জহুরুল কবীর:
আজ সেই ভয়াল-বীভৎস্য ৩ নবেম্বর। ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে।
বাঙালী জাতিকে নেতৃত্বশূন্য করতে ৪৫ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ৩ নবেম্বর মধ্যরাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ জাতির চার সূর্যসন্তান, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পরিচালক, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ-ঘনিষ্ঠ সহচর বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কারাগারের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় এমন জঘন্য, নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকা- পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
জেল হত্যাকা-ের পর ওই সময়ই লালবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘ ২১ বছর এ হত্যাকা-ের তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার জেলহত্যা মামলার প্রক্রিয়া পুনরুজ্জীবিত করে। এরপর দীর্ঘ ৮ বছরেরও বেশি সময় বিচারকাজ চলার পর বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করে। রায়ে ২০ আসামির মধ্যে ১৫ সাবেক সেনা কর্মকর্তার শাস্তি এবং অপর ৫ জনকে খালাস দেয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পলাতক তিন আসামির মৃত্যুদ- এবং অপর ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়।
মৃত্যুদ-প্রাপ্তরা হলো দফাদার মারফত আলী শাহ, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ওরফে হিরন খান ও এলডি দফাদার মোঃ আবুল হাসেম মৃধা। যাদের যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয় তারা হলো- কর্নেল (অব) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব) সৈয়দ শাহরিয়ার রশীদ, মেজর (অব) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ (বরখাস্ত), লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব) এমএইচএম বি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, লে. কর্নেল (অব) এএম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মোঃ কিসমত হোসেন এবং ক্যাপ্টেন (অব) নাজমুল হোসেন আনসার। খালাসপ্রাপ্তরা হলো বিএনপি নেতা মরহুম কে এম ওবায়দুর রহমান, জাতীয় পার্টি নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, সাবেক মন্ত্রী মরহুম তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, নুরুর ইসলাম মঞ্জুর এবং মেজর (অব) খায়রুজ্জামান।
২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকের্টের রায়ে কেবল রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদ- বহাল রেখে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি দফাদার মোঃ আবুল হাসেম মৃধা এবং যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত অপর চার আসামি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব) শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব) বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে মামলা থেকে খালাস দেয়া হয়। নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত ওই চার আসামির চারটি আপীল ও রাষ্ট্রপক্ষের ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করে হাইকের্টের একটি বেঞ্চ এ রায় দেয়।
তবে জেল হত্যাকা-ের সুদীর্ঘ সময় পর এর বিচারের রায় হলেও জাতীয় নেতার পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন মহল থেকে ওই সময়ই রায়টিকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ও ‘প্রহসনের রায়’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। একই সঙ্গে রায়টি প্রত্যাখ্যানও করা হয়। তাদের অভিযোগ, জেল হত্যার ষড়যন্ত্রের দায়ে কাউকে শাস্তি দেয়া হয়নি। জাতির ইতিহাসের নৃশংসতম এই হত্যাকা-ের পুনঃতদন্ত ও পুনঃবিচার দাবি করেন তারা।
অবশ্য জেলহত্যা মামলায় খালাস পেলেও লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব) শাহরিয়ার রশীদ খান, মেজর (অব) বজলুল হুদা ও লে. কর্নেল (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ- এই চারজন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত হওয়ায় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি এদের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ে পলাতক অপর আট যাবজ্জীবন কারাদ- পাওয়া আসামি সম্পর্কে কোন মতামত না দেয়ায় তাদের দ- বহাল আছে বলে আইনজীবীরা ব্যাখ্যা দেন।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ায় জেল হত্যাকা-ের পুনঃবিচারের সুযোগ আসে। ২০১২ সালের ১ নবেম্বর সরকারপক্ষ জেলহত্যা মামলার আপীল বিষয়ে সারসংক্ষেপ সুপ্রীমকোটের আপীল বিভাগে জমা দিলে পুনঃবিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল আপীল বিভাগের চূড়ান্ত সংক্ষিপ্ত রায়ে ২০০৮ সালের হাইকোটের রায় বাতিল করে ২০০৪ সালের নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখা হয়। অর্থাৎ পলাতক তিন আসামি রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ওরফে হিরন খান, দফাদার মারফত আলী শাহ ও এলডি দফাদার মোঃ আবুল হাসেম মৃধাকে মৃত্যুদ- এবং অন্য ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। সুদীর্ঘ বছর পর বাঙালী জাতি পায় কাঙ্খিত বিচার। আমরা চাই রায় কার্যকর হোক।
Leave a Reply