বৈশাখের মধ্য গগণে সূর্যের তেজ ফুটছে সেদিন। কৃষ্ণচূড়ার আগুন লেগেছে যেন নগরে। রাজশাহী জেলের জানালা দিয়ে এগিয়ে আসা কৃষ্ণচূড়ার আগুন রাঙা ডাল দেখবে সমস্ত কক্ষ, আকাশে বাতাসে তার রঙ আজ। কে জানত ধূসর মাখা এক বিকেলে নামবে লাশের মিছিল। শ্রাবণের অঝোর বর্ষণের মতো ঝরবে রক্ত। রাজশাহী জেলের ভিতরে আরেক জেল যেন খাপড়া ওয়ার্ড। টালির ছাদ, চারপাশে দেওয়াল।
যেভাবে খাপড়া ওয়ার্ডে প্রতিবাদের সূচনা
পাকিস্তানে আমলে কারাবন্দীদের উপর প্রচণ্ড নির্যাতন চালানো হতো নানা অজুহাতে। অমানবিক নির্যাতনের সঙ্গে কম খাবার দেওয়া হতো, তামাক খাওয়া নিষিদ্ধ ছিল পুরোদমে। পশুর মতো ব্যবহার করা হতো বন্দীদের সঙ্গে। তেলের ঘানি টানানো, গম মাড়াই, পেষাই সহ নানান কাজ করতে হতো বন্দীদের। আর কাজ করতে দেরী হলে কিংবা করতে গিয়ে খানিকটা বিশ্রাম নিলে ভয়াবহ অত্যাচার নেমে আসত তাদের উপর।
প্রথমে রাজশাহী কারাগারের কমিউনিস্ট বন্দীরা প্রথম ওই অমানবিক শাস্তির প্রতিবাদ করেন। চলে অনশন। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে অন্য কারাগারগুলোতেও। ১৯৪৯ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা ও রাজশাহী কারাগারে বন্দীরা চার দফায় মোট ১৫০ দিন অনশন করলেন। খুলনা কারাগারে পিটিয়ে হত্যা করা হয় কমিউনিস্ট আন্দোলন কর্মী বিষ্ণু বৈরাগীকে। ঢাকা কারাগারে জোর করে খাওয়াতে গেলে ৮ ডিসেম্বর শিবেন রায়ের মৃত্যু হয়। অথচ প্রচার করা হয় শিবেন রায় ও বিষ্ণু বৈরাগী আত্মহত্যা করেছে। এর আগে যেসব বন্দীরাই প্রতিবাদ করেছে তাদেরকে শারীরিক নির্যাতনের পর আত্মহত্যা করতে চেয়েছে অভিযোগ এনে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হলো। অন্যদিকে রাজবন্দীদের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হলো তাদের।
রাজবন্দীরা আসায় একদিকে শাপে বর হলো সাধারণ বন্দীদের জন্য। কারণ সাধারণ বন্দীরা নীরবে চোখ বুজে সহ্য করে গেলেও রাজবন্দীরা প্রতিবাদ করতেন। রাজবন্দীদের সঙ্গে থাকতে গিয়ে বিষয়টি অনুধাবন করল সাধারণ বন্দীরা। প্রতিবাদে বন্দীরা বলল, কারাগারে নির্যাতন চালানো যাবে না। বন্দীদের ভালো খাবার দিতে হবে। অন্যদিকে বিষ্ণু বৈরাগী ও শিবেন রায়ের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে সারাদেশের কারাগারগুলোতে বন্দীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিচ্ছিন্নভাবে বন্দীরা কারাগারের ভিতরেই প্রতিবাদ-বিক্ষোভে অংশ নেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্দীদের উপর নেমে আসে অসহনীয় নির্যাতন। যখন কারাগার কর্তৃপক্ষ দেখল অত্যাচারেও কাজ হচ্ছে না, তখন কারা কর্তৃপক্ষ হিন্দু, মুসলমান ও আদিবাসীদের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা চালায়।
বন্দীরা তখন তা বুঝে ফেলে। রাজশাহী কারাগারের রাজবন্দীরা নির্যাতন বন্ধের দাবি ও সাম্প্রদায়িক উসকানির প্রতিবাদে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে স্মারকলিপি দেন। সেই চিঠিতে কারারক্ষী ও কারাগারের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিটি অভিযোগ ও সুস্পষ্ট বিবরণ ছিল। এই চিঠিতে কারাবন্দীদের সমস্যা সমাধানে ১৫ দিনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। ওই সময়ের মধ্যে কোনো উত্তর আসেনি মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে। জবাব না পেয়ে বন্দীরা ৫ এপ্রিল অনশন শুরু করেন। ক্রমে অনশনকারীর সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। একপর্যায়ে রাজবন্দীদের দাবির খবর পৌঁছায় আইজি প্রিজন আমীরউদ্দিনের কাছে। তিনি রাজশাহী সফরে এসে কয়েদী ও সাধারণ বন্দীদের বলেন অনশন ত্যাগ করার জন্য কিন্তু রাজবন্দীরা তা মানবেন না বলে জানিয়ে দেন। এর পরই তিনি রাজবন্দীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হন। কারা অভ্যন্তরে কমিউনিস্ট বন্দীরা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২ জন প্রতিনিধি পাঠালেন। বৈঠকের প্রথমেই মেজাজ হারিয়ে আইজি প্রিজন আমীর হোসেন প্রশ্ন তোলেন, সাধারণ বন্দী, কয়েদিদের সমস্যা নিয়ে রাজবন্দীরা কেন আন্দোলন করছে? উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে কোনো সমাধান ছাড়াই এই আলোচনার সমাপ্তি ঘটে। তখনও দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তের কথা বলেনি কারাগার কর্তৃপক্ষ। অনশন চালিয়ে যান বন্দীরা।
