কাজী নজরুল ইসলাম মোসলেম ভারতে লিখছেন তুখড়ভাবে। সারা ভারতে না হলে আফজালুল হকের মোসলেম ভারত সমস্ত পশ্চিমবঙ্গে নজরুলের লেখা ছড়িয়ে দিচ্ছে। এ সময় আফজালুল হক নজরুলকে মোসলেম ভারতে আফিসিয়াল কাজে বসিয়ে দিলেন। দিন রাত পত্রিকার কাজ করতে হয়। এমনি কাজের প্রবল চাপে তিনি হাফিয়ে ওঠেন। দেখা গেল আর কোন নতুন লেখা তৈরি করতে পারছেন না। এমতাবস্থায় আফজালুল হক এবং আলী আকবর খানের পরামর্শ অনুযায়ী কিছুদিনের জন্য হাওয়া বদলাতে যান দেওঘরে। দেওঘর থেকে লেখা নজরুল লেখবেন তার সব মোসলেম ভারতের জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দেবেন, বিনিময়ে আফজালূল হক প্রতিমাসে একশত টাকা পাঠাবেন। এখানে আফজালূল হকের মুখ্য যে উদ্দেশ্য ছিল তা হলো নজরুলকে নিয়ে ব্যবসা করা। কিন্তু তা আর হয়ে উঠলো না। দেওঘরে গিয়ে আশানুরূপ রচনা তাঁর দ্বারা সম্ভব হয়নি। কাজী নজরুল ইসলাম এসময় দেওঘরে যা রচনা করেছিলেন তা হলো ¯েœহভীতু (ওরে এ কোন সুরধ্বনি নামলো আমার সাহারায়), প্রতিবেশিনী (আমার ঘরের পাশ দিয়ে সে), মুক্তিধারা (লক্ষী আমার! তোমার পথে আজকে অভিসার), ছলকুমারী (কত ছল করে সে বারে বারে), অকেজোর গান (ঐ ঘাসের ফুলে মটর শুটির ক্ষেতে)। তিন মাসে তিনি মাত্র পাঁচটি গান রচনা করেন। বোধ করি নজরুল ইসলাম অসুস্থ্য হবার আগ পর্যন্ত আর কখনো এত দীর্ঘ সময়ে এত অল্প রচনা তিনি করেননি। শীতকালে নজরুল এই হাওয়া পরিবর্তন করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি আর্থিক সংকটে পড়েছিলেন। আর তারই প্রমাণ দেওঘর থেকে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা নজরুলের এই চিঠিÑ
‘টাকা ফুরিয়ে গেছে, আফজাল কিংবা খান যেন শীগগীরই টাকা পাঠায়, খোঁজ নিবি আর বলবি আমার মাঝে মানুষের রক্ত আছে। আজ যদি তারা সাহায্য করে সে সাহায্য সুদে আসলে পুরে দেব।
(মুজফ্ফর আহমদ “কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা/পূর্বোক্ত” পৃষ্ঠা নং ১০৬)
মুজফ্ফর আহমদ এবং তাঁর এক বন্ধু ইমদাদুল্লাহ নজরুলকে দেখতে গিয়েছিলেন। দেওঘরে নজরুলের অবস্থা সুবিধাজনক না দেখে মুজফ্ফর আহমদ ইমদাদুল্লাহর কাছ থেকে টাকা ধার করে নজরুলকে কলকাতা নিয়ে আসেন। তখন মুজফ্ফর আহমদ থাকতেন ১৪/২ চেতলাহাঁট রোডের বাড়িতে। তিনি নজরুলকে সে বাড়িতে উঠালেন। পরদিন সকাল বেলা আফজালুল হক এসে তাকে বত্রিশ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এই বাড়িতে ছিল ‘বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি’, আর এ সাহিত্য সমিতির বাড়িতে কুমিল্লা (ত্রিপুরা) থেকে আগত শিশু পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা আলী আকবর খান