জহুরুল কবীর : উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলারদুই ইউনিয়নের নারীরা পশু পালন ও সবজি চাষ করে স্বাবলম্বি হচ্ছে। পুরুষ প্রধান সংসারের গৃহিনীরা সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও আশাশুনির প্রতাপনগর ও আনুলিয়া ইউনিয়নের গৃহিনীরা সংসারের কাজের ফাঁকে (অবসর সময়ে) বাড়ির মধ্যে পশু পালন ও সবজী চাষে আত্মনিয়োগ করে জীবন মান উন্নয়নে অগ্রনী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছেন। ফলে সংসারে নিজের কর্মের গুরুত্ব অপরিহার্য করার পাশাপাশি সামাজিকভাবে পরিবারকে দিন বদলের যাত্রায় সংযুক্ত করে সম্মানজনক পর্যায়ে নিতে সহযোগিতা দিয়ে আসছে এসব নারীরা।
আশাশুনি উপজেলা উপকূলীয় এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় লবণাক্ততায় ভরা। এখানের জীবন যাত্রা এখন লবণপানির মাছ চাষ ও কৃষি নির্ভর হলেও অনেক ভূমি এখনো পতিত থাকে। মানুষের একটি বড় অংশ কর্মহীন এবং অধিকাংশ গৃহিনীরা শুধুমাত্র গৃহস্থলী কাজ নিয়েই সময় কাটায়। এসব গৃহিনীদের মধ্যে একজন হলেন প্রতাপনগর ইউনিয়নের নাকনা গ্রামের রঞ্জন মন্ডলের স্ত্রী মলিনা ম-ল। তিনি বলেন, এনজিও ফ্রেন্ডশিপের সহযোগিতায় বাড়ির আঙিনায় সবজীচাষ করে সংসারের চাহিদা পুরনের পরও ৫/৬ হাজার টাকার সবজী বিক্রয় করেছেন। এই টাকা থেকে ১১টি হাঁসের বাচ্চা ও ২টি রাজ হাঁস ক্রয় করে ফার্ম করেছেন। ফ্রেন্ডশিপের দেয়া ছাগল লালন পালন করে গাভীন হয়েছে। খুব শীঘ্রই তিনি ছাগলের বাচ্চা পাবেন। সবজী বিক্রয়ের টাকা ও হাঁসের ডিম বিক্রয় করে তিনি সংসার খরচ নির্বাহসহ ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ যোগাচ্ছেন। পাশাপাশি তিনি টাকা সঞ্চয়করছেন।
একই গ্রামের নিরঞ্জন মন্ডলের স্ত্রী তাপসী বলেন, গৃহস্থলীর কাজের পাশাপাশি ফ্রেন্ডশিপের দেওয়া ছাগল পালন করে ২টি বাচ্চা পেয়েছে। একটি বিক্রিকওে মেয়ের জামাইকে স্বর্ণের আংটি দিয়েছেন। সবজী চাষ করে সংসারের চাহিদা পুরনের পর এক বছওে ৭ হাজার টাকার সবজী বিক্রি করেছেন। এই টাকা দিয়ে ২৩টি হাঁস-মুরগি কিনেছেন। প্রতিদিন ৬টি করে ডিম দিচ্ছে, সামনের সপ্তাহ থেকে আরও ৬/৭টি ডিম বেশি আসবে বলে তিনি জানান।
উপজেলার অপর ইউনিয়ন আনুলিয়ার ঘাসটিয়া গ্রামের রাজু রানী জানান, সবজী চাষের মাধ্যমে সংসারের চাহিদা পুরণ তিনি করে ৯ হাজার টাকার সবজী বিক্রি করেছেন। একটি ছাগল লালন পালন করে সেখান থেকে ৪টি বাচ্চা হয়েছে। একই গ্রামের অনুপমা রানী হালদারর ১টি ছাগল পুশে ৫টি বাচ্চা পেয়েছে। আরও একটি ছাগল তিনি ক্রয় করেছেন। সবজী চাষ করে ৫০০০ টাকা সবজী বিক্রি করেছেন।
স্বাবলম্বি এসব নারীরা বলেন, আমরা মেয়ে হিসাবে সংসারে স্বামীর মুখাপেক্ষী হয়ে ছিলাম। প্রয়োজনীয় কিছু পেতে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হতো। আজ আমরা নিজেরা আয় করছি, সংসার চালানোয় অংশীদার হয়েছি। নিজেদের প্রয়োজন মেটাচ্ছি, সন্তানদের লেখাপড়া শেখানোয় ব্যয় করছি। আমরা সবাই ফার্ম তৈরি করতে আগ্রহী। মেয়েরা এখন সংসারে বোঝা নয়, তারাও সংসারের হাল ধরতে পারে এ আত্মবিশ্বাস সংসার ও সমাজে প্রমাণিত হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় পর্যায়ে অলাভজনক ও অরাজনৈতিক বেসরকারি সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ চর ও উপকূলীয় এলাকায় সুবিধা বঞ্চিত জনগণের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে সমমর্যাদাসহ পূর্ণ জীবনমান প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এসব মানুষদের নিয়ে কাজ করছে। ঞৎধহংরঃরড়হ ঋঁহফ চৎড়লবপঃ (অঝউ) এর মাধ্যমে সংস্থাটি আনুলিয়া ও প্রতাপনগর ইউনিয়নের ঘাসটিয়া, ভোলানাথপুর, নয়াখালী, নাকনা, দরগাতলা আইট গ্রামে প্রত্যেক কমিটিতে ৩০ সদস্য বিশিষ্ট ৬টি ডিএমসি কমিটি গঠন করেছে। এদেরকে নিয়ে কমিটি প্রতি সপ্তাহে একটি করে মিটিং করে থাকে। এদেরকে পশু পালন ও সবজী চাষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এসব অসহায় দুস্থ সদস্যদের প্রত্যেককে একটি করে ছাগী ছাগল বা ভেড়া এবং মৌসুম ভিত্তিক উন্নতমানের ২১ প্রকারের বীজ, কীটনাশক ফাঁদ ও ঔষধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। আয় রোজগার নিয়মিতকরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সম্পদবৃদ্ধি এবং সমাজে সুশাসন যেমন- বাল্য বিবাহ, যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন বন্দ, জাতীয় সংসদ ও সংবিধান সম্পর্কে ধারণা, জিডি করার নিয়মসহ বিভিন্ন শিক্ষা মূলক আলোচনা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। এসব প্রশিক্ষণে উপজেলা কৃষি অফিসার ও মৎস্য কর্মকর্তাবৃন্দ প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। প্রজেক্ট ম্যানেজার শহীদুল ইসলামের ব্যবস্থাপনায় প্রজেক্টের ফ্যাসিলেটেটর আঃ মান্নান, আসাদুল হাসানের সহযোগিতায় আঞ্চলিক সমন্বয়কারী ইউনুস আলীর তত্ত্বাবধানে এলাকার ১৮০ জন সদস্য পারিবারিক শিক্ষা প্রহণ এবং পশু পালন ও সবজী চাষ করে নিজেদের খাদ্য চাহিদা ও পুষ্টি পুরণে সক্ষম হয়েছেন। সাথে সাথে আর্থিক লাভবান হয়ে নিজের ও পরিবারের জন্য ভিত তৈরিতে এগিয়ে এসেছেন। তাদের দেখাদেখি এলাকার অনেক পরিবারের নারীরা একাজে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতে শুরু করেছে। ফলে এলাকার নারী সমাজ স্বাবলম্বি হচ্ছে।
Leave a Reply