তখন ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ আইনে আইজি প্রিজন আমীর হোসেন জেল সুপার ডব্লিউ এফ বিলকে পরামর্শ দিলেন রাজবন্দীদের কয়েকজনকে সরিয়ে নিয়ে গেলেই অবস্থার সমাধান হবে। কিতু রাজবন্দীরা কেউই খাপড়া ওয়ার্ড ছেড়ে যেতে রাজী হলেন না। নির্দেশনা অনুযায়ী বলা হয়েছিল কমিউনিস্ট বন্দীদের ১৪ নম্বর সেলে যেতে হবে। ওই সেলটি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের জন্য। কুষ্ঠ ও যক্ষ্মা রোগীদের রাখা হতো। কারাগারে মারা যাওয়া বন্দীদের ময়নাতদন্তও হতো সেখানে। তখন কমিউনিস্ট বন্দীরা কারা কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান।
এদিকে সাত দিন চেষ্টা করেও যখন দেখা গেল কোন অগ্রগতি হচ্ছে না তখন রাজবন্দী ও কয়েদীদের কয়েকজন প্রতিনিধিদের জেল গেটে ডেকে এনে অনশন প্রত্যাহারের চাপ দেওয়া হলো। কিন্তু বন্দীরা অনড়, আগে তাদের দাবি মানতে হবে। এপ্রিল আইজি প্রিজন আশ্বাস দিলেন বন্দীদের শারীরিক নির্যাতন করা হবে না। নিজের পয়সায় বন্দীরা তামাক কিনে খেতে পারবে। এদিকে আইজি প্রিজন এটাকে দেখলেন ফায়দা লোটার বড় সুযোগ। তিনি আড়াই হাজার কয়েদীকে একত্র করলেন রাজশাহী কারাগারের খেলার মাঠে। সেখানে সমবেত বন্দীদের উদ্দেশ্যে বললেন, কমিউনিস্টরা বাইরে কিছুই করতে পারছে না। আর এখন জেলে এসে আপনাদের উসকে দিচ্ছে। সুবিধা লোটার চেষ্টা করছে আপনাদের উসকে দিয়ে। আপনারা কমিউনিস্টদের ফাঁদে পা দিয়ে নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনবেন না। অন্যদিকে আমীর হোসেন রাজবন্দীদের কক্ষে গিয়ে বললেন, ‘জেলের ভিতরে আপনারা বিপ্লবের নামে যে অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি করছেন তার পরিণাম শিগগির দেখতে পাবেন।’
এই পরিস্থিতিতে খাপড়া ওয়ার্ডের ভেতর রাজবন্দীরা বৈঠকে বসেন। বৈঠক চলে সারারাত।
২৪ এপ্রিল ১৯৫০
ভোরের দিকে বন্দীরা কিছু সময় ঘুমিয়ে ও নাস্তার খাওয়ার পর সকাল ৯টায় ফের আলোচনা শুরু করেন। ওই সময় জেল সুপার ডব্লিউ এফ বিল ওয়ার্ডের ভেতর ঢুকে বন্দীদের আবারও ১৪ নম্বর সেলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। জেল সুপার উত্তেজিত হয়ে ওয়ার্ডের দরজা বন্ধের নির্দেশ দিয়ে দৌড়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় তার পথরোধ করে দাঁড়ান বাবর আলী, দেলোয়ার ও রশিদ উদ্দিন। বিলের হান্টারের আঘাতে বাবর আলীর কব্জি ভেঙে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে হুইসেল বাজান। সঙ্গে সঙ্গে ৪০ জন কারারক্ষী খাপড়া ওয়ার্ড ঘিরে ফেলে। ওয়ার্ডের ভেতর কমিউনিস্ট বন্দীরা তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন, দরজা আটকে রাখতে হবে। তারা নারিকেলের ছোবড়া, চৌকি, তোশক বালিশ ও শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজা আটকে রাখেন। প্রসাদ রায় ছুটে গিয়ে দরজায় কাঁধ লাগান। বাইরে থেকে পুলিশ ধাক্কা দিতে থাকলে দরজা না খোলায় পুলিশ গুলি চালায়। গুলিবিদ্ধ প্রসাদ রায় মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়েন। বেপরোয়া পুলিশ ঢুকে পড়ে ওয়ার্ডের ভেতরে। রাইফেলের গুলির শব্দ আর অসহায় বন্দীদের আর্তচিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে কারাগারের বাতাস। খাপড়া ওয়ার্ডের বন্দীদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। তারা পুলিশের লাঠির আঘাতে মারাত্মক আহত হয়ে যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকেন। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পুরো কারাগারে। ঘটনাস্থলেই মারা যান ছয় জন। আহত হন ওয়ার্ডের সবাই। খাপড়া ওয়ার্ডে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন কুষ্টিয়া মোহিনী মিলের শ্রমিক নেতা হানিফ শেখ। চারপাশের নিস্তব্ধতা দেখে যখনই খুলনার ছাত্র নেতা আনোয়ার মাথা তোলেন ঠিক তখনই একটি গুলি এসে লাগে তার মাথায়। মুহূর্তেই লুটিয়ে পড়েন তিনি। তার মাথার খুলি উড়ে গিয়ে পড়ে পাশে নারকেলের ছোবড়ার মধ্যে।
