ন্যাশনাল ডেস্ক: জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘অপরাধী যেই হোক তার ঠিকানা জেলখানা। কোনও দল ও সংগঠন অপরাধীদের ঠিকানা হতে পারবে না। অপরাধীদের আশ্রয়দাতা নেতাদের মুখোশ খুলে দিতে হবে। অপরাধীদের সঙ্গে নেতাদের সন্ধি বিচ্ছেদ করে দিতে হবে।’
শুক্রবার (২ অক্টোবর) সকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে শহীদ কর্নেল তাহের মিলনায়তনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের সহযোগী যুব সংগঠন জাতীয় যুব জোট কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সভায় এসব কথা বলেন হাসানুল হক।
ইনু বলেন, ‘‘রাজাকাররা যেমন সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারে না, ঠিক তেমনি দুর্নীতিবাজ-লুটেরা-ধর্ষকদেরও সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে দেওয়া যাবে না। তাদের বেপরোয়া ভাব দমাতে ‘তুই রাজাকার’-এর মতোই ‘তুই দুর্নীতিবাজ’, ‘তুই লুটেরা’, ‘তুই ধর্ষক’ আওয়াজ তুলে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।’’
জাতীয় যুব জোটের সভাপতি রোকনুজ্জামান রোকনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় যুব জোটের সাধারণ সম্পাদক শরিফুল কবির স্বপন, সহ-সভাপতি কাজী সালমা সুলতানাসহ অনেকে বক্তব্য রাখেন।
Category: রাজনীতি
-

অপরাধীদের সঙ্গে নেতাদের সন্ধি বিচ্ছেদ করতে হবে: ইনু
-

‘গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুর চেতনায় তরুণদের আলোকিত করতে হবে’
ন্যাশনাল ডেস্ক: ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেছেন, ‘যুদ্ধ, গৃহযুদ্ধ, ছায়াযুদ্ধ, সন্ত্রাস ও ঘৃণা-বিদ্বেষে জর্জরিত বর্তমান বিশ্বে শান্তি ও সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরি করতে হলে মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শনের চেতনায় তরুণ প্রজন্মকে আলোকিত করতে হবে।’
শুক্রবার (২ অক্টোবর) মহাত্মা গান্ধীর ১৫২তম জন্মদিন উপলক্ষে ‘বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধুর অবদান’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন শাহরিয়ার কবির। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এই সভায় বাংলাদেশ ও ভারতের বুদ্ধিজীবী, সমাজকর্মী ও গান্ধীবাদী নেতারা অংশগ্রহণ করেন।
শাহরিয়ার কবির আরও বলেন, ‘শান্তি, সম্প্রীতি ও মানবতার শত্রুরা ভারত ও বাংলাদেশের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে। ধর্মনিরপেক্ষ মানবতা, শান্তিও সম্প্রীতির চেতনা ব্যক্তি ও সমাজ জীবন থেকে আরম্ভ করে রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে।’
ওয়েবিনারের ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘মহাত্মা গান্ধী ও বঙ্গবন্ধু দুজনেই শান্তির ধারণাকে অহিংসা, মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, সম্প্রীতি, পরিবেশ ও উন্নয়নের বৃহত্তর পরিসরে স্থাপন করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা ও প্রকৃতির ভারসাম্য থেকে শান্তিকে আলাদা করে দেখেননি।’
বৃটিশ গান্ধীবাদী সমাজকর্মী জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলেছেন, ‘এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতি অবলোকন করলে গান্ধীর প্রতিক্রিয়া কী হতো। নিশ্চিতভাবে বলতে পারি বর্তমানে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বিরোধ, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক অশান্তি, ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধ, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ প্রভৃতি গান্ধীকে অত্যন্ত বিচলিত করতো।’ -

বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় পাঠচক্র ফোরাম-এর উদ্যোগে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি: ভাত-কাজ-চিকিৎসাসহ বিভিন্ন দাবিতে বাসদ (মার্কসবাদী) কেন্দ্রীয় পাঠচক্র ফোরাম-এর উদ্যোগে আজ বিকেলে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
পাঠচক্র ফোরাম-এর সমন্বয়ক কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সদস্য বেলাল চৌধুরী ও সাদরুল হাসান রিপন।
কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী বলেন, ৬ মাসের করোনা-সংকটে কোটি কোটি মানুষ সংকটে পড়েছে। অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছে, অনেক মানুষের উপার্জন কমেছে। সে মানুষের জন্যে সারাদেশে রেশনিং-ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে স্বল্পসুদে ঋণ ও ন্যায্যদামে কৃষি-উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হবে।
তিনি বলেন, লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছে। মালিকরা শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ করছে না। জনগণের সম্পদ রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫ টা পাটকল বন্ধ করে ব্যক্তিগত মালিকানায় তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করে সরকারি উদ্যোগে আধুনিকায়নের মাধ্যমে অবিলম্বে চালু করতে হবে। শ্রমিকদের যাবতীয় পাওনা এককালীন পরিশোধ করতে হবে।
শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী বলেন, নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। নিত্যপণ্যের দাম কমাতে হবে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত। শিক্ষার্থীদের মেসবাড়া ও বেতন-ফি মওকুফ করে শিক্ষাজীবন সচল রাখার দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।
মৌলিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলন-সংগঠন গড়ে তোলার জন্যে কমরেড শুভ্রাংশু চক্রবর্ত্তী গ্রাম-শহরের শোষিত মানুষের প্রতি আহ্বান জানান।
-

অপু উকিলের বিরুদ্ধে নাজমার যতো ক্ষোভ
মশাল ডেস্ক: নাজমা আক্তার। যুব মহিলা লীগ সভাপতি। ১৯ বছর ধরে সংগঠনটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সম্প্রতি তার মা মৃত্যুবরণ করেন। অথচ যুব মহিলা লীগ সহানুভূতি জানিয়ে স্বজন হারানো নাজমা আক্তারের পাশে দাঁড়ানো তো দূরে থাক, তার মায়ের মৃত্যুতে কোনো শোকবার্তাও জানায়নি! এ নিয়ে শোকাহত নাজমা আক্তার ক্ষোভ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি আবেঘগন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এতে তিনি আমাদের রাজনৈতিক দৈন্যতার যে চিত্র তা তুলে ধরেছেন। পূর্বপশ্চিমের পাঠকদের জন্য তা হুবহু তলে ধরা হলো:
এটা কি বিবেকহীনতা, অমানবিকতা, শত্রুতা, হিংস্রতা, নাকি জঘন্য অপরাধবোধ থেকে সৌজন্যবোধটাকে হারিয়ে ফেলা ? প্রায় ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবনের ১৯টি বছরই কাটালাম যুব মহিলা লীগের সভাপতি হিসেবে। সম্প্রতি আমার মা মৃত্যুবরণ করেছেন। মায়ের মৃত্যুতে সংগঠনের সাধারন সম্পাদক প্রেস রিলিজ দিয়ে শোক বার্তা পাঠাবে, এটিই বোধ হয় রাজনৈতিক শিষ্টাচার। কিন্তু অত্যন্ত দু:খের সাথে লক্ষ্য করলাম, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল সেটি তো করলোই না, ফেসবুকে দু:খ প্রকাশ করেও কোন স্ট্যাটাস দিতে দেখলাম না। এমনকি গত ৭ দিনে তার কাছ থেকে সহানুভূতির কোনো ফোনও পেলাম না। তাহলে কি আমার মায়ের মৃত্যুর প্রেস রিলিজ আমাকেই দিতে হতো?
কার সাথে এতোটি বছর রাজনীতি করলাম? কোন একটি দৈনিক পত্রিকায় আমার মায়ের মৃত্যুতে শোক ও দু:খ প্রকাশ করে জনাব ওবায়দুল কাদেরের নামের সাথে অপু উকিলের নামটিও এসেছে। সেটি যুব মহিলা লীগের কোন প্রেস রিলিজ ছিল না, কোন এক সাংবাদিক ভাই তার নাম নিজের ইচ্ছাতেই জুড়ে দিয়েছেন। এইভাবেই কি মনুষ্যত্বহীন নিষ্ঠুর রাজনীতিকে সঙ্গী করে আমাদেরকে চলতে হবে?
সুত্র: পূর্বপশ্চিমবিডি/ এনএন
-

মনোনয়ন বাণিজ্য বিএনপির ভবিষ্যতের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে: জাফরুল্লাহ
মশাল ডেস্ক: বিএনপির মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণেই নির্বাচন এলে বেড়ে যায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল। কখনো কখনো তা রূপ নেয় সংঘর্ষে। যদিও এ নিয়ে দলের নেতাদের ভেতরেই রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা অনেকেই সরাসরি বলতে রাজি না হলেও শীর্ষ নেতারা বলছেন, এ ধরণের অভিযোগ ভিত্তিহীন।
ছোটখাটো দলীয় সংঘর্ষকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখছেন তারা। এদিকে, বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, বিভেদ মেটাতে আর্থিক লেনদেন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বিএনপিকে।
দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি রাজনীতির প্রেক্ষাপটে অনেকটা কোণঠাসা থাকলেও দলীয় কোন্দলের কারণে এবার আলোচনায়। সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে না উঠতেই নানা অভিযোগে বিভেদ এখন প্রকাশ্যে এসেছে দলটিতে। ছোটখাটো কোন্দল রূপ নিচ্ছে সংঘর্ষে।
ক্যামেরার সামনে কথা বলতে না চাইলেও দলটির অনেক নেতাকর্মী মনে করেন দলীয় কোন্দল মূলত অযোগ্যদের মূল্যায়ন ও যেকোনো নির্বাচনকে ঘিরে শীর্ষ নেতাদের মনোনয়ন বাণিজ্যই দায়ী।
ছোটখাটো সংঘর্ষকে স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করলেও মনোনয়ন বাণিজ্যকে উড়িয়ে দিলেন বিএনপির অন্যতম নীতিনির্ধারক ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তিনি বলেন, চাহিদা পূরণ না হলেই অভিযোগ আসে দলের ভেতর থেকেই।
তবে বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, সুষ্ঠু রাজনীতির ধারা অব্যাহত রাখতে অনৈতিক পথ থেকে বের হয়ে আসতে হবে বিএনপিকে। অর্থের বিনিময়ে প্রার্থিতা দেয়ার সংস্কৃতি বিএনপির ভবিষ্যতের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে বলেও মত তার।
ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘যা রটে তার কিছুতো বটেই। কিছু না হলে এটা রটবে কেন? গণতন্ত্রের চর্চাটা না থাকার কারণে এটা হচ্ছে।’
এধরণের কোন্দল বা অনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বের হয়ে আসতে গেলে গণতান্ত্রিক উপায়ে দলীয় কাউন্সিলের বিকল্প নেই।
-

পাঁচ মাস পর সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু বিএনপির
দীর্ঘ পাঁচ মাস পর দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরুর নির্দেশ দিয়েছে বিএনপি। শনিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাত ১১টায় দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এতে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম/সাংগঠনিক গঠন ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া গত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছিল।
বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারি এখনো বিরাজমান। এসময় বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে দলীয় কার্যক্রমের অগ্রগতির জন্য সাংগঠনিক কার্যক্রম/সাংগঠনিক গঠন ও পুনর্গঠন পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
দেশব্যাপী দলের নেতাকর্মীদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধি মেনে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, গত ২৩ মার্চ বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর সব সাংগঠনিক কার্যক্রম এক মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছিল। এরপর পাঁচ দফায় তা বাড়িয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সব সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়।
-

অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ: পর্ব ৫
জিয়াউল হক মুক্তা
[জিয়াউল হক মুক্তা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এ রচনায় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্যের সাথে যোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিচার-আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও কিছু সাক্ষ্যভাষ্য এবং বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রী প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিজনদের কিছু বক্তব্য; এবং বর্তমান লেখকের গবেষণালব্ধ কিছু পর্যবেক্ষণ। সবশেষে প্রধানমন্ত্রীর সদয় বিবেচনা ও সকলের আলোচনার জন্য যোগ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা সত্যানুসন্ধান কমিশন’ বিষয়ক কিছু বিষয়গত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা। পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় লেখাটি ১৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আজ প্রকাশিত হচ্ছে পঞ্চম পর্ব।]আমেরিকার পক্ষে এসব কোনোভাবেই মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ের দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি লরেন্স লিফস্যুলৎসের মতে এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে আমেরিকানরা শেখ মুজিব হত্যায় যুক্ত ছিল ও এতে সবুজ সংকেত দিয়েছিল; জিয়াউর রহমানের সমর্থন ছাড়া এ হত্যাকা- ঘটানো সম্ভব ছিল না এবং আমেরিকার সমর্থন ছাড়া জিয়ার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব ছিল না; জিয়া ও রশীদ-ফারুক ও অপরাপর খুনীদের সাথে আমেরিকানদের ‘পূর্ব-যোগাযোগ’ ছিল, এবং এ পূর্বযোগাযোগ হচ্ছে, লরেন্স লিফস্যুলৎসের ভাষায়, শেখ মুজিব হত্যা বিষয়ে এসেনসিয়াল বা অপরিহার্য ও ক্রুশিয়াল বা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। তৎকালীন [আগস্ট ১৯৭৫] সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ২০০২ সালের ১৫ আগস্টে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে ১৫ আগস্ট সাতসকালে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজেন বোস্টারকে বাংলাদেশ বেতারের পাশে শেরাটন হোটেলে দেখা গেছে; এবং ক্ষমতা দখলের পরে মোশতাক প্রথম সভাটি করেন বোস্টারের সাথে। লিফস্যুলৎসের সাথে এখানে বলে রাখা দরকার যে শুধু জিয়াই নয়, খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলসহ প্রায় সকল বড় সেনা কর্মকর্তারাই যে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত, তার তথ্য-প্রমাণ-ব্যাখ্যা এখন প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছে। এ রচনায় পরে তার কিছু কিছু তথ্য উল্লেখ করা হবে।
এভাবেই— সোভিয়েত ব্লকের ন্যাপ-সিপিবির জাতীয়তাবাদ বিরোধী ও জোট নিরপেক্ষতা বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান আর বাকশালে তাদের অন্তর্ভুক্তি— বঙ্গবন্ধু হত্যার বিবিধ জাতীয় পরিস্থিতির সাথে যোগ করলো আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিগত প্রেক্ষাপট; এ বিষয় অবহেলা করে বৈশ্বিক সুপার পাওয়ারদের হিসেব-নিকেশকে বাইরে রেখে বঙ্গবন্ধু হত্যাকে পুরোটা কোনভাবেই অনুধাবন করা যাবেনা। সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট নির্মাণে ন্যাপ-সিপিবির ও তাদের পরিচালক সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব এড়িয়ে যাবার উপায় নেই এক বিন্দুও।
অধ্যায় নয়. বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট ও নেপথ্য-কুশীলব
বঙ্গবন্ধু হত্যার পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট-পরিসরের সার-সংক্ষেপ বিবেচনা করা যাক। উল্লেখ্য পারিবারিক প্রেক্ষাপট বলতে এ রচনায় বোঝানো হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের আসাযাওয়া ও সামাজিক সম্পর্ক ছিল তাঁর পরিবারের সাথে; এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্যদের বক্তব্য এ রচনার অধ্যায় এগারোতে উপস্থাপন করা হয়েছে।[১] স্বাধীন দেশের বৈপ্লবিক রূপান্তর ব্যাহত করতে বঙ্গবন্ধুর নিজের মনোনীত বিএলএফ/মুজিববাহিনীর ৪ নেতার ৪ সুপারিশ [ইতোমধ্যে মুজিব বাহিনীর চার যুব নেতা আর ঐকমত্যে নেই; তারা বিভক্ত হয়েছেন ও পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন] আর মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র-যুব-তরুণদের ১৫ দফা ও ১২ দফা সুপারিশ গ্রহণ করা থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করা হলো ।
[২] সরকারি প্রতিবেদনের প্রগতিশীল পরামর্শ উপেক্ষা করে জনপ্রশাসনে পাকহানাদার-দোসরদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হলো।
[৩] গোয়েন্দা সংস্থায় পাকহানাদার-দোসরদের পুনর্বাসিত করা হলো।
[৪] সামরিক বাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে পাকহানাদার-দোসরদের পুনর্বাসিত করা হলো।
[৫] রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে হাজার হাজার বীর-মুক্তিযোদ্ধার জায়গা হলো জেলে আর হাজার হাজার পাকহানাদার-দালাল কারামুক্ত হয়ে বিচরণ করতে লাগলো অবাধে।
[৬] দুর্নীতি-লুটপাট-সন্ত্রাস-কালোবাজারি-মজুদদারি-পাচারকারিদের মহোৎসব অব্যাহত রইলো; দুর্নীতির ব্যাপকতা বোঝাতে বঙ্গবন্ধু নিজেই চাটার দল আর চোরের দল আর নরপশুর দলের কথা বলেছিলেন; বলেছিলেন, বলেছিলেন আমার কম্বল কই?
[৭] ১৯৭৪ সালে— বৈশ্বিক পরিসরে মূল্যস্ফীতি, দেশজ পরিসরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নি¤œবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস, আর চাটার দল ও চোরের দল ও নরপশুর দলের দুর্নীতির ফলে পর্যাপ্ত খাদ্য থাকার পরও দেশে দুর্ভিক্ষ হলো; মানুষ মারা গেল সরকারি হিসেবে ২৬,০০০ থেকে ৩৭,০০০ জন।
[৮] এ রচনায় আলোচিত হয়নি, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ নিবর্তনমূলক বিভিন্ন কালাকানুন প্রবর্তিত হলো।
[৯] ডাকসু ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া হলো; প্রার্থী অপহরণ ও ভোট ডাকাতি হলো, যদিও এর প্রয়োজন ছিল না। জাসদ কার্যালয় জ্বালিয়ে দেয়া হলো আর দৈনিক গণকণ্ঠ কার্যালয় তছনছ করা হলো।
[১০] শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ন্যাপ-সিপিবি আওয়ামী লীগ ও বাকশাল সরকারকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিলো; প্রকাশ্য অপর সকল দল সরকার বিরোধী জোট গঠন করলেও কোন ভূমিকা রাখতে পারলো না; চীনপন্থি দলগুলো গোপনে বিরোধিতা করলো শ্রেণিশত্রু খতমের রাজনীতির মাধ্যমে। আর রাজনৈতিক পরিমলে জাসদ ছিল একা।
[১১] একদলীয় ব্যবস্থা ‘বাকশাল’ কায়েম করা হলো; অন্য সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হলো; চারটি বাদে অন্যসব পত্রিকা নিষিদ্ধ হলো। গণকণ্ঠ নিষিদ্ধ হলো; নিষিদ্ধ জাসদ অপ্রকাশ্যে ও গোপনে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করলো।
[১২] বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হলো; মার্কিনীদের পুরোনো দিনের বঙ্গবন্ধু বিরোধী অবস্থান অব্যাহত রইলো ও শক্তিশালী হলো—মোশতাকের পেয়াদা রশিদ-ফারুকচক্রের কাছে বঙ্গবন্ধু-হত্যায় ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের গ্রিন সিগনাল গেল এভাবে যে— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না ও তৎকালীন সরকারকে তারা স্বীকৃতি দেন। এর মধ্যে জিয়াও সিআইএ-র সাথে অনুষ্ঠিত দুটো সভায় বঙ্গবন্ধু হত্যায় তাদের সম্মতি পেয়ে যান; বঙ্গবন্ধু হত্যার ছয় মাস আগেই এ হত্যা পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয় [বিস্তারিত দশম অধ্যায়ে]।
হয়তো এই সব নয়; বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপটে হয়তো যোগ করার আছে আরও অনেক কিছু। এবারে দেখা যাক বর্ণিত প্রেক্ষাপটে কোন কুশীলব-চক্র সাড়ে তিন বছর ধরে বঙ্গবন্ধুকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন ও তাঁকে হত্যার উল্লিখিত প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন—
[১] আওয়ামী রাজনীতিতে শেখ মনির অনুসারীগণ; যদিও ১৫ আগস্ট শেখ মনিরও মৃত্যু হয়েছে— তার মত-পথ-জন ও ক্ষমতালিপ্সায় গৃহীত কার্যক্রম তাকেই দুর্বল করেছে ও সামগ্রিক পরিস্থিতি ঘোলা করেছে।
[২] খন্দকার মোশতাকের অনুসারীগণ।
[৩] জনপ্রশাসনে পাকিস্তানপন্থার অনুসারীগণ।
[৪] গোয়েন্দা বিভাগে পাকিস্তানপন্থার অনুসারীগণ।
[৫] আধা-সামরিক ও সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরে পাকিস্তানপন্থার অনুসারীগণ।
[৬] মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু ঔপনিবেশিক সেনাকাঠামোর ক্ষমতালিপ্সু সামরিক কর্মকর্তাগণ।
[৭] বাকশালে বিলীন সোভিয়েত ব্লকের ন্যাপ-সিপিবির অনুসারীগণ।
[৮] ঢাকায় সোভিয়েত ইউনিয়ন দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ— বিশেষত কেজিবির কর্মকর্তাগণ।
[৯] ঢাকায় বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ ও সিআইএ’র কর্মকর্তাগণ, যারা যথাক্রমে মোশতাকের অনুসারীদের ও জিয়াকে বঙ্গবন্ধু-হত্যায় সবুজ সংকেত দিয়েছেন [বিস্তারিত দশম অধ্যায়ে]।
অধ্যায় দশ. আদালতের পর্যবেক্ষণ ও সাক্ষ্য-ভাষ্য
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরের ১২ নভেম্বর সংসদে কুখ্যাত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হয় ও বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার শুরু হয়। বিএনপি ও ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে মাঝে সাত বছরের বেশি ওই বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকে। পরে আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতৃত্বে নেতৃত্বে ১৪ দল ও মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে আবারও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। রায় হয়। রায়ে ঘোষিত দণ্ড কার্যকর করা শুরু হয়।বিশিষ্ট সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খান বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পর্যবেক্ষণ করেছেন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় তার বই ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল’। তিনি মুজিব-হত্যার বিচারের রায়ের একদম শেষ দিকে বিচারক কাজী গোলাম রসুলের ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন, “প্রাসঙ্গিকভাবে ইহা উল্লেখ করিয়া পারা যায় না যে, এই মামলায় প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ বিশেষ করিয়া যাহারা ঢাকায় অবস্থান করিতেছিলেন, তাহারা তাহাদের দায়িত্ব পালন করেন নাই, এমনকি পালনের কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করেন নাই, যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও। ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন আদেশ পাওয়ার পরও তাহার নিরাপত্তার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নাই। সাক্ষ্য প্রমাণে ইহা পরিষ্কার যে, মাত্র দুইটি রেজিমেন্টের খুবই অল্প সংখ্যক জুনিয়র সেনা অফিসার/সৈন্য এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেন এই কতিপয় সেনা সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ/নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে নাই তাহা বোধগম্য নয়। ইহা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য একটি চিরস্থায়ী কলঙ্ক হিসাবে চিহ্নিত হইয়া থাকিবে।”
বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার আদালত অনুসরণকারী আরেক সাংবাদিক সাহাদত হোসেন খান তার ‘স্বাধীনতা উত্তর ট্র্যাজেডি: মুজিব থেকে জিয়া’ বইয়ে আদালতে দেয়া বিভিন্ন সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট উর্ধতন সেনা কর্মকর্তাদের কার্যক্রমের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন; নিচে এর নির্বাচিত অংশ নগণ্য পরিমার্জনসহ প্রায় হুবহু তুলে ধরা হলো।
[১] মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার ও নৌবাহিনী প্রধান কমোডর মোশাররফ হোসেন খান ছাড়া উর্ধতন প্রায় সকল সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন; তাদের সমর্থন এবং পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষ সহায়তাও পেয়েছিলেন। খুনিরা ক্যু’র দিন বঙ্গবন্ধু, শেখ মনি ও আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসার টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করেননি; কারণ তারা জানতেন যে টেলিফোন করলেও কেউ এগিয়ে আসবেন না। শেখ মনিকে হত্যার প্রায় ঘণ্টা খানেক পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়; এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ ও আরও অনেক জায়গায় ফোন করেন; কিন্তু যথেষ্ট সময় থাকার পরও কেউ তাঁকে রক্ষায় ছুটে আসেননি।
[২] ক্যু’র পরপরই এক রহস্যময় নীরবতার চাদরে ঢাকা সেনানিবাস আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ঢাকার শক্তিশালী ৪৬-ব্রিগেড ও ডিজিএফআইয়ের নিষ্ক্রিয়তা তার প্রমাণ। মেজর ফারুকের পরিকল্পনায় ৪৬-ব্রিগেডের হুমকি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা হয় এবং তুলনামূলকভাবে দুর্বল রক্ষীবাহিনীকে একমাত্র প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করা হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ হামিদ (অব.) তার ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইয়ে বলেছেন যে খুনি দুই মেজর তার কাছে নির্দ্বিধায় বলেছেন, ‘বড় ভাইয়েরা সমর্থন না দিলে এমন একটি অসম্ভব কাজ আমরা কিভাবে করতে যেতাম?’ কর্নেল হামিদ ৪৬-ব্রিগেডের নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে ফারুকের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘রশীদকে জিজ্ঞেস করুন। কেননা রশীদই যে কোনোভাবে ৪৬-ব্রিগেডকে নিশ্চল করে রেখেছিল।’ যথারীতি কর্নেল এমএ হামিদ রশীদের কাছে সরাসরি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্যার, ব্যাপারটি আপনিই বুঝে নিন। ৪৬-ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল ছিলেন আমাদের লোক। তার তরফ থেকে আমরা কোনো আক্রমণের আশঙ্কা করিনি। শাফায়াত ও তার অধীনস্থ অফিসারদের সবাই ব্যাপারটি জানতেন।’
[৩] মুজিব-হত্যার পর মেজর রশীদ প্রথম কর্নেল শাফায়াত জামিলের সাথে দেখা করে হত্যার খবর জানান। কিন্তু শাফায়াত তাকে সাথে সাথে গ্রেফতার না করে স্টাফ অফিসার মেজর হাফিজকে নিয়ে সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি জিয়াউর রহমানের কাছে যান। জেনারেল জিয়া যথারীতি সকাল সাড়ে ৭টায় অফিসে উপস্থিত হন; যেন কিছুই হয়নি।
[৪] কর্নেল শাফায়াত বলছেন, সবার সঙ্গে যোগাযোগ করার পর জেনারেল সফিউল্লাহ সকাল প্রায় ৬টায় তাকে টেলিফোন করেন। হ্যাঁ, সফিউল্লাহ তাকে প্রায় সকাল ৬টায় টেলিফোন করেন; তবে এটা ছিল তার কাছে সেনাপ্রধানের দ্বিতীয় টেলিফোন। সে সময় মেজর রশিদ কর্নেল শাফায়াত জামিলকে বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন। ভোর সাড়ে ৫টায় মেজর রশীদ কর্নেল শাফায়াত জামিলের কাছে অবস্থান করার সময়ও মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ তাকে টেলিফোন করেছিলেন। কিন্তু শাফায়াত আদালতের কাছে তাকে সাড়ে ৫টায় জেনারেল সফিউল্লাহর নির্দেশ প্রদানের কথা এড়িয়ে যান।
৫] এছাড়া মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ কর্নেল শাফায়াত জামিলের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক কর্নেল সালাহউদ্দিনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি নিজেও তার কাছে টেলিফোন করার জন্য ডায়াল ঘুরাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখনো ছিলেন জীবিত; সাড়ে ৫টার দিকে তিনি ফোর্স পাঠানোর জন্য সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে নির্দেশ দেন। সফিউল্লাহ টেলিফোন করেন ৪৬-ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াতকে। এক্সচেঞ্জ থেকে সেনাপ্রধানকে জানানো হয়, মনে হয় তিনি [শাফায়াত জামিল] রিসিভার উঠিয়ে রেখেছেন।
[৬] সঠিকভাবে তদন্ত করা হলে দেখা যেতো যে, কর্নেল শাফায়াত জামিল ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে জড়িত। মেজর রশিদের বদলি হয়েছিল যশোরে গানারি স্কুলে। রশিদের এ বদলিতে তাদের হত্যা-পরিকল্পনা লাটে উঠতে যাচ্ছিল। শাফায়াত তাকে ঢাকায় থেকে যাবার জন্য আবেদন করতে বলেন। শাফায়াতের সহযোগিতায় রশীদের যশোরে বদলি বাতিল হয় এবং তাকে ঢাকায় টু-ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডার হিসেবে বহাল করা হয়।
[৭] মেজর ফারুক শেরেবাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীর সদরদপ্তর ট্যাঙ্ক দিয়ে ঘেরাও করে রেখেছিলেন। ৪৬-ব্রিগেড ছিল পুরোপুরি ঘেরাও মুক্ত। জেনারেল সফিউল্লাহ প্রেসিডেন্টকে রক্ষায় ৪৬-ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াতকে নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও তিনি সৈন্য মুভ করেননি। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ কর্নেল শাফায়াত জামিলের অফিসেও যান। কিন্তু তিনি তাকে অফিসে পাননি। শাফায়াত জামিল থাকছিলেন দূরে দূরে।
[৮] শুধু শাফায়াত জামিলই নয়, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফও অত্যন্ত রহস্যময় ভূমিকা পালন করেন। ব্রিগেডিয়ার রউফ রাত তিনটায় ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারি চলাচলের গোয়েন্দা তথ্য পান, কিন্তু প্রেসিডেন্ট অথবা সেনাপ্রধানকে তিনি কিছু জানাননি। তার একটি বিশ্লেষণ ভেবে দেখার মতো। ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাসদরে সব গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনি জেনারেল সফিউল্লাহর বাসার বারান্দার নিচে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের গাড়ি দেখতে পান। তিনি বিশ্বাস করছিলেন যে, তার দেখা অফিসারদের মধ্যে অভ্যুত্থানের নেপথ্য নায়ক উপস্থিত। তিনি প্রত্যেকের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকান। সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ছাড়া আর কাউকে তার সন্দেহ হয়নি। অবশ্য ব্রিগেডিয়ার রউফ যাকেই সন্দেহ করে থাকুন না কেন, সন্দেহের তালিকায় প্রথমে ছিলেন তিনি নিজে।
[৯] ১৫ আগস্ট পর্যন্ত খুনি মেজরদের প্রতি শাফায়াত জামিলের ছিল বলিষ্ঠ সমর্থন। কিন্তু এতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিলের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় তারা উল্টে যান। ক্যু সফল হওয়ার পর কর্নেল শাফায়াত জামিল দেখতে পেলেন যে, এতে তার কোনো লাভ হয়নি। জিয়া চিফ অব স্টাফ হওয়ায় খালেদও শঙ্কিত হয়ে উঠেন; তার স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যায়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিলের এ ক্ষোভ থেকে পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে।
[১০] মেজর ফারুক ও রশিদের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে পর্দার অন্তরালে থেকে কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা তাদের পরিচালনা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৮ আগস্ট ৪৬-ব্রিগেডের স্টাফ অফিসার মেজর সাখাওয়াত হোসেনের সাথে মেজর শরীফুল হক ডালিমের আলাপ থেকেও ক্যু’র সাথে সিনিয়র আর্মি অফিসারদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। ডালিম জিপ চালিয়ে ক্যুদেতার সময় আহত সৈন্যদের দেখতে সিএমএইচে যাবার পথে মেজর সাখাওয়াত হোসেনকে জানান যে সে ক্যু ছিল বহুদিনের ফসল। কিভাবে তারা সমস্ত সিনিয়র অফিসারের সমর্থন আদায় করেছিলেন সে ব্যাপারে জানতে চাইলে উল্টো ডালিম সাখাওয়াত হোসেনের কাছে জানতে চান, অল্প কজন অফিসার এ অভ্যুত্থানে জড়িত, এ ধারণা তিনি কোথা থেকে পেলেন। ডালিম অত্যন্ত সহজভাবে সাখাওয়াত হোসেনকে বললেন যে আপনি কিভাবে জানলেন যে এ ক্যু’র পরিকল্পনা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি?
[১১] পুরো সশস্ত্র বাহিনী আগস্ট ক্যু’তে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সার্বিকভাবে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা মৌনভাবে তা মেনে নিয়েছিলেন। সেনাবাহিনী প্রধান সফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকেও নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে; খালেদ সরল জবাব দিয়েছিলেন, ‘এখন কিছুই করণীয় নেই যা এ প্রক্রিয়াকে উল্টে দিতে পারে।’
[১২] ক্যুদেতায় মেজর ফারুক খালি ট্যাঙ্ক নিয়ে শেরেবাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীকে ধোঁকা দেন। সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ বা সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের কাছে তিনি তার অভিযানের বর্ণনা দেন এবং তাকে গোলা ইস্যু করতে বলেন। খালেদ সঙ্গে সঙ্গে সেনাসদরের জেনারেল স্টাফ বা জিএস ব্রাঞ্চের আওতাধীন গোলা সরবরাহে জয়দেবপুরের অর্ডিন্যান্স ডিপোকে নির্দেশ দেন। একইদিন তিনি মেজর শাহরিয়ার রশীদ খানকে চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। [আগামী কাল ষষ্ঠ পর্ব]
-
অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ: পর্ব ৪
জিয়াউল হক মুক্তা:[জিয়াউল হক মুক্তা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এ রচনায় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্যের সাথে যোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিচার-আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও কিছু সাক্ষ্যভাষ্য এবং বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রি প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিজনদের কিছু বক্তব্য; এবং বর্তমান লেখকের গবেষণালব্ধ কিছু পর্যবেক্ষণ। সবশেষে প্রধানমন্ত্রির সদয় বিবেচনা ও সকলের আলোচনার জন্য যোগ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা সত্যানুসন্ধান কমিশন’ বিষয়ক কিছু বিষয়গত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা। পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় লেখাটি ১৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আজ প্রকাশিত হচ্ছে চতুর্থ পর্ব।]
১৯৭৪ সালে বিজয় দিবসের একদিন আগে ১৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া এ ভাষণে মূল্যস্ফীতিকে এক নম্বর শত্রু, প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে দুই নম্বর শত্রু ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু বললেন, “আমাদের নতুন প্রতিরোধ সংগ্রামে সর্ব শেষ ও সর্বপ্রধান শত্রু চোরাকারবারি, কালোবাজারি, মুনাফাবাজ ও ঘুষখোরের দল। মানুষ যখন অনাহারে মারা যায়, তখনও এই সব নরপশুর দল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখের গ্রাস অন্যত্র পাচার করে দিয়ে থাকে। বিদেশ থেকে ধার-কর্জ, এমনকি ভিক্ষা করে আনা পণ্য ও বাংলার সম্পদ মজুদের মাধ্যমে এরা মুনাফার পাহাড় গড়ে তোলে। এদের কোন জাত নেই, নেই কোন দেশ।”আগে-পরে অন্য অনেক বক্তব্যের মতো, পরে ১৯৭৫ সালে বঙ্গভবনে বাকশাল কমিটির উদ্বোধনী ভাষণেও তিনি বলেন, “আমি সার দিতে পারি নাই। যা সার দিয়েছি, তার থার্টি পারসেন্ট চুরি হয়ে গেছে। স্বীকার করেন? আমি স্বীকার করি। আমি মিথ্যা কথা বলতে পারবো না। মিথ্যা বলে একদিনও হারাম এ-দেশের প্রেসিডেন্ট থাকবো না। আমার যে সার আমি দিয়েছি, তার কমপক্ষে থার্টি পারসেন্ট ব্ল্যাক মার্কেটিং-এ চুরি হয়ে গেছে। আমি যে ফুড দিই, তার কুড়ি পারসেন্ট চুরি হয়ে যায়। আমি যে মাল পাঠাই গ্রামে গ্রামে তার বিশ পারসেন্ট, পঁচিশ পারসেন্ট চুরি হয়ে যায়। সব চুরি হয়ে যায়। হুইট [গম] আমি তো হুইট পয়দা করি না, খুব কমই করি, তবু কোন বাজারে হুইট পাওয়া যায় না? গভর্নমেন্ট গোডাউনের হুইট? সার তো আমি ওপেন মার্কেটে বিক্রি করি না, তবু কোন বাজারে সার পাওয়া যায় না?” এ সময়, জাসদ ব্যস্ত আত্মরক্ষায়; পলাতক। বঙ্গবন্ধু কথিত চাটার দল আর চোরের দল আর নরপশুর দল ঠেকানোর কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক শক্তি তখন আর প্রকাশ্যে/মাঠে নেই। পাকিস্তানের সামরিক জান্তাদের বিরুদ্ধে দশ বছর লড়াই করা আর মুক্তিযুদ্ধে মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে তাকে তুড়ে মেরে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া ছাত্র-যুব-তরুণরা এ অশনিসংকেত দেখেছিলেন অনেক আগেই। ১৯৭৪ সালের শুরুতেই জাসদ বঙ্গবন্ধু কথিত চাটার দল আর চোরের দল আর নরপশুর দলের দুর্নীতি-লুটপাট-মজুদদারি-কালোবাজারি-পাচারকারিদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর ‘ঘেরাও’ কর্মসূচি। কর্মসূচির প্রথম দিনে ১৭ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাওয়া রক্ষীবাহিনী গুলি করে হত্যা করে ৫০ জন জাসদ নেতাকর্মীকে; তাদের চার জনের লাশ বাদে বাকিদের লাশ গুম করে ফেলা হয়; গ্রেফতার করা হয় শতাধিক। পরের দিন জ্বালিয়ে দেয়া হয় জাসদ কার্যালয়। তছনছ করা হয় জাসদের মুখপত্র দৈনিক গণকণ্ঠের কার্যালয়। ১৭ মার্চ রাত থেকে সারাদেশে শুরু হয় নতুন উদ্যমে জাসদ-দমন; চিরুনী অভিযানের ফলে কারোর এমনকি আত্মগোপনে থাকাও অসম্ভব হয়ে ওঠে। দেশের দুর্ভাগা জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিল জাসদ একা; আর কেউ দাঁড়ায়নি তাদের পাশে; ন্যাপ-সিপিবি সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল, গোপন চীনপন্থী দলগুলো ব্যস্ত কথিত শ্রেণিশত্রু খতমে আর অপরাপর প্রকাশ্য সব সংগঠন নিজেরা একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম তৈরি করলেও তেমন উল্লেখযোগ্য কোন কর্মসূচি হাজির করতে পারেনি। এককভাবে আন্দোলনে থাকা জাসদকে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনার দাম দিতে হলো কড়ায়গন্ডায়— অত্যাচার-নির্যাতন-জেল-জুলুম-সন্ত্রাস-নিপীড়ন-খুন-গুমের শিকার হয়ে। রাজনীতির মাঠে নিঃসঙ্গ জাসদ যেন হয়ে ওঠলো সংশপ্তক।
অধ্যায় আট. এ ব্যাটলফিল্ড অব দ্য প্রক্সি ওয়ার?
সে সময়টা ছিল শীতল যুদ্ধের কাল। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। পারমাণবিক যুদ্ধের শংকায় কম্পমান মানব সভ্যতা। পাকিস্তান সমাজতন্ত্র মোকাবেলার সামরিক জোট সাউথইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা সিয়াটো ও দি সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা সেনটো’র সদস্য; উপরন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় পাশে পেয়েছে চীন ও আমেরিকাকে। ইউরোপের অনেক দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক হস্তক্ষেপে; এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায় সমাজতন্ত্র এসেছে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের হাত ধরে। ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোও চেষ্টা করেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা পেতে; কিন্তু সহায়তা গ্রহণের পাশাপাশি তাদেরকে ঝুঁকিও নিতে হয়েছে অনেক। ১৯৫৪ সালে ভিয়েতনাম দ্বিখন্ডিত হয়েছিল ও ১৯৬২ সালের অক্টোবরে কিউবা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল ১৩ দিনের স্নায়ু-ছেঁড়া পারমানবিক যুদ্ধের মিসাইল সংকট।এদিকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্টরা চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয়ে বিভক্ত ছিলেন। ফলে চীনপন্থীদের কেউ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ও কেউ জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মূলধারার বাইরে স্বতন্ত্র অবস্থান গ্রহণ করেছেন; আর সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুসারীরাও ন্যাপ-সিপিবিতে বিভক্ত ছিলেন। এসব বামপন্থীদের কেউ বাঙালির জাতীয় মুক্তির দিকে পরিকল্পিত আন্দোলন সংগ্রামের অংশ ছিলেন না। এরা ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের ঔপনিবেশিক সরকার ও তাদের শাসনকে নিজেদের অবস্থান দ্বারা প্রকারান্তরে সহায়তাই করে গিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরশাসন ও সামরিক শাসনের বেলায়ও এরা আপোষই করেছেন প্রায় সকল সময়। বঙ্গবন্ধু তাই বলতেন যে বাংলাদেশ কোনো আমদানি করা সমাজতন্ত্র চলবে না। স্বাধীনতা-সমাজতন্ত্রের অগ্রবাহিনী নিউক্লিয়াসপন্থীরাও বলতেন যে আমদানি করা সমাজতন্ত্র নয়, বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিকশিত জাতীয় সমাজতন্ত্রীরা আন্তর্জাতিক প্রভাববলয়ের বাইরে থেকে কায়েম করবেন শোষণমুক্ত সমাজ ও দেশ। দেশজ বাস্তবতার বৈজ্ঞানিক অনুধাবন থেকে পরিচালনা করবেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের আন্দোলন ও নির্মাণ করবেন সমাজতান্ত্রিক সমাজ। কোন দেশ বা সামরিক জোটের অনুসরণ নয়, জোট নিরপেক্ষতা হবে ভূরাজনীতিগত অবস্থান। জাসদ তৎকালীন জাতীয়-আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ, সোভিয়েত সামাজিক সা¤্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল জাতীয় সার্বভৌমত্বকে বিপদমুক্ত রাখতে; আজ ২০২০ সালে এসে এ কথাগুলো হাস্যকর শোনাতে পারে, কিন্তু প্রক্সি ওয়ারের যুগে স্বাধীন ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকেই এসব রাজনৈতিক টার্ম তৈরি হয়েছিল। জাতীয় সমাজতন্ত্র ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারণা থেকে গঠিত জাসদ স্বাধীন দেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়, আর তাই চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী সমাজতান্ত্রিক দলগুলো মনে করতো জাসদ তাদের সমাজতান্ত্রিক জমিদারি ধ্বংস করে দিয়েছে; আর তাই তারা জাসদের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত সর্বদা সর্বত্র।
বঙ্গবন্ধু যখন দল ও দলের বাইরের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি দ্বারা অবরুদ্ধ ও জাসদ যখন রাজনৈতিকভাবে ‘একলা চলো’ নীতি অনুসরণ করে মিত্রহীন নিঃসঙ্গ, ওই ন্যাপ-সিপিবি সুযোগটি নিলো পুরোপুরি, অনপ্রবেশ করলো আওয়ামী লীগের ঘরে; সরকারের সমর্থক থেকে পরিণত হলো সরকারের অংশে। দেশে একদল বাকশাল গঠন করা হলে সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী সিপিবি ও ন্যাপ নিজেদের দল বিলোপ করে এতে ঢুকে পড়লো। ন্যাপ-সিপিবি বাকশালে বিলুপ্তির ফলে— বিশেষত ন্যাপ-সিপিবির জাতীয়তাবাদ বিরোধী আন্তর্জাতিকতাবাদের রাজনীতি, সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সাথে এদের পার্টি-টু-পার্টি সম্পর্ক ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর নির্দেশ পালনকারী বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির সাথে এদের সম্পর্ক বিবেচনায়— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনে হতেই পারে যে বাংলাদেশ বুঝি জোট নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে গিয়ে সোভিয়েত ব্লকে ঢুকে গেল। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অগত্যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হলেও, বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিতে পারেনি কখনোই; বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি কখনোই।
কোমিতেত গোসুদার্স্তভেন্নয় বেজোপাসনস্তিবা কেজিবি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বেসামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। কেজিবি’র পক্ষত্যাগী সাবেক আর্কাইভ কর্মকর্তা ভাসিলি মিত্রোখিন ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্রিস্টোফার এন্ড্রু কেজিবির নথিপত্রের ভিত্তিতে রচনা করেন ‘দি মিত্রোখিন আর্কাইভ: দি কেজিবি অ্যান্ড দি ওয়ার্ল্ড’ নামের গ্রবেষণাগ্রন্থ। ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-সিক্সের তদারকিতে ২০০৫ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর এটা পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত হয়। দি মিত্রোখিন আর্কাইভ, বাংলাদেশে পরিচালিত আরও কিছু গবেষণাকর্ম এবং ন্যাপ-সিপিবি’র নেতাদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে দৈনিক প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান ২০০৬ সালের মার্চ মাসে নিজ পত্রিকায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ও কেজিবির নীতিগত ও আর্থিক সহায়তা বিষয়ে একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
এ প্রতিবেদনে বলা হয় যে ১৯৭৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরো কেজিবিকে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে নির্দেশ দেয়। কেজিবি আওয়ামী লীগ ও এর মিত্র সিপিবি-ন্যাপ-এর নির্বাচনী প্রচারণায় তহবিলের যোগান দেয়। দি মিত্রোখিন আর্কাইভ জানায় ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে কেজিবি মিশনের আনুষ্ঠানিক বাজেট ছিল ৫২ হাজার ৯০০ রুবল। কেজিবি একটি দৈনিক পত্রিকা ও একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে দৈনিক পত্রিকাটিকে ছাপাখানা কেনার জন্য ৩ লাখ রুবলের সমপরিমাণ অর্থ দেয়। বইটির এক ফুটনোটে লেখা হয়েছে যে বাকশালে একীভূত আওয়ামী লীগকেও কেজিবি গোপনে তহবিলের যোগান দিয়েছে। অবশ্য আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতা তোফায়েল আহমেদ বিদেশী অর্থ নেয়ার বিষয়টিকে নাকচ করে দিয়েছেন; কিন্তু ন্যাপ-সিপিবি তা করেনি।
ন্যাপ-এর সাবেক নেতা মোনায়েম সরকার জানিয়েছেন যে সোভিয়েত সহায়তায় ১৯৭২-১৯৭৫ সময়কালে ন্যাপ পরিচালিত সমাজতন্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ৭ হাজার ৭০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সিপিবি সূত্র থেকে মিজানুর রহমান খান জানান যে আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক তাদেরকে দেয়া অর্থের পরিমাণ হয় সর্বোচ্চ বার্ষিক প্রায় ৫০ হাজার ডলার। ন্যাপও সিপিবির মতো অনেকটা সমপরিমাণ অর্থ পেত; সিপিবি-ন্যাপ-এর সাথে যুক্ত অন্যান্য গণসংগঠনও আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তা পেত। অন্যান্য সহায়তার মধ্যে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে ছাত্র পাঠানো, প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণ ইত্যাদি। সিপিবির এ বছরভিত্তিক তহবিল দলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ বিশেষভাবে নিজস্ব এখতিয়ারে দেখভাল করতেন। সিপিবির সাবেক নেতা অজয় রায়ও একই তথ্য প্রকাশ করে বলেন, ‘দলীয় তহবিলের হাঁড়ির খবর একমাত্র জানতেন দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মোহাম্মদ ফরহাদ। দলীয় সিদ্ধান্ত যৌথভাবে গৃহীত হলেও তহবিল ব্যবস্থাপনা কিন্তু যৌথ নেতৃত্বাধীন ছিল না।’ ১৯৮৭ সালে মোহাম্মদ ফরহাদের মৃত্যুর পর থেকে ১৯৯১ সালে সিপিবি বিভক্ত হওয়ার সময় পর্যন্ত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কেজিবিপ্রদত্ত সে অর্থ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৯৭২ সালে কেজিবির আবাসিক মিশন ঢাকা রেসিডেন্সি ‘মুজিবের সচিবালয়ের একজন উর্ধতন সদস্য, দুজন মন্ত্রি ও দুজন ঊর্ধতন গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে [তাদের এজেন্ট হিসেবে] নিয়োগ’ করে। এটা আরও জানায়, ১৯৭৫ সালে ‘সন্দেহাতীতভাবে মস্কোর উৎসাহে’ শেখ মুজিব বাংলাদেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। দি মিত্রোখিন আর্কাইভ-এর মতো অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামানের স্বতন্ত্র একটি গবেষণাও তা বলে। সোভিয়েত ইউনিয়নের নাম উল্লেখ না করে নিজের একটি বইয়ে তিনি বলেন যে ‘দেশটির ঢাকাস্থ দূতাবাস’ ১৯৭৪ সালের নভেম্বর থেকে মস্কোপন্থী দলগুলোর নেতৃত্বে সংসদীয় গণতন্ত্র বাতিল করে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার কথা বলছিল; আওয়ামী লীগের দুজন বড় নেতাকে তারা একদল বাকশাল গঠন করতে প্রভাবিত করেছিল। [আগামী কাল পঞ্চম পর্ব]
-

অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ: পর্ব ৩
জিয়াউল হক মুক্তা
[জিয়াউল হক মুক্তা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এ রচনায় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্যের সাথে যোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিচার-আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও কিছু সাক্ষ্যভাষ্য এবং বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রি প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিজনদের কিছু বক্তব্য; এবং বর্তমান লেখকের গবেষণালব্ধ কিছু পর্যবেক্ষণ। সবশেষে প্রধানমন্ত্রির সদয় বিবেচনা ও সকলের আলোচনার জন্য যোগ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা সত্যানুসন্ধান কমিশন’ বিষয়ক কিছু বিষয়গত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা। পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় লেখাটি ১৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আজ প্রকাশিত হচ্ছে তৃতীয় পর্ব।][বৃহস্পতিবারের পর]
এখানে বলে রাখা যাক যে ঔপনিবেশিক আমলের সেনা কর্মকর্তাগণ দেশ স্বাধীন হবার আগেই তাড়াহুড়া করে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর গঠন করেন ঔপনিবেশিক ভাবধারার ও কাঠামোর অনুরূপ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যাতে যুদ্ধ পরবর্তীকালে তারা একটি সংগঠিত শক্তি হিসেবে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে চাপে রাখতে পারেন; গেরিলা যুদ্ধ বা জনযুদ্ধের কৌশল যাতে কম অনুসৃত হয় এবং গেরিলা যুদ্ধ বা জনযুদ্ধের জনসম্পৃক্ততার প্রভাব যাতে ঔপনিবেশিক নিয়ম-নীতির প্রথাগত সেনা কাঠামোর ওপর না পরে; জনযুদ্ধের গেরিলাদের যাতে সেনাবাহিনীতে আত্মীকৃত করা না হয়; বিপ্লবী গণবাহিনীর গঠন যাতে ঠেকানো যায়। পরবর্তীকালের ইতিহাস বলে যে এই সেনা অফিসারগণ আওয়ামী লীগের মধ্যকার প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে মিলেমিশে সম্মিলিতভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছেন যা এ রচনায় পরে আলোচনা করা হবে এবং সেনাবাহিনীতে ক্যু আর পাল্টা ক্যু-তে উন্মত্ত থেকেছেন।২০০২ সালের ১৫ আগস্ট “আজকের কাগজের” তৎকালীন প্রতিনিধি জাহিদ রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর সাক্ষাৎকার নেন। এ সাক্ষাৎকারে তিনি বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে না যাবার জন্য শাফায়াত জামিলকে দোষী করেন; ঢাকার পথে ট্যাংক মুভ করা বিষয়ে ‘আসলে ইন্টেলিজেন্সের লোকও বুঝতে পারেনি আর্টিলারি কোথায় যাচ্ছে’ বলে তিনি তাদের রক্ষা করতে চাচ্ছেন যেখানে তিন/চার দিন আগে থেকেই এমনকি স্বাধীনতা-বিরোধী লোকজনও জেনে গিয়েছেন যে ‘দু’চার দিনের মধ্যেই খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে দেশে রক্তের গঙ্গা বয়ে যাবে’। মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ কি আসলে সেনা গোয়েন্দাদের রক্ষা করতে চাচ্ছেন? নাকি নিজেকে? প্রসঙ্গত বলে রাখা যাক যে এ রচনায় পরে জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশারফ ও শাফায়াত জামিলরাও যে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত থাকতে পারেন সে তথ্য ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হবে।
অধ্যায় ছয়. ইন অ্যান্ড আউট
১৯৬২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ছাত্রলীগের ভেতরে-বাইরে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ গঠন করেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ বা ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’। শিক্ষা ও গণতন্ত্রের সকল আন্দোলনকে তাঁরা জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের দিকে পরিচালিত করেন। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণার আগে তাঁরা পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে দেশব্যাপী প্রচার আন্দোলন গড়ে তোলেন, বিশেষভাবে ১৯৬৫ সালে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করলে তাঁরা সাথে সাথে এটাকে বাঙালির মুক্তির সনদ বিবেচনা করে ঝাঁপিয়ে পড়েন সর্বস্বত্যাগী মরণপণ সংগ্রামে। ‘ছয় দফা না হলে এক দফা’র ‘স্বাধীনতার আন্দোলন’ গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ গঠন করেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জেতানোর জন্য সারা দেশে সুপরিকল্পিত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধা দেন। ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনি চালু করেন। জাতীয় পতাকা তৈরি করেন। জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বিজয়ী হন।
স্বাধীন দেশে বিএলএফ/মুজিববাহিনী-র ৪ প্রধানের ৪ সুপারিশ আর ছাত্র-যুব সমাজের ১৫ দফা ও ১২দফা সুপারিশ বঙ্গবন্ধু গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে না পারায় ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াস পন্থীদের প্রায় সকলে, মুজিববাহিনী/বিএলএফ-এর আশি ভাগ সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় শতভাগ মুক্তিযোদ্ধার দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত জাসদ শুরু থেকেই সরকারের ও সরকারি দলের দমন-পীড়ন-নির্যাতন-নিপীড়ন-সন্ত্রাস-গুম-খুনের শিকার হতে থাকে।
অন্যদিকে, ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির আদেশে দালাল আইন প্রণীত হয় । এর অধীনে প্রচুর প্রকৃত দালালকে যেমন আটক করা হয়েছিল তেমনি দালাল নন এমন আরও অনেককে জাগতিক লেনদেন-দখল-প্রেম-পূর্বশত্রুতা-প্রতিহিংসা ইত্যাদি কারণেও আটক হতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞগণ বলেন যে এ আদেশের আওতায় সারা দেশে বিভিন্ন সময় কমবেশি ৭৫,০০০ লোক আটক হয়েছিল; আটকের পাশাপাশি তারা মুক্তিও পেয়ে যাচ্ছিল; দুটো প্রক্রিয়া একই সাথে চলছিল; এদের মধ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী শ্রেণির ব্যক্তিরা ছাড়া পাচ্ছিল দ্রুততর সময়ে। পুলিশ-প্রশাসক-বিচারকরাও প্রায় সবাই যেহেতু পুরো যুদ্ধের সময় ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে এ আদেশের অধীনে আটকদের নিয়মিতভাবে পুলিশি-প্রশাসনিক ও দলীয় আয়োজনে ছেড়ে দেয়া হতে থাকে; পাশাপাশি মূলত চারটি পর্বে আটককৃতদের সরকার কর্তৃক মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৭২ সালের ৩ অক্টোবর পর্যন্ত তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্যে ৪১,৮০০ জনকে এ আদেশবলে আটক করা হয়েছিল; মোট ২,৮৪৮ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছিল; এবং তাদের মধ্যে ৭৫২ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। পরে এ আদেশের আওতায় আটক থাকা ৯০%-এর জন্য (৩৬,৪০০ জনের জন্য) ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দি জেনারেল অ্যামনেস্টি অর্ডার ঘোষণা করে তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন যে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিকান্ডের দায়ে অভিযুক্ত ৪,০০০ জনের জন্য সে সাধারণ ক্ষমা প্রযোজ্য ছিল না; কেবল দালালিরই ক্ষমা ছিল। এ বিষয়ে অত্যন্ত বিস্তারিত আলোচনা আছে মিরিয়াম ব্রেইংমেইয়ার-এর সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল ইন বাংলাদেশ: ক্রিটিক্যাল অ্যাপ্রাইজাল অব লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অ্যান্ড জুরিসপ্রুডেন্স-এ। ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসের নিয়মিত প্রকাশনাতেও এসব তথ্য রয়েছে।
গণহত্যার সহায়তাকারী হাজার হাজার দালাল পঙ্গপালের মতো কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলেন সগৌরবে। আর কারাগারের সে শূন্যস্থান পূরণ করতে লাগলেন জাসদ নেতাকর্মীগণ! উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় পর্যন্ত কারাগারে যে হাজার হাজার রাজবন্দি ছিলেন, তাদের প্রায় সকলেই ছিলেন জাসদের কেন্দ্র থেকে প্রান্তের নেতাকর্মী।
হায়! হে সময়! হে দিন ও রাত্রি! হে আকাশ-বাতাস-জলাধার! হে বৃক্ষ ও বিহঙ্গ! হে জন ও স্বজন! হে ইতিহাস! হে আগামীর প্রজন্ম তোমরা জেনে রেখো স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘকাল ধরে মেধা-শ্রম-ঘাম-রক্তত্যাগী মহান জাতীয় বীরদের ঠাঁই হলো স্বাধীন দেশের কারাগারে আর সাথে সাথে স্বাধীনতার শত্রু ও গণহত্যার দোসররা কারামুক্ত হয়ে উপভোগ করতে লাগলো বাংলার সময়, দিন ও রাত্রি, আকাশ-বাতাস-জলাধার, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ, জন ও স্বজন, আর ইতিহাস। হায়! কারবালা প্রান্তর থেকে প্রজন্মান্তরে বিশ্বব্যাপ্ত বুক-চাপড়ানো রক্তাক্ত মাতম ‘হায় হাসান হায় হোসেন’ যেন এর কাছে ধূলিকণা!
কারামুক্তির আগে ও পরে আর কারাগারে ও কারাগারের বাইরে আর দেশের ভেতরে ও দেশের বাইরে দালালরা বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা রাখতে লাগলো; বাংলাদেশের সরকারও সমাজ আর সংস্কৃতি আর রাষ্ট্রের ধর্মীয়করণ করছিল। তা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোনা । কেউ চ্যালেঞ্জ করলে তা আলোচনা করা যাবে; প্রয়োজনে বর্তমান সময় পর্যন্ত একেবারে সংসদীয় আলোচনার সূত্র ধরে।
অধ্যায় সাত. অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু নিঃসঙ্গ আর নিঃসঙ্গ জাসদ যেন সংশপ্তক
জামাত-সংঘ, মুসলিম লীগ, শান্তি কমিটি ও রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী তখনও কারাগারে এবং এদের অনেকে সাংগঠনিক হিজরতে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে চিল্লায় বা লুকিয়ে কোথাও; আর পরে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেদের সংগঠিতকরণেও মনযোগী; কোথাও কোথাও ওয়াজ মাহফিলের নামে গর্ত থেকে মুখ বের করে নিজেদের পুনরুত্থানের জানান দিচ্ছে। এদের নেতৃস্থানীয়রা পাকিস্তান-মধ্যপ্রাচ্য-ইংল্যান্ড-আমেরিকায় অবস্থান করে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণায় ব্যস্ত। কিন্তু তখনও এরা বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাতের স্পর্ধা দেখায়নি; যদিও পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনের সম্ভাব্যতার কথা বলছিল বিভিন্ন মুসলিম-প্রধান দেশে।
এ দিকে [১] ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগে শেখ ফজলুল হক মনির অনুসারীগণ, [২] খন্দকার মোশতাক আহমাদের অনুসারীগণ, [৩] জনপ্রশাসনে পাকিস্তান পন্থার অনুসারীগণ, [৪] গোয়েন্দা বিভাগে পাকিস্তান পন্থার অনুসারীগণ, [৫] আধা-সামরিক ও সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরে পাকিস্তান পন্থার অনুসারীগণ, আর [৬] বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্ষমতালিপ্সু সামরিক কর্মকর্তাগণ পরিপূর্ণভাবে ঘিরে রেখেছেন বঙ্গবন্ধুকে; আর [৭] রাজনৈতিক পরিমুলে জাসদের বিরোধীতা করার মিশন নিয়ে একদম শুরু থেকে কোন ক্রিটিক্যাল এনগেজমেন্টের বদলে সরকার-প্রশাসন-দলের ন্যায্য-অন্যায্য সকল কাজে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে যেতে থাকলো ন্যাপ-সিপিবি। ধীরে ধীরে শতভাগ অবরুদ্ধ হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু।
মুক্তিযোদ্ধাদের ৮০% জাসদ করলেও আওয়ামী লীগে যে ভালো লোকজন ছিলেন না তা নয়; অনেক ভালো লোক ছিলেন। কিন্তু দাপটে ছিলেন কলুষিত লোকজন। এ সময় সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র কায়েম তো দূরের কথা, ১৯৭২ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর নিজের কথিত ‘চাটার দল’ ও ‘চোরের দল’ ও ‘নরপশুর দল’ সূচিত দুর্নীতি-লুটপাট-মজুদদারি-চোরাকারবারি-কালোবাজারির থাবায় বিপর্যস্ত হলো দেশ। দলানুগ প্রশাসন এদের সহায়তা করলো। বর্তমান সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কিছু ইউটিউব প্লাটফর্ম আছে; এগুলোর একটিতে আপলোড করা বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণের শ্রুতিলিখন দেখা যাক; তিনি বলছেন, “আপনারা ভালো কইরে কাজ করেন। ঘুষ খাওয়াডা বন্ধ করেন। দুর্নীতি বন্ধ করেন। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতিতে ভরে গেছে। আমি আচ্চায্য হয়ে যাই এত কষ্ট কইরে, এত ভিক্ষা কইরা প্রায় তিনশ, তিনশ নয় কোটি টাকা আমরা সাহায্য পেয়েছি। দুনিয়া থেকে তিনশ নয় কোটি টাকা সাহায্য, একশ ষোল [এখানে বক্তব্য একটু জড়ানো] কোটি টাকা আমি লোন কইরা আনছি, যা দিয়ে বাংলার মানুষকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছি। এক আনার বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের হাতে আমরা পাই নাই। সাত কোটি লোকের জন্য কোত্থেকে আমি দেব? যা ভিক্ষা কইরা আনি তাও চাটার গোষ্ঠি চাইটা খাইয়া ফেলায় দেয়, আমার গরিব পায় না। এত চোরের চোর, চোর কোত্থেকে যে পয়দা হয়েছে আমি জানি না। পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে, কিন্তু এই চোরটুক থুইয়া গেছে আমার কাছে, এই চোর নিয়া গেলে আমি বাঁচতাম। কিছু দালাল গেছে, এখন চোর গেলে বাঁচা যাবে।” গভীর দুঃখে, প্রতীকীভাবে, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সাড়ে সাত কোটি কম্বল আনলাম, আমার কম্বল কই?
১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও চাল-গম-চিনির দাম বেড়ে যায় এবং দেশের ভেতর ভোক্তার মূল্য সূচক (পড়হংঁসবৎ ঢ়ৎরপব রহফবী) বেড়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতির ফলে নি¤œ আয়ের কৃষক-শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় তাদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায়। ধানের ফলন বেশি হয়; কিন্তু বন্যায় পাটের ফলন ক্ষতিগ্রস্থ হলে কৃষক নগদ আয় থেকে বঞ্চিত হয় এবং তার ঋণাত্মক প্রভাব পড়ে আমন চাষে। মানুষের মনে অভাবের শংকা বেড়ে যায়; শংকার সাথে যুক্ত হয় স্পেকুলেটিভ (ংঢ়বপঁষধঃরাব) বাজার-আচরণ। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে বিশ্ব বাজার থেকে বাড়তি দামে খাদ্য আমদানি ব্যাহত হয়; দেশের ঋণযোগ্যতা (পৎবফরঃড়িৎঃযরহবংং) অত্যন্ত কম থাকায় স্বল্প মেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণের আওতায় সম্পাদিত খাদ্য আমদানি চুক্তির কয়েকটি বাতিল হয়ে যায়। উপরন্তু আমেরিকান প্রশাসন পিএল-৪৮০ কর্মসূচির খাদ্য সরবরাহ বিভিন্ন অজুহাতে প্রায় নয় মাস ঝুলিয়ে রাখে এবং শেষদিকে কিউবার সাথে পাটের ব্যাগের ব্যবসা করার দায়ে খাদ্য সরবরাহ চুক্তি বাতিল করে দেয়। এরকম জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু-কথিত চাটার দলের আর চোরের দলের আর নরপশুর দলের দুর্নীতি-লুটপাট-কালোবাজারি-মজুদদারি-চোরাকারবারি আর সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-দুঃশাসনে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয় এবং তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেশে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের পেছনে অ্যকাডেমিশিয়ানগণ অনেক কারণ উপস্থাপন [যেগুলো উপরে বলা হয়েছে] করতে পারেন এবং সেসবের কিছু সত্যও বটে, কিন্তু এ দুর্ভিক্ষ যে কেবল খাদ্য-শস্যের অভাবে হয়েছে এমনটা বলা যাবে না বঙ্গবন্ধু সচেতন ছিলেন তবুও দুর্ভিক্ষ হয়েছে, এবং প্রধানত তা হয়েছে গুড-গভর্ন্যান্সের অভাবে; এটা জাসদের কথা না. এসআর ওসমানী, ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর [পরে আওয়ামী লীগ নেতা] ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন এসব বলেছেন। বন্যার ত্রাণ ও দুর্ভিক্ষকালে প্রতিদিন ৪৪ লক্ষ লোককে খাওয়াতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক চালুকৃত ৫,৭০০ লঙ্গরখানার জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্য-শস্যেরও লুটপাট হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু তা নিজ মুখেই বলেছেন; একদম শুরু থেকে রেডক্রসের সহায়তা কার্যক্রমও লুটপাটের মুখে পড়ে; নি¤œবিত্তদের রেশনেও লুটপাট হয়েছে। ফলে সরকারী হিসেবে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে ২৬,০০০ থেকে ৩৭,০০০ বাঙালির মৃত্যু হয়; যদিও পরবর্তীকালের আওয়ামী লীগ নেতা ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের সহায়তায় নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনের হিসেবে সংখ্যাটি ভিন্ন। [আগামী কাল চতুর্থ পর্ব]
-

অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ: পর্ব ২
জিয়াউল হক মুক্তা
[জিয়াউল হক মুক্তা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এ রচনায় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্যের সাথে যোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিচার-আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও কিছু সাক্ষ্যভাষ্য এবং বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রি প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিজনদের কিছু বক্তব্য; এবং বর্তমান লেখকের গবেষণালব্ধ কিছু পর্যবেক্ষণ। সবশেষে প্রধানমন্ত্রির সদয় বিবেচনা ও সকলের আলোচনার জন্য যোগ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা সত্যানুসন্ধান কমিশন’ বিষয়ক কিছু বিষয়গত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা। পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় লেখাটি ১৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আজ প্রকাশিত হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব।][গতকালের পর] আগাচৌ বলেন, “মনি চান, তার প্রতি এখন যারা ব্যক্তিগত আনুগত্য দেখাচ্ছেন, তারা এককালে মোনায়েম খাঁর এনএসএফ বা জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের গুণ্ডা হোক বা প্রাক্তন রাজাকার আলবদর হোক, তাদের নিয়ে তিনি গ্রুপ গঠন করবেন। অন্যদিকে যারা নীতিগতভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেকুলারিজম, সোস্যালিজমে বিশ্বাসী কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগ বা যুবলীগের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে না, তাদের জাতীয় জীবনের ক্ষেত্রে পাত্তা দেয়া হবে না। এই নীতির সর্বনাশা দিক হলো, ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগে তখন আইয়ুব খাঁ-মোনায়েম খাঁর আমলের সুবিধাবাদী দল ভোল পাল্টিয়ে এসে আসর জাঁকিয়ে বসছিল। আর আওয়ামী লীগের যারা প্রকৃত কর্মী ৃ তারা ক্রমশই পিছনে হটে যাচ্ছিলেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা ছাত্রলীগের কিছু নেতা ও নেতৃস্থানীয় কর্মীও এই সুবিধাভোগী ও রাতারাতি বড়লোক হওয়ার দুর্নীতিময় পথে পা বাড়াননি, তা নয়। ৃ আর সংখ্যাগরিষ্ঠ যে অংশের দুর্নীতি ও সমাজবিরোধী কাজের জন্য বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে এত দুর্নাম কুড়াতে হয়েছে, তারা কেউ দুর্দিনে বা সংগ্রামের দিনে আওয়ামী লীগের বন্ধু বা সমর্থক ছিলেন না। ৃ শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব হ্রাস পাচ্ছিল এবং নেপথ্যে থেকে শক্তি সঞ্চয় করছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমাদের সমর্থক তরুণ প্রতিমন্ত্রিদের গ্রুপটি। এদের মধ্যে আছেন ফরিদপুরের কেএম ওবায়দুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাহের উদ্দিন ঠাকুর, বরিশালের নূরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রমুখ।” বলা নিষ্প্রয়োজন, শেখ মনিও রেহাই পাননি, তার ক্ষমতালিপ্সা তার প্রাণও কেড়ে নিয়েছে; কেএম ওবায়দুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও বরিশালের নূরুল ইসলাম মঞ্জুরদের উত্থান ঘটেছিল খুনি মোশতাক-মেজরদের হাত ধরে।
বলে রাখা ভালো যে ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কুখ্যাত ‘সেভেন মার্ডার’-এর কথা বলা হয়েছে, তার জন্য আইনের চোখে প্রধানত দায়ী ছিলেন আওয়ামী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান ও তার অনুসারীগণ; এজন্য তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল; পরে জিয়ার আমলে তিনি ক্ষমা পান। সে সময় শফিউল আলম প্রধান রাজ্জাক-তোফায়েল উপ-উপদলের অংশ ছিলেন। আওয়ামী রাজনীতিতে সে সময় বঙ্গবন্ধুর পর যাদের দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল, তারা হলেন শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদ দেখতেন পুরো প্রশাসন ও রক্ষীবাহিনী; আব্দুর রাজ্জাকের নিয়ন্ত্রণে ছিল আওয়ামী লীগের তরুণ নেতৃত্ব পুরোটা ও আওয়ামী ছাত্রলীগের অধিকাংশ; আর শেখ মনির নিয়ন্ত্রণে ছিল যুবলীগের পুরোটা, শ্রমিক লীগের আধাটা ও ছাত্রলীগের সামান্য অংশ। তোফায়েল আহমেদ যেহেতু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন, তাই তার ও আব্দুর রাজ্জাকের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লালিত শফিউল আলম প্রধানের অনুসারীদের কৃত সেভেন মার্ডারের সাথে প্রধানমন্ত্রির কার্যালয় জড়িত— এমন একটা ভ্রান্ত ধারণা বঙ্গবন্ধুর ইমেজের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর হয়ে ওঠেছিল; যদিও ক্ষমতার জন্য তাদের সকলের উপ-উপদলীয় কোন্দলের একটা রাজনৈতিক আবরণ ছিল যে তারা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য আবস্থান নিয়েছিলেন।
অধ্যায় তিন. জনপ্রশাসন আওয়ামী রাজনীতির ওই দুই উপদল— বঙ্গবন্ধু সরকারকে বাধ্য করলো ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের একদিন আগে ও বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় গৃহীত একটি সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে— যে সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়া বেসামরিক প্রশাসনের আমলাদের স্ক্রিনিং করার কথা বলা হয়েছিল। পরে এদের দালাল আইনে বিচার করার কথাও ওঠেছিল; কিন্তু তাও কখনও হয়নি। সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিস্টোরেশন কমিটির ৪ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখের প্রতিবেদন অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রাদেশিক প্রশাসন কাঠামোকে বাংলাদেশের জাতীয় প্রশাসন কাঠামোয় রূপান্তর করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যে আমলারা পাকিস্তানের হয়ে কাজ করছিলেন, তাদের নেতৃত্বে চলতে শুরু করলো স্বাধীন বাংলাদেশের জনপ্রশাসন; পরে এদের সাথে যোগ দেন পাকিস্তান ফেরত আমলারা, যাদের অনেকেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর স্বেচ্ছায় পাকিস্তানে বদলি নিয়েছিলেন। সরকার গঠিত অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যান্ড সার্ভিসেস রিঅর্গানাইজেশন কমিটি বা এএসআরসি ও ন্যাশনাল পে কমিশন বা এনপিসি কর্তৃক পেশকৃত প্রগতিশীল জনপ্রশাসন প্রতিষ্ঠার সুপারিশমালা লুকিয়ে ফেলা হলো। পাকিস্তানপন্থার দৌরাত্ম্য কায়েম হলো জনপ্রশাসনে। এসবের বিস্তারিত রয়েছে বাংলাপিডিয়ায় এটিএম ওবায়দুল্লাহ-র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফর্মস নিবন্ধে ও ইন্টারনেটে সহজলভ্য কিছু পিএইচডি অভিসন্দর্ভে।
মুজিব বাহিনী নেতৃত্বের ৪ দফা, ছাত্র-যুব-তরুণদের ১৫ দফা ও ১২ দফা, এএসআরসি ও এনপিসি না মেনে পুরোনো ব্যবস্থা বহাল রাখার ফলে, “বাংলার দুর্ভাগ্য আইনানুগ উত্তরাধিকারীর [অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের] বদলে [স্বাধীন দেশে] সর্বস্তরের নেতৃত্ব এসেছে তাদেরই হাতে যারা প্রাক বিপ্লব যুগে ছিলেন ক্ষমতার উৎস। প্রশাসন যন্ত্র সেই পুরোনো ব্যক্তিরাই চালান। বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তারাই। যে সামরিক অফিসার পাকিস্তানীদের সৈন্যদের সাথে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য ছিলেন সচেষ্ট, তিনি আজ আরও উচ্চপদে সমাসীন। যে পুলিশ অফিসার দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে সোপর্দ করেছে পাকিস্তানীদের হাতে, তিনি আবার মুক্তিযোদ্ধাদের নামে হুলিয়া বের করতে ব্যস্ত। যে আমলারা রাতদিন খেটে তৈরি করেছে রাজাকার বাহিনী, তারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চাকরি দিয়ে দয়া প্রদর্শনের অধিকারী। যে শিক্ষক দেশের ডাকে সাড়া দিতে পারেনি, তিনিই আজ তরুণদের শিক্ষা দেয়ার বাহানা করছেন।” কথাগুলো বলেছেন শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম তাঁর ‘মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে’ প্রবন্ধে।
পরের অনুচ্ছেদে তিনি আরও বলেছেন, “পরিকল্পনা বিভাগের যে কর্মীকে শোষণের পরিকল্পনা করা শেখানো হয়েছে বছরের পর বছর ধরে, তিনিই এখন সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পরিকল্পনা তৈরি করেন। যুদ্ধ চলাকালে যারা পাকিস্তানীদের হয়ে প্রচারণায় মত্ত ছিলেন, ১৬ ডিসেম্বরের পর তারাই ভোল পাল্টিয়ে সংস্কৃতির মধ্যমণি হয়েছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর প্রত্যেক দেশে করা হয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধকে যারা সাহায্য করেনি তারা স্থান পেয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে।সেখানে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদেরকে আত্মশুদ্ধির সুযোগ দেয়া হয়েছে, যাতে করে তারা বিপ্লবী জনতার অংশ হতে পারে। নিতান্তই পরিতাপের বিষয়, যাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে থেকে আত্মশুদ্ধি করার কথা, সকলের অগোচরে তারা সর্বস্তরের নেতৃত্বের আসন দখল করে বসেছে।”
অধ্যায় চার. গোয়েন্দা সংস্থা বঙ্গবন্ধু হত্যা ও কর্নেল তাহের হত্যা বিষয়ে ১৯৭৫ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফস্যুলৎসের ১৯৭৯ সালে জেড বুকস প্রকাশিত বই ‘বাংলাদেশ: দি আনফিনিশড রেভ্যুলুশন’-এর প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণিত কিছু তথ্য দেখা যাক। তৃতীয় বিশ্বে আমেরিকার সাহায্য কর্মসূচির একটি ছিল অফিস অফ পাবলিক সেফটি: এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বা ওপিএসএইড। এ কর্মসূচির একটা অংশ ছিল মাঝারি ও উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের আমেরিকায় প্রশিক্ষণ প্রদান। প্রশিক্ষণ দেয়া হতো ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অ্যাকাডেমি বা আইপিএ ও ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ সার্ভিসেস স্কুল বা ইনপোলসে থেকে। ওপিএস শুরু থেকেই সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ-র সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল; আর ইনপোলসে ছিল সরাসরি সিআইএ’র মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে এ কর্মসূচির আওতায় প্রায় ৪০ জন বাঙালি কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ পান। এরা সবাই পাকিস্তান জাতীয়তাবাদের কট্টর সমর্থক ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর দালালদের পাইকারিভাবে ক্ষমা করে দেয়ার ফলে এদের মধ্যকার রাঘব বোয়ালরা লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান।
পরে ১৯৭৪ সালে বন্যাপরবর্তী দুর্ভিক্ষ, গণবিক্ষোভ ও জাসদ দমনের জন্য সরকারের প্রয়োজন হয়ে ওঠে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা ব্যক্তিত্বের। আওয়ামী লীগ সরকার তখন এদের পুনর্বাসন শুরু করে। এদের মধ্যে বিশেষ কয়েকজনের দিকে একটু নজর দেয়া যাক। ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খানের সময়কার ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো বা আইবি-র সহকারী-পরিচালক ও পরে উপ-পরিচালক এবিএস সফদারকে নিয়োগ দেয়া হয় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা দলে। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে এবিএস সফদার বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহঅভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফাইল ও ডোঁশিয়ে তৈরির কাজ করতেন এবং প্রতিদিন নিজ হাতে বিচারকদের জন্য ব্রিফকেস নিয়ে আদালতে যেতেন। সফদারের সহপাঠি ও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর পরিচালক আবদুর রহিমকে নিয়োগ দেয়া হয় রাষ্ট্রপতির সচিব হিসেবে; এর আগে কোন পুলিশ কর্মকর্তা এভাবে পূর্ণসচিবের মর্যাদা ভোগ করেননি, এমনকি পাকিস্তান আমলেও নয়। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এরা দুজন ওয়াশিংটনে আইপিএ-তে ছিলেন। মার্চে যুদ্ধ শুরু হলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিগণ ও পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশের পক্ষ নেন; কিন্তু সফদার ও রহিম তা করেননি। তাদেরকে পাকিস্তান সরকার ডেকে পাঠালে ইউএস পাবলিক সেফটি প্রোগ্রাম ইন পাকিস্তান-এর প্রধান যোশেফ কার পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর পরিচালক এনএ রিজভির সাথে কথা বলে এদের প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখেন। প্রশিক্ষণ শেষে এরা নিজ ইচ্ছায় সরাসরি ঢাকা আসেন এবং ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড কাউন্টার ইনসার্জেন্সি কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এদের সাথে সাথে আওয়ামী লীগ সরকার পাকিস্তান পুলিশ কর্মকর্তা সৈয়দ আমীর খসরুকে নিয়োগ দেয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব পদে। পাকিস্তানের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্য এবং আমেরিকার ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই ও ইনপোলসে-তে প্রশিক্ষিত এমএন হুদাকেও নিয়োগ দেয়া হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা যাক যে এরা কেউ বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করেননি; খুনিদের সহায়তাই করেছেন; বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের সরকার কর্তৃক এদের আরও উচ্চতর পদায়ন ও ক্ষমতায়ন তার ইঙ্গিত দেয়।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে মিজানুর রহমান চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর এককালের রাজনৈতিক সহকর্মী; বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর একসময় তিনি আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনেও ভূমিকা রাখেন। ২০০২ সালের ১৩ আগস্ট আজকের কাগজের প্রতিবেদক জাহিদ রহমানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান যে বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন/চার দিন আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী মাওলানা মান্নান— যিনি পরে দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক হয়েছিলেন— তার বাসায় এসে সাবেক সিএসপি আব্দুর রব চৌধুরীর বরাত দিয়ে তাকে ‘একটা গোপন কথা’ জানান। গোপন কথাটি হলো— ‘দু’চার দিনের মধ্যেই খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে দেশে রক্তের গঙ্গা বয়ে যাবে’। এখানে বিষয় হলো খন্দকার মোশতাক ও সেনাবাহিনীর খুনিদের বাইরে এমনকি স্বাধীনতা বিরোধীরাও যখন বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন/চার দিন আগে থেকে হত্যা-পরিকল্পনাটি জানতেন— যা আসলে প্রণীত হয়েছিল আরও ছয় মাস আগে— সেখানে গোয়েন্দা বিভাগ এ তথ্য জানতো না এমনটি বিশ্বাসযাগ্য নয়। গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তাগণ অবশ্যই এ পরিকল্পনার অংশ ছিলেন। প্রসঙ্গত লরেন্স লিফস্যুলৎসের ‘বাংলাদেশ: দি আনফিনিশড রেভ্যুলুশন’ থেকে একটি চমৎকার অংশ দেখা যাক— লিফস্যুলৎস কথা বলছিলেন এনএসআই-এর কর্মকর্তা এমএন হুদার সাথে— ÒWhen asked whether the N.S.I. had been incompetent in discovering the conspiracy to kill Mujib or whether it was true the N.S.I. itself had been involved, Huda laughed and said the question was a very, very clever one. But he would not answer.প্রয়োজন নেই।
অধ্যায় পাঁচ. সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর এখানে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের ক্যুদেতার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও সংগঠক মেজর নাসির উদ্দিনের ‘গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী’ এবং ‘বাংলাদেশ: বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর’ বই দুটো থেকে সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরে ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের দালালদের পুনর্বাসনের দিকটি দেখা যাক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় পাকিস্তানের এক নম্বর সামরিক আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কেএম রহমানকে স্বাধীনতার পর দায়িত্ব দেয়া হয় সেনাবাহিনীর সরবরাহ ব্যবস্থার প্রধানের পদে। রাজাকার বাহিনীর উপপ্রধান লে. কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিনকে দেয়া হয় রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের পদ। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্টে চাকুরিরত থেকে বাঙালিদের হত্যাকারী— বিশেষত তেলিয়াপাড়া, মনতলা ও আখাউড়া এলাকায় যার গোলায় শহীদ হয়েছেন শত শত শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা— সেই ক্যাপ্টেন হাকিমকে দেয়া হয় সেনা-পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব। সেনা পুলিশে আরও নিয়োগ দেয়া হয় পাকিস্তানের অর্ডিন্যান্স কোরের কর্মকর্তা লে. আল ফরিদ ও লে. মোদাব্বেরকে; এরা ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সেনা বাহিনীকে সহযোগিতা করেছেন। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সেনা কর্মকর্তাদের বসানোর পাশাপাশি ভয়াবহতম যে কাজটি করা হয় তা হচ্ছে— প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিজিএফআই প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয় এয়ার কমোডর আমিনুল ইসলামকে। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি বাঙালি হয়েও বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স বা আইএসআইয়ের পরিচালক ছিলেন। এভাবে ক্রমে সেনা বাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সর্বত্রই কায়েম হয় পাকিস্তানপন্থী অফিসারদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ। [আগামী কাল তৃতীয় পর্ব] -

অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ: পর্ব ১
জিয়াউল হক মুক্তা
[জিয়াউল হক মুক্তা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এ রচনায় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্যের সাথে যোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিচার-আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও কিছু সাক্ষ্যভাষ্য এবং বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রি প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিজনদের কিছু বক্তব্য; এবং বর্তমান লেখকের গবেষণালব্ধ কিছু পর্যবেক্ষণ। সবশেষে প্রধানমন্ত্রির সদয় বিবেচনা ও সকলের আলোচনার জন্য যোগ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা সত্যানুসন্ধান কমিশন’ বিষয়ক কিছু বিষয়গত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা। পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় লেখাটি ১৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আজ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম পর্ব।]
অধ্যায় এক. ত্রিচক্রযান
[১] ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পাটি অফ বাংলাদেশ বা সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের সাবেকদের মধ্যে আত্মশ্লাঘা-জর্জরিত পরাজিতদের প্রতিভূ, আর [২] ছাত্রলীগে ও বহু-মত-পথের দল আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা প্রথমে স্বাধীনতার বদলে কেবল স্বায়ত্তশাসনে সন্তুষ্ট ছিলেন, পরে ১৯৬৯-১৯৭০ সালে স্বাধীনতার পক্ষে আসেন কিন্তু সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন, আরও পরে ১৯৭০-১৯৭১-এ স্বাধীনতা-সমাজতন্ত্র মেনে নিলেও স্বাধীনতার পর ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে পশ্চাদপদ অবস্থান নিয়েছেন এবং স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনে কোন বৈপ্লবিক পন্থা না নিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছেন, আর [৩] যারা পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের ফেডারেশন-কনফেডারেশনের স্বপ্নবিভোর খুনি খন্দকার মোশতাক আহমাদের দক্ষিণপন্থার প্রেতাত্মা— তারা সবাই সমস্বরে— গভীর-নিশিথে ধূর্ত শেয়ালের দল যেমন সমস্বরে হুক্কাহুয়া করে ওঠে— তেমনভাবে জাসদের বিরুদ্ধে উৎসবে-আনন্দে-কোরাসে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন বছরের দুটো সময়— ১৫ আগস্ট ও ৭ নভেম্বরের আগে-পরে। এদের উৎসবে-আনন্দে-কোরাসে কখনও কখনও অতিথি হিসেবে যোগ দেন জামাত-জঙ্গি-বিএনপি-তেঁতুল ও জাতীয় পার্টির লোকজন। এ দুটো মওসুমে তারা জাসদ-সমালোচনার মধ্য দিয়ে এক বিকৃত আনন্দলাভ করেন। বলে রাখা ভালো যে উল্লিখিত দ্বিতীয় ধারার নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি ও তৃতীয় ধারার নেতা ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমাদ; এঁদের বিষয়ে পরে আরও কথা হবে।বাংলাদেশের লেখক ও সাংবাদিকদের একটা নগণ্য অংশ ন্যাপ-সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আগত; এবং এরাই, এদের লেখালেখি ও বক্তব্যের মধ্য দিয়ে— যতোটা না আওয়ামী লীগ ও অপরাপর দলের ব্যক্তিবর্গ জাসদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন— তার চেয়ে বেশি উগ্র ও উন্মত্ত হয়ে ওঠেন জাসদের বিরুদ্ধে। ন্যাপ-সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের এসব সাবেক নেতা-কর্মীগণ অতীতে বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মেনে নিতে পারেননি, ছয় দফা মেনে নিতে পারেননি, বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিতে পারেননি; এবং এর ফলে এদেরকে বিশ্বাস করা হতো না বলে ১৯৭১ সালের সুমহান মুক্তিযুদ্ধে এরা অনানুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণের অধিকারও পাননি। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে ভূরাজনীতিগত কারণে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ৯ আগস্ট মৈত্রিচুক্তি স্বাক্ষরের পর যুদ্ধের শেষদিকে এসে এদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ছাড় দেয়া হয়। সংখ্যায় অতি নগণ্য এরা হলেন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে গণপ্রত্যাখ্যান থেকে বাঁচানোর জন্য ‘দায়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা’— পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কল্পিত বিপ্লব না হাতছাড়া হয়ে যায়— সে ভয়ে।
এদের আগের আমলনামাও একই সাক্ষ্য দেয়। ব্রিটিশ শাসনামলেও এরা সমাজতান্ত্রিক-আন্তর্জাতিকতার নাম করে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রগতিশীল বণকৌশলের সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান ঔপনিবেশিক আমলে এদের যে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি— সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির যে স্বকল্পিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তজাত জমিদারি— ১৯৬২ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও আওয়ামী লীগের স্বাধীনতাপন্থী-সমাজতন্ত্রী ছাত্র-যুব-নেতৃত্ব এবং ১৯৭২ সাল থেকে ওই স্বাধীনতাপন্থী-সমাজতন্ত্রী ছাত্র যুবসমাজ কর্তৃক গঠিত জাসদ— তা তছনছ করে দেয়। আর তাই যে কোন সুযোগে জাসদের প্রতি এরা প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে ওঠেন; প্রয়োজনে নদীর রচনা লিখতে গিয়ে— যেহেতু শুধু গরুর রচনাই মুখস্ত আছে— নদীর তীরে গরুকে ঠেলে দিয়ে নদীর রচনার নামে সে গরুর রচনা উগলে দেন। এসবের ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে।
ব্রিটিশ আমলে তাদের যে রাজনৈতিক দীনতা ও পরাজয়— সময়ানুসারে দূরে বলে তারা তা মোটামুটি কাটিয়ে ওঠেছেন। তবে পাকিস্তান আমলের পরাজয়ের ধারায় স্বাধীন বাংলাদেশেও তাদের একাধিক রাজনৈতিক পরাজয় আছে জাসদের কাছে— এদের মধ্যে কেবল একটি হলো এ যে— ১৯৮৩ সালে সূচিত সামরিক স্বৈরশাসন-বিরোধী গণআন্দোলনের সময় ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ থেকে ন্যাপ-সিপিবি ও আওয়ামী লীগ হেঁটেছিল সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পরিবর্তে আপোষের পথে, ১৫ দলের আন্দোলন পরিত্যাগ করে করে তারা জান্তার নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন ১৯৮৬ সালের ৭ মে; কিন্তু দুবছরের কম সময়ের মধ্যে ফিরে আসতে হয়েছিল রাজপথে— জাসদের গণঅভ্যুত্থানমূলক রাজনীতির লাইনে। ১৯৯০ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসন অবসানের মধ্য দিয়ে আদর্শিকভাবে জিতেছিল জাসদ। সিপিবি’র রণকৌশল কখনও জেতেনি। এ রকম বারবার রণকৌশলগত পরাজয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মনোবিকলনজাত আত্মশ্লাঘা জর্জরিত ন্যাপ-সিপিবির সাবেকদের প্রতিভূরা যে প্রতিনিয়ত জাসদের বিরুদ্ধে বলতেই থাকবেন— এ আর নতুন কী!
অধ্যায় দুই. দ্বিচক্রযান: উপদল ও উপ-উপদল
বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে যারা তাঁকে প্রেরিত-পুরুষের আসনে বসিয়ে স্তুতিগান বা বন্দনা করেন— তারা প্রকারান্তরে তাঁর সারাজীবনের ধারাবাহিক সংগ্রামকে অস্বীকার করেন। একটি মিশনে প্রেরিত পুরুষের নিজের অবদান থাকে কম, ঈশ্বরের ইচ্ছায় ও ঈশ্বরের সহায়তায় তাঁরা হাঁটেন ঈশ্বর-নির্দিষ্ট পথে। কিন্তু মানুষকে তার পথ তৈরি করে নিতে হয়, এবং সেজন্যই মানুষ হয়ে ওঠেন কথিত প্রেরিত পুরুষের চেয়েও মহান— জিতে যাওয়া বা হেরে যাওয়া নির্বশেষে। বাংলার মানুষের প্রতি সুগভীর ভালোবাসা থেকে রাজনীতি-আন্দোলন-সংগঠন গড়ে তুলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু নীতি-নিষ্ঠা-মেধা-কৌশল-শৃঙ্খলা-দক্ষতা-অভিজ্ঞতা-জ্ঞান-প্রজ্ঞার সুষম প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। বাঙালি জাতির সংগ্রামের পথে পথে হেঁটে গোপালগঞ্জের খোকা-তিনি গড়ে ওঠেছেন ধীরে ধীরে; তিনি নিজেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বক্তব্যে বলেছেন যে বাঙালির সাথে তাঁর সম্পর্ক ‘ইমোশনাল’ বা আবেগপ্রবণ [তিনি কোনোদিন কল্পনা করতে পারেননি যে বাঙালির কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারে]; বাঙালি জাতির জাতীয়তাবোধের প্রতি যে আনুগত্য তিনি প্রদর্শন করেছেন, বাঙালি জাতি তাঁকে তা ফিরিয়ে দিয়েছে বহুগুণে— তিনি অভিহিত ও অভিষিক্ত হয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জাতির জনক’ অভিধায়।১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরপরই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের পূর্ববর্ণিত ওই দুই রাজনৈতিক উপদল— যথাক্রমে শেখ মনির নেতৃত্বাধীন অংশ ও মোতাশতাকের নেতৃত্বাধীন অংশ— দ্রুত তাঁর চারপাশে এক কঠিন দেয়াল তুলে দেয় যাতে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-জাতীয়তাবাদের অনুসারী প্রগতিশীল ছাত্র-যুব সমাজ তাঁর কাছে ঘেঁষতে না পারেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ— একাত্তরের অক্টোবরে যা মুজিব বাহিনী নাম গ্রহণ করে— পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধুর নিজের নির্বাচিত চার যুবনেতা— সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ— তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তাঁকে ৪ দফা সুপারিশ প্রদান করেছিলেন, আর তার ক’দিন পর জানুয়ারির শেষ দিকে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-জাতীয়তাবাদের অনুসারী প্রগতিশীল ছাত্র-তরুণ-যুব সমাজের পক্ষ থেকে সিরাজুল আলম খান তাঁকে ১৫ দফা সুপারিশ প্রদান করেছিলেন। পরে আবারও ছাত্র-তরুণ-যুবকদের পক্ষে আসম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ ও শরীফ নূরুল আম্বিয়া ১৯৭২ সালের ২৫ মে এক বিবৃতিতে— বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে যা সকল দেশে হয়ে থাকে, সেভাবে— তাঁর প্রতি “জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সকল ক্ষমতার উৎস বলে ঘোষণা করতে হবে”সহ ১২ দফা সুপারিশ গ্রহণের আহ্বান জানান। এ আহ্বানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য-প্রবল অবস্থান নিলেন এ রচনার শুরুতে বর্ণিত তিন পক্ষ [পরে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে]। এদের প্রকাশ্য-প্রবল বিরোধীতার মুখে— ১৯৭২ সালের ৭ জুন ছাত্রলীগের প্রকাশনার মাধ্যমে সকল পক্ষকে এসব না মানার বিপদ সম্পর্কে অবহিত করা হলেও— বঙ্গবন্ধু সেসব সুপারিশের কিছুই গ্রহণ করতে পারলেন না। শামসুদ্দিন পেয়ারার ‘আমি সিরাজুল আলম খান: একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য’, ও মনিরুল ইসলামের [মার্শাল মনি’র] ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র’ ও ১৯৭২ সালের ৭ জুন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ প্রকাশিত পুস্তিকা ‘৭ই জুন’ এবং অপরাপর ঐতিহাসিক দলিল, প্রকাশনা ও তৎকালীন পত্রপত্রিকা এর সাক্ষ্য দেয়।
আওয়ামী রাজনীতির বর্ণিত দুই অভ্যন্তরীণ উপদল আর বহিঃশক্তি ন্যাপ-সিপিবির প্রকাশ্য-প্রবল বিরোধীতার ফলে বঙ্গবন্ধুর সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হলো তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী ও বিশ্বাসভাজন এবং এক দশক ধরে পরিচালিত স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা নেতা-কর্মীদের আশি ভাগের; পরিণতিতে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ [এ রচনায় এ বিষয়ে পরে আরও আলোচনা করা হবে]। তবে আপাতত কেবল এ বলে রাখা যাক যে জাসদকে প্রতিবিপ্লবী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে জাসদের উপর রাজনৈতিক দমন-পীড়ন পরিচালনায় শেখ মনি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত যুবলীগের নৃশংস ভুমিকা ছিল— নৃশংসতা ছিল তার সাধারণ কর্মপদ্ধতি। জাসদের প্রথম আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রহমত আলীকে প্রথম দিনই তুলে নিয়ে নির্যাতন করে পদত্যাগ পত্র লিখিয়ে নিয়েছিলেন শেখ মনি নিজে। ১৯৭৩ সালের ৪ জানুয়ারি তার অনুসারীরা শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে হামলা করেন, যাকে সামনে পান তাকে পেটান, ছাত্রলীগ সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়ার হাত ভেঙে দেন ও সাধারণ সম্পাদক আফম মাহবুবুল হকের মাথা ফাটিয়ে দেন। এক মাস তারা হাসপাতালে ছিলেন। শেখ মনি নিজেকে বিপ্লবী ভাবতেন; সেজন্য সে সময়ের অপরাপর সংগঠনের সাধারন অনুশীলনের বাইরে গিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আদলে সর্বময় ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে যুবলীগে চেয়ারম্যান পদ তৈরি করে তার চেয়ারম্যান হন। যদিও স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বিপ্লবী ধারার তেমন কেউ যুবলীগে যোগ দেননি; বরং কাজী ফিরোজ রশীদ চৌধুরী টাইপের এলিমেন্টের আধিক্য ছিল যুবলীগে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল গঠনের পর সিপিবি-ন্যাপ তাকে সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী বানাতে সমর্থ হয়েছিল।
জাসদ গঠন হয়ে যাবার পরও, আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতির অভ্যন্তরে শেখ মনির ক্ষমতালিপ্সা আবারও উপ-উপদলীয় কোন্দল তৈরি করলো, তারা সরিয়ে দিল তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতৃত্ব; আর তা শেষবিচারে শক্তিশালী করলো মোশতাকের উপদলকে। রচনার এ অংশে শেখ ফজলুল হক মনি বনাম আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বাধীন উপ-উপদল সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ রাজনীতির একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক, সমর্থক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরীর [আগাচৗ] লেখার তথ্যসূত্রে।
বঙ্গবন্ধু যখনই দেশের বাইরে থাকেন, এই উপ-উপদলীয় কোন্দল সশস্ত্র রূপ পায়; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩-এ খুন হলেন তিনজন আর ১৯৭৪-এর এপ্রিলে সূর্যসেন হল ও মহসিন হলে সংঘটিত হলো কুখ্যাত ‘সেভেন মার্ডার’; এ বিষয়ে আগাচৌ বলছেন, “তাহলে কি তাঁর [বঙ্গবন্ধুর] আমলাতন্ত্র, থানা, পুলিশ, সেনাবাহিনী কোন কিছুই কাজ করছে না? নাকি ভিতরের অথবা বাইরের উস্কানীতে তারা নিষ্ক্রিয়?” ১৯৭৪ সালের ৩০ মার্চ আওয়ামী ছাত্রলীগের এক সভা থেকে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে— গাজী গোলাম মোস্তফা ও অন্যান্যদের নামে— দুর্নীতির অভিযোগ এনে তাদের বিচার দাবি করা হয়; দুনীর্তিবাজদের প্রতি শেখ মনির আশ্রয়-প্রশ্রয়-পক্ষপাতিত্বের আভিযোগ ওঠে; এদিনই শেখ মনি বলেন যে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ঝগড়ায় তার কোন হাত নেই। অভিযোগ ছিল শ্রমিক লীগে উপদলীয় কোন্দলের পর ছাত্রলীগেও শেখ মনি এই দ্বন্দ্ব সম্প্রসারিত করেছিলেন এবং ছাত্রলীগ ভেঙে আরেকটি ছাত্রলীগ করতে চেয়েছিলেন। এদিন রাতে হোটেল পূর্বাণীতে আগাচৌ ও শেখ মনির আলোচনায় আগাচৌ ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বদলে ‘দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক পন্থা ও পদ্ধতির উন্মুক্ত থাকা প্রয়োজন’— এ কথা বললে শেখ মনি বিরক্ত হয়ে বলেন যে ‘সকল সময় তত্ত্ব দিয়ে রাজনীতি চলে না’। আগাচৌ তাকে বলেন যে শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ হয়ে আওয়ামী লীগে এ দ্বন্দ্ব সম্প্রসারিত হলে তা শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকেই আঘাত করবে, এবং বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করলে সে সময় তারাও কেউ রেহাই পাবেন না। আগাচৌ তাকে বলেন, নীতিগত আনুগত্যের বদলে ব্যক্তি-আনুগত্য দিয়ে কোন কাজ হবে না। [আগামী কাল দ্বিতীয় পর্ব]
-

করোনা মুক্ত হলেন ‘বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় সমাজতন্ত্র’ এ গ্রন্থের লেখক মর্শাল মনি
মশাল ডেস্ক: মার্শাল মনি ১৯৬৯-৭০ মেয়াদে ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন। ছাত্রলীগের সদস্যদের দার্শনিক-আদর্শিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-সাংগঠনিক চেতনার উন্নতর পর্যায়ে টেনে তোলা এবং মাঠের আন্দোলন ও সংগঠনের কাজ হাতে কলমে তিনি অগ্রণী ভুমিকা পালন শেখানোর ক্ষেত্র তিনি অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রসর সংগঠক ও নেতা ছিলেন। সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত স্বাধীনতার নিউক্লিয়াসে চতুর্থ ব্যক্তি হিসাবে তাকে অন্তর্ভক্তি নিশ্চিত ছিল। কিন্তু অজানা কারণে তাকে নিউক্লিয়াসের সর্বোচ্চ ফোরামে অন্তর্ভুক্ত করা ন হলেও সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ তার মতামত ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না। তিনি ঢাকা ও জেলা পর্যায়ে নিউক্লিয়াসের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে মুজিববাহিনীর উত্তরাঞ্চল কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। কমান্ডার ছিলেন সিরাজুল আলম খান। স্বাধীনতা পতাকা তৈরি, স্বাধীনতার ইস্তেহার প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ছাত্রলীগের যে কেন্দ্রীয় বর্ধিত সভায় শহীদ স্বপন চৌধুরী উত্থাপিত স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রস্তাব গৃহীত হয় সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন মার্শাল মনি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে সাথে সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক চেতনার দ্বারা পরিপুষ্ট করতে তিনি অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন। তিনি ছাত্রলীগে সমাজতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটান। তিনি দৈনিক গণকন্ঠের সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জাসদ গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। তিনি বিপ্লবী গণবাহিনীর উত্তরাঞ্চলের পলিটিকাল কমিশার ছিলেন। তিনি সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে জাসদের বলিষ্ঠ ভুমিকা পালনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তিনি জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
মার্শাল মনি রাজনীতি ও দলে সার্বক্ষণিক সক্রিয় থাকা অবস্থাতেও প্রচারবিমুখ ছিলেন। একান্ত বাধ্য না হলে তিনি মঞ্চে উঠতেন না, ভাষণ দিতেন।
রাজনৈতিক সাংগঠনিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি পড়ালেখা ও জ্ঞান চর্চাকে গুরুত্ব দিতেন এবং সক্রিয় দলীয় রাজনীতি থেকে অবসর নেবার পরও তার জ্ঞান সাধনা অব্যাহত রয়েছে।
তিনি ‘বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় সমাজতন্ত্র’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ লিখেছেন। এই গ্রন্থে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর দার্শনিক-আদর্শিক-রাজনৈতিক অবস্থান, ছাত্রলীগ, জাসদ গঠণের ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও অনিবার্যতা আলোচনা করেছেন। এ ছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি পুস্তিকা, অসংখ্য প্রবন্ধ, কয়েকটি ছোট গল্প লিখেছেন।
মার্শাল মনি আত্মপ্রচার বিমুখ একজন জ্ঞান সাধক। -

