Notice: Trying to get property 'post_content' of non-object in /home/dakshinermashalc/public_html/wp-content/plugins/pj-news-ticker/pj-news-ticker.php on line 202
মশাল সাহিত্য Archives - Daily Dakshinermashal

Category: মশাল সাহিত্য

  • তিব্বতের জনগণের স্বাধীনতা ও চীনের হুমকি

    তিব্বতের জনগণের স্বাধীনতা ও চীনের হুমকি

    সম্প্রতি তিব্বতের জনগণের ধর্ম পালন ও নিজেদের নিয়মিত স্বাধীন জীবনযাপনের বিষয়ে মার্কিন হাউসে ‘তিব্বত’ রেজল্যুশন পাস করা হয়। এ বিষয়ে শুরু থেকেই হুমকি দিয়ে আসছিল চীন। কিন্তু দেশটির সেই রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চস্তরের কংগ্রেশনাল প্রতিনিধিদল ভারতে তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামার সঙ্গে দেখা করেন জুন মাসের ১৯ তারিখে। বিষয়টি তিব্বতের মানবাধিকার ইস্যুর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। এই প্রতিনিধিদল তিব্বতের জনগণের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি তিব্বত ও চীনের মধ্যে বিরোধের শান্তিপূর্ণভাবে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের আহ্বান জানায়।

    রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে, তিব্বত ইস্যুতে চীনের ওপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে ওই অঞ্চলের জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ফেরত দেওয়ার আলোচনা শুরু করতেই যুক্তরাষ্ট্রের এ পদক্ষেপ। যেখানে মার্কিন প্রতিনিধিদলের মধ্যে ছিলেন মার্কিন হাউসের প্রাক্তন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। চীনের হুমকি উপেক্ষা করেই ভারতে দালাই লামার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। ২০২২ সালেও চীনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাইওয়ান সফর করেছিলেন তিনি। ন্যান্সি দালাই লামার শিষ্য হিসেবে সুপরিচিত। সুতরাং এটি বেশ স্পষ্ট যে, চীনের শত বিরোধিতার পরও ন্যান্সি প্রতিনিধিদলকে নিয়ে দালাই লামার সঙ্গে দেখা করেছেন এবং হয়তো ভবিষ্যতেও করবেন।

    বিগত কয়েক বছর করোনা মহামারি ও বৈশ্বিক টালমাটাল অবস্থার সুযোগ নিয়ে তিব্বতের নিজেদের আগ্রাসন আরও বাড়িয়েছে চীন। ২০২১ সালে তিব্বতে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু করে চীন। এ সময় তিব্বতের অধিবাসী ও প্রবাসে থাকা তিব্বতিয়ানরা জানান, স্থানীয়দের নিজেদের সংস্কৃতি অনুসারে চলতে বাধা দিচ্ছে চীন সরকার। সেইসঙ্গে তিব্বতের অধিবাসীদের স্থানীয় ভাষা শিক্ষা কার্যক্রমেও বাধা প্রদান করে চীন। ২০২২ সালে তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের মুখপাত্র তেনজিন লক্ষ্মী জানান, বেশ কিছু তিব্বতিয়ান লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পীদের বন্দি ও আটক করেছে চীন। তিনি আরও অভিযোগ করেন, তিব্বত এখনো চীনের প্রধান সমস্যাগুলোর একটি। আর তিব্বতকে নিয়ন্ত্রণে চীন আরও যুদ্ধংদেহী অবস্থান গ্রহণ করেছে। তারা তিব্বতের সব ঐতিহ্যের নিন্দা করার পাশাপাশি সেখানকার সব ঐতিহ্য মুছে ফেলছে ধীরে ধীরে।

    তিব্বতের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম এবং ইতিহাস ছিল। বেশ শক্তিশালী নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চেতনা বোধ ছিল এ অঞ্চলের মানুষের। কিন্তু চীনা কমিউনিস্টরা সর্বদা এ অঞ্চলকে যুক্ত করতে চেয়েছিল। ১৯৫০ সালের ৭ অক্টোবর চীনের সেনা তিব্বতে প্রবেশ করে। সেই সময় বেশিরভাগ তিব্বতি এ আক্রমণের কথা ভাবতেই পারেননি। দাওয়া নরবু, সেই সময়ে শিশু। ১৯৭৮ সালে ওয়ার্ল্ড ভিউ ম্যাগাজিনে তিনি লেখেন, ‘১৯৫০ সালের চীনা আগ্রাসনের খবর আমাদের কাছে ১৯৫২ সালের কোনো একসময়ে এসে পৌঁছেছিল।’ ১৯৫০ সালে তিব্বত এমনই ছিল। সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে নরবু লিখেছেন, ‘পৃথিবীর ছাদে আধুনিকতার আশীর্বাদ এবং বাধা উভয় থেকেই দূরে (তিব্বত) ছিল একটি প্রত্যন্ত ভূমি। ধীরে ধীরে চীনা আগ্রাসনের খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। উদ্বেগ ছড়ায় আরও ধীরে। আতঙ্কজনক খবর সত্ত্বেও শাক্যতে কেউ তার তরবারি ধারালো করেননি। তার ধনুক এবং তীর ব্যবহারও করেননি।’ শাক্যের বাসিন্দারা কল্পনাও করেননি যে, চীনের আক্রমণ একটি স্থায়ী দখলদারি হয়ে উঠবে, যা তিব্বতকে চিরতরে বদলে দেবে। চীনের সেই আক্রমণের ৭৪তম বছর চলছে এখন। কিন্তু চীনের অস্ত্রের বিরুদ্ধে কখনোই তিব্বতের মানুষ সহিংস অবস্থান গ্রহণ করেননি। কেননা সহিংসতা তিব্বতের অধিবাসীদের শিক্ষা নয়। কিন্তু এমন অহিংস একটি জাতির ওপর চীনের অত্যাচার নিপীড়ন নিয়ে বিশ্বের নিশ্চুপ অবস্থান এ অঞ্চলের মানুষের সেই অহিংস আচরণ বজায় রাখার পথে ভবিষ্যতে বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে। এটি শুধু চীনের জন্য নয়, বরং পরবর্তীকালে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান এমনকি বাংলাদেশের জন্যও হুমকির কারণ হতে পারে। আর এ কারণেই চীনের ক্ষোভ উপেক্ষা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দালাই লামার সঙ্গে বৈঠকের পর আমেরিকান আইনপ্রণেতাদের দ্বিদলীয় সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রায় একই সময়ে, কানাডিয়ান হাউস অব কমন্স সর্বসম্মতিক্রমে তিব্বতের স্বনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থন করে একটি প্রস্তাব পাস করে। তিব্বতিরা একটি জাতি হিসেবে এ মৌলিক অধিকারের দাবিদার।

    মার্কিন প্রতিনিধিদলের এ সফর শেষে বেইজিং বেশ হতাশার সঙ্গে উপলব্ধি করেছে যে, বিশ্ব তার চাপ এবং গুণ্ডামি কৌশলের কাছে নতিস্বীকার করবে না। বিশ্ব তিব্বতের ওপর চীনা দখলের বৈধতা সম্পর্কে দেশটির প্রোপাগান্ডাকে গ্রহণ করবে না। বেইজিং এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে তিব্বত সমর্থনে উত্থাপিত বিলে স্বাক্ষর না করার জন্য আবেদন করছে, যা শুধু স্বাক্ষরের অপেক্ষায় রয়েছে। এতদিন চীন হুমকি দিয়ে এসেছে, দালাই লামার সঙ্গে দেখা করলে তার ফল যুক্তরাষ্ট্রকে ভোগ করতে হবে। কিন্তু এখন দালাই লামার সঙ্গে বৈঠক শেষে চীন তার আগের একগুঁয়ে অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে। বরং এখন চীন ‘তার রাজনৈতিক প্রস্তাবগুলোর সম্পূর্ণ প্রতিফলন এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সংশোধন করার’ কথা জানিয়েছে, যদিও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো বার্তা বা ব্যাখ্যা প্রদান করেনি চীন। চীনের হঠকারিতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, তারা মার্কিন আইনপ্রণেতাদের দালাই লামার সঙ্গে দেখা না করার জন্য হুমকি দেওয়ার সাহস দেখিয়েছে। শুধু গণমাধ্যমে নয়, হুমকি প্রদান করে চীন প্রতিনিধিদলটিকেও চিঠি প্রদান করেছে। প্রতিনিধিদলের নেতা ইউএস হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান মাইকেল ম্যাককাল এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের প্রতিনিধিদল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছ থেকে একটি চিঠি পেয়েছে, যেখানে আমাদের এখানে না আসার জন্য সতর্ক করেছে। তারা তাদের মিথ্যা দাবির পুনরাবৃত্তি করেছে যে, ১৩ শতক থেকে তিব্বত চীনের অংশ। কিন্তু আমরা সিসিপির সেই ভয় দেখানোতে মনোযোগ দিইনি এবং আমরা আজ এখানে এসেছি।’ ভারতের ধর্মশালায় নির্বাসিত তিব্বত সরকারের তত্ত্বাবধানে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যাকে চীন ‘নিছক রাজনৈতিক চক্র’ বলে উড়িয়ে দেয়। মার্কিন প্রতিনিধিদলের এই নেতা বলেন, ‘তিব্বতের জনগণ একটি স্বতন্ত্র ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহাসিক পরিচয়ের অধিকারী এবং তাদের নিজেদের ভবিষ্যতের কথা বলা উচিত। তাদের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করার অধিকার লাভ করার কথা। সে কারণেই আমরা এখানে সিসিপির সতর্কতা অমান্য করেছি।’

    মার্কিন আইনপ্রণেতারা যারা আমেরিকার জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, তারা ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে সমর্থন করেছেন। তারা মনে করেন, তিব্বতে কখনোই চীনের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এ নিয়ন্ত্রণের মাত্রাটি ছিল একটি শিথিল আধিপত্য, যা এ অঞ্চলের ওপর সার্বভৌম অধিকার থেকে অনেক দূরের বিষয়। অতীতেও বেশ কয়েকবার এ বিষয়ক আলোচনায় জানানো হয়, তিব্বত কীভাবে চীনা নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীন ছিল এবং ১৯১২ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে তিব্বত একটি স্বাধীন দেশ ছিল। আর এ কারণেই ১৯৫০ সালে তিব্বতে চীনের অধিগ্রহণ ছিল অবৈধ।

    তিব্বত সমস্যার সমাধান বিষয়ক বিলটি মার্কিন হাউসে ৩৯১ বনাম ২৬ ভোট ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হয়। তিব্বতের পক্ষে সব ডেমোক্র্যাটের পাশাপাশি অধিকাংশ রিপাবলিকান ভোট দেন। মাত্র ২৬ জন রিপাবলিকান এর বিপক্ষে ভোট দেন। এ বিলটির অন্যতম প্রবর্তক ও মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতা ম্যাককল বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কখনোই স্বীকার করেনি যে, তিব্বত প্রাচীনকাল থেকে চীনের অংশ ছিল। কারণ সিসিপি মিথ্যা দাবি করেছে। এ আইনটি মার্কিন নীতিকে স্পষ্ট করেছে এবং তিব্বতি জনগণের অনন্য ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছে। এটি মার্কিন কূটনীতিকে চীনা প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশনা দেয়, তিব্বতিদের নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত করে এবং সিসিপি ও তিব্বতের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অন্য নেতাদের মধ্যে আলোচনার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেয়। যে কোনো রেজল্যুশন বা আলোচনায় তিব্বতি জনগণের ইচ্ছা ও কণ্ঠকে অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

    এর আগে, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০ সালে তিব্বতের জনগণের পরবর্তী দালাই লামার পছন্দে চীনের হস্তক্ষেপ রোধ করতে ২০২০ সালে তিব্বত নীতি ও সমর্থন আইনে স্বাক্ষর করেছিলেন। কানাডিয়ান হাউস অব কমন্সে গৃহীত প্রস্তাবটি তিব্বতিদের চীনের পদ্ধতিগত সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের বিরোধিতা করেছে এবং বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় নীতিগুলো বেছে নেওয়ার অধিকারকে তিব্বতি জনগণের অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করেছে। সেইসঙ্গে ১৪তম দালাই লামার পুনর্জন্ম নির্বাচনের বিষয়টিও তিব্বতের জনগণের নিজস্ব সিদ্ধান্ত বলে স্বীকৃতি প্রদান করেছে।

    কানাডিয়ান হাউসের প্রস্তাবে জোর দিয়ে বলা হয় যে, ‘চীন তিব্বতিদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের নীতি চালিয়ে যাচ্ছে। তিব্বতিরা, একটি জাতি হিসেবে তাদের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দাবি করতে পারে। কোনো বাহ্যিক শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় নীতি নির্বাচন করতে পারে এবং এ ক্ষমতায়ন চীনকে ১৪তম দালাই লামার পরবর্তী তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে বাধা দেয়।’

    কানাডিয়ান হাউসের রেজল্যুশন বেশ স্পষ্টভাবে তিব্বতের জনগণের জন্য প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে। সেইসঙ্গে বর্তমান দালাই লামার অবস্থানের সঙ্গেও বিষয়টি সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদিও এখানে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি রাজনৈতিক স্বাধীনতাকেও বোঝায়।

    এটি বেশ স্পষ্ট করেই বলা যায়, এ প্রেক্ষাপটে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মার্কিন আইনপ্রণেতাদের প্রতিনিধিদলের মধ্যে বৈঠক তিব্বতের জনগণের জন্য ভারতীয় সমর্থনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। তিব্বতের জনগণের স্বার্থকে এগিয়ে নিতে বিশ্বের জন্য ভারতীয় সমর্থন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত তিব্বতের নিকটতম প্রতিবেশী এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক তিব্বতি উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিচ্ছে। প্রায় এক লাখের বেশি তিব্বতিয়ান ভারতে আশ্রয় নিয়ে আছে। সেইসঙ্গে দালাই লামা ‘রাষ্ট্রপ্রধান’ মর্যাদাসহ ১৯৫৯ সাল থেকে ভারতের সম্মানিত অতিথি হিসেবে রয়েছেন। তিব্বত মালভূমিতে চীনের এ নীল-নকশাকে পরাস্ত করতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যে একটি কৌশলগত অংশীদারত্ব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে মার্কিন প্রতিনিধিদল। তারা বলেছিল, একসঙ্গে আমরা চীনা কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রতিরোধের একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠাতে পারি। কারণ যখন বিশ্বের দুটি বৃহত্তম গণতন্ত্র একসঙ্গে দাঁড়ায়, তখন স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা জয়লাভ করে।

    লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট

  • নর্থ ব্লকে স্বয়ংবর সভা

    নর্থ ব্লকে স্বয়ংবর সভা

    আমি যে এক সম্পূর্ণ অন্য দুনিয়ায় পা রেখেছি, খুব তাড়াতাড়িই টের পেলাম। আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছিল একটি অ্যাম্বাসাডর গাড়ি।

     

    কৌশিক বসু

    নির্বাচনের পর নতুন সরকার গঠিত হল, এ বার সেই সরকার বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নীতি রূপায়ণ করবে। অর্থ মন্ত্রকের নর্থ ব্লকে কী ভাবে নীতি রূপায়ণের কাজটি হয়, এবং আগামী কয়েক মাসে এই সরকারের থেকে কী কী আশা করা যেতে পারে, সে বিষয়ে অনেক কিছুই পড়ছি গত কয়েক দিন যাবৎ। পড়তে পড়তে মনে পড়ে যাচ্ছে নর্থ ব্লকে আমার শুরুর দিনগুলোর কথা— ভারত সরকারের হয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতার সূচনাপর্ব।

    আমার সৌভাগ্য যে, আমি চমৎকার সব মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁদের মধ্যে যেমন ছিলেন আমার দুই বস— প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ও অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়— তেমনই ছিলেন আমার অফিসের কর্মীরা, দফতর চালানোর কাজে প্রতিনিয়ত যাঁদের সহযোগিতা পেয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই, খুবই ইতিবাচক পরিবেশ ছিল অর্থ মন্ত্রকে— বন্ধুত্বপূর্ণ কাজের পরিবেশ, সবাই সাহায্য করতে প্রস্তুত। কিন্তু আমার কাছে সে এক সম্পূর্ণ নতুন দুনিয়া। তার আগে অবধি আমি আজীবন শুধু অর্থনীতির গবেষণা করেছি, এবং ক্লাসে ছাত্রদের অর্থশাস্ত্র পড়িয়েছি, তা সে ভারতে হোক বা আমেরিকায়। সরকারি দুনিয়ায় এই প্রথম পা রাখলাম আমি।
    সে সময়ের কিছু মজার অভিজ্ঞতা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে নিতে ইচ্ছা করছে।

    আমি যে এক সম্পূর্ণ অন্য দুনিয়ায় পা রেখেছি, খুব তাড়াতাড়িই টের পেলাম। আমার জন্য বরাদ্দ হয়েছিল একটি অ্যাম্বাসাডর গাড়ি। অফিসে যাব বলে গাড়িতে উঠেছি— অভ্যাসবশে সিটবেল্ট লাগাতে গেলাম। আমার গাড়ির চালককে দেখে মনে হল, খুবই অস্বস্তিতে পড়েছেন তিনি। প্রসঙ্গত, পরে টের পেয়েছি যে, মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নামক গেরামভারী পদের অধিকারীর গাড়ির সারথি বলে তাঁর বেশ গর্ববোধ ছিল। আমায় সিটবেল্ট পরতে দেখে শেষ অবধি নিজের আপত্তি আর চেপে রাখতে পারলেন না তিনি। আমার দিকে ঘুরে বললেন, “স্যর, আমি জানি আপনি আগে শিক্ষক ছিলেন; তবে এখন আপনি দেশের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। আর সিটবেল্ট পরার কোনও প্রয়োজন নেই!” বলা বাহুল্য, লোকটিকে আমার ভারী মনে ধরল! তবে, এটাও বুঝলাম যে, এক নতুন, অচেনা দুনিয়ায় পা দিয়েছি আমি।

    এখন আমি কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে গেম থিয়োরি বা দ্বন্দ্ব তত্ত্বের যে কোর্সটি পড়াই, তার একটি অংশের নাম ‘বারগেনিং থিয়োরি’। এই তত্ত্বটির উদ্ভাবক ছিলেন আশ্চর্য প্রতিভাধর গণিতজ্ঞ জন ন্যাশ। আ বিউটিফুল মাইন্ড নামের ছবিটিতে রাসেল ক্রো অভিনয় করেছিলেন তাঁর ভূমিকায়, এটা বললে হয়তো ন্যাশকে মনে করতে সুবিধা হবে। মাত্র ২২ বছর বয়সে বারগেনিং বিষয়ে দু’টি ছোট পেপার লিখেছিলেন ন্যাশ। তার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আক্রান্ত হন স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া রোগে, গবেষণার জগৎ থেকে হারিয়ে যান। কিন্তু, তাঁর ওই দু’টি ছোট গবেষণাপত্র ‘বারগেনিং থিয়োরি’-র ভিত গড়ে দিয়েছিল। গোটা দুনিয়ায় গেম থিয়োরির ক্লাসরুমে, এবং আমেরিকার আদালতকক্ষে, তার ব্যবহার চলছে।

    কিন্তু, বারগেনিং থিয়োরির সেরা বাস্তব উদাহরণটি আমি কোনও ক্লাসঘরে পাইনি, পেয়েছিলাম দিল্লির অর্থ মন্ত্রকে আমার অফিসের কর্মীদের থেকে। সে কথা বলি। মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টার অফিসে আমার চিফ অব স্টাফ ছিলেন সোমনাথন নামে এক জন— খুবই নির্ভরযোগ্য মানুষ। এক দিন তিনি আমার অফিসে এলেন। তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে, এবং তাঁর ঘাড়ের উপর দিয়ে আর কয়েক জন উঁকি মারছে, এমন অবস্থায় সোমনাথন আমায় জানালেন, আমার মতো উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের সরকার ৬০০০ টাকা অবধি দামের ব্রিফকেস কিনে দিয়ে থাকে। সেই মুহূর্তে আমার আদৌ একটা নতুন ব্রিফকেসের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু সোমনাথন ও তাঁর ঘাড়ের উপর থেকে উঁকি মারা সহকর্মীদের হতাশ করতে মন চাইল না। বললাম, আমায় কয়েকটা স্যাম্প্‌ল দেখানোর ব্যবস্থা করা হোক।

