Notice: Trying to get property 'post_content' of non-object in /home/dakshinermashalc/public_html/wp-content/plugins/pj-news-ticker/pj-news-ticker.php on line 202
মশাল সাহিত্য Archives - Page 4 of 7 - Daily Dakshinermashal

Category: মশাল সাহিত্য

  • ক্যাসলিং নিয়ম

    হুমায়ূন আফতার এর কবিতা

    ক্যাসলিং নিয়ম

    মধ্যরাতে শরীরে যখন বিপ্লব জেগে ওঠে
    ইকারুসের ঘোড়াগুলো তখন তীক্ষ্ম ক্ষুরে
    ছুটতে থাকে আমার বেদখল রণক্ষেত্রের দিকে।
    আমার পিঠে ঘোড়া, ঘোড়ার পিঠে আমি
    ছুটতে থাকি জীবনের ক্যাসলিং নিয়মে।
    হিংস্র শত্রুরা আহর্নিশ কৌশূলী হয়ে ওঠে,
    আর ঘুমপ্রিয় পৃথিবী তখন ঘোর কেটে
    খেলোয়ার হয়ে ওঠে ক্রমাগত।

  • ভেজা ইতিহাস

    ভেজা ইতিহাস

    হুমায়ূন আফতার এর কবিতা

    ভেজা ইতিহাস

    আজ বৃষ্টি হয় হোক…আমি আর ভিজতে চাই না,
    আমি যে জন্মান্তর ভিজে চলেছি অশুভ বৃষ্টিতে,
    ভিজতে ভিজতে আমি জলজ আগাছা বনে গেছি…
    আজ বৃষ্টি হয় হোক…আমি আর ভিজতে চাই না,
    শত কোটি বছর আগে মেঘপুত্র সমুদ্রের যে কান্নার ইতিহাস
    লিখে রেখেছিল গহিনে বিলুপ্ত দেবী মেঘাস্থিনা লু…
    তারই অভিশাপে আজও ভিজে যায় আরন্যক প্রজন্ম।
    আমি আর ভিজতে চাই না,
    আমি তো ভিজেছিলাম মেঘাস্থিনা লু’য়ের অভিশপ্ত বীর্য-বৃষ্টিতে,
    ভিজেছিলাম দেবী পার্সিফনির অনন্ত দীর্ঘ চুম্বনে।

