Site icon Daily Dakshinermashal

৯২ বছরের মাহাথিরেই কেন আস্থা মালয়েশীয় তরুণ প্রজন্মের?

Spread the love

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: অবসরের ১৫ বছর পর রাজনীতিতে ফিরে দিয়েছিলেন চমক। নির্বাচনে জয়ী ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। তিনি আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার খ্যাতি পাওয়া ৯২ বছর বয়সী মাহাথির মোহাম্মদ। তিনিই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘ ২২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে নিজ দলের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে এই নেতার ক্ষমতায় ফিরে আসা যেন এক অনন্য ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, মাহাথিরের এই ইতিহাস সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছেন দেশটির তরুণ প্রজন্ম। বুধবারের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন জোটের বদলে মাহাথিরের বিরোধী জোটকেই বেছে নিয়েছে এই প্রজন্ম।

২০০৩ সাল থেকে স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ত্যাগ করা মাহাথির ২০১৬ সালে নিজের ইউনাইটেড মালয়েশিয়া ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (উমনো) ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধে ৭০ কোটি ডলারের দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন মাহাথির। ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা নিজের রাজনৈতিক শিষ্য নাজিবকে ক্ষমতা থেকে সরানোর প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি। যোগ দিয়েছিলেন এক সময় যাকে কারাগারে পাঠিয়েছিলেন সেই আনোয়ার ইব্রাহিমের দলে।

মাহাথিরের এই ফিরে আসাকে ভালোভাবেই স্বাগত জানিয়েছেন মালয়েশীয়রা। অনেকের সংশয় ছিল মালয়েশিয়ার তরুণ প্রজন্ম তাকে গ্রহণ করবে কি না। নির্বাচন পূর্ববর্তী জরিপেও দেখা যাচ্ছিল জেতার সম্ভাবনা কম মাহাথিরের। তবে সব পূর্বাভাস ও জরিপকে ভুল প্রমাণিত করে জয় ছিনিয়ে নেন তিনি। তার নেতৃত্বাধীন পাকতান হারপান সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়লাভ করে।

তরুণ প্রজন্ম কেন মাহাথিরের মতো বয়স্ক নেতার উপর আস্থা রাখলো? তাদের বক্তব্য, পরিবর্তন চাইছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বয়সই বরং মাহাথিরের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। আর বৃদ্ধ হলেও এখনও শারীরিকভাবে এখনও অনেক সুস্থ তিনি।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি কথা বলে মালয়েশিয়ার তরুণদের সঙ্গে। এক মালয়েশীয় তরুণী বলেন, ‘বয়সের বিষয়টা নিয়ে আমরা খুব বেশি চিন্তা করিনি। তিনি আমাদের কাছে দাদা’র মতো। কিন্তু আমরা পরিবর্তন চেয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘হয়তো ভালো কিছু হবে কিংবা খারাপ কিছু। তবে আমরা পরিবর্তন চেয়েছি।’

আরেক মালয়েশীয় তরুণ বিবিসিকে বলেন, ‘মাহাথিরের প্রমাণ করার কিছু নেই। আমরা সবাই তার সম্পর্কে জানি।’ আরেকজন জানান, এখনই হয়তো পরিবর্তন আসবে না। তবে পরিবর্তনের এই তো শুরু।

নির্বাচনে জয়ের পর ২৪ বছর বয়সী শিক্ষার্থী আব্দুল আজিজ হামজা ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘আমরা আজ ঐক্য অনুভব করছি। মাহাথির খুবই দূরদর্শী কারণ তিনি অভিজ্ঞ।’

মাহাথিরের সত্যিই প্রমাণ করার কিছু নেই বলেই মনে করেন তার সমর্থকরা। তবে তাদের অনেকের সংশয় ছিল তার সুস্থতা নিয়ে। মালয়েশিয়ার এক ব্যাংক কর্মকর্তা এম কে লুম বলেন, ‘আমরা তার যোগ্যতা কিংবা সক্ষমতা নয়, চিন্তিত ছিলাম স্বাস্থ্য নিয়ে। তিনি যদি শারীরকভাবে সমর্থ থাকেন তবে তাকে কেন ভোট দেব না?’

