বাংলা বানান নিয়ে কিছু কথা


মার্চ ৩০ ২০১৮

আ র শি গা ই ন---
Spread the love

ভাষার ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখে তার শুদ্ধ চর্চার অন্যতম শর্ত হলো সে ভাষার বিশুদ্ধ বানানরীতি নিশ্চিতকরণ এবং তার ব্যবহারে সচেতন হওয়া। পৃথিবীর কোনো ভাষাই বিশৃঙ্খলতার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি আর পারবেও না। যে ভাষার ব্যাকরণগত নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই সে ভাষা টিকে থাকতে পারে না। আবার একথাও মনে রাখা দরকার নদী যেমন চলার পথে বাঁকে বাঁকে তার ভা-ার থেকে অনেক কিছু ফেলে যায়। আবার কখনো সখনো নতুনকে গ্রহণ করে। তেমনি গতিশীল ভাষা চলার পথে অনেক কিছু ফেলে যায় আবার সময়ের প্রয়োজনে অনেক নতুনকে সাদরে গ্রহণ করে। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ভাষার পরিবর্তন আসতে পারে। তবে সেটা যদি সঙ্গত কারণে এবং যৌক্তিকতার সাথে আসে তবে সে পরিবর্তনকে মেনে নেয়া প্রত্যেকের কর্তব্য।
বাংলা ভাষার বানান নিয়ে সমসাময়িক বিভিন্ন কথা উঠলেও আমি মনে করি বাংলা একাডেমি প্রমিত বানানের যে নিয়ম করে দিয়েছে তা আমাদের অনুসরণ করা কর্তব্য। যাতে ব্যাকরণসিদ্ধ পূর্বের নিয়মকে বলবৎ করা হয়েছে। আবার যে সব বানান দুই রকমভাবে প্রচলিত আছে বিভ্রান্তি এড়াবার জন্য সে সব বানান একটা রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে বানানের যাতে কোনো বিভ্রাট না ঘটে সেজন্য বিকল্পহীন বানানরীতি করেছে বাংলা একাডেমি।
কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলা একাডেমির বানানরীতি যাদের সর্বাগ্রে অনুসরণ করার কথা সেই সব সরকারি দফতর তোয়াক্কা করছে না প্রমিত বানানে। আর কেনোই বা করবে ভুল বানানের জন্য সেসব দফতরের কর্তাদের তো আর কৈফিয়ত দিতে হয় না। অন্যদিকে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা বানান নিয়ে চলছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। যে যার ইচ্ছে মতো বানান লিখছেন। এ বিষয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। নব্বইয়ের দশকেও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতায় তিনটা ভুল বানানের জন্য এক নম্বর কাটা হতো, কিন্তু এখন বানানের জন্য কোনো নম্বর কাটা হয় না। ফলে শুরু থেকে তারা বানানের প্রতি উদাসিন অবস্থায় বেড়ে উঠছে। যা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে উদ্বেগজনক। চলতি পথে পোস্টার ব্যানার এর কথা নাইবা বললাম।
আবার এসবের বাইরেও বাংলা বানানের নিয়ম না জানার কারণে অনেকে শুদ্ধ বানান লিখতে চাইলেও পারেন না। তাদের ক্ষেত্রে বলবো যদি একটু কষ্ট করে আমরা বাংলা একাডেমি প্রণিত বাংলা বানানের নিয়ম জেনে শুদ্ধ বানান লিখতে অভ্যস্ত হই তাতে আমাদেরই ভাষার ব্যবহার শুদ্ধ হবে।
