সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য সিপাহী বিদ্রোহের ১৬৪ বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল ১০ মে।
ফরাসী, পর্তুগিজদের সাথে ইংরেজরাও ভারতবর্ষে চলে আসে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে। প্রথমে ব্যবসা উদ্দেশ্য থাকলেও সময় পরিক্রমায় নানা চক্রান্ত ও কূটকৌশলের মাধ্যমে তাঁরা ভারতের নিয়ন্ত্রণ নিতে সচেষ্ট হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত করার মাধ্যমে এ দেশে তাদের ক্ষমতা ও আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ১৭৬৪ সালে বক্সারের যুদ্ধে মির কাসিমের পরাজয়ের পরে সমগ্র ভারতবর্ষ চলে যায় তাদের নিয়ন্ত্রণে। পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি যে নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হাতে পায়, তা কাজে লাগিয়ে সারা ভারতবর্ষে শোষণ ও নির্যাতন চালাতে থাকে।
বাংলার স্বাধীনচেতা জনগণ কখনো পরাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। এ কারনে ১৯ শতকের মাঝ পর্যন্ত ছোট বড় বহু আন্দোলন, আক্রমণ, যুদ্ধ, বিদ্রোহ বা অভ্যূত্থানের মধ্যে দিয়ে বিদ্রোহের ধারা অব্যাহত থেকেছে। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার যুদ্ধ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। ১৮৩১ সালে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায় তিতুমীর মারা যান।
ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ ওঠে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সর্বাগ্রে চলে আসে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের কথা। অনেকেই এটাকে বলেছেন ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ,মহাবিদ্রোহ, আবার কারো কাছে এটি ছিল গণ অভ্যুত্থান। ইংরজে শাসনামলে ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল সিপাহী বিদ্রোহ। ১৮৫৭ সালে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ ছিল এটি। এই বিদ্রোহের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা।
সিপাহী বিদ্রোহের শুরু
১৮৫৭ সালের ১০ মে মিরাট শহরে শুরু হওয়া ইংরেজ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সিপাহীদের সাথে যে যুদ্ধে সংঘটিত হয় তাই সিপাহী বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৮৫৭ সালে উত্তর ও মধ্য ভারতে যে বিরাট গণ-বিদ্রোহ সংঘটিত হয় তা ব্রিটিশ শাসনকে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কোম্পানির সেনাবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ শুরু হয়ে তা ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলায় শুরু হয়ে ইংরেজ অধিকৃত ভারতের অন্যান্য এলাকার সিপাহীদের মধ্যেও এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম বাংলার ব্যারাকপুরে সিপাহী ‘মঙ্গল পা-ের’ নেতৃত্বে প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয়। প্রায় এক বছর ধরে অগণিত কৃষক, শিল্পী, সৈন্য ও অন্যান্য জনগোষ্ঠী বীরত্বের সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যায়। তাদের সাহসিকতা ও আত্মবিসর্জন ভারতবাসীর ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
ইংরেজরা এই বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করে। নিরপরাধ বহুজনকে এ সময় নির্বিচারে ফাঁসি দেওয়া হয়। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে সে সময় বাংলার বিদ্রোহী সিপাহীদের ফাঁসি দেওয়া হয়। বিদ্রোহীরা পরাজিত হলেও এই বিদ্রোহের ফলেই কোম্পানির শাসনের অবসান হয়। শুরু হয় ব্রিটিশরাজ তথা রানী ভিক্টোরিয়ার শাসন।
ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন
২৯ শে মার্চ, ১৮৫৭ রবিবার বিকাল বেলা। ব্রিটিশদের জন্যে দিনটি ছিল ছুটির দিন। তারা বিশ্রাম নিচ্ছিল যার যার গৃহে। ব্যারাকপুরের প্যারেড ময়দানে অসময়ে মানুষদের ভিড় বাড়ছিল। ধীরে ধীরে প্যারেড গ্রাউন্ডে জড়ো হতে থাকে বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের সদস্যরা।পঞ্চম ব্যাটালিয়ন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য মঙ্গল পা-ে ঘুরছিলেন ব্যারাকপুর প্যারেড গ্রাউন্ডের আশেপাশেই। চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল চারদিকে, কী হচ্ছে তা তখনো কেউ জানে না, তবে এটুকু জানে যে কিছু একটা ঘটছে। সিপাহীদের মধ্যে কেউ আসছে খালি হাতে, কেউ বন্দুক নিয়ে। সৈনিকদের ভিড় ক্রমেই বাড়ছিল। কেউ জানেনা কি ঘটতে চলেছে তবে এটুকু জানে যে রচিত হবে এক মহান ইতিহাস।
কেউ একজন এগিয়ে এসে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিবে, সবাই এই অপেক্ষা করছে। ফলাফল যদি আশানুরূপ না হয় তাহলে পরিনাম ভয়াবহ হবে, এ কারনে কেউ এগিয়ে আসার সাহস করতে পারছে না !
এক সময় হুট করে সকল ভয় ভীতি আর জড়তা ভেঙ্গে এগিয়ে আসে মঙ্গল পান্ডে। মঙ্গল পা-ে সমস্ত সৈনিকদের প্যারেড গ্রাউন্ডে ডাকেন ও সেখান থেকে বিদ্রোহের ডাক দেন, সকলকে দেশ স্বাধীন করার আহ্বান জানালেন। লাইনের সামনে দাঁড়িয়ে মঙ্গল পান্ডে বন্ধুক হাতে টহল দিচ্ছে। পান্ডের দিকে সবাই শুধু গভীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে। সবাই কানাঘুসা করছে । নতুন এক রুপ নিয়ে সবার সামনে মঙ্গল পান্ডে, আরে চিরচেনা মঙ্গল পান্ডের আজ কি হয়েছে !হঠাৎ তীব্র চিৎকার,
“বেরিয়ে এসো ভাইসব। ফিরিঙ্গির পায়ের তলায় আর কত দিন থাকবে! ওরা আমাদের সোনার দেশ, গর্বের মাতৃভূমি লুটেপুটে যাচ্ছে। আর আমরা মরছি অনাহারে। ওরা আমাদের বেঁচে থাকার অস্তিত্বে হাত দিয়েছে। আমাদের করেছে জাতিভ্রষ্ট। ভাইসব এসব ফিরিঙ্গিদের মারো। “
তার বক্তব্যের মাধ্যমে উৎসাহ দিতে লাগলেন বাকি সিপাহীদের। এরই মধ্যে সেনানিবাসের দখল মঙ্গল পা-ের হাতে। হট্টগোল দেখে ঘোড়ায় চড়ে ইংরেজ অ্যাডজুটেন্ট লেফটেন্যান্ট বার্গ স্বয়ং ঘটনাস্থলে চলে আসেন। মঙ্গল পান্ডে অ্যাডজুটেন্টকে দেখেও সোজা তার দিকে বন্ধুকের নল তাক করে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। এ সময় বার্গ তার ঘোড়াটি মঙ্গল পান্ডের উপর উঠিয়ে দেয়। কাছে আসতেই মঙ্গলপান্ডের রাইফেল গর্জে ওঠে। গুলী লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় । ঘোড়াটি মাঠে লুটিয়ে পড়ল।
লেফটেন্যান্ট পা-েকে লক্ষ্য করে গুলি চালাল। কিন্তু ওই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। তরবারির আঘাতে মঙ্গলপান্ডে লেফটেন্যান্ট বার্গকে আহত করেন। পরবর্তীতে আরেক সার্জেন্ট পা-ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে পা-ে তাকেও তার ধারালো খড়গ দিয়ে ধরাশায়ী করে ফেলেন। তারপর আসল ইংরেজদের দালাল পল্টু । মঙ্গল পা-েকে পেছন থেকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে কিন্ত শেষ রক্ষা হল না পল্টুর। পান্ডের তলোয়ারের কাছে ধরাশায়ী। নিজেকে মুক্ত করল পা-ে। এরই মধ্যে সিপাহীদের মধ্যে জয়ধ্বনি শোনা যায়। সৈন্যরা উল্লাসে ফেটে পড়ে ।
এদিকে ব্রিটিশ সেনাপতি হিয়ার্সে ততক্ষণে দলবল নিয়ে হামলা করে ব্যারাকপুর সেনানিবাসে। অন্য ইংরেজ কর্মচারীরা এ সময় তাকে ঘিরে ফেললে ব্রিটিশদের হাতে জীবন না দিয়ে আত্মমর্যাদার সাথে আত্মাহুতি দেবার চেষ্টা করেন মঙ্গল পা-ে। নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে। বিধিবাম গুলি যায় ফসকে আহত হয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। আহত মঙ্গলপান্ডেকে বন্দী করতে অনীহা প্রকাশ করায় ঈশ্বরী পান্ডেকেও আটক করা হয়। মুমূর্ষ পান্ডেকে ব্রিটিশ সরকার হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।
