২৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সাংবাদিক ঐক্য’র নাগরিক সংলাপে বক্তাদের প্রতিশ্রুতি
সাতক্ষীরার মাটিতেই বিচার হবে শহীদ সম আলাউদ্দিনের খুনীচক্রের
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি: ১৯৭১ এ মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কোনরকম আরাম আয়েশের চিন্তা না করেই রাইফেল হাতে নিয়ে শত্রু নিধনে সাহসী ও অনবদ্য ভূমিকা রাখা সেদিনের ২৬ বছরের যুবক আলাউদ্দিন হত্যার বিচার এই সাতক্ষীরার মাটিতে একদিন হবেই। ৩৪ বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন করার দৃষ্টান্ত রয়েছে আমাদের রাষ্ট্রে, অথচ ২৬ বছর ধরে সম আলাউদ্দিনের বিচার হয়নি এমনটি হতাশাব্যঞ্জক উল্লেখ করে বক্তারা বলেছেন, এর জন্য কোন দল, কোন ব্যক্তি বা কোন গোষ্ঠী সরাসরি দায়ী নয় বরং আইনের কিছু খামতি এই বিচারকে বাধাগ্রস্থ করেছে। খুনীরা যত প্রতাপশালী হোক একদিন তাদের এই পাপের শাস্তি নিতেই হবে।
শনিবার শহীদ সম আলাউদ্দিনের ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকী ও ২৭ বছরে উত্তরণ উপলক্ষ্যে সাতক্ষীরার সাংবাদিক ঐক্য আয়োজিত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সম আলাউদ্দিন ও সাতক্ষীরা’ শীর্ষক এক নাগরিক সংলাপে এই অভিমত ব্যক্ত করেন অভ্যগতরা। তারা বলেন, একজন আলাউদ্দিনকে হত্যার পর তার বিচার না হওয়া সংস্কৃতি আরও হত্যাকে উৎসাহ যোগায়। আমরা প্রস্তাব করছি বিচার বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কয়েক সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই বিচার ত্বরান্বিত করার দাবি জানাচ্ছি। ২৬ বছর ধরে আমরা বিচার বাস্তবায়নের চেষ্টা করেও তা আদালতের কাঠগড়া পর্যন্ত আমাদের দাবি তুলে ধরতে না পারার ব্যর্থতা স্বীকার করে নিচ্ছি। এ বিষয়ে স্থানীয় সংশ্লিষ্ট বিচারকের সাথে সাক্ষাৎ করে বিচার বাস্তবায়নের ব্যাপারে আগ্রহী করে তোলা হবে।
শহরের এলজিইডি মিলনায়তনে সাংবাদিক ঐক্যের আহবায়ক সুভাষ চৌধুরীর সভাপতিত্বে নাগরিক সংলাপে অংশ নিয়ে জেলা পরিষদ প্রশাসক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত যথার্থভাবে বিচার আদায় করতে পারিনি। শহীদ সম আলাউদ্দিন গণমানুষের নেতা ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৯৯৬ এর নির্বাচনের প্রাক্কালে আমি নিজেও এমন একটি গুপ্ত হত্যার শিকার হতে চলেছিলাম। কিন্তু আমার পরিচিত কয়েকজন তারা আমাকে সতর্ক করে দিয়ে রাজনৈতিক সমাবেশে যথাযথ সুরক্ষা দিয়ে এই গুপ্ত হত্যাকে কৌশলে প্রতিহত করেছিলেন। আলাউদ্দিন হত্যার পর আমার সেই ধারনাই হলো যে, রাজনৈতিক নেতারা কোন সময় নিরাপদ নন। বিশেষ করে নির্বাচনে আসন দখল প্রতিযোগিতায় নেমে তারা ভাড়াটে হিসাবে রাজনৈতিক নেতাদের সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে থাকে। হত্যার দীর্ঘ ২৬ বছর পরও এই বিচারের জন্য আমরা বারবার আবেদন জানাচ্ছি। নিশ্চয়ই একদিন সাতক্ষীরার উন্নয়নের উপকার, শিল্প উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী সহ প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ভোমরা স্থলবন্দরের প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা এবং সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্সের সূতিকাগার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সম আলাউদ্দিনের বিচার আদায়ে সব রকম উদ্যোগ গ্রহণ করবো।
সংলাপে অংশ নিয়ে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন মশু বলেন, শহীদ আলাউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধকালে অনেকের মতো আরাম আয়েশে গা ভাসিয়ে না দিয়ে কাদামাটির মধ্যে গেরিলাযুদ্ধ করে শত্রু নিধন করার সাহস দেখিয়েছেন। একজন গণপরিষদ সদস্য হিসাবে গেরিলাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার দৃষ্টান্ত এই যুবকই রাখতে পেরেছিলেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, তাকে সরিয়ে দিয়ে সাতক্ষীরার উন্নয়নকে চরম বাঁধার সম্মুখীন করা হয়েছে। আলাউদ্দিন ভাই বেঁচে থাকলে আমরা সাতক্ষীরাবাসী আরও উন্নয়নের অংশীদার হতে পারতাম।
জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি বিশিষ্ট সমাজসেবক শেখ আজহার হোসেন বলেন, তিনি ছিলেন একজন ডাকসাইটের নেতা। যে কাজে তিনি হাত দিতেন তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার পেছনে লেগে থাকতেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তিনিই প্রথম এখানে কৃষিভিত্তিক সমাজ এবং শিল্পভিত্তিক বানিজ্য গড়ে তোলার সব উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমরা তার ডাকে সাড়া দিয়ে মাঠে নামতাম। আমাদের দূর্ভাগ্য, এমন উন্নয়ন সূতিকাগারকে আমরা অকালেই হারিয়েছি। আমি ঘাতকদের বিচার দাবি করছি এবং যতদিন বিচার সম্পন্ন না হবে ততদিন আমরা সবাই মাঠে থাকবো।
বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ আবু আহমেদ তার বক্তব্যে বলেন, খুনীরা তার সাথে কৌশলে মিলেমিশে থাকতো। আর তারাই তাকে হত্যা করে সাতক্ষীরার সার্বিক উন্নয়ন ভাবনাকে বাঁধাগ্রস্থ করে দিয়েছে। সম আলাউদ্দিন একজন বজ্রকন্ঠী সাচ্চা মানুষ ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা তার ভিতর বাহির সবটাই দেখে বুঝতাম, তিনি মনেপ্রাণে একজন রাজনীতিক, একজন শিল্প উদ্যোক্তা, একজন দরদী জনপ্রতিনিধি। তিনি সবাইকে সহযোগিতা দিয়ে নিজের জন্য কোনকিছু প্রত্যাশা করেননি। এমন মানুষ এই সমাজে খুজে পাওয়া বিরল। আজ তিনি জীবিত থাকলে আমরা সাতক্ষীরাকে অন্য চেহারায় দেখতে পেতাম।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান বাবু বলেন, আলাউদ্দিন সাহেব আমাদের নেতা ছিলেন। তিনি আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমরা তার কথা যথাযথভাবে মান্য করতাম। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে এবং সাতক্ষীরার উন্নয়নের রূপকার হিসাবে তার ভূমিকা কোনভাবেই কেউ খাটো করে দেখতে পারবে না। এই হত্যার বিচার বাস্তবায়নের জন্য যা কিছু করতে হয় আমি আপনাদের সঙ্গে থেকে তা করতে রাজী আছি। একইসাথে আমি তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে বিচার আদায়ে ব্যর্থতা স্বীকার করে নিচ্ছি।
দৈনিক দৃষ্টিপাত সম্পাদক জিএম নূর ইসলাম বলেন, আলাউদ্দিন সাহেবের সাথে প্রতিদিন রাত সাড়ে ১০টার পরে পত্রদূত অফিসে আমার সাক্ষাৎ হতো। কিছুক্ষণ গল্পআড্ডা দিয়ে চা খেয়ে আমি বাড়ি চলে যেতাম। একজন শিল্প উদ্যোক্তা হিসাবে তিনি পাটকেলঘাটা অঞ্চলে একটি মিনি সুগার মিল তৈরীর উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ভোমরা স্থলবন্দরের প্রতিষ্ঠালগ্নে সেখানকার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আমি ও আমরা পত্রপত্রিকায় রিপোর্ট করতাম। আলাউদ্দিন ভাই একদিন আমাকে ডেকে বলেন, বন্দরটি কেবলমাত্র যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে। এক্ষুণি যদি রাস্তাঘাট, টেলিফোন, ব্যাংক, ভবন এসব সমস্যা তুলে ধরা হয় তাহলে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা খুব কঠিন হয়ে পড়বে। জিএম নূর ইসলাম বলেন, আমি সেদিনই বুঝেছিলাম, একটি পজিটিভ নিউজ নেগেটিভ নিউজে রূপান্তরিত হতে পারে। তার এই পরামর্শ অনুযায়ী আমরা ভোমরা বন্দরের সব ভালো দিক তুলে ধরতাম।
বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা আনম তারেক উদ্দিন বলেন, সম আলাউদ্দিন সাতক্ষীরাকে গড়তে চেয়েছিলেন। তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারলো না। ঘাতকদের বুলেট তার প্রান কেড়ে নিয়েছিল। আমি এই হত্যার বিচার বাস্তবায়নে সবাইকে এগিয়ে আসার আহবান জানাই।
জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আনিসুর রহিম আলাউদ্দিন হত্যার ভিতর ও বাহির নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য তুলে ধরে বলেন, আমি নিজে কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে ঘাতকদের পিছু ধাওয়া করেছিলাম, সেইসাথে পুলিশও। এরই মধ্যে একজন ঘাতককে সেখানে গাড়ি নিয়ে এসে কথা বলতে শুনলাম, আলাউদ্দিন এখনও মরেনি ? অধ্যক্ষ আনিসুর রহিম বলেন, তাকে হত্যা বাস্তবায়নের জন্য ১৬ই জুন প্রস্তুত হয়েছিল ঘাতকরা। কিন্তু বন্দুকের গুলি বের না হওয়ায় ওইদিন তারা আলাউদ্দিন ভাইকে খুন করতে পারেনি। হত্যার আগে ও পরে আমি প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে যেসব ঘটনা দেখেছি তা আদালতে তুলে ধরেছি। আমি এই হত্যার দ্রুত বিচার দাবি করছি।
