বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের যে মহাসড়ক বেয়ে ধাবিত হচ্ছে তা যেন কোনভাবেই বাধাগ্রস্ত হতে না পারে সেদিকে সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, উন্নয়নের পথে সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করতে আমরা বদ্ধপরিকর। কিছু অসাধু মানুষ নানা কৌশলে জনগণের সম্পদ কুক্ষিগত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছি। দুর্নীতিবাজ যে দলেরই হোক আর যত শক্তিশালীই হোক, তাদের ছাড় দেয়া হচ্ছে না এবং হবে না। এ ব্যাপারে দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছে।
আইনের শাসন সমুন্নত রেখে মানুষের নাগরিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে যা যা করার প্রয়োজন আমরা তা করব উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা আজ অনেক দূর এগিয়েছি সত্য। আমাদের আরও বহুদূর যেতে হবে। হতে পারে সে গন্তব্য পথ মসৃণ, হতে পারে বন্ধুর। বাঙালী বীরের জাতি। পথ যত কঠিনই হোক, আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। আমরা যদি পরিশ্রম করি, সততা-দেশপ্রেম নিয়ে দায়িত্ব পালন করি, তাহলে আমরা সফলকাম হবই, ইনশাআল্লাহ।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় তার নেতৃত্বাধীন বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি ও তৃতীয় বর্ষে পদার্পণের দিনে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আসুন আমরা নতুন করে শপথ নেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আদর্শকে ধারণ করে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকামী বাংলাদেশ গড়ে তুলব। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১২ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
গণতন্ত্রের সূতিকাগার জাতীয় সংসদের ব্যাকগ্রাউন্ড ও লাখো শহীদের রক্তস্নাত জাতীয় পতাকা সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী ত্রিশ মিনিটের ভাষণে তার সরকারের গত এক যুগে দেশের উন্নয়ন, সফলতা ও অগ্রগতি দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার পাশাপাশি চলমান প্রাণঘাতী করোনার বিরুদ্ধে তার সরকারের নিরলস সংগ্রামের কথাও তুলে ধরেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারী টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেলগুলো একযোগে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করে।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, আমরা কঠোর হস্তে জঙ্গীবাদের উত্থানকে প্রতিহত করেছি। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষ পারস্পরিক সহনশীলতা বজায় রেখে বসবাস করে আসবেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। আর করোনাভাইরাসের এই অমানিশা দ্রুত কেটে যাক, মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এই প্রার্থনা করি। ততদিন আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবনযাপন করুন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
দ্রুত করোনার টিকা আনার সব চেষ্টা করছি ॥ প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এবং বৈশ্বিক মহামারীর অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। দুই বছর পূর্বে আজকের এই দিনে তৃতীয় মেয়াদে সরকার পরিচালনার যে গুরুদায়িত্ব আপনারা (দেশবাসী) আমার উপর অর্পণ করেছিলেন, সেটিকে পবিত্র আমানত হিসেবে গ্রহণ করে আমরা সরকার পরিচালনার তৃতীয় বছর শুরু করতে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, আমার পরম সৌভাগ্য যে, আপনাদের সকলের সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে পারছি এবং মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছি। এই শুভ মুহূর্তে আমি দেশ ও দেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশের সকল নাগরিককে অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং একই সঙ্গে খ্রিস্টীয় ২০২১-এর শুভেচ্ছা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে এক গভীর সঙ্কটের মধ্য দিয়ে আমাদের বিগত ২০২০ সাল অতিক্রম করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে ঘূর্ণিঝড় আমফান এবং উপর্যুপরি বন্যা আমাদের অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। আমরা সেসব ধকল দৃঢ়তার সঙ্গে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু করোনাভাইরাস জনিত সঙ্কট থেকে বিশ্ব এখনও মুক্ত হয়নি। তিনি বলেন, মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে বাংলাদেশে এখনও সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার অনেক কম। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি এই মহামারী নিয়ন্ত্রণে রাখার। আশার কথা বিভিন্ন দেশে কোভিড-১৯-এর টিকা প্রদান শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও আমরা দ্রুত টিকা নিয়ে আসার সব ধরনের চেষ্টা করছি। টিকা আসার পর পরই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ সম্মুখসারির যোদ্ধাদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে টিকা প্রদান করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী এবং মাঠ প্রশাসনের সদস্যসহ সম্মুখসারির করোনাযোদ্ধাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান এই মহামারী সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ দরিদ্র-অসহায় মানুষের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। আমি সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। যাদের মৃত্যু হয়েছে আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করছি।