পরিস্থিতি পুলিশ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ওয়ার্ডের ভেতর ঢোকেন জেল সুপার বিল। খুঁজে বের করেন রাজবন্দীদের নেতা আবদুল হককে। তাকে পেয়ে বিল রাগে দিশাহারা হয়ে হান্টারের শক্ত অংশ দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। রক্তাক্ত আবদুল হক মেঝের ওপর পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান। এই দৃশ্য দেখে গুলিবিদ্ধ রাজশাহীর বিজন সেন চিৎকার করে ওঠেন, ‘আমরা মরিনি কমরেড! আমরা জিতব। আগামী দিন আমাদের।’ এর পরই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একে একে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বাকিরা।
কেবল গুলিবর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ ও কারারক্ষীরা। আরেকদল পুলিশ এসে অতর্কিত লাঠিচার্জ শুরু করে আহত বন্দীদের উপর। এক বন্দী তখন তীব্র তৃষ্ণায় পানি পান করতে চাইলেন জেলার মান্নান সিপাহীকে নির্দেশ দিলেন সে বন্দীর মুখে প্রস্রাব করতে।
এর মধ্যে কারাগারের বাইরে থেকে রাজশাহীর পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্টকে খবর দেওয়া হয়েছিল যে রাজবন্দীরা জেলগেট ভেঙে পালাচ্ছে। তিনি কারাগারে এসে দেখেন পুরোটাই মিথ্যা এবং সাজানো। রক্তাক্ত খাপড়া ওয়ার্ড দেখে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে জেলার ও জেল সুপারকে গালাগাল করতে করতে পুলিশ নিয়ে চলে যান।
সেদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সাত জন কমিউনিস্ট নেতা-কর্মী। আহত হয়েছিলেন ৩২ জন।
খুলনার আনোয়ার হোসেন, রংপুরের সুধীন ধর, কুষ্টিয়ার হানিফ শেখ, ময়মনসিংহের সুখেন ভট্টাচার্য ও কুষ্টিয়ার দেলোয়ার হোসেন। বেলা ৩টায় গুরুতর আহত সৈয়দ মনসুর হাবিবুল্লাহ, আবদুল হক, কম্পরাম সিং, প্রসাদ রায়, বাবর আলী, আমিনুল ইসলাম বাদশা, শ্যামাপদ সেন, সত্যেন সরকার, সদানন্দ ঘোষ দস্তিদার, অনন্ত দেব, আবদুস শহীদ, প্রিয়ব্রত দাস ও নূরুন্নবী চৌধুরীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে মারা যান দিনাজপুরের কম্পরাম সিং। আহত অবস্থায় পরে শহীদ হয়েছিলেন বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা বিজন সিং ও তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী কম্পরাং সিং।
খাপড়া ওয়ার্ডে শহীদ প্রত্যেক বন্দীর লাশ গুম করে ফেলেছিল জেলার ও পুলিশ। শহীদদের কোন আত্মীয়স্বজনকে খবরটুকুও দেওয়া হয়নি। আর যেসব বন্দী আহত হয়েছিলেন তারা বেশীরভাগই পঙ্গু হয়ে গিয়েছিলেন। খাপড়া ওয়ার্ড গণহত্যা ছিল উপমহাদেশের প্রথম জেল হত্যা।
কিন্তু দীর্ঘদিন এই হত্যাকাণ্ডের খবর জানেনি সাধারণ মানুষ। সম্পূর্ণ চাপা পড়ে যায় এই হত্যাকাণ্ড। খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের কথা প্রকাশ্যে আসে ১৯৫৮ সালে সেখানে গুরুতর আহত আব্দুস শহীদের মাধ্যমে। তিনি খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড নিয়ে নিজের লেখা একটি বই ফেরি করে জানিয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষকে।
আজ ২৪ এপ্রিল রাজশাহীর কুখ্যাত খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডের দিন। খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ডে শহীদ রাজবন্দীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
সূত্র: খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড ১৯৫০/ মতিউর রহমান
( সংগৃহীত দ্যা ডেইলী স্টার, এপ্রিল ২৪, ২০২১)
Leave a Reply