বিভুরঞ্জন সরকার
গত কয়েক বছর থেকে নানা কারণে আলোচনায় আসা সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ৩৩ সদস্য বিশিষ্ট নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে ৭ জুন। ১৫১ সদস্যের অবশিষ্টদের পরে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও হেফাজতে ইসলাম রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েই আলোচনায় এসেছে। নারীনীতির বিরোধিতা দিয়ে শুরু করে হেফাজত কার্যত সাম্প্রদায়িক ধারার রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার কাজই করছে। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে জমায়েত হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের খোয়াব দেখেছিল হেফাজত। আওয়ামী লীগনিরোধী সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে গোপন সম্পর্ক গড়ে হেফাজত তার শক্তি প্রদর্শন করেতে দ্বিধা করেনি। তবে শাপলা চত্বরের নাশকতার পর হেফাজতের সঙ্গে সরকারের একটি গোপন সমঝোতা হয় বলে অনেকেই বিশ্বাস করেন। হেফাজতের প্রথম আমির শাহ আহমেদ শফীর সঙ্গে কৌশলের মৈত্রী করে সরকার হেফাজতকে আন্দোলনবিমুখ করতে সক্ষম হলেও তাদের এমন কিছু দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন এনে হেফাজতের মন রক্ষা করার সুদূরপ্রসারী কুফল পুরো জাতিকেই বহন করতে হবে।
হেফাজতে সরকারবিরোধী অংশ গত বছর থেকেই নেতৃত্ব কবজা করার পাঁয়তারা করে সফল হয় আহমেদ শফীর মৃত্যুর পর। আহমেদ শফী মৃত্যুবরণ করেন গত বছর ১৮ মার্চ। ১৫ নভেম্বর সম্মেলনের মাধ্যমে শফী অনুসারীদের বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির এবং নূর হোসেন কাসেমীকে মহাসচিব করে যে কমিটি গঠন করা হয় তাতে বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে জড়িতদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। হেফাজত সরকারবিরোধী অবস্থান দৃশ্যমান করে তোলে। যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ আরো কয়েকজন উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হেফাজতের নেতৃত্বে এসে ওয়াজ মাহফিলের নামে দশে উগ্র সাম্প্রদায়িক প্রচারণা চালাতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যবিরোধী বক্তব্য দিয়ে তারা সরকারকে তাতিয়ে তোলে।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের একটি অন্যতম মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও বাস্তবে কি ব্যক্তিজীবনে, কি রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থায় ‘ধর্ম’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবেই থেকে যায়। সাধারণ মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনার জন্য যে রকম প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন ছিল, শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণার অনুকূলে যে রকম মজবুত গাঁথুনি তৈরি করা দরকার ছিল তার কোনো কিছুই পরিকল্পিতভাবে করা হয়নি
এরপর মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের বিরোধিতা করতে গিয়ে হেফাজত দেশের বিভিন্ন স্থানে যে সহিংসতার আশ্রয় নেয় যা হজম করা সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে যায়। সরকার হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করায় হেফাজত কিছুটা বিপদের মধ্যেই পড়ে। আলোচিত- বিতর্কিত নেতা মামুনুল হকসহ অনেকেই গ্রেপ্তার হওয়ায় হেফাজত দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় সংগঠনের কমিটি বিলুপ্ত করা হয় ২৫ এপ্রিল রাতে। এটা হয়তো সরকারকে শান্ত করার একটি হেফাজতি কৌশল। তবে সরকারের কাছে যেসব তথ্য আছে তা থেকে মনে হয় না যে হেফাজত এবার শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে পারবে। মামুনুল হকসহ গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের নতুন কমিটিতে ঠাঁই না দেওয়া মানে অবশ্যই এটা নয় যে হেফাজত তার দৃষ্টিভঙ্গি বদল করেছে। হেফাজত সরকারি চাপের মুখে হেফাজত কৌশল বদল করলেও বাংলাদেশকে পাকিস্তানের আদলে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য থেকে সরে আসেনি।
