বদরুল আলম : এক পণ্যের ওপর নির্ভরশীল বৈচিত্র্যহীন রফতানি খাত। রাজস্ব আহরণের উৎস সীমিত। প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগও কাঙ্ক্ষিত মাত্রার চেয়ে অনেক কম। বিনিয়োগ আকর্ষণে যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিত্তিগুলো এখনো দুর্বল রয়ে গিয়েছে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে রূপান্তরের কালে অন্য কোনো দেশেই অর্থনীতির এমন দুর্বলতা দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার শর্ত পূরণ করে ২০১৫ সালে। ওই সময়ে দেশের মোট জাতীয় আয় (জিএনপি) মাথাপিছু ছিল ১ হাজার ২২০ ডলার। প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনার ভিত্তিতে কোনো দেশকে এলডিসির তালিকা থেকে উত্তরণের জন্য সুপারিশ করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট (সিডিপি)। সিডিপির পরপর দুটি ত্রিবার্ষিক সভায় সুপারিশপ্রাপ্ত হলেও উল্লিখিত দেশকে উত্তরণের যোগ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রথম দফায় ২০১৮ সালে ও দ্বিতীয় দফায় গত বছর উত্তরণের যোগ্য হিসেবে সুপারিশ পায় বাংলাদেশ। স্বীকৃতি পাওয়ার পরের তিন বছরকে ধরা হয় রূপান্তরকালীন প্রস্তুতি পর্ব হিসেবে। এ সময়ের মধ্যে সুপারিশপ্রাপ্ত দেশগুলো উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয়। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের ২০২৪ সালেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার কথা। তবে ঢাকার অনুরোধে সাড়া দিয়ে সিডিপি বাংলাদেশের রূপান্তরকালীন প্রস্তুতি পর্বের সময় নির্ধারণ করেছে পাঁচ বছর। সে হিসেবে ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। এছাড়া ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশের কাতারে পৌঁছারও লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি মাসেই এসব লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাব্য উপায় এবং এ নিয়ে বাংলাদেশের প্রস্তুতি সম্পর্কে তুলনামূলক বিশ্লেষণধর্মী এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইএমএফ।
নিম্নমধ্যম থেকে উচ্চমধ্যম আয়ে রূপান্তর ঘটানো কয়েকটি দেশের পাঁচ বছরের তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এতে দেখানো হয়েছে, বাণিজ্য, রফতানি, প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স, শুল্ক কাঠামো, করসহ সব সূচকেই দুর্বল অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
এ বিষয়ে আইএমএফের বক্তব্য হলো রফতানি এবং প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ নিম্ন ও উচ্চমধ্যম আয়ের দেশগুলোর প্রবৃদ্ধিতে বড় চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির প্রধান উৎস এখনো পোশাক রফতানি। এখানে মোট রফতানির ৮০ শতাংশই আসে পোশাক পণ্যের মাধ্যমে। দেশে প্রবৃদ্ধির আরেক চালিকাশক্তি প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। উচ্চ আয়ের দেশে রূপান্তরের ধারাবাহিকতায় এ রেমিট্যান্সপ্রবাহও কমে আসার আশঙ্কা রয়েছে।
অর্থনীতির রূপান্তরে কাঠামোগত শক্তিকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, কাঠামোগত শক্তিকে বাদ দিয়ে শুধু মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে রূপান্তর হলে যেকোনো দেশ সমস্যায় পড়তে বাধ্য। রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশের জন্য সুদহার বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে ঋণসেবার দায়ও। এ সমস্যা এড়ানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রাপ্রবাহ বাড়াতে হলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে কাঠামোগত পরিবর্তন করার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে পরিবর্তন আনা সম্ভব হলে অর্থনীতির প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে রফতানি ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যবহারের সক্ষমতাও।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে বাজার সুবিধানির্ভরতা থেকে সরিয়ে এনে দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতানির্ভর করতে হবে। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের কারণে এগুলো আমাদের করতেই হবে। মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের কারণে আমাদের ঋণের সুদ বেড়ে যাবে। এ দুই চ্যালেঞ্জের মুখে কাঠামোগত পরিবর্তন, অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় আহরণ বৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি—এগুলো যদি আমরা করতে না পারি তাহলে আমাদের মধ্যম আয়ের ফাঁদ ও ঋণ ফাঁদের মধ্যে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। এগুলো বিবেচনায় নিয়ে আগামী দিনের কৌশলগুলো নির্ধারণ করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, যেসব দেশের এ ঘাটতিগুলো রয়ে গিয়েছে, তারা ঋণের ফাঁদে পড়েছে। কেউ ফিলিপাইনের মতো নিম্নমধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়েছে। আবার কেউ উচ্চমধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়েছে, যেমনটা লাতিন আমেরিকার আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রে ঘটেছে। বাংলাদেশের যাতে এমন পরিস্থিতি না হয়, সেজন্য আমাদের অভ্যন্তরীণ সম্পদের ব্যবহার শক্তিশালী করা, কর জিডিপি অনুপাত বাড়ানো, সুশাসন, অর্থনীতির সক্ষমতার মতো প্রতিবন্ধকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