    পর দিনই এক সর্দারজি হাজির আমার অফিসে। তাঁর হাতে ছ’টি ব্রিফকেস, তবে বলে না-দিলে সেগুলোর মধ্যে ফারাক খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমার টেবিলের উপরে সেগুলো সাজিয়ে রাখা হল। মনে হচ্ছিল, স্বয়ংবর সভা চলছে— সামনে রাজপুত্রের দল, এক জনের গলায় আমি বরমাল্যটি পরিয়ে দিলেই হয়! সোমনাথন এলেন; তাঁর পিছন পিছন এলেন আমার পার্সোনাল সেক্রেটারি ও সহায়করা; তাঁদেরও পিছনে এলেন আমার পিয়নরা। এই শেষের দলটি এমনিতে লাজুক— কিন্তু এই মহাভারত-তুল্য ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করার লোভ তাঁরাও সামলাতে পারেননি বলে দেখা গেল।

    আমার উদ্দেশে মৃদুস্বরে উপদেশাবলি ভেসে আসতে আরম্ভ করল; বিভিন্ন ব্রিফকেসের দিকে ইতিউতি আঙুলও উঠল। আমার কোন ব্রিফকেসটা বাছা উচিত, সে বিষয়ে দফতরের বিভিন্ন স্তরের কর্মীরা আমায় সৎ পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু, ব্রিফকেস বাছার চেয়ে ঢের জরুরি কাজ পড়ে রয়েছে তখন। কাজেই, খুব একটা ভাবনাচিন্তা ছাড়াই একটা ব্রিফকেস বেছে নিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সম্মিলিত দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল— আমায় জানানো হল, আমার জন্য বরাদ্দ যেখানে ৬০০০ টাকা, আমি সেখানে মাত্র ২৫০০ টাকা দামের ব্রিফকেস বেছেছি! আর কথা বাড়াব না ভেবে বললাম, যে দামেরই হোক, এটাই আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে। আমার সহায়কদের মধ্যে এক জন বললেন, “তা হলে স্যর, আপনি দুটো ব্রিফকেস নিন।” আমি নিশ্চিত নই, তবে এই ভদ্রলোক সম্ভবত অর্থনীতি নিয়ে লেখাপড়া করেছিলেন— অর্থনীতিবিদদের কাছেই সব সমস্যার এমন চটজলদি সমাধান থাকে! প্রস্তাবটি শুনে অন্যরা বেশ সপ্রশংস ভঙ্গিতে তাঁর দিকে তাকালেন।
    ভেবে দেখলাম, আমার সামনে দুটো রাস্তা রয়েছে— এক, আমার দফতরের কর্মীদের এই সব ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া উপেক্ষা করে তাঁদের ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া; অথবা একটা নয়, দু’দুটো বেশ ‘বলতে নেই’-টাইপ খারাপ দেখতে ব্রিফকেসের মালিক হওয়া। দু’দিকের লাভ-ক্ষতি হিসাব কষে শেষ পর্যন্ত বললাম, “ঠিক আছে, দুটো ব্রিফকেসই নেব। কিন্তু, সরকার যে-হেতু ৬০০০ টাকা দেবে, আর দুটো ব্রিফকেসের দাম যে-হেতু ৬৭০০ টাকা পড়ছে, তাই বাকি ৭০০ টাকাটা আমার থেকে নিয়ে নিন।” আমার কথা শুনে দফতরের কর্মীরা স্তম্ভিত। তাঁরা সর্দারজিকে বললেন, “আপনি তো একটা ব্রিফকেস বেচবেন বলে এসেছিলেন। উনি দুটো নিচ্ছেন। ওই ৭০০ টাকাটা ডিসকাউন্ট দিন, মশাই।” সর্দারজি দাড়ি চুলকে একটু ভাবলেন, তার পর রাজি হয়ে গেলেন। এ ভাবেই আমি দুটো ব্রিফকেসের গর্বিত মালিক হলাম, যার মধ্যে একটাও আমি চাইনি।
    ( ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে নেওয়া)
  • কেন বধ্যভূমি চাই

    কেন বধ্যভূমি চাই

    হাজার বছরের ইতিহাসের পরিক্রমায় সমাজ সভ্যতার বিকাশে একটি জাতি আত্মমর্যাদা নিয়ে দাড়াতে আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে। কৃষি ভিত্তিক সমাজ কাঠামোয় বাঙ্গালী জাতি বারবার ঘুরে দাড়াবার চেষ্টা করেছে।আদি পাল যুগ থেকে শুরু করে এই বাঙ্গালীজাতীর পরিচয়,পরিচিতি, পালবংশের দীর্ঘ চার শত বছর স্বশাসন,সভ্যতার বিকাশ,দাক্ষিনাত্যের সেনবংশের কাছে পরাজয়,দীর্ঘ দিনধরে বিদেশি দেরদ্বারাশাসিত হওয়া,ধাপে ধাপে শোষন বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, বিক্ষোভ, চল্লিশ সালের লাহোর প্রস্তাব,১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবীতে আন্দোলন, ২৯৫২ সালে সালাম রফিক বরকতে আত্মাহুতি, ১৯৬৯ সালে গনঅভ্যুত্থান,১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন সব বাঙ্গালী জাতির আত্মপরিচয় আত্মমর্যাদার স্মৃতি চিহ্ন। পৃথিবীর বুকে মাথাউচু করে দাড়ানো জাতিই হলো বাঙালী জাতি।প্রজন্মেরপর প্রজন্ম বেঁচে থাকে ইতিহাস নিয়ে।ইতিহাসের সত্য মিথ্যা ভালোমন্দ নিয়ে সংস্কৃতি সভ্যতা গড়ে ওঠে।আজ আমরা কিদেখছি? নতুনপ্রজন্ম স্বাধীনতা,মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে খুব বেশী আগ্রহী নয়। যেমন করে আমরা বিদেশি দ্বারা শাসিত হয়ে অনেক কিছু ভুল জানি বা ভালো ভাবে জানি না,তেমনি বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস ও আমরা ভালো ভাবে জানি না বা জানতে পারিনা।এটা এক করুন বাস্তবতা। বাংলাদেশ সৃষ্টির শত্রুমিত্র না জানলে বাঙ্গালি জাতীয়বাদী চেতনা, মুক্তি যুদ্ধের চেতনা, মূল্যবোধ চর্চার ক্ষেত্র তৈরী হবে কিভাবে? যে বাংলাদেশে ধনী গরীব বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন গতিশীল হওয়ার কথা,মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সেই শিক্ষা দেয়। কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন তর। আজ সাতক্ষীরা জেলায় ৭৮ টি ইউনিয়নে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শত শত স্থানে সাধারণ জনগণের উপর পাকহানাদার বাহিনী ওতাদের দোশরদের দ্বারা অমানুষিক নির্যাতন, হত্যা গুম অগ্নিসংযোগের স্মৃতি চিহ্ন রয়েছে। অত্যাচারের ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের এই ক্ষতচিহ্ন গুলো ভালোভাবে দরদদিয়ে উপস্থাপন করা হয়নি।কারণ এইজেলার অধিকাংশ সংসদীয় সিট গুলো প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সংসদ সদস্য দ্বারা পরিচালিত হয়নি বা হতে পারেনি। মুক্তি যুদ্ধের চেতনার পক্ষে প্রচার খুবই দুর্বল। এইদেশটি কোনভাবে চলবে? জাতি রাষ্ট্র! না ধর্ম রাষ্ট্র। যারা ধর্মরাষ্ট্র চায়,তারাতো স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ইতিহাস চর্চা হউক সেটা চাইবে না।কিন্ত যারামুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী তারা তো চেষ্টা করবেন,স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহ্য নতুন প্রজন্ম যাতে জানতে পারে সে উদ্যোগ নেওয়া।”,সত্য যে বড়ই কঠিন, আমিকঠিনের ভালোবাসিলাম,সেকখনো করেনাবঞ্চনা” যারা শোষণ বঞ্চনার পক্ষে, তারা ইতিহাসের সত্য পাতাকে আড়াল করতে চায়,ছিঁড়ে ফেলতে চায়। কিন্তু পারেনা। একটি অবাক করার মত বিষয় হলো সাতক্ষীরা জেলার অন্যান্য উপজেলায় কমবেশী বধ্যভূমি, স্বাধীনতা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ স্থাপিত হলেও সাতক্ষীরা সদরউপজেলায় কোন বধ্যভূমি, স্বাধীনতার স্মৃতি স্তম্ভ গড়ে উঠেনি। এর কারণে র গভীরে প্রবেশ করলে দেখাযায় দেশ স্বাধীনের পর থেকে সংসদসদস্য ছিলেন কখনো জামাত নেতা কসাই খালেকমন্ডল,জামাত নেতা কাজীশামসুর রহমান, মুসলিম লীগেরর নেতা রাজিয়াফয়েজ।এমনকি মহাজোট সমর্থিতজাতীয়পার্টির এম এ জব্বার।এরা কেউই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সংসদ সদস্য ছিলেন না। সংগত কারণে এইসদর উপজেলায় মুক্তি যুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন বধ্যভূমি বা স্বাধীনতা,মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ গড়ে উঠেনি। সাতক্ষীরা জেলায় সরকারি হাইস্কুলের পিছনে দিনেষকর্মকারের বাড়ীতে আশ্রয় নেয়া প্রায়চারশ ‘ র মত নারীপুরুষকে পাক সেনারা নির্বিচারে গুলিকরে,বেয়নেটদিয়ে খুচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যাকরে। ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়। সাতক্ষীরার স্বাধীনতা,মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংগঠনও সাংবাদিক বৃন্দ,মুক্তি যোদ্ধারা সম্মিলিত ভাবে ২০১৪ সাল থেকে এই দিনেষকর্মকারের বাড়ীতে সংঘটিত হত্যাযগ্ঞস্থলে বধ্যভূমি গড়ে তোলার দাবী জানাচ্ছে।জনগনের চাপে জেলাপ্রশাসক মাঝে মাঝে বলে থাকেন খুবশিঘ্রই সংঘটিত স্থলে বধ্যভূমি হবে।কিন্তু হচ্ছেনা। আরও অবাক ব্যাপার হলো এখন সদরের সংসদসদস্য একজন মুক্তি যোদ্ধা। দুইবার পরপর সাংসদ। তিনি ও যাতে এইবধ্যভুমি গড়ে ওঠার ব্যাপারে তৎপর হয়ে উঠেন,এলাকাবাসী জোর দাবী জানাচ্ছেন। এছাড়াও, বড়বাজার ডায়মন্ড হোটেল, বাঁকাল ব্রীজ,বাদামতলা,,ঘোনার মোড়,ঝাউডাংগা,বিনেরপোতাসহ চালতেতলাসহ অসংখ্যেয় জায়গায় এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল। এসকল জায়গায় যদি বধ্যভূমি গড়ে উঠে,তাহলে নতুন প্রজন্ম ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে। স্বাধীনতার শত্রু মিত্র চিনতে পারবে।বিদেশি দ্বারাশাসিত হলে যে ইতিহাস পড়ে তরুণপ্রজন্ম বড় হয়,সে ইতিহাস হয় কাপুরুষের ইতিহাস। আর প্রকৃত বাঙ্গালি জাতি তাদের নিজেদের মনোনীত প্রতিনিধি দ্বারা শাসিত হলে তরুণপ্রজন্ম হবে বিরের জাতি,সাহসী জাতি।তাই সর্বক্ষেত্রে বিদেশী প্রভাব মুক্ত শাসনও বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস পড়াও চর্চার কোন বিকল্প নেই। এখন কার প্রজন্ম যদি এইজাতির বিকাশের ইতিহাস সম্পর্কে জানে,তাহলে আত্মমর্যাদা বাড়বে। প্রখ্যাত কবি সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা আমার পরিচয়ে যেমন করে বাঙালির পরিচয় তুলেধরেছেন,তেমনি আমরা বধ্যভূমির মাধ্যমে, স্বাধীনতা,মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ গড়ে তোলার মাধ্যমে এই জাতির শত্রু মিত্রের ইতিহাস সম্পর্কে তরুণদের অবহিত করে আমরা হতে পারব জ্ঞান সমৃদ্ধ গর্বিত জাতি।বর্তমানে মহান সংসদে পঁচিশে মার্চকে গনহত্যাদিবস ঘোষণা করা হয়েছে,তাই এইজেলার যেখানে যেখানে হত্যা নির্যাতন সংঘটিত হয়েছিল, সেখানেই বধ্যভুমি গড়ে উঠা এখন সমায়ের দাবী। জেলায়বধ্যভুমি চাই,ইতিহাস সচেতনপ্রজন্ম চাই।জেলায় মুক্তি যুদ্ধের জাগরণচাই,অতিসত্বর বধ্যভূমি চাই।সাহসী প্রজন্মের জাগরণচাই,হত্যা গুমের হোতাদের চিনতে চাই,দ্রুত বধ্যভূমি স্থাপন চাই।বাদল বিনয়,দিনেশের মত সাহসী প্রজন্ম চাই,সাতক্ষীরায় বধ্যভূমি চাই। বঙ্গবন্ধুর মত সাহসী জাতি চাই,এইজেলায় স্মৃতি সৌধ চাই,বধ্যভূমি চাই। আসুন সাতক্ষীরা কে কলঙ্কমুক্ত করি,রাজাকারমুক্ত,দুর্নীতি মুক্ত হিসাবে গড়েতুলি।সকল প্রকারের চক্রান্ত ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আলোকিত সাতক্ষীরা গড়েতুলি।জয় আমাদের নিশ্চিত।

    অধ্যাপক ইদ্রিস আলী
    সাধারণ সম্পাদক বাংলাদেশ জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি

  • “বিচ্ছেদ নয়, মিলনই মৌলিক” : গঙ্গা-যমুনা উৎসব

    প্রেস রিলিজ
    “বিচ্ছেদ নয়, মিলনই মৌলিক” এই প্রতিপাদ্যে আগামী ৫ নভেম্বর ২০২২ সুশীলন কালিগঞ্জ
    আঞ্চলিক কার্যালয়ে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দুই বাংলার কবি-শিল্পী সাহিত্যিকদের এক
    মিলন মেলা,সৌহার্দ সম্প্রীতি ও সস্ত্রমের গঙ্গা-যমুনা সাহিত্য উৎসবটি বর্তমান দুঃসময়ে অতীব
    গুুত্বপূর্ন। এই সম্মেলনের কলম সৈনিকেরা একটা সুস্থ্য-সুন্দর মানবিক পৃথিবী গড়তে আপ্রান চেষ্টা
    করবে সব যুদ্ধ, হিংসা, ঘৃনা ও বিভেদকে পদদলিত করে। তারা ভালোবসার বন্ধনে প্রতিরোধ করবে
    সব অন্যায়-অবিচার ও অপশক্তির আকমকে।
    এই উৎসব মুখর হয়ে উঠবে, আলো ছড়াবে, জনাব হুমায়ুন করিব, কবি আবদুস সামাদ ফারুক,
    হোসেন উদ্দীন, রফিকুর রশীদ, ড. কানাই সেন, নৃপেন চকবর্তী, শ্যামল জানা, কৃষ্ণা বন্দোপাধ্যায়,
    জয়িতা বসাক, সত্যকাম বাগচি, অঞ্জনা গোস্বামী, কল্লোল ঘোষাল, অনিন্দ্য আনিস, ইমরুল ইউসুফ,
    ফরহাদ খান চৌদুরী সহ শত কবি সাহিত্যিকদের সরব উপস্থিতিতে।
    পরাজয় নয়, মৃত্যু নয়, অমরত্বের অমিয় ধারায় এই সাহিত্য উৎসব আগামীর পথ চলায় শক্তি,
    সাহস ও প্রেরনা জোগাবে। জয় হোক শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির সব সম্মিলন ও উৎসবের।
    তারিখ ঃ ০৩/১১/২০২২ খ্রীঃ
    গাজী আজিজুর রহমান
    আহবায়ক
    গঙ্গা-যমুনা উৎসব কমিটি
    কালিগঞ্জ,সাতক্ষীরা

  • মহাভারত: কেন পড়ব বা কেন পড়ব না?

    মহাভারত: কেন পড়ব বা কেন পড়ব না?

