1. faysal.ce@gmail.com : dakshinermashal :
  2. abuhasan670934@gmail.com : Hasan :
  3. sakalctc.bd@gmail.com : Nityananda Sarkar : Nityananda Sarkar
বৃহস্পতিবার, ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:০১ পূর্বাহ্ন
২০ চৈত্র, ১৪৩১
Latest Posts
📰কিষান মজদুর ইউনাইটেড একাডেমী স্কুলে ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে মিলন মেলা অনুষ্ঠিত📰আশাশুনিতে যুগল প্রেমিকার আত্মহত্যা📰জামায়াতকে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ থেকে মুক্ত ঘোষণা কানাডার ট্রাইব্যুনালের📰বাংলাদেশ ও ড. ইউনূসকে শুভেচ্ছা ট্রাম্পের, সম্পর্ক জোরদারের বার্তা📰সাতক্ষীরায় কাজী আহসান হাবিব সম্রাটের আয়োজনে পথচারীদের ইফতার বিতরণ📰সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ 📰সাতক্ষীরা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের আয়োজনে মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা📰ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে ভিজিলেন্স টিম কর্তৃক সাতক্ষীরা পরিবহন কাউন্টারে মনিটারিং📰সাতক্ষীরা আয়েনউদ্দীন মাদ্রাসায় মহান স্বাধীনতা দিবস উদযাপন📰চার গোলে ব্রাজিলকে বিধ্বস্ত করলো আর্জেন্টিনা

সজনীকান্ত দাসের ‘নজরুল’

প্রতিবেদকের নাম :
  • হালনাগাদের সময় : মঙ্গলবার, ২৫ মে, ২০২১
  • ১২৪৯ সংবাদটি পড়া হয়েছে

বীরেন মুখার্জি

বিশ্বসাহিত্যে টি এস এলিয়ট, বোদলেয়ার যেমন সমকালীন-সমগোত্রীয়রা লাঞ্ছিত, অপমানিত করেছেন তেমনি বাংলা সাহিত্যেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ এমনকি হাল আমলে বিনয় মজুমদারকেও নানাভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। শিল্পস্রষ্টা সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার পাশাপাশি তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, হাসি-ঠাট্টারও কমতি ছিল না। সমকালীন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ কাজে ‘নাটের গুরু’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন সজনীকান্ত দাস। শনিমণ্ডলের মুখপত্র ‘শনিবারের চিঠি’-কে এ কাজে ব্যবহার করতেন তিনি। সম্পাদক সজনীকান্ত দাস দলবদ্ধভাবে কটূক্তিতে কুশলতা দেখান। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তার প্রধান লক্ষ্য। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে একধরনের মজার খেলাতেই তাকে মেতে উঠতে দেখা যায়। যদিও তিনি আত্মস্মৃতিতে লিখেছেন—‘নজরুল শনিবারের চিঠির জন্মকাল হইতেই সাহিত্যের ব্যাপারে একমাত্র নজরুলকে লক্ষ্য করিয়াই প্রথম উদ্যোক্তারা তাক করিতেন। তখন আমি আসিয়া জুটি নাই।’ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে মোহিতলাল মজুমদারকে নজরুল গুরু বলে মানতেন সেই মোহিতলালও নজরুলকে নিয়ে শনিবারের চিঠিতে ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন। তবে অন্যান্য নাম ছাপিয়ে ‘শনিবারের চিঠি’ প্রসঙ্গ এলে কাজী নজরুল ইসলামের নামের পাশাপাশি রসজ্ঞ হিসেবে সজনীকান্ত দাসের নামও সমভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে।
ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে গণমানুষের জাগরণে কলমযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে রাজরোষের শিকার হন নজরুল। কারাবরণও করেন। তার নাম তখন সাহিত্যের উচ্চশিখরে। এ সময় নজরুল ইসলাম হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করায় ভারতের ব্রাহ্মসমাজ তা ভালো চোখে দেখেনি। ব্রাহ্ম দলের তরুণরা নজরুলের ছিদ্রান্বেষণে দুষ্ট গ্রহের মতো লেগে থাকে। তা ছাড়া ব্রাহ্ম দলের সৃজনশীল তরুণরাই ছিল শনিমণ্ডলের কর্ণধার। ফলে এদের মুখপত্র ‘শনিবারের চিঠি’-তে নজরুলের ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যকে কেন্দ্র করে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, কৌতুকপূর্ণ বিভিন্ন লেখা প্রকাশ হতে থাকে।
নজরুল ও তার বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থকে কটাক্ষ করে লিখিত সজনীকান্ত দাসের প্রথম প্যারোডি কবিতা ‘আবাহন’ সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠির অষ্টম সংখ্যায় (২৮ ভাদ্র, ১৩৩১ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয়।
‘ওরে ভাই গাজী রে
কোথা তুই আজি রে
কোথা তোর রসময়ী জ্বালাময়ী কবিতা!
