সংবাদদাতা: ১০ বছরে সাতক্ষীরা জেলার ছয়টি খেয়াঘাট ইজারার ১৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আশাশুনি উপাজেলার শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিল ও জেলা পরিষদের দু’কর্মকর্তাসহ ১২জনের নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। বুধবার দূর্ণীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক নাজমুল হাসান বাদি হয়ে খুলনা দুদক কার্যালয়ে এ মামলা দায়ের করেন।
মামলার আসামীরা হলেন, আশাশুনি উপজেলার বুড়োখারাটি গ্রামের মৃত আবু বক্কর ছিদ্দিকের ছেলে শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিল, একই উপজেলার শ্রীউলা ইউনিয়নের কলিমাখালি গ্রামের নূর ইসলামের ছেলে সাতক্ষীরা জজ কোর্টের অ্যাড. নুরুল আমিন, একই উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের দলিল গাজীর ছেলে হারুণ অর রশিদ, গাজীপুর গ্রামের গোলাম মোস্তফার ছেলে মোঃ সরোয়ার হোসেন, কালিগঞ্জ উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের সাদুলল্লাহ কারিকরের ছেলে আব্দুল মজিদ কারিকর, কোমরপুর গ্রামের ওসমান গাজীর ছেলে মোঃ মোক্তার হোসেন, শ্যামনগর উপজেলার আটুলিয়া গ্রামের আব্দুল বারির ছেলে মোঃ শাহীন হোসেন, একই উপজেলার গোদাড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলী গাজীর ছেলে আইয়ুব হোসেন, শহরের মুনজিতপুরের আরশাদ আলীর ছেলে মোঃ ইকবাল হোসেন, শহরের সুলতানপুরের শেখ সাইফুদ্দিন আহমেদ এর ছেলে শেখ আহছান হাবিব অয়ন, সাতক্ষীরা সদরের মাটিয়াডাঙা গ্রামের আরিফ সরদারের ছেলে ও জেলা পরিষদের প্রধান সহকারি মোঃ খলিলুর রহমান ও শ্যামনগর উপজেলার মীরগাঙ গ্রামের আতিয়ার রহমান সরদারের ছেলে ও জেলা পরিষদের নিম্নমান সহকারি এসএম নাজমুল হোসেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, বাংলা ১৪১৫ সাল থেকে ১৪২৪ সাল বা ইংরেজি ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাতক্ষীরার চেউটিয়া, কালিগঞ্জ বাজার, ঝাঁপালি-মাদারবাড়িয়া, কালিকাপুর নাসিমাবাদ, ঘোলা- হিজলা- কল্যাণপুর এবং হাজরাখালি বিছট খেয়াঘাটসহ ২১টি খেয়াঘাটে এক কোটি ৯৬ লাখ ৪৬ হাজার ৪৫৮ টাকার ইজারা দেওয়া হয়। এরমধ্যে ইজারাদাররা এক কোটি ৮১ লাখ ৭১ হাজার ৬৩৮ টাকা জেলা পরিষদের কোষাগারে জমা দেন। বকেয়া থাকে ১৩ লাখ ৭৪ হাজার ৮২০ টাকা।
বাংলা ১৪২২ সালে কালিগঞ্জ বাজার খেয়াঘাটের ইজারাদার মোক্তার হোসেন ৩৭ হাজার ৯০০ টাকা, ১৪১৯ সালে ঝাঁপালি- মাদারবাড়িয়া খেয়াঘাটে ইজারাদার আইয়ুব হোসেন ৩৯ হাজার ৬৯২ টাকা, একই খেয়াঘাট ১৪২১ সালে ইজারাদার ইকবাল হোসেন ২৫ হাজার, ১৪২২ সালে ইজারাদার হারুন অর রশিদ ৫ হাজার ৪০০ টাকা ও ১৪২৩ সালে ইজারাদার মোঃ শাহীন ৩৮ হাজার টাকা পরিশোধ করেননি। এ ছাড়া ১৪২২ সালে কালিকাপুর – নাসিমাবাদ খেয়াঘাটের ইজারাদার আব্দুল মজিদ কারিকর ২৭ হাজার ১০০ টাকা, ১৪১৯ সালে হাজরাখালি- বিছট খেয়াঘাটের ইজারাদার শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিল ৫ লাখ ৬০ হাজার ৫২৮ টাকা, চেউটিয়া খেয়াঘাটে ১৪২৩ সালে ইজারাদার সরোয়ার হোসেন ৪৯ হাজার ৫০০ টাকা, ১৪২৪ সালে শেখ এহসান হাবিব অয়ন ৬৭ হাজার, ঘোলা- হিজলা- কল্যাণপুর খেয়াঘাটে ১৪১৫ সালে ইজারাদার অ্যাড. নুরুল আমিন ২৫ হাজার ১০০ টাকা, একই খেয়াঘাট ১৪১৯ সালে ইজারাদার শ্রীউলা ইউপি চেয়ারম্যান আবু হেনা শাকিল ৪ লাখ ৯৯ হাজার ৬০০ টাকা জেলা পরিষদের কোষাগারে জমা করেননি। এ ক্ষেত্রে শুধু আবু হেনা শাকিলই ১০ লাখ ৬০ হাজার ১২৮ টাকা ইজারার টাকা জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। টাকা পরিশোধের জন্য জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী ওইসব ইজারাদারদের নোটিশ করলেও তারা সাড়া পাননি।
