জিয়াউল হক মুক্তা
[জিয়াউল হক মুক্তা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এ রচনায় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্যের সাথে যোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিচার-আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও কিছু সাক্ষ্যভাষ্য এবং বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রি প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিজনদের কিছু বক্তব্য; এবং বর্তমান লেখকের গবেষণালব্ধ কিছু পর্যবেক্ষণ। সবশেষে প্রধানমন্ত্রির সদয় বিবেচনা ও সকলের আলোচনার জন্য যোগ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা সত্যানুসন্ধান কমিশন’ বিষয়ক কিছু বিষয়গত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা। পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় লেখাটি ১৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আজ প্রকাশিত হচ্ছে তৃতীয় পর্ব।]
[বৃহস্পতিবারের পর]
এখানে বলে রাখা যাক যে ঔপনিবেশিক আমলের সেনা কর্মকর্তাগণ দেশ স্বাধীন হবার আগেই তাড়াহুড়া করে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর গঠন করেন ঔপনিবেশিক ভাবধারার ও কাঠামোর অনুরূপ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যাতে যুদ্ধ পরবর্তীকালে তারা একটি সংগঠিত শক্তি হিসেবে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে চাপে রাখতে পারেন; গেরিলা যুদ্ধ বা জনযুদ্ধের কৌশল যাতে কম অনুসৃত হয় এবং গেরিলা যুদ্ধ বা জনযুদ্ধের জনসম্পৃক্ততার প্রভাব যাতে ঔপনিবেশিক নিয়ম-নীতির প্রথাগত সেনা কাঠামোর ওপর না পরে; জনযুদ্ধের গেরিলাদের যাতে সেনাবাহিনীতে আত্মীকৃত করা না হয়; বিপ্লবী গণবাহিনীর গঠন যাতে ঠেকানো যায়। পরবর্তীকালের ইতিহাস বলে যে এই সেনা অফিসারগণ আওয়ামী লীগের মধ্যকার প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে মিলেমিশে সম্মিলিতভাবে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছেন যা এ রচনায় পরে আলোচনা করা হবে এবং সেনাবাহিনীতে ক্যু আর পাল্টা ক্যু-তে উন্মত্ত থেকেছেন।
২০০২ সালের ১৫ আগস্ট “আজকের কাগজের” তৎকালীন প্রতিনিধি জাহিদ রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর সাক্ষাৎকার নেন। এ সাক্ষাৎকারে তিনি বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করতে না যাবার জন্য শাফায়াত জামিলকে দোষী করেন; ঢাকার পথে ট্যাংক মুভ করা বিষয়ে ‘আসলে ইন্টেলিজেন্সের লোকও বুঝতে পারেনি আর্টিলারি কোথায় যাচ্ছে’ বলে তিনি তাদের রক্ষা করতে চাচ্ছেন যেখানে তিন/চার দিন আগে থেকেই এমনকি স্বাধীনতা-বিরোধী লোকজনও জেনে গিয়েছেন যে ‘দু’চার দিনের মধ্যেই খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে দেশে রক্তের গঙ্গা বয়ে যাবে’। মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ কি আসলে সেনা গোয়েন্দাদের রক্ষা করতে চাচ্ছেন? নাকি নিজেকে? প্রসঙ্গত বলে রাখা যাক যে এ রচনায় পরে জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশারফ ও শাফায়াত জামিলরাও যে বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত থাকতে পারেন সে তথ্য ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হবে।
অধ্যায় ছয়. ইন অ্যান্ড আউট
১৯৬২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে ছাত্রলীগের ভেতরে-বাইরে সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ গঠন করেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ বা ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’। শিক্ষা ও গণতন্ত্রের সকল আন্দোলনকে তাঁরা জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের দিকে পরিচালিত করেন। বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণার আগে তাঁরা পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে দেশব্যাপী প্রচার আন্দোলন গড়ে তোলেন, বিশেষভাবে ১৯৬৫ সালে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ঘোষণা করলে তাঁরা সাথে সাথে এটাকে বাঙালির মুক্তির সনদ বিবেচনা করে ঝাঁপিয়ে পড়েন সর্বস্বত্যাগী মরণপণ সংগ্রামে। ‘ছয় দফা না হলে এক দফা’র ‘স্বাধীনতার আন্দোলন’ গড়ে তোলেন। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ গঠন করেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের জেতানোর জন্য সারা দেশে সুপরিকল্পিত কার্যক্রম পরিচালনা করেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধা দেন। ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনি চালু করেন। জাতীয় পতাকা তৈরি করেন। জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বিজয়ী হন।
