বিশ্ব ভালবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালবাসুন


ফেব্রুয়ারি ১৩ ২০১৭

Spread the love

।। প্রবীর বিশ্বাস।।

 

১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও ১৪ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবন দিবস। দিনটি আমাদের কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমন তাৎপর্যপূর্ণ। নদী মাতৃক এই দেশে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী, মধুমতি, শীতলক্ষা, ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য নদ-নদী জালের মতো ছড়িয়ে আছে সমস্ত দেশব্যাপী। সাধারণত এই নদীগুলো উত্তরে পাহাড়ী উচুভূমি থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণে নীচু ভূমি বঙ্গোপোসাগরে পতিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় সমুদ্রের বুকে পলি জমতে জমতে তৈরী হয়েছে সমতল ভূমি। যার উদাহরণ আমাদের সুন্দরবন। বঙ্গোপোসাগরের কোল ঘেঁষে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল সবুজের সমারোহ সুন্দরবন। এটি প্রায় ১৩০ মাইল লম্বা ও ৯০ মাইল চওড়া। যার আয়তন ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২’শ ৮৫ হেক্টর বা প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশের রয়েছে ৫ হাজার ৮’শ বর্গকিলোমিটার। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের আনুপাতিক হার ৬ঃ৪। এ বন আমাদের গর্বের ধন; তাই আসুন বিশ্ব ভালোবাসার এই দিনে সুন্দরবনকে ভালোবসি।

১৪ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস অর্থাৎ ভ্যালেন্টাইন্স ডে। তবে ১৪ই ফেব্রুয়ারি কিভাবে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে পরিণত হলো, সেটা অনেকের কাছেই অজানা। কারণ এ নিয়ে রয়েছে অনেক ঘটনা, অনেক কাহিনী ও অনেক গল্প। প্রথম ও প্রধান কহিনীটি এ রকম- ২৭০ খৃষ্টাব্দের কথা। রোমের সম্রাট “ক্লডিয়াস ডি সেকেন্ডরের” মনে হলো বিয়ে করলে মানুষ অলস হয়ে যায়। কারণ নারীর সংস্পর্শে বিবাহিত মানুষের মন ঘরমুখী হয়ে যায়। কিন্তু সম্রাট চান দুর্ধর্ষ কঠিন যোদ্ধা। যে কারণে সম্রাট বিয়ে না করার জন্যে বিশেষ  নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন অর্থাৎ কেউ বিয়ে করতে পারবে না। তখন রোমে ‘‘সাধু ভ্যালেন্টাইন ইস্টারমনার’’ নামে এক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সম্রাটের নিষেধাজ্ঞার প্রতি বিরোধিতা করে গোপনে তরুণ প্রেমিকদের বিবাহ মন্ত্রের দীক্ষা দিতে শুরু করলেন এবং কোন এক সময় সম্রাট এটা জেনে গেলেন। তারপর সম্রাট সাধুকে ডেকে রাজদরবারে এনে কৈফিয়ত তলব করলেন এবং সাধুর যুক্তিতে সম্রাট তাকে ক্ষমা করে দিলেন, তবে একটা শর্তে। শর্তটি হল তাকে খৃষ্টধর্ম পরিত্যাগ করে প্রচলিত ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সাধু সম্রাটের কথায় রাজিতো হলেনই না বরং সম্রাটকেই উল্টে খৃষ্ট ধর্মে দিক্ষা দিতে চাইলেন। এ কথা শুনে সম্রাট আরও ক্ষিপ্ত হয়ে সাধুকে বন্দী করে শিরোচ্ছেদের নির্দেশ দিলেন। বন্দী হওয়ার পূর্বে সাধু ভ্যালেন্টাইন এক অন্ধ মেয়ের চোখের চিকিৎসা করতেন এবং কোন এক সময় সাধু ঐ মেয়েটির প্রেমে পড়ে যায়। শিরোচ্ছেদের পর্যন্তও সাধু ঐ মেয়েটির নিকট প্রেমপত্র লিখতেন এবং সেই পত্রে লিখতেন ‘ফ্রম ইয়োর ভ্যালেন্টাইন’ তবে আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে সাধু ভ্যালেন্টাইনের যেদিন শিরোচ্ছেদ করা হয় সেদিনই মেয়েটি চোখের দৃষ্টি ফিরে পায়। দৃষ্টি ফিরে পেয়ে মেয়েটি চিঠি থেকে প্রথম যে লাইনটি পড়েছিল সে লাইনটি ছিল ‘ফ্রম ইয়োর ভ্যালেন্টাইন’ এবং যেদিন এই ঘটনা ঘটেছিল সেদিনটি ছিলো ১৪ই ফেব্রুয়ারি।