থাকতেন। তিনিও নজরুলকে দেওঘরে যেতে উৎসাহিত করেছিলেন। আলী আকবর খান ঐ বাড়িতে থাকাকালে এক সময় অসুস্থ্য হয়ে পড়লে নজরুল তাকে সেবা সুশ্রƒষা দিয়ে সুস্থ্য করে তোলেন। সে কারণে নজরুলকে তিনি বেশ ¯েœহ করতেন। এসব কারণে দেওঘরে থেকে ফিরে নজরুল তাদের উপর আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এ সময় নজরুলকে দিয়ে খান সাহেব শিশু পাঠ্য পুস্তকের জন্য ‘লিচু চোর’ সহ আরও কয়েকটি ছড়া লিখিয়ে নেন। পরে তিনি নজরুলকে তার দেশের বাড়ি যাবার প্রস্তাব দেন। আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে তার বাড়িতে যাওয়া উচিত কিনা সে সম্পর্কে মুজফ্ফর আহমদকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানিয়ে ছিলেন।
‘দেখ ভাই, আমার পরামর্শ যদি শুনতে চাও, তবে তুমি কিছুতেই আলী আকবর খানের বাড়িতে যেও না। তিনি অকারণে অনর্গল মিথ্য কথা বলে যান, যেন অভিনয় করছেন এই রকম একটা ভাব তার কথাবার্তার ভিতর দিয়ে সর্বদা প্রকাশ পায়। কি মতলবে তিনি তোমায় তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে চান তা কেউ জানে না। তিনি তোমাকে একটা বিপদেও ফেলতে পারেন।
(মুজফ্ফর আহমদ “কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি কথা/পূর্বোক্ত” পৃষ্ঠা নং ১২৩)
তারপরেও ১৯২১ সালের ১৫ এপ্রিল কাজী নজরুল ইসলাম আলী আকবর খানের সাথে চট্টগ্রাম মেলে যাত্রা করেন। পথে রচনা করেছিলেন ‘নীলপরি’ (ঐ সর্ষে ফুলে ফুটালো কার/হলুদ রাঙা উত্তরী/ঐ আকাশ গাঙে পাল তুলে যায়/ নলি সে পরীর দূর তরী/ তার অবুঝ বীণার সবুজ সুরে) কবিতাটি। যা পরে ছায়ানট কাব্য গ্রন্থে সংকলিত হয়।
পূর্ব বাংলার সে নৈসর্গিক দৃশ্য তা নজরুলের এই কবিতায় ধরা পড়েছে। ছোটবেলায় একবার তিনি ময়মনসিংহ এসেছিলেন। তার পর এই দ্বিতীয়বার তার পূর্ব বাংলায় আগমন। কিন্তু এবারের আগমন ও প্রত্যাগমন ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে ট্রাজেডিপূর্ণ। কুমিল্লায় পৌঁছে আলী আকবর খান ট্রেন থেকে নেমে নজরুলকে প্রথমে নিয়ে যান কান্দির পাড়ে ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায়। ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের পুত্র বীরেন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত ছিলেন আলী আকবর খানের সহপাঠী। তখন এই পরিবারের সাথে ছিল তার গভীর সম্পর্ক। আলী আকবর খান বীরেন্দ্রের মা বিরোজা সুন্দরী দেবীকে মা ডাকতেন, সে সুবাদে এবার তিনি নজরুলেরও মা হলেন। বিরোজা সুন্দরী দেবী ছিলেন অত্যন্ত অমায়িক এবং ¯েœহময়ী রমণী। এ পরিবারের আরো ছিলেন বীরেন্দ্রর দুটি বোন-কমলা সেনগুপ্ত (বাচ্চি) ও অঞ্জলি সেনগুপ্ত (জটু), বীরেন্দ্রের বিধবা জেঠিমা গিরিবালা দেবী এবং তার একমাত্র সন্তান আশালতা (দুলি) (যে পরে প্রমীলা দেবী) এবং বীরেন্দ্র বাবুর স্ত্রী ও পুত্র রাখাল। ইন্দ্র কুমার সেনগুপ্ত সবাই ছিলেন সংস্কৃতিমনা। বিশেষ করে এ বাড়ির ছোট মেয়েরা (দুলি, বাচ্চি ও জুট) ছিল সংগীতে মুখর। নজরুলকে পেয়ে তারা অল্পদিনেই আপন করে নিলেন। কয়েকদিন কুমিল্লায় কাটানোর পর বৈশাখের শুরুতেই আলী আকবর খানের সাথে তিনি তার দৌলতপুর গ্রামের বাড়িতে যান। আলী আকবর খানের গৃহকর্তী ছিলেন তার বিধবা বড় বোন। পাশেই ছিলেন আর এক বিধবা বোন মুন্সী আবদুল খালেকের স্ত্রী, ঐ বোনের এক পুত্র জাহাজে কাজ করতেন। সে কারণে তিনি সবসময় বাহিরে থাকতেন। আর ছিল এক কন্যা সৈয়েদা। সৈয়েদা মায়ের সঙ্গেই থাকতেন। নজরুল এ বাড়িতে অতিথি হবার পর আবদুল খালেকের স্ত্রী এবং সৈয়েদা প্রায়ই এ বাড়িতে আসা যাওয়া করতে থাকেন। নজরুলের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতাও হয়ে যায় তাদের। পরে এক সময় সৈয়েদা নজরুলের কাছে গান শিখতে আসে নিয়মিত। নজরুলের দৌলতপুরের কয়েকটি রচনায় ঐ ঘনিষ্ঠতার ছায়া পড়ে। ১৩২৮ সালের বৈশাখ মাসে দৌলতপুরে রচিত ‘হারামনির হার’ কবিতায় দেখি চির দুরন্ত কবিকে ঘরের মায়ায় মুগ্ধ করেছে।
তোরা কোথা হতে কেমনে এসে
মনিরমালার মতো আমার কণ্ঠে জড়ালি
আমার পথিক জীবন এমন করে
ঘরের মায়ায় মুগ্ধ করে বাঁধন পরালি।
একই পরিস্থিতিতে জ্যৈষ্ঠমাসে রচিত আর একটি কবিতা হলো ‘মানস বধূ’। এ কবিতায় কবির বেদনার ছাপ পরেছে। তবে তার মধ্য থেকে এক বধূর মূর্তি স্পষ্ট।
সে যেন কোন দূরের মেয়ে আমায় কবি মানস বধূ
বুক পোড়া আর মুখ ভরা তার পিছলে পড়ে ব্যাথার মধু
নিশিথে রােেতর স্বপন হেন
পেয়েও তারে পাইনি যেন
মিলন মোদের স্বপন কোলে কাঁদনভরা চুমোয় চুমোয়
নাম হারা সে আমার প্রিয়া, তারেই চেয়ে জনম গোয়ায়।
১৩২৮ সালের বৈশাখ মাসে দৌলতপুরে রচিত অবেলার গান, হার মানার হার, অনাদৃতা, বিদয়া বেলায়, পাপড়ি খোলা এবং জৈষ্ঠ্য মাসে রচিত বেদনা অভিমান, হারামনির হার, মানস বধু, বিধুরা পথিক প্রিয়া। কবিতাগুলি ছায়ানট কাব্যে সঙ্কলিত। এছাড়া একই সময়ে শিশুদের জন্যও তিনি রচনা করেন লাল সালাম এবং মুকুলের উদ্বোধন।
মূলত, আলী আকবর খানের যে উদ্দেশ্যে নজরুলকে কুমিল্লাতে আনা- তা হলো তাকে দিয়ে কিছু শিশু পাঠ্য পুস্তক উপযোগি ছড়া কবিতা লিখিয়ে নিয়ে ব্যবসা করে যাওয়া। কিন্তু তার সেই উদ্দেশ্য সফল না হওয়াতে খান সাহেব কৌশলে মন ঘোরালেন অন্যদিকে। তার ভাগ্নী সৈয়েদাকে নজরুলের সাথে অবাধ সম্পর্কের টার্গেটে এ বাড়িতে নিয়ে আসলেন, আর নজরুলও দিন দিন সৈয়েদার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলেন। নজরুল