Warning: Attempt to read property "post_content" on null in /home/dakshinermashalc/public_html/wp-content/plugins/pj-news-ticker/pj-news-ticker.php on line 202
উপ-সম্পাদকীয় Archives - Page 4 of 7 - Daily Dakshinermashal

Category: উপ-সম্পাদকীয়

  • জাসদের নবীনদের জন্য…

    জিয়াউল হক মুক্তা

    এক.
    সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে সর্বদলীয় বিপ্লবী সরকার গঠনের আহ্বান ও দেশ পুনর্গঠনের ১৫ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগঠক মুক্তিযোদ্ধা-ছাত্র-যুব-তরুণশক্তি। বঙ্গবন্ধু তা শোনেন নি। ফলে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। জাসদ একটি সমাজতান্ত্রিক গণসংগঠন; এর লক্ষ্য সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। আনুষ্ঠানিকভাবে দল গঠনের আগে থেকেই জাসদ-ছাত্রলীগ-শ্রমিকলীগ-কৃষকলীগের নেতাকর্মীদের ওপর শাসকদের খড়্গ নেমে এসেছিল— এরপর তা চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৭৪-এর ১৭ মার্চের পর। ১৯৭৩-এর নির্বাচনে জাসদ মাত্র দুটি আসন পায়— জাসদের প্রার্থীদেরকে মনোনয়নপত্র দাখিলের আগে অপহরণ করা, আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা, ভোট ডাকাতি করা আর ভোটের ঘোষিত ফলাফলও পাল্টে দেয়ার মতো ঘটনা ঘটে— যেমন, খোন্দকার মোশতাকের বিপরীতে আব্দুর রশিদ ইঞ্জিনিয়ারকে বেতারে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়, কিন্তু পরে হেলিকপ্টারে করে সব ব্যালটবাক্স ঢাকায় এনে পুনর্গণনার মাধ্যমে মোশতাককে বিজয়ী ঘোষণা করা হয় । ১৯৭৫-এ বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে আইনী রাজনীতির অধিকার হরণ করা হয়। পুরো সময়জুড়ে খুন-গুম-সন্ত্রাস-নিপীড়ন-রক্তক্ষরণ হয়ে ওঠে দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীর ভাগ্য। সমাজতন্ত্রের পথে এ বৈপ্লবিক সংগ্রামের সময় দলের নেতাকর্মীগণ দল ত্যাগ করেন নি।

    দুই.
    ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খোন্দকার মোশতাকের আমলে খুন-গুম-সন্ত্রাস-নিপীড়ন-রক্তক্ষরণ থেমে থাকে নি। আওয়ামী লীগের তখন কোন অস্তিত্ব ছিল না। জাসদকে মোকাবেলা করতে হয়েছে মোশতাকের আক্রমণ [যারা ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত ‘প্রেরণার মুখ’ নামে জাসদের শহীদদের অসম্পূর্ণ তালিকাটি দেখেছেন— দেখতে পাবেন খোন্দকার মোশতাক কোথায় কাদের হত্যা করেছেন। এখানে অন্য একটি উদাহরণও দেয়া যাক। বঙ্গবন্ধু হত্যার ১৫ দিন পর ১৯৭৫ সালের ৩০ আগস্ট খোন্দকার মোশতাকের শাসনামলে জাসদের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার তার বেইজ-এলাকা রংপুর থেকে গ্রেফতার হন ও অমানুষিক নিপীড়নের শিকার হন। ২৫ অক্টোবর তাঁকে ঢাকায় এনে গোয়েন্দা বিভাগের কার্যালয়ে রাখা হয় এক সপ্তাহ ও ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। ৩ নভেম্বর চার জাতীয় নেতার জেল-হত্যার পরপরই তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পরে জিয়ার সামরিক আদালতের রায়ে তাকে দুবছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। ১৯৭৭ সালের ১৩ জুলাই তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।] এ সময়ও দলের নেতাকর্মীগণ দল ত্যাগ করেন নি। এ পর্যায়ে বিপর্যস্ত জাসদ পুরোপুরি উঠে দাঁড়াতে না পারলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবিতে বক্তব্য রেখেছে। তাত্ত্বিকভাবে মনে করেছে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির বিরুদ্ধে অন্যদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

    তিন.
    ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমের নেতৃত্বে ও জাসদ-গণবাহিনী-সৈনিকসংস্থার উদ্যোগে সংঘটিত মহান সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেন। সুপরিকল্পিতভাবে দলকে ছিন্নভিন্ন নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেন। কর্নেল তাহেরকে হত্যা ও দলের প্রধান নেতাদের কারাগারে অন্তরীণ করেন। সারা দেশে গুপ্তহত্যা, বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা, হুমকি, বিনা বিচারে আটক ও লোভ দেখানোর মাধ্যমে জাসদের অনেককে জিয়া নিজ শিবিরে সমবেত করেন। এমনকি নেতৃত্বের কারো কারো মধ্যে জিয়ার সাথে আপোষের প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়। দলে নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দেয়। জিয়া এমনকি একটি শিখন্ডি জাসদও বানানোর চেষ্টা করেন। জিয়ার বিরুদ্ধে দল কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে নি। দলের হাজারো নেতা-কর্মী জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে নিজেদের জীবন রক্ষা করেন। ৭ নভেম্বরের মহান সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান ব্যর্থ হবার পর জাসদ এসময়ও গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে। ১৯৭৯-র সংসদে জাসদ ৮টি আসন পায়।

    চার.
    ১৯৮০ সালে দল ভেতর থেকে দ্বিমুখী সংকটে পড়ে। একদিকে, সিরাজুল আলম খানের গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার তত্ত্ব ও কর্মসূচি— যা কাউন্সিলে [এর সুবিধাবাদী অংশগুলো বাদ দিয়ে] সংশোধন করে গ্রহণ করা হয়। অন্যদিকে, জাসদ মেজর এম এ জলিল ও আসম আব্দুর রবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে সাথে নিয়ে ১০ দলীয় ঐক্যজোট গঠনের উদ্যোগ নিলে ‘চেতনার আশি সাল, জাসদ হলো বাকশাল’ শ্লোগান দিয়ে দলের একটি অংশ সে ঐক্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। সে সময় মতাদর্শ ও অতীত আন্দোলনের মূল্যায়ন নিয়ে দলে একটি অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম চলমান ছিল। সে সংগ্রামের একটি ধারা— দল ও ছাত্র সংগঠনের জনপ্রিয় নেতা আফম মাহবুবুল হক ও মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সামনে রেখে খালেকুজ্জামান ও মুবিনুল হায়দার চৌধুরীরা— আওয়ামী লীগ আমলে নিগৃহীত নেতা-কর্মীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ১০ দলীয় ঐক্যজোট গঠনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাঁরা আরও বলেন জাসদের ভেতরে থেকে বিপ্লব করার প্রক্রিয়া চালু করা সম্ভব নয়। তাঁরা দলত্যাগ করেন। ব্যাপক সংখ্যক তরুণের দলত্যাগে দলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাঁরা বাসদ গঠন করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যকে নাজায়েজ বলে যাঁরা বাসদ গঠন করলেন, ১৯৮৩ সালে তাঁরাই আবার জাসদ ও আওয়ামী লীগের সাথে ১৫ দলীয় ঐক্যজোটে যোগ দিলেন।

    পাঁচ.
    ১৯৮১ সালে সিরাজুল আলম খান দলে দ্বিতীয় আঘাত হানেন— তিনি তত্ত্ব দেন, দেশ ও জাতি গঠনে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নিঃশেষিত হতে চলেছে এবং পেশাজীবীদের ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। জাসদ তার মতের দ্বিতীয় অংশ গ্রহণ করলেও প্রথমাংশ গ্রহণ করে নি। ১৯৮১-র বিশেষ কাউন্সিলে দল ‘সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ’ ও ‘১৮ দফা কর্মসূচি’ গ্রহণ করে। সিরাজুল আলম খানের প্রস্তাবের আলোকে পেশাজীবীদের একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা থেকে সংসদে ২০০ প্রতিনিধি প্রেরণের রাজনৈতিক প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৮০ সালে মেজর এম এ জলিল ত্রিদলীয় ঐক্যজোট থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার পর থেকে মেজর এম এ জলিল ও আসম আব্দুর রবের দ্বন্দ্ব তীব্রতর হতে থাকে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখলের জন্য উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলেন; আসম আব্দুর রব তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, গর্ত থেকে মাথা বের করলে তা ফাটিয়ে দেয়া হবে।

    ছয়.
    ১৯৮২ সালে সাত্তার সরকার উচ্ছেদ করে এরশাদের ক্ষমতা দখলের পর জাসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৮৩-র মধ্য-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিরাজুল আলম খান ও জলিল-রব সর্বাত্মক আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন; এ আন্দোলনকে সিরাজুল আলম খান ক্ষমতার অংশীদার হবার জন্য এরশাদের সাথে দরকষাকষির উপায় হিসেবে ভাবছিলেন। কিন্তু দলের অপরাপর নেতৃত্ব দলের তাত্ত্বিক নির্দেশনা অনুযায়ী ‘গণঅভ্যুত্থান’-এর মাধ্যমে এরশাদকে উৎখাতের পক্ষে অবস্থান নেন; কোনো দরকষাকষির মাধ্যমে নয়। ১৯৮৩-র মার্চের প্রথম দিকে সিরাজুল আলম খান সব পক্ষকে ‘ধৈর্য ও সহনশীলতা’র মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলার আহ্বান জানান ও পরে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে বাড়াবাড়ি বলেন; রাষ্ট্র ও দেশ পরিচালনায় সেনাবাহিনীর অংশীদারিত্বের তত্ত্ব হাজির করেন; এবং ক্যান্টনমেন্টগুলোতে বৈঠক করতে থাকেন। আসম আব্দুর রবও ১৯৮৩-র ছাত্র আন্দোলনের ওপর থেকে আগ্রহ হারান; যদিও তিনি বৃহত্তর আন্দোলন গড়ার জন্য ইতোমধ্যে গঠিত ১৫ দলের ১১ দফায় জাসদের পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন। আসম আব্দুর রব— মেজর এম এ জলিলকে নেতৃত্ব থেকে অপসারন করতে— সিরাজুল আলম খান [তাঁর দিক থেকে দলের ওপর তাঁর তৃতীয় আঘাত], শাজাহান সিরাজ ও মীর্জা সুলতান রাজার সমর্থন পান।

    সাত.
    দলের ওপর সিরাজুল আলম খানের চতুর্থ আঘাত— ১৯৮৩-র মার্চের শেষের দিকে তিনি আকস্মিকভাবে জাতীয় কমিটির সভায় পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে জাসদ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগের সকল কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন। কমিটি তাঁর এ পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে তাঁকে জাতীয় কমিটির সভায় এসে মতামত জানানোর অনুরোধ করে তাঁর কাছে প্রতিনিধি-দল পাঠায়। তারপরও তিনি সে সভায় আসেন নি। এদিকে জলিল-রবের দ্বন্দ্ব নিরসন করতে দল কর্তৃক মেজর জলিলের এককভাবে বিবৃতি ও সাক্ষাৎকার দানের অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। রব তাতেও সন্তুষ্ট হন নি। পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন— পত্রিকায় বলেন যে তিনি মনযোগ দিয়ে সংসার করবেন, সাংবাদিকতা করবেন ও চাকুরি করবেন। জাসদ অপরাপর দলকে নিয়ে ১৫ দলের নেতৃত্বে সামরিক শাসন বিরোধী গণ-আন্দোলন অব্যাহত রাখে।

    আট.
    এর মধ্যে মেজর এম এ জলিলও জাসদ ত্যাগ করেন ও অন্য দল গঠন করেন। তাঁর দলত্যাগ দলের সাংগঠনিক কাঠামোয় কোনো প্রভাব না ফেললেও এতে দলের ইমেজের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

    নয়.
    পদত্যাগের কিছু দিন পর আসম আবদুর রব পাল্টা ছাত্রলীগ গঠন করেন। ১৯৮৪ সালে আবার জাসদ গঠন করেন ও উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এরশাদের শাসনপ্রক্রিয়াকে বৈধতা দেন । সিরাজুল আলম খানও তাঁকে সহায়তা দিতে থাকেন; এটা দলের ওপর তাঁর পঞ্চম আঘাত। খান-রব তাঁদের কাল্টের অনুসারীদেরকে সাথে পান। খান-জলিল-রবের দলত্যাগে দলের ব্যাপক শক্তিক্ষয় হয় ও ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। কিন্তু সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জাসদের আপোষহীন আন্দোলনের ফলে সারা দেশে তরুণদের মধ্যে জাসদ আবারও জায়গা করে নেয়।

    দশ.
    ১৯৮৬ সালে শাজাহান সিরাজ ও মীর্জা সুলতান রাজা আওয়ামী লীগ ও সিপিবিকে অনুসরণ করে এরশাদের অধীনে সংসদ নির্বাচনে যেতে দল ত্যাগ করেন ও আলাদা জাসদ গঠন করেন। জাসদের মতো ১৫ দলও ভেঙে যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৮ দল নির্বাচনে যায়; জাসদের নেতৃত্বে ৫ দল স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ১৯৮৮-র সংসদ নির্বাচনে ৫ দল, ৭ দল ও ৮ দল অংশগ্রহণ করে নি। আসম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজ প্রমুখগণ তাতে অংশগ্রহণ করেন ও ধিকৃত হন।

    এগারো.
    ১৯৯০ সালে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এরশাদের পতনে দল একটি রাজনৈতিক বিজয় অর্জন করে। গণতন্ত্রের সংগ্রামে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব প্রদান করার পরও ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দল কোনো আসন না পাওয়ায় দলের নেতা-কর্মীগণ আশাহত হন। এ প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীন সাংগঠনিক বিরোধে ঢাকায় ছাত্রলীগের শক্তিশালী অবস্থান কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

    বারো.
    ১৯৯১ সালে নির্বাচনের পর জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে— দলের বড়-মাঝারি-ছোট নেতা এবং আগের এক দশকের বেশি সময়ের ছাত্রলীগের বিখ্যাতসব সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকগণ প্রায় সকলে— আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেন। যাঁদের কাছে দলের প্রত্যাশা ছিল যে তাঁরা জাসদ নেতৃবৃন্দের টিম-মেট হয়ে দলকে নেতৃত্ব দেবেন— তাঁরা ব্যবসা, চাকুরি ও পড়াশোনার জন্য দল ছেড়ে চলে যান। ওই এক দশকের সকল ছাত্রনেতৃত্বের মধ্যে দলে রয়ে যান একমাত্র একজন— শিরীন আখতার। দলের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রীয় নেতা শরীফ নূরুল আম্বিয়াও সার্বক্ষণিকভাবে ব্যবসা করতে চলে যান। কাজী আরেফ আহমেদ ও হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে দল হতাশার-সংকট মোকাবেলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন সারাদেশের তরুণ-সংগঠকদের নেতৃত্বে। যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলন এগিয়ে নিতে দল সারাদেশে ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। জাসদ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী আরেফ আহমেদ শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধাপরাধ বিচার আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রীয় ও জাতীয় নেতৃত্ব হিসেবে ভূমিকা রাখেন।

    তের.
    শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনতার বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলতে জাসদ বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করে। বাম ফ্রন্ট নিয়ে দলে ভিন্ন মত থাকলেও দলকে সে প্লাটফর্মে যুক্ত থাকতে হয়েছে। বৃহত্তর আন্দোলনের জন্য এক ধরনের ‘মার্কটাইম’ নীতি অবলম্বন করতে হয়েছে। ১৯৯৬-এর নির্বাচনেও দল কোন আসন না পাওয়ায় দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে হতাশা আরও গভীর হতে থাকে।

    চৌদ্দ.
    ১৯৯৬ সালের সংসদ নির্বাচনের পর আসম আবদুর রবের একটি নির্ধারক ভোটের সমর্থনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায়। আসম আবদুর রব সরকারের মন্ত্রীসভায় স্থান পান। জাসদ ১৯৯৭ সালের ৩১ অক্টোবর আসম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ ও বাসদ (মাহবুব)-এর একাংশকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ জাসদের যাত্রা শুরু করে। দল বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে আসে। সারা দেশে দলে সাড়া পড়ে।

    পনের.
    ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা, ৩ নভেম্বরের ক্যু ও ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার পর থেকে জাসদ সবসময় যে রাজনীতি করার চেষ্টা করেছে— তা হলো, আওয়ামী লীগ ও সমমনাদের সাথে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার ঐক্যের রাজনীতি। আসম আবদুর রব মন্ত্রীসভায় থাকলেও সে ঐক্যকে আদর্শিক ভিত্তি দিতে এবং রাজনৈতিকভাবে কাঠামোবদ্ধ করতে তিনি আগ্রহী ছিলেন না। দলের সভাগুলোর সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সে আদর্শিক-রাজনৈতিক-সাংগঠনিক চুক্তির উদ্যোগ নেয়ার ফলে— জাসদ ঐক্যের মাত্র চার বছরের মাথায় ২০০১ সালে আসম আবদুর রব আবারও আগের বারের মতোই রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার ঘোষণা দেন। দলের কাউন্সিলে তাঁর চেয়ার ফাঁকা রেখে অধিবেশন সম্পন্ন হয়। তিনি দলে ফিরে আসেন নি। অনেক পরে, আগের মতোই, আবার তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি নামে একটি দল গঠন করেন।

    ষোল.
    ২০০১ সালের পর থেকে জাসদ বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক-কৌশলগত কর্মসূচি পালনের ধারাবাহিকতায়— আওয়ামী লীগ ও জাসদের মধ্যে, জাসদ ও ১১ দলের মধ্যে এবং জাসদ, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও ১১ দলের মধ্য ২৩ দফার রাজনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে— জামাত-যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গী ও এদের জন্মদাত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় প্লাটফর্ম ১৪ দল গড়ে তোলায় উদ্যোগী ও নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে। এক সাথে আন্দোলন, এক সাথে নির্বাচন ও এক সাথে দেশ পরিচালনার জন্য ১৪ দল ঐকমত্যে পৌঁছে।

    সতের.
    ২০০৮ সালে ১৪ দল ঐক্যবদ্ধভাবে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। জাসদ তিনটি আসন পায়; এর মধ্যে দুটিতে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থী না দিয়ে জাসদের প্রার্থীকে সমর্থন দেয়; একটিতে ১৪ দলের প্রার্থী হিসেবে জাসদ নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়। সরকার পরিচালনার এক পর্যায়ে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপিকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। কৃষিতে সহায়তা, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বর্ধিত বরাদ্দ, পোষাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি এবং স্বনির্ভর জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মতো জাতীয় উদ্যোগ গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারিক কার্যক্রম আবার শুরু হয়। যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হয়; সংবিধান বাহাত্তরের মূল চেতনায় ফেরত যায়। কর্নেল তাহের হত্যার বিচার হয়। যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গী-আগুনসন্ত্রাসী ও এদের জন্মদাত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী রাজনৈতিক প্রতিরোধ আন্দোলন ও বিচারিক উদ্যোগ গড়ে তোলা হয়।

    আঠারো.
    ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে জাসদ পাঁচটি আসনে জয়লাভ করে; সাথে যোগ হয় একটি সংরক্ষিত আসন— শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম-এর স্ত্রী লুৎফা তাহেরকে দলের পক্ষে সে সংরক্ষিত আসনে মনোনীত করা হয়। পূর্বোক্ত আন্দোলন ও উদ্যোগগুলো অব্যাহত থাকে।

    উনিশ.
    ২০১৫ সালে দলের জাতীয় কমিটির এক সভায় দলের নাম পরিবর্তন ও সমাজতন্ত্রকে আদর্শ হিসেবে পরিত্যাগের দাবি জানান দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য জনাব শরীফ নূরুল আম্বিয়া; তাঁর সাথে যোগ দেন দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য জনাব নাজমুল হক প্রধান— তিনি দলের নাম পাল্টে ‘জাতীয় সমতা দল’ রাখার প্রস্তাব করেন। অবিলম্বে সরকারের মন্ত্রীসভা ও ১৪ দল থেকে দলকে সরে এসে বিরোধী দল হিসেবে আন্দোলন করার দাবী জানান ডা. মুশতাক হোসেন। এবং জাগতিক সুবিধার জন্য এ দুই পক্ষের সাথে যোগ দেন জনাব মইনউদ্দিন খান বাদল। সব মিলিয়ে তাঁরা তিন পক্ষ এক হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে ২০১৬ সালের কাউন্সিলে দলের ঘোষিত রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। দলের ইতিহাসে দ্বিতীয়বারের মতো কাউন্সিল সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন অনুমোদন না করে তা প্রত্যাখ্যান করে। দলে আদর্শহীন-সুবিধাবাদী ধারার জনাব মইনউদ্দিন খান বাদল, সমাজতন্ত্র-বিরোধী পুঁজিবাদী আদর্শের প্রতিভু জনাব শরীফ নূরুল আম্বিয়া ও জনাব নাজমুল হক প্রধান এবং অতি-বাম চিন্তার ডা. মুশতাক হোসেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে মধ্য-বাম চিন্তার নেতা হাসানুল হক ইনুর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচনকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে হাসানুল হক ইনুকে ব্ল্যাকমেইল করতে তারা কাউন্সিল কক্ষ ত্যাগ করেন এবং মাঝরাতে প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় দলের নতুন কমিটি ঘোষণা করেন। দলের অফিস, নির্বাচনী প্রতীক এবং এমনকি নামও [যা তারা পরিবর্তনের দাবি করেছিলেন] দখলের জন্য তারা বিবিধ প্রয়াস চালান। কিন্তু আইন প্রত্যেক ক্ষেত্রে জাসদের পক্ষে রায় দিয়েছে। তারা এখন বাজাসদ নামে নিবন্ধনহীন একটি কথিত রাজনৈতিক দল।

    কুড়ি.
    ২০০১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধী-জঙ্গী-আগুনসন্ত্রাসী ও এদের জন্মদাত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে রাজনৈতিক প্রতিরোধ আন্দোলন ও বিচারিক উদ্যোগ গড়ে তোলা হয়— তাতে এরা কিছুটা পিছু হঠেছে; কিন্তু বিপদ কাটে নি। যে কোনো সময় এরা চাকু মারতে পারে। তাই জাসদ মনে করে এ আন্দোলন একদম ছেড়ে দেয়া যাবে না; বরং এখন দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে এদের বিরুদ্ধে লড়াই অব্যাহত রাখতে হব। এখন লড়াইয়ের প্রথম ফ্রন্ট হবে দুর্নীতি-দুঃশাসন-অপশাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সুশাসন-সমতা-সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম।

    একুশ.
    কালের যাত্রায় অনেকে হারিয়ে যাবেন— এই স্বাভাবিক। কিন্তু জাসদকে হারাতে হয়েছে অনেক অনেক বেশি। জাসদ নেতাকর্মীগণ যেমন হত্যা-খুনের শিকার হয়েছেন; তেমনি পথ চলতে গিয়ে ভিন্নমতের কারণেও অনেকে পথহারা হয়ে হারিয়ে গিয়েছেন। অনেকে হারিয়ে গিয়েছেন জীবন-জীবীকার কঠিন সংগ্রাম করতে গিয়ে। কেউ কেউ ঘর ছেড়ে পালিয়েছেন সুবিধাবাদের হাত ধরে। অতীতে আন্দোলনে যে যতোটুকুই ভূমিকা রাখুন না কেন— জাসদ তাঁদের প্রত্যেকের ভূমিকাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। জাসদ তাঁদের প্রত্যেককে নতশীরে ভালোবাসা জানায়। যাঁরা এখনও বেঁচে আছেন কিন্তু নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন কিংবা অন্য দলে আছেন— তাঁদের সকলের জন্য জাসদের দরজা সকল সময় খোলা। কারোর প্রতি জাসদের কোনো রাগ-ক্ষোভ নেই; কষ্ট-অভিমান থাকলেও থাকতে পারে। জাসদের প্রধান দুটি চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য হলো— (১) অন্যান্য দল যখন পুরো-দল একসাথে মিলেমিশে আপোষের পথে যায় [যেমন ১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগ ও সিপিবির নেতৃত্বে ৮ দল এরশাদের অধীনে নির্বাচনে যোগ দেয়], জাসদ-কর্মীগণ তখন যেটাকে ন্যায্য মনে করেন, তার সাথেই থাকেন; বারবার ভাঙন ও দলত্যাগের মধ্য দিয়ে শক্তিক্ষয়ের মতো ঘটনা ঘটলেও গণমানুষের অধিকার আদায়ের কোনো আন্দোলনে এ পর্যন্ত জাসদ কখনো অনুপস্থিত থাকে নি। এটা জাসদের একটি সাংগঠনিক-দুর্বলতাও বটে। আর— (২) এই দলে কাল্ট বা ব্যক্তিপূজার কোনো জায়গা নেই; যাঁরা বঙ্গবন্ধুকে নির্মাণ করেছিলেন, তাঁরা সে বঙ্গবন্ধু ও ক্ষমতার মোহ ছেড়ে ১৯৭২ সালে জাসদ গঠন করেন। তাঁরা আবার তাঁদের একচ্ছত্র নেতা সিরাজুল আলম খানের সব সিদ্ধান্তকেও অন্ধভাবে অনুসরন করেন নি। জাসদ আপোষহীন কর্মীদের দল।

    বাইশ.
    ফলে আজকাল যাঁরা জাসদের প্রাতিষ্ঠানিক ঐক্য চান, তাঁরা কি ১৯৯৭ সালের ঐক্যের কথা ভুলে গিয়েছেন? দেখেছেন, আসম আবদুর রব কীভাবে তাঁর প্রথম দলত্যাগকে দ্বিতীয়বার অনুসরণ করেছেন? তাই বলি— রাজনৈতিক ঐক্য ছাড়া সাংগঠনিক ঐক্য অর্থহীন; অকার্যকর; এমনকি ক্ষতিকরও বটে!!!

    জিয়াউল হক মুক্তা
    প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক
    জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ
    কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটি
    ৮ জুলাই ২০২০; ঢাকা।

  • একজন দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের সাধারণ মানুষের কথা ও প্রত্যাশা


    অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী

    পৃথক সৃজনশীল প্রাকৃতি বৈশিষ্ঠ মন্ডিত দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চল। উপকূলীয় এ অঞ্চলের ভুমি গঠনের সাথে রয়েছে জোয়ার ভাটার প্রভাব। সাগরের লবণপানি আর উজানের মিষ্টি পানির সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা পৃথক এক প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনায় উপকূলীয় জীবন-জীবিকার বিকাশ ঘটে। পলি অবক্ষেপনের মাধ্যমে গঠিত ভূমির গঠন প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ার পূর্বে উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ করায় ভূমি বসে যেয়ে নদী পাড় অপেক্ষা বাঁধের মধ্যের জমি নিচু হয়ে যায়। পাশাপাশি পলি জমিতে না পড়তে পেরে নদীর মধ্যে পড়ায় নদীর তলদেশও উচু হতে শুরু করে। যা আজ এলাকার জন্য ভয়াবহ অবস্থা তৈরী করেছে।

    ষাটের দশকে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে উপকূল অঞ্চল দিয়ে ভেড়ীবাধ নির্মানের মূল উদ্দেশ্য ছিল কৃষি জমিতে নোনা পানি উঠা বন্ধ করা ও অধিক ফসল উৎপাদন। কৃষি ভিত্তিক উৎপাদন কাঠামো গড়ে তোলা। রাষ্ট্রীয় কতৃপক্ষের এ দপ্তরের নাম ছিল ইপি-ওয়াপদা { ইস্ট পাকিস্তান ওয়াটার এন্ড পাওয়ার ডেভল্পমেন্ট বোর্ড সংক্ষেপে ইপি-ওয়াপদা। পরবর্তিতে পাওয়ার ডেবলম্পমেন্ট বোর্ড কে পৃথক করা হয়। বর্তমানে পানি উন্নয়ন বোর্ড – পাউবো কিন্তু এখনো ওয়াপদা নামে সমাধিক প্রচারিত}। উপকুলীয় বাঁধ নির্মানের সময়ে ফসল উৎপাদন, কৃষির ফলন বৃদ্ধি, নোনা পানি ঠেকানো নানান কথা বলা হলেও বলা হয়নি এ বাঁধ নির্মানে এলাকার পরিবেশ প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনায় কোন বিরূপ ক্রিয়া তৈরী হবে কিনা ? কতদিন নোনা পানির প্রভাব মুক্ত হয়ে কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক থাকবে ?

    উপকূলীয় বাঁধ এর নির্মানকালিন ত্রুটির বিরূপ প্রতিক্রিয়া ৭০ দশকের শেষ দিকে বিশেষ করে ৮২-৮৩ সালে মারাত্মক আকার ধারন করে। কৃষি উৎপাদন নেমে আসে নিন্মস্তরে আর তৈরী হতে থাকে অঞ্চল ভিত্তিক জলাবদ্ধতা। অন্যদিকে আর্ন্তজাতিক বাজারে চিংড়ী চাহিদা তৈরী হয়। ব্যবসায়ীরা তখন চিংড়ী উৎপাদনে কৃষি জমির উপর নজর দেন। যে জমিতে সারা বছর শ্রম ও অর্থ ঘাটিয়ে দেড় হাজার টাকা পাওয়া ছিল কষ্টকর সেখানে ৩০০০ টাকা অগ্রিম জমির মালিককে প্রদান করার প্রলোভনে পড়ে বৃহৎ জমির মালিকরা (এ শ্রেনী ছিল সরসরি জমি বিচ্ছিন্ন), চিংড়ী ঘের করার জন্য কৃষি জমি লীজ প্রদানে আগ্রহী হয়ে উঠে। ফলে ক্ষুদ্র কৃষক, মাঝারী কৃষক, কৃষি শ্রমিক ও অল্প জমির মালিকরা বিপদে পড়ে। এসময় এলাকাতে চিংড়ী বিরোধী আন্দোলনও গড়ে উঠে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা অবস্থায় বাঁঁধ বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার প্রধান অনুসংগ হিসেবে আজ উপক’লীয় বাঁধ প্রতীয়মান। আর সে কারনে স্থায়ীত্বশীল পরিবেশ বান্ধব, জলবায়ু পরিবর্তন সহিষ্ণু বাঁধ নির্মানের দাবী দক্ষিণ পশ্চিম উপক’লীয় ভুক্তভোগিক সকল পর্যায়ের মানুষের।

    মুলতঃ উপক’লীয় বাঁধ নির্মানের পিছনে বৈশি^ক অনৈতিক বানিজ্যিক আকাংখায় কাজ করে। ফলে ষাটের দশকের নির্মিত উপকূলীয় বাঁধ তৈরীর ক্ষেত্রে স্থানীয় পরিবেশ, নদীর প্রবাহ, ভুমি গঠন প্রক্রিয়া, পলি অবক্ষেপন, সুন্দরবন ও সংশ্লিষ্ঠ এলাকার জীববৈচিত্র ইত্যদি বিষয়গুলো বিবেচনা করা হয় না। নদীর সাথে প্লাবনভুমির সংযোগ খাল সমুহের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। নদীর মধ্যে আড়াআড়ি বাঁধ দেওয়া, কোথাও প্রবাহবান নদীর দু মুখ বেধে দেওয়া হয়। অভ্যন্তরিন যে গেট সমুহ নির্মাণ করা হয়, তা আকারে অনেক ছোট । এবং শুধু মাত্র একমুখ ফ্লাসগেট তৈরী করা হয়।

    ভেড়ী বাঁধ নির্মানের পে এটিকে টেকসই করা বা কোন জটিলতা ঘটলে নিরসনের পন্থা বিষয় নিয়ে কোন স্থায়ীত্বশীল কর্মপন্থা প্রস্তুত করা হয় না। পাউবোর মত অনুযায়ী, প্রতিবছর বাঁধের ১০ হতে প্রায় ২০ পার্সেন্ট পর্যন্ত মাটির ক্ষয় হওয়ার প্রবনতা থাকে। অন্যদিকে চিংড়ী চাষের কারনে বাঁধের অপ-ব্যবহার করা হয়। নিবিচারে বাঁধ কাটা, নিজেদের মত নিজস্ব পানি উত্তোলন পথ নির্মাণ, নদীর চরের বনাঞ্চল ধ্বংশ করা কারনে বাধঁ পুবোপুরি দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়ে। ২০০৯ এর আইলায় দেখা যায় যেখানে যেখানে চিংড়ী ঘেরে পানি উত্তোলনের জন্য ভেড়ীবাধ কাটা হয়েছিল, সেই সকল স্থানের বাঁধ ভেঙ্গে এলাকা প্লাবিত হয়। পাউবোর কিছু বিধি আছে বাঁধকে এ ধরনের অপ-ব্যবহার রোধ করার জন্য। কিন্তু পাউবোর অসৎ ব্যবস্থাপনা এ সকল বিধিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবহার করে চিংড়ী চাষ বিরোধী সাধারণ মানুষের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে।

    বাঁধ ভাঙ্গন একটা নিত্য সঙ্গি হলেও ২০০৭ সিডোর ও ২০০৯ এর আইলার প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হওয়ার পর থেকে ভঙ্গুর বাঁধ ব্যবস্থাপনার অবস্থা মানুষ অনুধাবন করা শুরু করে। বিশেষ করে ২০০৯ আইলার পর স্থানীয় মানুষের মধ্যে স্থায়ী বাধ নির্মানের প্রয়োজনীয়তার দাবীটি প্রাধান্য পায়। ২০০৯ মে তে ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ নভেম্বরের মধ্যে নির্মান করা হবে বলে প্রত্যশ্রুতি দেওয়া হয় কিন্তু ডিশেম্বর শেষে এসে যখন বাঁধ নির্মানের কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত না হয়, তখন স্থানীয় ভুক্তভোগি মানুষের নেতৃত্বে ‘আইলা বিধ্বস্থ বাঁধ নির্মান গণ সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করে ভাঙ্গা বাধ নির্মানের দাবী বাস্তবায়নের দাবী তোলা হয়।এ কমিটির উদ্যোগে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে ১০ জানুয়ারী২০১০ প্রথম সংবাদ সম্মেলন কওে বাধ নির্মানের দাবী করা হয় এবং ১৪ জানুষায়ী ২৪ ঘন্টায় দু বার জলে ডুকে যাওয়া গাবুরা পদ্মপুকুরের হাজার মানুষ শ্যামনগর সদরে বাঁধ নির্মানে দাবীতে মানব বন্ধন করে। এখানে তৎকালিন সাতক্ষীরা -৪ এর এমপি ও সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আসেন এবং দ্রুত বাধ ভেঙ্গে থাকা স্থান সমুহ সংযুক্ত কওে মজবুত স্থায়ী বাধ দেওয়ার উদ্যোগের প্রতিশ্রুতি দেন। এর পর থেকে প্রতিশ্রুতি আসতে থাকে। আন্দোলনের তীব্রতায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রি, পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপন্ াসংসদীয় কমিটি, পাউবোর প্রধান প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ঠ বক্তিরা আসেন আর প্রতিশ্রুত ব্যক্ত করেন। কিন্তু কাজের গতি না হওয়ায় মানুষের আন্দোলন তীব্রতর হয়। সাতক্ষীরা গণ অনেশন, ঘেরাওসহ সকল ভুক্তভোগি মানুষর কর্মসুচির সাথে স্থানীয় সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সংহতি জানায়। এ সময় দাবী তোলা হয় প্রধানমন্ত্রিকে দুর্গত এলাকায় পরিদর্শনের। জনদাবীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রি ২৩ সেপ্টেম্বর১০ শ্যামনগরে আসেন। নকিপুর হরিচরন হাইস্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত সমাবেশে তিনি ১৫ জানুয়ারী ১১ মধ্যে বাধ নির্মান সম্পন্ন হবে বলে ঘোষনা দেন। কিন্তু বাঁধের ভাঙ্গা সমুহে ক্লোজার দিতে সেনাবাহিনী নিয়োগ করে মধ্যে নির্মান শেষ হয়।

    বাঁধ নির্মানের আন্দোলন দু পবে বিভক্ত করা যায়। ২০১০ হতে ২০১৪ পর্যন্ত এবং ২০১৬ থেকে ২০২০। প্রথম পর্বে শুধু আইলায় ক্ষতিগ্রস্থ বাধ সংস্কারের দাবীকে প্রাধান্য দিয়ে সাতক্ষীরাতে আইলা বিধ্বস্থ বাধ নির্মান গণসংগ্রাম কমিটি ও খুলনাতে আইলা সংহতি পরিষদ এবং ঢাকাতে সিএসআরএল এর নেতৃত্বে ধারাবাহিক আন্দোলন করা হয়। এ সময় স্মারক লিপি প্রদান, সমাবেশ, মানববন্ধন, নীতি নির্দ্ধারকদের সাথে ঢাকাতে সংলাপ, গণশুনানী, খুলনা-৫, খুলনা-৬ এর এমপি মহোদয়দের ঢাকাতে সংলাপ, টেলিভিশনে টক শোতে অংশ নেওয়া, ঢাকা কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারে প্রথীক অবস্থান, থালা বাসন নিয়ে পিকসারপ্যালেসের সামনে ভুক্ষাদের অবস্থান, জাতীয় দৈনিকে জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকদের ধারাবাহিক প্রতিবেদন, সকল তথ্য নিয়মিত প্রধান মন্ত্রির দপ্তরে সংরক্ষন, ৩০ হাজার পোস্ট কার্ডএ ভুক্তভোগিদের প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি, দুযেৃাগ মন্ত্রি, পরিবেশ মন্ত্রী, পানি সম্পদ মন্ত্রী, পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী, জাতীয় বিশেজ্ঞ নেতৃৃন্দেও সাথে স্থানীয় ভুক্ত ভোগি মানুষদের সংলাপ প্রভৃতি । এ পর্যায়ে বাধের ডিজাইন পরিবর্তন করা ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্থ বাধ নির্মানের দাবীকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।

    দ্বিতীয় পর্বে আন্দোলনটি দেশের খ্যাতনামা গবেষকবৃন্দ যুক্ত করে শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) কয়রা (খুলনা)তে বাঁধ, খাওয়ার পানি সহ স্থানীয় প্রধান সমস্যগুলো সামনে নিয়ে আসা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুকি সমুহ চিহ্নিত করা হয়। যেখানে স্থায়ী বাঁধ ও নিরাপদ পানিকে গুরুত্ব প্রদান করে দলিল তৈরী করা হয়। এ র্পায়ে উপক’ল ও উত্তোর বঙ্গেরবাধ নিয়ে যৌথ সামাজিক আন্দোলন শুরু করা হয়। এ আন্দোলনের সুচনা স্থানীয় জলবায়ু পরিষদ’র নেতৃত্বে করা হয়। এক্ষত্রে স্থায়ী বাধ নির্মান ও বাঁধ তদারকির সাথে স্থানীয় সরকারকে যুক্ত করা এবং প্রধান সমস্যা হিসেবে সুপেয় পানির চাহিদাকে চিহ্নিত করা হয়। এ পর্যায়ে ৩০ জন ইউপি চেয়ারম্যানের পক্ষে প্রধানমন্ত্রি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান, তিন জন জাতীয় সংসদ সদস্যদেও মাধ্যমে জাতীয় সংসদে বক্তব্য প্রদান, জাতীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ও নীতি নিদ্ধারকদের সাথে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সংলাপ ইত্যাদি।
    ধারাবাহিক এ কার্যক্রমের ফলে আমফানের পরে প্রধান সমস্যা হিসেবে স্থায়ী বাঁধ নির্মানের দাবী প্রচারনার প্রথমে চলে আসে। নিরাপদ পানির সংকটও আলোচনায় প্রাধান্য পায়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সরকারের কর্মসুচি বাস্তবায়ন কতৃপক্ষকে মূল কর্মসুচি গ্রহণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহনে কার্যকর ভুমিকা রাখতে উদ্যোগ নেওয়ার সম্ভবনা তৈরী করা সম্ভব হয়নি। সফলতার জায়গা হচ্ছে এতদিন শ্যামনগর, কয়রার মানুষের প্রধান দাবী থাকলেও শহর কেন্দ্রিক নাগরিক আন্দোলনের দাবীর সাথে এটি কম গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিল কিন্তু এ বাওে প্রথম থেকেই সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটি স্থায়ী বাধ নির্মানের দাবীকে এক নম্বও সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত কওে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলে। যা সাতক্ষীরা সকল সুধি ও প্রশাসনকে দাবীর পক্ষে ঐক্যমত্য হতে সহায়ক হয়।

    উপকূলের প্রধান সমস্যা সমুহ বলতে গেলে আজ চিহ্নিত। প্রয়োজন এ সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহনে যথাযত কতৃপক্ষের কার্যকর ভুমিকা গ্রহণ। এক্ষত্রে জাতীয় নীতি বাস্তবায়ন সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপ। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় মাননীয় প্রধান মন্ত্রির হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে কোন বড় ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ফলে দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের স্থায়ীত্বশীল টেকসই ভেড়ী বাধ নির্মান ও নিরাপদ পানির স্থায়ী সমাধান বাস্তবায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রিও হস্তক্ষেপ এর প্রয়োজনীয় উদ্যোগ সৃষ্টি। আর এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ সৃষ্টি কর্মসুচি।
    জলবায়ু পরিবর্তরেনর ঝুঁকি এর আজ উপক’লের একটি জীবন্ত সমস্যা। উপক’লের মানুষদের এ ঝুঁকির সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে হবে। বড় প্রাকৃতিক দুযোগ বাদ দিয়েও নদীর জোয়ারের পানির প্রভাবে প্রায়শঃ বাঁধ ভেঙ্গে এলাকার সকল উন্নয়ন জীববন-জীবিকাকে ধ্বংশ করে দিয়ে থাকে। গত দশ বছরে শুধু পদ্মপুকুর ইউনিয়নের খোলপেটুয়া নদীর জোয়ারের ভেড়ীবাধ ভেঙ্গেছে ১০ বারের মত নদী ভাঙ্গনের শিকার হয়েছে, ১৮টি অধিক স্পটে। ফলে বর্তমান ভঙ্গুর বাঁধ দিয়ে কোন মতেই উপক’লের জীবন-জীবিকা ও সরকারী উন্নয়ন রক্ষা করা সম্ভব নয়।
    পাউবোর নিজস্ব ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সমুহ একমাত্র উপক’লীয় ভেড়ীবাধে কাজ করার অধিকার প্রাপ্ত। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সকল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান নিজেরা কাজ করে না। লীজ, সাব লীজ কখনো কখোনো লেবার সরদার দিয়ে কাজ করা হয়ে থাকে। কাজের মান অধিকাংশ ক্ষেত্রে অত্যান্ত নিন্মমানের হয়। আবার মূল ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে না পাওয়ায় কাজের বিষয়ে কথা কলার সুযোগও থাকে না। পাউবো ঝুকিপূর্ণ বাধ নিয়ে বার বার স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ হতে তাগাদা দিলেও কোন কাজ কওে না। তাদের নিয়ম বাধ ভেঙ্গে গেলে তবে দরপত্র প্রদানের মাধ্যমে কাজ করা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার, জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনসহ কাউকে কাজের বিষয়ে জ্ঞাত করা হয় না।
    বর্তমান আম্ফানে ভেঙ্গে যাওয়া অধিকাংশ স্থানগুলো স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বে জনগন স্বর্তফুর্ত ভাবে স্বেচ্ছাশ্রমে রিংবাধ দিয়ে পানি আটকেছে। বরাবরেরমত পাউবো একইস্থানে ডিপিএম এর মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছেন। অথচ কয়েক সপ্তাহ ধরে পানির সাখে লড়াই করে যে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা পানি আটকালো তাদেও নুন্যতম আর্থিক সহযোগিতা করা বা নুন্যতম আলোচনা করার ব্যবস্থা করার ব্যবস্থা নেই। একই ভাবে ৬৬ সালে বাঁধ নির্মান সম্পন্ন হওয়ার পর হতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা আজকের অতিরিক্ত জোয়ারের চাপে অগনিতবার বাঁধ ভেগে গেছে। বাঁধ ভেগে গেলে বাধ সংলগ্ন এলাকার মানুষদের জমি ছেড়ে দিয়ে পিছনে চলে আসতে হয়। ভাঙ্গন থেকে শত শত মিটার পিছন দিয়ে রিং বাধ কার হয়। এ রিং বাধ করার জন্য যাদেও জমি নেওয়া হয় বা বাধ ভেঙ্গে নদীর গর্ভে যাদেও জমি চলে যায় সে সকল ক্ষতিগ্রস্থ বা নিঃশ^ মানুষদেও ক্ষতিপূরনের কোন ব্যবস্থা পাউবোর নেই। অথচ সরকারের সকল নির্মানে ক্ষতিপূরন করার বিধি ব্যবস্থার আইন রয়েছে।
    সামগ্রিক বিচেনায় পাউবোর ভেড়ী বাধ ব্যবস্থার পদ্ধতি, নিয়মিত সংস্কার ও তদরকির বিষয় দক্ষিণ-পশ্চিম উপক’লীয় অঞলের জীববৈচিত্র, প্রতিবেশ ব্যবস্থা ও বৈশি^ক জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির আলোকে বিবেচনা করার প্রয়োজনীয় দাবী একজন উপক’লের মানুষ হিসেবে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। গবেষনা ভিত্তিক নয়, অভিজ্ঞার আলোকে স্বচোখে দৃশ্যমান সংকটের নিরসনে নিন্ম লিখিত প্রস্তাব সমুহ দাবী হিসেবে উপস্থাপন ও বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করার প্রয়োজনী কর্মসুচি গ্রহণ জরুরী।
    ১. দক্ষিণ-পশ্চিম উপক’ল তথা উপক’লের জন্য পৃথক একক কতৃপক্ষ তৈরী বা গঠন
    ২. জলবায়ু পরিবর্তন বিবেচনায় নিয়ে জনগণের অভিজ্ঞতা ও মতামতের ভিত্তিতে কমপক্ষে আগামী একশ’ বছরের জন্য স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করতে হবে, প্রয়োজনে ডেল্টাপ্ল্যানে পরিমার্জনা করতে হবে
    ৩. বাঁধের সংরক্ষণ-সংস্কার-মেরামতের ক্ষমতা স্থানীয় সরকারকে প্রদান ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে;
    ৪. পানি উন্নয়ন বোর্ড কেবল কারিগরি সহায়তার প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে;
    ৫. বাধঁ ভেঙ্গে এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ জমি ও মানুষের তালিকা প্রস্তুত ও প্রয়োজনীয় ক্ষতি পূরন প্রদান ও পূর্ণবাসন করতে হবে।
    ৬. . জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে, জাতীয় পর্যায়ে নতুন নতুন শস্যজাত উদ্ভাবনে বরাদ্দ দিতে হবে;
    ৭. পাউবো কতৃক টেন্ডার পদ্ধতি পরিবর্তনসহ সকল কাজের ডিজাইন, বিবরণ ও বরাদ্দ বিষয়ে সকল তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে।
    ৮. উপক’লে খাওয়া ও ব্যবহারের পানির স্থায়ী সমাধানের পন্থা জাতীয় নীতিমালায় সম্পৃক্ত করা ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
    ৯. উপক’লের সাথে যুক্ত সকল মন্ত্রনালয়কে সংযুক্ত করে আন্তঃমন্ত্রনালয় সমন্বয় কমিটি গঠন করতে হবে (ভুমি, কৃষি, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ, পানি সম্পদ, জলবায়ু ও পরিবেশ, স্থানীয় সরকার, স্ব-রাষ্ট্র, স্বাস্থ্য ইত্যাদি মন্ত্রনালয়)
    ১০. বিশেষ দুর্গত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা ও বিশেষ বরার্দ্দ এডিবিতে রাখা।

  • বাংলাদেশের ইতিহাস মোহাম্মাদ নাসিম

    বাংলাদেশের ইতিহাস মোহাম্মাদ নাসিম

    ডেক্স রিপোর্ট :

    মোহাম্মদ নাসিম (২ এপ্রিল ১৯৪৮ – ১৩ জুন ২০২০) বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। তিনি ১৯৯৬ সালেও স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও দলের মুখপাত্র হিসাবে ছিলেন।

    জন্ম ও শিক্ষা জীবন

    মোহাম্মদ নাসিমের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলায়। তার পিতা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী[৩] এবং মাতা আমেনা মনসুর। পিতা মনসুর আলী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে সরকারের মন্ত্রী, স্বাধীন বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।[৪]

    পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশের পর তিনি জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।

    রাজনৈতিক জীবন

    ১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালেও সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে তিনি সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

    ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতির জীবন শুরু হলেও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি প্রভাবে তিনি ছাত্রলীগে যোগদান করেন। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর মোহাম্মদ নাসিমকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সেইসময় দীর্ঘদিন তাকে কারাগারে থাকতে হয়েছে। ১৯৮১ সালের আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন নাসিম। ওই সম্মেলনে আওয়ামী লীগের যুব সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালের সম্মেলনে দলের প্রচার সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০২ সালের আগ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ একটি ছিল। এরপর থেকে বিভাগভিত্তিক সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০০২ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে তাকে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য পদে রাখা হয়। ২০১২ সালের সম্মেলনে তাকে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। পরপর তিন মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।

    ১৯৮৬ সালে নাসিম প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। সিরাজগঞ্জ-১ সংসদীয় আসন (কাজীপুর) থেকে পাঁচবার বিজয়ী হন তিনি। ১৯৯৬ সালে তিনি স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন ১/১১ সরকারের দেওয়া মামলার কারণে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি। ঐ নির্বাচনে তার সন্তান তানভীর শাকিল জয় দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন। ২০১২ সালে কাউন্সিলে তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত করা হয়। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে নাসিমকে মনোনয়ন পান এবং বিজয়ী সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হন।

    ব্যক্তিগত জীবন

    পারিবারিক জীবনে মোহাম্মদ নাসিম বিবাহিত এবং তিন সন্তানের জনক ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম লায়লা আরজুমান্দ।

    মৃত্যু

    রক্তচাপজনিত সমস্যা নিয়ে ২০২০ সালের ১ জুন হাসপাতালে ভর্তি হন নাসিম। ওই দিনই কোভিড-১৯ পজিটিভ আসে তার। এর চার দিন পর, চিকিৎসার সময় তার ইন্ট্রাসেরিব্রাল রক্তক্ষরণ হয়েছিল। এরপর ৪ জুন অবস্থার উন্নতি হয়, তবে পুনরায় ৫ জুন ভোরে তিনি বড় ধরনের স্ট্রোক করেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যার কারণে দ্রুত অস্ত্রোপচার করে আইসিইউতে রাখা হয়। তার চিকিৎসায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বোর্ড গঠিত হয়। এরপর দুই দফায় ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে ছিলেন। এর মধ্যে পরপর তিনবার নমুনা পরীক্ষা করে করোনাভাইরাস অনুপস্থিত পাওয়া যায়। ১২ জুন পরপর কয়েকদিন স্থিতিশীল থাকার পরে পুনরায় অবস্থার অবনতি ঘটে। আজ ১৩ই জুন ঢাকায় বেলা ১১টা ১০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।

  • দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাঁধ ব্যবস্থাপনা

    দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাঁধ ব্যবস্থাপনা

    জিয়াউল হক মুক্তা

    বাংলাদেশে কিছু হলেই আজকাল প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা হয়; এতে নিঃন্দেহে তার ওপর বাড়তি দায়বদ্ধতা ও চাপ আরোপ করা হয়। তার পরও তাকে উদ্দেশ করেই এই লেখা। লিখছি নদীমাতৃক বাংলাদেশের বাঁধ নির্মাণ-সংস্কার-ব্যবস্থাপনা বিষয়ে। শুধু একটি এলাকার বাঁধের কথাই বলছি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্পান-পরবর্তী করণীয় বিষয়ে, আমাদের আইলা-পরবর্তী অভিজ্ঞতা প্রেক্ষাপটে রেখে।
    একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে ২০০৯ সালে আইলার পরপরই দ্রুততর-পুনর্বাসন কার্যক্রমের তদারকি করতে গিয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা ও এর ইউনিয়নগুলোর সকল চেয়ারম্যান-কাউন্সিলর-মেম্বার ও ভুক্তভোগী জনগণ এক আলোচনায় আমাকে জানান যে তারা ত্রাণসাহায্য চান না, বরং চান যত দ্রুত সম্ভব আইলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলোর মেরামত, যাতে তারা ঘরে ফিরতে পারেন। উল্লেখ্য ঘূর্ণিঝড় আইলার পরে প্রায় আট লক্ষাধিক মানুষ প্লাবিত, ঘরবাড়ি জমিজিরাত ফেলে বিভিন্ন বাঁধ ও সড়কের অস্থায়ী ঝুপড়িতে আর বিভিন্ন শহরের বস্তি এলাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছিলেন।
    আইলার আঘাতে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ও খুলনার কয়রা উপজেলার বাঁধগুলোর অনেক স্থানে ভেঙে গিয়েছিল: যেগুলোর কিছু মেরামত করা সম্ভব হলেও শ্যামনগরের গাবুরা ও পদ্মপুকুর এলাকার ভাঙনগুলো মেরামত করতে আমাদের বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান-সিএসআরএলের পক্ষ থেকে আমরা যোগাযোগ রাখছিলাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) স্থানীয়, জেলা, বিভাগীয় প্রকৌশলীদের সঙ্গে ও ইউএনও-ডিসি-বিভাগীয় কমিশনারের সঙ্গে; কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
    অগত্যা আমাদের সংবাদ সম্মেলন, মিডিয়া ভিজিট, সমাবেশ, মিছিল, বাস্তুচ্যুতদের শোভাযাত্রা, কলসি নিয়ে সড়ক অবরোধ, অবস্থান ধর্মঘট আর খুলনায় সাত দিনব্যাপী আইলা-মঞ্চ সংগঠিত করতে হয়েছিল সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের বক্তব্য তুলে ধরার জন্য। প্রধানমন্ত্রী থেকে পাউবোর স্থানীয় প্রকৌশলী পর্যন্ত সংশ্নিষ্ট ২৪ জনকে আমরা প্রায় দুই বছর ধরে বাঁধ ভাঙন-মেরামত আর ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসন-অভিবাসন বিষয়ে জাতীয় ও স্থানীয় পত্রপত্রিকার সমস্ত সংবাদের কপি পাঠিয়েছি রেজিস্ট্রি ডাকযোগে আর তার সারবক্তব্য পাঠিয়েছি ই-মেইল ও ফ্যাক্সযোগে। নিজে তৎকালীন খাদ্য ও দুর্যোগমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এমপির সঙ্গে দেখা করেছি দু’বার। আমাদের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে তিনি ওইসব এলাকায় পরিদর্শনেও গিয়েছেন।
    তখন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পাউবোর খুলনা বিভাগীয় প্রকৌশলীকে পাঁচবার কারণ দর্শানোর চিঠি দেওয়া হয়েছিল। বিভাগীয় প্রকৌশলীকে বদলি করা হয়েছিল দু’বার। আমাদের অনুরোধে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ বরাদ্দও দেওয়া হয়েছিল বাঁধ মেরামতের জন্য। কিন্তু তারও কোনো সুষ্ঠু ব্যবহার হয়নি। এজন্য মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক এমপি তার দ্বিতীয় পরিদর্শনে প্রকাশ্যে-জনসমক্ষে উষ্ফ্মা প্রকাশ করেছিলেন।
    সবশেষে, অগত্যা আমরা বাঁধ মেরামতে সেনাবাহিনী নিয়োগের দাবি জানিয়েছিলাম এবং প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সফরের সবিনয় অনুরোধ জানিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন; তারা বাঁধ মেরামত করেছিলেন এবং তিনি নিজে সে এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। উপরন্তু পরিবারপিছু ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ করেছিলেন ঘর তৈরিতে সহযোগিতা করার জন্য।
    ষাটের দশক থেকে নির্মিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাঁধগুলোর একটা সমস্যা আছে। এগুলোর ডিজাইনে জোয়ার-ভাটাকে বিবেচনায় না নেওয়ায় নদীর তলদেশগুলো উঁচু হয়ে গেছে; ফলে নদীর বাইরের বসতভিটা-জমিজিরাতের উচ্চতা নদীপৃষ্ঠের উচ্চতার চেয়ে কমে গেছে; আর তার ফলে বাঁধ ভাঙনের মতো ঘটনা ঘটলে সহজেই বসতভিটা-জমিজিরাতে দিনে দু’বার নদীর লবণ-পানি ঢোকে আর বেরোয়; আর তার ফলে ভাঙনগুলো আরও প্রসারিত হতে থাকে। আগে প্রয়োজনে পানি ঢোকানো আর বের করার জন্য স্লুইচগেট ছিল, দেখভালের জন্য লোকও ছিল; বর্ণিত পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে স্লুইচগেটগুলো অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় সে লোকবলও প্রত্যাহার করা হয়েছে।
    পাউবো বাংলাদেশের বাঁধগুলোর নির্মাণ-সংস্কার-মেরামতের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। এর কাঠামোগত সমস্যা হলো ভাঙন-নির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে মেরামতের জন্য বাজেট তৈরি করে প্রকল্প দাখিল করলে এটা সরকারের বরাদ্দ পায়; এ প্রক্রিয়ায় বেশ সময়ক্ষেপণ হয়। কিন্তু বাস্তবে ভাঙন একটি তাৎক্ষণিক ঘটনা, কোন ঘূর্ণিঝড়ে কোন বাঁধের কোথায় কতটুকু বিস্তৃতিতে ভাঙবে, তা আগে থেকে অনুমান করা যায় না। এ কাঠামোগত বা প্রক্রিয়াগত দুর্বলতার ফলে পাউবো বাঁধ মেরামতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। এর ফলে অবশ্য তাদের দুর্নীতি করার সুযোগও বেড়ে যায়।
    বাঁধগুলো ভেঙে যায় প্রধানত সেসব স্থানে যেখানে এটা দুর্বল থাকে। নিজে অসংখ্য স্থানে ঘুরে ঘুরে বাঁধগুলো পর্যবেক্ষণ করেছি। বাঁধগুলো দুর্বল হয় মূলত দুই জায়গায়; যেখানে বাঁধ ফুটো করে পাইপ ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষের জমিতে পানি আনা-নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, আর যেখানে নলকূপ বসানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, উভয় ক্ষেত্রে পাউবোর কর্মকর্তারা চিংড়ি ঘেরের মালিকদের কাছ থেকে মাসোহারা পান।
    আরেকটি বিবেচ্য বিষয় হলো, ঠিকাদার ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ভূমিকা। বাঁধ নির্মাণ-সংস্কার-মেরামতের যারা ঠিকাদার, তারা স্থানীয় নন। ফলে যে ঠিকাদার কাজ পান, তিনি ‘বিক্রি’ করে দেন আরেক ঠিকাদারের কাছে। আবার তিনি আরেকজনের কাছে। এভাবে ঠিকাদার রি-চক্রে বাঁধের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ পর্যায়ক্রমে কমতে থাকে। নির্দিষ্ট কাজটি আর হয় না; ড্রেজিংয়ে যেমন তেলচুরি, বাঁধ সংস্কারেও তেমনি মাটি চুরি হয়। নদীতে বা বাঁধ-ভাঙন স্থানে মাটি ফেলার হিসাব রাখার কোনো উপায় নেই। বাঁধের উচ্চতা, উপরে-নিচে তার প্রশস্ততা ও বরাদ্দের তথ্য দিয়ে আমরা একবার ৩০টি স্থানে সাইনর্বোড স্থাপন করেছিলাম, যদিও তা পাউবো বা ঠিকাদারের করার কথা, ঠিকাদাররা সেগুলো তাদের নিয়োজিত লোকদের মাধ্যমে অপসারণ করেছিল।
    দুর্যোগকালে বসতভিটা-জমিজিরাত রক্ষায় নির্বাচিত স্থানীয় সরকার ও জনগণের স্বেচ্ছাশ্রম গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে একটি নতুন ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দুর্যোগে জনগণ সবার আগে তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে যান। এসময়কালে আমরা দেখেছি, চেয়ারম্যান-মেম্বার-জনগণ সকলে কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে মজুরের মতো গায়ে-গতরে খেটে বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করেন। তারা কখনও সফল হন, কখনও হন না। তাদের পরিশ্রমকে নিজেদের কাজ বলে চালিয়ে দেয় পাউবো। আম্পান-পরবর্তীকালেও জনগণ ও স্থানীয় সরকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাঁধ মেরামত করেছেন। এর বাইরে ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথডে পাউবোও কাজ করছে; শ্যামনগরের কাশিমারী ইউনিয়নে রিং বাঁধের কাজ অংশত সম্পন্ন হয়েছে, কিন্তু আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়ন এখনও পুরোটা প্লাবিত। এসব কাজ দ্রুত শেষ করতে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা আশা করছি।
    আর দীর্ঘমেয়াদে, আমরা দাবি করছি, ১. বাঁধের সংরক্ষণ-সংস্কার-মেরামতের কাজ ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারকে প্রদান করতে হবে ও তার জন্য বরাদ্দ দিতে হবে; ২. পানি উন্নয়ন বোর্ড কেবল কারিগরি সহায়তার প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে; ৩. রিং বাঁধের বাইরে জমিহারাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ও পুনর্বাসন করতে হবে; ৪. জলবায়ু পরিবর্তন বিবেচনায় নিয়ে জনগণের অভিজ্ঞতা ও মতামতের ভিত্তিতে কমপক্ষে আগামী একশ’ বছরের জন্য স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করতে হবে, প্রয়োজনে ডেল্টাপ্ল্যানে পরিমার্জনা করতে হবে; ৫. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে, জাতীয় পর্যায়ে নতুন নতুন শস্যজাত উদ্ভাবনে বরাদ্দ দিতে হবে; ৬. সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিসহ সকল কাজের ডিজাইন, বিবরণ ও বরাদ্দ বিষয়ে সকল তথ্য জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে।
    এসব প্রস্তাবনা আমরা তৈরি করেছি ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অডিটোরিয়ামে ও সিরডাপ মিলনায়তনে আয়োজিত দুটি শুনানিতে অংশগ্রহণকারী ক্ষমতাসীন দল ও জোটের সংসদ সদস্য ও সংশ্নিষ্ট সংসদীয় কমিটির সভাপতি, অর্থনীতিবিদ, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, পানি ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিনিধি আর ভুক্তভোগী জনগণের মতামতের ভিত্তিতে।
    সাধারণ সম্পাদক, গ্রামীণ জীবনযাত্রার স্থায়িত্বশীল উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান-সিএসআরএল

  • করোনাকালে শংকিত প্রাণবৈচিত্র্য ও মাতৃভাষা

    করোনাকালে শংকিত প্রাণবৈচিত্র্য ও মাতৃভাষা

    পাভেল পার্থ

    করোনাকালে কত শংকা আর আহাজারি চারদিকে। করোনার নিদান মানুষের সংসার ও চৌহদ্দি চুরমার করে দিচ্ছে। অপরদিকে জাগছে বাস্তুসংস্থানের আরেক মায়াময় চিত্রকলা। করোনাকালে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ প্রশ্নে সজাগ দুনিয়া। জাতিসংঘ পরপর দুটি বৈশ্বিক দিবসের প্রতিপাদ্যেও বিষয়টি ধরবার চেষ্টা করেছে। ২২ মে প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘প্রকৃতির মাঝেই সকল সমাধান’ আর ৫ জুন পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য ‘প্রাণবৈচিত্র্য উদযাপন’। প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে অধিপতি ব্যবস্থার মনস্তত্ত্ব¡ ও রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে এই করোনাকালে বহু আলাপ তুলেছি। প্রতিবেশ প্রশ্নে আমাদের প্রবল মানুষকেন্দ্রিক চিন্তা আজ এক জটিল প্রশ্নের মুখোমুখি। করোনাকালের পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্যকে নাভিকুন্ডে রেখে প্রকৃতি ও সংস্কৃতির পরস্পরনির্ভরশীল একটা সম্পর্ককে আজ বুঝতে চাইবো আবার। বোঝার চেষ্টা করবো একটি পাখি বা মানুষ হারিয়ে গেলে কী হয়? হয়তো অনেক কিছুই। খাদ্যশেকলে টান লাগে, বাস্তুতন্ত্রে চির ধরে। কিন্তু মানুষের সংস্কৃতিতে এর রক্তক্ষয়ী দাগ লাগে। যার যন্ত্রণা সইতে হয় মাতৃভাষাকে। প্রকৃতিতে থেকে ‘নানিদ মাছ’ হারিয়ে গেলে মানুষের ভাষিক সংস্কৃতি থেকেও তা হারিয়ে যায়। আবার যে মানুষের মাতৃভাষায় ‘নানিদ’ আছে সেই মানুষ হারিয়ে গেলে তার নানিদময় ভাষাটিও নিখোঁজ হয়। দুনিয়ায় অজ¯্র প্রাণপ্রজাতি যেমন প্রায় হারিয়ে যাওয়ার রেখায়, তেমনি অনেক মাতৃভাষাও এমনি হারানোর শংকায়। করোনাকালে ‘প্রাণবৈচিত্র্য প্রশ্নটি’ তাই প্রকৃতি ও সংষ্কৃতির এক জটিল সম্পর্ক থেকেই পাঠ হওয়া জরুরি। করোনাকালে দুনিয়া থেকে নিদারুণভাবে হারিয়ে গেছেন লাখো মানুষ। একইসাথে হারিয়ে মালয়েশিয়া থেকে হারিয়ে গেছে সুমাত্রা গন্ডার, হারিয়ে গেছে কত শস্যকণা, পতঙ্গ কী অণুজীব। মানুষসহ প্রাণবৈচিত্র্য নয়, করোনাকালে আমরা হারিয়েছি একটি মাতৃভাষাও। আন্দামান দ্বীপের ‘সারে’ ভাষাটিও হারিয়ে গেছে করোনাকালে, শেষ সারেভাষীর মৃত্যুর ভেতর দিয়ে। করোনার নিদানে তাই প্রাণের বৈচিত্র্য সুরক্ষায় আমাদের বৈচিত্র্যের প্রান্তিকতাকে গুরুত্ব দেয়া জরুরি। কে কীভাবে কেন ঝুঁকিপূর্ণ? সরীসৃপ, পাখি, পতঙ্গ, স্তন্যপায়ী থেকে বিলুপ্তপ্রায় মাতৃভাষা ও আদিজ্ঞান চর্চাকারী সকলকেই বিশেষভাবে বোঝাটা জরুরি। বাংলা বাঘ কী শকুন, ইরাবতী ডলফিন কী চামচ ঠুঁটো বাটান পাখি যেমন সংখ্যায় কম এবং বিলুপ্তির আশংকায় তাই এদের সুরক্ষায় আমাদের বিশেষ মনোযোগ থাকে। একইভাবে রাষ্ট্রের যেসব ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা একেবারেই তলানিতে এবং আদি লোকজ্ঞান চর্চাকারী যারা একেবারেই গোণাগুনতির ভেতরেই পড়েন না সেই সংস্কৃতির সুরক্ষাপ্রশ্নেও আমাদের বিশেষ কারিগরি ও মনোযোগ জরুরি। শেরপুরের মারগ্যান কোচভাষী পরিবার মাত্র ২৮, বান্দরবানের রেংমিটচাভাষী মাত্র ৩০ জন কিংবা দিনাজপুরের কড়াভাষী ৯৮ পরিবার। করোনাকালে ভাষিক সুরক্ষার প্রশ্নে অন্য অনেকের চেয়ে এই মানুষদের সংকট অনেক জটিল এবং এই মাতৃভাষাগুলিও বিপদাপন্ন। করোনাকালে আন্দামান-নিকোবর, আমাজন অরণ্য কী পাপুয়া দ্বীপপুঞ্জসহ দুনিয়াময় বিপদাপন্ন ভাষিক জনগোষ্ঠীর তরে বিশেষ সুরক্ষা মনোযোগ তৈরির দাবি ওঠছে। বাংলাদেশসহ দুনিয়াময় এই মনোযোগের একটা বৈশ্বিক কাঠামো জোরালো হওয়া জরুরি। আর করোনাকালের পরিবেশ দিবসে এটিই প্রাণবৈচিত্র্য উদযাপনের এক বিশেষ বার্তা। মানুষকেন্দ্রিক প্রবল বাহাদুরির বাইরে গিয়ে প্রকৃতি ও সংস্কৃতির জটিল ব্যাকরণ থেকেই আজ আমাদের প্রাণের বৈচিত্র্যকে বুঝতে হবে।

    প্রাণ, প্রকৃতি ও মাতৃভাষা
    অভিন্ন যমজেরা যেমন হয়। একজন চোট পেলে আরেকজন কঁকিয়ে ওঠে। কারো বুকে ব্যথা হলে আরেকজন তড়পায়। ভাষা ও প্রাণবৈচিত্র্যও তেমনি অভিন্ন যমজ। একজন আরেকজনের লগে জড়াজড়ি করে, পালককুসুম মেলে বিকশিত করে যোগাযোগের ময়দান। ভাষা তাই কোনোভাবেই একপাক্ষিক, একসূত্রীয় কোনো মাধ্যম নয়। বনপাহাড় থেকে জন্ম নিয়ে উজান থেকে ভাটিতে সংসার সাজায় নদী। নদীসংসারের চারধার জুড়ে অববাহিকা থেকে অববাহিকায় সেই নদী ঘিরে নি¤œবর্গের জীবনে তৈরি হয় নদীভাষার এক অবিস্মরণীয় ব্যাকরণ। লুটতরাজ রাষ্ট্র কী উন্নয়নের বাণিজ্যদম্ভ যখন সেই নদীকে ফালি ফালি করে হত্যা করে, গুম করে, দখল করে তখন কিন্তু নদীঅববাহিকার নদীভাষা বদলে যেতে বাধ্য হয়। নদী অববাহিকার আপন ভাষা তখন আর যোগাযোগের আপন ‘ঠাহর’ হিসেবে বিরাজিত থাকে না। মেঘকণা, রোদ্দুর, পাথর, অবিরাম জলরাশি, হাজারো ধানের জাত, পাখি, পতঙ্গ, বাঘ কি কুমির, সাপ ও সরীসৃপ, বৃক্ষগুল্মলতা, মাটি, কেঁচো, মানুষ, ব্যাঙের ছাতা কি উঁইঢিবি প্রাণের এমনতর শতকোটি বিন্যাসই তৈরি করেছে মানুষের ভাষাপরিসর। প্রাণবৈচিত্র্যের একটি প্রাণের বিলুপ্তি মানে ভাষা থেকে তার সকল আমেজ ও অস্তিত্ব¡ মুছে যাওয়া। আমন মওসুমের এক ছোট্ট আকারের ধান পিঁপড়ারচোখ। ধানের খোসায় পিঁপড়ার চোখের মতো কালো বিন্দু আছে বলেই এই ধানের এমন নাম। ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণা অঞ্চল এ ধানের আদিবসত। পিঁপড়ারচোখ ধানটি হারিয়ে গেছে। অধিকাংশ সময়ই এসব ঘটনাকে কেবলমাত্র প্রাণবৈচিত্র্যের বিলুপ্তি, পরিবেশ বিপর্যয়, উৎপাদন জটিলতা, কৃষি ঐতিহ্য এসব দিয়েই ব্যাখা করা হয়। কিন্তু একটি ধান হারিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে কোনো ভাষায় ওই ধানসম্পর্কিত রূপকল্প ও শব্দবিন্যাসের যে পরিবর্তন ঘটে আমরা ‘ভাষা পরিসর কী প্রাণবৈচিত্র্য সুরক্ষার’ আলাপে কখনোই তা দেখতে পাই না। এখন পিঁপড়ারচোখ বলতে ধান নয়, কেবলমাত্র পিঁপড়া নামক এক ক্ষুদে পতঙ্গের চোখকেই আন্দাজ করতে হবে।

    একটি পাখি হারিয়ে গেলে কি হয়?
    এই যে করোনাকালে সুমাত্রা গন্ডার হারিয়ে গেলো দুনিয়া থেকে তাতে কী এমন হলো? কিংবা আমাজন কী অস্ট্রেলিয়ায় দাবানলে হারালো কত জানা-অজানা প্রজাতি তাতে কী হবে? হচ্ছে তো বটেই হবে আরো হয়তো অকে কিছুই। দুনিয়ার বাস্তুশেকলে চির লাগবে। প্রকৃতিতে বেসামাল বিশৃংখলা তৈরি হবে। ঠিক যেমন করোনার নিদান। একটি ভাইরাস বাদুড় কী বনরুইয়ের সাথে মিলেমিশে ছিল। হয়তো কোনো সমাজ লোকজ্ঞানে সেসব ব্যবহারও করতো। কিন্তু মানুষ যখনি বাণিজ্য শুরু করলো, মুনাফার বাহাদুরি করলো তখনি এই ভাইরাস মানুষের জন্য বিপদজনক হয়ে ওঠলো। কোনো এলাকা থেকে একটি পাখি হারিয়ে গেলে ওই এলাকার মানুষের ভাষা থেকেও ওই পাখিটি হারিয়ে যায়। ওই পাখি সম্পর্কিত সকল বিশ্বাস-আচার-রীতি হারিয়ে যায়। আমরা বনরুইয়ের কথা টেনেছিলাম। একটাসময় দেশের বর্ষারণ্য, শালবনসহ গ্রামীণ অরণ্যে বনরুই নামে এক প্রাণি ছিল। প্রাণিটির নিদারুণ বিলুপ্তি দেশের অধিকাংশ জাতির ভাষা থেকে এই শব্দ ও বনরুইকেন্দ্রিক ধারণাসমূহ হারিয়ে যাচ্ছে। মান্দিদের আ.চিক ভাষায় বনরুই মানে কাওয়াথি এবং কোচ ভাষায় কাওতাই। কিন্তু নতুন প্রজন্মের মান্দি ও কোচ শিশুদের মাতৃভাষা থেকে শব্দদ্বয় নিদারুণভাবে হারিয়ে গেছে। আজকের কোচ শিশুরা বুঝবেই না ‘ওলামাখরাই’ কী? কারণ লজ্জাবতী এই বানরটি প্রায় দুই দশক আগে শালবন থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছে।

    করোনা-উত্তর দুনিয়ায় ভাষা ও প্রকৃতি
    দেশের মঙ্গোলয়েড মহাজাতির অংশ খাসি, মান্দি, ¤্রাে ও মারমা ভাষায় এক বহুল ব্যবহৃত শব্দ ‘চি’। খাসি ভাষায় এর মানে ভাত, মান্দি ভাষায় জল, ¤্রাে ভাষায় গাছ আর মারমা ভাষায় এর মানে ঔষধ। একই শব্দ, একই উচ্চারণ ব্যঞ্জনা নানান জাতির নানান ভাষায় নানান অর্থ নিয়ে দাঁড়ায়। এটিই ভাষার রূপ, আর ভাষার এই রূপশরীর গড়ে তুলেছে চারধারের প্রাণের অবারিত রূপঐশ্বর্য। ইংরেজিসহ ভাষিক বাহাদুরি প্রতিদিন নি¤œবর্গের ভাষাসমূহকে গলাটিপে হত্যা করছে। প্রতি দু’সপ্তাহে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। গত ১০০ বছরে প্রায় ৪০০০ ভাষা হারিয়ে গেছে। এই করোনাকালে দুনিয়া থেকে কত যে মাতৃভাষা হারাবে কে জানে? কত প্রান্তিক ভাষিক জনগোষ্ঠী সংকটে পড়বে কত রকেমর কে তার খোঁজ রাখবে? কিংবা করোনা-উত্তর দুনিয়া যদি আরো মুনাফার জন্য উন্মত্ত হয়, আরো কারখানা চাঙ্গা করে, আরো কার্বন ছড়িয়ে দেয়, আরো জংগল ও জলাভূমি দখল করে তবে প্রাণবৈচিত্র্য আরো হুমকীর সম্মুখীন হবে। প্রাণ-প্রকৃতির সেই বিনাশও বিপদাপন্ন ভাষাসমূহের টিকে থাকাকে আরো জটিল প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাবে। তার মানে করোনা-উত্তর সময়ে প্রাণবৈচিত্র্যের সুরক্ষা কৌশলকে আমাদের প্রকৃতি ও সংস্কৃতির চলমান প্রান্তিকতার ময়দান থেকেই পাঠ করতে হবে এবং বৈশ্বিক অবস্থান জোরালো করতে হবে।

    লীচোর চলে যাওয়া ও বৈশ্বিক পরিবেশ-প্রশ্ন
    বলা হয়ে থাকে চর্চাকারীর সংখ্যার উপরে কোনো ভাষা টিকে থাকার শর্ত জড়িত। ৫০০০ চর্চাকারী থাকলেও সেই ভাষা টিকবে কিনা তা নিয়ে শংকা থাকে। ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপের গ্রেট আন্দামানিজ ভাষা পরিবারের সারে ভাষার শেষ চর্চাকারী ছিলেন রাজা জিরোকের কন্যা লীচো। করোনাকালে ৪ এপ্রিল তিনি মারা যান। মৃত্যু ঘটে একটি জীবন্ত মাতৃভাষার। লীচো ও সারে ভাষার মৃত্যু আমাদের করোনাকালে আবারো এক বৈশ্বিক পরিবেশ-প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। প্রকৃতি ও সংস্কৃতির প্রান্তিকতাকে আমরা কীভাবে দেখবো? কীভাবে বুঝবো? কেমন উন্নয়ননীতি বহাল রাখবো? কেন বাঘ কী শকুন বা সারে ভাষা কী কোনো আদিবাসী জীবন একই নয়াউদারবাদী ব্যবস্থার ভেতর থেকেও প্রান্তিক হয়ে থাকে? মুষড়ে পড়ে, মুর্মূষু হয়ে ওঠে? দেশ থেকে দুনিয়া এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর ওপরই নির্ভর করছে এই মাতৃদুনিয়ায় সকলের বিকশিত হওয়ার ধারাপাত।
    …………………………………………….
    গবেষক ও লেখক। ধহরসরংঃনধহমষধ@মসধরষ.পড়স

  • শিঘ্রই করোনা চিকিৎসায় সাফল্য আসছে, আশাবাদ গবেষকদের

    শিঘ্রই করোনা চিকিৎসায় সাফল্য আসছে, আশাবাদ গবেষকদের


    ড. দিলীপ কুমার দেব
    ‘করোনা’ টর্নাডোতে বিশ^ বিপর্যস্ত। পৃথিবীর জুড়ে মৃত্যুর আতঙ্ক। সর্বত্র হাহাকার। দিনে দিনে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। মানুষ এখন চরম হতাশায় দিশেহারা। করোনা যুদ্ধে নেমেছে বিশে^র সব দেশ। এমন সময় করোনা মুক্তির আশার আলো দেখাচ্ছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। তাঁরা এখন আলোর দিশা। গবেষকরা বলছেন, আর মৃত্যু নয়, আর হতাশা নয়, শিঘ্রই আসছে করোনা মোকাবিরায় শক্তিশালী অস্ত্র। যে অজানা রোগের কোন ওষুধ নেই, সেই রোগের ওষুধ তৈরীতে একটু সময় তো লাগবেই। তবে সেসময় খুব বেশী দূরে নয়, আশাবাদ চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের। বসে নেই পৃথিবীর কোন দেশ। গবেষকরা কঠিন চেষ্টা করে চলেছেন করোনাকে হারাতে। করোনাযুদ্ধে ভ্যাকসিন ও ওষুধ উদ্ভাবনে দিনরাত কাজ করছে বিশে^র আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে সাফল্য অর্জনকারী দেশসমূহ। গবেষণায় কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, রাশিয়া, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, ইটালী, হংকং, নরওয়ে, ইসরাইল, ভারতসহ পৃথিবীর অন্ততঃ ৮০ টি দেশ। এদের মধ্যে ১০৮ টি গবেষক দল ১০৮ টি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের দাবি করেছে। এর মধ্যে মাত্র ৮টিকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বা মানবদেহে পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা। এছাড়া বিশে^র বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত শীর্ষ ওষুধ প্রস্ততকারী কোম্পানীও ওষুধ তৈরীর কাজ করছে। অধিকাংশ দেশের গবেষণা প্রায়ই শেষের দিকে। শিঘ্রই এই অন্ধকার কেটে গিয়ে আসবে আলোর দিন। করোনা পারস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে। যেখানে চীনের হুবাই প্রদেশের উহান থেকে সর্ব প্রথম করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি ঘটেছে সেই উহান এখন সম্পূর্ণ করোনা মুক্ত হয়েছে। সম্প্রতি সর্বশেষ করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে গেছেন। নিইজিল্যা-, স্পেন, সুইডেন, ফ্রান্স, চীন, ব্রিটেনসহ বিভিন্ন দেশ এখন স্বাভাবিক হয়ে আসছে। এভাবে বাংলাদেশসহ আক্রান্ত সব দেশ করোনা মুক্ত হবে বলে পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ^াস রাখছেন সকল বিশ^াসী মানুষ।
    করোনা ভাইরাস সংক্রমণের চিকিৎসায় বহুল আলোচিত ওষুধ ‘রেমডেসিভির’-এর সাফল্যের ‘সুস্পষ্ট’ প্রমাণ মিলেছে বলে দাবি করেছে আমেরিকা। বিশে^র বিভিন্ন হাসপাতালে ‘রেমডেসিভির’-এর পরীক্ষামূলক প্রয়োগে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের উপসর্গ ১১-১৫ দিনের মাথায় কমেছে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এ্যালার্জি এ্যা- ইনফেকশন ডিজিজ-এর পরিচালক এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিশেষজ্ঞ ডাঃ অ্যাস্থনি ফাউচি। গত ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ বিষয়ক শীর্ষ সংস্থা ফুড এ্য- ড্রাগস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ‘রেমডেসিভির’ প্রয়োগের অনুমতি দিয়েছে। ‘ইবোলা’ ভাইরাসের এই ওষুধটি ‘করোনা’ ভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসায় এখন ব্যবহার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ট ইউনিভার্সিটিতে এখন ‘রেমডেসিভির’ তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে। কোভিড-১৯ পজিটিভ আক্রান্তদের ওপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। করোনা আক্রান্তদের মধ্যে অধিকাংশই সুস্থ হয়ে ওঠছেন। এদিকে বাংলাদেশ ওষুধ প্রশাসন ৪ মে বেক্সিমেকো ফার্মাসিউটিক্যালসসহ দেশের ছয়টি ওষুধ প্রস্ততকারক কোম্পানীকে ‘রেমডিসিভির’ ওষুধ উৎপাদনে অনুমতি দিয়েছে এবং আগামী ২০ মে’র মধ্যে এই ‘রেমডিসিভির’ পাওয়া যাবে বলে আশা করছে ওষুধ প্রশাসন। এই ওষুধ রোগীর শিরায় প্রয়োগ করার জন্য প্রস্তত করা হয়েছে। প্রতিটি ইনজেকশনের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার টাকা। ইবোলা ভাইরাসের ওষুধ হিসাবে এই ‘রেমডিসিভির’ আমেরিকায় প্রস্তত করা হয়েছিল।
    এছাড়াও কিছু নতুন পদ্ধতিরও অবলম্বন করার চেষ্টা চলছে। যেমন, ‘স্টেম সেল’ পদ্ধতির মাধ্যমে চিকিৎসা। সংযুক্ত আরবআমীরশাহীতে ‘স্টেম সেল’ প্রযুক্তির ব্যবহারে চিকিৎসায় সাফল্যের দাবি ইতোমধ্যে সামনে এসেছে। আবুধাবি দাবি করেছে, তারা ‘স্টেম সেল’ ব্যবহার করে করোনার মোকাবিলায় সুফল পাচ্ছে। ‘স্টেম সেল’ চিকিৎসা হলো, রোগীর নিজের রক্ত থেকে ‘স্টেম সেল’ সংগ্রহ করে রোগীর ফুসফুসে ব্যবহার করা হয়। ইতোমধ্যে ৭৩ জন রোগীর দেহে এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করায় সাফল্য এসেছে বলে দাবি করেছে আবুধাবি।
    অন্যদিকে মোনোক্লানাল এন্টিবডি তৈরী করে করোনা চিকিৎসা শুরু করেছে ইসরাইল। ইটালীও এই পদ্ধতিতে কাজ করছে। এই পদ্ধতিতে চিকিৎসায় কোভিড-১৯ ভাইরাস শরীরে ছড়িয়ে পড়ার পক্রিয়া থামিয়ে দেবে। এছাড়া গত ৫ মে ইতালীর গবেষকদের এক বিবৃতিতে বলা হয়, রোমের স্পালানজানি হাসপাপতালের বিশেষজ্ঞরা করোনা নোভেল ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছেন। ইঁদুরের শরীরে প্রয়োগ করে আশাতীত সাফল্য পাওয়া গেছে। করোনা প্রতিষেক হিসাবে মানুষের শরীরে প্রয়োগ করেও সুফল আসবে। তাঁরা এধরনের পাঁচটি ভ্যাকসিন আবিষ্কার করায় সরকারের অনুমোনের অপেক্ষায় আছেন। এই ভ্যাকসিনের মধ্যে সেরা দু’টি অনুমোন গ্রহণে আগ্রহী গবেষকরা।
    তাছাড়া বিশে^র অনেক দেশ এখন প্লাজমা থেরাপী দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেছে। করোনা ভাইরাস থেকে সেরে ওঠা ব্যক্তির রক্তের প্লাজমা সংগ্রহ করে করোনা আক্রান্ত রোগীর শরীরে দেওয়া হচ্ছে। এতে আক্রান্তদের শরীরে করোনা প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাচ্ছে এবং চিকিৎসা সুফল হচ্ছে। ভারতের কেরালা শ্রীচিত্রা তিরুনাল ইনস্টিটিউট ফর মেডিকেল সায়েন্স ও টেকনোলজি এই প্লাজমা থেরাপীর কাজ করছে। এই প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনার মৃত্যুর ঝুকি কমাতে প্লাজমা থেরাপী অধিকতর কার্যকর এবং এই পদ্ধতিতে আক্রান্তদের শরীরে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে এ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করছে। ভারতের ২০ টিরও বেশী মেডিকেল রিসার্স সেন্টার এই থেরাপী নিয়ে কাজ করছে। দিল্লী ও মহরাষ্ট্র স্বাস্থ্যমন্ত্রক প্লাজমা থেরাপী পদ্ধতিতে চিকিৎসায় অনুমোদন দিয়েছে। মহারাষ্ট্র সরকার বলছে, সেখানে ২ জন করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়েছেন। লকনউ জর্জ মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় প্লাজমা থেরাপী নিয়েও কাজ করছে। পশি^মবঙ্গ সরকার এই প্লাজমা থেরাপী শুরু করছে। কলিকাতা বেলেঘাটা ইনফেকশন ডিজিজ (আইডি) হাসপাতাল প্রথম শুরু করতে যাচ্ছে। প্লাজমা থেরাপী চিকিৎসায় ভারতের আইসিএমআর অনুমোদন দিয়েছে। আমেরিকা, স্পেন, চীন, দক্ষিণ কোরিয়াসহ অনেক দেশ এই থেরাপী ব্যবহার করছে। ১৯১৮ সালে স্পেনিশ ফ্লুতে এবং ২০১৪ সালে ইবোলা ভাইরাস সারাতে প্লাজমা থেরাপী সাফল্য এনেছিল। দিল্লীর নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার মাজারে এক তাবলিক জামাতে যোগ দেওয়া ১৪ শত ব্যক্তির মধ্যে ৩৫০ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের ১০ জন ব্যক্তি প্লাজমা দিয়েছেন। আমেরিকার নিউইয়র্কে যারা করোনা ভাইরাসে মৃদু আক্রান্ত হয়ে সেরে গেছেন, তাঁদের ২১ ভাগ শরীরে ভাইরাটির বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরী হয়ে গেছে।
    গত ১৬ মার্চ প্রথমবারের মত করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন পরীক্ষামূলকভাবে মানবদেহে প্রয়োগ করে দি আমেরিকান ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট বা এনআইএস। এই পরীক্ষার পর আরও সাতটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা বায়োটেক কোম্পানী তাদের তৈরী ভ্যাসিন মানবদেহে প্রয়োগ করে। ভ্যাকসিন তৈরীতে একধাপ এগিয়ে চীন। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বা মানবদেহে পরীক্ষার জন্য অনুমোদন পাওয়া ৮টি ভ্যাকসিনের মধ্যে ৫টি চীনের। এছাড়া ২৩ এপ্রিল ইংল্যা-ের অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যায়ের উদ্ভাবিত করোনা ভাইরাসের টিকা ‘শ্যাডক্স১-এনকভ১৯’-এর পরীক্ষামূলক ভাবে মানবদেহে প্রয়োগ শুরু করা হয়েছে। এই টিকা উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যারয়ের জেনার ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিনোলজির অধ্যাপক সারাহ গিলবার্ট। এই টিকা কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ৮০ শতাংশ কার্যকর হবে বলে আশাবাদী গবেষকরা। এই টিকা করোনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ১০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন তৈরীর আশা করছেন তাঁরা। বিশে^র সাতটি জায়গায় এই প্রতিষেধক উৎপাদনের কাজ চলছে। এতে অক্সফোর্ডের অংশীদার হিসেবে রয়েছে যুক্তরাজ্যের তিনটি সংস্থা, ইউরোপের দুটি সংস্থা, চীনের একটি সংস্থা এবং ভারতের একটি সংস্থা। এই মে মাসেই ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতার ফলাফল বোঝা যাবে এবং শিঘ্রই বাজারে পাওয়া যেতে পারে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের টিকা। ভাইরাস প্রতিষেধক তৈরীতে সারাহ গিলবার্টের অতীত সাফল্য রয়েছে। তিনি ও তাঁর গবেষক দল ২০১২ সালে করোনা ভাইরাস গোত্রের সার্স ভাইরাস এবং ২০১৪ সালে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে ছিল, তার প্রতিরোধে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কাজ করেছিলেন। এছাড়াও লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজেও টিকা তৈরীর কাজ চলছে। চীন করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরী করেছে বলে দাবী করেছে। চীনরে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্টোল এ- প্রিভেনশনের পরিচালক ডা: গাও ফু জানান। চীনের দু’টি কোম্পানী প্রতিষেধক তৈরীতে কাজ করছে। এই প্রতিষেধকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন হয়েছে এবং মানবদেহে প্রয়োগ হবে শিঘ্রই। সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাজারে আসতে পারে এই প্রতিষেধক।
    এদিকে অন্যরোগের কয়েকটি ওষুধ নিয়ে বিশ^ব্যাপী অনেক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা করোনা চিকিৎসায় আশাবাদী হয়ে ওঠেছেন। এই ওষুধের মধ্যে ‘হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন’, ‘ক্লোরোকুইন’, ‘অ্যাজিথ্রোমাইসিন’ ও ‘ফ্যাভিপিরাভির’। ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসার জন্য জাপানি কোম্পানী ফুজিফিল্ম তোয়ামা কেমিক্যাল ফ্যাভিপিরাভির ওষুধটি তৈরী করেছিল। ওষুধটির ব্র্যান্ড নাম ‘অ্যাভিগান’। জাপান ওষুধটির ওপর নতুন করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ তৈরী করছে। কোভিড-১৯ আক্রান্ত ২০টি দেশকে এই ওষুধ পরীক্ষার জন্য বিনামূল্যে সরবরাহ করছে জাপান। আরও ৩০টি দেশ এই ওষুধ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ২০১৪ সাল থেকে ‘অ্যাভিগান’ সেদেশের অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এই ওষুধ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশকারী সব দেশগুলোতে বিনামূল্যে ‘অ্যাভিগান’ সরবরাহের কথা জানিয়েছেন, জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোতেগি। চীনের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ‘অ্যাভিগান’ প্রয়োগে তাঁরা সুফল পেয়েছেন। বিশে^র বিভিন্ন দেশ এই ওষুধ নিয়ে গবেষণা শুরু করেছে।
    করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় আলোচিত ‘ক্লোরোকুইন’, ‘হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন’ এবং ‘অ্যাজিথ্রোমাইসিন’ ওষুধের মধ্যে প্রথম দু’টি ওষুধ ম্যালেরিয়া ও রিউমেটয়েড আর্থাইটিসের চিকিৎসায় প্রয়োগ করা হয় এবং ‘অ্যাজিথ্রোমাইসিন’ একটি কার্যকর অতি পরিচিত অ্যান্টিবায়টিক। তবে চিকিৎসকরা বলেন, এই ওষুধগুলোর ব্যবহার খুবই সর্তকতার সাথে করা প্রয়োজন। ‘হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন’ ও ‘অ্যাজিথ্রোমাইসিন’ এই দুটি ওষুধের কম্বিনেশন সম্পর্কে বিশেষ সর্তকতা দরকার। এই দু’টি ওষুধের ভয়ঙ্কর পাশর্^ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। দীর্ঘদিন অধিক মাত্রায় ‘হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন’ ব্যবহার করলে চোখের রেটিনার মারাত্মক ক্ষতি বা অন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আতঙ্কিত হয়ে ঝোকের বশে এসব ওষুধ খেলে বিপদই ঘটতে পারে বলে জানিয়েছে, আমেরিকার ফুড এ- ড্রাগস অ্যাডসিনিস্টেশন (এফডিএ)। এদিকে বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই এই কাজে। নিজেদের সামর্থকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের গবেষকরা এনিয়ে কাজ করে চলেছেন। বাংলাদেশের চিকিৎসকরা কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় ‘হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন’ ও ‘ক্লোরোকুইন’ ব্যবহারে কার্যকর সাফল্য পেয়েছেন। আমেরিকা, ভারত, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ ‘হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন’, ‘ক্লোরোকুইন’ ও ‘অ্যাজিথ্রোমাইসিন’ ওষুধ ব্যবহার করছে। এই ওষুধ এক সপ্তাহ ব্যবহারে অধিকাংশ রোগী সুস্থ হচ্ছেন বলে দাবী করা হচ্ছে। কোভিড-১৯ আক্রান্তদের চিকিৎসায় ‘হাড্রোক্সিক্লোরোকুইন’ ও ‘ক্লোরোকুইন’ কার্যকর বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের বিশেষজ্ঞরা। সোসাইটির পক্ষ থেকে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সম্প্রতি স্ট্যান্ডর্ড ট্রিটমেন্ট গাইডলাইন প্রণয়ন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে এই ওষুধগুলো উৎপাদনে দেশীয় কোম্পানীগুলোকে ইতোমধ্যে অনুমোদন দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর। ভারত সরকার তাদের দেশের ৬ টি ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানীকে ‘হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন’ ‘ক্লোরোকুইন’ ওষুধ প্রস্ততের অনুমোদন দিয়েছে। এদিকে গণস্বাস্থ্য সংস্থার বিজ্ঞানীরা কোভিড-১৯ ভাইরাস পরীক্ষায় কিট আবিষ্কারের সাফল্য দেখিছেন। বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত করোনা ভাইরাস শনাক্তের কিটের নাম ‘জি র‌্যাপিড ডট ব্লট’। এই কিট পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
    ওদিকে পশ্চিমবঙ্গে করোনা টেষ্ট কিট তৈরী করেছে। এই কিট দ্বারা করোনা পরীক্ষার জন্য আইসিএমআর-এর ছাড়পত্র পেয়েছে। এছাড়া ভারতে ‘টুন্যন্ট’ পদ্ধতিতে করোনা ভাইরাস পরীক্ষা শুরু করা হয়েছে। নাক ও মূখের লালারসের নমুনায় কোভিড-১৯ ভাইরাস পরীক্ষায় এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। এই পদ্ধতিতে সহজে এবং দ্রুত ভাইরাস সনাক্ত করা যাবে এবং পোর্টেবল যন্ত্র ব্যবহার করে বাড়ীতে গিয়ে এই পরীক্ষা করা যাবে। এই পরীক্ষা সমূহের অনুমোদন দিয়েছে ভারতের আইসিএমআর।
    ভারতের হায়দ্রাবাদের ভারত বায়োটেক করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরীর চেষ্টা চালাচ্ছে। এছাড়াও ভারতে পাঁচ ধরনের ভ্যাকসিনের ওপর কাজ চলছে। কিন্তু কোভিড-১৯ যখন তখন তার চরিত্র পাল্টাচ্ছে। একটা টাইপ হতে অন্য টাইপে যাচ্ছে। করেনার চরিত্র নির্ধারণ না করতে পারলে প্রতিষেধক তৈরী সম্ভব নয়। করোনার নির্দিষ্ট চরিত্র জানলে সেটাকে ধরে প্রতিষেধক তৈরী সম্ভব হবে। এই চরিত্র নির্ধারণের জন্য ভারতের আইসিএমআর-এর মেডিকেল জার্নালে ভারতের দুইজন বাঙ্গালী বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা হচ্ছেন বিজ্ঞানী ডাঃ পার্থ মজুমদার ও ডাঃ নিধান বিশ^াস। তাঁরা করোনা ভাইরাসের চরিত্র নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁদের গবেষণায় করোনা ভাইরাসের ডিএনএ তে ১১ ধরনের চরিত্রের খোঁজ চলছে। এই নির্দিষ্ট চরিত্রের খোঁজ পাওয়া গেলে এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরীতে গতি আসবে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট লাগাতার ভাবে গবেষণার কাজ করে যাচ্ছে।
    অন্যদিকে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত নাইজেরিয়ার ওজো রাজ্যের গভর্নর সেয়ি মাকেন্দে প্রতিদিন দুইবার সকাল ও সন্ধ্যায় নিয়মিত এক চামচ করে মধুর সঙ্গে কালোজিরার তেল সেবন করে সুস্থ হয়েছেন। গভর্নর সেয়ি মাকেন্দে বলেন, তাঁর বন্ধু ডাঃ মুইদিন ওলাতুনজি কালোজিরার তেল ও মধু খাওয়ার পরামর্শ দেন। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। সেই সাথে তিনি ভিটামিন সি খেয়েছেন। তবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে পবিত্র হাদিস শরীফে কালোজিরার তেল ও মধুর কথাও উল্লেখ রয়েছে। এমনও বলা হয়েছে যে, মৃত্যুব্যতীত সকল রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কালোজিরার তেল কার্যকর এবং মহৌষধ হিসেবে মধুর ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া হিন্দু পৌরাণিক শাস্ত্রে বিভিন্ন চিকিৎসায় ও কবিরাজী চিকিৎসা বিজ্ঞানে মধু মহৌষধী হিসেবে ব্যবহারের কথা উল্লেখ রয়েছে।
    করোনা প্রতিরোধে এলাপ্যাথিক গবেষণা ছাড়াও হোমিওপ্যাথিক বিভিন্ন গবেষণা চলছে বিশে^র বিভিন্ন দেশে। ভারতের হোমিও গবেষকরা করোনা প্রতিষেধক ও চিকিৎসায় গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে অনেক চিকিৎসক করোনার প্রতিষেধক হিসেবে ‘আর্সেনিকাম ৩০’ ব্যবহারের কথা বলছেন। খাওয়ার নিয়ম হিসেবে বলা হয়েছে, সকালে খালি পেটে এক ফোটা করে তিন দিন খেতে হবে এবং একমাস পর অনুরূপ সেব্য। তবে এই প্রতিষেধকের কতটুকু কার্যকর তার ওপর এখনো পরীক্ষা চলছে।
    করোনার ভ্যাকসিন ও ওষুধ আবিষ্কারে গবেষকদের চিন্তা-ভাবনার পাশাপাশি প্রাণঘাতী এই ভাইরাসকে প্রতিহত করতে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন, ‘সরিষার তেল’ ব্যবহারের কথা বলছেন ভারতের যোগ গুরু বাবা শ্রী রামদেব। তিনি বলেন, দুই নাকের দুই ছিদ্রে দুই ফোটা করে ‘সরিষার তেল’ দিয়ে শ^াস টানলে শ^াসযন্ত্রে আটকে থাকা করোনা ভাইরাস পেটে চলে যাবে। এরপর পেটের মধ্যে থাকা এসিড সেগুলো মেরে ফেলবে বলে দাবি করছেন তিনি। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি সর্বভারতীয় একটি সংবাদ মাধ্যমের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে শ্রী রামদেব এসব কথা বলেন।
    এছাড়া আয়ুরবেদিক ও ইউনানীসহ চিকিৎসকদের অভিমত, ভিবিন্ন ভেষজ উপাদান শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং শরীরে বল বা শক্তি বৃদ্ধি করে। এসব উপাদান ব্যবহারে শুধু সর্দি-কাঁশি, গলা ব্যাথা, জ¦র থেকে মুক্ত থাকা যায়। যেমন, কালোজিরা ভাজা নিয়মিত খাওয়া, কালোজিরার তেল বা কালোজিরার ক্যাপসুল, প্রতিদিন অন্ততঃ দুইবার মধু পান করা, টক বা ভিটামিন সি জাতীয় খাবার, লেবু, লেবুর সরবত, লেবু চা, কমলা, তেঁতুল, আমলকি, কাঁচা আম আমের আঁচার, কাঁচা আমের কাসুন্দি, কুল, কুলের আঁচার, চালিতা, আমলকি, কামরাঙ্গা, পাঁকা পেপে, অ্যাপেল, আঙ্গুর, কাঁচা হলুদ, আদা ও গোল মরিচ একত্রে চিবিয়ে খাওয়া, আদা চা, কসুম গরম পানি বেশী বেশী করে খাওয়া, গলায় ব্যাথা অনুভব হলে লবন মিশিয়ে গরম পানির গড়গড়া করা, এতে কোন প্রকার ভাইরাস বা জীবানু থাকলে বিনষ্ট হবে ও গলার ভিতরে চলে যাবে। টাটকা সবুজ শাঁক-সবজি, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি। এছাড়া ফাস্টফুড, হাফ বয়েল ডিম, কাঁচা সবজী না খাওয়া হতে বিরত থাকা।
    তাছাড়া নিয়মিত স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মানতে হবে। খাবার আগে ও পরে সাবান বা হ্যা-ওয়াশ বা সোডা দিয়ে অন্ততঃ ২০ সেকে- ধরে হাত ধুতে হবে। বাসার অধিক ব্যবহার্য জিনিষপত্র স্যানেটাইজার দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। দূরে অবস্থিত আত্মীয়দের ও পরিচিতদের সাথে সম্পর্ক সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে করতে হবে। সকলে একটু কষ্ট শিকার করে নিজ নিজ বাসায় বা বাড়ীতে অবস্থান করতেই হবে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাওয়া যাবে না। যদি বাইরে যেতেই হয় তাহলে বাইরের কোন ব্যক্তির শরীরের সাথে নিজ শরীরে যেন কোন প্রকার স্পর্শ না লাগে। অর্থাৎ বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মত অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি হতে অন্যজন ব্যক্তির কমপক্ষে ৬ ফুট দুরত্বে অবস্থান করতে হবে। ফুলহাতা জামা এবং প্যান্ট পড়তে হবে। হাতে গ্লোপস ও মুখে মাস্ক অবশ্যই পড়তে হবে। ঘরে স্যাভলোন বা ডেটল বা ব্লিসিং পাউডার পানিতে মিশিয়ে জীবানু নাশক তৈরী করে ছিটাতে হবে। বাইরের থেকে আসার পর জুতার তলায় জীবানুনাশক ছিটাতে হবে। ঘরে বসে বসে মানসিক চাপ নেওয়া যাবে না। সকল সময় আনন্দে সময় কাটাতে হবে। ঘরে বসে গান শোনা ও গাঁওয়া, টেলিভিশন দেখা, বই পড়া, লেখালেখি করা, ছবি আঁকা, বাচ্চাদের লেখাপড়া করানো, গল্প করা, গল্প শোনা, পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা, নামাজ পড়া-ইবাদত করা, পবিত্র রমজানের সিয়াম সাধনায় নিজেকে ব্যস্ত রাখা, প্রার্থনা করা, কম্পিউটারে কাজ করাসহ বিভিন্ন সুন্দর চিন্তা ভাবনায় সময় কাটাত হবে।
    করোনা সংকটে মানুষকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন বিশে^র চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীরা। সেই সাথে সার্বক্ষণিক প্রশাসন, পুলিশকর্মী, গণমাধ্যমকর্মী ও সমাজকর্মী অসুস্থ মানুষের পাশে রয়েছেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, পরম দয়ালু আল্লাহ পৃথিবীতে এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি, যে রোগের কোন চিকিৎসা নেই। আশা হত নয়, আশার আলো ফুটবেই। দুর্যোগ আসে, আবার দুর্যোগ কেটে যায়, দুর্যোগ মোকাবিলা করেই বাঁচতে হয়। দুর্দিন আসছে, আসবেই সুদিন। নিরানন্দ যেখানে, আনন্দও সেখানে। নদীর এপাড় ভাঙ্গলে ওপাড় গড়বেই। আস্তে আস্তে সব কঠিন সমস্যা কেটে যাবে। এখন এক বিশ^, এক সমস্যা, এক চিন্তা, সব সমস্যা দূর হয়ে আসবে আলোর সুদিন। অপ্রতিরোধ্য মহাসংকটে প্রতিমুহূর্তে লড়াই করে মানুষ সকল সময়ই জয়ী হয়েছে। ভয় নাই, করোনা যুদ্ধেও মানুষ জিতবেই করুণাময়ের কৃপায়।(তথ্য সূত্র: বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও সংবাদ মাধ্যম)

  • করোনাকাল, লোকজ্ঞান ও প্রকৃতির বিজ্ঞান

    করোনাকাল, লোকজ্ঞান ও প্রকৃতির বিজ্ঞান

    পাভেল পার্থ

    করোনাকালে আবারো স্পষ্ট হয়ে ওঠছে লোকজ্ঞান ও প্রকৃতির শক্তি। কিন্তু অধিপতি পাটাতনে এই জ্ঞানভাষ্য অস্বীকৃতই থেকে যাচ্ছে। কারণ কী? লোকায়ত জ্ঞানের সাথে বিদ্যায়তনিক বাহাদুরির ঐতিহাসিক বিরোধ? নাকি এখনো বড় হয়ে থাকছে নির্দয় শ্রেণিপ্রশ্ন? ঐতিহাসিকভাবেই অসুখ ও মহামারী সামালে গ্রাম-বাংলায় গড়ে ওঠেছে নানা লোকভাষ্য, বিজ্ঞান ও সুরক্ষাবিধি। কলেরা থেকে কালাজ্বর কী বসন্তের সেইসব কাল সামাল দিতে লড়েছিল গণমানুষের বিজ্ঞানশক্তি। অথচ এই করোনারকালে আমরা সেইসব লোকায়ত প্রচেষ্টাগুলোকে একত্র করতে পারিনি। সঙ্গনিরোধ বা কোয়ারেন্টাইন, লকডাউন বা ঘরবন্দি এবং লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা। করোনা মোকাবেলায় এখনো এই তিনটি বিষয়ই বৈশ্বিকভাবে মানছে সবাই। মহামারী বা কঠিন অসুখ মোকাবেলায় এই পদ্ধতিগুলোই তো ঐতিহাসিকভাবে লোকায়ত জ্ঞানের উদ্ভাবন। এককভাবে কোনো মানুষ বা প্রতিষ্ঠান নয়, এসবের চল শুরু হয়েছিল সামষ্টিকভাবে মানুষের লোকায়ত জীবনের যৌথতায়। এখনো এর টাটকা প্রমাণ বয়ে চলেছে অনেক সমাজ।

    মহামারী মোকাবেলার লোকবিজ্ঞান
    এই যে বলা হচ্ছে মানুষ লকডাউন মানছে না, সঙ্গনিরোধ করছে না। কিন্তু কারা মানছে না একবার কী তলিয়ে দেখা যায়? দেশের গরিষ্ঠভাগ আদিবাসীরাই কিন্তু মানছে এই লকডাউন ও সঙ্গনিরোধ। এইসব শব্দ অনেক গ্রাম কী পাড়ায় পৌঁছানোর আগে থেকেই নিজেরা এই সুরক্ষাবিধি তৈরি করেছে নিজেদের মত করেই। ব্যক্তি নয়, মহামারী মোকাবেলাকে লোকায়ত জ্ঞানে সামষ্টিক কাজ হিসেবে দেখা হয়। আর লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসাই লোকায়ত চিকিৎসাবিদ্যার প্রধান সূত্র। চাকমা তালিক, মারমা বৈদ্য, মান্দি খামাল কি মণিপুরী মেইবাদের চিকিৎসাবিদ্যা কী গ্রামীণ কবিরাজি সবই লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসাকে গুরুত্ব দেয়। অসুস্থ ও আক্রান্তের ইতিহাস, তার পরিবেশ-প্রতিবেশ, সমাজে নানামুখী সম্পর্ক এসব জানতে চায়। আর এই লোকায়ত চিকিৎসায় গুরুত্ব পায় প্রাকৃতিক জিনসম্পদ। একতরফাভাবে ‘ভেষজ বা টোটকা চিকিৎসা’ নামে এই লোকায়তবিজ্ঞানকে দাবিয়ে রাখলেও সহ¯্র বছর ধরে এই বিজ্ঞানই দুনিয়াকে দিয়ে চলেছে বেঁচে থাকবার সব অবিস্মরণীয় পথ্য ও জোগান। এই করোনাকালেও অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানী, চিকিৎসক কী গণমাধ্যম পরামর্শ দিচ্ছে গরম পানি, ভিটামিন সি, আদা, রসুন, কাঁচা হলুদ, নিম, কালোজিরা, আমিষ, গোলমরিচ, লবঙ্গে গ্রহণের মতো নানা লোকবিধির। এইসব কার আবিষ্কার? কার উদ্ভাবন? করোনার মতো লক্ষণে এইসব পথ্য ও সুরক্ষাবিধি তো লোকায়ত চিকিৎসাবিদ্যার নিজস্ব ফসল। তার মানে এই দাঁড়ায় শ্রেণিপ্রশ্নে নি¤œবর্গের হলেও লোকায়ত জ্ঞান অভিজ্ঞতাই এই করোনাকালে বিশ্বের লাখো মানুষের সহায় হচ্ছে। কিন্তুসংকট সামালে নি¤œবর্গের এই জ্ঞানভাষ্য ও বিধির অবিস্মরণীয় অবদানকে আমরা তো এখনো মর্যাদা দিতে শিখিনি। অনৈতিহাসিক করে রাখি এর ভূমিকা।

    লোকায়ত লকডাউন
    আদিবাসীরা কেন নিজেদের মতো লকডাউন চালু করতে পেরেছে? নতুন অসুখ আর মহামারী থেকে বাঁচতে আদিবাসী সংস্কৃতিতে হাজার বছর ধরেই লকডাউন, আইসোলেশন, সঙ্গনিরোধের চল আছে বলেই এটি এসব সমাজে এতোটা সহজ হচ্ছে। বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় ¤্রােদের ভেতর অসুখ ও মহামারী থেকে বাঁচার জন্য গ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার যে কৃত্য পালিত হতো একসময় তার নাম আং ডুব। আশেপাশে কোথায় মহামারীর বিস্তার হলে গ্রামের লোকেরা একত্র হয়ে কিছুদিন গ্রামেক বিচ্ছিন্ন রাখার প্রস্তুতি নিতেন। জংগলের ঝিরি-ছড়া থেকে ভোর বেলা ¯œান সেরে তুলে আনা হতো ছোট ছোট পাথর। এইসব পাথরে মহামারী তাড়ানোর মন্ত্র লেখা হতো সুইয়ের আঁচড়ে। গ্রামের সবাই কাপাস তুলোর সূতা দিয়ে গ্রামের চারধারে বাঁধন দিতেন। গ্রামের সকল প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয়া হতো। প্রতিটি প্রবেশপথে মাটির তলায় গুঁজে রাখা হতো মন্ত্রপুত পাথর। চলতি করোনাকালেও ¤্রােরা আংডুব কৃত্যের মাধ্যমে পূুয়াভং বা গ্রাম লকডাউন করেছেন। রাঙামাটি ও বান্দরবানের পাংখোয়া আদিবাসীরাও একসময় বড়ধরণের অসুখ ও মহামারী সামাল দিতে নানা কৃত্য পালন করতো একসময়। ঝিরি থেকে ছোট পাথর সংগ্রহ করা হয় এবং এই পাথরে মহামারীর বিরুদ্ধে মন্ত্র আঁকা হয়। পাংখোয়া ভাষায় এই কৃত্যকে ‘লুংতেরঙেট ইন তোয়ালে রিত’ বলে। এরপর শুরু হয় গ্রামবন্ধের কাজ। পাংখোয়া ভাষায় একে খোয়া খার বলে। খোয়াখারের সময় ঘরে বহিরাগত কেউ গ্রামে ঢুকতে পারে না, গ্রাম থেকে কেউ বাইরেও যেতে পারে না। এমনকি গ্রামের ভেতরেও যারা থাকে তাদেরও ঘরে প্রবেশের পূর্বে ঘরের সামনে জ্বালানো আগুনে হাত-পা সেঁকে ঘরে ঢুকতে হয়। পাংখোয়া ভাষায় এই রীতিকে বলে ‘মেই রাকান’। লকডাউনের মান্দি কৃত্যের নাম দেনমারাংআ, লেঙাম ভাষায় খাং চোনং, চাকমারা বলে আদাম বন গারানা, খাসিরা বলে খাং খারদেপ সোনং, কোচ-বর্মণদের ভেতর গেরামপূজার মাধ্যমে ও ত্রিপুরাদের ভেতর কের পূজার মাধ্যমে গ্রাম লকডাউন করা হয়। কেবল আদিবাসী সমাজ নয়, প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র কি সংহিতাতে মহামারী নির্মূলে লকডাউন ও সঙ্গনিরোধের কথা উল্লেখ আছে। তার মানে কোনো রোগ বিস্তার ও সংক্রমণ রোধে এই লকডাউন ‘বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা’ প্রদত্ত কোনো নতুন ধারণা নয়। এটি জনসমাজে প্রচলিত মহামারী সামালের এক লোকায়ত কায়দা, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা যার নাম দিয়েছি ‘লকডাউন’।

    চেনা পথ্য, জানাশোনা চিকিৎসক
    কেবল বহুজাতিক ভ্যাকসিন কী করোনা সামাল দিতে পারে? সমাজের খাদ্যাভাস, স্বাস্থ্যবিধি, জীবনযাপনের ধরণ এবং এমনকি মানুষের জিনগতবৈচিত্র্যও এখানে প্রভাব রাখে। মঙ্গোলিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, তাইওয়ান, মিয়ানমার কিন্তু বেশ যুতসইভাবেই সামাল দিচ্ছে এই সংকট। উত্তর-পূর্ব ভারতেও এর ব্যাপক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েনি। ঠিক যেমন এখনো বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে সংক্রমণ কম। কিংবা শ্রীলংকা কিভাবে সামাল দিচ্ছে এই করোনাকাল? উল্লিখিত দেশগুলোর খাদ্যসংস্কৃতি ও স্বাস্থ্যবিধির অনেকখানিই এখনো প্রকৃতিনির্ভর এবং ভেষজপন্থী। মানুষের রোগপ্রতিরোধক্ষমতা তৈরিতে এই প্রকৃতিবিজ্ঞানের নিশ্চিত ভূমিকা আছে। লোকায়ত স্বাস্থ্যবিধির মূলে আছে পথ্যের সাথে মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক। কিন্তু আজকের চিকিৎসাদুনিয়া নিয়ন্ত্রণ করা বহুজাতিক ঔষধ কোম্পানির শিশি বোতল কী প্যাকেটে কী থাকে আমরা ক’জন তার খোঁজ রাখি? এমনকি গ্রামীণ সমাজের এক একজন অভিজ্ঞ লোকায়ত চিকিৎসক চারধারের মানুষের বেড়ে ওঠার সাথে জড়িত। রোগ নির্ণয় ও লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসায় তাই রোগীর ইতিহাস ও নির্ঘন্ট নানাভাবে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা তৈরি হয়। কিছু অভিজ্ঞ আদিবাসী লোকায়ত চিকিৎসকের সাথে আলাপ হলে তারা জানান, করোনার লক্ষণের মতো রোগের পথ্য ও বিধি কিছুটা তাদের জানা। মহামারীর মতো এক নির্দয় পরিস্থিতি সামালে আজকে এমন লোকায়ত চিকিৎসাবিদ্যাকেও সামগ্রিক কৌশলে যুক্ত করা জরুরি। এমনকি আর্য়ুবেদ, হোমিওপ্যাথি, ইউনানী ও গ্রামীণ কবিরাজিওকে। হয়তো করোনা মোকাবেলার এভাবেই রাষ্ট্রীয় বহুত্ববাদী চিকিৎসার রূপ তৈরি হতে পারে।

    অসুখের দর্শন
    আদিবাসীসহ গ্রামীণ নি¤œবর্গ মনে করে মানুষের অসুখ হলো প্রকৃতির কোনো যন্ত্রণার নির্দেশনা। বৃক্ষের বর্ষবলয়ে যেমন খরা কী প্লাবণের দাগ থাকে, মানুষের শরীর কী স্মৃতিতেও অসুখের দাগ রয়ে যায়। অসুখ ও মহামারী সম্পর্কিত লোকায়ত কৃত্যগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসব কৃত্যে উচ্চারিত প্রার্থনায় কেবল মানুষ নয় চারধারের প্রাণের সুস্থতার প্রার্থনা জানানো হয়। বাঁশের মড়ক যেমন ইঁদুর-বন্যা কী শকুনের অনুপস্থিতি যেমন গরুর অ্যানথ্রাক্স। নির্দয়ভাবে কাটা হলে গাছ, সমূলে বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য বিস্তার ঘটলে একসময় মানুষও রেহাই পাবে না। আদিবাসীরা অনেক আগে থেকেই এই হুঁশিয়ারি দুনিয়াকে জানিয়ে আসছিলো। নয়াউদারবাদী দুনিয়া কথা শোনেনি। কেবল করোনা নয়, প্রমাণিত হয়েছে গরিষ্ঠভাগ মহামারীর পেছনে আছে বন্যপ্রাণীর দশাসই বাজার। করোনাকালে আমাদের অসুখের দর্শনটা বদলানো দরকার। প্রকৃতির শরীরেই মানুষের অসুখের চিহ্ন আছে। সেই লক্ষণ বোঝার মতো দক্ষতা ও সাহস তৈরি হোক প্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসাবিদ্যায়।

    ভোগ নয়, সুরক্ষাই জীবনের নীতি
    করোনাকালে দিনাজপুরের সাঁওতাল সমাজ বাহা পরবে পবিত্র জাহেরথানে সম্মিলিত প্রার্থনা করে শালফুল গ্রহণ করেছে। প্রকৃতির কোনো স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ কী রঙ নি¤œবর্গের সমাজে গ্রহণের আগে নতজানু হতে হয়। প্রার্থনা করতে হয়। আর এভাবেই তৈরি হয়েছে সকল লোকায়ত কৃত্য। কোন মাসে, কোন ঋতুতে কি কি বিধিনিষেধ তা এখন কয়জন জানে? আর মানেইবা কতজন? নয়াউদারবাদী জীবনে প্রকৃতিঘনিষ্ঠ কোনো বিধিনিষেধ নেই। এখন সারাবছর বাজারমুখী শস্যফসল মেলে। কোনোকিছু দেখে বোঝার উপায় নেই এটা কোন ঋতু। লোকায়ত জীবনের বীক্ষা ভোগ নয়, সুরক্ষা। প্রাণ ও প্রকৃতির ভেতর সম্পর্ককে বোঝার জন্য একটা জীবনের সাথে আরেকটা জীবনের যোগাযোগ। লোকায়ত জ্ঞান আর প্রকৃতির বিজ্ঞানের এই সুরক্ষানীতিই আজ আমাদের করোনার নিদান থেকে আবারো তরতাজা করে তুলতে পারে। যদি আমরা ভোগকে বাতিল করে নতজানু হই সুরক্ষামিছিলে।

    গবেষক ও লেখক। ই-মেইল: ধহরসরংঃনধহমষধ@মসধরষ.পড়স

  • করোনা কালীন দুর্যোগ মোকাবেলায় কৃষি খাতে করণীয় প্রস্তাব

    গবেষণা, তথ্য সংগ্রহ ও সংকলন: মাহা মির্জা

    সাধারণভাবে অনিশ্চয়তায় ভরা কৃষকদের জন্য করোনাকালে বিপর্যয় গভীর সংকট তৈরি করেছে। এই সংকটের উৎস কৃষিখাতে বিদ্যমান বিভিন্ন বৈরী নীতি এবং করোনা কারণে বিদ্যমান বিধিনিষেধ। এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে এই লেখায় কৃষি খাতের জন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন করণীয় প্রস্তাব করা হয়েছে।

    দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৮ ভাগ কৃষিতে নিযুক্ত। এই কৃষকদের বড় অংশই জমির মালিক নন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) রিপোর্ট (২০১৮) অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ২ কোটি ৪৩ লাখের বেশি মানুষ কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে পারিবারিক সহকারী : ৮৭ লাখ ৬৫ হাজার জন বা প্রায় ৩৫ শতাংশ; স্ব-কর্মসংস্থান: ৮১ লাখ ৭৭ হাজার বা প্রায় ৩৩ শতাংশ; কৃষিশ্রমিক: ৭২ লাখ ৯১ হাজার জন বা প্রায় ৩০ শতাংশ; এবং অন্যান্যভাবে নিয়োজিত: ১ লাখ ৬৮ হাজার শ্রমিক।

    দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বছরের পর বছর কৃষিতে ব্যক্তিগত লোকসানের ভার বইতে হচ্ছে কৃষককে। অথচ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএওর (২০১৯)-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের কৃষক ২০১৭ সালে যে কৃষিপণ্য উৎপাদন করেছেন, তার আর্থিক মূল্য প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। অনেকের মতেই, জমির মালিকানার পরিবর্তন বা ভূমি সংস্কার ছাড়া বাস্তবে কৃষকের অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব না। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায় অন্ততপক্ষে বর্গা কৃষককে কীভাবে সরকারি ঋণ ও প্রণোদনার আওতায় আনা যায়, এই বিষয়টি নিয়ে অনেকেই ভাবছেন। বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাবে কৃষিকাজ কিছুটা চলমান থাকায় সকল কৃষক যদিও কর্মহীন হয়ে পড়েননি, তবে পরিবহন সংকটের কারণে উৎপাদিত ফসল ও সবজি ঠিক সময়মতো বাজারজাত করতে না পারায় এবং দুর্যোগের সুযোগে ফড়িয়াদের সিন্ডিকেটের ফলে সবজির দাম পড়ে যাওয়ায় দেশের প্রতিটি অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষক বিপুল লোকসানের সম্মুখীন হয়েছেন।

    বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সর্বজনকথার পক্ষ থেকে কৃষি খাতের জন্যে একটি দুর্যোগকালীন সহায়তা প্রস্তাব তৈরী করা হয়। প্রস্তাবে কৃষি খাতের বহুমুখী বাস্তবতা ও চাহিদা বিবেচনা করে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি, এবং দীর্ঘমেয়াদি করণীয়গুলো উত্থাপন করা হলো।

    স্বল্পমেয়াদে করণীয়

    বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাবে পরিবহণ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় কৃষকের পক্ষে তাদের উৎপাদিত শস্য/সবজি পাইকারি বা খুচরা বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছেনা। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষকের দুরবস্থার খবর আসছে। উত্তরবঙ্গের সবজি উৎপাদনকারী কৃষকেরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। বিভিন্ন জেলায় টমেটো, শশা, বেগুন, লাউ, কুমড়া, মরিচ সহ নানারকমের সবজির দাম কেজিতে মাত্র ৪-৫ টাকায় নেমে এসেছে। দিনাজপুরের কৃষক ৫০ পয়সা কেজিতে শশা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন এমন খবরও আমরা পাচ্ছি। পরিবহন সংকটের পাশাপাশি ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেও কৃষক দাম পাচ্ছেননা এমন অভিযোগও আছে।

    উত্তরবঙ্গের সবজি উৎপাদনকারী কৃষকেরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন। বিভিন্ন জেলায় টমেটো, শশা, বেগুন, লাউ, কুমড়া, মরিচ সহ নানারকমের সবজির দাম কেজিতে মাত্র ৪-৫ টাকায় নেমে এসেছে। দিনাজপুরের কৃষক ৫০ পয়সা কেজিতে শশা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন

    এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সবজি-কৃষকদের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে এবং উৎপাদিত সকল শস্য নষ্ট হওয়া থেকে বাঁচাতে স্বল্পমেয়াদে বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:

    ১. স্বাস্থ্যবিধি মেনে পাইকারি বাজার চালু রাখা

    বর্তমানে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে খুচরা বাজার সকাল ৯টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত চালু থাকে। অথচ পাইকারি বাজারগুলো বন্ধ রাখা হচ্ছে। সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখতে পাইকারি বাজার গুলো ন্যূনতম ৫ ঘন্টা চালু রাখা জরুরি। বহু এলাকায় ক্ষেত থেকে সবজি বা অন্যান্য পচনশীল শস্য পাইকারি বাজার পর্যন্ত পরিবহণ করার মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ ভ্যান নেই। কাজেই বিদ্যমান ২-৩টি ভ্যানকে ১০ থেকে ১৫ বার ক্ষেত থেকে বাজার পর্যন্ত আসা যাওয়া করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ। কাজেই পাইকারি বাজারগুলো নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা রাখতে হবে। প্রয়োজনে পৌরসভার অধীনে থাকা গাড়ি গুলো কাজে লাগাতে হবে। প্রশাসনের কর্মীরা সরাসরি স্বাস্থবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে নিবিড় তদারকি করবেন।

    ২. জনসমাগম ঠেকাতে ঢাকার মাঠগুলোকে বাজার হিসাবে কাজে লাগানো

    বাজারে অতিরিক্ত জনসমাগম ঠেকাতে ঢাকার ভিতরের খোলা মাঠগুলোকে বিভিন্ন এলাকার বাজার হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সিটি কর্পোরেশনের অধীনে মহাখালী, সায়দাবাদ এবং কারওয়ান বাজারে ইতিমধ্যেই বাজার বসানোর পর্যাপ্ত জায়গা আছে। এছাড়াও ঢাকার অন্যান্য খালি মাঠগুলোকেও বাজার হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রশাসনের কর্মীরা সরাসরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে নিবিড় তদারকি করবেন। এছাড়াও প্রতিটি এলাকার ওয়ার্ড কমিশনের পক্ষ থেকে এলাকার ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালা/মাছ, ফল বা সবজি বিক্রেতাদের মধ্যে মাস্ক ও স্যানিটাইজার সরবরাহ করতে হবে। খাদ্য বিক্রির সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবীদের কোনোভাবেই হয়রানি করা যাবে না।

    মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে করণীয়

    ১. আসন্ন বোরো মৌসুমে ক্ষেতমজুর সংকট ও করণীয়

    দেশে প্রায় ৪৭-৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়। এই বিপুল পরিমাণ ধান কাটার ক্ষেত্রে প্রতিবছরই ক্ষেতমজুর সংকট দেখা দেয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণা বলছে, হাওড় অঞ্চল হিসেবে পরিচিত সাত জেলা সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবার মোট বোরো আবাদ হয়েছে নয় লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে, যার অর্ধেক সমতলে, বাকিটা মূল হাওড়ে। এসব জমির ধান কাটতে মোট শ্রমিকের প্রয়োজন প্রায় ৮৪ লাখ জন। কিন্তু সেখানে শ্রমিকের ঘাটতি আছে ১৫ লাখ জনের বেশি, যা মোট প্রয়োজনের ১৮ শতাংশ। ফলে এ সময়ে প্রায় ২৫ দিনের জন্যে প্রতিদিন প্রায় ৬৬ হাজার অভিবাসী শ্রমিকের প্রয়োজন রয়েছে সেখানে (বণিক বার্তা, এপ্রিল ১৬, ২০২০)।

    বর্তমানে পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। চলতি মৌসুমে অন্য জেলা থেকে শ্রমিক যেতে পারছেন না সেখানে। ফলে এবার শ্রমিক সংকট আরো তীব্র হবে। অবশ্য সরকার ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের ধান কাটার কাজে লাগানো হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, শ্রমিক সংকট এড়াতে এরই মধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। দেশের শ্রম উদ্বৃত্ত জেলাগুলো থেকে শ্রমিকদের হাওড় অঞ্চলে পাঠানোর জন্য তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। এরই মধ্যে মাঠ পর্যায়ের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তারা শ্রম উদ্বৃত্ত জেলা বিশেষ করে মেহেরপুর, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, জামালপুর, ময়মনসিংহসহ পার্শ্ববর্তী জেলাগুলো থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় হাওড়ে শ্রমিক নিয়ে যাওয়ার তালিকা করেছে। এরই মধ্যে শ্রমিক যাওয়া শুরু হয়েছে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা তাদের তালিকা প্রস্তুত করে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন (বণিকবার্তা, এপ্রিল ১৬, ২০২০)।

    এক্ষেত্রে এক অঞ্চলের শ্রমিক অন্য অঞ্চলে পরিবহণের কাজটি করতে হবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক পরিবহণ (ট্রাক/বাস) ব্যবহার করতে হবে। ঠাসাঠাসি বা গাদাগাদি করে শ্রমিক পরিবহণ করা যাবেনা। সেই সঙ্গে কৃষি শ্রমিকের স্বাস্থ্য বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার জন্যও সঠিক নির্দেশনা থাকতে হবে। হাওড় অঞ্চলে যেসব ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত রোগীর সেবায় নিয়োজিত নন, তাদের বোরো ধান কর্তনকালীন কৃষি শ্রমিকদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত করা যেতে পারে। এছাড়া কেউ কেউ মনে করেন, এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে শ্রমিক পরিবহণের ক্ষেত্রে দেশের বড় পরিবহণ ব্যবসায়িদের কাজে লাগানো যেতে পারে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দেশের উদ্বৃত্ত অঞ্চল থেকে শ্রমিক ঘাটতি অঞ্চলে যাতায়াদের ক্ষেত্রে এসব পরিবহণ ভূমিকা নিতে পারে।

    ২. ধান/চাল কেনা ও সরকারের মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো

    এবারে বোরো ধানের লক্ষমাত্রা প্রায় ২ কোটি টন। অথচ সরকার ধান-চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে মাত্র ১৯ লাখ টন, যা একেবারেই পর্যাপ্ত নয়। সরকারকে ধাপে ধাপে ধান কেনার লক্ষমাত্রা বাড়াতে হবে। এদিকে সরকারি গুদামের ধারণ ক্ষমতা ২০ লাখ টনের কিছু বেশি। প্রশ্ন উঠেছে, সরকার সাধারণ সময়ের চেয়ে বেশি ধান-চাল কেনা শুরু করলে তা রাখবে কোথায়? অনেকেই প্রস্তাব করেছেন, প্রশাসনিক তালিকা তৈরি করে বোরো মৌসুমের ধান কৃষকদের কাছেই রেখে দেয়া যেতে পারে। সরকার ধাপে ধাপে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকেই এই ধান কিনে নেবে। আর দীর্ঘমেয়াদে সরকারের নিজস্ব মজুদ সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।

    কৃষকের ধান মজুদের সক্ষমতা বাড়ানো

    পূর্বের মতো প্রতি গৃহস্থ ঘরে একাধিক ধানের গোলা না থাকায় কৃষক পর্যায়ে ধান রাখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কিনা সেটাও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রস্তাব এসেছে: ক) উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে যেসব অডিটরিয়াম বা কমিউনিটি সেন্টার আছে সেগুলো ২-৩ মাসের জন্যে ভাড়া নিয়ে দ্রুত ধানের গুদামে পরিণত করে ফেলা যেতে পারে। খ) কৃষকদের টিন ও আনুষঙ্গিক কিছু উপকরণ প্রণোদনা আকারে দিলে কৃষক নিজের সুবিধা অনুযায়ী ধানের গোলা বা ছোট ছোট গুদামঘর তৈরি করে নিতে পারে। গ) প্রশাসনের উদ্যোগে উপজেলা পর্যায়ে বা ইউনিয়ন অফিসগুলোর সামনে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নিয়ে খালি পড়ে থাকা মাঠে অস্থায়ী ধান গুদাম তৈরি করাও দুরূহ নয়। এছাড়া ধানের গুদামঘর তৈরি ও তার ব্যবস্থাপনা কারিগরী দিক থেকে কঠিন কোন কাজ নয়। কৃষকরাই পালা করে এসব গুদামের নিরাপত্তা প্রদান করতে পারবেন।

    এর পাশাপাশি ধান থেকে চাল তৈরির সবগুলো বড় মিলকে আগামী কয়েক মাস সরকারের নিবিড় নজরদারিতে রেখে কাজে লাগাতে হবে। সরকার তার ক্রয়কৃত ধান নির্ধারিত দাম দিয়ে চাল করিয়ে নিবে এবং নিয়মিত বিতরণ করে যাবে। এছাড়া স্থানীয় চাতালগুলোকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজে লাগাতে হবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় চালের বাজার স্থিতিশীল থাকবে।

    সরকারি গুদামের সক্ষমতা বৃদ্ধি

    দীর্ঘমেয়াদে সরকারি গুদামের সক্ষমতা ধাপে ধাপে বাড়াতে হবে। প্রতি জেলায় সরকারি গুদাম এবং সবধরনের পচনশীল সবজির জন্যে হিমাগারের ব্যবস্থা করতে হবে। কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ টন ধান মজুদের কাঠামোগত সক্ষমতার জন্যে কৃষক পর্যায়ে বা কমিউনিটি পর্যায়ে বিনিয়োগ করতে হবে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই সরকারকে ন্যূনতম এক কোটি টন ধান মজুদ করার কাঠামোগত সক্ষমতা অবশ্যই বাড়াতে হবে।

    চালের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সতর্কতা

    বেসরকারি মিলগুলোর ধারণ সক্ষমতা প্রায় ১ কোটি টন। এই মুহূর্তে প্রায় ৪০ লক্ষ টন স্থান খালি আছে। করোনাকালীন সময়ে সরকারি গুদামের চাল দুস্থদের মধ্যে বিতরণের পর সরকারি মজুদ কমে যাওয়ায় বেসরকারি চাল ব্যবসায়ীরা যেন সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিতে না পারে, সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি রাখতে হবে। বড় মিল মালিকদের সঙ্গে সরকারি দলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের সখ্যতার অভিযোগ রয়েছে। এই ধরণের সখ্যতার ভিত্তিতেই শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে। ভবিষ্যতে সরকারকে এই ধরণের সিন্ডিকেট ভাঙতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রদর্শন করতে হবে।

    ৩. কৃষি খাতে সরকারের করোনা-কালীন প্রণোদনা বাস্তবে কে পাবে?

    সরকার ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে করোনা দুর্যোগ মোকাবেলায় ৪ শতাংশ সুদে মোট পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হবে কৃষককে। কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, প্রকৃত কৃষক বা বর্গা কৃষক এই সরকারি ঋণ পর্যন্ত আদৌ পৌঁছাতে পারবে কিনা? গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সম্পর্কিত সার্কুলারে বলা হয়েছে, শস্য ও ফসল খাত ব্যতীত কৃষির অন্যান্য চলতি মূলধন নির্ভরশীল খাত, যেমন: হর্টিকালচার (মৌসুমি ফুল ও ফল চাষ), মাছ চাষ, পোলট্রি, ডেইরি ও প্রাণিসম্পদ খাতে এই ঋণ দেওয়া হবে। এবং কোনো খাতে ৩০ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়া যাবে না। এছাড়াও সার্কুলারে আরো উল্লেখ করা আছে, ঋণ নেয়ার ১৮ মাসের মধ্যে ঋণ ফেরত দিতে হবে। প্রথম ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ড থাকবে (কিস্তি দিতে হবেনা)। পরবর্তী ১২ মাসে বারো কিস্তির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

    সম্প্রতি প্রথম আলোর একটি পর্যবেক্ষণমূলক প্রতিবেদনে সাংবাদিক আরিফুজ্জামান তুহিন বাস্তব চিত্রটি তুলে ধরেন এভাবে: ‘‘মূলত, কৃষিঋণ-নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকের উৎপাদিত ফসল বন্ধক রেখে কৃষিঋণ নিতে হয়। এর সরকারি নাম হলো ‘শস্য বন্ধকি দলিল’। অর্থাৎ কৃষক তাঁর শস্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখবেন। ধান বা যেকোনো শস্য বিক্রি করে ঋণের টাকা আবার ফেরত দেবেন। কৃষক ঋণ পাবেন কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী। এ নীতিমালা অনুযায়ী ৫ একর বা ১৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিক সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাবেন। সে জন্য তাঁদের জমির দলিল বন্ধক রাখতে হবে। যাঁদের জমি নেই, তাঁরাও এই ঋণ পাবেন, তবে সে ক্ষেত্রে কৃষককে জমি লীজের চুক্তিপত্র জমা দিতে হবে। বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশে প্রান্তিক ভূমিহীন চাষি কখনোই চুক্তি করে জমি লিজ নেন না। আর অকৃষক জমির মালিক লিখিত চুক্তির মাধ্যমে কোনো চাষিকে জমি বর্গা দেন না।… কারণ লিখিত চুক্তির মাধ্যমে জমি বর্গা দিলে সরকারকে ফি দিতে হয়। সেই ফি জমির মালিককেই পরিশোধ করতে হয়। ফলে, এই পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ থেকে বর্গা চাষির ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। শুধু তা-ই নয়, কৃষকদের সবচেয়ে বড় অংশ ধান চাষ করেন। কোনো এলাকায় যদি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের বড় একটি অংশ ব্যাংক পর্যন্ত যান ঋণের জন্য, তাহলে ওই অঞ্চলে বরাদ্দকৃত ঋণের ৩০ শতাংশই কেবল ধানচাষিরা পাবেন। এছাড়াও, বাংলাদেশে জেলাভেদে ফসলের উৎপাদনও ভিন্ন হয়। ফলে, সারা বাংলাদেশের কৃষকের জন্য গড় এই বেঁধে দেওয়া শতাংশ হার কৃষকের জন্য কতটা সুফল বয়ে আনবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়” (প্রথম আলো, এপ্রিল ১৭, ২০২০)।

    এতে আরও বলা হয়েছে, “এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সার্কুলারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, তা হলো যেসব উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান কৃষক কর্তৃক উৎপাদিত কৃষিপণ্য কিনে সরাসরি বিক্রি করে থাকে, তারা এই ঋণ প্যাকেজের আওতায় আসবে। এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা ঋণ পাবে। অর্থাৎ যে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপাদন করেন, তিনি পাবেন সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা। আর যিনি কৃষকের ফসল কম টাকায় কিনে বেশি টাকায় বিক্রি করবেন, সেই মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা ঋণ পাবেন পাঁচ কোটি টাকা। অথচ বহুকাল ধরে দাবি জানানো হচ্ছে, কৃষকের উৎপাদিত ফসল কীভাবে সরাসরি ক্রেতার কাছে যেতে পারে, সেই ব্যবস্থা সরকারিভাবে গড়ে তোলা হোক। উল্টো এই ঋণব্যবস্থায় মধ্যস্বত্বভোগীদের পোক্ত করা হয়েছে” (প্রথম আলো, এপ্রিল ১৭, ২০২০)।

    প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৮ ভাগ কৃষিতে নিযুক্ত। এর বড় অংশের হাতে নিজের জমি নেই। জমির মালিকদের একটি বড় অংশই অকৃষক। বড় ধরনের জমির মালিকানার পরিবর্তন বা ভূমি সংস্কার ছাড়া বাস্তবে কৃষকের জন্য কিছু করা সম্ভব না। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায়ও যদি কৃষকের জন্য কিছু করতে হয়, তাহলে বর্গা কৃষককে সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনার চেষ্টা করতে হবে।

    কৃষি খাতে প্রণোদনার ধরণ কেমন হওয়া উচিত?

    বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে বোরো ওঠার পরপরই কৃষক পরবর্তী মওসুমের ধান আবাদের প্রস্তুতি নেবে। সেক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট সরকারি সাহায্য নিশ্চিত করতে হবে। যেমন: ক) জমির লিজ মূল্য দিতে গিয়ে কৃষকের আয়ের একটা বড় অংশ বেরিয়ে যায়। এটা এলাকা ও জমির ধরন ভেদে কম-বেশি হলেও বাৎসরিক গড়ে প্রায় ১০ হাজার টাকা। যা কৃষককে অগ্রিম পরিশোধ করতে হয়। কমপক্ষে আগামী ১ বছর জমির লিজমূল্য সরাসরি ভর্তুকি হিসাবে উৎপাদক কৃষকদের হাতে পৌঁছে দিতে হবে এবং জমির মালিকরা যেন কোনভাবেই লিজ মূল্য বাড়াতে না পারে সেদিকে কড়া নজর রাখতে হবে। পাশাপাশি কৃষির শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তোলার জন্য নতুন বাস্তবতার নিরিখে দীর্ঘমেয়াদে ভূমি সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। খ) কৃষি উপকরণ যেমন সার-বীজ-কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরাসরি উৎপাদক কৃষকের হাতে ভর্তুকি পৌঁছে দিতে হবে। পাশাপাশি বাজারজাতকারীদের উপর কড়া নজরদারী রাখতে হবে যেন এ সময়ে কোনভাবেই এসব পণ্যের দাম বেড়ে না যায়। গ) ক্ষুদ্রঋণের কিস্তি কমপক্ষে আগামী ১ বছর বন্ধ রাখতে হবে। উৎপাদক কৃষকদের জন্য দীর্ঘমেয়াদে এবং বিনাসুদে সরকারী ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।

    ৪. কৃষকের ঋণের জাল

    আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) এর ২০১৯ সালের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কৃষকেরা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি ব্যাংক, এবং দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে প্রায় ৮১ শতাংশের বেশি ঋণ নিয়ে থাকেন। এসব ঋণের সুদের হার ১৯ থেকে ৬৩ শতাংশ। অন্যদিকে সরকারি কৃষি ব্যাংকের সুদের হার ৯ শতাংশ হলেও কৃষকের মোট ঋণের মাত্র ৬ শতাংশ আসে কৃষি ব্যাংক থেকে (প্রথম আলো, এপ্রিল ১৭, ২০২০)। ইফপ্রির সমীক্ষা অনুযায়ী: কৃষক মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ নেয় এনজিও থেকে; আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নেয় ১৯ শতাংশ; জমির মালিকের কাছ থেকে ঋণ নেয় ১৫ শতাংশ; মহাজন বা দাদন থেকে ১১ শতাংশ এবং বিভিন্ন সমিতি থেকে আসে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ ঋণ। এদিকে সরকারের কৃষি ব্যাংকের ৬ শতাংশ ঋণের সবচেয়ে বড় অংশটি পান বড় চাষিরা, যা প্রায় ১৫ শতাংশ। বড়, মাঝারি ও ছোট চাষি মিলে মোট ঋণের ৩৬ শতাংশ পান। আর প্রান্তিক চাষি পান মাত্র ৫ শতাংশের মতো। বর্গা চাষি, অর্থাৎ অন্যের জমি ইজারা নিয়ে চাষ করেন—এমন কৃষকেরা এই ঋণ পান না। ফলে তাঁদের এনজিওসহ অন্য উৎসের ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয় (প্রথম আলো, এপ্রিল ১৭, ২০২০।)

    বাংলাদেশের কৃষকেরা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি ব্যাংক, এবং দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে প্রায় ৮১ শতাংশের বেশি ঋণ নিয়ে থাকেন। এসব ঋণের সুদের হার ১৯ থেকে ৬৩ শতাংশ।

    এক্ষেত্রে সরকারি ঋণের আওতা বাড়ানোর পাশাপাশি স্থানীয় ঋণদান সমিতি ও গ্রামে সঞ্চয়ী সমিতিগুলোর জন্য প্রণোদনা ও সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও ক্ষৃদ্র ঋণের বিকল্প মডেল হিসাবে সমবায় গঠনের দিকে জোর দিতে হবে। পুরনো ধারার সমবায়ের বদলে নতুন বাস্তবতার নিরিখে নতুন ধরনের কৃষি ও গ্রামীণ সমবায় গঠনে জোর দিতে হবে।

    ৫. দুর্যোগকালীন কৃষি সহায়তা প্রসঙ্গে

    কৃষিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রায় কখনোই বিবেচনায় নেয়নি। বলা হয়, যুগে যুগেই কৃষি অরক্ষিত ও অনিশ্চিত জীবিকা। ঝড়, বন্যা, শিলাবৃষ্টি, পোকার আক্রমণ এসব প্রাকৃতিক কারণেই কৃষকের ঝুঁকি সীমাহীন। কৃষক বাজারদরের কাছেও জিম্মি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে এমন একটি দেশও নেই, যেখানে কৃষি ঝুঁকিপূর্ণ নয়। পার্থক্য হলো কৃষি ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চিত-এই বাস্তবতা বহু দেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে স্বীকৃত। তাই ঝুঁকি নিয়ে ফসল ফলানোর জন্য কৃষিতে বিপুল প্রণোদনা এবং ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা আছে। কখনো ভর্তুকি, কখনো শস্যবিমা, কখনো রিস্ক কাভারেজ (ঝুঁকি মিটিয়ে দেওয়া), কখনো প্রাইস লস কাভারেজ (দাম পড়ে যাওয়ার লোকসান মেটানো), কখনো সরাসরি অর্থ প্রদান ইত্যাদি বিভিন্নভাবে কৃষকদের সহযোগিতা করা হয়। বাংলাদেশে প্রান্তিক ও বর্গাচাষী কৃষিতে বিনিয়োগ করেন মূলত ঋণ করে ও বিকল্প পেশা থেকে আয় করে। ফলে বোরো মৌসূমে কাল বৈশাখী/শীলা বৃষ্টি/ পোকার আক্রমণ এবং বোরো পরবতী মৌসুমে অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ইত্যাদি কারণে ফসলের ক্ষতি হলে কৃষকের পক্ষে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কৃষকদের দুর্যোগকালীন সহায়তা কী কী ধরনের হতে পারে এই বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়কে সক্রিয় ভাবে একটি বিশদ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

    মাহা মির্জা: লেখক, গবেষক
    ইমেইল: maha.z.mirza@gmail.com

    তথ্যসূত্র:
    বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। ‘রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিসটিকস ২০১৮’। ২০১৮।
    আরিফুজ্জামান, মোঃ। ‘কৃষিঋণ কৃষককে কতটা রক্ষা করবে?’ প্রথম আলো। ১৭ এপ্রিল, ২০২০।
    শাহীন, সাইদ। ‘হাওরে দিনে ৬৬ হাজার অভিবাসী শ্রমিক প্রয়োজন।’ বণিক বার্তা। এপ্রিল ১৬, ২০২০।
    এছাড়াও মাঠ পর্যায়ের তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন: সাইদ শাহীন, আবুল কালাম আজাদ, এবং আলতাফ পারভেজ।

    (সর্বজনকথা অনলাইন বিশেষ সংখ্যা)

  • মে দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য

    মে দিবসের ইতিহাস ও তাৎপর্য

    সুদীপ্ত রশিদ

    দুনিয়ার মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের আশা আকাঙ্ক্ষার বার্তা নিয়ে আসে মে দিবস। প্রতিবছর মে মাসের ১ তারিখে এই দিবসটি পালন করা হয় যা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবেও পরিচিত।

    মে দিবসের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফিরে তাকাতে হবে। পশ্চিমা বিশ্বে শিল্প বিপ্লব তখন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু অস্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ ও দীর্ঘ কর্মঘণ্টার ফলে প্রতি বছরই অসুস্থ হয়ে পড়ছিল অসংখ্য পুরুষ, নারী ও শিশু শ্রমিক। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন দ্য ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস অ্যান্ড লেবার ইউনিয়নস (এফওটিএলইউ) কর্মস্থলের অমানবিক পরিস্থিতি দূর করতে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে একটি কনভেনশনের আয়োজন করে।

    পরবর্তীতে এফওটিএলইউ নাম বদলে আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবারস (এএফএল) নামে পরিচিতি পায়। এফওটিএলইউ কনভেনশনের আয়োজকরা দাবি করেন, ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা হিসেবে ধরে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের জন্য আইন পাস করতে হবে। ওই একই বছর তৎকালীন সময়ে আমেরিকার সবচেয়ে বড় শ্রমিক সংগঠন- নাইঠস অব লেবার এফওটিএলইউ’র দাবির প্রতি সমর্থন জানায়। দাবির পক্ষে শ্রমিকেরা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ শুরু করে। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ১৩ হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ৩ লাখেরও বেশি শ্রমিক কাজ প্রত্যাহার করে বের হয়ে যায়। দুই দিনের মধ্যেই তাদের সঙ্গে আরো অনেকে যোগ দেয়। অচিরেই কাজ প্রত্যাহার করা শ্রমিকের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়ায়। ৩ মে’র মধ্যে পুরো দেশজুড়ে শ্রমিক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং সেই বিক্ষোভ ক্রমেই সহিংসতায় রূপ নেয়।

    ১৮৮৬ সালের ৪ মে শিকাগোর হে-মার্কেট স্কয়ার নামক এক বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হন। সেসময় অগাস্ট স্পীজ নামে এক নেতা জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলছিলেন। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো পুলিশ দলের কাছে এক বোমার বিস্ফোরণ ঘটে এবং এতে একজন পুলিশ তৎক্ষণাৎ এবং আরো ছয়জন পরবর্তীতে নিহত হয়। পুলিশ বাহিনী শ্রমিকদের উপর অতর্কিতে হামলা শুরু করে যা রায়ট বা দাঙ্গায় রূপ নেয়। এই রায়টে ১১ জন শ্রমিক শহীদ হন। পুলিশের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করে অগাস্ট স্পীজ সহ মোট আটজনকে প্রহসনমূলকভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তাদের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। তাদের মধ্যে ফাঁসি দেয়ার আগেই কারারুদ্ধ অবস্থায় একজন আত্মহত্যা করেন।

    বাকিদের ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসি দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত এই মিথ্যা বিচারের অপরাধ ধরা পড়ে এবং ১৮৯৩ সালের ২৬ জুন রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে ওই বিচার কার্যক্রম মিথ্যা ছিলো। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের ‘দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ’-এর দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পায়। আর সেই থেকেই পহেলা মে শ্রমিকদের আত্মত্যাগ আর দাবি আদায়ের মুক্তির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

    ১ মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে। পরবর্তী বছর অর্থাৎ ১৮৯০ সাল থেকে ১ মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে ‘মে দিবস’ বা ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ হিসেবে। তবে মে দিবস আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায় ১৯০৪ সালের ১৪ থেকে ১৮ আগস্টে অনুষ্ঠিত সেকেন্ড ইন্টারন্যাশনাল প্রতিনিধিদের ষষ্ঠ কংগ্রেসে। অ্যামস্টারড্যামে অনুষ্ঠিত এই কংগ্রেসটি দ্য ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কংগ্রেস হিসেবে পরিচিতি পায়। আর এতে অংশগ্রহণ করে ইউরোপের সকল দেশের সব সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক রাজনৈতিক দল ও শ্রমিক সংগঠনগুলো। সেদিনই আইনের মাধ্যমে শ্রমিকদের জন্য একদিনে সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানানো হয় এবং পহেলা মে স্বীকৃতি পায় শ্রমিক দিবস হিসেবে।

    বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে প্রায় ৮০টি দেশে পহেলা মে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হচ্ছে। এছাড়াও আরো অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে শ্রমিক দিবস পালিত হলেও রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে পুরোপুরিভাবে শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি। ২০০৬ সালে শ্রমিকদের অধিকার আদায় এবং স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশে ‘জাতীয় শ্রম আইন’ গৃহীত ও কার্যকর হয়।

    কিন্তু আজও এই আইনের সম্পূর্ণ প্রয়োগ দৃশ্যমান নয়। বর্তমানে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও করোনাভাইরাসের আঘাতে জর্জরিত হলেও শ্রমিক শ্রেণীকে বলির পাঠা হিসেবে ব্যবহার করছে শিল্পকারখানার মালিক পক্ষসমূহ। তারা শ্রমিকদের জীবনের কথা চিন্তা না করে এই লকডাউনের মধ্যেও শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করছে। শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য যেসকল সংগঠন আছে তারাও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার নয়। তারাও বিভিন্নভাবে বুর্জোয়া ধনিক শ্রেণীরই স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত।

    লেখক: সুদীপ্ত রশিদ, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : সুত্র : বি বার্তা ২৪.নেট

  • ১লা মে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মহান “মে দিবস”

    ১লা মে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে মহান “মে দিবস”

    কর্মঘন্টাকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার সঙ্গে জড়িত আছে মে দিবসের জন্ম কাহিনী। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এই আন্দোলনের সূচনা। গোড়ার দিকে যদিও মুজুরী বাড়ানোর দাবীতেই আন্দোলন শুরু হয়। ১৮০৬ সালে ফিলাডেলফিয়ায় জুতা শ্রমিকরা যখন ধর্মঘট করে তখন তাদের কর্মঘন্ট ছিল প্রতিদিন প্রায় ২০ ঘন্টা। ১৮২০ থেকে ১৮৪০ সাল পর্যন্ত কর্মঘন্টা কমাবার জন্য অসংখ্য ধর্মঘট হয়। ১৮২৭ সালে দৈনিক ১০ ঘন্টা কাজের নিয়ম চালু করার দাবীতে মেকানিকদের উদ্যোগে ফিলাডেলফিয়ায় গঠিত হয় বিশ্বের প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন। ১৮৬৪ সালে লন্ডনে প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমজীবী মানুষের প্রথম আন্তর্জাতিক সংগঠন ফাস্ট ইন্টারন্যাশনাল। ১৮৬৬ সালে বাল্ডিমোরে ৬০টি ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা মিলিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম শ্রমিক ফেডারেশন “ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন” যা সে বছরই দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। একই বছর ফাস্ট ইন্টার‌্যাশনাল এর জেনেভা কংগ্রেসে ঐ প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। ১৮৮৪ সালে ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয় আন্দোলন। যার সঙ্গে মে দিবসের জন্ম সরাসরি জড়িত। ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত আমেরিকান ফেডারেশন অব লেবার ১লা মে তারিখ থেকে দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজের প্রস্তাবটি গ্রহণ করে আন্দোলন গড়ে তোলে। সে বছর ৮ ঘন্টা কাজের দাবীতে সকল শ্রমিক ধর্মঘট করে নিজ নিজ কারখানা থেকে বের হয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। ধর্মঘটের কেন্দ্র ছিল শিকাগো। ১৮৮৬ সালের ১লা মে তারিখে শিকাগোতে শ্রমিকদের এক বিশাল সমাবেশ হয়। আন্দোলনের ডাকে সকল শ্রমিক কাজ বন্ধ করে রাস্তায় নেমে আসে। শ্রমিক আন্দোলন ইতিহাসে এর আগে শ্রেণি সংহতি প্রকাশের এত বলিষ্ট প্রকাশ আর দেখা যায় নি। সেদিন ৮ ঘন্টা আন্দোলনের চূড়ান্ত রুপ ধারণ করে।

    ৩রা মে শিকাগোর ম্যাককর্মিক ফসল কাটার কারখানায় ধর্মঘটি শ্রমিকদের সমাবেশের উপর পুলিশের গুলিতে নিহত হন ৪ জন শ্রমিক। পরদিন হে মার্কেটে এর প্রতিবাদে সমাবেশস্থলে অজ্ঞাতনামা কারো বোমার আঘাতে এক পুলিশ সার্জেন্টের মৃত্যু হয়। এরপর লড়াই-সংগ্রামে আরো ৪ জন শ্রমিক আর ৭ জন পুলিশের মৃত্যুতে উন্মাদ হয়ে ওঠে পুলিশ বাহিনী। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হে মার্কেট চত্ত্বর রক্তে রঞ্জিত করে। এরপর প্রহসনের বিচারে ফাঁসির মঞ্চে নির্বিচারে প্রাণ দেয় সংগ্রামী শ্রমিক নেতারা। মে দিবসের আন্দোলনে প্রধান শ্রমিক নেতৃবৃন্দ ছিলেন আলবার্ট পারসনস্, স্যামুয়েল ফিয়েল্ড, অগাষ্ট স্পাইস, এডলফ ফিশার, মাইকেল শোব, জর্জ এঞ্জেল ও লুুইস লিংগে অন্যতম।
    মে দিবস আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির পবিত্র দিবস হিসাবে উন্নীত করার পেছনে আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবার এর রয়েছে অনন্য অবদান। ১৮৮৮ সালের ১লা মে তারিখ-কে ফেডারেশন ৮ ঘন্টা কাজের আন্দোলনের পুনুরুজ্জীবন দিবস হিসাবে বেছে নেয়। লন্ডন থেকে ফাষ্ট ইন্টারন্যাশনাল সদর দপ্তর নিউইয়র্কে স্থানান্তরিত হবার পর পরিবর্তিত হয়ে এর নাম হয় সেকেন্ড ইন্ট্রারন্যাশনাল, যার প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসে। ঐ কংগ্রেসেই ১লা মে তারিখকে বিশেষ দিবস হিসাবে উদযাপনের জন্য চিহ্নিত করা হয়, যা প্রতি বছরই শ্রমজীবী মানুষের একটি মহান দিবস হিসাবে সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে।

    ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশে মে দিবস ঃ
    আমেরিকার শিকাগো শহরের শহীদ শ্রমিকদের অনুপ্রেরনায় ভারতবর্ষেও দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ধর্মঘট আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯২০ সালের দিকে রেল, চা বাগান ও ষ্টিমার শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও সংহতি বৃটিশদের কাঁপিয়ে তোলে। পরবর্তীকালে সুতাকল সহ বিভিন্ন কলকারখানায় শ্রমিকদের দাবী আদায়ের জন্য সংগঠিত হতে থাকে, ঐ সময় গড়ে ওঠা ট্রেড ইউনিয়ন সমূহ মে দিবস পালনের প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু ঐ সময় অধিকাংশ স্থানে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় গোপনে গোপনে মে দিবস পালিত হয়।

    ১৯২৩ সালে এই উপমহাদেশে প্রথম মে দিবসের অনুষ্ঠান পালন করা হয় মাদ্রাজে। এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়া। তৎকালীন বাংলার শিল্প কেন্দ্র কলকাতায় সর্বপ্রথম মহান মে দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয় ১৯২৭ সালে। একই সময় তৎকালীন পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশে মে দিবস পালিত হয়। ১৯৩৮ সালে নারায়নগঞ্জে মে দিবস পালনের খবর পাওয়া যায়। দাবী আদায়ের জন্য পরবর্তীতে কোন কোন বছর মে দিবসে ধর্মঘট পালিত হয়। মে দিবসে ছুটি দেওয়ার দাবী উত্থাপিত হয় সর্বত্র। পুরো পাকিস্তান আমলে ঐক্যবদ্ধ ও পৃথক পৃথক ভাবে প্রতিবছর উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে মে দিবস পালিত হয়।

    স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১লা মে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। তিনি ১লা মে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা সহ রাষ্ট্রপতি আদেশে ২৭(ক) ধারা মতে সকল শিল্প কল-কারখানা, ব্যাংক, বীমা, বৈদেশিক বাণিজ্যের সিংহভাগ রাষ্ট্রয়াত্ব ঘোষণা করেন। শ্রমিক-কর্মচারীদের কারখানার লভ্যাংশ দেওয়া সহ শ্রমিকদের বাসস্থান, চিকিৎসা সেবা, প্রতিটি কারখানায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ঘোষণা করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্ট দেশীয় ও আন্তর্জাতিক কুচক্রী মহলের দ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্ব-পরিবারে নিহত হলে শ্রমিক কর্মচারীদের বঞ্চনা শুরু হতে থাকে। ১৯৭৬ সালে সামরিক শাসনের আমলে তৎকালীন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক শ্রমিক জনসভায় ভাষণ দেন এবং তিনি বলেন “ আমরা সবাই শ্রমিক” কিন্তু তার পর থেকে সামরিক শাসকদ্বয় জিয়াউর রহমান ও হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ শিল্প-কলকারখানা ব্যক্তি মালিকানায় দেওয়া সহ হোল্ডিং কোম্পানী গঠন করে রাষ্ট্রয়াত্ব কারখানা সমূহ ব্যক্তিমালিকানায় দেওয়া শুরু করেন।

    মানুষের দ্বারা মানুষের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সংগ্রামী সংহতিকে ক্ষুধা, দারিদ্র ও অপমানের হাত থেকে খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তি সংগ্রাম কে সামনে রেখে সারা বিশ্বের শ্রমিকরা মহান মে দিবস উদযাপন করে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলনে বিপুল শক্তির প্রথম সর্বাত্মক শক্তির সফল প্রতিক মহান মে দিবস। তাই একই সাথে শ্রমজীবী জনগণের ঐক্য, সংহতি সংগ্রাম ও বিজয়ের প্রতীক হিসাবেই তাৎপর্য ও মহিমাপূর্ণ।

    মে দিবসে শ্রমিকরা চেয়েছিল নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা যাতে সে বিশ্রামের পর্যাপ্ত সময় পায় এবং মর্যাদাকর মানবিক জীবন যাপন করতে পারে। ১৩৫ বছর পরেও শ্রমজীবী মানুষের এখন প্রধান দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা।

    অনেকেই মে দিবসের ছুটি পালন করছেন অথবা তাঁকে আনুষ্ঠানিকতায় বেঁধে তৃপ্তি পাচ্ছেন। তারা হয়তো মে দিবসের তারিখটার খবর রাখেন কিন্তু চেতনার খবর-টা রাখেন না। শ্রমজীবী মানুষ কখনো কখনো কিছুক্ষনের জন্য দাঁড়িয়ে যেতে পারে, কিন্তু সে দাঁড়ানো কোনদিন স্থায়ী হয় না। চাকা ঘোরানো যাদের কাজ তারা দাঁড়ালে ইতিহাস দাঁড়িয়ে যাবে, মহান মে দিবস সে কথাই বলে।

    স্বাধীনতার সংগ্রাম সহ অন্যান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমাদের দেশের শ্রমিকরা প্রমান করেছেন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। আইন করে বা নানা কূট কৌশলের মাধ্যমে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায় না, ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন তার নিজস্ব গতিতে চলে।

    স্বাধীনতার পর সাতক্ষীরা মহাকুমা শহরে রিক্সা ভ্যান শ্রমিক ও নৌকার মাঝিদের মধ্যে সংগঠন করার জন্য মীর এশরাক আলী ইস্যু মিয়া, নূরুল ইসলাম, ববিন, সৈয়দ মাহমুদ পাপা সহ অন্যান্যরা কাজ করেন। ১৯৮১ সালে মহাকুমার প্রথম মটর শ্রমিক ইউনিয়ন, রেজি নং-খুলনা-৫৫০ নামীয় সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনটি কলারোয়াতে গড়ে ওঠে। ১৯৮৪ সালে সাতক্ষীরা জেলা ঘোষণা হলে ট্রেড ইউনিয়নটি সাতক্ষীরা বাস টার্মিনালে স্থানান্তর করা হয়। জেলার ২য় ট্রেড ইউনিয়ন ১২ জুন ১৯৮৪ তারিখে সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস্ এমপ্লয়ীজ ইউনিয়ন, সাতক্ষীরা, রেজিঃ নং খুলনা-৬১২, যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান-উজ-জামান ও সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আলাউদ্দীন সানা। ১৯৮৬ সালে ৩য় ট্রেড ইউনিয়ন সাতক্ষীরা পৌরসভায় জেলা রিক্সা ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়ন, যার রেজিঃ নং খুলনা-৬৮৪। পরবর্তীতে একে একে জেলা ব্যাপী আজ পর্যন্ত প্রায় ৬০টির উর্দ্ধে ব্যাসিক ট্রেড ইউনিয়ন রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত আছে। তারপর সাতক্ষীরা-তে কিছু জাতীয় ইউনিয়নের শাখা আছে। সর্বপরি জাতীয় ফেডারেশনের অন্তর্ভূক্ত জাতীয় শ্রমিকলীগ, জাতীয়তাবাদী শ্রমিকদল, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, জাতীয় শ্রমিক পার্টি, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট, জাতীয় শ্রমিক জোট-বাংলাদেশ, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন উল্লেখযোগ্য।

    জাতীয়ভাবে ১১টি শ্রমিক ও কর্মচারী সংগঠন নিয়ে ১৯৮৩ সালে গড়ে ওঠে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ “স্কপ”।

    শ্রমিকের নিরাপত্তার প্রশ্নটি আজ একটি জাতীয় ইস্যু। স্পেকট্রাম ভবন ধসে পড়া থেকে শুরু করে বসুন্ধরায় সংগঠটিত অগ্নিকান্ড, যাত্রাবাড়ীর প্লাস্টিক কারখানা ও পোস্তগোলায় ডায়িং ফ্যাক্টরীতে দুর্ঘটনা, সাভারের রানা প্লাজায় দুর্ঘটনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, গ্রাম থেকে ঢাকা-চট্টগ্রামে কাজ করতে আসা শ্রমিক কফিনের সারি হয়ে ফিরে যাচ্ছে গ্রামে। অনেকে আবার নিজ গ্রামের মাটিও পাচ্ছে না। বেওয়ারিশ পরিচয় নিয়ে তাদের স্থান হচ্ছে পৌর কর্পোরেশনের গণকবরে। একটি সুস্থ সমাজ এই ব্যবস্থা ধারণ করতে পারে না। এ অবস্থার নিরসন হওয়া প্রয়োজন।

    দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ৫ কোটির উর্দ্ধে। শ্রম বাজারের দ্রুত পরিবর্তন এদের ছড়িয়ে দিচ্ছে বিচিত্র সব পেশায়, বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে। ২৫ বছর আগের মত কতিপয় নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষের বিচরণ সীমিত নেই। কিন্তু দেশের শ্রম আইন এখনো সীমিত শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য। তাও যারা বাস্তবায়ন করবে তাদের আছে অনেক দুর্বলতা। আইন আছে শ্রমিক হয়তো জানে, কিন্তু জানে না আইন না মানলে তারা কি করতে পারে? তাদের মধ্যে এই সচেতনতার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। এই হোক এবারের মে দিবসের অঙ্গীকার।

    তথ্য সূত্র : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস্ বুলেটিন
    শেখ হারুন-উর-রশিদ
    সাবেক সাধারণ সম্পাদক
    সুন্দরবন টেক্সটাইল মিলস্ (সিবিএ), সাতক্ষীরা।
    ০১৭১০-৮৪৯৩৫৩

  • কালেরগর্ভে হারিয়ে যাওয়া “তিয়র রাজার” জীবন কাহিনী

    ॥ এম কামরুজ্জামান ॥
    —————————-
    সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ধানদিয়া ইউনিয়নের মানিকহার গ্রামে আমার জম্ম।
    গ্রামটি তালা ও কলারোয়া উপজেলার একেবারেই সীমান্ত ঘেষা। এই গ্রামে আমার
    বেড়ে ওঠা। শৈশব, কৈশোর
    কেটেছে এই গ্রামেই।

    যখন একটু বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই শুনতাম “মানিকহার” গ্রামটি
    ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ একটি গ্রাম। একসময় এখানে তিয়র রাজার বাসবাস ছিল। এই
    রাজার ভিটেতে অনেক স্বর্ণ পুঁতে রাখা। মাটি খুঁড়লেই না-কি স্বর্ণ মেলে।
    মনি-মুক্তার হার পাওয়া যায়। সেই ‘মনি-মুক্তার হার’ থেকেই গ্রামটির নামকরণ
    “মানিকহার”। আবার কেউ বলেন গ্রামটির অতিত নাম “মণিঘর”। কালেরআবর্তে
    গ্রামটির নাম হয়েছে “মানিকহার”।

    স্কুলে যখন পড়তাম তখন প্রায় বাবার সঙ্গে তিয়র রাজার দিঘীর পাড়ে যেতাম।
    বিশাল দিঘী। কাকের চোখের মত জল। দেখলে গা চমকে উঠতো। তিয়র রাজার দিঘী
    নিয়ে অনেক কল্প কাহিনী শুনেছি। এই এলাকায় বড় ধরনের কোন বিয়ে-সাদি হলে
    আগের দিন সন্ধ্যায় জানান দিয়ে আসলে না-কি দিঘীর কিনারায় গাদিগাদি কাশার
    থালা, গ্লাস,চামচ রেখে যেতো। বিয়ের পরে সন্ধ্যায় আবার দিঘীর পাড়ে সেগুলো
    রেখে আসলে না-কি সেগুলো অদৃশ্য হয়ে যেত।

    ২০ বছর আগেও তিয়র রাজার উচু ভিটেবাড়িতে গিয়ে সেই আমলের ইট, খোয়া, শুরকি
    দেখেছি। দেখেছি বিশাল বিশাল একাধিক বট গাছ। কিন্তু এখন আর এসব দৃশ্যমান
    নয়। অস্তিত্ব প্রায় বিলীন। ভিটেবাড়ি আগের মত আর উচু নেই। এখন সমতলভূমি।
    ভিটেতে ফলে ফসল। তিয়র রাজার সেই জমিদারি আজ ব্যক্তিমালিকানায় দখল।
    স্থানীয় প্রশাসন নজরদিলে হয়তো উদ্ধার হতে পারে তিয়র রাজার সেই
    জমিদারিত্ব, ইতিহাস,ঐতিহ্য।

    কিন্তু গ্রামটির নামকরণের সঠিক ইতিহাস জানবার আগ্রহটা আমার সেই ছোটবেলা
    থেকেই। অনেক বই-পুস্তক ঘেটেছি। কিন্তু বিস্তর নামকরণের কোন ইতিহাস আমার
    চোখে পড়েনি।

    কৈশোরে বাবা-দাদাদের মুখে শুনতার রেডিও’তে তিয়র রাজার নাটক সম্প্রচার হয়
    প্রতিবছর। বছরে না-কি একদিন। নিজ কানে শুনেছি। কিন্তু বহুদিন ধরে সেটাও
    আর হয়না। কি কারণে সেই তিয়র রাজার নাটক এখন আর হয়না তা আমার জানা নেই।

    আজ দুপুরে ইন্টারনেট ঘাটতে গিয়ে চোখে পড়লো টিয়র রাজার সেই জীবন কাহিনী।
    এটাই সঠিক ইতহাস কি-না তাও জানিনা।

    তবে পাঠকদের সামনে হুবহু সেটি তুলে ধরা হল :
    —————————————————-
    সাতক্ষীরা হইতে ১২ মাইল উত্তরে কলারোয়া থানার নিকটস্থ নওপাড়া-মণিঘর
    গ্রাম ; ইহা গড়দানি নামেও অভিহিত। একটি মাটির গড়ের ভগ্নাবশেষ ও কতকগুলি
    পুরাতন পুষ্করিণী এখানে দৃষ্ট হয়; এগুলি তিয়র রাজার কীৰ্ত্তি বলিয়া
    কথিত।

    কিংবদন্তী, কোনও এক সময়ে জনৈক তিয়র জাতীয় ব্যক্তি যখন বিলে নৌকা
    করিয়া মাছ ধরিতে ছিলেন, তখন একজন সন্ন্যাসী তাহাকে বিলটি পার করিয়া
    দিতে বলেন । তিয়র সম্মত হইয়া সন্ন্যাসীকে লইয়া যখন বিলটি পার
    হইতেছিলেন, তখন দেখিলেন সন্ন্যাসীর ঝোলার স্পৰ্শণ পাইয় তাহার নৌকার একটি
    লৌহ পাট সোণায় পরিণত হইল।

    তিয়র বুঝিলেন ঝোলার মধ্যে পরশ পাথর আছে এবং লোভে পড়িয়া পাথরটি কড়িয়া
    লইয়া সন্ন্যাসীকে গভীর জলে ফেলিয়া দিলেন ; জলে ডুবিবার সময়ে সন্ন্যাসী
    অভিসম্পাত করিলেন যে তিয়র সপরিবারে বিনষ্ট হইবেন । পরশ পাথরের গুণে
    তিয়রের বহু ধনদৌলত হইল এবং তিনি রাজা বলিয়া পরিচিত হইলেন। তিনি একটি
    তুর্গ নিৰ্ম্মাণ করাইয়াছিলেন এবং ১২৬টি পুষ্করিণী খনন করাইয়া ছিলেন।

    অল্পকাল মধ্যেই বাংলার নবাব তাহার ধনসম্পত্তি প্রাপ্তির কথা শুনিয়া
    তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন । তিয়র ভাবিলেন হয়তো এরূপভাবে ধনপ্রাপ্তির
    জন্য নবাবের হাতে প্রাণ হারাইতে হইতে পারে এবং পাছে মহিলাদের সন্ত্রম
    হানি হয় এই জন্য সঙ্গে করিয়া একজোড়া বাৰ্ত্তাবাহী কপোত (পায়রা) লইয়া
    গেলেন, বলিয়া গেলেন যে তাহার অবস্থা শোচনীয় জানিলে এবং মৃত্যু নিশ্চিত
    বুঝিলে পায়রা দুইটি ছাড়িয়া দিবেন।

    তিয়র রাজাকে নবাব সসম্মানে ছাড়িয়া দিলেন। অশ্বপৃষ্ঠে তিনি যখন গৃহে
    প্রত্যাগমন করিতেছিলেন, পায়রা দুটি হঠাৎ ছাড়া পাইয়া যায়।

    ঘরে পায়রা ফিরিতে দেখিয়া তিয়র রাজার স্ত্রী ও সন্তানগণ একটি নৌকায়
    করিয়া বড় পুকুরের মধ্যস্থলে পৌঁছিয়া নৌকার তলদেশে ছিদ্র করিয়া
    ডুবিয়া প্রাণত্যাগ করেন। তিয়র রাজা প্রাণপণ শক্তিতে ঘোড়া ছুটাইয়া ঘরে
    ফিরিয়া দেখিলেন সব শেষ হইয়া গিয়াছে, তখন তিনিও বড় পুকুরে ডুবিয়া
    প্রাণত্যাগ করিলেন ; এইরূপে সন্ন্যাসীর অভিশাপ পূর্ণ হইল।

    এই বড় পুকুরটিকে লোকে এখনও দেখাইয়া থাকে। গ্রামের যে স্থানে গড়ের
    ভগ্নাবশেষ পড়িয়া রহিয়াছে উহাকে দানা-মণিঘর বা ‘ধনপোতার দান বলা হয় ;
    লোকের বিশ্বাস উহার নীচে তিয়র রাজার ধনদৌলত প্রোথিত আছে।
    ( সূত্র :উইকিসংকলন )

  • করোনাকাল

    করোনাকাল

    মো. আহাদ উল্লাহ

    যিনি একজন ডাক্তার এবং সাথে যদি অধ্যাপক লেখা থাকে উনি এই করোনাকালের মূহুর্তে মেজর জেনারেলের মতো দায়িত্ব পালন করার কথা। সমস্ত সম্মানীত অধ্যাপকেরাই এই যুদ্ধের নেতৃত্বে থাকার কথা। সচিব, মন্ত্রী, সরকার এরা শুধুই রসদ সরবরাহ করবে। ৮মার্চের আগেই বাংলাদেশ উচ্চ মাত্রার ঝুঁকিতে রয়েছে সতর্ক বার্তা দিয়েছিল WHO. আশ্চর্যের বিষয় হলো ৪৫দিন পরে এসে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি হয়েছে মেডিঃ অধ্যাপকদের নিয়ে। বলেছিলাম সরকার করোনার পিছু পিছু হাটছে, এইভাবে হেটে দেড় হাজার মাইল পিছনে পড়ে গেছে। এখন দৌড়াচ্ছে। আইইডিসিআর-এর দুই দুইজন রোগতত্ত্বের অধ্যাপক দিয়ে কতজনের কাশি হল, জ্বর হলো, গলা ব্যথা হলো, মারা গেলো, দুঃখ প্রকাশ এগুলো বলাচ্ছে। ব্রিফিংয়ে যে কি মজা পাইলো, রিজভী সাহেবের মতো। মাঝে মাঝে মন্ত্রী মহোদয়ও বুলেটিন পড়ছেন। মাননীয় মন্ত্রী হচ্ছেন এ যুদ্ধের জেনারেল। স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের সচিব স্পোকম্যান হতে পারতেন সাথে বিটিভি থেকে দুজন ঘোষক নিতে পারতো। মনে হচ্ছে কোথাও একটি সমস্যা আছে। আসলে সংবাদ দেয়ার বা পাঠ করার জন্য অধ্যাপকদের এখন সময় নয় বা মানায় না। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (IEDCR) যে জনবল তাতে এই করোনা যু্দ্ধের জন্য প্রাথমিকভাবে ঠেকিয়ে রাখার জন্য একটি পদাতিক ডিভিশন দরকার। এই প্রতিষ্ঠানটি স্রেফ একটি বিগ্রেডের মতো, অনেক প্রকার বিগ্রেড ও রেজিমেন্ট নিয়ে তো একটি ডিভিশন। যেমন সেনা বাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশন, সাভার। এই ডিভিশন শুধু ঢাকাকে রক্ষা করবে, তার জন্য সব আছে তাদের। তো, সারা দেশ! iedcr এরাতো সারাদেশে রোগ/রোগী চিহ্নিত করার ও গবেষণা করার একচ্ছত্র দায়িত্ব নিয়েছে, আর কেউ করবে না। বড় সমস্যা এই জায়গায়। এখন হযবরল। হ্যা সরকারী ভাবেই হবে, প্রতিটা সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে অঞ্চল ভাগ করে গাইড লাইন দিয়ে আগেই প্রস্তুত করা যেত। তা করা যেত, করবে না। এখন গলায় কাটা আটকে গেছে, বিড়ালের পা ধরবে, মাসিকে গিয়ে বলে আসবে, মুটি মুটি সাদা ভাত গিলেও তো হবে না। সারাদেশে ডাক্তাদের বডিল্যাঙ্গুয়েজ দেখে তাই মনে হয়। আমাদের যেহেতু চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত নয়, স্যাম্পল টেস্ট করেই কন্ট্রোল করে ফেলা যেত।
    দঃ কোরিয়া জার্মানির রাস্তার গাড়ী চালকের পর্যন্ত স্যাম্পল নিয়ে রেন্ডম টেস্ট করে ভাল ও আক্রান্তদের আলাদা করে সবকিছু এখন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। ভয়ের বিষয় হলো যাকে টেস্ট করা হলো এবং সে পজেটিভ হলো- সঙ্গে সঙ্গে আইসোলেশন ( সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া) করার কথা। টেস্ট করার আগের সমস্ত কন্ট্রাক্ট পারসন কে কে ছিল! এই প্রশ্নের উত্তরটা আইইডিসিআর দিচ্ছে না। বলছে কোয়ারান্টাইন (যে সময় পর্যন্ত রোগ সংক্রামণ আশঙ্কায় পৃথক রাখা হয়)এর কথা। সেটা কে বাস্তবায়ন করবে। যদি করেই থাকে ছড়ালো কেন? পুলিশ মিলিটারি দায়ী? প্রশাসন?
    দায়টা আমাদেরও নিতে হবে। পুলিশ ঘরে ঢুকিয়ে গেলো, বসে রইলাম। আরে! মনে হল পুলিশের কাঁধে তো পুরানো বন্দুক! ধূররর! এ বন্দুকের গুলি ফুটে না, কিছুই করতে পারবে না। সামনে একজন সাংবাদিক বা ক্যামেরাম্যান থাকলে তো কথাই নেই। পিটাবে দূরের থাক, দুইহাত জোড় করে বলবে ঘরে যান, বাবা ঘরে যান। মজাই আলাদা! পাবলিক মজা লুটছে!
    এদিকে ফেসবুকাররা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এক ভিক্ষুককে নিয়ে। আরে! লোকটি পুঁজিবাদী বিশ্বের সব খবর রাখে। সে তো জানেই ইনভেস্ট একটা করলে প্রণোদনা পাবেই। তো পেয়েছে। কোটিপতিরা যেরকম পাবে, হাজার হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা।
    মেম্বার, চেয়ারম্যান, ডিলার সবই তো চলতি সরকারের দলীয় লোক। কোনোভাবে হয়তো জেনে গেছে শেখের বেটি তাদের কোনো প্রণোদনা দিবেন না। তাই নিজেরাই চাল ডাল তেল নুন যা পারছে নিজ হাতে প্রণোদনা নিয়ে নিচ্ছে। ভাগে যারা কম পেয়েছিল তারাই পুলিশকে বলে দিয়েছে; করোনাকাল যাক টের…। চলবে…।
    পুনশ্চঃ সারা গিলবার্টের টিকা সফল হলে কিরকম হবে এই গ্রহ ? পুরুষতান্ত্রিকদের মহিষ শক্তির দাপটওয়ালা, ওয়াজআলাদের চেহারা, স্বৈরাচারী শাসকদের ফরমান কোথায় যায়, সেটাও করোনাকালের মধ্যে হিসাবটা সবাই লিখে রাখবেন যেহেতু গিলবার্ট একজন নারী।

    (+ প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের গণসাংস্কৃতিক বিভাগের দায়িত্বে)

  • কিটের মাঝে কীট!

    জাহিদুল আহসান পিন্টু

    Image may contain: Zayadul Ahsan Pintu

    অবস্থাদৃষ্টে মনে হইতেছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত করোনা ভাইরাস শনাক্তের কিট আবিস্কার লইয়া দুইপক্ষই পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলিয়া যাইতেছে। যাহা কখনোই কাম্য নহে। প্রথম যখন জানিতে পারিলাম দেশেরই একজন বিজ্ঞানী বিজন কুমার শীল ওই কিট আবিস্কার করিয়াছেন, তখন আনন্দে মন ভরিয়া উঠিয়াছিল। এখন বিষাদে মন জ্বলিতেছে।

    প্রধানমন্ত্রীও ওই বিজ্ঞানীরে ডাকিয়া কথা বলিতে চাহিয়াছেন। একটি তারিখও দেওয়া হইয়াছিল। কিন্তু ওই তারিখে প্রধানমন্ত্রীর ব্যস্ততা বাড়িয়া যাওয়ায় সাক্ষাতটি আর ঘটিতে পারে নাই। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হইতে ড. বিজনকে জানানো হইয়াছে, খুব শিগগিরই দুজনের সাক্ষাত ঘটিবে। করোনা পরীক্ষার যে দ্রুত পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হইযাছে তাহা বাস্তবায়নের লাগিয়া রিএজেন্ট আমদানির অনুমোদনের ব্যবস্থাও প্রধানমন্ত্রী নিজ উদ্যোগেই করিয়াছেন। কারণ তিনি জানেন ঘাপলা হইতেই পারে।

    ড. বিজনের এমন সাফল্য ইহাই প্রথম নহে। দুই দশক আগে ছাগলের মড়ক ঠেকাইতে পিপিআর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করিয়াছিলেন। ছাগলের মড়ক ঠেকাইয়া তিনি যে দেশে ছাগলের সংখ্যা বাড়াইয়া দিয়াছেন তাহা চারিপাশ দেখিয়াই বুঝিতে পারিতেছি। ওই বিজ্ঞানী সিঙ্গাপুরে সার্স ভাইরাসটিরও দ্রুত নির্ণয়ের পদ্ধতি উদ্ভাবন করিয়া ইতিহাসে নাম লেখাইয়াছেন। সার্স ভাইরাস শনাক্ত করার কিটের পেটেন্টে রহিয়াছে এই বিজ্ঞানীর নাম।

    প্রধানমন্ত্রী এই দেশপ্রেমিক বিজ্ঞানীকে আমন্ত্রণ জানাইয়া বিব্রতই করিয়াছেন বলিয়া মনে হইয়াছে। তিনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করিয়া থাকেন সেই প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা আরেক দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী নাখোশ হইয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন, একটা জিনিস পাইলেই আমরা সবাই মিলিয়া অন্যদিকে লইয়া যাই। এখানে ব্যক্তিপূজা তো মুখ্য নহে। প্রধানমন্ত্রী তো কেবল ড. বিজন কুমার শীলকে ডাকিতে পারেন না। পুরো একটা টিম কাজটি সম্পন্ন করিয়াছে। ডাকিলে তো সবাইকেই ডাকিতে হইবে।
    এক মাস পার হইয়া গেল বিজ্ঞানী বাবুর আর ডাক আসিল না।

    ২.
    দুইদিন আগে যখন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র বলিল, তাহারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করিয়া সরকারের কাছে তাদের আবিস্কৃত কিট পরীক্ষার জন্য তুলিয়া দিবে তখনই খটকা লাগিল। রিপোর্টারদের বলিলাম, খোঁজ নিয়া দেখতো সরকারি লোকজন এই বদান্যতা দেখাইবে কিনা? তাহারা খোঁজ আনিয়া দিল সরকারের পক্ষ থেকে কারণ উল্লেখপূর্বক চিঠি দিয়া আগেই জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে ওই অনুষ্ঠানে তাহাদের পক্ষে যাওয়া সম্ভন নহে। ওই অনুষ্ঠানে জাফরুল্লাহ সাহেব বলিলেন কী কারণে সরকারি লোকজন আসিল না তাহা তার বোধগম্য হইতেছে না।

    আজ যখন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের লোকজন ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে গেল, তখন প্রশাসনের অধিকর্তা আমাদের জানাইলেন, কিট বাজারে আনিতে হইলে প্রটোকল মানিয়া কিভাবে কি করতে হয় সেই প্রসেসটা জানিতে তাহারা আসিয়াছিলেন। আমার সব কিছু তাহাদের বুঝাইয়া দিয়াছি। তাহারা বুঝিয়াছেন ইহাতেই আমার খুশী।
    এরপর বিকালেই সংবাদ সম্মেলন করিয়া জাফরুল্লাহ সাহেব অভিযোগ করিলেন, প্রশাসন ঘুষ চায়। ভয়ঙ্কর অভিযোগ। প্রশাসন ঘুষে সন্তুষ্ট হইয়া থাকে ইহা সত্যি। করোনাযুগে চিকিৎসা ব্যবস্থা যে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে ইহাতো দিব্য চোখেই দেখিতেছি। তাই বলিয়া নিজেদের বিজ্ঞানীর আবিস্কার করা কিট লইয়া এমন রঙ্গ তামাসাতো মানিয়া লওয়া যায় না। আবারো রিপোর্টারকে বলিলাম খোঁজ লাগাও ঘটিযাছে কী? অধিদপ্তরের অধিকর্তার সহিত যোগাযোগ স্থাপন কর। রিপোর্টার সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করিল। তাহার কথা শুনিয়া মনে হইলো কোথাও একটা গন্ডগোল পাকিয়াছে। তিনি বলিলেন গনস্বাস্থ্যের লোকজন আসিয়া কিট পরীক্ষার জন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করিযাছে। যাহা আমরা প্রথম থেকেই বলিয়া আসিতেছি। তাহার রাজি হইল। এজন্য আমাদের কাছ থেকে চিঠি চাহিল। আমারও চিঠি দিয়া দিলাম। তাহার কোন কিট নিয়া আসে নাই। এখন বলিতেছে আমরা কিট গ্রহণ করি নাই। এরকম উল্টাপাল্টা বলিলে আমি কী করিবো। রাগিয়া গিয়া তিনি বলিয়াই দিলেন এমন করিতে থাকিলেতো তাহাদের আর এই অফিসে ঢুকিতেই দিবো না। বড়ই রাগের কথা। তিনি যদি তখন জানিতেন জাফরুল্লাহ সাহেব তাহার সম্পর্কে আরো কটু কথা বলিয়াছেন তাহলে না জানি কী মূর্তি ধারণ করিতেন তাহা অনুমানও করিতে পারিতেছি না।

    ৩.
    আমরা চিকিৎসা বিভাগের লোক নই। বিজ্ঞানীও নই। আমরা পিসিআর টেস্টও বুঝি না। এন্টিবডিও বুঝি না। আমরা কিটও বুঝি না। আমরা বুঝি- মরিতে চাহি না আমি সুন্দর এই ভুবনে। আমরা বুঝি, আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম।
    আর এখন দেখিতেছি কিটের মাঝে কীট। আমরা কি হইতেছি ফিট।

    ( জাহিদুল ইসলাম পিন্টুর ফেসবুক ওয়াল থেকে)

  • করোনার সাথে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে তৈরী হোক মানবিকতার পৃথিবী

    করোনার সাথে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে তৈরী হোক মানবিকতার পৃথিবী


    অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী
    একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি বিশ্ববাসীর সাথে আমরাও। সারা পৃথিবী আজ স্তব্ধ প্রায়। প্রতিদিন বাড়ছে মৃত মানুষের কাফেলা। সবচেয়ে শক্তিশালি, আর্থিক ভাবে নিরাপত্তাপূর্ন, ধনী রাষ্ট্রগুলো বেশী সংকটে। প্রতিদিন বাড়ছে মানুষের মৃত্যুর মিছিল। কোন ভাবেই সামাল দিতে পারছে না করোনা ভাইরাসের প্রকোপ। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর এতবড় হোচট খাইনি বিশ্ব।
    রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জীবনের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে সাধারন ছুটি ঘোষনা করেছে। আইন শৃংখলা বাহিনীর সাথে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে রাষ্ট্রের নাররিকদের ঘরে থাকা নিশ্চিত করার জন্য, যেটাকে বলা হচ্ছে ‘হোম কোয়ারেন্টাইন’। গত কয়েক দিনের কড়াকড়িতে মানুষকে ঘরে মোটামুটি ভাবে আটকানো গিয়েছিল। মানুষও নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়ে বেশ কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে- এটা বলার অবকাশ রাখে না। কিন্তু নিয়ম মানার ক্ষেত্রে ‘অন্যের জন্য আইন আমার জন্য নয়’ এরকম একটা মানষিক গঠন বলতে গেলে প্রায় সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
    করোনা নামক একটি অদৃশ্যমান শত্রুর অঘোষিত যুদ্ধে বিপর্যস্ত সমগ্র পৃথিবীর মানবকুল। চরম এক দুর্যোগময় মহামারীর মধ্য দিয়ে মানবজাতিকে চলতে হচ্ছে। ইতোপূর্বের সকল দূর্যোগের সময় মানুষ্য জাতির সাথে প্রকৃতিতেও বিপর্যয় ঘটতো। মাপনুষের পাশাপাশি নদী, প্রানীকুলসহ প্রাকৃতিক পরিবেশেও বিরুপ প্রতিক্রিয়া কিছু না কিছু ঘটতো। কিন্তু এবারের বিষয়টি একবারে উল্টো। প্রকৃতি অনেক স্বাভাবিক নয় আরো সৃজনশীল। নদী ফিরে পাচ্ছে পুরাতন ঐতিহ্য। প্রাণিকুলে সৃষ্টি হয়েছে নূতন জীবনের স্পন্দন। সবচেয়ে দূর্ষোনযুক্ত নদী গুলো আজ দূর্ষোণের কবল থেকে অনেকাংশে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়েছে। যেখানে পাখির দেখা পাওয়া যেত না সেখানে পাখির কলকাকলিতে মুখরিত। কেমন যেন মানবজাতির বিপক্ষে সকল প্রকৃতি।
    পৃথিবীতে মানুষজাতির উদ্ভব এরপর থেকে মানুষ প্রকৃতিকে নিজেদের ইচ্ছামত ব্যবহার করেছে নিজের বেঁচে থাকা ও বিকাশের প্রয়োজনে।এক শ্রেনী অত্যাধিক মুনাফা অর্জণ, ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখা এবং সকল মানবজাতিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে পৃথিবীর বুকে চালিয়েছে নির্বিচারে লুন্ঠন। আর এগুলো করতে যেয়ে বিজ্ঞানকে অপব্যবহার করে করেছে রাসয়ানিক বিষক্রিয়া। একেরপর এক মারনাস্ত্র ব্যবহার করে পৃথিবীকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। নিবিচারে ধ্বংশ করেছে প্রকৃতিক স্বাভাবিক চক্রকে। সীমাহীন ভোগবাদী মানষিকতায় সর্বচ্চ সুখ প্রাপ্তির আশায় তৈরী করেছে পরিবেশ নিয়ন্ত্রন করার যন্ত্র। ফলে ধরিত্রি গরম হতে হতে একটি জ্বলন্ত চুল্লিতে পরিনত হয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে সকল ধরনে ভারসাম্য।
    তাবৎ পৃথিবীর শান্তি প্রিয় মানুষ, বিজ্ঞানী, গবেষকসহ মানবিকতা সম্পন্ন গোষ্টি ও অপেক্ষাকৃত দূর্বল এবং ঝুঁকির মধ্যে পড়া দেশ গুলোর পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছিল, একটু সামলে চলো। একটু সংযত হও। ধরিত্রিকে কিছুটা হলেও স্বাভাবিকতার পথে ফিরে আসার সুযোগ তৈরী করো। প্রাণীকুলদের জীবনকে হুমকিতে রেখ না। নদীকে দুর্ষোনে ভরে দিও না। পানিকে নিরাপদ করো। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তাবৎ ধনী রাষ্ট্র ও তাদের মোড়লরা কারো কথায় কর্ণপাত করা দুরে থাক, আরো বেশী আগ্রাসীভাবে ধ্বংসের উৎমাদনায় নেচেছে।

    সাম্প্রতিক করোনা ভাইরাস এর উৎপত্তি-বিকাশ নিয়ে নানান আলোচনা হচ্ছে। কারনের কারন খুজছে বড় বড় পন্ডিতরা। প্রশ্ন তৈরী হয়েছে, এটি প্রাকৃতিক না মানুষ সুষ্ট। বিশ্ব মোড়ল আমেরিক ও তাদের কয়েকজন সহযোগি, যারা ইরাককে বিধ্বস্ত করেছে, লিবিয়াকে ধ্বংশের শেষ প্রান্তে নিয়ে গেছে, তারা প্রমান করার জন্য আর্ন্তজাতিক আদালতে যেয়ে উঠেছে এই বলে যে, চীন এ ভাইরাস টাকে ছেড়েছে।
    আর মানবজাতির এ বিপর্যয়ের মধ্যে প্রকৃতি, নদী, প্রাণীকুল যেন প্রাণ পেয়েছে। নদীরপানি দুষোনমুক্ত হয়েছে অনেকাংশে। বড় বড় প্রাকৃতিক বনগুলোতে সবুজের প্রলেপ লেগেছে বৃক্ষরাজীর পাতায় পাতায়। নানান ধরনের পাখির কলকাকোলী আবার শোনা যাচ্ছে। বিপন্ন হওয়ার হুমকিতে থাকা প্রানী কুলের বিচরন স্বস্তিদায়ক হয়ে উঠছে পরিবেশবীদদের কাছে। এ যেন ধ্বংশ আর সৃষ্টির পাশাপাশি চলা। কিন্তু একটু ব্যতিক্রম যেটি হচ্ছে সেটি হলো মনুষ্য জাতি প্রতিদিন মৃত্যুর তালিকাভুক্ত হচ্ছে। মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা শুধুই বাড়ছে। এ মৃত্য নিয়ে কেহ প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করতে পাছে না।
    রাষ্ট্র সমুহের অবস্থান দেখলে দেখা যাবে একটু নিয়মতান্ত্রিক বাষ্ট্র কাঠামো, পরিকল্পিত অর্থনীতি ও সামাজিক বিন্যাস সে সকল রাষ্ট্র অনেকাংশে সামলে নিয়েছে। মৃত্যুর কাফেলাকে কমাতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের জীবনকে বেশীভাগ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বলায়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে যে সকল রাষ্ট্র অবাধ জীবসযাপনে অভ্যস্ত, ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাশিতা সীমাহীন। পৃথিবীর মোড়ল তথা পরাাশক্তি হিসেবে এতদিন নিজেদেরকে প্রচারনায় রেখে ছিলেন, তারাই পড়েছেন বেশী সংকটে। মানুষের জীবন কত অসহায় করে রেখেছিল তার চিত্র প্রতিদিনের সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ ঘটছে। পৃথিবীর দেশে দেশে অস্ত্র পাঠিয়ে দেশগুলোকে অস্থির করে রেখেছিল। তারা কত অবস্থ্যাপনা নিজের দেশে করে রেখেছিল মানুষের মৃত্যুতে তা প্রকাশিত হয়েগেছে। মৃত্যুর কাফেলা রাশ টানতে হিসসিম খেতে হচ্ছে।
    সবথেকে ছোট দেশ গুলোর অন্যমত, পশ্চিমা প্রচারনায় সবচেয়ে আর্থিক সংকটে থাকা দেশ সামাতান্ত্রিক কিউবা আজ অনেক রাষ্ট্রের জন্য প্রেরনাদায়ক শুধু নয়, বরঞ্চ সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে তাদের দিকে। আজকের করোনা ভাইরাসের মধ্য দিয়ে পরিস্কার হয়ে গেছে পররাষ্ট্রের অভ্যন্তরিন বিষয় সমুহকে অস্থির করা দেশগুলোর মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে কত ব্যার্থ এর সরকারগুলো।
    আজকের প্রেক্ষাপটে পরিস্কার হয়েগেছে রাষ্ট্রের কোন কোন খাতগুলো বানিজ্যের বাহিরে নিয়ে মানুষের নাগরিকের নিরাপত্তার জন্য বাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে। মানুষের মৌলিক চাহিদা সমুহ রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। খাদ্য, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা আর পরিবেশকে রাষ্ট্রকে পৃথিবীর ভারসাম্যের সাথে মিলিয়ে চালাতে হবে। ধনী রাষ্ট্র গরিব রাষ্ট্র এ মূল্যবোধকে পরিত্যাগ করতে হবে। বিজ্ঞানকে মারনাস্ত্র তৈরীতে বেশী ব্যবহার না করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যবহার করা। দরকার পৃথিবীর ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্থ করে এমন সিদ্ধান্ত থেকে বড় রাষ্ট্র গুলোকে সরে আসতে হবে। রাষ্ট্রসংঘ বা জাতীসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত প্রতিষ্ঠান গুলোকে শক্তি প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করা। বিশ্ব বানিজ্য সংস্থাকে সার্বজনিন করা এবং পিছিয়ে থাকা রাষ্ট্র গুলোকে বিধি নিষেধের বেড়াজ্বাল মুক্ত করে নায্যতা নিশ্চিত করা।
    করোনা নামক ভয়বহ ভাইরাস খেকে পৃথিবীর মানুষকে নিরাপদ করতে ইতোমধ্যে শুরু হযেছে গবেষনা। মানব ট্রায়েল শুরু হয়েগেছে উৎপাদিত ভ্যাকসিনের। হয়ত আরো মানুষের শব যাত্রা শেষ করে মানুষ প্রতিরোধক ঔষধ তৈরী করে সামলে উঠবে। কিন্তু মরনের কাফেলায় সে সকল পরিবার তাদের প্রিয়জন অথবা আয়ের প্রধান ব্যক্তি যেুক্ত হয়ে গেছে ইতোমধ্যে সে সকল পরিবারের ক্ষতি কি ভাবে পুষিয়ে নেবে। রাষ্ট্রের যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে যাবে তা কাটিয়ে উঠতে কত কষ্টের সীমা অতিক্রম করতে হবে নাগরিকদের সেটি চিন্তা বাইরে। তবে এ সংকট চোখেআঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ব্যক্তি ভোগের জন্য উম্মুক্ত না রেখে পরিকল্পিত ব্যবস্থার মাধ্যমে নাগরিকের জীবন নিরাপত করতে প্রয়োজনীয় কাজ গুলোতে রাষ্ট্রকে বেশী মনোযোগি হতে হবে। প্রত্যেকটিনাগরিকের স্বাস্থ্য ও খাদ্য এবং পরিবেশ সম্মত নিরাপদ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রধান জরুরী। মোড়লীপনার চিন্তার পরিহার করে নুন্যতম সহমর্মিতার পথে হাটতে হবে সকল প্রধান রাষ্ট্রকে। বৈষম্যময় দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে নায্যতা স্বীকৃতি দেওয়ার মানষিকতা তৈরী করতে হবে সকল রাষ্ট্রের।
    সকলের আকাংথার জায়গাটা তৈরী হবে মানবিকতার পক্ষে। মানবিক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে। বৈষম্য নয়, সাম্য হোক লক্ষ্য।

  • করোনা প্রশমিত হলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পুনর্জাগরণ লক্ষ করা যাবে: আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম

    করোনা প্রশমিত হলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পুনর্জাগরণ লক্ষ করা যাবে: আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কলাম

     ঢাকার একটি দৈনিকে অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ‘করোনা জয় ও মানবতা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি করোনাভাইরাসের হামলা থেকে সতর্ক থাকার উপদেশ দিয়ে ভবিষ্যতে করোনা আমাদের জন্য কী পরিণতি বহন করে আনবে তারও স্পষ্ট আভাস দিয়েছেন। তাঁর এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ মননশীল প্রবন্ধে একজন অর্থনীতিবিদের দৃষ্টি দ্বারা বর্তমান অবস্থার যে বিশ্লেষণ করেছেন তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি। কিন্তু অর্থনীতি সম্পর্কে আমার জ্ঞান গ্রামের নকুল দাসের মতো, এ কথা স্বীকার করে বলছি, এক স্থানে এই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদের সঙ্গে সহমত পোষণ করি না।

    এই বিষয়টি হলো, তিনি মনে করেন, ‘করোনা-পরবর্তী বিশ্বে নিউ লিবারেলিজম বা নয়া উদারতাবাদের জয় হবে। নামে উদারতাবাদ। আসলে এটি হচ্ছে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম ও মার্কেট ইকোনমিরই মিলিত নাম। নিউ কনজারভেটিজম বা ‘নিউকন’ নামে এই মানবতাবিরোধী শক্তিই এখন আমেরিকায় ক্ষমতা দখল করেছে। বর্তমান বিশ্ববিধ্বংসী করোনা-হামলার পর এই আগ্রাসী বিশ্বধনতন্ত্রই আরো শক্তিশালী হবে এবং শোষিত মানবসমাজ আরো শোষিত এবং দুঃখ-কষ্টের ভাগী হবে বলে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। বলেছেন, সমাজতন্ত্রী বিশ্বের নব উত্থানের সম্ভাবনা ক্ষীণ।

    তাঁর নিজের ভাষায় বলি, ‘…নব্য উদারতাবাদ শনৈ শনৈ এগিয়ে চলে। এই প্রক্রিয়ার আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে ২০০৮ সালে বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থায় ধস নামে এবং বিশ্বমন্দা সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেই অবস্থা সত্ত্বেও নব্য উদারতাবাদ সাময়িক সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়ায় এবং এগিয়ে চলে। পাশাপাশি কোনো কোনো দেশকে সময় সময় বাম রাজনীতির দিকে ঝুঁকতে দেখা গেলেও তার অগ্রগতি হয়নি।’

    অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদকে আমি শ্রদ্ধা করি। আলোচিত প্রবন্ধটিতেও তিনি করোনা-জর্জরিত বিশ্বের বর্তমান ও ভবিষ্যতের পরিস্থিতি চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তবে তিনিও সম্ভবত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার মতো নব্য উদারতাবাদের চূড়ান্ত বিজয়ে বিশ্বাস করেন। যদি করেন, তাহলে আমাদের কিছু বলার নেই। কাজী খলীকুজ্জমানই বলেছেন, ১৯৯০ সালে ফুকুয়ামা উদারতাবাদের চূড়ান্ত বিজয়ের কথা বলেছেন। ২০০৪ সালে তিনিই আবার নব্য উদারতাবাদের গ্রাসে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বিপুলভাবে বাড়ছে দেখে রাষ্ট্র তথা সরকারের শক্তি বাড়ানোর কথা বলেছেন। অর্থাৎ উদারতাবাদের অবাধ আগ্রাসন থেকে জনগণের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য রাষ্ট্র ও সরকারের হাতে আবার অনেকটা ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া দরকার।

    আমি এই অর্থনীতিবিদের আলোচ্য বিশ্লেষণের সঙ্গে সহমত পোষণ করি; কিন্তু তাঁর প্রেডিকশনের সঙ্গে নয়। ২০০৮ সালে বিশ্বধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাদের ত্রুটির জন্যই মন্দা দেখা দেয়। বড় বড় ব্যাংকে ধস নামে। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে থাকে। এই ব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক বিধান মেনে রাষ্ট্র বা সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে করপোরেট পুঁজি বাধ্য হয়। ব্রিটেনের তৎকালীন লেবার দলীয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে সরকারি ফান্ড থেকে পড়ন্ত অবস্থার ব্যাংকগুলোকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে (সাময়িকভাবে) কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলে বাঁচানো হয়, শেয়ারবাজারের ধস থামানো হয়। অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক কম্যান্ড অর্থনীতি বিশ্বপুঁজিবাদকে রক্ষা করে। লন্ডনের ডেইলি টাইমস একে আখ্যা দিয়েছিল, ‘Sociolistic Prescription for capitalist illness’ (ধনতন্ত্রের রোগ সারানোর জন্য সমাজতান্ত্রিক চিকিৎসাপত্র)।

    আমরা সবাই জানি, নয়াচীন অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কমিউনিস্ট রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে পুঁজিবাদী অর্থনীতি গ্রহণ করেছে এবং একটি অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ার হয়েছে। ফলে এটিকে বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ সোশ্যালিজম ও কমিউনিজমের সম্পূর্ণ পরাজয় বলে বিশ্বময় প্রচার করছে। কিন্তু ধনতান্ত্রিক বিশ্বের অর্থনীতিবিদরা যে কথাটি সযত্নে লুকিয়ে রেখেছেন তা হলো, বিশ্বধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এখন যতই আগ্রাসী মূর্তিতে দেখা যাক, এটি তার ভয়াল প্রেতমূর্তি। অভ্যন্তরীণ ক্ষয়ে তারও বিশাল পরাজয় ও পতন ঘটেছে, যা কয়েক দশক ধরে চেপে রাখা হয়েছে।

    দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের শক্তিশালী অভ্যুদয়ে পশ্চিমা ধনতন্ত্রের পতনের সূচনা হয়। পশ্চিমা দেশগুলো এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় তার বিশাল বাজার হারায়। ধনতন্ত্রের পতন ঠেকাতে আমেরিকায় রিগ্যান প্রেসিডেন্সির আমলে যে ‘রেগানোমিক্স’ অর্থনীতির কথা বলা হয়, তা নব্য উদারতাবাদের পূর্বসূরি। ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচারের টোরি সরকারের আমলে অর্থনীতির পতন ঠেকানোর জন্য পোল ট্যাক্স নামে এক নতুন কর জনসাধারণের ওপর চাপানো হয়। জনগণ বিদ্রোহী হয়। মার্গারেট থ্যাচার দ্রুত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ধারা অনুসারে চিকিৎসা, আবাসন ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘোষণা করেন, ক্যাপিটালিজম এখন আর ধনীদের হাতে বন্দি নয়, তা এখন জনকল্যাণেরও বাহন। তার নাম পিপলস ক্যাপিটালিজম বা জনগণের ধনতন্ত্র।

    কট্টর ক্যাপিটালিজমের পথ থেকে সরে এসেও মার্গারেট থ্যাচার রক্ষা পাননি। পোল ট্যাক্সের জন্য অসন্তুষ্ট জনসমাজের বিক্ষোভের ফলে তাঁর পতন হয়। তাঁরই শিষ্য জন মেজর পরবর্তী টোরি প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়ন দিয়ে থ্যাচারপন্থীরা ভেবেছিল, জন মেজর মার্গারেট থ্যাচারের ‘অস্টারিটির’ পথ ধরবেন। অর্থাৎ জনকল্যাণ খাতে সরকারি খরচ বিপুলভাবে কমাবেন। প্রথম দিকে জন মেজর তা-ই ছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তিনি তাঁর চরিত্র পাল্টে রাষ্ট্রের হাতে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়ান এবং ওয়েলফেয়ার খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করার নীতি গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচার যে পিপলস ক্যাপিটালিজমের কথা বলেছিলেন, তা আসলে কিছুটা বাস্তবায়ন ঘটে জন মেজরের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলেই।

    পশ্চিম ইউরোপে যে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির বিস্তার ঘটে, তা আসলে ধনবাদ ও সমাজবাদের মিশ্রণ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন অধিকৃত পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের নামে একনায়কত্বমূলক অত্যাচারী শাসন চাপাতে গিয়ে জনগণের মনে সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থার আবেদন নষ্ট হয়। আমেরিকার পাতা আফগান যুদ্ধের ফাঁদে পা দিয়ে দ্বিতীয় সুপারপাওয়ার হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পতন হয়। মানুষ ধরে নেয়, বিশ্বে সমাজতন্ত্রের পতন ও পরাজয় ঘটেছে।

    এই সুযোগে ইউরোপের ধনবাদী রাষ্ট্রগুলো আমেরিকার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। চীন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদী প্রণোদনা থেকে কৌশলগত কারণে আমেরিকার Valued ally বা দামি মিত্র রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ধনবাদ ধরে নেয়, তার আর কোনো প্রতিযোগী নেই। তার হাতে তিন মারণাস্ত্র। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, সামরিক ক্ষেত্রে ন্যাটো। রাজনীতির ক্ষেত্রে বশংবদ জাতিসংঘ। এই তিন বাহুর শক্তিকে ভিত্তি করেই আমেরিকার হাতে চলে যায় গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের নেতৃত্ব। আমেরিকায়ই সামরিক শক্তিনির্ভর নিও-লিবারেলিজমের উদ্ভব। তারা বুশ পরিবারের নেতৃত্বে হোয়াইট হাউসে বসার পর প্রথম শক্তি পরীক্ষা চালায় মধ্যপ্রাচ্যে। লিবিয়ার গাদ্দাফি ও ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করে তারা মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।

    নব্য উদারপন্থী পশ্চিমা ধনবাদী অ্যাক্সিসের বিরুদ্ধে প্রথম চ্যালেঞ্জ আসে আন্তর্জাতিক ইসলামিস্ট ও জিহাদিস্টদের তরফ থেকে। তারা পশ্চিমা ধনবাদী ব্যবস্থাকে নয়, পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থাকেই চ্যালেঞ্জ জানায়। নিজের সৃষ্ট পোষা দৈত্যের বিদ্রোহে পশ্চিমা রাষ্ট্রশক্তি প্রথমে ভীত হয়নি। তারা ভেবেছিল, জিহাদিস্টদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে সন্ত্রাস দমনের নামে বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে। জিহাদিস্টরা পরে চূড়ান্তভাবে পরাজিত না হলেও তাদের সাময়িকভাবে দমন করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় না হলেও ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর ওপর দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ আসে মার্কিন সহায়তায় সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পুষ্ট নয়াচীনের কাছ থেকে। ওবামা আমল পর্যন্ত আমেরিকার নীতি ছিল চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ইসলামী শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠা ইরানকেও বেশি না খোঁচানো। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হতেই নব্য উদারবাদীরা আরো শক্তিশালীভাবে ক্ষমতায় আসে।

    তারা নয়াচীনকে দমনের জন্য তার সঙ্গে ট্রেড ওয়ার শুরু করে এবং ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে। প্রকাশ্য আণবিক যুদ্ধে জড়ানোর চেয়ে (কারণ চীনের হাতেও আণবিক বোমা এবং ইরানেরও আণবিক অস্ত্র বানানোর ক্ষমতা আছে) প্রয়োজনে গোপন জীবাণুযুদ্ধে নয়াচীনকে কাবু করার প্রস্তুতি আমেরিকার আছে। কয়েকটি ল্যাবরেটরিতেই বিষাক্ত জীবাণু নিয়ে তাদের গবেষণা চলছে। অন্যদিকে চীনের হুবেই প্রদেশের গবেষণাগারটি যে বিষাক্ত জীবাণু নিয়ে, তা এখন প্রকাশ পাচ্ছে।

    গত ১৯ এপ্রিল সানডে টাইমস হুবেই প্রদেশের গবেষণাগার নিয়ে একটি বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেছে। বিবরণটির শিরোনাম :Curse of the Bat woman what went on in Wuhan lab? (ব্যাট ওম্যানের অভিশাপ—উহান ল্যাবরেটরিতে কী চলছে?) এই ল্যাবরেটরির জীবাণুবিদ শি ঝেঙলি (She Jhengli) প্রথমে সন্দেহ করেছিলেন, চীনা ল্যাবরেটরি থেকেই ভুলক্রমে এই দৈত্য মুক্তি পেয়েছে। এখন তা মনে করছেন না। তাহলে কি কোনো মার্কিন গবেষণাগার থেকে তা মুক্তি পেয়েছে? এ প্রশ্নের জবাব দেবে কে? দুই পরাশক্তির গোপন প্রতিযোগিতা থেকে এই মারণদূতের জন্ম, তাতে সন্দেহ পোষণ করা চলে কি?

    আমার মতো এক অভাজনের বক্তব্য, এই যুদ্ধেও নয়া উদারতাবাদীদের একচেটিয়া জয়লাভের সম্ভাবনা কম। তবে এই যুদ্ধে মানবতা ধ্বংস হতে পারে। এই যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে, তা আমি মনে করি না। তবে করোনাভাইরাসের বর্তমান হামলা থেকে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের ওপর অর্থনৈতিক মন্দার বেশে যে প্রচণ্ড আঘাত আসবে, তা সামলানোর জন্য ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিকে ২০০৮ সালের মতো সমাজতান্ত্রিক প্রেসক্রিপশন গ্রহণ করতে হবে। আরো সহজ কথায়, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বহু বিষয় গ্রহণ করতে হবে।

    এই করোনাভাইরাস প্রশমিত হলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পুনর্জাগরণ লক্ষ করা যাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যেমন সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রকে পিছু হটতে হয়েছিল, এবারের করোনা-হামলার পরও নব্য উদারতাবাদীদের বেশ কিছুটা পিছু হটতে হবে।

    লন্ডন, মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল ২০২০ / আজকের সূর্যোদয় অনলাইন।।

  • কৃষক কি এমন প্রণোদনা চেয়েছিল – নুরুল আলম মাসুদ

    করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক তান্ডবের ধাক্কা বাংলাদেশেও লেগেছে। বাংলাদেশর মতো জনবহুল- ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশের জন্য কারোনাভাইরাসের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় কতাটা গভীর হতে পারে তা এখনো অনুমেয় নয়। তবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক আশঙ্কা করছে, করোনাভাইরাসের অভিঘাতে বাংলাদেশে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১.১ শতাংশ হ্রাস পেতে পারে। একই সাথে রেমিট্যান্সও তৈরি পোষাকসহ রপ্তানি আয় হ্রাস যে  পাবে তা প্রায় নিশ্চিত; সেই সাথে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানও হ্রাস পেতে পারে। অর্থনীতিকে সচল রাখতে সরকার যদিও ইতোমধ্যে ৭২,৭৫০ কোটি টাকার একটি প্রণোদনা ঘোষণা করেছে তবে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে এই প্রণোদনা প্যাকেজটি কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে তা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

    ফলে আমাদের ভরসা থাকলো কৃষি।বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, বাংলাদেশের এখনো শতকরা প্রায় ৮৭ ভাগ  গ্রামীণ মানুষের আয়ের উৎস কৃষি। দুই-তৃতীয়াংশ গ্রামীণ পরিবার কৃষি ও অকৃষিজ উভয় আয়ের ওপর নির্ভরশীল।   শহরে বসবাসকারীদের মধ্যেও ১১ শতাংশ মানুষ সরাসরি কৃষিকাজে যুক্ত।   বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপের (২০১৩) হিসাব মতে, দেশের মোট শ্রমমক্তির ৪৫.৭ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু, করোনার আগ্রাসন থেকে রেহাই পায়নি কৃষিখাতও।পরিবহন লকডাউন এবং  আঞ্চলিক লকডাউনের  কারণে পণ্যবাজার সংকুচিত হয়েছে, কৃষক তারউত্‌পাদিত ফসল বিক্রি করতে পারছেন না আবার উপকরণ সরবরাহে অপ্রতুলতায় আগামিতে উৎপাদন কমে আসারও শঙ্কা রয়েছে।তাতে আসছে দিনগুলোতেদেশে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেওয়ার সমূহ আশংকা রয়েছে। গত ৭ এপ্রিল জেলা প্রশাসকদের সাথে এক ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই যে করোনা প্রভাব, এতে ব্যাপকভাবে খাদ্যাভাব দেখা দেবে বিশ্বব্যাপী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল, সে রকম অবস্থা হতে পারে।‘ তাই কৃষিই হতে পারে একমাত্রআন্তঃসম্পর্কিত খাত। আসন্ন  মন্দায় জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির নিশ্চয়তা, কর্মসংস্থান, এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

    চলতি করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে কৃষকদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে গত ১২ এপ্রিল  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দেন। এই প্রণোদনা কৃষকদের আদতে কাজে আসবে কিনা সেই বিতর্ক পরে, কিন্তু সরকার যে কৃষকেদর নিয়ে ভেবেছেন তার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ।

    প্রথমত: এই প্রণোদনা কৃষকদের জন্যরাষ্ট্রীয় কোন অনুদান বা আর্থিক সহায়তা নয়। এটি কৃষিখাতে ৪% সুদে ঋণ (এটি প্রথমে ৫ শতাংশ ছিল, সমালোচনা হওয়ায় তা ৪ শতাংশ করা হয়েছে); কৃষকরা চাইলে এই তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারবে। মজার বিষয় হলো, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী বড় উদ্যোক্তাদের জন্যঘোষিত চারটি প্যাকেজের সুদের হার ২ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে।অথচ। ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য ৫ শতাংশ সুদের হার কৃষকের জন্য রীতিমত গলার কাটার মতো বিঁধে যাবে। তাই কৃষকেদের জন্য সুদের হার সর্বনিন্ম ২ শতাংশ করা উচিত।

    প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা ঘোষণাকালে বলেন, আগামি বাজেটে সারের ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকাবরাদ্দরাখা হয়েছে। বিগত পাঁচ বছরের বাজেটের দিকে তাকালে দেখা যায়, এটি গত পাঁচ বছর ধরেই রাখা হচ্ছে। কিন্তু,সংশোধিত বাজেটে দেখা যায় বরাদ্দের ৩০ শতাংশই টাকাই কম খরচ করা হয়েছে। তাই এবারও ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও আদতেই কত টাকা কৃষকের ভর্তুকির জন্য খরচ করা হবে সেই সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

    আর কয়েকদিনের মধ্যে বোরো ধান কাটা শুরু হবে। কৃষি মন্ত্রনালয়ের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এই বছর ২ কোটি ৪ লাখ মেট্রিকটনরোরো চাল উত্‌পাদিত হবে। সরকার ইতোমধ্যে ইতোমধ্যে ৬ লাখ টন ধান এবং ১১ লাখ টন চাল কেনার সিন্ধান্ত নিয়েছিলো। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্স আরো দুই লাখ টন বেশি ক্রয়ের ঘোষনা দেন। তাতে সবমিলিয়ে ১৯ লাখ মেট্রিক টন চাল/ ধান ক্রয় করবে। এটি মোট উত্‌পাদিত বোরোর ১০ শতাংশেরও কম? তাহলে বাকি ৯০ শতাংশ ধান কোথায় যাবে, তারজন্য কৃষকরা কী ন্যায্যমূল্য পাবে?

    দেশে অঘোষিত লকডাউন চলার কারণে বোরো ধান কাটা,ঘরে তোলা, চাতালে আনা এবং সরকারি গুদাম অব্দি নিয়ে আসা নিয়ে নিদারুন শঙ্কা রয়েছে। সেই সাথে ধান কাটার জন্য এক এলাকার শ্রমিক যদি অন্য এলাকায় যেতে না পারে তাহলে ব্যাপকভাবে শ্রমিক সংকট দেখা দিবে এবং কোন কোন এলাকায় দৈনিক মজুরি অনেক বেড়ে যেতে পারে। এই দিকে মিল মালিকরা বলতে শুরু করেছেন, ধানকাটা শুরু হলে এবং সরকার ধানক্রয় শুরু করলে ধানের দাম পড়ে যাবে; তাই খুব জরুরিভাবে সরকারকে ধানের আগাম মূল্য এবং ধান কাটা শ্রমিকদের জন্য দৈনিক ন্যূনতম মজরি ঘোষণা করা উচিত। তাতে ক্ষুদ্র কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাবে।

    এই মুহুর্তে কৃষকের হাতে কোন টাকা নেই। ফলে বোরো ধান কাটার জন্য শ্রমিকদের টাকা পরিবর্তে ধান দিয়ে পারিশ্রমিক শোধ করা হতে পারে। সরকারের ধানক্রয় নীতিমালায় উপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে সেই শ্রমিকরা যেন তাদের ধান সরকারের কাছে বিক্রি করতে পারে তার নির্দেশনা প্রদান করা যেতে পারে।

    বর্তমানে সরকারি গুদামজাতকৃত মোট ১৭৫১ লাখ মেঃ টন খাদ্যশস্যের মজুদ রয়েছে (১৫/০৩/২০২০ )।বৈশ্বিক বিভিন্ন পূর্বাভাসইবলছে, করোনা তান্ডব আরো দীর্ঘমেয়াদী হবে এবং লকডাউনের সময়ও বৃদ্ধি পাবে। সেই হিসেবে সরকার অতিদরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য যে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেটি আরো দীর্ঘসময় ধরে চালিয়ে গেলে সরকারি সব গুদামই খালি হয়ে যাবে। তাতে করে সরকারের ২৫ লাখ মেট্রিকটন মজুদ করার জন্য যে অবকাঠামো রয়েছে তার পুরোটাই ধানচাল ক্রয় করতে পারে। পাশাপাশি, ঘোষিত প্রণোদনা বেসরকারি গুদাম ভাড়া করেও এই ক্রয়সীমা আরো বাড়াতে পারে। এরফলে আগামিতে খাদ্য সঙ্কটের যেআশংকারয়েছে তা সরকারের পক্ষে মোকাবেলা করা সহজ হবে।

    সরকারের এই কৃষি প্রণোদনাটির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক “কৃষিখাতে বিশেষ প্রণোদনামূলক পুনঃঅর্থায়ন স্কীম” গঠন করে একটা সার্কুলার জারি করেছে। তাতে বলা হচ্ছে, শস্য ও ফসল খাত ব্যতীত কৃষির অন্যান্য চলতি মূলধন নির্ভরশীল খাতে এই ঋণ দেওয়া হবে। কোনো খাতে ৩০ শতাংশের বেশি ঋণ দেওয়া যাবে না। মূলত, কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী কৃষকের উৎপাদিত ফসল বন্ধক রেখে কৃষিঋণ নিতে হয়। এটার সরকারি নাম হলো ‘শস্য বন্ধকি দলিল’। অর্থাৎ কৃষক তাঁর শস্য একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখবেন। ধান বা যেকোনো শস্য বিক্রি করে ঋণের টাকা আবার ফেরত দেবেন।১৮ মাসের মধ্যে ঋণ ফেরত দিতে হবে। এর প্রথম ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ড থাকবে, মানে এ সময় কিস্তি দেওয়া লাগবে না। বাকি ১২ মাসে বারো কিস্তির মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।ঘোষিত প্রণোদনাটিমূলত: প্রাতিষ্ঠানিক কৃষকদের সহায়তা করতে। কিন্তু প্রচলতি ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই প্রণোদনা থেকে বর্গাচাষী করেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক কৃষি কাজ করেন এবং কৃষিসমন্ধীয় কাজ করেনএমন কৃষকরা কোন সহয়তা পাবেন না। সুতরাং, তাদের জন্য কোন ধরণের সুদ ছাড়াই খানাভিত্তিক আয় ধরে নগদ অর্থ সহায়তা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের খাদ্য চাহিদার ৯০ শতাংশ যোগানদাতার ৯৩ শতাংশ ক্ষুদ্র  ও ভূমিহীন কৃষক।সুতরাং, তাদের জন্য কোন ধরণের সুদ ছাড়াই খানাভিত্তিক আয় ধরে শর্তহীন নগদ অর্থ সহায়তা দিতে হবে।

    গত মার্চে দেশে স্বাভাবিকের চেয়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৬০ শতাংশ কম। এপ্রিলের এক সপ্তাহ চলে গেলেও এখন পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ এলাকায় বৃষ্টি হয়নি। দেশের ফসলের সবচেয়ে বড় এই মৌসুমে মাঠে আলু, সবজি ও শর্ষে রয়েছে, যেগুলোতে সেচ দিতে হচ্ছে। এক্ষেত্র ক্ষুদ্র কৃষকদের যারা নিজেরাই শ্যালো মেশিনে ইরিগেশন করে, তাঁদেরও ডিজেল ক্রয়ের জন্য জরুরিভাবে নগদ সহায়তা দিতে হবে।

    কৃষি মন্ত্রনালয়ের হিসাব মতে, এপ্রিল ও মে মাসে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টন কৃষিপণ্য বাজারে আসে এবং কৃষকদের জন্য এটাই সবচেয়ে বড় মৌসুম।এই দু’মাসে কৃষকের উত্‌পাদিত সকল পণ্যের লাভজনক মূল্য, সহজ বিপণন কৌশল এবং পরবর্তী ফলনের জন্য উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

    লকডাউনের কারণে সঙ্কটে পড়েছে দুগ্ধ খামারিরাও। ইতোমধ্যে তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় হাড়ি হাড়ি দুধ পুকুরে ঢেলে দিচ্ছেন—প্রতিবাদ করছেন। গরুর দুধের দাম লিটারপ্রতি ৫০ টাকা থেকে ২৫ টাকায়, এমনকি ১২ টাকায়ও নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিদিন ১৫০ লাখ লিটার দুধ অবিক্রীত থেকে যাচ্ছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫৭ কোটি টাকা। আগামী এক মাস এভাবে চলতে থাকলে প্রায় ১  ৭১০ কোটি টাকার ক্ষতির মধ্যে পড়বেন খামারিরা। একইভাবে সঙ্কটে পড়েছেন পোল্টি খামারীরা। ব্রয়লার মুরগির ডিমের দাম যেমন এক দমই পড়ে গেছে। এক্ষেত্রে আপাতত: ত্রাণ হিসেবে চালের সঙ্গে আলু, গম, ডিম ইত্যাদি দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি: করোনাকালীন সময়ে দুগ্ধ ও ব্রয়লার খামার পরিচালনার জন্য এককালীন নগদ ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদান করা যেতে পারে।

    আমাদের সবজি বীজের অর্ধেকটাই আসে চীন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান থেকে।এসব দেশও যেহেতু করোনায় আক্রান্ত, কাজেই আগেভাগেই বীজ আমদানির বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই সাথে সরকার আগামি বাজেটে বীজের জন্য বরাদ্দকৃত ১৫০ কোটি শুধুমাত্র আমদানির জন্য বরাদ্দ না করেস্থানীয়পর্যায়ে বীজ গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য কৃষকেদর কর্মরত সংগঠনগুলোতে বিনিয়োগ করতে পারে।

    অবশেষে, প্রতিটি সঙ্কটই আমাদের সামনে একটি সুযোগ উপস্থাপন করে। করোনা ভাইরাস শিল্পভিত্তিক বিশ্ব অর্থনীতিকে প্রায়ধ্বসিয়ে দিলেও  আমাদের দেখিয়েছে এই অন্তর্বর্তী পরিস্থিতি এবং অদূর ভবিষ্যতেও কৃষিই আমাদেরকে টিকিয়ে রাখার একমাত্র বিকল্প হতে পারে। একই সাথেনাগরিক, সরকার এই অবস্থার মধ্যদিয়ে খাদ্য অধিকার গুরুত্ব, খাদ্য উত্পাদনকারী কৃষকদের অবদান এবং কৃষিখাতে সরকার আরো বেশি স্বাবলম্বী হওয়ার মূল্য উপলব্ধি করবে।

    [1]সাধারণ সম্পাদক, খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি), বাংলাদেশ/ ০১৯১৯২৩১৭২২ / masud@pranbd.org

  • সমতার পৃথিবী- করোনাভাইরাসের সাথে কথোপকথন

    সমতার পৃথিবী- করোনাভাইরাসের সাথে কথোপকথন

    মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন

    “আমরা অতি ক্ষুদ্র, আমাদের নিজস্ব জীবন ছিল না, নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার সামর্থ্য ছিল না। কিন্তু এখন থেকে চারশো কোটি বছর আগে এই পৃথিবীতে আমরা ছিলাম। তখনো এই পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হয়নি। জীবন্ত জগতের পূর্বশর্ত যে কোষ তাও আত্মপ্রকাশ করেনি। আমরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছি জীবন্ত কোষ সৃষ্টিতে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ে আমাদের চেয়ে কত উন্নত, শক্তিশালী এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ জীবন্ত প্রজাতির উদ্ভব হয়েছে এই ধরিত্রীতে। এসেছে আমাদের চেয়ে বহু উন্নত এক কোষী ব্যাকটেরিয়া। তারা সালোক সংশ্লেষণের কাজটি শুরু করে প্রায় তিনশো কোটি বছর আগে। সম্ভব করে অক্সিজেনময় পৃথিবী। তারই হাত ধরে পঁচাত্তর কোটি বছর আগে সবুজ শৈবাল আর পঁয়তাল্লিশ কোটি বছর আগে বহুকোষী সবুজ পত্রাবলির উদ্ভিদরাজি ফুলে-ফলে পৃথিবীকে অপূর্ব সুন্দর ও বর্ণাঢ্য করে তোলে। পোকা-মাকড়, স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখী, বানরকুল হয়ে সোজা হয়ে হাঁটা প্রবুদ্ধ মানুষের(হোমো সেপিয়ান্স) আগমন ঘটে গত চল্লিশ কোটি থেকে আড়াই লক্ষ বছরের মধ্যে। এই দীর্ঘ সময়ে আমরাও ছিলাম সবার মধ্যে। অনেকটা অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে। কারণ আগেই বলেছি আমরা কোন জীবন্ত সত্তা নই। অন্য জীবকোষের আনুকূল্যে তাদের ভেতরেই কেবল আমরা বেঁচে থাকতে পারি, বংশ বিস্তার করতে পারি। চারশ কোটি বছরতো কম নয়! কিন্তু তোমাদের প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ যেমনটা লিখেছেন, ‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি যে, মনে হয় যেন সেই দিন।’ আমরা সব দেখেছি। সকল প্রজাতি মিলে মিশে কিভাবে প্রাণময় এই সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুললো। আবার কীভাবে ‘সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব’ মানুষের হাতে তার ধ্বংস চলতেই থাকলো।”

    “আমরা আবার এসেছি। কিছু কথা তোমাদের মনে করিয়ে দিতে।”

    “তোমাদের সভ্যতার ইতিহাসে বড় বড় রূপান্তরে তোমরা মানুষেরা নিজে ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছো। বিনিময়ে কোটি কোটি ভিন্ন প্রজাতি ধ্বংস করেছো। যেমন, তোমরা যখন গুহাবাসি, তখন পশু-পাখি-মাছ শিকার এবং বন্য শস্য-ফলমূল সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করতে। তোমরা ছিলে প্রকৃতির অংশ। সেই তোমরা প্রায় ১২ হাজার বছর আগে পরিকল্পিত চাষাবাদ শুরু করে তোমাদের সভ্যতার ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা করলে, বিনিময়ে বিলিন হয়ে গেল কোটি কোটি প্রজাতি। তারপর থেকে বর্তমান এই সময়ে পৃথিবীতে সাড়ে সাতশ কোটি মানুষ, যারা গোটা প্রজাতির মাত্র ০.১ ভাগ তারাই ধ্বংসের কারণ হয়েছো পৃথিবীর ৮৩ ভাগ বন্য প্রাণী ও ৫০ ভাগ উদ্ভিদের। একই সময়ে বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে মানব প্রজাতির ও তোমাদের গৃহপালিত পশুর সংখ্যা। তোমাদের বিজ্ঞানীরাই বলছেন- আধুনিক কৃষি এবং তোমাদের উন্নয়নের জন্য ব্যাপক বন উজাড় ও বন্য আবাসের ধ্বংস এবং পানি, বায়ু ও পরিবেশ বিষাক্ত করার ফলে পৃথিবী তার চারশো বছরের ইতিহাসে জীবন্ত প্রজাতির ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির পর্যায় পার করছে। পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক প্রাণী গত পঞ্চাশ বছরে হারিয়ে গেছে বলে মনে করছেন তোমাদের বিজ্ঞানিরা।”

    কথাগুলো বলছিল ‘কোভিড-১৯’ নামে পরিচিত করোনাভাইরাস। এমন নয় যে এই সত্যগুলো আমার অজানা ছিল, বা আগে অন্য কোথাও পড়িনি। ঠিক যখন মনে হচ্ছিল আমার উদ্দেশ্যে কোভিড ১৯ এর কথা হয়তো শেষ হয়েছে, তখনই সে আরো মনে করিয়ে দিল  জাতিসংঘের অধীন জীববৈচিত্র্য ও প্রতিবেশ রক্ষার আন্ত-সরকার বিজ্ঞান নীতির প্লাটফর্মের আশংকা যে, আগামী কয়েক দশকের মধ্যে দশ লাখের মত প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। রিপোর্টে নাকি বলা হয়েছে জীববৈচিত্র্যের এই ধ্বংস পৃথিবী নামের গ্রহের জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখ্য কারণ হিসেবে আধুনিক কৃষিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আরো নাকি বলা হয়েছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের সাথে রোগ সংক্রমণের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল যে, দ্রুত সংক্রমণ ঘটায় এমনসব রোগ-বীজাণু জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের সাথে পাল্লা দিয়ে বংশ বিস্তার করে।

    করোনাভাইরাসকে কী জবাব দেব? মনে পড়লো, ইতিমধ্যে সে প্রায় দেড় লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আমার পরিবার পরিজন আছে। এখনো সুন্দর এই পৃথিবীতে আরো কিছুকাল তাদের নিয়ে বাঁচতে চাই। ফুসফুস ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই। তবে আপাতদৃষ্টিতে করোনাভাইরাসকে শত্রু মনে হলেও, কেন জানি মনে হচ্ছিল বাস্তবে এটি আমাদের শত্রু নয়। এমন একটি ধারণা নিয়েই তার সাথে চলে আমার কথোপকথন।

    “আমরা মানুষেরা তোমাদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি। তোমরাই বলেছো পুরো জীবন্ত নও তোমরা। কারণ শুধু অন্য কোন জীবন্ত কোষের ভেতরেই কেবল তোমরা বেঁচে থাকতে পার, বংশ বিস্তার করতে পার। তোমরা একটি আরএনএ (রাইবো নিউক্লিক এসিড) ভাইরাস। আরএনএ’র কথা বলতে গিয়ে ডিএনএ (ডিওক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড) এবং প্রোটিনের কথাও বলতে হবে। জীবকোষের অতি গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি বৃহৎ অণু। একটা সময় ছিল যখন মনে করা হতো প্রোটিন হচ্ছে জীবন্ত প্রজাতির সকল রহস্যের মূলে। গত শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে আমাদের বিজ্ঞানিরা প্রমাণ করলেন প্রোটিন নয়, জীবনের মৌল রহস্য নিহিত আছে জীবকোষের নিউক্লিয়াসের ভেতরে ডিএনএ অণুর মধ্যে। এই অণুর উপাদানে এসিড যৌগ আছে। আর নিউক্লিয়াসের ভেতরে থাকে বলে ডিএনএকে একটি নিউক্লিক এসিড বলা হয়।  ডিএনএই হচ্ছে বংশগতির বাহক; ডিএনএই নির্দিষ্ট করে দেয় ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির জীবতত্ত্বিক বিশিষ্টতা, তার আপন বৈশিষ্ট্য। ডিএনএ’র গঠন কাঠামো দেখতে পুরনো দালানের প্যাঁচানো সিঁড়ির মত। নিচ থেকে উপরে উঠে যাওয়া সিঁড়ির ধাপে ধাপে সঞ্চিত থাকে জীবনের সকল সংকেত। এসব সংকেত প্রথমে আরএনএ নামের আরেকটি অণু হয়ে প্রোটিন নামের অণুতে প্রকাশিত হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রজাতির সকল বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হতে থাকে। জীবন্ত প্রজাতির সকল বৈশিষ্ট্য বা তথ্য বহন করে বলে ডিএনএকে তথ্যের প্রাণঅণুও (Information bimolecule) বলা হয়।

    একটি প্রজাতির কোষে ডিএনএ’র গোটা পরিমাণকে জেনোম হিসেবে অভিহিত করা হয়। প্রজাতির পরিচয় তার জেনোম দিয়ে। এই জেনোমে সকল জেনেটিক তথ্য সাজানো থাকে। তোমাদের ভাইরাসের জেনোম খুবই ছোট। অন্যদিকে বহুকোষী উচ্চতর প্রজাতি যেমন, মানুষের জেনোম অনেক বড়। বিজ্ঞানিরা ‘হিউম্যান জেনোম প্রোজেক্ট’ নামের এক বিশাল গবেষণা, যা ১৯৯০ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০০৩ সালে শেষ হয়, তার মাধ্যমে গোটা জেনোমে সঞ্চিত সকল তথ্যাদির ক্রমবিন্যাস নির্ধারণ করেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত মানুষ তার জীবনের সকল রহস্য উন্মোচনের জন্য জেনোমের একটি ম্যাপ তৈরিতে সক্ষম হয়। হাতে একটি ম্যাপ থাকলে যেমন অজানা ঠিকানা বা অনাবিষ্কৃত পৃথিবীকে জানা সহজ হয়, তেমনি মানব জেনোমের ম্যাপ থাকার কারণে মানুষের জীবনের সকল রহস্য সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিপুল গতিতে মানুষ জানতে পারছে অজানাকে। এভাবে ডিএনএ সম্পর্কে জানতে গিয়ে বিজ্ঞানিরা দেখলেন ডিএনএ গুরুত্বপূর্ণ বটে কিন্তু আরএনএও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।”

    কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললাম। বোঝা গেলনা করোনাভাইরাস ডিএনএ-এর কাহিনী আদৌ আগের থেকে জানতো কিনা। তবে আমার কথাগুলো শুনে করোনাভাইরাস খুব একটা বিরক্ত হয়েছে বলে মনে হলো না।

    “তোমরা যেহেতু আরএনএ ভাইরাস, তাই এবারে আরএনএ সম্পর্কেও কিছু বলবো। ডিএনএ’র মত আরএনএও একটি নিউক্লিক এসিড। উপাদান ও গঠনের দিক থেকে উভয়ের মধ্যে ভালই মিল থাকলেও এর গঠন কাঠামো অনেক সরল। আরএনএ এক ফিতা বিশিষ্ট। এই ফিতার মধ্যেই জমা আছে তোমাদের জেনেটিক তথ্য। শুরুতে বলেছি, ডিএনএতে সঞ্চিত সকল তথ্য প্রথমে আরএনএতে বাহিত হয়। তারপর  আরএনএ থেকে সে তথ্য অনুযায়ী প্রোটিন তৈরি হয়। তোমরা যেহেতু নিজেরা আরএনএ ভাইরাস তাই সরাসরি তোমাদের থেকে প্রোটিন তৈরি হতে পারে। সে যাই হোক জেনেটিক তথ্যের সুনিয়ন্ত্রিত প্রবহমানতার উপর নির্ভর করে দেহের সুস্থতা।”

    “আরএনএ ও ডিএনএ সম্পর্কে বলতে গিয়ে জিন সম্পর্কেও বলতে হবে। জিন হচ্ছে জেনোমে ডিএনএ’র একটি টুকরো, যা ট্রান্সক্রিপশান প্রক্রিয়ায় আরএনএতে রূপান্তরিত হয়। কয়েক ধরণের আরএনএ রয়েছে। যেমন, রাইবোসমাল আরএনএ (rRNA), ট্রান্সফার আরএনএ (tRNA) ও মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA)। ওইসব জিন, যাদের মধ্যে প্রোটিন তৈরির সংকেত রয়েছে, তাদের থেকে তৈরি হয় মেসেঞ্জার আরএনএ। শুধু মেসেঞ্জার আরএনএ’র তথ্য অনুযায়ী প্রোটিন তৈরি হয়। বাকি রাইবোসমাল আরএনএ ও ট্রান্সফার আরএনএ প্রোটিন তৈরিতে সহায়তা করে। প্রোটিন তৈরির জিনকে কোডিং জিন বলা হয়। এমন জিনের সংখ্যা খুব বেশি নয়। মানুষের জন্য তার সংখ্যা বাইশ হাজারের মত। তোমাদের জন্য এই সংখ্যা মাত্র ১৫। মানুষের গোটা জেনোমের মাত্র দেড় ভাগ তথ্য কোডিং জিনের মাধ্যমে সকল প্রোটিন তৈরিতে ব্যবহার হয়। তা হলে বাকি জেনোমের কাজ কী? সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে জেনোমের প্রায় ৮০ ভাগ নন-কোডিং জিন হিসেবে কাজ করে। এরা রাইবোসমাল আরএনএ (rRNA) ও ট্রান্সফার আরএনএ (tRNA) ছাড়াও আরো নানা ধরণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরএনএ তৈরি করে। এসব আরএনএ প্রোটিন তৈরি করেনা বটে, কিন্তু জিনের নিয়ন্ত্রনে, তাদের আত্মপ্রকাশে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।”

    আমার কথাগুলো শুনে করোনাভাইরাস হাসলো। তবে সে আমায় বাঁধা দিল না। বললো, “বলে যাও, শুনছি তোমার কথা।”

    “পঞ্চাশের দশকে যখন ডিএনএ’র গঠন কাঠামো আবিষ্কৃত হল এবং প্রাণের উদ্ভব, তার স্বাতন্ত্র ও অস্তিত্ব রক্ষায় মূল অণু হিসেবে ডিএনএ’র ভূমিকা জানা গেল, তখন বলা হয়েছিল, রেপ্লিকেশন প্রক্রিয়ায় ডিএনএ থেকে ডিএনএ, ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়ায় ডিএনএ থেকে আরএনএ, এবং ট্রান্সলেশন প্রক্রিয়ায় আরএনএ থেকে প্রোটিন তৈরি হয়। জেনেটিক কোডের এই গতি প্রবাহকে নাম দেয়া হয় ‘সেন্ট্রাল ডগমা’। ফ্রান্সিস ক্রিক যিনি জেমস ওয়াটসনের সাথে ডিএনএ’র গঠন কাঠামো আবিস্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন, তিনি ‘সেন্ট্রাল ডগমা’-এর তত্ত্বটি হাজির করেন এবং বলেন সকল জীবন্ত প্রজাতিতে তা ক্রিয়াশীল শুধু নয়, এমন ‘সেন্ট্রাল ডগমা’ একমুখী। অর্থাৎ ডিএনএ থেকে তথ্য যাবে আরএনএতে এবং আরএনএ থেকে পাওয়া তথ্য অনুয়ায়ী প্রোটিন তৈরি হবে – এর অন্যথা হবে না। আরো পরিষ্কারভাবে বললে, প্রোটিন থেকে আরএনএ অথবা আরএনএ থেকে ডিএনএ তৈরি হবে না। পরে দেখা গেল ‘সেন্ট্রাল ডগমা’ মূলত অভ্রান্ত হলেও প্রকৃতি জগতে তার ব্যতিক্রমও আছে। আরএনএ থেকে ডিএনএ তৈরির নজির পাওয়া গেল তোমাদের মত ভাইরাস নামের জীবন্ত ও অজীবন্তের মাঝামাঝি এক সত্ত্বার মধ্যে। ট্রান্সক্রিপশনের উল্টো রিভার্স ট্র্যান্সক্রিপশনের জন্য ক্রিয়াশীল ‘রিভার্স  ট্র্যান্সক্রিপটেইস’ এনজাইমের উপস্থিতি পাওয়া গেল তোমাদের মত ভাইরাসে। পরে দেখা গেল শুধু আরএনএতে সঞ্চিত তথ্য নিয়েই ভাইরাস থাকতে পারে। অর্থাৎ ডিএনএ ভাইরাস ছাড়াও আরএনএ ভাইরাস রয়েছে। শুধু তাই না, ডিএনএ ভাইরাস থেকে আরএনএ ভাইরাসের সংখ্যা অনেক বেশি। তোমরা করোনা তেমন একটি আরএনএ ভাইরাস। আরএনএ নিয়ে এত কথা বললাম আসলে তোমাদের এ কথা জানাতে যে প্রকৃতি জগতে তোমাদের মত আরএনএ ভাইরাসের গুরুত্বের কথা আমরা মানুষেরা জেনেছি।”

    “সকল ভাইরাসের মত তোমরা করোনা ভাইরাসেরও রয়েছে একটি বহিরাবরণ। প্রোটিন ও স্নেহ (লিপিড) দিয়ে তৈরি এই বহিরাবরণের আকৃতি হয় নানা ধরনের। দেখতেও ভারি সুন্দর। তোমরা দেখতে আমাদের দেশের কদম ফুলের মত। ভিরিয়ন নামের বহিরাবরণে রয়েছে দ্বিস্তর বিশিষ্ট লিপিড যার মধ্যে গেঁথে আছে পর্দা বা মেমব্রেন প্রোটিন, মোড়ক বা এনভেলাপ প্রোটিন ও স্পাইক প্রোটিন। ভিরিয়নের ভেতরে থাকে জেনেটিক উপাদান। তোমাদের করোনার জন্য তা আরএনএ। ভিরিয়নের বাইরে পেরেকের আকৃতি বিশিষ্ট প্রোটিন রয়েছে। তোমাদের যে ছবিটির সাথে সবাই পরিচিত, সেখানে এমন আকৃতির প্রোটিনের উপস্থিতি সহজেই চোখে পড়ে। এদের স্পাইক প্রোটিন বলা হয়, যার বাইরের দিকের ফোলানো অংশ বা মুকুটটির জন্য তোমাদের আমরা নাম দিয়েছি করোনা ভাইরাস। তুমি জানবে হয়তো, ল্যাতিন ভাষায় মুকুটকে বলা হয় করোনা। আশা করি এই সুন্দর নামটি তোমাদের পছন্দ হয়েছে। আগে বলেছি, তোমরা শুধুমাত্র অন্য একটি জীবন্ত কোষের অভ্যন্তরে বেঁচে থাকো ও বংশ বৃদ্ধি কর। কিভাবে তোমরা অন্য কোষে প্রবেশ করো, তা আমরা জেনেছি। যখন কোন জীবকোষের উপর তোমরা বসো, তখন তোমাদের স্পাইক প্রোটিনের সাথে ওই জীবকোষের angiotensine-converting enzyme2 (ACE2) নামের বহিরাবরণ প্রোটিনের সংযোগ ঘটে। এই সংযোগ যথাযথ হলে ওই কোষের একটি প্রোটিএস এনজাইম সংযোগকৃত স্পাইক প্রোটিনকে কেটে ফেলে ও সক্রিয় করে। এর ফলে তোমরা এন্ডোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবকোষে সহজেই প্রবেশ করতে পার। তা হলে দেখতেই পাচ্ছ আমাদের কোষে তোমাদের প্রবেশে আমরা সাহায্য করি।”

    “যতদূর আমরা জানতে পেরেছি, তোমরা ছিলে চীনের উহানে। গত ৩০ জানুয়ারী ২০২০ তারিখে ‘The Lancet’ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে উহানে একটি সিফুড মার্কেট, যেখানে বাদুড়, পেঙ্গোলিন (বনরুই্‌), সিভেট (গন্ধগোকুল) ও অন্যান্য বন্য প্রাণী খাদ্য হিসেবে বিক্রি হয়, সেখান থেকে ভাইরাস-জনিত নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৯ জন চীনা নাগরিকের থেকে নেয়া নমুনায় তোমাদের দেখা মেলে। আমরা নাম দিয়েছি কোভিড-১৯। এই ভাইরাসের জেনোমের সাথে বাদুড়ের দেহের ভাইরাস যা ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস হিসেবে মানুষের দেহে সংক্রমণ ঘটিয়েছিল তার জেনোমের মিল পাওয়া যায়। বাদুড় বা অন্য কোন প্রাণী থেকে মানব দেহে সংক্রমনের পর এই ভাইরাস অতি দ্রুত মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়তে পারে। গবেষণা পত্রে জানা যায় কিভাবে কোষের ACE2 surface protein-এর সাথে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের সংযোগের মাধ্যমে আমাদের কাছে নতুন তোমরা এই করোনা ভাইরাস দেহে প্রবেশ করতে পার।”

    “পৃথিবীতে প্রায় চৌদ্দ হাজার প্রজাতির বাদুড় আছে। পৃথিবীতে তাদের আগমন ঘটে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে। বাদুড় ও অন্যান্য প্রাণীদেহে প্রায় ছয় লাখের ওপর তোমাদের সমগোত্রীয় অজানা ভাইরাস বসবাস করে। যে তোমরা ছিলে বাদুড়ের দেহে, মিলে মিশে; একে অন্যের ক্ষতি করোনি কয়েক কোটি বছর ধরে, সেই তোমরা কেন বাদুড়ের দেহ ছেড়ে মানুষ বা মানুষের গৃহপালিত পশু, হাঁস-মুরগি, মাছের দেহে প্রবেশ করলে? শুধু তোমরা কোভিড ১৯ করোনা ভাইরাস নও, মানুষের দেহের দুই তৃতীয়াংশ সংক্রামক ব্যাধি যাদের মধ্যে তোমরা ছাড়াও রয়েছে সার্স, মার্স, ইবোলা, এইডস, জিকা, এইচ১এন১, রেবিস ইত্যাদি রোগের কারণ যে বিভিন্ন ভাইরাস তারা এসেছে বন্য প্রাণী থেকে অথবা তাদের মাধ্যমে আক্রান্ত অন্য প্রাণী থেকে।”

    “এবারে এমন একজন বিজ্ঞানীর কথা বলবো, যিনি বহু বছর ধরে তোমাদের নিয়ে কাজ করছেন। মধ্য চীনের উহানে কর্মরত এই ভাইরাস বিশেষজ্ঞ শি জেং লি। চীনের বনাঞ্চলের পাহাড়ে-পর্বতে প্রাচীন বা পরিত্যক্ত গুহায় তিনি সন্ধান করেন বাদুড়ের। যোগসূত্র বের করতে চান বাদুড়ের দেহে বসবাস করে যে ভাইরাস তার সাথে মানুষের দেহ সংক্রমণকারী ভাইরাসের কোন মিল আছে কিনা। সম্প্রতি ‘ব্যাট ওমেন’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠা এই নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞানী বাদুড়ের গুহায় কয়েক ডজন সার্সের মত ভাইরাসের সন্ধান পান। তিনি সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছিলেন যে আরো অনেক ভাইরাস সেখানে আছে। তার কথা সত্য হয়েছিল।”

    “৩০ ডিসেম্বর ২০১৯, সকাল ৭টা। উহান ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজিতে রহস্যময় রোগীর স্যাম্পল এসেছে। মুহূর্তেই ফোনে ডাক পড়লো শি জেং লি-র। ইন্সটিটিউটের পরিচালক বললেন, উহানের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রে নিউমোনিয়ার লক্ষণ নিয়ে ভর্তি হওয়া দুজন রোগীর দেহে নতুন করোনাভাইরাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানী শি’র গবেষণাগারে তা প্রমাণিত হলে, তা হবে মহা বিপদবার্তা। কারণ ২০০২-২০০৩ সালে এই ধরণের সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৮০০ রোগী মৃত্যুবরণ করেছিল। ভাবনায় পড়লেন শি ও তার গবেষণা দল। যে সব বাদুড়ের গুহায় করোনার মত ভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল, তাদের অবস্থান তো মধ্য চীনের উহান থেকে বহু দূরে, দক্ষিণ চীনের গুয়ান্ডং, গুয়াংশি এবং ইউনান অঞ্চলে। তা হলে কি তার গবেষণাগার থেকে ছড়িয়ে পড়েছে নতুন এই করোনাভাইরাস? উৎসের সন্ধান শুরু হলো। এর মধ্যেই তোমরা দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে হুবেই প্রদেশে, উহান যার রাজধানী। অল্প কয়েক দিনেই শি’র গবেষণা দল নতুন করোনা ভাইরাসের সাথে মিল খুঁজে পেলেন ২০১৩ সালে ইউনান প্রদেশের শিতো গুহায় পাওয়া হর্সশু বাদুড়ের করোনাভাইরাসের সাথে। এই অঞ্চলের  গন্ধগোকুল প্রাণীর দেহে পাওয়া করোনা ভাইরাসের সাথে ৯৭ ভাগ মিল খুঁজে পাওয়া গেল দুটো ভাইরাসের জেনোমের। অন্যদিকে উহানের বন্যপ্রাণীর খোলা বাজারে খাঁচায় আবদ্ধ বাদুড় এবং বনরুই-এর দেহে পাওয়া করোনাভাইরাসের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া গেল নতুন ভাইরাসের জেনোমের। ‘ব্যাট ওমেন’ আবার প্রমাণ করলেন বাদুড় কিংবা তার থেকে সংক্রামিত অন্য পশু থেকে তোমরা করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে মানব দেহে।”

    “এর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যাবে প্রায় বার হাজার বছর ধরে প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণে লিপ্ত আছে আধুনিক মানুষ (হোমো স্যাপিয়েন্স) এবং তাদের সভ্যতা। মানুষের এমন বিরুদ্ধাচরণ জ্যামিতিকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে। বিশেষ করে স্টিম ইঞ্জিন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্রথম শিল্প বিপ্লব (১৭৬০ – ১৮৩০) শুরু হওয়ার পর থেকে। এর পর এল বিদ্যুৎ ব্যবহার করে উৎপাদন বহুগুন বাড়িয়ে দেয়ার দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব (১৮৭০-১৯০০)। ইলেক্ট্রনিক্স ও তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদনে অটোমেশন তৃতীয় শিল্প বিপ্লব সূচনা করে। গত শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে তার শেষ পর্যন্ত তা চলে। ডিজিটাল বিপ্লব নামেও পরিচিত তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের উপর দাঁড়িয়ে বর্তমানে চলছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব। এর বৈশিষ্ট হচ্ছে সকল প্রযুক্তির মেলবন্ধনের মাধ্যমে তাদের সীমানা মুছে ফেলা। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে মুহূর্তে কোটি কোটি মানুষকে যুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। তথ্যের বিপুল সংগ্রহশালা গড়ে তোলা ও তার অবাধ প্রাপ্তির সাথে যুক্ত হচ্ছে অবিশ্বাস্য গতিতে নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন। যাদের মধ্যে রয়েছে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা, প্রাণ প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ বা যে কোন প্রজাতির জেনেটিক বৈশিষ্ট্য পাল্টে দেয়া, ন্যানো প্রযুক্তি, আইওটি (IOT বা ইন্টারনেট অব থিংগস), থ্রিডি প্রিন্টিং, কোয়ান্টাম কমপিউটিং ইত্যাদি। নতুন উদ্ভাবিত এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে অচিন্তনীয় গতিতে মানব সভ্যতা অগ্রসর হচ্ছে। তৃতীয় ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এই সময়ে প্রকৃতি ও তার প্রাণ বৈচিত্র্য সবচেয়ে দ্রুতগতিতে ধ্বংস হচ্ছে।

    ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের’ প্রতিষ্ঠাতা ও কার্যকর চেয়ারম্যান ক্লউস শোয়াব (তাঁকে একজন পরিবশবান্ধব ভাল মানুষ বলতে পার)  ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি তারিখে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপর ‘ফরেন অ্যাফেয়ার্স’ সাময়িকীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেন। ‘The Fourth Industrial Revolution: what it means, how to respond.’ শিরোনামে এই প্রবন্ধে তিনি বলেন, প্রযুক্তির একজন উৎসাহী প্রবক্তা হয়েও এই ভাবনা আমার আসে, যে আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে যেভাবে জড়িয়ে ফেলছে, তাতে মানুষ তার অন্তর্নিহিত গুণাবলী ও সামর্থ্য, যেমন সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মনোভাব হারিয়ে ফেলে কিনা। স্মার্ট ফোনের উদাহরণ দিয়ে তিনি বললেন, ‘এই ফোনের অবিরাম ব্যবহার আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ- বিরাম, চিন্তা ও অর্থপূর্ণ বাক্যালাপের জন্য কিছুটা সময়ও বরাদ্দ রাখবে কিনা’। তার প্রবন্ধের ইতি টেনেছেন তিনি এই আশাবাদ ব্যক্ত করে, ‘শেষ বিচারে মানুষ ও তার মূল্যবোধই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সামর্থ্য আছে মানুষকে হৃদয়হীন রোবোটে পরিণত করার। কিন্তু মানুষের রয়েছে সৃজনশীলতা, সহমর্মিতা ও বিপদে নেতৃত্ব দেয়ার অপার ক্ষমতা, যা ব্যবহার করে মানুষ সমষ্টিগতভাবে এক অভিন্ন লক্ষ্যে নিজেদের উন্নিত করতে পারে মানবিক ও নৈতিক সচেতনতার এক সুউচ্চ শিখড়ে’।”

    “আমরা হোমো স্যাপিয়েন্স বা প্রবুদ্ধ মানুষ অভিধায় নিজেদের পরিচিত করেছি। এই আমরাই কিভাবে তোমাদের বাধ্য করেছি আমাদের কিংবা আমাদের গৃহপালিত প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে আমাদের কঠিন রোগে আক্রান্ত করতে সে সম্পর্কে কিছু উদাহরণ দেব। ব্রাজিলের উত্তর অ্যামাজন রেইন ফরেস্টের বিশাল যে বনভূমি ছিল বাদুড় ও অন্যান্য বন্য পশুর আবাসস্থল, তা উজাড় করে গড়ে তোলা হয়েছে সাদা রঙের গরুর খামার। চারদিকে অ্যামাজনের ঘন সবুজের মাঝখানে সাদা রঙের গরুর পাল সহজেই চোখে পড়ে। যে অ্যামাজনের রেইন ফরেস্টকে বলা হত পৃথিবীর ফুসফুস, কারণ বাতাসের কার্বনডাইঅক্সাইড শুষে নিয়ে বাতাসে ছেড়ে দিত অক্সিজেন এই বনের ঘন উদ্ভিদরাজি, আগামী ১৫ বছরের মধ্যে সেই অ্যামাজন গড় কার্বন শোষণের বদলে কার্বন নির্গমনকারী হিসেবে বিবেচিত হবে। ভেবে দেখেছো প্রকৃতি ও সারা বিশ্বের জন্য তা হবে কত মারাত্মক।”

    “চীনের গুয়ান্ডং প্রদেশের  কিনউয়ান কাউন্টি এলাকায় বনভূমি পরিষ্কার করে বিশাল শূয়রের খামার গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মধুপুর এবং গাজীপুরের গজারি বন উজার হয়েছে। সেখানে জায়গা নিয়েছে পোলট্রি, মাছের প্রকল্প এবং টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্প। এই অঞ্চলের বনভূমি ছিল বন্য গাছ-গাছালি, পশু প্রাণী, বাদুড়, পাখি, অণুজীব ও ভাইরাসের আবাসস্থল। এর বাতাস ছিল নির্মল, নদী-খাল-ঝরনা ও নিচু জলাভুমির পানি ছিল বিশুদ্ধ টল টলে। এই প্রকৃতির মাঝখানে বসবাসরত সাধারণ মানুষের মধ্যে এই বোধটি ছিল যে এই বনভূমি তাদের বেঁচে থাকার জন্য বড়ই প্রয়োজন, তাই তাকে রক্ষা করতে হবে। খোঁজ নিলে জানা যাবে বন উজাড় ও প্রকৃতি ধ্বংসের জন্য বনভূমির মানুষজনেরা নয়, মুখ্যত দায়ী সরকারী বনবিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণি- যারা রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মধুপুর এবং গাজীপুরের বড় অংশ এখন আর বন্য পশু-পাখি ও অণুজীবের আবাসস্থল নয়, সেখানে বাতাসে মুরগির বিষ্ঠার গন্ধ। মাছের খামারে মাছের দ্রুত বৃদ্ধির জন্য পানিতে দেয়া হয় কৃত্রিম খাবার, যাতে রয়েছে শরীরের দ্রুত বর্ধনের জন্য হরমোন, রোগ-বালাই থেকে রক্ষার জন্য নানা ওষুধ ও উচ্চ শক্তির এন্টিবায়োটিক।  এই পানিও দুর্গন্ধময়। কালচারের মাছ ছাড়া এই পানিতে অন্য কোন প্রজাতি বাঁচতে পারেনা। এই অঞ্চলে নদী-খাল-জলাভূমির পানি আলকাতরার মত। টেক্সটাইল ও গার্মেন্টসের বিষাক্ত কেমিক্যাল এই পানিকে অনুপযুক্ত করেছে শুধু বন্য পশু-পাখি-অণুজীবের জন্য নয়, এখানে বসবাসরত সাধারণ গরিব মানুষের জন্যও। এইসব বড় বড় স্থাপনার মালিকদের অবকাশের জন্য অবশ্য জায়গায় জায়গায় গড়ে উঠেছে ঘন বন আচ্ছাদিত সুদৃশ্য রিট্রিট, ভূতল থেকে উত্তোলিত পরিস্কার পানি।”

    “পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও আবাসস্থলের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে আমরা হোমো স্যাপিয়েন্সরা ধ্বংস করেছি এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ বনভূমি- তার প্রতিবেশ। এক সময়ে এই বনভূমিতে বিচরণ করতো বন্য মোরগ, বরাহ, গয়াল, বাদুড়। তোমরা ভাইরাস তাদের কোন ক্ষতি করেনি। যখন বন উজাড় হলো, বাস্তুচ্যুত হলো বন্য পশু-পাখি-অণুজীব, তখন বাদুড় ও অন্যান্য বন্য পশু-পাখির দেহে সহঅবস্থান করতো তোমাদের মত যে অসংখ্য ভাইরাস, তারা কিভাবে বাঁচবে, নিজেদের বংশবিস্তার করবে? লক্ষ কোটি বছর ধরে যে নিরাপদ আবাসে তারা বেঁচে ছিল, তা এখন অরক্ষিত। বাদুড়, বনরুই – এসব মানুষের খাদ্য তালিকায় এসেছে। বন থেকে ধরে এনে বাজারে ছোট খাঁচায় বন্দী করা হয়েছে তাদের। মানুষের খাবারের টেবিলে চলে যাবে তারা। কী করণীয় ছিল ভাইরাসের, তোমাদের? তোমরা মানুষের দেহে আশ্রয় খুঁজেছো, সংক্রমিত করেছো খামারের শূয়োর, মুরগি ও মাছ। বন্য পশু-প্রাণীর কোষে তোমরা শুধু সহ-অবস্থান করতে, নিজেদের জীবন বাঁচাতে। আশ্রয়দাতাকে মেরে ফেলতে না। ওই সব পশু-প্রাণির রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা তা নিশ্চিত করতো। কিন্তু মানুষ বা খামারের পশু-পাখি-মাছ – এদের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাতো তোমাদের মত নতুন ভাইরাসকে মোকাবেলার জন্য গড়ে ওঠেনি। তাই কিছু দিন পর পর নতুন নতুন ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষ ও খামারে পালিত প্রাণী দলে দলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে নিতান্ত অসহায় ভাবে।”

    “মানুষকে কী বার্তা দিচ্ছ করোনাভাইরাস? মারণ ক্ষমতার দিক থেকে তোমরা ইতঃপূর্বে আমাদের পরিচিত ইবোলা, নিপা, সার্স, মার্স ভাইরাসের চেয়ে কম কার্যকর। কিন্তু মানুষের দেহে প্রবেশের পর তোমরা অতি দ্রুত গতিতে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়। সারা পৃথিবীর মানবকুলের মধ্যে তোমরা ছড়িয়ে পড়েছো। প্রতিরোধের বা প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা আমরা মানুষ এখনও গড়ে তুলতে পারিনি। আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে গৃহবন্দী করেছি নিজেদের। যানবাহন, উড়োজাহাজ, কল-কারখানা, অফিস, আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছি। যে গতিতে চলছিল চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, তা আজ বড়ই মন্থর। তবে তোমাদের একথাও জানিয়ে রাখি, ভাল মানুষও এই পৃথিবীতে আছে। প্রকৃতি তথা পৃথিবীকে বাঁচাতে চান এমন বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, নীতিপ্রণেতা, শিল্পী, সমাজসেবক রাজনীতিবিদ- এরা সবাই কতবার সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু পৃথিবীর গোটা সম্পদের ৮৫ ভাগ যে ১০ ভাগ মানুষের হাতে, যাদের হাতের মুঠোয় শক্তিমান পরাশক্তির সরকার – তারা তোয়াক্কা করেনি ওইসব সাবধানবাণী। এখন তোমরা এসে বাধ্য করেছে মহা শক্তিশালী আমেরিকা ও তার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন, মোদীর ভারত ও কর্পোরেট পুঁজির মালিকদের লকডাউন-শাটডাউনে যেতে। তথাকথিত সভ্যতার চাকাকে মন্থর করতে। পারমাণবিক অস্ত্র, জীবাণু অস্ত্র, নিখুঁত লক্ষ্যভেদী ড্রোন, দুর্বলের উপর পরাশক্তির চাপিয়ে দেয়া নিষেধাজ্ঞার অস্ত্র – কিছুই বশ করতে পারেনি অতি ক্ষুদ্র করোনা ভাইরাস তোমাদের। মহা আতংকে আছে মহা শক্তিধর পরাশক্তি। যে সুবচন শোনা যায়নি এসব শক্তিধরদের  মুখে এতকাল, নিতান্ত কাবু হয়ে তারা শরণাপন্ন হচ্ছে বিজ্ঞানীদের, ছুটছে টোটকার পেছনেও, দুহাত তুলে প্রার্থনা করছে যেন কোন অলৌকিক শক্তি এই যাত্রা তাদের উদ্ধার করুক। এতদিন কল্যাণ রাষ্ট্রের যে সামাজিক সুবিধাদি এরা ক্রমাগত কর্তন করেছে সমাজের ৮৫ ভাগ সম্পদ ভোগকারী ১০ ভাগ মহা বিত্তবানদের স্বার্থে, তারা আজ শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় খাতের কথা বলছে। কর্মহীন ব্রিটেনবাসীকে বেতনের ৮৫ ভাগ দেয়া ও রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসকে’ শক্তিশালী করার অঙ্গীকার করেছেন করোনায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসা প্রধান মন্ত্রী বরিস জনসন। ট্রাম্পের মুখেও অন্য সুর।”

    “হাজার হাজার বছর ধরে চীনা সভ্যতায় ঐতিহ্যগত খাবার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিল বন্য প্রাণী। যে ব্যবসার কাজে যুক্ত আছে এক কোটি চল্লিশ লাখ মানুষ, যে ব্যবসায় খাটে প্রায় সাড়ে ছয়শ হাজার কোটি টাকা এবং যে কারণে কখনো তা বন্ধ করা যায়নি, তোমাদের আক্রমণের ৫৫ দিনের মাথায় তা সম্পূর্ণ বন্ধের আইন জারিতে এগিয়ে এলো চীনা সরকার। ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি একটি বিশেষ তারিখ। চীনা সরকার গবেষণায় ওষুধ হিসেবে ব্যবহার ছাড়া বন্য প্রাণী ধরা, ভক্ষণ বা রপ্তানি করার উপর নিষেধাজ্ঞার আইন জারি করে। অবশ্য ট্র্যাম্প, যাকে নোয়াম চোমস্কি (তোমাদের অর্থাৎ প্রকৃতির একজন সুহৃদ) দেখেন এক সমাজ-বিচ্ছিন্ন মানসিক রোগী ও ভাঁড় হিসেবে, তার পক্ষে কখনো সম্ভব হতো না চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং সরকারের মত এমন বলিষ্ঠভাবে প্রকৃতির পক্ষ নিতে।”

    এক টানে অনেক কথা বলে ফেলেছিলাম। করোনা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, “দেখা যাচ্ছে, যে কথা মনে করিয়ে দিতে আমি ফিরে এসেছিলাম, তার অনেকটাই তুমি অনুধাবন করতে পারছো।”

    “আমি নিতান্ত সাধারণ একজন মানুষ। কিন্তু বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক, নীতিপ্রণেতা, শিক্ষাবিদ, সমাজ সেবক, লেখকরা কি বলছেন তোমাদের সম্পর্কে? শুনে তোমরা খুশিই হবে।”

    “ভারতের বরেণ্য ঔপন্যাসিক অরুন্ধতী রায় লিখেছেন  “করোনা শক্তিধরদের নত হতে বাধ্য করেছে। পৃথিবীকে সাময়িক ভাবে হলেও থামিয়ে রাখার যে কাজ অন্য কেউ কখনো পারেনি, তা সম্ভব করেছে করোনা। আমাদের মন এই ভাবনায় এখনো আচ্ছন্ন আছে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবার; যে গভীর ছেদটি ঘটে গেছে, তাকে আমলে না নিয়ে ভবিষ্যকে অতীতের সাথে আবার জোড়া লাগাবার। কিন্তু যে বিশাল পরিবর্তনটি ঘটে গেছে তাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। করোনার এই সময় আমাদের সামনে হাজির করেছে আমাদেরই সৃষ্ট মহা দানবীয় ব্যবস্থা যা পৃথিবীকে সমূহ ধ্বংসের শেষ সীমায় নিয়ে যাবে, তার সম্পর্কে খোলা চোখে নতুন করে ভাববার। নতুন পৃথিবীতে প্রবেশের যে পথটি খুলে গেছে, তা ধরে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে পারি আমাদের কুসংস্কার, ঘৃণা, লোভ, ডেটা ব্যাংক, অকেজো চিন্তা, মৃত নদী, ধোঁয়াটে আকাশকে পেছনে ফেলে। সাথে খুব বেশি কিছু নেবার দরকার নেই। হাল্কা হয়েই আমরা পথ চলবো আরেকটি পৃথিবীর স্বপ্ন নিয়ে। তার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নেব।”

    মার্কিন ভাষাবিদ ও দার্শনিক নোয়াম চোমস্কির কথা তোমাকে আগে জানিয়েছি। তিনি বলেন, “করোনা ভাইরাসের ভাল দিকটি হচ্ছে মানুষ হয়তো ভাবতে শুরু করবে কেমন পৃথিবী আমাদের চাই। … করোনা-পরবর্তী সময়ে একদিকে যেমন আগমন ঘটতে পারে হিংস্র স্বৈর সরকারের, অন্যদিকে ব্যক্তিগত লোভ ও লাভের বিপরীতে সূচীত হতে পারে সমাজের এমন মৌলিক সংস্কার, যা নিশ্চিত করবে মানুষের প্রয়োজনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মানবিক বিধান।

    লন্ডনের থিবা মারান্ডোকে তুমি চিনবে না। কোটি কোটি ভাল স্যাপিয়েন্সের একজন সাধারণ সদস্য। সেদিন কথা হচ্ছিলো তার সাথে। কত সহজেই না থিবা বললো, “যদি এক ভাইরাসের কারণে গোটা পৃথিবী থেমে যেতে পারে, তা হলে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রজাতির বিলুপ্তি, বিষাক্ত কিটনাশক, প্লাস্টিক, বন উজাড়, সবুজ পৃথিবীকে মরুভূমি বানানো, দারিদ্র, যুদ্ধ-বিগ্রহ, দুর্বল জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতির বিনাশ ইত্যাদি ইতাদি ইত্যাদির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এত কঠিন কেন হবে?

    “আরো একটি ভাল খবর দেব তোমাদের।” এ কথাটি বলতে বলতেই খেয়াল করলাম যে করোনার মুখে হাসি। কথোপকথনের শুরুতে তার মুখের কঠিন অভিব্যক্তি আর নেই।

    “রোমের ভ্যাটিকান সিটিতে পোপ পায়াস ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গণিত, পদার্থ বিদ্যা ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা ও জ্ঞানতত্ত্ব চর্চার জন্য পন্টিফিকাল একাডেমি অব সায়েন্সেস (পিএস) ১৬০৩ সালে রোমের প্রিন্স ফ্রেডেরিকো চেসি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘একাডেমি অব লিঙ্কস’ এবং তার প্রধান হিসেবে বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তারই ঐতিহ্য ধরে রেখেছে পিএস। অতিসম্প্রতি এই একাডেমির পক্ষ থেকে পাঠানো ৬৭ জন  বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, যাদের অধিকাংশই নোবেল পুরস্কারে ভূষিত, তাদের স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে  করোনার এই সময়ে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা এবং ভবিষ্যৎ অগ্রাধিকার নির্ধারণে তাদের পাঁচ দফায় প্রস্তাব করেছেন, সংকট মোকাবেলায় আশু সাড়া ও কাজ, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের প্রতি সহযোগিতা সম্প্রসারিত করা, গরিব ও দুঃস্থদের রক্ষা করা, সকল দেশের মধ্যে বৈশ্বিক নির্ভরতা ও সাহায্য নিশ্চিত করা এবং সকলের মধ্যে সংহতি ও সহমর্মিতা শক্তিশালী করা। চার্চের পক্ষ থেকে এলেও অন্ধ বিশ্বাসের পরিবর্তে বিজ্ঞান ও মানবিকতারপ্রতি চার্চের অঙ্গীকারের স্বাক্ষর পাওয়া যায় এই বিবৃতিতে।”

    “করোনা, তোমরা তো ভাল করেই বুঝেছো যে বিজ্ঞান ও মানুষের সহজাত মানবিকতা তোমাদের কিংবা প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয়। চার্চের পাঠানো উপরের বিবৃতিকে তাই তোমরাসহ সবার জন্য ভাল খবর বলেছি। পৃথিবী ও মানুষের উপর তোমাদের একচ্ছত্র রাজত্বের এই সময় কিভাবে বদলে দিচ্ছে মানুষের হাতে আক্রান্ত পৃথিবীকে, তার জলবায়ু ও প্রতিবেশকে, তা নিচের ছবিটি পরিষ্কার বলে দিচ্ছে।”

    “তোমাদের আগমনের আগে পরে এক মাসের ব্যবধানে স্যাটেলাইট থেকে তোলা চীন দেশের পাশাপাশি দুটো ছবি দেখে তোমাদের ভাল লাগবে। বাম পাশের ছবিতে করোনার আগে নাইট্রোজেন ডায় অক্সাইডে চীনের দূষিত ভূমণ্ডল। এক মাসের ব্যবধানে দূষণ-মুক্ত চীনের চিত্র। প্রধান পরিবেশগত সূচকসমূহ যা গত অর্ধ শতাব্দী ধরে ক্রমাগত খারাপের দিকে গেছে, তা বর্তমান লকডাউনের এই সময়ে হয় স্থিত অবস্থা বা উন্নতি করছে। কার্বন নিঃসরণের জন্য প্রধানত দায়ী চীনে ফেব্রুয়ারির প্রথম থেকে মধ্য মার্চ পর্যন্ত সময়ে তা কমে গেছে প্রায় ১৮ ভাগ। ধারণা করা হচ্ছে ইউরোপে ও আমেরিকাতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমে যাবে। পৃথিবীতে শব্দ দূষণ কমে গেছে, বায়ু নির্মল। তাই পাখির কল-কাকলীতে চারদিক মুখরিত। ভ্রমর সুন্দর হয়ে ওঠা ফুলে গুঞ্জন করছে।”

    সত্যি বলতে কি এতো কথা বলে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। করোনাও অনেকক্ষণ ধরে চুপ। জিজ্ঞেস করলাম, “কিছুই কি আর বলার নেই তোমার?” জবাব দ্রুতই এলো।

    “সারা পৃথিবীতে মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়ে তোমাদের মৃত্যুর কারণ হয়েছি, তোমাদের আতঙ্কিত করেছি। তোমরা নিজেদের গৃহবন্দি করেছো, লকডাউন, শাটডাউনে গেছ। কিন্তু তা কেন, কোন উদ্দেশ্যে করেছি? তোমাদের মানুষের কথাগুলো শুনে আমিতো ভালই আশা-ভরসা পাচ্ছি। মনে হচ্ছে, আমাদের কারণে মানুষের মৃত্যু, কষ্ট, নানাবিধ সংকট – এসবের বাইরেও আরো গভীর চিন্তা তোমাদের মাথায় ভিড় করছে। তাতো করবেই। চিন্তা করাই তো হোমো সেপিয়েন্সের কাজ। করোনার ‘দুঃসময়’ কেটে যাবার পর অতি দ্রুত তোমাদের মধ্যে ক্ষমতাবান শক্তিধরেরা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। মানুষ ও প্রকৃতির উপর তাদের অন্যায় শাসন আবার চাপিয়ে দেবে, এমনসব দুশ্চিন্তা তোমাদের ভাবিয়ে তুলছে। তার কারণও আছে। অতীতে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করেনি। বিপদ কেটে যাবার পর আবার স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছে। যা তোমাদের বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও চিন্তকদের কঠিন চিন্তায় ফেলেছে, তা হলো, এবারে ভুল করলে মহা বিপদ। গোটা সেপিয়েন্সের বিলুপ্ত হবার সম্ভাবনা। ইতোমধ্যে ট্রাম্প ও তার ভাবশিষ্য ‘ট্রপিক্যালের ট্রাম্প’ হিসেবে পরিচিত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর বেশ কিছু উন্মাদ সিদ্ধান্ত তেমন সম্ভাবনাকে বাস্তব করে তুলছে।”

    “আমাদের আরেকটি ক্ষমতার কথা তোমরা জান। তা হলো আমরা  সহজেই  নিজেদের রূপ পরিবর্তন করতে পারি। প্রকৃতি আমাদের সেভাবেই সহজ করে তৈরি করেছে। আমরা আরএনএ ভাইরাস। ডিএনএ’র সাথে তুলনায় আমাদের গঠন খুবই সরল। তাই সহজেই আমাদের গঠনে মিউটেশন হতে পারে। বিরূপ পরিবেশে আমরা সহজেই মিউটেশনের মাধ্যমে রূপ পরিবর্তন করে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার পথ বের করি। আমাদের এই সামর্থ্যের কথা তোমাদের স্মরণ করিয়ে দিলাম এজন্যে যে আমাদের বিরুদ্ধে নতুন ভ্যাকসিন বা আমাদের বিরুদ্ধে ওষুধ বের করেই যে তোমরা রক্ষা পেয়ে যাবে, তা কিন্তু নয়। সাময়িক কালের জন্য তোমাদের মনে হবে তোমরা জিতে গেছো। কিন্তু হে মানবকুল, এবারেও যদি তোমাদের শিক্ষা না হয়, তবে এর পরের বার আমরা আসবো আরও ভয়ংকর হয়ে। তা চলতেই থাকবে যতক্ষণ না পর্যন্ত হোমো স্যাপিয়েন্সরা পৃথিবীর বুক থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত না হয়।”

    “তোমরা তো হোমো স্যাপিয়েন্স বা প্রবুদ্ধ মানুষ। সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ প্রজাতি। সেজন্যেই পৃথিবী ও তার প্রকৃতি জগতকে তোমরা শাসন করছো। তার সমূহ সর্বনাশও করছো তোমরা। কিন্তু একবার ভেবে দেখ, এই পৃথিবী থেকে তোমাদের বিলুপ্তি ঘটলে প্রকৃতি জগতের কী কোন ক্ষতি হবে? না, কিছুই হবে না। বরং মানুষের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে প্রকৃতি স্বউদ্যোগে তার ক্ষতগুলো নিরাময় করে তুলবে। অন্যদিকে সালোক সংশ্লেষণে রত উদ্ভিদরাজি যদি বিলুপ্ত হয়, যদি এই কাজে নিয়োজিত এক কোষী সায়ানোব্যাকটেরিয়া বিলুপ্ত হয়, যদি উদ্ভিদের বংশবিস্তারের জন্য অত্যাবশ্যকীয় পরাগায়নে সতত নিয়োজিত কীট-পতঙ্গ বিলুপ্ত হয়ে যায়, তা হলেতো প্রাণময় পৃথিবী বিরাণভূমিতে পরিণত হবে। সেজন্যেই বলছি এবারে দানব হোমো স্যাপিয়েন্সরা যেন অতীতের মত আবারো পৃথিবী শাসনের সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে তোমাদের অতি দ্রুত কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। সময় তোমাদের হাতে কম। আমরা করোনাভাইরাস, প্রকৃতি জগতের সবচেয়ে নগন্য এক সত্তা। খুব বেশি সময় ট্রাম্পের মত আগ্রাসী মানুষদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবো না আমরা। তোমাদের বিজ্ঞানীরা আমাদের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য দিনরাত কাজ করছে। আমাদের দ্বারা আক্রান্তদের সারিয়ে তোলার  কার্যকর ওষুধও বের হবে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মেধা, শ্রম ও নিরবিচ্ছিন্ন সাধনায় উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন ও ওষুধ যখনই ট্রাম্পের মত  বা কর্পোরেট পুঁজির মালিকদের হাতে পড়বে, তখনই তারা প্রকৃতির বিপদ সংকেতকে  আর তোয়াক্কা করবে না। আমি ভেবে দেখেছি, খুব বড় জোর ছয় মাস পরাশক্তি তোমাদের মত ভাল মানুষদের কথা শুনবে, তাকে গুরুত্ব দেবে। তাই পৃথিবীর সকল দেশের মানুষ ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মৌলিক সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে হবে। যা মেনে চললে প্রকৃতিজগত ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে। আমরা করোনাসহ সকল প্রজাতি মিলেমিশে গড়ে তুলবে সমতার পৃথিবী।”

    গভীর মনযোগে করোনার কথাগুলো শুনছিলাম। ঠিক করলাম কথা আর বাড়াবো না। যা বোঝার বুঝে গিয়েছি। তার শেষ কথা কানে ভাসছে। করোনা বললো-

    “তুমি বলছিলে দার্শনিক নোয়াম চমস্কি’র কথা। মানুষ অজেয়, করোনা মহামারীতে মানুষ জয়ী হবেই এমন একটা প্রপঞ্চ প্রায় শতভাগ হোমো স্যাপিয়েন্সের আছে। চমোস্কি-র মত দার্শনিকও হয়তো এমন চিন্তার বাইরে নন। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে মানুষের জয়ী হওয়া নয়, প্রকৃতির জয়ী হওয়ার ভাবদর্শনে বিশ্বাসী হয়ে যদি মানুষ লড়াইটি চালায়, তাহলেই মাত্র সমতার পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব হবে। সেদিন সত্যিকার অর্থেই হোমো স্যাপিয়েন্স হয়ে উঠবে মানুষ প্রজাতি।”

    মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন : ইউজিসি অধ্যাপক, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

    সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গিরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
    সুত্র : বিডিনিউজ২৪.কম

  • বাংলা নববর্ষে ক্ষমা কর হে প্রভু

    ॥ এম কামরুজ্জামান ॥

    “ আমাদের দেখা হোক মহামারী শেষে
    আমাদের দেখা হোক বিজয়ের বেশে ”

    হে বৈশাখ তোমার আলোর ছোঁয়ায় বিশ্ব আজ আলোকিত হোক। হে বৈশাখ তোমার আগমনে আজ পৃথিবীজুড়ে কান্নার মিছিল থেমে যাক। হে বৈশাখ তুমি অন্ধকারের অমানিশা দূর করে পৃথিবীতে আলো ছিটিয়ে দাও।

    হে বৈশাখ পৃথিবীজুড়ে কান্না আর লাশের মিছিল ! লাশ রাখার জায়গা নেই। ভয়ে বাকরুদ্ধ শোকস্তব্ধ পৃথিবী। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়।

    হে বৈশাখ তোমার উজ্জল আলোর ছিটায় লাশের মিছিলকে আজ শান্তির মিছিল বানিয়ে দাও। গোটা বিশ্বের মানুষ আজ বাকরুদ্ধ। অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত। হে বৈশাখ তুমি আজ সব অনিশ্চয়তাকে দূরে, বহুদূরে ঠেলে দিয়ে নিশ্চয়তার এক পৃথিবী উপহার দাও। আজ আমরা বড্ডো অসহায়। বড্ডো অসহায়।

    হে বৈশাখ পৃথিবীর মানুষ আজ বাঁচার জন্য মরিয়া। সব বিজ্ঞান আজ অকার্যকর। উন্নত দেশগুলো আজ সব প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে আকাশের মালিকের দিকে তাকিয়ে। থামছে না ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে জীবাণু করোনা।

    হে বৈশাখ তুমি আকাশের মালিককে বলো আশরাফুল মাখলুকাতের দিকে একটু তাকাতে। কি করুন আর্তনাদ। সবই তো তোমার জানা। অজানা কিছুই নয়।

    হে বৈশাখ লাশের মিছিলে যেখানে লাখের বেশি। নিস্প্রান দেহ কবরে, নয় চিতায় বা মর্গে অথবা গনকবরে। পরিবারে যেখানে বিচ্ছেদের কান্না, প্রিয়জনদের প্রেম মায়ামমতা ভুলে বাকরুদ্ধ। আক্রান্ত আজ লাখ লাখ মানুষ। গোটা পৃথিবী কার্যত অচল। বেঁচে থাকলেও ভয়ংকর দিন সামনে। কি যেন অপেক্ষা করছে। হে মালিক আমদেরকে ক্ষমা করে দাও। দূর করে দাও সকল বালা-মুসিবত। সেই শুভ বার্তার অপেক্ষায়। তুমি সর্বশক্তিমান, দয়ালু। তুমি তো স্বার্থপর নও।

    হে বৈশাখ আজ আমাদের চোখে অশ্রু। বুকে চাপা কান্না, আর্তনাদ। ভয়ংকর এই পৃখিবী আমাদের বড় অচেনা। বহু মেধাবী প্রাণ তুমি নিয়েছো কেঁড়ে। আর নয়। করোনার ভয়ঙ্কর তান্ডবে আজ আমরা দিশেহারা। তুমি ছাড়া রক্ষার আর যে কেই নেই। তুমি মালিক, তুমিই সৃষ্টিকর্তা। বাংলা নববর্ষের এই দিনে তোমার পানে চাইছি ক্ষমা। ক্ষমা কর তুমি নিজগুনে। তুমিই তো সর্বসর্বা।

    বৈশাখ বয়ে আনুক করোনামুক্ত, নিরাপদ, সুখ-সমৃদ্ধ পৃথিবী। বাংলা নববর্ষে ক্ষমা কর হে আকাশের মালিক।