বিশেষ প্রতিনিধি: কালিগঞ্জের কৃষ্ণরগর ইউপি চেয়ারম্যান সাফিয়া পারভীনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত চলাকালীন দুর্নীতি ঢাকতে রাতারাতি পুরাতন বাটারফ্লাই সেলাই মেশিন পরিবর্তন করে নতুন সিঙ্গার সেলাই মেশিন দেয়া হয়েছে। আর নির্দিষ্ট সময়ে অভিযুক্ত ইউপি চেয়ারম্যান তদন্ত কর্মকর্তার নির্দেশমত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করেনি বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, ২০২১-২২ বছরে কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদে উন্নয়ন বরাদ্দ হতে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬০০ টাকায় ১৭ জন অসহায় দুস্থ মহিলাকে সেলাই মেশিন প্রদানের প্রকল্প নেয়া হয়। এই প্রকল্পে চেয়ারম্যানের চাচীসহ তার নিজের মানুষ, গাড়িচালক, চৌকিদার, ইউপি সদস্যদের মেয়ে, নাতি, ধর্ণাঢ্য পরিবার, পাকা টাইলস্ করা বাড়ি আছে এমন ১৭জনকে ৪ হাজার ৭০০ টাকা মূল্যের বাটারফ্লাই সেলাই মেশিন প্রদান করা হয়। কিন্তু ওই প্রকল্পে প্রাক্কালিত প্রতিটি মেশিনের মূল্য ধরা হয় ১০ হাজার ৩৮৮ টাকা। কালিগঞ্জ থানা রোডে অবস্থিত আহসানিয়া মেশিনারি হাউজ হতে আগাম ফাকা ভাউচার প্যাড নিয়ে নতুন মেশিন দেখিয়ে ভূয়া ভাউচার জমা দিয়ে হাজার হাজার টাকা লুটপাট করা হয়। বিষয়টি জানতে পেরে ইউপি চেয়ারম্যান সাফিয়া পারভীনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর গত ৯ সেপ্টেম্বর লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন এলাকাবাসী।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন কালিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অভিযোগের বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ওয়াসিম উদ্দিন সরেজমিনে তদন্ত না করে ২৬ ডিসেম্বর সকাল ১০ টার মধ্যে তার অফিসে প্রকল্পসমূহের কাগজপত্র জমা দিতে বলে তিনি ছুটিতে চলে যান। আর এই সুযোগে চেয়ারম্যান সাফিয়া পারভীন তদন্ত কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশ করে তালিকাভুক্ত ১৭ জনের বাড়ি হতে তার ক্যাডার বাহিনী পাঠিয়ে পুরাতন বাটারফ্লাই মেশিন সরিয়ে নতুন সিঙ্গার সেলাই মেশিন দিয়ে আসে। কোন অফিসার বা সাংবাদিক আসলে তাদেরকে ৬/৭ মাস আগে নতুন মেশিন দিয়েছে বলে স্বীকারোক্তি প্রদানের জন্য নির্দেশ দিয়ে আসে ওই ক্যাডার বাহিনী। তা না হলে ইউনিয়ন পরিষদের সকল সরকারি সুযোগ সুবিধা এবং বিভিন্ন ভাতার কার্ড বাতিল করা হবে বলে হুমকি দিয়ে আসে তারা। রাতারাতি প্রত্যেকের বাড়িতে নতুন মেশিন পৌঁছে দিয়ে পুরাতন সেলাই মেশিন সরিয়ে নেয়া হয়। এভাবে তদন্তে নিজেকে নির্দোশ প্রমাণের চেষ্টা করছেন ইউপি চেয়ারম্যান সাফিয়া পারভীন। অথচ এই প্রকল্পের ঠিকাদার ইউনিয়ন পরিষদের পাশে অবস্থিত কৃষ্ণনগর গ্রামের কানাইলাল ঘোষের ছেলে গোবিন্দ প্রসাদ ঘোষ। কথিত এই ঠিকাদারের নিকট থেকে চেয়ারম্যান তার সব দুর্নীতির নথিপত্রে স্বাক্ষর করে ক্রস চেক এর মাধ্যমে টাকা তুলে নিয়েছেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে গোবিন্দ প্রসাদ ঘোষ বলেন, বর্তমান চেয়ারম্যান সাফিয়া পারভীনের বাবা কে,এম মোশাররফ হোসেন ইউপি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় এভাবে আমার স্বাক্ষর নিয়ে টাকা উত্তোলন করতো। বর্তমান চেয়ারম্যানের আমলেও আমি তাই করছি। বিষয়টা উনারা ভালো বলতে পারবেন, আমি ভালো কিছু বুঝি না। সেলাই মেশিন বিষয়ে কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনারা যাচাই করে যেটা জানতে পেরেছেন সেটাই সত্য।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের সদস্য আবদুল গাফফারের মেয়ে রেহানা পারভীন, মহিলা ইউপি সদস্য সাজিদা খাতুনের নাতনি রঞ্জিতা আখতার বেবি, গ্রামপুলিশ খায়রুল ইসলামের স্ত্রী রেবেকা সুলতানা, চেয়ারম্যানের বডিগার্ড কাম ড্রাইভার হাফিজুলের স্ত্রী নুরজাহান, বাড়ির কাজের মহিলাসহ সেলাই মেশিন যাদেরকে দেয়া হয়েছে তারা সবাই চেয়ারম্যানের নিজের লোক। এই ১৭ জনের তালিকায় নাম থাকলেও প্রকৃত অসহায় ও দুস্থরা সেলাই মেশিন পান নি। আরও জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেটে ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়ন সহায়তা খাতের আওতায় সাধারণ বরাদ্দ বিবিজি হতে প্রথম কিস্তিতে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৬০০ টাকা এবং দ্বিতীয় কিস্তিতে ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৬০০ টাকা মিলে মোট ৭ লাখ ৬৬ হাজার ২০০ টাকায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাফিয়া পারভীন ৫টি প্রকল্প গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ চত্ত্বরে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল নির্মাণ বাবদ ৩ লক্ষ টাকার মধ্যে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা চুক্তিতে কাজ করিয়ে বাকি ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা লুটপাট করা হয়েছে। কৃষ্ণনগর ইউনিয়নে জলাবদ্ধতা নিরসনে পাইপ বসানোর নামে ৮৪ হাজার ৬০০ টাকার বরাদ্দে ২০ হাজার টাকায় পাইপ কিনে ৬৪ হাজার টাকা লুটপাট করেন। ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডে অসহায় দুঃস্থ মহিলাদের সেলাই মেশিন বিতরণের জন্য ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬০০ টাকা বরাদ্দের থেকে ৪ হাজার ৭০০ টাকা করে ১৭টি পুরাতন বাটারফ্লাই মেশিন কিনে বিতরণ করে প্রায় ৮০ হাজার টাকা আত্মসাত করা হয়।
এছাড়াও বালিয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য কল্যাণ কেন্দ্র হতে মোসলেম শেখার বাড়ি অভিমুখে নতুন মটর ক্রয় ও পানির লাইন সংস্কার বাবদ ১ লাখ ৮০ হাজার টাকার প্রকল্প গ্রহণ করে মাত্র ৩০ হাজার টাকা খরচ করে ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এছাড়াও ২৫ হাজার টাকায় শিশু খাদ্য বরাদ্দের নামে ১০ হাজার টাকা লুটপাটের বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন চেয়ারম্যানের নিকট ইউনিয়নবাসী অভিযোগ করেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের নির্দেশে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ইউপি চেয়ারম্যান নিজের সীমাহীন অনিয়ন দুর্নীতি ঢাকতে দৌঁড়ঝাপ শুরু করেছেন বলে জানা গেছে।
Leave a Reply