স্বাধীন দেশে বিএলএফ/মুজিববাহিনী-র ৪ প্রধানের ৪ সুপারিশ আর ছাত্র-যুব সমাজের ১৫ দফা ও ১২দফা সুপারিশ বঙ্গবন্ধু গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে না পারায় ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াস পন্থীদের প্রায় সকলে, মুজিববাহিনী/বিএলএফ-এর আশি ভাগ সদস্য, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় শতভাগ মুক্তিযোদ্ধার দল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত জাসদ শুরু থেকেই সরকারের ও সরকারি দলের দমন-পীড়ন-নির্যাতন-নিপীড়ন-সন্ত্রাস-গুম-খুনের শিকার হতে থাকে।
অন্যদিকে, ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির আদেশে দালাল আইন প্রণীত হয় । এর অধীনে প্রচুর প্রকৃত দালালকে যেমন আটক করা হয়েছিল তেমনি দালাল নন এমন আরও অনেককে জাগতিক লেনদেন-দখল-প্রেম-পূর্বশত্রুতা-প্রতিহিংসা ইত্যাদি কারণেও আটক হতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞগণ বলেন যে এ আদেশের আওতায় সারা দেশে বিভিন্ন সময় কমবেশি ৭৫,০০০ লোক আটক হয়েছিল; আটকের পাশাপাশি তারা মুক্তিও পেয়ে যাচ্ছিল; দুটো প্রক্রিয়া একই সাথে চলছিল; এদের মধ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী শ্রেণির ব্যক্তিরা ছাড়া পাচ্ছিল দ্রুততর সময়ে। পুলিশ-প্রশাসক-বিচারকরাও প্রায় সবাই যেহেতু পুরো যুদ্ধের সময় ছিলেন পাকিস্তানের পক্ষে এ আদেশের অধীনে আটকদের নিয়মিতভাবে পুলিশি-প্রশাসনিক ও দলীয় আয়োজনে ছেড়ে দেয়া হতে থাকে; পাশাপাশি মূলত চারটি পর্বে আটককৃতদের সরকার কর্তৃক মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৭২ সালের ৩ অক্টোবর পর্যন্ত তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্যে ৪১,৮০০ জনকে এ আদেশবলে আটক করা হয়েছিল; মোট ২,৮৪৮ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছিল; এবং তাদের মধ্যে ৭৫২ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছিল। পরে এ আদেশের আওতায় আটক থাকা ৯০%-এর জন্য (৩৬,৪০০ জনের জন্য) ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দি জেনারেল অ্যামনেস্টি অর্ডার ঘোষণা করে তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন যে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিকান্ডের দায়ে অভিযুক্ত ৪,০০০ জনের জন্য সে সাধারণ ক্ষমা প্রযোজ্য ছিল না; কেবল দালালিরই ক্ষমা ছিল। এ বিষয়ে অত্যন্ত বিস্তারিত আলোচনা আছে মিরিয়াম ব্রেইংমেইয়ার-এর সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণাগ্রন্থ দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল ইন বাংলাদেশ: ক্রিটিক্যাল অ্যাপ্রাইজাল অব লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অ্যান্ড জুরিসপ্রুডেন্স-এ। ওয়াশিংটন থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসের নিয়মিত প্রকাশনাতেও এসব তথ্য রয়েছে।
গণহত্যার সহায়তাকারী হাজার হাজার দালাল পঙ্গপালের মতো কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলেন সগৌরবে। আর কারাগারের সে শূন্যস্থান পূরণ করতে লাগলেন জাসদ নেতাকর্মীগণ! উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু হত্যার সময় পর্যন্ত কারাগারে যে হাজার হাজার রাজবন্দি ছিলেন, তাদের প্রায় সকলেই ছিলেন জাসদের কেন্দ্র থেকে প্রান্তের নেতাকর্মী।
হায়! হে সময়! হে দিন ও রাত্রি! হে আকাশ-বাতাস-জলাধার! হে বৃক্ষ ও বিহঙ্গ! হে জন ও স্বজন! হে ইতিহাস! হে আগামীর প্রজন্ম তোমরা জেনে রেখো স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘকাল ধরে মেধা-শ্রম-ঘাম-রক্তত্যাগী মহান জাতীয় বীরদের ঠাঁই হলো স্বাধীন দেশের কারাগারে আর সাথে সাথে স্বাধীনতার শত্রু ও গণহত্যার দোসররা কারামুক্ত হয়ে উপভোগ করতে লাগলো বাংলার সময়, দিন ও রাত্রি, আকাশ-বাতাস-জলাধার, বৃক্ষ ও বিহঙ্গ, জন ও স্বজন, আর ইতিহাস। হায়! কারবালা প্রান্তর থেকে প্রজন্মান্তরে বিশ্বব্যাপ্ত বুক-চাপড়ানো রক্তাক্ত মাতম ‘হায় হাসান হায় হোসেন’ যেন এর কাছে ধূলিকণা!