কোথা গিয়ে নিরিবিলি
ঝোপে ঝোপে ডুব দিলি
তুই যে রে কাব্যের গগনের সরিতা!’
চারদিকে তখন কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জয়জয়কার। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের পরপরই কবিতাটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয় ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কবিতাটি একদিকে যেমন ভারতের স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্র সৃষ্টিতে জনমনে নবজাগরণ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে ‘আপনারে ছাড়া কাহারে করিনা কুর্নিশ’ মনোভাবের কারণে রাজশক্তিও সচকিত হয়ে ওঠে। কবিতাটি প্রকাশের দুই বছর পর শনিবারের চিঠির একাদশ (আশ্বিন ১৩৩১ বঙ্গাব্দ) সংখ্যায় ভবকুমার প্রধান ছদ্মনামে কামস্কাট্কীয় ছন্দের ‘অসমছন্দ’ (ব্যাঙ) কবিতাটি ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়। মূলত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি প্রকাশই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। নজরুলের ‘বল বীর-/ বল উন্নত মম শির,/শির নেহারি আমারি নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!/বল বীর-/ বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,/উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!/মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/বল বীর-/ আমি চির উন্নত শির।’ কবিতার বিপরীতে ভবকুমার প্রধান লিখিত ‘অসমছন্দ’ কবিতাটি—
‘আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাং
ভৈরব রভসে বর্ষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাং।
আমি ব্যাঙ
আমি পথ হতে পথে দিয়ে চলি লাফ;
শ্রাবণ নিশায় পরশে আমার সাহসিকা
অভিসারিকা
ডেকে ওঠে ‘বাপ বাপ।’
শনিবারের চিঠিতে নজরুলের কবিতার প্যারোডি প্রকাশের পাশাপাশি কবিতা, গানসহ অন্যান্য সৃষ্টিকর্ম নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক গদ্যও প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এ ছাড়া তৎকালে প্রকাশিত পত্রিকা ‘প্রগতি’, ‘কালিকলম’, ‘উত্তরা’, ‘ধূপছায়া’, ‘আত্মশক্তি’ ও নজরুলের ‘কল্লোল’-কে গালমন্দ করেও বিভিন্ন প্যারোডি ছাপা হতো। আবার শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত প্যারোডিরও প্যারোডি প্রকাশিত হতে দেখা যায়। নজরুলের ‘অ-নামিকা’ কবিতার প্যারোডি ‘বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ’ শিরোনামে গাজী আব্বাস বিটকেল ছদ্মনামে শনিবারের চিঠিতে (ভাদ্র সংখ্যা, ১৩৩৪) প্রকাশিত হয়।
‘তোমারে পেয়ার করি
কপনি লুঙ্গি পরি
লো আমার কিশোরী নাতিনী
সুদূর ভবিষ্যৎলোকে নিশীথ নির্জন কুঞ্জে হে টোকা ঘাতিনী
তোমারে পেয়ার করি
শৈশবের ওগো উলঙ্গিনী
অ-পাতা শয্যায় মম অ-শোয়া সঙ্গিনী
তোমারে পেয়ার করি।’
‘সিন্দু-হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত কাজী নজরুলের কবিতাটি—
‘তোমারে বন্দনা করি
স্বপ্ন সহচরী
লো আমার অনাগত প্রিয়া
আমায় পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা জাগানিয়া!
তোমারে বন্দনা করি
হে আমার মানস-রঙ্গিনী
অনন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তন বাসনা-সঙ্গিনী!