    হামীম কামরুল হক

    প্রতিটি বই-ই একটা না একটা সময় শেষ হয়। লেখকের দিক থেকে তামামশোধ করা হয়। পাঠকের দিক থেকেও ইতি টানতে হয়, কিন্তু মহাভারত এমন এক বই যেটি কেবল শুরু হয়, শেষ হয় না। আপাতভাবে শেষ হয়, কিন্তু সেটি তৈরি করে অসংখ্য সূচনার বৈচিত্র্যময় পথ।
    মহাভারত এক অনিঃশেষ ভ্রমণ। মহাভারতের আরো মজা হলো- মহাভারতের সূচনামুখও অসংখ্য। পরীক্ষিতের মৃগয়ায় হরিণ শিকার, মৌনব্রতপালনরত শমীক মুনির গলায় মরা-সাপ ঝুলিয়ে দেওয়া, শমীক মুনির পুত্র শৃঙ্গীর অভিশাপ- এ থেকে কোথাও শুরু হয়। কোথাও শুরু উপরিচরবসুর কাহিনি দিয়ে। রূপবতী ও আবেদনময়ী স্ত্রী গিরিকার স্মরণে রেতঃপাত ঘটে। গল্পটি হলো: গিরিকা উপরিচরবসুর কাছে সহবাস আশা করেন, কিন্তু তিনি মৃগায় থাকায় তা সম্ভব হয় না। অথচ সেই স্ত্রীর স্মরণে তার রেতঃস্খলন ঘটে। সেই স্খলিত-শুক্র শ্যেনপক্ষীর একটি পাতায় করে নিয়ে যাওয়ার সময় আরেক শ্যেনপক্ষীর আক্রমণে সেটি জলে পড়ে যায়। তা খেয়ে নেয় মাছের রূপে থাকা অভিশপ্ত অপ্সরা অদ্রিকা। তার গর্ভ হয়। জন্ম হয় এক পুত্র ও এক কন্যার। এক ধীবরের জালে এই পুত্র-কন্যা ওঠে। নিয়ে যাওয়া হয় মৎস্যরাজের কাছে। অপ্সরা শাপমুক্ত হয়। পুত্রকে উপরিচরবসু গ্রহণ করেন, কিন্তু মৎস্যরাজকে কন্যাটি দান করেন। এই কন্যাই মৎস্যগন্ধ, পরে যোজনগন্ধা, পরে সত্যবতী। ঘটনাচক্রে সত্যবতীর সঙ্গে মহারাজ শান্তনুর বিয়ে হয়। এরপর… এরপর…। একথা তো সবার জানা, নানান লোকের লেখা মহাভারতে ঢুকিয়ে দিয়ে বেদব্যাসের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। শ্নোকের সংখ্যাও এক নয়। সবচেয়ে মজার বিষয় যে, সবমিলিয়ে মহাভারত পাওয়া গেছে ১২৬৯টি। আরো মজার বিষয় হলো, মহাভারতের নাম প্রথমে মহাভারত ছিল না। প্রথমে এর নাম ছিল ‘জয়’। সংস্কৃতে রচিত মহাভারত বাঙালির কাছে কয়েকটি সংস্করণ লাভ করে। কারো কাছে কাব্য, কারো কাছে তা ধর্মগ্রন্থতুল্য, কারো কাছে ইতিহাস। রবীন্দ্রনাথের মতো আরো অনেকেই এটিকে ভারতবর্ষের ইতিহাস বলেছেন।
    ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা দিয়ে আমরা ছোটগল্প লিখতে পারি, তা দিয়ে উপন্যাস লিখতে পারি না- এমন ছকে কোনো কিছুই বলে দেওয়া যায় না। মহাভারতের দিকে তাকালে এটা দারুণভাবে লক্ষ করা যায় যে, অসংখ্য ব্যক্তির নানান আকাঙ্ক্ষা ও সেটি পূরণ না হওয়ার বাধাই যেন মহাভারতে জালচক্রের মতো কত না আখ্যান-উপখ্যানের জন্ম দিয়েছে। কেউ কেউ বলেন, দ্রোণের বাল্যবন্ধু দ্রুপদের কথা দিয়ে কথা না রাখা থেকেই সংকটের সূচনা। কথা ছিল: দ্রুপদ রাজা হলে তিনি বন্ধু দ্রোণকে অর্ধেক রাজত্ব দেবেন। কিন্তু দ্রুপদ পাঞ্চালের রাজা হয়ে সেটি তো করলেনই না, বরং একদিন দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামা ক্ষুধায় কাতর হয়ে দুধ খেতে চাইলে তিনি তাকে পিটুলি গোলা খাইয়েছিলেন। (আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘দুধভাতে উৎপাত’ গল্পের কথা মনে পড়ছে কি?) এই ধোকা থেকেই মহাভারতের সংকট শুরু।
    কেউ বলবেন, দুর্যোধন যখন ভীমকে মিষ্টান্নের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাওয়াল, তাকে হত্যার চেষ্টা করল- তা থেকেই মহাভারতের সংকট ঘনিয়ে উঠল। আরো অনেক অনেক আগে ‘ভীস্মের প্রতিজ্ঞা’ই মহাভারতের সমস্ত জটিলতার কারণ। গঙ্গার চলে যাওয়া, সত্যবতীর হস্তিনাপুরের মহারানি হওয়াও তো এর আরেক সূচনা। ফলে মহাভারতের সংকটগুলির সূচনার এত এত দিক আছে, যা গুনে শেষ করা যাবে না। এমনকি গণেশ যখন এটিকে লিপিবদ্ধ করতে সম্মত হলেন এই শর্তে যে, ব্যাসদেব কোনোমাত্র বিরতি দিতে পারবেন না, তখন ব্যাসও গণেশকে পাল্টা একটি শর্ত দিলেন যে, গণেশ না বুঝে একটি পঙক্তিও লিপিবদ্ধ করতে পারবেন না। সেখানে কত কত ধাঁধা, আর কত না ব্যাসকূট- আমরা যেটিকে হেঁয়ালি বলি, ব্যাসকূটগুলি তার চেয়েও জটিলচক্রে গণেশকে ফেলে দিয়েছিল। এভাবে মহাভারত যে-পড়ে তার জন্য তৈরি করে বিচিত্র খাত। এক দিকে গেলে আরেক দিক নয়, হাজার দিক পড়ে থাকে। আবার সব দিক, নানান ধারা থেকে উঠে এসে একটা চূড়ায় পৌঁছাতে চায়, সেই চূড়া তো স্বর্গ। ফলে সেখানে ধর্মগ্রন্থগুলির লক্ষ্য বলি, আর দান্তের ‘দিব্যাভিসার’-এর কথাই বলি, সবই তো সেই স্থানে থিতু হতে চায়, যেখানে জীবন অনন্ত, যা সমস্ত ক্ষদ্রতা থেকে মুক্ত।
    অন্যদিকে, ব্যক্তি-পাঠকও মহাভারতের কাছে যান নিশ্চয়ই কেবল কাহিনি জানার জন্য নয়। এমনিতে মহাভারতের মূল কাহিনি, রূপরেখা ঋদ্ধ-পাঠকেরা নানানভাবেই জানেন। তার আরো চাওয়া থাকে। সেই চাওয়ার হাজারটা স্রোত তৈরি হতে থাকে। এক কাহিনি এত বার, বার বার পড়েও কেন তল পাওয়া যায় না? বার বার মহাভারতের কাছে ফিরে যান কোন কোন পাঠক? সব পাঠকই কি মহাভারত ফিরে ফিরে পড়েন? একজন ভারতীয়র কাছে মহাভারতের আবেদন যা, অভারতীয় পাঠক বা পশ্চিমা পাঠকের কাছে কি তা অভিন্ন? ইন্দোনেশিয়ায় যে-মহাভারতের পাঠ (টেক্সট) পাওয়া যায়, তাতে প্রধান চরিত্র ঘটোৎকোচ; যুধিষ্ঠির, অর্জুন বা কৃষ্ণ কেউ নয়; এবং সেখানে দ্রৌপদীর স্বামী কেবল যুধিষ্ঠির। এছাড়াও মহাভারতের যে ১২৬৯টি মহাভারত পাওয়া গেছে, এর কোনো কোনোটিকে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধটিই অনুষ্ঠিত হয়নি। তাহলে মহাভারতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যেকোনো বিষয়কে একেবারে সরিয়ে রেখে, বা বাদ দিয়ে বা গণ্য না করেও কিছু মহাভারত পাওয়া যায়। কিন্তু একটি বিষয় ধরেই নেওয়া যায় যে জীবনের অনন্ত তৃষ্ণা ছাড়া কি মহাভারতকে ভাবা যায়?
    বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে- ধ্রুপদি সাহিত্যপাঠে মেধা-বুদ্ধিমত্তা এবং আই.কিউ দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। মহাভারত পাঠে সেটি কতটা ঘটানো যায়? মহাভারতের উপযোগিতা হিসেবে মেধা বাড়ানোর জন্য এটি পড়তে হবে, তা-ই বরং মহাভারত পড়তে পড়তে এর পাঠক সবার আগে ভুলে যেতে পারে। তারপরও এই সময়ের পাঠক হিসেবে আমি ও আমরা কী চাই মহাভারতের কাছে? নিজেকেই কি দেখতে পাই এর কোনো চরিত্রের ভেতর? দেখতে পাই কি যে রাজনীতি কূটচালে রাষ্ট্র চলে, তার কেন্দ্রে বা সেন্টার পয়েন্টে যে থাকে, তাকে যেন একদম অন্ধ করে দেওয়া হয়- এমন ব্যবস্থাই কি হাজার বছর আগে থেকেই চলমান আছে? রাজা বা প্রধান নির্বাহীকে ঘিরে ফেলে এমন এক নষ্টচক্র, যার বিরুদ্ধে রাজা বা ওই প্রধান নির্বাহীর প্রায় কিছুই করার থাকে না। ক্ষমতার জালচক্র এমনই জটিল- তাতে কোনো সরল অঙ্ক চলে না। কোনো গাণিতিক সমীকরণে এর ইতি টানা যায় না। তবুও রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাজনীতি ও ক্ষমতার সূক্ষ্ণ সব দিকের গভীর নিবিড় পাঠে মহাভারত দারুণভাবে সহায়তা করতে পারে। দাবা খেলার চাল যেমন লিখে রাখা যায়, পরে সেমতো খেলাটা আবার খেলা যায়, তখন স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে একটি চালের একাধিক ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য, তেমন করেই যেন মহাভারত একবার পুরো পড়ে আবার পড়লে বা বার বার পড়লে তেমনই কাণ্ড ঘটতে থাকে। এবং এই কাণ্ড নিরন্তর। অশেষ। জীবনের মতোই।
    ব্যক্তি মানুষের জীবন শেষ হয়, কিন্তু জনগোষ্ঠীর জীবন, মানবজীবন চলতে থাকে। মানুষের মৃত্যু হলেও মানব থেকে যায়। মহাভারতে পাঠ কোনোদিন ফুরায় না। আর কী গভীর প্রত্যয়ে মহাভারতে ঘোষণা করা হয়: এই কাব্য আগামীতে অসংখ্য লেখকের হাতে চর্চিত হতে থাকবে। আসলে জীবনকে বোঝার জন্যই এর প্রয়াস অব্যাহত থাকবে। আর কী সে জীবন? যতটা সমষ্টির, ততটাই ব্যষ্টির। ফলে মহাভারত গোষ্ঠীর ইতিহাসই শুধু নয়, জগতে পথ সন্ধানী অনুসন্ধানী প্রত্যেক ব্যক্তির রূপরেখা দেখে নেওয়ার মহাকাব্য। তবে একে একটি আজগুবি ও অনৈতিক (এক নারীর পাঁচ স্বামী, ইত্যাদি) মহাকাব্য বলে আগেই ধরে নেবেন, বা খোলামনে একে পড়তে আগ্রহী হবেন না, তার মহাভারত না পড়াই উত্তম।
    আরো একটি বিষয় খেয়াল করার যে বাংলা অঞ্চলে রামায়ণ যতটা জনপ্রিয়, মহাভারত ততটা আদৃত নয়, আদৃত নয় মানে ছিল না। রামায়ণে গার্হস্থ্য জীবন, পারিবারিক মূল্যবোধই প্রবল, অন্যদিকে মহাভারত পূর্ণ হয়ে আছে বিচিত্র ট্যাবুতে। এক নারীর পাঁচ স্বামীর বিষয়টি তো বটেই, অবৈধ প্রণয়, সন্তানের জন্মপরিচয়হীন দশার নানান পরিপ্রেক্ষিত ও পটভূমিতে টলে যাচ্ছে প্রচলের সমস্ত মূল্যবোধের ভূমি ও ভূমিকা। স্বজনের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ- ইত্যাদি কঠোরতা কোমল বাঙালি প্রাণে সয় না হয়তো। তাই মহাভারত খোলামনে পাঠ না করতে পারলে মহাভারত পড়া উপভোগ্য নাও হতে পারে। তবে মহাভারত পড়তে পড়তেই কেটে যেতে পারে সংস্কার-কুসংস্কারের অনেক জটাজট। মহাভারতের গভীর দার্শনিকতা ও প্রজ্ঞা আমাদের তো সেই স্তরে নিয়ে যায়- বিখ্যাত দার্শনিক ইমানুয়েল লেভিনাস দর্শনকে যেভাবে বুঝতে চেয়েছিলেন। ইউরোপে দর্শন বা ফিলোসফি অর্থ তো জ্ঞানের জন্য প্রেম। তিনি এটা উল্টে দিয়ে বললেন: প্রেমের জন্য জ্ঞানই হলো প্রকৃত দর্শন। মহাভারত দর্শনকে দিয়ে প্রজ্ঞা আর প্রেমকে নিয়ে গেছে খাঁটি বাসনার প্রকৃত প্রতীকে। এই বাসনা হলো সৃষ্টিশীলতার বাসনা। সৃষ্টির জন্য তীব্র ও সংহতশক্তি চাই। মহাভারতে দ্রৌপদী হলেন সেই সংহতশক্তি। তিনিই সংহতির কেন্দ্র আর পঞ্চ পাণ্ডব হলো পঞ্চ ইন্দ্রিয়। খোলা হাত মুঠি করলে যা হয়, তাতে হাতে ততটা শক্তি দেখা দেয় না, পাঁচ আঙুল হলো পাঁচ ইন্দ্রিয়, সেগুলি আলাদা ও বিচ্ছিন্ন থাকলে মনুষ্যত্ব লড়াইয়ে মানুষ হেরে যায়। তখন অন্যায়ই বড় হয়ে ওঠে। ফলে এদের একসঙ্গে আনতে হয়, তাদের বিচ্ছিন্ন শক্তিকে কেন্দ্রীভূত করতে হয়। আর হাতের তালুটিতে সব জড়ো হয়ে সংহত ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এমন অসংখ্য আভাস ইঙ্গিত দিয়ে মহাভারত ভরে আছে। যেমন ভীস্ম স্বয়ং আরেকটি ইঙ্গিত দেন। আমরা বুঝতে পারি, যে-ব্যক্তি কোনো বিষয়ে গভীর জ্ঞানে প্রজ্ঞায় ও প্রতিজ্ঞায় অটল থাকে তাকে আসলে আর হত্যাই করা যায় না। সে অমরত্ব লাভ করে। ফলে একেকজন আইনস্টাইন, একেকজন রবীন্দ্রনাথ, একেকজন পিকাসো কি সুলতানের আর কোনো ক্ষয় নেই। এক প্রচণ্ড প্রবল বলিষ্ঠতা, জীবনাকাঙ্ক্ষার অপার শক্তি ব্যক্তি ও তার সৃষ্টিকে স্থায়ী ও চিরায়ত মূল্যে দুনিয়ার কাছে বার বার উপস্থাপন করতে থাকে। মহাভারত স্বয়ং সেই প্রতিজ্ঞার নাম।
    আবার ঠিক উল্টো দিকে মহাভারত এক অন্তহীন দ্বিধা-সংশয়ের অগ্নিপথ তৈরি করে দেয়। চিরঅতৃপ্তিতে লীন করে দেয়ে মানুষকে। মহাভারতের সঙ্গে যে যুক্ত হয়, সে এত কিছুর হাত থেকে মুক্ত হতে থাকে যে জগতের কোনো প্রচল পথে আর সে নিজেকে বাঁধতে পারে না। কোনো বন্ধনই তার আর ভালো লাগবে না। সে হয়ে উঠতে পারে অরণ্যে কি জনারণ্যে সাধুসন্ত, একদম বেদব্যাস যেমন। কারোবা দেখা দিতে পারে অন্তহীন অপার সৌন্দর্যতৃষ্ণা। সেই সঙ্গে সে দেখে: জীবনের কাছে কোনো কিছু চূড়ান্ত নয়, ধ্রুব নয়। ফলে নিৎসের মতো লোকদের না পড়লেও মহাভারতে পাঠক জেনে যান, উপলব্ধি করেন, নাথিং ইজ অ্যাবসলিউট। সে পাঠক ফ্রয়েড বা হ্বিটগেস্টাইন না পড়লে জেনে যায়, প্রত্যেকে নিয়ত এক সূক্ষ্ণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে যেকোনো সময় পতন ঘটতে পারে। উত্থান ও পতন- কোনোটাই কারো জন্য ধ্রুব নয়। কোনো সংকট চিরস্থায়ী নয়, চিরসুখ বলে মনের কোনো অবস্থা নেই। সবই ক্ষণিকের। কিন্তু কিছুই কি স্থায়ী নয়? জগতের আরেক অসামান্য মহাকাব্য শাহনামায় ফেরদৌসী ঘোষণা করেছিলেন, একমাত্র সুকর্ম চিরস্থায়ী। তিনি বার বার বলেছেন, মানুষ এই জগতের সরাইখানায় ক্ষণিকের অতিথিমাত্র, আবর্তমান আকাশের নিচে সুকর্ম ছাড়া আর কোনো কিছুই স্থায়ী নয়, তাই মঙ্গল ছাড়া অমঙ্গলের কোনো বীজ যেন কেউ বপন না করে। কারণ যে বীজ সে বপন করবে, পরিণামে কাটতে হবে তারই ফসল।- এই সহজ কথাগুলি কি জগতের মানুষ শোনেনি? কত বার শুনেছে? এর ফলে কী ঘটেছে? সাহিত্যের আবেদন ব্যক্তি মানুষের কাছে হলেও তা সেই ভাষা ও জনগোষ্ঠীর সীমা পার হয়ে যদি সর্বজনীন হয়ে ওঠে, তাহলেই তার জিৎ।
    ভীস্ম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন হস্তিনাপুরকে সুরক্ষিত করবেন। কিন্তু নিজের পরম্পরা নির্মাণ না করেই এই সুরক্ষা কতটা নির্মিত হলো? ভীষণ প্রতিজ্ঞা যে করেছিলেন, সত্য (ধর্ম) ও সামর্থ্যের সম্মেলনে এক আদর্শরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য, শেষমেশ তিনি কি তা প্রতিষ্ঠা করে যেতে পারলেন? শান্তনু যদি গঙ্গাকে অষ্টমপুত্রটি ফেলতে বাধা না দিতেন, তাহলেই তো মহাভারত নামের এই আখ্যান তৈরি হতো না, এই ধারায় তা নির্মিত হতো না, হতো কি? গঙ্গাপুত্র ভীস্ম, চন্দ্রবংশজাত। মহাভারতের আরেক দ্বন্দ্ব হলো চন্দ্র ও সূর্যবংশীয়দের মধ্যে। কিন্তু তা কেবল এখানেই শেষ নয়। দ্বন্দ্বের ভেতরে আরো আরো দ্বন্দ্ব আছে। তা থেকে জাত নানান সংকটের ভেতরে আছে আরো অনেক সংকট। ফলে যে-যুদ্ধ, সেই যুদ্ধের ভেতরে আছে আরো অনেক যুদ্ধ।
    ধর্মযুদ্ধের নামে অর্জুনকে প্ররোচিত করা কৃষ্ণ আদতে কোন সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন? কৃষ্ণ মূলত বিষ্ণুর আরেক আবর্তন, যার সঙ্গে শিবের চিরবিরোধ। আর কৌরবরা হচ্ছে মহাদেব শিবের দিকে ঝোঁকানো পক্ষ। এমন দ্বন্দ্বের ভেতরে আছে কত না ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব। যেমন, কেবল দ্রোণকে ঘায়েল করার জন্য অশ্বত্থামার মৃত্যু হয়েছে ‘ইতি গজ’- নামে এই একটি মিথ্যা নয়, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির আরো আরো মিথ্যা বলেছিলেন। বেদব্যাস নিজের সবচেয়ে গোপন কথা বলতেও দ্বিধান্বিত ছিলেন, না কিন্তু ‘যুধিষ্ঠির যে বিদুরের পুত্র’, যে বিদুর স্বয়ং ‘ধর্ম’, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির বলতে একটা গভীর গোপন রহস্য খেলে গেছে মহাভারতের আখ্যানজুড়ে, যা ব্যাস স্পষ্ট উচ্চারণ করেননি, কারণ ক্ষমতা, তাও রাজ্যের ক্ষমতা বলে কথা। ফলে সবই প্রকাশযোগ্য কিন্তু ক্ষমতা হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে- তেমন কিছু নৈব নৈব চ।
    মহাভারত মহাসমুদ্রের মতো। তীর আছে, পার নেই। মহাভারত-প্রেমও একই। শুরু আছে, শেষ নেই। কিন্তু পাঠককে মহাভারত থেকে নিজেকে তুলেও আনতে হয় বার বার। দেখে নিতে হয়, এই মহাভারত-বিচ্ছিন্নতা তাকে কী দেয়? সবচেয়ে যেটি দেয় তা হলো, প্রজ্ঞার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা। যে-বিচ্ছিন্নতা জগৎকে বুদ্ধি ও মননকে প্রধান করে তুলতে চায়। ভারতীয় সাধকরা জানেন, বুদ্ধির সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো অহংকার। সেই অহংকার বিদ্যা ও বুদ্ধির সম্মেলনে উৎসারিত হতে পারে। বিদ্যা ও জ্ঞান যথাক্রমে খণ্ডিত ও সার্বিক। কিন্তু জ্ঞানের চেয়ে প্রজ্ঞা দুর্লভ। নিজের জীবনকাহিনির দিকে না তাকালে সেই প্রজ্ঞা কোথা থেকে তৈরি হবে? প্রজ্ঞা কল্পনা ত্যাগ তিতিক্ষা- ইত্যাকার অনেক কিছুকে, কেউ কেউ বুর্জুয়া, কেউবা প্রাচীন বলে গণ্য করেন। সত্য বলে কিছু নেই, যা সাহিত্যের মধ্যে দিয়ে আমার পেতে পারি- তা হলো মানবিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ, লেখক তার সৃজনের গুণে একটি স্তরের বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করেই সেটি আমাদের পাইয়ে দিতে পারেন। এছাড়া সাহিত্য থেকে এখন লেখকের কি পাঠকের আর কিছু পাওয়ার নেই।
    আমরা বিস্মিত হয়ে দেখতে পাব, আমাদের ধরে নেওয়া সমস্ত কিছুতে কতভাবে উৎখাত করা হয়েছে মহাভারতে। এতে থাকা কোনো না কোনো কাহিনি সেই নিরাকরণ ঘটিয়েছে, যা কিছু নিশ্চিত, মহাভারত পাঠ সেগুলিকে অনিশ্চিত করে তোলে। আবার যা কিছু অনিশ্চিত, সেগুলিকে নিশ্চিত করে তোলে। কিন্তু এর ভেতরেই আছে সেই পরশপাথর। গল্পটা অনেকেরই জানা: পরশপাথরের খোঁজ করছিল এক ব্যক্তি, যে-পাথরের ছোঁয়ায় লোহা সোনায় পরিণত হয়। এক সাধক বলেন, সমুদ্রপাড়ে অসংখ্য পাথরের ভেতরে এটা আছে। খোঁজো। লোকটি খুঁজতে থাকে। অক্লান্ত চেষ্টা করেও পায় না। কিন্তু একসময় খেয়াল করে তার লোহার আংটিটি এর ভেতরেই সোনা হয়ে গেছে। পরশপাথরটি সে নিজের অজান্তে স্পর্শ করেছিল, কিন্তু চিনতে পারেনি। পেয়েও হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু মহাভারতে পরশপাথরগুলি হলো এর পঙক্তিমালা, যা চাইলেই চোখের সামনে ফুটে উঠতে পারে। মহাভারতের অসংখ্য ঘটনা কাহিনি চরিত্র ও ভাষা-ভাষ্যের ভেতরে আছে এমন সব পরশপাথর, যা জান্তে ও অজান্তে আমাদের অনেক কিছুকে শুধু সোনায় পরিণত করাই নয়, হীরের ধার এনে দিতে পারে, যা দিয়ে আপনি আমি আমরা আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা অনেক কাচের দেওয়াল ভেদ করতে পারি।