করোনা অর্থনীতিতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে ॥ করোনার ছোবলে সারা বিশ্বের অর্থনীতির ওপর নেমে আসা স্থবিরতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস মহামারী ইতোমধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতিতে এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। অনেক দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতিও ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবে, বিভিন্ন নীতি-সহায়তা এবং বিভিন্ন উদার-নৈতিক আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ প্রদানের মাধ্যমে আমরা অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত আমরা ১ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি, যা মোট জিডিপির ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা সে প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রেখেছি। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রায় আড়াই কোটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আমরা নগদ অর্থসহ বিভিন্ন সহায়তার আওতায় এনেছি। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, গত অর্থবছরে আমাদের জিডিপি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের প্রাক্কলন অনুয়ায়ী এ বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৭ দশমিক ৪ শতাংশে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী জিডিপির প্রবৃদ্ধির হারে বাংলাদেশের অবস্থান হবে এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। আইএমএফ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ২০২০-এ মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬৪ মার্কিন ডলারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের শুরুতে আমি আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলাম যে দেশবাসীর সহায়তায় আমরা এই দুর্যোগ সফলভাবে মোকাবেলা করব, ইনশাআল্লাহ। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে দেশবাসী এ দুঃসময়ে আমার এবং আমার সরকারের পাশে ছিলেন। আপনারা আমাদের এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছেন। এ ধরনের যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভবিষ্যতেও আপনাদের পাশে পাব – এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।
২০৩০ সালে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ॥ গত এক যুগ ধরে তার সরকারের ধারাবাহিক উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং ’৭৫ পরবর্তী দেশবিরোধী নানা চক্রান্তের কথা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ২৪ বছরের রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ; একটি জাতিরাষ্ট্র। আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরে পদার্পন করতে যাচ্ছি। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল একটি শোষণ-বঞ্চনামুক্ত গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের। যেখানে সকল ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণী-পেশার মানুষ সুখে-শান্তিতে বসবাস করবে। প্রতিটি মানুষ অন্ন-বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার সুযোগ পাবে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সদ্যস্বাধীনতাপ্রাপ্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ যখন পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনের পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছিল, তখনই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। তাঁকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দেয়া হয়। তারপর অনেক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র। সামরিক শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষণ, গণতন্ত্রহীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-বিচ্যুতি, ইতিহাস বিকৃতিসহ শাসকদের নানা অপকীর্তি প্রত্যক্ষ করেছে এ দেশের মানুষ। জনগণের সম্পদ লুটপাট করে, তাদের বঞ্চিত রেখে, ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে বাংলাদেশকে পরনির্ভরশীল করে রেখেছিল।
১৯৮১ সালে তার দেশে ফিরে আসার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭৫ সালের বিয়োগান্তক ঘটনার পর ৬ বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে আমি ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে সমর্পণ করি। আমার একটাই লক্ষ্য ছিল জাতির পিতার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। তিনি বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। আমরা দায়িত্ব নিয়েই বাংলাদেশকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। মাঝখানে ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বিএনপি-জামাত এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সে প্রচেষ্টায় ছেদ পড়েছিল।
গত এক যুগে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়নের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১২ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি আত্মমর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর্থ-সামাজিক এবং অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। দ্য ইকোনমিস্ট-এর ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ৯ম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।
