বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগের ব্যাপকতার অভিযোগ, আমলে নিচ্ছে না সরকার


মে ৭ ২০১৮

Spread the love

ডেস্ক রিপোর্ট: এবারের মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলায় বোরো ধানের আবাদে ছত্রাকজনিত ‘নেক ব্লাস্ট’ রোগ ব্যাপক আকারে দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কারণে ধানের শীষ শুকিয়ে চিটা হয়ে যাচ্ছে। ক্ষেতের ধান নষ্ট হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। অনেকে ঋণ নিয়ে বোরো ফসলের আবাদ করেছেন। প্রত্যাশা অনুযায়ী ফলন না পেলে কীভাবে ঋণ শোধ করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তাদের। তবে সরকার বিষয়টি মানতে নারাজ। সরকারের এ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বলছে, এসব গুজব। এর কোনও ভিত্তি নেই।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,প্রতিবছর বোরো ফসলের মাঠের কিছু না কিছু অংশে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়। এটি ফসলের ক্ষতি ‘স্বাভাবিক নিয়মে’ পরিণত হয়েছে। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ব্যাপকতা আকার ধারণ করার কোনও তথ্য নেই। এ বছর বোরো ফসলের বাম্পার ফলন হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র বলছে, জেলা পর্যায় থেকে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ব্লাস্টের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। দেশে এ বছর ১ কোটি ৯০ লাখ টন বোরো চাল উৎপাদন হবে, যা রেকর্ড।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত ব্লাস্টের কোনও খবর আমরা জানি না। যা শুনেছি, তা পত্রপত্রিকায় ও টেলিভিশনে। এসব প্রতিবেদন দেখার পর জেলা কৃষি অফিসগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানার চেষ্টা করেছি। সেখানকার কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রতিবছরের মতো স্বাভাবিক নিয়মে এ বছরও কিছু জমিতে হয়তো ব্লাস্ট রোগ হয়েছে। তবে তা খুবই সামান্য। রেকর্ড করার মতো নয়। এটি এ বছরের বাম্পার ফলনে কোনও প্রভাব ফেলবে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ এরপরও আমরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরকে সতর্ক রেখেছি, যাতে যেকোনও পরিস্থিতি তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করা যায়। এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর কাজ করছে।’
এদিকে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, ‘প্রতিবছর প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করেই বোরো ফসল কৃষকের ঘরে ওঠে। এটি নতুন কিছু নয়। এ বছরও উঠবে। এ বছর বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। আশা করছি, এ বছর ১ কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদন হবে। মাঠের ফসল সম্পূর্ণ উঠলে মোট উৎপাদন পাওয়া যাবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে কামরুল ইসলাম বলেন, ‘বোরোর মৌসুমে ঝড়বৃষ্টি, রোদ-খরা সবই হয় এবং হবে। এর ওপর ব্লাস্ট তো আছেই। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। তবে এ বছর ব্লাস্ট যা হয়েছে, তা হিসাবে আনার মতো নয়। প্রতিবছর কিছু না কিছু জমিতে হয়। এবারও হয়েছে। এটি মোট উৎপাদনে কোনও প্রভাব ফেলবে না।’
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, ‘অনেকে হয়তো বলবেন, বৃষ্টিতে ধান শুকাতে পারেননি কৃষক। আবার কেউ বলবেন, খরার কারণে বোরো ধানের চিটা হয়ে গেছে। আবার কেউ বলবেন, ব্লাস্ট রোগ উৎপাদন ব্যাহত করেছে। এসবই গুজব। এ বছর সবই হবে। তারপরও বাম্পার ফলনের বোরো কৃষকের ঘরে উঠবে।’
সরকার এ বছর ১০ লাখ মেট্রিক টন বোরো চাল সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। চাল উৎপাদনে কেজিপ্রতি কৃষকের জন্য মুনাফা বাবদ ২ টাকা যুক্ত করে প্রতি কেজি সিদ্ধ বোরো চাল সংগ্রহ করা হবে ৩৮ টাকা দরে। আর আতপ বোরো চাল সংগ্রহ করা হবে প্রতিকেজি ৩৭ টাকা দরে। আর বোরো ধান সংগ্রহ করা হবে ২৬ টাকা কেজি দরে। সম্প্রতি সচিবালয়ের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জানা গেছে, এ বছর সিদ্ধ বোরো চাল সংগ্রহ করা হবে ৮ লাখ টন এবং আতপ চাল সংগ্রহ করা হবে ১ লাখ টন। বাকি ১ লাখ টন চালের জন্য দেড় লাখ টন বোরো ধান সংগ্রহ করা হবে। আগামী ২ মে থেকে চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হবে, চলবে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।
এদিকে গাজীপুর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ, জামালপুর, গাইবান্ধা, দিনাজপুরের চাষীরা জানান, চলতি বোরো মৌসুমে এসব জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ায়। ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন তারা। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ওষুধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কৃষকের ভুলের কারণে কিছু জমিতে এ রোগ দেখা দিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি কোনোভাবে আমলে নিচ্ছে না সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
জানা গেছে, এসব জেলার কৃষকেরা জমিতে সবুজ ধান গাছের চারা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। কিন্তু ধানের ছড়া বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাতাগুলো বাদামি, আবার কখনও সাদা বর্ণের হওয়া শুরু করে। কিছুদিন পর থেকে ছড়ার গোড়ার অংশে কালো হয়ে ধানের ছড়াটাও বাদামি ও সাদা বর্ণের হতে শুরু করে। পরে কৃষি অফিসের পরামর্শ নিয়ে জমিতে ছত্রাকনাশক ওষুধ প্রয়োগ করেও কোনও কাজ হয়নি। ১ একর জমির ধান কাটার খরচ পড়বে ৯ হাজার টাকা। খড় পাওয়া যাবে ৬ হাজার টাকার।

