আজ থেকে ২৮ বছর পূর্বে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার মধ্যে দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং দ্বিতীয়টি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। ২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুসারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করে। কয়েকজন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর বিচারকার্য সম্পন্ন হয়েছে, এবং বাকীদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান। কিন্তু অন্য গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।
অনেকে মনে করেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর মধ্যে দিয়ে নির্মূল কমিটির কাজ সমাপ্ত হয়েছে। কিন্তু আদতে তা হয়নি। এখনও বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়নি। যতদিন না বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে ততদিন নির্মূল কমিটির আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সফল করতে হলে তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বে এগিয়ে আসতে হবে। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের গণআদালতে বিচারের মধ্যে দিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলন একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ১৯৭২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন দেশের রাজপথে শহীদ পরিবারের সদস্যরা প্রথম মিছিল করে তাদের দাবি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপন করেন। সে দাবি তখন ছিল মুষ্টিমেয় স্বজন হারানো শহীদ পরিবারের। ক্রমশ এই দাবি সাধারণ মানুষের মধ্যে আবেদন সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বিস্তার লাভ করে।
বঙ্গবন্ধু দালাল আইন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি দেশে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আনুকূল্যে যুদ্ধাপরাধীরা সমাজ ও রাষ্ট্রে পুনর্বাসিত হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ধারার রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলে। কিন্তু এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও শহীদ পরিবার ও সুশীল সমাজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখেন।
১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামীর আমীর নির্বাচিত করার পর সুশীল সমাজ এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। প্রতিবাদের ফলস্বরুপ ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। এই কমিটি ২৬ মার্চ প্রকাশ্য গণআদালতে গোলাম আযমের বিচার করে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করে তৎকালীন বিএনপি-জামায়েত জোট সরকারকে তা বাস্তবায়নের অনুরোধ জানায়। কারণ গণআদালত কোনো প্রচলিত আদালত ছিল না, যে তারা রায় বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার রায় বাস্তবায়ন না করে উল্টো শহীদজননীসহ নির্মূল কমিটির ২৪ জন নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করে। হামলা-মামলা দিয়ে নির্মূল কমিটিকে দমিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। গণতদন্ত কমিশন গঠন করে পর্যায়ক্রমে ১৬জন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর অপকর্ম জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা মাথায় নিয়ে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন শহীদ জননী মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য চলমান আন্দোলন স্তিমিত হলেও বন্ধ হয়ে যায়নি। তখন তরুণ প্রজন্মকে সাথে নিয়ে এই আন্দোলন অব্যাহত রাখেন শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন, শহীদজায়া শ্যামলী নাসীর চৌধুরী, কাজী মুকুলসহ অন্যরা। এই সময়ে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করার জন্য নির্মূল কমিটি ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র’ ও ‘শহীদ স্মৃতি পাঠাগার’ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে নতুন করে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলন তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্মূল কমিটি ও অন্যান্য সমমনা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সহায়তায় জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের সহযোগী সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। ফলস্বরূপ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয় লাভ করে।
ক্রমশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি শহীদ পরিবার ও সুশীল সমাজের গণ্ডীর বাইরে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্মূল কমিটির শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। তরুণ প্রজন্ম এই আন্দোলনে যোগদান করে যুদ্ধপরাধীদের বিচারের দাবিকে নতুন মাত্রা দেয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নির্মূল কমিটির শাখা গঠন করে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করার কাজ এগিয়ে চলে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও ছাত্রদের নিয়ে কমিটি গঠন করে তাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উজ্জীবিত করার চেষ্টা অব্যাহত থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মহাজোটকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করে। বঙ্গবন্ধু কন্যা সরকার গঠনের পর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদের মোল্লার রায়ের প্রতিবাদে শাহবাগে গণজাগরণমঞ্চ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি তাদের ঘৃণা এবং বিচারের প্রতি তাদের দৃঢ়তা প্রকাশ করে। জয় বাংলা স্লোগান আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে। শহীদ জননীর ছবি সামনে রেখে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে জেগে ওঠা শাহবাগ কাদের মোল্লাসহ শীর্ষ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রত্যক্ষ করেছে। তরুণরা প্রমাণ করেছে তারা শহীদ জননীর আন্দোলনের সন্তান।
গত ২৮ বছরের আন্দোলনের ভেতর দিয়ে নির্মূল কমিটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত একটি প্রজন্ম সৃষ্টি করতে পেরেছে। আন্দোলনে যৌথ নেতৃত্ব গড়ে উঠেছে কেন্দ্র থেকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে নির্মূল কমিটির যাত্রা শুরু হয়েছে এবং শীর্ষ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে আন্দোলনের সফলতা এসেছে। এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তরুণ প্রজন্মকে সাথে নিয়ে নির্মূল কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। ২০২০ সাল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘মুজিব বর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছে। শহীদ জননীন আন্দোলনের সন্তান তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে যাত্রা শুরু করলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন সত্যি হবে। মুজিব বর্ষে এই প্রত্যাশা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক তপন পালিত সূত্র বিডিনিউজ২৪ডটকম
Leave a Reply