জিয়াউল হক মুক্তা
[জিয়াউল হক মুক্তা, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এ রচনায় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্যের সাথে যোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিচার-আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও কিছু সাক্ষ্যভাষ্য এবং বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রি প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিজনদের কিছু বক্তব্য; এবং বর্তমান লেখকের গবেষণালব্ধ কিছু পর্যবেক্ষণ। সবশেষে প্রধানমন্ত্রির সদয় বিবেচনা ও সকলের আলোচনার জন্য যোগ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা সত্যানুসন্ধান কমিশন’ বিষয়ক কিছু বিষয়গত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা। পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় লেখাটি ১৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আজ প্রকাশিত হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব।]
[গতকালের পর] আগাচৌ বলেন, “মনি চান, তার প্রতি এখন যারা ব্যক্তিগত আনুগত্য দেখাচ্ছেন, তারা এককালে মোনায়েম খাঁর এনএসএফ বা জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের গুণ্ডা হোক বা প্রাক্তন রাজাকার আলবদর হোক, তাদের নিয়ে তিনি গ্রুপ গঠন করবেন। অন্যদিকে যারা নীতিগতভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সেকুলারিজম, সোস্যালিজমে বিশ্বাসী কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী লীগ বা যুবলীগের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য পোষণ করে না, তাদের জাতীয় জীবনের ক্ষেত্রে পাত্তা দেয়া হবে না। এই নীতির সর্বনাশা দিক হলো, ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগে তখন আইয়ুব খাঁ-মোনায়েম খাঁর আমলের সুবিধাবাদী দল ভোল পাল্টিয়ে এসে আসর জাঁকিয়ে বসছিল। আর আওয়ামী লীগের যারা প্রকৃত কর্মী ৃ তারা ক্রমশই পিছনে হটে যাচ্ছিলেন। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা ছাত্রলীগের কিছু নেতা ও নেতৃস্থানীয় কর্মীও এই সুবিধাভোগী ও রাতারাতি বড়লোক হওয়ার দুর্নীতিময় পথে পা বাড়াননি, তা নয়। ৃ আর সংখ্যাগরিষ্ঠ যে অংশের দুর্নীতি ও সমাজবিরোধী কাজের জন্য বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে এত দুর্নাম কুড়াতে হয়েছে, তারা কেউ দুর্দিনে বা সংগ্রামের দিনে আওয়ামী লীগের বন্ধু বা সমর্থক ছিলেন না। ৃ শেখ ফজলুল হক মনি ও তোফায়েল আহমেদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব হ্রাস পাচ্ছিল এবং নেপথ্যে থেকে শক্তি সঞ্চয় করছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমাদের সমর্থক তরুণ প্রতিমন্ত্রিদের গ্রুপটি। এদের মধ্যে আছেন ফরিদপুরের কেএম ওবায়দুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাহের উদ্দিন ঠাকুর, বরিশালের নূরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রমুখ।” বলা নিষ্প্রয়োজন, শেখ মনিও রেহাই পাননি, তার ক্ষমতালিপ্সা তার প্রাণও কেড়ে নিয়েছে; কেএম ওবায়দুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও বরিশালের নূরুল ইসলাম মঞ্জুরদের উত্থান ঘটেছিল খুনি মোশতাক-মেজরদের হাত ধরে।
বলে রাখা ভালো যে ১৯৭৪ সালের এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কুখ্যাত ‘সেভেন মার্ডার’-এর কথা বলা হয়েছে, তার জন্য আইনের চোখে প্রধানত দায়ী ছিলেন আওয়ামী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান ও তার অনুসারীগণ; এজন্য তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল; পরে জিয়ার আমলে তিনি ক্ষমা পান। সে সময় শফিউল আলম প্রধান রাজ্জাক-তোফায়েল উপ-উপদলের অংশ ছিলেন। আওয়ামী রাজনীতিতে সে সময় বঙ্গবন্ধুর পর যাদের দোর্দণ্ড প্রতাপ ছিল, তারা হলেন শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদ দেখতেন পুরো প্রশাসন ও রক্ষীবাহিনী; আব্দুর রাজ্জাকের নিয়ন্ত্রণে ছিল আওয়ামী লীগের তরুণ নেতৃত্ব পুরোটা ও আওয়ামী ছাত্রলীগের অধিকাংশ; আর শেখ মনির নিয়ন্ত্রণে ছিল যুবলীগের পুরোটা, শ্রমিক লীগের আধাটা ও ছাত্রলীগের সামান্য অংশ। তোফায়েল আহমেদ যেহেতু বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব ছিলেন, তাই তার ও আব্দুর রাজ্জাকের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লালিত শফিউল আলম প্রধানের অনুসারীদের কৃত সেভেন মার্ডারের সাথে প্রধানমন্ত্রির কার্যালয় জড়িত— এমন একটা ভ্রান্ত ধারণা বঙ্গবন্ধুর ইমেজের জন্য যথেষ্ট ক্ষতিকর হয়ে ওঠেছিল; যদিও ক্ষমতার জন্য তাদের সকলের উপ-উপদলীয় কোন্দলের একটা রাজনৈতিক আবরণ ছিল যে তারা আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য আবস্থান নিয়েছিলেন।
