ জেলগেটে।


    ২১শে জুলাই সকাল। অন্যান্য দিনের মতোই খুব ভোরে আমাদের সেলের তালা খুলে দিয়ে সুবেদার সাহেব চাবি নিয়ে চলে গেছেন। আমাদের মনটা একেবারেই ভালো ছিলো না,কারণ চারিদিকে ঘটছিলো এমন কিছু ঘটনা,যেখানে আমাদের করবার কিছুই ছিলো না। কিন্তু আমাদের জন্য তা ছিলো অত্যন্ত বেদনার। আমরা বিষণ্ণ মনে নিজেদের মধ্যে এই সব কথাই বলাবলি করছিলাম। আমরা নিজেদের মধ্যে আরও বলাবলি করছিলাম,তাহের ভাইকে পরিবারের সঙ্গে যেহেতু বিশেষভাবে দেখা করানো হয়েছে,তাহলে পরিস্থিতি নিশ্চয় ভালো নয়। আমাদের মুখের কথা মুখেই আছে,সকালের দায়িত্বপ্রাপ্ত জমাদ্দার্নী এর মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললেন,আপনারা সব সেলে ঢোকেন। তাহের সাহেবের মরদেহ জেল গেটে দেখে এলাম। আপনাদের সেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুবেদার সাহেব সে রকমই ব্যস্ত হয়ে এসে,আমাদের সেলের দরজায় তালা লাগিয়ে কোনো কথা না বলে চলে গেলেন। আমরা তখন জেলের মধ্যে সেল বন্দী হয়ে রইলাম। এবং সেই সেলবন্দী ছিলাম পাঁচ দিন। সেদিন সেলবন্দী করা হয়েছিলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রায় সকল রাজবন্দীকেই। সেলবন্দী হলেও আমরা সহ গোটা জেলখানা হয়ে উঠেছিল বেশ সরগরম। কারণ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অধিকাংশ বন্দীবাসিন্দা এবং কর্মকর্তা কর্মচারীরা তাহের ভাইকে ভালোবেসে ফেলেছিলো। শহীদ কর্নেল আবু তাহের মানুষকে ভালবাসতেন এবং মানুষের ভালোবাসা তিনি আদায় করে নিতেও জানতেন। সম্ভবত তাহের ভাইয়ের রাজনৈতিক প্রভাব পড়েছিলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রায় সকলের উপরই। তাঁর রাজশক্তি মোকাবেলা করবার সাহস দেখে সকল রাজবন্দিই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। ২১ জুলাই সকালে আমাদের সকলের কষ্ট দুঃখ তাই একাকার হয়ে গিয়েছিলো। তিনদিন আগে ঘোষণা করা কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ-, ২১ জুলাই ভোরে চোরের মতো কার্যকর করেছিলো তৎকালীন স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান। এবং এটা ছিলো নজিরবিহীন একটা নিকৃষ্ট-বর্বর ঘটনা। সভ্য জগতের সমস্ত নিয়ম ভেঙ্গে তাহের ভাইয়ের মামলা পরিচালনা করা হয়েছিলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভিতরে,এবং সে মামলার আদালত ছিলো মিলিটারি শাসিত। সেখানে কোনো অভিযুক্তদের স্বাধীন মতো আইনজীবী নিয়োগের অধিকার দেওয়া হয়নি। যদিও পরবর্তী সময়ে আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি,কোনো কোনো সামরিক আদালতে বন্দীদের নিজেদের আইনজীবী নিয়োগের অধিকার দেওয়া হয়েছে। অথচ কর্নেল তাহেরকে নিয়ে গঠিত আদালতে,স্বাধীন মতো নিজেদের কথাও উপস্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। তার মানে দাঁড়ায় অন্যান্য সামরিক আদালতের থেকেও নিকৃষ্ট ছিলো কর্নেল তাহের মামলার সামরিক