1. faysal.ce@gmail.com : dakshinermashal :
  2. abuhasan670934@gmail.com : Hasan :
  3. sakalctc.bd@gmail.com : Nityananda Sarkar : Nityananda Sarkar
বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৪৩ পূর্বাহ্ন
২৭ চৈত্র, ১৪৩১
Latest Posts
📰গাজায় গণহত্যার প্রতিবাদে সাতক্ষীরায় বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ📰ভূমিদস্যু কর্তৃক শ্যামনগরের ১০টি অসহায় পরিবারের ভিটাবাড়ি জবরদখল চেষ্টার প্রতিবোদে সংবাদ সম্মেলন📰আশাশুনিতে বানভাসী মানুষের মাঝে জেলা পুলিশের পক্ষে উপহার সামগ্রী বিতরণ📰আশাশুনিতে বাংলা নববর্ষ  উদযাপনে প্রস্তুতিমূলক সভা 📰সাতক্ষীরায় পলিথিনের ব্যবহার বর্জন বিষয়ে জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন📰২৫০ ধরনের ওষুধ ৩ ভাগের ১ ভাগ দামে পাবে জনগণ📰সাতক্ষীরায় সরকারি খাসজমি উদ্ধারে অভিযান শুরু📰নাসার সঙ্গে মহাকাশ গবেষণায় অংশীদার হলো বাংলাদেশ📰তালা উপজেলা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি নির্বাচনে প্রার্থীদের মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ📰তালায় গাজায় ইসরায়েলের হামলার প্রতিবাদে জামায়াতের বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ

অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও সংশপ্তক জাসদ: পর্ব ৫

প্রতিবেদকের নাম :
  • হালনাগাদের সময় : রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২০
  • ৪৬০ সংবাদটি পড়া হয়েছে


জিয়াউল হক মুক্তা


[জিয়াউল হক মুক্তা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এ রচনায় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকা-ের পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্যের সাথে যোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিচার-আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও কিছু সাক্ষ্যভাষ্য এবং বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রী প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিজনদের কিছু বক্তব্য; এবং বর্তমান লেখকের গবেষণালব্ধ কিছু পর্যবেক্ষণ। সবশেষে প্রধানমন্ত্রীর সদয় বিবেচনা ও সকলের আলোচনার জন্য যোগ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা সত্যানুসন্ধান কমিশন’ বিষয়ক কিছু বিষয়গত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা। পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় লেখাটি ১৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আজ প্রকাশিত হচ্ছে পঞ্চম পর্ব।]

আমেরিকার পক্ষে এসব কোনোভাবেই মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ের দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি লরেন্স লিফস্যুলৎসের মতে এটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে আমেরিকানরা শেখ মুজিব হত্যায় যুক্ত ছিল ও এতে সবুজ সংকেত দিয়েছিল; জিয়াউর রহমানের সমর্থন ছাড়া এ হত্যাকা- ঘটানো সম্ভব ছিল না এবং আমেরিকার সমর্থন ছাড়া জিয়ার পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব ছিল না; জিয়া ও রশীদ-ফারুক ও অপরাপর খুনীদের সাথে আমেরিকানদের ‘পূর্ব-যোগাযোগ’ ছিল, এবং এ পূর্বযোগাযোগ হচ্ছে, লরেন্স লিফস্যুলৎসের ভাষায়, শেখ মুজিব হত্যা বিষয়ে এসেনসিয়াল বা অপরিহার্য ও ক্রুশিয়াল বা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। তৎকালীন [আগস্ট ১৯৭৫] সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ ২০০২ সালের ১৫ আগস্টে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন যে ১৫ আগস্ট সাতসকালে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজেন বোস্টারকে বাংলাদেশ বেতারের পাশে শেরাটন হোটেলে দেখা গেছে; এবং ক্ষমতা দখলের পরে মোশতাক প্রথম সভাটি করেন বোস্টারের সাথে। লিফস্যুলৎসের সাথে এখানে বলে রাখা দরকার যে শুধু জিয়াই নয়, খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলসহ প্রায় সকল বড় সেনা কর্মকর্তারাই যে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত, তার তথ্য-প্রমাণ-ব্যাখ্যা এখন প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছে। এ রচনায় পরে তার কিছু কিছু তথ্য উল্লেখ করা হবে।