বাংলা একাডেমির নিয়মানুযায়ী আমরা যদি সামান্য কিছু সরল ব্যাকরণিক সূত্র মনে রাখতে পারি তবে কখনোই বানানে ভুল হবে না। আসুন বাংলা একাডেমির সে সূত্রগুলো নিয়ে এবার কথা বলি।
ই, ঈ, উ, ঊ এবং এদের কার চিহ্নের ব্যবহার ঃ বাংলা বানানে যেসব শব্দে দুটোরই ব্যবহার আছে সেসব শব্দে দীর্ঘ বাদ দিয়ে হ্রাস্য লিখতে হবে। অর্থাৎ ই,উ এবং তাদের কার চিহ্ন ি ু লিখতে হবে। সকল অতৎসম শব্দ অর্থাৎ তৎভব, দেশি, বিদেশি শব্দে ঈ, ঊ না হয়ে ই, উ এবং তাদের কারচিহ্ন ি ু হবে।
এই নিয়মে ‘ইদ’ ‘ইদগাহ’ ইমান’ ‘ঈ’ দিয়ে লেখা যাবে না। যদিও বহুল প্রচলিত তবুও আমাদের বানানরীতিতে তা ভুল। আর এই ভুলটা দীর্ঘদিন প্রচলেনের কারণে শুদ্ধটা কেউ মেনে নিতে চাইছেন না। যদিও ভাষার ক্ষেত্রে কোনো ভুল বানান দীর্ঘদিন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত থাকে তবে ওই ভুলটাই ভাষা গ্রহণ করে শুদ্ধতার মর্যাদা দেয়। যেহেতু বাংলা একাডেমির নির্দিষ্ট একটি নিয়মে ‘ঈদ’ ফারসি শব্দ হবার কারণে ‘ইদ’ হবে সেহেতু আমরা সঙ্গত বানানটার চর্চা শুরু করতে পারি। সে ক্ষেত্রে দৈনিক পত্রিকাগুলোকে বেশি ভূমিকা রাখা দরকার বলে আমি মনে করি।
‘কি’ এবং ‘কী’ এর ব্যবহার পূর্বনির্ধারিত। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য এ শব্দটা অহরহ ভুল করে থাকেন অনেকে। এখানে যা মনে রাখতে হবে তা হলো সর্বনাম, বিশেষণ, ক্রিয়া বিশেষণ ও যোজক পদ রূপে কী শব্দটা ‘ঈ’ কার হবে। অন্য ক্ষেত্রে অব্যয়রূপে আসলে সেখানে ই কার হবে। যেমন- ‘তুমি কী সুন্দর!, ‘তুমি কি সুন্দর ?’ মনে রাখার জন্য আরো সহজ উপায় হলো যে ‘কি’ এর জবাব ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ হবে সে ‘কি’ তে ‘ই-কার হবে। আর যেখানে কোনো প্রশ্ন বা জবাবের বিষয় থাকবে না সেখানে ঈ-কার হবে। অনুরূপ অতৎসম শব্দের সাথে যদি ‘আলী’ প্রত্যয় যুক্ত হয় তবে তা হ্রাস ই-কার ি হবে। যেমন-সোনালি, রূপালি। পদাশ্রিত নির্দেশকটি ই-কার ি হবে যেমন-লোকটি, কলমটি।
উচ্চারণের নিয়মানুযায়ী ‘অ’ যখন ‘ও’ হয়ে যায় তখন ওই শব্দে ও-কার লেখা যাবে। যেমন- কোনো।
রেফের এর পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব কখনোই হবে না। এখানে মনে রাখা দরকার দ্বিত্বব্যঞ্জনবর্ণের একটি ব্যঞ্জন লুপ্ত হয়ে পূর্বের ব্যঞ্জনবর্ণে রেফের রূপ ধারণ করেছে। যেমন ‘কাত্তিক’ শব্দটি ‘কার্তিক’ লিখতে হবে। কিন্তু ‘কার্ত্তিক’ লেখা যাবে না। সন্ধির ক্ষেত্রে ক- বর্গ যদি পরে থাকে অর্থাৎ ক, খ, গ, ঘ এ চারটি বর্ণ পরে থাকলে তৎসম শব্দে পূর্বের ‘ম’ এর স্থলে ‘ং’ (অনুস্বর) লিখতে হবে। যেমন সম+গীত=সংগীত। কিন্তু দুঃখের বিষয় সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও সেটি ভুল করে থাকে। সন্ধিবদ্ধ না হলে ‘ঙ’ লিখতে হবে। যেমন-শঙ্কা, ব্যাঙ্ক, অঙ্ক। এক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি বাংলাদেশের সংবিধানে অনুস্বর ‘ং’ দিয়ে