জুলফিকার আলী,কলারোয়া(সাতক্ষীরা)প্রতিনিধিঃ সাতক্ষীরা কলারোয়ার ১০০ বছরের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক শ্যামসুন্দর মন্দিরে গিয়ে শিব ঠাকুরের মাথায় জল ঢেলে রাধা মাধবে পূজা দিয়েছেন ভারতীয় উপ-হাইকমিশনার সুরেশ রাইনা ও তার সহধর্মিণী নন্দিতা পাল। শনিবার (১৯মার্চ) বেলা সাড়ে ১১ দিকে কলারোয়ার সোনাবাড়ীয়ার শ্যামসুন্দর মন্দির পরিদর্শন কালে ভারতীয় উপ-হাইকমিশনার বলেন, ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে রাণী রাশমণি, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সহ গুণী ব্যাক্তিত্বের আগমন ঘটেছে এ মন্দিরে। তবে এখানে পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য কমিউনিটি হলরুম কেন্দ্র নির্মান প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রাচীনতম এ মন্দিরের অবশিষ্ট অংশ যাতে আর ধ্বংস না হয়ে যায় এজন্য প্রাচীন চুন সুরকির ঐতিহাসিক শৈল্পিক এ ঐতিহ্য রক্ষার্থে পরিচর্যার সাথে পাঁচিল নির্মান প্রয়োজন। ১০০বছরের প্রাচীন এ মন্দিরটি পর্যটক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে অর্থনৈতিকভাবেও রাজস্ব পাবে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিনি বলেছেন ধর্ম যার যার উৎসব সবার। রক্তের বিনিময়ে বাংলা ভাষার সংস্কৃতি রক্ষা করেছে বাঙালিরা সেই দেশের প্রাচীন সকল ঐতিহ্য রক্ষায় সরকার অগ্রণী ভূমিকা রেখে কাজ করছে। বাংলাদেশ সরকার অবশ্যই শ্যামসুন্দর মন্দিরটির উন্নয়ন ও পর্যটক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। এসময় তিনি সোনাবাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেনজির হোসেন হেলালের উদ্দেশ্যে বলেন, বাংলাদেশ ভারত আপন দুই ভাইয়ের মত বসবাস করে। ধর্মীয় এ মন্দিরকে পর্যটক কে›ন্দ্রনির্মাণের জন্য চারিধারের দেওয়াল / প্রাচীর ও আভ্যন্তরীণ উন্নয়নের চাহিদা প্রকল্প দেওয়া হলে ভারত থেকে সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন। শ্যামসুন্দর মন্দিরের পূজারী দেব প্রসাদ চৌধুরী মন্ত্র পাঠ করে পূজা পরিচালনা করেন। শ্যামসুন্দর মন্দিরটি বাংলাদেশের দক্ষিণে সাতক্ষীরা জেলা সদর থেকে ২০ উত্তর পশ্চিমে কলারোয়া উপজেলার সীমান্ত অঞ্চল সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের শ্যামসুন্দর (মঠ বাড়ি) মন্দির নামে পরিচিত। পরিদর্শন শেষে আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্যামসুন্দর মন্দির কমিটির সভাপতি দেব প্রসাদ চৌধুরী। মন্দির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন-ভারতীয় উপ-হাইকমিশনার সুরেশ রাইনার সহধর্মিণী নন্দিতা পাল, ৬নং সোনাবাড়ীয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বেনজির হোসেন হেলাল, কলারোয়া সাব ইন্সপেক্টর এসআই বাকি বিল্লাহ, সাতক্ষীরা পুলিশ লাইনের প্রটোকল অফিসার সাব ইন্সপেক্টর আজিজুল ইসলাম, এএসআই সেলিম রেজা, নুরুজ্জামানসহ পুলিশের চৌকস টিম, উপজেলা হিন্দ বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি সিদ্ধেশ্বর চক্রবর্তী, জগবন্দু নন্দী, জগদীশ পাল, লক্ষমণ কুমার পাল, সুজন বাবু, ইউপি সদস্য নুরুল ইসলাম, ইউপি সদস্য সাদ্দাম হোসেন, ইউপি সদস্য শহিদুল ইসলাম, ইউপি সদস্য আলামিন, কলারোয়ার বিশিষ্ট স্বর্ণ ব্যবসায়ী লক্ষণ বিশ্বাস প্রমূখ। অনুষ্ঠান চলাকালীন ভারতীয় হাই কমিশনের নিকট সহযোগিতা চেয়ে স্মারক তুলে দেয় শ্যামসুন্দর মন্দিরের সভাপতি দেব প্রসাদ চক্রবর্তী। এ সময় তিনি স্মারক পাঠ করে বলেন, মন্দীরে আপনার আগমনকে অভিনন্দন। আপনি আমাদের দুরবস্থা স্বচক্ষে দেখেছেন। আমরা ১৫থেকে ২০বছরের মধ্যে কোন সরকারি অনুদান পায় নাই। একটা স্বতন্ত্র রাধা গোবিন্দ মন্দির নির্মান করতে আগ্রহী। আপনার ব্যক্তিগত অনুদানে অথবা আপনার প্রচেষ্টায় সরকারি কোন অনুদানে রাধাগোবিন্দ মন্দির নির্মিত হলে আপনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। মন্দির যতদিন থাকবে আপনার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। নব বসন্তের আগমনে আপনার শুভাগমনের আমরা সকলে উৎদ্বোলিত। আমাদের ঐকান্তিক আবেদন, আপনি আমাদের প্রত্যাশা পূরণে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করে অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র অধিবাসী। এ সময় ভারতীয় উপ-হাইকমিশনার সুরেশ রাইনার সহধর্মিণী নন্দিতা পাল বলেন, শ্যামসুন্দর মন্দিরটি অতি প্রাচীন। শৈল্পিক এ স্থাপনার অনেক অংশই এখন সংস্কারের অভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে প্রাচীন ঐতিহ্য রক্ষাথের্ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এ সময় ভারতীয় উপ হাইকমিশনার সুরেশ রাইনা বলেন, শ্যামসুন্দর মন্দির পরিদর্শন শেষে তিনি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার যশোরেশ্বরী দেবী মন্দির পরিদর্শনের উদ্দেশ্য রওনা দেন। জানা গেছে, এই পুরাকীর্তির সবচেয়ে বড় এর তিন তলাবিশিষ্ট নবরতœ মন্দির। এটিই ‘শ্যামসুন্দর মন্দির’ নামে পরিচিত। এ মন্দিরটির তিনতলা ভবনের বিশেষ বৈশিষ্ঠ হচ্ছে ভবনটি নির্মাণে ব্যবহার করা হয়নি কোন রড সিমেন্টের ঢালাই। এগুলো গাঁথা হয়েছে চুন ও সুরকি মিশ্রিত মসলা দিয়ে। এর সাথে লাগোয়া রয়েছে দুর্গামন্দির ও শিবমন্দির। এই মঠের মূল ভবনের গা ঘেঁষে পশ্চিমের মন্দিরের ছাদ ও দেওয়ালের অংশবিশেষ ধসে পড়েছে। পূর্ব দিকে ধ্বংস্ত কূপের ওপর নতুন করে শিব মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরটিতে ৯১.৪৩ সেন্টিমিটার/ ৩ফুট উঁচু একটি কালো পাথরের শিবলিঙ্গ আছে। তবে এখনকার পুরোহিত জানিয়েছেন এখানে প্রথম পর্যায়ে যে শিবলিঙ্গ ছিল সেটি চুরি হয়ে গেছে। মূল মঠের দক্ষিণে রয়েছে আর একটি ধসে পড়া ভবনের অংশবিশেষ। যার কোন সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় নি। ভবনে ব্যবহৃত ইটে খোদাই করা লেখার বেশিরভাগ স্থান ক্ষয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। তবে যেটুকু লেখা অবশিষ্ট আছে তা এখনকার মত বাংলা অক্ষর নয়। কিছু শব্দ বর্তমান বাংলার মত হলেও অনেক অক্ষর একেবারে বোঝা যায় না। এটিকে বাংলা হরফের আদি রূপ বলে স্থানীয় ইতিহাস ও ভাষাতত্ত্ব শিক্ষকরা মনে করেন। আর হরফের এই রূপ দেখে এর নির্মাণকাল ৪/৫শ বছর আগে কেউবা ৭/৮শ বছর আগে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তবে প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক মো. মোশারফ হোসেন তার ‘প্রতœতাত্ত্বিক জরিপ প্রতিবেদন বৃহত্তর খুলনা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন এ মন্দির ১৭৬৭ খ্রিস্টাব্দে জনৈক হরিরাম দাশ (মতান্তরে