মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ২৭ জানুয়ারি, এসবিনিউজ : বড়রা এ লেখাটি পড়তে পারবেন না, তা নয়। কিন্তু আমার ধারণা, বড় মানুষেরা, যাদের ছেলে–মেয়েরা স্কুল–কলেজে পড়ে, তারা এ লেখাটি পড়ে একটু বিরক্ত হতে পারেন।
কিভাবে কিভাবে যেন আমাদের দেশের লেখাপড়াটা হয়ে গেছে পরীক্ষানির্ভর এই দেশে এখন লেখাপড়ার সঙ্গে শেখার কোনো সম্পর্ক নেই, পরীক্ষায় নম্বর পাওয়াটাই বিশাল একটা ব্যাপার। বাচ্চারা স্কুল–কলেজে কিছু শিখল কি–না, সেটা নিয়ে বাবা–মায়ের কোনো মাথা ব্যথা নেই। পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেল কি–না কিংবা জিপিএ ফাইভ পেল কি–না, সেটা নিয়ে তাদের ঘুম নেই।
পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়াটা এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে যে, মা–বাবারা রাত জেগে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো কি–না, তা ফেসবুকে খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। কোথাও যদি পেয়ে যান, তার সমাধান করিয়ে ছেলে–মেয়েদের পেছনে লেগে থাকেন, সেটা মুখস্থ করানোর জন্যে। পরীক্ষার হলে গিয়ে পরীক্ষার ঠিক আগে আগে বের হওয়া এমসিকিউ প্রশ্নগুলো নিজেদের স্মার্টফোনে নিয়ে এসে সেগুলো তাদের ছেলে–মেয়েদের শেখাতে থাকেন।
এখানেই শেষ হয় না। এতো কিছুর পরেও যদি পরীক্ষার ফলাফল ভালো না হয়, তাদের এমন ভাষায় গালাগালি আর অপমান করেন যে, বাচ্চাগুলো গলায় দড়ি দেওয়ার কথা চিন্তা করে!
আমাদের দেশে কিভাবে কিভাবে যেন এমন একটি ‘অভিভাবক প্রজন্ম’ তৈরি হয়েছে যারা সম্ভবত এই দেশের লেখাপড়ার জন্যে সবচেয়ে বড় একটি বাধা! কাজেই যদি এ রকম কোনো একজন অভিভাবক এ লেখাটি পড়া শুরু করেন, তার কাছে অনুরোধ– তিনি যেন শুধু শুধু আমার এ লেখাটি পড়ে সকাল বেলাতেই তার মেজাজটুকু খারাপ না করেন।
তবে পড়া বন্ধ করার আগে সিঙ্গাপুরের একটি স্কুলের প্রিন্সিপালের অভিভাবকদের কাছে লেখা একটি চিঠি পড়ার অনুরোধ করছি। চিঠিটি বাংলায় অনুবাদ করলে হবে এরকম–
প্রিয় অভিভাবকেরা
আপনাদের ছেলে–মেয়েদের পরীক্ষা কয়েকদিনের মধ্যেই শুরু হবে। আমি জানি, আপনাদের ছেলে–মেয়েরা যেন পরীক্ষায় ভালো করে, সেজন্য আপনারা নিশ্চয়ই খুব আশা করে আছেন।
কিন্তু একটি জিনিস মনে রাখবেন, যেসব শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে বসবে, তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই একজন শিল্পী আছে, যার গণিত শেখার কোনো দরকার নেই। একজন নিশ্চয়ই ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তা আছে যার ইতিহাস কিংবা ইংরেজি সাহিত্যের প্রয়োজন নেই।
একজন সংগীত শিল্পী আছে, যে রসায়নে কতো নম্বর পেয়েছে, তাতে কিছু আসে যায় না। একজন খেলোয়াড় আছে, তার শারীরিক দক্ষতা পদার্থবিজ্ঞান থেকে বেশি জরুরি। উদাহরণ দেওয়ার জন্যে স্কুলিংয়ের কথা বলতে পারি।
যদি আপনার ছেলে বা মেয়ে পরীক্ষায় খুব ভালো নম্বর পায়, সেটা হবে খুবই চমৎকার। কিন্তু যদি না পায়, তাহলে প্লিজ, তাদের নিজেদের ওপর বিশ্বাস কিংবা সম্মানটুকু কেড়ে নেবেন না।
তাদের বলবেন, এটা নিয়ে যেন মাথা না ঘামায়, এটা তো একটা পরীক্ষা ছাড়া আর কিছু নয়। তাদেরকে জীবনে আরও অনেক বড় কিছুর জন্যে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
তাদের বলুন, পরীক্ষায় তারা যতো নম্বরই পাক, আপনি সব সময় তাদের ভালোবাসেন এবং কখনোই পরীক্ষার নম্বর দিয়ে তাদের বিচার করবেন না!