আহত মুমূর্ষু মঙ্গল পান্ডেকে ব্যারাকপুর ময়দানের সব সৈনিকদের সামনে একটা অশ্বথ গাছে ঝুলিয়ে ফাঁসির মৃত্যুদন্ডাদেশ কার্যকর করে ব্রিটিশ বেনিয়াদিরা। একই সাথে ঈশ্বর পা-েকেও ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। কারণ তিনি মঙ্গল পা-েকে গ্রেফতার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। সামরিক আদালতের রায়ে ১৮ এপ্রিল মৃত্যুদ- কার্যকরের নির্দেশ দেওয়া থাকলেও নির্ধারিত সময়ের ১০ দিন আগে তাকে হত্যা করা হয়। সমগ্র ভারতে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে এই খবর।
মঙ্গল পা-ের এই বীরত্বপূর্ণ কর্মকে স্মরণ করে ভারতে ২০০৫ সালে একটি সিনেমা নির্মাণ করা হয়।। ‘মঙ্গল পা-ে: দ্য রাইজিং’ নামক সিনেমাটিতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় নায়ক আমির খান।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের একশ বছরে ভারতের জনগণের মধ্যে বৃটিশ বিরোধী ক্ষোভ জমা হতে থাকে। সেই ক্ষোভ কোম্পানীর সেনাবাহিনীর ভারতীয় সদস্যদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহের প্রস্তুতিও চলছিল। মঙ্গল পান্ডের বিদ্রোহের মাধ্যমে শুরু হয়ে যায় সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। মূল বিদ্রোহ শুরু হয় মিরাটে, ১০ মে ১৮৫৭ সালে। এ দিন সিপাহীরা বিদ্রোহ করে সেনা ছাউনি থেকে বেরিয়ে যায় এবং শত্রুদের হত্যা করে দিল্লি অভিমুখে যাত্রা করে। ১১ মে মিরাট থেকে তিনশ’ বিদ্রোহী সিপাই দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করে এবং দিল্লী এসে তারা ৪৯ বৃটিশ নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। দিল্লী দখল করে তারা মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে সমগ্র ভারতবর্ষের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে। সম্রাটকে তারা এ বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ জানালে শেষ পর্যন্ত তিনি রাজি হন। তবে কয়েক মাসের মধ্যে সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। ১৮৫৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ইংরেজরা আবার দিল্লী দখল করে নেয়।
এরপর একে একে মথুরা, লক্ষ্ণৌ, ভরতপুর, কানপুর, এলাহাবাদ, ঝাঁসি, ইন্দোরসহ পুরো ভারতেই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এই সব অঞ্চলে বিদ্রোহীদের দমন করতে কোম্পানিকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। বিদ্রোহ শুরুর আগে যদিও ব্রিটিশ বিভিন্ন প্রশাসক ও সেনা কর্মকর্তারা সিপাহী ও জনসাধারণের মধ্যে অসন্তোষের ইঙ্গিত দিয়েছিল, কিন্তু ঊর্ধ্বমহল একে ততটা পাত্তা দেয়নি।
