নিজস্ব সংবাদ দাতা: জলাবায়ু পরিবর্তনের মুখে বারবার দুর্যোগতাড়িত হয়ে শ্যামনগরের পদ্মপুকুরের আলিমুদ্দিন ও তার পরিবার এখন বাস্তুহারা হয়ে বস্তিবাসীর খাতায় নাম লিখিয়েছে। পৈত্রিক এক চিলতে জমি আর ছোট্ট একটি ঘর নিয়ে পাঁচটি মুখের খাবার যোগাতে আলিমুদ্দিনকে সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলে মাছ কাঁকড়া ধরতে যেতে হতো। কিন্তু ভয়াবহ আইলা তার বেঁচে থাকার সব স্বপ্নকে ধূলিস্যাত করে নিয়েছে সব সম্পদ। শুধু আলিমুদ্দিন নয়, এমন দুর্যোগের মুখে প্রাণ ও সম্পদ হারিয়ে উদ্বাস্তু হওয়া গাবুরার দরিদ্র মানুষগুলো তাদের কর্মসংস্থান হারিয়ে বেঁচে থাকার জন্য তল্পিতল্পা নিয়ে সাতক্ষীরা ও খুলনা শহরে বস্তিতে আস্তানা গেড়েছে। এখন তাদের সামনে কোন স্বপ্ন নেই। শুধু দিন এনে দিন খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে তাদের। এই চিত্র সাতক্ষীরার বস্তিবাসীদের। যাদের সামান্য হলেও সম্পদ ছিল, কাজ ছিল। এখন তারা স্বর্বস্ব হারা। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় এলাকার জীবন জীবিকা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে দক্ষিণের বড় অংশ বারবার জলোচ্ছ্বাসের মুখে পড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় এই অঞ্চল পানিতে তলিয়ে যাবার আশংকা মাথায় নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে এরই মধ্যে হয় দেশান্তরী হয়েছেন না হয় দেশের অন্য কোনো এলাকায় যেয়ে জীবন রক্ষার সংগ্রামে নেমেছেন। একইভাবে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ ২০০৭ এর ভয়াল সিডরের দাপটে সাগরগর্ভে তলিয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, ঘন ঘন দুর্যোগ ঝুঁকি, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার শিকার দেশের দক্ষিণ পশ্চিমের ধনী গরিব সব মানুষ। তবে ধনী মানুষ অর্থের জোরে বিকল্প খুঁজে নিতে পারলেও দরিদ্র শ্রেণির মানুষ পড়ছে মহাসংকটে। এই সংকট উপকূল থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে নগরে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এদের বড় অংশই হয়ে উঠছে বস্তির মানুষ। তারা হারাচ্ছেন তাদের পেশা। নতুন পেশা খুঁজে পাওয়াও তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়ছে। লেখাপড়া জানা শিক্ষিত ছেলেরাও এখন শহরে রিকশার হ্যান্ডেল ধরেছে কিংবা দৈনিক ভাড়ার চুক্তিতে ইজিবাইক চালিয়ে জীবনধারণের চেষ্টা করছে।
নগর জনপদের বস্তিবাসী মানুষ সবচেয়ে বড় সংকটে পড়ে যে কোনো দুর্যোগ আঘাত হানলে। এমন আঘাত ১৯৮৮ থেকে ২০২১ পর্যন্ত কমপক্ষে ১৫টি। গত ১২ জুন ২০২২ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জরিপের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার কয়েকটি এলাকার বস্তিবাসী ৭২ শতাংশ তরুণী ও কিশোরীরা তাদের গোসল ও বাথরুম নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। বিশেষ করে পিরিয়ডকালীন তারা আরও সংকটে পড়ে। সব বয়সের নারী পুরুষের মুখোমুখি হয়ে তাদের সংকট আরও বেড়ে যায়। এজন্য প্রকৃতির কাজ সারতে তাদের রাত পর্যন্ত অনেককেই অপেক্ষা করতে হয়। এসব তরুণী ও কিশোরীরা অভিযোগ করে বলেন, খোলামেলা এবং আচ্ছাদন না থাকায় পাশ^বর্তী সুউচ্চ ভবনগুলি থেকে ছেলেরা মোবাইলে তাদের ভিডিও ধারণ করে এবং অনেক সময় ইন্টারনেটে ছেড়ে দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে। এমন বিব্রতকর অবস্থা থেকে তারা কোনভাবে মুক্তি পাচ্ছেন না। সাতক্ষীরা জেলার হালনাগাদ জনগোষ্ঠী ২৫ লাখ পেরিয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা পৌর এলাকার জনগোষ্ঠী দুই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ৩১.১০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই পৌরসভায় বস্তি আছে ৪৭ টি। এর মধ্যে ১৫টি সরকারি ও কিছু ক্লাস্টার বস্তি রয়েছে। বিবিএস এর ২০১৪ সালের পরিসংখ্যান বলছে, সাতক্ষীরা পৌর এলাকায় ৩৩ হাজার খানা রয়েছে। এর মধ্যে বস্তিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৪৫ হাজার। বস্তিবাসীদের খানার সংখ্যা কমবেশী ৮ হাজার। তারা সবাই বিভিন্ন সময় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নিজ নিজ এলাকা থেকে তাড়িত হয়ে এখানে সরকারি অথবা ব্যক্তি মালিকানাধীন জমিতে বসতি গড়েছেন।
Leave a Reply