সৈয়দ মনিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর ১১-এর অধিনায়ক মেজর (পরে কর্নেল)আবু তাহের। সেক্টরের সদর দফতর মেঘালয় রাজ্যের তুরা পাহাড়ের সীমান্তঘেষা মহেন্দ্রগঞ্জে। মহেন্দ্রগঞ্জ, মানকারচর, পুরাকাশিয়া, সাঙ্গু ও বাগমারা-এই পাঁচটি ‘সাব-সেক্টর’ নিয়ে গঠিত হয় সেক্টর-১১। মেজর আবু তাহের উল্কার মত ছুটে প্রতিদিন প্রতিটি ‘সাব-সেক্টর”-এ পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। সে এক বিস্ময়কর যোগ্যতা।
১৪ নভেম্বর ১৯৭১। ঘটনাবহুল ১১ নম্বর সেক্টরে ঐতিহাসিক কামালপুর যুদ্ধের অবিস্মরণীয় এক দিন।
১৩ নভেম্বর গোপন সংবাদে জানা গেল কামালপুর বিওপির উত্তর দিকে ভারতীয় বেড়িবাঁধ সংলগ্ন কিছু বাঙ্কার থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা সরে গেছে। এই সংবাদের ভিত্তিতে সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের ঐ বাঙ্কারগুলোতে অবস্থান নিয়ে কামালপুর দখল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হেলাল কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা একটি গ্রুপ নিয়ে রাত সাড়ে দশটায় মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে গেল। বেড়িবাঁধ অতিক্রম করে কামালপুর পোস্টের উত্তর-পূর্ব কোণে পাকিস্তানীদের পরিত্যাক্ত বাঙ্কারগুলোতে অবস্থান নিল।
উত্তর পূর্ব দিকে প্রথম বাঙ্কারে মেজর তাহের, তাঁর দেহরক্ষী বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন সিপাহী এবং তাঁর দুই ভাই বেলাল-বাহার। হেলাল কোম্পানির কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও একই সাথে অবস্থান নেয়। কয়েকশত গজ দূরে পশ্চিম দিকের বাঙ্কারগুলোতে হেলাল, লতা, মিঠু, সুজাসহ আরও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অবস্থান গ্রহণ করে। কামালপুর বিওপির মুখোমুখি ধানুয়াতে আবেদীন কোম্পানির জয়নাল আবেদীন, লেফটেন্যান্ট মিজান, সাঈদ কোম্পানির সাঈদ (তাহেরের ছোট ভাই), ক্যাপ্টেন মান্নান ও হারুন-হাবীব সহ আরো অনেকে তাদের গ্রুপ নিয়ে বিভিন্ন “হাইড আউটে” আগে থেকেই অবস্থান করছিল।
প্রত্যেক গ্রুপের সাথে যোগাযোগ ও সমন্বয় রক্ষার জন্যে ছিলো কয়েকটি ‘ওয়াকিটকি’। মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে আমার হাতে ছিলো আরেকটি সেট। প্রত্যেকটি গ্রুপের সাথে আমি যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলাম। বেড়িবাঁধের উত্তর পাশে মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে মিত্রবাহিনীর ১৩ গার্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ফায়ারিং দিয়ে ঐতিহাসিক অপারেশনটিকে ‘কভারেজ’ দিচ্ছিল। পরিকল্পনাটি আগেই করা হয়েছিল।
ভোররাত ৩টা ৪৫ মিনিটে অপারেশন শুরু হল। সকাল সোয়া সাতটা পর্যন্ত দু’পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড গুলিবিনিময় হলো। কিন্তু এতো প্রচন্ড গোলাগুলির পরও হানাদার বাহিনী তাদের বাঙ্কার থেকে উঠে আসেনি। ১৪ নভেম্বর সকাল সাড়ে আটটার দিকে মেজর তাহের তাঁর বাঙ্কার থেকে উঠে লে. মিজান ও হেলালের পজিশনে আসেন। তাদের কোন অবস্থাতেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে উঠে না যাওয়ার নির্দেশ দেন। এ সময় ধানুয়া ‘হাইড আউটের’ কোম্পানি কমান্ডার আবেদীন এগিয়ে এসে মেজর তাহেরের সাথে কথা বলতে থাকেন। সকলের সাথে কথা বলতে বলতে তাদের বাঁধের কাছে ঘাসের ওপর বসে পড়েন। মুহূর্তেই প্রচন্ড একটি শব্দ হয় এবং সকলের সামনেই মেজর তাহের মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। উপস্থিত সকলেই মনে করেন, কোন একটি মর্টার সেলের আঘাত- আবার কেউ কেউ মনে করেন যেখানে তাহের লুটিয়ে পড়েন সেখানে একটি ‘এন্টি পারসোনাল মাইন’ ছিল। সে যাই হোক, তাঁর বাম পায়ের হাঁটুর উপরের অংশ প্রায় দ্বিখন্ডিত হয়ে সামান্য কিছু শুধু চামড়ার সাথে ঝুলে থাকে।
এ ঘটনায় উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা হতভম্ব ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে এই মর্মান্তিক খবর। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ থেমে যায়। সে বারে কামালপুর বিওপি থেকে পাকিস্তানীদের হটিয়ে দেয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু কি আশ্চর্য, এত রক্তপাতের পরও মেজর তাহের সংজ্ঞা হারান নি। তিনি আঘাতপ্রাপ্ত অংশটিকে গামছা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিতে বললেন যেন রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়। দু’তিন জনকে তাঁর কাছে থাকবার এবং বাকী সবাইকে যার যার অবস্থানে চলে যেতে বললেন।
এরপর গামছা দিয়ে বেঁধে রাইফেলের বাঁট দিয়ে ঝুলিয়ে বহু কষ্টে বাঁধের ওপারে ভারতীয় সীমানায় আনা হয় আহত তাহেরকে। আসার সময় জয়নাল আবেদীনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা এসো না-কামালপুর আজ দখল করতেই হবে।’ ভাবতে অবাক লাগে এ অবস্থায় এমন সঠিক নির্দেশ দেয়া কী ভীষণ মনোবলের পরিচয় বহন করে একজন সেনাপতির!
এ সময় ক্যাম্পে বসে আমি প্রতিটি গ্রুপের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলাম। প্রায় ন’টার দিকে ক্যাপ্টেন মান্নান জানতে চাইলেন আমি মেজর তাহেরের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পেরেছি কিনা। তিনি জানালেন কয়েকবার চেষ্টা করেও তিনি লাইন ধরতে পারেন নি।
কিছুক্ষণ পর আমি লে. মিজানের লাইন পেলাম। ধরেছিল কোম্পানি কমান্ডার হেলাল। হেলাল কান্নাজড়িত কন্ঠে মেজর তাহেরের অবস্থা জানাল এবং সেক্টর কমান্ডারকে সরিয়ে নেয়ার জন্যে এম্বুলেন্স পাঠাতে বলল। আমি বিএসএফের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নিয়োগীর সাথে যোগাযোগ করে এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করি। তিনি জানালেন, তিনি আগেই খবরটি পেয়েছেন এবং এম্বুলেন্স ইতিমধ্যেই পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এক ঘন্টা পর হেলালের সাথে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হলাম যে, মেজর তাহেরকে বাঁধের এপারে নিয়ে এসে এম্বুলেন্সে তুলে দেয়া হয়েছে। মিত্র বাহিনীর মেজর মুখার্জী (ডাক্তার) নিজেই এম্বুলেন্স নিয়ে এসেছিলেন। আমাদের মেডিক্যাল কোরের মুক্তিযোদ্ধা নাসিরকে এম্বুলেন্সের সাথে দেয়া হয়েছে। সেক্টরের ডাক্তার প্রেমাংকুর রায়ও এসেছেন। ডা. মেজর মুখার্জী মেজর তাহেরকে শিলিগুড়ি হাসপাতালে নিয়ে যান। ক্যাম্পে আমি দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠায় পায়চারি করে কালক্ষেপণ করছি মাত্র। কিছুই যেন করার নেই। এমন সময় সেন্ট্রি মহেন্দ্রগঞ্জ থানার একজন পুলিশকে আমার কাছে নিয়ে এলো। সে আমাকে ভাঁজ করা একটি কাগজ হাতে দিয়ে বলল, থানার ও.সি. সাহেব পাঠিয়েছেন। চিরকুটটি হাতে নিয়ে পড়লাম।
হাতের লেখা স্পষ্ট, সুন্দর-কিন্তু আমার পরিচিত নয়। পুলিশকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, আহত তাহেরকে নিয়ে যে এম্বুলেন্সটি যাচ্ছিল, মহেন্দ্রগঞ্জ থানার সামনে থামিয়ে থানার ও.সি.কে ডেকে একজন ডাক্তার চিরকুটটি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছে দিতে বলেন।
ঘটনার সাত-আটদিন পর ডাক্তার মেজর মুখার্জীর সঙ্গে মহেন্দ্রগঞ্জে আমার দেখা। তিনি কিছুক্ষণ সময় দিলেন। জানতে চাইলাম ১৪ নভেম্বর মেজর তাহেরকে কেমন দেখেছেন। জবাবে মেজর মুখার্জী বললেন, “কি বলব মেজর তাহেরের কথা। আমি সামরিক বাহিনীর ডাক্তার-যুদ্ধাহত সৈনিক নিয়েই আমার কারবার। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে যুদ্ধাহত কত সৈনিকই তো দেখলাম কিন্তু মেজর তাহেরের মত একজনও দেখিনি। অমন আহত অবস্থায় রোগীরা যন্ত্রণায় চিৎকার করে- বাবাগো, মাগো, আল্লাহ-ভগবান বলে বিলাপ করে। কিন্তু তাহেরকে যখন এম্বুলেন্সে উঠালাম-তিনি নিশ্চুপ তাকিয়ে ছিলেন, আমায় দেখলেন। ভাবলাম, অধিক রক্তক্ষরণে নির্জীব হয়ে গেছেন। আমি তাড়াতাড়ি স্যালাইনের ব্যবস্থা করলাম। এম্বুলেন্স নিয়ে যখন বাঁধরোড অতিক্রম করে মহেন্দ্রগঞ্জ থানার কাছে এসেছি-তিনি জানালা দিয়ে চারদিকে তাকালেন। এরপর আমাকে বললেন- উড়পঃড়ৎ, ও ংঁঢ়ঢ়ড়ংব ও ধস হবধৎ ঃড় গবযবহফৎধমধহল ঞযধহধ?
আমি বললাম, ‘ণবং’
বললেন ঝঃড়ঢ় ঃযব াবযরপষব. গাড়ি থামানো হল। তিনি বললেন, ‘চষবধংব ঃধশব ধ ঢ়রবপব ড়ভ ঢ়ধঢ়বৎ ধহফ ৎিরঃব যিধঃ ও ংধু.’
তাঁর নির্দেশমতো কাগজ কলম নিয়ে লিখলাম তিন লাইনের একটি চিঠি। তাঁর পরামর্শমতোই চিরকুটটি থানার ওসিকে দেয়া হলো, যা আপনি পেয়েছেন। তারপর থেকে সেদিনকার ঘটনাটি আমি অনেক ভেবেছি। অমন মারাত্মক আহত অবস্থায় একজন মানুষ অমন সুচিন্তিত কথা বলতে পারে-নির্দেশ দিতে পারে-তা আমি আজও ভাবতে পারি না। আমার মনে হয়-ওঃ ধিং হড়ঃ গধল. ঞধযবৎ ঃধষশবফ ঃড় সব ৎধঃযবৎ রঃ ধিং যরং রহারহপরনষব রিষষ ঢ়ড়বিৎ ধহফ ফবঃবৎসরহধঃরড়হ যিড় ঃধষশবফ. অমন সাহসী ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী মানুষ আমি দেখিনি!”
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মার্চ ১৯৭২ মেজর তাহের পুনা হাসপাতাল থেকে দেশে ফিরে আসেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তাঁর বাসায় দেখা করতে গেলাম। পুনা হাসপাতালে চিকিৎসার কথা, ‘ফলস’ পা লাগানোর কথা তাঁর মুখে বিস্তারিত শুনলাম। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে দেখতে পুনা হাসপাতালে গিয়েছিলেন এবং কেমন আন্তরিকতার সাথে তাঁর চিকিৎসার খোঁজ খবর নেন, সে ঘটনা বর্ণনা করলেন তিনি।
মেজর তাহেরের সাথে দীর্ঘ আলাপচারিতার এক পর্যায়ে তিনি হাসতে হাসতে বললেন,- ‘জামান, আমার জন্ম হয়েছে ১৪ নভেম্বর, পঙ্গু হলাম ১৪ নভেম্বর, মনে হয় আমার মৃত্যুও হবে কোন এক ১৪ নভেম্বর।’
তাই কি হয়েছিল?
প্রত্যেক ২১ জুলাই কর্নেল তাহেরের স্মৃতি উজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে আমার মনের আকাশে। আর ভাবি, তাই কি হয়েছিল?
-সান ফিচার সার্ভিস
Leave a Reply