জিয়াউল হক মুক্তা
[জিয়াউল হক মুক্তা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক। এ রচনায় সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পারিবারিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-আর্থরাজনীতিক-অন্তঃদলীয়-আন্তঃদলীয়-প্রশাসনিক-গোয়েন্দা-আধাসামরিক-সামরিক-ভূরাজনীতিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করা হয়েছে। এখানে বঙ্গবন্ধুর নিজের ভাষ্যের সাথে যোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু-হত্যা বিচার-আদালতের বিচারকের পর্যবেক্ষণ ও কিছু সাক্ষ্যভাষ্য এবং বঙ্গবন্ধুতনয়া জননেত্রি প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার ও তাঁর পরিজনদের কিছু বক্তব্য; এবং বর্তমান লেখকের গবেষণালব্ধ কিছু পর্যবেক্ষণ। সবশেষে প্রধানমন্ত্রির সদয় বিবেচনা ও সকলের আলোচনার জন্য যোগ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা সত্যানুসন্ধান কমিশন’ বিষয়ক কিছু বিষয়গত ও কাঠামোগত প্রস্তাবনা। পাঠকদের সুবিধা বিবেচনায় লেখাটি ১৬ কিস্তিতে প্রকাশিত হচ্ছে; আজ প্রকাশিত হচ্ছে প্রথম পর্ব।]
অধ্যায় এক. ত্রিচক্রযান
[১] ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পাটি অফ বাংলাদেশ বা সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের সাবেকদের মধ্যে আত্মশ্লাঘা-জর্জরিত পরাজিতদের প্রতিভূ, আর [২] ছাত্রলীগে ও বহু-মত-পথের দল আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা প্রথমে স্বাধীনতার বদলে কেবল স্বায়ত্তশাসনে সন্তুষ্ট ছিলেন, পরে ১৯৬৯-১৯৭০ সালে স্বাধীনতার পক্ষে আসেন কিন্তু সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন, আরও পরে ১৯৭০-১৯৭১-এ স্বাধীনতা-সমাজতন্ত্র মেনে নিলেও স্বাধীনতার পর ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে পশ্চাদপদ অবস্থান নিয়েছেন এবং স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনে কোন বৈপ্লবিক পন্থা না নিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ প্রয়োগ করেছেন, আর [৩] যারা পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের ফেডারেশন-কনফেডারেশনের স্বপ্নবিভোর খুনি খন্দকার মোশতাক আহমাদের দক্ষিণপন্থার প্রেতাত্মা— তারা সবাই সমস্বরে— গভীর-নিশিথে ধূর্ত শেয়ালের দল যেমন সমস্বরে হুক্কাহুয়া করে ওঠে— তেমনভাবে জাসদের বিরুদ্ধে উৎসবে-আনন্দে-কোরাসে উন্মত্ত হয়ে ওঠেন বছরের দুটো সময়— ১৫ আগস্ট ও ৭ নভেম্বরের আগে-পরে। এদের উৎসবে-আনন্দে-কোরাসে কখনও কখনও অতিথি হিসেবে যোগ দেন জামাত-জঙ্গি-বিএনপি-তেঁতুল ও জাতীয় পার্টির লোকজন। এ দুটো মওসুমে তারা জাসদ-সমালোচনার মধ্য দিয়ে এক বিকৃত আনন্দলাভ করেন। বলে রাখা ভালো যে উল্লিখিত দ্বিতীয় ধারার নেতা ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি ও তৃতীয় ধারার নেতা ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমাদ; এঁদের বিষয়ে পরে আরও কথা হবে।
বাংলাদেশের লেখক ও সাংবাদিকদের একটা নগণ্য অংশ ন্যাপ-সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়ন থেকে আগত; এবং এরাই, এদের লেখালেখি ও বক্তব্যের মধ্য দিয়ে— যতোটা না আওয়ামী লীগ ও অপরাপর দলের ব্যক্তিবর্গ জাসদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন— তার চেয়ে বেশি উগ্র ও উন্মত্ত হয়ে ওঠেন জাসদের বিরুদ্ধে। ন্যাপ-সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের এসব সাবেক নেতা-কর্মীগণ অতীতে বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মেনে নিতে পারেননি, ছয় দফা মেনে নিতে পারেননি, বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিতে পারেননি; এবং এর ফলে এদেরকে বিশ্বাস করা হতো না বলে ১৯৭১ সালের সুমহান মুক্তিযুদ্ধে এরা অনানুষ্ঠানিকভাবে অংশগ্রহণের অধিকারও পাননি। অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের এক পর্যায়ে ভূরাজনীতিগত কারণে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ৯ আগস্ট মৈত্রিচুক্তি স্বাক্ষরের পর যুদ্ধের শেষদিকে এসে এদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ছাড় দেয়া হয়। সংখ্যায় অতি নগণ্য এরা হলেন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে গণপ্রত্যাখ্যান থেকে বাঁচানোর জন্য ‘দায়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধা’— পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কল্পিত বিপ্লব না হাতছাড়া হয়ে যায়— সে ভয়ে।
এদের আগের আমলনামাও একই সাক্ষ্য দেয়। ব্রিটিশ শাসনামলেও এরা সমাজতান্ত্রিক-আন্তর্জাতিকতার নাম করে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রগতিশীল বণকৌশলের সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করেছিলেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান ঔপনিবেশিক আমলে এদের যে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি— সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির যে স্বকল্পিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তজাত জমিদারি— ১৯৬২ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও আওয়ামী লীগের স্বাধীনতাপন্থী-সমাজতন্ত্রী ছাত্র-যুব-নেতৃত্ব এবং ১৯৭২ সাল থেকে ওই স্বাধীনতাপন্থী-সমাজতন্ত্রী ছাত্র যুবসমাজ কর্তৃক গঠিত জাসদ— তা তছনছ করে দেয়। আর তাই যে কোন সুযোগে জাসদের প্রতি এরা প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে ওঠেন; প্রয়োজনে নদীর রচনা লিখতে গিয়ে— যেহেতু শুধু গরুর রচনাই মুখস্ত আছে— নদীর তীরে গরুকে ঠেলে দিয়ে নদীর রচনার নামে সে গরুর রচনা উগলে দেন। এসবের ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে।
ব্রিটিশ আমলে তাদের যে রাজনৈতিক দীনতা ও পরাজয়— সময়ানুসারে দূরে বলে তারা তা মোটামুটি কাটিয়ে ওঠেছেন। তবে পাকিস্তান আমলের পরাজয়ের ধারায় স্বাধীন বাংলাদেশেও তাদের একাধিক রাজনৈতিক পরাজয় আছে জাসদের কাছে— এদের মধ্যে কেবল একটি হলো এ যে— ১৯৮৩ সালে সূচিত সামরিক স্বৈরশাসন-বিরোধী গণআন্দোলনের সময় ১৯৮৬ সালের ২১ মার্চ থেকে ন্যাপ-সিপিবি ও আওয়ামী লীগ হেঁটেছিল সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পরিবর্তে আপোষের পথে, ১৫ দলের আন্দোলন পরিত্যাগ করে করে তারা জান্তার নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন ১৯৮৬ সালের ৭ মে; কিন্তু দুবছরের কম সময়ের মধ্যে ফিরে আসতে হয়েছিল রাজপথে— জাসদের গণঅভ্যুত্থানমূলক রাজনীতির লাইনে। ১৯৯০ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসন অবসানের মধ্য দিয়ে আদর্শিকভাবে জিতেছিল জাসদ। সিপিবি’র রণকৌশল কখনও জেতেনি। এ রকম বারবার রণকৌশলগত পরাজয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মনোবিকলনজাত আত্মশ্লাঘা জর্জরিত ন্যাপ-সিপিবির সাবেকদের প্রতিভূরা যে প্রতিনিয়ত জাসদের বিরুদ্ধে বলতেই থাকবেন— এ আর নতুন কী!
অধ্যায় দুই. দ্বিচক্রযান: উপদল ও উপ-উপদল
বঙ্গবন্ধুর মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে যারা তাঁকে প্রেরিত-পুরুষের আসনে বসিয়ে স্তুতিগান বা বন্দনা করেন— তারা প্রকারান্তরে তাঁর সারাজীবনের ধারাবাহিক সংগ্রামকে অস্বীকার করেন। একটি মিশনে প্রেরিত পুরুষের নিজের অবদান থাকে কম, ঈশ্বরের ইচ্ছায় ও ঈশ্বরের সহায়তায় তাঁরা হাঁটেন ঈশ্বর-নির্দিষ্ট পথে। কিন্তু মানুষকে তার পথ তৈরি করে নিতে হয়, এবং সেজন্যই মানুষ হয়ে ওঠেন কথিত প্রেরিত পুরুষের চেয়েও মহান— জিতে যাওয়া বা হেরে যাওয়া নির্বশেষে। বাংলার মানুষের প্রতি সুগভীর ভালোবাসা থেকে রাজনীতি-আন্দোলন-সংগঠন গড়ে তুলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু নীতি-নিষ্ঠা-মেধা-কৌশল-শৃঙ্খলা-দক্ষতা-অভিজ্ঞতা-জ্ঞান-প্রজ্ঞার সুষম প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। বাঙালি