দুর্গাপ্রিয় দাশ) নির্মাণ করেছিলেন। মন্দিরটির নির্মাণকাল সম্পর্কে সতীশ চন্দ্র মিত্র তার বইয়েও একই কথা উল্লেখ করেছেন। এই মঠের বিশেষত্ব হচ্ছে এর তিনতালা ভবনের ছাদ কোন রড, সিমেন্টের ঢালাই বা কড়ি বর্গা ছাড়াই নির্মিত হয়েছে। মঠের মূল ভবনের নীচতলায় ১৪ কুঠুরি এবং দ্বিতীয় তলায় ১৪ কুঠুরি। তৃতীয় তলায় রয়েছে ৭কুঠুরি। আড়াই বর্গ হাতের এসব ক্ষুদ্রাকৃতির কুঠুরি নির্মাণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। এসব কুঠুরির মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে অন্ধকোটা। অন্ধকোটায় এত অন্ধকার যে দিনের বেলায়ও কিছুই দেখা যায় না। দিনের বেলায়ও আলো ছাড়া এ ঘরে প্রবেশ বিপদজনক। অন্ধকোটার মধ্যস্থলে ছিলো কূপ। যেখানে পড়ে গেলে জীবন্ত ফেরার সম্ভাবনা থাকেনা। কিন্তু বর্তমানে সে কূপ ইট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণামুখী এই মন্দিরের নিচের তলার ভেতরের অংশে চারটি ভাগ রয়েছে। প্রথম ভাগের চারপাশে রয়েছে ঘূর্ণায়মান টানা বারান্দা। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে ৬.১৪ মিটার/২০ ফুট-২ ইঞ্চি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা এবং ১.৩২ মিটার/৪ ফুট-৫ ইঞ্চি চওড়া একটি মন্ডপ। তৃতীয় ভাগের পশ্চিম পাশের কোঠা এবং মাঝের কোঠাটির উত্তরে একটি করে কক্ষ রয়েছে। কিন্তু পূর্বাংশের কোঠাটির পেছনে রয়েছে একটি বারান্দা, যেখানে দ্বিতীয় তলায় ওঠার সিঁড়ি রয়েছে। ধারণা করা যায়, পূর্ব ও পশ্চিম কোঠা দুটিতে সংরক্ষিত মূর্তির উদ্দেশ্যে মন্দিরটি নিবেদিত ছিল। দ্বিতলে রয়েছে একটি দক্ষিণামুখী কোঠা। এর পরিমাপ ২.২৮ মিটার/৭ফুট-৬ ইঞ্চি ১.৯৮মিটার/৬ ফুট-৬ ইঞ্চি। মন্দিরের তৃতীয় তলার ভবনটি তুলনামূলক ছোট। এর দক্ষিণ দিকের মধ্যের খিলানটির ওপর একটি পোড়ামাটির ফলক রয়েছে। শ্যামসুন্দর মঠের নিচে রয়েছে ৪৫.৭ সেন্টিমিটার/১ ফুট-৬ ইঞ্চি উঁচু নিরেট মঞ্চ। এর প্রত্যেক তলার ছাদপ্রান্ত ধনুকের মত বাঁকা। কোণগুলো কৌণিক। এগুলোর ছাদের ওপর ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে ঊর্ধমুখী গম্বুজ রয়েছে। আর মাঝখানে তুলনামূলক বড় একটি রতœ রয়েছে। এটি তাই ‘নবরতœ স্মৃতি মন্দির’। এই মন্দিরগুচ্ছের দক্ষিণে একটি দিঘি আছে। কথিত আছে দিঘিটিতে এক সময় একটি নৌকা বাঁধা থাকতো। তবে এখন সে নৌকার দেখা মেলেনা। মঠের চূড়ায় একটি বজ্র নিরোধক দন্ড আছে। দন্ডটির সাথে পাশের দীঘির পানির নীচের মাটিতে একটি সংযোগ শিকল ছিলো। সে শিকলটি এখন আর নেই। এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটির চতুর্দিকে আরও মন্দির ছিল বলে শোনা যায়। এরকম বেশ কিছু ধ্বংসস্তুপ পাশে দেখা যায়। কিন্তু মঠের মূল ভবনের উপর গাছপালা লতাগুল্ম জন্মেছে। ক্ষয় শুরু হয়েছে। ভবনটির অসংখ্য স্থানে ফাটল ধরেছে। তবে এই ধ্বংস্তুপ পটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে খুবই গুরুত্ব বহন করছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই ভারতীয় উপ হাইকমিশনার নিকট মন্দিরটি সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন। ১০০বছরের প্রাচীন সাতক্ষীরা কলারোয়ার শ্যামসুন্দর মন্দিরে রাধা মাধবে পূজা করছেন ভারতীয় উপ হাইকমিশনার সুরেশ রাইনা ও তার সহধর্মিণী নন্দিতা পাল।
Leave a Reply