  • আহত সেনাপতি আবু তাহের এবং একটি চিরকুট

    আহত সেনাপতি আবু তাহের এবং একটি চিরকুট


    সৈয়দ মনিরুজ্জামান
    মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর ১১-এর অধিনায়ক মেজর (পরে কর্নেল)আবু তাহের। সেক্টরের সদর দফতর মেঘালয় রাজ্যের তুরা পাহাড়ের সীমান্তঘেষা মহেন্দ্রগঞ্জে। মহেন্দ্রগঞ্জ, মানকারচর, পুরাকাশিয়া, সাঙ্গু ও বাগমারা-এই পাঁচটি ‘সাব-সেক্টর’ নিয়ে গঠিত হয় সেক্টর-১১। মেজর আবু তাহের উল্কার মত ছুটে প্রতিদিন প্রতিটি ‘সাব-সেক্টর”-এ পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। সে এক বিস্ময়কর যোগ্যতা।
    ১৪ নভেম্বর ১৯৭১। ঘটনাবহুল ১১ নম্বর সেক্টরে ঐতিহাসিক কামালপুর যুদ্ধের অবিস্মরণীয় এক দিন।
    ১৩ নভেম্বর গোপন সংবাদে জানা গেল কামালপুর বিওপির উত্তর দিকে ভারতীয় বেড়িবাঁধ সংলগ্ন কিছু বাঙ্কার থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা সরে গেছে। এই সংবাদের ভিত্তিতে সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের ঐ বাঙ্কারগুলোতে অবস্থান নিয়ে কামালপুর দখল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হেলাল কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা একটি গ্রুপ নিয়ে রাত সাড়ে দশটায় মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে গেল। বেড়িবাঁধ অতিক্রম করে কামালপুর পোস্টের উত্তর-পূর্ব কোণে পাকিস্তানীদের পরিত্যাক্ত বাঙ্কারগুলোতে অবস্থান নিল।
    উত্তর পূর্ব দিকে প্রথম বাঙ্কারে মেজর তাহের, তাঁর দেহরক্ষী বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সিপাহী এবং তাঁর দুই ভাই বেলাল-বাহার। হেলাল কোম্পানির কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও একই সাথে অবস্থান নেয়। কয়েকশত গজ দূরে পশ্চিম দিকের বাঙ্কারগুলোতে হেলাল, লতা, মিঠু, সুজাসহ আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান গ্রহণ করে। কামালপুর বিওপির মুখোমুখি ধানুয়াতে আবেদীন কোম্পানির জয়নাল আবেদীন, লেফটেন্যান্ট মিজান, সাঈদ কোম্পানির সাঈদ (তাহেরের ছোট ভাই), ক্যাপ্টেন মান্নান ও হারুন-হাবীব সহ আরো অনেকে তাদের গ্রুপ নিয়ে বিভিন্ন “হাইড আউটে” আগে থেকেই অবস্থান করছিল।
    প্রত্যেক গ্রুপের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় রক্ষার জন্যে ছিলো কয়েকটি ‘ওয়াকিটকি’। মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে আমার হাতে ছিলো আরেকটি সেট। প্রত্যেকটি গ্রুপের সাথে আমি যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলাম। বেড়িবাঁধের উত্তর পাশে মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে মিত্রবাহিনীর ১৩ গার্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ফায়ারিং দিয়ে ঐতিহাসিক অপারেশনটিকে ‘কভারেজ’ দিচ্ছিল। পরিকল্পনাটি আগেই করা হয়েছিল।
    ভোররাত ৩টা ৪৫ মিনিটে অপারেশন শুরু হল। সকাল সোয়া সাতটা পর্যন্ত দু’পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গুলিবিনিময় হলো। কিন্তু এতো প্রচন্ড গোলাগুলির পরও হানাদার বাহিনী তাদের বাঙ্কার থেকে উঠে আসেনি। ১৪ নভেম্বর সকাল সাড়ে আটটার দিকে মেজর তাহের তাঁর বাঙ্কার থেকে উঠে লে. মিজান ও হেলালের পজিশনে আসেন। তাদের কোন অবস্থাতেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে উঠে না যাওয়ার নির্দেশ দেন। এ সময় ধানুয়া ‘হাইড আউটের’ কোম্পানি কমান্ডার আবেদীন এগিয়ে এসে মেজর তাহেরের সাথে কথা বলতে থাকেন। সকলের সাথে কথা বলতে বলতে তাদের বাঁধের কাছে ঘাসের ওপর বসে পড়েন। মুহূর্তেই প্রচন্ড একটি শব্দ হয় এবং সকলের সামনেই মেজর তাহের মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। উপস্থিত সকলেই মনে করেন, কোন একটি মর্টার সেলের আঘাত- আবার কেউ কেউ মনে করেন যেখানে তাহের লুটিয়ে পড়েন সেখানে একটি ‘এন্টি পারসোনাল মাইন’ ছিল। সে যাই হোক, তাঁর বাম পায়ের হাঁটুর উপরের অংশ প্রায় দ্বিখন্ডিত হয়ে সামান্য কিছু শুধু চামড়ার সাথে ঝুলে থাকে।
    এ ঘটনায় উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা হতভম্ব ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে এই মর্মান্তিক খবর। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ থেমে যায়। সে বারে কামালপুর বিওপি থেকে পাকিস্তানীদের হটিয়ে দেয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু কি আশ্চর্য, এত রক্তপাতের পরও মেজর তাহের সংজ্ঞা হারান নি। তিনি আঘাতপ্রাপ্ত অংশটিকে গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিতে বললেন যেন রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। দু’তিন জনকে তাঁর কাছে থাকবার এবং বাকী সবাইকে যার যার অবস্থানে চলে যেতে বললেন।
    এরপর গামছা দিয়ে বেঁধে রাইফেলের বাঁট দিয়ে ঝুলিয়ে বহু কষ্টে বাঁধের ওপারে ভারতীয় সীমানায় আনা হয় আহত তাহেরকে। আসার সময় জয়নাল আবেদীনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা এসো না-কামালপুর আজ দখল করতেই হবে।’ ভাবতে অবাক লাগে এ অবস্থায় এমন সঠিক নির্দেশ দেয়া কী ভীষণ মনোবলের পরিচয় বহন করে একজন সেনাপতির!
    এ সময় ক্যাম্পে বসে আমি প্রতিটি গ্রুপের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলাম। প্রায় ন’টার দিকে ক্যাপ্টেন মান্নান জানতে চাইলেন আমি মেজর তাহেরের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পেরেছি কিনা। তিনি জানালেন কয়েকবার চেষ্টা করেও তিনি লাইন ধরতে পারেন নি।
    কিছুক্ষণ পর আমি লে. মিজানের লাইন পেলাম। ধরেছিল কোম্পানি কমান্ডার হেলাল। হেলাল কান্নাজড়িত কন্ঠে মেজর তাহেরের অবস্থা জানাল এবং সেক্টর কমান্ডারকে সরিয়ে নেয়ার জন্যে এম্বুলেন্স পাঠাতে বলল। আমি বিএসএফের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নিয়োগীর সাথে যোগাযোগ করে এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করি। তিনি জানালেন, তিনি আগেই খবরটি পেয়েছেন এবং এম্বুলেন্স ইতিমধ্যেই পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
    এক ঘন্টা পর হেলালের সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হলাম যে, মেজর তাহেরকে বাঁধের এপারে নিয়ে এসে এম্বুলেন্সে তুলে দেয়া হয়েছে। মিত্র বাহিনীর মেজর মুখার্জী (ডাক্তার) নিজেই এম্বুলেন্স নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের মেডিক্যাল কোরের মুক্তিযোদ্ধা নাসিরকে এম্বুলেন্সের সাথে দেয়া হয়েছে। সেক্টরের ডাক্তার প্রেমাংকুর রায়ও এসেছেন। ডা. মেজর মুখার্জী মেজর তাহেরকে শিলিগুড়ি হাসপাতালে নিয়ে যান। ক্যাম্পে আমি দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠায় পায়চারি করে কালক্ষেপণ করছি মাত্র। কিছুই যেন করার নেই। এমন সময় সেন্ট্রি মহেন্দ্রগঞ্জ থানার একজন পুলিশকে আমার কাছে নিয়ে এলো। সে আমাকে ভাঁজ করা একটি কাগজ হাতে দিয়ে বলল, থানার ও.সি. সাহেব পাঠিয়েছেন। চিরকুটটি হাতে নিয়ে পড়লাম।
    হাতের লেখা স্পষ্ট, সুন্দর-কিন্তু আমার পরিচিত নয়। পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, আহত তাহেরকে নিয়ে যে এম্বুলেন্সটি যাচ্ছিল, মহেন্দ্রগঞ্জ থানার সামনে থামিয়ে থানার ও.সি.কে ডেকে একজন ডাক্তার চিরকুটটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছে দিতে বলেন।
    ঘটনার সাত-আটদিন পর ডাক্তার মেজর মুখার্জীর সঙ্গে মহেন্দ্রগঞ্জে আমার দেখা। তিনি কিছুক্ষণ সময় দিলেন। জানতে চাইলাম ১৪ নভেম্বর মেজর তাহেরকে কেমন দেখেছেন। জবাবে মেজর মুখার্জী বললেন, “কি বলব মেজর তাহেরের কথা। আমি সামরিক বাহিনীর ডাক্তার-যুদ্ধাহত সৈনিক নিয়েই আমার কারবার। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে যুদ্ধাহত কত সৈনিকই তো দেখলাম কিন্তু মেজর তাহেরের মত একজনও দেখিনি। অমন আহত অবস্থায় রোগীরা যন্ত্রণায় চিৎকার করে- বাবাগো, মাগো, আল্লাহ-ভগবান বলে বিলাপ করে। কিন্তু তাহেরকে যখন এম্বুলেন্সে উঠালাম-তিনি নিশ্চুপ তাকিয়ে ছিলেন, আমায় দেখলেন। ভাবলাম, অধিক রক্তক্ষরণে নির্জীব হয়ে গেছেন। আমি তাড়াতাড়ি স্যালাইনের ব্যবস্থা করলাম। এম্বুলেন্স নিয়ে যখন বাঁধরোড অতিক্রম করে মহেন্দ্রগঞ্জ থানার কাছে এসেছি-তিনি জানালা দিয়ে চারদিকে তাকালেন। এরপর আমাকে বললেন- উড়পঃড়ৎ, ও ংঁঢ়ঢ়ড়ংব ও ধস হবধৎ ঃড় গবযবহফৎধমধহল ঞযধহধ?
    আমি বললাম, ‘ণবং’
    বললেন ঝঃড়ঢ় ঃযব াবযরপষব. গাড়ি থামানো হল। তিনি বললেন, ‘চষবধংব ঃধশব ধ ঢ়রবপব ড়ভ ঢ়ধঢ়বৎ ধহফ ৎিরঃব যিধঃ ও ংধু.’
    তাঁর নির্দেশমতো কাগজ কলম নিয়ে লিখলাম তিন লাইনের একটি চিঠি। তাঁর পরামর্শমতোই চিরকুটটি থানার ওসিকে দেয়া হলো, যা আপনি পেয়েছেন। তারপর থেকে সেদিনকার ঘটনাটি আমি অনেক ভেবেছি। অমন মারাত্মক আহত অবস্থায় একজন মানুষ অমন সুচিন্তিত কথা বলতে পারে-নির্দেশ দিতে পারে-তা আমি আজও ভাবতে পারি না। আমার মনে হয়-ওঃ ধিং হড়ঃ গধল. ঞধযবৎ ঃধষশবফ ঃড় সব ৎধঃযবৎ রঃ ধিং যরং রহারহপরনষব রিষষ ঢ়ড়বিৎ ধহফ ফবঃবৎসরহধঃরড়হ যিড় ঃধষশবফ. অমন সাহসী ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী মানুষ আমি দেখিনি!”
    দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মার্চ ১৯৭২ মেজর তাহের পুনা হাসপাতাল থেকে দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তাঁর বাসায় দেখা করতে গেলাম। পুনা হাসপাতালে চিকিৎসার কথা, ‘ফলস’ পা লাগানোর কথা তাঁর মুখে বিস্তারিত শুনলাম। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে দেখতে পুনা হাসপাতালে গিয়েছিলেন এবং কেমন আন্তরিকতার সাথে তাঁর চিকিৎসার খোঁজ খবর নেন, সে ঘটনা বর্ণনা করলেন তিনি।
    মেজর তাহেরের সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তিনি হাসতে হাসতে বললেন,- ‘জামান, আমার জন্ম হয়েছে ১৪ নভেম্বর, পঙ্গু হলাম ১৪ নভেম্বর, মনে হয় আমার মৃত্যুও হবে কোন এক ১৪ নভেম্বর।’
    তাই কি হয়েছিল?
    প্রত্যেক ২১ জুলাই কর্নেল তাহেরের স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে আমার মনের আকাশে। আর ভাবি, তাই কি হয়েছিল?
    -সান ফিচার সার্ভিস

  • মৌচাক সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সভা

    মৌচাক সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সভা


    নিজস্ব প্রতিনিধি: মৌচাক সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শনিবার বিকালে সাতক্ষীরা জেলা শিল্পকলা একাডেমির দ্বিতীয় তলায় হলরুমে সংগঠনের সহ সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মো. আব্দুল বারীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মৌচাক সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে সাহিত্য সম্মেলন, গুণীজন সংবর্ধনা, মৌচাক পত্রিকা প্রকাশনাসহ মৌচাকের একযুগ পূর্তি অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রাখেন মৌচাক সাহিত্য পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা আব্দুর রব ওয়ার্ছী, উপদেষ্টা অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হোসেন, সহ সভাপতি ডা. মো. রবিউল ইসলাম, শেখ মোশফিকুর রহমান মিল্টন, কোষাধ্যক্ষ মো. আব্দুল মজিদ, সাহিত্য সম্পাদক বেদুঈন মোস্তফা, সহ সাহিত্য সম্পাদক মো. রফিকুল বারী, মহিলা সম্পাদিকা শাহানা জামান, সহ সম্পাদিকা গুলশান আরা, আশরাফুল হক রাজ্জাক, মো. মসরুর রহমান, সাকিবুর রহমান বাবলা প্রমুখ। অনুষ্ঠানে মৌচাক সাহিত্য পরিষদের সদস্য মিফতাহুল জান্নাত সৃজনশীল মেধা অন্বেষন প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম ও জাতীয় পর্যায়ে ২য় স্থান অধিকার করায় সংগঠনের পক্ষ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানানো হয়। এছাড়া সাধারণ সভায় আগামী ৯ জুলাই এর মধ্যে মৌচাক পত্রিকার জন্য লেখা পাঠানোর অনুরোধ জানানো হয়। সমগ্র অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন মৌচাক সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওহাব আজাদ।

  • কবিগুরুর জন্মবার্ষিক : নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য ‘দ্য নোবেল প্রাইজ’- এর!

    কবিগুরুর জন্মবার্ষিক : নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য ‘দ্য নোবেল প্রাইজ’- এর!

    Sritama Mitra :

    • ,’দ্য নোবেল প্রাইজ’ কর্তৃপক্ষ আজকের দিনটি রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে উদযাপন করছে।

    ক্যালেন্ডারে মে মাস পড়লেই, বাঙালি অপেক্ষা করে থাকে দুই প্রবাদপ্রতীম কিংবদন্তীর জন্মোৎসব পালনের জন্য। ২ রা মে সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনের পরই আসে ৭ মে। ক্যালেন্ডারের দিন অনুযায়ী ১৮৬১ সালের ৭ মে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর সেই উপলক্ষ্যে ৭ মে বিশ্বজুড়ে তাঁর জন্মবার্ষিকীতে চলছে রবি-বন্দনা। তবে বাঙালির কাছে কবিগুরুর জন্মদিন মানেই ২৫ শে বৈশাখ। সেই দিকনেই ‘রবীন্দ্রজয়ন্তী’ হিসাবে পালন করে আপামর বাঙালি।

    ভারতের প্রথম নোবেলজয়ী, তথা ইউরোপের বাইরের কোনও দেশের নাগরিক হিসাবে প্রথম নোবেল পুরষ্কারের সম্মান পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আর সেই নোবেলজয়ীর স্মরণে এদিন ‘দ্য নোবেল প্রাইজ’এর তরফে জানানো হয়েছে শ্রদ্ধার্ঘ। এক টুইটে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে জানানো হয়,’দ্য নোবেল প্রাইজ’ কর্তৃপক্ষ আজকের দিনটি রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে উদযাপন করছে। এদিকে বাংলার বুকে কার্যত আজ থেকেই সাজো সাজো রব ২৫ শে বৈশাখ ঘিরে। যেদিন জোড়াসাঁকো থেকে শান্তিনিকেতন মেতে ওঠে কবির বন্দনায়। তাঁর সাহিত্যদর্শন যুগ যুগ ধরে মানুষকে ছুঁয়ে গিয়েছে, যার রেশ চিরন্তন। আর এমন এক ব্যক্তিত্ব কার্যত বাঙালি জীবনের মহীরুহ হয়ে উঠেছেন। আর তাঁর স্মরণে আজ দিনভর ৭ মে-র তারিখকে উপলক্ষ্য় করে চলছে উদযাপনের পালা।

  • সাতক্ষীরার কলেজছাত্র তারিক ইসলামের নতুন দুটি বই প্রকাশিত

    সাতক্ষীরার কলেজছাত্র তারিক ইসলামের নতুন দুটি বই প্রকাশিত

    শেখ শাকিল হোসেন :
    সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তারিক ইসলামের কৃষি বিষয়ক নতুন দুটি বই ‘পুকুরে মুক্তা চাষ’ এবং ‘আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি চাষ’ প্র‍কাশিত হয়েছে। বই দুটি প্র‍কাশ করেছে রাজধানীর আদিত্য অনিক প্র‍কাশনী। বই দুটি অনলাইনে রকমারিতেও পাওয়া যাচ্ছে।
    তারিক ইসলাম জানান, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্র‍ধান ভিত্তি হল কৃষি। তাই কৃষির আধুনিকায়ন সময়ের দাবি। আমার লেখা বই দুটি নবীন কৃষি উদ্যোক্তাদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে উৎসাহিত করবে।
    তিনি আরো বলেন, আমার পিতা একজন কৃষক। মা, মাটি, মানুষ ও দেশের প্র‍তি ভালবাসা থেকেই কৃষি ভিত্তিক বংলাদেশের মানুষের জীবন জীবিকার উন্নয়নের জন্য আমার এই ক্ষুদ্র‍ প্র‍চেষ্টা।বইটি যদি কৃষি প্র‍ধান বাংলাদেশের মানুষের উপকারে আসে তাহলে আমার শ্র‍ম স্বার্থক হবে।

    সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার আজিজপুর গ্র‍ামের মো. জামসেদ আলী ও মমতাজ বেগম দম্পতির সন্তান তারিক ইসলাম। দুই ভাইবোনের মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা। জগৎ জীবনকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে দেখার আবল্য স্পৃহা তাকে লেখক হওয়ার স্বপ্ন দেখায়। জীবন পরিবেশ, সংগ্র‍াম ও ব্যার্থতার দিকে সে তাকিয়ে থাকে নিরন্তর। বই, ব্যক্তি অনুভব আর যাপিত জীবন থেকে সে তিল তিল করে সংগ্র‍হ করে তার লেখার উপকরণ। সাহিত্যের এই বন্ধুর পথে কবিতা দিয়েই পথচলা শুরু। সময়ের আবর্তে তাতে যুক্ত হয়েছে অনুগল্প, নিবন্ধ ও অন্যান্য জীবন বোধের রচনা।

    এই দুটি বইসহ তারিক ইসলামের সর্বোমোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪টি। তার লেখা অনান্য দুটি বই হলো ‘দৃষ্টিভঙ্গি: ইতিবাচক চিন্তা-চেতনা’ এবং ‘চিন্তাধারা বদলান জীবন বদলে যাবে’। দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্ম ও সাহিত্যে পড়তে আগ্রহ বোধ করেন তরুণ কবি ও লেখক খ্যাত এই তরুণ।

  • সজনীকান্ত দাসের ‘নজরুল’

    সজনীকান্ত দাসের ‘নজরুল’