নাগরিক সংলাপে চ্যানেল আইয়ের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি ও প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ একটি মুখবন্ধ তুলে ধরে তা পাঠ করে শোনান। এতে তিনি শহীদ সম আলাউদ্দিনের জীবনের সকল দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেন। যার মধ্যে ছিল, কৃষিভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা, শিল্প ভিত্তিক বানিজ্য প্রতিষ্ঠা, কারিগরী শিক্ষা সম্প্রসারণ, ভোমরা স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠা, সাতক্ষীরা চেম্বার অব কমার্স প্রতিষ্ঠাসহ বহু দিক। একারনে তিনি ঢাকা, কোলকাতা, দিল্লী সকল স্থানে সংশ্লিষ্টদের কাছে যথাযথ আবেদন করেছিলেন।
সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদক মোঃ আলী সুজন বলেন, আমার বাবা এএফএম এন্তাজ আলী ও আমার চাচা সম আলাউদ্দিন দুজনেই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তারা দেশ ও জাতির জন্য কাজ করে গেছেন। দুর্ভাগ্য বশতঃ আমরা শহীদ সম আলাউদ্দিনকে অকালে হারিয়েছি। খুনীরা তাকে বেঁচে থাকতে দিলো না।
নাগরিক সংলাপে অংশ নিয়ে আরও বক্তব্য রাখেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সহ-সভাপতি আব্দুল ওয়াজেদ কচি, দৈনিক দক্ষিণের মশাল সম্পাদক অধ্যক্ষ আশেক ই এলাহী, বিশিষ্ট এনজিও ব্যক্তিত্ব মাধব চন্দ্র দত্ত, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী, বাংলাদেশ বেতারের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি ফারুক মাহবুবুর রহমান, আলাউদ্দিন কন্যা লায়লা পারভিন সেঁজুতি, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল বারী, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা শেখ হারুনার রশিদ, বাসদ নেতা এড. শেখ আজাদ হোসেন বেলাল, জাসদ নেতা ওবায়দুস সুলতান বাবলু, দৈনিক কল্যাণের প্রতিনিধি কাজী শওকত হোসেন ময়না, টিভি জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের আহবায়ক আবুল কাশেম, জাসদ অপরাংশের নেতা সুধাংশু শেখর সরকার, উদীচির শেখ সিদ্দিকুর রহমান, গণফোরাম নেতা আলী নূর খান বাবুল, আশাশুনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান অসীম চক্রবর্তী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির ডা. মুনসুর রহমান প্রমুখ।
দেশটিভি ও দেশ রূপান্তরের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি সাংবাদিক ঐক্য’র সদস্য সচিব শরীফুল্লাহ্ কায়সার সুমনের সঞ্চালনায় সকাল থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নাগরিক সংলাপে উঠে আসে অনেক তথ্য। এসময় তিনি বলেন, অকালে তার প্রাণঘাতে আমরা একজন সফল রাজনীতিক, সফল উন্নয়নের রূপকারকে হারিয়েছি। তার হত্যার বিচার আমরা আদায় করবোই।
সভার সভাপতি সুভাষ চৌধুরী শহীদ আলাউদ্দিনকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, তিনি ছিলেন একজন উদার মানসিকতার মানুষ। তিনি মানুষকে ভালোবাসতেন। দলীয় কর্মীদের ভালোবাসতেন। সমাজের প্রতিটি মানুষের সাথে তার মধুর সম্পর্ক ছিল। যে পত্রিকাকে তিনি তার দল আওয়ামী লীগ ও রাষ্ট্রের কাছে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন না হতে হয় বলে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছিলেন সেই পত্রিকা অফিসেই ঘাতকদের বুলেট তার বক্ষ ও মস্তক ভেদ করে তার প্রাণবায়ু নিভিয়ে দেয়। এই মানুষটির মৃত্যুর পরও তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র থামেনি। তাকে নিয়ে অপপ্রচারও থামেনি। আমি এই হত্যার বিচার বাস্তবায়নে সকলকে এগিয়ে আসার আহবান জানাই।
১২
Leave a Reply