তোমারে বন্দনা করি।’
আবার দেখা যায়, ‘বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ’ লেখক গাজী আব্বাস বিটকেলকেও ছাড়লেন না সজনীকান্ত দাস। তিনি ভবকুমার প্রধান নামে গাজী আব্বাসকে উদ্দেশ করে লিখলেন—
‘গাজী আব্বাস বিটকেল
কল্লি মহা খিটকেল
লিখে ফেল্লি কাব্বি
তাও আবার ছাপবি?
ছাপলে তাও কাটবে
কেউ কেউ তা চাটবে।’
নজরুলের গান গ্রন্থিত হওয়ার আগে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আবার এসব গানের প্যারোডিও প্রকাশ করা হয় শনিবারের চিঠিতে। নজরুলের একটি বিখ্যাত গান—‘কে বিদেশী বন উদাসী/বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে’ গানটির প্যারোডি শনিবারের চিঠির পৌষ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় ‘কে উদাসী বন গাঁ বাসী/বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে/বাঁশী সোহাগে ভিরমি লাগে/বর ভুলে যায় বিয়ের কনে’ ছাপা হয়। নজরুলের ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’ গানটির প্যারোডি করা হয়—‘জানালায় টিকটিকি তুই টিকটিকিয়ে করিস নে আর দিক।’
সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠিতে ‘ভবকুমার প্রধান’, ‘গাজী আব্বাস বিটকেল’ নামে নজরুলকে ব্যঙ্গ করে লিখতেন। এ ছাড়া মোহিতলাল মজুমদার ‘সত্যসুন্দর দাস’ ছদ্মনামে, নীরদ সি চৌধুরী ‘বলাহক নন্দী’ ছদ্মনামে ক্রমাগত নজরুল সাহিত্যের বিদ্রূপ করতেন। মাঝেমধ্যে নজরুলও ‘কল্লোল’ পত্রিকার মাধ্যমে এসব লেখার জবাব দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। মোহিতলাল মজুমদার নজরুলের ‘মাধবী প্রলাপ’ কবিতার মধ্যে ব্যক্ত দেহবাদী প্রেমের নগ্নরূপের উপস্থিতি দেখতে পেয়ে লিখলেন—‘আধুনিক তরুণ সাহিত্যিকের বালক প্রতিভা কাব্যকাননে কাম-কণ্টক-ব্রণ-মহুয়া কুঁড়ির চাষ আরম্ভ করিয়াছে।’ আবার ‘সত্যসুন্দর দাস’ ছদ্মনামে নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ সিরিজের কবিতা বিশেষ করে ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় বারাঙ্গনাকে ‘মা’ সম্বোধন করা তিনি মোটেই সমর্থন করেননি। তিনি এ কবিতাটির তীব্র সমালোচনা করে ‘শনিবারের চিঠি’ কার্তিক ১৩৩৪ সংখ্যায় ‘সাহিত্যের আদর্শ’ শিরোনামের প্রবন্ধে লেখেন—“সম্প্রতি একটি কবিতায় নব্য সাম্যবাদ প্রচারিত হয়েছে। এই কবিতাটি নাকি কবির একটি উৎকৃষ্ট কীর্তি। ইহাতে এক প্রকার nihilism বা নাস্তিক্যনীতির উল্লাস আছে— ইহাতে বর্তমান যুগের রণ-পিপাসু পাঠক-পাঠিকার বড় আদরের সামগ্রী। কাবতাটির যতটুকু মনে আছে, তাহাতে ইহাই কবির বক্তব্য বলিয়া মনে হয় যে, জগতে সকলেই অসাধু। সকলেই ভণ্ড, চোর এবং কামুক। অতএব জাতিভেদের প্রয়োজন নাই; আইস আমরা সকল ভেদাভেদ দূর করিয়া মহানন্দে নৃত্য করি।…মৈত্রীর আগে কবি বেশ্যাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন—‘কে বলে তুমি বারাঙ্গনা মা’? বিদ্রোহের চরম হইল বটে। কিন্তু কথাটা দাঁড়াইল কি?…বারাঙ্গনা মা নয়, বারাঙ্গনা নারী বটে,…কবি প্রচারিত নব সাম্যবাদ অনুসারে ইহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে—তুমিও বারাঙ্গনা, মাও বারাঙ্গনা। অতএব মা-তে ও তোমাতে কোন প্রভেদ নাই। এই ব্যাখ্যায় বেশি দূর অগ্রসর হইলে অন্তরাত্মা কলুষিত হয়, কিন্তু এই কবিতাটি তরুণদের বড় ভাল লাগিয়াছে। এই যে মনোভাব কেবল সমাজ বিদ্রোহ নয়, ইহা মানুষের মনুষ্যত্ব বিরোধী। ইহা সাহিত্য হইতে পারে না।”
লক্ষ করা যায়, ক্ষুরধার লেখনীর কারণে কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয়তা যত বেড়েছে তাকে নিয়ে ‘শনিবারের চিঠি’র ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের তীব্রতাও তত বাড়ানো হয়েছে। সুতরাং শনিবারের চিঠির মূল উদ্দেশ্য রস সৃষ্টি এবং রস সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের (লেখক) জনপ্রিয় করে তোলা, এটিই সর্বৈব প্রতীয়মান হয়েছে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় যে নজরুলের কাব্যপ্রতিভাকে হেয় করার উদ্দেশ্যেই তার কবিতার ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হতো সে বিষয়েও দ্বিমত করা যায় না। সজনীকান্ত দাস ছিলেন কুশলী খেলোয়াড়। তিনি ভালোকে ভালোবাসতে জানেন। সজনীকান্ত দাস যে নজরুলের ভক্ত ছিলেন, তা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের স্মৃতিচারণা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে— “একদিন নজরুল যাচ্ছে ট্রামে চড়ে, তার পাশের খালি সিটটাতে একজন ভদ্রলোক এসে বসল। যেন জেনে শুনেই ঐ সিটটা সে নির্বাচন করল, বসল গা ঘেঁষে।
‘জানেন, আমি আপনার একজন ভক্ত।’ বললেন ভদ্রলোক, আচমকা শুনে কে না খুশি হয়? নজরুলও খুশি হল। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম?’
‘শ্রী সজনীকান্ত দাস।’
আরে আপনি? হৃদ্যতায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে নজরুলের এতটুকু দেরি হলো না। বললে, ‘কী আশ্চর্য, পথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। কিন্তু ভাই আমাকে যে এই সামনের স্টপেই নেমে যেতে হবে।’
‘তাতে কী! আবার দেখা হবে আমাদের।’ সজনী নজরুলকে যাবার জায়গা করে দিল।”
বুদ্ধিধর সজনীকান্ত দাস বুঝেছিলেন ব্যক্তি হিসেবে নজরুলকে ভালোবাসা সহজ আর তাকে বিষয় হিসেবে নিয়ে ব্যঙ্গ করা লাভজনক। সজনীকান্ত হয়তো চেয়েছিলেন নজরুলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে কিন্তু ‘শনিবারের চিঠি’র খ্যাতি ও পরিচিতি তাকে এ কাজ থেকে বিচ্যুত হতে দেয়নি। তিনি ‘আত্মস্মৃতি’তে লিখেছেন—‘ভিতরে গান চলিতেছে। নজরুল ইসলামের বোতাম খোলা পিরহান ঘামে এবং পানের পিকে বিচিত্র হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তাহার কলকণ্ঠের বিরাম নাই। বিদ্রোহীর প্রলাপ পড়িয়া যে মানুষটিকে কল্পনা করিয়াছিলাম ইহার সহিত তাঁহার মিল নাই। বর্তমানের মানুষটিকে ভালবাসা যায়, সমালোচনা করা যায় না। এ ঘটনা-বিসুভিয়াসের মত সঙ্গীতগর্ভ এই পুরুষ।’ শনিবারের চিঠিতে নজরুলকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হলেও কবি-সাহিত্যিকদের বিবাদ যে বেশি দিন টেকে না, তা বোঝা যায় মোহিতলাল মজুমদার ও সজনীকান্ত দাসের জবানিতে। মোহিতলাল মজুমদার নজরুলকে অভিশাপ দিলেও তার রচনার বিদ্রূপ করলেও খোঁজ নিয়েছেন। নজরুল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত জেনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন—‘নজরুল মোটেই শরীরের যত্ন নেয় না।’ সুতরাং এ কথা বলা অসঙ্গত নয় যে ‘শনিবারের চিঠি’ নজরুলকে যত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, যত সমালোচনা করে রচনা প্রকাশ করুক না কেন, এতে নজরুলের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বই কমেনি। পাশাপাশি ‘শনিবারের চিঠি’ ও সজনীকান্ত দাসসহ সংশ্লিষ্ট সবার নাম কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেই উচ্চারিত হয়ে আসছে।