    বীরেন মুখার্জি

    বিশ্বসাহিত্যে টি এস এলিয়ট, বোদলেয়ার যেমন সমকালীন-সমগোত্রীয়রা লাঞ্ছিত, অপমানিত করেছেন তেমনি বাংলা সাহিত্যেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ এমনকি হাল আমলে বিনয় মজুমদারকেও নানাভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। শিল্পস্রষ্টা সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার পাশাপাশি তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, হাসি-ঠাট্টারও কমতি ছিল না। সমকালীন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ কাজে ‘নাটের গুরু’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন সজনীকান্ত দাস। শনিমণ্ডলের মুখপত্র ‘শনিবারের চিঠি’-কে এ কাজে ব্যবহার করতেন তিনি। সম্পাদক সজনীকান্ত দাস দলবদ্ধভাবে কটূক্তিতে কুশলতা দেখান। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তার প্রধান লক্ষ্য। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে একধরনের মজার খেলাতেই তাকে মেতে উঠতে দেখা যায়। যদিও তিনি আত্মস্মৃতিতে লিখেছেন—‘নজরুল শনিবারের চিঠির জন্মকাল হইতেই সাহিত্যের ব্যাপারে একমাত্র নজরুলকে লক্ষ্য করিয়াই প্রথম উদ্যোক্তারা তাক করিতেন। তখন আমি আসিয়া জুটি নাই।’ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে মোহিতলাল মজুমদারকে নজরুল গুরু বলে মানতেন সেই মোহিতলালও নজরুলকে নিয়ে শনিবারের চিঠিতে ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন। তবে অন্যান্য নাম ছাপিয়ে ‘শনিবারের চিঠি’ প্রসঙ্গ এলে কাজী নজরুল ইসলামের নামের পাশাপাশি রসজ্ঞ হিসেবে সজনীকান্ত দাসের নামও সমভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে।
    ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে গণমানুষের জাগরণে কলমযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে রাজরোষের শিকার হন নজরুল। কারাবরণও করেন। তার নাম তখন সাহিত্যের উচ্চশিখরে। এ সময় নজরুল ইসলাম হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করায় ভারতের ব্রাহ্মসমাজ তা ভালো চোখে দেখেনি। ব্রাহ্ম দলের তরুণরা নজরুলের ছিদ্রান্বেষণে দুষ্ট গ্রহের মতো লেগে থাকে। তা ছাড়া ব্রাহ্ম দলের সৃজনশীল তরুণরাই ছিল শনিমণ্ডলের কর্ণধার। ফলে এদের মুখপত্র ‘শনিবারের চিঠি’-তে নজরুলের ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যকে কেন্দ্র করে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, কৌতুকপূর্ণ বিভিন্ন লেখা প্রকাশ হতে থাকে।
    নজরুল ও তার বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থকে কটাক্ষ করে লিখিত সজনীকান্ত দাসের প্রথম প্যারোডি কবিতা ‘আবাহন’ সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠির অষ্টম সংখ্যায় (২৮ ভাদ্র, ১৩৩১ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয়।
    ‘ওরে ভাই গাজী রে
    কোথা তুই আজি রে
    কোথা তোর রসময়ী জ্বালাময়ী কবিতা!
    কোথা গিয়ে নিরিবিলি
    ঝোপে ঝোপে ডুব দিলি
    তুই যে রে কাব্যের গগনের সরিতা!’
    চারদিকে তখন কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জয়জয়কার। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের পরপরই কবিতাটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয় ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কবিতাটি একদিকে যেমন ভারতের স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্র সৃষ্টিতে জনমনে নবজাগরণ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে ‘আপনারে ছাড়া কাহারে করিনা কুর্নিশ’ মনোভাবের কারণে রাজশক্তিও সচকিত হয়ে ওঠে। কবিতাটি প্রকাশের দুই বছর পর শনিবারের চিঠির একাদশ (আশ্বিন ১৩৩১ বঙ্গাব্দ) সংখ্যায় ভবকুমার প্রধান ছদ্মনামে কামস্কাট্কীয় ছন্দের ‘অসমছন্দ’ (ব্যাঙ) কবিতাটি ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়। মূলত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি প্রকাশই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। নজরুলের ‘বল বীর-/ বল উন্নত মম শির,/শির নেহারি আমারি নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!/বল বীর-/ বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,/উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!/মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/বল বীর-/ আমি চির উন্নত শির।’ কবিতার বিপরীতে ভবকুমার প্রধান লিখিত ‘অসমছন্দ’ কবিতাটি—
    ‘আমি ব্যাঙ
    লম্বা আমার ঠ্যাং
    ভৈরব রভসে বর্ষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাং।
    আমি ব্যাঙ
    আমি পথ হতে পথে দিয়ে চলি লাফ;
    শ্রাবণ নিশায় পরশে আমার সাহসিকা
    অভিসারিকা
    ডেকে ওঠে ‘বাপ বাপ।’
    শনিবারের চিঠিতে নজরুলের কবিতার প্যারোডি প্রকাশের পাশাপাশি কবিতা, গানসহ অন্যান্য সৃষ্টিকর্ম নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক গদ্যও প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এ ছাড়া তৎকালে প্রকাশিত পত্রিকা ‘প্রগতি’, ‘কালিকলম’, ‘উত্তরা’, ‘ধূপছায়া’, ‘আত্মশক্তি’ ও নজরুলের ‘কল্লোল’-কে গালমন্দ করেও বিভিন্ন প্যারোডি ছাপা হতো। আবার শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত প্যারোডিরও প্যারোডি প্রকাশিত হতে দেখা যায়। নজরুলের ‘অ-নামিকা’ কবিতার প্যারোডি ‘বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ’ শিরোনামে গাজী আব্বাস বিটকেল ছদ্মনামে শনিবারের চিঠিতে (ভাদ্র সংখ্যা, ১৩৩৪) প্রকাশিত হয়।
    ‘তোমারে পেয়ার করি
    কপনি লুঙ্গি পরি
    লো আমার কিশোরী নাতিনী
    সুদূর ভবিষ্যৎলোকে নিশীথ নির্জন কুঞ্জে হে টোকা ঘাতিনী
    তোমারে পেয়ার করি
    শৈশবের ওগো উলঙ্গিনী
    অ-পাতা শয্যায় মম অ-শোয়া সঙ্গিনী
    তোমারে পেয়ার করি।’
    ‘সিন্দু-হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত কাজী নজরুলের কবিতাটি—
    ‘তোমারে বন্দনা করি
    স্বপ্ন সহচরী
    লো আমার অনাগত প্রিয়া
    আমায় পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা জাগানিয়া!
    তোমারে বন্দনা করি
    হে আমার মানস-রঙ্গিনী
    অনন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তন বাসনা-সঙ্গিনী!
    তোমারে বন্দনা করি।’
    আবার দেখা যায়, ‘বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ’ লেখক গাজী আব্বাস বিটকেলকেও ছাড়লেন না সজনীকান্ত দাস। তিনি ভবকুমার প্রধান নামে গাজী আব্বাসকে উদ্দেশ করে লিখলেন—
    ‘গাজী আব্বাস বিটকেল
    কল্লি মহা খিটকেল
    লিখে ফেল্লি কাব্বি
    তাও আবার ছাপবি?
    ছাপলে তাও কাটবে
    কেউ কেউ তা চাটবে।’
    নজরুলের গান গ্রন্থিত হওয়ার আগে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আবার এসব গানের প্যারোডিও প্রকাশ করা হয় শনিবারের চিঠিতে। নজরুলের একটি বিখ্যাত গান—‘কে বিদেশী বন উদাসী/বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে’ গানটির প্যারোডি শনিবারের চিঠির পৌষ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় ‘কে উদাসী বন গাঁ বাসী/বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে/বাঁশী সোহাগে ভিরমি লাগে/বর ভুলে যায় বিয়ের কনে’ ছাপা হয়। নজরুলের ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’ গানটির প্যারোডি করা হয়—‘জানালায় টিকটিকি তুই টিকটিকিয়ে করিস নে আর দিক।’
    সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠিতে ‘ভবকুমার প্রধান’, ‘গাজী আব্বাস বিটকেল’ নামে নজরুলকে ব্যঙ্গ করে লিখতেন। এ ছাড়া মোহিতলাল মজুমদার ‘সত্যসুন্দর দাস’ ছদ্মনামে, নীরদ সি চৌধুরী ‘বলাহক নন্দী’ ছদ্মনামে ক্রমাগত নজরুল সাহিত্যের বিদ্রূপ করতেন। মাঝেমধ্যে নজরুলও ‘কল্লোল’ পত্রিকার মাধ্যমে এসব লেখার জবাব দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। মোহিতলাল মজুমদার নজরুলের ‘মাধবী প্রলাপ’ কবিতার মধ্যে ব্যক্ত দেহবাদী প্রেমের নগ্নরূপের উপস্থিতি দেখতে পেয়ে লিখলেন—‘আধুনিক তরুণ সাহিত্যিকের বালক প্রতিভা কাব্যকাননে কাম-কণ্টক-ব্রণ-মহুয়া কুঁড়ির চাষ আরম্ভ করিয়াছে।’ আবার ‘সত্যসুন্দর দাস’ ছদ্মনামে নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ সিরিজের কবিতা বিশেষ করে ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় বারাঙ্গনাকে ‘মা’ সম্বোধন করা তিনি মোটেই সমর্থন করেননি। তিনি এ কবিতাটির তীব্র সমালোচনা করে ‘শনিবারের চিঠি’ কার্তিক ১৩৩৪ সংখ্যায় ‘সাহিত্যের আদর্শ’ শিরোনামের প্রবন্ধে লেখেন—“সম্প্রতি একটি কবিতায় নব্য সাম্যবাদ প্রচারিত হয়েছে। এই কবিতাটি নাকি কবির একটি উৎকৃষ্ট কীর্তি। ইহাতে এক প্রকার nihilism বা নাস্তিক্যনীতির উল্লাস আছে— ইহাতে বর্তমান যুগের রণ-পিপাসু পাঠক-পাঠিকার বড় আদরের সামগ্রী। কাবতাটির যতটুকু মনে আছে, তাহাতে ইহাই কবির বক্তব্য বলিয়া মনে হয় যে, জগতে সকলেই অসাধু। সকলেই ভণ্ড, চোর এবং কামুক। অতএব জাতিভেদের প্রয়োজন নাই; আইস আমরা সকল ভেদাভেদ দূর করিয়া মহানন্দে নৃত্য করি।…মৈত্রীর আগে কবি বেশ্যাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন—‘কে বলে তুমি বারাঙ্গনা মা’? বিদ্রোহের চরম হইল বটে। কিন্তু কথাটা দাঁড়াইল কি?…বারাঙ্গনা মা নয়, বারাঙ্গনা নারী বটে,…কবি প্রচারিত নব সাম্যবাদ অনুসারে ইহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে—তুমিও বারাঙ্গনা, মাও বারাঙ্গনা। অতএব মা-তে ও তোমাতে কোন প্রভেদ নাই। এই ব্যাখ্যায় বেশি দূর অগ্রসর হইলে অন্তরাত্মা কলুষিত হয়, কিন্তু এই কবিতাটি তরুণদের বড় ভাল লাগিয়াছে। এই যে মনোভাব কেবল সমাজ বিদ্রোহ নয়, ইহা মানুষের মনুষ্যত্ব বিরোধী। ইহা সাহিত্য হইতে পারে না।”
    লক্ষ করা যায়, ক্ষুরধার লেখনীর কারণে কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয়তা যত বেড়েছে তাকে নিয়ে ‘শনিবারের চিঠি’র ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের তীব্রতাও তত বাড়ানো হয়েছে। সুতরাং শনিবারের চিঠির মূল উদ্দেশ্য রস সৃষ্টি এবং রস সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের (লেখক) জনপ্রিয় করে তোলা, এটিই সর্বৈব প্রতীয়মান হয়েছে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় যে নজরুলের কাব্যপ্রতিভাকে হেয় করার উদ্দেশ্যেই তার কবিতার ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হতো সে বিষয়েও দ্বিমত করা যায় না। সজনীকান্ত দাস ছিলেন কুশলী খেলোয়াড়। তিনি ভালোকে ভালোবাসতে জানেন। সজনীকান্ত দাস যে নজরুলের ভক্ত ছিলেন, তা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের স্মৃতিচারণা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে— “একদিন নজরুল যাচ্ছে ট্রামে চড়ে, তার পাশের খালি সিটটাতে একজন ভদ্রলোক এসে বসল। যেন জেনে শুনেই ঐ সিটটা সে নির্বাচন করল, বসল গা ঘেঁষে।
    ‘জানেন, আমি আপনার একজন ভক্ত।’ বললেন ভদ্রলোক, আচমকা শুনে কে না খুশি হয়? নজরুলও খুশি হল। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম?’
    ‘শ্রী সজনীকান্ত দাস।’
    আরে আপনি? হৃদ্যতায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে নজরুলের এতটুকু দেরি হলো না। বললে, ‘কী আশ্চর্য, পথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। কিন্তু ভাই আমাকে যে এই সামনের স্টপেই নেমে যেতে হবে।’
    ‘তাতে কী! আবার দেখা হবে আমাদের।’ সজনী নজরুলকে যাবার জায়গা করে দিল।”
    বুদ্ধিধর সজনীকান্ত দাস বুঝেছিলেন ব্যক্তি হিসেবে নজরুলকে ভালোবাসা সহজ আর তাকে বিষয় হিসেবে নিয়ে ব্যঙ্গ করা লাভজনক। সজনীকান্ত হয়তো চেয়েছিলেন নজরুলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে কিন্তু ‘শনিবারের চিঠি’র খ্যাতি ও পরিচিতি তাকে এ কাজ থেকে বিচ্যুত হতে দেয়নি। তিনি ‘আত্মস্মৃতি’তে লিখেছেন—‘ভিতরে গান চলিতেছে। নজরুল ইসলামের বোতাম খোলা পিরহান ঘামে এবং পানের পিকে বিচিত্র হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তাহার কলকণ্ঠের বিরাম নাই। বিদ্রোহীর প্রলাপ পড়িয়া যে মানুষটিকে কল্পনা করিয়াছিলাম ইহার সহিত তাঁহার মিল নাই। বর্তমানের মানুষটিকে ভালবাসা যায়, সমালোচনা করা যায় না। এ ঘটনা-বিসুভিয়াসের মত সঙ্গীতগর্ভ এই পুরুষ।’ শনিবারের চিঠিতে নজরুলকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হলেও কবি-সাহিত্যিকদের বিবাদ যে বেশি দিন টেকে না, তা বোঝা যায় মোহিতলাল মজুমদার ও সজনীকান্ত দাসের জবানিতে। মোহিতলাল মজুমদার নজরুলকে অভিশাপ দিলেও তার রচনার বিদ্রূপ করলেও খোঁজ নিয়েছেন। নজরুল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত জেনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন—‘নজরুল মোটেই শরীরের যত্ন নেয় না।’ সুতরাং এ কথা বলা অসঙ্গত নয় যে ‘শনিবারের চিঠি’ নজরুলকে যত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, যত সমালোচনা করে রচনা প্রকাশ করুক না কেন, এতে নজরুলের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বই কমেনি। পাশাপাশি ‘শনিবারের চিঠি’ ও সজনীকান্ত দাসসহ সংশ্লিষ্ট সবার নাম কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেই উচ্চারিত হয়ে আসছে।
    বিশ্বসাহিত্যে টি এস এলিয়ট, বোদলেয়ার যেমন সমকালীন-সমগোত্রীয়রা লাঞ্ছিত, অপমানিত করেছেন তেমনি বাংলা সাহিত্যেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ এমনকি হাল আমলে বিনয় মজুমদারকেও নানাভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। শিল্পস্রষ্টা সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার পাশাপাশি তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, হাসি-ঠাট্টারও কমতি ছিল না। সমকালীন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ কাজে ‘নাটের গুরু’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন সজনীকান্ত দাস। শনিমণ্ডলের মুখপত্র ‘শনিবারের চিঠি’-কে এ কাজে ব্যবহার করতেন তিনি। সম্পাদক সজনীকান্ত দাস দলবদ্ধভাবে কটূক্তিতে কুশলতা দেখান। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তার প্রধান লক্ষ্য। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে একধরনের মজার খেলাতেই তাকে মেতে উঠতে দেখা যায়। যদিও তিনি আত্মস্মৃতিতে লিখেছেন—‘নজরুল শনিবারের চিঠির জন্মকাল হইতেই সাহিত্যের ব্যাপারে একমাত্র নজরুলকে লক্ষ্য করিয়াই প্রথম উদ্যোক্তারা তাক করিতেন। তখন আমি আসিয়া জুটি নাই।’ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে মোহিতলাল মজুমদারকে নজরুল গুরু বলে মানতেন সেই মোহিতলালও নজরুলকে নিয়ে শনিবারের চিঠিতে ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন। তবে অন্যান্য নাম ছাপিয়ে ‘শনিবারের চিঠি’ প্রসঙ্গ এলে কাজী নজরুল ইসলামের নামের পাশাপাশি রসজ্ঞ হিসেবে সজনীকান্ত দাসের নামও সমভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে।
    ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে গণমানুষের জাগরণে কলমযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে রাজরোষের শিকার হন নজরুল। কারাবরণও করেন। তার নাম তখন সাহিত্যের উচ্চশিখরে। এ সময় নজরুল ইসলাম হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করায় ভারতের ব্রাহ্মসমাজ তা ভালো চোখে দেখেনি। ব্রাহ্ম দলের তরুণরা নজরুলের ছিদ্রান্বেষণে দুষ্ট গ্রহের মতো লেগে থাকে। তা ছাড়া ব্রাহ্ম দলের সৃজনশীল তরুণরাই ছিল শনিমণ্ডলের কর্ণধার। ফলে এদের মুখপত্র ‘শনিবারের চিঠি’-তে নজরুলের ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যকে কেন্দ্র করে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, কৌতুকপূর্ণ বিভিন্ন লেখা প্রকাশ হতে থাকে।
    নজরুল ও তার বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থকে কটাক্ষ করে লিখিত সজনীকান্ত দাসের প্রথম প্যারোডি কবিতা ‘আবাহন’ সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠির অষ্টম সংখ্যায় (২৮ ভাদ্র, ১৩৩১ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয়।
    ‘ওরে ভাই গাজী রে
    কোথা তুই আজি রে
    কোথা তোর রসময়ী জ্বালাময়ী কবিতা!
    কোথা গিয়ে নিরিবিলি
    ঝোপে ঝোপে ডুব দিলি
    তুই যে রে কাব্যের গগনের সরিতা!’
    চারদিকে তখন কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জয়জয়কার। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের পরপরই কবিতাটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয় ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কবিতাটি একদিকে যেমন ভারতের স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্র সৃষ্টিতে জনমনে নবজাগরণ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে ‘আপনারে ছাড়া কাহারে করিনা কুর্নিশ’ মনোভাবের কারণে রাজশক্তিও সচকিত হয়ে ওঠে। কবিতাটি প্রকাশের দুই বছর পর শনিবারের চিঠির একাদশ (আশ্বিন ১৩৩১ বঙ্গাব্দ) সংখ্যায় ভবকুমার প্রধান ছদ্মনামে কামস্কাট্কীয় ছন্দের ‘অসমছন্দ’ (ব্যাঙ) কবিতাটি ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়। মূলত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি প্রকাশই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। নজরুলের ‘বল বীর-/ বল উন্নত মম শির,/শির নেহারি আমারি নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!/বল বীর-/ বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,/উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!/মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/বল বীর-/ আমি চির উন্নত শির।’ কবিতার বিপরীতে ভবকুমার প্রধান লিখিত ‘অসমছন্দ’ কবিতাটি—
    ‘আমি ব্যাঙ
    লম্বা আমার ঠ্যাং
    ভৈরব রভসে বর্ষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাং।
    আমি ব্যাঙ
    আমি পথ হতে পথে দিয়ে চলি লাফ;
    শ্রাবণ নিশায় পরশে আমার সাহসিকা
    অভিসারিকা
    ডেকে ওঠে ‘বাপ বাপ।’
    শনিবারের চিঠিতে নজরুলের কবিতার প্যারোডি প্রকাশের পাশাপাশি কবিতা, গানসহ অন্যান্য সৃষ্টিকর্ম নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক গদ্যও প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এ ছাড়া তৎকালে প্রকাশিত পত্রিকা ‘প্রগতি’, ‘কালিকলম’, ‘উত্তরা’, ‘ধূপছায়া’, ‘আত্মশক্তি’ ও নজরুলের ‘কল্লোল’-কে গালমন্দ করেও বিভিন্ন প্যারোডি ছাপা হতো। আবার শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত প্যারোডিরও প্যারোডি প্রকাশিত হতে দেখা যায়। নজরুলের ‘অ-নামিকা’ কবিতার প্যারোডি ‘বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ’ শিরোনামে গাজী আব্বাস বিটকেল ছদ্মনামে শনিবারের চিঠিতে (ভাদ্র সংখ্যা, ১৩৩৪) প্রকাশিত হয়।
    ‘তোমারে পেয়ার করি
    কপনি লুঙ্গি পরি
    লো আমার কিশোরী নাতিনী
    সুদূর ভবিষ্যৎলোকে নিশীথ নির্জন কুঞ্জে হে টোকা ঘাতিনী
    তোমারে পেয়ার করি
    শৈশবের ওগো উলঙ্গিনী
    অ-পাতা শয্যায় মম অ-শোয়া সঙ্গিনী
    তোমারে পেয়ার করি।’
    ‘সিন্দু-হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত কাজী নজরুলের কবিতাটি—
    ‘তোমারে বন্দনা করি
    স্বপ্ন সহচরী
    লো আমার অনাগত প্রিয়া
    আমায় পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা জাগানিয়া!
    তোমারে বন্দনা করি
    হে আমার মানস-রঙ্গিনী
    অনন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তন বাসনা-সঙ্গিনী!
    তোমারে বন্দনা করি।’
    আবার দেখা যায়, ‘বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ’ লেখক গাজী আব্বাস বিটকেলকেও ছাড়লেন না সজনীকান্ত দাস। তিনি ভবকুমার প্রধান নামে গাজী আব্বাসকে উদ্দেশ করে লিখলেন—
    ‘গাজী আব্বাস বিটকেল
    কল্লি মহা খিটকেল
    লিখে ফেল্লি কাব্বি
    তাও আবার ছাপবি?
    ছাপলে তাও কাটবে
    কেউ কেউ তা চাটবে।’
    নজরুলের গান গ্রন্থিত হওয়ার আগে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আবার এসব গানের প্যারোডিও প্রকাশ করা হয় শনিবারের চিঠিতে। নজরুলের একটি বিখ্যাত গান—‘কে বিদেশী বন উদাসী/বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে’ গানটির প্যারোডি শনিবারের চিঠির পৌষ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় ‘কে উদাসী বন গাঁ বাসী/বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে/বাঁশী সোহাগে ভিরমি লাগে/বর ভুলে যায় বিয়ের কনে’ ছাপা হয়। নজরুলের ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’ গানটির প্যারোডি করা হয়—‘জানালায় টিকটিকি তুই টিকটিকিয়ে করিস নে আর দিক।’
    সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠিতে ‘ভবকুমার প্রধান’, ‘গাজী আব্বাস বিটকেল’ নামে নজরুলকে ব্যঙ্গ করে লিখতেন। এ ছাড়া মোহিতলাল মজুমদার ‘সত্যসুন্দর দাস’ ছদ্মনামে, নীরদ সি চৌধুরী ‘বলাহক নন্দী’ ছদ্মনামে ক্রমাগত নজরুল সাহিত্যের বিদ্রূপ করতেন। মাঝেমধ্যে নজরুলও ‘কল্লোল’ পত্রিকার মাধ্যমে এসব লেখার জবাব দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। মোহিতলাল মজুমদার নজরুলের ‘মাধবী প্রলাপ’ কবিতার মধ্যে ব্যক্ত দেহবাদী প্রেমের নগ্নরূপের উপস্থিতি দেখতে পেয়ে লিখলেন—‘আধুনিক তরুণ সাহিত্যিকের বালক প্রতিভা কাব্যকাননে কাম-কণ্টক-ব্রণ-মহুয়া কুঁড়ির চাষ আরম্ভ করিয়াছে।’ আবার ‘সত্যসুন্দর দাস’ ছদ্মনামে নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ সিরিজের কবিতা বিশেষ করে ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় বারাঙ্গনাকে ‘মা’ সম্বোধন করা তিনি মোটেই সমর্থন করেননি। তিনি এ কবিতাটির তীব্র সমালোচনা করে ‘শনিবারের চিঠি’ কার্তিক ১৩৩৪ সংখ্যায় ‘সাহিত্যের আদর্শ’ শিরোনামের প্রবন্ধে লেখেন—“সম্প্রতি একটি কবিতায় নব্য সাম্যবাদ প্রচারিত হয়েছে। এই কবিতাটি নাকি কবির একটি উৎকৃষ্ট কীর্তি। ইহাতে এক প্রকার nihilism বা নাস্তিক্যনীতির উল্লাস আছে— ইহাতে বর্তমান যুগের রণ-পিপাসু পাঠক-পাঠিকার বড় আদরের সামগ্রী। কাবতাটির যতটুকু মনে আছে, তাহাতে ইহাই কবির বক্তব্য বলিয়া মনে হয় যে, জগতে সকলেই অসাধু। সকলেই ভণ্ড, চোর এবং কামুক। অতএব জাতিভেদের প্রয়োজন নাই; আইস আমরা সকল ভেদাভেদ দূর করিয়া মহানন্দে নৃত্য করি।…মৈত্রীর আগে কবি বেশ্যাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন—‘কে বলে তুমি বারাঙ্গনা মা’? বিদ্রোহের চরম হইল বটে। কিন্তু কথাটা দাঁড়াইল কি?…বারাঙ্গনা মা নয়, বারাঙ্গনা নারী বটে,…কবি প্রচারিত নব সাম্যবাদ অনুসারে ইহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে—তুমিও বারাঙ্গনা, মাও বারাঙ্গনা। অতএব মা-তে ও তোমাতে কোন প্রভেদ নাই। এই ব্যাখ্যায় বেশি দূর অগ্রসর হইলে অন্তরাত্মা কলুষিত হয়, কিন্তু এই কবিতাটি তরুণদের বড় ভাল লাগিয়াছে। এই যে মনোভাব কেবল সমাজ বিদ্রোহ নয়, ইহা মানুষের মনুষ্যত্ব বিরোধী। ইহা সাহিত্য হইতে পারে না।”
    লক্ষ করা যায়, ক্ষুরধার লেখনীর কারণে কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয়তা যত বেড়েছে তাকে নিয়ে ‘শনিবারের চিঠি’র ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের তীব্রতাও তত বাড়ানো হয়েছে। সুতরাং শনিবারের চিঠির মূল উদ্দেশ্য রস সৃষ্টি এবং রস সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের (লেখক) জনপ্রিয় করে তোলা, এটিই সর্বৈব প্রতীয়মান হয়েছে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় যে নজরুলের কাব্যপ্রতিভাকে হেয় করার উদ্দেশ্যেই তার কবিতার ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হতো সে বিষয়েও দ্বিমত করা যায় না। সজনীকান্ত দাস ছিলেন কুশলী খেলোয়াড়। তিনি ভালোকে ভালোবাসতে জানেন। সজনীকান্ত দাস যে নজরুলের ভক্ত ছিলেন, তা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের স্মৃতিচারণা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে— “একদিন নজরুল যাচ্ছে ট্রামে চড়ে, তার পাশের খালি সিটটাতে একজন ভদ্রলোক এসে বসল। যেন জেনে শুনেই ঐ সিটটা সে নির্বাচন করল, বসল গা ঘেঁষে।
    ‘জানেন, আমি আপনার একজন ভক্ত।’ বললেন ভদ্রলোক, আচমকা শুনে কে না খুশি হয়? নজরুলও খুশি হল। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম?’
    ‘শ্রী সজনীকান্ত দাস।’
    আরে আপনি? হৃদ্যতায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে নজরুলের এতটুকু দেরি হলো না। বললে, ‘কী আশ্চর্য, পথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। কিন্তু ভাই আমাকে যে এই সামনের স্টপেই নেমে যেতে হবে।’
    ‘তাতে কী! আবার দেখা হবে আমাদের।’ সজনী নজরুলকে যাবার জায়গা করে দিল।”
    বুদ্ধিধর সজনীকান্ত দাস বুঝেছিলেন ব্যক্তি হিসেবে নজরুলকে ভালোবাসা সহজ আর তাকে বিষয় হিসেবে নিয়ে ব্যঙ্গ করা লাভজনক। সজনীকান্ত হয়তো চেয়েছিলেন নজরুলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে কিন্তু ‘শনিবারের চিঠি’র খ্যাতি ও পরিচিতি তাকে এ কাজ থেকে বিচ্যুত হতে দেয়নি। তিনি ‘আত্মস্মৃতি’তে লিখেছেন—‘ভিতরে গান চলিতেছে। নজরুল ইসলামের বোতাম খোলা পিরহান ঘামে এবং পানের পিকে বিচিত্র হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তাহার কলকণ্ঠের বিরাম নাই। বিদ্রোহীর প্রলাপ পড়িয়া যে মানুষটিকে কল্পনা করিয়াছিলাম ইহার সহিত তাঁহার মিল নাই। বর্তমানের মানুষটিকে ভালবাসা যায়, সমালোচনা করা যায় না। এ ঘটনা-বিসুভিয়াসের মত সঙ্গীতগর্ভ এই পুরুষ।’ শনিবারের চিঠিতে নজরুলকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হলেও কবি-সাহিত্যিকদের বিবাদ যে বেশি দিন টেকে না, তা বোঝা যায় মোহিতলাল মজুমদার ও সজনীকান্ত দাসের জবানিতে। মোহিতলাল মজুমদার নজরুলকে অভিশাপ দিলেও তার রচনার বিদ্রূপ করলেও খোঁজ নিয়েছেন। নজরুল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত জেনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন—‘নজরুল মোটেই শরীরের যত্ন নেয় না।’ সুতরাং এ কথা বলা অসঙ্গত নয় যে ‘শনিবারের চিঠি’ নজরুলকে যত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, যত সমালোচনা করে রচনা প্রকাশ করুক না কেন, এতে নজরুলের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বই কমেনি। পাশাপাশি ‘শনিবারের চিঠি’ ও সজনীকান্ত দাসসহ সংশ্লিষ্ট সবার নাম কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেই উচ্চারিত হয়ে আসছে।
    a

