বিনোদন ডেস্ক ॥ তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে ‘ফিরকি’ নামে যে ধারাবাহিকটি চলছে প্রায় এক বছর ধরে, সেটি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জনপ্রিয় ভারতীয় চ্যানেল জি বাংলা। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে এর আগে কোনও বাংলা ধারাবাহিক হয়নি কলকাতায়।
ওই ধারাবাহিকে কাজ করছেন এমন কলাকুশলীরা বলছেন যে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের নিয়ে কাহিনী থেকে দর্শক মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন- এই কারণ দেখিয়েই সিরিয়ালটি বন্ধ করে দিচ্ছে জি বাংলা। যদিও চ্যানেল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন যে ধারাবাহিকের কাহিনীটি শেষ হয়ে গেছে বলেই বন্ধ করা হচ্ছে।
জি গোষ্ঠীর চ্যানেলগুলির ক্লাস্টার বিজনেস হেড সম্রাট ঘোষ বিবিসিকে জানিয়েছেন, “এ ধরণের একটি ধারাবাহিক আনতে পেরে আমরা গর্বিত ঠিকই, কিন্তু কাহিনীর যাত্রাপথ শেষ হয়ে গেছে। সেজন্যই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।”
তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের দেখলেই নাকি ছোট শহর বা মফস্বলের মানুষ অন্য চ্যানেলে চলে যাচ্ছেন, ফলে টিআরপি কমছে। আর সেজন্যই এই ধারাবাহিক বন্ধ করা হচ্ছে বলে বিবিসিকে জানাচ্ছিলেন এটিতে অভিনয় করা তৃতীয় লিঙ্গের এক অভিনেত্রী সুজি ভৌমিক।
তার কথায়, “আমি সরাসরি প্রোডিউসারের কাছ থেকে জেনেছি যে সিরিয়ালে যখনই আমাদের গল্প আসছে, যখন আমাদের তৃতীয় লিঙ্গের চরিত্রগুলো দেখানো হচ্ছে, তখনই নাকি দর্শক অন্য চ্যানেলে চলে যাচ্ছে। এটা চ্যানেল কর্তৃপক্ষ বলছেন।তারা তো ব্যবসা করতে এসেছে, টিআরপি কমলে তারা সিরিয়ালটা আর চালাবে কেন! আমাদের দুর্ভাগ্য যে সিরিয়ালটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।”
প্রযোজনা সংস্থা অ্যাক্রপলিস এন্টারটেইনমেন্টের সানি ঘোষ রায় অবশ্য বলছেন, “সিরিয়ালটার যা টিআরপি আসছিল, হয়তো চ্যানেল আরও বেশী আশা করছিল। প্রত্যেক চ্যানেলের তো নিজস্ব কিছু মানদণ্ড আছে কোনটা জনপ্রিয় হচ্ছে, সেটা মাপার। সেই মাপকাঠিতে হয়তো পৌঁছনো যাচ্ছিল না।
তবে তৃতীয় লিঙ্গের কিছু চরিত্র আছে, তাই মানুষ চ্যানেল ঘুরিয়ে দিচ্ছে বলেই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে যা বলা হচ্ছে, তা সঠিক নয়।”ধারাবাহিকটির পরিচালক সৌমেন হালদার বলেন, তার কাছেও সঠিক তথ্য নেই যে কেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ‘ফিরকি’।
“প্রযোজনা সংস্থা এবং চ্যানেল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই হবে, তারাই হয়তো অনেক ভাল বোঝেন ব্যাপারাটা। হয়তো আমরাই ভাল করতে পারছিলাম না। সেজন্যই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।” হালদার আরও বলেন, “আমি কিন্তু অনেক দর্শকের কাছ থেকে নিয়মিত বার্তা পাচ্ছি, তারা জানতে চাইছেন কেন ধারাবাহিকটি বন্ধ হচ্ছে – ‘আমরা তো দেখছিলাম সিরিয়ালটা’।
ভারতে আইন করে তৃতীয় লিঙ্গ এবং রূপান্তরকামীদের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, আইনি অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকটি চরিত্র থাকলে সেই ধারাবাহিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন, তার অর্থ কী এটাই যে আইনি স্বীকৃতি পেলেও তৃতীয় লিঙ্গ এখনও সামাজিক স্বীকৃতি পায়নি?
রূপান্তরিত সমাজকর্মী রঞ্জিতা সিনহা বলছিলেন যে তার ব্যাখ্যাটা এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন। “আমি গ্রামে গঞ্জে বা মফস্বল শহরে গিয়ে দেখেছি এই সিরিয়ালটাকে মানুষ খুবই পছন্দ করেন। একটা অনুষ্ঠানে সুজি আমার সঙ্গে ছিল, দেখলাম কয়েকটা বাচ্চা ওকে এগিয়ে এসে হাগ করল। এদের সবার কত যে ফ্যান রয়েছে আপনি ভাবতেও পারবেন না।
মানুষ কিন্তু রূপান্তরকামীদের সম্বন্ধে এই সিরিয়ালটা দেখেই জানতে, বুঝতে পারছিলেন। তাই মানুষ পছন্দ করছেন না, এটা বোধহয় ঠিক কথা বলা হচ্ছে না,” বলছিলেন রঞ্জিতা সিনহা। তার কথায়, “কেন সিরিয়ালটা বন্ধ করে দিল জানি না। হতেই পারে এটা জেন্ডার পলিটিক্স হচ্ছে। কোনও কোনও মহল হয়তো চাইছে না এভাবে রূপান্তরকামীরা এগিয়ে আসুন।”
অভিনেত্রী সুজি ভৌমিকও বলছিলেন এই সিরিয়ালটি নিয়ে মানুষের আগ্রহের কথা। “আমি নানা দেশ থেকে ফ্যান মেসেজ পাই। আমার বাড়ি মুর্শিদাবাদে। সেখানে লোকে আমার বন্ধুদের ডেকে নিয়ে গিয়ে খাওয়ায় তারা আমার বন্ধু বলে। সেলফি তোলে। এমনকি কেউ যদি জানে আমার মা আমার চরিত্র রাণিমাসির মা, তাহলে মায়ের সঙ্গে সেলফি তোলে। তো কীভাবে এটা হতে পারে যে গ্রাম-মফস্বলের মানুষ সিরিয়ালটা দেখছে না!”
ফিরকি ধারাবাহিকে পাঁচজন তৃতীয় লিঙ্গের কলাকুশলী অভিনয় করছিলেন এবং এটাই তাদের আয়ের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছিল। সিরিয়ালটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাউকে এখন নাচের আসরে গিয়ে দাঁড়াতে হবে, কেউ হয়তো বাধ্য হবেন অন্ধকারের কোনও পেশা বেছে নিতে, বলছিলেন ভৌমিক।
সিরিয়াল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে- তাই তাদের সবার মন খারাপ। সাথে রোজগার নিয়ে দুশ্চিন্তাও। কিন্তু এর মধ্যেও সুজি ভৌমিক ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন প্রযোজনা সংস্থাটিকে, যারা রূপান্তরকামী- রূপান্তরিত এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের একটি সিরিয়ালের চরিত্র হিসাবে তুলে ধরেছিলেন। সূত্র : বিবিসি বাংলা।
Leave a Reply