আবার অন্য একটি কাহিনীতে আছে প্রাচীন রোমবাসীদের কুমারী মেয়েরা বছরের একটি দিন প্রেমের কবিতা লিখে মাটির পাত্রে জমা করতো এবং প্রত্যেক যুবক ঐ পাত্র থেকে চোখ বন্ধ করে একটি লেখা তুলে নিতো। সে যুবকটির হাতে যে মেয়েটির লেখা আসতো সেই যুবক সেই মেয়েকে ভালবাসতো এবং পরবর্তীতে বিয়ে করে জীবনসঙ্গিনী করতো। এখানেও উল্লে¬খ্য বছরের যে দিনটিতে এটি হতো সে দিনটিও ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি।

অপরদিকে ‘‘বিশ্ব ভালবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালবাসুন’’ এই শ্লোগানকে সামনে রেখে খুলনার উন্নয়ন সংস্থা রূপান্তর ও এর সহযোগী সংগঠন সুন্দরবন একাডেমিসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে খুলনাসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সুন্দরবন সংলগ্ন পাাঁচটি জেলা, এর উপজেলায় এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও দিবসটি পালন হয়ে আসছে ২০০২ সাল থেকে। দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বসেরা এ বনাঞ্চল রক্ষায় ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি এ বন ধ্বংসের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের প্রতিহত করা এবং একই সাথে সুন্দরবন সংরক্ষণে সরকারের উদ্যোগসমূহ বাস্তবায়নে সহায়তা করা।

খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর ও বরগুনা এই পাঁচটি জেলার ১৭টি উপজেলায় প্রায় ২’শটি ইউনিয়নে সুন্দরবন অবস্থিত হলেও বেশী অংশ রয়েছে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলাতে। তবে নাম নিয়ে যত মতভেদ থাকুক না কেন আমাদের সুন্দরবন পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জোয়ার ভাটা দ্বারা প্রভাবিত ব-দ্বীপ যেখানে লবনাক্ত বা ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের আধিক্য। বাংলাদেশের আয়তনের প্রায় ৪.২ শতাংশ এবং সমগ্র বনভূমির প্রায় ৪৪ শতাংশের এ বনে প্রাকৃতিক সম্পদের কি নেই? গাছ, মাছ, বহুজাতির প্রাণী, মধু, কাকড়া, ঝিনুক, চিংড়ি, গোলপাতা, পাখি, সাপ, নদ-নদীসহ অসমূল্য সম্পদের আঁধার এই সুন্দরবন। সুন্দরবনে মোট ২’শ ৪৫টি পরিবারের ৩’শ ৩৪টি প্রজাতির বড় বৃক্ষ, গুল্ম-লতা ও পরজীবী উদ্ভিদ পাওয়া যায়। মাছ পাওয়া যায় ২৭টি পরিবারের ৫৩টি প্রজাতির (সমুদ্রচর) ও ৪৯টি পরিবারের ১’শ ২৪ প্রজাতির (তলদেশ বিহারী)। চিংড়ি পাওয়া যায় ৫ পরিবারের ২৪ প্রজাতির। সুন্দরবনের প্রায় ৩৫ ভাগ জলাভূমি, যার ১লাখ ৭৫হাজার ৬’শ ৮৫ হেক্টর এলাকায় ছোট বড় ৪’শ ৫০টি নদী ও খাল রয়েছে। শুধু এ পর্যন্তই নয়, মধু, গোলপাতা ছাড়াও এ বনে রয়েছে তেল ও গ্যাস। বাংলাদেশের পেট্রোবাংলা পেট্রোলিয়ামজাত তেল-গ্যাস কার্যক্রমকে ২৩টি ব্লকে ভাগ করেছে। যার মধ্যে সুন্দরবন ৫ ও ৭নং ব্লকের অর্ন্তগত। এ বনে বন্যপ্রাণী রয়েছে ৪’শ ২৫ প্রজাতির, যার মধ্যে ৩’শ ১৪ প্রজাতির পাখি, ১৪ প্রজাতির কাছিম, ৯ প্রজাতির অজগর, কালকেউটে, বোড়া, গোসাপসহ ৩০ প্রজাতির সাপ ও কুমির, ৫৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী। সব কিছুর মধ্যে এখানের অন্যতম প্রাণী হচ্ছে পৃথিবীর বিরল প্রজাতির রয়েল বেঙ্গল টাইগার। ১৯৮৫ সালের জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৪’শ ৫০টি। ১৯৯৩ সালের গণনা অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা ৩’শ ৫০ থেকে ৪’শ ৫০টি। ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের জরিপ অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা ৩’শ ৬৯টি এবং সর্বশেষ ২০০৪ সালে সুন্দরবনের বাঘ শুমারী ফলাফল পুরুষ বাঘ ১’শ ২১টি, স্ত্রী বাঘ ২’শ ৯৮টি ও ২১টি বাচ্চাসহ সব মিলিয়ে ৪’শ ৪০টি।