বিশ্বসাহিত্যে টি এস এলিয়ট, বোদলেয়ার যেমন সমকালীন-সমগোত্রীয়রা লাঞ্ছিত, অপমানিত করেছেন তেমনি বাংলা সাহিত্যেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ এমনকি হাল আমলে বিনয় মজুমদারকেও নানাভাবে লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। শিল্পস্রষ্টা সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করার পাশাপাশি তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, হাসি-ঠাট্টারও কমতি ছিল না। সমকালীন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের শিকার হয়েছেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এ কাজে ‘নাটের গুরু’ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন সজনীকান্ত দাস। শনিমণ্ডলের মুখপত্র ‘শনিবারের চিঠি’-কে এ কাজে ব্যবহার করতেন তিনি। সম্পাদক সজনীকান্ত দাস দলবদ্ধভাবে কটূক্তিতে কুশলতা দেখান। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন তার প্রধান লক্ষ্য। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে একধরনের মজার খেলাতেই তাকে মেতে উঠতে দেখা যায়। যদিও তিনি আত্মস্মৃতিতে লিখেছেন—‘নজরুল শনিবারের চিঠির জন্মকাল হইতেই সাহিত্যের ব্যাপারে একমাত্র নজরুলকে লক্ষ্য করিয়াই প্রথম উদ্যোক্তারা তাক করিতেন। তখন আমি আসিয়া জুটি নাই।’ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে মোহিতলাল মজুমদারকে নজরুল গুরু বলে মানতেন সেই মোহিতলালও নজরুলকে নিয়ে শনিবারের চিঠিতে ব্যঙ্গ কবিতা লিখেছেন। তবে অন্যান্য নাম ছাপিয়ে ‘শনিবারের চিঠি’ প্রসঙ্গ এলে কাজী নজরুল ইসলামের নামের পাশাপাশি রসজ্ঞ হিসেবে সজনীকান্ত দাসের নামও সমভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে।
ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে গণমানুষের জাগরণে কলমযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে রাজরোষের শিকার হন নজরুল। কারাবরণও করেন। তার নাম তখন সাহিত্যের উচ্চশিখরে। এ সময় নজরুল ইসলাম হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করায় ভারতের ব্রাহ্মসমাজ তা ভালো চোখে দেখেনি। ব্রাহ্ম দলের তরুণরা নজরুলের ছিদ্রান্বেষণে দুষ্ট গ্রহের মতো লেগে থাকে। তা ছাড়া ব্রাহ্ম দলের সৃজনশীল তরুণরাই ছিল শনিমণ্ডলের কর্ণধার। ফলে এদের মুখপত্র ‘শনিবারের চিঠি’-তে নজরুলের ব্যক্তিজীবন ও সাহিত্যকে কেন্দ্র করে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, কৌতুকপূর্ণ বিভিন্ন লেখা প্রকাশ হতে থাকে।
নজরুল ও তার বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থকে কটাক্ষ করে লিখিত সজনীকান্ত দাসের প্রথম প্যারোডি কবিতা ‘আবাহন’ সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠির অষ্টম সংখ্যায় (২৮ ভাদ্র, ১৩৩১ বঙ্গাব্দ) প্রকাশিত হয়।
‘ওরে ভাই গাজী রে
কোথা তুই আজি রে
কোথা তোর রসময়ী জ্বালাময়ী কবিতা!
কোথা গিয়ে নিরিবিলি
ঝোপে ঝোপে ডুব দিলি
তুই যে রে কাব্যের গগনের সরিতা!’
চারদিকে তখন কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জয়জয়কার। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি ‘বিজলী’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের পরপরই কবিতাটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয় ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কবিতাটি একদিকে যেমন ভারতের স্বাধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্র সৃষ্টিতে জনমনে নবজাগরণ সৃষ্টি করে, অন্যদিকে ‘আপনারে ছাড়া কাহারে করিনা কুর্নিশ’ মনোভাবের কারণে রাজশক্তিও সচকিত হয়ে ওঠে। কবিতাটি প্রকাশের দুই বছর পর শনিবারের চিঠির একাদশ (আশ্বিন ১৩৩১ বঙ্গাব্দ) সংখ্যায় ভবকুমার প্রধান ছদ্মনামে কামস্কাট্কীয় ছন্দের ‘অসমছন্দ’ (ব্যাঙ) কবিতাটি ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়। মূলত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্যারোডি প্রকাশই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। নজরুলের ‘বল বীর-/ বল উন্নত মম শির,/শির নেহারি আমারি নত-শির ওই শিখর হিমাদ্রির!/বল বীর-/ বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া/খোদার আসন আরশ ছেদিয়া,/উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!/মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/বল বীর-/ আমি চির উন্নত শির।’ কবিতার বিপরীতে ভবকুমার প্রধান লিখিত ‘অসমছন্দ’ কবিতাটি—
‘আমি ব্যাঙ
লম্বা আমার ঠ্যাং
ভৈরব রভসে বর্ষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাং।
আমি ব্যাঙ
আমি পথ হতে পথে দিয়ে চলি লাফ;
শ্রাবণ নিশায় পরশে আমার সাহসিকা
অভিসারিকা
ডেকে ওঠে ‘বাপ বাপ।’
শনিবারের চিঠিতে নজরুলের কবিতার প্যারোডি প্রকাশের পাশাপাশি কবিতা, গানসহ অন্যান্য সৃষ্টিকর্ম নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক গদ্যও প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এ ছাড়া তৎকালে প্রকাশিত পত্রিকা ‘প্রগতি’, ‘কালিকলম’, ‘উত্তরা’, ‘ধূপছায়া’, ‘আত্মশক্তি’ ও নজরুলের ‘কল্লোল’-কে গালমন্দ করেও বিভিন্ন প্যারোডি ছাপা হতো। আবার শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত প্যারোডিরও প্যারোডি প্রকাশিত হতে দেখা যায়। নজরুলের ‘অ-নামিকা’ কবিতার প্যারোডি ‘বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ’ শিরোনামে গাজী আব্বাস বিটকেল ছদ্মনামে শনিবারের চিঠিতে (ভাদ্র সংখ্যা, ১৩৩৪) প্রকাশিত হয়।
‘তোমারে পেয়ার করি
কপনি লুঙ্গি পরি
লো আমার কিশোরী নাতিনী
সুদূর ভবিষ্যৎলোকে নিশীথ নির্জন কুঞ্জে হে টোকা ঘাতিনী
তোমারে পেয়ার করি
শৈশবের ওগো উলঙ্গিনী
অ-পাতা শয্যায় মম অ-শোয়া সঙ্গিনী
তোমারে পেয়ার করি।’
‘সিন্দু-হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত কাজী নজরুলের কবিতাটি—
‘তোমারে বন্দনা করি
স্বপ্ন সহচরী
লো আমার অনাগত প্রিয়া
আমায় পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা জাগানিয়া!
তোমারে বন্দনা করি
হে আমার মানস-রঙ্গিনী
অনন্ত-যৌবনা বালা, চিরন্তন বাসনা-সঙ্গিনী!
তোমারে বন্দনা করি।’
আবার দেখা যায়, ‘বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ’ লেখক গাজী আব্বাস বিটকেলকেও ছাড়লেন না সজনীকান্ত দাস। তিনি ভবকুমার প্রধান নামে গাজী আব্বাসকে উদ্দেশ করে লিখলেন—
‘গাজী আব্বাস বিটকেল
কল্লি মহা খিটকেল
লিখে ফেল্লি কাব্বি
তাও আবার ছাপবি?