এভাবেই— সোভিয়েত ব্লকের ন্যাপ-সিপিবির জাতীয়তাবাদ বিরোধী ও জোট নিরপেক্ষতা বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থান আর বাকশালে তাদের অন্তর্ভুক্তি— বঙ্গবন্ধু হত্যার বিবিধ জাতীয় পরিস্থিতির সাথে যোগ করলো আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিগত প্রেক্ষাপট; এ বিষয় অবহেলা করে বৈশ্বিক সুপার পাওয়ারদের হিসেব-নিকেশকে বাইরে রেখে বঙ্গবন্ধু হত্যাকে পুরোটা কোনভাবেই অনুধাবন করা যাবেনা। সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট নির্মাণে ন্যাপ-সিপিবির ও তাদের পরিচালক সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব এড়িয়ে যাবার উপায় নেই এক বিন্দুও।

অধ্যায় নয়. বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট ও নেপথ্য-কুশীলব
বঙ্গবন্ধু হত্যার পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট-পরিসরের সার-সংক্ষেপ বিবেচনা করা যাক। উল্লেখ্য পারিবারিক প্রেক্ষাপট বলতে এ রচনায় বোঝানো হয়েছে যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের আসাযাওয়া ও সামাজিক সম্পর্ক ছিল তাঁর পরিবারের সাথে; এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও অন্যদের বক্তব্য এ রচনার অধ্যায় এগারোতে উপস্থাপন করা হয়েছে।

[১] স্বাধীন দেশের বৈপ্লবিক রূপান্তর ব্যাহত করতে বঙ্গবন্ধুর নিজের মনোনীত বিএলএফ/মুজিববাহিনীর ৪ নেতার ৪ সুপারিশ [ইতোমধ্যে মুজিব বাহিনীর চার যুব নেতা আর ঐকমত্যে নেই; তারা বিভক্ত হয়েছেন ও পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন] আর মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র-যুব-তরুণদের ১৫ দফা ও ১২ দফা সুপারিশ গ্রহণ করা থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করা হলো ।

[২] সরকারি প্রতিবেদনের প্রগতিশীল পরামর্শ উপেক্ষা করে জনপ্রশাসনে পাকহানাদার-দোসরদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হলো।

[৩] গোয়েন্দা সংস্থায় পাকহানাদার-দোসরদের পুনর্বাসিত করা হলো।

[৪] সামরিক বাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে পাকহানাদার-দোসরদের পুনর্বাসিত করা হলো।

[৫] রাজনৈতিক ভিন্নমতের কারণে হাজার হাজার বীর-মুক্তিযোদ্ধার জায়গা হলো জেলে আর হাজার হাজার পাকহানাদার-দালাল কারামুক্ত হয়ে বিচরণ করতে লাগলো অবাধে।

[৬] দুর্নীতি-লুটপাট-সন্ত্রাস-কালোবাজারি-মজুদদারি-পাচারকারিদের মহোৎসব অব্যাহত রইলো; দুর্নীতির ব্যাপকতা বোঝাতে বঙ্গবন্ধু নিজেই চাটার দল আর চোরের দল আর নরপশুর দলের কথা বলেছিলেন; বলেছিলেন, বলেছিলেন আমার কম্বল কই?

[৭] ১৯৭৪ সালে— বৈশ্বিক পরিসরে মূল্যস্ফীতি, দেশজ পরিসরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নি¤œবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস, আর চাটার দল ও চোরের দল ও নরপশুর দলের দুর্নীতির ফলে পর্যাপ্ত খাদ্য থাকার পরও দেশে দুর্ভিক্ষ হলো; মানুষ মারা গেল সরকারি হিসেবে ২৬,০০০ থেকে ৩৭,০০০ জন।

[৮] এ রচনায় আলোচিত হয়নি, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ নিবর্তনমূলক বিভিন্ন কালাকানুন প্রবর্তিত হলো।

[৯] ডাকসু ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া হলো; প্রার্থী অপহরণ ও ভোট ডাকাতি হলো, যদিও এর প্রয়োজন ছিল না। জাসদ কার্যালয় জ্বালিয়ে দেয়া হলো আর দৈনিক গণকণ্ঠ কার্যালয় তছনছ করা হলো।