স্থানীয় সরকারসহ উপনির্বাচনে অংশ নেবে বিএনপি
মশাল ডেস্ক: স্থানীয় সরকারসহ সব উপনির্বাচনের বিএনপির অংশ নেবে বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান।
মির্জা ফখরুল বলেন, গত দুটি উপনির্বাচনে (যশোর ও বগুড়া) যোগ দিয়ে পরবর্তীতে করোনার কারণে আমরা সরে দাঁড়িয়েছি। উপজেলা নির্বাচনসহ স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আমরা অংশগ্রহণ করবো সে সিদ্ধান্তই আছে। তিনি বলেন, আমরা ঢাকা-৫, ঢাকা-১৮, নওগাঁ-৫ ও সিরাজগঞ্জ-১ উপনির্বাচনে অংশ নেব। আগামী ১০ তারিখে নমিনেশন ফরম বিক্রি করা হবে। ১২ তারিখে পার্লামেন্টারি বোর্ড সাক্ষাৎকারে বসবে প্রার্থী চূড়ান্ত করার জন্য।
-

আওয়ামী লীগ দুই উপ-নির্বাচনে ঢাকায় কাজী মনু এবং নওগাঁয় হেলালকে মনোনয়ন দিয়েছে
দুই উপ–নির্বাচনে ঢাকায় হাবিবুর রহমান মোল্লার আসনে কাজী মনিরুল ইসলাম মনু এবং নওগাঁয় ইসরাফিল আলমের আসনে মো. আনোয়ার হোসেন হেলালকে মনোনয়ন দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সোমবার নিজের সরকারি বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা-৫ ও নওগাঁ-৬ আসনে দলীয় মনোনয়নের এই ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, গত ৩০ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে আওয়ামী লীগ সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায় দুই উপনির্বাচনের প্রার্থী চূড়ান্ত হয়।
“ঢাকা-৫ আসনে মনিরুল ইসলাম মনু ও নওগাঁ-৬ আসনে মো. আনোয়ার হোসেন হেলাল দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি।”
দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসা হাবিবুর রহমান মোল্লা গত ৬ মে মারা যান। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪৮, ৪৯ ও ৫০ নম্বর ওয়ার্ড এবং ডেমরা, দনিয়া, মাতুয়াইল ও সারুলিয়া ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার জন্য ফরম সংগ্রহ করেছিলেন ১৯জন। তাদের মধ্যে মনোনয়ন পাওয়া কাজী মনিরুল ইসলাম মনু রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
ষাটের দশকের শেষে তখনকার জগন্নাথ কলেজে পড়ার সময় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত হন মনু। ১৯৭১ সালে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে জিয়াউর রহমান বিএনপি প্রতিষ্ঠা করলে যাত্রাবাড়ি থানা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন মনু। ১৯৮১ সাল শেখ হাসিনা দেশে এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরলে মনুও দলে ফেরেন। ২০০৩ সালে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তাকে বৃহত্তর ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব দেন। সর্বশেষ ২০১৬ সাল থেকে যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন মনু।
গত ২৮ জুলাই সাংসদ ইসরাফিল আলমের মৃত্যুতে নওগাঁ-৬ (আত্রাই-রাণীনগর) আসনটি শূন্য হয়। এই আসনে ৩৩ জন নৌকার মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছিলেন। এ আসনে মনোনয়ন পাওয়া আনোয়ার হোসেন হেলাল রানীনগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। স্থানীয় রাজনীতিতে তিনি প্রয়াত সংসদ সদস্য ইস্রাফিল আলমের বিরোধী পক্ষের নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন হেলাল। পরে আওয়ামী লীগের সমর্থনে রানীনগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সর্বশেষ উপজেলা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পেয়েও তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হন। নির্বাচন কমিশনের ঘোসিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ১৭ অক্টোবর ঢাকা-৫ ও নওগাঁ-৬ আসনের উপ নির্বাচনে ভোট হবে ইভিএমে। আগ্রহী প্রার্থীরা ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন। ২০ সেপ্টেম্বর বাছাইয়ের পর ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা যাবে।
-
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের কমিটি অনুমোদন:ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রশিদ॥সম্পাদক শাহজাহান
সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুনসুর আহমেদ এবং সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ নজরুল ইসলাম সাতক্ষীরা সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের বিগত ৭ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে কাউন্সিল অধিবেশনে আংশিক কমিটি গঠনের পর মরহুম বীরমুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের সরদার ও শাহজাহান আলীর দাখিলকৃত কমিটি সাময়িক অনুমোদন দিয়েছেন।
উদ্ধর্তন সহ-সভাপতি শেখ আব্দুর রশিদ ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী, সহ-সভাপতি গোলাম মোরর্শেদ, আসাদুজ্জামান অছলে চেয়ারম্যান, সরদার নজরুল ইসলাম, কামরুল ইসলাম, আব্দুল কাদের, ফারুক হোসেন, অধ্যক্ষ ফজলুর রহমান মোশা, এড. স্যামুয়েল ফেরদৌস পলাশ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এনছান বাহার বুলবুল, মোস্তাফিজুর রহমান নাছিম ও গনেশ চন্দ্র মন্ডল, সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ শফিউদ্দীন, শেখ মনিরুল হোসেন মাছুম, প্রভাষক হাসান মাহমুদ রানা, আইন সম্পাদক এড. হাসান উল্লাহ, কৃষি ও সমবায় সম্পাদক মহসীন কবির পিন্টু, তথ্য গবেষণা সম্পাদক আব্দুল জলিল, ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ গোলাম মোস্তফা বাবু, দপ্তর সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক ক্বারী মিজানুর রহমান, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক শেখ মোনায়েম হোসেন, বন পরিবেশন সম্পাদক আমিনুর রহমান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক অধ্যক্ষ মিজানুর রহমান, মহিলা সম্পাদিকা এড. ইরানী, মুক্তিযোদ্ধা সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসানুল ইসলাম, যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক আব্দুল হান্নান, শিক্ষা ও মানব সম্পাদক প্রভাষক আফাজ উদ্দীন, শ্রম সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, সাংস্কৃতিক সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম, স্বাস্থ্য সম্পাদক ডাঃ আব্দুল হামিদ, সহ-দপ্তর সম্পাদক শাহীনুর রহমান, সহ-প্রচার সম্পাদক রহমত আলী, কোষাধ্যক্ষ জি এম আমীর হামজা, নির্বাহী সদস্যবৃন্দ আলহাজ¦ নজরুল ইসলাম, আলহাজ¦ এস এম শওকত হোসেন, বীরমুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম, আলহাজ¦ আসাদুজ্জামান বাবু, এড. আব্দুল লতিফ, ডাঃ মুনসুর আহমেদ, আশরাফুজ্জামান, স ম জালাল উদ্দীন, ডাঃ মহিয়ূর রহমান ময়ুর, রহেল উদ্দীন, হাবিবুর রহমান হবি, লুৎফর রহমান, বজলুর রহমান, রমজান আলী, এড. মোস্তাফিজুর রহমান শাহনেওয়াজ, শওকত আলী, ইউসুফ আলম, এস এম মোশারফ হোসেন, তাপস কুমার আচার্য্য, নুর ইসলাম মাগরেব, শামছুর রহমান, আবু বক্কর সিদ্দিক, অমরেন্দ্র নাথ ঘোষ, ওবায়দুর রহমান লাল্টু, মিজানুর রহমান বাবু সানা, ওবায়দুল ইসলাম মানি, মাস্টার মফিজুল ইসলাম, শাহীনুর ইসলাম শাহীন, আজহারুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম, লোকমান হোসেন, মোঃ ইশারুল, মশিয়ার রহমান ঈদুল, আছাদুজ্জামান ও প্রভাষক এম সুশান্ত।
-

করোনায় রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা, ঘাটতি প্রকাশিত হয়েছে-ইনু
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ‘করোনায় রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা, ঘাটতি প্রকাশিত হয়েছে। সংবিধান পর্যালোচনা করে রাষ্ট্র ও শাসন ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে।’ আজ বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শহীদ কর্নেল তাহের মিলনায়তনে জাতীয় যুব জোট কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি আয়োজিত আলোচনা সভায় মোবাইলে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।
ইনু বলেন, দুর্নীতি-লুটপাট-বৈষম্যে দেশের যুবসমাজের মেধার অপচয় হচ্ছে। সার্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্যনিরাপত্তা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আর পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এ সময় দুর্নীতি-লুটপাট-বৈষম্যের বিরুদ্ধে যুবসমাজকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি। জাসদের সহযোগী যুব সংগঠন জাতীয় যুব জোটের ১৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এ সভায় জাতীয় যুব জোটের সভাপতি রোকনুজ্জামান রোকনের সভাপতিত্বে এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ সামছুল ইসলাম সুমনের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য রাখেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম, জাতীয় শ্রমিক জোট-বাংলাদেশের সভাপতি সাইফুজ্জামান বাদশা ও সাধারণ সম্পাদক নইমুল আহসান জুয়েল, জাতীয় যুব জোটের সাধারণ সম্পাদক শরিফুল কবির স্বপন, যুবমৈত্রীর সভাপতি সাব্বাহ আলী খান কলিন্স, জাতীয় যুব জোটের সহ-সভাপতি কাজী সালমা সুলতানা ও হারুন অর রশিদ সুমনসহ আরও অনেকে।
-

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন
২০০২ সালের ৩০ আগস্ট সাতক্ষীরার কলারোয়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে হামলা মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগ সোমবার (৩১ আগস্ট) বেলা ১১টায় জেলা শহরের শহীদ আলাউদ্দিন চত্বরে এ কর্মসূচি পালন করে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা মুনসুর আহম্মেদের সভাপতিত্বে মানববন্ধনে বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ সাহিদ উদ্দিন, আইন-বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ওসমান গণি, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ শহাদাত হোসেন, দেবহাটা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনি প্রমুখ।
সাবেক দফতর সম্পাদক শেখ হারুন উর রশিদের পরিচালনায় মানববন্ধনে বক্তারা জানান, ২০০২ সালের ৩০ আগস্ট সকাল ১০টায় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা কলোরোয়া উপজেলার চন্দনপুর ইউনিয়নের হিজলি গ্রামের এক মুক্তিযোদ্ধার ধর্ষিতা স্ত্রীকে দেখতে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আসেন। সেখান থেকে যশোরে যাওয়ার পথে সকাল ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে কলারোয়া উপজেলা বিএনপি অফিসের সামনে বিএনপি ও যুবদলের নেতাকর্মীরা যাত্রীবাহী একটি বাস রাস্তার ওপর আড় করে গতি রোধ করে তার গাড়ি বহরে হামলা চালায়। জেলা বিএনপি’র সভাপতি ও তৎকালীন সংসদ সদস্য হাবিবুল ইসলাম হাবিব ও বিএনপি নেতা রঞ্জুর নির্দেশে ওই হামলা হয়। হামলায় তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রকৌশলী শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মতিন, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী সাথী ও সাংবাদিকসহ কমপক্ষে এক ডজন দলীয় নেতাকর্মী আহত হন।
তারা জানান, এ ঘটনায় কলারোয়া থানা মামলা না নেওয়ায় ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর কলারোয়া মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোসলেমউদ্দিন বাদী হয়ে যুবদল নেতা আশরাফ হোসেন, আব্দুল কাদের বাচ্চুসহ ২৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৭০-৭৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিলেও তৎকালীন কলারোয়ার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ২০০৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঘটনা মিথ্যা বলে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। পরে নারাজির আবেদন, জজ কোর্টে রিভিশন খারিজ হয়ে গেলে ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট বাদী এ আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনে আপির করেন। ২০১৩ সালের ১৮ জুলাই আপিল মঞ্জুর হয়। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়ে নতুন করে মামলার কার্যক্রম শুরুর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশে ২০১৪ সালের ১৫ অক্টোবর মামলাটি এজাহার হিসেবে গণ্য করা হয়।
নেতাকর্মীদের বক্তব্যে আরও জানা যায়, পরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কলারোয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক শফিকুর রহমান জেলা বিএনপি’র সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিবসহ ৫০ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তিনটি ভাগে ভাগ হয়ে (এসটিসি ২০৭/১৫, এসটিসি ২০৮/১৫ দু’টি ও টিআর-১৫১/১৫) মামলাটির বিচার চলতে থাকে। আসামি পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা তিনটির কার্যক্রম যথাক্রমে ২০১৭ সালের ৯ আগস্ট ও ২৩ আগস্ট হাইকোর্ট স্থগিত করেন। অবিলম্বে উচ্চ আদালতের দেওয়া মামলা তিনটির কার্যক্রমের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নিম্ন আদালতে বিচার কার্যক্রম শুরু করে দ্রুত নিষ্পত্তির আহ্বান জানান মানববন্ধনকারীরা।
-

সাধু সাবধান: হাসানুল হক ইনু কি ট্যাংকে উঠে উল্লাস করেছেন?
জিয়াউল হক মুক্তা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পর জাসদের বর্তমান সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি ট্যাংকের উপর ওঠে নেচে উল্লাস করেছিলেন— এ প্রচারণার শুরু হয়েছিল জামাত-শিবিরের ‘বাঁশেরকেল্লা’ নামের ফেইসবুক পেইজ থেকে; এজন্য বাঁশেরকেল্লা একটি ট্যাংকের উপর কালো শার্ট-প্যান্ট পরিহিত গোঁফওয়ালা একজন সৈনিকের ছবির মুখমণ্ডল গোল দাগ দিয়ে ফটোশপে একটি তীর চিহ্ন এঁকে তীরের পেছনে হাসানুল হক ইনুর বর্তমান সময়ের একটি ছবি যোগ করে বাজারে ছেড়েছিল; একই ছবির দ্বিতীয় ম্যানিপুলেশনে তীর চিহ্ন ছিল না— সৈনিকের মুখমণ্ডল গোল দাগ দিয়ে চিহ্নিত করে উপরের দিকে একটি বক্সে হাসানুল হক ইনুর বর্তমান সময়ের ছবি যোগ করা হয়েছে। বাঁশেরকেল্লার এ ফটোশপ-ম্যানুফ্যাকচার্ড বা ফটোশপ-ম্যানিপুলেটেড ছবি ও/বা বক্তব্য ব্যাপকভাবে প্রচার করেছিল শত্রুপক্ষের অনেক ইতর ও মিত্রপক্ষের অনেক আহাম্মকের দল। বিষয়টি আলোচনা করা যাক।
এক.
বাঁশেরকেল্লা প্রকাশিত ছবিটির প্রচারকারী গণশত্রুরা ও অন্যদিকে আহাম্মকেরা বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিষয়ে একটি বিকৃত অথচ শক্তিশালী রাজনৈতিক মত তৈরি ও প্রকাশ করে চলেছে এখনও পর্যন্ত— আর তা হলো, বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর দেশে উল্লাস হয়েছিল। কিন্তু আদতে তা নয়; হত্যাকাণ্ডের পর দেশে ছিল থমথমে ভাব; সামরিক আইন জারি ছিল; কারফিউ জারি ছিল; জনগণ নিজ গৃহে অবরুদ্ধ ছিলেন; জনগণের কোন সংগঠিত প্রতিবাদ হয়নি সত্য, কিন্তু জনগণ তাতে উল্লাসও করেননি। জাতীয়-আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় এরকম কোন উল্লাসের খবর বা ছবিও কোনোদিন প্রকাশিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু-হত্যার মধ্য দিয়ে কোন ধরনের ভীতি তৈরি ও প্রচার করা হয়েছিল তা মেজর ডালিমের বেতার-বক্তব্যে খুব পরিষ্কারভাবে শোনা যায়; বর্তমানে ইউটিউবে সহজলভ্য অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ এ বক্তব্যের এক অংশে ডালিম বলছেন, “বাংলাদেশ পুলিশ, বিডিআর ও রক্ষীবাহিনীর সিপাহী ভাইগণ, আপনারা সবাই সেনা বাহিনীর সঙ্গে যোগদান ও সহযোগিতা করুন। যাহারা অসহযোগিতা করিবেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে তাহাদের চরম দণ্ড দেওয়া হইবে।” অপরাপর বাহিনীগুলোকে সেনা বাহিনীর দেয়া এ হুমকি সাধারণ নাগরিকদের মনে কী প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে তা খুব সহজেই অনুমেয়।দুই.
খুনি মেজর রশীদ-ফারুকরা ট্যাংক নিয়ে বেরিয়েছিল রাতে; বাঁশেরকেল্লা প্রকাশিত-প্রচারিত ফটোশপ-ম্যানিপুলেটেড ছবিটি দিনের বেলার।তিন.
১৫ আগস্ট থেকে ট্যাংকগুলোর অবস্থান ছিল ঢাকার চারটি স্থানে— বঙ্গভবন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পুলিশ কন্ট্রোল রুম, শাহবাগে বাংলাদেশ বেতার ও শের-ই-বাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীর সদর দপ্তরে। এ চারটি অবস্থানের বাইরে সেদিন বা সমকালে ঢাকায় ট্যাংকের আর কোন মুভমেন্ট হয়নি।চার.
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল কায়েমের পর থেকে জাসদ ছিল নিষিদ্ধ ও গোপন দল; আর ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ থেকে জাসদের শীর্ষনেতৃবৃন্দ ছিলেন কারাগারে অন্তরীণ। কাজী আরেফ আহমেদ, মনিরুল ইসলাম [মার্শাল মনি], হাসানুল হক ইনু প্রমুখগণ ছিলেন আত্মগোপনে। ক্যুদেতার পর ১৫ আগস্ট ভোরে বেতার ভাষণে রাজনৈতিক কার্যক্রম ও রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আরোপিত পূর্বতন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়নি বা জাসদকেও প্রকাশ্য করা হয়নি। আত্মগোপনে থাকা জাসদের কারো পক্ষে প্রকাশ্যে আনন্দ-উল্লাস করার কোন প্রশ্ন আসেনা।পাঁচ.
আত্মগোপনে থাকা কাজী আরেফ আহমেদ, মনিরুল ইসলাম [মার্শাল মনি], হাসানুল হক ইনু ও অন্যরা ১৬ আগস্ট বৈঠকে ব্যস্ত থাকেন ও মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেন; মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারপত্র তৈরি করেন।ছয়.
১৯৭৫ থেকে পরবর্তী প্রায় ৩৫/৪০ বছর পর্যন্ত আর বাঁশেরকেল্লার ফটোশপ-ম্যানিপুলেটেড ছবি প্রকাশ পর্যন্ত কোথাও কোনোদিন কারো কোন কথায়-লেখায়-ছবিতে বা পত্রপত্রিকায় এমন কিছু প্রচারিত হয়নি যে জাসদ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর উল্লাস করেছে বা হাসানুল হক ইনু বা জাসদের অন্য কোন নেতা-কর্মী উল্লাস করেছেন।সাত.
বঙ্গবন্ধু-হত্যার পর তাঁর নিজের দলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ক্ষমতাবান সমস্ত লোকজন মোশতাকের সাথে ছিলেন; আর মাওলানা ভাসানী, হাজি মোহাম্মদ দানেশ ও আতাউর রহমান খান মোশতাককে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন; ন্যাপের মহিউদ্দিন আহমেদ মোশতাকের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন গিয়েছিলেন। জাসদ বা জাসদের কারান্তরীণ নেতৃবৃন্দ বা হাসানুল হক ইনু মোশতাককে অভিনন্দন জানাননি; সমর্থন করেননি।আট.
খন্দকার মোশতাকের ৮৩ দিনের শাসনকালে— আওয়ামী লীগ ও বাকশাল সরকার কর্তৃক আটককৃত হাজার হাজার জাসদ নেতা-কর্মীর একজনও কারাগার থেকে মুক্তি পাননি; বরং মোশতাক বিরোধী অবস্থান নেয়ায় সারাদেশে জাসদের শতাধিক নেতা-কর্মী শহীদ হন ও সহস্রাধিক নেতা-কর্মী নতুন করে কারান্তরীণ হন।নয়.
১৯৭৫ সাল থেকে ২০২০ সাল— এ ৪৫ বছরে প্রকাশিত জাসদের অভ্যন্তরীণ বা উন্মুক্ত কোন দলীয় সাহিত্যে বঙ্গবন্ধু-হত্যাকে সমর্থন জানানো হয়নি বা এ ঘটনার পক্ষ নেয়া হয়নি বা মোশতাক সরকারের ৮৩ দিনের কোন কার্যক্রমকে সমর্থন জানানো হয়নি; বরং মোশতাক সরকারের বিরোধীতার প্রমাণ আছে ভুরি ভুরি।দশ.
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে হাসানুল ইনু জাতীয় কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বিপ্লবী গণবাহিনীর রাজনৈতিক কমিসার ছিলেন। একজন জননেতার যে ট্যাংকের উপর ওঠে উল্লাস করা সাজে না তা হাসানুল হক ইনু জানতেন। শত্রুদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত দোদুল্যমান মিত্ররা এসব বিশ্বাস করার মতো কাণ্ডজ্ঞানহীনতা ও বালখিল্যতা প্রদর্শন করলে তাদের প্রতি করুণাবর্ষণ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।এগারো.
১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জাসদ আওয়ামী লীগ ও বাকশালের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করেছে; কিন্তু রাজনৈতিক সংগ্রামের বিপরীতে ১৯৭৫ সালে ও পরবর্তীতে সামরিক শাসনের আবির্ভাব হলে জাসদ সকল সময় সামরিক শাসকদের বিরোধীতা করেছে। জাসদ ও আওয়ামী লীগ পরস্পরের ব্যাপারে গভীরভাবে খোঁজ খবর নিয়েই সামরিক শাসন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ রাজনীতি করেছে— জিয়ার সামরিক শাসনামলে গঠন করেছে ১০ দলীয় ঐক্যজোট, এরশাদের সামরিক শাসনামলে গঠন করেছে ১৫ দল ও খালেদা জিয়ার আমলে গঠন করেছে ১৪ দল। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে জাসদের সংশ্লিষ্টতার কণা-পরিমাণ প্রমাণ থাকলে এ ঐক্য হতো না।বারো.
২০০১ সাল থেকে জাসদের বিরতিহীন প্রচেষ্টার ফলে ২০০৪ সালে গঠিত হয় ১৪ দল; কুখ্যাত ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও এ ঐক্য বহাল থাকে; ২০০৯ সালে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ১৪ দল ও মহাজোট সরকার গঠন করে। নির্বাচনের আগে-পরে ও সরকারে থেকে বিএনপি-জামাত-জঙ্গির বিরুদ্ধে জাসদের অনমনীয় ও দৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের ফলে— মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে বিভক্ত করার লক্ষ্যে, আওয়ামী লীগ ও জাসদের ঐক্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যে— বাঁশেরকেল্লা যে ফটোশপ-ম্যানিপুলেটেড ছবি ও কাহিনী তৈরি করে— ডান-বাম নির্বিশেষে জাসদ-বিরোধীগণ ও আওয়ামী লীগের আহাম্মকগণ সে ছবি ও গল্প বিশ্বাস ও প্রচার করেন।তের.
ডান-বাম নির্বিশেষে জাসদ-বিরোধীদের কথা না হয় বাদ দেয়া গেল, আওয়ামী লীগের আহাম্মকরাও যখন এ বিষয়ে শেখ হাসিনার মনযোগ আকর্ষণ করেন, তখন তা থেকে মনে হয় এ যেন মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি, যেন শেখ হাসিনার চেয়েও তারা বঙ্গবন্ধুর খাঁটি অনুসারী; এভাবে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেন; আহাম্মকেরা মনে করেন দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের প্রধান শেখ হাসিনার চেয়েও তারা পাওয়ার-পলিটিক্সের ইকুয়েশন ভালো বোঝেন।চৌদ্দ.
আহাম্মকের দলের আচরণ থেকে মনে হয় যে তারা জাসদ ও আওয়ামী লীগের ঐক্য মানতে পারছেন না; মনে হয় যে জাসদ ও বিএনপি মধ্যে ঐক্য হলে যেন এরা খুশি হতেন।পনের.
আহাম্মকের দল ভুলে যান যে ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত টিকে থাকা সামরিক স্বৈরশাসনের অবসানের পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ একবারের জন্যও এককভাবে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যেতে পারেনি। ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ছিলো তারা ক্ষমতায় যাবে; কিন্তু তা হয়নি; বিএনপি ক্ষমতায় গিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হলেও সরকার গঠনের মতো সংখ্যাধিক্য ছিলোনা; জাসদের সমর্থনেই সরকার গঠন করতে হয়েছিল। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগ শিক্ষা না নেয়ায় ২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় আসে জামাত-বিএনপির চার দল। ২০০১ সাল থেকে জাসদের নিরলস প্রয়াসে ২০০৪ সালে প্রথমে জাসদ ও আওয়ামী লীগ ঐক্য করে ও পরে ১৪ দল ও মহাজোট গঠন করে; এ ঐক্যের ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে পারে। এ ঐক্য গত ১২ বছর ধরে দেশ-জনতা-অর্থনীতি-রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনছে।ষোল.
শত্রুপক্ষের ইতরগণ ও মিত্রপক্ষের আহাম্মকগণ বলে থাকেন যে আওয়ামী লীগ দয়া করে জাসদকে এমপি ও মন্ত্রি দিয়েছিল। বলে থাকেন যে আওয়ামী লীগের ঘাড়ে পা দিয়ে জাসদ থেকে এমপি-মন্ত্রি হয়েছেন। না, তা নয়; বরং জাসদসহ ১৪ দলের ঘাড়ে পা দিয়েই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। জাসদ থেকে মন্ত্রি-এমপি হওয়া কারো বা কোন দলের দয়া নয়; এ ছিল জাসদ ও আওয়ামী লীগ ও অপরাপর দলের ২৩ দফাভিত্তিক রাজনৈতিক চুক্তির অংশ— একসাথে আন্দোলন, একসাথে নির্বাচন ও একসাথে সরকার গঠনের চুক্তির দায়বদ্ধতা। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে প্রথমে জাসদকে মন্ত্রি পরিষদে নেয়া হয়নি, পরে অবশ্য বিবিধ কারণে নেয়া হয়েছে; যে আয়োজন শুরু থেকেই অনুসৃত হওয়া উচিত ছিল। এবং তা এখনও অনুসৃত হওয়া উচিত।সতের.
২০০৯ সালের কথা না হয় বাদ দেয়া গেল। কিন্তু ২০১৪ সাল ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতৃত্বে ১৪ দল ও মহাজোটের নির্বাচন হলো কেন? আওয়ামী লীগ জোট ভেঙে দিল না কেন? একা নির্বাচন করলো না কেন? কারণ এখনও এ ঐক্যের প্রয়োজন আছে এবং নিকট ভবিষ্যতেও তার প্রয়োজন আছে।বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রী প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা যথেষ্ট প্রজ্ঞাবান। তিনি জানেন কী করতে হবে। টোকাইদের পরামর্শে তিনি চলেন না। সুতরাং— জামাত-বিএনপি-জঙ্গি-তেঁতুলরা জাসদ ও আওয়ামী লীগের ঐক্য ভাঙার জন্য যতোই উস্কানী দিন না কেন, সে উস্কানীতে জাতীয় পার্টির কেউ কেউ যতোই হাউ কাউ করুন না কেন, ন্যাপ-সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের সাবেকগণ বঙ্গবন্ধু-প্রেমিক সেজে যতোই চোথা লিখুন না কেন, আর আওয়ামী লীগের আহাম্মকগণ যতোই শক্রুদের ফাঁদে পা দিয়ে গাঁড়লগিরি করুন না কেন— ঐক্য বহাল থাকবে। আহাম্মকদের কথায় কর্ণপাত করেননি শেখ হাসিনা বা হাসানুল হক ইনু; বরং একবার এ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠলে শেখ হাসিনা তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদককে ডেকে এসব অহেতুক ও অর্থহীন বিতর্ক বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। জাসদ নেতা-কর্মীগণও দলের সভাপতির নির্দেশে এগুলো নিয়ে সম্মুখসমরে লড়াই করেননি। বাঁশেরকেল্লার ষড়যন্ত্র কোন কাজে আসবে না; ক্ষমতায় একবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আর একবার মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি— অপরাজনীতির এ মিউজিক্যাল-চেয়ার খেলা তছনছ করে দিতে হবে। জাসদ আশা করে সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় জামাত-বিএনপি-জঙ্গি-তেঁতুলদের রাজনীতি থেকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠাতে হবে, এবং পাশাপাশি, বঙ্গবন্ধু কথিত ‘চাটার দল, চোরের দল ও নরপশুর দল’-এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে দেশে সুশাসন কায়েম করতে হবে। শেখ হাসিনাও তাতে একমত। সুতরাং— সাধু সাবধান।
[জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জিয়াউল হক মুক্তা রচিত ও শীঘ্র প্রকাশিতব্য “অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ” রচনার অংশবিশেষ।]