করোনার মধ্যেও দেশের অর্থনীতি সঠিক পথে ॥ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ শীর্ষক ইশতেহার ঘোষণা করেছিলাম। আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল দক্ষ, সেবামুখী ও জবাবদিহিতামূলক প্রশাসন গড়ে তুলে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ নির্মূল করে একটি ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতা মুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করা। ২০৩১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে উচ্চ মধ্যম-আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের সমৃদ্ধশালী-মর্যাদাশীল দেশ। আমরা ২০২১ সালের পূর্বেই উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছতে আমরা পথ-নক্সা তৈরি করেছি। রূপকল্প ২০৪১-এর কৌশলগত দলিল হিসেবে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-৪১ প্রণয়ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, গত সপ্তাহে ২০২১-২৫ মেয়াদী অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়েছে। যা বাস্তবায়নে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এ মেয়াদে ১ কোটি ১৬ লাখ ৭০ হাজার কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শেষে দারিদ্র্যের হার ১৫ দশমিক ৬ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ৭ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে আসবে। শেষ বছর ২০২৫ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াবে ৮.৫১ শতাংশে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর ১০টি উদ্যোগ বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকবে যা দারিদ্র্যবিমোচনে সহায়ক হবে।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে আরও বলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবিলা করে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য এর আগে আমরা ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ শীর্ষক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। করোনাভাইরাসের মহামারী সত্ত্বেও আমাদের অর্থনীতি সঠিক পথে অগ্রসর হচ্ছে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে আমাদের বহুল আরাধ্য নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণাঞ্চলকে রাজধানীসহ অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করা হয়েছে। এ পর্যন্ত পদ্মা সেতুর ৮২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী বছর এই স্বপ্নের সেতু যানবাহন এবং রেল চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া সম্ভব হবে।
দেশের জন্য কী করেছি মূল্যায়নের ভার দেশবাসীর ॥ গত একযুগে আমরা জনগণের জন্য কী করেছি, তা মূল্যায়নের ভার দেশবাসীর ওপর ছেড়ে দিয়ে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, অন্যান্য বৃহৎ প্রকল্পের কাজও পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার অংশে রেললাইন বসানো হয়েছে। শীঘ্রই জাপান থেকে ট্রেন ঢাকায় পৌঁছবে।
তিনি বলেন, এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ইতিহাসে এ যাবতকালের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের ১২শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন প্রথম ইউনিটের নির্মাণ কাজের ৮০ শতাংশ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। নির্ধারিত সময় ২০২৩ সালের এপ্রিল নাগাদ এই ইউনিট থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুত সরবরাহ সম্ভব হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র দেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করবে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলীর নদীর তলদেশে ট্যানেল নির্মাণের কাজও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এই ট্যানেলের ৬২ শতাংশ কাজ সমাপ্ত হয়েছে।
দেশবাসীকে উদ্দেশে করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জনগণের সরকার হিসেবে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য বলেই আমি মনে করি। গত একযুগে আমরা জনগণের জন্য কী করেছি, তা মূল্যায়নের ভার আপনাদের। আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে- সে রকম কয়েকটি খাতের কথা সংক্ষেপে তুলে ধরে তিনি দেশবাসীকে উদ্দেশে করে আরও বলেন, ২০০৯ সালে আমাদের সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে বিদ্যুত সরবরাহ পরিস্থিতির কথা একবার স্মরণ করুন। কী দুঃসহ পরিস্থিতি ছিল সে সময়। বিদ্যুত কখন আসবে আর কখন যাবে তার কোন নিশ্চয়তা ছিল না। আমরা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে আজ বিদ্যুত উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করেছি।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রতিটি ঘরে বিদ্যুত ॥ চলমান মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রায় ১৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক বিদ্যুত উৎপাদনের সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৪২১ মেগাওয়াটে। বিদ্যুত সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ২০০৫-০৬ সালের ৪৭ শতাংশ থেকে বর্তমানে ৯৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পায়রাতে ইতোমধ্যে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।
তিনি বলেন, রামপাল, পায়রা, বাঁশখালী, মহেষখালী এবং মাতারবাড়িতে আরও মোট ৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট শক্তিসম্পন্ন বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণ কাজ চলছে। মুজিববর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুত পৌঁছে দেয়া হবে। সব ঘর আলোকিত হবে। গ্যাস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে জাতীয় গ্রিডে ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হতো, বর্তমানে যা ২ হাজার ৫২৫ মিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে। গ্যাসের অব্যাহত চাহিদা মেটাতে ২০১৮ থেকে তরলীকৃত গ্যাস আমদানি করা হচ্ছে।
গ্রামেই আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণ ॥ প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, আজ খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার টন। বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে ৪র্থ থেকে ৩র্থ স্থান উন্নীত হয়েছে। অব্যাহত নীতি সহায়তা ও প্রণোদনার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে এই বিপ্লব সাধিত হয়েছে। শুধু ২০১৯-২০ বছরে কৃষি খাতে ৭ হাজার ১৮৮ কোটিরও বেশি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। মাছ-মাংস, ডিম, শাকসবজি উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে এবং ইলিশ উৎপাদনকারী ১১ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম।