[১০] শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ন্যাপ-সিপিবি আওয়ামী লীগ ও বাকশাল সরকারকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিলো; প্রকাশ্য অপর সকল দল সরকার বিরোধী জোট গঠন করলেও কোন ভূমিকা রাখতে পারলো না; চীনপন্থি দলগুলো গোপনে বিরোধিতা করলো শ্রেণিশত্রু খতমের রাজনীতির মাধ্যমে। আর রাজনৈতিক পরিমলে জাসদ ছিল একা।

[১১] একদলীয় ব্যবস্থা ‘বাকশাল’ কায়েম করা হলো; অন্য সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হলো; চারটি বাদে অন্যসব পত্রিকা নিষিদ্ধ হলো। গণকণ্ঠ নিষিদ্ধ হলো; নিষিদ্ধ জাসদ অপ্রকাশ্যে ও গোপনে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করলো।

[১২] বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হলো; মার্কিনীদের পুরোনো দিনের বঙ্গবন্ধু বিরোধী অবস্থান অব্যাহত রইলো ও শক্তিশালী হলো—মোশতাকের পেয়াদা রশিদ-ফারুকচক্রের কাছে বঙ্গবন্ধু-হত্যায় ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের গ্রিন সিগনাল গেল এভাবে যে— মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাবে না ও তৎকালীন সরকারকে তারা স্বীকৃতি দেন। এর মধ্যে জিয়াও সিআইএ-র সাথে অনুষ্ঠিত দুটো সভায় বঙ্গবন্ধু হত্যায় তাদের সম্মতি পেয়ে যান; বঙ্গবন্ধু হত্যার ছয় মাস আগেই এ হত্যা পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয় [বিস্তারিত দশম অধ্যায়ে]।

হয়তো এই সব নয়; বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপটে হয়তো যোগ করার আছে আরও অনেক কিছু। এবারে দেখা যাক বর্ণিত প্রেক্ষাপটে কোন কুশীলব-চক্র সাড়ে তিন বছর ধরে বঙ্গবন্ধুকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিলেন ও তাঁকে হত্যার উল্লিখিত প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন—

[১] আওয়ামী রাজনীতিতে শেখ মনির অনুসারীগণ; যদিও ১৫ আগস্ট শেখ মনিরও মৃত্যু হয়েছে— তার মত-পথ-জন ও ক্ষমতালিপ্সায় গৃহীত কার্যক্রম তাকেই দুর্বল করেছে ও সামগ্রিক পরিস্থিতি ঘোলা করেছে।

[২] খন্দকার মোশতাকের অনুসারীগণ।

[৩] জনপ্রশাসনে পাকিস্তানপন্থার অনুসারীগণ।

[৪] গোয়েন্দা বিভাগে পাকিস্তানপন্থার অনুসারীগণ।

[৫] আধা-সামরিক ও সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরে পাকিস্তানপন্থার অনুসারীগণ।

[৬] মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু ঔপনিবেশিক সেনাকাঠামোর ক্ষমতালিপ্সু সামরিক কর্মকর্তাগণ।

[৭] বাকশালে বিলীন সোভিয়েত ব্লকের ন্যাপ-সিপিবির অনুসারীগণ।

[৮] ঢাকায় সোভিয়েত ইউনিয়ন দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ— বিশেষত কেজিবির কর্মকর্তাগণ।

[৯] ঢাকায় বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী আমেরিকান দূতাবাসের কর্মকর্তাগণ ও সিআইএ’র কর্মকর্তাগণ, যারা যথাক্রমে মোশতাকের অনুসারীদের ও জিয়াকে বঙ্গবন্ধু-হত্যায় সবুজ সংকেত দিয়েছেন [বিস্তারিত দশম অধ্যায়ে]।

অধ্যায় দশ. আদালতের পর্যবেক্ষণ ও সাক্ষ্য-ভাষ্য
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওই বছরের ১২ নভেম্বর সংসদে কুখ্যাত পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা হয় ও বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার শুরু হয়। বিএনপি ও ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে মাঝে সাত বছরের বেশি ওই বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকে। পরে আওয়ামী লীগ ও জাসদের নেতৃত্বে নেতৃত্বে ১৪ দল ও মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে আবারও বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। রায় হয়। রায়ে ঘোষিত দণ্ড কার্যকর করা শুরু হয়।