লেখা আছে সে জন্যে নিয়ম ছাড়ায় ‘বাংলাদেশ’ লিখতে হবে। তৎসম শব্দে মূল শব্দের সাথে যদি ‘ইন’ প্রত্যয়ান্তে ঈ- কার ‘ ী ’ হয় এবং সেটি সমাসবদ্ধ হলে ই- কার ‘ ি ’ লিখতে হবে। তবে সমাসবদ্ধ ছাড়া দীর্ঘ ঈ-কার ‘ ী’ থাকবে। যেমন গুণী- গুণিজন, প্রাণী- প্রাণিসম্পদ। আবার একই শব্দে যদি ‘ত’ প্রত্যয় যুক্ত হয় সেক্ষেত্রেও হ্রস্ব ই-কার হবে। যেমন-মন্ত্রী-মন্ত্রিত্ব, প্রতিযোগী- প্রতিযোগিতা। শব্দের শেষে কোনো অবস্থাতে বিসর্গ ঃ থাকবে না।
মূর্ধন্য ‘ণ’ এবং দন্ত্যন ‘ন’-এর ক্ষেত্রে তৎসম বানানে ব্যাকরণসিদ্ধ পূর্বের সকল নিয়ম বলবৎ থাকবে। সেখানে ণ- ত্ব বিধান ষ-ত্ব বিধান প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ র, ঋ, ষ এর পরে মধূর্ন্য ‘ণ’ লিখতে হবে। ট-বর্গের সাথে ‘ন’ যুক্ত হলে তা মর্ধূন্য হবে। যেমন-কণ্ঠ, ঘণ্টা। আর অতৎসম শব্দের বানানে অর্থাৎ তৎভব, দেশি, বিদেশি শব্দে কখনোই মূর্ধন্য ‘ণ’ হবে না। সেখানে সর্বদায় দন্ত্যন লিখতে হবে। তবে অতৎসম শব্দে ট-বর্গের সাথে যদি ‘ন’ যুক্ত হয় তবে তাও দন্ত্যন লিখতে হবে।
শ, ষ, স এ তিনটি বর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে বিদেশি শব্দে কখনোই মূর্ধন্য- ষ লেখা যাবে না। যদি ইংরেজি শব্দে ঐঝ হয় এবং আরবি শব্দে ‘শিন’ হয় তবে তালব্য ‘শ’ লিখতে হবে। অন্য সব ক্ষেত্রে দন্ত্যস লিখতে হবে।
এবার আসা যাক কোন শব্দ একসাথে লিখতে হবে কোন শব্দ একসাথে লেখা যাবে না। যে সব শব্দ সমাসবদ্ধ তা একসাথে লিখতে হবে। যেমন-উদ্বেগজনক। বিশেষণ পদ সাধারণত পরবর্তী পদের সাথে যুক্ত হবে না। যেমন- শুভ সকাল।
না বাচক ‘না’ শব্দের পরে সম্পূর্ণ আলাদা পদ হিসেবে বসবে। আবার না বাচক ‘নি’ সমাসবদ্ধ হিসেবে আসলে পূর্বপদের সাথে যুক্ত হবে। এছাড়াও পূর্বে না বাচক উপসর্গ উত্তর পদের সাথে যুক্ত থাকবে। যেমন ‘জানি না, বলা হয়নি, নাবালক। অধিকন্তু অর্থে ‘ও’ প্রত্যয় শব্দের সাথে কার চিহ্ন রূপে না বসে পূর্ণ বর্ণ লিখতে হবে। যেমন- আজও। নিশ্চয়ার্থক ‘ই’ শব্দের কার চিহ্ন যুক্ত না হয়ে পূর্ণ বর্ণ লিখতে হবে। যেমন- অবশ্যই।
ক্রিয়া পদে হ্রস্ব ই এবং অন্তস্থো ‘য়’ এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে বাক্যে কর্তা যদি উত্তম পুরুষ হয় তবে ক্রিয়া পদে হ্রস্ব ই হবে। আর কর্তা যদি নাম পুরুষ হয় তবে অন্তস্থো ‘য়’ হবে। যেমন ‘আমি দেখতে চাই’। বাক্যে ‘আমি’ উত্তম পুরুষ তাই ক্রয়াপদ ‘চাই’ তে হ্রস্ব ই হয়েছে। আবার ‘সে’ আমাকে দেখতে চায় বাক্যে ‘সে’ নাম পুরুষ হওয়াতে ক্রিয়াপদ ‘চায়’ তে অন্তস্থো ‘য়’ হয়েছে।
এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে অসচেতনতার কারণে আমরা বিশেষণ এর সাথে ‘তা’ প্রত্যয় যুক্ত করে বিশেষণ করার চেষ্টা করি। যা ভুল। শুধুমাত্র বিশেষ্য পদের সাথে ‘তা’ প্রত্যয়যুক্ত করে বিশেষণ করা যেতে পারে। যেমন ‘দারিদ্র্য’ শব্দটি বিশেষণ। তার সাথে ‘তা’ প্রত্যয়যুক্ত করে ‘দারিদ্র্যতা’ লেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সেটা হবে সম্পূর্ণ ভুল। যদি লিখতে হয় তবে এর বিশেষ্য ‘দরিদ্র’ শব্দের সাথে ‘তা’ প্রত্যয় যুক্ত করে দরিদ্রতা লিখতে হবে। অনুরূপ ‘দৈন্য’ এর সাথে তা প্রত্যয় যুক্ত করা যাবে না। করতে হবে ‘দীন’ এর সাথে ‘দীনতা’।
এ সব ছাড়াও অনেক শব্দ বানানের কারণে অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়। আর সে ভুলগুলো অনেক গুণিমানুষও করে থাকেন। যেমন-‘পাশ’ শব্দের অর্থ পার্শ্ব এবং ‘পাস’ শব্দের অর্থ উত্তীর্ণ। ‘মানসিক’ অর্থ মনসংক্রান্ত আবার ‘মানুষিক’ অর্থ মানুষ দ্বারা। এখন মানসিক নির্যাতন আর মানুষিক নির্যাতন এর পার্থক্য আমরা স্পষ্ট হতে পারি। চন্দ্রবিন্দু’র কারণে অর্থ পরিবর্তন হয় যেসব শব্দ তার মধ্যে কয়েকটি হলো- ফোটা (প্রস্ফুটিত), আঁধার (অন্ধকার), আধার (খাদ্য, পাত্র), আশ (আকাক্সক্ষা, আঁশ (তন্তু), কাটা (কর্তন), কাঁটা (কণ্টক) এভাবে অনেক শব্দ আছে যার সঠিক ব্যবহারে আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি।
মনে রাখতে হবে আলোচিত সকল নিয়মের বাইরে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের নামে যে বানান লেখেন সে ক্ষেত্রে সেই বানানই লিখতে হবে।

তথ্য সূত্র:
১) বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানোর নিয়ম
২) বানান বোধনী
৩) বাংলা ব্যাকরণের মূল পাঠ।
ভাষার ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখে তার শুদ্ধ চর্চার অন্যতম শর্ত হলো সে ভাষার বিশুদ্ধ বানানরীতি নিশ্চিতকরণ এবং তার ব্যবহারে সচেতন হওয়া। পৃথিবীর কোনো ভাষাই বিশৃঙ্খলতার ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে পারেনি আর পারবেও না। যে ভাষার ব্যাকরণগত নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম নেই সে ভাষা টিকে থাকতে পারে না। আবার একথাও মনে রাখা দরকার নদী যেমন চলার পথে বাঁকে বাঁকে তার ভা-ার থেকে অনেক কিছু ফেলে যায়। আবার কখনো সখনো নতুনকে গ্রহণ করে। তেমনি গতিশীল ভাষা চলার পথে অনেক কিছু ফেলে যায় আবার সময়ের প্রয়োজনে অনেক নতুনকে সাদরে গ্রহণ করে। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ভাষার পরিবর্তন আসতে পারে। তবে সেটা যদি সঙ্গত কারণে এবং যৌক্তিকতার সাথে আসে তবে সে পরিবর্তনকে মেনে নেয়া প্রত্যেকের কর্তব্য।
বাংলা ভাষার বানান নিয়ে সমসাময়িক বিভিন্ন কথা উঠলেও আমি মনে করি বাংলা একাডেমি প্রমিত বানানের যে নিয়ম করে দিয়েছে তা আমাদের অনুসরণ করা কর্তব্য। যাতে ব্যাকরণসিদ্ধ পূর্বের নিয়মকে বলবৎ করা হয়েছে। আবার যে সব বানান দুই রকমভাবে প্রচলিত আছে বিভ্রান্তি এড়াবার জন্য সে সব বানান একটা রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে বানানের যাতে কোনো বিভ্রাট না ঘটে সেজন্য বিকল্পহীন বানানরীতি করেছে বাংলা একাডেমি।
কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলা একাডেমির বানানরীতি যাদের সর্বাগ্রে অনুসরণ করার কথা সেই সব সরকারি দফতর তোয়াক্কা করছে না প্রমিত বানানে। আর কেনোই বা করবে ভুল বানানের জন্য সেসব দফতরের কর্তাদের তো আর কৈফিয়ত দিতে হয় না। অন্যদিকে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা বানান নিয়ে চলছে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। যে যার ইচ্ছে মতো বানান লিখছেন। এ বিষয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। নব্বইয়ের দশকেও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতায় তিনটা ভুল বানানের জন্য এক নম্বর কাটা হতো, কিন্তু এখন বানানের জন্য কোনো নম্বর কাটা হয় না। ফলে শুরু থেকে তারা বানানের প্রতি উদাসিন অবস্থায় বেড়ে উঠছে। যা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে উদ্বেগজনক। চলতি পথে পোস্টার ব্যানার এর কথা নাইবা বললাম।
আবার এসবের বাইরেও বাংলা বানানের নিয়ম না জানার কারণে অনেকে শুদ্ধ বানান লিখতে চাইলেও পারেন না। তাদের ক্ষেত্রে বলবো যদি একটু কষ্ট করে আমরা বাংলা একাডেমি প্রণিত বাংলা বানানের নিয়ম জেনে শুদ্ধ বানান লিখতে অভ্যস্ত হই তাতে আমাদেরই ভাষার ব্যবহার শুদ্ধ হবে।
বাংলা একাডেমির নিয়মানুযায়ী আমরা যদি সামান্য কিছু সরল ব্যাকরণিক সূত্র মনে রাখতে পারি তবে কখনোই বানানে ভুল হবে না। আসুন বাংলা একাডেমির সে সূত্রগুলো নিয়ে এবার কথা বলি।
ই, ঈ, উ, ঊ এবং এদের কার চিহ্নের ব্যবহার ঃ বাংলা বানানে যেসব শব্দে দুটোরই ব্যবহার আছে সেসব শব্দে দীর্ঘ বাদ দিয়ে হ্রাস্য লিখতে হবে। অর্থাৎ ই,উ এবং তাদের কার চিহ্ন ি ু লিখতে হবে। সকল অতৎসম শব্দ অর্থাৎ তৎভব, দেশি, বিদেশি শব্দে ঈ, ঊ না হয়ে ই, উ এবং তাদের কারচিহ্ন ি ু হবে।
এই নিয়মে ‘ইদ’ ‘ইদগাহ’ ইমান’ ‘ঈ’ দিয়ে লেখা যাবে না। যদিও বহুল প্রচলিত তবুও আমাদের বানানরীতিতে তা ভুল। আর এই ভুলটা দীর্ঘদিন প্রচলেনের কারণে শুদ্ধটা কেউ মেনে নিতে চাইছেন না। যদিও ভাষার ক্ষেত্রে কোনো ভুল বানান দীর্ঘদিন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত থাকে তবে ওই ভুলটাই ভাষা গ্রহণ করে শুদ্ধতার মর্যাদা দেয়। যেহেতু বাংলা একাডেমির নির্দিষ্ট একটি নিয়মে ‘ঈদ’ ফারসি শব্দ হবার কারণে ‘ইদ’ হবে সেহেতু আমরা সঙ্গত বানানটার চর্চা শুরু করতে পারি। সে ক্ষেত্রে দৈনিক পত্রিকাগুলোকে বেশি ভূমিকা রাখা দরকার বলে আমি মনে করি।