  • তসলিমা নাসরিন করোনায় আক্রান্ত

    তসলিমা নাসরিন করোনায় আক্রান্ত

    ন্যাশনাল ডেস্ক: করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন।
    রোববার (৯ মে) বেলা আড়াইটার দিকে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে স্ট্যাটাস দিয়ে তিনি এ তথ্য জানিয়েছেন।

    স্ট্যাটাসে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘আমি চিরকালই বড় দুর্ভাগা। এই যে গত বছরের মার্চ মাস থেকে একা আছি ঘরে, একখানা ইন্ডোর ক্যাট সঙ্গী, কোথাও এক পা বেরোলাম না, কাউকে ঘরে ঢুকতে দিলাম না, রান্না বান্না বাসন মাজা কাপড় কাচা ঝাড়ু মোছা সব একাই করলাম, কী লাভ হলো? কিছুই না। ঠিকই কোভিড হলো। গত এক বছরে শুধু একবার এক ঘণ্টার জন্য বাইরে বেরিয়েছিলাম, তাও দু’মাস আগে, টিকার প্রথম ডোজ নিতে। ওই ডোজটি কিছু অ্যান্টিবডি তৈরি করেছিল বলে হয়তো এ যাত্রা বেঁচে গেছি।
    আমি চিরকালই বড় দুর্ভাগা। এক এক করে যদি লিখি কী কী ঘটেছে জীবনে যা ঘটার কথা ছিল না, তাহলে তালিকা এত দীর্ঘ হবে যে পড়ে কেউ কূল পাবে না। আপাতত কোভিড হওয়ার দুঃখটাই থাক। দুঃখ থাকাও হয়তো ঠিক নয়। কারণ ধীরে ধীরে আমি সুস্থ হয়ে উঠছি। কিন্তু হাজারো মানুষ যারা সুস্থ হতে পারেনি! যারা শ্বাস নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি শ্বাস নিতে! দুঃখগুলো বরং তাদের জন্য থাক।
    এখন এইটুকু অন্তত ভালো লাগছে, এটি আর স্টিগমা নয় আগের মতো। কারো কোভিড হলে সে লুকিয়ে রাখতো খবর, কারণ কোভিড হওয়াটা অনেকটা ছিল এইডস হওয়ার মতো। সমাজ ব্রাত্য করে দিত। এক বছরে এত মানুষকে ধরেছে এই কোভিড, এতে, ভালো, যে, স্টিগমাটা গেছে। কেউ আর বলতে দ্বিধা করে না যে তার কোভিড হয়েছে।’

  • রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তা

    রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তা


    বীরেন মুখার্জী

    জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ধর্ম-দর্শন নিয়ে আমাদের সমাজে নানান মত চালু আছে। এই পরিবার বংশানুক্রমিক উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী হয়েছিলেন। রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মধর্মের প্রবক্তা ছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম মূলত ১৯০০ শতাব্দীর বাংলার একটি ধর্মীয় আন্দোলন। ব্রাহ্মধর্মের অনুগামীরা ‘ব্রাহ্ম’ নামে পরিচিত। ব্রাহ্মধর্ম হিন্দুধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলেও রাজা রামমোহন একসময় হিন্দুধর্মের ভেতর থেকেই উক্ত ধর্মকে সংস্কার করতে উদ্যোগী হন। তবে তার উত্তরসূরি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সময় বেদের অভ্রান্ততা অস্বীকার করেন, ফলে এর মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজ মূলধারার হিন্দুধর্ম থেকে বেরিয়ে আসে বলে ধারণা করা হয়। যদিও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কিছু হিন্দু রীতিনীতি রক্ষা করেছিলেন। তৎকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় অগ্রগামী এই পরিবারে জন্মগ্রহণ করা রবীন্দ্রনাথ, ঠাকুর পরিবারের ধর্মীয় বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করেছেন। নিজে ব্রাহ্ম হওয়া সত্ত্বেও সাহিত্যকর্মে হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। তাহলে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তায় কোন বিশেষ ধর্ম-দর্শন ক্রিয়াশীল ছিল- এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।
    অস্বীকারের সুযোগ নেই, যেকোনো সৃষ্টিকর্মের নেপথ্যে একটি বিশেষ ভাব, চিন্তা-দর্শন, মন-মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। স্রষ্টার মনের ভাব, চিন্তা-দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি তার সৃষ্টিকর্মে প্রতিফলিত হবে, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কেউ নাস্তিক হলে, তার সৃজনকর্মেও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বা নাস্তিক্য চিন্তাচেতনার প্রকাশ ঘটে। আস্তিকের সৃষ্টিকর্মেও স্বাভাবিকভাবেই আস্তিক্য ভাব-দর্শনের প্রতিফলন ঘটে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিপ্রাচুর্যে আস্তিক্যবাদী দর্শনের সন্ধান মেলে। রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। ধর্ম পালনে তার অনীহা না থাকলেও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সজ্ঞানে পরিহার করতেন। তবে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন। রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠে এটি স্পষ্ট হয়, জীবনের একটি পর্যায়ে এসে তিনি অরূপের সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘আধ্যাত্মিক সাধনা কখনোই রূপের সাধনা হইতে পারে না। তাহা সমস্ত রূপের ভিতর দিয়া চঞ্চল রূপের বন্ধন অতিক্রম করিয়া ধ্রুব সত্যের দিকে চলিতে চেষ্টা করে। ইন্দ্রিয়গোচর যে কোনো বস্তু আপনাকেই চরম বলিয়া স্বতন্ত্র বলিয়া ভান করিতেছে, সাধক তাহার সেই ভানের আবরণ ভেদ করিয়া পরম পদার্থকে দেখিতে চায়।’ (রূপ ও অরূপ)। আমরা দেখতে পাই, যিশুখ্রিষ্ট, গৌতম বুদ্ধ ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কেও নিয়েও নানান সময় লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।

    নিজের মৃত্যুর আগেই রবীন্দ্রনাথকে আপনজনদের লোকান্তরিত হওয়ার অভাবনীয় দৃশ্যগুলো অবলোকন করতে হয়েছে। যে কারণে মৃত্যুচিন্তাও তার পরমার্থ সাধনার একটি অন্যতম বিষয় হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা কখনো মর্ত্যচেতনা, আত্মচেতনা, কখনো ব্যঙ্গ কৌতুক, আবার কখনো প্রেম ও সৌন্দর্য চেতনার সঙ্গে বিশ্বচেতনায় সমকালসংলগ্ন হয়ে উঠেছে। উপনিষদের ঋষিসুলভ প্রত্যয়ও তার কবিতায় উচ্চকিত হয়েছে। সুফিবাদের ধারা, কবির ও রামপ্রসাদ সেনের আলিঙ্গন তাকে ঋদ্ধ করেছে। বাংলার বাউল-ফকিরদের দ্বারাও সমৃদ্ধ হয়েছেন তিনি। বাউলের ‘মনের মানুষে’র মতোই তিনি ‘জীবনদেবতা’ সৃষ্টি করেছেন। খেয়া-গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালি কাব্য এবং অন্যান্য রচনায়ও অধ্যাত্মচেতনা প্রকাশিত হয়েছে। কবির অধ্যাত্মসাধনা নিঃসন্দেহে সর্বজনীনচেতনা দ্বারা পরিশুদ্ধ। তার বিশ্বাসগুলো পৃথিবীর মানুষের জন্য কতটুকু জরুরি? তার আধ্যাত্মিকতায় মানবতার জন্য যে কাতরতা, তা সর্বযুগের সর্ব মানুষের হয়ে উঠেছে কি? এসব প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করলে কবির আধ্যাত্মিক চেতনার সর্বজনীন রূপ আবিষ্কার করা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম ভাবের গভীরতা, ভাষার মাধুর্য এবং বিষয় বিন্যাসের চমৎকারিত্বে আমাদের চিন্তাকে পৌঁছে দেয় এমন এক স্তরে যেখানে আমাদের চেনা অনুভূতিগুলো আমাদের ভেতর এক অসাধারণ বিশ্বের সন্ধান দেয়। কবির রচনাকর্ম নানান নাটকীয়তা, রহস্যময় মহাজাগতিক আবহের মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে স্র্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের অভিপ্রায়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
    ঈশ্বরচিন্তা বলতে সেই বাস্তবতাকে বোঝানো হয়, যা আমাদের প্রতিদিনের স্থূলতা থেকে অনেক দূরের। এটি হচ্ছে সেই গহিন পথ, যার দ্বারা একজন ব্যক্তির বেঁচে থাকা কিংবা তার অস্তিত্ব আবিষ্কারের প্রচেষ্টা স্পষ্ট হয়। ধ্যান, প্রার্থনা, প্রত্যাশা দিয়ে একজনের অন্তরজীবনের উন্নতি হতে পারে। আধ্যাত্মিকতার বাস্তবতা হতে পারে ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ এবং এই সংযোগ ব্যক্তি থেকে প্রসারিত হতে পারে মানবসমাজ, প্রকৃতি, বিশ্বলোক ও ঈশ্বরের সিংহাসন পর্যন্ত। জীবনে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণাও হতে পারে পরমার্থ সাধনা। যে বিশ্বাস ধারণ করে ঈশ্বর সম্পর্কে অন্তর্নিহিত ভাবনা কিংবা বিশ্বের সীমানা ছাড়িয়ে অসীমের জন্য কাতরতা, তারই নাম কি আধ্যাত্মিকতা? বিশ্লেষকদের মতে, প্রচলিত ধারণায় আধ্যাত্মিকতা বা পরমার্থ সাধনাকে ধর্মীয় জীবনেরই অংশ বলা হয়। আর আধ্যাত্মিকতা বিশ্লেষণে গুরুত্ব পায় মানবতাবাদ, প্রেম, সমবেদনা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, পরিতৃপ্তি, দায়িত্ব, সংগতি, অপরের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখা প্রভৃতি। রবীন্দ্রসাহিত্যে এসব বৈশিষ্ট্যের সম্মিলন লক্ষ করা যায় গভীরভাবে।
    বলাই বাহুল্য, আস্তিক্যবাদী দর্শন মানে প্রতিদিনের কাজের সঙ্গে প্রার্থনা ও ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বরকে স্মরণ করা। আবার মৃত্যুর পরে কী কী ঘটবে, এসব চিন্তাও অধ্যাত্ম চেতনারও অংশ। আধ্যাত্মিক জীবনের পথ বিচিত্র। ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নিজেকে তৈরি করা, নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি জগতের সঙ্গে মিলতে চাওয়ার জন্য সুশৃঙ্খলভাবে ধ্যান, প্রার্থনা, নৈতিকতার উন্নতি সাধন ইত্যাদি। আধ্যাত্মিকতার লক্ষ্য হচ্ছে ভেতরের জীবন ও বাইরের জীবনের উন্নতি। প্রেম ও করুণা ধারায় সিক্ত হলে আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি ঘটে। আধ্যাত্মিকতা মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও জড়িত। আধ্যাত্মিকতাকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন ‘পবিত্রতার স্মারক’। পূজা ও নৈবেদ্যের মধ্যে সেই স্মারক লুকিয়ে থাকতে পারে। মানুষে মানুষে মৈত্রী, সাম্য, ঐক্য ও পারস্পরিক বিশ্বাস এই চেতনার প্রধান দিক। রবীন্দ্রসাহিত্যে এই চিন্তার উপস্থিতি থাকলেও অধ্যাত্ম্য বা ধর্মীয় চেতনার আড়ালে-আবডালে রবীন্দ্রনাথ কখনোই সন্ন্যাসী কিংবা সাধক ছিলেন না। বিশেষ কোনো ধারার অধ্যাত্মসাধনায়ও নিজেকে নিমগ্ন করেননি। তিনি ছিলেন কবি। নিজের চেতনার অধ্যাত্ম-অনুভূতিগুলো শিল্পচেতনার মধ্য দিয়ে কাব্যরূপে প্রকাশিত করেছেন। বলা যায়, উপনিষদের ধর্মীয় আরাধনার পথ বেয়ে তিনি মানুষের ধর্মে উপনীত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আধ্যাত্মিকতায় আমাদের আর কিছু দেয় না, আমাদের ঔদাসীন্য আমাদের অসাড়তা ঘুচিয়ে দেয়। অর্থাৎ তখনই আমরা চেতনার দ্বারা চেতনাকে, আত্মার দ্বারা আত্মাকে পাই। সেই রকম করে যখন পাই তখন আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে সমস্তই তার আনন্দরূপ।’ রবীন্দ্রনাথ আস্তিক ছিলেন বলেই বিশ্বাস করতেন ‘আধ্যাত্মিকতা’ মানুষের চেতনাকে ঈশ্বরের সঙ্গে সংযুক্ত করে। যার মাধ্যমে স্রষ্টার আনন্দরূপই প্রত্যক্ষ করা য়ায়। জীবনব্যাপী এ সত্যই তিনি বহন করেছেন।