প্লিজ, এ কাজটি করুন। যখন এটি করবেন, দেখবেন আপনার সন্তান একদিন পৃথিবীটাকে জয় করবে। একটা পরীক্ষা কিংবা একটা পরীক্ষায় কম নম্বর কখনোই তাদের স্বপ্ন কিংবা মেধাকে কেড়ে নিতে পারবে না।
আরেকটা কথা। প্লিজ, মনে রাখবেন, শুধু ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়াররাই এই পৃথিবীর একমাত্র সুখী মানুষ নয়।
অনেক শুভেচ্ছার সঙ্গে
প্রিন্সিপাল
(চিঠিটিতে স্কুলিং নামে একটি ছেলের কথা বলা হয়েছে। এই বাচ্চা ছেলেটি অলিম্পিকে সাঁতারে সোনার মেডেল পেয়েছিল!)
সিঙ্গাপুরের স্কুলের এই প্রিন্সিপালের চিঠিটি আসলে শুধু তার দেশের ছাত্র–ছাত্রীদের অভিভাবকদের জন্যই নয়, আমাদের দেশের অভিভাবকদের জন্যও সত্যি। আমরা ভুলে যাই কিংবা হয়তো জানিই না যে, একজন শিশুর অনেক রকম বুদ্ধিমত্তা থাকতে পারে। এবং তার মাঝে আমরা শুধু লেখাপড়ার বুদ্ধিমত্তাটাই যাচাই করি! এ লেখাপড়ার বুদ্ধিমত্তা ছাড়াও অন্য বুদ্ধিমত্তা দিয়ে যে একটি ছেলে–মেয়ে অনেক বড় হতে পারে, সেটিও আমাদের বুঝতে হবে।
আমি অনেকদিন থেকে ছেলে–মেয়েদের পড়িয়ে আসছি। যতোই দিন যাচ্ছে ততোই আমার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে যে, পরীক্ষার ফলের সঙ্গে একজনের জীবনের সাফল্য–ব্যর্থতার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার দেখা যে ছেলেটি বা মেয়েটি সমাজ, দেশ কিংবা পৃথিবীকে সবচেয়ে বেশি দিয়েছে, সে পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে, তা কিন্তু সত্যি নয়।
২.
আইনস্টাইন অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন। তার কথাগুলোর মধ্যে যে কথাটি আমার সবচেয়ে প্রিয় সেটি হচ্ছে– ‘কল্পনা করার শক্তি জ্ঞান থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ!’
আইনস্টাইন পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ছিলেন। জ্ঞানের গুরুত্বটুকু যদি কেউ বুঝতে পারেন, সেটি বোঝার কথা তার মতো একজন বিজ্ঞানীর। কিন্তু এই মানুষটিই জ্ঞান থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন কল্পনাশক্তিকে।
কারণটা কী? সেটি বোঝার জন্যে আমাদের রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হবে না, একটুখানি চিন্তা করলেই বোঝা যায়। আমরা যেটাকে জ্ঞান বলি, সেটা আমরা চেষ্টা–চরিত্র করে পেয়ে যেতে পারি। যদি আমরা কিছু একটা না জানি, খুঁজে–পেতে কিছু বই ঘাঁটাঘাঁটি করে, জার্নাল পেপার পড়ে, অন্যদের সঙ্গে কথা বলে আমরা সেগুলো জেনে যেতে পারি। সোজা কথায় জ্ঞান অর্জন করতে পারি, সেটি অর্জন করতে চাই কি–না কিংবা তার জন্য পরিশ্রম করতে রাজি আছি কি–না সেটিই হচ্ছে একমাত্র প্রশ্ন।
কিন্তু যদি আমাদের কল্পনাশক্তি না থাকে তাহলে কি আমরা চেষ্টা–চরিত্র করে, খাটা–খাটনি করে সেই কল্পনাশক্তি অর্জন করতে পারবো?