রোমের জন ক্যাবট বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ব্রিজেট ওয়েলশ বলেন, ‘মাহাথিরের বয়সই তার হয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। ভোটাররা তাকে অভিজ্ঞ মনে করেছেন যিনি মালয়েশিয়াকে দুর্নীতি থেকে টেনে তুলতে পারবেন।’ ওয়েলশ বলেন, ‘৯২ বছর বয়সী একজন মালয়েশিয়াকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছেন, দুর্নীতির কারণে ক্ষুব্ধ মানুষের কাছে তা ছিল বড় কিছু। তার অভিজ্ঞতা রয়েছে, বিশ্বাসযোগ্যতা আছে।’

মাহাথির নিজেও বলেন, ‘তরুণদের অভিজ্ঞতা নেই। যাদের অভিজ্ঞতা ছিল তারা বেঁচে নেই। আমি অভিজ্ঞতা নিয়ে বেঁচে আছি।’ নিজের প্রচারণা ভিডিওতে বয়সকে ব্যবহার করেছেন তিনি। ভিডিওতে ৯২ বছর বয়সী এই নেতা বলেন, ‘আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি। আমার সময় নেই। দেশকে পুনর্গঠনে বাকি সময়টা কাজে লাগাতে চাই। কারণ আমি হয়তো অতীতে ভুল করেছি।’

মাহাথির কি রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্ষম?

মাহাথিরের সুস্থতা এবং রাজনৈতিক সক্ষমতা ও সম্ভাবনা নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম হেরাল্ড হুইগ। সংবাদমাধ্যমটি জানায়, নির্বাক চলচ্চিত্রের সময় জন্ম নেওয়া মাহাথির বয়সকে হার মানিয়েছেন। তার জন্ম এমন সময়ে যখন এডলফ হিটলার চৌকস রাজনৈতিক। ইতিহাসের বড় বড় অধ্যায়ের স্বাক্ষী মাহাথির নিজেই মালয়েশিয়ায় বারবার ইতিহাস তৈরি করেছেন। অনুন্নত দেশ থেকে মালয়েশিয়াকে দিয়েছেন আধুনিক রূপ। ৯২ বছর বয়সেও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে সৃষ্টি করেছেন নতুন ইতিহাস।

তবে তিনি কি সত্যিই অনেক বৃদ্ধ? গতমাসে বার্তা সংস্থা এপি’র পক্ষ থেকে এই বিষয়ে মাহাথিরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল— কত বৃদ্ধ হলে একজন নেতা দেশ চালাতে সমর্থ থাকেন না? তার জবাব ছিল বরাবরে মতোই সাবলীল, ‘আমি হয়তো একটু বুড়িয়ে গেছি। না! আসলে অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছি। কিন্তু এখনও কাজ করতে সমর্থ আমি।’

মাহাথিরের মতো বয়স্ক নেতা অন্যান্য দেশেও ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট রিগানের কথা বলেছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস। তারা জানায়, রিগ্যান দায়িত্ব ছাড়ার পর ডাক্তাররা জানায় তার আলঝেইমার ছিল। প্রায়ই ভুলে যেতেন সবকিছু। মাঝে মাঝেই ঘুমিয়ে পড়তেন। এখনও ইতিহাসবিদরা সংশয় প্রকাশ করেন, হোয়াইট হাউসে থাকা অবস্থাতেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। তবে মিডিয়ায় সবসময় রিগানের কম বয়স দেখানোর চেষ্টা ছিল। গাছ কাটা কিংবা ঘোড়ায় চড়া ছবি বারবার দেখানো হতো।

তবে মাহাথির এখনও দিব্যি সুস্থ। হেরাল্ড উইগ জানায়, মাহাথিরের বয়স কম দেখানোর কিছু নেই। এখনও তাকে বৃদ্ধ মনে হয় না। ডাক্তার হওয়ার কারণে নিজের খেয়াল রেখেছেন তিনি। নিজে সবসময়ই বলেন, ‘খান কম, অনুশীলন করুন বেশি, বই পড়ুন বেশি।’ দুটি বাইপাস সার্জারি হলেও এখনও দিব্যি সুস্থ এই নেতা। মাথা ভর্তি চুল আর ঠোঁটে হাসি। বচন থাকে রসিকতায় মাখা। যখন কথা বলেন মনে হয় বয়স তার আরও ২০ বছর কম।

১৯৮১ সালে মাহাথির যখন প্রথমবার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তখন দেশটির পরিচয় ছিল দরিদ্র হিসেবে। ২০০৩ সালে যখন তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেন তখন দেশটি এশিয়ার শীর্ষ এক অর্থনীতি। নিজে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার খ্যাতি পাওয়ার পাশাপাশি ১৯৯৮ সালের এশিয়ার মন্দা কাটিয়ে দেশকে তুলে ধরেছেন ‘অর্থনৈতিক বাঘ’ হিসেবে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী হয়ে নিজেকে মুসলিম বিশ্বের কণ্ঠস্বরে পরিণত করেছিলেন তিনি। আবার টুইন টাওয়ারে ৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে সমর্থনও জানিয়েছিলেন মাহাথির।

Exit mobile version