ঢাকার একটি দৈনিকে অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ‘করোনা জয় ও মানবতা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি করোনাভাইরাসের হামলা থেকে সতর্ক থাকার উপদেশ দিয়ে ভবিষ্যতে করোনা আমাদের জন্য কী পরিণতি বহন করে আনবে তারও স্পষ্ট আভাস দিয়েছেন। তাঁর এই পাণ্ডিত্যপূর্ণ মননশীল প্রবন্ধে একজন অর্থনীতিবিদের দৃষ্টি দ্বারা বর্তমান অবস্থার যে বিশ্লেষণ করেছেন তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি। কিন্তু অর্থনীতি সম্পর্কে আমার জ্ঞান গ্রামের নকুল দাসের মতো, এ কথা স্বীকার করে বলছি, এক স্থানে এই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদের সঙ্গে সহমত পোষণ করি না।
এই বিষয়টি হলো, তিনি মনে করেন, ‘করোনা-পরবর্তী বিশ্বে নিউ লিবারেলিজম বা নয়া উদারতাবাদের জয় হবে। নামে উদারতাবাদ। আসলে এটি হচ্ছে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম ও মার্কেট ইকোনমিরই মিলিত নাম। নিউ কনজারভেটিজম বা ‘নিউকন’ নামে এই মানবতাবিরোধী শক্তিই এখন আমেরিকায় ক্ষমতা দখল করেছে। বর্তমান বিশ্ববিধ্বংসী করোনা-হামলার পর এই আগ্রাসী বিশ্বধনতন্ত্রই আরো শক্তিশালী হবে এবং শোষিত মানবসমাজ আরো শোষিত এবং দুঃখ-কষ্টের ভাগী হবে বলে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। বলেছেন, সমাজতন্ত্রী বিশ্বের নব উত্থানের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তাঁর নিজের ভাষায় বলি, ‘…নব্য উদারতাবাদ শনৈ শনৈ এগিয়ে চলে। এই প্রক্রিয়ার আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে ২০০৮ সালে বিশ্ব আর্থিক ব্যবস্থায় ধস নামে এবং বিশ্বমন্দা সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেই অবস্থা সত্ত্বেও নব্য উদারতাবাদ সাময়িক সংকট থেকে ঘুরে দাঁড়ায় এবং এগিয়ে চলে। পাশাপাশি কোনো কোনো দেশকে সময় সময় বাম রাজনীতির দিকে ঝুঁকতে দেখা গেলেও তার অগ্রগতি হয়নি।’
অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজী খলীকুজ্জমান আহমদকে আমি শ্রদ্ধা করি। আলোচিত প্রবন্ধটিতেও তিনি করোনা-জর্জরিত বিশ্বের বর্তমান ও ভবিষ্যতের পরিস্থিতি চমৎকারভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তবে তিনিও সম্ভবত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামার মতো নব্য উদারতাবাদের চূড়ান্ত বিজয়ে বিশ্বাস করেন। যদি করেন, তাহলে আমাদের কিছু বলার নেই। কাজী খলীকুজ্জমানই বলেছেন, ১৯৯০ সালে ফুকুয়ামা উদারতাবাদের চূড়ান্ত বিজয়ের কথা বলেছেন। ২০০৪ সালে তিনিই আবার নব্য উদারতাবাদের গ্রাসে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বিপুলভাবে বাড়ছে দেখে রাষ্ট্র তথা সরকারের শক্তি বাড়ানোর কথা বলেছেন। অর্থাৎ উদারতাবাদের অবাধ আগ্রাসন থেকে জনগণের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য রাষ্ট্র ও সরকারের হাতে আবার অনেকটা ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া দরকার।
আমি এই অর্থনীতিবিদের আলোচ্য বিশ্লেষণের সঙ্গে সহমত পোষণ করি; কিন্তু তাঁর প্রেডিকশনের সঙ্গে নয়। ২০০৮ সালে বিশ্বধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তাদের ত্রুটির জন্যই মন্দা দেখা দেয়। বড় বড় ব্যাংকে ধস নামে। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে থাকে। এই ব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক বিধান মেনে রাষ্ট্র বা সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে করপোরেট পুঁজি বাধ্য হয়। ব্রিটেনের তৎকালীন লেবার দলীয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মেনে আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে সরকারি ফান্ড থেকে পড়ন্ত অবস্থার ব্যাংকগুলোকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে (সাময়িকভাবে) কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলে বাঁচানো হয়, শেয়ারবাজারের ধস থামানো হয়। অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক কম্যান্ড অর্থনীতি বিশ্বপুঁজিবাদকে রক্ষা করে। লন্ডনের ডেইলি টাইমস একে আখ্যা দিয়েছিল, ‘Sociolistic Prescription for capitalist illness’ (ধনতন্ত্রের রোগ সারানোর জন্য সমাজতান্ত্রিক চিকিৎসাপত্র)।
আমরা সবাই জানি, নয়াচীন অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য কমিউনিস্ট রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে পুঁজিবাদী অর্থনীতি গ্রহণ করেছে এবং একটি অর্থনৈতিক সুপারপাওয়ার হয়েছে। ফলে এটিকে বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ সোশ্যালিজম ও কমিউনিজমের সম্পূর্ণ পরাজয় বলে বিশ্বময় প্রচার করছে। কিন্তু ধনতান্ত্রিক বিশ্বের অর্থনীতিবিদরা যে কথাটি সযত্নে লুকিয়ে রেখেছেন তা হলো, বিশ্বধনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে এখন যতই আগ্রাসী মূর্তিতে দেখা যাক, এটি তার ভয়াল প্রেতমূর্তি। অভ্যন্তরীণ ক্ষয়ে তারও বিশাল পরাজয় ও পতন ঘটেছে, যা কয়েক দশক ধরে চেপে রাখা হয়েছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের শক্তিশালী অভ্যুদয়ে পশ্চিমা ধনতন্ত্রের পতনের সূচনা হয়। পশ্চিমা দেশগুলো এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় তার বিশাল বাজার হারায়। ধনতন্ত্রের পতন ঠেকাতে আমেরিকায় রিগ্যান প্রেসিডেন্সির আমলে যে ‘রেগানোমিক্স’ অর্থনীতির কথা বলা হয়, তা নব্য উদারতাবাদের পূর্বসূরি। ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচারের টোরি সরকারের আমলে অর্থনীতির পতন ঠেকানোর জন্য পোল ট্যাক্স নামে এক নতুন কর জনসাধারণের ওপর চাপানো হয়। জনগণ বিদ্রোহী হয়। মার্গারেট থ্যাচার দ্রুত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ধারা অনুসারে চিকিৎসা, আবাসন ও শিক্ষাক্ষেত্রে সংস্কার সাধনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘোষণা করেন, ক্যাপিটালিজম এখন আর ধনীদের হাতে বন্দি নয়, তা এখন জনকল্যাণেরও বাহন। তার নাম পিপলস ক্যাপিটালিজম বা জনগণের ধনতন্ত্র।
কট্টর ক্যাপিটালিজমের পথ থেকে সরে এসেও মার্গারেট থ্যাচার রক্ষা পাননি। পোল ট্যাক্সের জন্য অসন্তুষ্ট জনসমাজের বিক্ষোভের ফলে তাঁর পতন হয়। তাঁরই শিষ্য জন মেজর পরবর্তী টোরি প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়ন দিয়ে থ্যাচারপন্থীরা ভেবেছিল, জন মেজর মার্গারেট থ্যাচারের ‘অস্টারিটির’ পথ ধরবেন। অর্থাৎ জনকল্যাণ খাতে সরকারি খরচ বিপুলভাবে কমাবেন। প্রথম দিকে জন মেজর তা-ই ছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তিনি তাঁর চরিত্র পাল্টে রাষ্ট্রের হাতে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাড়ান এবং ওয়েলফেয়ার খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করার নীতি গ্রহণ করেন। মার্গারেট থ্যাচার যে পিপলস ক্যাপিটালিজমের কথা বলেছিলেন, তা আসলে কিছুটা বাস্তবায়ন ঘটে জন মেজরের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলেই।
পশ্চিম ইউরোপে যে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির বিস্তার ঘটে, তা আসলে ধনবাদ ও সমাজবাদের মিশ্রণ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন অধিকৃত পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের নামে একনায়কত্বমূলক অত্যাচারী শাসন চাপাতে গিয়ে জনগণের মনে সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থার আবেদন নষ্ট হয়। আমেরিকার পাতা আফগান যুদ্ধের ফাঁদে পা দিয়ে দ্বিতীয় সুপারপাওয়ার হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পতন হয়। মানুষ ধরে নেয়, বিশ্বে সমাজতন্ত্রের পতন ও পরাজয় ঘটেছে।
এই সুযোগে ইউরোপের ধনবাদী রাষ্ট্রগুলো আমেরিকার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়। চীন কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদী প্রণোদনা থেকে কৌশলগত কারণে আমেরিকার Valued ally বা দামি মিত্র রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ধনবাদ ধরে নেয়, তার আর কোনো প্রতিযোগী নেই। তার হাতে তিন মারণাস্ত্র। অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, সামরিক ক্ষেত্রে ন্যাটো। রাজনীতির ক্ষেত্রে বশংবদ জাতিসংঘ। এই তিন বাহুর শক্তিকে ভিত্তি করেই আমেরিকার হাতে চলে যায় গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের নেতৃত্ব। আমেরিকায়ই সামরিক শক্তিনির্ভর নিও-লিবারেলিজমের উদ্ভব। তারা বুশ পরিবারের নেতৃত্বে হোয়াইট হাউসে বসার পর প্রথম শক্তি পরীক্ষা চালায় মধ্যপ্রাচ্যে। লিবিয়ার গাদ্দাফি ও ইরাকের সাদ্দাম হোসেনকে হত্যা করে তারা মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে।
নব্য উদারপন্থী পশ্চিমা ধনবাদী অ্যাক্সিসের বিরুদ্ধে প্রথম চ্যালেঞ্জ আসে আন্তর্জাতিক ইসলামিস্ট ও জিহাদিস্টদের তরফ থেকে। তারা পশ্চিমা ধনবাদী ব্যবস্থাকে নয়, পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থাকেই চ্যালেঞ্জ জানায়। নিজের সৃষ্ট পোষা দৈত্যের বিদ্রোহে পশ্চিমা রাষ্ট্রশক্তি প্রথমে ভীত হয়নি। তারা ভেবেছিল, জিহাদিস্টদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে সন্ত্রাস দমনের নামে বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা যাবে। জিহাদিস্টরা পরে চূড়ান্তভাবে পরাজিত না হলেও তাদের সাময়িকভাবে দমন করা সম্ভব হয়েছে। বিশ্বধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় না হলেও ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর ওপর দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ আসে মার্কিন সহায়তায় সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পুষ্ট নয়াচীনের কাছ থেকে। ওবামা আমল পর্যন্ত আমেরিকার নীতি ছিল চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক বজায় রাখা, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন ইসলামী শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠা ইরানকেও বেশি না খোঁচানো। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হতেই নব্য উদারবাদীরা আরো শক্তিশালীভাবে ক্ষমতায় আসে।
তারা নয়াচীনকে দমনের জন্য তার সঙ্গে ট্রেড ওয়ার শুরু করে এবং ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে। প্রকাশ্য আণবিক যুদ্ধে জড়ানোর চেয়ে (কারণ চীনের হাতেও আণবিক বোমা এবং ইরানেরও আণবিক অস্ত্র বানানোর ক্ষমতা আছে) প্রয়োজনে গোপন জীবাণুযুদ্ধে নয়াচীনকে কাবু করার প্রস্তুতি আমেরিকার আছে। কয়েকটি ল্যাবরেটরিতেই বিষাক্ত জীবাণু নিয়ে তাদের গবেষণা চলছে। অন্যদিকে চীনের হুবেই প্রদেশের গবেষণাগারটি যে বিষাক্ত জীবাণু নিয়ে, তা এখন প্রকাশ পাচ্ছে।
গত ১৯ এপ্রিল সানডে টাইমস হুবেই প্রদেশের গবেষণাগার নিয়ে একটি বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশ করেছে। বিবরণটির শিরোনাম :Curse of the Bat woman what went on in Wuhan lab? (ব্যাট ওম্যানের অভিশাপ—উহান ল্যাবরেটরিতে কী চলছে?) এই ল্যাবরেটরির জীবাণুবিদ শি ঝেঙলি (She Jhengli) প্রথমে সন্দেহ করেছিলেন, চীনা ল্যাবরেটরি থেকেই ভুলক্রমে এই দৈত্য মুক্তি পেয়েছে। এখন তা মনে করছেন না। তাহলে কি কোনো মার্কিন গবেষণাগার থেকে তা মুক্তি পেয়েছে? এ প্রশ্নের জবাব দেবে কে? দুই পরাশক্তির গোপন প্রতিযোগিতা থেকে এই মারণদূতের জন্ম, তাতে সন্দেহ পোষণ করা চলে কি?
আমার মতো এক অভাজনের বক্তব্য, এই যুদ্ধেও নয়া উদারতাবাদীদের একচেটিয়া জয়লাভের সম্ভাবনা কম। তবে এই যুদ্ধে মানবতা ধ্বংস হতে পারে। এই যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে, তা আমি মনে করি না। তবে করোনাভাইরাসের বর্তমান হামলা থেকে গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের ওপর অর্থনৈতিক মন্দার বেশে যে প্রচণ্ড আঘাত আসবে, তা সামলানোর জন্য ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিকে ২০০৮ সালের মতো সমাজতান্ত্রিক প্রেসক্রিপশন গ্রহণ করতে হবে। আরো সহজ কথায়, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বহু বিষয় গ্রহণ করতে হবে।
এই করোনাভাইরাস প্রশমিত হলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পুনর্জাগরণ লক্ষ করা যাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যেমন সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রকে পিছু হটতে হয়েছিল, এবারের করোনা-হামলার পরও নব্য উদারতাবাদীদের বেশ কিছুটা পিছু হটতে হবে।
লন্ডন, মঙ্গলবার, ২১ এপ্রিল ২০২০ / আজকের সূর্যোদয় অনলাইন।।
Leave a Reply