পরবর্তীতে তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় গত বছরের ১৩ আগষ্ট ১০জন ইজারার টাকা আত্মসাৎকারি ও ইজারার টাকা আদায়ের দায়িত্বে থেকেও গাফিলতি করা জেলা পরিষদের প্রধান সহকারি মোঃ খলিলুর রহমান ও নিম্নমান সহকারি এসএম নাজমুল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করার সুপারিশ করে দু’দকের খুলনা বিভাগীয় সমন্বিত কার্যালয় ও ঢাকার সেগুনবাগিচার প্রধান কার্যালয়ে চিঠি দেওয়া হয়। চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে উপরোক্ত দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য খুলনা বিভাগীয় সমন্বিত কার্যালয়ে নির্দেশ পাঠানো হয়। সে অনুযায়ি খুলনা অফিস ২১ জানুয়ারি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য অনুমোদন দিলে ২৭ জানুয়ারি দুদকের খুলনা অফিসের উপপরিচালক নাজমুল হাসান বাদি হয়ে দ-বিধির ৪০৯/১০৯ এবং ১৯৪৭ সালের দূর্ণীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় তাদের কার্যালয়ে এ মামলা(২) দায়ের করেন। মামলার তদন্তভার দেওয়া হয়েছে সহকারি পরিচালক তরুণ কান্তি ঘোষ। সাতক্ষীরা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে এ মামলার নথি পাঠানো হলে বিশেষ মামলা (০১/২১) হিসেবে বিচার কার্যক্রম শুরু হয়ে আগামি ২৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তদন্তকারি কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন শেখ মফিজুল ইসলাম।
সাতক্ষীরা জজ কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে দুদকের মামলা পরিচালনাকারি অ্যাড. আসাদুজ্জামান দিলু মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
প্রসঙ্গত, ঘোলা- হিজলা- কল্যাণপুর খেয়াঘাট ও হাজরাখালি- বিছট খেয়াঘাটের শ্রেণী পরিবর্তণ করার বিরুদ্ধে জেলা পরিষদের তৎকালিন প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম মাহাবুবর রহমান নোটিশ করলে ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি আবু হেনা শাকিল হাইকোর্টে ২৫/২০১২ নং রিট পিটিশন দাখিল করেন। বাংলা ১৪২০-১৪২১ সালে ঘোলা- হিজলা- কল্যাণপুর খেয়াঘাট ইজারাদার আবু হেনা শাকিল ইজারার চার লাখ ২০ হাজার ৪৮০ টাকা পরিশোধ না করায় ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালিন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী শেখ মোঃ মনিরুজ্জামান আশাশুনি উপজেলা নির্বাচন অফিসারকে এক চিঠি দেন। চিঠিতে আবু হেনা শাকিল যাহাতে ইজারার টাকা পরিশোধ না করে ওই বছরের ২২ মার্চ ইউপি নির্বাচন না করতে পারেন সেজন্য ব্যবস্থা নিতে বলেন। যদিও তৎকালিন উপজেলা নির্বাচন অফিসার কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ইজারার টাকা পরিশোধ না করেও শ্রীউলা ইউনিয়নে নির্বাচন করেন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আবু হেনা শাকিল।
সাতক্ষীরার ২১টি খেয়াঘাটে ইজারার টাকা আত্মসাতসহ জেলা পরিষদের বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ এনে ২০১৮ সালের ১৩ মে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. সত্যরঞ্জন ম-ল স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেন। ওই বছরের জেলা পরিষদে এ নিয়ে প্রাথমিক তদন্ত করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক (যুগ্ম সচিব) হোসেন আলী খন্দকার। সেখানে তথ্য অধিকার আইনের মাধ্যমে পাওয়া তৎকালিন জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী এএনএম মঈনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত কাগজপত্র দেখিয়ে স্বাক্ষ্য দেন অ্যাড. সত্যরঞ্জন ম-ল ও মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ। পরে ওই কর্মকর্তা তদন্তের দায়িত্ব পালনে অনীহা প্রকাশ করলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় খুলনা বিভাগীয় কমিশনারকে তদন্তের দায়িত্ব দেন। বিভাগীয় কমিশনার আনোয়ার হোসেন হাওলাদার তদন্তে অপরাগতা প্রকাশ করে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন।
এরপর শুধুমাত্র খেয়াঘাটের ইজারার টাকা দূর্ণীতির মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ করে অ্যাড. সত্যরঞ্জন ম-ল ২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে ১২২৬২/১৮ নং রিট পিটিশন দাখিল করেন। ওই বছরের ১৫ অক্টোবর হাইকোর্টের বিচারপতি মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি হাফিজুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এক মাসের মধ্যে সত্যরঞ্জন ম-লের আবেদন নিষ্পত্তি করার জন্য ৮নং বিবাদী দুদক চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন।
Leave a Reply