কারামুক্তির আগে ও পরে আর কারাগারে ও কারাগারের বাইরে আর দেশের ভেতরে ও দেশের বাইরে দালালরা বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা রাখতে লাগলো; বাংলাদেশের সরকারও সমাজ আর সংস্কৃতি আর রাষ্ট্রের ধর্মীয়করণ করছিল। তা এখানে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোনা । কেউ চ্যালেঞ্জ করলে তা আলোচনা করা যাবে; প্রয়োজনে বর্তমান সময় পর্যন্ত একেবারে সংসদীয় আলোচনার সূত্র ধরে।
অধ্যায় সাত. অবরুদ্ধ বঙ্গবন্ধু নিঃসঙ্গ আর নিঃসঙ্গ জাসদ যেন সংশপ্তক
জামাত-সংঘ, মুসলিম লীগ, শান্তি কমিটি ও রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী তখনও কারাগারে এবং এদের অনেকে সাংগঠনিক হিজরতে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে চিল্লায় বা লুকিয়ে কোথাও; আর পরে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেদের সংগঠিতকরণেও মনযোগী; কোথাও কোথাও ওয়াজ মাহফিলের নামে গর্ত থেকে মুখ বের করে নিজেদের পুনরুত্থানের জানান দিচ্ছে। এদের নেতৃস্থানীয়রা পাকিস্তান-মধ্যপ্রাচ্য-ইংল্যান্ড-আমেরিকায় অবস্থান করে বাংলাদেশ-বিরোধী প্রচারণায় ব্যস্ত। কিন্তু তখনও এরা বঙ্গবন্ধু সরকার উৎখাতের স্পর্ধা দেখায়নি; যদিও পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশনের সম্ভাব্যতার কথা বলছিল বিভিন্ন মুসলিম-প্রধান দেশে।
এ দিকে [১] ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগে শেখ ফজলুল হক মনির অনুসারীগণ, [২] খন্দকার মোশতাক আহমাদের অনুসারীগণ, [৩] জনপ্রশাসনে পাকিস্তান পন্থার অনুসারীগণ, [৪] গোয়েন্দা বিভাগে পাকিস্তান পন্থার অনুসারীগণ, [৫] আধা-সামরিক ও সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরে পাকিস্তান পন্থার অনুসারীগণ, আর [৬] বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্ষমতালিপ্সু সামরিক কর্মকর্তাগণ পরিপূর্ণভাবে ঘিরে রেখেছেন বঙ্গবন্ধুকে; আর [৭] রাজনৈতিক পরিমুলে জাসদের বিরোধীতা করার মিশন নিয়ে একদম শুরু থেকে কোন ক্রিটিক্যাল এনগেজমেন্টের বদলে সরকার-প্রশাসন-দলের ন্যায্য-অন্যায্য সকল কাজে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে যেতে থাকলো ন্যাপ-সিপিবি। ধীরে ধীরে শতভাগ অবরুদ্ধ হয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু।
মুক্তিযোদ্ধাদের ৮০% জাসদ করলেও আওয়ামী লীগে যে ভালো লোকজন ছিলেন না তা নয়; অনেক ভালো লোক ছিলেন। কিন্তু দাপটে ছিলেন কলুষিত লোকজন। এ সময় সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র কায়েম তো দূরের কথা, ১৯৭২ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর নিজের কথিত ‘চাটার দল’ ও ‘চোরের দল’ ও ‘নরপশুর দল’ সূচিত দুর্নীতি-লুটপাট-মজুদদারি-চোরাকারবারি-কালোবাজারির থাবায় বিপর্যস্ত হলো দেশ। দলানুগ প্রশাসন এদের সহায়তা করলো। বর্তমান সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কিছু ইউটিউব প্লাটফর্ম আছে; এগুলোর একটিতে আপলোড করা বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণের শ্রুতিলিখন দেখা যাক; তিনি বলছেন, “আপনারা ভালো কইরে কাজ করেন। ঘুষ খাওয়াডা বন্ধ করেন। দুর্নীতি বন্ধ করেন। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতিতে ভরে গেছে। আমি আচ্চায্য হয়ে যাই এত কষ্ট কইরে, এত ভিক্ষা কইরা প্রায় তিনশ, তিনশ নয় কোটি টাকা আমরা সাহায্য পেয়েছি। দুনিয়া থেকে তিনশ নয় কোটি টাকা সাহায্য, একশ ষোল [এখানে বক্তব্য একটু জড়ানো] কোটি টাকা আমি লোন কইরা আনছি, যা দিয়ে বাংলার মানুষকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছি। এক আনার বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের হাতে আমরা পাই নাই। সাত কোটি লোকের জন্য কোত্থেকে আমি দেব? যা ভিক্ষা কইরা আনি তাও চাটার গোষ্ঠি চাইটা খাইয়া ফেলায় দেয়, আমার গরিব পায় না। এত চোরের চোর, চোর কোত্থেকে যে পয়দা হয়েছে আমি জানি না। পাকিস্তানিরা সব নিয়ে গেছে, কিন্তু এই চোরটুক থুইয়া গেছে আমার কাছে, এই চোর নিয়া গেলে আমি বাঁচতাম। কিছু দালাল গেছে, এখন চোর গেলে বাঁচা যাবে।” গভীর দুঃখে, প্রতীকীভাবে, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সাড়ে সাত কোটি কম্বল আনলাম, আমার কম্বল কই?
