১৬ বছর পরও আইলার ক্ষত মুছে যায়নি উপকূলের মানুষের জীবন থেকে

২০০৯ সালের ২৫ মে—এই দিনটি বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবনে এক বিভীষিকাময় স্মৃতি হয়ে আছে। ঘূর্ণিঝড় আইলা নামক প্রলয়ংকরী দুর্যোগ সেদিন আছড়ে পড়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার উপর। ভয়াবহ এই ঘূর্ণিঝড় প্রাণ কেড়ে নেয় শত শত মানুষের, লাখ লাখ মানুষকে করে গৃহহীন, এবং চিরস্থায়ী ক্ষত তৈরি করে প্রকৃতি ও জনজীবনে।

আইলার আঘাত ও তাণ্ডব

ঘূর্ণিঝড় আইলার গতি ছিল ঘণ্টায় প্রায় ১২০ কিলোমিটার। এই দুর্যোগে ৩৩৯ জন মানুষ প্রাণ হারান, আহত ও নিখোঁজ হন আরও হাজারো। প্রায় ২৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হন, যাদের অনেকেই বছরের পর বছর ধরে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। সুন্দরবনের একটি বড় অংশও প্লাবিত হয়, যার প্রভাব পড়ে বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের উপর।

বাঁধ ভাঙন ও লবণাক্ত দুর্ভোগ

ঘূর্ণিঝড়ের মূল ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় বাঁধ ভেঙে। খুলনার কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপ, সাতক্ষীরার আশাশুনি ও শ্যামনগরসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ২৭টির বেশি স্থানে বাঁধ ভেঙে পড়ে। এর ফলে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি প্লাবিত করে কৃষিজমি, ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাস্তা-ঘাট, মৎস্যঘের ও খামার। লবণাক্ততার এই করাল ছায়া দীর্ঘ তিন থেকে পাঁচ বছর ধরে কৃষিতে বিপর্যয় নামিয়ে আনে।

মানবিক বিপর্যয় ও সুপেয় পানির সংকট

ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে উপকূলবাসীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় সুপেয় পানির সংকট। তলিয়ে যাওয়া টিউবওয়েল, লবণাক্ত পুকুর এবং ভেসে যাওয়া রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং সিস্টেমের কারণে পানযোগ্য জলের জন্য তাদের হাঁটতে হয়েছে কিলোমিটার পর কিলোমিটার। অনেক পরিবার আজও টেকসই ও নিরাপদ আশ্রয়ের বাইরে বসবাস করছে।

আজও দুঃসহ স্মৃতি

আইলার ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও, ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের মানুষের জীবন পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। এখনও অনেক পরিবার অস্থায়ী কুঁড়েঘরে বসবাস করে, প্রতি বর্ষায় বাঁধ ভেঙে নতুন করে দুর্ভোগে পড়ে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ সত্ত্বেও টেকসই বাঁধ নির্মাণ, পুনর্বাসন ও জীবিকা নির্বাহের সমস্যা পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।

পরিবেশ ও সুন্দরবনের ক্ষতি

সুন্দরবন, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, এই ঘূর্ণিঝড়ের অন্যতম শিকার। বনাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে গাছপালা ধ্বংস হয়, পশুপাখির আবাসস্থল বিপন্ন হয়। এর ফলে বনজ সম্পদে যেমন ঘাটতি দেখা দেয়, তেমনি জীববৈচিত্র্যেও স্থায়ী প্রভাব পড়ে।

Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *