স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
সুরের আলাপে ভরে যাচ্ছে নয়াদিল্লির সাধনা এনক্লেভ। শিষ্যদের পাশে বসিয়ে আলোকবৃত্তে টেনে আনছেন ওস্তাদ আমজাদ আলি খান। পুত্র আমন আর আয়ানকে রাগ ‘নারায়ণী’-র তালিম দিচ্ছেন ওস্তাদজি। চলছে লকডাউন। বঙ্গাশ পরিবার গৃহবন্দি।
কথা বলতে গিয়ে আমন আলি বঙ্গাশ লকডাউনে এই বিশেষ তালিমের কথাই বলছিলেন। তাঁর কাছে লকডাউন হল শিক্ষার এবং সংযমের কাল। আমনের কথায়, “গত ১০ বছরে আব্বার কাছ থেকে যা শিখতে পারিনি, এই লকডাউনে তা শিখলাম। হুসেনি কানাড়া, দেব গান্ধার, জয়ন্ত মল্লার যে কী আগে জানতাম না। আব্বা হাতে ধরে শেখালেন।”
লকডাউনে পরিবারে সঙ্গীতচর্চার এক অন্য অভিজ্ঞান মেলে ধরলেন আমজাদ। বললেন, “ আয়ানের যমজ ছেলে আবির আলি আর জোহান আলি আমার জন্মদিনে প্রথম ভিডিয়ো করে তিলোককামোদ পাঠিয়েছে। লকডাউন আমায় সেরা জন্মদিন উপহার দিল।”
যা কিছু নতুন, যা কিছু প্রথম, তার সমস্তই যন্ত্রে বাজিয়ে তোলে এই পরিবার। আমনের জন্মের খুশিতে বাবা আমজাদ সরোদ বাজিয়েছিলেন। আয়ানের জন্মের সময়েও সেই রেওয়াজের ব্যাতিক্রম হয়নি। সেই ধারাই সুর হয়ে এসেছে আয়ানের যমজ সন্তানের মধ্যে। বঙ্গাশ ঘরানার প্রবীণ উত্তারধিকারী বললেন, “এই লকডাউনে আমার দুই নাতির স্কুল বন্ধ। মা নিমা শর্মার সঙ্গে ওরা আমাদের বাড়িতে চলে আসত। কখনও আমন ওদের শেখাচ্ছে, কখনও আমি, কখনও ওর বাবা। তিন গুরুর কাছে ওরা তালিম নিয়েছে।”
সুরে কথা বলে এই পরিবার। সকালের চায়ের টেবিলে তাঁদের ‘আব্বা’ হয়তো সুরে গুনগুনিয়ে উঠলেন আর ছেলে বা নাতিদের জবাব এল স্বরের মাধ্যমে। পারিবারিক সেই ছন্দ ফিরিয়ে দিয়েছে করোনাকালের লকডাউন।
আমন বাবা-মায়ের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকলেও আয়ান পরিবার নিয়ে কাছেই অন্য একটি বাড়িতে থাকেন। লকডাউনে দুই বাড়ির মেলবন্ধন আরও দৃঢ় হয়েছে। “আমি, আব্বা, আমন একসঙ্গে শুধু রেওয়াজে বসেছি, তা নয়। জীবনের অনেক বিষয় নিয়ে খোলাখুলি কথা বলার সময় পেয়েছি”, বলছিলেন আয়ান।
তবে অন্য সকলের মতো লকডাউন থামিয়েও দিয়েছে এই পরিবারকে। খান প়ঞ্চাশেক ৫০ কনসার্ট বাতিল করতে হয়েছে। আয়ানের কথায়, “আমার তো মনেই পড়ে না টানা দু’ঘন্টা আমার দুই ছেলেকে লকডাউনের আগে কোনওদিন তালিম দিতে পেরেছি! সারাক্ষণ তো অনুষ্ঠানের জন্য ট্রাভেল করে চলেছি। ছুটে চলেছি। এখন আমার ৮ বছরের ছেলেরা যখন জুম ক্লাস করে, তখন আমিই ওদের সাহায্য করতে পারছি! জীবনের এই সময়টা কখনও ভুলব না।”
পরিবারের সঙ্গে থাকতে থাকতে, ভাইয়ের সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে আমন নিজস্ব পরিবারের কথাও ভাবতে শুরু করেছেন। বলছিলেন, “এই লকডাউনে পরিবার কী, সেটা বুঝেছি। ইচ্ছে করছে নিজের পরিবার হোক। সন্তান থাকুক। খুব শিগগিরি হয়তো আপনারা সুখবর পাবেন।”
গুরু না বাবা কাকে কাছ থেকে দেখলেন?
ছোটবেলায় ওস্তাদ আমজাদ আলি খান নয়, আয়ান তাঁর ‘আব্বা’-কেই পেয়েছেন। বড় হয়ে যিনি আবার অনেক বেশি ‘গুরু’ হয়ে উঠেছেন। অন্যদিকে, আমনের কাছে তাঁর বাবা কখনও ‘গুরু’। কখনও ‘আব্বা’। বলছিলেন, “একদিন সন্ধ্যাবেলা কথা হচ্ছিল। আব্বা বুঝিয়ে দিলেন, এখন এত লোক সঙ্গীতের মধ্যে আছে। কেউ তবলা বাজাচ্ছে। কেউ গাইছে। কে কার চেয়ে ভাল, সেটা বড় কথা নয়। সঙ্গীতের কোনও শেষ হয় না। তাই রেওয়াজে প্রতিযোগিতা নয়। সহযোগী হয়ে ওঠা উচিত।”
লকডাউনে গৃহবন্দি আমজাদ যেন ফিরে দেখছেন একুশ শতককে। দেশে-দেশে নিরাপত্তার আশঙ্কা, ধর্মান্ধতা বিষণ্ণ করেছে তাঁকে। বলছিলেন, “মানুষ হিংস্র জন্তুর চেয়েও এখন ভয়ঙ্কর। সহনশীলতা আর স্থিতি যাদের মধ্যে থাকবে, তারাই লকডাউন-পরবর্তী পৃথিবীতে নিজেদের জায়গা করে নেবে বলে আমার বিশ্বাস।”
পাশাপাশি, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও গতে-বাঁধা একঘেয়েমি না-পসন্দ চিরনবীন এই শিল্পীর। তাঁর কথায়, ‘‘পরম্পরা আর মৌলিকতায় বিরোধ নেই। উপস্থাপনার ব্যাকরণ ছাপিয়ে সঙ্গীত রচনার অভিনবত্বই আসল জিনিয়াসের স্বাক্ষর।” এই লকডাউনেও তিনি তৈরি করেছেন গিটারিস্ট শ্যারন ইসবিনের সঙ্গে শান্তির সঙ্গীত। তিনি বিশ্বাস করেন, পৃথিবীতে শান্তি প্রয়োজন। কিন্তু এই একুশ শতকেও রাজনীতি ধর্মনির্ভর এবং রাজনীতিকরা ধর্মকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। শ্যারনের সঙ্গে সাত সুর নিয়েই কাজ করেছেন তিনি। সেই সাত সুর, যা ভাষা এবং ধর্মকে ছাপিয়ে মানুষের জন্য থেরাপির কাজ করে।
ওস্তাদজি চিন্তিত দেশের অর্থনীতি নিয়ে। করোনা থাবা বসিয়েছে বিশ্বজুড়ে। কথা প্রসঙ্গে বললেন, লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন সিংহভাগ পরিযায়ী শ্রমিক। কাজ না থাকায় হাতে নেই নগদ টাকা। অন্যদিকে, মিউজিক ইণ্ডাস্ট্রিও থমকে আছে। অনলাইন ক্লাস আর কনসার্টকে আপাতত ইন্ডাস্ট্রি সচল রাখার পথ হিসেবে মনে করলেও বিনা পারিশ্রমিকে অনলাইন কনসার্টের ঘোর বিরোধী এই শিল্পী। একই সুর তাঁর দুই পুত্রের। আমন যেমন বললেন, “রোজ ফেসবুক লাইভ করে কী হবে বলুন তো? অনলাইন ক্লাস ঠিক আছে। কিন্তু একজন শিল্পী বিনা পারিশ্রমিকে গান গাওয়া শুরু করলে তিনি তো অন্য শিল্পীদের পরোক্ষ ভাবে ক্ষতি করছেন! সঙ্গীতকে এ ভাবে মূল্যহীন করার অধিকার কারও নেই।”
সঙ্গীতজগৎ নিয়ে চিন্তা থাকলেও ‘কলকাতা’ শব্দেই উচ্ছ্বসিত বঙ্গাশ পরিবার। যেন তাঁদের স্পন্দনের সিংহভাগ রাখা আছে এই শহরেই। কলকাতায় (১২ বছরে ওস্তাদজি আর ১৩ বছর বয়সে আমন) সরোদ বাজিয়েই তাঁদের মঞ্চে হাতেখড়ি। মা শুভলক্ষ্মী ভরতনাট্যমের শিল্পী। অসমের মানুষ। আয়ান বলছিলেন, “অহমিয়া আর বাংলা ভাষা তো কাছাকাছি। তাই আমরা সকলেই বাংলা বুঝি। বলতেও পারি।” শুধু ভাষাই নয়, আয়ান জানাচ্ছেন, তাঁদের বাড়িতে প্রায়শই বাঙালি রান্না হয়। মায়ের হাতের কষা মাংসের নাকি কোনও জবাব নেই!
কলামন্দির বা রবীন্দ্রসদনে বাজানো হচ্ছে না বহুদিন। যা নিয়ে বেশ মনখারাপ সপুত্র ওস্তাদজির। কলকাতায় দুর্গাপুজোর সময় বাংলার মানুষের কথা ভেবেই তাঁরা ডিজিটাল উপহারের কথা ভেবেছেন। তাঁদের বিজয়ার নিবেদনে রাগ ‘দুর্গা’, রাগ ‘সরস্বতী’ এবং বাছাই রবীন্দ্রসঙ্গীত দশমীকে ভরিয়ে তুলবে।
সোমবার, বিজয়া নিশিতে রাত ৮টায় শুধু আনন্দবাজার ডিজিটালের মঞ্চে বেজে উঠবে দুই প্রজন্মের সরোদে শারদ উপহার।
Leave a Reply