  • নজরুল প্রেমে নার্গিস ও কিছু প্রাসঙ্গিকতা

    নজরুল প্রেমে নার্গিস ও কিছু প্রাসঙ্গিকতা

    কাজী নজরুল ইসলাম মোসলেম ভারতে লিখছেন তুখড়ভাবে। সারা ভারতে না হলে আফজালুল হকের মোসলেম ভারত সমস্ত পশ্চিমবঙ্গে নজরুলের লেখা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ সময় আফজালুল হক নজরুলকে মোসলেম ভারতে আফিসিয়াল কাজে বসিয়ে দিলেন। দিন রাত পত্রিকার কাজ করতে হয়। এমনি কাজের প্রবল চাপে তিনি হাফিয়ে ওঠেন। দেখা গেল আর কোন নতুন লেখা তৈরি করতে পারছেন না। এমতাবস্থায় আফজালুল হক এবং আলী আকবর খানের পরামর্শ অনুযায়ী কিছুদিনের জন্য হাওয়া বদলাতে যান দেওঘরে। দেওঘর থেকে লেখা নজরুল লেখবেন তার সব মোসলেম ভারতের জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন, বিনিময়ে আফজালূল হক প্রতিমাসে একশত টাকা পাঠাবেন। এখানে আফজালূল হকের মুখ্য যে উদ্দেশ্য ছিল তা হলো নজরুলকে নিয়ে ব্যবসা করা। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। দেওঘরে গিয়ে আশানুরূপ রচনা তাঁর দ্বারা সম্ভব হয়নি। কাজী নজরুল ইসলাম এসময় দেওঘরে যা রচনা করেছিলেন তা হলো ¯েœহভীতু (ওরে এ কোন সুরধ্বনি নামলো আমার সাহারায়), প্রতিবেশিনী (আমার ঘরের পাশ দিয়ে সে), মুক্তিধারা (লক্ষী আমার! তোমার পথে আজকে অভিসার), ছলকুমারী (কত ছল করে সে বারে বারে), অকেজোর গান (ঐ ঘাসের ফুলে মটর শুটির ক্ষেতে)। তিন মাসে তিনি মাত্র পাঁচটি গান রচনা করেন। বোধ করি নজরুল ইসলাম অসুস্থ্য হবার আগ পর্যন্ত আর কখনো এত দীর্ঘ সময়ে এত অল্প রচনা তিনি করেননি। শীতকালে নজরুল এই হাওয়া পরিবর্তন করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন। আর তারই প্রমাণ দেওঘর থেকে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা নজরুলের এই চিঠিÑ
    ‘টাকা ফুরিয়ে গেছে, আফজাল কিংবা খান যেন শীগগীরই টাকা পাঠায়, খোঁজ নিবি আর বলবি আমার মাঝে মানুষের রক্ত আছে। আজ যদি তারা সাহায্য করে সে সাহায্য সুদে আসলে পুরে দেব।
    (মুজফ্ফর আহমদ “কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা/পূর্বোক্ত” পৃষ্ঠা নং ১০৬)
    মুজফ্ফর আহমদ এবং তাঁর এক বন্ধু ইমদাদুল্লাহ নজরুলকে দেখতে গিয়েছিলেন। দেওঘরে নজরুলের অবস্থা সুবিধাজনক না দেখে মুজফ্ফর আহমদ ইমদাদুল্লাহর কাছ থেকে টাকা ধার করে নজরুলকে কলকাতা নিয়ে আসেন। তখন মুজফ্ফর আহমদ থাকতেন ১৪/২ চেতলাহাঁট রোডের বাড়িতে। তিনি নজরুলকে সে বাড়িতে উঠালেন। পরদিন সকাল বেলা আফজালুল হক এসে তাকে বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এই বাড়িতে ছিল ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি’, আর এ সাহিত্য সমিতির বাড়িতে কুমিল্লা (ত্রিপুরা) থেকে আগত শিশু পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা আলী আকবর খান থাকতেন। তিনিও নজরুলকে দেওঘরে যেতে উৎসাহিত করেছিলেন। আলী আকবর খান ঐ বাড়িতে থাকাকালে এক সময় অসুস্থ্য হয়ে পড়লে নজরুল তাকে সেবা সুশ্রƒষা দিয়ে সুস্থ্য করে তোলেন। সে কারণে নজরুলকে তিনি বেশ ¯েœহ করতেন। এসব কারণে দেওঘরে থেকে ফিরে নজরুল তাদের উপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এ সময় নজরুলকে দিয়ে খান সাহেব শিশু পাঠ্য পুস্তকের জন্য ‘লিচু চোর’ সহ আরও কয়েকটি ছড়া লিখিয়ে নেন। পরে তিনি নজরুলকে তার দেশের বাড়ি যাবার প্রস্তাব দেন। আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে তার বাড়িতে যাওয়া উচিত কিনা সে সম্পর্কে মুজফ্ফর আহমদকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানিয়ে ছিলেন।
    ‘দেখ ভাই, আমার পরামর্শ যদি শুনতে চাও, তবে তুমি কিছুতেই আলী আকবর খানের বাড়িতে যেও না। তিনি অকারণে অনর্গল মিথ্য কথা বলে যান, যেন অভিনয় করছেন এই রকম একটা ভাব তার কথাবার্তার ভিতর দিয়ে সর্বদা প্রকাশ পায়। কি মতলবে তিনি তোমায় তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চান তা কেউ জানে না। তিনি তোমাকে একটা বিপদেও ফেলতে পারেন।
    (মুজফ্ফর আহমদ “কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা/পূর্বোক্ত” পৃষ্ঠা নং ১২৩)
    তারপরেও ১৯২১ সালের ১৫ এপ্রিল কাজী নজরুল ইসলাম আলী আকবর খানের সাথে চট্টগ্রাম মেলে যাত্রা করেন। পথে রচনা করেছিলেন ‘নীলপরি’ (ঐ সর্ষে ফুলে ফুটালো কার/হলুদ রাঙা উত্তরী/ঐ আকাশ গাঙে পাল তুলে যায়/ নলি সে পরীর দূর তরী/ তার অবুঝ বীণার সবুজ সুরে) কবিতাটি। যা পরে ছায়ানট কাব্য গ্রন্থে সংকলিত হয়।
    পূর্ব বাংলার সে নৈসর্গিক দৃশ্য তা নজরুলের এই কবিতায় ধরা পড়েছে। ছোটবেলায় একবার তিনি ময়মনসিংহ এসেছিলেন। তার পর এই দ্বিতীয়বার তার পূর্ব বাংলায় আগমন। কিন্তু এবারের আগমন ও প্রত্যাগমন ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে ট্রাজেডিপূর্ণ। কুমিল্লায় পৌঁছে আলী আকবর খান ট্রেন থেকে নেমে নজরুলকে প্রথমে নিয়ে যান কান্দির পাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায়। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পুত্র বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন আলী আকবর খানের সহপাঠী। তখন এই পরিবারের সাথে ছিল তার গভীর সম্পর্ক। আলী আকবর খান বীরেন্দ্রের মা বিরোজা সুন্দরী দেবীকে মা ডাকতেন, সে সুবাদে এবার তিনি নজরুলেরও মা হলেন। বিরোজা সুন্দরী দেবী ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক এবং ¯েœহময়ী রমণী। এ পরিবারের আরো ছিলেন বীরেন্দ্রর দুটি বোন-কমলা সেনগুপ্ত (বাচ্চি) ও অঞ্জলি সেনগুপ্ত (জটু), বীরেন্দ্রের বিধবা জেঠিমা গিরিবালা দেবী এবং তার একমাত্র সন্তান আশালতা (দুলি) (যে পরে প্রমীলা দেবী) এবং বীরেন্দ্র বাবুর স্ত্রী ও পুত্র রাখাল। ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত সবাই ছিলেন সংস্কৃতিমনা। বিশেষ করে এ বাড়ির ছোট মেয়েরা (দুলি, বাচ্চি ও জুট) ছিল সংগীতে মুখর। নজরুলকে পেয়ে তারা অল্পদিনেই আপন করে নিলেন। কয়েকদিন কুমিল্লায় কাটানোর পর বৈশাখের শুরুতেই আলী আকবর খানের সাথে তিনি তার দৌলতপুর গ্রামের বাড়িতে যান। আলী আকবর খানের গৃহকর্তী ছিলেন তার বিধবা বড় বোন। পাশেই ছিলেন আর এক বিধবা বোন মুন্সী আবদুল খালেকের স্ত্রী, ঐ বোনের এক পুত্র জাহাজে কাজ করতেন। সে কারণে তিনি সবসময় বাহিরে থাকতেন। আর ছিল এক কন্যা সৈয়েদা। সৈয়েদা মায়ের সঙ্গেই থাকতেন। নজরুল এ বাড়িতে অতিথি হবার পর আবদুল খালেকের স্ত্রী এবং সৈয়েদা প্রায়ই এ বাড়িতে আসা যাওয়া করতে থাকেন। নজরুলের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতাও হয়ে যায় তাদের। পরে এক সময় সৈয়েদা নজরুলের কাছে গান শিখতে আসে নিয়মিত। নজরুলের দৌলতপুরের কয়েকটি রচনায় ঐ ঘনিষ্ঠতার ছায়া পড়ে। ১৩২৮ সালের বৈশাখ মাসে দৌলতপুরে রচিত ‘হারামনির হার’ কবিতায় দেখি চির দুরন্ত কবিকে ঘরের মায়ায় মুগ্ধ করেছে।
    তোরা কোথা হতে কেমনে এসে
    মনিরমালার মতো আমার কণ্ঠে জড়ালি
    আমার পথিক জীবন এমন করে
    ঘরের মায়ায় মুগ্ধ করে বাঁধন পরালি।
    একই পরিস্থিতিতে জ্যৈষ্ঠমাসে রচিত আর একটি কবিতা হলো ‘মানস বধূ’। এ কবিতায় কবির বেদনার ছাপ পরেছে। তবে তার মধ্য থেকে এক বধূর মূর্তি স্পষ্ট।
    সে যেন কোন দূরের মেয়ে আমায় কবি মানস বধূ
    বুক পোড়া আর মুখ ভরা তার পিছলে পড়ে ব্যাথার মধু
    নিশিথে রােেতর স্বপন হেন
    পেয়েও তারে পাইনি যেন
    মিলন মোদের স্বপন কোলে কাঁদনভরা চুমোয় চুমোয়
    নাম হারা সে আমার প্রিয়া, তারেই চেয়ে জনম গোয়ায়।
    ১৩২৮ সালের বৈশাখ মাসে দৌলতপুরে রচিত অবেলার গান, হার মানার হার, অনাদৃতা, বিদয়া বেলায়, পাপড়ি খোলা এবং জৈষ্ঠ্য মাসে রচিত বেদনা অভিমান, হারামনির হার, মানস বধু, বিধুরা পথিক প্রিয়া। কবিতাগুলি ছায়ানট কাব্যে সঙ্কলিত। এছাড়া একই সময়ে শিশুদের জন্যও তিনি রচনা করেন লাল সালাম এবং মুকুলের উদ্বোধন।
    মূলত, আলী আকবর খানের যে উদ্দেশ্যে নজরুলকে কুমিল্লাতে আনা- তা হলো তাকে দিয়ে কিছু শিশু পাঠ্য পুস্তক উপযোগি ছড়া কবিতা লিখিয়ে নিয়ে ব্যবসা করে যাওয়া। কিন্তু তার সেই উদ্দেশ্য সফল না হওয়াতে খান সাহেব কৌশলে মন ঘোরালেন অন্যদিকে। তার ভাগ্নী সৈয়েদাকে নজরুলের সাথে অবাধ সম্পর্কের টার্গেটে এ বাড়িতে নিয়ে আসলেন, আর নজরুলও দিন দিন সৈয়েদার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলেন। নজরুল তার নাম পাল্টিয়ে রাখলেন নার্গিস আশার খানম। এক পর্যায়ে আলী আকবর খানের উদ্যোগে তাদের মধ্যে বিবাহ স্থির হয়। নজরুল এ সময়ে তার বিয়ের খবর কোলকাতার বন্ধুবান্ধবদের লিখে জানান। কোলকাতার সাহিত্যিক বন্ধুরা এ সংবাদ শুনে অবাক হলেও তাদের বিবাহের জন্য শুভ কামনা জানিয়ে নজরুলকে পত্র দেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ১৯২১ সালের ৫জুন নজরুলকে লিখলেন।
    ‘যখন আজ তোর চিঠিতে জানলুম যে, তুই স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে বরণ করে নিয়েছিস, তখন আমার অবশ্য কোন দুঃখ নেই। তবে একটা কথা- তোর বয়স আমাদের চেয়ে ঢের কম, অভিজ্ঞতাও তদনুরূপ, ফিলিংস এর দিকটা অসম্ভব রকম বেশী, কাজেই ভয় হয় যে হয়ত দুটো জীবনই ব্যর্থ হবে।’   (নজরুল রচনা সম্ভার, ঢাকা ২৫মে ১৯৬৯)।
    তবে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের ঐ পত্রে নজরুলের প্রেরীতে চিঠির একটা উদ্ধৃতিতেও মেনে যাতে নজরুলের সৈয়েদা সম্পর্কে মনোভাব স্পষ্ট,
    ‘যাকে পেয়েছিস তিনিই যে তোর চির জনমের হারানো গৃহলক্ষী এ কথা যদি ককেটুকু সত্যি হয়, তাহলে তোর সৌভাগ্যের সত্যই ঈর্ষা হচ্ছে…। লিখেছিস এক অচেনা পল্লীবালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছিস, যা কোন নারীর কাছে কখনও হইনি। জেনে খুশীই হলাম যে তার বাইরের ঐশ্বর্যও যথেষ্ঠ’। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের এই চিঠিতে নজরুলের উদ্বৃতি থেকে প্রমাণিত হয় যে, সৈয়েদার চেহারাও ছিল বেশ আকর্ষণীয়। ১৩জুন ওজেদ আলী লিখেছিলেন;
    ‘নিভৃত পল্লীর যে কুটির বাসিনী (দৌলতপুরের দৌলতখানার শাহজাদী বলাই বোধ হয় ঠিক না?) সাথে আপনার মনের মিল ও জীবনের যোগ হয়ে গেছে, তাকে আমার শ্রদ্ধা ও প্রীতিপূর্ণ আদাব জানাবেন।’
    সৈয়েদা মাত্র ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া জানতো। তাই জনরুলের সাথে তার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেলে সৈয়েদার মামা আলী আকবর খান সৈয়েদাকে নজরুল ইসলামের সহযোগী করে গড়ে তোলার জন্য নিজ হাতে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সবকটি উপন্যাস বুঝিয়ে-বুঝিয়ে পড়িয়ে বাস্তব জীবন সম্বন্ধে তাকে জ্ঞান দান করেন। এ ব্যাপারটি খান সাহেবের সংসারের কর্তী তার বিধবা বোনের খুব অপছন্দ ছিল, কিন্তু তার করার কিছু ছিল না। তিনি শুধুমাত্র নজরুলকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তখন নজরুলেরও করার কিছু ছিল না। কারণ তাদের বিয়ে সমাগত। বিয়ে ঠিক হয়েছিল ৩রা আষাঢ় ১৪২৮ শুক্রবার। এই বিয়ে উপলক্ষ্যে একটা নিমন্ত্রণপত্র বিভিন্ন কাগজে ছাপা হয়েছিল। পত্রটি হলো;
    বিনয় সম্ভাষণ পূর্বক নিবেদন,
    জগতের পুরোহিত তুমি, তোমার এ জগৎ মাঝারে
    এক চায় একেরে পাইতে, দুই চায় এক হইবারÑরবীন্দ্র
    এ বিশ্ব নিখিলের সকল শুভ কাজে যাঁর প্রসন্ন কল্যাণ আঁখি অনিখিল হয়ে জেগে রয়েছে, তাঁর ওই মহাকাশের মহা সিংহাসনের নীচে আমার মাথা নত করে আমি আপনাদের জানাচ্ছি যে আমার পরম আদরের কল্যাণীয়া ভাগ্নী নার্গিস আশার খানমের বিয়ে বর্ধমান জেলার ইতিহাস প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশ বিখ্যাত পরম পুরুষ, অভিজাত্য গৌরবে পরম গৌরবান্বিত, আয় মাদার মরহুম মৌলভী কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দেশ বিশ্রুত মুসলিম কুল গৌরব মুসলিম বঙ্গের রবি কবি সৈনিক নবযুগের ভুতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুলস ইসলামের সাথে। বাণী দুলাল দামাল ছেলে বাংলার এই তরুণ সৈনিক কবি ও প্রতিভান্বিত লেখকের নতুন করে নাম বা পরিচয় দেয়ার দরকার নেই। এই আনন্দঘন চির শিশুকে যে দেশের সকল লেখক-লেখিকা সকল কবি যুবকেরা ভালবাসা দিয়েছিলেন সেই বাঁধনহারা যে দেশমাতার একেবারে বুকের কাছটিতে প্রাণের মাঝে নিজের আসনখানি পেতে চলেছে এর চেয়ে বড় পরিচয় তার আর নেই। আপনারা আমার বন্ধু, বড় আপন জন। আমার এ গৌরব আমার এ সম্পদের দিনে আপনারা এসে আনন্দ করে আমার কুঠিরখানিকে পূর্ণানন্দ দিয়ে ভরাট করে তুলুন। তাই এ আমন্ত্রণ।
    বিয়ের দিন আগামী ৩রা আষাঢ়, শুক্রবার নিশীথ রাতে।
    আরজ
    দৌলতপুর, ত্রিপুরা বিনীত
    ২৮শে জৈষ্ঠ্য ১৩২৮     আলী আকবর খান
    (সূত্র: আবদুল আজীজ আল আমান’ নজরুল পরিক্রমা’ কলকাতা ১৩৭৬)
    এই নিমন্ত্রণপত্র নজরুল ইসলামের বংশ এবং নিজের পরিচয়ে বেশ অহমিকার ছাপ স্পষ্ট যাতে তাঁর অনেক বন্ধু বান্ধব সাহেব, আপনার পত্রাদি যে মোটেও পাওয়া যাইতেছে না তাহার কারণ কী? খান সাহেবের নিমন্ত্রণপত্র পাইয়াছিলাম, পত্রখানায় আপনারই মুসবিদা করা দেখিলাম। পত্রের ভাষা দুই এক জায়গায় বড় অসংযত হইয়াছে একটু যেন কেমন দাম্ভিকতা প্রকাশ পাইয়াছে। আপনার হাত দিয়া অমোন লেখা বাহির হওয়া কিছুতেই ঠিক হয় নাই। আমার বড় ভয় হইতেছে যে খান সাহেবের সংশ্রবে আপনিও না শেষে দাম্ভিক হইয়া পড়েন। অন্যে বড় বলিলে গৌরবের কথা হয়। আর নিজেকে নিজে বড় বলিলে অগৌরবের মাত্রা বাড়িয়ে যায়। “মোহাম্মদী” কে বিবাহের কথা ছাপিতে অনুরোধ করাটা ঠিক হইয়াছে কি? তারাতো নিজে হইতেই খবর ছাপিতে পারিতেন। বাস্তবিক আমার প্রাণে বড় লাগিয়াছে বলিয়া আমি এত কথা বলিলাম। এই নিমন্ত্রণ পত্র আবার ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণপত্র” শিরোনামে বাঙালিতে মুদ্রিত হইয়াছে। দেখিলাম। বাঙালিকে কে পাঠাইল?
    (কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা/পূর্বোক্ত ভূমিকা ১৯৬৯)
    আসলে মুজফ্ফর আহমদের চিঠিতে আমরা যা পাই তাই ঠিক। কারণ কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি ও জীবন পর্যালোচনা করলে কোথাও তাঁর মধ্যে দাম্ভিকতার চিহ্ন পাওয়া যায় না। কুমিল্লায় থাকাকালীন সময়ে নজরুলের মধ্যে যে অহংকার জন্ম নিয়েছিলো তা সব আলী আকবর খানের জন্য। মুজফ্ফর আহমদ ছিল তাঁর খুব কাছের বন্ধু। তাই তার প্রাণে লাগাটাই স্বাভাবিক।
    সেকথা এখানেই থাক। নজরুলের বিয়েতে আলী আকবর খান কান্দির পাড় থেকে ইন্দ্র কুমার সেন গুপ্তের পরিবার নিয়ে আসলেন। বিয়ের আসরে আরো ছিলেন বাঙ্গোরার জমিদার রায় বাহাদুর রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার এবং বাঙ্গোরার হাই স্কুলের হেড মাস্টার অবনীমোহন মজুমদার। ঘটনার চক্রান্তে সে বিয়ে হয়নি। এই ঘটনা অনুসন্ধান করে মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন ‘কাজী নজরুল ইসলামের সাথে সৈয়েদা খাতুন ওরফে নার্গিস বেগমের বিয়ে হয় নি এ সম্বন্ধে আমি স্থির নিশ্চিন্ত হইয়াছি। ইন্দ্র কুমার সেনের বাসা হইতে যে কয়জন নিয়ন্ত্রিত দৌতপুরে গিয়েছিলেন সন্তোস কুমার সেন নামক এক ১৫/১৬ বছর বয়সের বালক ছিলেন। অবশেষে সন্তোষের সাথে আমার কথা হয়, তার দেওয়া তথ্য থেকে বুঝা যায় আলী আকবর খানও এ বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন। তার কাবিননামায় একটা শর্ত ছিল। তা হলো নার্গিসকে নিয়ে সে কুমিল্লাতে থাকতে পারবে কিন্তু ইচ্ছামত যেখানে সেখানে নিয়ে যেতে পারবে না। যা কাজী নজরুল ইসলামের গৌরবে বেশ বেধেছিল আর বাধাটাই স্বাভাবিক।
    এমন এক দূরন্ত কবিকে ঘর জামাই করে ঘরের কোনে বন্দি হওয়া কখনও সম্ভব নয়। সেবার কুমিল্লাতে বন্যা উঠেছিল। এমনি রাতে বিয়ের আসর হতে উঠে কুমিল্লার ১০/১২ মাইল পথ পায়ে হেটে কান্দির পাড়ে বিরোজা সুন্দরী দেবীর বাড়ি উঠেন। আবার বিরোজা সুন্দরী দেবীর প্রবন্ধ থেকেও এমনি তথ্য পাওয়া যায়।
    ৩রা আষাঢ় দিবাগত রাতে বিরোজা সুন্দরী দেবীর নিকট বিদায় নিতে এসে বললো, ‘মা আমি এখনি চলে যাচ্ছি,’ ঐ অবস্থায় তাকে ফেরানোর কথাই ওঠে না। তিনি বললেন, তুমি বাইরের ছেলে কুমিল্লার পথঘাট চেনো না। যাও যদি বীরেন্দ্রকে নিয়ে যাও। সে কুমিল্লায় জন্মেছে আর কুমিল্লায় মানুষ হয়েছে। এ দেশের লোকজনকে চেনে। সে কাদা বিছানো পথে হেটে পরদিন সকাল বেলা কান্দির পাড়ে এসে পৌঁছালো। এমনিভাবে বিয়ের রাতে শাহ্ নজর ও বাসরের পরিবর্তে নজরুলকে হাঁটু কাদা পাড়ি দিতে হয়েছিল। পরদিন নজরুলের জিনিসপত্র বিরোজা সুন্দরী নিয়ে যান। আলী আকবর খান নজরুলের জিনিসপত্র তল্লাসি করে কিছু চিঠি এবং কাগজপত্র রেখে দেন। এর পরে নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের আর কখনও দেখা হয়নি। এখানে নজরুল যে নার্গিসকে ভালবাসতেন একথা সত্য তবে মুজফ্ফর আহমদ নার্গিসকে অভিনেত্রী ও আলী আকবর খানকে অভিনেতা আখ্যা দিয়েছেন। মূলত: আলী আকবর খান ভাগ্নীকে নজরুলের সাথে বিয়ে দিয়ে নজরুলের মত একজন প্রতিভাবান লেখককে হাতের মুঠোয় পুরে প্রকাশনা জগতে একচেটিয়া ব্যবসা করে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নজরুল তা বুঝতে পারেন নি। আলী আকবর খান এবং নার্গিস আশার খানমের আচরণে নজরুলের পৌরষ যে প্রচণ।ড আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি তা বিরোজা সুন্দরী দেবীর বাড়িতে থাকাকালীন কিছু সামাল দিতে পেরেছিলেন। কিছুদিন পর তিনি সেখান থেকে মুজফ্ফর আহম কে একটা পোস্টকার্ডে লেখেন তিনি যেন কুমিল্লাতে এসে তাঁকে নিয়ে যান। তিনি আলী আকবর খান দ্বারা প্রভাবিত এবং অপমানিত, দারুন অসুস্থ। এ সংবাদ পেয়ে মুজফ্ফর আহমদ ফকির দাস গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ৩০ টাকা ধার করে ১৯২১ সালের ৬ জুলাই কুমিল্লায় এসে পৌঁছান। এখানে এসে দেখেন বিরোজা সুন্দরী পরিবারের ¯েœহমমতায় দৌলতপুর বিরহ অনেকটা সামলে উঠেছেন। তারা ৮ জুলাই কুমিল্লা থেকে কলকাতায় রওয়ানা দেন। চাঁদপুরে এসে টাকা ফুরিয়ে গেলে চাঁদপুর ডাকবাংলোয় উঠেন, আর কলকাতায় আফজালুল হককে টাকার জন্য টেলিগ্রাম করেন। তার অনুরোধে কুমিল্লার আরশাদ উদ্দিন চৌধুরী চাঁদপুর হরদয়াল নাথকে টেলিগ্রাম করে ভাড়ার টাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেন। পরে তার টাকায় তারা কলকাতা পৌঁছান। এরই মধ্য দিয়ে কুমিল্লার বেদনা বিধুর ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে।
    নজরুল কুমিল্লা থেকে কলকাতায় ফেরেন। কলকাতায় ফেরার পথে ১৭ দিনে ৪টি গান রচনা করেন। পরশপূজা (আমি এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম…), মনের মানুষ (ফিরিনু যেদিন দ্বারে-দ্বারে কেউ কি এসেছিল…), বিজয় গান (ঐ অভ্রভেদী তোমার ধ্বজ উড়লো আকাশে…), এবং পাগল পথিক (এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলোক বন্ধিনি মার আঙিনায়…)। এর ৮ বছর পরে নজরুল প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করেন।
    নজরুল ফিরে এসে কলকাতায় মুজফ্ফর আহমদের সাথে জ্জ সি, তালতলার বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। দুমাস পরে সেপ্টেম্বর মাসের এক রাতে আলী আকবর খান একদিন ঐ বাড়িতে যান। তিনি একটা মিটমাট করে নজরুলকে ফিরিয়ে নিতে চান। কিন্তু সফল হন না। খান সাহেব নিজে নজরুলের পাশে খাটের উপর বসলেন। তার হাতে ১০ টাকার নোটের একটা বড় বান্ডিল ছিল। সেটা বার বার নাড়াচাড়া করছিলেন। খান চলে যাবার পরদিন নজরুল বিরোজী সুন্দরীকে লিখলেন ‘মা খান সাহেব আমাকে নোটের তোড়া দেখিয়ে গেল’।
    নজরুল নার্গিসকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে ঢাকায় নিয়ে আলী আকবর খান নার্গিসকে কাছে ডাকলেন এবং নিজের প্রকাশনা দপ্তর, ঢাকার দোতলা বাড়ি তার নামে লিখে দিলেন। পরে তাকে অনেক শিক্ষিত করে তুললেন। নার্গিস অনেক শিক্ষিত হয়েছিল বটে কিন্তু নজরুলের উপযোগী হয়েছিল কিনা তাতে সন্দেহ আছে। দৌলতপুর ঘটনার ১৫ বছর পর নজরুল ০১/০৭/৩৭ তারিখে নার্গিসের একটা চিঠির উত্তর দেন। চিঠিটির বিভিন্ন অংশ বিশ্লেষণ করলে নজরুল নার্গিসের সম্পর্ক স্পষ্ট। সে চিঠিতে সম্বোধন ছিল কল্যাণীয়াসু। তিনি লিখেছিলেন;
    ‘১৫ বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিাধারায় প্লাবন নেমেছিল। তা তুমি হয়তো স্মরণ করতে পারো। যাক তোমার অনুযোগ অভিযোগের উত্তর নেই। লোকের মুখের শোনা কথা দিয়ে তুমি যদি আমার মুখটি কল্পনা করে থাকো তাহলে আমায় ভুল বুঝবে। আর তা মিথ্যা।’
    চিঠিতে নার্গিসের প্রতি কোন অনুযোগ ও অভিযোগ ছিল না। একটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি নিয়েই লিখেছিলেন। ১৫ বছর পর নার্গিসের সাথে তার কোন যোগাযোগ না থাকলেও নার্গিসের প্রতি ভালবাসা ও অসীম বেদনার অকপট স্বীকৃতি;
    ‘আমার অন্তর্যামীই জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা- কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমি নিজেই পুড়ছি। তা নিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি আগুনের এই পরশমনি না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না, ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, সে রূপকে আমার জীবনে সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলী দিয়েছিলাম সেরূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মত চির অম্লাণ হয়ে আমার বক্ষে আছে।’
    নজরুলের এই চিঠিতে যেমন নার্গিসের প্রতি ভালবাসা ও অসীম বেদনা স্পষ্ট তেমনি তার অভিভাবকের প্রতি তার অভিযোগও স্পষ্ট।
    ‘তুমি ভুলে যেও না আমি কবিÑ আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতের সাধণা আমার নয় আমার আঘাত বর্বর কা-পুরুষের আঘাতের মত নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি শুনেছ জানিনা) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই।’ উদ্বৃতিতে স্পষ্ট তার অভিভাবক আলী আকবর খান সম্বন্ধে নজরুলের মন্তব্য। নার্গিসের চিঠিতে আত্মহত্যার কথাও হয়তো ছিল যার উত্তর নজরুল সহজভাবে দিয়েছিলেন ‘আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরনো কথা হলেও পরম হত্যা। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না।’
    এই চিঠিতে নার্গিসের প্রতি নজরুলের আরো অনুভব মেলে
    ‘হঠাৎ মনে পরে গেল পনের বছর আগের কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল, বহুসাধনার পর আমার তুষিত দুটি কর তোমার শুভ্র সুন্দর ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল, তোমার ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। মনে হয় যেন কালকের কথা। মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারে না। কি উদগ্র অতৃপ্তি কি দূর্দমনীয় প্রেমের জ্বরই সেদিন এসেছিল, সারারাত আমার চোখে ঘুম ছিল না। যাক আজ চলেছি, জীবনের অস্তমান দিনে শেষ রশ্মি ধরে ভাটার ¯্রােতে। তোমার ক্ষমতা নেই সেই পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করো না। তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক।
    নজরুল নার্গিসের পত্র পাবার পর একটি গানও রচনা করেছিলেন (যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই কেন মনে রাখো তারে…)। নজরুল নার্গিসের সম্পর্ক ও এই সম্পর্কে জীবনে প্রতিফলন নার্গিসের কাছে লেখা নজরুলের প্রথম ও শেষ চিঠি থেকে বুঝা যায়। তবে একথা সত্য যে নজরুল নার্গিসের বিয়ে না হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী নার্গিসের মামা আলী আকবর খান।
  • তমিজ উদ্ দীন লোদী’র কবিতা : সন্ধ্যা ঠেলছি রাত্রি ঠেলছি

