মো. জাকির হোসেন
বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের অনুসারীর সংখ্যা ৯০ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশের মানুষ ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে ধর্মনিরপেক্ষ কিংবা ইসলামি আইন ও বিধি-বিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনায় বিশ্বাসী নয় এমন রাজনৈতিক দলকে অধিক পছন্দ করে, তাদের ভোট দেয়। ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রতি তাদের আস্থা নেই। এই অনাস্থার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। অবিভক্ত ভারতে মুসলিম লীগ নেতাদের অদূরদর্শিতা, একগুঁয়েমি, হঠকারিতা ও ষড়যন্ত্রের কারণে ভারত ভাগের সময় বাংলাদেশ তার প্রাপ্য অনেক ভূ-খন্ড হারিয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর লর্ড মাউন্টব্যাটেন চেয়েছিলেন সাময়িকভাবে তিনি ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেরই গভর্নর জেনারেল থাকবেন। ভারত মেনে নিলেও জিন্নাহ রাজি হলেন না, তিনি নিজেই পাকিস্তানের গভর্নর হলেন। এতে মাউন্টব্যাটেন ক্ষেপে গিয়ে পাকিস্তানের সর্বনাশ করলেন। যদিও র্যাডক্লিফকে ভার দেওয়া ছিল ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণ করতে, তথাপি রাগান্বিত মাউন্টব্যাটেন গোপনে কংগ্রেসের সঙ্গে পরামর্শ করে একটি ম্যাপ নির্ধারণ করেছিলেন বলে অনেকেই মনে করেন। এরূপ মনে করার পেছনে প্রধান যুক্তি হলো, মওলানা আকরাম খাঁ মুসলিম লীগের সভাপতি হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার রক্তের উপর দিয়ে বাংলা ভাগ হবে। আমার জীবন থাকতে বাংলা ভাগ করতে দেব না। সমস্ত বাংলাই পাকিস্তানে যাবে।’ কিন্তু ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের স্থলে নাজিমুদ্দিন সাহেব নেতা নির্বাচিত হয়ে যে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেন তাতেই বাংলাদেশের কপাল পুড়লো। বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এ বিষয়ে লিখেছেন, ‘নাজিমুদ্দিন সাহেব মুসলিম লীগ বা অন্য কারো সাথে পরামর্শ না করেই ঘোষণা করলেন ঢাকাকে রাজধানী করা হবে। তাতেই আমাদের কলকাতার ওপর আর কোনও দাবি রইল না। এদিকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েছিলেন, কলকাতা নিয়ে কী করবেন?’ ইংরেজ তখনও ঠিক করে নাই কলকাতা পাকিস্তানে আসবে, না হিন্দুস্তানে থাকবে। আর যদি কোনও উপায় না থাকে তবে একে ‘ফ্রি শহর’ করা যায় কিনা? কারণ, কলকাতার হিন্দু-মুসলমান লড়বার জন্য প্রস্তুত। যেকোনও সময় দাঙ্গা-হাঙ্গামা ভীষণ রূপ নিতে পারে। কলকাতা হিন্দুস্তানে পড়লেও শিয়ালদহ স্টেশন পর্যন্ত পাকিস্তানে আসার সম্ভাবনা ছিল। হিন্দুরা কলকাতা পাওয়ার জন্য আরও অনেক কিছু ছেড়ে দিতে বাধ্য হতো।’ একজন ইংরেজ গভর্নর হয়ে ঢাকা আসতে রাজি হচ্ছিল না, কারণ ঢাকায় খুব গরম। তার উত্তরে মাউন্টব্যাটেন যে চিঠি দিয়েছিলেন তাতে লেখা ছিল, ‘পূর্ব পাকিস্তানে দুনিয়ার অন্যতম পাহাড়ি শহর, থাকার কোনও কষ্ট হবে না। অর্থাৎ দার্জিলিংও আমরা পাব। তাও নাজিমুদ্দিন সাহেবের এই ঘোষণায় শেষ হয়ে গেল। যখন গোলমালের সম্ভাবনা থাকল না, মাউন্টব্যাটেন সুযোগ পেয়ে যশোর জেলায় সংখ্যাগুরু মুসলমান অধ্যুষিত বনগাঁ জংশন কেটে দিলেন। নদীয়ায় মুসলমান বেশি, তবু কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট জংশন ওদের দিয়ে দিলেন। মুর্শিদাবাদে