বিশিষ্ট সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খান বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার পর্যবেক্ষণ করেছেন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় তার বই ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: সামরিক ও গোয়েন্দা ব্যর্থতার প্রামাণ্য দলিল’। তিনি মুজিব-হত্যার বিচারের রায়ের একদম শেষ দিকে বিচারক কাজী গোলাম রসুলের ভাষ্য উপস্থাপন করেছেন, “প্রাসঙ্গিকভাবে ইহা উল্লেখ করিয়া পারা যায় না যে, এই মামলায় প্রাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ইহা প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ বিশেষ করিয়া যাহারা ঢাকায় অবস্থান করিতেছিলেন, তাহারা তাহাদের দায়িত্ব পালন করেন নাই, এমনকি পালনের কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করেন নাই, যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও। ইহা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, বঙ্গবন্ধুর টেলিফোন আদেশ পাওয়ার পরও তাহার নিরাপত্তার জন্য কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় নাই। সাক্ষ্য প্রমাণে ইহা পরিষ্কার যে, মাত্র দুইটি রেজিমেন্টের খুবই অল্প সংখ্যক জুনিয়র সেনা অফিসার/সৈন্য এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেন এই কতিপয় সেনা সদস্যকে নিয়ন্ত্রণ/নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে নাই তাহা বোধগম্য নয়। ইহা আমাদের জাতীয় ইতিহাসে সেনাবাহিনীর জন্য একটি চিরস্থায়ী কলঙ্ক হিসাবে চিহ্নিত হইয়া থাকিবে।”

বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার আদালত অনুসরণকারী আরেক সাংবাদিক সাহাদত হোসেন খান তার ‘স্বাধীনতা উত্তর ট্র্যাজেডি: মুজিব থেকে জিয়া’ বইয়ে আদালতে দেয়া বিভিন্ন সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট উর্ধতন সেনা কর্মকর্তাদের কার্যক্রমের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন; নিচে এর নির্বাচিত অংশ নগণ্য পরিমার্জনসহ প্রায় হুবহু তুলে ধরা হলো।

[১] মেজর ফারুক ও মেজর রশিদ সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার ও নৌবাহিনী প্রধান কমোডর মোশাররফ হোসেন খান ছাড়া উর্ধতন প্রায় সকল সামরিক কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন; তাদের সমর্থন এবং পরোক্ষ অথবা প্রত্যক্ষ সহায়তাও পেয়েছিলেন। খুনিরা ক্যু’র দিন বঙ্গবন্ধু, শেখ মনি ও আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসার টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করেননি; কারণ তারা জানতেন যে টেলিফোন করলেও কেউ এগিয়ে আসবেন না। শেখ মনিকে হত্যার প্রায় ঘণ্টা খানেক পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়; এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল কেএম সফিউল্লাহ ও আরও অনেক জায়গায় ফোন করেন; কিন্তু যথেষ্ট সময় থাকার পরও কেউ তাঁকে রক্ষায় ছুটে আসেননি।

[২] ক্যু’র পরপরই এক রহস্যময় নীরবতার চাদরে ঢাকা সেনানিবাস আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ঢাকার শক্তিশালী ৪৬-ব্রিগেড ও ডিজিএফআইয়ের নিষ্ক্রিয়তা তার প্রমাণ। মেজর ফারুকের পরিকল্পনায় ৪৬-ব্রিগেডের হুমকি পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা হয় এবং তুলনামূলকভাবে দুর্বল রক্ষীবাহিনীকে একমাত্র প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করা হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমএ হামিদ (অব.) তার ‘তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা’ বইয়ে বলেছেন যে খুনি দুই মেজর তার কাছে নির্দ্বিধায় বলেছেন, ‘বড় ভাইয়েরা সমর্থন না দিলে এমন একটি অসম্ভব কাজ আমরা কিভাবে করতে যেতাম?’ কর্নেল হামিদ ৪৬-ব্রিগেডের নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে ফারুকের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘রশীদকে জিজ্ঞেস করুন। কেননা রশীদই যে কোনোভাবে ৪৬-ব্রিগেডকে নিশ্চল করে রেখেছিল।’ যথারীতি কর্নেল এমএ হামিদ রশীদের কাছে সরাসরি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্যার, ব্যাপারটি আপনিই বুঝে নিন। ৪৬-ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল ছিলেন আমাদের লোক। তার তরফ থেকে আমরা কোনো আক্রমণের আশঙ্কা করিনি। শাফায়াত ও তার অধীনস্থ অফিসারদের সবাই ব্যাপারটি জানতেন।’