     

     সন্ধ্যা ঠেলছি রাত্রি ঠেলছি

    তমিজ উদ্ দীন লোদী

    সেই কখন থেকে আমারা সন্ধ্যা ঠেলছি রাত্রি ঠেলছি
    স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা অন্ধকার ঠেলছি
    জড়ানো আঁধারকুচি ঠেলে-ঠেলে আমরা প্রত্যুষ ও আলো খুজছি।
    সেই ধ্বনি, বাতাস আর সমুদ্রের নীল খুঁজছি।

    স্তব্ধতা ফুঁড়ে বুনো ফুলের সৌরভ খুজছি
    চকিতে দেখা একটি মায়া হরিণের অবয়ব
    পিক শব্দে উড়ে যাওয়া একটি কোকিল
    অদৃশ্য ভাস্কর্যের মনোদর্পণ খুঁজছি।

    খুঁজছি প্রায় হারানো একটি তাম্প্রলিপি
    আঁধারের পলেস্তরায় যা ঢেকে গেছে দীর্ঘকাল
    খুঁজছি বৃষ্টিস্নাত ফুলসমেত একটি কদম শাখা
    খুঁজছি আমাদের দোআশঁলা ভ্রান্তিবিলাস
    ভাঙা আয়না, ভুলের টুকরো, উন্মাদোপম কথামালা
    খুঁজছি রক্তক্রোধ ও রুপোলি আগুন
    খুঁজছি হারানো ছন্দমাত্রা মিল-অন্ত্যমিল
    চতুর্দিক ঘন হয়ে আসা ঠান্ডা মেঘময়তা
    আর তার থেকে ঝরে যাওয়া শ্রাবণ কি আষাঢ়ের বৃষ্টি।
    খুঁজছি একটি হারানো কৌটো যা প্রত্যুষ আলো ও উজ্জ্বলতার প্রতীক।
    খুঁজছি একটি গ্রামফোন রেকর্ড যাতে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে
    আমাদের হারানো সব গান।

  • সায়েম ফেরদৌস মিতুল এর কবিতা

    সায়েম ফেরদৌস মিতুল এর কবিতা

    ভূত

    এসেই চলেগেল
    কয়েক লক্ষ পদ্ম ফুটিয়ে সর্ষের ভেতর দিয়ে চলে গেল ভূত, বললো যাই
    আর অমনি ভিন্ন ছায়াপথ থেকে খসে পড়লো ছত্রিশখানা তারা, তা থেকে একটির বীজ সংগ্রহ করে বাঁকল ছাড়ানো দেহে রুয়ে দিতেই চোখ ভরে দেখলাম দুরে কেউকারাডঙের চুড়োয় বহুদিনের ফেলে আসা বৃক্ষীটি হয়েছে স্তনবতী
    অমরাবতী..
    বিশ^াস করো আমি তার দুধ পান করিনি একটুও, আমি তার দীর্ঘিকারের মতো অতলে চুবিয়ে ধরিনি কোন শুড়, শুধু বাঁকল ছাড়ানো দেহটির লেবুঠোঁট চক্ষুআষ্টে আর তন্তুচুল জমিয়েছি, ভেবেছি অঞ্জলী দেবো তাই
    অমনি সারা গায়ে নৈশ মেখে স্বপ্নের ঝোলের ভেতর নাভি রেখে চলেগেল
    বললো যাই…।

    বুলড্রেজার প্রীতি

    ভাঙারও একটা শিল্প আছে
    যাপিত জীবনে ঠেস দিয়ে বুঝেছি কেবল নির্মান নয়, কেবল আঙুলের উত্তাপে
    বীজ জড়ো করলেই বা´বন্দি হয় না অমৃতের দৈত্য
    অমরাবতী…
    বুলড্রেজার প্রীতিই জম্ম রসায়ন, ভাঙতে ভাঙতে অলক্ষে গড়ে তুললে প্রতœজীব তার প্রতিবিম্বে বৃক্ষলগ্ন হয় গুল্মেরা, সেই সব বৃক্ষের সবুজাভ ছায়া নিয়ে পাখিরা গড়ে সমবায়ী জীবন, শে^তকুষ্ঠহীন ধোয়ামুখ গুলো ত্বক ভরে পান করে ঋতুরন্ধ্রের বাতাস, ঠিক ঐ সময়ই কবিদের পিঠের খোলায় জমা হয় হলুদ ঘিলু তা কি চেঁখে দেখেছে স্তন্যপায়ী মানুষেরা
    অথচ ধ্বংস বলছো কেন ধ্বংসতো হয় না কিছুই
    পৃথিবীর মুদিতপদ্মচোখে সবিতো নিষ্ঠার চুম্বন, অবশেষে মিলে যায় সকল গাণিতিক ফল অবিরল, কেবল ভাঙলেই প্রসারিত হয় শিল্পের দরজা..।

    আবেদন

    মাননীয়া উত্তরা…
    দক্ষিণা দিতে এসে ফিরতে হবে, দেবী
    পা-এতে ফেনা উঠে গেল অথচ এমন করে দিতেন আর্শিবাদ
    এমন করে চুলের ভিতর বিলিকাটা মাথায় রাখা হাত
    এমন করে মন্ত্র করে দিতেন জপে আর অমনি হতেম কবি থেকে পুরুষ
    ভালোবাসার রামধনু আর খুলে ছিলেন ধনুক থেকে তীরের যত ফলা
    শিখিয়ে ছিলেন যজ্ঞ শেষে উতলে ওঠে বর্ণমালা তাদের ছলাকলা
    লাগিয়ে দিলেন সমস্ত গায় দূর্বা রঙের সবুজ
    তাইতে আমি শিশুর চেয়ে সরল, লোকালয়ে আমিই বোকা, আমি কেবল অবুঝ

    কেন তবে ফিরতে হবে, দেবী
    লগ্ন শুরুর ভূমিই তো শেকড়ে গেছে পুতে
    ঘুরছে কেবল বিষ বিহীন চ্যালা, আমার সকল জঙ্ঘা ফুঁড়ে কেবলই কাঞ্চন
    সাতমনিহার, দুধ মাখা চাঁদ, সর খাওয়ার বেলা
    এমন পাতের বাড়া থালা ঠেঁলে দিবেন বলেন
    আয় দেবী আয় টিটি টিটি, স্বর্গ গড়ি চলেন…..।

  • কুড়িয়ে পাওয়া গল্পের মতো

    কুড়িয়ে পাওয়া গল্পের মতো

    সৌহার্দ সিরাজ

    সন্ধ্যাশ্রী বলত-দুপুর হাতে নিও না,
    মনে রেখ গল্পের উপাদানে ব্যাসবাক্য দিলে ক্ষতি নেই।

    আমি দেখলাম প্রথম প্রথম যারা প্রেম করতে শিখেছিল
    তাদের সবারই একবার দুঃখ সরোবারে ¯œান করতে হয়।

    মানুষের অনন্ত জিজ্ঞাসার মধ্যে একটা সৌন্দর্য আছে মানতে হবে
    হিসেব বৈচিত্রে পথযাত্রা বহুমাত্রিক হলে
    চাওয়া পাওয়ার একটা ব্যাবস্থা শেষ পর্যন্ত হয়ে যায়।

    নাবিকদের চোখের মধ্যে থাকে পথ
    পথের কী কথা বলছে দু’জন ছন্দ প্রকরণ
    কুড়িয়ে পাওয়া গল্পের মতো ছাইরঙ স্মৃতি আজও ভীষণ টানে
    সহজে কেউ কি মাটির মায়া ছাড়ে!

    ভোরের ঘরে নতুনত্ব সোহাগী ভোগের বীজ
    খসড়া দলিলে হাত তো নিজেদেরই খেলা
    মনটা ছায়ার উপর ঘোরাঘুরি করে
    স্মৃতি ভেঙে ছুটে যায় দিন
    সন্ধ্যাশ্রী আজ আমাদের নতুন পরিচয়।

  • শ্যামল সেই ইচ্ছেটুকু খুঁজে পেয়েছেন  তাই পৃথিবীর রহস্যের কাছে পায়ে হেঁটে যেতে তাঁর দ্বিধা নেই

    শ্যামল সেই ইচ্ছেটুকু খুঁজে পেয়েছেন তাই পৃথিবীর রহস্যের কাছে পায়ে হেঁটে যেতে তাঁর দ্বিধা নেই

    স ম তুহিন

    কাজী মুহম্মদ অলিউল্লাহ স্যার বাংলা পড়াতেন একটা বড় কলেজে। ভাষার পরে বিশেষ করে উপভাষা নিয়ে কাজ করেছেন। অনেক মেধা আর মানসিক পরিশ্রমের চিহ্ন তার ‘সাতক্ষীরার উপভাষা স্বরূপ ও স্বাতন্ত্র্য’ বইটি। অনেকেই বলেন এ কাজটি অনেক টিকে থাকা কাজের মধ্যে একটু বেশি রকমের ভাব নিয়ে টিকে থাকবে। কবিতা লিখতে কষ্ট হয় বলে কবিতা লেখেন না, চেষ্টাও করেন না। তারমানে অন্য যে কোনো কাজের চেয়ে কবিতা লেখা বা সাজানো অনেক কঠিন কাজÑঅনেকবার শুনেছি এ কথা তাঁর মুখে। যদি তিনি কবিতা লিখতেন, তাহলে ভালো কিছু কবিতা আমরা পেতাম, আমার ধারণা। কবিতা সবাই লিখলেও কবিতার সাথে মিশে যেতে পারে না কিংবা কবিতা ধরতে পারে না বেশিরভাগ কবিতার লেখক। এমনকি কবি হিসেবে সবাই চেনে এমন কবিতা লেখকও কবিতা কী, কবিতার বাঁকবদল, কোন সময়ের কবিতা কেমন হবে…ইত্যাদি বিষয়গুলো ঠিক ঠিক ধরতে পারেননি, এমন উদাহরণের উপস্থাপন করা যাবে অনেক। আমার মনে হয়, কাজী মুহম্মদ অলিউল্লাহ স্যার কবিতাটা ধরতে পারেন (একাডেমিক ধাঁচের প্রচলিত বর্ণনার বাইরেও আলাদা-আলাদা ভঙ্গিমায় বুঝিয়ে দিতে পারার অনবদ্য ক্ষমতা তাঁর সহজাত, তাই এমন বলা)

    কথা বলতে বলতে স্যার বলেছিলেন, একটা মিছিল বা প্রোসেশন-এ অনেক লোক থাকে। অনেক মাথা-মুখ, শরীর থাকে। সামনে থেকে কাউকে কাউকে দেখা যায়, পেছন থেকেও দেখা যায় কিছু জনকে, আবার ধার থেকেও দেখা যায় বেশ কিছু জনকে। একেবারে উপর থেকে চোখ মেললে অন্য রকমের ছবি দেখা যায়Ñ সব মাথাগুলোর ছবি।

    স্যার যেটা বলতে চেয়েছিলেন, সম্ভবত এ রকমÑ যে কোন এলাকায়, যে কোনো দেশে শিল্প-সাহিত্যের কোনো একটা আন্দোলন সমবেত প্রচেষ্টার একটা মিছিল বা প্রসেশন। যে যে কোণ থেকে যেভাবে দেখবে সে সেভাবেই মনে মনে ধরে নিতে পারবে, ঐ প্রসেশনটা কী বলতে চেয়েছিল। কী বলার জন্যে তারা চলছিল সময়ের সাথে, সময়ের রাস্তা ধরে। সবাই ছিল। কেউ সামনে কেউ পেছনে কেউ ধারে। একটু সময়ের হেরফেরে কেউ দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়…। আমাদের খুজে নিতে হয়, কষ্ট করে খুজে নিতে হয়Ñ

    স্যারের বলা কথার ধার ঘেঁষা এমন কিছু কথা ঔপন্যাসিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে বলেছেন, সুপরিচিত মননশীল লেখক গোলাম মুরশিদÑ ‘সবাই স্বীকার করবেন না, কিন্তু ভাগ্য বলে একটা কথা আছে। সেই ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ তরতর করে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে যান। ডান হাতে, বাঁ হাতে পুরস্কার নিতে থাকেন। আবার কেউ কেউ উজান ঠেলে প্রতিকূল ¯্রােতে প্রাণপণ বৈঠা টেনেও জনপ্রিয়তা অথবা জনস্বীকৃতির প্রত্যাশিত বন্দরে পৌঁছাতে পারেন না। তাঁর কপালÑ শ্যামলদা দূর্ভাগ্যক্রমে এই দ্বিতীয় দলের নিবন্ধিত লোক।১

    কয়েকদিন আগে সকালে দেখি চকচকে স্ট্যাম্প পড়ে আছে রাস্তায়।

    রেভিনিউ স্ট্যাম্প, তুলে নিলাম। মনে পড়ে গেল ছেলেবেলায় একবার একটা টিঠি পাঠাতে খামের ওপর সেঁটে দিয়েছিলাম বাড়িতে থাকা রেভিনিউ স্ট্যাম্প। বাছাইয়ের সময় বোধহয় পোস্টমাষ্টার কাকা সেটা দেখেছিলেন। পোস্টম্যানকে দিয়ে ডেকে নিয়ে বুঝিয়েছিলেন কোন্ স্ট্যাম্প কোন্ কাজে ব্যবহার করতে হয়। তখন ভালোভাবে বুঝিনি। এখনও বুঝি এমন না। তবে এটা বুঝি সব স্ট্যাম্প সব কাজে লাগে নাÑ