ছাপলে তাও কাটবে
কেউ কেউ তা চাটবে।’
নজরুলের গান গ্রন্থিত হওয়ার আগে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আবার এসব গানের প্যারোডিও প্রকাশ করা হয় শনিবারের চিঠিতে। নজরুলের একটি বিখ্যাত গান—‘কে বিদেশী বন উদাসী/বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে’ গানটির প্যারোডি শনিবারের চিঠির পৌষ ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় ‘কে উদাসী বন গাঁ বাসী/বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে/বাঁশী সোহাগে ভিরমি লাগে/বর ভুলে যায় বিয়ের কনে’ ছাপা হয়। নজরুলের ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিসনে আজি দোল’ গানটির প্যারোডি করা হয়—‘জানালায় টিকটিকি তুই টিকটিকিয়ে করিস নে আর দিক।’
সজনীকান্ত দাস শনিবারের চিঠিতে ‘ভবকুমার প্রধান’, ‘গাজী আব্বাস বিটকেল’ নামে নজরুলকে ব্যঙ্গ করে লিখতেন। এ ছাড়া মোহিতলাল মজুমদার ‘সত্যসুন্দর দাস’ ছদ্মনামে, নীরদ সি চৌধুরী ‘বলাহক নন্দী’ ছদ্মনামে ক্রমাগত নজরুল সাহিত্যের বিদ্রূপ করতেন। মাঝেমধ্যে নজরুলও ‘কল্লোল’ পত্রিকার মাধ্যমে এসব লেখার জবাব দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। মোহিতলাল মজুমদার নজরুলের ‘মাধবী প্রলাপ’ কবিতার মধ্যে ব্যক্ত দেহবাদী প্রেমের নগ্নরূপের উপস্থিতি দেখতে পেয়ে লিখলেন—‘আধুনিক তরুণ সাহিত্যিকের বালক প্রতিভা কাব্যকাননে কাম-কণ্টক-ব্রণ-মহুয়া কুঁড়ির চাষ আরম্ভ করিয়াছে।’ আবার ‘সত্যসুন্দর দাস’ ছদ্মনামে নজরুলের ‘সাম্যবাদী’ সিরিজের কবিতা বিশেষ করে ‘বারাঙ্গনা’ কবিতায় বারাঙ্গনাকে ‘মা’ সম্বোধন করা তিনি মোটেই সমর্থন করেননি। তিনি এ কবিতাটির তীব্র সমালোচনা করে ‘শনিবারের চিঠি’ কার্তিক ১৩৩৪ সংখ্যায় ‘সাহিত্যের আদর্শ’ শিরোনামের প্রবন্ধে লেখেন—“সম্প্রতি একটি কবিতায় নব্য সাম্যবাদ প্রচারিত হয়েছে। এই কবিতাটি নাকি কবির একটি উৎকৃষ্ট কীর্তি। ইহাতে এক প্রকার nihilism বা নাস্তিক্যনীতির উল্লাস আছে— ইহাতে বর্তমান যুগের রণ-পিপাসু পাঠক-পাঠিকার বড় আদরের সামগ্রী। কাবতাটির যতটুকু মনে আছে, তাহাতে ইহাই কবির বক্তব্য বলিয়া মনে হয় যে, জগতে সকলেই অসাধু। সকলেই ভণ্ড, চোর এবং কামুক। অতএব জাতিভেদের প্রয়োজন নাই; আইস আমরা সকল ভেদাভেদ দূর করিয়া মহানন্দে নৃত্য করি।…মৈত্রীর আগে কবি বেশ্যাকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন—‘কে বলে তুমি বারাঙ্গনা মা’? বিদ্রোহের চরম হইল বটে। কিন্তু কথাটা দাঁড়াইল কি?…বারাঙ্গনা মা নয়, বারাঙ্গনা নারী বটে,…কবি প্রচারিত নব সাম্যবাদ অনুসারে ইহার অর্থ এই দাঁড়ায় যে—তুমিও বারাঙ্গনা, মাও বারাঙ্গনা। অতএব মা-তে ও তোমাতে কোন প্রভেদ নাই। এই ব্যাখ্যায় বেশি দূর অগ্রসর হইলে অন্তরাত্মা কলুষিত হয়, কিন্তু এই কবিতাটি তরুণদের বড় ভাল লাগিয়াছে। এই যে মনোভাব কেবল সমাজ বিদ্রোহ নয়, ইহা মানুষের মনুষ্যত্ব বিরোধী। ইহা সাহিত্য হইতে পারে না।”
