চিকিৎসা পেশায় নিযুক্ত কয়েকজন তরুণের সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে আমি বুঝতে পারলাম যে, মেডিকেল কলেজগুলো থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী সম্ভবত প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার জন এখন বেকার, বা যথাযথ কর্মসংস্থান তাদের নেই। বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলো প্রতি বছর প্রায় ১০ হাজার মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট তৈরি করে এবং এর মধ্যে মাত্র আড়াইশ জনের মতো পছন্দসই সরকারি চাকরি পেয়ে থাকে। বাকিরা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেতনের বেসরকারি চাকরিতে যোগ দেয়।
বেশ কিছু কারণে এই চাকরিগুলোকে কাঙ্ক্ষিত বা আদর্শ কর্মসংস্থান হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। বাংলাদেশে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার সুযোগ সীমিত। এমআরসিপির চূড়ান্ত পরীক্ষার কেন্দ্রটি বাংলাদেশে নেই, অথচ ভারত এবং মিয়ানমারে এই পরীক্ষাকেন্দ্র আছে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি হিসেবে তরুণ ডাক্তারদের জন্য এফসিপিএস খুব আকর্ষণীয়, তবে এর সুযোগ পাওয়া খুব কঠিন।
তরুণ মেডিকেল গ্র্যাজুয়েটরা তাদের সিনিয়র এবং নেতাদের ওপর মোটেও সন্তুষ্ট নন, কারণ উত্তসূরীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরির জন্য এই সিনিয়র এবং নেতাদের উদ্যোগ অপ্রতুল। প্রায়ই নবীন চিকিৎসকেরা পূর্বসূরীদের প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল তোলেন এই বলে যে, নবীনরা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করুক, সিনিয়ররা সেটা খুবই কমই চান, কারণ তারা মনে করেন এতে করে তাদের বাজার নষ্ট হবে!
স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা ও উন্নয়নের বাজেটের আকার কতো? আমাদের আইইডিসিআর, বিএসএমপিজিএমআর এবং মেডিকেল কলেজগুলোর জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। চিকিৎসার কিছু ইস্যু খুবই স্থানীয় এবং আমাদের চিকিৎসা গবেষকদের এগুলো নিজেরাই শনাক্ত করতে সক্ষম হওয়া উচিৎ।
আমি একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী না হয়েও বর্তমান কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুসরণ করছি এবং লক্ষ করছি যে, করোনা ভাইরাস সঙ্কট বিষয়ে, বিশেষ করে মাস্ক ব্যবহার এবং মৃতদেহের সৎকারের ক্ষেত্রে, তাদের অবস্থানে কোনো সামঞ্জস্য নেই। সংস্থাটি একেক সময় একেক ধরনের পরামর্শ দিয়েছে, যা আমাদের জন্য বিভ্রান্তিকর। প্রথমে তারা করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় চীনের প্রশংসা করলো, অথচ সারা দুনিয়া জানে যে, চীন তথ্য গোপন করছে। দ্বিতীয়ত সংস্থাটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধের পক্ষে ছিল না, সংস্থাটির শীর্ষ ব্যক্তি বৈশ্বিক মহামারী ঘোষণাটিকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত বিলম্বিত করলো। চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে এই ধরনের একটি মহামারীর বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা এক বছর আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সতর্ক করেছিল, কিন্তু ট্রাম্প বিষয়টিকে পাত্তাই দেননি।
আমি দৃঢ়ভাবে অনুভব করি যে, কিছু কিছু পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চোখ বন্ধ করে অনুসরণ না করেও, নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজস্ব গবেষণা ও উদ্যোগ দিয়ে নিজেদেরকেই খুঁজে বের করার সক্ষমতা আমাদের থাকা উচিৎ। আমাদের মনে রাখতে হবে, বিভিন্ন রোগ ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন আচরণ করে।
উল্লেখ্য, উহান গত কয়েক বছরে রফতানি বাড়াতে প্রযুক্তি উন্নয়নে বেশি ব্যয় করতে গিয়ে স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা ও উন্নয়নমূলক বাজেট কমিয়েছে। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া মহামারীর মুখোমুখি হয়ে তারা এখন এর মূল্য পরিশোধ করছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, কভিড-১৯ পরবর্তী নতুন বিশ্বে আমাদের কাছে আরো অনেক বেশি অগ্রীম তথ্য থাকতে হবে, ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি আঁচ করার সক্ষমতা থাকতে হবে। এই ধরনের সক্ষমতা অর্জিত হতে পারে স্বাস্থ্য খাতে আমাদের নিজস্ব গবেষণা এবং উন্নয়ন থেকেই।
রেজাউল করিম চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট
সুত্র:দৈনিক বণিক বার্তা – ১২ এপ্রিল
Leave a Reply