অজ্ঞাত উৎস থেকে অর্থ প্রাপ্তি, পাকিস্তানি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগসহ যেসব তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পেয়েছে, গণমাধ্যমে যেসব খবর প্রকাশ হচ্ছে, তার ভিত্তিতে সরকার কি ব্যবস্থা গ্রহণ করে সেটাই এখন দেখার বিষয়। হেফাজতকে নিয়ন্ত্রণ নয় শুধু সমূলে উৎপাটনের কার্যকর উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা থাকতে হবে। হেফাজত যেমন বাংলাদেশ চায়, একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা তেমন। বাংলাদেশ চাননি।
মানুষকে সংখ্যা দিয়ে গণনা করে সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু হিসেবে বিভাজন করাটা সমীচীন না হলেও এটা বিশ্বব্যাপীই হয়ে আসছে। সংখ্যালঘুরা সব দেশে, সব সমাজেই কিছুটা আলাদা, তাদের অধিকার ও মর্যাদা সব ক্ষেত্রে এক রকম নয়। মূলত ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে এটা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে আরো নানাভাবেই এই ভাগ-বিভক্তি করা যায়, করা হয়। ধর্ম ছাড়াও মানুষের বর্ণ (গায়ের রং), বিশ্বাস, চিন্তা ইত্যাদি দিয়েও সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু নিরূপিত হয়ে থাকে।
মোটা দাগে পৃথিবীতে ধর্মবিশ্বাসীরা সংখ্যাগুরু আর ধর্মে অবিশ্বাসীরা সংখ্যালঘু। আস্তিক-নাস্তিক লড়াই নতুন নয়। কোথাও সাদা রঙের মানুষ সংখ্যাগুরু, কোথাও কালো রঙের। কোথাও মুসলমান সংখ্যাগুরু, কোথাও হিন্দু, কোথাও খৃস্টান, কোথাও বৌদ্ধ কিংবা অন্য কোনো ধর্ম বিশ্বাসী। এক ধর্মের মানুষের মধ্যেও সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু আছে থাকতে পারে । যেমন কোথাও শিয়া মুসলমান সংখ্যালঘু, কোথাওবা সুন্নী। খৃস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক প্রোটেস্টান আছে। হিন্দুদের বর্ণ বিভাজন তো মারাত্মক।
বিশ্বাস এবং চিন্তার ক্ষেত্রেও সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু আছে। তবে আমরা বাংলাদেশে প্রধানত ধর্মের ভিত্তিতেই সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু নির্ধারণ করে থাকি। বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যাগুরু আর সনাতন ধর্ম বিশ্বাসীরা সংখ্যালঘু। বৌদ্ধ, খৃস্টানরাও ধর্মীয় সংখ্যালঘু। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যখন একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে দুই খণ্ড হয়ে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটলো তখন স্বভাবতই আশা করা হয়েছিল যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি আর পাকিস্তানি কোনো লিগাসি বা মন্দ উত্তরাধিকার কিংবা ধারা বহন করবে না। পাকিস্তান ছিল ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। রাষ্ট্রটি হবে অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক চরিত্রের। ধর্ম হবে মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, আচরণ ও পালনের বিষয়। রাষ্ট্র হবে সবার, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃস্টান – সব মানুষের। এমনকি গরিবের নিঃস্বের ফকিরেরও। রাষ্ট্র বিশেষ কোনো ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। বিত্তবান এবং বিত্তহীনদের যে বৈষম্য অর্থাৎ ধনবৈষম্য কমিয়ে একটি সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র্রের আগ্রহ প্রকাশ পেয়েছিল রক্তমূল্যে অর্জিত নতুন স্বাধীন দেশের বাহাত্তরের প্রথম সংবিধানে। কিন্তু বাস্তবে সেরকম হলো না। দেশ স্বাধীনতা হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই আমাদের মনোভূমির রং বদলাতে লাগলো। আজ তা উজ্জ্বলতা হারিয়ে প্রায় ফ্যাকাশে।
হিন্দু-মুসলমানের মিলিত রক্তস্রোত সাঁতরে যে দেশ স্বাধীন হলো সে দেশ আবার পাকিস্তানমুখী হবে – সেটা ছিল আমাদের তখনকার চিন্তার বাইরে! জাতি হিসেবে আমরা একটু আবেগপ্রবণ। যুদ্ধ জয়ের উন্মাদনা, নতুন দেশ, নতুন পতাকা, নতুন জাতীয় সঙ্গীত পাওয়ার উত্তেজনায় আমরা তখন আবেগ-উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসছিলাম। কিছুটা যুক্তিরহিত আচরণ করেছিলাম। মানুষের মনোজগতের পরিবর্বতন যে রাতারাতি হয় না, সেটা যে ধারাবাহিক চর্চা ও সাধনার মাধ্যমে অর্জন করতে হয় – তা আমরা তখন ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করিনি। অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার প্রত্যয় থেকে আমরা কীভাবে সরে এলাম, নিজেদের মানুষ হিসেবে না ভেবে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে পরিচিত করার প্রবণতা কীভাবে আমাদের পেয়ে বসলো – সে বিষয়গুলো আমাদের গভীর পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা দাবি করে। বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। ক্ষমতাসীনরা এই কথাটা বেশি উচ্চারণ করে থাকেন। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকতেও এই আপ্তবাক্য উচ্চারিত হয়েছে। বাংলাদেশে ধর্ম পরিচয় নির্বিশেষে সব মানুষ সমান সুযোগ ও অধিকার ভোগ করে থাকে বলে যে দাবি করা হয় তা যথার্থ নয়। এটা ঠিক যে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে যা বোঝায় বাংলাদেশে তা দীর্ঘ দিন ধরেই হয়নি বা হয় না। তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা নেই। এক সময় হয়তো কিছুটা প্রচ্ছন্ন ছিল, এখন তা প্রকট এবং প্রকাশ্য হয়েছে। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার পরিবর্তে তাকে তার ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে বিচার করার প্রবণতা এখন প্রবল।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের একটি অন্যতম মূলনীতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও বাস্তবে কি ব্যক্তিজীবনে, কি রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থায় ‘ধর্ম’ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবেই থেকে যায়। সাধারণ মানুষের মনোজগতে পরিবর্তন আনার জন্য যে রকম প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন ছিল, শিক্ষা-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণার অনুকূলে যে রকম মজবুত গাঁথুনি তৈরি করা দরকার ছিল তার কোনো কিছুই পরিকল্পিতভাবে করা হয়নি। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, পাকিস্তানের পরাজয় মানে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিজয়। যে মানুষ ২৫ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত পাকিস্তানের ভৌগোলিক কাঠামোয় এবং রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী ছিল, রাতারাতি তার মধ্যে আদর্শিক পরিবর্তন ঘটার কোনো স্বাভাবিক কারণ ছিল না। মানুষের মনোজগতের পরিবর্তন হয় ধীরে ধীরে, ক্রমাগত উন্নত বা অগ্রগামী দর্শন চর্চার মধ্য দিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কোনো সময় একটি দৃঢ় আদর্শভিত্তিক একশিলা দল ছিল না। এটা ছিল মূলত বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের একটি বৃহত্তর জাতীয় প্লাটফরম। এই দলের পতাকাতলে যারা সমবেত হয়েছিলেন তারা সবাই এক মত, এক পথের ছিলেন না। এমন কি দলের নেতৃত্বের মধ্যেও চিন্তার পার্থক্য ছিল। আওয়ামী লীগের মধ্যে একাধিক ধারা সক্রিয় ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে উদার, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ধারাটি এক সময় প্রধান হয়ে উঠলেও তার বিরোধী একটি ধারা দুর্বল হলেও সক্রিয় ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা তথা অসাম্প্রদায়িক চেতনা যেমন আওয়ামী লীগে ছিল, তেমনি ধর্ম নিয়ে দুর্বলতাও ছিল।
আমাদের দেশে সমাজ-রাজনীতি, মানুষের সামাজিক ও ধর্মীয় মনস্তত্ত্ব নিয়ে সিরিয়াস কোনো গবেষণা হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। কতগুলো সস্তা জনপ্রিয় ধারণাকে ভিত্তি করেই আমরা গুরুত্বপূর্ণ অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বছর না ঘুরতেই ভাষার মর্যাদা নিয়ে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে তৈরি মতভিন্নতা নিঃসন্দেহে আমাদের এই ভূখণ্ডের অধিবাসীদের চিন্তার জগতে একটি বড়ো মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা ছিল। কিন্তু সেটা কত শতাংশ মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের সূচনা করেছিল তার কোনো বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ-পরীবিক্ষণ হয়েছে কি? ভাষার লড়াইটা তৃণমূল পর্যায়ের মুসলিম মানসে যতটা অসাম্প্রদায়িক ভাবনার ঢেউ তুলেছিল বলে মনে করা হয়, বাস্তবটা কি আসলে তাই? পাকিস্তানি শাসকেরা বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল, ঢাকা শহর রক্তে ভাসিয়েছিল বলে এক ধরনের কাতরতা অনেকের মধ্যে তৈরি হয়েছিল কিন্তু সে জন্য এটা বলা যায় না যে দ্বিজাতিতত্ত্ব তখনই মানুষের মন থেকে খারিজ হয়ে গিয়েছিল!