    অন্যরকম একটা রেভিনিউ স্ট্যাম্প আছে, সেটি শুধুমাত্র জীবনের সাথে সেঁটে নেওয়া যায় বা যেতে পারে। অমৃতা প্রীতমের আত্মজীবনী ‘রেভিনিউ স্ট্যাম্প’। আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যে অমৃতা প্র্রীতম জনপ্রিয় এবং বিশেষ উল্লেখযোগ্য একটি নাম। সাহিত্যিক হিসেবে বৈপ্লবিক চেতনা ও দৃঢ়তায় সমাজকে যতটা না শৃঙ্খল-মুক্ত করতে পেরেছেন, তার চাইতে নিজের একক বিদ্রোহে নিজেই বিধ্বস্ত হয়েছেন অনেক বেশি। তবে কোনো কৃত্রিমতা বা আড়াল দিয়ে তিনি নিজেকে কখনও ঢেকে রাখেন নি, রাখার চেষ্টাও করেন নি এবং তার এই অকপট স্বীকারোক্তিই অমৃতা প্রীতমের সাহিত্যের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট, সম্ভবত এরই জন্যে বিতর্কিত হয়েও সাহিত্যিক হিসেবে তিনি আজও অনেক জনপ্রিয়।

    ছেলেবেলায় চিঠির খামে না জেনে রেভিনিউ স্ট্যাম্প সেঁটেছিলাম, সেটি আমার এক বন্ধুর কাছে পাঠাতে চেয়েছিলাম। নিছক অফিসের কাজের জন্যে ছাড়া এখন আর কাগজে লেখা চিঠি কেউ কাউকে লেখে না। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। এ অনুভূতি এখন রূপান্তরিত হয়েছে এস এম এস কিংবা চ্যাটিং-এ। কলম ধরে না লিখলে লেখকদের ভাব আসে না, অনেকে বলেন। এখন অনেক লেখকই অভ্যস্ত হয়ে গেছে কম্পিউটারের কী-বোর্ডে। কী-বোর্ডের সামনে না বসলে তাদের এখন আর ভাব আসে না। কাজে লাগে এমন যা কিছু প্রযুক্তির হাত আসছে যা কিছু আসবে সে সব হাতে হাত মিলিয়ে অভিনন্দন জানানোই ভালো। স্ট্যাম্প বদলের পর চিঠিটা গিয়েছিল আমার বন্ধুর কাছে।

    বন্ধুত্ব নিয়ে সন্দিপন চট্টোপাধ্যায়-এর ডায়েরিতে ১৯৯৩ সালের ৩০ জানুয়ারির পাতায় চোখ রাখি ‘বন্ধুতা ব্যাপারে এক-একজনের একটা নিজস্ব খেলা আছে। শতরঞ্চের ওপর চার আনা দান ফেলে কেউ বলে, ‘এই ষোলো আনা ফেললাম।’ বিশ^াস করে যারা ষোলো আনা খেলে (অনেকে ডাবল দেয়), তারা পরে বুঝতে পারে, তারা ষোলো আনা খেলেছে মাত্র চার আনার ওপর। এদিকে সেই বাকি বারো আনা তো নিস্কর্মা হয়ে বসে থাকতে পারে না। তারা, ইন স্পাইট অফ দেমসেলভস প্রতারক বন্ধুটির সঙ্গে অবুঝ অপ্রণয় শুরু করে। এই কারণেই তাঁর সমসাময়িক বন্ধুরা কেউ জীবনানন্দের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পেরেছিলেন, এমন শোনা যায়নি। কারণ, উনি চার আনা ফেলতেন। শক্তি কিন্তু বছরে একবার দেখা হলেও ষোলো আনা বন্ধুত্ব দিয়ে গেছে। সুনীলও ষোলো আনা দেয়, তবে তার বন্ধুত্ব আঠারো আনা। দু আনা নিজের কাছে থেকে যায়।’২

    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বন্ধু সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখতে যান নার্সিংহোমে। ১৪ জুলাই ২০০১ তারিখে ডায়েরির পাতায় লেখা ‘কাল শ্যামলকে (সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়) দেখতে গিয়েছিলাম। সিঁথির নার্সিংহোমে। লোকে বলল চিনতে পারছে। আমি টের পেলাম, পারছে এবং পেরেছে।’ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয় ২৪ সেপ্টেম্বর ২০০১।*

    সাহিত্যিক বন্ধু শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আরও লিখেছেন

    ‘… শ্যামল হচ্ছে সেই লেখক যার যে কোনো এক্সপেরিমেন্ট বিনা পরিকল্পনাতেই ভূখ- জয় করে নিতে পারে। ওর লেখক সত্ত্বাকে বোঝাবার জন্য বই পড়বার দরকার নেই, ওর পিছু পিছু ঘুরে বেড়ালেই হবে। একদম শ্যামলের মতো আনপ্রেডিকটেবল। কোনো তত্ত্ব দিয়ে বেশিক্ষণ একটা কুকুরকে বেঁধে রাখা যাবে না। পরের মুহূর্তেই আরেকটা আরেকভাবে চিৎকার করবে। এতে বিপদও আছে। কোনোভাবেই কুকুরটাকেই বুঝতে পারা যায় না ঠিক করে যাতে ধরা পড়ে চিহ্নিত করার মত অপরাধচিহ্ন। ওর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী লেখাগুলো ছোট ছোট। ‘কুবেরের বিষয় আশায়’-এর মত। ‘শাহজাদা দারাশুকো’ সবচেয়ে ফালতু। ওর কিন্তু ধারণা সেটাই সবচেয়ে ভালো। যে কাজটা বিমল মিত্রের সে কাজটা শ্যামল করতে গেল কেন বুঝলাম না। তবে খুব পরিশ্রম করে ইসলামি ব্যাপারগুলো জেনেছে। চাল টিপে দেখলেই বুঝতে পারা যায়। এ চালে কোনো পাইল নেই, না খুদ, না কাঁকর।

    আমার মনে হয় ঐতিহাসিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস যেমন আর লেখার দরকার নেই, তেমনি দরকার নেই আড়াইশ, তিনশ, পাঁচশ পাতার ভল্যুম। কেবল পাতার পর পাতা লিখেই যাব এমন মানত না থাকলে দু’শ পাতার উপন্যাস মানে মহাকাব্য লেখা হল। হ্যাঁ, আমি কখনও দু’শ পাতাও লিখিনি। সেটা কেবলমাত্র কুঁড়েমির জন্য নয়, দৃষ্টিভঙ্গির জন্যও।৩

    শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে বলেছেন, লিখেছেন অনেকে। আবার তার গল্প নিয়ে গল্প বলেছেন মানে সমালোচনা করেছেনও অনেকে, সে সব সমালোচনা সোনায় মোড়ানো। সব লেখা হয়তো সবার পড়া হয়ে উঠবে না। ছোট পরিসরে তাই আমরা এ লেখাটা পড়ে নিতে পারি
    ‘হালফিল বাংলা গল্পের অনেকটাই ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। শুধু ঘরের ভেতরে নয়, একেবারে খাটের ওপরে। মনস্তত্বের গুপ্ত গহ্বরে তার চলাফেরা। এ নিয়ে কিছু ভাল গল্প লেখা হয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু তার সংখ্যা সামান্য। এ ধরণের অধিকাংশ লেখা লেখকের অভিজ্ঞতা ও উপকরণ-সংগ্রহের দূর্বলতাকে স্পষ্ট করে তোলে। ফলে গল্পগুলোকে ছক-বাঁধা ও কৃত্রিম বলে মনে হয়। এসব লেখকের ভেতর কেউ কেউ অবশ্যই শক্তিমান।

    যে-ভঙ্গি, বিষয়বস্তু এস্টাব্লিস্মেন্টের প্রিয় শ্যামল তাকে পরোয়া করেন না। এস্টাব্লিস্মেন্টের নির্দিষ্ট কিছু থিয়োরি থাকে। সেই থিয়োরীর মাপের সঙ্গে পোষমানা লেখক মানিয়ে চলতে চান। এ থিয়োরী কখনো রুগ্ন বিকৃত মানসিকতাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে তোলে, আবার কখনো দেশকালের অনুপযোগী তত্ব-কে প্রকাশ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। শ্যামল এসব থিয়োরী মানেন না। তাই নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে আটকে রাখেন না তিনি।

    বাঙলা গল্পের প্রধান ধারা একদিন গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পদ্মাপাড় থেকে বিভূতি-মানিক-তারাশঙ্করের হাটে ঘাটে তার সাবলীল পদসঞ্চার। সে-ধারাই নতুন স্বাদে ও বিন্যাসে শ্যামলের গল্পে ধরা দিয়েছে। উপকরণের জন্য তাঁকে বানিয়ে-তোলা মানসিক সমস্যার কাছে হাজির হতে হয়নি।

    স্বাধীনতার আগে গ্রাম শহরে বিচ্ছেদ এখনকার মতো এমন প্রবল ছিল না। বেড়া ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু এপার-ওপার যাতায়াত খুব কঠিন হয়ে দেখা দেয়নি। এখন কলকাতার আধিপত্যে বাঙলা সাহিত্য থেকে গ্রাম প্রায় নির্বাসিত হতে চলেছে। গ্রাম জীবন নিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখা হয়ত চলছে আজও, কিন্তু তার স্পন্দনে স্বাভাবিকতা কমেছে। অথচ গ্রামের রঙ এখনো বাঙলার মানচিত্রের অনেকটাই দখল করে আছে। এ গরিষ্ঠ জনম-লীকে শ্যামল অস্বীকার করেন নি। তিনি সরাসরি তার ভেতরে ঢুকে পড়েছেন। এমন লেখকের পক্ষে এস্টাব্লিস্মেন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকা কঠিন।

    এখানে কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত করা হচ্ছে না যে গ্রাম-জীবন নিয়ে লিখলেই লেখা ভালো হবে। আসলে আমাদের শহরকেন্দ্রিক জীবন-বৃত্তের একটু বাইরেই বানিয়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় কোন অস্তিত্বই নেই। অথচ অসংখ্য ইচ্ছাশক্তি সেখানে ভালোমন্দের কাটাকুটি খেলে। এবং সব কিছুর কাটাকুটির পর হাতে থাকে মানুষ। এসব মানুষকে শ্যামল দেখেছেন নানাভাবে। কোনো অনুকম্পার চোখ দিয়ে নয়। গুরুমশায়ের ভঙ্গিতে শেখাতেও বসেন নি কিছু। অর্থনৈতিক কোনো শস্তা সমাধানেও পৌঁছোতে চান নি তিনি। যে-জবিনকে কেন্দ্রে রেখে মহাকাল অতি ধীরে পাশ ফেরে, শ্যামল নিস্পৃহ আবেগে তার আবর্তনকে ধরে রাখতে চেয়েছেন তাঁর লেখায়।

    ‘লক্ষণ তখনো দেখছিল, ছেচতলান নিচেই ঘন ঘাস হয়েছে। সবুজ আর বিনবিনে। সাদা ন্যাড়া উঠোনের লাগোয়া এই সবুজ জায়গাটুকুতে ঘরের চাল ধুয়ে নাগাড়ে বৃষ্টির জল এসে পড়ে। সেখানটায় মাথা দিয়ে সে শুয়ে আছে। চোখের পাশেই ঘাসের গোড়া। পরিস্কার দেকতে পাচ্ছিল লক্ষণ। সিধে সিধে সব ঘাস দাঁড়ানো। সবাই তার চোখের সমকক্ষ। সেই পরিমান লম্বা। ঘাসগুলো যে বাড়ছে তার আওয়াজও শুনতে পাচ্ছিল লক্ষণ।’ (লক্ষণ মিস্ত্রির জীবন ও সময়)

    শুনতে পান শ্যামলও। প্রাকৃতিক শক্তির মতো অনিবার্য জীবনপ্রবাহের স্বরগ্রাম তাঁর কানে পৌঁছোয় অনায়াসে। তাই নিস্পৃহবাবে লিখতে পারেন, ‘যখন এখানে এভাবে থাকতেই হবে তখন আর পাম্পসু খুঁজে লাভ নেই বুঝে যেকানে ছিল টিক সেখানেই ক্ষীরোদ একটুও না নড়ে বসে গেল। কোথাও অন্ধকারের ছিটেফোঁটা নেই। বাদা ভর্তি জ্যোৎ¯œা। ডোঙ্গার চড়ে পোড়ো গায়েন ইচ্ছে করলেই ফিরতে পারে এখন।’ (রাখাল কড়াই)

    এ নিস্পৃহতা কিন্তু একেবারেই লোকঠকানো। তাই দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়। অর্থাৎ ঠকে। শ্যামলের নিস্পৃহ নীলপর্দা সরিয়ে আগুনের গোলাগুলোকে চিনে নিতে সময় লাগে। অথচ একটু সরালেই দেখতে পাওয়া যাবে, দাক্ষী দুটি যুযুধান পুরুষকে বন্ধ দরজার বাইরে রেখে ‘পা’ গুটিয়ে অন্ধকার মেঝেয় ধামাটা খুঁজে বেড়াচ্ছে’ (দখল)। তার উন্মুখ প্রতীক্ষা সাপের সান্নিধ্য খুঁজছে।

    শ্যামলের গল্পে সাপ ঘুরে ফিরে দেখা দেয়। এ মসৃণ সুন্দর ভয়ঙ্কর সরীসৃপটি নানা পাকে পাঠককে জড়িয়ে ধরতে চায়। কোন এক অতলস্পর্শী রহস্য জীবন অথবা মুত্যুর রূপ ধরে দূরে যায়, আমাদের অন্ধ নিয়তি ! সাপের ছিলায় ভাগ্যের তীর কোন্ দিকে ছুটে যায় ?

    আর তার পাশেই থাকে ‘গত জন্মের রাস্তা’।

    শৈশবকে কেন্দ্রে রেখে দুটি পৃথক জীবনবোধের ধনুকে গুনপরানো সহজ নয়। সাপের ছিরাও সেখানে হার মানে। কিংবা সাপের চিলা বলেই হয়ত। শহুরে মন। এমন জীবন অস্বীকার তো করবেই। নব-ভালোবাসার বৃত্তে না ফিরলেও বাঘা কিন্তু ঠিক ফিরে আসে। কুকুর কিনা !

