জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিধ্বংসী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও অন্যান্য পরিবেশগত বিপর্যয়গুলো বাংলাদেশে ১ কোটি ৯০ লাখের বেশি শিশুর জীবন ও ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলছে। ইউনিসেফের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে একথা বলা হয়েছে।
ইউনিসেফের নতুন এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশিরা দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রশংসনীয় ক্ষমতা অর্জন করলেও দেশটির নবীনতম নাগরিকদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদ এড়াতে জরুরি ভিত্তিতে আরও সম্পদ ও উদ্ভাবনীমূলক কর্মসূচি প্রয়োজন।
চলতি বছরের মার্চের শুরুতে বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েত্তা ফোর বলেন, “বাংলাদেশের দরিদ্রতম কমিউনিটিগুলো পরিবেশগত যে হুমকির মোকাবেলা করছে তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, যার কারণে তারা তাদের সন্তানদের যথাযথভাবে রাখতে, খাওয়াতে এবং স্বাস্থ্যবান ও শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে সক্ষম হচ্ছে না। বাংলাদেশে এবং বিশ্ব জুড়ে শিশুদের বাঁচিয়ে রাখা এবং তাদের উন্নয়নে দেশগুলোর অনেক অর্জন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ম্লান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’’
‘ঝড়ের আভাস: বাংলাদেশের শিশুদের ভবিষ্যৎ মেঘাচ্ছন্ন করে দিচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের সমতল প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, ঘনবসতি ও দুর্বল অবকাঠামোর কারণে দেশটি শক্তিশালী ও অননুমেয় শক্তিগুলোর কাছে বিশেষভাবে অরক্ষিত হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে জলবায়ু পরিবর্তন। দেশটির উত্তরের বন্যা ও খরা-প্রবণ নিম্নাঞ্চল থেকে শুরু করে বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী ঝড় ও ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অঞ্চল পর্যন্ত এই হুমকি অনুভূত হয়।
পরিবার, সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে ইউনিসেফ বলছে, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও খরার মতো বিরূপ আবহাওয়াজনিত ঘটনার সম্মিলন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া ও নোনাপানির অনুপ্রবেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি ঘটনাসমূহ পরিবারগুলোকে আরও বেশি দারিদ্র্য ও স্থানচ্যুতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ শিশুর বসবাস শক্তিশালী নদীপ্রবাহের মধ্যে ও এগুলোকে ঘিরে। নদীগুলো বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং নিয়মিতভাবে এগুলোর তীর ভাঙে। ব্রহ্মপুত্র নদে সবচেয়ে সাম্প্রতিক বন্যায় ২০১৭ সালে ৪৮০টি কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক প্লাবিত হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫০ হাজার নলকূপ, যেগুলো কমিউনিটিগুলোর নিরাপদ পানির চাহিদা পূরণের জন্য অপরিহার্য ছিল।
উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী আরও ৪৫ লাখ শিশু নিয়মিত শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় দ্বারা আক্রান্ত হয়। এদের মধ্যে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুও রয়েছে, যারা বাঁশ ও প্লাস্টিকের দুর্বল কাঠামোয় গড়ে তোলা আশ্রয়স্থলগুলোতে বসবাস করে।
আরও ৩০ লাখ শিশুর বসবাস দূরবর্তী দ্বীপগুলোতে, যেখানে কৃষিকাজে নিয়োজিত সম্প্রদায়গুলো দীর্ঘকালীন খরাজনিত সমস্যা মোকাবেলা করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ, যা দরিদ্র বাংলাদেশিদের তাদের ঘরবাড়ি ও কমিউনিটি ফেলে অন্যত্র নতুন করে জীবন শুরু করার চেষ্টার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অনেকে ঢাকা ও অন্য বড় শহরগুলোতে যাচ্ছে, যেখানে শিশুদের বিপজ্জনক শ্রম বা শিশুবিয়ের ঝুঁকির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। গবেষণার কথা উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে, ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ৬০ লাখ জলবায়ুজনিত অভিবাসী রয়েছে, যে সংখ্যাটি ২০৫০ সালের মধ্যে বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি এডুয়ার্ড বেগবেদার বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলো তাদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়, তখন শিশুরা কার্যকরভাবে তাদের শৈশব হারায়। শহরে তারা বিপদ ও বঞ্চনার সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি শোষণ ও নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও বাইরে কাজে যেতে চাপের মুখে পড়ে।”
ইউনিসেফ উল্লেখ করে যে, ১৯৯০ এর দশকের শুরু থেকে দুর্যোগ প্রস্তুতি ও ঝুঁকি হ্রাসের কর্মসূচি উভয় ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও কার্যক্রম বাংলাদেশে ঝুঁকির মুখে থাকা সম্প্রদায়গুলোকে জলবায়ুজনিত দুর্যোগের বিপদ মোকাবেলায় আরও বেশি সাবলীল ও সক্ষম করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে মৃত্যুর হার নাটকীয়ভাবে কমেছে।
প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শিশুদের সুরক্ষা প্রদানে বেশ কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকারকে সহযোগিতা দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও অন্য অংশীদারদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ইউনিসেফ ও অন্য অংশীদারদের সহযোগিতায় চালু করা একটি প্রযুক্তি এমনই একটি উদাহরণ, যা উপকূলীয় কমিউনিটিগুলোকে তাদের গুরুত্বপূর্ণ খাবার পানির সরবরাহে সমুদ্রের লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সহায়তা করে। ‘ম্যানেজড অ্যাকুইফার রিচার্জ’ নামে পরিচিত এই ব্যবস্থা ১০০টির বেশি কমিউনিটিতে কাজ করছে এবং এর ব্যবহার আরও বাড়ানো দরকার।
Leave a Reply