লক্ষ করা যায়, ক্ষুরধার লেখনীর কারণে কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয়তা যত বেড়েছে তাকে নিয়ে ‘শনিবারের চিঠি’র ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের তীব্রতাও তত বাড়ানো হয়েছে। সুতরাং শনিবারের চিঠির মূল উদ্দেশ্য রস সৃষ্টি এবং রস সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের (লেখক) জনপ্রিয় করে তোলা, এটিই সর্বৈব প্রতীয়মান হয়েছে। তবে প্রাথমিক অবস্থায় যে নজরুলের কাব্যপ্রতিভাকে হেয় করার উদ্দেশ্যেই তার কবিতার ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হতো সে বিষয়েও দ্বিমত করা যায় না। সজনীকান্ত দাস ছিলেন কুশলী খেলোয়াড়। তিনি ভালোকে ভালোবাসতে জানেন। সজনীকান্ত দাস যে নজরুলের ভক্ত ছিলেন, তা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের স্মৃতিচারণা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে— “একদিন নজরুল যাচ্ছে ট্রামে চড়ে, তার পাশের খালি সিটটাতে একজন ভদ্রলোক এসে বসল। যেন জেনে শুনেই ঐ সিটটা সে নির্বাচন করল, বসল গা ঘেঁষে।
‘জানেন, আমি আপনার একজন ভক্ত।’ বললেন ভদ্রলোক, আচমকা শুনে কে না খুশি হয়? নজরুলও খুশি হল। জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম?’
‘শ্রী সজনীকান্ত দাস।’
আরে আপনি? হৃদ্যতায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে নজরুলের এতটুকু দেরি হলো না। বললে, ‘কী আশ্চর্য, পথে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল। কিন্তু ভাই আমাকে যে এই সামনের স্টপেই নেমে যেতে হবে।’
‘তাতে কী! আবার দেখা হবে আমাদের।’ সজনী নজরুলকে যাবার জায়গা করে দিল।”
বুদ্ধিধর সজনীকান্ত দাস বুঝেছিলেন ব্যক্তি হিসেবে নজরুলকে ভালোবাসা সহজ আর তাকে বিষয় হিসেবে নিয়ে ব্যঙ্গ করা লাভজনক। সজনীকান্ত হয়তো চেয়েছিলেন নজরুলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে কিন্তু ‘শনিবারের চিঠি’র খ্যাতি ও পরিচিতি তাকে এ কাজ থেকে বিচ্যুত হতে দেয়নি। তিনি ‘আত্মস্মৃতি’তে লিখেছেন—‘ভিতরে গান চলিতেছে। নজরুল ইসলামের বোতাম খোলা পিরহান ঘামে এবং পানের পিকে বিচিত্র হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তাহার কলকণ্ঠের বিরাম নাই। বিদ্রোহীর প্রলাপ পড়িয়া যে মানুষটিকে কল্পনা করিয়াছিলাম ইহার সহিত তাঁহার মিল নাই। বর্তমানের মানুষটিকে ভালবাসা যায়, সমালোচনা করা যায় না। এ ঘটনা-বিসুভিয়াসের মত সঙ্গীতগর্ভ এই পুরুষ।’ শনিবারের চিঠিতে নজরুলকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা হলেও কবি-সাহিত্যিকদের বিবাদ যে বেশি দিন টেকে না, তা বোঝা যায় মোহিতলাল মজুমদার ও সজনীকান্ত দাসের জবানিতে। মোহিতলাল মজুমদার নজরুলকে অভিশাপ দিলেও তার রচনার বিদ্রূপ করলেও খোঁজ নিয়েছেন। নজরুল ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত জেনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন—‘নজরুল মোটেই শরীরের যত্ন নেয় না।’ সুতরাং এ কথা বলা অসঙ্গত নয় যে ‘শনিবারের চিঠি’ নজরুলকে যত ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ, যত সমালোচনা করে রচনা প্রকাশ করুক না কেন, এতে নজরুলের জনপ্রিয়তা বেড়েছে বই কমেনি। পাশাপাশি ‘শনিবারের চিঠি’ ও সজনীকান্ত দাসসহ সংশ্লিষ্ট সবার নাম কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেই উচ্চারিত হয়ে আসছে।
a

আপনার সামাজিক মিডিয়ায় এই পোস্ট শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর :
© All rights reserved © 2025
প্রযুক্তি সহায়তায়: csoftbd