পারবো না। শত মাথা কুটলেও আমরা কল্পনাশক্তি বাড়াতে পারবো না। এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, যখন একটি শিশু জন্ম নেয়, তার ভেতরে অন্য সবকিছুর সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ কল্পনাশক্তি থাকে। আমাদের কাজ খুব সহজ– সেই কল্পনাশক্তিটুকু বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর কিছু নয়।
আমরা মোটেও সেটা করি না। শুধু যে করি না তা নয়, সেটাকে যতœ করে নষ্ট করি।
আমি লিখে দিতে পারি, এ দেশের অনেক অভিভাবক মনে করেন যে, ভালো লেখাপড়া মানে হচ্ছে ভালো মুখস্থ করা! সবাই নিশ্চয়ই এটা লক্ষ্য করেছেন যে, অনেক ছেলে–মেয়েকে বই নিয়ে পড়তে বসার কথা বললে তারা চোখ বন্ধ করে মুখস্থ করা শুরু করে।
আমি নিজের চোখে পত্রিকায় একটি স্কুলের বিজ্ঞাপন দেখেছি যেখানে বড় বড় করে লেখা আছে, ‘এখানে মুখস্থ করানোর সুবন্দোবস্ত আছে!’ আমার মনে হয়, আমি যদি দেখতাম, সেখানে লেখা আছে ‘এখানে মাস্তানি শেখার সুবন্দোবস্ত আছে’, তাহলেও আমি কম আতঙ্কিত হতাম।
যে কেউ ইচ্ছে করলে আমার কথাটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। যে বাচ্চা স্কুলে যেতে শুরু করেনি, যাকে এখনও লেখাপড়া শুরু করানো হয়নি, তাকে যেকোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন শুরু করলে নিজের মতো করে উত্তর দিয়ে দেবে। একটু চেষ্টা করলেই তার ভেতর থেকে কাল্পনিক বিষয় বের করে নিয়ে আসা যায়। ছোট একটা কাপড়ের পুতুলকে ‘বউ’ হিসেবে কল্পনা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেবে সে। এক টুকরো লাঠিকে একটা ‘গাড়ি’ হিসেবে কল্পনা করে ছোট্ট শিশু সারা বাড়ি ছুটে বেড়াবে।
কিন্তু সেই শিশুটি যখন ভালো স্কুলে লেখাপড়া করবে, অভিভাবকেরা উপদেশ দেবেন, প্রাইভেট টিউটর তাকে জটিল বিষয় শিখিয়ে দেবেন, কোচিং সেন্টার মডেল পরীক্ষার পর মডেল পরীক্ষা নিয়ে তাকে প্রস্তুত করে দেবে। তখন আমরা আবিষ্কার করবো– সে যে জিনিসগুলো শিখেছে, তার বাইরের একটি প্রশ্নের উত্তরও দিতে পারে না। বানিয়ে কিছু
লিখতে পারে না, কল্পনা করতে পারে না। একটি আস্ত মানুষকে আমরা পুরোপুরি রোবট বানিয়ে ফেলি।
একজন শিশুর কল্পনাশক্তিকে বাঁচিয়ে রাখা অনেকটা তার মস্তিষ্ককে অক্ষত রাখার মতো। যে শিশুটি অনেক কিছু শিখেছে, কিন্তু মস্তিষ্কের সর্বনাশ করে ফেলেছে, তার কাছে আমরা খুব বেশি কিছু চাইতে পারবো না। তার তুলনায় যে বিশেষ কিছু শেখেনি, কিন্তু মস্তিষ্কটা পুরোপুরি সজীব আছে, সৃষ্টিশীল আছে, তার কাছে আমরা অনেক কিছু আশা করতে পারি।
মনে আছে, একবার কোনো এক জায়গায় বেড়াতে এসেছি। একটি শিশু আমাকে দেখে ছুটে এসে আমার সঙ্গে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিয়েছে। আমি এক ধরনের মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম, এইটুকুন একটা শিশু, কিন্তু সে কতো কিছু জানে! এবং আরও জানার জন্য আমার কাছে তার কতো রকম প্রশ্ন, আমি উত্তর দিয়ে শেষ করতে পারি না।