আদালত। ন্যাক্কারজনক এসব ঘটনা আমাদের দেশের সকল সচেতন মানুষই জানেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকার সুবাদে,ঐরকম একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ সাক্ষী হওয়ার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিলো। যা আমার কাছে আজও একটা দুঃসহ স্মৃতি। সে সময় প্রতিটা মুহূর্তই আমরা পার করেছিলাম কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা নিয়ে। এতো কষ্টকর পরিস্থিতি অন্তত আমার জীবনে আর কোনোদিন আসেনি। ফাঁসির দ- ঘোষণার পর,শহীদ কর্নেল আবু তাহেরকে তিনদিন অতিক্রমের সময়ও দেওয়া হয়নি। কর্নেল তাহের ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার। স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র ছয় বছর আগে। এত কিছু বাদ দিলেও একটা স্বাধীন দেশের,একজন সাধারণ নাগরিকের যে অধিকার থাকে,তাহের ভাইকে সে অধিকারও দেওয়া হয়নি। তাহের ভাইয়ের সকল মানবিক অধিকার সেদিন হরন করা হয়েছিলো অত্যন্ত নিকৃষ্ট এবং নির্মমভাবে। জেনারেল জিয়াউর রহমান অবশ্য এই হত্যাকা-ে ফেলেছিলো স্বস্তির নিঃশ্বাস। যদিও আমাদের মতো অসংখ্য মানুষের চিরদিনের জন্য তা হয়ে রইলো দীর্ঘ নিঃশ্বাস। একটা গৌরবের কথা এখানে বলি,চারিদিকের নিদারুণ সংকটে জড়িয়ে থাকা জাসদের নেতা কর্মীরা সেদিন কিন্তু সব বাঁধা অতিক্রম ক’রে বিক্ষোভ করেছিল। জাসদের নেতা কর্মীরা রীতিমত বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলো তাদের প্রিয় নেতার মর্মান্তিক হত্যাকা-ে। আজ সময় পাল্টেছে অনেক,পানি গড়িয়েছে অনেকদুর। কিন্তু তার পরেও তাহের হত্যাকারী এবং হত্যাকারীদের পদলেহনকারীদের ভুলে যাওয়া আমাদের মতো অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই,এই কথা আওড়ে যারা কালে কালে একাকার হয়েছেন তাহের হত্যাকারী বা হত্যাকারীর দলের সঙ্গে,যারা যে কোন ধরনের নিকৃষ্ট উপায় সহজ করবার ফন্দি হিসেবে বলে থাকেন রাজনীতি ব’লে কথা,হোক না তাহেরের খুনি,তবুও আমার বা আমাদের তরী ঐ ঘাটেই বাঁধবো। তারা নিক্ষিপ্ত হোক ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। জনতা প্রস্তুত করুক সেই বিচারাসন,যেখানে তাহের হত্যাকারী এবং তার পদলেহীদের বিচার যেন হয় একই মানদ-ে।
    ৭ই নভেম্বর এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবেই এসে দাঁড়ায়। আমি ৭ই নভেম্বরকে যতটা রাজনৈতিক ভাবে দেখি তার থেকেও বেশি দেখি মূল্যবোধের ঢাল হিসেবে। ৭ই নভেম্বর নিয়ে এতদিনে অনেকে অনেক কিছুই লিখেছেন। পাঠক হিসেবে আমি লক্ষ্য করেছি দুই একটা লেখার মধ্যে শহীদ কর্নেল আবু তাহেরকে বেশ কিছুটা ম্লান ক’রে দেওয়া হয়েছে। তবে তা ইচ্ছাকৃত করা হয়েছে এমন নাও হতে পারে। আবার তা হতেও পারে। আমি মনে করি কোনো লড়াই মানেই সব সময় তা সফলতার হিসাব নয়। পৃথিবীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লড়াই সংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার প্রমাণ আছে। সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। বা চট্টগ্রাম ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ এখানে স্মরণযোগ্য। প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরপিয়ান ক্লাবে আক্রমণ করবার আগে সেখানে আরও দুইবার হামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। এবং দুইবারই তা ব্যর্থ হয়। কিন্তু তৃতীয়বার যখন প্রীতিলতার নেতৃত্বে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়,তখন আগের দুই হামলার বীরদের অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। তাছাড়া ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অনেক আক্রমন শুরুর দিকে তো ব্যর্থতার চাদরেই মোড়া ছিলো। ধীরে ধীরে সেই সব আন্দোলনের পথ পরিশীলিত হয়েছে। এবং মানুষ তখন বুঝতে আরম্ভ করেছে ব্যর্থতা আসলে সাময়িক একটা ব্যাপার। প্রতিটা আন্দোলনের মধ্যেই পথের নিশানা থাকে। এখানে কথা উঠতে পারে সেই আন্দোলন এবং ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থান একেবারেই এক নয়। আমিও তা অস্বীকার করিনা। তবে আমি মনে করি ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক ভ্রান্তির পুরো দায় সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের। শহীদ কর্নেল আবু তাহের সেখানে ছিলেন পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী। বা বিশেষ সময়ের নেতৃত্ব দানকারী। সঙ্গতকারণেই সমালোচনার কেন্দ্র বিন্দু হবে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল। শহীদ কর্নেল আবু তাহের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একটা জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন এটা হতে পারে। কিন্তু তারপরেও তিনি অন্যদের সঙ্গে মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে সিদ্ধান্ত ছিলো দলীয়। তাই রাজনৈতিক ভ্রান্তির শতভাগ দায় সংশ্লিষ্ট দলেরই নিতে হবে। ৭ই নভেম্বরের গোলকধাঁধা থেকে শহীদ কর্নেল আবু তাহেরের বেরিয়ে আসা হয়তো আর সম্ভব ছিলো না। তবে তিনি যা পারতেন সে দায়িত্ব তিনি শতভাগ পালন করেছেন। তাঁর এই নিষ্ঠা এবং বীরত্বের চরিত্র যদি কেউ ছোট করবার চেষ্টা করে,তারা কিছুতেই মানব বান্ধব নয়। লড়াই সফলতার মুখ দেখবে না,হয়তো তিনি তা বুঝতে পেরেছিলেন। এবং যে কোনো লড়াইয়ের নেতারা এটা বুঝতে পারেন। তারপরেও শহীদ কর্নেল আবু তাহের সেখানে ছিলেন অবিচল আত্মনিবেদিত মানুষ। তিনি যা পারতেন-আত্মবলিদানে অবিচল থাকা। সেই আত্মবলিদানের মঞ্চে সেদিন তিনি পৃথিবী সেরা মানুষদের সারিতে উঠে এসেছিলেন এবং তা আজও তিনি আছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ কর্নেল আবু তাহের আপসহীন জীবনের অসাধারণ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। যা আমাদের দেশের আগামী যে কোনো আন্দোলন সংগ্রামের আলোবর্তিকা হয়ে কাজ করবে।


