গত সোমবার রাত ৮-৩০ টায় রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী কবরস্থান চত্বরে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ঢাকা জেলা প্রশাসন এড. হাবিবুর রহমান শওকতের মরদেহ জাতীয় পতাকা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে, পুষ্পস্তবক অর্পণ করে, পুলিশের একটি চৌকস দল বিউগলের করুণ সুরে গানস্যালুট দিয়ে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান করে।
এরপর জাসদ স্থায়ী কমিটির পক্ষ থেকে প্রয়াত নেতার মরদেহ জাসদের দলীয় পতাকা দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়। জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাকা মহানগর কমিটি, মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদ, জাতীয় শ্রমিক জোট, জাতীয় যুব জোট, জাতীয় কৃষক জোট ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তার মরদেহে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করে এবং তাকে শেষ অভিবাদন জানায়। এশার নামাজ শেষে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে রাত ৯ঃ২০টায় তাকে সমাহিত করা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বীরমুক্তিযোদ্ধা শফিউদ্দিন মোল্লা, নুরুল আকতার, নাদের চৌধুরী, সাইফুজ্জামান বাদশা, আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম, রোকনুজ্জামান রোকন, সাজ্জাদ হোসেন, এড. মোহাম্মদ সেলিম, এড. মহিবুর রহমান মিহির, ইদ্রিস ব্যাপারী, আনিসুজ্জামান জম, সরদার খোরশেদ, রাশিদুল হাসান ননী, আলাউদ্দিন খোকন, আবুল কালাম আজাদ মিন্টু, সৈয়দ নাভেদ হোসেন, রাশেদুল হাসান মানিক, শাহজামাল পিন্টু, আকরাম হোসেন সহ জাসদ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীগণ এবং মিসেস হাবিবুর রহমান শওকত, কন্যা ছুটি, পুত্র রাজি, জামাতা অপুসহ আত্মীয় স্বজন।
এড. হাবিবুর রহমান শওকত গতকাল ৩ আগষ্ট ২০২০ সোমবার বিকাল ৩-৪১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিট-২ এর আইসিইউ’তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি করোনা আক্রান্ত হয়ে গত ১৯ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিট-২য়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তার অবস্থা অবনতি হলে তাকে আইসিইউ’তে স্থানান্তর করা হয়। চিকিৎসক ও নার্সগণ তাকে সুস্থ্য করে তুলতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তার কন্যা ছুটি, পুত্র রাজি, জামাতা অপু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির দিন থেকে হাসপাতালে পিতার পাশে থেকে পিতার সেবা করেছেন। বীরমুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান শওকত করোনার বিরুদ্ধে ১৪ দিন তুমুল যুদ্ধ করেছেন। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি সজ্ঞানে ছিলেন।
তার সংকটাপন্ন অবস্থা শুনেই জাসদের দফতর সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন ও ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ মিন্টু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে গিয়ে তার অন্তিম মুহূর্তে তার শয্যাপাশে উপস্থিত হন এবং পরিবারের সদস্যদের পাশে থাকেন।
বিভিন্ন দল, সংগঠন ও নেতৃবৃন্দের শোক
বীর মুক্তিযোদ্ধা এড. হাবিবুর রহমান শওকতের মৃত্যুতে জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি ও সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার এমপি, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সমন্বয়ক ও আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু এমপি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি ও সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা এম এমপি, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, সেক্টর কমান্ডারর্স ফোরামের সভাপতি মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ অব: বীরউত্তম ও সাধারণ সম্পাদক হারুন হাবিব, সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, ন্যাপ(মো), গণতন্ত্রী পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণ আজাদী লীগ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ও শোক সন্তপ্ত পরিবার-স্বজনদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।
