রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে মানসিক চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমকে টেনে-হিঁচড়ে ও ধস্তাধস্তি করে একটি কক্ষে নিয়ে যান হাসপাতালের ছয় কর্মী। দ্বিতীয়তলার ওই কক্ষে নেওয়ার পর তাকে মেঝেতে উপুড় করে হাঁটু দিয়ে চেপে ধরা হয়। ধস্তাধস্তির সময় তাকে মারধরও করা হয়। একজন কনুই দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাতও করেন। ধস্তাধস্তির ঠিক ৪ মিনিটের মাথায় একেবারে নিস্তেজ হয়ে যান ওই পুলিশ কর্মকর্তা।
সোমবার (৯ অক্টোবর) সাড়ে ১১টার দিকে সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিমকে হাসপাতালে নেওয়া হয়, আর ১২টার মধ্যে ওই হাসপাতালে তিনি মারা যান। এদিকে মরদেহ উদ্ধার করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মর্গে পাঠানো হলে বিকেলে মৃত আনিসুলের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।
হাসপাতালের দ্বিতীয়তলার কক্ষে থাকা ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় এএসপি আনিসুল করিমকে টেনেহিঁচড়ে নেওয়া ও ধস্তাধস্তি এবং মারধরের চিত্র স্পস্ট দেখা গেছে। ফুটেজটি আলামত হিসেবে পুলিশ উদ্ধার করেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি, হাসপাতালের স্টাফদের ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে এএসপি আনিসুল করিমের মৃত্যু হয়েছে। তবে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে না পেয়ে নির্দিষ্ট করে কিছুই বলা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া হাসপাতালের স্টাফসহ ৬/৭ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। ঘটনার বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালের দ্বিতীয়তলার ওই কক্ষে প্রবেশের আগে থেকে এএসপিকে টেনেহিঁচড়ে আনার চিত্র স্পষ্ট দেখা য়ায়। ওই কক্ষের সিসিটিভি ক্যামেরার ১৩ মিনিটের ফুটেজে দেখা যায়, ধস্তাধস্তির সময় একটি কাপড় নিয়ে লাল রঙের গেঞ্জি পরা হাসপাতালের এক কর্মী এগিয়ে যাচ্ছিলো। এএসপি আনিসুল করিমকে টেনেহিঁচড়ে প্রথমে চারজন কক্ষের ভেতরে নেন। তাকে মেঝেতে উপুড় করে ফেলে চেপে ধরে রাখা হয়। এরপর নীল রঙের পোশাক পরা দুই স্টাফ সেখানে আসেন। তারা দ্রুত আনিসুলের দুই পা শক্তি প্রয়োগ করে চেপে ধরে রাখেন। এসময় আরও দুইজন কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করেন। তখনও এএসপির দুই হাত বাঁধার চেষ্টায় ধস্তাধস্তি চলছিলো।
মেঝেতে চেপে ধরে রাখা আনিসুলের মাথার ডান পাশে থাকা একজন স্টাফ প্রথমে তার ঘাড়ে আঘাত করেন। এরপর বাম পাশ থেকে অপর একজন স্টাফ হাতের কনুই দিয়ে তার ঘাড়ের দুই পাশে পরপর দুইবার জোরে আঘাত করেন। স্টাফরা তার দুই হাত ও বাহু লম্বা কাপড় দিয়ে পেছন থেকে বাঁধছিলেন। ছয় স্টাফের মধ্যে সাদা গেঞ্জি পরা একজন আনিসুলের ওপরে চেপে বসেছিল। পুরো ঘটনাটি দাঁড়িয়ে দেখছিলেন হাসপাতালের ম্যানেজার (অ্যাডমিশন/ভর্তি) আরিফ মাহমুদ। তখন কক্ষের ভেতরে হাসপাতালের স্টাফসহ নয় জন উপস্থিত ছিলেন। এসময় তার নড়াচড়া কমতে থাকে। চার মিনিট পর দুই হাত পেছন থেকে বাঁধা অবস্থায় পাঁচজন স্টাফ মিলে আনিসুলকে ঘুরিয়ে সোজা করে মেঝেতে রাখেন। তাকে টেনে লম্বা করে শোয়ান তারা। কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার (এ্যাডমিশন/ভর্তি) আরিফ মাহমুদ জয় কক্ষ থেকে বের হয়ে যান।
সিসিটিভি ফুটেজে আরও দেখা যায়, নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা এএসপি আনিসুল করিমের চোখে ও মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছিলেন লাল গেঞ্জি পরা এক কর্মী। কিন্তু সাড়া মিলছিল না তার। তখন স্টাফদের সবাই কক্ষের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাদের মধ্যে মেরুন (খয়েরি) রঙের শার্ট পরা একজন স্টাফ নিজের হাতের কনুই নেড়ে মারধরের বিষয়টি দেখাচ্ছিলেন। অবশ্য তখন তার মুখে হাসি ছিল। অপর এক স্টাফ একটি বালতিতে করে পানি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করেন। তার হাত থেকে সবুজ শার্ট পরা অপর স্টাফ কক্ষের মেঝেতে পানি ঢেলে দেন এবং সব পরিষ্কার করেন।
এসময় সাদা অ্যাপ্রোন পরা এক নারী চিকিৎসক কক্ষে আসেন। দাঁড়িয়ে থেকে উঁকি দিয়ে দেখছিলেন। তখন আরও একজন নারী চিকিৎসক ওই কক্ষে প্রবেশ করেন। দুইজন মিলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা এএসপি আনিসুলের রক্তচাপ ও পালস চেক করেন। বারবার তার বুকে পাম্প করা হয়। তখন আরিফ মাহমুদ জয় ওই কক্ষে প্রবেশ করেন। এরপর ঘটনার ১১ মিনিটের মাথায় তিনি একজন স্টাফকে দরজা বন্ধ করার নির্দেশ দেন। তখন বন্ধ কক্ষে ছিলেন, দুই নারী চিকিৎসক, তিন স্টাফ ও হাসপাতালর ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়। রোগী (এএসপি আনিসুল করিম) জীবিত নেই বোঝার পর আরিফ মাহমুদ জয়ের মধ্যে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। তিনি পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে কাউকে কল দেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হাসপাতালের স্টাফরা জানান, হাসপাতালে এএসপি উত্তেজিত হয়ে আরিফ মাহমুদ জয়কে মারেন। আরিফ মাহমুদের নির্দেশে আনিসুলকে জোরপূর্বক ধরে এবং ধস্তাধস্তির মাধ্যমে ওই কক্ষে নিয়ে যান তারা।
আদাবর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মো. ফারুক মোল্লা বাংলানিউজকে বলেন, হাসপাতালে যে কক্ষে এই ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে ঘটনায় জড়িত হাসপাতালের ৬/৭ জন কর্মীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
নিহত আনিসুল করিম ৩১তম বিসিএসে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। সর্বশেষ তিনি বরিশাল মহানগর পুলিশে ট্রাফিক বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। তিনি এক সন্তানের জনক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন তিনি।
Leave a Reply