    আজ ৭ই নভেম্বর, আমার কাছে ৭ই নভেম্বর এবং ২১ জুলাই সময়ের ফারাক ছাড়া আর কিছু নয়। আজ তাহের ভাইকে জানাই সস্রদ্ধ সালাম। শেষে আমি স্পার্টাকাসের একটা উক্তি দিয়ে আমার লেখা শেষ করবো।
    “আমার ব্যর্থ বিদ্রোহ শত শত সার্থক বিদ্রোহের জন্ম দিয়ে গেলো।”

  • কলারোয়ায়৪১টি মন্ডপে হবে দুর্গাপূজা, প্রতিমায় চলছে রঙ তুলির কাজ

    কলারোয়ায়৪১টি মন্ডপে হবে দুর্গাপূজা, প্রতিমায় চলছে রঙ তুলির কাজ

    মশাল ডেস্ক : শারদীয় দুর্গোৎসবের আর মাত্র কয়েকটি দিন বাকি। দুর্গাপুজোকে সামনে রেখে কলারোয়া উপজেলাব্যাপী চলছে প্রতিমায় শিল্পময় রঙের চূড়ান্ত প্রলেপ দেওয়ার কাজ। উপজেলার ৪১ টি মন্ডপেই ইতোমধ্যে প্রতিমা তৈরি ও রঙের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। প্রতিমা শিল্পীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমা পরিচর্যা ও রঙের প্রলেপের শেষ মুহূর্তের কাজে। রঙ-তুলির অনুপম পরশে দেবি দুর্গাকে মোহনীয় সাজে সজ্জিত করা হয়েছে ইতোমধ্যেই। আবহাওয়া মোটামুটি সুপ্রসন্ন থাকায় প্রতিমা সম্পন্নের কাজে বিঘ্ন ঘটেনি কোথাও। উপজেলার বিভিন্ন মন্ডপ ঘুরে প্রায় অভিন্ন চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। সবখানেই প্রতিমা তৈরি হয়ে গেছে। রঙের কাজও শেষ। তারপরেও সৌন্দর্যবর্ধক কর্মের যেমন শেষ নেই। এটিও অনেকটা সেরকম। দু’একদিনের মধ্যে সকল মন্ডপে রঙের কাজ শতভাগ শেষ হয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন সংল্লিষ্টরা। এবার কোভিডজনিত বিরূপ পরিবেশে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি ও শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে ভক্তবৃন্দ দেবি দুর্গাকে বরণ করবেন।
    শনিবার পৌরসভাধীন কয়েকটি পুজোমন্ডপে যেয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ। প্রতিমায় রঙের পরশও বুলানো হয়েছে। চলছে চূড়ান্ত কারুকাজ। প্রতিমা শিল্পীরা জানান, নজরকাড়া প্রতিমা গড়তে গেলে নিবিড় পরিশ্রম করতে হয়। আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে সৃষ্টি করতে হয় প্রতিমার অবয়ব। রঙের মিশেলে শতভাগ দক্ষতা ও কারুকাজ দেখাতে হয়। সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বড় উৎসব এই দুর্গাপুজোকে ঘিরে এখন প্রতিটি হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে উৎসবের আমেজ। হিন্দু ধর্মাবলম্বী সব বয়সী মানুষ সময় পেলেই চলে আসেন মন্ডপে প্রতিমার রঙের কাজ নিজ চোখে দেখতে। তাঁদের বিশ্বাস, পৃথিবীর সকল দুর্গতির অবসান ঘটিয়ে শান্তির বাতাবরণ দিতে দেবি দুর্গার মর্ত্যে আবির্ভাব ঘটে। তাই তো তিনি দুর্গতিনাশিনী। তাই দেবির মর্ত্যে অবস্থানের দিনগুলো তাদের বিশ্বাসমতে অতি তাৎপর্যপূর্ণ। সেকারণে একই সাথে আনন্দ ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের এই দুর্লভ সুযোগ ভক্তবৃন্দ ছাড়তে চান না। আনন্দ চিত্তে দেবিকে বরণ আর বেদনা বিধূর বিদায়-ভক্তগণকে মোহিত করে রাখে সারাটি বছর। প্রতীক্ষা থাকে পরবর্তী বছরে আবার দেবিকে বরণ করার বাসনা। আগামী ২১ অক্টোবর পূণ্য মহালয়ার মধ্য দিয়ে মর্ত্যধামে দেবি পক্ষের শুরু হবে।
    উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি মনোরঞ্জন সাহা এবং মাস্টার প্রদীপ পাল জানান, এ বছর কলারোয়া উপজেলাতে ৪১ টি পুজোমন্ডপে শারদীয় দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হবে।
    কলারোয়া থানার ওসি (তদন্ত) হারান চন্দ্র পাল জানান, শারদীয় দুর্গাপুজোয় এবার অনুষ্ঠিতব্য ৪১টি পূজা মন্ডপে আড়ম্বরতা না থাকলেও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে সকলকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ধর্মীয় উৎসব পালন করার আহবান জানানো হয়েছে। তিনি আরও জানান, এবার পুজোয় শান্তি-শৃংখলা বজায় রাখা এবং অপ্রীতিকর পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হতে পারে সেজন্য পূজা উদযাপন কমিটির কর্মকর্তাসহ স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতায় পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

  • কামাল লোহানী আর নেই

    কামাল লোহানী আর নেই

    করোনায় আক্রান্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক কামাল লোহানী আর নেই। আজ শনিবার সকাল ১০টার পরে রাজধানীর বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। কামাল লোহানীর ছেলে সাগর লোহানী এ কথা জানান।
    কামাল লোহানীর কোভিড-১৯ রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে বলে গতকাল শুক্রবার জানান তাঁর মেয়ে ঊর্মি লোহানী। কামাল লোহানী ফুসফুস ও কিডনির জটিলতা ছাড়াও হৃদ্‌রোগ ও ডায়াবেটিসের সমস্যাতেও ভুগছিলেন।

    কামাল লোহানীকে উত্তরীয় পরিয়ে দিচ্ছেন সুলতানা কামাল (বামে)


    শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান কামাল লোহানী। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর।
    কামাল লোহানীর মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
    ঊর্মি লোহানী গতকাল জানান, কামাল লোহানীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় ১৭ জুন সকালে তাঁকে হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল কোভিড টেস্টের ফলাফল হাতে পান তাঁরা। রিপোর্টে কামাল লোহানীর কোভিড-১৯ পজিটিভ বলা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রথমে কামাল লোহানীকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু সেখানে কোনো সিট পাওয়া যায়নি।


    ঊর্মি লোহানী জানান, কামাল লোহানী অনেক দিন ধরেই ফুসফুস ও কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন। শুরুতে লকডাউনে চিকিৎসা করাতেও বেশ সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে। হাসপাতালে নেওয়ার সমস্যা ছিল। টেলিফোনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করানো হচ্ছিল। কিন্তু অবস্থা বেশ গুরুতর হয়ে পড়লে গত ১৮ মে তাঁকে রাজধানীর পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানে বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলে ২ জুন তাঁকে বাসায় নেওয়া হয়েছিল। পরে আবার ভর্তি করাতে হয়েছে।


    কর্মজীবনে কামাল লোহানী দৈনিক মিল্লাত পত্রিকা দিয়ে সাংবাদিকতার শুরু করেন। এরপর আজাদ, সংবাদ, পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তায় গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
    উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটেরও উপদেষ্টা কামাল লোহানী বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দুবার মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবে এবং ছায়ানটের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি।

  • মোহাম্মদ নাসিম: রাজনীতিতে পাঁচ দশকের বেশি পথচলা

    মোহাম্মদ নাসিম: রাজনীতিতে পাঁচ দশকের বেশি পথচলা

    ন্যাশনাল ডেক্স : সিরাজগঞ্জ-১ আসন (কাজীপুর ও সদর উপজেলার একাংশ) থেকে তিনি পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগের হুইপ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় স্বরাষ্ট্র, ডাক ও টেলিযোগাযোগ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং সর্বশেষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

    সর্বশেষ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম কমিটির সদস্য মোহাম্মদ নাসিম দলের মুখপাত্র হিসাবেও দায়িত্ব পালন করছিলেন।

    রাজনীতির সঙ্গে মোহাম্মদ নাসিম সম্পৃক্ত হন ষাটের দশকে। শুরুর দিকে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হলেও পরবর্তীতে ছাত্রলীগ করতে শুরু করেন। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশের পর ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

    মোহাম্মদ নাসিমের জন্ম হয়েছিল ১৯৪৮ সালের দোসরা এপ্রিল, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলায়। তার পিতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে সরকারের মন্ত্রী, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী।Image caption জনসভায় ভাষণ দানরত মো. নাসিম।

    উনিশশো পঁচাত্তর সালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারের হত্যাকাণ্ড ও জেলখানায় আরো তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে তাঁর পিতা এম মনসুর আলী হত্যাকাণ্ডের পরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হয়ে ওঠেন।

    পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর মোহাম্মদ নাসিমকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সেইসময় দীর্ঘদিন তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে।

    ওই হত্যাকাণ্ডের শিকার আরেকজন নেতা এ এইচ এম কামরুজ্জামানের ছেলে, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’১৯৭৫ সালের পর তাকে বেশ একটা দুঃসময় পার করতে হয়। আমাদের সবাইকেই সেটা করতে হয়েছে। ৭৮ সালের দিক থেকেই তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েন। নেত্রী আসার পর (আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিদেশ থেকে দেশে আসার পর) তিনি সবসময় নেত্রীর সঙ্গেই থেকেছেন।‘’

    ‘’একাত্তর সালে মুক্তিসংগ্রামের সময় কলকাতায় আমরা এক বাড়িতে থাকতাম। জাতীয় চার নেতার পরিবারের মধ্যে আমরা তাকে আমাদের বড় ভাইয়ের মতো মনে করতাম। তিনিও সেভাবেই আমাদের খোঁজখবর রাখতেন। তাকে দেখেছি, যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশেও শক্ত মন নিয়ে দাঁড়াতে পারতেন, কর্মীদের চাঙ্গা করে তুলতে পারবেন। পরবর্তীতে প্রশাসক হিসাবেও তাকে সফল দেখতে পেয়েছি।‘ছবির কপিরাইট Facebook Image caption প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে মো. নাসিম।

