একদিকে উজানে সীমান্তের ওপারে বাঁধ তৈরি করে এক তরফা পানি সরিয়ে নেয়ার ফলে বাংলাদেশের নদীগুলোতে দেখা দিয়েছে জল সঙ্কট।
অন্যদিকে, দেশের মধ্যেই অতিরিক্ত পলি জমে নদীগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নানা ধরনের শিল্প বর্জ্যের দূষণে নদীর প্রাণ বৈচিত্র্য এখন হুমকির মুখে। পাশাপাশি নদীর পাড় দখল করে, কিংবা নদীর বুকেই চলছে অবৈধ নির্মাণ।
ফলে বহু নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হয়তো ইতোমধ্যেই হারিয়ে গিয়েছে, নয়তো কোন রকমে ধুঁকছে।
এরকমই একটি মৃতপ্রায় নদীকে কাছাকাছি থেকে দেখার জন্য আমি গিয়েছিলাম পাবনার জেলার চাটমোহর উপজেলায়।
চলন বিলের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া বড়াল নদীকে দেখলে বিশ্বাসই হবে না যে এটি একটি নদী।
এর বুকের ঠিক মাঝ বরাবর তৈরি করা হয়েছে একটি ক্রস-ড্যাম বা আড়ি-বাঁধ। এটি একই সঙ্গে সড়ক হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। এই বাঁধ নদীটিকে মাঝ বরাবর কেটে দু’টুকরো করে ফেলেছে।
বড়ালে পানি আছে। তবে নদীতে যেমন পানি প্রবহমান থাকে। বড়ালে তেমনটি নয়। নদীর জল স্থবির। কচুরিপানায় ঢাকা। বেশ কয়েকটি বাঁধ এবং স্লুইস গেটের কারণে নদীটি খন্ড খন্ড হয়ে গিয়েছে।
বড়ালে পাড়ে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল কুমারগাড়া গ্রামের মোঃ. খলিলুর রহমানের সাথে। সারা জীবন তার কেটেছে বড়ালের কূলে।
তিনি জানালেন, বড়াল দিয়ে এক সময় হাজার-বারশো মন মালবাহী নৌকা চলাচল করতো। চাটমোহর ছিল ব্যস্ত এক বন্দর। চলন বিলের কৃষিপণ্য বড়াল বেয়ে চালান হয়ে যেত দূর-দূরান্তে।
“কিন্তু এখন এই নদীর পানি পাখিও পান করে না,” বলছিলেন মি. রহমান।
বড়াল নদীর প্রবাহকে যেভাবে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে তার ইতিহাস বেশ চমকপ্রদ।
বড়ালের উৎপত্তি পদ্মা নদী থেকে। রাজশাহীর চারঘাট এলাকায়। ১৯৮৫ সালে চারঘাটে বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য নিয়ে নদীর মুখে নির্মাণ করা হয় একটি স্লুইস গেট।
কিন্তু এটি নির্মাণের সময় সে সময় শুধুমাত্র স্থানীয় স্বার্থের কথাই বিবেচনা করা হয়েছিল। ২২০-কিলোমিটার দীর্ঘ বড়ালের ভাটিতে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ বসবাস করছিলেন, যারা নির্ভর করছিলেন এই নদীর ওপর, তাদের কথা সেই সময়কার পরিকল্পনাকারীরা মোটেও ভাবেনি।
যে নদীর কুলে একসময় ছিল বেশ ক’টি ব্যস্ত নদী বন্দর। ৮০ দশকের শেষ নাগাদ দেখা গেল সেই নদীতে আর জল আসে না।
আপনি ভাবছেন বড়ালের মত দুর্ভাগ্য নিশ্চয় অন্য নদীর হয়নি। ব্যাপারটি মোটেও তা না।
সরকারি হিসেব মতে দেশে প্রায় ৪০০ নদী থাকলেও এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক নদীতে শুকনো মৌসুমে কোন জল থাকে না।
ব্রিটিশ শাসনামলে জেমস রেনেল এই অঞ্চলের নদনদীর ওপর যে মানচিত্র তৈরি করেছিলেন, তা থেকেও বোঝা যায় গত ২০০ বছরে বাংলাদেশের নদনদীতে কতটা পরিবর্তন ঘটেছে।
দেশে মোট নদীর মোট সংখ্যা কত তা নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। নবগঠিত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মোঃ. আতাহারুল ইসলাম নদনদীর প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তথ্য ঘাটতির কথা স্বীকার করলেন।
তিনি জানালেন, প্রধান নদীর সংখ্যা মোট ৫৭টা। তিনটা নদী বাংলাদেশে ঢুকেছে মিয়ানমার থেকে। বাকি ৫৪টা এসেছে ভারত থেকে।
“কিন্তু বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যেই নদীর সংখ্যা নিয়ে সরকারের একেক বিভাগের কাছে একেক ধরনের তথ্য রয়েছে,” তিনি বললেন, “পরিসংখ্যান ব্যুরোর কাছে এক ধরনের হিসেব, আবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে আরেক হিসেব।”
তবে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান নদীগুলেরা বর্তমান চিত্রটা তুলে ধরলেন তার নাব্যতার হিসেব কষে।
তিনি জানালেন, স্বাধীনতার পর বিআইডাব্লিউটিএ’র তরফে যে জরিপ হয়েছিল তাতে জানা গিয়েছিল বাংলাদেশে নদীপথের মোট দৈর্ঘ্য ২৪০০০ কিলোমিটার।