    শ্যামল ব্যঙ্গ করেন কম। করেন যখন, তখনো কাঠখোট্টা হতে পারেন না। নিপুণ শল্য চিকিৎসকের মতো তাঁর ছুরির ফলা কখন হৃদ্পি-ের গভীরে ঢুকে যায়, ঠাহর পাওয়া যায় না। অপারেশনের আগে অনুরাগের আরকে তিনি অ্যানাস্থাসিয়া সেরে নেন। তাই ‘গত জন্মের রাস্তা’য় নব’র চলে যাওয়া আর বাঘার ফিরে আসার মধ্যে কোনো চোখ বেঁধানো চমক থাকে না। প্রমীলাকে নিয়ে হাজরা যকন বাদা দিয়ে করো খরো চলে যায়, তখন ‘অন্য বছর এই সময় বাদায় এক হাঁটু জল থাকে। এখন প্রায় শুকনো। পৃথিবী তার নিজের সুখে মাঠ ঘাট ছাড়িয়ে ঠা-া খাচ্ছিল। চাঁদ তার পচন্দ মত জায়গা তেকে জ্যোৎ¯œা ঢালছিল। হাজরার পেছন পেছন প্রমীলা। সামনেই নবীনবাবুদের আবাদ। দুধারে শুঁটকো শুঁটকো ধান চারা। চরাচর জুড়ে ধামা-ওলাটানো কুয়াশায় ওরা মুছে গেল’। (অন্নপূর্ণা)

    প্রমীলা যাবে হিগ্গাড়ির বাজারে। রাতের বেলা ব্যাপারিদের কাছে দেহের মজুরি খেটে পয়সা এনে উপুসী স্বামী সন্তানকে খাওয়াবে সে। হাজরা তার চলনদার। অথচ এ-হাজরাই সীতাকু-ে যাবে না পাছে চোর সম্বন্ধীর সান্নিধ্যে এসে সে-ও চোর বনে যায়। জীবনের গভীর থেকে উৎসারিত এ ব্যঙ্গ। প্রচলিত কোনো হাস্যরসের কাপে একে এঁটে দেওয়া শক্ত।

    কত ধরণের মানুষ। প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে গল্প আছে। প্রত্যেকটি গল্প আলাদা। উপলব্ধি আলাদা। এক সমতলে বাস করেও বিভিন্ন জীবন ধাপে ধাপে উঠে গেছে। নেমে গেছে। সেখানে কখনো দেখা দেয় বিপিন। কখনো গনেশ। এই সব মানুষ পরিচিত দুঃখসুখের রঙ মেখে অপরিচিত হয়ে দেখা দেয়।

    আমাদের জামায় মোড়া ভদ্রতা থেকে মাত্র পনেরো মাইল দূরে এমন জীবন অজ¯্র ফলে আছে। সকালের পয়লা রেলগাড়ীতে তরিতরকারির সঙ্গে তার কিছু চালানও আসে কলকাতায়। ততক্ষণে অবশ্য তার রঙ যায় পাল্টে। প্যাকেটে গুঁড়ো মশলার কারি বানিয়ে তার টাটাকা স্বাদ পাওয়া তখন অসম্ভব। শ্যামল তাই সেই টাটকা স্বাদের কাছে আমাদের সোজা চালান দিতে চান। সরেজমিনে।

    পথগুলো কাছাকাছি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে দূরে দূরে চলে গেছে। কখনো কখনো একে অপরকে জড়িয়েও গেছে। সাপের মতন। সে-পথে শুধু হাজরা-প্রমীলা হাঁটে না। রিক্সা চালায় অমৃতও। অমৃত ভগবান দেখে বেড়ায়। ভগবান কোথায়? অমৃতের ভগবান কোনো গুহানিহিত তত্বে বাস করেন না। তার ভগবান প্রসারিত পৃথিবীতে, প্রকৃতির আলোছায়ায় বিছিয়ে থাকেন। চন্দনেশ^রের মাচানতলায় গিয়ে ‘অমৃত দেখল এখানে ভগবানের কোন শেষ নেই। যতই এগোয় ততই বেড়ে যায়। মনটা কিসে তরে যাচ্ছে। … বাতাসে কিসের সুবাস। … অমৃত একবার ফিরে তাকাল। পেছনেও সেই একই ছবি। হলুদ ফুল। গুঁড়ো গুঁড়ো পরাগ-মাখানো কেশরগুলি ফুরের লাল জন্মভূমি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভোরের বাতাসে দুলছে। মাচানের পর মাচান ফেলে এসেছে অমৃত। তার শেষে রিক্সাখানা কত ছোট দেখাচ্ছে। সিটে সাদাপানা একটা মানুষ বসে। ধুতি পাঞ্জাবি পরেছে। এখান থেকে কুচো-পাখির চেয়ে ছোট দেখাচ্ছে শ্যামলবাবুকে। মানুষটা বড় ভাল। তাঁর জন্যেই ওর আজ এখানে আসা হল’। (চন্দনেশ^রের মাচানতলায়)

    সহজ সুন্দর সহাস্য ভগবান অমৃতকে দেখা দেন এমন আয়োজনহীন অবহেলায়। মন্ত্রের মতো অমোঘ তার আবেদন। অথচ অমৃতের শ্যামলবাবু কিন্তু যাতয়াতে ষোল মাইল বিনে ভাঢ়ায় ওই রিক্সায় চড়ে পটলের চাষীদের দাদান দিতে গেছেন।

    এখানেই শ্যামলের জিৎ। তিনি ইচ্ছে করলেই দূরে বসে থাকতে পারেন। অকুস্থল থেকে তাঁকে হয়ত কুচো-পাখির থেকেও ছোট দেখায়। তাই বলে তিনি কখনো মিলিয়ে যান না। চলমান জীবনের দ্রুতমন্থর ছবি তাই তাঁর ফ্রেমে ধরা পড়ে অনায়াসে। প্রবহমান ¯্রােত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেন বলেই তাঁর তট-স্থ দৃষ্টি এমন গভীরতায় পৌঁছে যেতে পারে।

    ‘এ জীবন কলকাতা থেকে খুব দূরে নয়। মাত্র পনেরো মাইল। আমার জন্য এই পৃথিবীটুকু আলাদা করা ছিল। ইস্ জীবনের কতখানি ব্যয় করার পর তবে আমি এলাম। আগে যদি জানতাম সবাই একে একে খসে যাবে। শেষ অবধি ওই শিরীষ গাছের ছায়াটুকু এত আপন মনে হবে’। (কন্দর্প)

    ঈশ^রের তাড়াহুড়ো নেই। একেকটি প্রাণ মাখানো পৃথিবী তৈরি করতে তিনি কাটিয়ে দিতে পারেন অনন্তকাল। তাকে ইচ্ছে দিয়ে মুড়ে দিতেও সময় লাগে অনেক।

    শ্যমল সেই ইচ্ছেটুকু খুঁজে পেয়েছেন। তাই পৃথিবীর রহস্যের কাছে পায়ে হেঁটে যেতে তাঁর দ্বিধা নেই। আর এ জন্যেই তাঁর বিস্ময় কখনো শেষ হতে চায় না : ‘তুই কে দাক্ষী ? তুই আসলে কে?’

    এ জিজ্ঞাসা সন্তোষ টাকির। হয়ত শ্যামলের। এবং আমাদেরও।৪

    ১. ঔপন্যাসিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়: আলোকিত মুখচ্ছবি: গোলাম মুরশিদ: অবসর, ফেব্রুয়ারি ২০১৭। পাতা- ১২২।

    ২. সন্দিপন চট্টোপধ্যায়ের ডায়েরি: অদ্রীশ বিশ^াস সম্পাদিত: প্রতিভাস, কলকাতা: পাতা-১৫৭

    ৩. সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডায়েরি: সম্পাদনা- অদ্রীশ বিশ^াস: প্রতিভাস, কলকাতা: পাতা- ১৯২
    ৪. শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প (ভূমিকা): ড. বিষ্ণু বসু: শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পসংগ্রহ: তিন সঙ্গী, কলকাতা, এপ্রিল ১৯৮০।

  • ধর্মতলার চা

    মামা! তিনটা মালাই চা দিবেনতো।
    জ্বি মামা বসেন দিতাছি।
    শত ব্যস্ততার মাঝে কথাটা যিনি বলছিলেন তিনি ধর্মতলার ইয়াকুব মোল্লা। সবার কাছে পরিচিত ইয়াকুব মামা নামেই।
    খুলনা রেলওয়ে স্টেশন। তখন ঘড়ির কাটা ঠিক বিকাল চারটা। ট্রেন চলতে শুরু করলো…ঝক ঝক শব্দে উদ্দেশ্য যশোর শহর এক পলক দেখা। সাথে  সাইমুম, বায়জিদ এবং অামি। সময় বিকাল ৫.২০ মিনিট। যশোর স্টেশনের মনোরম প্রকৃতি অামাদের স্বাগত জানালো। প্রকৃতির শুভেচ্ছা সাদরে গ্রহণ করলাম কিন্তু অাসলে অামরা কোথায় যাবো কেউ জানিনা। ধর্মতলার চা

    তৈয়েবুর তামিম
    মামা! তিনটা মালাই চা দিবেনতো।
    জ্বি মামা বসেন দিতাছি।
    শত ব্যস্ততার মাঝে কথাটা যিনি বলছিলেন তিনি ধর্মতলার ইয়াকুব মোল্লা। সবার কাছে পরিচিত ইয়াকুব মামা নামেই।
    খুলনা রেলওয়ে স্টেশন। তখন ঘড়ির কাটা ঠিক বিকাল চারটা। ট্রেন চলতে শুরু করলো…ঝক ঝক শব্দে উদ্দেশ্য যশোর শহর এক পলক দেখা। সাথে  সাইমুম, বায়জিদ এবং অামি। সময় বিকাল ৫.২০ মিনিট। যশোর স্টেশনের মনোরম প্রকৃতি অামাদের স্বাগত জানালো। প্রকৃতির শুভেচ্ছা সাদরে গ্রহণ করলাম কিন্তু অাসলে অামরা কোথায় যাবো কেউ জানিনা।
    মামা! অামরা এই প্রথম যশোর অাসছি এখানে উল্ল্যেখযোগ্য কিছু অাছে যেমন: দর্শনীয় স্থান বা বিখ্যাত খাবারের কিছু? স্টেশনের পাশের দোকানীর কাছে প্রশ্নটা ছিলো বায়জীদের। দোকানী মামার সাদামাঠা উত্তর ‘না মামা এখানে তেমন কিছু নাই যা অাছে সব বহুদুরে। তবে ধর্মতলায় বিখ্যাত চা অাছে সেখানে যেতে পারেন’
    -সাইমুম দোকানী মামাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিক্সা ভাড়া করলো। এবার উদ্দেশ্যটা ধর্মতলা। বিখ্যাত চা পান করা।
    মামা! তিনটা মালাই চা দিবেনতো।
    মামা! বসুন দিচ্ছি।
    শত ব্যস্ততার মাঝে কথাটা যিনি বলছিলেন তিনি ধর্মতলার ইয়াকুব মোল্লা। সবার কাছে পরিচিত ইয়াকুব মামা নামেই।
    যশোর শহরের ধর্মতলা এলাকায় তাঁর চায়ের দোকান। দোকানের নাম ‘ইয়াকুব টি স্টোর’। রাস্তার ঠিক পাশেই প্রায় চার হাত বাই অাট হাতের একটি ঘর। এই ছোট্ট ঘুপছি ঘরটিই এখন যশোর শহরের সবচেয়ে পরিচিত চায়ের দোকান।
    স্বল্প পুঁজি, তাই ছোট্ট ঘর। ঘর ছোট হলে কী হবে? কাস্টমারের কিন্তু কমতি নেই। চা বানাইতে দিনে প্রায় ২৫ কেজি দুধ লাগে তার।
    সদালাপী, বিনয়ী আর হাসিমাখা মুখ নিয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষটি সদা ব্যস্ত চা বানাতে আর সরবরাহ করতে। সাথে ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা অার এই পুরো সময়টা তাকে যিনি সময় দিয়ে যাচ্ছেন তিনি হলেন তার সহধর্মীনি।
    চা বানানোর প্রস্তুতিটাই একটু অন্যরকম। শতব্যস্ততার মধ্যেও সুন্দর করে চায়ের কাপ গুলো পরিষ্কার করা হয় যাতে কেউ তার দূর্নাম গায়তে না পারে তারপর  সারিবদ্ধ কাপগুলোতে ঢালা হয় গাভীর দুধ, এরপর মামা ঘন কালো লিকার এমন ভাবে প্রতিটা কাপে ব্যালেন্স করে ফেলতে থাকেন; দেখে মনে হয় ফোটায় ফোটায় লিকারের সাথে দুধের এক ধরনের সখ্যতা তৈরি হচ্ছে। ধীরে ধীরে এই সখ্যতা মিত্রতায় রূপ নেয়। আর এভাবেই লিকার আর দুধ এর এক গভীর আত্মীয়তায় তৈরি হয় যশোরের ধর্মতলার চা।
    স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ সব মিলিয়ে মননে একধরনের চাঞ্ছল্য তৈরি করে ধর্মতলার এই চা। দুধের রঙ ধীরে ধীরে সাদা থেকে অফ হোয়াইটের দিকে যেতে থাকে। বিকেলে একটু ভিড় তুলনামূলক কম থাকে তবে সন্ধার পরের চিত্র ভিন্ন। রাতের প্রহর বাড়ার সাথে সাথে দুধের লাল রঙ এর এক্সপোজার শুরু হয়, চা এর কাপে শুরু হয় ভৈরবী রাগ এর মাতোম।
    চা এ চিনি বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে রাত। আর দোকানের সামনে বাড়তে থাকে জনমানুষের ভীড়।
    জনমানুষের ভীড়কে দূরে ঠেলে সেখান থেকে অামাদের খুলনার উদ্দ্যেশে রাত ৮ টার ট্রেন ধরা। সুন্দর একটি উদ্দ্যেশ্যহীন যাত্রা এমন একটি গল্পেরূপ নেয় যা স্মৃতিপটে লেপ্টেথাকবে বছরের পর বছর। রাত ৯.৩০ এ নিউমার্কেট পৌঁছালাম সেখান থেকে সোনাডাঙ্গা  তারপর তিনজনের উদ্দেশ্য তিনদিকে বেড়িয়ে পড়া…
    মামা! অামরা এই প্রথম যশোর অাসছি এখানে উল্ল্যেখযোগ্য কিছু অাছে যেমন: দর্শনীয় স্থান বা বিখ্যাত খাবারের কিছু? স্টেশনের পাশের দোকানীর কাছে প্রশ্নটা ছিলো বায়জীদের। দোকানী মামার সাদামাঠা উত্তর ‘না মামা এখানে তেমন কিছু নাই যা অাছে সব বহুদুরে। তবে ধর্মতলায় বিখ্যাত চা অাছে সেখানে যেতে পারেন’
    -সাইমুম দোকানী মামাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রিক্সা ভাড়া করলো। এবার উদ্দেশ্যটা ধর্মতলা। বিখ্যাত চা পান করা।
    মামা! তিনটা মালাই চা দিবেনতো।
    মামা! বসুন দিচ্ছি।
    শত ব্যস্ততার মাঝে কথাটা যিনি বলছিলেন তিনি ধর্মতলার ইয়াকুব মোল্লা। সবার কাছে পরিচিত ইয়াকুব মামা নামেই।
    যশোর শহরের ধর্মতলা এলাকায় তাঁর চায়ের দোকান। দোকানের নাম ‘ইয়াকুব টি স্টোর’। রাস্তার ঠিক পাশেই প্রায় চার হাত বাই অাট হাতের একটি ঘর। এই ছোট্ট ঘুপছি ঘরটিই এখন যশোর শহরের সবচেয়ে পরিচিত চায়ের দোকান।
    স্বল্প পুঁজি, তাই ছোট্ট ঘর। ঘর ছোট হলে কী হবে? কাস্টমারের কিন্তু কমতি নেই। চা বানাইতে দিনে প্রায় ২৫ কেজি দুধ লাগে তার।
    সদালাপী, বিনয়ী আর হাসিমাখা মুখ নিয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষটি সদা ব্যস্ত চা বানাতে আর সরবরাহ করতে। সাথে ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা অার এই পুরো সময়টা তাকে যিনি সময় দিয়ে যাচ্ছেন তিনি হলেন তার সহধর্মীনি।
    চা বানানোর প্রস্তুতিটাই একটু অন্যরকম। শতব্যস্ততার মধ্যেও সুন্দর করে চায়ের কাপ গুলো পরিষ্কার করা হয় যাতে কেউ তার দূর্নাম গায়তে না পারে তারপর  সারিবদ্ধ কাপগুলোতে ঢালা হয় গাভীর দুধ, এরপর মামা ঘন কালো লিকার এমন ভাবে প্রতিটা কাপে ব্যালেন্স করে ফেলতে থাকেন; দেখে মনে হয় ফোটায় ফোটায় লিকারের সাথে দুধের এক ধরনের সখ্যতা তৈরি হচ্ছে। ধীরে ধীরে এই সখ্যতা মিত্রতায় রূপ নেয়। আর এভাবেই লিকার আর দুধ এর এক গভীর আত্মীয়তায় তৈরি হয় যশোরের ধর্মতলার চা।
    স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ সব মিলিয়ে মননে একধরনের চাঞ্ছল্য তৈরি করে ধর্মতলার এই চা। দুধের রঙ ধীরে ধীরে সাদা থেকে অফ হোয়াইটের দিকে যেতে থাকে। বিকেলে একটু ভিড় তুলনামূলক কম থাকে তবে সন্ধার পরের চিত্র ভিন্ন। রাতের প্রহর বাড়ার সাথে সাথে দুধের লাল রঙ এর এক্সপোজার শুরু হয়, চা এর কাপে শুরু হয় ভৈরবী রাগ এর মাতোম।
    চা এ চিনি বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে রাত। আর দোকানের সামনে বাড়তে থাকে জনমানুষের ভীড়।
    জনমানুষের ভীড়কে দূরে ঠেলে সেখান থেকে অামাদের খুলনার উদ্দ্যেশে রাত ৮ টার ট্রেন ধরা। সুন্দর একটি উদ্দ্যেশ্যহীন যাত্রা এমন একটি গল্পেরূপ নেয় যা স্মৃতিপটে লেপ্টেথাকবে বছরের পর বছর। রাত ৯.৩০ এ নিউমার্কেট পৌঁছালাম সেখান থেকে সোনাডাঙ্গা  তারপর তিনজনের উদ্দেশ্য তিনদিকে বেড়িয়ে পড়া…
  • পূর্ণজ্ঞান সূত্র