কিন্তু এই সম্পদের আধার ধ্বংস হতে বসেছে। দিনে দিনে কমে যাচ্ছে এর সম্পদ এবং রাজস্ব আয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। মূলত বৃটিশরা এদেশ শাসন গ্রহণের পর থেকে সুন্দরবনের আয়তন ক্রমশঃ কমতে থাকে। ইতিহাস বলে এখন যেখানে কলকাতা ও খুলনা শহরের অবস্থান, ১৭৬৫ সালে সে পর্যন্ত ছিল সুন্দবনের বিস্তৃতি। রাজস্ব আয় বাড়ানো ও জীবজন্তুর হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রথম ১৭৭০ সালে কালেক্টর জেনারেল ক্লড রাসেলের সময় থেকে চাষের জন্য সুন্দরবনকে ইজারা দেওয়া শুরু হয়। এ সময় বনের কোন সীমানা নির্ধারণ ছিল না। প্রথম বনের সীমানা নির্ধারিত হয় ১৭৮৩ সালে যশোরের তৎকালীন জর্জ ও কালেক্টর টিনম্যান হেংকেল এর সময় থেকে। ১৭৮৫ সালে হেংকেল বনের ছোট ছোট জমি ১৫০ জনকে লীজ দেন। তবে হেংকেলের এই তৎপরতায় বন নিধনের সাথে সাথে আবাদী জমি বাড়তে থাকে। ১৮১১ সাল থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত লেফটেনেন্ট ডাবলু ই মরিশন সমগ্র সুন্দরবন এলাকা জরিপ কাজ শুরু করেন এবং এই জরিপ কাজ শেষ করেন মরিশনের ভাই ক্যাপ্টেন হিউজ মরিশন। অবশ্য এ সময় দু ভাইয়ের মিলে একটি আংশিক ম্যাপও তৈরী করেন এবং তাদের আংশিক ম্যাপ নিয়ে ও জরিপকৃত ফলাফলের উপর ভিত্তি করে ১৮২২ থেকে ১৮২৩ সালে সর্ভেয়ার টমাস প্রিন্সেস সাহেব সুন্দরবনের একটি ম্যাপ তৈরী করেন। যা ১৮৩০ সালে সম্পূর্ণ আঙ্গিকে রূপ দেন সুন্দরবনের প্রথম কমিশনার উইলিয়াম ড্যাম্পিয়ার ও জরিপ কর্মকর্তা হজেয ।

১৮১৭ সালে সুন্দরবন এলাকার জন্য জেলা কালেক্টরের ক্ষমতা সম্পন্ন পদ সৃষ্টি করে প্রথম দায়িত্ব পান ইউলিয়াম ড্যাম্পিয়ার। ১৮২৮ সালে বৃটিশ সরকার সুন্দরবনের স্বত্ত্বাধিকার অর্জন করেন। অবশ্য এর পূর্বে সুন্দরবনের প্রথম দপ্তর স্থাপন করা হয় কলকাতার আলীপুরে। ১৮৫৩ সালে অনাবাদী ও জঙ্গল এলাকা বিতরণের জন্য নতুন আইন তৈরী হয়। ১৭৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংরেজরা পতিত এবং বন কেটে নতুন আবাদী জমি সৃষ্টি করে, যা একাধারে চলে ১৮৭৩ সাল পর্যন্ত। ১৮৭৮ সালে সমগ্র সুন্দরবন এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয় এবং ১৮৭৯ সালে সমগ্র সুন্দরবনের দায় দায়িত্ব বন বিভাগের উপর ন্যস্ত করা হয়। সুন্দরবনের প্রথম বিভাগীয় বন কর্মকর্তার নাম এম.ইউ.গ্রিন। তবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন ১৮৮৬ সাল থেকে, কারণ ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তৎকালিন কতিপয় জমিদারের অধীনে।

সে কারণে দেখা যাচ্ছে সুন্দরবনের উপর অত্যাচার সেই অনাদী কাল থেকে। মনুষ্যসৃষ্ট নানান কারণসহ সুন্দরবন ক্ষতির জন্য দায়ী প্রাকৃতিক কারণও। সুদীর্ঘকাল থেকে এ ধারা চলে আসলেও বর্তমানে তা বিপজ্জনক অবস্থানে পৌঁছে গেছে। এ দুরবস্থা কাটাতে চাই সামাজিক ভাবে একটি গণআন্দোলন। ১৯৯৪ সালের ৬ই ডিসেম্বর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ২১তম অধিবেশনে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) সুন্দরবনকে হেরিটেজ সাইট বা বিশ্ব সম্পদ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ৫২২টি বিশ্ব ঐতিহ্যের মধ্যে সুন্দরবনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

শুধু কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয়, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন জীবিকার সঙ্গে সুন্দরবন সম্পৃক্ত নয়। বাংলাদেশের পরিবেশগত দিক বিবেচনায়ও এটিকে হাল্কা করে দেখার সুযোগ নেই। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে আগলে রেখেছে সুন্দরবন। অনেকটা মাতৃক্রোড়ে যেমনটি একটি শিশু পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকে। তাই আসুন ভালোবাসার এই দিনের মতো প্রতিটি দিনে সুন্দরবনকে ভালোবেসে এটিকে রক্ষা করে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করি।

(লেখকঃ- সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী)

শ্যামনগর

যশোর

আশাশুনি


জলবায়ু পরিবর্তন