সারা বাংলাদেশে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। চট্টগ্রাম ও ঢাকার প্রতিরোধ এবং সিলেট, যশোর, রংপুর, পাবনা ও দিনাজপুরের খ-যুদ্ধগুলো বাংলাদেশকে সতর্ক ও উত্তেজনাকর করে তুলেছিল। ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের পদাতিক বাহিনী প্রকাশ্য বিদ্রোহে মেতে ওঠে এবং জেলখানা থেকে সব বন্দিকে মুক্তি দেয়। তারা অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে নেয়, কোষাগার লুণ্ঠন করে এবং অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ত্রিপুরার দিকে অগ্রসর হয়।
সিপাহীরা আশা করেছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে এ স্বাধীনতা সংগ্রামে ত্রিপুরার রাজা তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু ইংরেজদের দালাল ত্রিপুরার রাজা সিপাহীদের সাহায্য করা তো দূরের কথা, বরং সিপাহীদের গতিরোধ করার জন্য সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করলো। সেখানে বাধা পেয়ে সংগ্রামী সিপাহীরা কুমিল্লার পাহাড়ি এলাকার দিকে ধাবিত হলেন। সেখানেও ত্রিপুরার রাজার সৈন্যবাহিনী সিপাহীদের ওপর হামলা চালালে সিপাহীরা মনিপুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিলেটের দিকে অগ্রসর হয়। সে সময় ইংরেজ মেজর বাইজের নেতৃত্বে একটি পদাতিক বাহিনী মুক্তিপাগল সিপাহীদের ওপর আক্রমণ করে। সীমান্ত স্টেশন লাতুতে উভয়পক্ষের মধ্যে প্রচন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে ইংরেজ মেজর বাইজ নিহত হলেও বিদ্রোহী সিপাহীরা পরাজিত হয়। পরে তারা জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করে। এরপর তাদের আর কখনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
চট্টগ্রামে সিপাহীদের মনোভাব ঢাকার রক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। ১৯ নভেম্বর চট্টগ্রামে হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে যে সিপাহী বিপ্লব সংঘটিত হয় তার সংবাদ গোয়েন্দা মারফত ঢাকায় পৌঁছে ২১ নভেম্বরের দিকে। সিপাহিদের আরো অভ্যুত্থানের আশঙ্কায় কর্তৃপক্ষ ৫৪তম রেজিমেন্টের তিনটি কম্পানি এবং ১০০ নৌসেনা ঢাকায় প্রেরণ করে। একই সঙ্গে যশোর, রংপুর, দিনাজপুরসহ বাংলাদেশের আরো কয়েকটি জেলায় একটি নৌ-ব্রিগেড পাঠানো হয়। প্রধানত ইউরোপীয় বাসিন্দাদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবীদের সংগঠিত করে ঢাকা রক্ষা করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নৌ-বিগ্রেড ঢাকা পৌঁছে সেখানে নিয়োজিত সিপাহিদের নিরস্ত্র করতে গেলে অবস্থা চরমে ওঠে।