“কিন্তু এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৮০০০ কিলোমিটার,” তিনি বলেন, “এ থেকেই বুঝতে পারেন নদীগুলোর অবস্থা আসলে কেমন।” অর্থাৎ প্রায় চার দশকে ১৬০০০ কিলোমিটার নদীপথ শুকিয়ে গিয়েছে।
কিন্তু যেখানে নদনদীর সংখ্যা নিয়েই কেউ একমত হতে পারছে না, সেখানে গত ৫০ কিংবা ১০০ বছরে বাংলাদেশে ক’টি নদীর মৃত্যু ঘটেছে? কিন্তু এ সম্পর্কে পাকা খবর কারো কাছেই নেই।
তবে এই প্রতিবেদন তৈরির সময় আমি প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তা, গবেষক এবং পরিবেশ আন্দোলনকারীর সঙ্গে কথা বলেছি, তারা ধারনা করছেন বাংলাদেশে গত প্রায় চার দশকে ৫০ থেকে ৮০টা নদী, শাখা নদী এবং উপনদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে।
পাশাপাশি ময়মনসিংহের পুরনো ব্রহ্মপুত্র, নেত্রকোনার মগড়া, কংশ ও সোমেশ্বরী, যশোরের ভৈরব, কপোতাক্ষ, ইছামতী, বেতনা, মুক্তেশ্বরী; কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা, ঘোড়াউত্রা, ফুলেশ্বরী; খুলনার রূপসা, শিবসা, ডাকি, আত্রাই-এর মতো নদীগুলো এখন মৃত্যুর দিন গুনছে।
একই চিত্র ফরিদপুরের কুমার, বগুড়ার করতোয়া, কুমিল্লার গোমতী, পিরোজপুরের বলেশ্বর, রাজবাড়ীর গড়াই, কুড়িগ্রামের ধরলা, গাইবান্ধার ঘাঘট, বান্দরবানের সাঙ্গু, খাগড়াছড়ির চেঙ্গী, নওগাঁর আত্রাই, জামালপুরের ঝিনাই নদীর।
নদীর মৃত্যুর পেছনে কিছু স্বাভাবিক প্রাকৃতিক কারণ থাকে। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তা ব্যারেজের মতো মানুষের তৈরি বাধার কারণেও মরে যাচ্ছে নদী।
অন্যদিকে, দেশের সীমানার মধ্যেই নদীকে সহায়হীন মনে করে চলছে দখল উৎসব। এমনি একটি ঘটনা সম্পর্কে বলছিলেন নদী বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত।
তিনি জানালেন, কিছুদিন আগে তিনি ইছামতী নদীর ওপর এক ছোট এক সেতুর ওপর গিয়েছিলেন। “তাকিয়ে দেখি ভাটিতে নদীর মধ্যখানে একটি ছ’তলা বিল্ডিং উঠেছে,” তিনি বললেন, “অর্থাৎ নদীটিকে আমরা দখল করে ফেলেছি। ”
মি. নিশাত জানান, নদীর তলদেশের ভূমি খাস জমি। এই জমি উদ্ধার করা কঠিন নয়। দেশের প্রতিটি থানায় কোথায় কোন্ নদী অবৈধ দখলের শিকার হয়েছে সে সম্পর্কে সিএস রেকর্ড থেকে সে সম্পর্কে প্রকৃত উদ্ধার করা সম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মানুষ তার লোভ কিংবা মুনাফার টানে নদীর শুধু গতিপথই বদলে দিচ্ছে না, আঘাত করছে নদীগুলোর প্রাণবৈচিত্রেও।
বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বংশী, বালু, লৌহজঙ্গ কিংবা শীতলক্ষ্যার মতো নদীগুলোর দু’ধারে যে শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে, তার অপরিশোধিত বর্জ্য গিয়ে পড়ছে এসব নদীতে। ফলে বিষক্রিয়ায় মরে যাচ্ছে নদীর প্রাণ।
সে কথাই জানালেন নারায়ণগঞ্জের পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মোহাম্মদ মুজাহেদুল ইসলাম।
“শীতলক্ষ্যা অলরেডি মারা গিয়েছে। আপনারা শীতলক্ষ্যার পাড়ে গেলে দেখবেন পানি অসম্ভব দুর্গন্ধ বের হয়। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ এখন নূন্যতম মাত্রার চেয়েও কম।”
গত ৫০ বছরে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় রাস্তাঘাটের মতো অবকাঠামো নির্মাণের মতো বিষয়তে যতখানি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সে তুলনায় নদনদীর উন্নয়নের দিকে নজর দেয়া হয়েছে কম।
রাস্তাঘাট নির্মাণ করাটা রাজনৈতিক নেতাদের কাছে নদী খননের চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
কারণ রাস্তাঘাট, সেতু, কালভার্ট ইত্যাদি নির্মাণ করলে তা খালি চোখে দেখা যায়।
কিন্তু নদী খনন করলে তা খালি চোখে দেখা যায় না । জনগণের বাহবাও পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশে নদীপ্রবাহে যে সর্বব্যাপী পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে, তার চিত্রটা এখনই ফুটে উঠতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশবাদীরা।
তারা বলছেন, নদী-রক্ষার প্রশ্নে এই মুহূর্তে পদক্ষেপ নেয়া শুরু না হলে, এক সময় মানচিত্র থেকে মুছে যাবে বহু নদীর নাম।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের উত্তর প্রজন্মকে নদী সম্পর্কে জানতে হবে যাদুঘর থেকে।
Leave a Reply