  • আজ পঁচিশে বৈশাখ: রবীন্দ্র জয়ন্তী

    আজ পঁচিশে বৈশাখ: রবীন্দ্র জয়ন্তী


    ন্যাশনাল ডেস্ক: আজ পঁচিশে বৈশাখ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০তম জন্মবার্ষিকী। বাংলা সাহিত্যের এই প্রাণপুরুষ ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।

    শুধু কবি পরিচয়েই নন, রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই অঞ্চলের অন্যতম প্রভাববিস্তারী ব্যক্তিত্ব। তার রচিত দুটি গান ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এই অঞ্চল, তথা ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ নির্মাণেও ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে রবীন্দ্রনাথের।
    সংগীত, কবিতাসহ বাংলা সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় রয়েছে রবীন্দ্রনাথের সমান বিচরণ। সাহিত্যের সীমা পেরিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজচিন্তা, ধর্মসংস্কারেও রবীন্দ্রনাথ সক্রিয় ছিলেন সমানতালে। তার চিত্রকলা আরও বিস্ময় জাগায় শিল্পপিয়াসী মানুষের মনে।
    সাহিত্যকর্মের বাইরে তার অন্যতম কীর্তি বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা। প্রাচীন ভারতীয় তপোবনের আদলে বোলপুরের শান্তিনিকেতনে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এ শিক্ষায়তন।
    অসামান্য সাহিত্যকর্মের নিদর্শন হিসেবে গীতাঞ্জলির ইংরেজি সংস্করণের জন্য ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পান। যা ছিল প্রথম কোনো এশীয়র নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি।
    দেশে বর্তমানে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে কবির জন্মদিন উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে তেমন কোনো আয়োজন হচ্ছে না। তবে সরকারি ও বেসরকারি বেতার-টেলিভিশনে কবি স্মরণে বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে।

  • চির নূতনেরে দিলো ডাক, পঁচিশে বৈশাখ

    চির নূতনেরে দিলো ডাক, পঁচিশে বৈশাখ


    সুপান্থ মল্লিক

    স্রষ্টামাত্রেরই সংশয়, সৃষ্টি বাঁচবে তো! নশ্বর জীবদেহ বিলীন হয়ে যাবে। মুছে যাবে বেঁচে থাকার যাবতীয় বাহ্যিক অহংকার। সাধারণ মানুষের এই পরিণতি। এই নিয়ে কারোর অভিযোগ থাকে না কিছু, কিন্তু সৃজনশীল মানুষের ভিন্নতর এক অন্বেষণ থাকে, থাকে অমরত্বের আত্মগত এক স্পৃহা। আমি বা আমার নাম রূপের লয় হোক, ক্ষতি নেই! কিন্তু আমার সৃষ্টি যেন নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়। মহাকালের অসম্ভাব্য পরিবর্তনে তাঁর সার্বজনীন সৃষ্টি যেন সবকিছুই নিঃশেষে না বিদায় করে দেয়! অনন্ত মানবস্মৃতিতে যেন চিরলগ্ন থাকতে পারে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মহান স্রষ্টারও সংশয় ছিল ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে, কোন সে পাঠক?’ যিনি তন্ময় হয়ে থাকবেন কবির সৃষ্টিতে। সোচ্চার কোনো দাবি নয় কবিসুলভ স্মিত এক প্রার্থনা নিজেরই সৃষ্টির কাছে, তবুও মনে রেখো―‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে… তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে।’ কিন্তু আমার সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক বিস্ময়ে যেন এই উক্তি―‘তুমি কেমন করে গান করো, হে গুণী!’ ক্ষণকাল থেকে চিরকালের উত্তরণের গুণ যেন আমার থাকে। এই আমার সাধনা, বিচারক আমি নই, বিচারক সেই মহাকাল! শতাব্দীর পর নতুন শতাব্দীতে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিটি বিভাগকে সঞ্জীবিত করে বিশাল গগনে রবিপ্রভা দীপ্যমান, রবিপ্রভা আজও মূর্তিমান, তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল!

    বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ। তিনি কর্মকা-ে রাজত্ব করেছেন বঙ্গীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর তিন দশক আর বঙ্গীয় চতুর্দশ শতাব্দীর পাঁচ দশকব্যাপী। প্রথম তিরিশ বছর তো প্রস্তুতিকাল গেছে―বাকি পঞ্চাশ বছরেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। সেই হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চতুর্দশ শতাব্দীর কবি ও লেখক।
    সুদীর্ঘকাল পূর্বে বুদ্ধদেব বসু তাঁর এক ইংরেজি রচনায় রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন ‘চযবহড়সবহড়হ’ অর্থাৎ ‘নৈসর্গিক আবির্ভাব’। বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতির বর্তমান অবক্ষয়ের কালে এই পর্যবেক্ষণলব্ধ আবিস্কার যে কী গভীর সত্য তা পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাঙালির সমাজ বিবর্তনের আগ্রহী ছাত্রমাত্রই জানেন যে, শুধু এই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ও প্রিন্সের ছোট নাতিটির কাছে বঙ্গদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঋণ কতখানি বিশাল। ঋণ পরিশোধের বালখিল্য ইচ্ছাপোষণ মূঢ়তা তো নিঃসন্দেহে অধিকন্তু তা বুঝিয়ে দেয় যে, ঋণের চরিত্র ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পর্যন্ত আমাদের নেই। ধারণা থাকলে এই বিচার বুদ্ধি ও সিদ্ধান্ত মনে জাগতে বাধ্য যে, তাঁর প্রতিতুল্য কোনো ব্যক্তি মণীষা বাঙালিদের মধ্যে অদ্যাবধি জন্মাননি। কিন্তু সাহিত্যসাধনা রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিস্বরূপের একটি প্রকাশমাধ্যম শুধু, এই প্রায়শ বিস্তৃত তথ্য সচেতনভাবে মনের ভেতরে সংশোধন করে না নিলে তাঁর বিষয়ে নানা ধরনের ভ্রান্তি দেখা দেবেই। সৃজনশীল কল্পনা-মণীষার সঙ্গে, ইতিহাসচেতনা, ভাষাতত্ত্ব, সমাজবুদ্ধি, দেশহিতৈষণ্য ও সমকালীন বিশ্বরাজনীতির জ্ঞান মিলে যে রবীন্দ্রনাথকে নৈসর্গিক আবির্ভাব হিসেবেই আমাদের উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে আদ্যোপান্ত চিনে নেওয়া তাই জরুরি কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এ ঘটনাও সত্যি যে, রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য ক্ষেত্রে না হলেও সাহিত্যে অন্তত সারা জীবন কটু সমালোচনা ও বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁকে আক্রমণ ও আঘাতের ক্ষেত্র হিসেবে বাণীশিল্প রচনাকে নির্বাচন করার অন্যতম কারণ, আমার ধারণা এই হতে পারে যে, জীবনব্যাপী তাঁর সাধনা যতদিকেই নিয়োজিত থাকুক না কেন, তাঁর প্রধানকর্ম ছিল ভাষাশিল্পের চৌহদ্দিতে কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র। তাঁর অন্যান্য কর্মপ্রয়াস নিয়ে কেউ যে ব্যঙ্গপ্রাণ সমালোচনামুখর হননি তার সম্ভাব্য কারণ―ব্যবসা করা, কি ব্যাংক পত্তন, শান্তিনিকেতন কিংবা শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার মতো কর্মোদ্যোগে যে কতদূর পরিশ্রমসাধ্য এবং পরিকল্পনা মেধা দাবি করে তা সকলেই বুঝতেন। কিন্তু সাহিত্যনির্মাণ, যার ফলে রবীন্দ্রনাথ কালিক গ-ি অতিক্রম করে বিশ্বের সম্পত্তি―যা তাঁর প্রতিভার মহত্তম পরিচয় সেখানেই কত বিভিন্ন ধরনের আলোচনার মুখোমুখি তাঁকে হতে হয়েছিল।
    রবীন্দ্রনাথ লিখতে শুরু করেছিলেন খুব ছোট বয়সে, প্রকাশিত হয়েছিল কিশোর বয়সেই। তিনি স্কুল পালানো ছাত্র ছিলেন। তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুজনদের মনে উৎকণ্ঠারও অবধি ছিল না, তা সত্ত্বেও তাঁর সাহিত্য প্রচেষ্টায় কেউ বাধ সাধেনি। পারিবারিক এই রুচিবোধ সহ্যশক্তি ও ঔদার্য লক্ষ করবার মতো। রবীন্দ্রনাথের প্রথম গুণগ্রাহীতার দল তাঁদের বৃহৎ ঠাকুর পরিবারের সদস্যম-লী। তার কিছু পরিচয় তিনি ধরে রেখেছেন তাঁর ‘জীবন স্মৃতি’তে। তাঁর রচিত ব্রহ্মসঙ্গীতের রসগ্রাহী ছিলেন তাঁর পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম ভারতীয় আইসিএস মেজোভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্নেহদৃষ্টির ছবি আমরা জানি, কিন্তু কিশোর কবির কবিপ্রতিভার গুণগ্রাহীতার কোনো পরিচয় তিনি তাঁর আচরণে ফেলে রেখে যাননি। কিন্তু দাদা জ্যোতিন্দ্রনাথ ও নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর প্রশ্রয় ও মনোযোগ সমস্ত শূন্যতা ভরাট করেছিল। জ্যেষ্ঠদের মধ্যে বড়োভাই কবি, দার্শনিক-অঙ্কবিদ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী, সেকালের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, ছোটভাইটির প্রতি যে শ্রদ্ধাপূর্ণ স্নেহদৃষ্টি রেখেছিলেন তার পরিচয় ‘ভারতী’ পত্রিকার উদ্ভব ও পরিণতির কাহিনিতে পাওয়া যাবে। এঁনারা ছাড়া পরবর্তীকালে ঠাকুরবাড়ির কনিষ্ঠ প্রজন্মের বিভিন্ন দল তো ছিলই, যেমন―ভাইঝি ইন্দিরা, ভাগ্নী সরলা, বিভিন্ন ভ্রাতার সন্ততি সুধীন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পৌত্র দিনেন্দ্রনাথ, পিতৃব্য গিরিন্দ্রনাথের পৌত্র গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ প্রমুখ নানা গুণীজন।
    তাঁর দ্বিতীয় গুণগ্রাহী ছিলেন ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুবৃত্ত, যাঁরা প্রায় তাঁর সমবয়সী ছিলেন। এর মধ্যে পড়েন অক্ষয় চন্দ্র, লোকেন পালিত, প্রিয়নাথ সেন, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার, মোহিতান্ত্র সেন, আশুতোষ চৌধুরী এঁনারা সকলেই ব্যক্তি মানুষ ও জায়মান শিল্পী উভয়েররই প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন।
    ক্রমে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের সমাজের স্থায়ী ভিত্তি তৈরি করেন জীবনব্যাপী রবীন্দ্রচর্চার মাধ্যমে, তাঁরা এসেছেন অনেক পরে। যেমন অজিত কুমার চক্রবর্তী, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রবোধচন্দ্র সেন, বুদ্ধদেব বসু, সোমেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ। জীবনব্যাপী রবীন্দ্রচর্চা নয়, কিন্তু অসামান্য ধীশক্তির বলে রবীন্দ্রনাথকে অন্য মাত্রায় চিনে নেবার সুযোগ যাঁরা করে দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ধূর্জটীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায় এবং আবু সয়ীদ আইয়ুব অগ্রগণ্য। বর্তমানে বিদ্বৎসমাজে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি তো একাডেমিক ডিসিপ্লিনের অন্তর্গত হয়ে গেছে, তাই রবীন্দ্রচর্চা আজ এতখানিই গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানসাধনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
    স্বদেশের মানুষ তার এক উজ্জ্বল মণীষা ও সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যপ্রতিভাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের তীব্র বেদনাবোধ আমৃত্যু সঙ্গী ছিল। তাঁর ছোটখাটো মানসিক দুর্বলতা যেমন―প্রশংসায় খুশি হওয়া, নিন্দায় কষ্ট পাওয়া, কারো বেয়াদবিতে অসন্তুষ্ট হওয়া ইত্যাদি কিছু কিছু থাকলেও এটুকু বোঝার মতো প্রখর কা-জ্ঞান তাঁর ছিল যে, বঙ্গদেশে তো অবশ্যই, এমনকি আধুনিক ভারতবর্ষে তাঁর সমতুল্য কবি আর কেউ নেই। নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় তিনি কতটুকু খুশি হয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়, কিন্তু পশ্চিমের দেওয়া মণিহার গলার ফাঁস হিসেবে নিজেকে জাহির করবে কি না তা নিয়ে তাঁর সংশয় ছিল। তার পরেও পুরস্কারপ্রাপ্ত কবির প্রতি সম্মাননা প্রকাশে দেশবাসীর ঔদাসীন্য তাঁকে আরো কষ্ট দিয়েছিল। তাঁর প্রতি, তার সাহিত্যসাধনার ও দেশব্রতের প্রতি জনগণের নিরঙ্কুশ মনোযোগ তিনি দাবি করতেন। আমরা জানি যে, কবিগুরুর ভক্তবৃন্দের মতোই তাঁর বিরোধী পক্ষও দলে কম ভারী ছিল না। এহেন কৃতঘ্নতায় তিনি কতখানি রুষ্ট হতেন বলা মুশকিল, কারণ ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ তাঁর বিবেচনায় হয়তো-বা অশালীন ও গর্হিত আচরণ বলে গণ্য হতো, কিন্তু তাঁর নিজের তৈরি শান্তিনিকেতনের মানুষজনও তাঁর মূল্য বোঝে না।
    বস্তুতপক্ষে, রবীন্দ্র-আলোচনার শতাব্দীব্যাপী ইতিহাস বিচার করলে আমরা তিনটি পৃথক ধারার দেখা পেতে পারি বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত। প্রথমটি হলো, তাঁকে ভালোবেসে মমতার সঙ্গে বিচার বিশ্লেষণ ও যাচাইয়ের চেষ্টা। দ্বিতীয়টি হলো, নিরপেক্ষ ও অসম্পর্কিত অবস্থান নিয়ে তাঁর সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা। তৃতীয়টি হলো, স্বেচ্ছায় নিরূপিত পূর্ব নির্ধারিত বিরোধী অবস্থান নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধতা করা এবং তাঁর যাবতীয় সুকীর্তিরও অপব্যাখ্যা অন্বেষণ।
    রবীন্দ্রনাথ, অন্তর্জগতে রূপায়ন, ভাবের আক্ষরিক রূপদান বস্তুতন্ত্রহীনতার প্রবর্তন। বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ এই বস্তুতন্ত্রহীনতার প্রবর্তক। বিশ্বসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বড়ো মাপেরই এক নৈসর্গিক ঘটনা। তাঁর সমস্ত জীবনের সাধনা, তাঁর জীবনবোধের বিশ্লেষণ করলে একথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত মণপ্রাণ ছিল বিশ্বশান্তির জন্য সমর্পিত। কবি সকল মানব প্রেমিকের প্রতি উদ্দাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানালেন, ‘যাত্রা কর, যাত্রা কর, যাত্রীদল এসেছে আদেশ!’
    তাই আজ নির্দ্বিধায় বলব, আমরা শুধু তাঁকে মনেই রাখিনি―কাল থেকে কালান্তরে শ্রুত হবে রবীন্দ্রময় আমাদের এই জীবন। তাই কবি বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে পূর্ণ শান্তিতে, পূর্ণ আনন্দে, পূর্ণ সৌন্দর্যের এই বাংলাদেশে। আজ ২৫শে বৈশাখ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০তম জন্মজয়ন্তী। তাঁকে চিত্ত থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা!

  • কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী লাইফ সাপোর্টে

    কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী লাইফ সাপোর্টে


    ন্যাশনাল ডেস্ক: বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভেন্টিলেশন সাপোর্টে (লাইফ সাপোর্ট) চিকিৎসাধীন রয়েছেন। জাতীয় কবিতা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি তারিক সুজাত মঙ্গলবার এ তথ্য জানিয়েছেন।
    তারিক সুজাত বলেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাংলা একাডেমি এবং বিভিন্ন সূত্রে জেনেছি, তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। অবস্থা সংকটাপন্ন। ওনার চিকিৎসা তত্ত্বাবধানের জন্য একটা মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তারা সম্মিলিতভাবে চিকিৎসা প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান করছেন।
    বাংলা একাডেমি সূত্র জানায়, বেশ কয়েক দিন ধরেই শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন তিনি। একুশে বইমেলা চলাকালীন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যান। সোমবার (২৬ এপ্রিল) অবস্থার অবনতি হলে তাকে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

  • বাংলা কবিতার দেবদূত শঙ্খ ঘোষ

    বাংলা কবিতার দেবদূত শঙ্খ ঘোষ

    ইমদাদুল হক মিলন

    শঙ্খ ঘোষের কবিতা প্রথম পড়েছিলাম ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায়। শক্তি সুনীল শঙ্খ—এই তিন কবি তখন কবিতাপ্রেমী বাঙালিকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখছেন। কৃত্তিবাস সম্পাদনা করতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সেই পত্রিকা ঘিরে গড়ে উঠেছে কবিদের একটি দল। আমাদের বেলাল চৌধুরীও ছিলেন সেই দলে। যত দূর মনে পড়ে শঙ্খ ঘোষের একগুচ্ছ কবিতা ছাপা হয়েছিল কৃত্তিবাসের কোনো একটি সংখ্যায়। নাম ছিল ‘দিনগুলি রাতগুলি’। পরে এই নামে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এত স্নিগ্ধ মায়াময় কবিতা, শব্দের কী অপূর্ব ব্যবহার, ছন্দের কী মধুর খেলা! এক বিস্ময়কর কবি! চুয়াত্তর সালে শঙ্খদাকে সামনাসামনি দেখলাম। ঢাকায় এসেছিলেন। বেইলি রোডের মহিলা সমিতির হলে রবীন্দ্রনাথের গানের একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল। মঞ্চে শিল্পীদের মাঝখানে বসেছিলেন। ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা শ্যামবর্ণের পুরোদস্তুর বাঙালি বাবু। অনুষ্ঠানের আয়োজনটি চমৎকার। রবীন্দ্রনাথের এক একটি গান ধরে কথা বলছেন শঙ্খ ঘোষ। তাঁর কথা শেষ হওয়ার পরই সেই গানটি গেয়ে শোনাচ্ছেন কোনো শিল্পী। অপূর্ব আয়োজন! কবিতা পড়ে যে শঙ্খ ঘোষের চেহারা মানসপটে এঁকেছিলাম, মানুষটি যেন অনেকখানিই তেমন। একজন মানুষ যে এত সুন্দর করে কথা বলতে পারেন, কণ্ঠের স্নিগ্ধতায় যে আবিষ্ট করতে পারেন শ্রোতাদের, সেদিনই আমি যেন প্রথম তা অনুভব করলাম। যেমন তাঁর কবিতার স্নিগ্ধতা, তেমনি তাঁর কণ্ঠমাধুর্য। সেদিন কল্পনাও করিনি এই মহান কবির সঙ্গে কখনো পরিচয় হবে। তাঁর খুব কাছাকাছি যেতে পারব। একই মঞ্চে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে উদ্বোধন করতে পারব কোনো বইমেলা।