তার নাম পাল্টিয়ে রাখলেন নার্গিস আশার খানম। এক পর্যায়ে আলী আকবর খানের উদ্যোগে তাদের মধ্যে বিবাহ স্থির হয়। নজরুল এ সময়ে তার বিয়ের খবর কোলকাতার বন্ধুবান্ধবদের লিখে জানান। কোলকাতার সাহিত্যিক বন্ধুরা এ সংবাদ শুনে অবাক হলেও তাদের বিবাহের জন্য শুভ কামনা জানিয়ে নজরুলকে পত্র দেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ১৯২১ সালের ৫জুন নজরুলকে লিখলেন।
‘যখন আজ তোর চিঠিতে জানলুম যে, তুই স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে বরণ করে নিয়েছিস, তখন আমার অবশ্য কোন দুঃখ নেই। তবে একটা কথা- তোর বয়স আমাদের চেয়ে ঢের কম, অভিজ্ঞতাও তদনুরূপ, ফিলিংস এর দিকটা অসম্ভব রকম বেশী, কাজেই ভয় হয় যে হয়ত দুটো জীবনই ব্যর্থ হবে।’ (নজরুল রচনা সম্ভার, ঢাকা ২৫মে ১৯৬৯)।
তবে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের ঐ পত্রে নজরুলের প্রেরীতে চিঠির একটা উদ্ধৃতিতেও মেনে যাতে নজরুলের সৈয়েদা সম্পর্কে মনোভাব স্পষ্ট,
‘যাকে পেয়েছিস তিনিই যে তোর চির জনমের হারানো গৃহলক্ষী এ কথা যদি ককেটুকু সত্যি হয়, তাহলে তোর সৌভাগ্যের সত্যই ঈর্ষা হচ্ছে…। লিখেছিস এক অচেনা পল্লীবালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছিস, যা কোন নারীর কাছে কখনও হইনি। জেনে খুশীই হলাম যে তার বাইরের ঐশ্বর্যও যথেষ্ঠ’। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের এই চিঠিতে নজরুলের উদ্বৃতি থেকে প্রমাণিত হয় যে, সৈয়েদার চেহারাও ছিল বেশ আকর্ষণীয়। ১৩জুন ওজেদ আলী লিখেছিলেন;
‘নিভৃত পল্লীর যে কুটির বাসিনী (দৌলতপুরের দৌলতখানার শাহজাদী বলাই বোধ হয় ঠিক না?) সাথে আপনার মনের মিল ও জীবনের যোগ হয়ে গেছে, তাকে আমার শ্রদ্ধা ও প্রীতিপূর্ণ আদাব জানাবেন।’
সৈয়েদা মাত্র ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া জানতো। তাই জনরুলের সাথে তার বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেলে সৈয়েদার মামা আলী আকবর খান সৈয়েদাকে নজরুল ইসলামের সহযোগী করে গড়ে তোলার জন্য নিজ হাতে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সবকটি উপন্যাস বুঝিয়ে-বুঝিয়ে পড়িয়ে বাস্তব জীবন সম্বন্ধে তাকে জ্ঞান দান করেন। এ ব্যাপারটি খান সাহেবের সংসারের কর্তী তার বিধবা বোনের খুব অপছন্দ ছিল, কিন্তু তার করার কিছু ছিল না। তিনি শুধুমাত্র নজরুলকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তখন নজরুলেরও করার কিছু ছিল না। কারণ তাদের বিয়ে সমাগত। বিয়ে ঠিক হয়েছিল ৩রা আষাঢ় ১৪২৮ শুক্রবার। এই বিয়ে উপলক্ষ্যে একটা নিমন্ত্রণপত্র বিভিন্ন কাগজে ছাপা হয়েছিল। পত্রটি হলো;
