বাংলাদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। স্থানীয় সময় গতকাল বৃহস্পতিবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক নির্বাহী আদেশে নতুন এ হার ঘোষণা করা হয়। সবশেষ বাংলাদেশকে চিঠি দিয়ে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কের কথা জানিয়েছিল মার্কিন প্রশাসন। সে হিসাবে শুল্ক ১৫ শতাংশ কমিয়ে নতুন হার ঘোষণায় করা হয়েছে।
হোয়াইট হাউসের ঘোষণায় বাংলাদেশ ছাড়াও কয়েক ডজন দেশের শুল্কের হার তুলে ধরা হয়েছে। অন্য দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের ওপর ১৯ শতাংশ, আফগানিস্তানের ওপর ১৫ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ, ব্রাজিলের ওপর ১০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ওপর ১৯ শতাংশ, মিয়ানমারের ওপর ৪০ শতাংশ, ফিলিপাইনের ওপর ১৯ শতাংশ, শ্রীলংকার ওপর ২০ শতাংশ ও ভিয়েতনামের ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ওয়াশিংটন।
এ নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষরের মাধ্যমে ৭০টিরও বেশি দেশের ওপর ১০% থেকে ৪১% পর্যন্ত রেসিপ্রোকাল (পারস্পরিক) শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ট্রাম্প একে বর্ণনা করেছেন দীর্ঘদিনের বাণিজ্যগত অসাম্য দূর করার পদক্ষেপ হিসেবে। হোয়াইট হাউজের একটি তথ্যপত্র অনুযায়ী, নতুন আমদানি কর হারগুলো আজ শুক্রবার থেকেই কার্যকর হবে।
এর আগে, গত ২ এপ্রিল বাণিজ্য ঘাটতির কথা উল্লেখ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ওপর উচ্চ হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তখন বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল। পরে ৯ এপ্রিল বিভিন্ন দেশের ওপর ওই শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়। এ সময় শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন দেশকে আলোচনার সুযোগ দেয় ওয়াশিংটন।
যুক্তরাষ্ট্রের তিন মাসের সময়সীমা গত ৯ জুলাই শেষ হয়। এর আগের দিন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়ে ট্রাম্প জানান, বাংলাদেশের পাল্টা শুল্ক ২ শতাংশ কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে। যদিও ৯ জুলাইয়ের পর পাল্টা শুল্ক কার্যকর করেনি মার্কিন প্রশাসন। শুল্কের হার কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তির জন্য ৩১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন দেশকে সময় দেয়া হয়।
সেই সময়সীমা শেষে আজ শুক্রবার (১ আগস্ট) থেকে নতুন শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা। সে হিসাবে আজ থেকে বাংলাদেশকে বর্তমানের গড় ১৫ শতাংশ ও নতুন পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশ, অর্থাৎ মোট ৩৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতানি করতে হবে।
পাল্টা শুল্ক নিয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র সফরে রয়েছে। শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) সঙ্গে টানা তিন দিন আলোচনা করেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। গত মঙ্গল ও বুধবারের পর গতকাল বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের মতো আলোচনা করা হয়। এ আলোচনায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। প্রতিনিধি দলে আরো আছেন প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গাবিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. নাজনীন কাওসার চৌধুরী। দুদিনের বৈঠকেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের কর্মকর্তারা ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে সেনসাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করেছে ২২১ কোটি ডলারের পণ্য। এ হিসাবে বাংলাদেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ৬১৫ কোটি ডলারের।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা যদি শুধু শুল্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে বিষয়গুলো অনেক সহজ হতো। কিন্তু দরকষাকষি শুধু শুল্ক নিয়ে নয়, এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ চুক্তিতে থাকা বাণিজ্যিক বাধ্যবাধকতাবিষয়ক শর্ত, যা পুরো বিষয়টির জটিলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বাধ্যবাধকতা আবার অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার বাইরে। এমনকি সেগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
সূত্র আরো জানায়, দরকষাকষির আলোচনাটি শুল্কের চেয়েও বেশি বাণিজ্য বিধিমালাবিষয়ক। এমনকি সেগুলো শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিকও না। অনেকগুলো মন্ত্রণালয় ও খাতসংশ্লিষ্টদেরও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয় রয়েছে। বাণিজ্যবিষয়ক কিছু শর্ত একেবারেই অগ্রহণযোগ্য বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত বাংলাদেশের পক্ষে মেনে নেয়া প্রায় অসম্ভব।
এদিকে, এপ্রিলে ট্রাম্প টাইম ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন, তিনি দুই শতাধিক চুক্তি করছেন। কিন্তু বাস্তবে ১২০ দিনে মাত্র ১১টি চুক্তি হয়েছে, যার মধ্যে একটি পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে।
২ জুলাই ট্রাম্পের ঘোষণায় ভিয়েতনামের ওপর শুল্ক ৪৬% থেকে কমিয়ে ২০% করা হয়েছে। তবে পলিটিকো জানিয়েছে, ভিয়েতনাম মাত্র ১১% প্রত্যাশা করেছিল। ট্রাম্প একতরফাভাবে ২০% ঘোষণা করেন। ট্রান্সশিপমেন্টের ৪০% শুল্ক কীভাবে কার্যকর হবে তা এখনো পরিষ্কার নয়।
ইন্দোনেশিয়ার জন্য পাল্টা শুল্ক ৩২ থেকে ১৯ শতাংশে হ্রাস করা হয়েছে। বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৯% পণ্যে শুল্ক বিলোপ ও নন-ট্যারিফ বাধা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জাকার্তা।
২৩ জুলাই চুক্তির আওতায় জাপানের ওপর শুল্ক ২৫% থেকে ১৫% করা হয়েছে। গাড়ি উৎপাদন খাতে বিশেষ ছাড় দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্প বলেছেন, জাপান ৫৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে যুক্তরাষ্ট্রে, যার ৯০% মুনাফা পাবে আমেরিকানরা।
চীনের সঙ্গে এখনো চুক্তি হয়নি, আছে কেবল মে মাস থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত একটি সাময়িক বিরতি। এখন চীনের ওপর ৩০% ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ১০% শুল্ক বলবৎ। সর্বশেষ স্টকহোম বৈঠকে কোনো নতুন চুক্তি হয়নি।
বুধবার ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, ভারতের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। রাশিয়া থেকে অস্ত্র ও জ্বালানি কেনার জন্য একটি অতিরিক্ত ‘পেনাল্টি’ও থাকবে। আগে এ হার ছিল ২৬%। ট্রাম্প বলেন, ‘ভারতের শুল্কহার বিশ্বের সর্বোচ্চের মধ্যে একটি।’
এদিকে শুল্ক থেকে বাঁচতে মেক্সিকোকে আরো ৯০ দিনের সময় দিয়েছেন ট্রাম্প। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লদিয়া শেনবাউমের সঙ্গে টেলিফোন আলাপের পর ট্রাম্প বলেন, ‘আলোচনায় দুই দেশের মধ্যে আগের বাণিজ্য চুক্তিটি আরো ৯০ দিনের জন্য বহাল রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মেক্সিকোর সঙ্গে চুক্তির বিষয়টি অন্য অনেক দেশ থেকে আলাদা, কারণ আমাদের মধ্যে সীমান্ত রয়েছে, যেখানে অনেক সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সম্ভাবনাও রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, মেক্সিকো আগামী ৯০ দিন আগের মতোই যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রফতনির ক্ষেত্রে নির্ধারিত শুল্ক পরিশোধ করবে। এর মধ্যে রয়েছে ফেন্টানিলে ২৫ শতাংশ, গাড়ি আমদানিতে ২৫ শতাংশ এবং স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম ও কপারের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক।
Leave a Reply