আন্তর্জাতিক ডেক্স: দশ দশটা সপ্তাহ পরে লকডাউন উঠল উহানে। যে শহরের হাত ধরে বিশ্ব প্রথম জেনেছিল নভেল করোনা ভাইরাসের কথা। তারপর যা ছড়িয়ে পড়ল গোটা পৃথিবীতে, এবং যা এখনও কেড়ে চলেছে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। কোভিড-১৯ এর আঁতুড়ঘর সেই উহান কী ভাবে স্বাভাবিকতায় ফেরে, কী ভাবে জয় করে বিপর্যয়ের স্মৃতি, সে দিকেই তাকিয়ে থাকবে গোটা বিশ্ব।
করোনা ভাইরাসের এত তীব্র আঘাত দেখেছে উহান, এত মৃত্যু দেখেছে যে সেই ট্রমা বয়ে বেড়াবে বহুকাল। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো খুললেও তাদেরও বিপুল ক্ষয় ক্ষতির ধাক্কা সামলাতে লাগবে অনেকগুলো মাস।
এক কোটি দশ লক্ষ মানুষের বাস শিল্প শহর এই উহানে। করোনা ভাইরাসের তীব্রতা সামলাতে জানুয়ারির শেষে চীনা কর্তৃপক্ষ লকডাউন করে এই শহরকে। তখন অনেকের মনে হয়েছিল, এমন একটা চূড়ান্ত পদক্ষেপ কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্রের পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু গোটা পৃথিবী জুড়ে মহামারী যখন ভয়াবহ আকার নিল, তখন দেখা গেল দেশে দেশে সকলেই প্রায় এই রাস্তাই নিচ্ছে।
গোটা পৃথিবী এখন আক্রান্ত। ইরান , ইতালি আর স্পেনের পরে আমেরিকায় এখন মৃত্যুর সংখ্যা প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্তে বাড়ছে। নিউইয়র্ক শহর যেন শ্মশান। কিন্তু চীনে এর তীব্রতা অনেকটাই কমেছে। গত তিন সপ্তাহে মাত্র তিনজন নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুও বন্ধ হয়েছে। এরপরেই মঙ্গলবার মধ্যরাতে উহানে লকডাউন উঠল। মানুষ এখন শহর ছাড়তে পারবে, তবে তার আগে প্রমাণ করতে হবে সে সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে বাকিদের জন্য কোনও ঝুঁকির কারণ নয়। বুধবার ভোর থেকেই দেখা গেছে শয়ে শয়ে গাড়ি উহান থেকে বেরিয়ে গেছে। শুধু বুধবার সারাদিনেই ট্রেনে উহান থেকে অন্য শহরে গেছেন প্রায় ৫৫ হাজার মানুষ। শহরের মধ্যে অবশ্য কড়াকড়ি এখনও যথেষ্টই আছে, স্কুল এখনও খোলেনি। মানুষজনকে বলা হয়েছে যতটা সম্ভব ঘরেই থাকুন।
শহরের এক সেল্স এক্সিকিউটিভ বছর ৫০ এর ইয়ান হুই বললেন, ‘এখন আর এখানে কাওকে বেশি কিছু বলতে হচ্ছে না। চোখের সামনে এত মৃত্যু আমরা দেখেছি, যে বিষাদ ও বিপর্যয় কাকে বলে আমাদের চেয়ে বেশি এখন কেউ জানে না।’ সেই কারণেই বিভিন্ন বড় দোকান যে স্ট্রিট ফ্রন্ট কাউন্টার খুলেছে, সেখানে মানুষ জিনিসপত্র কিনছেন পরস্পরের থেকে দূরত্ব রেখেই। ইয়াংজে নদীর ধারে মানুষ হাওয়া খেতে যাচ্ছেন, সেখানেও ভীড় নেই। পাবলিক বাস আর সাবওয়েতেও খুবই অল্প যাত্রী, এবং বেড়েছে অনলাইন শপিংয়ের প্রবণতা।
দোকানপাট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা শহরে সবমিলিয়ে ১১ হাজারের মতো। তার প্রায় সবটুকুই খুলে গেছে। কিন্তু ব্যবসা কতদূর হচ্ছে বলা শক্ত। এদিকে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মীদের মাত্র ৬০ কাজে ফিরেছেন আবার। বিদ্যুতের চাহিদাও কমে গেছে অনেকটাই। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে রপ্তানি যেহেতু তলানিতে তার প্রভাব পড়ছে এই শিল্পশহরে। ফ্যাক্টরি মালিকরা বহু ক্ষেত্রেই খরচ অনেকটাই কমিয়ে ফেলছেন। এ দিকে গত দু মাসে এই শহরে বাড়ি, ফ্ল্যাটের কেনা-বেচা কার্যত শূন্যে এসে ঠেকেছে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছোট ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর। তারা নগদের অভাবে যে কর্মী ছাঁটাই করেছে, তাঁদের ফিরিয়ে নেওয়া খুব মুশকিল। একে মালপত্র বিক্রি হচ্ছে না, তার উপরে অফিস আর যন্ত্রপাতির রক্ষণাবেক্ষণ একটা বিরাট চাপ। দিন কয়েক আগেই উহানের সব রেঁস্তোরা মালিকরা সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে তাঁদের ভাড়ায় ছাড় দেওয়া হোক, আর অল্প সুদে ধার দেওয়া হোক। এক ছোট রেঁস্তোরার মালিক জানিয়েছেন, তিনি মোট কর্মীর পাঁচ ভাগের এক ভাগ ছেঁটে আগামী সপ্তাহে ব্যবসা আবার শুরু করবেন।
শহরবাসীর খেদ করোনা ভাইরাসের এই দাপটে কেমন সার্বিকভাবে বদলে গেল তাঁদের উহান। খাতায় কলমে হয়তো স্বাভাবিক হচ্ছে, বা আরও হবে, কিন্তু প্রাণশক্তিই যেন হারিয়ে গেছে উহানের। অর্থনৈতিক উন্নতির নিরীখে বেজিং ,সাংহাই, গোয়াংজো বা শেনঝেনের সঙ্গে সবে পাল্লা দিতে শুরু করেছিল উহান, হঠাৎ সব গোলমাল হয়ে গেল। সুত্র :আজকাল
Leave a Reply