বিনয় সম্ভাষণ পূর্বক নিবেদন,
জগতের পুরোহিত তুমি, তোমার এ জগৎ মাঝারে
এক চায় একেরে পাইতে, দুই চায় এক হইবারÑরবীন্দ্র
এ বিশ্ব নিখিলের সকল শুভ কাজে যাঁর প্রসন্ন কল্যাণ আঁখি অনিখিল হয়ে জেগে রয়েছে, তাঁর ওই মহাকাশের মহা সিংহাসনের নীচে আমার মাথা নত করে আমি আপনাদের জানাচ্ছি যে আমার পরম আদরের কল্যাণীয়া ভাগ্নী নার্গিস আশার খানমের বিয়ে বর্ধমান জেলার ইতিহাস প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশ বিখ্যাত পরম পুরুষ, অভিজাত্য গৌরবে পরম গৌরবান্বিত, আয় মাদার মরহুম মৌলভী কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দেশ বিশ্রুত মুসলিম কুল গৌরব মুসলিম বঙ্গের রবি কবি সৈনিক নবযুগের ভুতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুলস ইসলামের সাথে। বাণী দুলাল দামাল ছেলে বাংলার এই তরুণ সৈনিক কবি ও প্রতিভান্বিত লেখকের নতুন করে নাম বা পরিচয় দেয়ার দরকার নেই। এই আনন্দঘন চির শিশুকে যে দেশের সকল লেখক-লেখিকা সকল কবি যুবকেরা ভালবাসা দিয়েছিলেন সেই বাঁধনহারা যে দেশমাতার একেবারে বুকের কাছটিতে প্রাণের মাঝে নিজের আসনখানি পেতে চলেছে এর চেয়ে বড় পরিচয় তার আর নেই। আপনারা আমার বন্ধু, বড় আপন জন। আমার এ গৌরব আমার এ সম্পদের দিনে আপনারা এসে আনন্দ করে আমার কুঠিরখানিকে পূর্ণানন্দ দিয়ে ভরাট করে তুলুন। তাই এ আমন্ত্রণ।
বিয়ের দিন আগামী ৩রা আষাঢ়, শুক্রবার নিশীথ রাতে।
আরজ
দৌলতপুর, ত্রিপুরা বিনীত
২৮শে জৈষ্ঠ্য ১৩২৮ আলী আকবর খান
(সূত্র: আবদুল আজীজ আল আমান’ নজরুল পরিক্রমা’ কলকাতা ১৩৭৬)
এই নিমন্ত্রণপত্র নজরুল ইসলামের বংশ এবং নিজের পরিচয়ে বেশ অহমিকার ছাপ স্পষ্ট যাতে তাঁর অনেক বন্ধু বান্ধব সাহেব, আপনার পত্রাদি যে মোটেও পাওয়া যাইতেছে না তাহার কারণ কী? খান সাহেবের নিমন্ত্রণপত্র পাইয়াছিলাম, পত্রখানায় আপনারই মুসবিদা করা দেখিলাম। পত্রের ভাষা দুই এক জায়গায় বড় অসংযত হইয়াছে একটু যেন কেমন দাম্ভিকতা প্রকাশ পাইয়াছে। আপনার হাত দিয়া অমোন লেখা বাহির হওয়া কিছুতেই ঠিক হয় নাই। আমার বড় ভয় হইতেছে যে খান সাহেবের সংশ্রবে আপনিও না শেষে দাম্ভিক হইয়া পড়েন। অন্যে বড় বলিলে গৌরবের কথা হয়। আর নিজেকে নিজে বড় বলিলে অগৌরবের মাত্রা বাড়িয়ে যায়। “মোহাম্মদী” কে বিবাহের কথা ছাপিতে অনুরোধ করাটা ঠিক হইয়াছে কি? তারাতো নিজে হইতেই খবর ছাপিতে পারিতেন। বাস্তবিক আমার প্রাণে বড় লাগিয়াছে বলিয়া আমি এত কথা বলিলাম। এই নিমন্ত্রণ পত্র আবার ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণপত্র” শিরোনামে বাঙালিতে মুদ্রিত হইয়াছে। দেখিলাম। বাঙালিকে কে পাঠাইল?
(কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা/পূর্বোক্ত ভূমিকা ১৯৬৯)
আসলে মুজফ্ফর আহমদের চিঠিতে আমরা যা পাই তাই ঠিক। কারণ কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি ও জীবন পর্যালোচনা করলে কোথাও তাঁর মধ্যে দাম্ভিকতার চিহ্ন পাওয়া যায় না। কুমিল্লায় থাকাকালীন সময়ে নজরুলের মধ্যে যে অহংকার জন্ম নিয়েছিলো তা সব আলী আকবর খানের জন্য। মুজফ্ফর আহমদ ছিল তাঁর খুব কাছের বন্ধু। তাই তার প্রাণে লাগাটাই স্বাভাবিক।
সেকথা এখানেই থাক। নজরুলের বিয়েতে আলী আকবর খান কান্দির পাড় থেকে ইন্দ্র কুমার সেন গুপ্তের পরিবার নিয়ে আসলেন। বিয়ের আসরে আরো ছিলেন বাঙ্গোরার জমিদার রায় বাহাদুর রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার এবং বাঙ্গোরার হাই স্কুলের হেড মাস্টার অবনীমোহন মজুমদার। ঘটনার চক্রান্তে সে বিয়ে হয়নি। এই ঘটনা অনুসন্ধান করে মুজফ্ফর আহমদ লিখেছেন ‘কাজী নজরুল ইসলামের সাথে সৈয়েদা খাতুন ওরফে নার্গিস বেগমের বিয়ে হয় নি এ সম্বন্ধে আমি স্থির নিশ্চিন্ত হইয়াছি। ইন্দ্র কুমার সেনের বাসা হইতে যে কয়জন নিয়ন্ত্রিত দৌতপুরে গিয়েছিলেন সন্তোস কুমার সেন নামক এক ১৫/১৬ বছর বয়সের বালক ছিলেন। অবশেষে সন্তোষের সাথে আমার কথা হয়, তার দেওয়া তথ্য থেকে বুঝা যায় আলী আকবর খানও এ বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন। তার কাবিননামায় একটা শর্ত ছিল। তা হলো নার্গিসকে নিয়ে সে কুমিল্লাতে থাকতে পারবে কিন্তু ইচ্ছামত যেখানে সেখানে নিয়ে যেতে পারবে না। যা কাজী নজরুল ইসলামের গৌরবে বেশ বেধেছিল আর বাধাটাই স্বাভাবিক।
এমন এক দূরন্ত কবিকে ঘর জামাই করে ঘরের কোনে বন্দি হওয়া কখনও সম্ভব নয়। সেবার কুমিল্লাতে বন্যা উঠেছিল। এমনি রাতে বিয়ের আসর হতে উঠে কুমিল্লার ১০/১২ মাইল পথ পায়ে হেটে কান্দির পাড়ে বিরোজা সুন্দরী দেবীর বাড়ি উঠেন। আবার বিরোজা সুন্দরী দেবীর প্রবন্ধ থেকেও এমনি তথ্য পাওয়া যায়।
৩রা আষাঢ় দিবাগত রাতে বিরোজা সুন্দরী দেবীর নিকট বিদায় নিতে এসে বললো, ‘মা আমি এখনি চলে যাচ্ছি,’ ঐ অবস্থায় তাকে ফেরানোর কথাই ওঠে না। তিনি বললেন, তুমি বাইরের ছেলে কুমিল্লার পথঘাট চেনো না। যাও যদি বীরেন্দ্রকে নিয়ে যাও। সে কুমিল্লায় জন্মেছে আর কুমিল্লায় মানুষ হয়েছে। এ দেশের লোকজনকে চেনে। সে কাদা বিছানো পথে হেটে পরদিন সকাল বেলা কান্দির পাড়ে এসে পৌঁছালো। এমনিভাবে বিয়ের রাতে শাহ্ নজর ও বাসরের পরিবর্তে নজরুলকে হাঁটু কাদা পাড়ি দিতে হয়েছিল। পরদিন নজরুলের জিনিসপত্র বিরোজা সুন্দরী নিয়ে যান। আলী আকবর খান নজরুলের জিনিসপত্র তল্লাসি করে কিছু চিঠি এবং কাগজপত্র রেখে দেন। এর পরে নার্গিসের সঙ্গে নজরুলের আর কখনও দেখা হয়নি। এখানে নজরুল যে নার্গিসকে ভালবাসতেন একথা সত্য তবে মুজফ্ফর আহমদ নার্গিসকে অভিনেত্রী ও আলী আকবর খানকে অভিনেতা আখ্যা দিয়েছেন। মূলত: আলী আকবর খান ভাগ্নীকে নজরুলের সাথে বিয়ে দিয়ে নজরুলের মত একজন প্রতিভাবান লেখককে হাতের মুঠোয় পুরে প্রকাশনা জগতে একচেটিয়া ব্যবসা করে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নজরুল তা বুঝতে পারেন নি। আলী আকবর খান এবং নার্গিস আশার খানমের আচরণে নজরুলের পৌরষ যে প্রচণ।