কৃষকদের অভিযুক্ত করে কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, কৃষকেরা নিয়ম মেনে ওষুধ প্রয়োগ করেন না। জমিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি হলেও এ রোগের আক্রমণ ঘটে। প্রথমে ধানের পাতা পরে ধান গাছের গিঁটে ও সবশেষে শীষে এ রোগের আক্রমণ দেখা দেয়। তাদের মতে, ধান গাছে আক্রমণের পর ন্যাটিভো, ডাইমেনশন, ফিলিয়া জাতীয় ছত্রাকনাশক ওষুধ প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু কৃষকেরা তা করেননি।
এ বিষয়ে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবু সাঈদ বলেন, ‘এবার শ্রীপুর উপজেলায় ১২ হাজার ১৯০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। নেক ব্লাস্ট রোগের আক্রমণের পরও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’
বাংলা ট্রিবিউনের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বোরো মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হলেও প্রায় সাড়ে ৭ হাজার হেক্টর জমির ধানে ব্লাস্টের আক্রমণ হয়েছে। এ বছর বোরো ধান থেকে চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৯৪ হাজার ৪৭২ মেট্রিক। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কৃষকেরা নিজ উদ্যোগে ৭৬ হাজার ৩৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে বোর ধানের বাম্পার ফলন হবে।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান বলেন, ‘আবহাওয়ার কারণে অর্থাৎ দিনে গরম, রাতে ঠাণ্ডা, মেঘলা আবহাওয়া, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এবং বাতাসের কারণে কিছু কিছু এলাকার ফসলে ব্লাস্ট রোগ দেখা দিয়েছিল। কৃষি বিভাগ থেকে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখায় ও পরামর্শ দেওয়ায় এ রোগ বাড়তে পারেনি। এ কারণে ধানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কোনও প্রভাব পড়বে না।
জামালপুরের ৭ উপজেলায় ব্রি-২৮ জাতের বোরো ধানক্ষেতে ছত্রাকজনিত ব্লাস্ট রোগের দেখা দিয়েছে। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৩১ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ব্রি-২৮ জাতের ধান আবাদ হয়েছে ৪৭ হাজার হেক্টর জমিতে। অন্য জাতের ফলন ভালো হলেও ব্রি-২৮ জাতের ক্ষেতে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে ব্লাস্ট রোগ। এতে অধিকাংশ জমির ধানের শীষ শুকিয়ে চিটা হয়ে গেছে। আক্রান্ত জমিতে শীষ থাকলেও তাতে চাল নেই।
জামালপুরের কৃষি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ব্লাস্ট একটি ছত্রাকজনিত রোগ। বোরো ও আমন মৌসুমে সাধারণত এই রোগটি দেখা দেয়। ব্লাস্ট রোগে যেন ক্ষেত আক্রান্ত না হয়, সেজন্য আমরা সঠিক সময়ে কৃষকদের পরামর্শ ও প্রচারপত্র বিলি করেছি। তারপরও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে ব্লাস্ট ছড়িয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আশা করছি, এই রোগটি আর ছড়াবে না।’
এদিকে গাইবান্ধা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বোর মৌসুমে জেলার ৭ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ১ লাখ ২৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোর ধানের চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। কিন্তু জেলায় আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে। জেলায় চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৫ হাজার টন।
গাইবান্ধা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আ ক ম রুহুল আমীন বলেন, ‘জেলায় মাত্র ৫০০ হেক্টর জমিতে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ দেখা দিয়েছে। তবে সমস্যা সমাধানে মাঠপর্যায়ে কৃষকদের স্প্রে ব্যবহার করাসহ নানা পরামর্শ দিচ্ছে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা।’ এ রোগে মোট উৎপাদনে কোনও ঘাটতি হবে না, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চালের উৎপাদন অর্জিত হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বাংলা ট্রিবিউনের রামপুর (দিনাজপুর) সংবাদদাতা জানিয়েছেন, সারাদেশের মতো বিরামপুরেও দেখা দিয়েছে ভয়াবহ ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণ। ছত্রাক জাতীয় এ রোগের আক্রমণে ধানের শীষ সাদা ও পাতা ধূসর বর্ণ ধারণ করছে। এ রোগে চিটায় পরিণত হচ্ছে ধান। শেষ সময়ে ধানে ব্লাস্ট রোগ সংক্রমণ দেখা দেওয়ায় দিশেহারা কৃষক। যখন শীষে সংক্রমণ হয় তখন ছত্রাকনাশক দিয়ে কোনও উপকার হচ্ছে না।
বিরামপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নিক্সন চন্দ্র পাল জানান, চলতি বোরো মৌসুমে উপজেলায় ১২ হাজার ৬৭৬ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে আবাদ হয়েছে ১৬ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭৭ হাজার ৮৪০ মেট্রিক টন। নেক ব্লাষ্ট রোগে সংক্রামিত জমি থেকে ধানের ফলন কম হলেও সার্বিকভাবে কোনও প্রভাব পড়বে না ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায়।

শ্যামনগর

যশোর

আশাশুনি


জলবায়ু পরিবর্তন