এছাড়াও পৃথক পৃথক শোকবার্তায়, জাসদের সহযোগী সংগঠন জাতীয় নারী জোটের আহবায়ক আফরোজা হক রীনা, জাতীয় শ্রমিক জোট-বাংলাদেশের সভাপতি সাইফুজ্জামান বাদশা ও সাধারণ সম্পাদক নইমুল আহসান জুয়েল, জাতীয় কৃষক জোটের সভাপতি নুরুল আমিন কাওছার এবং সাধারণ সম্পাদ আশেক এলাহী, জাতীয় যুব জোটের সভাপতি রোকনুজ্জামান রোকন ও সাধারণ সম্পাদক শরিফুল কবির স্বপন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ(হা-ন) সভাপতি আহসান হাবীব শামীম এবং সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল হক ননী, বীর মুক্তিযোদ্ধা এড. হাবিবুর রহমান শওকতের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ও তাঁর পরিবার-আত্মীয়-পরিজন-বন্ধু-স্বজন-সহযোদ্ধাদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
সংগ্রামী জীবন
এড. হাবিবুর রহমান শওকত একজন বিরল দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক ৩য় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি তিনি ৩ জুন ১৯৭১ থেকে ১১ জুন তারিখে ‘বিলোনিয়া ব্রীজ’ ঐতিহাসিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পরবর্তীতে প্রশিক্ষণ নিয়ে ২নং সেক্টরের ফরিদপুর কোম্পানীর কোর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি জেনারেল ওসমানীর কাছে নিজের এলাকায় যুদ্ধ করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তিনি ৭০জন মুক্তিযোদ্ধাকে সংগঠিত কওে কোলকাতায় ৯নং সেক্টও হেড কোর্য়াটে যোগদান করেন। জে. ওসমানীর নির্দেশে ৯নং সেক্টরের সেক্টর ট্রুপসের পটুখালী-গলাচিপা সাব-সেক্টরের ডেপুটি কমান্ডার/সহ-অধিনায়ক ও সামরিক কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পান। তিনি ১৮ নভেম্বর ১৯৭১ সাগরপারের যুদ্ধখ্যাত পানপট্টি সম্মুখ যুদ্ধসহ পটুয়াখালী হানাদারমুক্ত করার যুদ্ধে দুঃসাহসী ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এ যুদ্ধের বিজয় পটুয়াখালীকে হানাদার মুক্ত করতে নিয়ামকের ভুমিকা পালন করে। এড. হাবিবুর রহমান শওকত ‘তৃণমূলে যুদ্ধাপরাধীদের চিহ্নতকরণে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ নির্যাতিত-ধর্ষিত পরিবারের সদস্যদের গণশুনানী করেন’। তার এই পদক্ষেপ ‘তৃণমূলে যুদ্ধাপরাধী চিহ্নিতকরণে পটুয়াখালী মডেল’ হিসাবে পরিচিতি পায়। তার উদ্যোগে এই গণশুনানীতে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে প্রেরণ করা হলে আদালত তদন্ত করে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা দায়ের-তদন্ত-বিচার করে, বিচারে ৮ জন যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। ১৬ ডিসেম্বরের পর এড. হাবিবুর রহমান শওকত পটুয়াখালী ট্রেজারি থেকে লুট হয়ে যাওয়া ৩৫ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করে জেলা প্রশাসকের নিকট জমা দেন। উক্ত জেলা প্রশাসক ও কতিপয় অফিসারের যোগসাজসে এই স্বর্ণ আত্মসাৎ করলে তিনি দুর্নীতির মামলা করেন। মামলায় উক্ত জেলা প্রশাসকের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্তসহ ৭ বছর দন্ড হয়। এড. হাবিবর রহমান শওকত ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জাসদের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি পটুয়াখালী জেলা জাসদের সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সাংগঠনিক সম্পাদক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সহ-সভাপতিসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদ এবং জাতীয় আইনজীবী পরিষদকে সংগঠিত করেন। তিনি স্বাধীনতা পরবর্তীকাল থেকে তিনি নির্যাতিত-অনির্বাচিত-সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সকল গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্দোলন, তেল-গ্যাস-বন্দর-বিদ্যুৎ-সুন্দরবন-জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ২০০৪ সাল থেকে জাতীয় পর্যায়ে ১ ডিসেম্বর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালনের মূল সংগঠকের কাজ করতেন।
জাসদ নিরবাচনী প্রতীক মশাল মামলার প্রধান কৌশলী ছিলেন করোনায় প্রয়াত জাসদের আরেক অভিভাবক এড. ইদ্রিসুর রহমান। সেই মামলায় জাসদের পক্ষে পেপারবুক তৈরি করেছিলেন এড. হাবিবুর রহমান শওকত। কুখ্যাত খুনি ওসি রফিক কর্তৃক বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের স্বীকার চাঞ্চল্যকর ছাত্রনেতা মোমিন হত্যা মামলার প্রধান কৌশলী ছিলেন এড. হাবিবুর রহমান শওকত।
Leave a Reply