মুসলমান বেশি কিন্তু সমস্ত জেলাই দিয়ে দিলেন। মালদহ জেলায় মুসলমান ও হিন্দু সমান সমান তার আধা অংশ কেটে দিলেন, দিনাজপুরে মুসলমান বেশি, বালুর ঘাট মহকুমা কেটে দিলেন যাতে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং হিন্দুস্তানে যায় এবং আসামের সাথে হিন্দুস্তানের সরাসরি যোগাযোগ হয়। উপরোক্ত জায়গাগুলো কিছুতেই পাকিস্তানে না এসে পারত না। এদিকে সিলেটে গণভোটে জয়লাভ করা সত্ত্বেও মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ করিমগঞ্জ মহকুমা ভারতবর্ষকে দিয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম, আসামের কাছাড় জেলা ও সিলেট জেলা পাকিস্তানের ভাগে না দিয়ে পারবে না।’ নেতারা যদি নেতৃত্ব দিতে ভুল করে, জনগণকে তার খেসারত দিতে হয়। যে কলকাতা পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল সেই কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম। কেন্দ্রীয় লীগের কিছু কিছু লোক কলকাতা ভারতে চলে যাক এটা চেয়েছিল বলে আমার মনে হয়। অথবা পূর্বেই গোপনে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দী নেতা হলে তাদের অসুবিধা হতো তাই তারা পেছনের দরজা দিয়ে কাজ হাসিল করতে চাইল।’
ইসলাম ধর্মের নামে রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র সেই সময় ছিল, এখনও চলছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার মানুষকে ধর্মের দোহাই দিয়ে শোষণ-নির্যাতন শুরু হলো। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি স্বায়ত্তশাসনের জন্য ঐক্যবদ্ধ হলে আবারও ধর্মের নামে মনগড়া ফতোয়া দিল ইসলামপন্থী দলগুলো। ইসলাম রক্ষা করতে হলে পাকিস্তান রক্ষা করতে হবে জিগির তুললো। ধর্মজীবীদের মিথ্যার জাল ছিন্ন করে জেগে উঠলো মানুষ, শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। ইসলাম ধর্মের ভয়ঙ্কর অপব্যবহার করলো পাকিস্তান ও তাদের এ দেশীয় দোসর ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। ইসলাম রক্ষার নামে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম নৃশংসতম গণহত্যা, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করল। ইসলাম ধর্মের নামে মিথ্যাচার, মনগড়া ফতোয়া কেবল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেই নয় এর আগেও ইসলামপন্থী দলগুলো এমন করেছে। চুয়ান্নর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর বিপরীতে মুসলিম লীগ প্রার্থী ছিলেন ওয়াহিদুজ্জামান। নির্বাচনে মুসলিম লীগ কিভাবে ধর্মের অপব্যবহার করেছে সে বিষয়ে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জামান সাহেব ও মুসলিম লীগ যখন দেখতে পারলেন তাদের অবস্থা ভালো না, তখন এক দাবার ঘুঁটি চাললেন। অনেক বড় বড় আলেম, পীর ও মওলানা সাহেবদের হাজির করলেন। গোপালগঞ্জে আমার নিজ ইউনিয়নে পূর্ব বাংলার এক বিখ্যাত আলেম মওলানা শামসুল হক সাহেব জন্মগ্রহণ করেছেন। আমি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। তিনি ধর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন। আমার ধারণা ছিল, মওলানা সাহেব আমার বিরুদ্ধাচরণ করবেন না। কিন্তু এর মধ্যে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করলেন এবং আমার বিরুদ্ধে ইলেকশনে লেগে পড়লেন। ঐ অঞ্চলের মুসলমান জনসাধারণ তাকে খুবই ভক্তি করত। মওলানা সাহেব ইউনিয়নের পর ইউনিয়ন স্পিডবোট নিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন এবং এক ধর্ম সভা ডেকে ফতোয়া দিলেন আমার বিরুদ্ধে যে, ‘আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে।’ সাথে শর্ষিনার পীর সাহেব, বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের শাহ সাহেব সকলেই আমার বিরুদ্ধে নেমে পড়লেন এবং যত রকম ফতোয়া দেয়া যায় তাহা দিতে কৃপণতা করলেন না।’ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নির্বাচনে ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব প্রায় দশ হাজার ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন এবং সেই সাথে মুসলিম লীগও শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ধর্মের অপরাজনীতির বিষয়ে এদেশের মানুষের আস্থাহীনতার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে যে, জনগণকে ‘ইসলাম ও মুসলমানের নামে’ শ্লোগান দিয়ে ধোঁকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালোবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দিবে না।’
ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি এদেশের মানুষের আস্থাহীনতার কারণেই একসময়ের অত্যন্ত দাপুটে ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলো বিলুপ্ত বা ‘প্যাড’সর্বস্ব দলে পরিণত হয়েছে, কিংবা অন্য অ-ইসলামিক দলের কাঁধে সওয়ার হয়ে ৩-৪ শতাংশ ভোট নিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর এমন আস্থা সংকটের সময়ে দৃশ্যপটে অরাজনৈতিক মোড়কে আবির্ভূত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। আসলে এটি অরাজনৈতিক সংগঠন কি? আমার বিবেচনায় অবশ্যই না। হেফাজতের কর্মকা- বিবেচনা করলে, এর নেতৃত্বে যারা আছেন সেদিকে দেখলে সহজেই অনুমেয় অরাজনৈতিক মোড়কটা একটা ধোঁকা মাত্র। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে ‘প্রয়াত শাহ আহমদ শফীর জীবনকর্ম, অবদান’ শীর্ষক আলোচনা ও মতবিনিময় সভায় হেফাজতের সাবেক নেতারা দাবি করেন, মতিঝিলের শাপলা চত্বরে ২০১৩ সালের ৫ মে সংঘটিত পুরো ঘটনার দায়ভার হেফাজতে ইসলামের ওই সময়ের মহাসচিব ও বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীর। তাঁরা অভিযোগ করেছেন- তৎকালীন আমির শাহ আহমদ শফীকে না জানিয়ে হেফাজতের নেতাকর্মীদের রাতভর শাপলা চত্বরে রেখে দেন বাবুনগরী। শফী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলবে; কিন্তু তিনি হুজুরকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। তার ধারণা ছিল, সারারাত শাপলা চত্বরে অবস্থান নিতে পারলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী নামতে বাধ্য হবে। সভায় শাহ আহম্মদ শফীর জীবনের শেষ তিনদিনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বক্তারা অভিযোগ করেন, হাটহাজারী মাদ্রাসায় হামলা, ভাঙচুর হয়েছে। শফীর প্রতি চরম বেয়াদবি করা হয়েছে। গৃহবন্দি করে নির্যাতনের মাধ্যমে তাকে শাহাদাত বরণ করতে বাধ্য করা হয়েছে। খাবার-ওষুধ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, অ্যাম্বুলেন্স বন্ধ ছিল- এগুলোই তার মৃত্যুর মূল কারণ।
স্বভাবতই প্রশ্ন, একটি অরাজনৈতিক সংগঠন সরকার উৎখাতের জন্য মতিঝিলে মরিয়া হয়ে উঠেছিল কেন? আহম্মদ শফীর নেতৃত্ব পরিবর্তনে এমন নিষ্ঠুর ‘অনৈসলামিক’ পন্থা বেছে নেওয়া হয়েছিল রাজনীতির কোন অদৃশ্য হাতের ইশারায়?
বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের অনেক নেতাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কোভিডের কারণে কয়েকজন এসেছেন, অন্যরা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদি বিজেপির নেতা হিসাবে নয়,ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে উদযাপনে যোগ দিতে এসেছেন। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ভারতের অবদান অবিস্মরণীয়। সুবর্ণজয়ন্তীর সময়ে যিনিই ভারতের সরকার প্রধান থাকতেন তিনি আমন্ত্রিত হতেন। মোদির বাংলাদেশে আগমনকে কেন্দ্র করে হেফাজতের কয়েক দিনব্যাপী তা-বের ফলে এর অরাজনৈতিক খোলসটা পুরোপুরি খুলে গিয়েছে। সৌদি আরব, জর্ডান, ওমান, বাহরাইন, ফিলিস্তিন, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মোদি অনেক মুসলিম দেশ সফর করেছেন। কোথায়ও কি মোদির আগমন ঠেকাতে বিরোধিতা, তা-ব হয়েছে? অবশ্যই না। বরং, সংযুক্ত আরব আমিরাত সেদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘জায়েদ মেডাল’ দিয়েছে মোদিকে। এছাড়াও আবুধাবিকে নরেন্দ্র মোদির ‘দ্বিতীয় বাসস্থান’ হিসেবেও ঘোষণা করা হয়েছে। অন্যদিকে বাহরাইনও মোদিকে সম্মাননা দিয়েছে। তারা মোদিকে জাতি গঠনে অগ্রগতির স্বীকৃতিস্বরূপ ‘কিং হামাদ অর্ডার অব দ্য রেনেসাঁ’ পুরস্কার দিয়েছে। ২০১৯ এর ডিসেম্বরে মোদি সৌদি আরব সফর করেছেন। রিয়াদ ভারতের সাথে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বের’ কথা ঘোষণা করে এ সময়। সৌদি আরব ও ভারতের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত মজবুত করতে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানও ভারত সফর করেছেন এবং বিরাট অংকের সৌদি বিনিয়োগের ঘোষণা করেছেন। দশকের পর দশক ধরে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর পাকিস্তান এখন ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে অতি তৎপর হয়ে উঠেছে। পাক সেনাপ্রধান জেনারেল বাজওয়া গত ২১ মার্চ অতীতের বিরোধকে কবর দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সম্পর্কের আহ্বান জানিয়েছেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানও ভারতের সাথে তার দেশের শান্তি স্থাপনের প্রস্তাব দেন। প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাপ্রধানের কথার প্রতিধ্বনি করেছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশীও। পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের সরকার ভারতের সাথে বিরোধের বদলে সহাবস্থান এবং সহযোগিতার সম্পর্কে ইচ্ছুক। তাহলে মোদির বাংলাদেশ আগমনকে কেন্দ্র করে হেফাজতের তা-বের পেছনে কি রহস্য? হরতালের নামে ভাংচুর, জ্বালাও-পোড়াও, ধ্বংসযজ্ঞ ইসলাম কি সমর্থন করে? হেফাজতে ইসলাম ভয়ংকর তা-ব চালিয়ে সারা দেশে হাজার কোট টাকার সম্পদ ধ্বংস করেছে। তা-বের একটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। হরতালের দিন হেফাজতে ইসলাম নেতাকর্মীরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগার, প্রেসক্লাব, জেলা পরিষদ ভবন, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, জেলা পুলিশ লাইন, সার্কিট হাউস, ফায়ার সার্ভিসের কার্যালয়, সদর উপজেলা ভূমি অফিস, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়, সরাইলে হাইওয়ে থানা, সদরের খাঁটিহাতা থানা, রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি, সদর থানাধীন দুই নম্বর পুলিশ ফাঁড়ি, জেলা আনসার-ভিডিপি কার্যালয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা কার্যালয়, জেলা প্রশাসন আয়োজিত উন্নয়ন মেলা, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমপ্লেক্স, ব্যাংক এশিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল স্টেশন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর কার্যালয়, মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র, দলিল লেখক সমিতির কার্যালয়, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ ভাষা চত্বর, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন, আব্দুল কুদ্দুস মাখন মুক্তমঞ্চ, জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কার্যালয় ও বাড়ি, জেলা আওয়ামীগ নেতা ও আয়কর উপদেষ্টা জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়ার কার্যালয়, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির বাড়ি, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের বাড়ি, বিজয়নগর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির অফিস, বিজয়নগর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের বাসভবন ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকের বাড়ি ভাংচুর করেছে এবং কিছু ক্ষেত্রে পুড়িয়ে দিয়েছে। পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও ফাঁড়িতে থাকা ১৮টি মাইক্রোবাস এবং মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া সিভিল সার্জন, মৎস্য কর্মকর্তা ও জেলা পরিষদ কার্যালয়ের মধ্যে থাকা প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলীর তিনটি গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কালীবাড়ি মন্দিরের প্রতিমা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেন, ঢাকা থেকে সিলেটগামী পারাবাত এক্সপ্রেস ট্রেন ভাংচুর করেছে। প্রেসক্লাবের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন জামি ও চ্যানেল টুয়েন্টি ফোরের প্রতিনিধির ওপর হামলা করা হয়েছে।
হেফাজতে ইসলাম সেদিন ইসলাম হেফাজত দূরে থাক ভয়ংকরভাবে কুরআন ও হাদিসের বিধান লংঘন করে তা-ব চালিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে সমাজে ফিতনা-ফ্যাসাদ, বিপর্যয়, নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হত্যার চেয়েও বড় পাপ। মহান রব পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘ফিতনা হত্যা অপেক্ষা গুরুতর’। (সূরা বাকারা: ১৯১) ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিরা আল্লাহর অনুগ্রহ বঞ্চিত। আল্লাহ বলেন, ‘ৃআল্লাহ ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের ভালোবাসেন না।‘ (সুরা মায়িদা:৬৪) ইসলাম অন্যায়ের প্রতিকার অন্যায় পথে করতে নিষেধ করেছে। এ বিষয়ে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘ভালো কাজ এবং মন্দ কাজ সমান হতে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা; ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো’। (সুরা ফুসসিলাত: ৩৪) হাটহাজারীতে হেফাজত কর্মী নিহত হওয়ার প্রতিকার হিসাবে ইসলাম কি আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া অনুমোদন করে? রাস্তা বন্ধ করতে ইটের দেওয়াল তুলে দেওয়া, মসজিদের পরিবর্তে রাস্তায় নামাজ আদায় ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কুরআন তিলাওয়াত করতে রাস্তায় বসিয়ে দেওয়া ইসলাম সমর্থন করে কি? রাসুল (সা.) পথিকের হক নষ্ট করতে নিষেধ করে বলেছেন এমন কোন কাজ না করা যাতে তার দ্বারা কোনও চলাচলকারীর সামান্য কষ্টও হয়। (আবু দাউদ, ৪৮১৯; মুসনাদে বাযযার, ৫২৩২; মুসলিম, ২১৬১; মুসনাদে আবি ইয়ালা, ৬৬০৩)। ইসলামের যুদ্ধনীতি প্রতিরক্ষামূলক, আক্রমণাত্মক নয়, এমনকি প্রতিশোধমূলকও নয়। ইসলাম এমনকি যুদ্ধের সময়ও আসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে, বাড়িঘর ও উপাসনালয় ধ্বংস করতে নিষেধ করেছে। (বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৯/৯০) অথচ হেফাজত অনেক বাড়িঘর ও অসামরিক স্থাপনা পুড়িয়েছে, ভাংচুর করেছে। বুখারি, মুসলিমসহ প্রায় ৬০টির উপরে হাদিসের কিতাবে পাওয়া যায়, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যার জিহ্বা ও হাত থেকে মুসলমানগণ নিরাপদ থাকে সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলিম। আর যাকে মানুষ তাদের জান ও মালের জন্য নিরাপদ মনে করে সে-ই প্রকৃত মুমিন’। (তিরমিযী,২৫৫১; নাসাঈ, ৪৯০৯) অন্য হাদিসে মুসলমানের পরিবর্তে মানুষ শব্দটি এসেছে (সহীহ ইবনে হিব্বান)। রাসুল (সা.)