তিনি বলেন, আমাদের গ্রামগুলো বরাবরই উন্নয়ন ভাবনার বাইরে ছিল। আমরাই প্রথম গ্রামোন্নয়নকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করি। ২০১৮ সালে আমাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষটি অন্তর্ভুক্ত করে ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে প্রতিটি গ্রামে আধুনিক নগর সুবিধা সম্প্রসারণের অঙ্গীকার করি। তিনি বলেন, আজ দেশের প্রায় সকল গ্রামে পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত পল্লী এলাকায় ৬৩ হাজার ৬৫৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন, ৩ লাখ ৭৬ হাজার ব্রিজ-কালভার্ট, ১ হাজার ৬৮৫টি ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স ভবন, ৯৩৬টি সাইক্লোন সেন্টার এবং ২৪৯টি উপজেলা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
তাঁর সরকারের আমলে সড়ক, নৌ ও আকাশপথের উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে ৪৫৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক ৪ বা তদুর্ধ লেনে উন্নীত করা হয়েছে। আরও ৬৬১ কিলোমিটার মহাসড়ক চার এবং তদুর্ধ লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। ঢাকায় বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ ২০২৩ সাল নাগাদ শেষ হবে। ২০০৯ থেকে ২০২০ পর্যন্ত ৪৫১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং ১ হাজার ১৮১ কিলোমিটার রেলপথ পুনর্বাসন করা হয়েছে। ৪২৮টি নতুন রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে। কিছুদিন আগে আমরা যমুনা নদীর ওপর ৪ দশমিক ৮ কিলোমটির দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছি। লোকোমোটিভ যাত্রীবাহী ক্যারেজ এবং মালবাহী ওয়াগন সংগ্রহ করা হয়েছে ১ হাজার ৪০টি। এ সময় বাংলাদেশ রেলওয়েতে ১৩৭টি নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সের বিমানবহরে ১২টি নতুন অত্যাধুনিক বোয়িং এবং ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ সংযোজিত হয়েছে। গত মাসে ১টি ড্যাশ-৮-৪০০ উড়োজাহাজ সংযোজিত হয়েছে। চলতি মাসে আরও ২টি ড্যাশ-৮-৪০০ উড়োজাহাজ সংযোজিত হবে। এছাড়া সরকারী-বেসরকারী মিলিয়ে স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যসেবার সম্প্রসারণ এবং গুণগত মানোন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ু ২০১৯-২০ বছরে ৭২ দশমিক ৬ বছরে উন্নীত হয়েছে। ৫ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৮ ও অনুর্ধ ১ বছর বয়সী শিশু মৃত্যুর হার ১৫-তে হ্রাস পেয়েছে। মাতৃমৃত্যু হার কমে দাঁড়িয়েছে প্রতি লাখে ১৬৫ জনে।
পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হলেই খুলবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ॥ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেয়া হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। শুধু আমাদের দেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই একই পরিস্থিতি। তবে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ নেই। অনলাইনে এবং স্কুল পর্যায়ের জন্য টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেয়া হবে। বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই বিতরণ শুরু হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি টাকা শিক্ষার্থীর মধ্যে ২ হাজার ৯৫৮ কোটি টাকার বৃত্তি-উপবৃত্তি বিতরণ করা হয়েছে। ২০২০ সালে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা টাস্ট্রের আওতায় স্নাতক ও সমমানের শ্রেণীর আরও ২ লাখ ১০ হাজার ৪৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ১১১ কোটি বিতরণ করা হয়। মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২১ শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ১ হাজার টাকা করে কিট এলাউন্স দেয়া হবে। এজন্য ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, দেশের ৭ হাজার ৬২৪টি এমপিও-ভুক্ত মাদ্রাসায় ১ লাখ ৪৮ হাজার ৬১ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে প্রতিমাসে ২৭৬ কোটি টাকা বেতন ভাতা দেয়া হচ্ছে। ২০২০ সালে নতুন করে ৪৯৯টি মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। ১ হাজার ৫১৯টি ইবতেদায়ি মাদ্রাসার ৪ হাজার ৫২৯ শিক্ষককে ত্রৈমাসিক ৩ কোটি ১৫ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হচ্ছে। দাওয়ারে হাদিস পর্যায়কে মাস্টার্স সমমান দেয়া হয়েছে। সারাদেশে ৫৬০টি মডেল মসজিদ এবং ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে।
সারাদেশে ডিজিটাল প্রযুক্তি সম্প্রসারণ ॥ প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, করোনাভাইরাসের এই মহামারীর সময়ে যখন মানুষের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে, তখন ডিজিটাল প্রযুক্তি যোগাযোগের এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে পরিগণিত হয়। আমাদের সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সুদূরপ্রসারী উদ্যোগ গ্রহণের ফলেই এই ক্রান্তিকালে ডিজিটাল প্রযুক্তি ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশের ১৮ হাজার ৪৩৪টি সরকারী প্রতিষ্ঠান ও ৩ হাজার ৮০০ ইউনিয়নে ফাইবার অপটিক ক্যাবল স্থাপনের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সময় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১১ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। অনলাইনে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং লেনদেন সুবিধা গ্রহণ করে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে সমর্থ হয়েছেন। আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১-এর মাধ্যমে দেশের সব টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান সম্প্রচার ছাড়াও প্রত্যন্ত ৩১টি দ্বীপে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা হচ্ছে। কয়েকটি ব্যাংক এবং সেনাবাহিনী স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১-এর সেবা গ্রহণ করছে।
বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ আজ একটি সমীহের নাম ॥ জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ আজ একটি সমীহের নাম। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব আজ চোখে পড়ার মতো। ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- জাতির পিতা প্রণীত বৈদেশিক নীতির এই মূলমন্ত্রকে পাথেয় করে আমরা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছি। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে এই মুহূর্তে শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।
তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত ১১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে শান্তিপূর্ণভাবে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর সব ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। কক্সবাজারে বিভিন্ন ক্যাম্পে তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য ভাসানচরে ১ লাখ মানুষের বসবাস উপযোগী উন্নতমানের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে শুধু স্ব-ইচ্ছায় যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পাঠানো হচ্ছে। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আরও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি।
সাড়ম্বরে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন ॥ প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা আড়ম্বরপূর্ণভাবে উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু করোনাভাইরাসের মহামারী ছড়িয়ে পড়ার কারণে অনুষ্ঠানমালায় পরিবর্তন আনতে হয়েছে। গত বছরের ১৭ মার্চ উদ্বোধন অনুষ্ঠান জনসমাগম ছাড়াই ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়। আমরা ‘বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন শীর্ষক’ টিভি স্পট প্রচার করছি। অনলাইন কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া স্মারক মুদ্রা ও ডাকটিকেট অবমুক্ত করা হয়েছে। স্বল্প দৈর্ঘ্য, এনিমেটেড চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে। সারাদেশে ১ কোটি ১৫ লাখ গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য প্রত্যেকে ২ শতাংশ খাসজমি বরাদ্দসহ ৬৫ হাজার ৭২৬টি ঘর তৈরির কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। দেশের একটি মানুষও গৃহহীন বা ভূমিহীন থাকবে না- সরকার এই নীতি নিয়ে দেশ পরিচালনা করছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যও ১৪ হাজার গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, আগামী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ইউনেস্কো সৃজনশীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে একটি পুরস্কার চালু করেছে। আর আগামী ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। করোনাভাইরাসের প্রকোপ না থাকলে আমরা সাড়ম্বরে এই অনুষ্ঠান উদযাপন করবো, ইনশাআল্লাহ। একইসঙ্গে চলতে থাকবে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, বাংলাদেশের মানুষের সৌভাগ্য এবং আওয়ামী লীগের জন্য গর্বের বিষয় যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। ১৯৯৭ সালে রজতজয়ন্তী উদ্যাপনকালেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্য কোন দল বা গোষ্ঠী স্বাধীনতার এই মাহেন্দ্রক্ষণকে স্মরণীয় করে রাখার তাগিদ অনুভব করবে না।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় জাতির পিতা শেখ মুজিব ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের চাইতেও দেশ গড়া বেশ কঠিন। দেশ গড়ার সংগ্রামে আরও বেশি আত্মত্যাগ, আরও বেশি ধৈর্য, আরও বেশি পরিশ্রম দরকার। …আমরা যদি একটু কষ্ট করি, একটু বেশি পরিশ্রম করি, সকলেই সৎপথে থেকে সাধ্যমতো নিজের দায়িত্ব পালন করি, সবচাইতে বড় কথা, সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকি তাহলে আমি বিনা দ্বিধায় বলতে পারি ইনশাল্লাহ কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা আবার সোনার বাংলায় পরিণত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আজ অনেক দূর এগিয়েছি সত্য। আমাদের আরও বহুদূর যেতে হবে। হতে পারে সে গন্তব্য পথ মসৃণ, হতে পারে বন্ধুর। বাঙালী বীরের জাতি। পথ যত কঠিনই হোক, আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে হবে। আমরা যদি পরিশ্রম করি, সততা-দেশপ্রেম নিয়ে দায়িত্ব পালন করি, তাহলে আমরা সফলকাম হবোই, ইনশাল্লাহ। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ভাষায় তাই বলতে চাই- ‘দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার/ লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীতে যাত্রীরা হুঁশিয়ার! তাই আসুন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে আসুন আমরা নতুন করে শপথ নেইÑ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আদর্শকে ধারণ করে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্য-নিরক্ষরতামুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকামী বাংলাদেশ গড়ে তুলব। করোনাভাইরাসের এই অমানিশা দ্রুত কেটে যাক, মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে এই প্রার্থনা করি। ততদিন আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবনযাপন করুন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন।
Leave a Reply