[৩] মুজিব-হত্যার পর মেজর রশীদ প্রথম কর্নেল শাফায়াত জামিলের সাথে দেখা করে হত্যার খবর জানান। কিন্তু শাফায়াত তাকে সাথে সাথে গ্রেফতার না করে স্টাফ অফিসার মেজর হাফিজকে নিয়ে সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি জিয়াউর রহমানের কাছে যান। জেনারেল জিয়া যথারীতি সকাল সাড়ে ৭টায় অফিসে উপস্থিত হন; যেন কিছুই হয়নি।

[৪] কর্নেল শাফায়াত বলছেন, সবার সঙ্গে যোগাযোগ করার পর জেনারেল সফিউল্লাহ সকাল প্রায় ৬টায় তাকে টেলিফোন করেন। হ্যাঁ, সফিউল্লাহ তাকে প্রায় সকাল ৬টায় টেলিফোন করেন; তবে এটা ছিল তার কাছে সেনাপ্রধানের দ্বিতীয় টেলিফোন। সে সময় মেজর রশিদ কর্নেল শাফায়াত জামিলকে বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিলেন। ভোর সাড়ে ৫টায় মেজর রশীদ কর্নেল শাফায়াত জামিলের কাছে অবস্থান করার সময়ও মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ তাকে টেলিফোন করেছিলেন। কিন্তু শাফায়াত আদালতের কাছে তাকে সাড়ে ৫টায় জেনারেল সফিউল্লাহর নির্দেশ প্রদানের কথা এড়িয়ে যান।

৫] এছাড়া মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ কর্নেল শাফায়াত জামিলের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক কর্নেল সালাহউদ্দিনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি নিজেও তার কাছে টেলিফোন করার জন্য ডায়াল ঘুরাচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তখনো ছিলেন জীবিত; সাড়ে ৫টার দিকে তিনি ফোর্স পাঠানোর জন্য সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে নির্দেশ দেন। সফিউল্লাহ টেলিফোন করেন ৪৬-ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াতকে। এক্সচেঞ্জ থেকে সেনাপ্রধানকে জানানো হয়, মনে হয় তিনি [শাফায়াত জামিল] রিসিভার উঠিয়ে রেখেছেন।

[৬] সঠিকভাবে তদন্ত করা হলে দেখা যেতো যে, কর্নেল শাফায়াত জামিল ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে জড়িত। মেজর রশিদের বদলি হয়েছিল যশোরে গানারি স্কুলে। রশিদের এ বদলিতে তাদের হত্যা-পরিকল্পনা লাটে উঠতে যাচ্ছিল। শাফায়াত তাকে ঢাকায় থেকে যাবার জন্য আবেদন করতে বলেন। শাফায়াতের সহযোগিতায় রশীদের যশোরে বদলি বাতিল হয় এবং তাকে ঢাকায় টু-ফিল্ড আর্টিলারির কমান্ডার হিসেবে বহাল করা হয়।

[৭] মেজর ফারুক শেরেবাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীর সদরদপ্তর ট্যাঙ্ক দিয়ে ঘেরাও করে রেখেছিলেন। ৪৬-ব্রিগেড ছিল পুরোপুরি ঘেরাও মুক্ত। জেনারেল সফিউল্লাহ প্রেসিডেন্টকে রক্ষায় ৪৬-ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াতকে নির্দেশ দেয়া সত্ত্বেও তিনি সৈন্য মুভ করেননি। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ কর্নেল শাফায়াত জামিলের অফিসেও যান। কিন্তু তিনি তাকে অফিসে পাননি। শাফায়াত জামিল থাকছিলেন দূরে দূরে।