যে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো, মাত্র ৭ বছর যেতে না যেতেই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় সেই মুসলিম লীগের কবর রচিত হলো। অথচ এ তথ্যও আমাদের অজানা নয় যে, এই অঞ্চলের মানুষই পাকিস্তানের পক্ষে একচেটিয়া ভোট দিয়েছিল। তো, এই যে মানুষের মন পরিবর্তন, একেবারে এদিক থেকে ওদিক যাওয়া – এর পেছনে ঠিক কি কি বিষয় কাজ করেছে তা কি আমাদের কোনো রাজনৈতিক চিন্তাবিদ বা সমাজ গবেষকের গবেষণায় উঠে এসেছে? এটা কি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সচেতনতাজাত, নাকি তার সঙ্গে আবেগ এবং হুজুগপ্রিয়তার মিশেলও ছিল?
বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র যে আজ অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করতে পারছে না, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও বাংলাদেশে ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুরা যে আজ এক চরম অন্তর্জ্বালা নিয়ে বসবাস করছে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে অতীতের দিকে চোখ দিয়েই। ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’ বলে বিলাপসঙ্গীত গেয়ে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়া যাবে না। সেটা গড়তে হলে ঐতিহাসিকভাবে যে ভুলভ্রান্তি আমরা করে এসেছি তা স্বীকার করে ফাঁকফোকড় মেরামত করে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
বাংলাদেশে যারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করেন, তাদের কাছে ড. আহমেদ শরীফের নাম অজানা থাকার কথা নয়। তিনি একজন মুক্তবুদ্ধির মানুষ ছিলেন। ধর্মের প্রতি যে তার আস্থা-বিশ্বাস ছিল না, সেটা তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েই সবার সামনে প্রকাশ করেছিলেন। তাকে ‘নাস্তিক’ বলা হতো। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা, ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে মানুষে মানুষে বিভাজন তৈরি করার তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। কিন্তু তিনি তার চিন্তায় তার ছাত্রদেরও খুববেশি প্রভাবিত করতে পারেননি। ধর্ম বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাসজাত সংস্কার-কুসংস্কার মানুষের মনে যতোটা সহজে বাসা বাধে, ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার পরামর্শ ততোটা মানুষকে আলোড়িত-আলোকিত করে না।
মানুষ সহজাতভাবেই যুক্তিবাদী বা যুক্তিপ্রিয় হয় না। যুক্তিবাদিতা একটি বিশেষ গুণ বা প্রবণতা যা চর্চার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হয়। অন্ধ বিশ্বাস কিংবা যুক্তিহীনতা মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে। অন্যদিকে কুসংস্কারমুক্ত ও যুক্তিবাদী মন মানুষকে বিনয় ও সৌজন্যতার ধারায় অগ্রসর হতে সহায়তা করে। এক ধর্মের মানুষ যদি অন্য ধর্মের মানুষ সম্পর্কে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল থাকেন তাহলে পরস্পরের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি কম হতে পারে। সব থেকে বড়ো কথা হলো, যে যে ধর্মবিশ্বাসী তাকে সেই ধর্ম পালনের অধিকার দিতে হবে। মুসলমান নামাজ-রোজা, ইবাদত-বন্দেগি করার অধিকার পাবে, হিন্দুও তার পূজা-পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে পারবে অনায়াসে, অবাধে। অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের বেলায়ও একই নিয়ম প্রযোজ্য হবে।
এমন অবস্থা যখন বাধাগ্রস্ত হয়, এক পক্ষ যখন অন্য পক্ষের বিশ্বাস নিয়ে কৌতুক-তামাশা করে কিংবা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-উপহাস করে তখনই বিষয়টি আর সহনীয় থাকে না। গোলমাল বাধে, বেধে যায় দাঙ্গা-হাঙ্গামাও।
আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করি যে, মামুনুল হকসহ গ্রেপ্তারকৃত হেফাজত নেতারা ইসলামী জলসা কিংবা ওয়াজ মাহফিলের নামে এমন কুরুচিপূর্ণ এবং জাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ তৈরির জন্য উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করে দেশের পরিস্থিতি অস্বাভাবিক করার অপপ্রয়াস চালাতে অভ্যস্ত। যাদের ব্যক্তিজীবন অসততা ও নোংরামিতে পূর্ণ তারা যদি ধর্মের হেফাজতের দায়িত্ব নেন তাহলে সেটা যে ধর্মের মাহাত্ম্যকেই ম্লান করে – এটা বুঝতে হবে সবাইকে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ।
Leave a Reply