    পূর্ণজ্ঞান সূত্র

    চিরকাল মনে করি একটি আকাশ আমাদের আছে
    অতি দূরে নয় , অতি কাছেও নয়, অস্তিত্ব রয়েছে
    বহুকাল আকাশ দেখা হয় নি, অনেকের দেখা হয় নি
    আমি গরমের রাতে চিৎ হয়ে ছাদে শুয়ে আকাশ দেখে
    খুব বোকা হয়ে ভাবি, এতো তারা ভরা আকাশটা নিজের
    তবু আমি ক্যানো প্রতি রাতে নিয়ম করে আকাশ দেখি না
    ভাবলেই অবাক হয়ে ভাবি, গত রাতেও আকাশে নক্ষত্র ছিলো
    কেউ দেখেছিলো, কেউ কেউ উঠোনে মাদুর পেতে
    একসাথে আকাশ দেখে অনেক নক্ষত্রের নাম বলে পুরুষের বুকে
    মেয়েটি আকাশ এঁকে অনেক নক্ষত্র বসিয়ে মুখ ঘষে বলেছিলো, তুমি আমার আকাশ হবে?
    এ ভাবে কেউ কেউ কোনো কোনো রাতে কারো কারো আকাশ হয়ে যেতে পারে
    লাভ ক্ষতি কিছু নেই, আমিও পাহাড়ে উঠে এক রাতে
    ওই একটাই আকাশ একই লম্ব ও কৌণিক দূরত্বে দেখে এ কথা ভেবেছি
    আকাশ থেকে মানুষের সরল দৃষ্টির দূরত্ব একই সমান থাকে।
    তারাগুলি একই ভাবে সবখানে একই দূরত্বে আলো দেয়
    আমি যতো উপরে গিয়েছি, আকাশ আমার কাছ থেকে সমান দূরে চলে গেছে
    সারস পাখি দেখেছি অনেক, সিন্ধুসারস কোথা থাকে
    অথবা আমাদের বিলের সারসগুলি কোথায় বাস করে
    দেখি নি কখনো, পথের মানুষের বাড়ি কোনখানে কে ভাবে এতোটা ?
    এসব নিয়ে চিন্তা করার মানুষ আলাদা,
    ভাবনা ক্ষনেক হলেও চিন্তার পথ, অনেক চিন্তা করে চলে
    অবিরত চিন্তাগুলি সামনে গিয়ে বাঁক বদলাতে পারে
    আমিও হয়তো চিন্তা করি কিছুটা সময়, ভালোবাসি
    কিছুটা সময়, কাজ করি কিছুটা সময়, ঘুমের ভেতরে স্বপ্ন দেখি কিছুটা সময়
    সব মিলে একাকার একটা জীবন সারসের বাড়ি না চিনে মরে যেতে পারে
    অপূর্ণতা চিরকাল পূর্ণতা পাবার আশা করে কি করে না
    এ কথাও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারে না,
    খন্ডে খন্ডে মানুষের সব কিছু একটি এককে নিলে মনে হয়
    সকল অভিজ্ঞতা সেলাই করে একটি একক পূর্ণতা পায়
    অথচ ভালো করে ভেবে নিলে অপূর্ণতাই পূর্ণ জ্ঞান মনে হয়।

  • ম্যাজিক মেডেল

    মাহফুজা নামটির প্রতি কি যেন এক সান্ধ্যকালীন ছাতিম সন্ধ্যার দরদ আজীবন চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ে। শুধু আদর কেন? যখন কবিতার লাইন হয়ে ওঠে মাহফুজার প্রেম ও বন্দনার একমাত্র শব্দ তখন অন্য এক আবহ তৈরি হয় আজীবন।

