হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ সংগঠনটির নামের অর্থ দাঁড়ায় ‘বাংলাদেশে ইসলাম রক্ষা’। এটি ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। হেফাজতে ইসলাম মূলত তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে দেশের কওমি (ধর্মীয় স্কুল) মাদরাসায়। উগ্র ইসলামী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ (এইচআইবি) দেশব্যাপী প্রতিবাদ শুরু করে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের প্রাক্কালে।
সংগঠনটি সর্বসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ২০১৩ সালে। তখন এই সংগঠনটি কওমি মাদরাসার প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি কর্মী নিয়ে ঢাকায় আন্দোলন করে। সংগঠনটির হাজার হাজার মাদরাসার একটি নেটওয়ার্ক দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে আল্লামা শাহ আহমদ শফী মারা যান। তিনি মারা যাওয়ার পর দলটির ভেতরের সরকারবিরোধী উপদলগুলো আরো চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে। ক্ষমতার ভারসাম্যও চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে।
শাহ আহমদ শফীর উত্তরসূরি হিসেবে আমির পদে আসেন জুনায়েদ বাবুনগরী। তার বয়স যখন ২০-এর কোটায় তখন তিনি চার বছর পাকিস্তানে পড়াশোনা করেছিলেন। প্রথমে তিনি পড়াশোনা করেন জামিয়া উলূম-উল-ইসলামিয়ায়। পরে করাচির জামিয়া দারুল উলূম নামের এক প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। কট্টরপন্থী বাবুনগরী দায়িত্ব নেওয়ার পর তার পূর্বসূরির প্রণীত দলটির মধ্যপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সরে এসে অনেকটাই রাজনৈতিক চরিত্র দেন।
এই বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন দ্য ডেইলি স্টারের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট রাশিদুল হাসান।২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি নিবন্ধে তিনি জানান, হেফাজত একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হচ্ছে। দলটির কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই, কৌশলগত এমন দাবির পরও হেফাজতে ইসলাম এখন রাজনৈতিক দলের চেয়েও বেশি কিছু।
এর আগে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া নিষিদ্ধ মৌলবাদী ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর (জেআই) সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জোটবদ্ধ হয়েছিলেন। এই দুটি দল আগে ঢাকায় সরকার গঠনের জন্য জোটবদ্ধও হয়েছে। শেখ হাসিনাকে হটাতে হেফাজতের উচ্চাভিলাষী নতুন নেতৃত্বকে শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে দেখছে বর্তমান বিএনপি।
কিছু বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ মনে করেন, হেফাজতে ইসলাম জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে একটি ফ্রন্টে পরিণত হয়েছে। যে দলটি বাংলাদেশে শরিয়াহ শাসন কায়েম করতে চায়। জামায়াত পাকিস্তানি আন্তঃবাহিনী গোয়েন্দা সংস্থার (আইএসআই) সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে বলে মনে করা হয়। জামায়াত ও হেফাজত একে অপরের কাছে আসার পেছনে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে বলে মনে করা হয়।
চলতি বছরের ২৬ মার্চ হেফাজত বাংলাদেশে যে সহিংসতা সৃষ্টি করেছিল, তার পটভূমি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা দরকার। দেশে মোদি আসার পরও সহিংসতা চলছিল, সহিংসতা চলমান থাকে বেশ কয়েক দিন। বাংলাদেশ সরকার হেফাজতের কর্মকাণ্ড গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের প্রথম প্রতিক্রিয়া দৃঢ় ছিল। তিনি বিক্ষোভ থামানোর আহ্বান জানান। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী ধৈর্য্য সহকারে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। বিক্ষোভ বন্ধ না করা হলে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব।
এদিকে ইসলামের নামে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোয় হেফাজতের প্রতি তীব্র নিন্দা জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হেফাজতকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার জন্য বিএনপি ও জামায়াতের সমালোচনা করেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, এসব কর্মকাণ্ড হেফাজত কি একা করেছে? এর পেছনে বিএনপি-জামায়াত জোটের হাত রয়েছে।
হেফাজতকে সমর্থন জানিয়ে ২৭ ও ২৮ মার্চ বিএনপি ও জামায়াত পৃথক বিবৃতি জারি করেছিল বলে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে তাদেরও ভূমিকা রয়েছে এটি তার প্রমাণ করেছে। তিনি এই দুটি দলকেই আদর্শবর্জিত বলে দাবি করেন। তার দাবি, মোদির সফরবিরোধী হেফাজতের তাণ্ডবকে সমর্থন করছে এই দুই দল। আবার একই সময়ে মোদি যখন দেশে এলেন, তখন তারা তাঁকে (মোদিকে) স্বাগত জানিয়েছে। শেখ হাসিনা দেশের সংসদকে নিশ্চিত করেছেন যে যারা এমন ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
মোদির বাংলাদেশ সফর সম্পর্কে ভারত সরকার তাদের বিবৃতিতে জানিয়েছে, মোদির সফর ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতাকে আরো দৃঢ় করবে। হেফাজতের তাণ্ডব সম্পর্কে তারা বলছে, সহিংসতা উদ্বেগের বিষয়। আমরা সর্বদা মৌলবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে ছিলাম। আমরা নিশ্চিত যে বাংলাদেশ সরকার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে।
বিক্ষোভের আসল উদ্দেশ্য হলো দলটির নতুন নেতৃত্বের অধীনে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হেফাজতের উত্থান ঘোষণা করা। যে দলটি বাংলাদেশে ইসলামকে ‘রক্ষা’ করতে চায়। মনে করা হচ্ছে, এই বিষয়টি সম্পর্কে শেখ হাসিনা অবগত এবং মোকাবেলা করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন।
সূত্র: কালের কণ্ঠ, (ইউরোপীয় ফাউন্ডেশন ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজে ‘ভায়োলেন্ট প্রটেস্টস ডিউরিং ইন্ডিয়ান পিএম’স ভিজিট মে হেরাল্ড দ্য ডাউন অব এ পটেন্ট নিউ এক্সট্রিমিস্ট ইনটিটি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে অনূদিত (সংক্ষেপিত)।
Leave a Reply