[৮] শুধু শাফায়াত জামিলই নয়, ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) প্রধান ব্রিগেডিয়ার রউফও অত্যন্ত রহস্যময় ভূমিকা পালন করেন। ব্রিগেডিয়ার রউফ রাত তিনটায় ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারি চলাচলের গোয়েন্দা তথ্য পান, কিন্তু প্রেসিডেন্ট অথবা সেনাপ্রধানকে তিনি কিছু জানাননি। তার একটি বিশ্লেষণ ভেবে দেখার মতো। ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাসদরে সব গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনি জেনারেল সফিউল্লাহর বাসার বারান্দার নিচে সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের গাড়ি দেখতে পান। তিনি বিশ্বাস করছিলেন যে, তার দেখা অফিসারদের মধ্যে অভ্যুত্থানের নেপথ্য নায়ক উপস্থিত। তিনি প্রত্যেকের দিকে অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকান। সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ছাড়া আর কাউকে তার সন্দেহ হয়নি। অবশ্য ব্রিগেডিয়ার রউফ যাকেই সন্দেহ করে থাকুন না কেন, সন্দেহের তালিকায় প্রথমে ছিলেন তিনি নিজে।

[৯] ১৫ আগস্ট পর্যন্ত খুনি মেজরদের প্রতি শাফায়াত জামিলের ছিল বলিষ্ঠ সমর্থন। কিন্তু এতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিলের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় তারা উল্টে যান। ক্যু সফল হওয়ার পর কর্নেল শাফায়াত জামিল দেখতে পেলেন যে, এতে তার কোনো লাভ হয়নি। জিয়া চিফ অব স্টাফ হওয়ায় খালেদও শঙ্কিত হয়ে উঠেন; তার স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যায়। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও কর্নেল শাফায়াত জামিলের এ ক্ষোভ থেকে পঁচাত্তরের ৩ নভেম্বর পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটে।

[১০] মেজর ফারুক ও রশিদের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে পর্দার অন্তরালে থেকে কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা তাদের পরিচালনা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৮ আগস্ট ৪৬-ব্রিগেডের স্টাফ অফিসার মেজর সাখাওয়াত হোসেনের সাথে মেজর শরীফুল হক ডালিমের আলাপ থেকেও ক্যু’র সাথে সিনিয়র আর্মি অফিসারদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। ডালিম জিপ চালিয়ে ক্যুদেতার সময় আহত সৈন্যদের দেখতে সিএমএইচে যাবার পথে মেজর সাখাওয়াত হোসেনকে জানান যে সে ক্যু ছিল বহুদিনের ফসল। কিভাবে তারা সমস্ত সিনিয়র অফিসারের সমর্থন আদায় করেছিলেন সে ব্যাপারে জানতে চাইলে উল্টো ডালিম সাখাওয়াত হোসেনের কাছে জানতে চান, অল্প কজন অফিসার এ অভ্যুত্থানে জড়িত, এ ধারণা তিনি কোথা থেকে পেলেন। ডালিম অত্যন্ত সহজভাবে সাখাওয়াত হোসেনকে বললেন যে আপনি কিভাবে জানলেন যে এ ক্যু’র পরিকল্পনা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি?

[১১] পুরো সশস্ত্র বাহিনী আগস্ট ক্যু’তে সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সার্বিকভাবে সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা মৌনভাবে তা মেনে নিয়েছিলেন। সেনাবাহিনী প্রধান সফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকেও নির্দেশ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে; খালেদ সরল জবাব দিয়েছিলেন, ‘এখন কিছুই করণীয় নেই যা এ প্রক্রিয়াকে উল্টে দিতে পারে।’

[১২] ক্যুদেতায় মেজর ফারুক খালি ট্যাঙ্ক নিয়ে শেরেবাংলা নগরে রক্ষীবাহিনীকে ধোঁকা দেন। সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ বা সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের কাছে তিনি তার অভিযানের বর্ণনা দেন এবং তাকে গোলা ইস্যু করতে বলেন। খালেদ সঙ্গে সঙ্গে সেনাসদরের জেনারেল স্টাফ বা জিএস ব্রাঞ্চের আওতাধীন গোলা সরবরাহে জয়দেবপুরের অর্ডিন্যান্স ডিপোকে নির্দেশ দেন। একইদিন তিনি মেজর শাহরিয়ার রশীদ খানকে চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। [আগামী কাল ষষ্ঠ পর্ব]

আপনার সামাজিক মিডিয়ায় এই পোস্ট শেয়ার করুন...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর :
© All rights reserved © 2025
প্রযুক্তি সহায়তায়: csoftbd