    ‘মাহফুজা তোমার শরীর আমার তসবির দানা
    আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়।’
    কিন্তু আজ হঠাৎ মাহফুজা নামের ওপর আরশ হতে কি এক লানত বর্ষিত হতে থাকে! অথচ মাহফুজা যখন এসএ ফেডারেশনের প্রশিক্ষণে ঢুকছিল তখনও ওর মন ছিল চনমনে। শরীর ছিল ঝরঝরে। ও সকালে ঘড়ি ধরে এক ঘন্টা ঘাম ঝরিয়ে হেঁটেছে আজ। যদিও অন্যদিন ঘরোয়া প্রশিক্ষণের সময় সকালে আলাদা করে হাঁটতে বের হয় না। কিন্তু এখন ওর ছিল বাড়তি মনোযোগ। যে করেই হোক ওকে ডিঙোতে হবে বাঁধার প্রাচির!
    অনুশীলনের পুরো সময়টা জুড়েই ছিল আলাদা রকম কারসাজি। মনের ওপর চাপবিহীন ভার মুক্ত অবস্থায় ও অনুশীলন করেছে এবং সর্বক্ষেত্রেই ও হায়েষ্ট স্কোর নিয়ে প্রশিক্ষকদের হাসিমুখের জবাবে প্রতিবারই হাসিমুখ দেখাতে পেরেছে। ও প্রায় সিওর। অলিম্পিকে যাচ্ছে অভয়কন্যা মাহফুজা।
    কিন্তু শেষ মূহুর্তের কানাঘুষাÑ ‘মাহফুজা বুড়িয়ে গেছে’! ওর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ওর বাঁধহীন চক্ষু মাধবকুন্ড জলপ্রপাত আনে। ছলাৎ ছলাৎ গড়িয়ে পড়ে অভিমানের- কষ্টের- লজ্জ্বার- অশ্রু। ওর চিরচেনা কবিতার লাইনগুলো কুকড়ে যায়!
    ওর খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ও এ কথাও জানে, কান্না করবার মত বিশ^স্ত একটি কাঁধ লাগে। যেটি এই মূহুর্তে ওর কাছে নেই। তবে ওর ইদানীং কান্নার জন্য কাঁধ লাগে না। আর কান্নার মাধ্যমে সে নিঃস্ব হয় না। বরং শক্তিশালী হয়। শক্তি সঞ্চয় করে। ইদানিং কান্নার জন্য ধাতব পদার্থই যথেষ্ট। রক্তমাংসের কাঁধের যে বড় অভাব! তাই ধাতব পদার্থের তৈরি মেডেলটা ধরেই তার কান্নার আয়োজন শুরু হয়। শেষ হয়। মেডেলের কথা মনে আসতেই ওর চোখে হাজার ঝরনা সিরিয়াল দেয়। হাজির হয়। ১৯৯৯ সালে পাওয়া শিশু একাডেমীর প্রতিযোগিতায় জীবনের প্রথম বড় মেডেল। এটি শুধু সোনার একটি ধাতব মেডেলই ছিল না। বরং সেটি ছিল ওর জীবনের মোড় ঘোরানোর ম্যাজিক মেডেল। লড়াই করা শিখতে পারার মেডেল। যুদ্ধ যুদ্ধ জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়ার মেডেল। যুদ্ধে জয়ী হবার মেডেল। সব মিলিয়ে জীবনটার প্লাটফ্রম চেঞ্জ করার মেডেল। সেটি ধরে সে তার কান্নার শখ মেটাতো। কান্নার দুঃখ ঘোঁচাতো। কান্নার তৈজস আঞ্জাম দিতো। সে মেডলটির কথা মনে হতেই আবার মাহফুজার চোখে বাণ ডাকে। শত চেষ্টাতেও জীবনের প্রথম পাওয়া মেডেলটি ও আর ফিরে পাবে না। কারণ তার মা করিমুন্নেসা বাধ্য হয়ে মেডেলটি বিক্রি করে দিয়েছেন। বাবা আলী আহমেদ গাজী অসুস্থ হয়ে খুলনার হাসপাতালে জীবন মৃত্যূর সন্ধিক্ষণে পড়ে ছিলেন দীর্ঘদিন। বাবার চিকিৎসার টাকা যোগাড় করতে যেয়ে মা হিমসিম খেয়েছেন। অবশেষে বাধ্য হয়েই মেয়ের জেতা জীবনের প্রথম পথ প্রদর্শক পরশ পাথর হীরক খ-ের ওজ্জ্বল্যে বিচ্ছুরিত সোনার মেডেলটি বিক্রি করে দিয়েছেন।
    খবরটি প্রথম শুনে মাহফুজা বাকরুদ্ধ হয়ে অনেক কান্না কাটি করে। পরে সে এক সময় টের পায় যদি মায়ের কাছে তখন তার বিশেষ কারো দেয়া কোন লকেটও থাকতো কিংবা ছবির ফ্রেম। সেটিও বেঁচতে মায়ের কুণ্ঠা হতো না। কারণ সবকিছু ছাড়িয়ে বাবার সুস্থতা ছিল মায়ের কাছে সবচেয়ে আকাক্সিক্ষত। সে জানে জীবন সব কিছুকেই হার মানিয়ে ছুটে চলে তারই নির্ধারিত গন্তব্যে। জীবন সাহিত্যকেও হার মানায়। ও কয়েকদিন আগে একজন বিখ্যাত লেখকের একটি উপন্যাস পড়ছিলো। সেখানে ও দেখেছিল নায়িকার মা কিভাবে তার অভাবের সংসারে তার প্রথম প্রেমিকের দেয়া সোনার ছবির ফ্রেমটি অবলীলায় পানির দরে বিক্রি করে তার সন্তানের চিকিৎসা করেছিল। যখন মাহফুজা উপন্যাসটি পড়ছিলো, তখন তার মধ্যে এক ধরনের ক্ষরণ হচ্ছিল। জীবন কি এতটা নিষ্ঠুর!
    কিন্তু বাস্তব জীবনে যখন ওর নিজের মেডেলটি বিক্রি হবার কথা শুনলো ততক্ষণে ও বেশ খানিকটা ধাতস্থ হয়েছে, নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। ওর দুঃখ কিছুটা হলেও লাঘব করেছে ওর পঠিত উপন্যাস। ওর পঠিত উপন্যাসের সাথে আগেই ভাগ করে নিয়েছিল ওর বোধের গভীরতা। তাই উপন্যাসটি পড়ে তখন ওর যতটা কষ্ট হয়েছিল, তার মেডেল বিক্রির দুঃখের ভার ততটা হয় নি। ও আগেই যেহেতু উপন্যাস পড়াকালীন সময়ে সেটি পেয়েছিল তাই সহজেই মেডেল হারানোর দুঃখ নিজে নিজে সামলে নেয়। কারণ জীবনের অপর পৃষ্ঠা- অন্য রূপের নামই তো সাহিত্য!
    তাছাড়া চিকিৎসা বলে কথা! বাবা না থাকলে কি কখনো কোনদিন ওর পক্ষে এখানে আসা সম্ভব ছিল। ও বাবার অসুস্থতা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়ে। বাবার চেয়ে কি মেডেলের গুরুত্ব তার কাছে বেশি! বাবা যদি সুস্থ হয়ে ওঠে তো সে আবার এ রকম সোনার মেডেল দেশ বিদেশ থেকে বহুবার বহুভাবে অর্জন করতে পারবে।
    মেডেলের কথা মনে আসতেই আবারও ওর বর্তমান ছিটকে পড়ে শৈশবের ঝিনুক মুঠোয়। সেখানে বহুবর্ণিল সংগ্রাম আর কষ্টের ঝিলিকে নিজেকে আবার ঝলসে নেয়। ওর জন্ম হয়েছিল যশোরের অভয়নগরের এক কৃষক পরিবারে। বাবা একজন সামান্য বর্গাচাষী। মা বাবা, পাঁচটি ছেলেমেয়েসহ নিজেরা দুজন। মোট নয়জনের সংসার চালাতে বাবা সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। সেখানে বড় মেয়ে মাহফুজা হতে চায় সাঁতারু। গ্রামবাসীর চোখে যা গরিবের ঘোড়া রোগ। আহলাদ!
    যেখানে আজীবন মেয়েরা গোসল সারে পর্দার ঘেরাটোপে। সেখানে এই মেয়েটা আঁটসাঁট হাফ- প্যান্ট, গেঞ্জি পড়ে হদ্দমদ্দ হয়ে সাঁতার কাটে পুকুরে। সারা গ্রাম রাষ্ট্র হয়ে গেল। মেয়ে কোথায় যায়, না যায়। ছেলেদের মত ছোট করে চুল ছাটে। বুক উঁচু করে হাঁটে। হাতের পেশি ছেলেদের মতো, পায়ের মাসল ছেলেদের মতো, বুকের গভীরে ছেলেদের রেখা! বলে কি- এই মেয়েকে কে বিয়ে করবে?
    সেটাই মাহফুজার কাছে শিকল ভাঙার গান! সামাজিক বঞ্চনা আর দারিদ্রের মহাসাগর পাড়ি দিয়ে তাঁকে হতে হবে সাঁতারু। সাঁতারের মধ্যেই সে খুঁজে পায় প্রাণ। খুঁজে পায় জীবনের ঘ্রাণ! এর জন্য অভয়নগর থেকে প্রতিদিন আঠার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নওয়াপাড়া শহরে এসে শুরু হলো নতুন অভিযান। শুরুটা ছিল লুকোচুরি করেই। খেলাধুলা- সাতারের পোশাক ট্রাউজার- টি শার্ট গায়ে জড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর কোন উপায় নেই। তাই সাধারণ পোশাক পরেই চলতে থাকলো অভয়নগর টু নওয়াপাড়া সাঁতার অভিযান। তবুও কি থেমে থাকে গ্রামের মানুষের কটু কথার অমানিশা?
    মেয়ে কোথায় যায় রোজ ব্যাগ ঘাড়ে করে? খোঁজ খবর রাখো না কি, শিলার বাপ?
    শিলা মাহফুজার ডাক নাম। বাবা মা তাকে আদর করে শিলা নামেই ডাকে।
    হ, জানি তো। মেয়ে আমার সাঁতার শিখে।
    ও বাবা! সে ডলফিন নাকি? সারাদিন পানিতে ভিজে থাকে? এই গ্রামের মেয়ে হয়ে অর্ধ উলঙ্গ সেজে সাঁতার শিখবে? এ রকম চলতে পারে না। মেয়েকে ঠেকাও। এ রকম বেপরোয়া চলতে থাকলে তোমার মেয়েকে তো বিয়ে দিতে পারবা না। সমাজ নষ্ট হবে। কে বিয়ে করবে তোমার ঐ পুরুষালি মেয়েকে?
    মেয়ে আমার এখনো ছোট। এখনি ওর বিয়ের কথার কি হলো?
    কি কথা বলো মুখে মুখে শিলার বাপ? মেয়ে এখন ছোট তা বড় কি হবে না? তাকে কি বুড়ি বানাতে চাও?
    মেয়ের আমার সাঁতার শেখার ইচ্ছে। সবার তো সব রকম ইচ্ছা থাকে না। তাছাড়া…
    গ্রামের নানা জনের নানান কথা- প্রশ্নের মধ্যে আলী আহমেদ গাজী খেঁই হারিয়ে ফেলেন।
    নানান কথার মাঝেই তার মনে হয় নিজের জীবনের কথা। শৈশবে সেও ভাল হা-ড-ুডু খেলতো। তারও ইচ্ছে ছিল দিগি¦জয়ী খেলোয়াড় হবার। কিন্তু কঠিন জীবন তাকে তার স্বপ্নের দুয়ার খুলতে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই তো সে তার লড়াকু মেয়েটার দু’চোখের স্বপ্ন পড়তে পারে। স্বপ্নের মাঠে হেঁটে বেড়ায়। পূর্ণতা দিতে চায়। সে বুঝতে চায়, যে কোন মূল্যে তার লড়াকু মেয়ের স্বপ্নের দরজায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব তার। তাই তো সে গ্রামের মুরব্বীদের অকারণ নানা প্রশ্নের জবাব দেয়, আবার দেয়ও না। এ কান দিয়ে শোনে আর ও কান দিয়ে বের করে দেয়। খুঁজতে থাকে অন্য পথ। এ ভাবে বাড়ি থেকে আসা যাওয়া সম্ভব নয়।
    তাই তো ওর জন্মদাত্রী মা- বাবা বেঁচে থাকতেও ওর আশ্রয় হলো এতিমখানায়। বেচে বর্তে থাকা মা বাবাকে ছেড়ে জায়গা করে নিতে হলো অনাথ আশ্রমে। ও নিজের কাছেই নিজে কৈফিয়ত দেয়। স্বপ্ন পূরণের জন্য মানুষ কত ত্যাগই তো করে। যে নারী অন্দরমহল ছেড়ে পথে নামে, সেই জানে তাকে ঠিক কতটা বাঁধন ছিড়তে হয়! আর এ তো মাত্র বাবা মা থাকতেও অনাথ আশ্রমে জায়গা পাওয়া! কে দেবে তাকে এইখানে থাকা খাওয়ার খরচ। কে দেবে তাকে নিরাপত্তার চাদর। কারণ এ সমাজ পারতপক্ষে কাউকে নিরাপত্তা দেয় না। খুবলে খায়। এক মূহুর্ত সময় পেলে খুবলে খায়। এই তো মাত্র সেদিন। মেধাবী এম. এ পাশ রুপা। মেধাবী রুপা। ঢাকায় একটি এনজিওতে চাকরিরত রুপা শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে ফেরার পথে বাসের মধ্যেই খুন হয়। রুপা নামের মেধাবী, শিক্ষিত নারী শরীরটি চলন্ত বাসেও অরক্ষিত হয়ে খুন হয়েছে। শুধু কি খুন! তার আগে তাকে ধর্ষণ করেছে হেলপার, কনডাকটর, ড্রাইভার। তখনও কিন্তু সে বাঁচার জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছিল। চেষ্টা করেছিল। তার কাছে থাকা দামী মোবাইল ফোন এবং নগদ পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ করেছিল। হাতে পায়ে ধরেছিল। (এই কথাগুলো পরে আসামীরা নিজেরাই আদালতে স্বীকার করেছে।) কিন্তু তারা তা শুনবে কেন? এই তো আমাদের সমাজ। মাহফুজা ভাবে আর নিজেকে প্রবোধ দেয়। কেঁদো না, মাহফুজা! বেঁচে যে আছো এর জন্য শুকরিয়া আদায় করো। এই সমাজ যে অন্তত তোমাকে বেঁচে থাকতে দিচ্ছে! তুমি তো মানুষ নও। জীবন্ত ডলফিন! যে পানিতে উপুড় হয়ে বাঁচতে চায়! জীবন চায়!
    তো এত ত্যাগ, এত সংগ্রাম বৃথা যাবার নয়। সাফল্য ধরা দেয় জালে মাছ আটকে পড়বার মতো আনন্দে। ঢাকায় ১৯৯৯ সালে শিশু একাডেমী আয়োজিত আন্তজেলা মহিলা সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন হলেন মাহফুজা। জয় করলেন সোনার মেডেল। বয়স তখন মাত্র নয় বছর। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতার কারণেই তাকে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) সাঁতার প্রশিক্ষণে ভর্তির সুযোগ করে দেয়। সেই জলভরা সাঁতারের সমুদ্রে মাহফুজা সাঁতরায় আর ভাবে- আহা! জলপূর্ণ সাঁতারের নদীতে সাঁতার কাটবার মত জলহীন এক ঝাঞ্ঝ্্ার জীবন সাগরে সাঁতরানো এত সহজ নয় কেন?
    সব ঠিকঠাক। কিন্তু ভর্তির টাকা? কে দেবে তাকে এত টাকা? জলপূর্ণ সাঁতারের এত পানির মতো জীবনের সাতারে এত পানির অভাব কেন?
    না! জোয়ারের পানি যেমন নির্ধারিত সমুদ্রের পানির সকাল সন্ধ্যা বৃদ্ধি ঘটায় সে রকম জীবন নদীতেও কি কখনো সময় মেপে মেপে জোয়ার কিংবা শুকনো নদীতে ঢল ঢল করে উছলে ওঠে জোয়ারের পানি? নাকে মুখে ঢোকে অন্তহীন। হাবুডুবু খায়। তারপর সব কিছুর মধ্যে থিতু হয়ে ভাসতে থাকে সে উচ্ছ্বল পানির বন্যায়? হ্যাঁ। কখনো সখনো। তাই তো জীবন এতো মধুর। জীবন এতো সাফল্য মন্ডিত! জীবন এতো ব্যাপক! জীবন এতো অর্থময়!
    চাচা চিন্তা করবেন না। শিলার ভর্তির টাকা আমি দেবো। বিকেএসপি তে ভর্তি হতে কত টাকা লাগবে, চাচা?
    কি বলো বাবা? তুমি দেবে আমার শিলার ভর্তি খরচ?
    হ্যাঁ চাচা। শুধু ভতির্র খরচ নয়। আমি ওর যাবতীয় খরচের ভার নিতে চাই।
    কি বলে যে তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাবো, বাবা। মহাচিন্তায় ছিলাম।
    কোন কৃতজ্ঞতা নয় চাচা। এতো আমাদের দায়িত্ব। শিলার মত এ গ্রামের হাজারো মেয়ে আমার গার্মেন্টস এ সেলাই করে সুঁইতে সুতো ভরে জীবন পার করে দিচ্ছে। সেখানে আমাদের শিলা যদি সাঁতরে আমাদের গ্রামের, আমাদের জেলার, আমাদের বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারে তো আমরা হবো সত্যিকার অর্থেই গর্বিত।
    সেই থেকে শিলার জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা। কিন্তু এখানেও আসে কত রকম নোংরামি। কত রকম কুৎসা?
    ফেরদৌসের কি এমন লাভ আছে আলী আহমেদের মেয়ের পড়ার খরচ যুগিয়ে? আর মেয়েই বা এইখান ছেড়ে, যশোর ছেড়ে ঢাকায় থাকে? কি এমন কাজ তার? ঢাকায় মেয়ে কি করে? আরও কত কি?…
    সময় এক সময় শান্ত হয়!
    যখন সে ২০০৩ এর বয়সভিত্তিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতে নেয়। জিতে নেয় জাতীয় প্রতিযোগিতায় জ্যেষ্ঠ সাঁতারুদের পেছনে ফেলে।
    টিভির স্ক্রীনে দশমুখে হেসে ওঠে মাহফুজা। যখন হেসে ওঠে তার হাতের ফুলের গুচ্ছ, হেসে ওঠে তার গলার সোনার মেডেল, হেসে ওঠে তার চুলের গুচ্ছ, চোখের দ্যুতি এবং দাতের হীরক। তখন হেসে ওঠে তার গ্রামের সেই সারাজীবনের সমালোচনায় ব্যস্ত মানুষগুলোও।
    যারা কোনদিন তার সাথে কথা বলে নি তারাই সেধে এসে কথা বলতে শুরু করল।
    তারাও আড়ালে আবডালে আলী আহমেদের কাছে খোঁজ নেয়, কি করে তাদের মেয়েকেও সাঁতারু বানানো যায়। বিশ^ব্যাপী টিভির পর্দায় ফুলের ঘ্রাণে ঢেকে থাকা হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখানো যায়। সোনার মেডেলের চমকে চমকিত করাতে পারে সারা দেশ। সারা বিশ^!
    এবার গ্রামের মানুষের ভুল ভাঙলো। অপবাদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে থাকা মাহফুজা রাতারাতি হয়ে ওঠে সে গ্রামের গর্ব। এভাবেই এগিয়ে যায় মাহফুজার দিন রাত। বুনতে থাকে স্বপ্ন। বাড়তে থাকে স্বপ্নের বীজ তলা। ২০০৬ এর কলম্বো সাফ গেমসে প্রথমবার পুলে নেমেই জিতে নিল দুটি ব্রোঞ্জ। আন্তর্জাতিক মঞ্চে মাহফুজার প্রথম প্রতিভার ঝলক। এবার তার লক্ষ্য। ব্রোঞ্জকে বানাতে হবে খাঁটি সোনা।
    তাই তো কঠোর পরিশ্রম শুরু করলেন মাহফুজা। দিনকে রাত। রাতকে দিন। চললো এভাবেই প্রতিদিন।
    ভর্তি হলেন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে। সাংবাদিকতা বিভাগে শুরু হলো নতুন অধ্যায়। পড়াশুনা চালিয়ে নেবার জন্য নতুন সংগ্রাম হাসিমুখে মেনে নিলেন। জীবন, সাতারের পুল আর পড়াশোনা। তিনটি একইসাথে চালিয়ে নিতে বিকেলে প্রতিযোগিতা করে রাতের বাসে চট্টগ্রাম যেতেন। সকালে পরীক্ষা দিয়েই ঢাকায় ফিরে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন আবার। আলস্য কখনো তাকে ছুঁতে পারে নি। না পেরেছে ক্লান্তি! টাইমিংয়ের প্রভাব পড়তে দেননি জীবনের কোন অসতর্ক মূহুর্তে। টাইমিংয়ের টাইটানিক ঠিক ঠিক ভেসে চলেছে জীবনের গভীর সমুদ্রে।
    শুরু হলো এসএ গেমস্। মেলে ধরলেন নিজেকে। ২০০৬ এ জিতেছিলেন দুটি ব্রোঞ্জ। এবার জিতে নিলেন দুটি সোনা! উন্নতির গ্রাফটা ঠিকপথেই চলছিল। কিন্তু তৃপ্ত ছিল না সে। তার স্বপ্ন ছিল আন্তর্জাতিক আসরে সোনা জেতার আকাক্সক্ষা। এরইমধ্যে একটি ইভেন্টে ফটোফিনিশিংয়ে সোনা হাতছাড়া হয়েছে। এই দুঃখবোধ মাহফুজাকে আরও তাতিয়ে দিল। কে যেন বলল-
    মেয়েটার উচ্চতা কম। অত খাটো না হলে ফটোফিনিশিংয়ে সেই এগিয়ে থাকতো।
    কানে ভেসে বেড়াতে লাগলো সহমর্মিতার সুর! না কি তার সামর্থ্য? নাকি খোঁটা?
    এই উচ্চতা দিয়ে কত কত বাঁধার দেয়াল টপকেছেন! আর আজ? তাকে যোগ্য জবাব দিতেই হবে। প্রতিক্ষায় থাকেন সুযোগের! প্রতিক্ষায় থাকলে আসলেই সুযোগ এসে ধরা দেয় একদিন। মাহফুজার ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। তার সুযোগ এসেছে দীর্ঘ ছয় বছর পর ২০১৬ তে।
    ৬ ফেব্রুয়ারি। ২০১৬ খ্রি.। সেদিনও গুয়াহাটির সোনামাখা সূর্য রং টকটকে লাল ছিল। ছিল অবারিত প্রান্তরে নানা রংয়ের বর্ণিল প্রভা! সূর্যের সোনা মাখা রং যখন চারিদিকে চিকচিক হেসে উঠছিল তখন সারুসাজাই স্পোর্টস কমপ্লেক্সের জাকির হোসেন সুইমিংপুলে বাংলাদেশের সাঁতারুদের নিয়ে কারো তেমন কোন আগ্রহ নেই। তারা তো এসেছে ‘অংশগ্রহণই বড় কথা’ এই শ্লোগানে মাতোয়ারা হতে- অন্যদের ভাবখানা এমনই! কিন্তু মাইকের একটি ঘোষণা চারিদিকে অন্য রকম সুরের মোহনীয় উচ্ছাসে ভেসে গেল। চারিদিক নিস্তব্ধ। সবাইকে স্তব্ধ করে দিলো একটি ঘোষণা। ‘১০০ মিটার ব্রেষ্ট ষ্ট্রোকে সোনা জিতেছেন বাংলাদেশের মাহফুজা খাতুন।’ সময় নিলেন মাত্র ১ মিনিট ১৭ দশমিক ৮৬ সেকেন্ড। গেমসে সোনাজয়ী বাংলাদেশের প্রথম নারী সাতারু! একদিন পরেই সেই সুইমিংপুলে ৫০ মিটার ব্রেষ্ট ষ্ট্রোকে রেকর্ড গড়ে সোনা জিতলেন আবারো। ভাঙলেন ১০ বছর পুরনো গেমস রেকর্ড।
    অথচ এখানে পাঠানো নিয়েই কর্তৃপক্ষ ঘোলা করেছিল জল। ‘মাহফুজা বুড়িয়ে গেছে!’ ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভারতে আনা হয়েছে তাকে।’ ইত্যাদি শুনতে শুনতে তার মাথায় বিজয়ের মুকুট রেখা তড়পরায় রাতদিন। অবশেষে জীবনের শেষ জ¦ালানিটুকু দিয়ে লড়াই করার তাগিদ অনুভব করে সে। এবং এক সময় নিজের দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ পায় এক সন্ধ্যায়Ñসময় করে একান্ত নিজের জন্য। কথা হয় একান্ত একান্তজনের সাথে। সে কি আজ বড় বেশি অসহিষ্ণু?
    আর কত অপেক্ষা পৃথিবী?
    আর একটু সূর্য!
    অস্ত যে যেতে চায় সূর্য, তর সয়না আর আমার পৃথিবী। গণগণে তাপ যে আমার মাথায়। সে শান্তি চায়, শান্ত হতে চায়।
    দিনের শুরুতেই অস্ত যেতে চাইলে পৃথিবী যে কোনদিন পরিপূর্ণ অন্তরাপার্তায় নিমজ্জ্বিত হতে পারে না সূর্য!
    আজ চৌদ্দ বছর ধরে অপেক্ষার পর আজ পৃথিবীর কি কথা শুনি?
    তাই! ওভাবে ঘড়ির আহ্নিক গতির রেখা ধরে হিসাবে বসিনি কোনদিন।
    মেঘে মেঘে বেলা তো অনেক হলো। এখন সময় হিসাবের।
    বাহ! ভারী হিসাব শিখে যাচ্ছো মনে হচ্ছে।
    শিখে যাচ্ছো মানে কি? শিখে ফেলেছি ঠিকঠাক। আর নয় কোন অযুহাত। এবার তাড়া আমার তাড়া করে ফেরে। কিছু বলো পৃথিবী।
    চৌদ্দ বছর সংগ্রাম করে মাহফুজার শরীর আজ ধারণ করে পৃথিবীর রং। আর সূর্য তো অপেক্ষায় থাকে অনন্তদিন!
    আর অপেক্ষা নয়। এবার নতুন জীবনের শুরু।
    চলো রচি নতুন জীবনের গন্তব্য এক! সূর্যের সাথে তাল মেলায় পৃথিবীর কণ্ঠস্বর।
    অতঃপর এক শুভ ক্ষণে চৌদ্দবছর ধরে ভালবাসার মানুষ আরেক সোনাজয়ী সাতারু শাজাহান আলী রনির সঙ্গে বিয়ের পিড়িতে বসলেন মাহফুজা। যোগ দিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে চিফ পেটি অফিসার পদে। দিন গড়াতে থাকে তার আপন মহিমায়Ñ
    আজ সকাল থেকেই অভয়নগরের আকাশে বাতাশে এক নতুন আশা- নতুন গুঞ্জন- নতুন শব্দধ্বনি। জড়ো হয়েছে হাজারো মানুষ। তারা এক নজর দেখতে চায় এ গ্রামেরই গর্ব অহঙ্কার শিলাকে। শিলা আজ আসছে অভয়নগরের মাটিকে ধন্য করতে। নিজেকে ধন্য করতে। তার ধুলোবালির গ্রামের মানুষের চেয়ে তাকে আর কে ভাল চেনে?
    যারা একদিন তার নামে নাক সিটকাতো তারাই আজ গোলাপ-বকুলের মালা নিয়ে অপেক্ষা করছে রোদ বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে মাইলের পর মাইল, তার আঙিনায়! অদূরে দাঁড়িয়ে আছে এ গ্রামের সম্ভ্রান্ত অভিভাবক লিয়াকত চাচা। পাশে তার সুন্দরী শিক্ষিত মেয়ে নাজনীন। হাজারো ভিড় ঠেলে মাহফুজার চোখ যায় নাজনীনের দিকে। হাত ইশারায় কাছে ডাকে তাকে। সে ধীর পায়ে ছুটে আসে মাহফুজার কাছে। আর তার বাবা অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে। নিমগ্ন। একদিন সেও যে তাকে অপমান করতে এতটুকু পিছপা ছিল না! অথচ মাহফুজার চোখ যায় সেখানেই আগে।
    আসুন চাচা। কেমন আছেন? কিভাবে যাচ্ছে দিনকাল।
    লজ্জায় সমস্ত রক্ত মুখে উঠে আসে লিয়াকত চাচার।
    এই তো মা। তোমাকে দেখতে এলাম। তুমি আজ গর্ব আমাদের!
    মাহফুজার নির্মল, গর্বের, বিজয়ের হাসিতে লিয়াকত চাচার মুখের সমস্ত রক্ত নামিয়ে সেখানে দরদ এনে দেয়।
    ভালো আছি মা। তুমিও ভালো থেকো চিরদিন এভাবেই।
    নিন্দা আর শ্লাঘার ঝড়কে জয় করে আজ চারিদিকে মাহফুজার জয়গান- দরদের দাপাদাপি- অভয়নগর গ্রামে ভেসে বেড়ায়। আসলে সময় এরকমই। সুসময় এবং দুঃসময়Ñ সব সময় শত্রুকে বন্ধু বানায়। মানুষ ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে একাকার হয়। তাই তো অভয়নগর গ্রামের সব মানুষ আজ একে অপরের বন্ধু হয়ে যায়। সব কিছু সম্ভব করে মাহফুজার ম্যাজিক মেডেল! মাহফুজা হঠাৎ খেয়াল করে তার ম্যাজিক মেডেলের দ্যুতি ঝিলিক দেয় চারিদিক–অভয়নগরের সমস্ত ধুলোমাটি, আকাশ, বাতাশ, নদী, সমুদ্র, মানুষের মুখ আর বৃক্ষের বাকলে বাকলে।