১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও চাল-গম-চিনির দাম বেড়ে যায় এবং দেশের ভেতর ভোক্তার মূল্য সূচক (পড়হংঁসবৎ ঢ়ৎরপব রহফবী) বেড়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতির ফলে নি¤œ আয়ের কৃষক-শ্রমিকদের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় তাদের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায়। ধানের ফলন বেশি হয়; কিন্তু বন্যায় পাটের ফলন ক্ষতিগ্রস্থ হলে কৃষক নগদ আয় থেকে বঞ্চিত হয় এবং তার ঋণাত্মক প্রভাব পড়ে আমন চাষে। মানুষের মনে অভাবের শংকা বেড়ে যায়; শংকার সাথে যুক্ত হয় স্পেকুলেটিভ (ংঢ়বপঁষধঃরাব) বাজার-আচরণ। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে বিশ্ব বাজার থেকে বাড়তি দামে খাদ্য আমদানি ব্যাহত হয়; দেশের ঋণযোগ্যতা (পৎবফরঃড়িৎঃযরহবংং) অত্যন্ত কম থাকায় স্বল্প মেয়াদি বাণিজ্যিক ঋণের আওতায় সম্পাদিত খাদ্য আমদানি চুক্তির কয়েকটি বাতিল হয়ে যায়। উপরন্তু আমেরিকান প্রশাসন পিএল-৪৮০ কর্মসূচির খাদ্য সরবরাহ বিভিন্ন অজুহাতে প্রায় নয় মাস ঝুলিয়ে রাখে এবং শেষদিকে কিউবার সাথে পাটের ব্যাগের ব্যবসা করার দায়ে খাদ্য সরবরাহ চুক্তি বাতিল করে দেয়। এরকম জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু-কথিত চাটার দলের আর চোরের দলের আর নরপশুর দলের দুর্নীতি-লুটপাট-কালোবাজারি-মজুদদারি-চোরাকারবারি আর সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-দুঃশাসনে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয় এবং তার অনিবার্য পরিণতি হিসেবে দেশে শুরু হয় দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের পেছনে অ্যকাডেমিশিয়ানগণ অনেক কারণ উপস্থাপন [যেগুলো উপরে বলা হয়েছে] করতে পারেন এবং সেসবের কিছু সত্যও বটে, কিন্তু এ দুর্ভিক্ষ যে কেবল খাদ্য-শস্যের অভাবে হয়েছে এমনটা বলা যাবে না বঙ্গবন্ধু সচেতন ছিলেন তবুও দুর্ভিক্ষ হয়েছে, এবং প্রধানত তা হয়েছে গুড-গভর্ন্যান্সের অভাবে; এটা জাসদের কথা না. এসআর ওসমানী, ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর [পরে আওয়ামী লীগ নেতা] ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন এসব বলেছেন। বন্যার ত্রাণ ও দুর্ভিক্ষকালে প্রতিদিন ৪৪ লক্ষ লোককে খাওয়াতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক চালুকৃত ৫,৭০০ লঙ্গরখানার জন্য বরাদ্দকৃত খাদ্য-শস্যেরও লুটপাট হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু তা নিজ মুখেই বলেছেন; একদম শুরু থেকে রেডক্রসের সহায়তা কার্যক্রমও লুটপাটের মুখে পড়ে; নি¤œবিত্তদের রেশনেও লুটপাট হয়েছে। ফলে সরকারী হিসেবে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে ২৬,০০০ থেকে ৩৭,০০০ বাঙালির মৃত্যু হয়; যদিও পরবর্তীকালের আওয়ামী লীগ নেতা ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের সহায়তায় নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনের হিসেবে সংখ্যাটি ভিন্ন। [আগামী কাল চতুর্থ পর্ব]
Leave a Reply