কিছুক্ষণ পর তার মায়ের সঙ্গে দেখা হলো। মা মুখ ভার করে আমার কাছে অভিযোগ করে বললেন, ‘আমার এই ছেলেটা মোটে লেখাপড়া করতে চায় না, দিন–রাত গল্পের বই পড়ে। আপনি প্লিজ তাকে একটু উপদেশ দিয়ে দেবেন যেন, সে একটুখানি লেখাপড়া করে’।
আমি তার মাকে বললাম, ‘ক্লাস এইটে ওঠার আগে কোনো লেখাপড়া নেই। সে এখন যা করছে, তাকে সেটাই করতে দিন। কারণ, সে একেবারে ঠিক জিনিসটা করছে’।
তারপর ছেলেটিকে ফিস ফিস করে বললাম, ‘তুমি তোমার স্কুলে গিয়ে তোমার সব বন্ধু–বান্ধবকে আমার কথা বলবে যে, আমি বলেছি, ক্লাস এইটের আগে কোনো লেখাপড়া নেই। এখন যা মন চায়, তাই করো। গল্পের বই পড়ো, ছবি আঁকো, ক্রিকেট খেলো’।
আমার কথা শুনে মা বেচারির হার্টফেল করার অবস্থা। আমি জানি, এই ছোট ছেলেটিকেও এক সময় স্কুল, শিক্ষক, অভিভাবক, প্রাইভেট টিউটর আর কোচিং সেন্টার মিলে সাইজ করে ফেলবে। তারপরেও আমি আশা করে থাকি, এই ছোট কাজগুলো হয়তো তাদের অসম্ভব প্রাণশক্তি, স্বপ্ন আর কল্পনার শক্তিতে টিকে থাকবে। তাদের কেউ কেউ হয়তো রোবট নয়, সত্যিকার মানুষ হয়ে বড় হবে।
মস্তিষ্ককে বাঁচিয়ে রাখা বা কল্পনা করার ক্ষমতাকে ধরে রাখার একটা খুব সহজ উপায় আছে। সেটি হচ্ছে বই পড়া। সারা পৃথিবীই এখন খুব দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেট, ফেসবুক– এসব প্রযুক্তির কারণে আমাদের শিশুরা বই পড়ার জগত থেকে সরে আসতে শুরু করেছে।
আগে পৃথিবীর সব শিশু মাথা গুঁজে বই পড়তো, তাদের চোখের সামনে থাকতো ছোট একটি বই। কিন্তু তাদের মাথার ভেতরে উন্মুক্ত হতো কল্পনার বিশাল একটি জগত। এখন এই শিশুদের চোখের সামনে থাকে কম্পিউটার কিংবা ট্যাবের স্ক্রিন। সেখানে তারা দেখে, চকমকে ছবি কিংবা ভিডিও কিংবা চোখ ধাঁধানো গ্রাফিক্সের কম্পিউটার গেম। তাদের মাথার ভেতরেও থাকে সেই একই ছবি, ভিডিও কিংবা একই গ্রাফিক্স। কল্পনার বিশাল একটা জগত আর উন্মুক্ত হয় না। কী দুঃখের একটা ব্যাপার!
আমি জানি আজ হোক, কাল হোক পৃথিবীর সব বড় বড় জ্ঞানী–গুণী মানুষেরা বলবেন, ছোট ছোট শিশুদের ইন্টারনেট, কম্পিউটার, গেম আর ফেসবুকের জগতে পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়ার কাজটা একেবারে ঠিক হয়নি। তাদেরকে আরও অনেক অনেক বেশি বই পড়তে দেওয়া উচিত ছিল।
বইমেলা আসছে। আমি সব অভিভাবকদের বলবো, শিশুর হাত ধরে তাকে বইমেলায় নিয়ে আসুন। তাকে কয়েকটি বই কিনে দিন। একটি ছোট শিশুকে যদি একটিবার বই পড়ার অভ্যাস করিয়ে দিতে পারেন, তাহলে আপনি সারাজীবনের জন্যে নিশ্চিন্ত হয়ে যাবেন।
ছেলে–মেয়ে মানুষ করার এতো সহজ উপায় থাকতে আমরা কেন তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা করি?
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
-(সংগৃহীত)
Leave a Reply