॥ শাহিদুর রহমান ॥
করোনাভাইরাস মহামারীর সময় শিশু পাচার, শিশুর প্রতি যৌন ও শারীরিক নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসঙ্গে বাল্যবিবাহ ও মানসিক সহিংসতার শিকার হয়েছে শিশুরা। এ পরিস্থিতি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও সমাজের ওপর খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাসযোগ্য পৃথিবী বিনির্মাণে শিশুদের ওপর সকল প্রকার সহিংসতা বন্ধ করতে সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে।
এক মাত্র মেয়েকে নিয়ে কষ্টের মধ্যে দিনপার করছি। সারাদিন ভাবি কিভাবে মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ বানাবো।স্বামী-স্ত্রী,ছেলে ও মেয়ে মোট পরিবারের সদস্য সংখ্যা চারজন। বসবাস করার মত ঘর টুকু ছাড়া আর কোন জমি না থাকায় ডাব বিক্রি করে কোন রকমে সংসার চালায় ।শুক্রবার সকালে ভয়েস অব সাতক্ষীরা অফিসে এসে অশ্রুসিক্ত কন্ঠে এসব কথা বলেন সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল গ্রামের নির্যাতনের শিকার ২য় শ্রেনির ছাত্রীর পিতা।
তিনি বলেন, আমার মেয়ে পলাশপোল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২য় শ্রেনির ছাত্রী। তার বয়স ৯ বছর। সে ০৫.০৩.২০১৩ ইং তারিখে নানার বাড়িতে জন্ম গ্রহন করে। আমি একজন ডাব বিক্রেতা এবং স্ত্রী বাসায় গৃহিনীর কাজ করে। আমার এক মাত্র মেয়ে গত দুই বছর থেকেই স্কুলে যেত এবং স্কুল থেকে সে তিনটি বই পায়। তারা এক ভাই এক বোন এবং সে বড়। তার ছোট ভাইয়ের বয়স ৫ বছর ।কিন্ত করোনা পরিস্থিতির জন্য স্কুল বন্ধ থাকায় তার সময় কাটত বাড়ির পাশে সমবয়সীদের সাথে খেলাধুলা করে।
তিনি আরও বলেন, আমার মেয়ে মানসিক প্রতিবন্ধী একটি মেয়ে।সে তার বন্ধুদের সাথে খেলতে খুব ভালোবাসত। কিন্তু এই খেলাধুলা করাটাই তার জন্য অভিশাপ হয়ে গেল। কেননা ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখ তার জীবনে ঘটে গেল মর্মান্তিক ঘটনা।
ঘটনার দিন আনুমানিক বিকাল ৪ টার দিকে সে তার বাড়ির পার্শ্বে খেলাধুলা করছিল এবং একসময় সে এক নির্মাণাধীন বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন সেই নির্মাণাধীন বাড়ির কর্তা শামছুল গাজী (৫০) তাকে ডাক দেয় এবং খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে তাকে নির্মানাধীন বাড়িতে নিয়ে যায় এবং উক্ত নির্মানাধীন ঘরের মধ্যে নাবালিকা মেয়েটির মুখ চেপে ধরে শরীরের স্পর্শকাতর স্থান (যৌনাঙ্গে) হাত দিয়ে জোর পূর্বক ধর্ষণের চষ্টা করে।ব্যথায় মেয়েটি চিৎকার ও কান্নাকাটি করে উঠলে তার নানা ও নানি ঘটনাস্থলে পৌছালে আসাসী শামছুল গাজী আমার মেয়েকে ঘটনাস্থলে ফেলে দৌড়ে পালিয়ে যায়।সেসময় নানা-নানিকে কাছে পেয়ে নাবালিকা মেয়েটি ব্যথায় কাঁতরাতে ও কাঁদতে থাকে।তার মা দ্রুত আমাকে সংবাদ দেয় এবং দ্রুত তাকে নিকটস্থ ডাক্তারের কাছ থেকে চিকিৎসা করায়।
তারপর সাতক্ষীরা সদর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করি। এরপর সাতক্ষীরা সদর থানা হতে এই অভিযোগের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা আমার মেয়ের জবানবন্দি নেন। সে নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন ছিল। কিন্তু সে তখন পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। কেননা তখনও সে ভয়ে কুঁকড়ে থাকত। সে কারও সাথে কথা বলতে চাইত না। তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থাও স্বচ্ছল না।তার উপর মেয়ের এই অবস্থা দেখে আমরা খুবই চিন্তিত।