    সেদিনের সেই অনুষ্ঠানের পর থেকে যেখানেই শঙ্খ ঘোষের যে লেখা পাই, সংগ্রহ করি। পড়ে মুগ্ধ হয়ে থাকি। কবিতায় তো তাঁর কোনো তুলনাই হয় না। একের পর এক অসামান্য সব কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হতে লাগল তাঁর। ‘নিহিত পাতালছায়া’, ‘আদিম লতাগুল্মময়’, ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’। ‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে’-এর জন্য পেলেন রবীন্দ্র পুরস্কার। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেলেন ‘একাডেমি অ্যাওয়ার্ড’। আরেক অসামান্য কাব্যগ্রন্থ ‘মূর্খ বড়, সামাজিক নয়’-এর জন্য পেলেন নরসিংহ দাস পুরস্কার। আর অনেক পরে এসে লেখা ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। আমাদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল এই কবিতার কয়েকটি লাইন,

    একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি

    তোমার জন্য গলির কোণে

    ভাবি আমার মুখ দেখাবো

    মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।

    আর্জেন্টিনার মেয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছিলেন রবীন্দ্রপ্রেমে মগ্ন। রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পোকে নিয়ে অসামান্য একটি গ্রন্থ রচনা করলেন শঙ্খ ঘোষ। ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’। এই বই বলতে গেলে আমাদের পাগল করে দিল। কত যত্নে, কত মায়ায়, কত অনুসন্ধানে শঙ্খ ঘোষ লিখলেন রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পোকে নিয়ে। শঙ্খ ঘোষের ‘জার্নাল’গুলো সাহিত্যের বোদ্ধা পাঠকদের ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছে। সাহিত্যের কত কত বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন! তাঁর লেখা ছোটদের দুটো উপন্যাসের কথা আমার খুব মনে পড়ছে। ‘সকালবেলার আলো’ ছোটদের জন্য লিখেছিলেন পুজো সংখ্যা আনন্দমেলায়। আরেক কিশোর উপন্যাস ‘সুপারিবনের সারি’। কবিতার মতো গদ্যভাষাও অতুলনীয় শঙ্খ ঘোষের। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল আমার যেন পরিচয় হলো এক ঋষির সঙ্গে, এক দেবদূতের সঙ্গে। যাঁর অন্তরে সর্বক্ষণই খেলা করছে সকালবেলার আলো।

    কয়েক বছর ধরে কলকাতায় একটা সাহিত্য উৎসব হয়। ‘এপিজে সাহিত্য উৎসব’। অক্সফোর্ড বুকসের সেই বনেদি বইয়ের দোকানটির দোতলা একতলা মিলে হয়েছিল প্রথমবারের আয়োজন। চারজন কবি লেখক ছিলেন সেবারের অনুষ্ঠানের উদ্বোধক। শঙ্খ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার আর বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে গেছি আমি। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হলো। শঙ্খদার শরীর খারাপ যাচ্ছে অনেক দিন ধরেই। অনুষ্ঠানাদিতে যান না। গেলেও কথা একেবারেই বলেন না। পাশাপাশি বসে শ্রোতাদের উদ্দেশে সবাই কথা বললেন, শুধু শঙ্খদাই কিছু বললেন না। এত কাছাকাছি থেকেও সেদিনও তাঁর সঙ্গে কোনো কথা হলো না। মাঝখানে এক বছর গ্যাপ পড়ল। সে বছরও এপিজে সাহিত্য সম্মেলনে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কী যেন কী কারণে যাওয়া হলো না। অক্সফোর্ড বুকসের সঙ্গে যৌথভাবে উৎসবটির আয়োজন করে প্রকাশন সংস্থা ‘পত্রভারতী’। পত্রভারতীর স্বত্বাধিকারী ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক। লেখক হিসেবেও জনপ্রিয়। কলকাতা পাবলিশার্স গিল্ডের কর্তাব্যক্তি। আমার বিশেষ বন্ধু। পত্রভারতী আমার দুটো বইও প্রকাশ করেছে। পরের বছর আবার আমন্ত্রণ পেলাম এপিজে সাহিত্য উৎসবে। এবারের আয়োজন একটি মাঠে। একদিকে কিছু বইয়ের স্টল আছে। শামিয়ানা টানিয়ে সুন্দর স্টেজ করা হয়েছে। আগের অনুষ্ঠান হতো এক দিনের। সেবার হলো দুদিনের। শেষ দিনকার সন্ধ্যায় এসেছেন শঙ্খ ঘোষ ও সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। আমাকে বসানো হয়েছে শঙ্খ ঘোষ আর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মাঝখানে। একপাশে এত বড় কবি, আরেক পাশে হাস্যরসের রাজা লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়! আমি খানিকটা সংকুচিত হয়ে আছি। তার পরও শঙ্খদার সঙ্গে টুকটাক কথা শুরু হলো। সেই প্রথম কথা বলা তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন খুবই কম, শোনেন বেশি। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য ভাবনা নিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের অতি রসালো বক্তৃতা করলেন। তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য মাঠে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সঞ্জীবদা লেখেন যেমন, বলেনও তেমন। তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে ‘কিশোরদের হাসির গল্প’ সম্পাদনা করেছি আমি। আগে থেকেই পরিচয় ছিল। সঞ্জীবদার পরনে সেদিন প্যান্ট আর ফতুয়া। শঙ্খদা আছেন তাঁর সারা জীবনের পোশাকে। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। আমি একটা ব্লেজার পরে আছি। শীতকাল আসি আসি করছে। কথার ফাঁকে খুবই আগ্রহী গলায় সঞ্জীবদা একসময় আমাকে বললেন, ‘ঢাকায় বুঝি খুব শীত পড়েছে!’ সঞ্জীবদার সূক্ষ্ম ঠাট্টাটা আমি বুঝলাম এবং আমার খুবই গরম লেগে উঠল। মনে হলো ব্লেজারটা খুলে ফেলি।

    পরের রসিকতাটা এলো শঙ্খদার কাছ থেকে। বক্তৃতা শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে শঙ্খদার পাশে এসে বসেছি। কিছু দর্শক-শ্রোতা আমার পরিচয় পেয়ে বেশ আগ্রহী হয়েছেন। কিছু উৎসাহী ছেলেমেয়ে অটোগ্রাফ নিতে এলো। লিখতে গেলে শঙ্খদার হাত কাঁপে। এ জন্য বোধ হয় তিনি অটোগ্রাফ ইত্যাদি এড়িয়ে চলেন। ছেলেমেয়েরা আমার অটোগ্রাফ নিচ্ছে। শঙ্খদার দিকেও খাতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। শঙ্খদা অটোগ্রাফ না দিয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ অতিমৃদু কণ্ঠে আমাকে বললেন, ‘মিলন, আমার অটোগ্রাফটাও দিয়ে দিয়ো।’

    কয়েক বছর আগে শঙ্খ ঘোষ ‘জ্ঞানপীঠ’ পুরস্কার পেলেন। সেলিনা আপা (সেলিনা হোসেন) ও আমি তখন কলকাতায়। নিউ টাউন এলাকায় বইমেলা হচ্ছে। আমরা গেছি অতিথি হয়ে। অরুণিমা নামের একজন তরুণ কবি শঙ্খ ঘোষের জ্ঞানপীঠ পাওয়ার সুসংবাদটি দিলেন। সুভাস মুখোপাধ্যায়ের অনেক দিন পরে আরেকজন বাঙালি কবি এই উচ্চ মর্যাদার পুরস্কারটি পেলেন। গবেষক প্রাবন্ধিক ইমানুল হক আমাদের বিশেষ পরিচিত। শঙ্খদার খুবই অনুরাগী এবং প্রিয়ভাজন। বললেন, চলুন, শঙ্খদার বাড়িতে যাই। তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে আসি।

    এই সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়? চললাম শঙ্খদার বাড়িতে। যেতে যেতে আমার মনে পড়ল বাদল বসুর কথা। আনন্দ পাবলিশার্সের কর্ণধার ছিলেন। সেই সন্ধ্যার কয়েক মাস আগে কলকাতা এয়ারপোর্টে নেমেই শুনেছিলাম তাঁর প্রয়াণের কথা। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে গিয়েছিলাম বাদলদার ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর মাঝখানে অনেকখানি করে চওড়া জায়গা। সেখানে বাদল বসুর অনুরাগী বন্ধুরা আছেন। শঙ্খদাকে দেখেছিলাম উদাস বিষণ্ন মুখে একটা চেয়ারে বসে আছেন। মুখ দেখে বোঝা যায়, দেখছেন সব কিছুই আবার কিছুই যেন দেখছেন না। তিনি যেন আছেন তাঁর নিজের জগতে।

    শঙ্খদার ফ্ল্যাটে গিয়ে সেই সন্ধ্যায় সেলিনা আপা, ইমানুল আর আমি বসে আছি তাঁর বসার ঘরে। শঙ্খদার জন্য আমি নিয়ে গেছি আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত আমার ‘নূরজাহান’ বইটির অখণ্ড সংস্করণ। সেলিনা আপা নিয়েছেন ফুল। শঙ্খদা তাঁর বেডরুমে ছিলেন। আমাদের একটু অপেক্ষাই করতে হলো। তারপর তিনি এলেন। সেই সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা। আমার মনে হলো, একজন দেবদূত এসে উপস্থিত হলেন আমাদের মাঝখানে। তারপর কত কথা, কত গল্প! অসামান্য একটি সন্ধ্যাবেলা কেটে গেল।

    করোনা কেড়ে নিল আমাদের এই দেবদূতকে। জন্মেছিলেন ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২, চলে গেলেন ২১ এপ্রিল ২০২১।

    বাংলাদেশটিকে বড় ভালোবাসতেন শঙ্খ ঘোষ। বরিশালের বানারীপাড়ায় ছিল আদি বাড়ি। জন্মেছেন চাঁদপুরে। বাবার কর্মসূত্রে ছেলেবেলার কতগুলো বছর কেটেছে পাবনায়। শঙ্খ ঘোষ তাঁর আসল নাম নয়। প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন যাদবপুর ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৩৪-৩৫টি কবিতার বই, গদ্যগ্রন্থ ৪৮টি, শিশু-কিশোরদের বই ২৩টি। কত পুরস্কার, কত সম্মান তাঁর জীবনজুড়ে! বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’, ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’। সব কিছু পেছনে ফেলে চলে গেলেন শঙ্খদা। এই চলে যাওয়া কি আসলে চলে যাওয়া? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘যাওয়া তো নয় যাওয়া’। বাংলা কবিতায় শঙ্খ ঘোষ এক অমর নাম। চলে গিয়েও এই কবি রয়ে গেলেন বাংলা কবিতার অনেকখানি জায়গা আলোকিত করে।

    শঙ্খদা, যে অচিনলোকে আপনি চলে গেলেন, যেখানে অনন্তকাল আপনার বসবাস, সেই জগতেও যেন আপনার অন্তর ভরে থাকে সকালবেলার আলোয়।

  • নিমতলা মহাশ্মশানে শঙ্খ ঘোষের শেষকৃত্য

    নিমতলা মহাশ্মশানে শঙ্খ ঘোষের শেষকৃত্য

    অনলাইন ডেস্ক: ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় হুগলি নদীর তীরে নিমতলা মহাশ্মশানে কবি শঙ্খ ঘোষের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। বুধবার বিকেলে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় এই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।

    এরআগে বেলা ৩টার দিকে বাড়ি থেকে রওনা হয় কবির মৃতদেহবাহী গাড়ি। কবির ভাই নিত্যপ্রিয় ঘোষের সল্টলেকের বাড়িতে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। তার পর সেখান থেকেই নিমতলায় উদ্দেশে রওনা দেয় কবির দেহবাহী গাড়ি।

    করোনাবিধি মেনে কবির শেষকৃত্য হয় বলে জানিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা। মৃতদেহ বের করার সময় কোভিড প্রোটোকল যাতে মানা হয়, সেদিকে নজর রাখা হয়। রাজ্য সরকার আগেই জানিয়ে দেয়, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কবির শেষকৃত্য হবে। তবে কবির শেষবিদায়ের সময় তোপধ্বনি করা হবে না বলে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

    কবির মৃত্যুতে শোক জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদার কবিকে শেষ সম্মান জানানো হলেও ‘গান স্যালুট’ বাদ রাখা হবে। কারণ, তোপধ্বনি পছন্দ করতেন না কবি। পাশাপাশি, কবির পরিবারের ইচ্ছানুযায়ী আড়ম্বরহীন ভাবে তাকে শেষ সম্মান জানানো হবে।

    করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বুধবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে মৃত্যু হয় কবি শঙ্খ ঘোষের। তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। জ্বর থাকায় গত সপ্তাহে করোনা পরীক্ষা করিয়েছিলেন কবি। গত ১৪ এপ্রিল বিকেলে তার করোনা রিপোর্ট পজিটিভ আসে। আগে থেকেই বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। গত ২১ জানুয়ারি অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালেও ছিলেন কয়েকদিন।

    করোনার আক্রান্ত হওয়ার পর কলকাতার বাড়িতে থেকে তার চিকিৎসা চলছিল। মঙ্গলবার রাতে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। বুধবার সকালে তাকে ভেন্টিলেশনে নেওয়ার পর সাড়ে ১১টার দিকে মৃত্যু হয়।

    ১৯৩২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলায় জন্ম হয় শঙ্খ ঘোষের। তার পৈতৃক বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়ায়। তবে শঙ্খ ঘোষ বড় হয়েছেন পাবনায়। বাবার কর্মস্থল হওয়ায় তিনি বেশ কয়েক বছর পাবনায় অবস্থান করেন এবং সেখানকার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫১ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন তিনি। বিশ্বভারতী ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি অধ্যাপনা করেছেন।

    বাংলা কবিতার জগতে শঙ্খ ঘোষের অবদান কিংবদন্তিপ্রতিম। ‘দিনগুলি রাতগুলি’, ‘বাবরের প্রার্থনা’, ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’, ‘গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ’ তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে একাধিক সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন শঙ্খ ঘোষ।

    ১৯৭৭ সালে ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থটির জন্য তিনি দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৯৯ সালে কন্নড় ভাষা থেকে বাংলায় ‘রক্তকল্যাণ’ নাটকটি অনুবাদ করেও সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান তিনি। এ ছাড়াও রবীন্দ্র পুরস্কার, সরস্বতী সম্মান ও জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১১ সালে তাকে পদ্মভূষণে সম্মানিত করে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার।

  • শোকে স্তব্ধ সমরেশ-বুদ্ধদেব-শীর্ষেন্দু

    শোকে স্তব্ধ সমরেশ-বুদ্ধদেব-শীর্ষেন্দু

    ন্যাশনাল ডেস্ক: কবি শঙ্খ ঘোষের মৃত্যুতে শোক নেমে এসেছে সাহিত্যমহলে। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকরা। সংবাদ মাধ্যমের কাছে বলা তাদের কথায় উঠে এসেছে কবির জীবন, সাহিত্যসহ নানা বিষয়।

    বিশিষ্ট সাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার বললেন, জীবিতকালে উনি নীরবে থাকলেও হৃদয়ে থাকতেন সবসময়। আজ উনি যখন চলে গেলেন তাও গেলেন নীরবেই। প্রয়াত কবিকে যে তিনি একবার জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ হয়তো ‘ তুমি হৃদয়ে মম ‘ লাইনটি তাকে দেখেই লিখেছিলেন, সেকথাও বললেন ‘কালবেলা’-র স্রষ্টা।

    বললেন,শঙ্খ ঘোষের লেখা কবিতা তার কাছে শুধুমাত্রই ব্যক্তিগত তা আবৃতি কিংবা পাঠ করার জন্য নয়। খুব তেষ্টা পেলে এক গ্লাস জল খেলে যেমন অনুভূতি হয়, কবির সৃষ্টি সেইসব কবিতা পড়ে তার সেই একই অনুভূতি হয়।

    বিখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব গুহ বললেন,’ একটি যুগের অবসান হলো। এই ঘটনা বাংলা সাহিত্যে মহীরুহ পতনের মতো। বাংলা কাব্য জগতে শঙ্খদা শেষ প্রতিষ্ঠান ছিলেন।’

    আরও বললেন, বরাবরই নীরবে থাকা পছন্দ করতেন কবি। যেমন অন্তর্মুখী ছিলেন, তেমনই ছিলেন গভীর মনের একজন মানুষ তার ‘শঙ্খদা’। কলেজ জীবন থেকেই শঙ্খ ঘোষের অসংখ্য কবিতার পাঠক হয়েও কবির ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ কাব্যগ্রন্থটি যে তার অশেষ প্রিয় সেকথাও নিজের বক্তব্যের শেষে উল্লেখ করতে ভুললেন না ‘ঋজুদা’-র স্রষ্টা।

    সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় জানালেন তার কাছে শঙ্খ ঘোষ শুধুই একজন বিরাট কবি ছিলেন না। তার কাছে মানুষ শঙ্খ ঘোষও একটু অদ্ভুত ছিলেন। সাধারণ চোখে যাকে বিচার করা অসম্ভব।

    লেখকের কথায়, অসম্ভব শান্ত ও স্থিতধি ছিলেন প্রয়াত কবি। সঙ্গে অসম্ভব ধৈর্য্যশীল ও সমপরিমানের স্নেহশীল। বিশেষ করে তরুণ লেখক,কবি, প্রকাশকদের প্রতি তার যে প্রশ্রয়,পিতৃসুলভ মনোভাব তা এককথায় তুলনাহীন।

    শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘একই বিষয়ে সুনীলের খানিকটা ছিল,কিন্তু শঙ্খবাবুর ব্যাপ্তি আরও অনেকটাই বেশি।নিজের সময় নষ্ঠ করে তরুণ কবিদের কবিতা সংশোধন করে দিচ্ছেন একথা আজকাল আর ভাবা যায় না। অলীক রূপকথা মনে হয়। অথচ দিনের পর দিন তাই করে গেছেন শঙ্খ ঘোষ।’

    নিজের বক্তব্যে তার আরও সংযোজন, অসংখ্য পুরস্কার,সন্মান পেয়েও বদলে যাননি শঙ্খ ঘোষ। অহংকারের লেশমাত্র ছিল না। এমনও হয়েছে পুরস্কারের মোটা টাকা মুহূর্তে বিলিয়ে দিয়েছেন অসহায় মানুষদের মধ্যে। একবার নয় একাধিকবার।’ উদাহরণস্বরূপ জানালেন, দীর্ঘদিন বঙ্গীয় সাহিত্যে পরিষদের কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছিলেন না জানতে পেরে পুরস্কারের পাঁচ লক্ষ টাকা তাদের দিয়ে দিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। এমনই মানুষ ছিলেন তিনি।

    একই সুর শোনা গেল সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্তের গলাতেও। লেখকের কাছে তার ‘শঙ্খ জেঠু’কে হারানো পিতাকে হারানোর মতোই। তিনি শঙ্খবাবুকে হারালেন শব্দটি বলার বদলে জানালেন শঙ্খ ঘোষকে ‘পাওয়া’-র স্মৃতি তার কাছে আজন্ম উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। শঙ্খ ঘোষের জীবন এবং তাঁর সৃষ্টি আমাদের এই সমাজকে অনেককিছু দিয়ে গেল বলেই ধারণা তার। আরও বললেন,ইতিহাসে থেকে যাবেন কবি নিজের কৃত্বিতে কিন্তু সাহিত্যে যিনি থেকে যাবেন একজন মনীষী হিসেবে। নানান স্মৃতিচারণার ফাঁকে কবির একটি বিশেষ গুণের ব্যাপারে জোর দিলেন এই বিশিষ্ট লেখক।

    প্রচেত গুপ্তের কথায়, ‘যেভাবে প্রবীণ সাহিত্যিক, প্রকাশক, সম্পাদকদের দেখতেন ঠিক সেই একই মূল্যে আনকোরা নতুন কবি, লেখক, সম্পাদক, প্রকাশকদেরও দেখতেন উনি। কোনওরকম তফাৎ করতেন না গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে।শঙ্খবাবু একজন বড় প্রকাশনার ক্ষেত্রে যেভাবে লিখতেন,একটি ছোট প্রকাশনার ক্ষেত্রে এককিভাবে লিখতেন।’ গদ্যেও যে তার অসাধারণ সব কাজ রয়েছে তার মাধ্যমেও শঙ্খবাবু দৃপ্তভাবে থেকে যাবেন বলেও জোর গলায় জানালেন প্রচেত গুপ্ত।