  • সিরাম না

    সিরাম না

    ছায়েদ বিশ্বাসের তিন ছেলের মধ্যে ছোট ছেলের নাম সুখচাঁন। ছোটছেলে বিধায় অতি আদরের কিন্তু সবার ধারণা সে পাগল। এই পাগল ভাবার কারণ- সুখচাঁনের কাছে তারা কয় ভাই জিজ্ঞাসা করলেই বলে, আব্বার দিয়ে আমরা চার ভাই। সুখচাঁনের একটাই কাজ সারাদিন ঘুরে বেড়ান।
    আশির দশকে মদনপুর গ্রামে প্রতিবছর যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ, ম্যাজিক দল নিয়ে আসতো। উদ্দেশ্য ছিল মদনপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উন্নয়ন সাধন। স্কুলের উন্নয়ন না হলেও কিছু লোকের পকেট ভারি হতো। এসব তথ্য সুখচাঁনের জানার কথা না। সেই বয়সও তার হয়নি। প্রতিবাদি মেধাও সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে সে বঞ্চিত। তবে সুখচাঁন খুব আনন্দ পেত। সারাদিন প্যান্ডেলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে সুন্দর সময় পার হতো। একবার সার্কাস পার্টি এলে সুখচাঁনের আনন্দ আরও বেড়ে গেল। বানর, বাঘ, ভালুক আরও কত কি এসেছে। একটা মস্ত বড় হাতি এসেছে। দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয় ছোটখাট একটা কালা পাহাড়। সকালবেলা হাতি আশপাশের পাড়াগায়ে গামালে (বেড়াতে) যায়। হাতি দেখে গ্রামের লোক ধান, চাল, টাকা-পয়সা দেয়। কলাগাছ ফ্রি, হাতি যত খেয়ে পারে। কেউ বাঁধা দেয় না; বরং খুশি হয়। সুখচাঁন সারাদিন হাতির পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়ায়। পনের দিনের একদিনও সে ঘুরতে মিস করিনি বরং সার্কাস পার্টি চলে যাওয়ার সময় সুখচাঁন খুব কষ্ট পেয়েছিল। অনেকদিন যাবৎ অনেকের কাছে তার দেখা বিশাল হাতির বর্ণনা দিয়ে তৃপ্তি বোধ করেছে।
    সুখচাঁনের কাছ থেকে ধীরে ধীরে শৈশব কৈশোর বিদায় নিয়েছে। অকর্মণ্য শরীরে যৌবন এসেছে। বড় দুই ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। মা-বাবার দুশ্চিন্তা তাদের মৃত্যু হলে পাগল সুখচাঁনের কি হবে। কেউ কেউ পরামর্শ দিল সুখচাঁনের বিয়ে দাও। কলে পড়লে সব পাগলামি ছুটে যাবে।
    সুখচাঁন বিয়ে করল কিন্তু সংসারী হল না। এর মধ্যে তার বাবা মাও পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। সুখচাঁন বাবাও হয়ে গিয়েছে। এবার কলে পড়ে রিকসা-ভ্যান চালিয়ে সংসারের হাল ধরতে হল। পাগলামিও কিছুটা ছুটে গেল।
    সুখচাঁন বেশ বুড়িয়ে গিয়েছে। গ্রামের বাজারে ভ্যান নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষায় থাকে। যাত্রী খোঁজার থেকেও চলমান মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে। হাসির অর্থ বুঝা মুশকিল।
    ফাগুনের প্রথম দিকে গ্রামময় হৈ চৈ পড়ে গেল মুড়াগাছা বাজারে সার্কাস পার্টি এসেছে। খবর শুনে সুখচাঁনের ছোটবেলার ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। একদিন ভ্যান না চালিয়ে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেল। সারাদিন সার্কাস প্যান্ডেলে ঘোরাঘুরি করল। একটা হাতি এসেছে কিন্তু হাতি দেখে সুখচাঁনের মন ভরল না। হাতিটা রোগা, দূর্বল, আয়তনে খুব ছোট। কেউ এখন আর কলাগাছ ফ্রি দেয় না। এককাঁদি কলার দাম শতশত টাকা। কে দেবে?
    শেষ বিকেলে সুখচাঁন মদনপুর বাজারের মধ্যে দিয়ে বাড়ি ফিরছে। বাজারে চায়ের দোকানে বহুলোক। সেখান থেকে হোসেন আলি সুখচাঁনকে ডাক দিল। কোথায় গিয়েছিল জানতে চায়লো। সুখচাঁন বলল, মুড়াগাছায় সার্কাস প্যান্ডেলে গিলাম।
    হোসেন বলল, হাতি দেখিছিস?
    সুখচাঁন বলল, দেখিছি তবে সিরাম ( সেই রকম ) না।
    হোসেন বলল, সিরাম না মানে?
    সুখচাঁন একগাল হাসল। হাসিতেই বুঝা গেল শৈশবে যে হাতি মদনপুর গ্রামের সার্কাস প্যান্ডেলে এসেছিল সে তুলনায় এ হাতি যেন মরা হাতি। এখন সুখচাঁনের যে যেখানে দেখা পায় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠে- ‘সিরাম না।’
    সুখচাঁনের কথাটা মানুষের কাছে জীবন্ত হয়ে গেল। এখন এলাকায় তুলনামূলক ভাল কিছু না হলে একগাল হেসে বলতে শুনা যায়-সিরাম না।

  • ভুলে গ্যাছি

    ভুলে গ্যাছি

    ভুলতে ভুলতে ভুলে গ্যাছি
    প্রিয় নাম ধরে ডাকতে’
    ভুলে গ্যাছি প্রিয় কবিতার ঘ্রাণ
    ভুলে গ্যাছি নিজেকেও
    ভুলিনা কেবল তার অব্যক্ত চোখের
    সেই ব্যাকুলতা
    যে ব্যাকুলতা আর কারো মাঝে দেখিনা
    এমন কি তার মাঝেও না
    ঘর গৃহস্থলী জীবনে যে আমার
    চিরোকালীন পথের সাথি কাগজে কলমে
    ভুলেগ্যাছি কাঁদা জল মাখা পথের প্রান্তে

  • খোঁড়া বসন্তের কবিতা

    খোঁড়া বসন্তের কবিতা

    বসন্তের কথা বলেছিলে তুমি
    বসন্তে ফুল ফোটার কথা বলেছিলে
    দগ্ধ দুপুরে দুরন্ত পথিকের কথা বলেছিলে
    মেঘের ঘরে বৃষ্টির ঘুমিয়ে থাকার গল্প বলেছিলে

    সবুজ আনন্দে নতুন পাতারা জেগে ওঠে
    ভাটিয়ালি গন্ধে দুলে ওঠে বাতাসের বুক

    পলাশের ঝরে পড়া মুগ্ধতায় তুমি
    রক্তের উচ্ছ্বাসে জেগে ওঠা মানুষের কথা বলেছিলে
    অথচ তোমার বসন্তে
    কোকিল ডাকার কোনো কথা বলতে পারোনি

    যে বসন্তে কোকিল ডাকে না
    আমি তাকে খোঁড়া বসন্ত বলেই ডাকি।

  • চা-বাগানের কাছে

    চা-বাগানের কাছে

    ঝিমিয়ে পড়ো না, চা-বাগান।ভোর নামছে একশোটি রঙে।
    সূর্য ছুঁয়েছে ব্যস্ত হাত।
    শ্রমজীবীদের কোলাহলে স্তব্ধতা ভাঙছে।
    তাপে ও উত্তাপে আবহাওয়াবার্তা স্বাভাবিক আছে।
    গৃহমুখী অভিপ্রায় আবাসন খুঁজছে।
    প্রিয় মগ্নতা, থেমে যেও না।

    ঝিমিয়ে পড়ো না, ছায়াভালোবাসা চা-বাগান।
    এককাপ প্রণোদনা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে।
    জড়ত্বের কোল থেকে আশ্রয় চাইছে শিশু,
    যুবক, যুদ্ধাহত তরুণ, যাবতীয় প্রেম।
    কারখানা জাগছে নতুন করে।
    সঙ্গে নিয়ে এসেছে শুভ্র পার্থিবতা।
    দ্যাখো তার ঘরবাড়ি, আশ্রয়,আহবান।
    প্রিয় স্থিরতা, হৃদয়ের লেনদেন বন্ধ করো না।

    ঝিমিয়ে পড়ো না নিবিড় চা-বাগান।
    তোমার পুষ্পিত হৃৎকম্পন থামিয়ে দিও না।

  • ঘুনপোকা

    ঘুনপোকা

    আমার আজকের সুন্দর সবুজ সময়গুলো
    ঘুনপোকার মতো রোজ একটু একটু করে খেয়ে যাচ্ছো তুমি।
    বুকের বাম পাশটায় করেছো ক্যাকটাস চাষ
    যেখানে প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়াতাম আমি।
    আজ আর কোন অতীত আমার চোখে কাটা হয়না
    বর্তমানে ঘুমে কাতর আমার সাজানো স্বপ্নেরা।
    তুমিও কি এমনিই অতীত
    বর্তমানের বর্তমান?

  • মধ্যরাতের পিং

    মধ্যরাতের পিং

    রাত রেখে গেলাম
    হাত রেখে গেলাম
    রাত নিয়ে নেড়োচেড়ো
    হাত নিয়ে নেড়োচেড়ো
    বন্ধু!
    ক্লান্ত এসময়,
    রাতে হাত
    হাতে রাত
    নষ্ট করা ঠিক হবে না …

  • তালিম

    তালিম

    রোজ সন্ধ্যায় মেয়েটি হারমোনিয়াম নিয়ে বসে
    তোমার আঙুল তখন তবলার সমকেন্দ্রিক বৃত্তের পরিধির উপর
    খুলে যায় বিস্তৃতির জানালা…
    আমাদের পূর্ব অথবা পরজন্মের যুগ্ম সমমেল

    আমরা কিভাবে সমস্ত প্রাণীদের বিলুপ্তির দিকে ঠেলে
    ঢুকে গেছি অন্য গ্রহে
    কিভাবে বেয়াদপ সমুদ্রের ভেতর হতে বেরিয়ে
    মেয়েটি নিয়মিত রেওয়াজ করে

    তাল আর সুরের যুগলবন্দী হলে
    নতুন রাগের শরীরজাত তরঙ্গ
    কয়েক আলোকবর্ষ দূর থেকে এগোয় আমাদের দিকে
    গন্তব্যহীন…

    বন্দরের ঠিকানা হারিয়ে গেলে এভাবেই প্রজন্মের শরীরে মরক আসে…

  • নন্দনব্রত

    নন্দনব্রত

    কানা-গলির মেয়েরা কানা কি না দেখা হয়নি তো, মা
    ধুলোখেলার ছলে যা দিয়েছ তা তো অনুৎসবের পাঁতাবাাঁশি
    ধরলেও না ধরালেও না, বাজাতেও শেখালে না
    রুপনন্দনে জমলে আর্শিবাদ কে করবে তোমার কচ্ছ মুক্ত

    শুনেছি বেলারুসে সূর্যোদয় দেখলে পর চোখ শাস্ত্রের উন্নতি হয় আর
    বেহিসেবিরা কুমিরসঙ্গবাসে করে পথের শিলান্যাশ
    তালো মা রুপ দক্ষ তালুতেই তোলো বন-তুলসি, বেঘোরে না ঘুমিয়ে করক্ষেপে
    মুক্তো ফলাও, তোমার দ্বারে পা বুনে আমিও শিখি উরুস্বর্ণ-ঠোঁটের মধু
    কলালক্ষীর নাভী খাজে দিতে শিখি বর্ণ-প্রলেপ মা’গো

    তবুও যদি দেবেই
    শরীর দিলে দাও ভূষণশিল্প জল দিলে দাও জলকন্যা, ওঠাতে দাও সিংহ ভূমে
    কোলজে ভরে বিলাস ফসল, নইলে কিন্তু যষ্ণবরাত নিকুচি করে আমি মা মরু গড়বো
    রোদে রোদে, বালিতে বালিতে, রোদবালিতে রোদবালিতে…।