১৯৭৬ সালে বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল এম এ তাহের ও তাঁর সঙ্গীদের গোপন বিচার অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। এতে তাহেরের মৃত্যুদন্ডকে ঠান্ডা মাথার খুন হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।রায়ে বলা হয়, কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ- হত্যাকা-। কারণ, ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জেনারেল জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদ- প্রদানে মনস্থির করেন। ওই হত্যাকা-কে বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- হিসেবে চিত্রিত করতে সরকারের প্রত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেহেতু জেনারেল জিয়া জীবিত নেই, আইন অনুযায়ী তাঁর বিচার সম্ভব নয়। তাই দ-বিধি অনুযায়ী তাঁর বিচার করার সুযোগ নেই। কিন্তু এ হত্যার জন্য দায়ী কেউ জীবিত থাকলে সরকারের উচিত হবে তাঁদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা।১৯৭৬ সালে সামরিক আইন আদেশের মাধ্যমে সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন, ট্রাইব্যুনালে তাহেরসহ অপরাপর ব্যক্তিদের গোপন বিচার এবং তাঁদের দেওয়া সাজার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে চারটি রিটের শুনানি শেষে ২০১১ সালের ২২ মার্চ বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেন। ১৯৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ের মূল অংশ সংবাদমাধ্যমের সামনে প্রকাশ করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান।২০১০ সালের ২৩ আগস্ট কর্নেল তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের, ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খান বীর বিক্রমের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ ও অপর ভাই আনোয়ার হোসেন, হাসানুল হক ইনু (সাবেক তথ্যমন্ত্রী), মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন ও মো. আবদুল মজিদ পৃথক রিট করেন।
রায়ের অংশবিশেষ: রায়ে কর্নেল তাহেরকে জাতীয় বীর ও দেশের গৌরব হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। একই সঙ্গে আবু তাহের, আবু ইউসুফ খান, আনোয়ার হোসেন, হাসানুল হক ইনু, রবিউল আলম, জিয়াউদ্দিন, শামসুল হক, আবদুল হাই মজুমদার ও মো. আবদুল মজিদকে দেওয়া শাস্তিও অবৈধ বলা হয়। তাঁদের নাম ওই তালিকা থেকে মুছে দিতে বলা হয়েছে। জিয়াউদ্দিন, শামসুল হক, আবদুল হাই মজুমদার ও মো. আবদুল মজিদকে সামরিক বাহিনী থেকে বরখাস্ত করা অবৈধ ঘোষণা করে চাকরিতে পূর্ণ মেয়াদে বহাল ছিলেন ধরে নিয়ে তাঁদের বেতন-ভাতা ও অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা দিতে বলা হয়েছে। অনুলিপি পাওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে পাওনা পরিশোধ করতেও বলা হয়।
বিধান নেই, তবু দ-: রায়ে বলা হয়, এটা পরিষ্কার যে সামরিক আদালতে বিচার হয়েছে, সেই আদালতের বিচার করার এখতিয়ার ছিল না। ওই আদালতের মৃত্যুদ- দেওয়ার এখতিয়ার ছিল না। সর্বোচ্চ ১০ বছর শাস্তি দিতে পারতেন। যে আইনে তাহেরকে মৃত্যুদ- দেওয়া হয় তখন সে আইনে মৃত্যুদ-ের কোনো বিধান ছিল না। তাহেরের ফাঁসির রায় কার্যকর করার পর ১৯৭৬ সালের ৩১ জুলাই বিধান করা হয়। বিচারের সময় আদালতের সামনে এজাহার বা অভিযোগপত্রও ছিল না। আসামিরা জানতেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে কী অভিযোগ। তাঁদের পক্ষে বক্তব্য দিতে কোনো আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাই ওই বিচার কার্যক্রম ছিল অবৈধ। এ কারণে ওই বিচার-সংক্রান্ত সব নথিপত্র ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
মওদুদের বই সম্পর্কে: মওদুদ আহমদের ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট: এ স্টাডি অব পলিটিক্যাল অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশন ইন বাংলাদেশ’ বইয়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরে রায়ে বলা হয়, এই বিচারের ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনেক আগেই জেনারেল জিয়াউর রহমান পাকিস্তান-ফেরত সামরিক অফিসারদের তুষ্ট করতে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিতে মনস্থির করেছিলেন। জেনারেল জিয়াউর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ছিলেন মওদুদ আহমদ। তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমানের মুখ থেকে এই কথাগুলো শুনেছেন বলে বইয়ে দাবি করেছেন। তাই তাঁকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। রায়ে বলা হয়, এই মামলার শুনানির একপর্যায়ে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ আদালতকক্ষে প্রবেশ করলে আদালত তাঁর লেখা বই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেন। তিনি তাঁর লেখাকে স্বীকার করে নেন।
তাহেরসহ ১৭ জনকে বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালের গোপন বিচারে ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই সাজা দেওয়া হয়। এরপর ২১ জুলাই ভোররাতে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল।
সুত্র: প্রথম আলো
Leave a Reply