    ‘’তিনি অনেক সময় গর্ব করেই বলতেন,আমি কোন বেঈমানের সন্তান নই, আমি বঙ্গবন্ধুর পরীক্ষিত আদর্শের সৈনিক, তার সন্তান।‘’ বলছেন এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন।

    উনিশশো একাশি সালে আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলে মোহাম্মদ নাসিম যুব সম্পাদক হন। তখন থেকেই কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে আসেন মোহাম্মদ নাসিম। পরবর্তীতে ১৯৮৭ তিনি আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন।

    তার আগের বছর, ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সিরাজগঞ্জ থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম।

    আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’মোহাম্মদ নাসিম রাজনীতির ক্ষেত্রে সারাজীবন সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ষাটের দশক থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত। তিনি একটা রাজনীতিক পরিবারের বেড়ে উঠেছেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাকে সাজা পর্যন্ত দিয়েছে। কিন্তু প্রতিটা আন্দোলন সংগ্রামে তিনি সম্মুখ সারিতে ছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিটা সংগ্রামের সাথে তিনি সামনের কাতারে ছিলেন।‘’

    আওয়ামী লীগের ‘৯২ ও ‘৯৭ সালের জাতীয় সম্মেলনে তাকে দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০১২ সালে কাউন্সিলে তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত করা হয়।ছবির কপিরাইট Facebook

    উনিশশো ছিয়ানব্বই, ২০০১, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে তিনি সিরাজগঞ্জ থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একসময় তিনি জাতীয় সংসদের হুইপ হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।

    রাজনীতিতে তাদের পরিবারের ভূমিকা নিয়ে ‘সংসদে তিন প্রজন্ম’ নামের একটি বইয়ের সম্পাদনাও করেছেন মোহাম্মদ নাসিম। সেখানে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, তার সন্তান মোহাম্মদ নাসিম এবং তার ছেলে তানভীর শাকিল জয়ের ভূমিকা নিয়ে বইটি লেখা হয়েছে। তিনি তিন সন্তানের জনক।

    তাঁর নির্বাচনী এলাকা কাজীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘’তার পিতাকে যেমন এলাকার লোক দরকারের সময় পেতো, তেমনি তাকেও আমাদের যেকোনো দরকারে সবসময় কাছে পেয়েছি। প্রতিমাসে কয়েকবার তিনি এলাকায় আসতেন। তিনি বিদেশে থাকলেও আমাদের ফোন করে এলাকার খোঁজখবর নিতেন। দলমত নির্বিশেষে এখানকার সবাই জানে, তার মতো নেতা পাওয়া যায় না।‘’

    ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী করা হয়।

    রাজনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে মোহাম্মদ নাসিমকে অনেকবার কারাবন্দী হতে হয়েছে। প্রথম তাকে কারাগারে যেতে হয় ১৯৬৬ সালে, যখন তিনি এইচএসসি পড়ছিলেন। সেই সময় পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ভুট্টা খাওয়ানোর চেষ্টার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পিতা এম মনসুর আলীর সঙ্গে কারাগারে যেতে হয় মোহাম্মদ নাসিমকেও। একবছর পরে তিনি ছাড়া পান।

    ১৯৭৫ সালে সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের পরে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল মোহাম্মদ নাসিমকে। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিযানে আরো অনেক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

    সেই সময় অবৈধভাবে এক কোটি ২৬ লাখ টাকার সম্পদ অর্জন ও ২০ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলায় বিশেষ জজ আদালত ২০০৭ সালে মোহাম্মদ নাসিমকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়। তবে ২০১০ সালে উচ্চ আদালত ওই সাজা ও মামলা বাতিল করে দেন।

    কিন্তু মামলায় সাজা হওয়ার কারণে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি মোহাম্মদ নাসিম। সেই আসনে তার ছেলে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। মামলা ও সাজা উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যাওয়ার পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম। এরপর তাকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী করা হয়, ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকেন।

    ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মন্ত্রী না হলেও তিনি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও দলের মুখপাত্র হিসাবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন।