Warning: Attempt to read property "post_content" on null in /home/dakshinermashalc/public_html/wp-content/plugins/pj-news-ticker/pj-news-ticker.php on line 202
উপ-সম্পাদকীয় Archives - Page 2 of 7 - Daily Dakshinermashal

Category: উপ-সম্পাদকীয়

  • খাপড়া ওয়ার্ড : দেশের ইতিহাসে প্রথম জেল হত্যা

    খাপড়া ওয়ার্ড : দেশের ইতিহাসে প্রথম জেল হত্যা

    আহমাদ ইশতিয়াক :

    বৈশাখের মধ্য গগণে সূর্যের তেজ ফুটছে সেদিন। কৃষ্ণচূড়ার আগুন লেগেছে যেন নগরে। রাজশাহী জেলের জানালা দিয়ে এগিয়ে আসা কৃষ্ণচূড়ার আগুন রাঙা ডাল দেখবে সমস্ত কক্ষ, আকাশে বাতাসে তার রঙ আজ। কে জানত ধূসর মাখা এক বিকেলে নামবে লাশের মিছিল। শ্রাবণের অঝোর বর্ষণের মতো ঝরবে রক্ত। রাজশাহী জেলের ভিতরে আরেক জেল যেন খাপড়া ওয়ার্ড। টালির ছাদ, চারপাশে দেওয়াল।

    যেভাবে খাপড়া ওয়ার্ডে প্রতিবাদের সূচনা

    পাকিস্তানে আমলে কারাবন্দীদের উপর প্রচণ্ড নির্যাতন চালানো হতো নানা অজুহাতে। অমানবিক নির্যাতনের সঙ্গে কম খাবার দেওয়া হতো, তামাক খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল পুরোদমে। পশুর মতো ব্যবহার করা হতো বন্দীদের সঙ্গে। তেলের ঘানি টানানো, গম মাড়াই, পেষাই সহ নানান কাজ করতে হতো বন্দীদের। আর কাজ করতে দেরী হলে কিংবা করতে গিয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিলে ভয়াবহ অত্যাচার নেমে আসত তাদের উপর।

    প্রথমে রাজশাহী কারাগারের কমিউনিস্ট বন্দীরা প্রথম ওই অমানবিক শাস্তির প্রতিবাদ করেন। চলে অনশন। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে অন্য কারাগারগুলোতেও। ১৯৪৯ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও রাজশাহী কারাগারে বন্দীরা চার দফায় মোট ১৫০ দিন অনশন করলেন। খুলনা কারাগারে পিটিয়ে হত্যা করা হয় কমিউনিস্ট আন্দোলন কর্মী বিষ্ণু বৈরাগীকে। ঢাকা কারাগারে জোর করে খাওয়াতে গেলে ৮ ডিসেম্বর শিবেন রায়ের মৃত্যু হয়। অথচ প্রচার করা হয় শিবেন রায় ও বিষ্ণু বৈরাগী আত্মহত্যা করেছে। এর আগে যেসব বন্দীরাই প্রতিবাদ করেছে তাদেরকে শারীরিক নির্যাতনের পর আত্মহত্যা করতে চেয়েছে অভিযোগ এনে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো। অন্যদিকে রাজবন্দীদের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হলো তাদের।

    রাজবন্দীরা আসায় একদিকে শাপে বর হলো সাধারণ বন্দীদের জন্য। কারণ সাধারণ বন্দীরা নীরবে চোখ বুজে সহ্য করে গেলেও রাজবন্দীরা প্রতিবাদ করতেন। রাজবন্দীদের সঙ্গে থাকতে গিয়ে বিষয়টি অনুধাবন করল সাধারণ বন্দীরা। প্রতিবাদে বন্দীরা বলল, কারাগারে নির্যাতন চালানো যাবে না। বন্দীদের ভালো খাবার দিতে হবে। অন্যদিকে বিষ্ণু বৈরাগী ও শিবেন রায়ের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে সারাদেশের কারাগারগুলোতে বন্দীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্নভাবে বন্দীরা কারাগারের ভিতরেই প্রতিবাদ-বিক্ষোভে অংশ নেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্দীদের উপর নেমে আসে অসহনীয় নির্যাতন। যখন কারাগার কর্তৃপক্ষ দেখল অত্যাচারেও কাজ হচ্ছে না, তখন কারা কর্তৃপক্ষ হিন্দু, মুসলমান ও আদিবাসীদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালায়।

    বন্দীরা তখন তা বুঝে ফেলে। রাজশাহী কারাগারের রাজবন্দীরা নির্যাতন বন্ধের দাবি ও সাম্প্রদায়িক উসকানির প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে স্মারকলিপি দেন। সেই চিঠিতে কারারক্ষী ও কারাগারের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিটি অভিযোগ ও সুস্পষ্ট বিবরণ ছিল। এই চিঠিতে কারাবন্দীদের সমস্যা সমাধানে ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ওই সময়ের মধ্যে কোনো উত্তর আসেনি মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে। জবাব না পেয়ে বন্দীরা ৫ এপ্রিল অনশন শুরু করেন। ক্রমে অনশনকারীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। একপর্যায়ে রাজবন্দীদের দাবির খবর পৌঁছায় আইজি প্রিজন আমীরউদ্দিনের কাছে। তিনি রাজশাহী সফরে এসে কয়েদী ও সাধারণ বন্দীদের বলেন অনশন ত্যাগ করার জন্য কিন্তু রাজবন্দীরা তা মানবেন না বলে জানিয়ে দেন। এর পরই তিনি রাজবন্দীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হন। কারা অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট বন্দীরা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২ জন প্রতিনিধি পাঠালেন। বৈঠকের প্রথমেই মেজাজ হারিয়ে আইজি প্রিজন আমীর হোসেন প্রশ্ন তোলেন, সাধারণ বন্দী, কয়েদিদের সমস্যা নিয়ে রাজবন্দীরা কেন আন্দোলন করছে? উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে কোনো সমাধান ছাড়াই এই আলোচনার সমাপ্তি ঘটে। তখনও দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তের কথা বলেনি কারাগার কর্তৃপক্ষ। অনশন চালিয়ে যান বন্দীরা।

    তখন ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ আইনে আইজি প্রিজন আমীর হোসেন জেল সুপার ডব্লিউ এফ বিলকে পরামর্শ দিলেন রাজবন্দীদের কয়েকজনকে সরিয়ে নিয়ে গেলেই অবস্থার সমাধান হবে। কিতু রাজবন্দীরা কেউই খাপড়া ওয়ার্ড ছেড়ে যেতে রাজী হলেন না। নির্দেশনা অনুযায়ী বলা হয়েছিল কমিউনিস্ট বন্দীদের ১৪ নম্বর সেলে যেতে হবে। ওই সেলটি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের জন্য। কুষ্ঠ ও যক্ষ্মা রোগীদের রাখা হতো। কারাগারে মারা যাওয়া বন্দীদের ময়নাতদন্তও হতো সেখানে। তখন কমিউনিস্ট বন্দীরা কারা কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান।

    এদিকে সাত দিন চেষ্টা করেও যখন দেখা গেল কোন অগ্রগতি হচ্ছে না তখন রাজবন্দী ও কয়েদীদের কয়েকজন প্রতিনিধিদের জেল গেটে ডেকে এনে অনশন প্রত্যাহারের চাপ দেওয়া হলো। কিন্তু বন্দীরা অনড়, আগে তাদের দাবি মানতে হবে। এপ্রিল আইজি প্রিজন আশ্বাস দিলেন বন্দীদের শারীরিক নির্যাতন করা হবে না। নিজের পয়সায় বন্দীরা তামাক কিনে খেতে পারবে। এদিকে আইজি প্রিজন এটাকে দেখলেন ফায়দা লোটার বড় সুযোগ। তিনি আড়াই হাজার কয়েদীকে একত্র করলেন রাজশাহী কারাগারের খেলার মাঠে। সেখানে সমবেত বন্দীদের উদ্দেশ্যে বললেন, কমিউনিস্টরা বাইরে কিছুই করতে পারছে না। আর এখন জেলে এসে আপনাদের উসকে দিচ্ছে। সুবিধা লোটার চেষ্টা করছে আপনাদের উসকে দিয়ে। আপনারা কমিউনিস্টদের ফাঁদে পা দিয়ে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনবেন না। অন্যদিকে আমীর হোসেন রাজবন্দীদের কক্ষে গিয়ে বললেন, ‘জেলের ভিতরে আপনারা বিপ্লবের নামে যে অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি করছেন তার পরিণাম শিগগির দেখতে পাবেন।’

    এই পরিস্থিতিতে খাপড়া ওয়ার্ডের ভেতর রাজবন্দীরা বৈঠকে বসেন। বৈঠক চলে সারারাত।

    ২৪ এপ্রিল ১৯৫০

    ভোরের দিকে বন্দীরা কিছু সময় ঘুমিয়ে ও নাস্তার খাওয়ার পর সকাল ৯টায় ফের আলোচনা শুরু করেন। ওই সময় জেল সুপার ডব্লিউ এফ বিল ওয়ার্ডের ভেতর ঢুকে বন্দীদের আবারও ১৪ নম্বর সেলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। জেল সুপার উত্তেজিত হয়ে ওয়ার্ডের দরজা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে দৌড়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় তার পথরোধ করে দাঁড়ান বাবর আলী, দেলোয়ার ও রশিদ উদ্দিন। বিলের হান্টারের আঘাতে বাবর আলীর কব্জি ভেঙে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হুইসেল বাজান। সঙ্গে সঙ্গে ৪০ জন কারারক্ষী খাপড়া ওয়ার্ড ঘিরে ফেলে। ওয়ার্ডের ভেতর কমিউনিস্ট বন্দীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন, দরজা আটকে রাখতে হবে। তারা নারিকেলের ছোবড়া, চৌকি, তোশক বালিশ ও শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজা আটকে রাখেন। প্রসাদ রায় ছুটে গিয়ে দরজায় কাঁধ লাগান। বাইরে থেকে পুলিশ ধাক্কা দিতে থাকলে দরজা না খোলায় পুলিশ গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ প্রসাদ রায় মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়েন। বেপরোয়া পুলিশ ঢুকে পড়ে ওয়ার্ডের ভেতরে। রাইফেলের গুলির শব্দ আর অসহায় বন্দীদের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে কারাগারের বাতাস। খাপড়া ওয়ার্ডের বন্দীদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। তারা পুলিশের লাঠির আঘাতে মারাত্মক আহত হয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো কারাগারে। ঘটনাস্থলেই মারা যান ছয় জন। আহত হন ওয়ার্ডের সবাই। খাপড়া ওয়ার্ডে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের শ্রমিক নেতা হানিফ শেখ। চারপাশের নিস্তব্ধতা দেখে যখনই খুলনার ছাত্র নেতা আনোয়ার মাথা তোলেন ঠিক তখনই একটি গুলি এসে লাগে তার মাথায়। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। তার মাথার খুলি উড়ে গিয়ে পড়ে পাশে নারকেলের ছোবড়ার মধ্যে।

    পরিস্থিতি পুলিশ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ওয়ার্ডের ভেতর ঢোকেন জেল সুপার বিল। খুঁজে বের করেন রাজবন্দীদের নেতা আবদুল হককে। তাকে পেয়ে বিল রাগে দিশাহারা হয়ে হান্টারের শক্ত অংশ দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। রক্তাক্ত আবদুল হক মেঝের ওপর পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান। এই দৃশ্য দেখে গুলিবিদ্ধ রাজশাহীর বিজন সেন চিৎকার করে ওঠেন, ‘আমরা মরিনি কমরেড! আমরা জিতব। আগামী দিন আমাদের।’ এর পরই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বাকিরা।

    কেবল গুলিবর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ ও কারারক্ষীরা। আরেকদল পুলিশ এসে অতর্কিত লাঠিচার্জ শুরু করে আহত বন্দীদের উপর। এক বন্দী তখন তীব্র তৃষ্ণায় পানি পান করতে চাইলেন জেলার মান্নান সিপাহীকে নির্দেশ দিলেন সে বন্দীর মুখে প্রস্রাব করতে।

    এর মধ্যে কারাগারের বাইরে থেকে রাজশাহীর পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্টকে খবর দেওয়া হয়েছিল যে রাজবন্দীরা জেলগেট ভেঙে পালাচ্ছে। তিনি কারাগারে এসে দেখেন পুরোটাই মিথ্যা এবং সাজানো। রক্তাক্ত খাপড়া ওয়ার্ড দেখে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে জেলার ও জেল সুপারকে গালাগাল করতে করতে পুলিশ নিয়ে চলে যান।

    সেদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সাত জন কমিউনিস্ট নেতা-কর্মী। আহত হয়েছিলেন ৩২ জন।

    খুলনার আনোয়ার হোসেন, রংপুরের সুধীন ধর, কুষ্টিয়ার হানিফ শেখ, ময়মনসিংহের সুখেন ভট্টাচার্য ও কুষ্টিয়ার দেলোয়ার হোসেন। বেলা ৩টায় গুরুতর আহত সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ, আবদুল হক, কম্পরাম সিং, প্রসাদ রায়, বাবর আলী, আমিনুল ইসলাম বাদশা, শ্যামাপদ সেন, সত্যেন সরকার, সদানন্দ ঘোষ দস্তিদার, অনন্ত দেব, আবদুস শহীদ, প্রিয়ব্রত দাস ও নূরুন্নবী চৌধুরীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে মারা যান দিনাজপুরের কম্পরাম সিং। আহত অবস্থায় পরে শহীদ হয়েছিলেন বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা বিজন সিং ও তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী কম্পরাং সিং।

    খাপড়া ওয়ার্ডে শহীদ প্রত্যেক বন্দীর লাশ গুম করে ফেলেছিল জেলার ও পুলিশ। শহীদদের কোন আত্মীয়স্বজনকে খবরটুকুও দেওয়া হয়নি। আর যেসব বন্দী আহত হয়েছিলেন তারা বেশীরভাগই পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। খাপড়া ওয়ার্ড গণহত্যা ছিল উপমহাদেশের প্রথম জেল হত্যা।

    কিন্তু দীর্ঘদিন এই হত্যাকাণ্ডের খবর জানেনি সাধারণ মানুষ। সম্পূর্ণ চাপা পড়ে যায় এই হত্যাকাণ্ড। খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের কথা প্রকাশ্যে আসে ১৯৫৮ সালে সেখানে গুরুতর আহত আব্দুস শহীদের মাধ্যমে। তিনি খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড নিয়ে নিজের লেখা একটি বই ফেরি করে জানিয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষকে।

    আজ ২৪ এপ্রিল রাজশাহীর কুখ্যাত খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের দিন। খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডে শহীদ রাজবন্দীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

    সূত্র: খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০/ মতিউর রহমান

    ( সংগৃহীত দ্যা ডেইলী স্টার, এপ্রিল ২৪, ২০২১)

  • আজ প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালাম’র ৭৩তম জন্ম বার্ষিকী

    আজ প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালাম’র ৭৩তম জন্ম বার্ষিকী



    -মীর জিল্লুর রহমান

    মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালাম ১৯৪৮ সালের ১লা এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলাধীন তালা উপজেলার কৃষ্ণকাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই বীর সেনানী জীবদ্দশায় অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে সমাজ পরিবর্তনের ও দুর্নীতিমুক্ত আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে বিপ্লবী আদর্শের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে কয়েকবার কারা বরণ করেন। ১৯৭১ সালে তালা থানার মুজিব বাহিনীর প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নির্দেশনায় কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ ও সফলতা অর্জন করেন।
    তার আদর্শ ও জীবন আচরণ সকলকে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করবে। ৭১’র অকুতোভয় বীর সেনানী মোড়ল আব্দুস সালাম জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ খ্রিঃ ১লা এপ্রিল সাতক্ষীরা জেলাধীন তালা উপজেলার কৃষ্ণকাটি গ্রামে। তার পিতার নাম হাজী আবুল কাশেম মোড়ল, মাতা আশাফুন্নেছা বেগম। ৩ ভাই ও ৪ বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। ছোট বেলায় তার বাবা-মা ও গ্রামবাসি আদর করে তাকে বাঁচা বলে ডাকতো। লেখাপড়ার হাতে খড়ি কৃষ্ণকাটি প্রাইমারী স্কুলে। পরবর্তীতে ভর্তি হন কপিলমুনি সহচারী বিদ্যামন্দিরে। স্কুলে লেখাপড়ার সময় ১৯৬২ সালে ৮ম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলন ও ধর্মঘট পালনের মধ্যে দিয়েই মূলত তাঁর রাজনীতিতে হাতে খড়ি। তিনি ১৯৬৪ সালে কপিলমুনি সহচারী বিদ্যামন্দিরে ছাত্রদের বিভিন্ন দাবির আন্দোলন, স্কুলের নির্বাচিত ছাত্র মনিটর এবং ছাত্র ইউনিয়ন শাখার সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৫ সালে একই স্কুল থেকে ২য় বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন সম্পন্ন করেন। উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে পরবর্তীতে ভর্তি হন বাংলার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ দৌলতপুর ব্রজ লাল (বি.এল কলেজ) মহাবিদ্যালয়ে এবং ১৯৬৬ সালে দৌলতপুর কলেজ শাখার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। উচ্চ শিক্ষা লাভের আশায় পরবর্তীতে বাগেরহাট আচার্য্য প্রফুল্ল্য চন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে (পি.সি কলেজ) ¯œাতক ভর্তি হন। সে সময়ে দেশে রাজনীতি তুঙ্গে। তিনিও সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৮-৭০ সালে পর পর দু’বার বাগেরহাট মহাকুমায় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
    ১৯৬৯ সালে ০১ ফেব্রুয়ারি সরকার বিরোধী গণআন্দোলনে ক্যাম্পাস থেকে গ্রেপ্তার হন এবং ০২ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের মুখে সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। একই বছর তৎকালীন পাকিস্তানের মন্ত্রী খান এ সবুর তার রাজনৈতিক সফরে তালায় এসে পরবর্তীতে কৃষ্ণকাটি হাইস্কুল পরিদর্শণে যান। এই সময় খান এ সবুর তার অঞ্চলে আসায় প্রতিবাদ জানায়। ছাত্রাবস্থায় তিনি ১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহবানে মক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং সাতক্ষীরা জেলার তালা ও পাইকগাছা উপজেলার কপিলমুনি অঞ্চলে অন্যতম সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। দেশের রাজনৈতিক টানা পোড়নের এক পর্যায়ে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালনের পাশাপাশি ১৯৭৪ সালে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর সহ কয়েকটি জেলার গণবাহিনী প্রধান ও সি.ও.সি. এর সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি কয়েকবার কারা বরণ করেন। প্রগতিশীল প্রতিটি আন্দোলনে তিনি ছিলেন সক্রীয়। তার দলের মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনায় বাঁধাগ্রস্থ হয়ে দল থেকে বিচ্ছিন্ন হন এবং বাসদ গঠন করে বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালে সংস্কারপন্থি জাসদের সাথে যুক্ত হন এবং ১৯৮৬-১৯৮৮ মেয়াদে জাসদের খুলনা জেলার সভাপতি ও পরবর্তীতে আমৃত্যু জাসদের (জেএসডি) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মোড়ল আব্দুস সালাম তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনীতির পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে বিভিন্ন সামাজিক ও ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৯৭ সালে হোমল্যান্ড লাইফ ইন্সুরেন্স কোম্পানীর খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী ছিলেন। এছাড়াও কেন্দ্রীয় পানি কমিটি ও ভূমি কমিটি পরিচালনায় দক্ষ ভূমিকা পালন করেন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যায় সুপেয় পানির নিশ্চয়তা এবং এতদ্ঞ্চলে জলাবদ্ধতা নিরসন আন্দোলনে কেন্দ্রীয় পানি কমিটির অন্যতম পুরোধা। এছাড়াও খুলনা সাতক্ষীরা অঞ্চলে খাস জমিতে ভূমিহীনদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগ্রাম এবং ভূমিহীন নারী পুরুষদের মাঝে খাস জমি বিতরণের নেতৃত্ব দেন। তিনি তালা উপজেলা ভূমি কমিটির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ভূমি কমিটির সহ-সভাপতি হিসাবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন। তালা উপজেলার খাস জমি চিহ্নিতকরণ, ভূমিহীন বাছাই ও তালিকা প্রণয়ন ছিল তারই চিন্তার ফসল। সামাজিক জীবনে বীর মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। তিনি কানাইদিয়া রথখোলা বালিকা মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, রায় সাহেব বিনোদ বিহারী সাধু স্মৃতি সংসদের আজীবন সদস্য, কপিলমুনি পাবলিক লাইব্রেরীর প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, কপিলমুনি আঞ্চলিক বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সভাপতি, কপিলমুনি ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, কৃষ্ণকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সহ আরও বহু প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে মোড়ল আব্দুস সালাম এক কন্যা সন্তানের জনক। তিনি ছিলেন সম্পুর্ণ নির্লোভ, খাঁটি বাঙালী, আদর্শ দেশপ্রেমিক, সদালাপী, বিনয়ী, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞান মনোস্ক। তিনি কখনও সুযোগ সন্ধানী ছিলেন না। মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িকতাই ছিল তার ধর্ম। সকলের কাছে প্রিয় এই মানুষটি আমাদের মাঝে নেই। তিনি গত ৫ জুলাই ২০১১ খ্রিঃ মঙ্গলবার না ফেরার দেশে চলে যান। আমরা এ বীর সেনানীর অকাল প্রয়াণে শোকাহত, মর্মাহত। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার চির শান্তি কামনা করি। মৃত্যুর পরে যে সকল প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয় তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ ঃ মোড়ল আব্দুস সালাম গণ-গ্রন্থাগার, বিপ্লবী আব্দুস সালাম স্মৃতি পরিষদ, আব্দুস সালাম ফাউন্ডেশন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালাম বৃত্তি ও কল্যাণ ট্রাষ্ট, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোড়ল আব্দুস সালাম স্মৃতি মিনার পরিষদ, ৬নং তালা সদর ইউনিয়ন পরিষদ ঘোষিত উপজেলার শ্রেষ্ঠ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মরণোত্তর স্মারক প্রদান করা হয়, কপিলমুনি বালিকা বিদ্যালয়ের একটি ভবন সালাম চত্ত্বর নামে নামকরণ করা হয়, তালা ব্রীজ ভায়া কপিলমুনি খেয়া ঘাট পর্যন্ত রাস্তাটি সালাম সড়ক নামে নামকরণ করা হয়।

    তিনি বাঙালী জাতীর মুক্তির চেতনায় মুক্তির পথ খোঁজার নতুন তাগিদ অনুভব করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের আন্দোলন সহ ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদীর আন্দোলনের ইতিহাসের মধ্যে বাঙালীর গৌরবময় জাতীয়তাবাদীর স্বাধীনতা আন্দোলন সংগ্রামে ধারাবাহিক ইতিহাস অধ্যায়ন ও চর্চার পাশাপাশি সাংগঠনিক কাজ নিরলস ভাবে অব্যাহত রাখেন। তিনি ১৯৭০ খ্রিঃ ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ছাত্রলীগের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিরুপনে ছাত্রলীগ আহুত কেন্দ্রীয় বর্ধিত ফোরামের ঢাকা বলাকা ভবনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে তৎকালীন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক স্বপন কুমার চৌধুরীর প্রস্তাবে সমর্থন দিয়ে নতুন রাজনৈতিক নির্দেশনা খুঁজে পান।
    মোড়ল আব্দুস সালাম ১৯৭০ খ্রিঃ ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসকে বাংলাদেশ দিবস হিসাবে পালনের কর্মসূচীতে তৎকালীন পাইকগাছা, আশাশুনি, বড়দল, রাড়–লী, কপিলমুনি, খুলনা সাতক্ষীরার ব্যাপক এলাকায় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য ও সাংগঠনিক কাজ পরিচালনা করেন। কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নির্দেশনায় ২৬ মার্চ আশাশুনি খড়িহাটির জনসভা বাতিল করে সাতক্ষীরা সদরে পৌছে ছাত্রনেতা মোস্তাফিজুর রহমান, কামরুল, আজিবর, ময়না, জজ ভাই, মাসুদা, কামরুছামা, এনামুল, দেলোয়ার হোসেন দুলু, মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, দুই খসরু, কাজল, হাবলু, গোলাম, সুভাষ সরকার, সাইদুর রহমান সহ সাতক্ষীরার ছাত্রনেতাদের প্রয়োজনীয় কাজের প্রস্তুতিকে নির্দেশনা প্রদান করেন। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ২৯ মার্চ সাতক্ষীরার তৎকালীন এসডিও খালেক মাসুদের অফিসের সামনে হাজির হয়ে মোড়ল আব্দুস সালামের নেতৃত্বে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা নামিয়ে তা পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং একই সাথে স্বাধীন বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। গণপরিষদের সদস্য এম.এ গফুর এবং সুবেদার আয়ুব আলী সহ সাতক্ষীরা জেলার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহায়তায় পাঞ্জাবী খালেদ মাহমুদকে গ্রেপ্তার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মোড়ল আব্দুস সালাম। দেশ মাতৃকা শৃঙ্খল ভান্ডার দুর্বর শপথে বলিয়ান মোড়ল আব্দুস সালামের চেতনায় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সৃষ্ট মশাল দাউ দাউ করে জ্বলতে শুরু করে। স্বাধীন দেশের কর্মযোগ্য পরিচালনায় অর্থের প্রয়োজনে সাতক্ষীরা সহ পাকিস্তান ন্যাশনাল ব্যাংকের অর্থ ও সম্পদ সংগ্রহ করার পরিকল্পনা ১৯৭১ সালে ৮ এপ্রিল সফল অভিযানে অংশগ্রহণ করেন মোড়ল আব্দুস সালাম। সংগৃহীত হয় নগদ এক কোটি বিরাশি লক্ষ টাকা যা ছিল নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক সহযোগিতার শুভ সূচনা।
    ১৯৭০ খ্রিঃ নির্বাচনে ব্যাপক গণসংযোগ এবং সাংগঠনিক কাজের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন যোদ্ধা হিসাবে ভারতের দেরাদুল ক্যাম্প থেকে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৯৭১ খ্রিঃ ১৫ আগস্ট বৃহত্তর খুলনা জেলার মুজিব বাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে ১৬ জন প্রশিক্ষিত এবং ১৯ জন সহযোগী মোট ৩৫ জনের একটি দল নিয়ে ভারতীয় সিমান্ত অতিক্রম করে সাতক্ষীরা জেলার তালা থানার মাগুরায় অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার ঘাটি গড়ে তোলেন মোড়ল আব্দুস সালাম। এরপর শুরু করেন স্থানীয় মানুষের মধ্যে ট্রেনিং প্রদানের কাজ এবং পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোষর শত্রু ঘাটি আক্রমনের পরিকল্পনা। প্রস্তুতি পূর্বে প্রাথমিক আক্রমন পরিচালনায় পাইকগাছা বড়দল, বারহাড়িয়া সফলতা অর্জিত হয়। এরপর পাটকেলঘাটা ও কপিলমুনি রাজাকার ঘাটির বিরুদ্ধে কোনটি আগে পরিচালিত হবে সেই প্রশ্নে মোড়ল আব্দুস সালাম সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তার নির্দেশনায় কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ ও সফলতা অর্জন করেন। ৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার এই যুদ্ধ সম্পর্কে মোড়ল আব্দুস সালাম লিখেছেন, তার জীবনে নৌপথ ও সামুদ্রিক গেরিলা যুদ্ধ খুলনা/কপিলমুনি যুদ্ধই শেষ যুদ্ধ। কপিলমুনি রাজাকার ঘাটির তালিকা মতে এক হাজার ছয়শত এক জন মানুষকে হত্যা করে। কপিলমুনি যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হবার পর গণ আদালতের রায়ে বন্দী ১৫৫ জন রাজাকারের মধ্যে ১৫১ জনকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। এদিকে নৌপথ ও সামুদ্রিক গেরিলা যুদ্ধে খুলনা সাতক্ষীরা বাগেরহাট অঞ্চলে নৌকমান্ডার লে. মোহাম্মদ রহমত উল্লাহ (দাদু) (বীর প্রতীক) এর নেতৃত্বে মুজিব বাহিনীর প্রধান বৃহত্তর খুলনা কমান্ডো শেখ কামরুজ্জামান টুকু, স. ম বাবর আলী, ইউনুস আলী ইনু, আবুল কালাম আজাদ, গাজী মোঃ রফিক, মোড়ল আব্দুস সালাম, স. ম আলাউদ্দীন, ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবর রহমান, নৌকমান্ডো বজলুর রহমান, সামসের আলী, শফিক আহম্মেদ, ড. মাহফুজুর রহমান, মেজর সামছুল আরেফিন, সাইদুর রহমান কুটু, নুরুল ইসলাম মানিক, কে.এ.ম মুজিবর রহমান, শাহাদাৎ হোসেন বাচ্চু সহ হাজারও মুক্তিযোদ্ধা কপিলমুনি যুদ্ধের পর পর্যায়ক্রমে ১৬ ডিসেম্বর খুলনার বিজয় অর্জনে মোড়ল আব্দুস সালাম একজন নিবেদিত প্রাণ ও সংগঠক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
    মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ের প্রশ্নে মোড়ল আব্দুস সালাম এর বক্তব্য ছিল যে, মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত ছিল, সার্টিফেকেট অর্জনের জন্য নয়। সার্টিফিকেট দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভূক্ত হতে হবে এমন ভাবনা তাদের ছিল না। তাই অনেক মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট না থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই বলে কি সে মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভূক্ত হবে না?
    তিনি আরো বলেন, আমরা ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় যুবকদের ট্রেনিং দিয়েছি। যেমন- সাতক্ষীরার মহাকুমার তালা থানার ভাতুয়াডাঙ্গায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছিল।

    #

  • সলঙ্গা বিদ্রোহ : চাপা পড়া ইতিহাস

    সলঙ্গা বিদ্রোহ : চাপা পড়া ইতিহাস

    ইমাম গাজ্জালী

    আজ থেকে শতবর্ষ আগে, এই দিনে সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায় বড় ধরণের গণহত্যা সংঘটিত করেছিল ব্রিটিশ পুলিশ ও সৈন্য। একটা হাটে বিলেতি পণ্য বর্জনের শান্তিপূর্ণ আয়োজনে গুলি করে গণহত্যা চালানো হয়। সেখানে নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আড়াল করতে সাড়ে চার হাজার মানুষ ‘হতাহত’ হয়েছিল বলে সরকারিভাবে স্বীকার করা হয়েছিল।

    ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি। এ ঘটনার তিন বছর আগে ১৯১৯ সালের ২৪ এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিনওয়ালাবাগে ব্রিটিশ পুলিশের গুলিতে ৩৭৯ থেকে এক হাজার লোক নিহত হয়েছিলেন বলে জানা যায়। সে ঘটনাটি নিয়ে উপমহাদেশে বেশ তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশের দেওয়া নাইট উপাধি প্রত্যাখান করেছিলেন। অথচ শতবছরেও সলঙ্গা বিদ্রোহের ঘটনাটি সামনে আসেনি, আসেনি আলোচনায়। বিষয়টি বিষ্ময়কর।

    সলঙ্গা বিদ্রোহের প্রেক্ষাপট : প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে জার্মানের অক্ষ শক্তির পরাজয় হলেও, পর্যুদস্থ হয়েছিল ব্রিটিশ শক্তি। এছাড়া যুদ্ধে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের একতরফা ভারতীয় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্তে লোকজনের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাধতে থাকে। ঠিক সেই সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রাওলাট আইন নামে একটি আইন পাশ করা হয়। ভারতের ভাইসরয় ও ইম্পিরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল ১৯১৯ সালের ৬ এপ্রিল এ আইন বলবৎ করে। এ আইনবলে ভারতবাসীর ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন শুরু হয়। ন্যূনতম প্রমাণ দাখিল ব্যতিরেকেই সেনা ও পুলিশকে সাধারণ ভারতীয়দের গ্রেপ্তার, জেল-জরিমানা ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি দেওয়া হয়। পুলিশের দমন পীড়নে মানুষ ক্ষোভে ফুসতে থাকে।

    অন্যদিকে, তুরস্কের সুলতানকে বিশ্বের সকল সুন্নী মুসলমানদের খলিফা বলে মনে করতেন খেলাফতিরা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮) তুরস্ক ছিল জার্মানীর নেতৃত্বে অক্ষ শক্তির পক্ষে। তাদের পরাজয় ঘটে। তুরস্কের অখণ্ডতা হুমকিতে পড়ে। মুস্তাফা কামাল তুরস্কের সুলতানকে সিংহাসনচ্যুত করলে ব্রিটিশ সরকার কামালকে সমর্থন করেন। তখন লাখ লাখ ভারতীয় মুসলমান সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হন। তারা তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার দাবি তোলেন। তুর্কি সুলতান বা খলিফার মর্যাদা ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রাখার দাবিতে মুসলমান নেতারা খিলাফত কমিটি গঠন করেন। তাঁদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের ঔদাসিন্যের অবসান ঘটাতে সচেষ্ট হন।

    উল্লেখ্য, খেলাফতিরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি। মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্না খেলাফত আন্দোলনকে সমর্থন দেননি। কংগ্রেস খেলাফত আন্দোলনকে সমর্থন জানায়।

    অপরদিকে, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মুখতার আহমেদ আনসারী, হাকিম আজমল খান, আব্বাস তয়েবজি, মওলানা মহম্মদ আলি ও মওলানা শওকত আলী প্রমুখ মুসলিম নেতারা গান্ধীকে সমর্থন করেন। ১৯১৯ ও ১৯২০ সালে গান্ধী ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। হিন্দু মুসলিমের মধ্যেকার বিরোধটি আপাত স্থগিত হয়ে যায়।

    এদিকে, গান্ধী রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে গণক্ষোভকে কাজে লাগাতে একটি জাতীয় প্রতিবাদ আন্দোলনের সূচনা করেন। সকল অফিস ও কলকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ভারতীয়দের সরকারি স্কুল, পুলিশ বিভাগ, সেনাবাহিনী ও সরকারি চাকরি ত্যাগে উৎসাহিত করা হয়। আইনজ্ঞরা সরকারি আদালত বর্জন করেন। গণ-পরিবহন, ব্রিটিশ দ্রব্যসামগ্রী বিশেষত কাপড় বর্জিত হয়।

    অসহযোগ আন্দোলনের সাফল্য ও লক্ষ লক্ষ ভারতীয়ের এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পর্যুদস্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। এমন একটি বাস্তবতায় সংঘটিত হয় সলঙ্গা বিদ্রোহ। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলা এই আন্দোলনের সময়কে ‘গান্ধী যুগ’’ বলে অভিহিত করা হয়।

    অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ার থেকে বাদ যায় না প্রত্যন্ত সিরাজগঞ্জের সলঙ্গা। সলঙ্গার গণহত্যার তিন দিন আগে, সেখান থেকে কয়েক মাইল উত্তরে চান্দাইকোনা হাটে অসহযোগ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। আন্দোলনকারীরা পুলিশের বন্দুক কেড়ে নিয়ে পাশের ফুলঝোর নদীতে ফেলে দেয়। সলঙ্গা বিদ্রোহের সপ্তাহ খানেক পর ১৯২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি উত্তর ভারতের গোরক্ষপুর জেলায় চৌরিচৌরার ‘অসহযোগ’ আন্দোলনকারী জনতা একটি থানায় আগুন ধরিয়ে দিলে পুলিশ গুলি চালায়। সেখানে ২৩ জন পুলিশ ও তিনজন আন্দোলনকারী নিহত হয়। ‘অহিংস ও অসহযোগ’ চরিত্র থেকে আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করে। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী আন্দোলনের তেজ দেখে ভীত হয়ে পড়েন। তিনি ভারতীয় জনগণকে সংগ্রাম বন্ধ করার অনুরোধ জানান। আন্দোলন বন্ধ করার জন্য গান্ধী তিন দিন অনশন পালন করেন। চৌরিচৌরায় সহিংস ঘটনার ৮ দিন পর ১২ ফেব্রুয়ারি গান্ধী আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। হিন্দু-মুসলমানের মিলন বিরোধে রূপ নেয়। আন্দোলন এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছিল, সেটা অব্যাহত রাখলে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের মেরুদণ্ড তখনই ভেঙে দেওয়া সম্ভব ছিল, সাতচল্লিশে সমঝোতায় ইংরেজ বিদায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হত না। তার আগেই ব্রিটিশকে ভারত ছাড়তে বাধ্য করার চমৎকার হাতে আসা সুযোগ পায়ে ঠেলা হয়।

    কিন্তু মোহনদাস করমচাদ গান্ধী এত বড় রক্তক্ষয়ী ঘটনার পরও আসেননি সলঙ্গায়। তিনি ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি পর্যন্ত দেননি। যে রবীন্দ্রনাথ জালিনওয়ালাবাাগের হত্যাকাণ্ডের প্রশ্নে নাইট উপাধি প্রত্যাখ্যান করলেন, পূর্ববাঙলার জমিদারির (নওগাঁর পতিসর, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর) অর্থ বিত্তে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি দ্যুতি ছড়ালেও, সেই রবীন্দ্রনাথ সলঙ্গা গণহত্যা নিয়ে সরব হননি।

    আমাদের জানা মতে, ইতিহাসের এই অধ্যায় নিয়ে কোনো কাজ হয়নি। কেউ নাটক লেখেনি, কোনো সিনেমা হয়নি। কারো কবিতা চোখে পড়েনি। শুধু উপমহাদেশ নয়, বাংলাদেশেও ইতিহাসের এই অধ্যায়টি অনালোচিত।

    জানা গেছে, সিরাজগঞ্জের গাড়াদহ নদীর তীরেই বসত সলঙ্গার হাট। সিরাজগঞ্জ তো বটেই, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, টাঙ্গাইল ও বগুড়া থেকে নানা পণ্যবাহী মহাজনী নৌকা এসে ভিড়ত সলঙ্গার হাটে। এত নৌকা আসত যে, নদীর ঘাট প্রায় দেড় মাইল লম্বা হয়ে যেত।

    ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি, দিনটি ছিল শুক্রবার, বড় হাটবার। বিলেতি পণ্য বর্জনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছিল কংগ্রেস ও খেলাফতের কর্মীরা। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেসময়ের তরুণ কংগ্রেসকর্মী আবদুর রশিদ, যিনি পরবর্তীতে আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ নামেই খ্যাতি পেয়েছিলেন। একপর্যায়ে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নিযুক্ত হন। গণ-আজাদী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেছিলেন। ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি, দিনটি ছিল শুক্রবার, বড় হাটবার। বিলেতি পণ্য বর্জনে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করছিল কংগ্রেস ও খেলাফতের কর্মীরা।

    আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের সংক্ষেপিত বয়ান, “আমি প্রায় তিনশ’ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে সলঙ্গা হাটে কাজ করছি। এমন সময় পাবনার তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. আর এন দাস, সিরাজগঞ্জ মহকুমার এসডিও মি. এসকে সিনহা বা সুনীল কুমার সিংহ (তিনি ছিলেন আইসিএস লর্ড বিজয় কুমার সিংহ রায়ের ছেলে) এবং পাবনা জেলার ব্রিটিশ পুলিশ সুপার ৪০ জন আর্মড পুলিশ নিয়ে হাটে উপস্থিত হন। আমি ছিলাম কংগ্রেস অফিসে। বিশাল বপু টাক মাথাওয়ালা এসপি সাহেব আমাকে দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। আগে থেকেই তার খাতায় আমার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ জমা হয়েছিল। তাই আমাকে হাতের কাছে পাওয়ার পর তার আর তর সইল না। তৎক্ষণাৎ আমার ওপর নির্মম দৈহিক নির্যাতন শুরু করেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমার নাক-কান ফেটে দেহের নানা অংশ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। সলঙ্গা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা আমার পিতামহ ও পিতার অনেক ভক্ত মুরিদান ছিলেন। তারা তো বটেই, হাটের সাধারণ হাটুরেরাও এ নির্যাতন দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার জ্ঞান ফিরে আসে। আমাকে টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় ভিড়ের মধ্য থেকে জনৈক ব্যক্তি ‘নড়ি’ (গরু খেদানোর লাঠি) দিয়ে পুলিশ সুপারের মাথায় সজোরে আঘাত হানে। ইংরেজ সাহেবের টাকমাথা ফেটে গিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। পুলিশ সুপার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সবাই যখন পুলিশ সুপারকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন হাটের তিন দিক থেকে লাখো জনতা আমাকে মুক্ত করার জন্য এগিয়ে এলো। ক্ষিপ্ত জনতা নিকটবর্তী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্মড পুলিশ সারিবদ্ধ হয়ে জনতার দিকে রাইফেল তাক করে হাঁটু গেড়ে বসে।”

    “ইতোমধ্যে পুলিশ সুপারের সংজ্ঞা ফিরে আসে। পুলিশ সুপার পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে পরামর্শ করে গুলি চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। পুলিশ সুপার হুকুম দিলেন ‘ফায়ার’। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠল ৩৯টি রাইফেল। অবিরাম গুলিবর্ষণ চলে বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর। গুলিবিদ্ধ হয়ে আমার সামনেই সাতজন নিহত হয়। অবিরাম গুলিবর্ষণে কতজন যে নিহত হয়ে হাটের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছিল, তার কোনো হিসাব ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকেও পাওয়া যায়নি। সরকারি তদন্ত রিপোর্টে হতাহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার বলে হিসাব পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কত শত আহত হয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে পথঘাটে ঝোপে-জঙ্গলে মৃত্যুবরণ করেছে এবং কত শত আজও অজ্ঞাত, তার হিসাব নেই। সরকারি কোপদৃষ্টিতে পড়ে নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে কখনো মৃত্যুর কথা প্রকাশ করেনি স্বজনরা।

    “সরকারি তদন্ত রিপোর্টে হতাহতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার হাজার বলে হিসাব পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু কত শত আহত হয়ে ছুটে পালাতে গিয়ে পথঘাটে ঝোপে-জঙ্গলে মৃত্যুবরণ করেছে এবং কত শত আজও অজ্ঞাত, তার হিসাব নেই। সরকারি কোপদৃষ্টিতে পড়ে নির্যাতিত হওয়ার ভয়ে কখনো মৃত্যুর কথা প্রকাশ করেনি স্বজনরা।

    অবিরাম গুলিবর্ষণে আর্মড পুলিশের সব গুলি শেষ হয়ে যায়। এ খবর মুহূর্তে সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষিপ্ত, উত্তেজিত, মার খাওয়া জনতা ফালা, লাঠি, সরকি, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে চারদিক ঘিরে সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে মুক্ত করে দিয়ে অনুরোধ করেন, ‘আপনি যেমন করেই হোক জনতাকে বুঝিয়ে শান্ত করুন এবং ফিরিয়ে নিন। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের অনুরোধ আমি গ্রহণ করলাম। কারণ অহিংস আন্দোলনের সৈনিক হিসেবে এটা আমার নৈতিক দায়িত্বও ছিল।”

    “যতদূর মনে পড়ে বলেছিলাম, এখন আপনার যদি নিরস্ত্র না হন, শান্ত না হন, তবে এ সংবাদ পেয়ে আরো পুলিশ আসবে, গোটা সৈন্যও আসবে। তারা এলে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেবে, নির্বিচারে হত্যা করবে, ধরে নিয়ে যাবে। এ কথা শোনার পর জনগণের ভেতর থেকে একটি বিক্ষুব্ধ কণ্ঠ ভেসে এলো, তাহলে গান্ধী রাজারে খবর দেন, সেও তার সৈন্য পাঠাক। উত্তরে বললাম, গান্ধী রাজার সৈন্য তো আমরাই। অন্য সৈন্য গান্ধী পাবেন কোথায়? তখন ভিড়ের মধ্যে শতকণ্ঠে প্রশ্ন এলো, তাহলে ওই পচা ভেড়ার লেজ ধরেছেন কেন?”

    “এই ভয়াবহ হত্যাকান্ডের খবর রাতারাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরদিনই কলকাতা, ঢাকা ও বাংলার বিভিন্ন এলাকা থেকে কংগ্রেস ও খেলাফত কমিটির নেতা, কর্মী

    বাহিনী, ডাক্তার, ছাত্র, স্বেচ্ছাসেবক সলঙ্গা বাজারের দিকে দলে দলে আসতে থাকে। নায়ক, আনন্দবাজার, অমৃতবাজার প্রভৃতি দৈনিক এই হত্যাকান্ডের উল্লেখ করে সরকারি ও বেসরকারি তদন্তের দাবি উত্থাপন করে।”

    অসহযোগ ও খেলাফতের যুগ্ম আন্দোলন প্রত্যাহার হওয়ার পর হিন্দু মুসলিম-দুই সম্প্রদায় পুনরায় ফিরে যায় বিভেদের পথে। তরুণ আবদুর রশিদ তৎকালীন ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র দেওবন্দের পথে পা বাড়ান।

  • হেফাজতের নতুন কমিটি এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি

    বিভুরঞ্জন সরকার

    গত কয়েক বছর থেকে নানা কারণে আলোচনায় আসা সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে ৭ জুন। ১৫১ সদস্যের অবশিষ্টদের পরে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও হেফাজতে ইসলাম রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েই আলোচনায় এসেছে। নারীনীতির বিরোধিতা দিয়ে শুরু করে হেফাজত কার্যত সাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার কাজই করছে। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে জমায়েত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের খোয়াব দেখেছিল হেফাজত। আওয়ামী লীগনিরোধী সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক গড়ে হেফাজত তার শক্তি প্রদর্শন করেতে দ্বিধা করেনি। তবে শাপলা চত্বরের নাশকতার পর হেফাজতের সঙ্গে সরকারের একটি গোপন সমঝোতা হয় বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন। হেফাজতের প্রথম আমির শাহ আহমেদ শফীর সঙ্গে কৌশলের মৈত্রী করে সরকার হেফাজতকে আন্দোলনবিমুখ করতে সক্ষম হলেও তাদের এমন কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন এনে হেফাজতের মন রক্ষা করার সুদূরপ্রসারী কুফল পুরো জাতিকেই বহন করতে হবে।

    হেফাজতে সরকারবিরোধী অংশ গত বছর থেকেই নেতৃত্ব কবজা করার পাঁয়তারা করে সফল হয় আহমেদ শফীর মৃত্যুর পর। আহমেদ শফী মৃত্যুবরণ করেন গত বছর ১৮ মার্চ। ১৫ নভেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে শফী অনুসারীদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির এবং নূর হোসেন কাসেমীকে মহাসচিব করে যে কমিটি গঠন করা হয় তাতে বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে জড়িতদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। হেফাজত সরকারবিরোধী অবস্থান দৃশ্যমান করে তোলে। যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ আরো কয়েকজন উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হেফাজতের নেতৃত্বে এসে ওয়াজ মাহফিলের নামে দশে উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালাতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য দিয়ে তারা সরকারকে তাতিয়ে তোলে।

    বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের একটি অন্যতম মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও বাস্তবে কি ব্যক্তিজীবনে, কি রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থায় ‘ধর্ম’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবেই থেকে যায়। সাধারণ মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনার জন্য যে রকম প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন ছিল, শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণার অনুকূলে যে রকম মজবুত গাঁথুনি তৈরি করা দরকার ছিল তার কোনো কিছুই পরিকল্পিতভাবে করা হয়নি

    এরপর মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের বিরোধিতা করতে গিয়ে হেফাজত দেশের বিভিন্ন স্থানে যে সহিংসতার আশ্রয় নেয় যা হজম করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে যায়। সরকার হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করায় হেফাজত কিছুটা বিপদের মধ্যেই পড়ে। আলোচিত- বিতর্কিত নেতা মামুনুল হকসহ অনেকেই গ্রেপ্তার হওয়ায় হেফাজত দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় সংগঠনের কমিটি বিলুপ্ত করা হয় ২৫ এপ্রিল রাতে। এটা হয়তো সরকারকে শান্ত করার একটি হেফাজতি কৌশল। তবে সরকারের কাছে যেসব তথ্য আছে তা থেকে মনে হয় না যে হেফাজত এবার শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে পারবে। মামুনুল হকসহ গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের নতুন কমিটিতে ঠাঁই না দেওয়া মানে অবশ্যই এটা নয় যে হেফাজত তার দৃষ্টিভঙ্গি বদল করেছে। হেফাজত সরকারি চাপের মুখে হেফাজত কৌশল বদল করলেও বাংলাদেশকে পাকিস্তানের আদলে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি।

    অজ্ঞাত উৎস থেকে অর্থ প্রাপ্তি, পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগসহ যেসব তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পেয়েছে, গণমাধ্যমে যেসব খবর প্রকাশ হচ্ছে, তার ভিত্তিতে সরকার কি ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেটাই এখন দেখার বিষয়। হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণ নয় শুধু সমূলে উৎপাটনের কার্যকর উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা থাকতে হবে। হেফাজত যেমন বাংলাদেশ চায়, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা তেমন। বাংলাদেশ চাননি।

    মানুষকে সংখ্যা দিয়ে গণনা করে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু হিসেবে বিভাজন করাটা সমীচীন না হলেও এটা বিশ্বব্যাপীই হয়ে আসছে। সংখ্যালঘুরা সব দেশে, সব সমাজেই কিছুটা আলাদা, তাদের অধিকার ও মর্যাদা সব ক্ষেত্রে এক রকম নয়। মূলত ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে এটা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে আরো নানাভাবেই এই ভাগ-বিভক্তি করা যায়, করা হয়। ধর্ম ছাড়াও মানুষের বর্ণ (গায়ের রং), বিশ্বাস, চিন্তা ইত্যাদি দিয়েও সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু নিরূপিত হয়ে থাকে।

    মোটা দাগে পৃথিবীতে ধর্মবিশ্বাসীরা সংখ্যাগুরু আর ধর্মে অবিশ্বাসীরা সংখ্যালঘু। আস্তিক-নাস্তিক লড়াই নতুন নয়। কোথাও সাদা রঙের মানুষ সংখ্যাগুরু, কোথাও কালো রঙের। কোথাও মুসলমান সংখ্যাগুরু, কোথাও হিন্দু, কোথাও খৃস্টান, কোথাও বৌদ্ধ কিংবা অন্য কোনো ধর্ম বিশ্বাসী। এক ধর্মের মানুষের মধ্যেও সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু আছে থাকতে পারে । যেমন কোথাও শিয়া মুসলমান সংখ্যালঘু, কোথাওবা সুন্নী। খৃস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক প্রোটেস্টান আছে। হিন্দুদের বর্ণ বিভাজন তো মারাত্মক।

    বিশ্বাস এবং চিন্তার ক্ষেত্রেও সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু আছে। তবে আমরা বাংলাদেশে প্রধানত ধর্মের ভিত্তিতেই সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু নির্ধারণ করে থাকি। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগুরু আর সনাতন ধর্ম বিশ্বাসীরা সংখ্যালঘু। বৌদ্ধ, খৃস্টানরাও ধর্মীয় সংখ্যালঘু। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যখন একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দুই খণ্ড হয়ে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটলো তখন স্বভাবতই আশা করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি আর পাকিস্তানি কোনো লিগাসি বা মন্দ উত্তরাধিকার কিংবা ধারা বহন করবে না। পাকিস্তান ছিল ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্রটি হবে অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চরিত্রের। ধর্ম হবে মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, আচরণ ও পালনের বিষয়। রাষ্ট্র হবে সবার, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃস্টান – সব মানুষের। এমনকি গরিবের নিঃস্বের ফকিরেরও। রাষ্ট্র বিশেষ কোনো ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। বিত্তবান এবং বিত্তহীনদের যে বৈষম্য অর্থাৎ ধনবৈষম্য কমিয়ে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র্রের আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছিল রক্তমূল্যে অর্জিত নতুন স্বাধীন দেশের বাহাত্তরের প্রথম সংবিধানে। কিন্তু বাস্তবে সেরকম হলো না। দেশ স্বাধীনতা হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই আমাদের মনোভূমির রং বদলাতে লাগলো। আজ তা উজ্জ্বলতা হারিয়ে প্রায় ফ্যাকাশে।

    হিন্দু-মুসলমানের মিলিত রক্তস্রোত সাঁতরে যে দেশ স্বাধীন হলো সে দেশ আবার পাকিস্তানমুখী হবে – সেটা ছিল আমাদের তখনকার চিন্তার বাইরে! জাতি হিসেবে আমরা একটু আবেগপ্রবণ। যুদ্ধ জয়ের উন্মাদনা, নতুন দেশ, নতুন পতাকা, নতুন জাতীয় সঙ্গীত পাওয়ার উত্তেজনায় আমরা তখন আবেগ-উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসছিলাম। কিছুটা যুক্তিরহিত আচরণ করেছিলাম। মানুষের মনোজগতের পরিবর্বতন যে রাতারাতি হয় না, সেটা যে ধারাবাহিক চর্চা ও সাধনার মাধ্যমে অর্জন করতে হয় – তা আমরা তখন ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করিনি। অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার প্রত্যয় থেকে আমরা কীভাবে সরে এলাম, নিজেদের মানুষ হিসেবে না ভেবে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে পরিচিত করার প্রবণতা কীভাবে আমাদের পেয়ে বসলো – সে বিষয়গুলো আমাদের গভীর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা দাবি করে। বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ক্ষমতাসীনরা এই কথাটা বেশি উচ্চারণ করে থাকেন। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকতেও এই আপ্তবাক্য উচ্চারিত হয়েছে। বাংলাদেশে ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সব মানুষ সমান সুযোগ ও অধিকার ভোগ করে থাকে বলে যে দাবি করা হয় তা যথার্থ নয়। এটা ঠিক যে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে যা বোঝায় বাংলাদেশে তা দীর্ঘ দিন ধরেই হয়নি বা হয় না। তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নেই। এক সময় হয়তো কিছুটা প্রচ্ছন্ন ছিল, এখন তা প্রকট এবং প্রকাশ্য হয়েছে। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার পরিবর্তে তাকে তার ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে বিচার করার প্রবণতা এখন প্রবল।

    বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের একটি অন্যতম মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও বাস্তবে কি ব্যক্তিজীবনে, কি রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থায় ‘ধর্ম’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবেই থেকে যায়। সাধারণ মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনার জন্য যে রকম প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন ছিল, শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণার অনুকূলে যে রকম মজবুত গাঁথুনি তৈরি করা দরকার ছিল তার কোনো কিছুই পরিকল্পিতভাবে করা হয়নি। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, পাকিস্তানের পরাজয় মানে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিজয়। যে মানুষ ২৫ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত পাকিস্তানের ভৌগোলিক কাঠামোয় এবং রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিল, রাতারাতি তার মধ্যে আদর্শিক পরিবর্তন ঘটার কোনো স্বাভাবিক কারণ ছিল না। মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন হয় ধীরে ধীরে, ক্রমাগত উন্নত বা অগ্রগামী দর্শন চর্চার মধ্য দিয়ে।

    মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কোনো সময় একটি দৃঢ় আদর্শভিত্তিক একশিলা দল ছিল না। এটা ছিল মূলত বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের একটি বৃহত্তর জাতীয় প্লাটফরম। এই দলের পতাকাতলে যারা সমবেত হয়েছিলেন তারা সবাই এক মত, এক পথের ছিলেন না। এমন কি দলের নেতৃত্বের মধ্যেও চিন্তার পার্থক্য ছিল। আওয়ামী লীগের মধ্যে একাধিক ধারা সক্রিয় ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে উদার, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ধারাটি এক সময় প্রধান হয়ে উঠলেও তার বিরোধী একটি ধারা দুর্বল হলেও সক্রিয় ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা তথা অসাম্প্রদায়িক চেতনা যেমন আওয়ামী লীগে ছিল, তেমনি ধর্ম নিয়ে দুর্বলতাও ছিল।

    আমাদের দেশে সমাজ-রাজনীতি, মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় মনস্তত্ত্ব নিয়ে সিরিয়াস কোনো গবেষণা হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। কতগুলো সস্তা জনপ্রিয় ধারণাকে ভিত্তি করেই আমরা গুরুত্বপূর্ণ অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বছর না ঘুরতেই ভাষার মর্যাদা নিয়ে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে তৈরি মতভিন্নতা নিঃসন্দেহে আমাদের এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের চিন্তার জগতে একটি বড়ো মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা ছিল। কিন্তু সেটা কত শতাংশ মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের সূচনা করেছিল তার কোনো বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ-পরীবিক্ষণ হয়েছে কি? ভাষার লড়াইটা তৃণমূল পর্যায়ের মুসলিম মানসে যতটা অসাম্প্রদায়িক ভাবনার ঢেউ তুলেছিল বলে মনে করা হয়, বাস্তবটা কি আসলে তাই? পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল, ঢাকা শহর রক্তে ভাসিয়েছিল বলে এক ধরনের কাতরতা অনেকের মধ্যে তৈরি হয়েছিল কিন্তু সে জন্য এটা বলা যায় না যে দ্বিজাতিতত্ত্ব তখনই মানুষের মন থেকে খারিজ হয়ে গিয়েছিল!

    যে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো, মাত্র ৭ বছর যেতে না যেতেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় সেই মুসলিম লীগের কবর রচিত হলো। অথচ এ তথ্যও আমাদের অজানা নয় যে, এই অঞ্চলের মানুষই পাকিস্তানের পক্ষে একচেটিয়া ভোট দিয়েছিল। তো, এই যে মানুষের মন পরিবর্তন, একেবারে এদিক থেকে ওদিক যাওয়া – এর পেছনে ঠিক কি কি বিষয় কাজ করেছে তা কি আমাদের কোনো রাজনৈতিক চিন্তাবিদ বা সমাজ গবেষকের গবেষণায় উঠে এসেছে? এটা কি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সচেতনতাজাত, নাকি তার সঙ্গে আবেগ এবং হুজুগপ্রিয়তার মিশেলও ছিল?

    বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র যে আজ অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করতে পারছে না, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও বাংলাদেশে ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুরা যে আজ এক চরম অন্তর্জ্বালা নিয়ে বসবাস করছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে অতীতের দিকে চোখ দিয়েই। ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ বলে বিলাপসঙ্গীত গেয়ে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়া যাবে না। সেটা গড়তে হলে ঐতিহাসিকভাবে যে ভুলভ্রান্তি আমরা করে এসেছি তা স্বীকার করে ফাঁকফোকড় মেরামত করে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।

    বাংলাদেশে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেন, তাদের কাছে ড. আহমেদ শরীফের নাম অজানা থাকার কথা নয়। তিনি একজন মুক্তবুদ্ধির মানুষ ছিলেন। ধর্মের প্রতি যে তার আস্থা-বিশ্বাস ছিল না, সেটা তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই সবার সামনে প্রকাশ করেছিলেন। তাকে ‘নাস্তিক’ বলা হতো। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা, ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করার তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। কিন্তু তিনি তার চিন্তায় তার ছাত্রদেরও খুববেশি প্রভাবিত করতে পারেননি। ধর্ম বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাসজাত সংস্কার-কুসংস্কার মানুষের মনে যতোটা সহজে বাসা বাধে, ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার পরামর্শ ততোটা মানুষকে আলোড়িত-আলোকিত করে না।

    মানুষ সহজাতভাবেই যুক্তিবাদী বা যুক্তিপ্রিয় হয় না। যুক্তিবাদিতা একটি বিশেষ গুণ বা প্রবণতা যা চর্চার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়। অন্ধ বিশ্বাস কিংবা যুক্তিহীনতা মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে। অন্যদিকে কুসংস্কারমুক্ত ও যুক্তিবাদী মন মানুষকে বিনয় ও সৌজন্যতার ধারায় অগ্রসর হতে সহায়তা করে। এক ধর্মের মানুষ যদি অন্য ধর্মের মানুষ সম্পর্কে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল থাকেন তাহলে পরস্পরের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি কম হতে পারে। সব থেকে বড়ো কথা হলো, যে যে ধর্মবিশ্বাসী তাকে সেই ধর্ম পালনের অধিকার দিতে হবে। মুসলমান নামাজ-রোজা, ইবাদত-বন্দেগি করার অধিকার পাবে, হিন্দুও তার পূজা-পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে অনায়াসে, অবাধে। অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের বেলায়ও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।

    এমন অবস্থা যখন বাধাগ্রস্ত হয়, এক পক্ষ যখন অন্য পক্ষের বিশ্বাস নিয়ে কৌতুক-তামাশা করে কিংবা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-উপহাস করে তখনই বিষয়টি আর সহনীয় থাকে না। গোলমাল বাধে, বেধে যায় দাঙ্গা-হাঙ্গামাও।

    আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করি যে, মামুনুল হকসহ গ্রেপ্তারকৃত হেফাজত নেতারা ইসলামী জলসা কিংবা ওয়াজ মাহফিলের নামে এমন কুরুচিপূর্ণ এবং জাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ তৈরির জন্য উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে দেশের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করার অপপ্রয়াস চালাতে অভ্যস্ত। যাদের ব্যক্তিজীবন অসততা ও নোংরামিতে পূর্ণ তারা যদি ধর্মের হেফাজতের দায়িত্ব নেন তাহলে সেটা যে ধর্মের মাহাত্ম্যকেই ম্লান করে – এটা বুঝতে হবে সবাইকে।

    লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ।

  • বাম নেতাদের ভুল ভাঙছে, চোখ খুলছে

    আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

    বিদেশে খুব নৈরাশ্যের মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। ঠিক এই সময়ে দুটি বিষয় আমার মনে কিছুটা আশা ফিরিয়ে এনেছে। একটা হলো, সম্প্রতি ঢাকার একটি দৈনিকে প্রকাশিত ভারতীয় সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষালের একটি প্রবন্ধ, যে প্রবন্ধে তিনি বলতে চেয়েছেন, গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম ব্যর্থ হয়েছে এবং মার্কসবাদ বর্তমান বিশ্বে তার প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাচ্ছে। আমি তার এই কথায় আশান্বিত হয়েছি। কিন্তু তার সব কথার সঙ্গে সহমত পোষণ করি না।
    আরেকটি বিষয় হলো, সম্প্রতি ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির ৫০ বছর এবং উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তির পুনরুত্থান’ শীর্ষক এক ওয়েবিনার অনুষ্ঠান এবং তাতে সাবেক মন্ত্রী এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের বক্তব্য। আমি তার বক্তব্যের সর্বাংশের সঙ্গে সহমত পোষণ করি না। কিন্তু এত দীর্ঘকাল পর মন্ত্রিত্বের মোহ ত্যাগ করে কিছু সত্য কথা বলার জন্য তিনি যে এগিয়ে এসেছেন, সেজন্য আশাবাদী হয়েছি। কারণ, বাংলাদেশে বাম গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি গড়ে তুলতে রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বের ওপর আমি এখনও আশা রাখি। তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব স্বীকার করেছেন এবং অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাকে সমর্থন দিচ্ছেন। কিন্তু তাকে অতীতের বাম রাজনীতির ব্যর্থতার কারণগুলো সততার সঙ্গে স্বীকার করতে হবে এবং অতীতের চৈনিক রাজনীতির মোহ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
    মার্কসবাদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করতে পারি এমন পা-িত্য আমার নেই। জয়ন্ত ঘোষালও তার প্রবন্ধে মার্কসবাদ বর্তমান বিশ্বে প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাচ্ছে বলেছেন, কিন্তু কোথায় পাচ্ছে, কীভাবে পাচ্ছে তা বলেননি। কেবল পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের চৌত্রিশ বছরব্যাপী রাজত্বের অবসান কেন হলো তার কারণগুলো বিশ্নেষণ করেছেন। আমার মতো একজন অতি সাধারণ মানুষের ধারণা, মার্কসবাদ বর্তমান বিশ্বে অবশ্যই প্রাসঙ্গিকতা ফিরে পাবে। তবে কিছু গ্রহণ ও বর্জনের পর।
    বিশ্বের প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণির বিপ্লবের ধারণাটি ত্যাগ করতে হবে। কারণ, বতর্মান বিশ্বে দরিদ্র শ্রেণি আছে। সর্বহারা শ্রেণি বলতে কিছু নেই। গ্লোবাল ধনতন্ত্রের বিকাশে এই সর্বহারা শ্রেণিটির বিনাশ ঘটেছে। বলা চলে, আধুনিক প্রযুক্তির বিস্ময়কর বিকাশে বিশ্বে এই পরিবর্তন ঘটেছে।
    মার্কস পৃথিবীকে দু’ভাগে ভাগ করেছিলেন। হ্যাভস এবং হ্যাভ নটস এই দুই শ্রেণিতে। উৎপাদন শক্তির ওপর শ্রমিক শ্রেণির আধিপত্য বিস্তারের জন্য সশস্ত্র শ্রেণি সংগ্রামের বিধান দিয়েছিলেন। বর্তমানে সর্বহারা (হ্যাভ নটস) শ্রেণি বলে কিছু নেই। সুদূর আফ্রিকাতেও নয়। এখন শ্রেণিচরিত্র বহু জটিল ভাগে বিভক্ত। যন্ত্রশক্তির বদলে নতুন প্রযুক্তিশক্তির আবির্ভাবে হোয়াইট কলার এডুকেটেড শ্রমিক শ্রেণির আবির্ভাব ঘটেছে। তারা মালিক পক্ষ না হয়ে মালিক পক্ষের অনেক সুখ-সুবিধার দাবিদার। ব্রিটেনের ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা এখন ট্রেড-ব্যারন নামে খ্যাত। ব্রিটেনের একজন ধনী লর্ডের মতো তাদের আধিপত্য। তারা শ্রেণি সংগ্রামের কথা কখনও ভাবেন না।
    মার্কস তার জীবদ্দশায় অণুশক্তির কথা ভাবতেও পারেননি। বিশ্বের আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর হাতে এই আণবিক শক্তি। চীন যখন রাশিয়াকে এক সময়ে আমেরিকা আক্রমণ করার জন্য উস্কাচ্ছিল, তখন বলেছিল আমেরিকা হচ্ছে কাগজের বাঘ। রাশিয়ার ক্রুশ্চেভ জবাবে বলেছিলেন, ‘এই কাগজের বাঘের আণবিক দাঁত আছে।’ মার্কস যদি আজ বেঁচে থাকতেন, তাহলে তার সর্বহারা বিপ্লব ও সশস্ত্র শ্রেণি সংগ্রামের থিওরি পাল্টাতেন। মার্কসবাদকে পরিবর্তিত বিশ্বের প্রেক্ষাপটে পরিবর্তন করতেন ও পাল্টাতেন। এ কাজটা তার শিষ্যরা কেন করতে পারছেন না সেটাই বিস্ময়কর। মার্কসবাদ একটা বিজ্ঞান। মার্কসবাদ কোনো ধর্মমত নয় যে, এর পরিবর্তন ঘটানো যাবে না।
    এবার রাশেদ খান মেননের কথায় আসি। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে মওলানা ভাসানীর অবদান অসামান্য বলে মনে করি। তার দলের প্রায় সব নেতাই যেমন মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়া, আনোয়ার জাহিদ, মির্জা গোলাম হাফিজ প্রমুখ ছিলেন ঘোর চীনপন্থি আর তখন চীন ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী এবং পাকিস্তানের গণহত্যায় সাহায্যদাতা। এ সময় রাশেদ খান মেনন, তার বন্ধু কাজী জাফর ছিলেন চীনপন্থি নামে খ্যাত। বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বেরও বিরোধী ছিলেন। মেননরা তখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব মেনে নেননি। জয় বাংলা স্লোগানে কণ্ঠ মেলাননি। মুক্তিযুদ্ধের আগে সেই স্লোগান দেননি, পরেও দেননি। তাদের চরিত্রের পরিবর্তন হয়েছে মূলত হাসিনার মন্ত্রিসভায় যুক্ত হওয়ার পর। তখন দেশে বাম দলগুলোর শক্তি ও প্রভাব প্রায় নিঃশেষ। আওয়ামী লীগের টিকিটে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়ে ও মন্ত্রী পদ পেয়ে অনেক বাম নেতা আওয়ামী লীগ কর্তৃক ব্যবহৃত হয়েছেন। মন্ত্রী হয়েও মন্ত্রিত্বের ক্ষমতা পাননি।
    আগের কথায় ফিরে যাই। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগেই মওলানা ভাসানী বুঝতে পেরেছিলেন তিনি তার দলের নেতাদের হাতে বন্দি হয়েছেন। যাদু মিয়া জুলফিকার আলি ভুট্টোর ‘এক গ্লাসের বন্ধু’ বলে পরিচিত ছিলেন। তাদের চাপে মওলানা ভাসানী জেনারেল আইয়ুবের সঙ্গে বৈঠকের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে যান। সেখানে ভাসানী-আইয়ুব গোপন চুক্তি হয়। চীনপন্থি কমিউনিস্ট রাজবন্দিদের এই শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়- তারা জেল থেকে বেরিয়ে শেখ মুজিবের ছয় দফার বিরোধিতা করবেন। সে কাজটি তারা করেছিলেন। এই বাম মহল তখন জোরেশোরে প্রচারও করেছিল ‘মার্কিন সিআইএ এই ছয় দফার প্রণেতা।’ মণি সিংহসহ কমিউনিস্ট পার্টির নেতারাও প্রথম দিকে এই মিথ্যা প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন। পরে তারা মত পরিবর্তন করেন এবং শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিতে শুরু করেন।
    মাওলানা ভাসানীও শেখ মুজিব ও তার আন্দোলনকে সমর্থন দিতে থাকেন। এমনকি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবকে মুক্ত করার আন্দোলনেও নেতৃত্ব দেন। আমার ধারণা মওলানা ভাসানী সচেতনভাবেই তা করেছিলেন। পরে ‘৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরু হওয়ার প্রারম্ভেই তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতের আসাম রাজ্যে আশ্রয় নেন। তিনিই ভারতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম শরণার্থী। আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মওলানা ভাসানীকে এজন্যই বিশেষভাবে সম্মান জানানো উচিত ছিল। প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠনের সময় মওলানা ভাসানী তার প্রভাব বিস্তার না করলে এই সরকার গঠিত হতো না। মেনন মুক্তিযুদ্ধে বামদের অবদান যথাযথভাবে স্বীকৃত হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু এই সংগ্রামে বামদের ভূমিকা কী ছিল? চীনপন্থি বামেরা এটিকে জাতীয় মুক্তির বিপ্লব বলে স্বীকার করেননি। শেখ মুজিবের নেতৃত্বও স্বীকার করেননি। জয় বাংলা স্লোগান তারা ভুলেও দেননি। জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দেওয়ার বদলে তার স্লোগান দিয়েছেন ‘সংগ্রাম সংগ্রাম জ্যোতি বসুর অপর নাম’।
    এ গেল চীনপন্থি বাংলাদেশের বামপন্থিদের কথা। রুশপন্থি বামেরা কী করেছেন? মুক্তিযুদ্ধে তারা গোড়া থেকেই ছিলেন কিন্তু দরকষাকষি করেছেন। তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার গঠনের সময় সিপিবি নেতারা শর্ত দিয়েছিলেন, মন্ত্রিসভায় তাদের দু-একজন নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করা না হলে তারা এই সরকারের নেতৃত্বে কাজ করবেন না। মওলানা ভাসানীর ভেটোদানের ফলে সিপিবির এই দাবি নাকচ হয়ে যায়। মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, জনগণ যেহেতু আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে, তখন সরকার গঠনের একক দায়িত্ব আওয়ামী লীগের। অনির্বাচিত কোনো দলের সদস্যদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। তাহলে ছোট-বড় আরও অনেক দল একই দাবি জানাবে।
    বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে মওলানা ভাসানীর অবদান এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। মওলানাকে নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার আরেকটি পরিকল্পনা ছিল। শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করে বিদেশের মাটিতে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর এই সরকারের বৈধতার দাবি নস্যাৎ করার জন্য পাকিস্তানের হানাদাররা তাদের অধিকৃত পূর্ব পাকিস্তানের কোনো একটি এলাকা থেকে সরে এসে জায়গাটিকে ‘মুক্ত এলাকা’ করার পরিকল্পনা করেছিল। সেখানে মুজিবনগর সরকারের পাল্টা সরকার গঠন করা হবে। তার নাম হবে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার। মওলানা ভাসানী হবেন ওই সরকারের রাষ্ট্রপতি। চীনপন্থি বাম নেতারা হবেন তার মন্ত্রিসভার সদস্য। চীন সঙ্গে সঙ্গে এই সরকারকে স্বীকৃতি দেবে। শুরু হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে চীন ও ভারতের রশি টানাটানি। মাঝখান থেকে বাংলাদেশে পাকিস্তানের শাসন অবসানের কোনো সুযোগই থাকবে না। এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির জন্য। তিনি দেশে পাকিস্তানের হানাদারদের গণহত্যা শুরু হবে- এই আঁচ পেয়ে আগেই ভারতে চলে যান। হানাদাররা তাকে হাতে না পেয়ে তার সন্তোষের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।
    মওলানা ভাসানী ভারত চলে যাওয়ার পরেও স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার গঠনে তাকে রাজি করানোর জন্য যাদু মিয়া কলকাতায় যান মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক সেজে। মওলানার সঙ্গে দেখা করার জন্য শিয়ালদহের এক হোটেলে অবস্থান করতে থাকেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা তার খোঁজ পেয়ে তাকে ধরার আগেই তিনি কলকাতা থেকে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসেন। ভারতের পুলিশ শিয়ালদহে হোটেল সার্চ করে যাদু মিয়ার ফেলে যাওয়া যেসব কাগজপত্র পায়, তারই ভিত্তিতে মওলানা ভাসানীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ভাসানী ন্যাপের একদল নেতার এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারে। মওলানা ভাসানী এই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিতে রাজি হননি। তিনি প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ প্রধানের পদ গ্রহণ করেন।
    বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মওলানা ভাসানী দেশে ফিরেই আবার যাদু মিয়া চক্রের হাতে বন্দি হন এবং সন্তোষ থেকে ‘হক-কথা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করে তাতে প্রচ- ভারতবিদ্বেষ প্রচার দ্বারা নবলব্ধ স্বাধীনতার ভিত্তিমূলেই আঘাত হানতে শুরু করেন। চীনপন্থি বামেরা নানাভাবে মুজিব সরকারের বিরোধিতা আরম্ভ করেন। কোনো কোনো স্থানে তারা স্লোগান দেন ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’। মওলানা ভাসানীকে অনশন ভাঙার জন্য অনুরোধ জানাতে গেলে মেননের বন্ধু কাজী জাফর বঙ্গবন্ধুকে প্রকাশ্যে অবমাননা করার চেষ্টা করেন।
    মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থিদের অবশ্যই অবদান ছিল। চীনপন্থি বামদেরও ছিল। কিন্তু ছিল বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রবিশেষ মূলধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সিপিবি মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দেখা গেল এই দলও ঘাতক জিয়াউর রহমানের মৈত্রী অর্জনের জন্য ব্যস্ত।
    দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ছিল, নিজেদের তাত্ত্বিক বিবাদ দূরে রেখে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক সোনার বাংলা গঠনের কাজে সাহায্য করা। প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে মাথা তুলতে না দেওয়া। সেখানে তারা নানা তাত্ত্বিক বিতর্ক তুলে জাতীয় নেতাদের ক্রমাগত বিরোধিতা করেছেন এবং তাদের কেউ শ্রেণি-সংগ্রাম, কেউ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধুয়া তুলে বঙ্গবন্ধুর জাতীয় নেতৃত্বকে ক্রমাগত আঘাত করেছেন এবং বাংলাদেশে প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে ক্ষমতা দখলে সাহায্য জুগিয়েছেন। বামদের সব চাইতে বড় ভুল, জামায়াত-হেফাজতের হুমকির মুখেও বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ রক্ষায় তারা এগিয়ে আসেননি। বরং আওয়ামী লীগকে ক্রমাগত প্রতিক্রিয়াশীলদের শিবিরে ঠেলে দিয়েছেন। হেফাজতিরা তাতে লাভবান হয়েছে। বঙ্গবন্ধু একটি সমাজতন্ত্রঘেঁষা দল ও দেশ গঠন করতে চেয়েছিলেন। দেশের বাম রাজনৈতিক দলগুলোর বেশিরভাগ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং তার কন্যা শেখ হাসিনাকে সেই অবস্থান থেকে চরম পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে।
    পশ্চিমা পুঁজিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা দুই-ই সহোদর ভাই। পশ্চিমা পচনশীল পুঁজিবাদ বাংলাদেশেও ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মওলানা ভাসানী, তাজউদ্দীনসহ চার জাতীয় নেতা এবং মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মতো মুক্তি সংগ্রামের সামনের কাতারের নেতারাও যথোচিত সম্মান পাননি। তাদের মূল্যায়ন হয়নি। একটি আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জাতীয় নেতা ও বাম নেতৃত্বের এই স্বীকৃতি মেনন কি করে আশা করেন?
    অনেক হতাশার মধ্যে আমার আশান্বিত হওয়ার কারণ এই, রাশেদ খান মেননের মতো বাম নেতাদের ভুল ভাঙছে, চোখ খুলছে। তাদের সঙ্গে দেশে নবপ্রজন্মের নতুন নেতৃত্বের পদধ্বনি আমি শুনছি। আমি আর হতাশ নই। বাংলাদেশে হাওয়া বদল হবেই।

  • সিপাহী বিদ্রোহের ১৬৪ বছর: ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ

    সিপাহী বিদ্রোহের ১৬৪ বছর: ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ


    সৈয়দ আমিরুজ্জামান

    ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য সিপাহী বিদ্রোহের ১৬৪ বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল ১০ মে।
    ফরাসী, পর্তুগিজদের সাথে ইংরেজরাও ভারতবর্ষে চলে আসে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে। প্রথমে ব্যবসা উদ্দেশ্য থাকলেও সময় পরিক্রমায় নানা চক্রান্ত ও কূটকৌশলের মাধ্যমে তাঁরা ভারতের নিয়ন্ত্রণ নিতে সচেষ্ট হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত করার মাধ্যমে এ দেশে তাদের ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মির কাসিমের পরাজয়ের পরে সমগ্র ভারতবর্ষ চলে যায় তাদের নিয়ন্ত্রণে। পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি যে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হাতে পায়, তা কাজে লাগিয়ে সারা ভারতবর্ষে শোষণ ও নির্যাতন চালাতে থাকে।
    বাংলার স্বাধীনচেতা জনগণ কখনো পরাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। এ কারনে ১৯ শতকের মাঝ পর্যন্ত ছোট বড় বহু আন্দোলন, আক্রমণ, যুদ্ধ, বিদ্রোহ বা অভ্যূত্থানের মধ্যে দিয়ে বিদ্রোহের ধারা অব্যাহত থেকেছে। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার যুদ্ধ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। ১৮৩১ সালে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় তিতুমীর মারা যান।

    ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ ওঠে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সর্বাগ্রে চলে আসে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের কথা। অনেকেই এটাকে বলেছেন ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ,মহাবিদ্রোহ, আবার কারো কাছে এটি ছিল গণ অভ্যুত্থান। ইংরজে শাসনামলে ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল সিপাহী বিদ্রোহ। ১৮৫৭ সালে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ ছিল এটি। এই বিদ্রোহের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা।
    সিপাহী বিদ্রোহের শুরু
    ১৮৫৭ সালের ১০ মে মিরাট শহরে শুরু হওয়া ইংরেজ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সিপাহীদের সাথে যে যুদ্ধে সংঘটিত হয় তাই সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সালে উত্তর ও মধ্য ভারতে যে বিরাট গণ-বিদ্রোহ সংঘটিত হয় তা ব্রিটিশ শাসনকে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কোম্পানির সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়ে তা ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
    বাংলায় শুরু হয়ে ইংরেজ অধিকৃত ভারতের অন্যান্য এলাকার সিপাহীদের মধ্যেও এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম বাংলার ব্যারাকপুরে সিপাহী ‘মঙ্গল পা-ের’ নেতৃত্বে প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয়। প্রায় এক বছর ধরে অগণিত কৃষক, শিল্পী, সৈন্য ও অন্যান্য জনগোষ্ঠী বীরত্বের সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যায়। তাদের সাহসিকতা ও আত্মবিসর্জন ভারতবাসীর ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
    ইংরেজরা এই বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করে। নিরপরাধ বহুজনকে এ সময় নির্বিচারে ফাঁসি দেওয়া হয়। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে সে সময় বাংলার বিদ্রোহী সিপাহীদের ফাঁসি দেওয়া হয়। বিদ্রোহীরা পরাজিত হলেও এই বিদ্রোহের ফলেই কোম্পানির শাসনের অবসান হয়। শুরু হয় ব্রিটিশরাজ তথা রানী ভিক্টোরিয়ার শাসন।
    ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন
    ২৯ শে মার্চ, ১৮৫৭ রবিবার বিকাল বেলা। ব্রিটিশদের জন্যে দিনটি ছিল ছুটির দিন। তারা বিশ্রাম নিচ্ছিল যার যার গৃহে। ব্যারাকপুরের প্যারেড ময়দানে অসময়ে মানুষদের ভিড় বাড়ছিল। ধীরে ধীরে প্যারেড গ্রাউন্ডে জড়ো হতে থাকে বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের সদস্যরা।পঞ্চম ব্যাটালিয়ন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য মঙ্গল পা-ে ঘুরছিলেন ব্যারাকপুর প্যারেড গ্রাউন্ডের আশেপাশেই। চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল চারদিকে, কী হচ্ছে তা তখনো কেউ জানে না, তবে এটুকু জানে যে কিছু একটা ঘটছে। সিপাহীদের মধ্যে কেউ আসছে খালি হাতে, কেউ বন্দুক নিয়ে। সৈনিকদের ভিড় ক্রমেই বাড়ছিল। কেউ জানেনা কি ঘটতে চলেছে তবে এটুকু জানে যে রচিত হবে এক মহান ইতিহাস।

    কেউ একজন এগিয়ে এসে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিবে, সবাই এই অপেক্ষা করছে। ফলাফল যদি আশানুরূপ না হয় তাহলে পরিনাম ভয়াবহ হবে, এ কারনে কেউ এগিয়ে আসার সাহস করতে পারছে না !
    এক সময় হুট করে সকল ভয় ভীতি আর জড়তা ভেঙ্গে এগিয়ে আসে মঙ্গল পান্ডে। মঙ্গল পা-ে সমস্ত সৈনিকদের প্যারেড গ্রাউন্ডে ডাকেন ও সেখান থেকে বিদ্রোহের ডাক দেন, সকলকে দেশ স্বাধীন করার আহ্বান জানালেন। লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে মঙ্গল পান্ডে বন্ধুক হাতে টহল দিচ্ছে। পান্ডের দিকে সবাই শুধু গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। সবাই কানাঘুসা করছে । নতুন এক রুপ নিয়ে সবার সামনে মঙ্গল পান্ডে, আরে চিরচেনা মঙ্গল পান্ডের আজ কি হয়েছে !হঠাৎ তীব্র চিৎকার,
    “বেরিয়ে এসো ভাইসব। ফিরিঙ্গির পায়ের তলায় আর কত দিন থাকবে! ওরা আমাদের সোনার দেশ, গর্বের মাতৃভূমি লুটেপুটে যাচ্ছে। আর আমরা মরছি অনাহারে। ওরা আমাদের বেঁচে থাকার অস্তিত্বে হাত দিয়েছে। আমাদের করেছে জাতিভ্রষ্ট। ভাইসব এসব ফিরিঙ্গিদের মারো। “
    তার বক্তব্যের মাধ্যমে উৎসাহ দিতে লাগলেন বাকি সিপাহীদের। এরই মধ্যে সেনানিবাসের দখল মঙ্গল পা-ের হাতে। হট্টগোল দেখে ঘোড়ায় চড়ে ইংরেজ অ্যাডজুটেন্ট লেফটেন্যান্ট বার্গ স্বয়ং ঘটনাস্থলে চলে আসেন। মঙ্গল পান্ডে অ্যাডজুটেন্টকে দেখেও সোজা তার দিকে বন্ধুকের নল তাক করে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় বার্গ তার ঘোড়াটি মঙ্গল পান্ডের উপর উঠিয়ে দেয়। কাছে আসতেই মঙ্গলপান্ডের রাইফেল গর্জে ওঠে। গুলী লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় । ঘোড়াটি মাঠে লুটিয়ে পড়ল।
    লেফটেন্যান্ট পা-েকে লক্ষ্য করে গুলি চালাল। কিন্তু ওই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। তরবারির আঘাতে মঙ্গলপান্ডে লেফটেন্যান্ট বার্গকে আহত করেন। পরবর্তীতে আরেক সার্জেন্ট পা-ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে পা-ে তাকেও তার ধারালো খড়গ দিয়ে ধরাশায়ী করে ফেলেন। তারপর আসল ইংরেজদের দালাল পল্টু । মঙ্গল পা-েকে পেছন থেকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কিন্ত শেষ রক্ষা হল না পল্টুর। পান্ডের তলোয়ারের কাছে ধরাশায়ী। নিজেকে মুক্ত করল পা-ে। এরই মধ্যে সিপাহীদের মধ্যে জয়ধ্বনি শোনা যায়। সৈন্যরা উল্লাসে ফেটে পড়ে ।
    এদিকে ব্রিটিশ সেনাপতি হিয়ার্সে ততক্ষণে দলবল নিয়ে হামলা করে ব্যারাকপুর সেনানিবাসে। অন্য ইংরেজ কর্মচারীরা এ সময় তাকে ঘিরে ফেললে ব্রিটিশদের হাতে জীবন না দিয়ে আত্মমর্যাদার সাথে আত্মাহুতি দেবার চেষ্টা করেন মঙ্গল পা-ে। নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে। বিধিবাম গুলি যায় ফসকে আহত হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। আহত মঙ্গলপান্ডেকে বন্দী করতে অনীহা প্রকাশ করায় ঈশ্বরী পান্ডেকেও আটক করা হয়। মুমূর্ষ পান্ডেকে ব্রিটিশ সরকার হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।

    আহত মুমূর্ষু মঙ্গল পান্ডেকে ব্যারাকপুর ময়দানের সব সৈনিকদের সামনে একটা অশ্বথ গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসির মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করে ব্রিটিশ বেনিয়াদিরা। একই সাথে ঈশ্বর পা-েকেও ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। কারণ তিনি মঙ্গল পা-েকে গ্রেফতার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। সামরিক আদালতের রায়ে ১৮ এপ্রিল মৃত্যুদ- কার্যকরের নির্দেশ দেওয়া থাকলেও নির্ধারিত সময়ের ১০ দিন আগে তাকে হত্যা করা হয়। সমগ্র ভারতে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে এই খবর।
    মঙ্গল পা-ের এই বীরত্বপূর্ণ কর্মকে স্মরণ করে ভারতে ২০০৫ সালে একটি সিনেমা নির্মাণ করা হয়।। ‘মঙ্গল পা-ে: দ্য রাইজিং’ নামক সিনেমাটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক আমির খান।
    ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের একশ বছরে ভারতের জনগণের মধ্যে বৃটিশ বিরোধী ক্ষোভ জমা হতে থাকে। সেই ক্ষোভ কোম্পানীর সেনাবাহিনীর ভারতীয় সদস্যদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহের প্রস্তুতিও চলছিল। মঙ্গল পান্ডের বিদ্রোহের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। মূল বিদ্রোহ শুরু হয় মিরাটে, ১০ মে ১৮৫৭ সালে। এ দিন সিপাহীরা বিদ্রোহ করে সেনা ছাউনি থেকে বেরিয়ে যায় এবং শত্রুদের হত্যা করে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করে। ১১ মে মিরাট থেকে তিনশ’ বিদ্রোহী সিপাই দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করে এবং দিল্লী এসে তারা ৪৯ বৃটিশ নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। দিল্লী দখল করে তারা মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে সমগ্র ভারতবর্ষের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে। সম্রাটকে তারা এ বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ জানালে শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হন। তবে কয়েক মাসের মধ্যে সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। ১৮৫৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ইংরেজরা আবার দিল্লী দখল করে নেয়।
    এরপর একে একে মথুরা, লক্ষ্ণৌ, ভরতপুর, কানপুর, এলাহাবাদ, ঝাঁসি, ইন্দোরসহ পুরো ভারতেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এই সব অঞ্চলে বিদ্রোহীদের দমন করতে কোম্পানিকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। বিদ্রোহ শুরুর আগে যদিও ব্রিটিশ বিভিন্ন প্রশাসক ও সেনা কর্মকর্তারা সিপাহী ও জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষের ইঙ্গিত দিয়েছিল, কিন্তু ঊর্ধ্বমহল একে ততটা পাত্তা দেয়নি।
    সারা বাংলাদেশে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। চট্টগ্রাম ও ঢাকার প্রতিরোধ এবং সিলেট, যশোর, রংপুর, পাবনা ও দিনাজপুরের খ-যুদ্ধগুলো বাংলাদেশকে সতর্ক ও উত্তেজনাকর করে তুলেছিল। ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের পদাতিক বাহিনী প্রকাশ্য বিদ্রোহে মেতে ওঠে এবং জেলখানা থেকে সব বন্দিকে মুক্তি দেয়। তারা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে নেয়, কোষাগার লুণ্ঠন করে এবং অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ত্রিপুরার দিকে অগ্রসর হয়।
    সিপাহীরা আশা করেছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে এ স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্রিপুরার রাজা তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু ইংরেজদের দালাল ত্রিপুরার রাজা সিপাহীদের সাহায্য করা তো দূরের কথা, বরং সিপাহীদের গতিরোধ করার জন্য সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করলো। সেখানে বাধা পেয়ে সংগ্রামী সিপাহীরা কুমিল্লার পাহাড়ি এলাকার দিকে ধাবিত হলেন। সেখানেও ত্রিপুরার রাজার সৈন্যবাহিনী সিপাহীদের ওপর হামলা চালালে সিপাহীরা মনিপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়। সে সময় ইংরেজ মেজর বাইজের নেতৃত্বে একটি পদাতিক বাহিনী মুক্তিপাগল সিপাহীদের ওপর আক্রমণ করে। সীমান্ত স্টেশন লাতুতে উভয়পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে ইংরেজ মেজর বাইজ নিহত হলেও বিদ্রোহী সিপাহীরা পরাজিত হয়। পরে তারা জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করে। এরপর তাদের আর কখনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
    চট্টগ্রামে সিপাহীদের মনোভাব ঢাকার রক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। ১৯ নভেম্বর চট্টগ্রামে হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে যে সিপাহী বিপ্লব সংঘটিত হয় তার সংবাদ গোয়েন্দা মারফত ঢাকায় পৌঁছে ২১ নভেম্বরের দিকে। সিপাহিদের আরো অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ ৫৪তম রেজিমেন্টের তিনটি কম্পানি এবং ১০০ নৌসেনা ঢাকায় প্রেরণ করে। একই সঙ্গে যশোর, রংপুর, দিনাজপুরসহ বাংলাদেশের আরো কয়েকটি জেলায় একটি নৌ-ব্রিগেড পাঠানো হয়। প্রধানত ইউরোপীয় বাসিন্দাদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবীদের সংগঠিত করে ঢাকা রক্ষা করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নৌ-বিগ্রেড ঢাকা পৌঁছে সেখানে নিয়োজিত সিপাহিদের নিরস্ত্র করতে গেলে অবস্থা চরমে ওঠে।

    ১৮৫৭ সালের ২২ নভেম্বর ছিল পবিত্র আশুরার দিন অর্থাৎ ১০ মহররম। ওই দিন ইংরেজদের দ্বারা সিপাহীরা আক্রান্ত হয়। মুসলমান সিপাহীরা রোজা রাখার উদ্দেশ্যে সেহরি খেয়ে নিন্দ্রামগ্ন ছিল। মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছিল, কুয়াশাচ্ছন্ন প্রত্যুষে কিছু ইংরেজ স্বেচ্ছাসেবক ও শতাধিক নৌ সেনা আন্টাঘড় ময়দানে উপস্থিত হয়ে দ্রুতগতিতে বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থিত তৎকালীন ট্রেজারির সিপাহীদের আটক করে এবং সেখান থেকে ইংরেজ সৈন্যরা ক্ষিপ্রগতিতে লালবাগ কেল্লায় উপস্থিত হয়ে অপর দলের সাথে মিলিত হয়।
    কেল্লার দক্ষিণ-পশ্চিমে ভাঙা প্রাচীরের কাছ দিয়ে ইংরেজ সৈন্যরা সিপাহীদের ওপর নির্মম আক্রমণ চালায়। এ আকস্মিক আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি সিপাহীদের ছিল না। সংঘটিত খ-যুদ্ধে বেশ কিছু সিপাহি নিহত ও বন্দি হয় এবং অনেকেই পালিয়ে যায়। ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। অনেকে আত্মরক্ষার জন্য কেল্লার ২০ ফুট উচু দেয়াল থেকে লাফিয়ে পালাবার সময় ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েন। অনেকের নদীতে সলিল সমাধি হয়। বেশির ভাগ পলাতক সিপাহিই গ্রেপ্তার হয় এবং দ্রুত গঠিত সামরিক আদালতে সংক্ষিপ্ত বিচারের জন্য তাদের সোপর্দ করা হয়। অভিযুক্ত সিপাহিদের মধ্যে ১১ জন মৃত্যুদ- এবং বাকিরা যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত হয়।

    বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে সিলেট, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর এবং যশোরে চাপা ও প্রকাশ্য উত্তেজনা বিরাজমান ছিল। পলাতক সিপাহি ও ইউরোপীয় সৈন্যদের মধ্যে সিলেট এবং অপরাপর স্থানে কয়েকটি সংঘর্ষ ঘটে, যার ফলে উভয় পক্ষেই প্রাণহানি ঘটে। সিলেট এবং যশোরে বন্দি ও নিরস্ত্র সিপাহীদের স্থানীয় বিচারকদের দ্বারা সংক্ষিপ্ত বিচার করা হয়। ফাঁসি ও নির্বাসন ছিল এ সংক্ষিপ্ত বিচারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
    ১৮৫৮ সালের ২০শে জুন গোয়ালিয়রে বিদ্রোহীদের পরাজয়ের পরই একমাত্র বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়। সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, মহাবিদ্রোহ, ভারতীয় বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ এবং ১৮৫৮ সালের গণ অভ্যুত্থান নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
    সিপাহী বিদ্রোহ কেন হয়েছিল ?
    খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রকাশ্যে ধর্মপ্রচার, হিন্দু-মুসলিমদের জোড় করে খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা, মসজিদ ও মন্দিরের জমির উপর কর আরোপ এসব মিলিয়ে জনগণ বিক্ষুদ্ধ হতে থাকে। এরূপ নানা কারনে ১৮৫৭ সালের বহু আগে থেকেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সামরিক কারণে সিপাহীদের ক্ষোভ জমা হচ্ছিল।

    সামরিক বৈষম্য সিপাহী বিপ্লবের উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল। ইংরেজ সামরিক অফিসার ও সিপাহীদের তুলনায় দেশীয় সিপাহী ও অফিসারদের বেতন ছিল কম। তাছাড়া ইংরেজ সামরিক অফিসাররা দেশীয় সামরিক অফিসারও সিপাহীদের খুব বিশ্রি ভাষায় গালিগালাজ করত। বৃটিশ সরকার ৩ লাখ ১৫ হাজার ৫০০ জন ভারতীয় সৈন্যের জন্য বার্ষিক ৯৮ লাখ পাউন্ড ব্যয় করতো এবং অন্যদিকে ৫১ হাজার ৩১৬ ইংরেজ সৈনিকের জন্য ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পাউন্ড ব্যয় করতো। যা ছিল ভারতীয় সিপাহীদের জন্য চরম বৈষম্য।
    সেনাবিভাগে ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে বেতন, পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ ভারতের সৈন্যদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয় । সিন্ধু ও আফগানিস্তানে নিযুক্ত সেনাদলকে বিশেষ ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ভারতীয় সেনাদের তা থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাঁদের ধর্ম বিশ্বাসকে মর্যাদা না দিয়ে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সামরিক কর্তৃপক্ষ তাঁদের যত্রতত্র বদলির ব্যবস্থা করেন । জাত ও ধর্ম হারাবার ভয়ে সিপাহীগণ কালাপানি পার হয়ে ব্রহ্মদেশ বা অন্যত্র যেতে অনাগ্রহী হয়।
    সিপাহিদের ক্ষোভ যখন ক্রমশ পূঞ্জীভূত হচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে এনফিল্ড রাইফেল (ঊহভরবষফ জরভষব) নামে এক নতুন ধরনের রাইফেলের প্রবর্তন তাদের ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় । এনফিল্ড রাইফেলে যে কার্তুজ (ঈধৎঃৎরফমব) ব্যবহার করা হত, তার খোলসটি দাঁতে কেটে রাইফেলে ভরতে হত । গুজব রটে যায় যে, এই কার্তুজে গরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানো আছে । ধর্মচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় কোম্পানির সেনাবাহিনীর হিন্দু ও মুসলমান সিপাহীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এই টোটা ব্যবহার করতে অস্বীকার করে ।
    এনফিল্ড রাইফেলকে প্রত্যক্ষ ধরা হলে, এটি কিন্ত মূল কারন নয়। কারন সরকার সিপাহীদের সামনে এই টুটা নষ্ট করা হলেও তাদের অসন্তোষ স্থিমিত হয় নি। কারন এই বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ প্রশানের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণ তথা সিপাহীদের তীব্র অসন্তোষ । পরবর্তীকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহীরা চর্বি মাখানো এই টোটাই ব্যবহার করেছিল । সিপাহী বিদ্রোহ একদিনে জন্ম নেয়নি বরং এটি ছিল বহুদিনের তিলে তিলে সঞ্চিত প্রস্তুতির ফল।
    শেষ কথা
    ১৮৫৭ সালে কলকাতার ব্যারাকপুরে মঙ্গল পান্ডের বিদ্রোহের দ্বারা শুরু হওয়া সিপাহী বিদ্রোহ পরবর্তিতে মহাবিদ্রোহে রূপ নেয়। ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহকে কঠোর হস্তে দমন করলেও এর মাধ্যমে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়। দীর্ঘ ১০০ বছর অত্যাচার, লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের পরে এ মহাবিদ্রোহ ছিল একটি জলোচ্ছ্বাসের মত। এটাকে অনেকে আবেগের সাথে পলাশীর প্রতিশোধও বলে থাকেন।
    প্রথমদিকে অনেকটা বিজয়ী হয়েও, শেষে পরাজয় বরণ করেছিলেন। পরাজয় সত্ত্বেও ভারতবর্ষের সিপাহী ও জনগণের এই যে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ তা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণা যুগিয়েছে। পাশাপাশি বৃটিশ শাসকদের নৃশংস বর্বরতার চিত্রও তুলে ধরেছে।

    লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

  • রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তা

    রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তা


    বীরেন মুখার্জী

    জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের ধর্ম-দর্শন নিয়ে আমাদের সমাজে নানান মত চালু আছে। এই পরিবার বংশানুক্রমিক উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী হয়েছিলেন। রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মধর্মের প্রবক্তা ছিলেন। ব্রাহ্মধর্ম মূলত ১৯০০ শতাব্দীর বাংলার একটি ধর্মীয় আন্দোলন। ব্রাহ্মধর্মের অনুগামীরা ‘ব্রাহ্ম’ নামে পরিচিত। ব্রাহ্মধর্ম হিন্দুধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হলেও রাজা রামমোহন একসময় হিন্দুধর্মের ভেতর থেকেই উক্ত ধর্মকে সংস্কার করতে উদ্যোগী হন। তবে তার উত্তরসূরি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সময় বেদের অভ্রান্ততা অস্বীকার করেন, ফলে এর মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজ মূলধারার হিন্দুধর্ম থেকে বেরিয়ে আসে বলে ধারণা করা হয়। যদিও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কিছু হিন্দু রীতিনীতি রক্ষা করেছিলেন। তৎকালীন সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায় অগ্রগামী এই পরিবারে জন্মগ্রহণ করা রবীন্দ্রনাথ, ঠাকুর পরিবারের ধর্মীয় বৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ করেছেন। নিজে ব্রাহ্ম হওয়া সত্ত্বেও সাহিত্যকর্মে হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছেন। তাহলে রবীন্দ্রনাথের ঈশ্বরচিন্তায় কোন বিশেষ ধর্ম-দর্শন ক্রিয়াশীল ছিল- এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে।
    অস্বীকারের সুযোগ নেই, যেকোনো সৃষ্টিকর্মের নেপথ্যে একটি বিশেষ ভাব, চিন্তা-দর্শন, মন-মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। স্রষ্টার মনের ভাব, চিন্তা-দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি তার সৃষ্টিকর্মে প্রতিফলিত হবে, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কেউ নাস্তিক হলে, তার সৃজনকর্মেও নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি বা নাস্তিক্য চিন্তাচেতনার প্রকাশ ঘটে। আস্তিকের সৃষ্টিকর্মেও স্বাভাবিকভাবেই আস্তিক্য ভাব-দর্শনের প্রতিফলন ঘটে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিপ্রাচুর্যে আস্তিক্যবাদী দর্শনের সন্ধান মেলে। রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। ধর্ম পালনে তার অনীহা না থাকলেও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সজ্ঞানে পরিহার করতেন। তবে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন যুক্তির অবতারণা করেছেন। রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠে এটি স্পষ্ট হয়, জীবনের একটি পর্যায়ে এসে তিনি অরূপের সাধনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘আধ্যাত্মিক সাধনা কখনোই রূপের সাধনা হইতে পারে না। তাহা সমস্ত রূপের ভিতর দিয়া চঞ্চল রূপের বন্ধন অতিক্রম করিয়া ধ্রুব সত্যের দিকে চলিতে চেষ্টা করে। ইন্দ্রিয়গোচর যে কোনো বস্তু আপনাকেই চরম বলিয়া স্বতন্ত্র বলিয়া ভান করিতেছে, সাধক তাহার সেই ভানের আবরণ ভেদ করিয়া পরম পদার্থকে দেখিতে চায়।’ (রূপ ও অরূপ)। আমরা দেখতে পাই, যিশুখ্রিষ্ট, গৌতম বুদ্ধ ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কেও নিয়েও নানান সময় লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।

    নিজের মৃত্যুর আগেই রবীন্দ্রনাথকে আপনজনদের লোকান্তরিত হওয়ার অভাবনীয় দৃশ্যগুলো অবলোকন করতে হয়েছে। যে কারণে মৃত্যুচিন্তাও তার পরমার্থ সাধনার একটি অন্যতম বিষয় হয়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা কখনো মর্ত্যচেতনা, আত্মচেতনা, কখনো ব্যঙ্গ কৌতুক, আবার কখনো প্রেম ও সৌন্দর্য চেতনার সঙ্গে বিশ্বচেতনায় সমকালসংলগ্ন হয়ে উঠেছে। উপনিষদের ঋষিসুলভ প্রত্যয়ও তার কবিতায় উচ্চকিত হয়েছে। সুফিবাদের ধারা, কবির ও রামপ্রসাদ সেনের আলিঙ্গন তাকে ঋদ্ধ করেছে। বাংলার বাউল-ফকিরদের দ্বারাও সমৃদ্ধ হয়েছেন তিনি। বাউলের ‘মনের মানুষে’র মতোই তিনি ‘জীবনদেবতা’ সৃষ্টি করেছেন। খেয়া-গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতালি কাব্য এবং অন্যান্য রচনায়ও অধ্যাত্মচেতনা প্রকাশিত হয়েছে। কবির অধ্যাত্মসাধনা নিঃসন্দেহে সর্বজনীনচেতনা দ্বারা পরিশুদ্ধ। তার বিশ্বাসগুলো পৃথিবীর মানুষের জন্য কতটুকু জরুরি? তার আধ্যাত্মিকতায় মানবতার জন্য যে কাতরতা, তা সর্বযুগের সর্ব মানুষের হয়ে উঠেছে কি? এসব প্রশ্নের উত্তর অন্বেষণ করলে কবির আধ্যাত্মিক চেতনার সর্বজনীন রূপ আবিষ্কার করা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম ভাবের গভীরতা, ভাষার মাধুর্য এবং বিষয় বিন্যাসের চমৎকারিত্বে আমাদের চিন্তাকে পৌঁছে দেয় এমন এক স্তরে যেখানে আমাদের চেনা অনুভূতিগুলো আমাদের ভেতর এক অসাধারণ বিশ্বের সন্ধান দেয়। কবির রচনাকর্ম নানান নাটকীয়তা, রহস্যময় মহাজাগতিক আবহের মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে স্র্রষ্টার সান্নিধ্য লাভের অভিপ্রায়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
    ঈশ্বরচিন্তা বলতে সেই বাস্তবতাকে বোঝানো হয়, যা আমাদের প্রতিদিনের স্থূলতা থেকে অনেক দূরের। এটি হচ্ছে সেই গহিন পথ, যার দ্বারা একজন ব্যক্তির বেঁচে থাকা কিংবা তার অস্তিত্ব আবিষ্কারের প্রচেষ্টা স্পষ্ট হয়। ধ্যান, প্রার্থনা, প্রত্যাশা দিয়ে একজনের অন্তরজীবনের উন্নতি হতে পারে। আধ্যাত্মিকতার বাস্তবতা হতে পারে ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগ এবং এই সংযোগ ব্যক্তি থেকে প্রসারিত হতে পারে মানবসমাজ, প্রকৃতি, বিশ্বলোক ও ঈশ্বরের সিংহাসন পর্যন্ত। জীবনে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণাও হতে পারে পরমার্থ সাধনা। যে বিশ্বাস ধারণ করে ঈশ্বর সম্পর্কে অন্তর্নিহিত ভাবনা কিংবা বিশ্বের সীমানা ছাড়িয়ে অসীমের জন্য কাতরতা, তারই নাম কি আধ্যাত্মিকতা? বিশ্লেষকদের মতে, প্রচলিত ধারণায় আধ্যাত্মিকতা বা পরমার্থ সাধনাকে ধর্মীয় জীবনেরই অংশ বলা হয়। আর আধ্যাত্মিকতা বিশ্লেষণে গুরুত্ব পায় মানবতাবাদ, প্রেম, সমবেদনা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, পরিতৃপ্তি, দায়িত্ব, সংগতি, অপরের সুবিধা-অসুবিধার প্রতি দৃষ্টি রাখা প্রভৃতি। রবীন্দ্রসাহিত্যে এসব বৈশিষ্ট্যের সম্মিলন লক্ষ করা যায় গভীরভাবে।
    বলাই বাহুল্য, আস্তিক্যবাদী দর্শন মানে প্রতিদিনের কাজের সঙ্গে প্রার্থনা ও ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বরকে স্মরণ করা। আবার মৃত্যুর পরে কী কী ঘটবে, এসব চিন্তাও অধ্যাত্ম চেতনারও অংশ। আধ্যাত্মিক জীবনের পথ বিচিত্র। ঈশ্বরের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য নিজেকে তৈরি করা, নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি জগতের সঙ্গে মিলতে চাওয়ার জন্য সুশৃঙ্খলভাবে ধ্যান, প্রার্থনা, নৈতিকতার উন্নতি সাধন ইত্যাদি। আধ্যাত্মিকতার লক্ষ্য হচ্ছে ভেতরের জীবন ও বাইরের জীবনের উন্নতি। প্রেম ও করুণা ধারায় সিক্ত হলে আধ্যাত্মিক জীবনের উন্নতি ঘটে। আধ্যাত্মিকতা মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও জড়িত। আধ্যাত্মিকতাকে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেছেন ‘পবিত্রতার স্মারক’। পূজা ও নৈবেদ্যের মধ্যে সেই স্মারক লুকিয়ে থাকতে পারে। মানুষে মানুষে মৈত্রী, সাম্য, ঐক্য ও পারস্পরিক বিশ্বাস এই চেতনার প্রধান দিক। রবীন্দ্রসাহিত্যে এই চিন্তার উপস্থিতি থাকলেও অধ্যাত্ম্য বা ধর্মীয় চেতনার আড়ালে-আবডালে রবীন্দ্রনাথ কখনোই সন্ন্যাসী কিংবা সাধক ছিলেন না। বিশেষ কোনো ধারার অধ্যাত্মসাধনায়ও নিজেকে নিমগ্ন করেননি। তিনি ছিলেন কবি। নিজের চেতনার অধ্যাত্ম-অনুভূতিগুলো শিল্পচেতনার মধ্য দিয়ে কাব্যরূপে প্রকাশিত করেছেন। বলা যায়, উপনিষদের ধর্মীয় আরাধনার পথ বেয়ে তিনি মানুষের ধর্মে উপনীত হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আধ্যাত্মিকতায় আমাদের আর কিছু দেয় না, আমাদের ঔদাসীন্য আমাদের অসাড়তা ঘুচিয়ে দেয়। অর্থাৎ তখনই আমরা চেতনার দ্বারা চেতনাকে, আত্মার দ্বারা আত্মাকে পাই। সেই রকম করে যখন পাই তখন আর আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে সমস্তই তার আনন্দরূপ।’ রবীন্দ্রনাথ আস্তিক ছিলেন বলেই বিশ্বাস করতেন ‘আধ্যাত্মিকতা’ মানুষের চেতনাকে ঈশ্বরের সঙ্গে সংযুক্ত করে। যার মাধ্যমে স্রষ্টার আনন্দরূপই প্রত্যক্ষ করা য়ায়। জীবনব্যাপী এ সত্যই তিনি বহন করেছেন।

  • চির নূতনেরে দিলো ডাক, পঁচিশে বৈশাখ

    চির নূতনেরে দিলো ডাক, পঁচিশে বৈশাখ


    সুপান্থ মল্লিক

    স্রষ্টামাত্রেরই সংশয়, সৃষ্টি বাঁচবে তো! নশ্বর জীবদেহ বিলীন হয়ে যাবে। মুছে যাবে বেঁচে থাকার যাবতীয় বাহ্যিক অহংকার। সাধারণ মানুষের এই পরিণতি। এই নিয়ে কারোর অভিযোগ থাকে না কিছু, কিন্তু সৃজনশীল মানুষের ভিন্নতর এক অন্বেষণ থাকে, থাকে অমরত্বের আত্মগত এক স্পৃহা। আমি বা আমার নাম রূপের লয় হোক, ক্ষতি নেই! কিন্তু আমার সৃষ্টি যেন নিশ্চিহ্ন না হয়ে যায়। মহাকালের অসম্ভাব্য পরিবর্তনে তাঁর সার্বজনীন সৃষ্টি যেন সবকিছুই নিঃশেষে না বিদায় করে দেয়! অনন্ত মানবস্মৃতিতে যেন চিরলগ্ন থাকতে পারে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মতো বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মহান স্রষ্টারও সংশয় ছিল ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে, কোন সে পাঠক?’ যিনি তন্ময় হয়ে থাকবেন কবির সৃষ্টিতে। সোচ্চার কোনো দাবি নয় কবিসুলভ স্মিত এক প্রার্থনা নিজেরই সৃষ্টির কাছে, তবুও মনে রেখো―‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে… তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে।’ কিন্তু আমার সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক বিস্ময়ে যেন এই উক্তি―‘তুমি কেমন করে গান করো, হে গুণী!’ ক্ষণকাল থেকে চিরকালের উত্তরণের গুণ যেন আমার থাকে। এই আমার সাধনা, বিচারক আমি নই, বিচারক সেই মহাকাল! শতাব্দীর পর নতুন শতাব্দীতে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতিটি বিভাগকে সঞ্জীবিত করে বিশাল গগনে রবিপ্রভা দীপ্যমান, রবিপ্রভা আজও মূর্তিমান, তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল!

    বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ। তিনি কর্মকা-ে রাজত্ব করেছেন বঙ্গীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর তিন দশক আর বঙ্গীয় চতুর্দশ শতাব্দীর পাঁচ দশকব্যাপী। প্রথম তিরিশ বছর তো প্রস্তুতিকাল গেছে―বাকি পঞ্চাশ বছরেই রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। সেই হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চতুর্দশ শতাব্দীর কবি ও লেখক।
    সুদীর্ঘকাল পূর্বে বুদ্ধদেব বসু তাঁর এক ইংরেজি রচনায় রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন ‘চযবহড়সবহড়হ’ অর্থাৎ ‘নৈসর্গিক আবির্ভাব’। বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতির বর্তমান অবক্ষয়ের কালে এই পর্যবেক্ষণলব্ধ আবিস্কার যে কী গভীর সত্য তা পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাঙালির সমাজ বিবর্তনের আগ্রহী ছাত্রমাত্রই জানেন যে, শুধু এই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ও প্রিন্সের ছোট নাতিটির কাছে বঙ্গদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঋণ কতখানি বিশাল। ঋণ পরিশোধের বালখিল্য ইচ্ছাপোষণ মূঢ়তা তো নিঃসন্দেহে অধিকন্তু তা বুঝিয়ে দেয় যে, ঋণের চরিত্র ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পর্যন্ত আমাদের নেই। ধারণা থাকলে এই বিচার বুদ্ধি ও সিদ্ধান্ত মনে জাগতে বাধ্য যে, তাঁর প্রতিতুল্য কোনো ব্যক্তি মণীষা বাঙালিদের মধ্যে অদ্যাবধি জন্মাননি। কিন্তু সাহিত্যসাধনা রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিস্বরূপের একটি প্রকাশমাধ্যম শুধু, এই প্রায়শ বিস্তৃত তথ্য সচেতনভাবে মনের ভেতরে সংশোধন করে না নিলে তাঁর বিষয়ে নানা ধরনের ভ্রান্তি দেখা দেবেই। সৃজনশীল কল্পনা-মণীষার সঙ্গে, ইতিহাসচেতনা, ভাষাতত্ত্ব, সমাজবুদ্ধি, দেশহিতৈষণ্য ও সমকালীন বিশ্বরাজনীতির জ্ঞান মিলে যে রবীন্দ্রনাথকে নৈসর্গিক আবির্ভাব হিসেবেই আমাদের উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে আদ্যোপান্ত চিনে নেওয়া তাই জরুরি কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু এ ঘটনাও সত্যি যে, রবীন্দ্রনাথ অন্যান্য ক্ষেত্রে না হলেও সাহিত্যে অন্তত সারা জীবন কটু সমালোচনা ও বিরুদ্ধতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁকে আক্রমণ ও আঘাতের ক্ষেত্র হিসেবে বাণীশিল্প রচনাকে নির্বাচন করার অন্যতম কারণ, আমার ধারণা এই হতে পারে যে, জীবনব্যাপী তাঁর সাধনা যতদিকেই নিয়োজিত থাকুক না কেন, তাঁর প্রধানকর্ম ছিল ভাষাশিল্পের চৌহদ্দিতে কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, চিঠিপত্র। তাঁর অন্যান্য কর্মপ্রয়াস নিয়ে কেউ যে ব্যঙ্গপ্রাণ সমালোচনামুখর হননি তার সম্ভাব্য কারণ―ব্যবসা করা, কি ব্যাংক পত্তন, শান্তিনিকেতন কিংবা শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার মতো কর্মোদ্যোগে যে কতদূর পরিশ্রমসাধ্য এবং পরিকল্পনা মেধা দাবি করে তা সকলেই বুঝতেন। কিন্তু সাহিত্যনির্মাণ, যার ফলে রবীন্দ্রনাথ কালিক গ-ি অতিক্রম করে বিশ্বের সম্পত্তি―যা তাঁর প্রতিভার মহত্তম পরিচয় সেখানেই কত বিভিন্ন ধরনের আলোচনার মুখোমুখি তাঁকে হতে হয়েছিল।
    রবীন্দ্রনাথ লিখতে শুরু করেছিলেন খুব ছোট বয়সে, প্রকাশিত হয়েছিল কিশোর বয়সেই। তিনি স্কুল পালানো ছাত্র ছিলেন। তাঁর ভবিষ্যৎ নিয়ে গুরুজনদের মনে উৎকণ্ঠারও অবধি ছিল না, তা সত্ত্বেও তাঁর সাহিত্য প্রচেষ্টায় কেউ বাধ সাধেনি। পারিবারিক এই রুচিবোধ সহ্যশক্তি ও ঔদার্য লক্ষ করবার মতো। রবীন্দ্রনাথের প্রথম গুণগ্রাহীতার দল তাঁদের বৃহৎ ঠাকুর পরিবারের সদস্যম-লী। তার কিছু পরিচয় তিনি ধরে রেখেছেন তাঁর ‘জীবন স্মৃতি’তে। তাঁর রচিত ব্রহ্মসঙ্গীতের রসগ্রাহী ছিলেন তাঁর পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম ভারতীয় আইসিএস মেজোভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্নেহদৃষ্টির ছবি আমরা জানি, কিন্তু কিশোর কবির কবিপ্রতিভার গুণগ্রাহীতার কোনো পরিচয় তিনি তাঁর আচরণে ফেলে রেখে যাননি। কিন্তু দাদা জ্যোতিন্দ্রনাথ ও নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর প্রশ্রয় ও মনোযোগ সমস্ত শূন্যতা ভরাট করেছিল। জ্যেষ্ঠদের মধ্যে বড়োভাই কবি, দার্শনিক-অঙ্কবিদ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং দিদি স্বর্ণকুমারী দেবী, সেকালের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক, ছোটভাইটির প্রতি যে শ্রদ্ধাপূর্ণ স্নেহদৃষ্টি রেখেছিলেন তার পরিচয় ‘ভারতী’ পত্রিকার উদ্ভব ও পরিণতির কাহিনিতে পাওয়া যাবে। এঁনারা ছাড়া পরবর্তীকালে ঠাকুরবাড়ির কনিষ্ঠ প্রজন্মের বিভিন্ন দল তো ছিলই, যেমন―ভাইঝি ইন্দিরা, ভাগ্নী সরলা, বিভিন্ন ভ্রাতার সন্ততি সুধীন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পৌত্র দিনেন্দ্রনাথ, পিতৃব্য গিরিন্দ্রনাথের পৌত্র গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ প্রমুখ নানা গুণীজন।
    তাঁর দ্বিতীয় গুণগ্রাহী ছিলেন ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুবৃত্ত, যাঁরা প্রায় তাঁর সমবয়সী ছিলেন। এর মধ্যে পড়েন অক্ষয় চন্দ্র, লোকেন পালিত, প্রিয়নাথ সেন, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার, মোহিতান্ত্র সেন, আশুতোষ চৌধুরী এঁনারা সকলেই ব্যক্তি মানুষ ও জায়মান শিল্পী উভয়েররই প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন।
    ক্রমে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের সমাজের স্থায়ী ভিত্তি তৈরি করেন জীবনব্যাপী রবীন্দ্রচর্চার মাধ্যমে, তাঁরা এসেছেন অনেক পরে। যেমন অজিত কুমার চক্রবর্তী, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, প্রবোধচন্দ্র সেন, বুদ্ধদেব বসু, সোমেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ। জীবনব্যাপী রবীন্দ্রচর্চা নয়, কিন্তু অসামান্য ধীশক্তির বলে রবীন্দ্রনাথকে অন্য মাত্রায় চিনে নেবার সুযোগ যাঁরা করে দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে ধূর্জটীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন রায় এবং আবু সয়ীদ আইয়ুব অগ্রগণ্য। বর্তমানে বিদ্বৎসমাজে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি তো একাডেমিক ডিসিপ্লিনের অন্তর্গত হয়ে গেছে, তাই রবীন্দ্রচর্চা আজ এতখানিই গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানসাধনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
    স্বদেশের মানুষ তার এক উজ্জ্বল মণীষা ও সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যপ্রতিভাকে যেভাবে গ্রহণ করেছে তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথের তীব্র বেদনাবোধ আমৃত্যু সঙ্গী ছিল। তাঁর ছোটখাটো মানসিক দুর্বলতা যেমন―প্রশংসায় খুশি হওয়া, নিন্দায় কষ্ট পাওয়া, কারো বেয়াদবিতে অসন্তুষ্ট হওয়া ইত্যাদি কিছু কিছু থাকলেও এটুকু বোঝার মতো প্রখর কা-জ্ঞান তাঁর ছিল যে, বঙ্গদেশে তো অবশ্যই, এমনকি আধুনিক ভারতবর্ষে তাঁর সমতুল্য কবি আর কেউ নেই। নোবেল পুরস্কার পাওয়ায় তিনি কতটুকু খুশি হয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়, কিন্তু পশ্চিমের দেওয়া মণিহার গলার ফাঁস হিসেবে নিজেকে জাহির করবে কি না তা নিয়ে তাঁর সংশয় ছিল। তার পরেও পুরস্কারপ্রাপ্ত কবির প্রতি সম্মাননা প্রকাশে দেশবাসীর ঔদাসীন্য তাঁকে আরো কষ্ট দিয়েছিল। তাঁর প্রতি, তার সাহিত্যসাধনার ও দেশব্রতের প্রতি জনগণের নিরঙ্কুশ মনোযোগ তিনি দাবি করতেন। আমরা জানি যে, কবিগুরুর ভক্তবৃন্দের মতোই তাঁর বিরোধী পক্ষও দলে কম ভারী ছিল না। এহেন কৃতঘ্নতায় তিনি কতখানি রুষ্ট হতেন বলা মুশকিল, কারণ ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ তাঁর বিবেচনায় হয়তো-বা অশালীন ও গর্হিত আচরণ বলে গণ্য হতো, কিন্তু তাঁর নিজের তৈরি শান্তিনিকেতনের মানুষজনও তাঁর মূল্য বোঝে না।
    বস্তুতপক্ষে, রবীন্দ্র-আলোচনার শতাব্দীব্যাপী ইতিহাস বিচার করলে আমরা তিনটি পৃথক ধারার দেখা পেতে পারি বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত। প্রথমটি হলো, তাঁকে ভালোবেসে মমতার সঙ্গে বিচার বিশ্লেষণ ও যাচাইয়ের চেষ্টা। দ্বিতীয়টি হলো, নিরপেক্ষ ও অসম্পর্কিত অবস্থান নিয়ে তাঁর সমস্ত কিছু পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন করা। তৃতীয়টি হলো, স্বেচ্ছায় নিরূপিত পূর্ব নির্ধারিত বিরোধী অবস্থান নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধতা করা এবং তাঁর যাবতীয় সুকীর্তিরও অপব্যাখ্যা অন্বেষণ।
    রবীন্দ্রনাথ, অন্তর্জগতে রূপায়ন, ভাবের আক্ষরিক রূপদান বস্তুতন্ত্রহীনতার প্রবর্তন। বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ এই বস্তুতন্ত্রহীনতার প্রবর্তক। বিশ্বসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বড়ো মাপেরই এক নৈসর্গিক ঘটনা। তাঁর সমস্ত জীবনের সাধনা, তাঁর জীবনবোধের বিশ্লেষণ করলে একথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমস্ত মণপ্রাণ ছিল বিশ্বশান্তির জন্য সমর্পিত। কবি সকল মানব প্রেমিকের প্রতি উদ্দাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানালেন, ‘যাত্রা কর, যাত্রা কর, যাত্রীদল এসেছে আদেশ!’
    তাই আজ নির্দ্বিধায় বলব, আমরা শুধু তাঁকে মনেই রাখিনি―কাল থেকে কালান্তরে শ্রুত হবে রবীন্দ্রময় আমাদের এই জীবন। তাই কবি বেঁচে আছেন আমাদের হৃদয়ে পূর্ণ শান্তিতে, পূর্ণ আনন্দে, পূর্ণ সৌন্দর্যের এই বাংলাদেশে। আজ ২৫শে বৈশাখ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০তম জন্মজয়ন্তী। তাঁকে চিত্ত থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা!

  • ভয়ংকর পরিণতি আর সংক্রমণ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে

    ডা. সুব্রত ঘোষ

    দেশে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ আশঙ্কার চেয়েও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। দৈনিক আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেশি। হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ঠাঁই হচ্ছে না। আইসিইউ সেবা দেওয়া জরুরি হলেও শয্যার অভাবে অনেক রোগীকেই এই সেবা দেওয়া যাচ্ছে না। এমনকি অক্সিজেন সংকট তৈরিরও আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, সেই গতি কমানো না গেলে এই সংকট আরো তীব্র হবে এবং পুরো দেশের হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় ধস নামতে পারে। তাঁদের মতে, সংক্রমণের গতি কমানোর জন্য মানুষকে সচেতন হতে হবে, সঠিকভাবে মাস্ক পরাসহ জরুরি স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলতে হবে এবং লকডাউন ও বিধি-নিষেধ আরো কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সঙ্গে টিকা প্রদান আরো দ্রুততর করতে হবে। কিন্তু টিকা যেহেতু পুরোপুরি নিরাপত্তা দেয় না, তাই টিকা দেওয়ার পরও স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলতে হবে। আর এখানেই সমস্যা। বেশির ভাগ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানতে চান না। সামাজিক দূরত্ব মানা তো দূরের কথা, মাস্ক পরতেও তাঁদের অনীহা। তাহলে যে ভয়ংকর পরিণতির আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে কিভাবে?
    করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে ১৮ দফা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। তারপর লকডাউনের আদলে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। সর্বশেষ গত বুধবার থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংক, অনেক অফিস, কারখানাসহ জরুরি অর্থনৈতিক কর্মকা- চালু থাকায় প্রচুর মানুষ চলাচল করছে। তার পাশাপাশি প্রয়োজন ছাড়াও বহু মানুষ ঘরের বাইরে আসছে। হাট-বাজারগুলোতে অত্যধিক ভিড় রয়েছে। প্রায় কোথাও সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না। এবার লকডাউনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে তুলনামূলকভাবে বেশি তৎপর দেখা গেছে। রাস্তায় বের হওয়া মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তার পরও নানা অজুহাতে মানুষ ঘরের বাইরে আসছেই। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘লকডাউন’ বলতে যা বোঝায়, তা সঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে না। তাই লকডাউনের সুফল পাওয়া নিয়েও অনেকে সংশয় প্রকাশ করছেন। আবার লকডাউনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে অন্যায় ক্ষমতা প্রদর্শনের অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালে যাওয়া-আসার পথে তারা চিকিৎসকদেরও হয়রানি, হেনস্তা করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এগুলো বন্ধ করতে হবে।
    মানুষ নিজে সচেতন না হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি পালন নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব। তার পরও গত কিছুদিনের কড়াকড়িতে কিছুটা হলেও সুফল পাওয়া গেছে। যে গতিতে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছিল, সেই গতি কিছুটা হলেও রোধ করা গেছে। সংক্রমণের হার একটা জায়গায় এসে থেমে গেছে। এখন প্রয়োজন এই হার কমানো। এ জন্য সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। পরিপূর্ণ লকডাউনে যাওয়া খুবই কঠিন কাজ, তাতে বহু মানুষের জীবন-জীবিকায় আঘাত আসে। আবার খুব বেশি শিথিলতাও কাম্য নয়, তাতে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

  • কমরেড লেনিন আজও প্রাসঙ্গিক

    কমরেড লেনিন আজও প্রাসঙ্গিক


    সৈয়দ আমিরুজ্জামান

    ২২ এপ্রিল ২০২১: মহান সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত বিপ্লবের মহানায়ক কমরেড ভ ই লেনিনের ১৫১তম জন্মবার্ষিকী । কমিউনিস্ট মতাদর্শের শ্রমিক শ্রেণীর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় কমরেড লেনিন আজও প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য। মহান মার্কসবাদী এই বিপ্লবী নেতার জন্মদিনে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
    ২২ এপ্রিল হলো কমরেড লেনিনের জন্মদিন। এই দিনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ লেনিন দিবস হিসাবে পালন করে থাকে। ১৮৭০ সালের ২২ এপ্রিল কমরেড লেনিন রাশিয়ার ভলগা নদীর তীরবর্তী সিমবিস্ক শহরে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি মস্কোতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি কাজান বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্রের উপর লেখাপড়া করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময়েই তিনি জার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এই ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে জার সরকার তাকে সাইবেরিয়াতে নির্বাসনে পাঠায়। লেনিন যে সময়ে রাশিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন সেই সময়ে রাশিয়ায় নৈরাজ্যবাদী বাকুনিনপন্থীদের ব্যাপক প্রভাব ছিল। এই বাকুনিনপন্থীরা ব্যক্তি সন্ত্রাসে বিশ্বাস করতো। তাদের ধারণা ছিল রাশিয়ার জনগণের সমগ্র দুর্দশার জন্য দায়ী হলো রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিচালনায় নিযুক্ত মুষ্টিমেয় কয়েকজন শীর্ষ কর্তা ব্যক্তি। তাই এই শীর্ষ কর্তাদের যে কোন পন্থায় অপসারণ করতে পারলেই জনগণের মুক্তির লড়াইয়ে বিজয় অর্জিত হবে। সেই প্রেক্ষিতেই তারা রাশিয়ার জারকে খুন করে। আর এই খুনের দায়ে লেনিনের বড় ভাইয়ের ফাঁসি হয়। কমরেড লেনিন সেই থেকে শিক্ষা নিয়ে নৈরাজ্যবাদ, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে মার্কসবাদের পথ অনুসরণ করেন এবং রুশ দেশে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লব সম্পন্ন করে পৃথিবীর বুকে প্রথম শোষণমুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা শ্রমিক শ্রেণীর রাষ্ট্ররূপ সোভিয়েতে রাষ্ট্রের সৃষ্টি করেন। তিনি শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রেণী সংগ্রামের বিকাশের গতিধারায় বিপ্লবী সংগ্রামের ভিতর দিয়ে পশ্চাৎপদ সমাজ ব্যবস্থা তথা জারতন্ত্রের উচ্ছেদ করে শ্রমিক শ্রেণীসহ অন্যান্য শোষিত জনগণের মুক্তির সংগ্রামকে অগ্রসর করতে ব্রতী হন।
    মানব জাতির ইতিহাসে উৎপাদন শক্তি বিকাশের প্রক্রিয়ায় আদিম সাম্যবাদী সমাজের ভাঙনের পর সৃষ্টি হয় শ্রেণী বিভক্ত সমাজ ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র। এই শ্রেণী বিভক্ত সমাজ সৃষ্টির সাথে সাথে সমাজে দেখা দেয় শ্রেণী শোষণ ও শ্রেণী সংগ্রাম। শোষিত নিপীড়িত শ্রেণী তার ওপর চেপে বসা শোষণ থেকে মুক্তির জন্য শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে বার বার বিদ্রোহ ঘোষণা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কিন্তু শোষিত জনগণ শ্রেণী শোষণ থেকে মুক্তি অর্জন করতে পারেনি। ইতিহাসের গতিধারায় বুর্জোয়া ব্যবস্থা বিকাশের সাথে সাথে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিপরীতে শ্রমিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। বুর্জোয়া শ্রেণী বিভিন্ন দেশে সামন্তদের হটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে। সৃষ্টি হয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার। বুর্জোয়া ব্যবস্থার যত বিকাশ ঘটতে থাকে শ্রমিক শ্রেণীরও ততই বিকাশ ঘটে। বুর্জোয়া শ্রেণীর বিপরীতে শ্রমিক শ্রেণী ছাড়া বুর্জোয়া ব্যবস্থা তার অস্তিত্বের শর্ত হারায়। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় গোটা উৎপাদন প্রক্রিয়া হলো সামাজিক, কিন্তু মালিকানা হলো ব্যক্তিগত। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় জমি, বাড়ি, কলকারখানা সকল সম্পদের মালিক হচ্ছে বুর্জোয়া শ্রেণী। কিন্তু তারা উৎপাদন করে না, উৎপাদন কাজ চালায় হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী। কিন্তু এই উৎপাদিত সামগ্রির মালিক হয় বুর্জোয়া শ্রেণী। ইতিহাসের রঙ্গমঞ্চে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিপরীত শ্রেণী হিসাবে শ্রমিক শ্রেণীর আবির্ভূত হয়। শ্রমিক শ্রেণী এমন একটি শ্রেণী যা বুর্জোয়া সমাজের কবর খননকারী। কিন্তু বুর্জোয়া সমাজে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিপরীত শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণীর অস্তিত্ব ছাড়া বুর্জোয়া উৎপাদন ব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। পুঁজিবাদী সমাজে এই পরস্পর বিরোধী স্বার্থযুক্ত দুই শ্রেণীর মধ্যে শুরু হয় তীব্র শ্রেণী সংগ্রাম।
    মার্কসবাদের তিনটি অপরিহার্য অংশ হলো (১) মার্কসীয় দর্শন- দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ; (২) সর্বহারা শ্রেণীর শ্রেণী সংগ্রামের মতবাদ; (৩) রাজনৈতিক অর্থনীতি। তৎকালীন ইউরোপের সবচেয়ে অগ্রসর তিনটি দিক জার্মান দর্শন, ফ্রান্সের শ্রেণী সংগ্রাম ও ইংল্যান্ডের বিকাশমান বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্রের সারসঙ্কলন করে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন মার্কসবাদ। বুর্জোয়া ব্যবস্থার এই বিকাশের যুগে শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেণী সংগ্রামের মতবাদ প্রচার করেন মহান মনীষী কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস। মহান মনীষী মার্কস দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আবিষ্কারক। দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি ও ফয়েরবাখের বস্তুবাদকে গ্রহণ করে সৃষ্টি করে বিশ্বের বুকে সম্পূর্ণ নতুন দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। মার্কস ও এঙ্গেলস হেগেলের দ্বান্দ্বিকতার যুক্তিসঙ্গত সারভাগ গ্রহণ করেন এবং ভাববাদী জঞ্জাল বর্জন করেন। সেই সাথে ফয়েরবাখের বস্তুবাদের অন্তর্নিহিত সারভাগ গ্রহণ করেন এবং বর্জন করেন তার অধিবিদ্যক পদ্ধতিকে। মার্কস ও এঙ্গেলস ফয়েরবাখের বস্তুবাদী ভিত্তি এবং হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে উন্নত করে সমন্বিত করে এক গুণগত উন্নয়ন ঘটিয়ে সৃষ্টি করেন সর্বহারা শ্রেণীর মুক্তির দর্শন দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। মহান মনীষী মার্কস দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের আলোকে সমাজ ব্যবস্থার বিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণ করে দেখান যে, সভ্যতার ইতিহাস হলো শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। মহামনীষী মার্কস পুঁজিবাদী শোষণের মর্মবস্তুকে আবিষ্কার করেন। তিনি আবিষ্কার করেন উদ্বৃত্তের মূল্যতত্ত্ব। মহামনীষী মার্কস তার অবদান সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে ১৮৫২ সালের ৫ মার্চ লন্ডন থেকে ইয়ো. ভেইদেমেয়ারের কাছে লিখিত এক চিঠিতে তিনি নিজেই বলেছেন, “এখন আমার প্রসঙ্গে ধরলে, বর্তমান সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব আবিষ্কারের বা তার মধ্যে সংগ্রাম আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার নয়। আমার বহু পূর্বে বুর্জোয়া ঐতিহাসিকেরা এই শ্রেণী সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা এবং বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদেরা বিভিন্ন শ্রেণীর অর্থনৈতিক শরীরস্থান বর্ণনা করেছেন। আমি নতুন যা করেছি তা হচ্ছে এইটা প্রমাণ করা যে, (১) উৎপাদন বিকাশের বিশেষ ঐতিহাসিক স্তরের সঙ্গেই শুধু শ্রেণীসমূহের অস্তিত্ব জড়িত; (২) শ্রেণী সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে প্রলেতারীয় একনায়কত্ব; (৩) এই একনায়কত্বটা সমস্ত শ্রেণীর বিলুপ্তি ও শ্রেণীহীন সমাজে উত্তরণের পর্যায় মাত্র।” [মার্কস এঙ্গেলস রচনা সঙ্কলন- দ্বিতীয় খন্ড, দ্বিতীয় অংশ, পাতা ১৩৮, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো]।

    লেনিন শুধু মার্কস এঙ্গেলসের শিক্ষাকে কার্যকরী করেননি। তিনি ছিলেন এই শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষাকারী। তিনি সাম্রাজ্যবাদী যুগে বিকাশের নতুন পর্যায়ের সাথে, পুঁজিবাদের নতুন পর্যায়ের সাথে মার্কস ও এঙ্গেলসের শিক্ষাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে একে আরও বিকশিত করেন। এর অর্থ হলো শ্রেণী সংগ্রামের নতুন অবস্থাধীনে মার্কসবাদকে আরও বিকশিত করতে গিয়ে পুঁজিবাদের বিকাশের যুগে মার্কস ও এঙ্গেলস কর্তৃক যা সৃষ্ট হয়েছিল তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগে মার্কসবাদের জ্ঞানভান্ডারে নতুন নতুন অবদান যুক্ত করেন।
    মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের মতবাদ প্রচার করেন প্রাক সাম্রাজ্যবাদের যুগে, পুঁজিবাদের বিকাশের যুগে। যখন পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের যুগে প্রবেশ করেনি। অর্থাৎ বিকশিত সাম্রাজ্যবাদের যখন জন্ম হয়নি, শ্রমিক শ্রেণী যখন বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, শ্রমিক বিপ্লব যখন কার্যক্ষেত্রে আশু ও অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেনি সেই প্রাক বিপ্লব যুগে মার্কস ও এঙ্গেলস তাদের কার্যকলাপ চালান। মার্কস ও এঙ্গেলসের সুযোগ্য শিষ্য লেনিন তার কাজ চালিয়েছেন বিকশিত সাম্রাজ্যবাদের যুগে, শ্রমিক বিপ্লব যখন আশু করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস যখন শ্রেণী সংগ্রামের মতবাদ প্রচার করেন, তখন বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণীর সাথে বুর্জোয়া শ্রেণীর দ্বন্দ্বই ছিল মৌলিক দ্বন্দ্ব। আর লেনিন যখন তার কার্যকলাপ চালান তখন পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী যুগে প্রবেশ করেছে। পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদী যুগে প্রবেশের সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী তিনটি মৌলিক দ্বন্দ্ব ক্রিয়াশীল হয়। (ক) পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাথে শ্রমিক শ্রেণীর দ্বন্দ্ব; (খ) ঔপনিবেশিক দেশের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের সাথে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব; (গ) এক সাম্রাজ্যবাদী দেশের সাথে আর এক সাম্রাজ্যবাদী দেশের দ্বন্দ্ব। কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি ১৯১৭ সালে রুশ দেশে শ্রমিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ও সাম্যবাদের লক্ষ্যে শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার পর আরও একটি মৌলিক দ্বন্দ্ব যুক্ত হয়। তা হলো (ঘ) সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব। আবার ১৯৯১ সালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বব্যাপী কোন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র না থাকায় সমাজতন্ত্রের সাথে পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব- এই দ্বন্দ্বের কোন অস্তিত্ব বর্তমানে নেই।

    মার্কসবাদ- লেনিনবাদের অন্যতম অনুসারি কমরেড স্তালিন লেনিনবাদের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘লেনিনবাদ হলো সাম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারা বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, লেনিনবাদ হলো সাধারণভাবে শ্রমিক বিপ্লবের মতবাদ ও রণকৌশল এবং বিশেষভাবে এ হলো শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্বের মতবাদ ও রণকৌশল। বিকশিত সাম্রাজ্যবাদের যখন জন্ম হয়নি, সর্বহারা শ্রেণী যখন বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে শ্রমিক বিপ্লব যখন কার্যক্ষেত্রে আশু এবং অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেনি সেই প্রাক বিপ্লব যুগে (এখানে আমরা শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবের কথাই বলছি) মার্কস আর এঙ্গেলস তাদের কার্যকলাপ চালাতেন। আর মার্কস-এঙ্গেলসের শিষ্য লেনিন তাঁর কাজ চালিয়েছেন বিকশিত সাম্রাজ্যবাদের যুগে, শ্রমিক বিপ্লবের বিকাশের যুগে- যখন শ্রমিক বিপ্লব একটি দেশে ইতিমধ্যে জয়যুক্ত হয়েছে, বুর্জোয়া গণতন্ত্রকে চূর্ণ করে, শ্রমিক শ্রেণীর গণতন্ত্রের সোভিয়েততন্ত্রের যুগের সূত্রপাত করেছে। এই কারণেই লেনিনবাদ হলো মার্কসবাদের আরও বিকশিত রূপ।’ [লেনিনবাদের ভিত্তি- কমরেড স্তালিন]।
    মার্কস ও এঙ্গেলস প্রাক সাম্রাজ্যবাদের যুগে পুঁজি গ্রন্থে পুঁজিবাদের মূল ভিত্তিগুলোর বিশ্লেষণ প্রদান করেন। আর কমরেড লেনিন পুঁজি গ্রন্থের মূল নীতিমালার ভিত্তিতে পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদ গ্রন্থে- সাম্রাজ্যবাদের এক মার্কসবাদী বিশ্লেষণ উপস্থিত করেন। কমরেড লেনিন সাম্রাজ্যবাদকে সংজ্ঞায়িত করেন। কমরেড লেনিন বলেন যে, পুঁজিতন্ত্রের একচেটিয়া স্তরই হলো সাম্রাজ্যবাদ।’ তিনি সাম্রাজ্যবাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদের ৩টি চরিত্র ও ৫টি বৈশিষ্ঠ্য আলোচনা করেন। তাঁর আলোচিত সাম্রাজ্যবাদের এই ৩টি চরিত্র হলো (১) সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে একচেটিয়া পুঁজিবাদ; (২) সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে ক্ষয়িষ্ণু বা পরজীবী পুঁজিবাদ; (৩) সাম্রাজ্যবাদ হচ্ছে মুমূর্ষু বা মৃতপ্রায় পুঁজিবাদ। লেনিন সাম্রাজ্যবাদের ৫টি মূলগত বৈশিষ্ঠ্য তুলে ধরেন। এই বৈশিষ্ঠ্যগুলি হলো- (১) উৎপাদন ও মূলধনের কেন্দ্রীভবন এমন উঁচু স্তরে উন্নীত হয়েছে যে, তা থেকে একচেটিয়া কারবারের উদ্ভব ঘটেছে আর এই সমস্ত একচেটিয়া কারবারই অর্থনৈতিক জীবনের অধিনিয়ন্তার ভূমিকা গ্রহণ করেছে; (২) ব্যাঙ্ক পুঁজির সাথে শিল্প পুঁজির সহমিলন ঘটেছে আর এই মহাজনি মূলধনের ভিত্তিতে মহাজনি মোড়লতন্ত্রের অভ্যুদয় ঘটেছে; (৩) পণ্য রপ্তানি থেকে স্বতন্ত্র যে মূলধন রপ্তানি তা অসাধারণ গুরুত্ব অর্জন করেছে; (৪) আন্তজাতিক একচেটিয়া পুঁজিবাদী সমাহারের আবির্ভাব ঘটেছে। আর এই সমস্ত সমাহার পৃথিবীকে নিজেদের মধ্যে বেঁটে নিতে শুরু করেছে; (৫) বৃহত্তম পুঁজিতান্ত্রিক শক্তিবর্গের মধ্যে সমগ্র বিশ্বের ভূখন্ড ভাগবাঁটোয়ারা পরিসমাপ্ত হয়েছে।
    সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার মার্কসীয় মৌলিক ভাবনার বাস্তবে রূপায়ন করেন। এক্ষেতে মার্কসবাদের জ্ঞান ভান্ডারে লেনিনের নতুন অবদান হলো- (১) তিনি সোভিয়েত ব্যবস্থাকে সর্বহারা শ্রেণীর শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রীয় রূপ হিসাবে আবিষ্কার করেন। এপ্রেক্ষিতে তিনি প্যারি কমিউন ও রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। (২) তিনি সর্বহারা শ্রেণীর মিত্রের সমস্যার দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বের ব্যাখ্যা প্রদান করেন। সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্বকে সংজ্ঞায়িত করেন পরিচালক হিসাবে সর্বহারা শ্রেণী আর পরিচালিত হিসাবে অসর্বহারা শ্রেণীসমূহের শোষিত জনগণের মধ্যেকার শ্রেণী মৈত্রীর বিশেষ রূপ হিসাবে। (৩) তিনি এই বাস্তব ঘটনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন যে, সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব হলো শ্রেণী বিভক্ত সমাজে গণতন্ত্রের সর্বোচ্চ রূপ। সর্বহারা গণতন্ত্রের এই রূপ পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থকেই অভিব্যক্ত করে।
    তিনি প্রমাণ করেন, পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী পরিবেষ্টিত একটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সাফল্যের সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক বির্নিমাণ ও শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রযাত্রা সম্ভব। মার্কসবাদের মৌলিক নীতিমালার ভিত্তিতে তিনি সোভিয়েত রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে বিশেষ সাফল্য স্থাপন করেন। এক্ষেত্রে মার্কসবাদের জ্ঞানভান্ডারে তার নতুন অবদান হলো- (১) তিনি প্রমাণ করেন যে, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক পরিবেষ্টিত সর্বহারা একনায়কত্বাধীন একটি দেশে পরিপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব। (২) তিনি আবিষ্কার করেন অর্থনীতির কর্মনীতির সুনির্দিষ্ট গাইডগুলো, যার দ্বারা সর্বহারা শ্রেণী অর্থনীতির মূল অবস্থানগুলোর অধিকারী হওয়ার সুবাদে সমাজতান্ত্রিক শিল্পকে কৃষির সাথে সংযুক্ত করে সমগ্র জাতীয় অর্থনীতি সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে পরিচালিত হতে পারে। (৩) তিনি আবিষ্কার করেন সমবায়ের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক বিনির্মানের গতিপথে কৃষক সমাজের মূল অংশকে ক্রমান্বয়ে পরিচালনা করার ও টেনে নিয়ে আসার সুনির্দিষ্ট পন্থার, যে সমবায় হলো সর্বহারা একনায়কত্বের হাতে ক্ষুদে কৃষক অর্থনীতির রূপান্তর সাধনের ও সমাজতন্ত্রের ভাবধারায় কৃষক সমাজের মূল অংশকে পুনর্শিক্ষিত করে গড়ে তোলার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।
    তিনি মার্কস-এঙ্গেলসের মৌলিক গাইড লাইনের আলোকে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার অবসান ও সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা নিপীড়িত জাতি ও জনগণের জাতীয় মুক্তি অর্জনের আকাঙ্খা বাস্তবায়নের সমস্যার সমাধান করেন। এই ক্ষেত্রে মার্কসবাদী জ্ঞানভান্ডারে তার নতুন অবদান হলো- (১) লেনিন সাম্রাজ্যবাদের যুগে জাতীয় ও ঔপনিবেশিক বিপ্লব সম্পর্কিত ধারণাগুলোকে একটি একক সামঞ্জস্যপূর্ণ পদ্ধতির মতামতে একত্রীভূত করেন। (২) তিনি জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নকে সাম্রাজ্যবাদ উচ্ছেদের প্রশ্নের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেন। (৩) তিনি জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নকে আন্তর্জাতিক সর্বহারা বিপ্লবের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে ঘোষণা করেন।
    লেনিনের এই সব গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে ধারণ করে আজও বিশ্বের দেশে দেশে সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ শ্রেণী সংগ্রাম, গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে অগ্রসর করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। লেনিনবাদ বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণী ও নিপীড়িত জাতি জনগণের মুক্তির সংগ্রামে পথ নির্দেশিকা হিসাবে কাজ করে চলেছে। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র তথা সর্বহারা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই ও নয়া ঔপনিবেশিক দেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তির লড়াই এক ও অভিন্ন লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থায় যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক তথা সামগ্রিক সঙ্কটের উদ্ভব ঘটেছে বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার দুর্বলতম গ্রন্থী ছিন্ন করার ফল হিসাবে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশের শ্রমিক শ্রেণী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও নয়া ঔপনিবেশিক দেশের শ্রমিক শ্রেণী এবং জনগণ সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই কাজে শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ তখনই সাফল্য অর্জন করতে পারবে যখন লেনিনবাদের মৌলিক অবদানসমূহকে ধারণ করে তা সাফল্যের সাথে প্রয়োগ করতে পারবে। বিশ্বের দেশে দেশে কমিউনিস্ট মতাদর্শে শ্রমিক শ্রেণী ও জনগণ আজ সেই মহান বিপ্লবী ব্রত পালনের লক্ষ্যেই অগ্রসর হচ্ছে

    লেখক:-মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক

  • বাংলা কবিতার দেবদূত শঙ্খ ঘোষ

    বাংলা কবিতার দেবদূত শঙ্খ ঘোষ

    ইমদাদুল হক মিলন

    শঙ্খ ঘোষের কবিতা প্রথম পড়েছিলাম ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায়। শক্তি সুনীল শঙ্খ—এই তিন কবি তখন কবিতাপ্রেমী বাঙালিকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখছেন। কৃত্তিবাস সম্পাদনা করতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সেই পত্রিকা ঘিরে গড়ে উঠেছে কবিদের একটি দল। আমাদের বেলাল চৌধুরীও ছিলেন সেই দলে। যত দূর মনে পড়ে শঙ্খ ঘোষের একগুচ্ছ কবিতা ছাপা হয়েছিল কৃত্তিবাসের কোনো একটি সংখ্যায়। নাম ছিল ‘দিনগুলি রাতগুলি’। পরে এই নামে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এত স্নিগ্ধ মায়াময় কবিতা, শব্দের কী অপূর্ব ব্যবহার, ছন্দের কী মধুর খেলা! এক বিস্ময়কর কবি! চুয়াত্তর সালে শঙ্খদাকে সামনাসামনি দেখলাম। ঢাকায় এসেছিলেন। বেইলি রোডের মহিলা সমিতির হলে রবীন্দ্রনাথের গানের একটি অনুষ্ঠান হয়েছিল। মঞ্চে শিল্পীদের মাঝখানে বসেছিলেন। ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা শ্যামবর্ণের পুরোদস্তুর বাঙালি বাবু। অনুষ্ঠানের আয়োজনটি চমৎকার। রবীন্দ্রনাথের এক একটি গান ধরে কথা বলছেন শঙ্খ ঘোষ। তাঁর কথা শেষ হওয়ার পরই সেই গানটি গেয়ে শোনাচ্ছেন কোনো শিল্পী। অপূর্ব আয়োজন! কবিতা পড়ে যে শঙ্খ ঘোষের চেহারা মানসপটে এঁকেছিলাম, মানুষটি যেন অনেকখানিই তেমন। একজন মানুষ যে এত সুন্দর করে কথা বলতে পারেন, কণ্ঠের স্নিগ্ধতায় যে আবিষ্ট করতে পারেন শ্রোতাদের, সেদিনই আমি যেন প্রথম তা অনুভব করলাম। যেমন তাঁর কবিতার স্নিগ্ধতা, তেমনি তাঁর কণ্ঠমাধুর্য। সেদিন কল্পনাও করিনি এই মহান কবির সঙ্গে কখনো পরিচয় হবে। তাঁর খুব কাছাকাছি যেতে পারব। একই মঞ্চে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে উদ্বোধন করতে পারব কোনো বইমেলা।

    সেদিনের সেই অনুষ্ঠানের পর থেকে যেখানেই শঙ্খ ঘোষের যে লেখা পাই, সংগ্রহ করি। পড়ে মুগ্ধ হয়ে থাকি। কবিতায় তো তাঁর কোনো তুলনাই হয় না। একের পর এক অসামান্য সব কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হতে লাগল তাঁর। ‘নিহিত পাতালছায়া’, ‘আদিম লতাগুল্মময়’, ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’। ‘ধুম লেগেছে হৃদকমলে’-এর জন্য পেলেন রবীন্দ্র পুরস্কার। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেলেন ‘একাডেমি অ্যাওয়ার্ড’। আরেক অসামান্য কাব্যগ্রন্থ ‘মূর্খ বড়, সামাজিক নয়’-এর জন্য পেলেন নরসিংহ দাস পুরস্কার। আর অনেক পরে এসে লেখা ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। আমাদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল এই কবিতার কয়েকটি লাইন,

    একলা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি

    তোমার জন্য গলির কোণে

    ভাবি আমার মুখ দেখাবো

    মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে।

    আর্জেন্টিনার মেয়ে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছিলেন রবীন্দ্রপ্রেমে মগ্ন। রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পোকে নিয়ে অসামান্য একটি গ্রন্থ রচনা করলেন শঙ্খ ঘোষ। ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’। এই বই বলতে গেলে আমাদের পাগল করে দিল। কত যত্নে, কত মায়ায়, কত অনুসন্ধানে শঙ্খ ঘোষ লিখলেন রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পোকে নিয়ে। শঙ্খ ঘোষের ‘জার্নাল’গুলো সাহিত্যের বোদ্ধা পাঠকদের ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছে। সাহিত্যের কত কত বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন! তাঁর লেখা ছোটদের দুটো উপন্যাসের কথা আমার খুব মনে পড়ছে। ‘সকালবেলার আলো’ ছোটদের জন্য লিখেছিলেন পুজো সংখ্যা আনন্দমেলায়। আরেক কিশোর উপন্যাস ‘সুপারিবনের সারি’। কবিতার মতো গদ্যভাষাও অতুলনীয় শঙ্খ ঘোষের। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল আমার যেন পরিচয় হলো এক ঋষির সঙ্গে, এক দেবদূতের সঙ্গে। যাঁর অন্তরে সর্বক্ষণই খেলা করছে সকালবেলার আলো।

    কয়েক বছর ধরে কলকাতায় একটা সাহিত্য উৎসব হয়। ‘এপিজে সাহিত্য উৎসব’। অক্সফোর্ড বুকসের সেই বনেদি বইয়ের দোকানটির দোতলা একতলা মিলে হয়েছিল প্রথমবারের আয়োজন। চারজন কবি লেখক ছিলেন সেবারের অনুষ্ঠানের উদ্বোধক। শঙ্খ ঘোষ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার আর বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে গেছি আমি। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হলো। শঙ্খদার শরীর খারাপ যাচ্ছে অনেক দিন ধরেই। অনুষ্ঠানাদিতে যান না। গেলেও কথা একেবারেই বলেন না। পাশাপাশি বসে শ্রোতাদের উদ্দেশে সবাই কথা বললেন, শুধু শঙ্খদাই কিছু বললেন না। এত কাছাকাছি থেকেও সেদিনও তাঁর সঙ্গে কোনো কথা হলো না। মাঝখানে এক বছর গ্যাপ পড়ল। সে বছরও এপিজে সাহিত্য সম্মেলনে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কী যেন কী কারণে যাওয়া হলো না। অক্সফোর্ড বুকসের সঙ্গে যৌথভাবে উৎসবটির আয়োজন করে প্রকাশন সংস্থা ‘পত্রভারতী’। পত্রভারতীর স্বত্বাধিকারী ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক। লেখক হিসেবেও জনপ্রিয়। কলকাতা পাবলিশার্স গিল্ডের কর্তাব্যক্তি। আমার বিশেষ বন্ধু। পত্রভারতী আমার দুটো বইও প্রকাশ করেছে। পরের বছর আবার আমন্ত্রণ পেলাম এপিজে সাহিত্য উৎসবে। এবারের আয়োজন একটি মাঠে। একদিকে কিছু বইয়ের স্টল আছে। শামিয়ানা টানিয়ে সুন্দর স্টেজ করা হয়েছে। আগের অনুষ্ঠান হতো এক দিনের। সেবার হলো দুদিনের। শেষ দিনকার সন্ধ্যায় এসেছেন শঙ্খ ঘোষ ও সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। আমাকে বসানো হয়েছে শঙ্খ ঘোষ আর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মাঝখানে। একপাশে এত বড় কবি, আরেক পাশে হাস্যরসের রাজা লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়! আমি খানিকটা সংকুচিত হয়ে আছি। তার পরও শঙ্খদার সঙ্গে টুকটাক কথা শুরু হলো। সেই প্রথম কথা বলা তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন খুবই কম, শোনেন বেশি। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য ভাবনা নিয়ে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের অতি রসালো বক্তৃতা করলেন। তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য মাঠে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সঞ্জীবদা লেখেন যেমন, বলেনও তেমন। তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে ‘কিশোরদের হাসির গল্প’ সম্পাদনা করেছি আমি। আগে থেকেই পরিচয় ছিল। সঞ্জীবদার পরনে সেদিন প্যান্ট আর ফতুয়া। শঙ্খদা আছেন তাঁর সারা জীবনের পোশাকে। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি। আমি একটা ব্লেজার পরে আছি। শীতকাল আসি আসি করছে। কথার ফাঁকে খুবই আগ্রহী গলায় সঞ্জীবদা একসময় আমাকে বললেন, ‘ঢাকায় বুঝি খুব শীত পড়েছে!’ সঞ্জীবদার সূক্ষ্ম ঠাট্টাটা আমি বুঝলাম এবং আমার খুবই গরম লেগে উঠল। মনে হলো ব্লেজারটা খুলে ফেলি।

    পরের রসিকতাটা এলো শঙ্খদার কাছ থেকে। বক্তৃতা শেষ করে মঞ্চ থেকে নেমে শঙ্খদার পাশে এসে বসেছি। কিছু দর্শক-শ্রোতা আমার পরিচয় পেয়ে বেশ আগ্রহী হয়েছেন। কিছু উৎসাহী ছেলেমেয়ে অটোগ্রাফ নিতে এলো। লিখতে গেলে শঙ্খদার হাত কাঁপে। এ জন্য বোধ হয় তিনি অটোগ্রাফ ইত্যাদি এড়িয়ে চলেন। ছেলেমেয়েরা আমার অটোগ্রাফ নিচ্ছে। শঙ্খদার দিকেও খাতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। শঙ্খদা অটোগ্রাফ না দিয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ অতিমৃদু কণ্ঠে আমাকে বললেন, ‘মিলন, আমার অটোগ্রাফটাও দিয়ে দিয়ো।’

    কয়েক বছর আগে শঙ্খ ঘোষ ‘জ্ঞানপীঠ’ পুরস্কার পেলেন। সেলিনা আপা (সেলিনা হোসেন) ও আমি তখন কলকাতায়। নিউ টাউন এলাকায় বইমেলা হচ্ছে। আমরা গেছি অতিথি হয়ে। অরুণিমা নামের একজন তরুণ কবি শঙ্খ ঘোষের জ্ঞানপীঠ পাওয়ার সুসংবাদটি দিলেন। সুভাস মুখোপাধ্যায়ের অনেক দিন পরে আরেকজন বাঙালি কবি এই উচ্চ মর্যাদার পুরস্কারটি পেলেন। গবেষক প্রাবন্ধিক ইমানুল হক আমাদের বিশেষ পরিচিত। শঙ্খদার খুবই অনুরাগী এবং প্রিয়ভাজন। বললেন, চলুন, শঙ্খদার বাড়িতে যাই। তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে আসি।

    এই সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়? চললাম শঙ্খদার বাড়িতে। যেতে যেতে আমার মনে পড়ল বাদল বসুর কথা। আনন্দ পাবলিশার্সের কর্ণধার ছিলেন। সেই সন্ধ্যার কয়েক মাস আগে কলকাতা এয়ারপোর্টে নেমেই শুনেছিলাম তাঁর প্রয়াণের কথা। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে গিয়েছিলাম বাদলদার ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর মাঝখানে অনেকখানি করে চওড়া জায়গা। সেখানে বাদল বসুর অনুরাগী বন্ধুরা আছেন। শঙ্খদাকে দেখেছিলাম উদাস বিষণ্ন মুখে একটা চেয়ারে বসে আছেন। মুখ দেখে বোঝা যায়, দেখছেন সব কিছুই আবার কিছুই যেন দেখছেন না। তিনি যেন আছেন তাঁর নিজের জগতে।

    শঙ্খদার ফ্ল্যাটে গিয়ে সেই সন্ধ্যায় সেলিনা আপা, ইমানুল আর আমি বসে আছি তাঁর বসার ঘরে। শঙ্খদার জন্য আমি নিয়ে গেছি আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত আমার ‘নূরজাহান’ বইটির অখণ্ড সংস্করণ। সেলিনা আপা নিয়েছেন ফুল। শঙ্খদা তাঁর বেডরুমে ছিলেন। আমাদের একটু অপেক্ষাই করতে হলো। তারপর তিনি এলেন। সেই সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা। আমার মনে হলো, একজন দেবদূত এসে উপস্থিত হলেন আমাদের মাঝখানে। তারপর কত কথা, কত গল্প! অসামান্য একটি সন্ধ্যাবেলা কেটে গেল।

    করোনা কেড়ে নিল আমাদের এই দেবদূতকে। জন্মেছিলেন ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২, চলে গেলেন ২১ এপ্রিল ২০২১।

    বাংলাদেশটিকে বড় ভালোবাসতেন শঙ্খ ঘোষ। বরিশালের বানারীপাড়ায় ছিল আদি বাড়ি। জন্মেছেন চাঁদপুরে। বাবার কর্মসূত্রে ছেলেবেলার কতগুলো বছর কেটেছে পাবনায়। শঙ্খ ঘোষ তাঁর আসল নাম নয়। প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন যাদবপুর ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ৩৪-৩৫টি কবিতার বই, গদ্যগ্রন্থ ৪৮টি, শিশু-কিশোরদের বই ২৩টি। কত পুরস্কার, কত সম্মান তাঁর জীবনজুড়ে! বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’, ভারত সরকারের ‘পদ্মভূষণ’। সব কিছু পেছনে ফেলে চলে গেলেন শঙ্খদা। এই চলে যাওয়া কি আসলে চলে যাওয়া? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘যাওয়া তো নয় যাওয়া’। বাংলা কবিতায় শঙ্খ ঘোষ এক অমর নাম। চলে গিয়েও এই কবি রয়ে গেলেন বাংলা কবিতার অনেকখানি জায়গা আলোকিত করে।

    শঙ্খদা, যে অচিনলোকে আপনি চলে গেলেন, যেখানে অনন্তকাল আপনার বসবাস, সেই জগতেও যেন আপনার অন্তর ভরে থাকে সকালবেলার আলোয়।

  • স্বশিক্ষিত একজন আকবর আলী সরদারের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি


    মতিয়ার রহমান
    সমাজের প্রচলিত যে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে শিক্ষা লাভের কোনও সুযোগ হয় নাই, প্রাতিষ্ঠানিক কোনও শিক্ষা বলতে যা বুঝায় কোনও সার্টিফিকেট পর্যন্ত নাই, অথচ জ্ঞান বিস্তারের জন্য নিজের সার্মথ্য অনুযায়ী অনেক কিছু করেছেন স্বশিক্ষিত আকবর আলী সরদার, যশোর জেলার শার্শা উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলকে আলোকিত করেছেন পাকশিয়া গ্রামে জন্ম নেয়া এই মানুষটি। সমাজের মানুষের জ্ঞান বিস্তারের জন্য পাকশিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩৭ শতক জমি দান করেন ১৯৬৭ সালে, ইউনিয়ন পরিষদকে জমি ও ইট দিয়ে স্থায়ী ভিত্তির উপর দাঁড় করান। ১৯৭৭ সালে ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরীকে( পাকশিয়া) ১৭ শতক জমি দান করেন, যার উপর ভিত্তি করে আজ লাইব্রেরী সম্প্রসারিত হয়েছে।
    অর্থ আর দারিদ্রতা যখন গ্রামের মানুষের নিত্য সঙ্গী তখন তাদের জীবন রক্ষার্থে নিজের অর্থ দিয়ে একটি টিউবওয়েল স্থাপন করে গ্রামের মানুষের পানি সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিলেন এছাড়াও পুকুর খনন করে মানুষের সেবা করে গেছেন। নিজের অর্থকষ্ট থাকলেও মানুষকে ভালোবেসে নিজেকে তাদের সেবাই আত্মসমর্পন করেছিলেন আমৃত্যু পর্যন্ত। আপদমস্তক একজন সৎ, ত্যাগী, দানশীল ও পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন। তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ঠ্যের কারনে তিনি অন্যদের চেয়ে আলাদা করে বেঁচে থাকবেন।
    আকবর আলী সরদার ১৯৯০ সালের ১৮ এপ্রিল জীবনাবাসন হয় ঠিকই, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞলি জানানোর জন্য প্রতি বছর তাঁর সন্তানেরা তাঁর মৃত্যু বার্ষিকীতে বিনামুল্যে দেশের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। এবছর কভিডের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওযায় অনুষ্ঠানকরা সম্ভব হয় নাই। মরহুম আকবর আলী সরদারের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং তিনি আজীবন নিজে অর্থ কষ্টে থাকলেও মানুষের কল্যানে নিয়োজিত থাকতে ভালোবাসতেন , শত বাঁধা বিঘœ উপেক্ষা করে অংশ গ্রহন করতেন। প্রচন্ড কাজের মানুষ ছিলেন , কাজ দিয়ে তিনি প্রমান করতেন। ইউনিয়নের উন্নয়নের জন্য তিনি ছিলেন সামনের সারিতে। আলোকিত করেছেন সমাজ ও রাষ্ট্রকে, তিনি এখন আমাদের অনুভব আর অনুভুতির বাইরে কিন্তু খুবই বেদনাদায়ক। তাই এ সময়ে এ সমাজকে এগিয়ে নিতে এমন দানশীল, সৎ, ও পরিশ্রমী আলোকিত মানুষের স্পর্শ খুবই প্রয়োজন।

    লেখক: উন্নয়নকর্মী ও কলামিষ্ট।

  • আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

    আজ ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস

    জহুরুল কবীর : আজ ১৭ এপ্রিল। ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য এক দিন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদিনে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে।এ দিনটি এবার এসেছে নজিরবিহীন এক সঙ্কেটের মধ্যে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস বাঙালিকেও ঘরে থাকতে বাধ্য করছে।দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবার বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও এবার করোনাভাইরাসের কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগ সংক্ষিপ্তভাবে মুজিবনগর দিবস পালন করবে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে বাইরে থেকে লোক না যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা চালানোর পর ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়েছিল। জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন।ওই সরকারের শপথগ্রহণের স্থান বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর নামকরণ করা হয়। মুজিবনগরে ১২ জন আনসার সদস্য বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। মুজিবনগর সরকারের সফল নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকচক্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং বেআইনিভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। পরবর্তীতে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ন্যায়নীতিবহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ শুরু করলে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়ারলেসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।তারই ধারাবাহিকতায় ১০ এপ্রিল মেহেরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকার মুক্তাঞ্চলে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এক বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হন এবং স্বাধীন-সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন।এদিকে ঘরে বসেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস পালনের জন্য আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতাকর্মীসহ দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে সৃষ্ট সংকটের কারণে মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ নির্যাতিত মা-বোন, মুক্তিযুদ্ধের সকল সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ঘরে বসেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস পালনের জন্য আওয়ামী লীগের সকল স্তরের নেতাকর্মী এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনসমূহসহ সর্বস্তরের জনগণ ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।এর আগে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। সারা দেশে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি চলছে। এ ছুটি ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।

  • আবার জমবে মেলা……….

    রুবেল হোসেন

    বিখ্যাত গীতিকার ও সুরকার লোকমান হোসেন খানের আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা অঘ্রাণে নবান্নে উৎসবে …… গানটি বাংলা লোক সংগীতকে করেছে ঐশ্বর্যমন্ডিত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের যে কালজয়ী গানগুলো সীমাহীন দুঃখ ও অপার শঙ্কার মধ্যেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগাত, আশা জাগাত মনে যে একদিন প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন হবেই, তেমনি একটি গান প্রয়াত লোকমান হোসেন খানের ‘আবার জমবে মেলা বটতলা-হাটখোলা অঘ্রাণে নবান্নের উৎসবে……’। এমন অনেক গান বীর যোদ্ধাদের দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করত একাত্তরে, উৎসাহ যোগাত মহারণে ঝাপিয়ে পড়তে। সাহস জোগাত বাঁচার। বর্তমান সময়ে সকলের মাঝে উদ্দীপনা সঞ্চারের জন্য গানটি সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রায় দুই বছর সারাবিশ্ব মহামারীর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। মৃত্যুও মিছিল বেড়েই চলেছে। আমাদেও দেশেও ক্রমাগত মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার ফলে আজ থেকে ১ সপ্তাহের কঠোর লকডাউন ঘোষনা করেছে সরকার। সবকিছু না থামলেও স্বাভাবিক গতি শ্লথ হয়েছে । ঋতু পরিক্রমায় চৈত্র্য সংক্রান্তির মধ্য দিয়ে বিদায় নিয়েছে একটি বছর। পূর্ব আকাশে উদিত হয়েছে নতুন বছরের গনগনে সূর্যের। বছর ঘুওে এলো আরও একটি বৈশাখ, আরও একটি বছর। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এবারও মঙ্গলবার শোভাযাত্রার মাধ্যমে পহেলা বৈশাখকে বরণ কওে নিতে পারছি না। মহামারী করোনার কারণে গত বছর উৎসবে মাতেনি চারুকলা। বৈশাখী রঙের পোশাক, বাহারী সাজ আর মুখোশে সুসজ্জিত মঙ্গল শোভাযাত্রা রাজপথে বের হয় নি। এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ব্যস্ততা চোখে পড়েনি চারুকলার শিল্পীদের। এত সবের মধ্যেও আমরা আশাবাদী হতে চাই। আধার কাটবেই, প্রভাত একদিন আসবে। আবার আমরা শামিল হবো মঙø শোভাযাত্রায়, রমনার বটমূলে, ছায়ানট আর বকুলতলায়। বিষাদের সুর লোপ পাবে, চারিদিকে বাজবে আনন্দেও গান। আজ পহেলা বৈশাখ একটি সর্বজনীন আনন্দমুখর উৎসব, যে উৎসবে এ দেশের ধনী-গরিব, উচ্চ-নীচ সব মানুষ সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, ঝেড়ে ফেলে সব সঙ্কীর্ণতা-মলিনতা ও পশ্চাদমুখিতা দৃপ্ত পদভারে এগিয়ে যাব সম্মুখপানে। মহামারী করোনার পর ‘আবার জমবে মেলা, বটতলা-হাটখোলা…। নতুন আশার আলো নিয়ে হাজির বাংলা নববর্ষ। বাংলাদেশ সহ পার্শ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও এই দিনটি আনন্দ ও উল্লাসের সঙ্গে পালিত হয়। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের ১৪ বা ১৫ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ হিসেবে পালিত হয়। ১৪২৮ সনের শেষ দিন চৈত্র সংক্রান্তির পর শুরু হলো বাংলা নববর্ষ ১৪২৯।
    বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে মোঘল সম্রাট আকবরের নামই বেশি শোনা যায়। তবে অনেকের মতে, বাংলা পঞ্জিকা উদ্ভাবক সপ্তম শতকের রাজা শশাঙ্ক। পরবর্তী কালে সম্রাট আকবর সেটিকে খাজনা ও রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশে ব্যবহার করতে শুরু করেন। আকবরের সময় প্রচলিত ক্যালেন্ডারের নাম ছিল তারিখ-এ-এলাহি। মনে করা হয়, বাংলা বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে। যেমন- বিশাখা নক্ষত্র থেকে বৈশাখ, জায়ীস্থা থেকে জৈষ্ঠ্য, শার থেকে আষাঢ়, শ্রাবণী থেকে শ্রাবণ।
    ভারতবর্ষে মোঘল শাসনকালে খাজনা দিতে সমস্যায় পড়তেন কৃষকরা। খাজনা শোধে কৃষকদের যাতে কোনও অসুবিধা না হয়, সে কারণে বর্ষ পঞ্জিতে সংস্কার আনেন সম্রাট আকবর। শুরুতেই এই বছরের নাম দেওয়া হয়েছিল ফসলি সন। পরে তা বঙ্গাব্দে পরিণত হয়।
    পহেলা বৈশাখ শহুরে সংস্কৃতি না গ্রামীন সংস্কৃতি সে আলোচনায় যেয়ে লাভ নেই। গ্রামে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে উঠার সুবাদে ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি কালি মন্দির সংলগ্ন গায়ের প্রাচীন বটতলায় মেলা বসতো। মেলায় গ্রামীণ যাত্রাপালা, জারি গাণের আসর বসতো। আমরা মেলায় যেতাম। মেলার সবথেকে আকর্ষনীয় ছিলো মিঠাই খাওয়া ও নাগরদোলায় চড়া। টেপা পুতুলের বাহারি পশরা সাজিয়ে বসতে দোকানিরা। কিনতে ভিড় জমাতাম আমরা। জমে উঠতো রীতিমত প্রতিযোগীতা। পহেলা বৈশাখ গায়ের দোকানগুলোও সাজতো বাহারি সাজে। মাইকে বাজতো বাংলা লোক সংগীত, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালী, পুথি, বাউল ইত্যাদি। পুরাতন হিসাব মিটিয়ে নববর্ষের নতুন খাতা খুলতেন দোকানীরা। চিরায়ত সে প্রথা হালখাতা নামে পরিচিত।
    কালক্রমে অপসংস্কৃতি, কুশিক্ষার প্রভাবে, বিশ্বায়নের প্রভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে নববর্ষের সেই আমেজ। আগে যেখানে মেলা বসতো তার সিংহভাগ জায়গায় এখন মেলা বসে না। হালখাতা তো এখন সারা বছর হয়। কিন্তু দোকান থেকে আর গ্রামীন লোকসুর ভেসে আসে না। অশ্লীল চেচামেচি আর নারী বিদ্বেষী কথায় কান ঝালাপালা করে। বারবার আঘাত এসছে বাঙলা সংস্কৃতির উপর। অস্তাকূড় থেকে উঠে আসা একদল খল নববর্ষ উদযাপন করা হারাম ফতোয়া দিয়ে নিজ নিজ অনুসারীদের তা বর্জন করার আহবান জানিয়েছেন। এই সব শয়তানেরা বহুবার বিশ্বশান্তির মঙ্গল কামনায় নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয় তা প্রতিহতের হুমকি দিয়েছে। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আকা দেয়ালচিত্র রাতের আধাওে পোড়া মবিল দিয়ে মুছে দেয় মৌলবাদীরা। ২০০১ সালের পহেলা বৈশাখের দিন ভোরে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের ঘটনাস্থলে দুইটি বোমা পুঁতে রাখা হয় এবং পরে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে তা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে একটি এবং ১০-১৫ মিনিট পর আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হয়।
    বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই সাতজন প্রাণ হারান এবং ২০-২৫ জন আহত হন। পরে আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আরো তিন জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। যে ঘটনায় হুজি নেতা মুফতি হান্নান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন তাদের উদ্দেশ্য বাঙালী সংস্কৃতি ধ্বংস করে দেশকে পাকিস্তান- আফগানিস্তান বানানো। পরবর্তীতে এই ঘটনায় মুফতি হান্নানকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয়।

    এত কিছুর পরেও তারুণ্য থামেনি, বীর বাঙালী থামেনি। মঙ্গল শোভাযাত্রা থামেনি। মৌলবাদীদের উদ্ভট চেহারা আর হুমকিতে কর্ণপাত না করে বাঙালী সম্মুখপাণে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের কারণে গতবছর মঙ্গল শোভাযাত্রা হয় নি। করোনার প্রকোপ ও সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে এবারও মঙ্গল শোভাযাত্রা হবে না। রমনার বটমূল, বকুল তলা সুরের মুর্ছনায় ভাসবে না। তারপরও আমি আশাবাদী আগামী বছর আমরা নতুন উদ্যামে আবার মিলিত হবো। আবার জাগবে প্রাণের গান। আজ শুভ নববর্ষ পহেলা বৈশাখ। বৈশাখ তুমি এসো শান্তির বাতাশ নিয়ে। এসে মহামারীযুক্ত ধরাকে ধুইয়ে দাও। গ্লানি জরা সবকিছু মুছে দাও। এবারই বিদায় হোক মহামারী। আবার জমুক প্রাণের মেলা। বারবার কানে ভাসছে আবার জমবে মেলা……
    আবার মেলা জমবে সবকিছু স্বভাবাবিক হবে এ আমার দৃড় বিশ্বাস।

    লেখক: সাধারণ সম্পাদক, আশাশুনি উপজেলা সাহিত্য পরিষদ

  • বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রতি আস্থাহীনতা

    মো. জাকির হোসেন
    বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ৯০ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশের মানুষ ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা ইসলামি আইন ও বিধি-বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনায় বিশ্বাসী নয় এমন রাজনৈতিক দলকে অধিক পছন্দ করে, তাদের ভোট দেয়। ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রতি তাদের আস্থা নেই। এই অনাস্থার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। অবিভক্ত ভারতে মুসলিম লীগ নেতাদের অদূরদর্শিতা, একগুঁয়েমি, হঠকারিতা ও ষড়যন্ত্রের কারণে ভারত ভাগের সময় বাংলাদেশ তার প্রাপ্য অনেক ভূ-খন্ড হারিয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন চেয়েছিলেন সাময়িকভাবে তিনি ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেরই গভর্নর জেনারেল থাকবেন। ভারত মেনে নিলেও জিন্নাহ রাজি হলেন না, তিনি নিজেই পাকিস্তানের গভর্নর হলেন। এতে মাউন্টব্যাটেন ক্ষেপে গিয়ে পাকিস্তানের সর্বনাশ করলেন। যদিও র‌্যাডক্লিফকে ভার দেওয়া ছিল ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণ করতে, তথাপি রাগান্বিত মাউন্টব্যাটেন গোপনে কংগ্রেসের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি ম্যাপ নির্ধারণ করেছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন। এরূপ মনে করার পেছনে প্রধান যুক্তি হলো, মওলানা আকরাম খাঁ মুসলিম লীগের সভাপতি হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার রক্তের উপর দিয়ে বাংলা ভাগ হবে। আমার জীবন থাকতে বাংলা ভাগ করতে দেব না। সমস্ত বাংলাই পাকিস্তানে যাবে।’ কিন্তু ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের স্থলে নাজিমুদ্দিন সাহেব নেতা নির্বাচিত হয়ে যে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেন তাতেই বাংলাদেশের কপাল পুড়লো। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘নাজিমুদ্দিন সাহেব মুসলিম লীগ বা অন্য কারো সাথে পরামর্শ না করেই ঘোষণা করলেন ঢাকাকে রাজধানী করা হবে। তাতেই আমাদের কলকাতার ওপর আর কোনও দাবি রইল না। এদিকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েছিলেন, কলকাতা নিয়ে কী করবেন?’ ইংরেজ তখনও ঠিক করে নাই কলকাতা পাকিস্তানে আসবে, না হিন্দুস্তানে থাকবে। আর যদি কোনও উপায় না থাকে তবে একে ‘ফ্রি শহর’ করা যায় কিনা? কারণ, কলকাতার হিন্দু-মুসলমান লড়বার জন্য প্রস্তুত। যেকোনও সময় দাঙ্গা-হাঙ্গামা ভীষণ রূপ নিতে পারে। কলকাতা হিন্দুস্তানে পড়লেও শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত পাকিস্তানে আসার সম্ভাবনা ছিল। হিন্দুরা কলকাতা পাওয়ার জন্য আরও অনেক কিছু ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো।’ একজন ইংরেজ গভর্নর হয়ে ঢাকা আসতে রাজি হচ্ছিল না, কারণ ঢাকায় খুব গরম। তার উত্তরে মাউন্টব্যাটেন যে চিঠি দিয়েছিলেন তাতে লেখা ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে দুনিয়ার অন্যতম পাহাড়ি শহর, থাকার কোনও কষ্ট হবে না। অর্থাৎ দার্জিলিংও আমরা পাব। তাও নাজিমুদ্দিন সাহেবের এই ঘোষণায় শেষ হয়ে গেল। যখন গোলমালের সম্ভাবনা থাকল না, মাউন্টব্যাটেন সুযোগ পেয়ে যশোর জেলায় সংখ্যাগুরু মুসলমান অধ্যুষিত বনগাঁ জংশন কেটে দিলেন। নদীয়ায় মুসলমান বেশি, তবু কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট জংশন ওদের দিয়ে দিলেন। মুর্শিদাবাদে মুসলমান বেশি কিন্তু সমস্ত জেলাই দিয়ে দিলেন। মালদহ জেলায় মুসলমান ও হিন্দু সমান সমান তার আধা অংশ কেটে দিলেন, দিনাজপুরে মুসলমান বেশি, বালুর ঘাট মহকুমা কেটে দিলেন যাতে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং হিন্দুস্তানে যায় এবং আসামের সাথে হিন্দুস্তানের সরাসরি যোগাযোগ হয়। উপরোক্ত জায়গাগুলো কিছুতেই পাকিস্তানে না এসে পারত না। এদিকে সিলেটে গণভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ করিমগঞ্জ মহকুমা ভারতবর্ষকে দিয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম, আসামের কাছাড় জেলা ও সিলেট জেলা পাকিস্তানের ভাগে না দিয়ে পারবে না।’ নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়। যে কলকাতা পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল সেই কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম। কেন্দ্রীয় লীগের কিছু কিছু লোক কলকাতা ভারতে চলে যাক এটা চেয়েছিল বলে আমার মনে হয়। অথবা পূর্বেই গোপনে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী নেতা হলে তাদের অসুবিধা হতো তাই তারা পেছনের দরজা দিয়ে কাজ হাসিল করতে চাইল।’
    ইসলাম ধর্মের নামে রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র সেই সময় ছিল, এখনও চলছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার মানুষকে ধর্মের দোহাই দিয়ে শোষণ-নির্যাতন শুরু হলো। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি স্বায়ত্তশাসনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হলে আবারও ধর্মের নামে মনগড়া ফতোয়া দিল ইসলামপন্থী দলগুলো। ইসলাম রক্ষা করতে হলে পাকিস্তান রক্ষা করতে হবে জিগির তুললো। ধর্মজীবীদের মিথ্যার জাল ছিন্ন করে জেগে উঠলো মানুষ, শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। ইসলাম ধর্মের ভয়ঙ্কর অপব্যবহার করলো পাকিস্তান ও তাদের এ দেশীয় দোসর ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। ইসলাম রক্ষার নামে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম নৃশংসতম গণহত্যা, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করল। ইসলাম ধর্মের নামে মিথ্যাচার, মনগড়া ফতোয়া কেবল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেই নয় এর আগেও ইসলামপন্থী দলগুলো এমন করেছে। চুয়ান্নর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর বিপরীতে মুসলিম লীগ প্রার্থী ছিলেন ওয়াহিদুজ্জামান। নির্বাচনে মুসলিম লীগ কিভাবে ধর্মের অপব্যবহার করেছে সে বিষয়ে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জামান সাহেব ও মুসলিম লীগ যখন দেখতে পারলেন তাদের অবস্থা ভালো না, তখন এক দাবার ঘুঁটি চাললেন। অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। গোপালগঞ্জে আমার নিজ ইউনিয়নে পূর্ব বাংলার এক বিখ্যাত আলেম মওলানা শামসুল হক সাহেব জন্মগ্রহণ করেছেন। আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তিনি ধর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। আমার ধারণা ছিল, মওলানা সাহেব আমার বিরুদ্ধাচরণ করবেন না। কিন্তু এর মধ্যে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করলেন এবং আমার বিরুদ্ধে ইলেকশনে লেগে পড়লেন। ঐ অঞ্চলের মুসলমান জনসাধারণ তাকে খুবই ভক্তি করত। মওলানা সাহেব ইউনিয়নের পর ইউনিয়ন স্পিডবোট নিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন এবং এক ধর্ম সভা ডেকে ফতোয়া দিলেন আমার বিরুদ্ধে যে, ‘আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।’ সাথে শর্ষিনার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে নেমে পড়লেন এবং যত রকম ফতোয়া দেয়া যায় তাহা দিতে কৃপণতা করলেন না।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নির্বাচনে ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব প্রায় দশ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন এবং সেই সাথে মুসলিম লীগও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ধর্মের অপরাজনীতির বিষয়ে এদেশের মানুষের আস্থাহীনতার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে যে, জনগণকে ‘ইসলাম ও মুসলমানের নামে’ শ্লোগান দিয়ে ধোঁকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালোবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না।’
    ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি এদেশের মানুষের আস্থাহীনতার কারণেই একসময়ের অত্যন্ত দাপুটে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো বিলুপ্ত বা ‘প্যাড’সর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে, কিংবা অন্য অ-ইসলামিক দলের কাঁধে সওয়ার হয়ে ৩-৪ শতাংশ ভোট নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর এমন আস্থা সংকটের সময়ে দৃশ্যপটে অরাজনৈতিক মোড়কে আবির্ভূত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। আসলে এটি অরাজনৈতিক সংগঠন কি? আমার বিবেচনায় অবশ্যই না। হেফাজতের কর্মকা- বিবেচনা করলে, এর নেতৃত্বে যারা আছেন সেদিকে দেখলে সহজেই অনুমেয় অরাজনৈতিক মোড়কটা একটা ধোঁকা মাত্র। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ‘প্রয়াত শাহ আহমদ শফীর জীবনকর্ম, অবদান’ শীর্ষক আলোচনা ও মতবিনিময় সভায় হেফাজতের সাবেক নেতারা দাবি করেন, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে সংঘটিত পুরো ঘটনার দায়ভার হেফাজতে ইসলামের ওই সময়ের মহাসচিব ও বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীর। তাঁরা অভিযোগ করেছেন- তৎকালীন আমির শাহ আহমদ শফীকে না জানিয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীদের রাতভর শাপলা চত্বরে রেখে দেন বাবুনগরী। শফী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলবে; কিন্তু তিনি হুজুরকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। তার ধারণা ছিল, সারারাত শাপলা চত্বরে অবস্থান নিতে পারলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী নামতে বাধ্য হবে। সভায় শাহ আহম্মদ শফীর জীবনের শেষ তিনদিনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বক্তারা অভিযোগ করেন, হাটহাজারী মাদ্রাসায় হামলা, ভাঙচুর হয়েছে। শফীর প্রতি চরম বেয়াদবি করা হয়েছে। গৃহবন্দি করে নির্যাতনের মাধ্যমে তাকে শাহাদাত বরণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। খাবার-ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, অ্যাম্বুলেন্স বন্ধ ছিল- এগুলোই তার মৃত্যুর মূল কারণ।
    স্বভাবতই প্রশ্ন, একটি অরাজনৈতিক সংগঠন সরকার উৎখাতের জন্য মতিঝিলে মরিয়া হয়ে উঠেছিল কেন? আহম্মদ শফীর নেতৃত্ব পরিবর্তনে এমন নিষ্ঠুর ‘অনৈসলামিক’ পন্থা বেছে নেওয়া হয়েছিল রাজনীতির কোন অদৃশ্য হাতের ইশারায়?
    বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের অনেক নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কোভিডের কারণে কয়েকজন এসেছেন, অন্যরা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদি বিজেপির নেতা হিসাবে নয়,ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে উদযাপনে যোগ দিতে এসেছেন। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ভারতের অবদান অবিস্মরণীয়। সুবর্ণজয়ন্তীর সময়ে যিনিই ভারতের সরকার প্রধান থাকতেন তিনি আমন্ত্রিত হতেন। মোদির বাংলাদেশে আগমনকে কেন্দ্র করে হেফাজতের কয়েক দিনব্যাপী তা-বের ফলে এর অরাজনৈতিক খোলসটা পুরোপুরি খুলে গিয়েছে। সৌদি আরব, জর্ডান, ওমান, বাহরাইন, ফিলিস্তিন, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মোদি অনেক মুসলিম দেশ সফর করেছেন। কোথায়ও কি মোদির আগমন ঠেকাতে বিরোধিতা, তা-ব হয়েছে? অবশ্যই না। বরং, সংযুক্ত আরব আমিরাত সেদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘জায়েদ মেডাল’ দিয়েছে মোদিকে। এছাড়াও আবুধাবিকে নরেন্দ্র মোদির ‘দ্বিতীয় বাসস্থান’ হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে বাহরাইনও মোদিকে সম্মাননা দিয়েছে। তারা মোদিকে জাতি গঠনে অগ্রগতির স্বীকৃতিস্বরূপ ‘কিং হামাদ অর্ডার অব দ্য রেনেসাঁ’ পুরস্কার দিয়েছে। ২০১৯ এর ডিসেম্বরে মোদি সৌদি আরব সফর করেছেন। রিয়াদ ভারতের সাথে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বের’ কথা ঘোষণা করে এ সময়। সৌদি আরব ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত মজবুত করতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানও ভারত সফর করেছেন এবং বিরাট অংকের সৌদি বিনিয়োগের ঘোষণা করেছেন। দশকের পর দশক ধরে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর পাকিস্তান এখন ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে অতি তৎপর হয়ে উঠেছে। পাক সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া গত ২১ মার্চ অতীতের বিরোধকে কবর দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও ভারতের সাথে তার দেশের শান্তি স্থাপনের প্রস্তাব দেন। প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাপ্রধানের কথার প্রতিধ্বনি করেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশীও। পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের সরকার ভারতের সাথে বিরোধের বদলে সহাবস্থান এবং সহযোগিতার সম্পর্কে ইচ্ছুক। তাহলে মোদির বাংলাদেশ আগমনকে কেন্দ্র করে হেফাজতের তা-বের পেছনে কি রহস্য? হরতালের নামে ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও, ধ্বংসযজ্ঞ ইসলাম কি সমর্থন করে? হেফাজতে ইসলাম ভয়ংকর তা-ব চালিয়ে সারা দেশে হাজার কোট টাকার সম্পদ ধ্বংস করেছে। তা-বের একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। হরতালের দিন হেফাজতে ইসলাম নেতাকর্মীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার, প্রেসক্লাব, জেলা পরিষদ ভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা পুলিশ লাইন, সার্কিট হাউস, ফায়ার সার্ভিসের কার্যালয়, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, সরাইলে হাইওয়ে থানা, সদরের খাঁটিহাতা থানা, রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি, সদর থানাধীন দুই নম্বর পুলিশ ফাঁড়ি, জেলা আনসার-ভিডিপি কার্যালয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা কার্যালয়, জেলা প্রশাসন আয়োজিত উন্নয়ন মেলা, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স, ব্যাংক এশিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর কার্যালয়, মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র, দলিল লেখক সমিতির কার্যালয়, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ ভাষা চত্বর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন, আব্দুল কুদ্দুস মাখন মুক্তমঞ্চ, জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কার্যালয় ও বাড়ি, জেলা আওয়ামীগ নেতা ও আয়কর উপদেষ্টা জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়ার কার্যালয়, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির বাড়ি, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের বাড়ি, বিজয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির অফিস, বিজয়নগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের বাসভবন ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের বাড়ি ভাংচুর করেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে পুড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও ফাঁড়িতে থাকা ১৮টি মাইক্রোবাস এবং মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া সিভিল সার্জন, মৎস্য কর্মকর্তা ও জেলা পরিষদ কার্যালয়ের মধ্যে থাকা প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলীর তিনটি গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কালীবাড়ি মন্দিরের প্রতিমা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেন, ঢাকা থেকে সিলেটগামী পারাবাত এক্সপ্রেস ট্রেন ভাংচুর করেছে। প্রেসক্লাবের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামি ও চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের প্রতিনিধির ওপর হামলা করা হয়েছে।
    হেফাজতে ইসলাম সেদিন ইসলাম হেফাজত দূরে থাক ভয়ংকরভাবে কুরআন ও হাদিসের বিধান লংঘন করে তা-ব চালিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ, বিপর্যয়, নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হত্যার চেয়েও বড় পাপ। মহান রব পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর’। (সূরা বাকারা: ১৯১) ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিরা আল্লাহর অনুগ্রহ বঞ্চিত। আল্লাহ বলেন, ‘ৃআল্লাহ ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের ভালোবাসেন না।‘ (সুরা মায়িদা:৬৪) ইসলাম অন্যায়ের প্রতিকার অন্যায় পথে করতে নিষেধ করেছে। এ বিষয়ে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘ভালো কাজ এবং মন্দ কাজ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো’। (সুরা ফুসসিলাত: ৩৪) হাটহাজারীতে হেফাজত কর্মী নিহত হওয়ার প্রতিকার হিসাবে ইসলাম কি আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া অনুমোদন করে? রাস্তা বন্ধ করতে ইটের দেওয়াল তুলে দেওয়া, মসজিদের পরিবর্তে রাস্তায় নামাজ আদায় ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কুরআন তিলাওয়াত করতে রাস্তায় বসিয়ে দেওয়া ইসলাম সমর্থন করে কি? রাসুল (সা.) পথিকের হক নষ্ট করতে নিষেধ করে বলেছেন এমন কোন কাজ না করা যাতে তার দ্বারা কোনও চলাচলকারীর সামান্য কষ্টও হয়। (আবু দাউদ, ৪৮১৯; মুসনাদে বাযযার, ৫২৩২; মুসলিম, ২১৬১; মুসনাদে আবি ইয়ালা, ৬৬০৩)। ইসলামের যুদ্ধনীতি প্রতিরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক নয়, এমনকি প্রতিশোধমূলকও নয়। ইসলাম এমনকি যুদ্ধের সময়ও আসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে, বাড়িঘর ও উপাসনালয় ধ্বংস করতে নিষেধ করেছে। (বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৯/৯০) অথচ হেফাজত অনেক বাড়িঘর ও অসামরিক স্থাপনা পুড়িয়েছে, ভাংচুর করেছে। বুখারি, মুসলিমসহ প্রায় ৬০টির উপরে হাদিসের কিতাবে পাওয়া যায়, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলমানগণ নিরাপদ থাকে সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলিম। আর যাকে মানুষ তাদের জান ও মালের জন্য নিরাপদ মনে করে সে-ই প্রকৃত মুমিন’। (তিরমিযী,২৫৫১; নাসাঈ, ৪৯০৯) অন্য হাদিসে মুসলমানের পরিবর্তে মানুষ শব্দটি এসেছে (সহীহ ইবনে হিব্বান)। রাসুল (সা.)-এর হাদিসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হেফাজত কর্মীদের হাতগুলো কী ভয়ানক তা-ব চালালো। রাসুল (সা.) মানুষকে ভয় দেখাতে এবং শাসাতে নিষেধ করেছেন। কেননা, তা মানুষের অধিকার ও মর্যাদার পরিপন্থী। তিনি বলেন, ‘কোনও মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমকে ভয় দেখানো বৈধ নয়।’ (আবু দাউদ, ৫০০৪) অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কখনও আগে অস্ত্র উত্তোলন করো না বা অস্ত্রের ভয়ভীতিও প্রদর্শন করো না।’ (মুসনাদে আহমাদ, ২৭২৮) হেফাজত কর্মীরা লাঠি, রামদা, কুড়াল, শাবল, কিরিচ, গুলতি, ঘোড়া, হেলমেট নিয়ে হরতালের শুরুতেই রাস্তা দখল নেয়। হেফাজতের পিকেটাররা অনবরত ইটপাটকেল ছুড়তে থাকলে ট্রেনের যাত্রীরা আত্মরক্ষার জন্য ট্রেনের মেঝেতে শুয়ে পড়েন। তারপরও ইটপাটকেলের আঘাতে অনেক যাত্রী আহত হন। শিশুর প্রতি আচরণ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শিশুকে স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান দেখায় না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (তিরমিজি, ১৯২১)। অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেবল হতভাগ্য ব্যক্তির হৃদয় থেকেই দয়া তুলে নেওয়া হয়।’ (তিরমিজি, ১৯২৩)। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ইসলামের নামে শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে হেফাজত। খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা যারা জ্বালিয়ে দিয়েছে ওই হামলাকারীদের মধ্যে ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু ও কিশোর। এ সময় পুলিশের গুলিতে নিহত দুজনের একজন শিশু। আহতদের মধ্যেও কয়েকটি শিশু রয়েছে।
    মোদি বিরোধিতায় এই যে জীবন হানি ও হাজার কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হলো, জমির দলিলসহ নানা সরকারী নথি ধ্বংসের কারণে নিশ্চিত হয়রানি, ভোগান্তি ও ভয়ংকর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলো তাতে মোদির কি ক্ষতি হলো? বরং শাপে বর হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে হয়ত মোদির দলের বিজয়গাথা রচিত হলো। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমারের জনগণ সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। পুলিশ, সেনাবাহিনীর গুলিতে শত শত লোক নিহত হয়েছে কিন্তু তারা সরকারি-বেসরকারি সম্পদের ওপর এমন তা-ব চালিয়েছে? অথচ ইসলাম হেফাজতের ধ্বজাধারীরা ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে কী নারকীয় তা-বে মেতে উঠলো। ফ্রান্সে জিহাদের নামে একজন অমুসলিমকে গলা কেটে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ফরাসি সরকার এমন এক আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে যার দ্বারা ফরাসি সরকার মসজিদসহ যেকোনও ইসলামি কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে পারবে। মোদিবিরোধী তা-বের সময় হেফাজতিরা ভারতের ৩০ কোটি মুসলমানের নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করেছে বলে প্রতীয়মান হয় না। ইসলামকে অপরাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার, ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যা, মিথ্যাচার, হঠকারিতা, অদূরদর্শিতা, বিদ্বেষ, উগ্রতা, ঘৃণা ছড়ানো, ভয়ংকর সাম্প্রদায়িকতা, ষড়যন্ত্র, ইত্যাদি কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ইসলামি রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে।

    লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

  • কী পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সেই ইতিহাস বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন?

    কী পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু সেই ইতিহাস বিখ্যাত ভাষণ দিয়েছিলেন?


    ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন। ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে পাকিস্তানি দস্যুদের কামান-বন্দুক-মেশিনগানের হুমকির মুখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ওই দিন বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
    ১৯৭০-এর ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯ আসনের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি আসন বাকি ২টি আসন পায় পিডিপি। ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ’৭১-এর ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপি নেতা জেড এ ভুট্টো এবং পাকিস্তান সামরিক চক্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে ষড়যন্ত্র শুরু করে।
    ১ মার্চ : এই দিনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার কথা ছিল পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের।সারা দেশের মানুষ তাই রেডিও আর টেলিভিশন খুলে বসে থাকলো তার কথা শোনার জন্য।কিন্তু দেশবাসীকে হতাশ করে,ইয়াহিয়ার যায়গায় অন্য আরেকজন এসে ঘোষণা করলো,”পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাতিল করেছেন।তিনি পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিকে একটি গভীর রাজনৈতিক সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছেন।”
    তখন তীব্র ক্ষোভে ফেটে পরলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।তিনি বাঙালি জনগণের মুক্তির ডাক দিলেন।সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেন এটি কোন গণতন্ত্র নয় বরং এটি পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।আমরা বাঙালিরা ঘৃণাভরে এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করলাম এবং ২ মার্চ ঢাকা ও ৩ মার্চ সারাদেশব্যাপী বাংলার সাধারণ মানুষ হরতাল পালন করবে।পরবর্তী দিক নির্দেশনার জন্য আপনারা(বাঙালিরা) ৭ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করুণ। এরপর বাঙালি জাতির ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য স্বাধীনতার স্লোগান দিল, “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।” শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন ।গঠিত হলো স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ।
    ২ মার্চ : ঢাকা এদিন ছিলো হরতালের নগরী, মিছিলের নগরী এবং কারফিউর নগরী। দিনের হাইলাইট ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন। সকাল থেকেই মিছিল ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়মুখী। স্মরণকালে এমন ছাত্র সমাবেশ দেখেনি কেউ! নিউমার্কেটের মোড় থেকে নীলক্ষেতের সড়ক দিয়ে পাবলিক লাইব্রেরি পর্যন্ত যার বিস্তার। এদিন বটতলায় ওড়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা, ওড়ায় ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ। সমাবেশ শেষে বিশাল এক মিছিল রড ও লাঠি উচিয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিন করে। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে এদিন থেকে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান কথাটা একরকম হাওয়া হয়ে যায় বাঙালীদের মুখ থেকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সন্ধ্যায় তার প্রেস কনফারেন্সে বারবার বাংলাদেশ উচ্চারণ করেন।
    সারা শহরে সরকারের পেটোয়া বাহিনী হরতাল ঠেকাতে মাঠে নামে। পঞ্চাশ জনের মতো গুলিবিদ্ধ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। এদের বেশীরভাগই তেজগাঁও এলাকার। তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুলের ছাত্র্ আজিজ মোর্শেদ ও মামুনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে আনার পর আজিজ মারা যান।
    সামরিক আইন প্রশাসকের তরফে এদিন কারফিউ জারি করা হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে পরদিন সকাল ৭টা পর্যন্ত এই কারফিউ পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত অব্যহত থাকবে বলে ঘোষণা করা হয়। সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলন করেন শেখ মুজিবুর রহমান যাতে নিরস্ত্রদের উপর গুলি বর্ষণের তীব্র নিন্দা করা হয়। পরদিন ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারাদেশে অর্ধদিবস (ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা) হরতালের ডাক দেন মুজিব।পরদিন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বৈঠক শেষে পল্টনে এক সমাবেশের ঘোষণা দেন তিনি।
    ৩ মার্চ : নিহতদের স্মরণে পালন করা হয় শোক দিবস । পল্টনে ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের সভায় প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমি থাকি আর না থাকি, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন থেমে না থাকে। বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি না থাকলে- আমার সহকর্মীরা নেতৃত্ব দিবেন। তাদেরও যদি হত্যা করা হয়, যিনি জীবিত থাকবেন, তিনিই নেতৃত্ব দিবেন। যে কোনো মূল্যে আন্দোলন চালাইয়া যেতে হবে- অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।” বঙ্গবন্ধু আগেই ঘোষণা করেছিলেন, ৭ মার্চ রোববার রেসকোর্স ময়দানে তিনি পরবর্তী কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন।
    ৪ মার্চ : গন বিক্ষোভে টালমাটাল ছিল ৪ মার্চ ১৯৭১। দিন যতই যাচ্ছিল এক দফার দাবী অথ্যাৎ স্বাধীনতার আকাঙ্খার তীব্রতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল । এ দিন সামরিক জান্তার সান্ধ্যআইন ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ । খুলনায় বাঙালী অবাঙালীদের মাঝে সংঘর্ষ হয় এই দিন। ঢাকায় আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় হরতালে দমন পীড়নের নিন্দা জানানো হয় । লাগাতার হরতালের এই দিনে ঢাকা সহ সারা দেশ অচল হয়ে পড়ে । পূর্ব পাকিস্হান মহিলা পরিষদের নেত্রী কবি সুফিয়া কামাল ও মালেকা বেগম যৌথ বিবৃতিতে ৬ ই মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের আহব্বান জানান । এই দিনে ঘটে এক গুরুত্বপূর্ন ঘটনা । এই দিনে রেডিও পাকিস্হান ঢাকা’র নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’। সে দিনের সেই ঘটনা চলমান আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে ।যা আমাদের মুক্তির পথকে এগিয়ে নেয় ।
    ৬ মার্চ : ৭ মার্চের একদিন আগে অর্থাৎ ৬ মার্চ জে. ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। ৬ মার্চ এও ঘোষণা করা হলো যে, ২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে। পরিস্থিতির চাপে ভীতসন্ত্রস্ত পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সদর দপ্তর থেকে বিভিন্নভাবে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে এই মেসেজ দেয়া হয় যে, ৭ মার্চ যেন কোনোভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা না করা হয়। ৭ মার্চ জনসভাকে কেন্দ্র করে কামান বসানো হয়। এমনকি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত রাখা হয়। মেজর সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ৭ মার্চের জনসভার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ নেতাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, “পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে। বিশ্বাসঘাতকদের (বাঙালি) হত্যার জন্য ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সবই প্রস্তুত রাখা হবে। প্রয়োজন হলে ঢাকাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হবে। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে না।”
    ৭ মার্চ : এমন এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ রেসকোর্সে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।

  • ৭ মার্চের ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা


    বিভুরঞ্জন সরকার
    ৭ মার্চে বাঙালি জাতির জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক বিশাল সমাবেশে ভাষণ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পথ রচনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মাচের ঐতিহাসিক ভাষণটিকে ইউনেস্কো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভাষণটিকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে যেসব তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্য রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ এবং পরবর্তী প্রজন্ম যাতে তা থেকে উপকৃত হতে পারে সে লক্ষ্যেই এ তালিকা প্রণয়ন করে ইউনেস্কো।
    ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ এসেছিল এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে। পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের ইতিহাস ছিলো শোষণ-বঞ্চনার। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কৃত্রিম রাষ্ট্রটি শুরু থেকেই ছিল বাঙালিবৈরি। বাঙালি তার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে গেছে অব্যাহতভাবে। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে ওঠেন বাঙ্গালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পরই এটা স্পষ্ট হচ্ছিল যে, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তারা নানা কৌশলে কালক্ষেপণ করছিল আর বাঙালির বিরুদ্ধে হামলে পড়ার জন্য সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। বঙ্গবন্ধু এসব জানতেন। তাই ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বাঙালি জাতিকে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়েছেন।
    পৃথিবীর সেরা রাজনৈতিক ভাষণের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ব্যতিক্রমী এবং অনন্য। অন্য সব সেরা ভাষণ ছিল লিখিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি লিখিত ছিল না। তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার মনের কথা জনতার উদ্দেশ্যে বলেছেন। প্রায় ১৯ মিনিটের ভাষণ শেখ মুজিব শুরু করেছিলেন জনতাকে ‘আপনি’ সম্বোধনের মাধ্যমে। বলেছিলেন ‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন’। তিনি জনতাকে তার সহযাত্রী মনে করেছিলেন। যে সহযাত্রীর সব কিছু সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল। উভয়ের দুঃখ-বেদনা আশা-আকাঙ্ক্ষা এক। কেউ কারও চেয়ে কম জানে না বা বোঝে না। প্রকৃত নেতা কখনও তার কর্মী-সমর্থকদের ‘কম বুদ্ধিমান’ মনে করেন না। যেমন করেননি বঙ্গবন্ধু। তিনি শুধু বাস্তবতার দিকগুলো তুল ধরেছেন। সাধারণ মানুষের অনুভূতিগুলোকে নিজের অনুভূতির সঙ্গে ঝালিয়ে নিয়েছেন। একপর্যারে উপস্থিত জনতার সঙ্গে এতোটাই একাত্ম হয়ে পড়েছেন, কখন যে জনতা ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে পরিণত হয়ে গেছে তা না-বক্তা, না-শ্রোতা কেউই খেয়াল করেননি। ভাষণের একপর্যায়ে তিনি বলেছেন:
    ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।’
    এই বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান একটি গেরিলাযুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। ভাষণ শেষে স্বাধীনতার পক্ষে শ্লোগানমুখর হয়ে উঠেছিলো ঢাকার রাস্তাগুলো।
    বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ওই ভাষণ দিয়েছিলেন। একদিকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, অন্যদিকে তাকে যেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে অভিহিত করা না হয়, সেদিকেও তার সতর্ক দৃষ্টি ছিলো। তিনি পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নেননি। তার এই কৌশলের কারণেই ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এই জনসভার ওপর হামলা করার প্রস্ততি নিলেও তা করতে পারেনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও শেখ মুজিবকে ‘চতুর’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে এক গোয়েন্দা কর্মকতা বলেন, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে চলে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না (ডয়েচে ভেলে, ৩১ অক্টোবর ২০১৭)।
    ৭ মার্চের একদিন আগে অর্থাৎ ৬ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান টেলিফোনে কথা বলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সরকারের তৎকালীন তথ্য কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালিকের ‘ডরঃহবংং ঃড় ঝঁৎৎবহফবৎ’ গ্রন্থে এসব তথ্য রয়েছে। জেনারেল ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে বলার চেষ্টা করেন, তিনি (বঙ্গবন্ধু) যেন এমন কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন, যেখানে থেকে ফিরে আসার উপায় আর না থাকে।’ ৬ মার্চ এ-ও ঘোষণা করা হলো যে, ২৫ মার্চে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।
    পরিস্থিতির চাপে ভীতসন্ত্রস্ত পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সদর দপ্তর থেকে বিভিন্নভাবে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে এই মেসেজ দেয়া হয় যে, ৭ মার্চ যেন কোনোভাবেই স্বাধীনতা ঘোষণা না করা হয়। ৭ মার্চ জনসভাকে কেন্দ্র করে কামান বসানো হয়। এমনকি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুত রাখা হয়। মেজর সিদ্দিক সালিক তার গ্রন্থে লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ৭ মার্চের জনসভার প্রাক্কালে আওয়ামী লীগ নেতাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘পাকিস্তানের সংহতির বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা হলে তা শক্তভাবে মোকাবেলা করা হবে। বিশ্বাসঘাতকদের (বাঙালি) হত্যার জন্য ট্যাংক, কামান, মেশিনগান সবই প্রস্তুত রাখা হবে। শাসন করার জন্য কেউ থাকবে না কিংবা শাসিত হওয়ার জন্যও কিছু থাকবে না।’
    এমন এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চ রেসকোর্সে তার অমূল্য ভাষণটি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে ভাষণের শেষাংশে বজ্রকন্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু অংশ ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, তিনি সেদিন যুদ্ধের ঘোষণা যেমন পরোক্ষাভাবে প্রদান করেন, আবার যুদ্ধে কীভাবে জয়ী হতে হবে সে ব্যাপারেও দিকনির্দেশনা দেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের বৈধ সরকারপ্রধানের মতো এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন।ৃ যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো – কেউ দেবে না! ’
    অনেকেরই আশঙ্কা ছিল, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা কিংবা গ্রেপ্তার করা হতে পারে। এ আশঙ্কা হয়তো বঙ্গবন্ধুরও ছিল। তাই তিনি আগাম সতর্কতা হিসেবে বলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা রাস্তাঘাট সবকিছু বন্ধ করে দেবে।’ অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে বাঙালি যেন শত্রু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে কোনোভাবেই নমনীয়তা প্রদর্শন না করে। জয় ছাড়া আর কিছু নয়–এটাই ছিলো ৭ মার্চের ভাষণের প্রধান সুর।
    ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন এটা বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোও অনুমান করেছিলো। ৬ মার্চ, ১৯৭১ লন্ডনের ‘ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় ছাপা হয়, ‘শেখ মুজিবুর রহমান আগামীকাল (৭ মার্চ) পূর্ব পাকিস্তানের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে পারেন’।
    বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাত্তরের ৭ মার্চ সরাসরি কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি, তার ব্যাখ্যা পরবর্তীকালে তিনি নিজেই দিয়েছেন। ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে এনডব্লিউ টিভির দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ৭ মার্চের ঘটনা বর্ণনা করেন। শেখ মুজিবের কাছে ফ্রস্ট জানতে চান – ‘আপনার কি ইচ্ছা ছিলো যে, তখন ৭ মার্চ রেসকোর্সে আপনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা দেবেন’? জবাবে শেখ মুজিব বলেন, ‘আমি জানতাম এর পরিণতি কী হবে এবং সভায় আমি ঘোষণা করি যে এবারের সংগ্রাম মুক্তির, শৃঙ্খল মোচন এবং স্বাধীনতার।’ ফ্রস্ট প্রশ্ন করেন ‘আপনি যদি বলতেন, আজ আমি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঘোষণা করছি, তো কী ঘটতো’? শেখ মুজিব উত্তর দেন, ‘বিশেষ করে ওই দিনটিতে আমি এটা করতে চাইনি। কেননা বিশ্বকে তাদের আমি এটা বলার সুযোগ দিতে চাইনি যে, মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন তাই আঘাত হানা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প ছিলো না। আমি চাইছিলাম তারাই আগে আঘাত হানুক এবং জনগণ তা প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল।’
    বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল একটি অগ্নিমশাল, যা প্রজ্জ্বলিত করেছিলো মুক্তিযুদ্ধের দাবানল, যার সামনে টিকতে পারেনি হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়কেই নাড়া দেয়নি, ভাষণটি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। এ ভাষণের মধ্যে দিয়ে সমগ্র জাতিকে মুক্তির মোহনায় দাঁড় করিয়েছিলেন শেখ মুজিব। তিনি একটি ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন।
    সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফেরত নেওয়া, নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা এবং যে হত্যাকা- সংঘটিত হয়েছে তার বিচার বিভাগীয় তদন্ত করা। এ চারটি শর্ত দিয়ে একদিকে আলোচনার পথ উন্মুক্ত রাখলেন, অপরদিকে বক্তৃতা শেষ করলেন এই কথা বলে যে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি প্রকারান্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলেন।
    মূলত স্বাধীনতা সংগ্রাম স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপ নেয় যখন ইয়াহিয়া-মুজিব বৈঠক চলাকালীন ২৫ মার্চের কালরাতে জেনারেল টিক্কা খান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে নারকীয় গণহত্যা শুরু করে। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম সশস্ত্র রূপ ধারণ করলেও আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন এবং নৈতিক বৈধতা বাংলাদেশের পক্ষে চলে আসে। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ এই ১৮ দিনে এই ভাষণ বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে মুক্তির সংগ্রামে, স্বাধীনতার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
    কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছেন,‘৭ মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’ যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ বলেছেন ‘ পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা।’
    আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী গণমাধ্যমেও এ ভাষণকে একটি যুগান্তকারী দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে। ‘নিউজউইক’ সাময়িকীর বিখ্যাত রিপোর্ট, যেখানে বঙ্গবন্ধুকে অভিহিত করা হয়েছিলো ‘পোয়েট অব পলিটিক্স’ হিসেবে:‘৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয় একটি অনন্য কবিতা। এই কবিতার মাধ্যমে তিনি ‘রাজনীতির কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান।’ ১৯৯৭ সালে টাইম ম্যাগাজিনে বলা হয়েছে ‘ শেখ মুজিব ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন’। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট ১৯৭১-এর এক ভাষ্যে বলা হয়- ‘শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ঐ ভাষণেরই আলোকে।’
    ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়জুড়ে মানুষকে উজ্জীবিত রেখেছে। প্রিয় নেতা সুদূর পাকিস্তান কারাগারে বন্দি। বেঁচে আছেন কিনা তাও জানা নেই। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ঐ অমর ভাষণ জীবন-মরণের কঠিন দুঃসময়ে এক সঞ্জীবনী সুধার মতো বিপন্ন মানুষকে সজীব রেখেছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন প্রচারিত ‘বজ্রকণ্ঠ’ অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য গ্রাম ও শহরের মানুষ উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করেছে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার কণ্ঠই মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। আর ছিল কালজয়ী ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। বঙ্গবন্ধুর মুখনিঃসৃত ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের রণধ্বনি। ঐ ধ্বনি উচ্চারণ করে মুক্তিযোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে। মেশিনগানের গুলির মুখে এগিয়ে গেছে, প্রবেশ করেছে শত্রুর বাংকারে। বুকের গভীরে ‘বঙ্গবন্ধু’ আর মুখে ‘জয় বাংলা’-এইতো ছিলো বাঙালির মূল প্রেরণা ও অস্ত্র। এই দুটো শব্দ তখন আর কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলের নয়, তা হয়ে গিয়েছিলো স্বাধীনতা ও মুক্তির স্বপ্নে বিভোর এক জাতির- গোটা বাঙালি জাতির সবচেয়ে প্রিয় শব্দ।
    ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করলেও ৭ মার্চের ভাষণেই তিনি কার্যত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ‘স্বাধীনতা ও মুক্তি’ অর্জনের রূপরেখা ঘোষণা করেছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় রাষ্ট্রীয় সফরে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন- ‘গত ৭ মার্চ (১৯৭১) তারিখে আমি জানতাম পৈশাচিক বাহিনী আমার মানুষের ওপর আক্রমণ করবে। আমি বলেছিলাম, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি তোমরা প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। আমি বলেছিলাম, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। আমি বলেছিলাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমার লোকেরা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বৃদ্ধ থেকে বালক পর্যন্ত সকলেই সংগ্রাম করেছে’।
    সুতরাং, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়েছে আসলে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, আর ২৬ মার্চ ১৯৭১ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত সশস্ত্র প্রতিরোধ অথবা যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার নির্দেশ ৭ মার্চের ঘোষণার ধারাবাহিকতা মাত্র।
    এই ভাষণটি আজও আমাদের জাতীয় জীবনের অনুপ্রেরণা। বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু তার দিকনির্দেশনা আজও রয়ে গেছে। আমাদের জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে এই ভাষণটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পথ হারানোর ক্ষণে কিংবা দেশবিরোধী শত্রুদের ষড়যন্ত্র আর আস্ফালনে দিশেহারা মুহূর্তে যেন বেজে ওঠে সেই বজ্রকণ্ঠ ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারিৃ!’