এদিকে, আমাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে সদর থানা হতে পুলিশ আসামীকে কয়েকবার গ্রেফতার করতে আসে কিন্তু এই আসামী পলাতক থেকে পরে কোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বাড়ি ফিরে আসে এবং পূর্বের মতো আবারও দেদার্ছে চলাফেরা করছে। আসামী এলাকায় ফিরে আসার পর আমার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় পড়ে এবং ভয় পেতে থাকে। আমরা খুব চিন্তিত এবং এই মামলার আসামীর যথাযথ শাস্তির জন্য কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
স্কুল ছাত্রীর মা জানান, স্থানীয় ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং বাড়িতে রাখা হয়। এরপর থেকে আমার মেয়ে কারও সাথে কথা বলতে চাইত না। তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে।পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খুব বেশি স্বচ্ছল না। আমরা একদিন কাজ না করলে সংসার ঠিক মতো চলেনা। তা উপর মেয়ের এই অবস্থা দেখে আমরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছি।
ভয়েস অব সাতক্ষীরার সম্পাদক এম কামরুজ্জামান জানান, ২০২১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী দেশের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৪৫ জন শিশু। সে হিসেবে দেশে শিশুর সংখ্যা আনুমানিক ৬ কোটি ৩০ লাখ। এর মধ্যে শতকরা ২৭ ভাগ শহরে ও ৭৩ ভাগ গ্রামে বাস করে। প্রতিদিন অসংখ্য শিশু পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ সমাজের বিভিন্ন স্থানে দৈহিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হয়। সেই সঙ্গে বাল্যবিবাহ ও পাচারের মত ভয়াবহ পরিণতিও হয় অনেক শিশুর। ২০১১ সালের প্রণীত শিশু নীতিমালায় শিশুদের মৌলিক মানবাধিকারের বিষয়টি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবে দেখা হয়েছে। সরকারি নীতি ও আইন থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ, শিশু শ্রম, যৌন নির্যাতন, শিশু পাচার একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিনত হয়েছে। এই অবস্থার প্রতিকারে সরকারসহ সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানায়।পাশাপাশি জরুরি সেবার হটলাইন ৯৯৯, ১০৯, ১০৯৮ এর ব্যবহার সম্পর্কে শিশুদের সচেতন করতে হবে।
মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান উজ্জল বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারনে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ও ইন্টারনেটের অপব্যবহার ফলে সাতক্ষীরায় ধর্ষণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ধর্মীয় অনুশাসন কেও দায়ি করেণ তিনি।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক অধ্যক্ষ আনিসুর রহিম জানান, দেশে কিছু ব্যক্তির হাতে অবৈধ পয়সা,অবৈধ ক্ষমতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি কারনে মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে ।যার ফলে শিশু ও নারী ধর্ষণ এবং নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর জন্য মানুষকে সচেতনতার পাশাপাশি আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে।
সাতক্ষীরা সদর থানার ওসি মোহাম্মদ গোলাম কবির জানান, স্কুল ছাত্রীর পিতার দেওয়া মামলাটির সত্যতা রয়েছে।আসামীর বিরুদ্ধে আমারা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম। আদালত থেকে আসামী জামিন নিয়েছে।নতুন ভাবে অন্যকোন সমস্যা করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
Leave a Reply