১৮৫৭ সালের ২২ নভেম্বর ছিল পবিত্র আশুরার দিন অর্থাৎ ১০ মহররম। ওই দিন ইংরেজদের দ্বারা সিপাহীরা আক্রান্ত হয়। মুসলমান সিপাহীরা রোজা রাখার উদ্দেশ্যে সেহরি খেয়ে নিন্দ্রামগ্ন ছিল। মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছিল, কুয়াশাচ্ছন্ন প্রত্যুষে কিছু ইংরেজ স্বেচ্ছাসেবক ও শতাধিক নৌ সেনা আন্টাঘড় ময়দানে উপস্থিত হয়ে দ্রুতগতিতে বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থিত তৎকালীন ট্রেজারির সিপাহীদের আটক করে এবং সেখান থেকে ইংরেজ সৈন্যরা ক্ষিপ্রগতিতে লালবাগ কেল্লায় উপস্থিত হয়ে অপর দলের সাথে মিলিত হয়।
কেল্লার দক্ষিণ-পশ্চিমে ভাঙা প্রাচীরের কাছ দিয়ে ইংরেজ সৈন্যরা সিপাহীদের ওপর নির্মম আক্রমণ চালায়। এ আকস্মিক আক্রমণ প্রতিহত করার প্রস্তুতি সিপাহীদের ছিল না। সংঘটিত খ-যুদ্ধে বেশ কিছু সিপাহি নিহত ও বন্দি হয় এবং অনেকেই পালিয়ে যায়। ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। অনেকে আত্মরক্ষার জন্য কেল্লার ২০ ফুট উচু দেয়াল থেকে লাফিয়ে পালাবার সময় ইংরেজদের হাতে ধরা পড়েন। অনেকের নদীতে সলিল সমাধি হয়। বেশির ভাগ পলাতক সিপাহিই গ্রেপ্তার হয় এবং দ্রুত গঠিত সামরিক আদালতে সংক্ষিপ্ত বিচারের জন্য তাদের সোপর্দ করা হয়। অভিযুক্ত সিপাহিদের মধ্যে ১১ জন মৃত্যুদ- এবং বাকিরা যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত হয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে সিলেট, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর এবং যশোরে চাপা ও প্রকাশ্য উত্তেজনা বিরাজমান ছিল। পলাতক সিপাহি ও ইউরোপীয় সৈন্যদের মধ্যে সিলেট এবং অপরাপর স্থানে কয়েকটি সংঘর্ষ ঘটে, যার ফলে উভয় পক্ষেই প্রাণহানি ঘটে। সিলেট এবং যশোরে বন্দি ও নিরস্ত্র সিপাহীদের স্থানীয় বিচারকদের দ্বারা সংক্ষিপ্ত বিচার করা হয়। ফাঁসি ও নির্বাসন ছিল এ সংক্ষিপ্ত বিচারের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
১৮৫৮ সালের ২০শে জুন গোয়ালিয়রে বিদ্রোহীদের পরাজয়ের পরই একমাত্র বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়। সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, মহাবিদ্রোহ, ভারতীয় বিদ্রোহ, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ এবং ১৮৫৮ সালের গণ অভ্যুত্থান নামেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
সিপাহী বিদ্রোহ কেন হয়েছিল ?
খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রকাশ্যে ধর্মপ্রচার, হিন্দু-মুসলিমদের জোড় করে খৃষ্টান ধর্মে দীক্ষিত করার চেষ্টা, মসজিদ ও মন্দিরের জমির উপর কর আরোপ এসব মিলিয়ে জনগণ বিক্ষুদ্ধ হতে থাকে। এরূপ নানা কারনে ১৮৫৭ সালের বহু আগে থেকেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সামরিক কারণে সিপাহীদের ক্ষোভ জমা হচ্ছিল।
সামরিক বৈষম্য সিপাহী বিপ্লবের উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল। ইংরেজ সামরিক অফিসার ও সিপাহীদের তুলনায় দেশীয় সিপাহী ও অফিসারদের বেতন ছিল কম। তাছাড়া ইংরেজ সামরিক অফিসাররা দেশীয় সামরিক অফিসারও সিপাহীদের খুব বিশ্রি ভাষায় গালিগালাজ করত। বৃটিশ সরকার ৩ লাখ ১৫ হাজার ৫০০ জন ভারতীয় সৈন্যের জন্য বার্ষিক ৯৮ লাখ পাউন্ড ব্যয় করতো এবং অন্যদিকে ৫১ হাজার ৩১৬ ইংরেজ সৈনিকের জন্য ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পাউন্ড ব্যয় করতো। যা ছিল ভারতীয় সিপাহীদের জন্য চরম বৈষম্য।
সেনাবিভাগে ব্রিটিশ ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে বেতন, পদোন্নতি, বদলি ইত্যাদির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ ভারতের সৈন্যদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয় । সিন্ধু ও আফগানিস্তানে নিযুক্ত সেনাদলকে বিশেষ ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ভারতীয় সেনাদের তা থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাঁদের ধর্ম বিশ্বাসকে মর্যাদা না দিয়ে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সামরিক কর্তৃপক্ষ তাঁদের যত্রতত্র বদলির ব্যবস্থা করেন । জাত ও ধর্ম হারাবার ভয়ে সিপাহীগণ কালাপানি পার হয়ে ব্রহ্মদেশ বা অন্যত্র যেতে অনাগ্রহী হয়।
সিপাহিদের ক্ষোভ যখন ক্রমশ পূঞ্জীভূত হচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে এনফিল্ড রাইফেল (ঊহভরবষফ জরভষব) নামে এক নতুন ধরনের রাইফেলের প্রবর্তন তাদের ক্ষোভের আগুনে ঘৃতাহুতি দেয় । এনফিল্ড রাইফেলে যে কার্তুজ (ঈধৎঃৎরফমব) ব্যবহার করা হত, তার খোলসটি দাঁতে কেটে রাইফেলে ভরতে হত । গুজব রটে যায় যে, এই কার্তুজে গরু ও শুয়োরের চর্বি মেশানো আছে । ধর্মচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় কোম্পানির সেনাবাহিনীর হিন্দু ও মুসলমান সিপাহীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এই টোটা ব্যবহার করতে অস্বীকার করে ।
এনফিল্ড রাইফেলকে প্রত্যক্ষ ধরা হলে, এটি কিন্ত মূল কারন নয়। কারন সরকার সিপাহীদের সামনে এই টুটা নষ্ট করা হলেও তাদের অসন্তোষ স্থিমিত হয় নি। কারন এই বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ প্রশানের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণ তথা সিপাহীদের তীব্র অসন্তোষ । পরবর্তীকালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিপাহীরা চর্বি মাখানো এই টোটাই ব্যবহার করেছিল । সিপাহী বিদ্রোহ একদিনে জন্ম নেয়নি বরং এটি ছিল বহুদিনের তিলে তিলে সঞ্চিত প্রস্তুতির ফল।
শেষ কথা
১৮৫৭ সালে কলকাতার ব্যারাকপুরে মঙ্গল পান্ডের বিদ্রোহের দ্বারা শুরু হওয়া সিপাহী বিদ্রোহ পরবর্তিতে মহাবিদ্রোহে রূপ নেয়। ইংরেজ সরকার এই বিদ্রোহকে কঠোর হস্তে দমন করলেও এর মাধ্যমে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়। দীর্ঘ ১০০ বছর অত্যাচার, লাঞ্ছনা ও নির্যাতনের পরে এ মহাবিদ্রোহ ছিল একটি জলোচ্ছ্বাসের মত। এটাকে অনেকে আবেগের সাথে পলাশীর প্রতিশোধও বলে থাকেন।
প্রথমদিকে অনেকটা বিজয়ী হয়েও, শেষে পরাজয় বরণ করেছিলেন। পরাজয় সত্ত্বেও ভারতবর্ষের সিপাহী ও জনগণের এই যে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ তা পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণা যুগিয়েছে। পাশাপাশি বৃটিশ শাসকদের নৃশংস বর্বরতার চিত্রও তুলে ধরেছে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
Leave a Reply