অধ্যায় তিন. জনপ্রশাসন আওয়ামী রাজনীতির ওই দুই উপদল— বঙ্গবন্ধু সরকারকে বাধ্য করলো ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের একদিন আগে ও বিজয়ের পর ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় গৃহীত একটি সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে— যে সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের পক্ষ নেয়া বেসামরিক প্রশাসনের আমলাদের স্ক্রিনিং করার কথা বলা হয়েছিল। পরে এদের দালাল আইনে বিচার করার কথাও ওঠেছিল; কিন্তু তাও কখনও হয়নি। সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিস্টোরেশন কমিটির ৪ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখের প্রতিবেদন অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রাদেশিক প্রশাসন কাঠামোকে বাংলাদেশের জাতীয় প্রশাসন কাঠামোয় রূপান্তর করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস যে আমলারা পাকিস্তানের হয়ে কাজ করছিলেন, তাদের নেতৃত্বে চলতে শুরু করলো স্বাধীন বাংলাদেশের জনপ্রশাসন; পরে এদের সাথে যোগ দেন পাকিস্তান ফেরত আমলারা, যাদের অনেকেই ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর স্বেচ্ছায় পাকিস্তানে বদলি নিয়েছিলেন। সরকার গঠিত অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অ্যান্ড সার্ভিসেস রিঅর্গানাইজেশন কমিটি বা এএসআরসি ও ন্যাশনাল পে কমিশন বা এনপিসি কর্তৃক পেশকৃত প্রগতিশীল জনপ্রশাসন প্রতিষ্ঠার সুপারিশমালা লুকিয়ে ফেলা হলো। পাকিস্তানপন্থার দৌরাত্ম্য কায়েম হলো জনপ্রশাসনে। এসবের বিস্তারিত রয়েছে বাংলাপিডিয়ায় এটিএম ওবায়দুল্লাহ-র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফর্মস নিবন্ধে ও ইন্টারনেটে সহজলভ্য কিছু পিএইচডি অভিসন্দর্ভে।
মুজিব বাহিনী নেতৃত্বের ৪ দফা, ছাত্র-যুব-তরুণদের ১৫ দফা ও ১২ দফা, এএসআরসি ও এনপিসি না মেনে পুরোনো ব্যবস্থা বহাল রাখার ফলে, “বাংলার দুর্ভাগ্য আইনানুগ উত্তরাধিকারীর [অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের] বদলে [স্বাধীন দেশে] সর্বস্তরের নেতৃত্ব এসেছে তাদেরই হাতে যারা প্রাক বিপ্লব যুগে ছিলেন ক্ষমতার উৎস। প্রশাসন যন্ত্র সেই পুরোনো ব্যক্তিরাই চালান। বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তারাই। যে সামরিক অফিসার পাকিস্তানীদের সৈন্যদের সাথে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য ছিলেন সচেষ্ট, তিনি আজ আরও উচ্চপদে সমাসীন। যে পুলিশ অফিসার দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে সোপর্দ করেছে পাকিস্তানীদের হাতে, তিনি আবার মুক্তিযোদ্ধাদের নামে হুলিয়া বের করতে ব্যস্ত। যে আমলারা রাতদিন খেটে তৈরি করেছে রাজাকার বাহিনী, তারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চাকরি দিয়ে দয়া প্রদর্শনের অধিকারী। যে শিক্ষক দেশের ডাকে সাড়া দিতে পারেনি, তিনিই আজ তরুণদের শিক্ষা দেয়ার বাহানা করছেন।” কথাগুলো বলেছেন শহীদ কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম তাঁর ‘মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে’ প্রবন্ধে।
পরের অনুচ্ছেদে তিনি আরও বলেছেন, “পরিকল্পনা বিভাগের যে কর্মীকে শোষণের পরিকল্পনা করা শেখানো হয়েছে বছরের পর বছর ধরে, তিনিই এখন সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পরিকল্পনা তৈরি করেন। যুদ্ধ চলাকালে যারা পাকিস্তানীদের হয়ে প্রচারণায় মত্ত ছিলেন, ১৬ ডিসেম্বরের পর তারাই ভোল পাল্টিয়ে সংস্কৃতির মধ্যমণি হয়েছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর প্রত্যেক দেশে করা হয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধকে যারা সাহায্য করেনি তারা স্থান পেয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে।সেখানে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদেরকে আত্মশুদ্ধির সুযোগ দেয়া হয়েছে, যাতে করে তারা বিপ্লবী জনতার অংশ হতে পারে। নিতান্তই পরিতাপের বিষয়, যাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে থেকে আত্মশুদ্ধি করার কথা, সকলের অগোচরে তারা সর্বস্তরের নেতৃত্বের আসন দখল করে বসেছে।”