জাতির সংগ্রামের পথে পথে হেঁটে গোপালগঞ্জের খোকা-তিনি গড়ে ওঠেছেন ধীরে ধীরে; তিনি নিজেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বক্তব্যে বলেছেন যে বাঙালির সাথে তাঁর সম্পর্ক ‘ইমোশনাল’ বা আবেগপ্রবণ [তিনি কোনোদিন কল্পনা করতে পারেননি যে বাঙালির কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারে]; বাঙালি জাতির জাতীয়তাবোধের প্রতি যে আনুগত্য তিনি প্রদর্শন করেছেন, বাঙালি জাতি তাঁকে তা ফিরিয়ে দিয়েছে বহুগুণে— তিনি অভিহিত ও অভিষিক্ত হয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘জাতির জনক’ অভিধায়।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরপরই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের পূর্ববর্ণিত ওই দুই রাজনৈতিক উপদল— যথাক্রমে শেখ মনির নেতৃত্বাধীন অংশ ও মোতাশতাকের নেতৃত্বাধীন অংশ— দ্রুত তাঁর চারপাশে এক কঠিন দেয়াল তুলে দেয় যাতে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-জাতীয়তাবাদের অনুসারী প্রগতিশীল ছাত্র-যুব সমাজ তাঁর কাছে ঘেঁষতে না পারেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার লক্ষ্যে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএফ— একাত্তরের অক্টোবরে যা মুজিব বাহিনী নাম গ্রহণ করে— পরিচালনার জন্য বঙ্গবন্ধুর নিজের নির্বাচিত চার যুবনেতা— সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদ— তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তাঁকে ৪ দফা সুপারিশ প্রদান করেছিলেন, আর তার ক’দিন পর জানুয়ারির শেষ দিকে গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতা-জাতীয়তাবাদের অনুসারী প্রগতিশীল ছাত্র-তরুণ-যুব সমাজের পক্ষ থেকে সিরাজুল আলম খান তাঁকে ১৫ দফা সুপারিশ প্রদান করেছিলেন। পরে আবারও ছাত্র-তরুণ-যুবকদের পক্ষে আসম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ ও শরীফ নূরুল আম্বিয়া ১৯৭২ সালের ২৫ মে এক বিবৃতিতে— বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতিতে যা সকল দেশে হয়ে থাকে, সেভাবে— তাঁর প্রতি “জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সকল ক্ষমতার উৎস বলে ঘোষণা করতে হবে”সহ ১২ দফা সুপারিশ গ্রহণের আহ্বান জানান। এ আহ্বানের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য-প্রবল অবস্থান নিলেন এ রচনার শুরুতে বর্ণিত তিন পক্ষ [পরে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে]। এদের প্রকাশ্য-প্রবল বিরোধীতার মুখে— ১৯৭২ সালের ৭ জুন ছাত্রলীগের প্রকাশনার মাধ্যমে সকল পক্ষকে এসব না মানার বিপদ সম্পর্কে অবহিত করা হলেও— বঙ্গবন্ধু সেসব সুপারিশের কিছুই গ্রহণ করতে পারলেন না। শামসুদ্দিন পেয়ারার ‘আমি সিরাজুল আলম খান: একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য’, ও মনিরুল ইসলামের [মার্শাল মনি’র] ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সমাজতন্ত্র’ ও ১৯৭২ সালের ৭ জুন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ প্রকাশিত পুস্তিকা ‘৭ই জুন’ এবং অপরাপর ঐতিহাসিক দলিল, প্রকাশনা ও তৎকালীন পত্রপত্রিকা এর সাক্ষ্য দেয়।
আওয়ামী রাজনীতির বর্ণিত দুই অভ্যন্তরীণ উপদল আর বহিঃশক্তি ন্যাপ-সিপিবির প্রকাশ্য-প্রবল বিরোধীতার ফলে বঙ্গবন্ধুর সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হলো তাঁর একনিষ্ঠ অনুসারী ও বিশ্বাসভাজন এবং এক দশক ধরে পরিচালিত স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগঠক ও মুক্তিযোদ্ধা নেতা-কর্মীদের আশি ভাগের; পরিণতিতে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত হলো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ [এ রচনায় এ বিষয়ে পরে আরও আলোচনা করা হবে]। তবে আপাতত কেবল এ বলে রাখা যাক যে জাসদকে প্রতিবিপ্লবী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে জাসদের উপর রাজনৈতিক দমন-পীড়ন পরিচালনায় শেখ মনি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত যুবলীগের নৃশংস ভুমিকা ছিল— নৃশংসতা ছিল তার সাধারণ কর্মপদ্ধতি। জাসদের প্রথম আহ্বায়ক কমিটির সদস্য রহমত আলীকে প্রথম দিনই তুলে নিয়ে নির্যাতন করে পদত্যাগ পত্র লিখিয়ে নিয়েছিলেন শেখ মনি নিজে। ১৯৭৩ সালের ৪ জানুয়ারি তার অনুসারীরা শহীদ মিনারে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে হামলা করেন, যাকে সামনে পান তাকে পেটান, ছাত্রলীগ সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়ার হাত ভেঙে দেন ও সাধারণ সম্পাদক আফম মাহবুবুল হকের মাথা ফাটিয়ে দেন। এক মাস তারা হাসপাতালে ছিলেন। শেখ মনি নিজেকে বিপ্লবী ভাবতেন; সেজন্য সে সময়ের অপরাপর সংগঠনের সাধারন অনুশীলনের বাইরে গিয়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির আদলে সর্বময় ক্ষমতা নিজের হাতে রাখতে যুবলীগে চেয়ারম্যান পদ তৈরি করে তার চেয়ারম্যান হন। যদিও স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বিপ্লবী ধারার তেমন কেউ যুবলীগে যোগ দেননি; বরং কাজী ফিরোজ রশীদ চৌধুরী টাইপের এলিমেন্টের আধিক্য ছিল যুবলীগে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল গঠনের পর সিপিবি-ন্যাপ তাকে সোভিয়েত ইউনিয়নপন্থী বানাতে সমর্থ হয়েছিল।
জাসদ গঠন হয়ে যাবার পরও, আওয়ামী লীগের দলীয় রাজনীতির অভ্যন্তরে শেখ মনির ক্ষমতালিপ্সা আবারও উপ-উপদলীয় কোন্দল তৈরি করলো, তারা সরিয়ে দিল তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতৃত্ব; আর তা শেষবিচারে শক্তিশালী করলো মোশতাকের উপদলকে। রচনার এ অংশে শেখ ফজলুল হক মনি বনাম আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বাধীন উপ-উপদল সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করা হচ্ছে আওয়ামী লীগ রাজনীতির একনিষ্ঠ পর্যবেক্ষক, সমর্থক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরীর [আগাচৗ] লেখার তথ্যসূত্রে।
বঙ্গবন্ধু যখনই দেশের বাইরে থাকেন, এই উপ-উপদলীয় কোন্দল সশস্ত্র রূপ পায়; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩-এ খুন হলেন তিনজন আর ১৯৭৪-এর এপ্রিলে সূর্যসেন হল ও মহসিন হলে সংঘটিত হলো কুখ্যাত ‘সেভেন মার্ডার’; এ বিষয়ে আগাচৌ বলছেন, “তাহলে কি তাঁর [বঙ্গবন্ধুর] আমলাতন্ত্র, থানা, পুলিশ, সেনাবাহিনী কোন কিছুই কাজ করছে না? নাকি ভিতরের অথবা বাইরের উস্কানীতে তারা নিষ্ক্রিয়?” ১৯৭৪ সালের ৩০ মার্চ আওয়ামী ছাত্রলীগের এক সভা থেকে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে— গাজী গোলাম মোস্তফা ও অন্যান্যদের নামে— দুর্নীতির অভিযোগ এনে তাদের বিচার দাবি করা হয়; দুনীর্তিবাজদের প্রতি শেখ মনির আশ্রয়-প্রশ্রয়-পক্ষপাতিত্বের আভিযোগ ওঠে; এদিনই শেখ মনি বলেন যে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ঝগড়ায় তার কোন হাত নেই। অভিযোগ ছিল শ্রমিক লীগে উপদলীয় কোন্দলের পর ছাত্রলীগেও শেখ মনি এই দ্বন্দ্ব সম্প্রসারিত করেছিলেন এবং ছাত্রলীগ ভেঙে আরেকটি ছাত্রলীগ করতে চেয়েছিলেন। এদিন রাতে হোটেল পূর্বাণীতে আগাচৌ ও শেখ মনির আলোচনায় আগাচৌ ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বদলে ‘দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক পন্থা ও পদ্ধতির উন্মুক্ত থাকা প্রয়োজন’— এ কথা বললে শেখ মনি বিরক্ত হয়ে বলেন যে ‘সকল সময় তত্ত্ব দিয়ে রাজনীতি চলে না’। আগাচৌ তাকে বলেন যে শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ হয়ে আওয়ামী লীগে এ দ্বন্দ্ব সম্প্রসারিত হলে তা শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকেই আঘাত করবে, এবং বঙ্গবন্ধুকে আঘাত করলে সে সময় তারাও কেউ রেহাই পাবেন না। আগাচৌ তাকে বলেন, নীতিগত আনুগত্যের বদলে ব্যক্তি-আনুগত্য দিয়ে কোন কাজ হবে না। [আগামী কাল দ্বিতীয় পর্ব]
Leave a Reply