‘কি’ এবং ‘কী’ এর ব্যবহার পূর্বনির্ধারিত। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য এ শব্দটা অহরহ ভুল করে থাকেন অনেকে। এখানে যা মনে রাখতে হবে তা হলো সর্বনাম, বিশেষণ, ক্রিয়া বিশেষণ ও যোজক পদ রূপে কী শব্দটা ‘ঈ’ কার হবে। অন্য ক্ষেত্রে অব্যয়রূপে আসলে সেখানে ই কার হবে। যেমন- ‘তুমি কী সুন্দর!, ‘তুমি কি সুন্দর ?’ মনে রাখার জন্য আরো সহজ উপায় হলো যে ‘কি’ এর জবাব ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ হবে সে ‘কি’ তে ‘ই-কার হবে। আর যেখানে কোনো প্রশ্ন বা জবাবের বিষয় থাকবে না সেখানে ঈ-কার হবে। অনুরূপ অতৎসম শব্দের সাথে যদি ‘আলী’ প্রত্যয় যুক্ত হয় তবে তা হ্রাস ই-কার ি হবে। যেমন-সোনালি, রূপালি। পদাশ্রিত নির্দেশকটি ই-কার ি হবে যেমন-লোকটি, কলমটি।
উচ্চারণের নিয়মানুযায়ী ‘অ’ যখন ‘ও’ হয়ে যায় তখন ওই শব্দে ও-কার লেখা যাবে। যেমন- কোনো।
রেফের এর পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব কখনোই হবে না। এখানে মনে রাখা দরকার দ্বিত্বব্যঞ্জনবর্ণের একটি ব্যঞ্জন লুপ্ত হয়ে পূর্বের ব্যঞ্জনবর্ণে রেফের রূপ ধারণ করেছে। যেমন ‘কাত্তিক’ শব্দটি ‘কার্তিক’ লিখতে হবে। কিন্তু ‘কার্ত্তিক’ লেখা যাবে না। সন্ধির ক্ষেত্রে ক- বর্গ যদি পরে থাকে অর্থাৎ ক, খ, গ, ঘ এ চারটি বর্ণ পরে থাকলে তৎসম শব্দে পূর্বের ‘ম’ এর স্থলে ‘ং’ (অনুস্বর) লিখতে হবে। যেমন সম+গীত=সংগীত। কিন্তু দুঃখের বিষয় সংগীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও সেটি ভুল করে থাকে। সন্ধিবদ্ধ না হলে ‘ঙ’ লিখতে হবে। যেমন-শঙ্কা, ব্যাঙ্ক, অঙ্ক। এক্ষেত্রে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি বাংলাদেশের সংবিধানে অনুস্বর ‘ং’ দিয়ে লেখা আছে সে জন্যে নিয়ম ছাড়ায় ‘বাংলাদেশ’ লিখতে হবে। তৎসম শব্দে মূল শব্দের সাথে যদি ‘ইন’ প্রত্যয়ান্তে ঈ- কার ‘ ী ’ হয় এবং সেটি সমাসবদ্ধ হলে ই- কার ‘ ি ’ লিখতে হবে। তবে সমাসবদ্ধ ছাড়া দীর্ঘ ঈ-কার ‘ ী’ থাকবে। যেমন গুণী- গুণিজন, প্রাণী- প্রাণিসম্পদ। আবার একই শব্দে যদি ‘ত’ প্রত্যয় যুক্ত হয় সেক্ষেত্রেও হ্রস্ব ই-কার হবে। যেমন-মন্ত্রী-মন্ত্রিত্ব, প্রতিযোগী- প্রতিযোগিতা। শব্দের শেষে কোনো অবস্থাতে বিসর্গ ঃ থাকবে না।
মূর্ধন্য ‘ণ’ এবং দন্ত্যন ‘ন’-এর ক্ষেত্রে তৎসম বানানে ব্যাকরণসিদ্ধ পূর্বের সকল নিয়ম বলবৎ থাকবে। সেখানে ণ- ত্ব বিধান ষ-ত্ব বিধান প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ র, ঋ, ষ এর পরে মধূর্ন্য ‘ণ’ লিখতে হবে। ট-বর্গের সাথে ‘ন’ যুক্ত হলে তা মর্ধূন্য হবে। যেমন-কণ্ঠ, ঘণ্টা। আর অতৎসম শব্দের বানানে অর্থাৎ তৎভব, দেশি, বিদেশি শব্দে কখনোই মূর্ধন্য ‘ণ’ হবে না। সেখানে সর্বদায় দন্ত্যন লিখতে হবে। তবে অতৎসম শব্দে ট-বর্গের সাথে যদি ‘ন’ যুক্ত হয় তবে তাও দন্ত্যন লিখতে হবে।
শ, ষ, স এ তিনটি বর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে বিদেশি শব্দে কখনোই মূর্ধন্য- ষ লেখা যাবে না। যদি ইংরেজি শব্দে ঐঝ হয় এবং আরবি শব্দে ‘শিন’ হয় তবে তালব্য ‘শ’ লিখতে হবে। অন্য সব ক্ষেত্রে দন্ত্যস লিখতে হবে।