-এর হাদিসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হেফাজত কর্মীদের হাতগুলো কী ভয়ানক তা-ব চালালো। রাসুল (সা.) মানুষকে ভয় দেখাতে এবং শাসাতে নিষেধ করেছেন। কেননা, তা মানুষের অধিকার ও মর্যাদার পরিপন্থী। তিনি বলেন, ‘কোনও মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমকে ভয় দেখানো বৈধ নয়।’ (আবু দাউদ, ৫০০৪) অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কখনও আগে অস্ত্র উত্তোলন করো না বা অস্ত্রের ভয়ভীতিও প্রদর্শন করো না।’ (মুসনাদে আহমাদ, ২৭২৮) হেফাজত কর্মীরা লাঠি, রামদা, কুড়াল, শাবল, কিরিচ, গুলতি, ঘোড়া, হেলমেট নিয়ে হরতালের শুরুতেই রাস্তা দখল নেয়। হেফাজতের পিকেটাররা অনবরত ইটপাটকেল ছুড়তে থাকলে ট্রেনের যাত্রীরা আত্মরক্ষার জন্য ট্রেনের মেঝেতে শুয়ে পড়েন। তারপরও ইটপাটকেলের আঘাতে অনেক যাত্রী আহত হন। শিশুর প্রতি আচরণ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শিশুকে স্নেহ করে না এবং বড়দের সম্মান দেখায় না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (তিরমিজি, ১৯২১)। অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেবল হতভাগ্য ব্যক্তির হৃদয় থেকেই দয়া তুলে নেওয়া হয়।’ (তিরমিজি, ১৯২৩)। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ইসলামের নামে শিশুদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে হেফাজত। খাঁটিহাতা হাইওয়ে থানা যারা জ্বালিয়ে দিয়েছে ওই হামলাকারীদের মধ্যে ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু ও কিশোর। এ সময় পুলিশের গুলিতে নিহত দুজনের একজন শিশু। আহতদের মধ্যেও কয়েকটি শিশু রয়েছে।
মোদি বিরোধিতায় এই যে জীবন হানি ও হাজার কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হলো, জমির দলিলসহ নানা সরকারী নথি ধ্বংসের কারণে নিশ্চিত হয়রানি, ভোগান্তি ও ভয়ংকর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলো তাতে মোদির কি ক্ষতি হলো? বরং শাপে বর হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে হয়ত মোদির দলের বিজয়গাথা রচিত হলো। আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমারের জনগণ সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। পুলিশ, সেনাবাহিনীর গুলিতে শত শত লোক নিহত হয়েছে কিন্তু তারা সরকারি-বেসরকারি সম্পদের ওপর এমন তা-ব চালিয়েছে? অথচ ইসলাম হেফাজতের ধ্বজাধারীরা ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে কী নারকীয় তা-বে মেতে উঠলো। ফ্রান্সে জিহাদের নামে একজন অমুসলিমকে গলা কেটে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় ফরাসি সরকার এমন এক আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে যার দ্বারা ফরাসি সরকার মসজিদসহ যেকোনও ইসলামি কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে পারবে। মোদিবিরোধী তা-বের সময় হেফাজতিরা ভারতের ৩০ কোটি মুসলমানের নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করেছে বলে প্রতীয়মান হয় না। ইসলামকে অপরাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার, ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যা, মিথ্যাচার, হঠকারিতা, অদূরদর্শিতা, বিদ্বেষ, উগ্রতা, ঘৃণা ছড়ানো, ভয়ংকর সাম্প্রদায়িকতা, ষড়যন্ত্র, ইত্যাদি কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ইসলামি রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Leave a Reply