অধ্যায় চার. গোয়েন্দা সংস্থা বঙ্গবন্ধু হত্যা ও কর্নেল তাহের হত্যা বিষয়ে ১৯৭৫ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফস্যুলৎসের ১৯৭৯ সালে জেড বুকস প্রকাশিত বই ‘বাংলাদেশ: দি আনফিনিশড রেভ্যুলুশন’-এর প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ডে বর্ণিত কিছু তথ্য দেখা যাক। তৃতীয় বিশ্বে আমেরিকার সাহায্য কর্মসূচির একটি ছিল অফিস অফ পাবলিক সেফটি: এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট বা ওপিএসএইড। এ কর্মসূচির একটা অংশ ছিল মাঝারি ও উচ্চ পর্যায়ের পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের আমেরিকায় প্রশিক্ষণ প্রদান। প্রশিক্ষণ দেয়া হতো ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অ্যাকাডেমি বা আইপিএ ও ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ সার্ভিসেস স্কুল বা ইনপোলসে থেকে। ওপিএস শুরু থেকেই সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি বা সিআইএ-র সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল; আর ইনপোলসে ছিল সরাসরি সিআইএ’র মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। ১৯৬১ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে এ কর্মসূচির আওতায় প্রায় ৪০ জন বাঙালি কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ পান। এরা সবাই পাকিস্তান জাতীয়তাবাদের কট্টর সমর্থক ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর দালালদের পাইকারিভাবে ক্ষমা করে দেয়ার ফলে এদের মধ্যকার রাঘব বোয়ালরা লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান।
পরে ১৯৭৪ সালে বন্যাপরবর্তী দুর্ভিক্ষ, গণবিক্ষোভ ও জাসদ দমনের জন্য সরকারের প্রয়োজন হয়ে ওঠে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গোয়েন্দা ব্যক্তিত্বের। আওয়ামী লীগ সরকার তখন এদের পুনর্বাসন শুরু করে। এদের মধ্যে বিশেষ কয়েকজনের দিকে একটু নজর দেয়া যাক। ফিল্ডমার্শাল আইয়ুব খানের সময়কার ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো বা আইবি-র সহকারী-পরিচালক ও পরে উপ-পরিচালক এবিএস সফদারকে নিয়োগ দেয়া হয় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা দলে। ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে এবিএস সফদার বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহঅভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ফাইল ও ডোঁশিয়ে তৈরির কাজ করতেন এবং প্রতিদিন নিজ হাতে বিচারকদের জন্য ব্রিফকেস নিয়ে আদালতে যেতেন। সফদারের সহপাঠি ও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর পরিচালক আবদুর রহিমকে নিয়োগ দেয়া হয় রাষ্ট্রপতির সচিব হিসেবে; এর আগে কোন পুলিশ কর্মকর্তা এভাবে পূর্ণসচিবের মর্যাদা ভোগ করেননি, এমনকি পাকিস্তান আমলেও নয়। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এরা দুজন ওয়াশিংটনে আইপিএ-তে ছিলেন। মার্চে যুদ্ধ শুরু হলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালিগণ ও পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশের পক্ষ নেন; কিন্তু সফদার ও রহিম তা করেননি। তাদেরকে পাকিস্তান সরকার ডেকে পাঠালে ইউএস পাবলিক সেফটি প্রোগ্রাম ইন পাকিস্তান-এর প্রধান যোশেফ কার পাকিস্তান ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর পরিচালক এনএ রিজভির সাথে কথা বলে এদের প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখেন। প্রশিক্ষণ শেষে এরা নিজ ইচ্ছায় সরাসরি ঢাকা আসেন এবং ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড কাউন্টার ইনসার্জেন্সি কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। এদের সাথে সাথে আওয়ামী লীগ সরকার পাকিস্তান পুলিশ কর্মকর্তা সৈয়দ আমীর খসরুকে নিয়োগ দেয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব পদে। পাকিস্তানের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্য এবং আমেরিকার ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা এফবিআই ও ইনপোলসে-তে প্রশিক্ষিত এমএন হুদাকেও নিয়োগ দেয়া হয়। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা যাক যে এরা কেউ বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করেননি; খুনিদের সহায়তাই করেছেন; বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের সরকার কর্তৃক এদের আরও উচ্চতর পদায়ন ও ক্ষমতায়ন তার ইঙ্গিত দেয়।