আইএমএফের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে বাণিজ্য জিডিপি অনুপাত ৩৯ দশমিক ৯। নিম্নমধ্যম আয়ের অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এ অনুপাতের রূপান্তকালীন গড় ৭৬ দশমিক ৮। রফতানি জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১৭ দশমিক ১। নিম্নমধ্যম আয়ের অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে অনুপাতটির রূপান্তরকালীন গড় ৩৩।
মোট প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ জিডিপি অনুপাত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ১ দশমিক ২। নিম্নমধ্যম আয় থেকে রূপান্তরকালে অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এর গড় ২ দশমিক ৫। আবার বাংলাদেশের শুল্কহারও অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি। কাস্টমস ও অন্যান্য আমদানি শুল্ক এবং কর আয় অনুপাত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ৬, অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে যা মাত্র ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরকালে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর এক্ষেত্রে গড় অনুপাত ৮ দশমিক ৩। উচ্চ আয়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে এ অনুপাত ২ দশমিক ৭।
কর জিডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের দুর্বলতা অনেক বেশি। রূপান্তরকালে বাংলাদেশের কর জিডিপি অনুপাত যেখানে ৮ দশমিক ৬, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে রূপান্তরকালে অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রে এ অনুপাতের গড় ১৬ দশমিক ২। আবার উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরকালীন গড় অনুপাত ১৯ দশমিক ৪। উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ে রূপান্তরের ক্ষেত্রে এর গড় ২০ দশমিক ৫০।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের বর্তমান কর জিডিপি অনুপাত দ্বিগুণ করতে হবে। রফতানি বৈচিত্র্যকরণের ক্ষেত্রেও আমাদের পারদর্শিতা খুব দুর্বল। অন্যান্য দেশের মতো আমরা রফতানিতে বৈচিত্র্য আনতে পারছি না। অন্যান্য দেশের কেন্দ্রীভবন অনেক কম, অন্যদিকে আমাদের কেন্দ্রীভবন অনেক উচ্চমাত্রার। কেউ বলতে পারে, কর জিডিপি অনুপাত কম রেখেও বাংলাদেশ উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর হবে। সেক্ষেত্রে আমি বলব, আয়ের সীমা হয়তো পার হলো, কিন্তু কর জিডিপি অনুপাত যদি বাড়াতে না পারে, তাহলে শিক্ষায় সরকার কীভাবে খরচ করবে? স্বাস্থ্যে কীভাবে খরচ করবে? অবকাঠামো, সামাজিক নিরাপত্তার মতো ক্ষেত্রগুলোয় এত কম কর জিডিপি অনুপাত দিয়ে সরকার কীভাবে ব্যয় করবে?
ড. সেলিম রায়হান আরো বলেন, বাণিজ্য জিডিপি অনুপাতেও বাংলাদেশের দুর্বলতা রয়েছে। তিন বছর ধরে বাণিজ্য জিডিপি অনুপাত কমছে। আমরা যদি বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে সমন্বিত হতে না পারি, তাহলেও একই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। নামে আমরা ধনী হলাম, কিন্তু কার্যত কি আমরা ধনী হচ্ছি? উচ্চমধ্যম আয়ের দেশগুলোর যে চেহারা, যেমন আমরা যদি মালয়েশিয়ার কথা চিন্তা করি বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশগুলো, যেমন সিঙ্গাপুর—এ দেশগুলোর মতো আমরা হব না। দেখা যাবে আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর মতোই আছি, কিন্তু আয়ের ক্ষেত্রে দেখাচ্ছি আমরা ধনী হয়েছি।
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, আয়ের সীমা পার করলেও বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্র যেমন রফতানি বৈচিত্র্যকরণ কেমন হয়েছে, বিদেশী বিনিয়োগ কতটা আকৃষ্ট করা যাচ্ছে, কর জিডিপি অনুপাত বাড়ানো যাচ্ছে কিনা, বাণিজ্য জিডিপি অনুপাত কেমন—এসব বিষয়ও পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের আয় হয়তো বাড়ছে, কিন্তু আমাদের সরকারের আয়ের আকার সে হিসেবে বাড়ছে না। সরকার দুর্বল অবস্থায় আছে, সরকারের টাকা কম। রাজস্ব আহরণের উৎস খুবই কম। ফলে সরকারের সেবা প্রদানের সক্ষমতা থাকবে না। অনেক ক্ষেত্রে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে; যেমন ঋণসেবার ব্যয়। আবার সরকারের বেতন-ভাতা ব্যয় বাড়ছে, পেনশন ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু সরকারের আয় সেভাবে বাড়ছে না। ফলে সামগ্রিকভাবে সমস্যাগুলো আরো ঘনীভূত হবে। বিষয়গুলোয় আমরা যদি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারি, তাহলে দেশের অগ্রযাত্রা থেমে যেতে পারে। কারণ আমাদের দুর্বলতাগুলোও বাড়ছে, যা আমাদের অর্থনীতিকে টেনে ধরবে। পাশাপাশি আছে আয়বৈষম্যের মতো সমস্যা। আছে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মান, সরকারি ব্যয়ের মান নিয়ে সমস্যা। এগুলো বিবেচনায় নিতে প্রথমেই অর্থের দরকার। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দরকার। এগুলো করতে না পারলে দেশ এগিয়ে যাবে কীভাবে? সুত্র : বণিক বার্তার সৌজন্যে।
Leave a Reply