এবার আসা যাক কোন শব্দ একসাথে লিখতে হবে কোন শব্দ একসাথে লেখা যাবে না। যে সব শব্দ সমাসবদ্ধ তা একসাথে লিখতে হবে। যেমন-উদ্বেগজনক। বিশেষণ পদ সাধারণত পরবর্তী পদের সাথে যুক্ত হবে না। যেমন- শুভ সকাল।
না বাচক ‘না’ শব্দের পরে সম্পূর্ণ আলাদা পদ হিসেবে বসবে। আবার না বাচক ‘নি’ সমাসবদ্ধ হিসেবে আসলে পূর্বপদের সাথে যুক্ত হবে। এছাড়াও পূর্বে না বাচক উপসর্গ উত্তর পদের সাথে যুক্ত থাকবে। যেমন ‘জানি না, বলা হয়নি, নাবালক। অধিকন্তু অর্থে ‘ও’ প্রত্যয় শব্দের সাথে কার চিহ্ন রূপে না বসে পূর্ণ বর্ণ লিখতে হবে। যেমন- আজও। নিশ্চয়ার্থক ‘ই’ শব্দের কার চিহ্ন যুক্ত না হয়ে পূর্ণ বর্ণ লিখতে হবে। যেমন- অবশ্যই।
ক্রিয়া পদে হ্রস্ব ই এবং অন্তস্থো ‘য়’ এর ব্যবহারের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে বাক্যে কর্তা যদি উত্তম পুরুষ হয় তবে ক্রিয়া পদে হ্রস্ব ই হবে। আর কর্তা যদি নাম পুরুষ হয় তবে অন্তস্থো ‘য়’ হবে। যেমন ‘আমি দেখতে চাই’। বাক্যে ‘আমি’ উত্তম পুরুষ তাই ক্রয়াপদ ‘চাই’ তে হ্রস্ব ই হয়েছে। আবার ‘সে’ আমাকে দেখতে চায় বাক্যে ‘সে’ নাম পুরুষ হওয়াতে ক্রিয়াপদ ‘চায়’ তে অন্তস্থো ‘য়’ হয়েছে।
এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে অসচেতনতার কারণে আমরা বিশেষণ এর সাথে ‘তা’ প্রত্যয় যুক্ত করে বিশেষণ করার চেষ্টা করি। যা ভুল। শুধুমাত্র বিশেষ্য পদের সাথে ‘তা’ প্রত্যয়যুক্ত করে বিশেষণ করা যেতে পারে। যেমন ‘দারিদ্র্য’ শব্দটি বিশেষণ। তার সাথে ‘তা’ প্রত্যয়যুক্ত করে ‘দারিদ্র্যতা’ লেখার কোনো প্রয়োজন নেই। সেটা হবে সম্পূর্ণ ভুল। যদি লিখতে হয় তবে এর বিশেষ্য ‘দরিদ্র’ শব্দের সাথে ‘তা’ প্রত্যয় যুক্ত করে দরিদ্রতা লিখতে হবে। অনুরূপ ‘দৈন্য’ এর সাথে তা প্রত্যয় যুক্ত করা যাবে না। করতে হবে ‘দীন’ এর সাথে ‘দীনতা’।
এ সব ছাড়াও অনেক শব্দ বানানের কারণে অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়। আর সে ভুলগুলো অনেক গুণিমানুষও করে থাকেন। যেমন-‘পাশ’ শব্দের অর্থ পার্শ্ব এবং ‘পাস’ শব্দের অর্থ উত্তীর্ণ। ‘মানসিক’ অর্থ মনসংক্রান্ত আবার ‘মানুষিক’ অর্থ মানুষ দ্বারা। এখন মানসিক নির্যাতন আর মানুষিক নির্যাতন এর পার্থক্য আমরা স্পষ্ট হতে পারি। চন্দ্রবিন্দু’র কারণে অর্থ পরিবর্তন হয় যেসব শব্দ তার মধ্যে কয়েকটি হলো- ফোটা (প্রস্ফুটিত), আঁধার (অন্ধকার), আধার (খাদ্য, পাত্র), আশ (আকাক্সক্ষা, আঁশ (তন্তু), কাটা (কর্তন), কাঁটা (কণ্টক) এভাবে অনেক শব্দ আছে যার সঠিক ব্যবহারে আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি।
মনে রাখতে হবে আলোচিত সকল নিয়মের বাইরে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তাদের নামে যে বানান লেখেন সে ক্ষেত্রে সেই বানানই লিখতে হবে।

তথ্য সূত্র:
১) বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানোর নিয়ম
২) বানান বোধনী
৩) বাংলা ব্যাকরণের মূল পাঠ।

শ্যামনগর

যশোর

আশাশুনি


জলবায়ু পরিবর্তন