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে মিজানুর রহমান চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর এককালের রাজনৈতিক সহকর্মী; বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর একসময় তিনি আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনেও ভূমিকা রাখেন। ২০০২ সালের ১৩ আগস্ট আজকের কাগজের প্রতিবেদক জাহিদ রহমানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান যে বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন/চার দিন আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী মাওলানা মান্নান— যিনি পরে দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক হয়েছিলেন— তার বাসায় এসে সাবেক সিএসপি আব্দুর রব চৌধুরীর বরাত দিয়ে তাকে ‘একটা গোপন কথা’ জানান। গোপন কথাটি হলো— ‘দু’চার দিনের মধ্যেই খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে দেশে রক্তের গঙ্গা বয়ে যাবে’। এখানে বিষয় হলো খন্দকার মোশতাক ও সেনাবাহিনীর খুনিদের বাইরে এমনকি স্বাধীনতা বিরোধীরাও যখন বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন/চার দিন আগে থেকে হত্যা-পরিকল্পনাটি জানতেন— যা আসলে প্রণীত হয়েছিল আরও ছয় মাস আগে— সেখানে গোয়েন্দা বিভাগ এ তথ্য জানতো না এমনটি বিশ্বাসযাগ্য নয়। গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তাগণ অবশ্যই এ পরিকল্পনার অংশ ছিলেন। প্রসঙ্গত লরেন্স লিফস্যুলৎসের ‘বাংলাদেশ: দি আনফিনিশড রেভ্যুলুশন’ থেকে একটি চমৎকার অংশ দেখা যাক— লিফস্যুলৎস কথা বলছিলেন এনএসআই-এর কর্মকর্তা এমএন হুদার সাথে— ÒWhen asked whether the N.S.I. had been incompetent in discovering the conspiracy to kill Mujib or whether it was true the N.S.I. itself had been involved, Huda laughed and said the question was a very, very clever one. But he would not answer.প্রয়োজন নেই।
অধ্যায় পাঁচ. সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর এখানে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের ক্যুদেতার অন্যতম পরিকল্পনাকারী ও সংগঠক মেজর নাসির উদ্দিনের ‘গণতন্ত্রের বিপন্ন ধারায় বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী’ এবং ‘বাংলাদেশ: বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর’ বই দুটো থেকে সামরিক বাহিনী ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরে ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের দালালদের পুনর্বাসনের দিকটি দেখা যাক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় পাকিস্তানের এক নম্বর সামরিক আদালতের দায়িত্বপ্রাপ্ত লে. কর্নেল কেএম রহমানকে স্বাধীনতার পর দায়িত্ব দেয়া হয় সেনাবাহিনীর সরবরাহ ব্যবস্থার প্রধানের পদে। রাজাকার বাহিনীর উপপ্রধান লে. কর্নেল ফিরোজ সালাহউদ্দিনকে দেয়া হয় রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের পদ। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তান সেনা বাহিনীর ৩১ ফিল্ড রেজিমেন্টে চাকুরিরত থেকে বাঙালিদের হত্যাকারী— বিশেষত তেলিয়াপাড়া, মনতলা ও আখাউড়া এলাকায় যার গোলায় শহীদ হয়েছেন শত শত শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধা— সেই ক্যাপ্টেন হাকিমকে দেয়া হয় সেনা-পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব। সেনা পুলিশে আরও নিয়োগ দেয়া হয় পাকিস্তানের অর্ডিন্যান্স কোরের কর্মকর্তা লে. আল ফরিদ ও লে. মোদাব্বেরকে; এরা ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সেনা বাহিনীকে সহযোগিতা করেছেন। এ রকম গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সেনা কর্মকর্তাদের বসানোর পাশাপাশি ভয়াবহতম যে কাজটি করা হয় তা হচ্ছে— প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর বা ডিজিএফআই প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয় এয়ার কমোডর আমিনুল ইসলামকে। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি বাঙালি হয়েও বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স বা আইএসআইয়ের পরিচালক ছিলেন। এভাবে ক্রমে সেনা বাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সর্বত্রই কায়েম হয় পাকিস্তানপন্থী অফিসারদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ। [আগামী কাল তৃতীয় পর্ব]
Leave a Reply