ড আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছি তা বিরোজা সুন্দরী দেবীর বাড়িতে থাকাকালীন কিছু সামাল দিতে পেরেছিলেন। কিছুদিন পর তিনি সেখান থেকে মুজফ্ফর আহম কে একটা পোস্টকার্ডে লেখেন তিনি যেন কুমিল্লাতে এসে তাঁকে নিয়ে যান। তিনি আলী আকবর খান দ্বারা প্রভাবিত এবং অপমানিত, দারুন অসুস্থ। এ সংবাদ পেয়ে মুজফ্ফর আহমদ ফকির দাস গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ৩০ টাকা ধার করে ১৯২১ সালের ৬ জুলাই কুমিল্লায় এসে পৌঁছান। এখানে এসে দেখেন বিরোজা সুন্দরী পরিবারের ¯েœহমমতায় দৌলতপুর বিরহ অনেকটা সামলে উঠেছেন। তারা ৮ জুলাই কুমিল্লা থেকে কলকাতায় রওয়ানা দেন। চাঁদপুরে এসে টাকা ফুরিয়ে গেলে চাঁদপুর ডাকবাংলোয় উঠেন, আর কলকাতায় আফজালুল হককে টাকার জন্য টেলিগ্রাম করেন। তার অনুরোধে কুমিল্লার আরশাদ উদ্দিন চৌধুরী চাঁদপুর হরদয়াল নাথকে টেলিগ্রাম করে ভাড়ার টাকার ব্যবস্থা করে দিতে বলেন। পরে তার টাকায় তারা কলকাতা পৌঁছান। এরই মধ্য দিয়ে কুমিল্লার বেদনা বিধুর ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটে।
নজরুল কুমিল্লা থেকে কলকাতায় ফেরেন। কলকাতায় ফেরার পথে ১৭ দিনে ৪টি গান রচনা করেন। পরশপূজা (আমি এদেশ হতে বিদায় যেদিন নেব প্রিয়তম…), মনের মানুষ (ফিরিনু যেদিন দ্বারে-দ্বারে কেউ কি এসেছিল…), বিজয় গান (ঐ অভ্রভেদী তোমার ধ্বজ উড়লো আকাশে…), এবং পাগল পথিক (এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলোক বন্ধিনি মার আঙিনায়…)। এর ৮ বছর পরে নজরুল প্রমিলা দেবীকে বিয়ে করেন।
নজরুল ফিরে এসে কলকাতায় মুজফ্ফর আহমদের সাথে জ্জ সি, তালতলার বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। দুমাস পরে সেপ্টেম্বর মাসের এক রাতে আলী আকবর খান একদিন ঐ বাড়িতে যান। তিনি একটা মিটমাট করে নজরুলকে ফিরিয়ে নিতে চান। কিন্তু সফল হন না। খান সাহেব নিজে নজরুলের পাশে খাটের উপর বসলেন। তার হাতে ১০ টাকার নোটের একটা বড় বান্ডিল ছিল। সেটা বার বার নাড়াচাড়া করছিলেন। খান চলে যাবার পরদিন নজরুল বিরোজী সুন্দরীকে লিখলেন ‘মা খান সাহেব আমাকে নোটের তোড়া দেখিয়ে গেল’।
নজরুল নার্গিসকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলে ঢাকায় নিয়ে আলী আকবর খান নার্গিসকে কাছে ডাকলেন এবং নিজের প্রকাশনা দপ্তর, ঢাকার দোতলা বাড়ি তার নামে লিখে দিলেন। পরে তাকে অনেক শিক্ষিত করে তুললেন। নার্গিস অনেক শিক্ষিত হয়েছিল বটে কিন্তু নজরুলের উপযোগী হয়েছিল কিনা তাতে সন্দেহ আছে। দৌলতপুর ঘটনার ১৫ বছর পর নজরুল ০১/০৭/৩৭ তারিখে নার্গিসের একটা চিঠির উত্তর দেন। চিঠিটির বিভিন্ন অংশ বিশ্লেষণ করলে নজরুল নার্গিসের সম্পর্ক স্পষ্ট। সে চিঠিতে সম্বোধন ছিল কল্যাণীয়াসু। তিনি লিখেছিলেন;
‘১৫ বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিাধারায় প্লাবন নেমেছিল। তা তুমি হয়তো স্মরণ করতে পারো। যাক তোমার অনুযোগ অভিযোগের উত্তর নেই। লোকের মুখের শোনা কথা দিয়ে তুমি যদি আমার মুখটি কল্পনা করে থাকো তাহলে আমায় ভুল বুঝবে। আর তা মিথ্যা।’
চিঠিতে নার্গিসের প্রতি কোন অনুযোগ ও অভিযোগ ছিল না। একটা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি নিয়েই লিখেছিলেন। ১৫ বছর পর নার্গিসের সাথে তার কোন যোগাযোগ না থাকলেও নার্গিসের প্রতি ভালবাসা ও অসীম বেদনার অকপট স্বীকৃতি;
‘আমার অন্তর্যামীই জানেন তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা- কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমি নিজেই পুড়ছি। তা নিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি আগুনের এই পরশমনি না দিলে আমি অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না, ধুমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, সে রূপকে আমার জীবনে সর্বপ্রথম ভালবাসার অঞ্জলী দিয়েছিলাম সেরূপ আজো স্বর্গের পারিজাত-মন্দারের মত চির অম্লাণ হয়ে আমার বক্ষে আছে।’
নজরুলের এই চিঠিতে যেমন নার্গিসের প্রতি ভালবাসা ও অসীম বেদনা স্পষ্ট তেমনি তার অভিভাবকের প্রতি তার অভিযোগও স্পষ্ট।
‘তুমি ভুলে যেও না আমি কবিÑ আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। অসুন্দর কুৎসিতের সাধণা আমার নয় আমার আঘাত বর্বর কা-পুরুষের আঘাতের মত নিষ্ঠুর নয়। আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি শুনেছ জানিনা) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই।’ উদ্বৃতিতে স্পষ্ট তার অভিভাবক আলী আকবর খান সম্বন্ধে নজরুলের মন্তব্য। নার্গিসের চিঠিতে আত্মহত্যার কথাও হয়তো ছিল যার উত্তর নজরুল সহজভাবে দিয়েছিলেন ‘আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরনো কথা হলেও পরম হত্যা। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না।’
এই চিঠিতে নার্গিসের প্রতি নজরুলের আরো অনুভব মেলে
‘হঠাৎ মনে পরে গেল পনের বছর আগের কথা। তোমার জ্বর হয়েছিল, বহুসাধনার পর আমার তুষিত দুটি কর তোমার শুভ্র সুন্দর ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল, তোমার ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। মনে হয় যেন কালকের কথা। মহাকাল যে স্মৃতি মুছে ফেলতে পারে না। কি উদগ্র অতৃপ্তি কি দূর্দমনীয় প্রেমের জ্বরই সেদিন এসেছিল, সারারাত আমার চোখে ঘুম ছিল না। যাক আজ চলেছি, জীবনের অস্তমান দিনে শেষ রশ্মি ধরে ভাটার ¯্রােতে। তোমার ক্ষমতা নেই সেই পথ থেকে ফেরানোর। আর তার চেষ্টা করো না। তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ চিঠি হোক।
নজরুল নার্গিসের পত্র পাবার পর একটি গানও রচনা করেছিলেন (যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই কেন মনে রাখো তারে…)। নজরুল নার্গিসের সম্পর্ক ও এই সম্পর্কে জীবনে প্রতিফলন নার্গিসের কাছে লেখা নজরুলের প্রথম ও শেষ চিঠি থেকে বুঝা যায়। তবে একথা সত্য যে নজরুল নার্গিসের বিয়ে না হওয়ার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী নার্গিসের মামা আলী আকবর খান।
Leave a Reply